হররল্যান্ড
লেখক: অভিষেক সরকার
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
অ্যালিসের আর কোনো কিছুতেই মন বসছে না। ছোট্ট ভাইটা যে কোথায় চলে গেল! দুধের শিশুটাকে রাতের অন্ধকারে এইভাবে কে তুলে নিয়ে গেল? দু-চোখের পাতা কিছুতেই আর এক করতে পারছে না অ্যালিস। চোখ বন্ধ করলেই ভাইয়ের মুখটা ভেসে উঠছে। বাড়ির গভর্নেস মার্থা অ্যালিসকে বলেছিল, ওর ভাই চেশায়ারকে নাকি এক ডাইনি নিয়ে চলে গেছে। আচ্ছা, মার্থা কি সত্যি কথা বলছে? উইচেসরা তো শুধুমাত্র রূপকথার কাহিনিতেই থাকে। তার মানে ডাইনিরা কি সত্যি অ্যালিসের রূপকথার বই থেকে বেরিয়ে এসে ওর ভাইকে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে? নাহ্! আর বেশি কিছু ভাবতে চাইছে না অ্যালিস। চেশায়ার নিখোঁজ হওয়ার পরপরই অ্যালিসের মা শয্যা নিলেন। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে অ্যালিসের বাড়ির চিত্রটাই পুরো আমূল বদলে গেল। চেশায়ারের জন্মের পর সারা বাড়ি আনন্দে মেতে উঠেছিল, কিন্তু ওর চলে যাওয়ার পরমুহূর্তেই শোকের এক অতল সাগর এই বাড়িটাকে একটু একটু করে গ্রাস করে নিল।
অ্যালিসের বাবাও ব্যাবসার কাজে নিজেকে আরও বেশি ব্যস্ত করে ফেললেন। বাড়িতে খুব কম সময়ের জন্যই আসতেন। বলতে গেলে এখন মার্থাই এই বাড়ির সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছে। আচ্ছা, মার্থাই আমার ভাইটাকে নিখোঁজ করে দেয়নি তো? নিজের মনে প্রশ্ন করে ওঠে বছর তেরোর অ্যালিস। অ্যালিস নিজের ভাইয়ের ছবিটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। নিজের মনেই ও তখন বলে ওঠে, কী সুন্দর ফুটফুটে আমার ভাইটা! মায়ের কোলে কেমন হাসি-হাসি মুখে সেদিন ছবি তুলেছিল। অ্যালিসই নিজের ভাইয়ের নাম চেশায়ার রেখেছিল। এই নাম রাখার কারণ অ্যালিসের সব চেয়ে প্রিয় ফ্যান্টাসি গল্পের বই হল ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’। এই গল্পে ডাচেসের প্রিয় পোষ্য বিড়ালের নাম ছিল চেশায়ার। এই চেশায়ার বিড়ালটির চরিত্রটিকে ওর খুব ভালো লাগে। তাই ওর আদরের ভাই যখন জন্মাল, তখন গল্পে থাকা সেই মোটাসোটা বেড়ালটির সঙ্গে ভীষণ মিল খুঁজে পেয়েছিল অ্যালিস। এমনকি সেই বিড়ালের বিখ্যাত কান-এঁটো-করা হাসিটার সঙ্গে ওর ভাইয়ের হাসিটার ভীষণ মিল ছিল। আচ্ছা, মিল ছিল কেন বলছে অ্যালিস? অ্যালিস এখনও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে রূপকথার গল্পে দৈত্যদানবদের শেষ করে যেমন রাজপুত্র একদিন নিজের রাজ্যে ফিরে আসে, সেই একইভাবে ওর ভাইটাও ওর কাছে একদিন ঠিক ফিরে আসবে। ভাইটার কথা ভাবতে ভাবতে ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’-এর বইটা হাতে তুলে নিল অ্যালিস। ও খুব ভালো করেই বুঝে গেছে, আজও ওর প্রতি নিদ্রাদেবী প্রসন্ন হবেন না। বইয়ের একটি পাতার দিকে চেয়ে থাকল অ্যালিস। যেখানে গল্পের অ্যালিস নদীতীরে একাকী বসে আছে, আর ঠিক তখনই সে দ্যাখে, ওয়েস্টকোট-পরিহিত একটি সাদা খরগোশ হাতে একটি পকেট ওয়াচ নিয়ে নিজের মনেই দুঃখ প্রকাশ করছিল যে সে তার গন্তব্যে পৌঁছোতে দেরি করে ফেলেছে। আর তারপর গল্পের অ্যালিস কৌতূহলবশত সেই খরগোশটাকে অনুসরণ করতে গিয়ে একটি র্যাবিট হোলের মধ্যে পড়ে যায়। অবশেষে পড়ে যাওয়ার পর ও এক অলীক জগতে প্রবেশ করে। গল্পটির প্রতিটা দৃশ্য অ্যালিসের মুখস্থ হয়ে গেছে।
ইশ্শ! কতই-না ভালো হত যদি বাস্তবের অ্যালিসও এমন এক অলীক জগতের খোঁজ পেয়ে যেত। এই শোকের পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর একমাত্র পথ গল্পের সেই অলীক জগতের খোঁজ-পাওয়া কিন্তু এই অ্যালিস এখন বড়ো হয়ে গেছে। ও খুব ভালো করেই জানে, অলীক জগৎ শুধু গল্পের বইতেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাস্তব জগতের সঙ্গে সেই জগতের কোনো সম্পর্ক নেই। তবুও সেই জগৎটাকে বিশ্বাস করতে ভীষণ মন চায় ওর।
বাগান থেকে এখন একবার ঘুরে আসব? ঘুরে এসে যদি ঘুমটা চলে আসে? নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে বইটাকে খাটের উপর রেখে পা টিপে টিপে নিজের রুম থেকে তখনই বেরিয়ে গেল অ্যালিস। রাতের বেলায় বাড়িটাকে এক শ্মশানপুরীর মতো মনে হচ্ছিল। চারদিকে অন্ধকার আর এক পিনপতন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। মা-বাবা আর মার্থা সকলেই নিজেদের রুমে এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সেই রাতেও তো ওরা সকলে গভীর ঘুমে ছিল আর সেই সুযোগে কেউ একজন এসে ওর ভাইটাকে…
এই মুহূর্তে আর বেশি কিছু ভাবতে চাইল না অ্যালিস। বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে অতি সন্তর্পণে বেরিয়ে গিয়ে বাড়ির বাগানের পথে এগোতে থাকল অ্যালিস। ওদের বাড়িটা যত-না বড়ো, তার চেয়ে প্রায় তিনগুণ বড়ো এই বাগান। চারদিকে নানান প্রজাতির ফল এবং ফুলের গাছে ভরে আছে। ভাইটা নিখোঁজ হওয়ার পর মালিটাকেও মার্থা আসতে বারণ করে দিয়েছিল। তাই পরিচর্যার অভাবে শুকনো গাছের পাতা আর আগাছায় চারপাশটা ভরে গেছে।
আরও কিছুটা পথ হাঁটার পর একটা ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল অ্যালিস। সেই মালিটা এখানে লাল গোলাপের বীজ পুঁতবে বলে মাটিটাকে কিছুটা খুঁড়ে রেখেছিল। কিন্তু মার্থা ওকে আসতে বারণ করে দিয়েছিল বলে ও আর কাজটাকে শেষ করে যেতে পারেনি।
আজ পূর্ণিমার রাত তাই অ্যালিসের এতটা পথ হেঁটে আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ওর ঠিক পিছনেই শুকনো পাতার খসখস শব্দটা শুনতে পেয়ে ও ভয় পেয়ে গেল।
মার্থা আবার ঘুম থেকে জেগে গেল না তো? এত রাতে আমাকে এখানে দেখে ফেললে আমার আর রক্ষে থাকবে না। পাতার খসখসানি শব্দটা আর দ্বিতীয়বার শুনতে না পেয়ে নিশ্চিন্ত হয় গেল অ্যালিস।
যাক! মার্থা নয়, ও থাকলে এতক্ষণে…
নিজের মনে কথাগুলো বলার সময় আবার সেই শব্দটা শুনতে পেল অ্যালিস, তখন পিছন ঘুরে তাকাতে গিয়েই ও হতবাক হয়ে দেখল…
প্রায় ছ-ফিট সমান একটি সাদা রঙের খরগোশ, যার পরনে লাল রঙের ওয়েস্টকোট আর হাতে একটি পকেট ওয়াচ নিয়ে অ্যালিসের দিকে এখন একদৃষ্টে চেয়ে আছে। আর সব চেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হল এত লম্বা খরগোশের মুখের অভিব্যক্তি ভীষণই হিংস্র, চোখ দুটো আগুনের ভাঁটার মতন জ্বলছে, মুখের সামনে থাকা দু-জোড়া উপর আর নীচের দাঁতগুলো শান-দেওয়া ধারালো ছুরির মতন যেন ক্ষণেক্ষণে ঝিকিয়ে উঠছে।
আর ঠিক তখনই সেই পকেট ওয়াচে বর্তমান সময়টা দেখে নিয়ে খরগোশের মুখে এক কুটিল হাসি খেলে গেল।
খরগোশের মুখটা এত চেনা-চেনা লাগছে কেন? আরে এই মুখটা তো পুরো ওর বাবার মুখের…
আর কিছু ভেবে ওঠার আগেই সেই খরগোশটা হঠাৎ করে চিৎকার করে মানুষের গলায় বলে ওঠে, “সঠিক সময় চলে এসেছে…” অ্যালিসের হাতটাকে ওই খরগোশটা তখন শক্ত করে চেপে ধরল। আর তারপর ওকে সেই খালি জায়গাটায় আবার নিয়ে গেল। ভয় এবং আতঙ্কে অ্যালিসের মুখ দিয়ে তখন আর কোনো কথা বেরোল না। ওর মনে হচ্ছে, ও বোধহয় সত্যি এখন কোনো এক ভয়ংকর জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। কিন্তু খরগোশের মুখটা…! দ্বিতীয়বার সেই বিষয় ভাবার আর অবকাশ পেল না অ্যালিস, তার কারণ, ও অবাক হয়ে দেখল, কিছুক্ষণ আগে যে খালি জায়গাটার সামনে ও দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে বিরাট বড়ো দেখতে একটা গর্ত হঠাৎ করে কোথা থেকে চলে এসেছে। খরগোশটা গর্তটার দিকে কিছুক্ষণের জন্য চেয়ে থাকল। আর তারপর আবার সেই কুটিল হাসি হেসে অ্যালিসকে ধাক্কা মেরে সেই গর্তের মধ্যে ফেলে দিল।
গর্তের ভেতর পড়ে যাওয়ার সময় চিৎকার করারও আর সময় পেল না অ্যালিস। শুধু ওর মনে হল, ভয় পাওয়ার এখনও অনেক কিছু বাকি আছে।
দু-চোখের পাতা বহু কষ্টে খোলার চেষ্টা করল অ্যালিস। যাক! তার মানে আমি এতক্ষণ ধরে স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু সেই স্বপ্নটা এত ভয়ংকর ছিল কেন? নাহ্! সেই দুঃস্বপ্নের কথা আর আমি ভাবতে চাই না। চোখ বন্ধ আছে যখন, তার মানে আমি এখন নিজের ঘরেই শুয়ে আছি। আমি বাগানে তখন যাইনি। পুরো ঘটনাটাই ঘুমের মধ্যে ঘটেছিল। কিন্তু আমার এত গরম লাগছে কেন? চোখ দুটো খোলার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে অ্যালিস। ও নিজেকে এখন একটি জ্বলন্ত খাটের উপর আবিষ্কার করে। যে রুমটাকে ও নিজের রুম ভেবে ভুল করেছিল, সেটি মনে হচ্ছিল কোনো এক নরকের ঘর! যেখানে ও শুয়ে ছিল, সেই খাটটায় এখন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। কিন্তু ও এতক্ষণ ধরে এই আগুন সহ্য করছিল কীভাবে? খাট থেকে তড়িঘড়ি নেমে গিয়ে অ্যালিস দ্যাখে বিশাল বড়ো এই ঘরটা পুরো লাল রঙের। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন গ্যালন গ্যালন পেট্রোলের সঙ্গে তাজা রক্ত দিয়ে এই ঘরের দেয়ালগুলোকে রং করে দিয়েছে। আগুনের শিখা তখন অ্যালিসকে গ্রাস করতে ওর দিকে ধেয়ে আসে। ও তখন প্রাণপণে ছুটে ঘরের মধ্যে থাকা একটিমাত্র দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।
কিন্তু বাইরে বেরিয়ে ও দ্যাখে বিশাল লম্বা একটি প্যাসেজ, যার শেষ বলে কিছু নেই। কিন্তু অ্যালিসকে এখান থেকে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে বাড়ি ফিরতেই হবে। সেই প্যাসেজ দিয়ে ছুটতে শুরু করে অ্যালিস। কিন্তু যতই সে ছোটে, ততই ওর মনে হয়, এই প্যাসেজটা আরও দৈর্ঘ্য হয়ে চলেছে। এইভাবে তো ও আর কোনোদিনও নিজের বাড়ি ফিরতে পারবে না সে। হাঁপিয়ে ওঠে অ্যালিস। আর ঠিক তখনই একজনের হাত ওর কাঁধে এসে পড়ে। অ্যালিস চমকে ওঠে। মাটিতে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার সময় সেই হাত দুটো অ্যালিসকে শক্ত করে ধরে ফ্যালে।
সেই ব্যক্তিকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য মুখটা তার দিকে ঘোরাতে গিয়ে অবাক হয়ে যায় অ্যালিস। একটি বেঁটেখাটো লোক, যার মাথায় বিরাট বড়ো একটা হ্যাট রয়েছে। হ্যাটটা দেখতে পেয়েই অ্যালিস নিশ্চিন্ত হয়ে বলে উঠল, ম্যাড হ্যাটার! যাক, একজন কাউকে পাওয়া গেল, যে ওকে এখান থেকে বেরোতে সাহায্য করবে। তবে ম্যাড হ্যাটার এমন গম্ভীর মুখে কেন দাঁড়িয়ে আছে? গল্পের বইতে তো ভীষণ ছটফটে ছিল আর সেই অ্যালিস কোনো বিপদে পড়লেই এই ম্যাড হ্যাটার ওকে বাঁচানোর জন্য চলে আসত।
হ্যাটটা নিজের মাথার থেকে কিছুক্ষণের জন্য খুলে ফ্যালে ম্যাড হ্যাটার। এত বড়ো হ্যাটের আড়ালে ম্যাড হ্যাটারের অর্ধেক মুখটা ঢেকে গিয়েছিল। অ্যালিসের মনে হচ্ছিল, ওই খরগোশের মতন এই ম্যাড হ্যাটারের মুখটাও বোধহয় ভয়ংকর দেখতে হবে। কিন্তু সেই লম্বা নাক আর একজোড়া রামধনু-রঙের চোখের সঙ্গে মিলিয়ে তাপ্পি-মারা রামধনু রঙের কোট-প্যান্ট-পরিহিত এই ম্যাড হ্যাটার ঠিক যেন গল্পের পাতা থেকে উঠে এসছে। কিন্তু সব কিছু ঠিক মনে হলেও কোথায় যেন একটা গণ্ডগোল ঠেকছে অ্যালিসের।
“আমাদের কাছে আর বেশি সময় নেই।” অ্যালিসের হাতটা শক্ত করে ধরে বলে ওঠে ম্যাড হ্যাটার। তারপর ওরা দুজনে ছুটতে ছুটতে প্যাসেজের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছে গেল। সেখানে ওরা দেখল, ওদের জন্য তিনটে দরজা অপেক্ষা করছে। তিনটে দরজাই একরকম দেখতে। কোনো কিছু বোঝার আগেই ম্যাড হ্যাটার ধাক্কা মেরে অ্যালিসকে এক নম্বর দরজার ভেতর ঢুকিয়ে দিল, ওকে কিছু বলতে যাবে অ্যালিস, তার আগেই হতবাক হয়ে ও দেখল, ম্যাড হ্যাটারের রামধনু-রঙের চোখজোড়া বদলে যাচ্ছে আর তার জায়গায় একজোড়া আগুনের ভাঁটার মতন চোখ ওর দিকে এখন চেয়ে আছে। দরজা খুলে বেরোতে যাবে অ্যালিস, কিন্তু বাইরে থেকে সেই ম্যাড হ্যাটাররূপী না জানি কে এই দরজাটাকে এখন লক করে দিয়েছে।
অ্যালিসের এখন খুব জোর কান্না পাচ্ছে। মা-বাবার কথা ওর খুব মনে পড়ে যাচ্ছে। যদি এখান থেকে বেঁচে না ফিরতে পারে? না, এখান থেকে ওকে বেরোতেই হবে। এই রুমটা ওর এত চেনা-চেনা লাগছে কেন? সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর অ্যালিস বুঝতে পারে এই রুমটা তো ওর মায়ের! কিন্তু রুমটা এত ঠান্ডা কেন? অ্যালিসের সারা শরীর হঠাৎ করে কাঁপতে থাকে। ওর মনে হল, ও যেন একটা মর্গে এখন প্রবেশ করেছে। কিন্তু মায়ের এই রুমটা একটু একটু করে বরফে পরিণত হয়ে যাচ্ছে কেন? আসবাবপত্র, রুমের মধ্যে মায়ের বইগুলো—সব কিছুই বরফে বদলে যাচ্ছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে অ্যালিস দেখল, একজন মহিলা ধবধবে সাদা রঙের একটি রাজকীয় পোশাক পরে একটি বরফের সিংহাসনে বসে আছে। সেই মহিলার মাথায় বরফের মুকুট শোভা পাচ্ছে, মুখটা অবিকল ওর মায়ের মতন। কিন্তু চোখের চাহনি মায়ের মতন নয়, বরং তার জায়গায় একজোড়া হিমশীতল চোখ এখন অ্যালিসের দিকেই নিবদ্ধ।
অ্যালিসের প্রথমে মনে হল, গল্পের চরিত্র হোয়াইট কুইন এখন ওর সামনে বসে আছে, কিন্তু মুখটা তো পুরো…
“মা! তুমি এখানে কী করছ? আর এইরকম পোশাক কেন পরে আছ?” অ্যালিসের কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সেই মহিলা নিজের সিংহাসন ছেড়ে উঠে পড়ে আর অ্যালিসের খুব কাছে চলে এসে ওর গলাটা টিপে ধরে।
অ্যালিস অবাক হয়ে ওর মায়ের মতন দেখতে এই মহিলার দিকে চেয়ে থাকে।
“মা! এ তুমি কী করছ?” অ্যালিসকে অবাক করে দিয়ে সেই মহিলা ফ্যাঁসফেঁসে গলায় তখন বলে ওঠে, “কেন এমন করলি তুই? বল! কী করে করতে পারলি?” মহিলার কথাগুলো অ্যালিসের কিছুই বোধগম্য হল না। আর যে-ই হোক, এই মহিলা যে ওর মা নয়, সেটা ও খুব ভালো করেই বুঝতে পারল।
সেই মহিলা তখন একটি কান্নামিশ্রিত চিৎকার করে ওঠে। আর সেই কান্নার ফলে সমস্ত বরফ একটু একটু করে ভাঙতে শুরু করে দেয়। বরফের টুকরোগুলো অ্যালিসের সারা শরীরকে আঘাত করতে থাকে। আর বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না অ্যালিস। জ্ঞান হারানোর সময় শেষবারের জন্যে ‘মা!’ বলে চিৎকার করে ওঠে অ্যালিস।
চোখ খোলার পর কিছুক্ষণ স্থির হয়ে উপরের দিকে চেয়ে থাকল অ্যালিস। প্রথমে ওর মনে হল, ও বোধহয় নিজের রুমেই শুয়ে আছে, কিন্তু যখন ও উঠে দাঁড়াল, তখন ও নিজেকে আবার সেই তিনটে দরজার সামনে আবিষ্কার করল। এই দুই আর তিন নম্বর দরজা দিয়ে যাওয়া ছাড়া ওর কাছে আর অন্য কোনো উপায় নেই। তার কারণ এই দরজা তিনটে ওর পথ আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দু-নম্বর দরজা দিয়ে ও ঢুকতে যাবে, ঠিক তখনই একজনের গমগমে গলার স্বর ও শুনতে পেল। পিছন ঘুরে অ্যালিস আঁতকে ওঠে, তার কারণ, একটা বিশাল আকারের সবুজ রঙের শুঁয়োপোকা ওর খুব কাছে চলে আসে। খরগোশ আর ম্যাড হ্যাটারের মতন এই শুঁয়োপোকার চোখগুলো আগুনের ভাঁটার মতন জ্বলছে।
“দু-নম্বর দরজা দিয়ে এখন যেতে পারবে না। আগে তিন নম্বর দরজা দিয়ে তোমায় প্রবেশ করতে হবে।”
“নাহ্! আমি আপনার কথা কেন শুনব? আমি দু-নম্বর দরজা দিয়েই প্রবেশ করব।” অ্যালিস নিজের গলার স্বর শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল। এত বিপদের মধ্যেও সে যে সাহস করে কথা বলতে পারছে—এটাই ওর কাছে অনেক বড়ো ব্যাপার।
অ্যালিস গল্পে এই শুঁয়োপোকাটা খুব ভালো ছিল। ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারত, কিন্তু এই জগতে তো কেউই দেখছি ভালো নয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অ্যালিস আর ঠিক তখনই হতবাক হয়ে ও দেখল, সেই শুঁয়োপোকাটা একটি সাপের মতন অ্যালিসকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। শুঁয়োপোকাটা নিজের মুখটাকে অ্যালিসের মুখের খুব কাছে নিয়ে এসে বলে ওঠে, “দু-নম্বরে তোমার ভবিতব্য রয়েছে তাই ওই দরজা দিয়ে সবার শেষে প্রবেশ করবে আগে তিন নম্বর দরজা দিয়ে…”
অ্যালিসকে বলপূর্বক সেই শুঁয়োপোকাটা তিন নম্বর দরজাটা খুলে ভেতরে ছুড়ে ফেলে দিল। বাইরে দিয়ে এই দরজাটাও আবার লক হয়ে গেল। মাটি থেকে কোনোভাবে উঠে অ্যালিস দেখল এই ঘরটা পুরো তাস দিয়ে তৈরি। আর সব তাসের মধ্যে শুধু রানির ছবি রয়েছে। সেই রানির ছবিগুলোর মুখের অভিব্যক্তিগুলো একেকটা একেক রকমের। কোনোটায় সেই রানি হাসছে, কোনোটায় সে কাদঁছে, কোনোটায় সে অপরাধীদের মুণ্ডুচ্ছেদ করছে। কিন্তু সব ক-টা তাসের মধ্যে একই রানির মুখ। অ্যালিস সেই সব ক-টা তাসে থাকা রানির মুখটাকে দেখে অবাক হয়ে গেল, তার কারণ, গল্পের চরিত্র কুইন অব হার্টসের মতন মনে হলেও এই রানির মুখটা এক্কেবারে…
মার্থা!
“কী অ্যালিস? এই দরজা অব্দি পৌঁছে গেলে অথচ এখনও বুঝে উঠতে পারলে না, কেন তোমার সঙ্গে এই ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে? এতটা নির্বোধ তো তুমি নও। তোমার মা শুধুমাত্র তোমার ভাইয়ের চলে যাওয়ায় অসুস্থ হয়ে যায়নি। তোমার মুখ যাতে ওঁকে আর কোনোদিন দেখতে না হয় তাই উনি নিজের ঘর থেকে বেরোতে চান না। ভেবো না, তোমার বাবা শুধুমাত্র তোমার ভাইয়ের শোকে পাগল হয়ে দিনের পর দিন বাড়ি ফেরেন না। উনিও তোমার মায়ের মতন তোমার মুখদর্শন করতে চান না। তুমি এখনও কিছুই বুঝতে পারছ না, অ্যালিস?”
মার্থাকে এমনিতেই ভীষণ সুন্দর দেখতে আর এখন টকটকে লাল রঙের রাজকীয় পোশাকে ওকে সত্যি রানির মতনই মনে হচ্ছিল। তাসের দ্বারা নিমিত্ত একটি সিংহাসনে বসে এই কথাগুলো মার্থারূপী তাসের রানি বলে চলেছিল।
অ্যালিস এখনও কিছু বুঝতে পারছিল না, সকলে ওর উপর কেন এত রেগে আছে।
“এখনও কিছু না বুঝতে পারলে এই রুমের কোনায় একটা বড়ো আয়না রাখা আছে, সেই আয়নার সামনে দাঁড়ালে সব কিছু বুঝতে পেরে যাবে।” তাসের রানির কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে চলেছিল অ্যালিস। আর সময় নষ্ট না করে বড়ো আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল অ্যালিস। আর ঠিক তখনই ও দেখল…
ও কতটা নিজের ভাইকে হিংসে করত। ওর মনে ওর ভাইয়ের প্রতি কতটা বিষ ছিল। অ্যালিস ভেবেছিল, ওর মা-বাবার অন্ত প্রাণ একমাত্র ও-ই ছিল। কিন্তু ও যখন জানতে পারল, এত বছর পর এই বাড়িতে ওর এই ভালোবাসার উপর ভাগ বসাতে আরেকজন খুব তাড়াতাড়ি চলে আসছে, তখন ও আর সহ্য করতে পারল না। ও সব শেষ করে দিতে চেয়েছিল। আয়নায় তখন এক-এক করে প্রতিটা দৃশ্য ফুটে উঠছিল। অ্যালিস তখন পাথরের মূর্তির মতন নিজের কুকর্মের দৃশ্যগুলো দেখে চলেছিল। চেশায়ারের প্রতি ওর ভালোবাসা ছিল সব মিথ্যে, নাটক। প্রতিটা মুহূর্তে ও নিজের ভাইয়ের মৃত্যুকামনা করেছিল। সদ্যোজাত ভাইটার উপর এর আগেও একাধিকবার আঘাত করার চেষ্টা করেছিল অ্যালিস, কিন্তু কোনোবারই ও সফল হতে পারেনি। সেসব কিছু এখন আয়নায় ফুটে উঠছে। ভাইয়ের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়ে অ্যালিসের মা-বাবাও ওদের মেয়েকেই সন্দেহ করত, কিন্তু ভেবেছিল, সময়ের সঙ্গে অ্যালিস নিজের ভাইকে একদিন চোখে হারাবে। কিন্তু ওদের ধারণা সব ভুল ছিল।
অবশেষে আয়নায় ফুটে উঠল সেই চরম মুহূর্ত, যখন মার্থার বানানো কফিতে অ্যালিস লুকিয়ে ওর মৃত ঠাকুমার ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিচ্ছে। আর তারপর সকলে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার পর অ্যালিস নিজের ফুটফুটে দেখতে ভাই চেশায়ারকে কোলে নিয়ে সেই গোলাপ ফুলের জন্য বরাদ্দ জমিটা খুঁড়ে সেখানে নিজের ভাইটাকে মাটিচাপা দিয়ে এল। পরের দিন সকালে বাড়ির সকলের যখন ঘুম ভাঙল, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। অ্যালিসের মা-বাবা এবং মার্থা বুঝতে পেরেছিল, চেশায়ারের নিখোঁজের পিছনে অ্যালিসই দায়ী, কিন্তু ওর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ ছিল না। এক অভাগা মা-বাবা কোনোদিন জানতেও পারল না, বাড়ির বাগানেই এই বংশের কুলদীপকের নিথর দেহ শায়িত আছে।
দৃশ্যপটগুলো আয়নার থেকে সরে সরে গিয়ে তার জায়গায় অ্যালিস দেখতে পেল ওর নিজের প্রতিবিম্বকে। কিন্তু ওর এই প্রতিবিম্বটি বড়োই হিংস্র, বড়োই কুটিল চেহারার। আর ঠিক তখন আয়নাটার মধ্যে চিড় ধরতে থাকল। আয়নার কাচের টুকরোগুলো এখন অ্যালিসকে লক্ষ করে ধেয়ে এল। তাসের রানি সিংহাসনে বসা অবস্থায় অ্যালিসের উদ্দেশে বলে উঠল, “মন স্বচ্ছ আর সুন্দর থাকলে তুমি আজ সত্যি সত্যি একটি সুন্দর রূপকথার জগতে প্রবেশ করতে পারতে, কিন্তু তোমার মন বিকৃত এবং ঘৃণ্য তাই এই জগতে তুমি প্রবেশ করেছ।”
নাহ্!
অ্যালিস আবার নিজের জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। চোখ খুলে সে নিজেকে আবার সেই তিনটে দরজার সামনে পড়ে থাকতে দেখল। এবার ও সব কিছু বুঝতে পেরে গেল। তবে এখন আর কিছু করার নেই। কোনো কিছু আর না ভেবে ও তৃতীয় দরজার ভেতর প্রবেশ করল। এই ঘরটি বাকি দুটো ঘরের চেয়ে অনেক বড়ো। এই ঘরটি পুরো অন্ধকারে ঢাকা। কেমন যেন এক নিবিড় শূন্যতা ঘরটাকে আলিঙ্গন করে রেখেছে। অ্যালিস সেই অন্ধকারের মধ্যেই কোনোভাবে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। আর ঠিক তখনই ও দেখল, অন্ধকারের বুক চিরে একজন হাসছে। কান-এঁটো-করা হাসি। আর সেই হাসির সঙ্গে একজোড়া সবুজ-হলুদ চোখ অ্যালিসের দিকেই চেয়ে আছে।
“ভাই! আমাকে ক্ষমা করে দে! আমি তখন হিংসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি তখন বুঝতে পারিনি তোর প্রতি আমার এই ঈর্ষা, হিংসে আমাকে এতটা নীচে নামিয়ে দেবে। আমাকে ক্ষমা করে দে। ক্ষমা…!”
বেশি কিছু আর বলতে পারল না অ্যালিস। ওর মনে হল, কেউ একজন হামাগুড়ি দিতে দিতে ওর গায়ের উপর উঠে আসছে।
নাহ্!
“কী হল, আবার কোনো নাইটমেয়ার দেখলে নাকি?” চোখ খুলে অ্যালিস দেখল, মার্থা নিষ্পলক চোখে ওর দিকে চেয়ে আছে।
অ্যালিস তখন ধড়ফড় করে খাট থেকে উঠে পড়ল। সূর্যের প্রথম আলো ওর সারা শরীরটাকে যেন স্নান করিয়ে দিচ্ছে।
দু-বছর পর…
আজ অ্যালিস পুরোপুরি পালটে গেছে। এই দু-বছরের মধ্যে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। সব ওর জন্যে হয়েছে। ওই এই পরিবারের ধ্বংস হওয়ার পিছনে দায়ী। ওর ভাইয়ের সেই ঘটনার পর অ্যালিসের মা-ও কয়েক মাস পরে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। মার্থা এমনিতেই এই বাড়ির কর্ত্রী হয়ে উঠেছিল। অ্যালিস শুধু একটা ব্যাপারই তখন জানতে পারেনি। চেশায়ার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর অ্যালিসের বাবা মার্থার শরীরটাকে নিজের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে খুঁজে পেয়েছিল। আর এখন পরিণতি হিসেবে মার্থা অ্যালিসের আক্ষরিক অর্থে সৎমা হয়ে উঠেছে। মার্থা এখন সন্তানসম্ভবা। মার্থার যদি ছেলে হয় তাহলে অ্যালিসকে হয়তো এই বাড়ি থেকেও চলে যেতে হবে। কারণ অ্যালিসের বাবা তার হারিয়ে-যাওয়া চেশায়ারকে ফিরে পেতে চায়।
কিছু মাস পর…
অ্যালিসের বাবা নিজের মেয়েকে মার্থার ঘরে ঢুকতে দিচ্ছিল না। কিন্তু মার্থা নিজের স্বামীকে আশ্বাস দেয়, আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর হবে না।
নতুন ভাইকে দেখার জন্যে উশখুশ করে অ্যালিস। এবারে ও আর আগের মতন ভুল করবে না। নিজের ভাইকে ও আগলে রাখবে।
“কী হল, অতদূরে দাঁড়িয়ে কী এত ভাবছ? তোমার ভাইয়ের মুখ দেখবে না?”
খাটের পাশে থাকা দোলনায় সদ্যোজাত ভাইটাকে দেখার জন্যে অ্যালিস নিজের মুখটাকে খানিক বাড়িয়ে দিল।
আর ঠিক তখনই ও আঁতকে উঠে দেখল…
অবিকল ওর ভাই চেশায়ার দোলনায় শুয়ে আছে। অ্যালিসকে দেখতে পেয়ে সদ্যোজাত শিশুটি কান-এঁটো-করা হাসি হেসে উঠল।
Tags: অভিষেক সরকার, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
পড়তে ভালোই লাগলো । তবে ঠিক কল্পবিজ্ঞান নয় ।