কল্পবিজ্ঞানের পপ-আপ বই
লেখক: প্রদীপকুমার সেনগুপ্ত
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ভেবে দেখুন তো, আপনি একটা বই খুললেন। ধরুন বইটার নাম ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’। লেখক সত্যজিৎ রায়। পাতা খোলার সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের ভাঁজের ভিতর থেকে একটা মহাকাশযান উঠে দাঁড়াল। তার থেকে মাথা বের করে আছে ক্রনিয়াস গ্রহের অ্যাং। পাশে বঙ্কুবাবু দাঁড়িয়ে আছেন অপার বিস্ময় নিয়ে। অন্য একটা পাতায় বঙ্কুবাবু দেখছেন উত্তর মেরুর ভাসমান বরফ, তার উপর শ্বেতভল্লুক বসে আছে, আকাশে মেরুজ্যোতি। সবটাই ত্রিমাত্রিক, বইয়ের পাতা থেকে ছবিগুলো লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এরকম একটা বই, যার পাতাগুলি এরকম ত্রিমাত্রিক ছবিতে ভরা, তা হাতে পেলে কেমন লাগবে? নাঃ, বাংলা ভাষায় এই বইটা এখনও বের হয়নি। তবে বাংলায় এরকম বই তৈরি হতে পারে। এবং মোটেই অসম্ভব কিছু নয়। এই বইকে বলা হয় পপ-আপ বই।
পপ-আপ কথাটার জুতসই বাংলা পেলাম না। ইংরেজি ভাষাতেও কথাটা ঢুকেছে মাত্র একশো বছর আগে। তার আগে বলা হত ‘মুভেব্ল বুক’ বা নড়াচড়া-করা বই। ‘মুভেব্ল বুক’ কথাটা এখনও চালু আছে। তা মুভেব্ল হোক আর নড়াচড়া-করাই হোক, বাংলা ভাষায় এর নিতান্তই অভাব রয়েছে। আমাদের ছোটোবেলায় এই ধরনের ‘মুভেব্ল বুক’ বা ত্রিমাত্রিক বই প্রচুর পাওয়া যেত। বইগুলি আসত সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। তা সে দেশটাও আর নেই, বই আসাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
একটি সাহিত্যকর্মকে জীবন্ত করে তুলতে তাতে ছবি যোগ করা হয়। অনেক জটিল দৃশ্যের বর্ণনা আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, যখন উপযুক্ত ইলাসট্রেশন তাতে যোগ করা হয়। এটা পাঠকদের কল্পনাকে আরও প্রসারিত করে। বলা চলে, লেখকের কল্পনার সঙ্গে পাঠকের যোগসূত্র রচনা করে বইয়ের ইলাসট্রেশন। এই বই যদি ছোটোদের জন্য হয়, তবে ইলাসট্রেশন গল্পকে আরও আকর্ষণীয় করতে সাহায্য করে। এবার যদি এই ইলাসট্রেশন ত্রিমাত্রিক হয় তাহলে তো কথাই নেই। আজ যখন প্রযুক্তি নানা ধরনের ভিশুয়াল অভিজ্ঞতার সম্ভার আমাদের সামনে উপস্থাপন করছে, আমাদের মনোরঞ্জনের জন্য তখন ছাপানো বইকে আরও আকর্ষক করতে পপ-আপ বইয়ের জুড়ি নেই।
একটি পপ-আপ বইয়ের মৌলিক কাঠামো হল একটা ছবিকে ভাঁজ করা এবং এটিকে দুটি পৃষ্ঠার মধ্যে লুকিয়ে রাখা। যখন পৃষ্ঠাটি খোলা হবে, তখন ছবিটি উন্মোচিত হবে এবং এটি বইয়ের পাতার উপর দাঁড়িয়ে একটি ত্রিমাত্রিক দৃশ্য রচনা করবে। এই অনন্য সৃষ্টি কিন্তু একজনের কাজ নয়। একজন চিত্রশিল্পী এবং একজন পেপার ইঞ্জিনিয়ার মিলে এটির জন্য একটি উপযুক্ত পটভূমি তৈরি করেন। দুজনে মিলে ছবির বিভিন্ন অংশকে টুকরো টুকরো করে তৈরি করেন, এবং তারপর এমনভাবে তা জোড়া দেওয়া হয়, যাতে তা বইয়ের পাতা ভাঁজ করার সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা নিজেই ভাঁজ হয়ে পাতার ভিতরে লুকিয়ে যায়। অনেক সময় এইসব বইয়ে কিছু অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ যুক্ত করা হয়, যা দিয়ে ছবিগুলিকে নড়াচড়া করানো যায়। যেমন: বেড়াল ল্যাজ নাড়ছে, বা একটা দরজা খোলা বা বন্ধ করা যাচ্ছে, বা একজন মানুষ তার হাত নাড়াচ্ছে। এর জন্য পুল স্ট্রিপ, রোটেটর ইত্যাদি যুক্ত করা হয়। এই ধরনের বইকে অনেক সময় মোবাইল বই বলা হয়। টেক্সট, ছবি এবং উপাদান, যা ভাঁজ করা, বা টানা যায়—সবই পপ-আপ বইতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। সাধারণত শিশুরাই এই ধরনের বইয়ের মূল টার্গেট, তবে বড়োদের কাছেও এর আকর্ষণ কম নয়। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
এই মুহূর্তে, ‘পপ-আপ’ বা চলমান বইগুলি শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের জন্যই বিনোদনের সাধারণ উত্স। কিন্তু আজকের পাঠকদের সামনে এই ধারার যে ধরনের বইগুলিকে পাচ্ছি, তার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং যা প্রকাশনার ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
পপ-আপ বইয়ের ইতিহাস
পপ-আপ বইয়ের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। প্রাথমিক পপ-আপ বইগুলি কিন্তু শিশুদের উদ্দেশে ছিল না, ছিল ধার্মিক ভাবনা, দর্শন, গণিত ও বিজ্ঞানশিক্ষার জন্য। প্রথম হাতে তৈরি পপ-আপ বই ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়, যা পপ-আপ ইতিহাসের সূচনা করে। সে সময়ের বিজ্ঞানীরা পপ-আপ বইগুলির মাধ্যমে শারীরবিদ্যা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা বোঝানোর চেষ্টা করতেন। বইয়ের ভিতরেই থাকত একটা বা একাধিক চলমান ছবি, যা দিয়ে চাঁদের পর্যায় এবং মানবদেহের ভিতরের চেহারার মতো জিনিসগুলিকে ব্যাখ্যা করা হত।
বিশ্বের প্রথম সচল বইটি কাতালান রহস্যবাদী দার্শনিক র্যামন লুল (১২৩২-৩৬) তৈরি করেছিলেন। ইনি তাঁর মতবাদ ব্যাখ্যা করতে এবং ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য বইয়ের ভিতরে ভল্লেল বা ঘূর্ণায়মান ডিস্ক যুক্ত করেছিলেন। তাঁর বইয়ে কাগজের চাকার মতো কয়েকটা ডিস্ক পাতার সঙ্গে লাগানো থাকত, যা ঘুরিয়ে লুল ধর্মতাত্ত্বিক বক্তব্যের পাশাপাশি অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত প্রশ্নের সমাধানের চেষ্টা করতেন। এই ভল্লেল বা ঘোরানো যায় এমন চক্র সমুদ্রযাত্রায় নেভিগেশনের জন্য কাজে লাগানো হত। এরকম অন্য বইগুলির মধ্যে একটি ছিল Martn Cortés’ Breve compendio de la sphera y de la aite de navegar, যা ১৫৫১ সালে সেভিলে প্রকাশিত হয়েছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানের বইয়ে এই vollele দিয়ে সূর্য এবং চাঁদের অবস্থান নির্ধারণে সহায়তা করা হত।
তরুণ পাঠকদের জন্য সচল বইয়ের নির্মাণ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে শুরু হয়। বাস্তবে, ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে প্রকাশক জন নিউবেরির দ্বারা প্রকাশিত শিশুদের বই ব্যাপকভাবে বিক্রি হতে শুরু করে। উইলিয়াম গ্রিমাল্ডি, একজন ছোটো মাপের শিল্পী, ১৮২০ সালে একটি টয়লেট বই তৈরি করেছিলেন, যা একটি ভিন্ন ধরনের ‘লিফট দ্য ফ্ল্যাপ’ বই। তিনি তাঁর মেয়ের ড্রেসিং টেবিলের আইটেমগুলি স্কেচ করেছিলেন একটা বইয়ে। আইটেমগুলির ফ্ল্যাপগুলি তুললে তার নীচে প্রতিটি বস্তুর গুণের বর্ণনা দেখা যেত। গ্রিমাল্ডির ছেলে স্টেসি গ্রিমাল্ডি ১৮২১ সালে তাকে প্রথম বই আকারে প্রকাশ করেন। বই হিসাবে ‘দ্য টয়লেট’ অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছিল এবং অন্য প্রকাশকদের এই ধরনের বই তৈরি করতে প্ররোচিত করেছিল।
লোথার মেগেনডর্ফার, একজন জার্মান চিত্রশিল্পী, সচল বইয়ের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মেগেনডর্ফার ১৮৬৬ সালে হাস্যরস প্রকাশনা ফ্লায়িং পেজ-এর লেখক এবং চিত্রকর হিসেবে কাজ শুরু করেন, যা ইংল্যান্ডের পাঞ্চের সঙ্গে তুলনীয় ছিল। তিনি ১৮৮০-এর দশকে তাঁর নিজস্ব প্রকাশনা দ্য মেগেনডর্ফার পেজেস শুরু করেন। প্রথম বই ‘লিভিং পিকচারস’ (১৮৭৮), যা তিনি প্রাথমিকভাবে তাঁর ছেলে অ্যাডল্ফের জন্য ক্রিসমাস উপহার হিসাবে তৈরি করেছিলেন। পরে, তিনি ২০০টি ‘মুভেব্ল বই’-এর জন্য ডিজ়াইন এবং ইলাসট্রেশন তৈরি করেছিলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসিরা উচ্চমানের ‘মুভেব্ল বই’ তৈরি করেছিল। A. Capendu, একজন প্যারিসের প্রকাশক, Libraire Enfantine Illustrée সিরিজ়ে এরকম বেশ কিছু বই প্রকাশ করেন। তাদের মধ্যে কিছু ছিল ‘পুল দ্য ট্যাব’ বই, ম্যাকলাফলিনের লিট্ল শোম্যান’স সিরিজ়-এর মতো। সিরিজের একটি ট্যাব-চালিত বই হল লে চ্যাপেরন রুজ বা লিট্ল রেড রাইডিং হুড।
নিউ ইয়র্কের ব্লু রিবন পাবলিশিং সৃজনশীল পপ-আপগুলির একটি সাধারণ ব্র্যান্ড তৈরি করতে ১৯৩০ সালে প্রতিভাধর ডিজ়াইনার এবং প্রকৌশলীদের নিয়ে একটা সংস্থা তৈরি করে। বইয়ের প্রথমদিককার ছবিগুলিতে ওয়াল্ট ডিজ়নির অ্যানিমেশনের প্রভাব ছিল। প্রকৃতপক্ষে, ব্লু রিবন তাদের প্রকাশনা প্রচারের জন্য প্রথম ‘পপ-আপ’ শব্দটিকে ব্যবহার করে।
জুলিয়ান ওয়েহর গত শতকের চারের দশকে বিভিন্ন আমেরিকান প্রকাশকের জন্য অনেক পপ-আপ বই বানিয়েছিলেন। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির সঙ্গে পুল ট্যাবের কাজ ছিল, যা দিয়ে ছবিগুলিকে নাড়ানো যায়। ওয়েহরের ডিজ়াইনগুলি প্রচলিত ‘পুল দ্য ট্যাব’ বইগুলির চেয়ে বেশি চমকপ্রদ ছিল, যেগুলিতে পৃষ্ঠাগুলির নীচের অংশে একটা ট্যাব থাকত, যাতে ছবিটা নতুন একটা মাত্রা পেত। এরপর উল্লেখযোগ্য শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন ভয়টেক কুবাস্তা। তিনি ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর মাঝামাঝি সময়ে আর্টিয়ার জন্য অনেকগুলি পপ-আপ বই তৈরি করেছিলেন এবং লন্ডনের ব্যানক্রফ্ট অ্যান্ড কোম্পানি সেগুলি সারা বিশ্বে বিক্রি করেছিল। কুবাস্তার রঙিন, চিত্তাকর্ষক চিত্রগুলি প্রায়শই রূপকথার বইয়ের সঙ্গে সংযুক্ত।
‘৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন গ্রাফিক্স ইনটারন্যাশনালের আমেরিকান ব্যবসায়ী ওয়াল্ডো হান্ট প্রায় এককভাবে পপ-আপ বইয়ের দ্বিতীয় স্বর্ণযুগের সূচনা করেন, তখন একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়। ইউরোপ ভ্রমণের সময় তিনি কুবাস্তার পপ-আপ বই আবিষ্কার করেন ও তাঁর অনুপ্রেরণায় নতুন বই প্রকাশ করতে শুরু করেন।
১৯৬৫ সালে বেনেট সার্ফের পপ-আপ রিড্ল বই প্রকাশিত হয়েছিল, যা তিনি র্যান্ডম হাউসের সঙ্গে একত্রে প্রকাশ করেছিলেন এবং ম্যাক্সওয়েল হাউস কফি প্রিমিয়াম হিসাবে বিতরণ করেছিলেন। ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে, র্যান্ডম হাউস অনেকগুলি পপ-আপ এবং চলমান বই তৈরি করেছিল, যেগুলিকে অবশেষে গ্রাফিক্স ইনটারন্যাশনাল অধিগ্রহণ করে। হান্ট ১৯৭৬ সালে প্যাকেজিং ব্যাবসা ছেড়ে ‘ইনটারভিশুয়াল বুকস’ প্রতিষ্ঠা করেন। তার অনেক পপ-আপ আজও ক্লাসিক হিসাবে বিবেচিত হয়।
পপ-আপ আর্টস ব্যাপকভাবে বিজ্ঞাপন, স্থাপত্য নকশা এবং আসবাবপত্র নকশার জন্য ব্যবহৃত হয়। ওল্ড মাস্টার শিল্পীদের কিছু কাজ পপ-আপ আর্টে অনুবাদ করা হয়েছে। হোকুসাই এবং সালভাদর দালির ছবি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
বিংশ শতকের শেষার্ধে পপ-আপ বইগুলি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উদীয়মান প্রকাশক এবং উন্নত মেধার শিল্পী ও প্রকৌশলীদের কাজ প্রতিষ্ঠিত বাজারে ব্যাপকভাবে উত্পাদিত হতে থাকে। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের সুপরিচিত পেপার ইঞ্জিনিয়ারদের কাজগুলি যদি দেখি তাহলে বুঝতে পারব, এর জন্য কী পরিমাণ মেধা ও কল্পনাশক্তির সমন্বয় ঘটেছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে, শিশুদের এবং প্রাপ্তবয়স্কদের পপ-আপ বইগুলি তৈরিতে কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে লাগল। প্রকাশনা ও ডিজ়াইনিং আরও সহজ হয়ে উঠল। সহজ-সরল পপ-আপের যুগ শেষ হয়ে গেল। চলে এল বহুস্তরীয় জটিল, সচল পপ-আপের যুগ, যার ফলে কল্পবিজ্ঞানের অনেক জটিল কাহিনিকে পপ-আপের সীমানার মধ্যে নিয়ে আসা সহজ হল। আমরা পপ-আপ বইয়ের ভিতরেই মহাকাশযুদ্ধ বা লেজ়ার সোর্ড নিয়ে লড়াই দেখতে পেলাম।
কল্পবিজ্ঞানে পপ-আপ
যদিও কল্পবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু অষ্টাদশ শতাব্দীতেই, কিন্তু আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের সূচনা হয় ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে। তারপর পুরো বিংশ শতক জুড়ে কল্পবিজ্ঞান আমাদের নিয়ে গিয়েছে নানা কাহিনির ভিতর দিয়ে রহস্য, আতঙ্ক, উত্তেজনা ও মনোমুগ্ধকর এক কল্পজগতে, যেখানে মহাকাশযান, অজানা অ্যালিয়েন, টাইম মেশিন, অজানা গ্রহের বিপদ আমাদের শিহরিত করে। কল্পবিজ্ঞান আমাদের নিয়ে যায় বিকল্প ইতিহাসে কিংবা অতি জটিল বহুমাত্রিক বিশ্বের সীমানায়।
কল্পবিজ্ঞানের কাহিনির পাশাপাশি আমরা পেতে থাকি কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক চলচ্চিত্র, বিভিন্ন ভাষায় ও বিভিন্ন জনরের। তার মধ্যে ‘স্টার ট্রেক’, ‘জুরাসিক পার্ক’ যেমন আছে, তেমনি আছে আইজ্যাক অ্যাসিমভ, রে ব্র্যাডবেরি, জুল ভার্ন… প্রমুখ দিক্পাল লেখকের কালজয়ী সৃষ্টির চলচ্চিত্র রূপ। এই শতাব্দীতে এসে এশিয়ার দেশগুলিও অসাধারণ সব কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করে। পাঠকদের অনেকেই এ বিষয়ে যথেষ্ট অবহিত আছেন, কাজেই এ নিয়ে আর বেশি কিছু বলতে চাই না।
চলচ্চিত্রের হাত ধরেই প্রায় পপ-আপ বই কল্পবিজ্ঞানের পরিসরে প্রবেশ করে। যেসব সিনেমা খুবই জনপ্রিয় হয়েছে, একে একে তার পপ-আপ ভার্শন বাজারে আসতে থাকে। যেহেতু কল্পবিজ্ঞান বিষয়টি বহুমুখী ও জটিল তাই পপ-আপ বইগুলিও ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। বিশ শতাব্দীতে যে ধরনের ভাঁজ পপ-আপ বইয়ে দেখা যেত, একবিংশ শতকের কল্পবিজ্ঞানের বইতে তার থেকে অনেক জটিল ও অনেক অভিনব সব ভাঁজ ও বহুস্তরীয় পপ-আপ উদ্ভাবিত হতে থাকে। আমরা পাই মনোমুগ্ধকর ও বিস্ময়কর সব পপ-আপ বই, যা ফ্যান্টাসি ও কল্পবিজ্ঞানকে এক নতুন স্তরে উন্নীত করে। কয়েকটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে।
প্রথমেই ধরা যাক জুল ভার্নের ‘টোয়েন্টি থাউজ়্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’ বইটির কথা। এর পপ-আপ ভার্শন প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে র্যান্ডম হাউস প্রকাশনা থেকে। বইটি তৈরি করেছেন অ্যালবার্ট জি মিলার। এই বইয়ে অল্প কয়েকটি পপ-আপ আছে অন্য দ্বিমাত্রিক ইলাসট্রেশনের সঙ্গে। এরপরে ২০০০ সালে স্যাম ইটনা এই কাহিনি নিয়েই আর-একটি পপ-আপ বই তৈরি করেন। তবে সেটিতে পপ-আপ-এর সঙ্গে কমিক স্ট্রিপও সংযোজিত হয়েছে।
‘টোয়েন্টি থাউজ়্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’, ১৯৬৯ সালের ও ২০০০ সালের দুটি পপ-আপ বইয়ের কভার (সূত্র: আমাজ়ন ডট ইন)
১৯৬৫ সালে প্রকাশিত ফ্র্যাংক হিলবার্টের বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান ‘দ্য ডিউন’ পপ-আপ রূপ নেয় ১৯৮৪ সালে। এর পপ-রূপকার ড্যানিয়েল কার্ক। আজকের পপ-আপ বইয়ের সঙ্গে তুলনা করলে এর পপ-আপ কিছুটা সরল।
বর্তমান শতাব্দীর শুরু হওয়ার থেকে বেশ কয়কটি কল্পবিজ্ঞান পপ-আপ বইয়ের রূপ নিল। শুধু কল্পবিজ্ঞান নয়, কিছু ফ্যান্টাসিও এই দলে এসে জুটল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এডগার অ্যালেন পো-র কবিতা ‘র্যাভেন’ অবলম্বনে একটি পপ-আপ বই। বইটিতে পো-র কবিতার রহস্যময়তা অত্যন্ত সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত এই বইটির রূপকার ডেভিড পেলহ্যাম ও খ্রিস্টোফার ওয়রমেল।
আর-একটি ফ্যান্টাসি বইয়ের নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় তা হল The Girl Who Loved Tom Gordon। এই মনস্তাত্ত্বিক হরর নভেলের পপ-আপ ভার্শনটি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। রূপকার কিস মরবিক ও অ্যালান ডিংম্যান।
পপ-আপের সঙ্গে গ্রাফিক নভেল যুক্ত করে অনেক আকর্ষণীয় বই তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে কিছু কল্পবিজ্ঞানও আছে। মেরি শেলির ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’, ও ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ড্রাকুলার পপ-আপ গ্রাফিক নভেল ভার্শনটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৯ সালে।
পপ-আপ বই তৈরিতে যাঁর নাম সবার আগে মনে আসে, তিনি হলেন ম্যাথু রেইনহার্ট। তিনি গত দুই দশক ধরে একের পর এক পপ-আপ বই বানিয়ে চলেছেন। তাঁর তৈরি বিখ্যাত পপ-আপ বইগুলি হল: স্টার ওয়ারস (২০১১), ট্রান্সফর্মারস (২০১৩), জুরাসিক ওয়ার্ল্ড (২০২১)।
কল্পবিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসি ও হরর কাহিনির লেখক হিসাবে লাভক্রাফ্ট খুবই জনপ্রিয়। এঁর হরর চরিত্র অর্থাৎ তাঁর সৃষ্ট ভয়ংকর জীবগুলিকে নিয়ে একটিমাত্র পপ-আপ বই তৈরি হয়েছে। এটি এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু লাভক্রাফ্টের কাহিনি পপ-আপ বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরবরাহ করতে পারে। লাভক্রাফ্টের গল্প অবলম্বনে পপ-আপ বই কেমন হতে পারে, তার একটা নমুনা দিলাম।
সবশেষে যে পপ-আপ বইটির নাম করব, তা হল বিখ্যাত চিনা কল্পবিজ্ঞান ‘থ্রি বডি প্রবলেম’। এটির পপ-আপ বইটি চিনা ভাষায় তৈরি হয়েছে।
বাংলা ভাষায় অসাধারণ কল্পবিজ্ঞান রচিত হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে কোনো পপ-আপ বই তৈরি হল না। ঘনাদার গল্প ও সত্যজিৎ রায়ের গল্প ছাড়াও অসংখ্য মণিমুক্তা বাংলা সাহিত্যের কল্পবিজ্ঞানের ভাণ্ডারে ছড়িয়ে রয়েছে। এগুলির পপ-আপ বই তৈরি হলে কেমন হত, তার একটু নমুনা এই সঙ্গে দিলাম। এই পাতাটি ঘনাদার গল্প ‘মশা’ অবলম্বনে তৈরি।
পপ-আপ বই চিত্তাকর্ষক, সন্দেহ নেই। কিন্তু এর রচনাপ্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এ ছাড়া এই বইগুলির দামও খুব বেশি হয়, কারণ তৈরির খরচ খুব বেশি। এই কারণেই হয়তো বাংলা বইয়ের প্রকাশকেরা পপ-আপ বইয়ের পিছনে লগ্নি করতে সাহস পান না।
আজকে নানা ধরনের মিডিয়ার চাপে কিছু মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা বই থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। তা ছাড়া ইংরেজি বই পড়তে শহুরে বাঙালি শিশুরা ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। এদের হাত থেকে বাংলা সাহিত্য এবং বাংলা কল্পবিজ্ঞান ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। এই সময়, আমার ধারণা, পপ-আপ বই তাদেরকে বাংলা বইমুখী করে তুলতে পারে।
তথ্যসূত্র:
Candy Bedworth (2022)The Surprising History of Pop-Up Books, Availble at https://www.dailyartmagazine.com/pop-up-books/
Domestica https://www.domestika.org/en/blog/5236-a-brief-history-of-pop-up-books
Lauren Corba (2014) A Brief History of the Pop-Up Book, Availbale at https://blog.bookstellyouwhy.com/a-brief-history-of-the-pop-up-book
Stephen Miller, The ‘King of the Pop-Ups’ Made Books Spring to Life, The Wall Street Journal https://www.wsj.com/articles/SB125902884513660749
Wikipedia (2023) Pop Up Book, Article, https://en.wikipedia.org/wiki/Pop-up_book#:~:text=These%20books%20were%20popular%20in,Louis%20Giraud%20and%20Theodore%20Brown
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, প্রদীপকুমার সেনগুপ্ত