এমন যদি হয়
লেখক: রঙ্গন রায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
হাতের কাজগুলো চটজলদি সেরে নিচ্ছিল হরিশ। গ্রামের লোকেদের কথায় তাকে গ্রাম থেকে এই এতদূরে জঙ্গলের কিনারায় পোল্ট্রির ফার্ম বানাতে হয়েছে। এদিকে কোনো লোকবসতি নেই। অনেকটা পর্যন্ত ফাঁকা ঘাসজমি, তারপর শুরু হয়েছে গভীর জঙ্গল। কাজেই পোল্ট্রি ফার্মের উৎকট গন্ধ শোঁকার লোকও এখানে নেই।
সারারাত ফার্মে কোনো পাহারা রাখা যায় না। এরকম জঙ্গলের পাশে সারারাত কে-ই বা পাহারায় থাকবে? এবং এই বিনা প্রহরাই গত রাতে ঘটনা ঘটিয়ে গেছে। হরিশ বুঝতে পারছে না, পুকুরের মধ্যে দিয়ে এসে পাতলা লোহার বেড়া ছিঁড়ে কে তার মুরগি হাপিস করল। যেন গাছের গুঁড়ি দিয়ে কেউ ফুটো করে ভেতরে ঢুকে মুরগি চুরি করে পালিয়েছে। যদি চুরির ব্যাপারটা প্রমাণিত হত তাহলেও সে আশ্বস্ত হত। কিন্তু চুরি কোনো মানুষ করেনি। ফার্মের ভেতর চারদিকে মুরগির পালক আর রক্ত পড়ে থাকতে দেখেছে। মানে এখানে বসেই খেয়েছে কোনো প্রাণী। কিন্তু কোন প্রাণী? চিতা পুকুরে সাঁতরে এসে এভাবে ফুটো করতে পারবে না। সামনের জমির দরজা দিয়েও তার পক্ষে আসা সম্ভব না, কারণ সেটা যথেষ্ট মজবুতভাবে বানিয়েছে হরিশ। তাহলে? কী এমন প্রাণী, যে জল থেকে উঠে এসেছিল? জল থেকেই উঠে এসেছিল কি না নিশ্চিত না হলেও জলে কিছু পালক ভাসতে দেখেছে সে।
কিছুদিন আগে যখন সে এই ফার্মটা খোলার কথা ভেবেছিল, তখন গ্রামের ভেতরে তার যে পাঁচ কাঠা জায়গা আছে, সেখানেই করবে, ঠিক করেছিল। কিন্তু প্রতিবেশীরা বেঁকে বসল। এরকম গ্রামের ভেতরে পোল্ট্রি ফার্ম বানানোটা নাকি অস্বাস্থ্যকর। মাতব্বরদের চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত তাকে এই জঙ্গলের ধারের পৈতৃক তিন বিঘা জমিতেই ফার্মটা বানাতে হয়েছে। হরিশ ভেবেছিল, এখানে চা-বাগান লাগাবে। এখন সেই জমিরই মাঝামাঝিতে পোল্ট্রি ফার্ম বিরাজ করছে।
তবে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের বুদ্ধিতে ফার্মের দু-দিকে পুকুরও কাটিয়ে নিয়েছিল সে। এমনভাবে পোল্ট্রি ফার্মটা বানিয়েছে, যাতে করে মুরগির বিষ্ঠাতেই পুকুরে তেড়ে মাছচাষও করা যায়। গত দু-মাসে বেশ লাভের মুখও দেখেছিল হরিশ। কিন্তু গত রাতের ঘটনাটা প্রথম তাকে ক্ষতির কথাও চিন্তা করাচ্ছে। একটা-দুটো না, প্রায় দশটা মুরগি!!
পুকুর দুটো আয়তনে অনেকটা বড়ো। আয়তাকার। বার্ড আই ভিউ থেকে দেখলে তিনটি আয়তক্ষেত্র চোখে পড়বে। পুকুর, ফার্ম, পুকুর। একদম নিখুঁত মাপ।
হরিশ জাল মেরামত করা শেষ করে দ্রুত ফার্মের ভেতরের হ্যারিকেনগুলো জ্বালাচ্ছিল। এদিকটায় ইলেকট্রিসিটি নেই। অন্ধকারে তো আর পাখিগুলোকে রাখা যায় না সারারাত!
পাখি!
মনে মনে হাসে হরিশ। মুরগি অবশ্যই পাখি, কিন্তু তাকে পাখি বলে ডাকাটা একেবারেই যেন অসাংবিধানিক পর্যায়ের ব্যাপার।
এখন সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে। জঙ্গলের এত কাছে একদম একা একা থাকাটা এই অন্ধকারে মোটেই নিরাপদ নয়। তার মধ্যে কাল কোনো অজ্ঞাত প্রাণী এখানেই হানা দিয়েছিল। সারাটা সকাল ধরে সে শহর থেকে মোটা জাল কিনে আনা থেকে শুরু করে সেগুলো ঠিকঠাকমতো লাগানো, সবটাই নিজে হাতে করেছে। এখনও কোনো কাজের লোক খুঁজে পায়নি হরিশ। নিজে হাতেই করতে হয়। এই যে এখন সব আলো জ্বালিয়ে, দরজায় তালা ঝুলিয়ে সে সাইকেলে উঠে বিড়ি জ্বালাবে, তারপর তার ছুটি। যদিও এখান থেকে বাড়ি ফিরতে তাকে প্রায় মাইলখানেক নির্জন অন্ধকার রাস্তা পেরোতে হবে। তবে এই জঙ্গল-লাগোয়া গ্রামেই তো তার জন্ম। ভয়ডর খুব একটা নেই কোনোকালেই। বাঘ বলতে এখানে মাঝেমধ্যে চিতার উপদ্রব হয়, গ্রামে ঢুকে হাঁস-মুরগি তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু চিতার চেয়েও ভয় যদি সত্যিই কাউকে করে থাকে হরিশ তাহলে সেটা মহাকালকে। রাতের বেলা তার আসল নাম উচ্চারণ করতে নেই। এটাই অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ।
তালা লাগিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল হরিশ। আজকে আকাশে চাঁদের আলো আছে। তার লম্বা সুদৃশ্য পোল্ট্রি ফার্মের টিনের চাল আলো পড়ে ঝকঝক করছে। দু-পাশের পুকুরের জলও চিকচিক করছে। অদ্ভুত মায়াবী এই নীল আলো। চারদিকে ফাঁকা মাঠের দিকে তাকালে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। ডানদিকে মাঠের শেষ প্রান্ত থেকেই শুরু হচ্ছে গভীর অরণ্য। দিগন্তরেখার মতো কালো গাছপালার সারিকে এতদূর থেকেও রহস্যময় লাগে। যেন এক্ষুনি ওখান থেকে কিছু একটা বেরিয়ে আসবে।
হরিশ একবার ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ করে কোঁচা থেকে দেশলাই বের করল। বিড়িটা ধরিয়ে একটা সুখটান দিতেই হঠাৎ দূরের জঙ্গল থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে এল। কিন্তু এ কী! এই শেয়ালের ডাক তো স্বাভাবিক শেয়ালের ডাক নয়! একে ফেউ-ডাকা বলে। তার মানে জঙ্গলের রাজা বেরিয়েছে!
চিতা নয়! বাঘ। বড়ো বাঘ!
মহাকাল বাদ দিয়ে এই আরেকটি প্রাণী, যাকে হরিশ ভীষণ ভয় পায়। বহুদিন জঙ্গলে বাঘ বেরোনোর কথা শোনা যায়নি। সবাই ভেবেছিল, বাঘ বোধহয় আর নেই এ জঙ্গলে। কিন্তু না! এইমাত্র শোনা ডাক স্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছে, বাঘ আছে। শেয়াল এরকম স্বরে তখনই ডাকে, যখন বাঘ বের হয়!
তাহলে কি বাঘই এসে তার ফার্ম ভেঙে ঢুকে মুরগি খেয়ে গেছে?
আর এক মুহূর্তও দেরি করল না হরিশ। সাইকেলে উঠেই ভগবানের নাম জপ করতে করতে ফুল স্পিডে চালিয়ে দিল।
“জয় মা কালী! তুই মোর মুরগিগুলাক দেখিস! অইলাক বাচাইস! আর মা মোকো এই এক মাইল আস্তা ভালে ভালে পার করি দিস।”
বিড়বিড় করতে করতে সাইকেল চালাচ্ছে সে। হেমন্তকালের মাঝামাঝি সময় এখন। বাতাসে বদল এসেছে। তা সত্ত্বেও ঘামে ভিজে গেছে গোটা পিঠ।
ভয়টা কাটানোর জন্য হরিশ তার দু-নম্বরি ব্যাবসাটার কথা ভাবতে শুরু করল। কাল তার কাছে পার্টির আসার কথা। এ সপ্তাহে দুটোর বেশি ধরতে পারেনি সে। ওধারের নদীর আশপাশে ঝোপঝাড়গুলোতে ওরা থাকে। ধরা খুবই রিস্কি। প্রাণ হাতে রেখে ধরতে হয়। যদিও বিক্রি করলে ভালোই টাকাপয়সা মেলে। তাও…
আধ মাইলমতো সাইকেল চালিয়ে আসার পর একটা খাল পড়ে। তারপর বেশ কিছুটা রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। খুব একটা গভীর নয়। ওদিকের ঘন জঙ্গলের একটা অংশ এখানে এসে শেষ হয়েছে।
হরিশ মোটামুটি ফেউয়ের ডাক থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে জেনে যখন প্রশান্তির দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে গেল, ঠিক তখনই আচমকা রাস্তার পাশের খালের ঝোপ থেকে একটা গাছের গুঁড়ি বেরিয়ে এসে রাস্তা জুড়ে থেমে পড়ল। চাঁদের আলো এখানে গাছপালার জন্য ভালো করে পড়েনি। পাতার আড়াল দিয়ে ছায়া-ছায়া যেটুকু এসেছে, তাতে হরিশ একদম দেখতে পায়নি জিনিসটা। সাইকেল সমেত তার উপর দিয়ে চালিয়ে দিতে গিয়ে মুখ থুবড়ে ব্রিক সোলিং-করা আধা কাঁচা-আধা পাকা রাস্তায় আছড়ে পড়ল সে।
“ওরের মাও!” যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠে বসতে গিয়ে হরিশ যা দেখল, তাতে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেল সে।
গাছের গুঁড়ির মতো দেখতে হলেও তার যেন প্রাণ আছে। নড়ছে সেটা। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, তার হাত-পা-ও আছে। একটা জান্তব গড়গড় শব্দ শুনতে পাচ্ছে হরিশ, নিশ্বাসপ্রশ্বাসের।
ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল প্রাণীটা।
এখন দেখা যাচ্ছে, তার একটা প্রকাণ্ড মুখও আছে।
দু-পাশের পাতলা অন্ধকার জঙ্গলের ভেতরের রাস্তায় আতঙ্কে ছটফট করে উঠল হরিশ। কারণ যে প্রাণীটাকে সে দেখছে, তাকে কোনোদিনও এই জঙ্গলে দেখেনি কেউ। এ এখানকার প্রাণীই না। এমনকি ভারতবর্ষের কোনো জঙ্গলেই এর দেখা পাওয়া যায় না। এর নাম সে জানে। ছবি দেখেছে। কিন্তু চোখের সামনে এই প্রথম দেখছে। আর তাই সীমাহীন আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাকে।
সাইকেলটা পাশে পড়ে আছে। বাড়ি এখান থেকে কম করেও আধ মাইল। এই পাতলা নির্জন জঙ্গলের ভেতরের রাস্তা দিয়েই সে রোজ যাতায়াত করে। ছোটো থেকে কোনোদিন এতটা ভয় পায়নি নিজের বাড়ি ফেরার রাস্তাটাকে। কিন্তু আজ…
চেরা জিবটা বার দুয়েক দেখিয়েই আস্তে আস্তে এবার সেটা হরিশের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল। পালানোর কথা ভুলে গেছে সে। আর কিচ্ছু করার নেই তার। মায়াজালে আটকে ফেলেছে তাকে প্রাণীটা। পরিত্রাণের কোনো পথ নেই।
শেষবারের মতো হরিশের মাথায় একটাই কথা ঝিলিক দিয়ে উঠল। সে বুঝতে পেরে গেছে, গত রাতে তার পোল্ট্রি ফার্মে আগন্তুক সেই রহস্যময় প্রাণীটা আসলে কী ছিল!
দুই
অসিত যখন আলিপুরদুয়ার থেকে রওনা হয়েছিল, তখন দুপুরের রোদ পড়ে এসেছে। মনোরম প্রকৃতির গায়ে আলতো আঙুল বোলাচ্ছিল সদ্য তেজ-হারানো সূর্য। আগের দিন সে রাত কাটিয়েছে পিসির বাড়িতে। একটা চাপা উত্তেজনায় ঘুমটা ঠিকভাবে হয়নি তার। কলকাতা থেকে এতদূরে এসেছে স্রেফ ওই লোকটার সঙ্গে দেখা করতে। যদিও ব্যাপারটা তার সংবাদপত্রের অফিসের কেউ জানে না। চার দিনের ক্যাজ়ুয়াল লিভ নিয়ে চলে এসেছে। ডুয়ার্সের এই জঙ্গলে বসে উনি কী এমন কাজ করছেন, কে জানে!
গাড়িটা রাজাভাতখাওয়ার চেকপোস্টে থেমে পারমিট নিয়ে তারপর এখানে এসে পৌঁছেছিল। খুব একটা টুরিস্টের ভিড় ছিল না। একটা নৌকা সে গোটাটা ভাড়া করে নিয়েছে। ফোনে এমনটাই জানিয়ে দিয়েছিলেন উনি। তারপর দুজন মাঝির তত্ত্বাবধানে ভেসে পড়েছে খাড়িতে।
এখন দু-পাশে ঘন বনের মাঝখান দিয়ে তার নৌকা এগিয়ে চলেছে। যত এগোচ্ছে, তত খাড়ি সরু হয়ে আসছে। দু-পাশের গাছপালা নুয়ে পড়েছে প্রায় মাথার ওপর।
এতক্ষণ কেউ একটাও কথা বলেনি। এই জঙ্গলের ভেতর কথা বলা নিষিদ্ধ। আশপাশের জঙ্গল থেকে হাতি বেরিয়ে আসে এখানে জল খাওয়ার জন্য। জারুল, শিশু, পানিয়াল, শাল গাছের গভীর জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে মাঝিদের দাঁড় টানার ছলাত ছলাত শব্দ আর নাম-না-জানা পাখির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ পায়নি অসিত।
হঠাৎ নৌকার গতি স্তিমিত হয়ে এল। সামনের খাড়ি আরও সরু এবং জঙ্গলাকীর্ণ। মাঝিদের একজন দাঁড়টা জল থেকে তুলে নিয়ে বলল, “ব্যাস। এইটুকুই যাওয়ার পারমিশন আছে। আর যাওয়া যাবেনি।”
অসিত এতক্ষণ ডুয়ার্সের সুন্দরবন নামক এই জায়গার অসাধারণ জার্নিতে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মাঝির আচমকা কথায় সংবিৎ ফিরল তার। তারপর বলল, “আরেকটু চলো। এখনও তো আলো নেভেনি আকাশে।”
তার কথা শুনে মাঝি দুজন পরস্পরের দিকে তাকাল একবার।
“আইজ্ঞা, আমাদের আর পারমিশন নাই, বাবু। তা ছাড়া এর পরের রাস্তা খুবই ভয়ংকর আছে। যেকুনো সময় চিতাবাঘ ঝাঁপাইতে পারে। মহাকাল উতর এলে তো রক্ষাই থাকবেনি।”
অসিত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “মহাকাল?”
দুই মাঝিই শহুরে এই বাবুর অবস্থা বুঝতে পারল। মহাকাল কলকাতার লোকেরা বুঝবেই বা কী করে। তারা প্রণামের ভঙ্গি করে বলল, “জি হাতি, বাবু।”
অসিত জানে, এখানকার সমস্ত গ্রামের লোকেরাই হাতিকে ভীষণ ভয় পায়। কিন্তু তাকেই যে মহাকাল বলা হয়, সেটা প্রথম জানল।
“কিন্তু আমাকে যে আরও একটু যেতেই হবে, মাঝিভাই!”
তার কথা মাঝিরা বুঝতে পারল না। যেতেই হবে মানে কী?
“অন্ধকার হয়ে আসছে, বাবু। এ জঙ্গল অন্ধকারে জেগে ওঠে। তা ছাড়া এর পরের জলাভূমিতে প্রচুর বিষাক্ত সাপ আছে। এই এলাকা থেকেই কোর জঙ্গল শুরু। আমাদের কাম চলে যাবে, বাবু।”
মাঝি দুটোর কথায় স্পষ্ট ভয়ের ছাপ আছে। এদেরকে টাকার লোভ দেখিয়ে তাকে আরেকটু এগিয়ে যেতে বলেছিলেন উনি। অভাবী দরিদ্র মাঝিদের একটু বেশি টাকা দিলে অনেক কাজ হয়। তা ছাড়া সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাতেও সে জানে এটা।
“তোমরা জানো আমি কে?”
“আইজ্ঞে না, বাবু।” ওরা ক্রমশই অবাক হচ্ছে।
“আমি কলকাতার একটি খবরের কাগজের সাংবাদিক। আমার সব জায়গায় যাওয়ার জন্য পারমিশন লাগে না। আমাকে নিয়ে গেলে তোমাদের চাকরিও যাবে না। তা ছাড়া…” বলে সে পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগটা বের করল, “এই যে, তোমাদের সামান্য বকশিশও আমি দেব। আমাকে আর-একটু নিয়ে যেতেই হবে তোমাদের।”
মাঝি দুজন বুঝে পেল না, কী করবে। তাদের ওপর কড়া নির্দেশ আছে, টুরিস্টদের কোনোরকম প্রলোভন কিংবা বায়নাক্কায় যেন তারা কান না দেয়। আজ টুরিস্ট একদম কম ছিল। এই বাবুই আজকের শেষ কাস্টমার। বহুক্ষণের মধ্যে একজন টুরিস্টও এদিকে আসেনি। জঙ্গল এখন প্রকৃতই জনমানবশূন্য।
অসিত প্রবোধ দেওয়ার জন্য বলল, “আরে, এগুলো রাখো। আমি তোমাদের ওপর আর জোরাজুরি করব না। আর অল্প একটু নিয়ে গেলেই হবে। একজনের দেখা করতে আসার কথা আছে। আমি তাকে মেসেজ করে দিয়েছিলাম নৌকায় ওঠার সময়। এখানে তো এখন টাওয়ার পাচ্ছি না!”
এই গভীর জঙ্গলে কে দেখা করতে আসবে? তাও এই প্রায় সন্ধ্যারাতে? মাঝি দুটো এবার ছটফট করে উঠল।
“বাবু, আপনার দিমাগ আউলে গেছে। এই জঙ্গলের ভিতর কুনো মানুষ থাকে না। কুনো আদিবাসী গ্রামও নাই। কে দেখা করতে আসবে আপনার সঙ্গে?”
এমন সময় জলে ঝটপট শব্দ শুনে অসিত চমকে তাকাতে দ্যাখে, দুটো পানকৌড়ি উড়ে গেল জল থেকে ওপাশের দমনপুর রেঞ্জের দিকে। এপাশের জঙ্গলটা বক্সা টাইগার রিজ়ার্ভ ফরেস্ট। এদিক থেকেই তো তাঁর আসার কথা!
অসিত আর কোনো কথা না বলে এবার পাড়ের দিকে ভেড়াতে বলল নৌকা। কিন্তু তাতেও বেঁকে বসল ওরা।
“পাড়ে ভিড়ানোর কুনো অনুমতি নাই, বাবু। আপনি এরকম কোরেন না। চুপ করে বোসেন, আমরা ইবার ফিরব।”
অসিত দেখল, কোনোভাবেই এদেরকে এই খাড়ির অদৃশ্য সীমানা পার করানো যাচ্ছে না। দুইদিকের পাড়ে সবুজ বোর্ডে সাদা রঙে লেখাও আছে—“ডু নট ক্রস দ্য লাইন।”
এমন সময় হঠাৎ একটা শিসের শব্দ ভেসে এল। তারপরই বক্সা টাইগার রিজ়ার্ভ ফরেস্টের দিক থেকে বন্দুক হাতে ফরেস্ট রেঞ্জার অফিসারের পোশাক-পরা পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন বেরিয়ে এলেন। অসিত তাকে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। যাক। অবশেষে তিনিই এখানে এলেন!
“নেমে এসো অসিত। আমরা এখান থেকে পদব্রজেই যাব। সামনেই আমার বাংলো।”
গমগমে গলাটা নিস্তব্ধ জঙ্গলে খাড়ির মধ্যে বেশ জোরালো শোনাল। মাঝিরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপরই একটা স্যালুট ঠুকে দিল। অসিতের দিকে এখন বেশ সম্ভ্রমের চোখেই তাকাচ্ছে তারা।
নৌকা পাড়ে ভিড়তেই লাফিয়ে নেমে পড়ল অসিত। রেঞ্জার অফিসার এগিয়ে এসে হাত ধরে কাদামাটির এলাকা থেকে শক্ত জমিতে আসতে সাহায্য করলেন।
“কিন্তু সার, উনাকে নিয়ে না ফিরলে তো বড়ো সাহিব খুব চ্যাঁচামেচি করবেন!”
পঞ্চাশোর্ধ্ব রেঞ্জার অফিসার পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে মাঝিদের হাতে দিয়ে বললেন, “এটা বড়ো সাহেবকে দিয়ো। অসুবিধা হবে না আর।” তারপর কবজি উলটে ঘড়ি দেখেই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, “তোমরা তাড়াতাড়ি ফিরে যাও! সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে! আমাদেরও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলোয় ফিরতে হবে। কাম অন অসিত।”
বলেই তিনি ঝোপঝাড়ের ওপর দিয়ে হাঁটু অবধি ওঠানো গামবুট পায়ে দ্রুত অরণ্যের দিকে এগিয়ে গেলেন। মাঝি দুটো আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে নৌকা রওনা করে দিল। অসিত পিঠের রুকস্যাকটা ভালোমতো সেট করে যখন রেঞ্জার অফিসারের পেছনে পেছনে এগোল, তখন সত্যিই অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে।
তিন
কিছুক্ষণ পরপর মুখে টক জল উঠে আসছে। বমি হয়ে যাবে নাকি? অবশ্য হলেও অবাক হওয়ার মতো কিছু ঘটনা নয়। কারণ এই দৃশ্য দেখলে যে কারোই অবস্থা খারাপ হতে বাধ্য।
খগেন অধিকারী তার সঙ্গী দুজনের দিকে তাকাল। তাদের কারও মুখে কোনো কথা নেই। বিস্ফারিত চোখে তারা হরিশ রায়ের অর্ধেক দেহটা দেখছে।
“এই পুলিশ আসছে! পুলিশ!”
ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠতেই খগেন দেখল, একটা পুলিশের জিপ জঙ্গলের আড়ালের রাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে এদিকেই আসছে।
এতক্ষণ সবাই বেশ কৌতূহলের সঙ্গে চারদিকে জটলা করে আধখাওয়া দেহটার দিকে তাকিয়ে ছিল। জঙ্গলের ধারের ছোট্ট একটি গ্রামে এরকম উত্তেজক ঘটনা তো সচরাচর ঘটে না! স্বাভাবিকভাবেই একে অপরের সঙ্গে রোমহর্ষক আলোচনায় মেতে ছিল সবাই। পুলিশ আসতেই তারা একটু পিছিয়ে গেল।
খগেন তার সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, “এই চল, সটকে পড়ি। পুলিশ আইসে গ্যাসে। এখানে থাকাটা ঠিক হবে না।”
দ্রুতগতিতে তারা খানিক দূরে রাখা নিজেদের সবুজ রঙের মহেন্দ্রা জাইলোর দিকে এগিয়ে গেল। খগেনের টেকো মাথায় কিছুতেই হরিশের এরকম শোচনীয় পরিণতি সম্পর্কে কোনো ধারণা আসছে না। বুক থেকে বাকি শরীরটা নেই! এই জঙ্গলে কী এমন ভয়ানক প্রাণী আছে, যে এরকমভাবে খেয়েছে তাকে?
ব্রিক সোলিং-করা এবড়োখেবড়ো রাস্তায় হরিশের সাইকেলটা এখনও পড়ে আছে। সকালে কেউ খবর দিতেই পুরো গ্রাম উজিয়ে চলে এসেছে দেখতে। হরিশের কাছে ‘মাল’ নিতে এসে এই ঘটনার কথা শুনে এখানে পৌঁছোয় খগেনরা। অবশ্য কালো মাছিদের ভিড়ে কালচে-হয়ে-যাওয়া অবশিষ্ট শরীরটা ছাড়া আর কিছুই দেখার সুযোগ ছিল না তাদের।
টোটোন গাড়িটা ছেড়ে দেওয়ার পরও খগেনের গা-বমি, গা-বমি ভাবটা গেল না। জানালায় মুখ বাড়িয়ে হাওয়াগুলো গিলে নিতে লাগল সে।
“বস, এমন ঘটনা ক্যামনে হইল? হরিশরে কীসে খাইছে?”
পেছনের সিটে বসা হোঁতকা চেহারার শাগরেদ সুমিতের কথার কোনো উত্তর দিল না খগেন। এমনিতেই আজকের ‘মাল’ হাতছাড়া হয়ে গেছে। দুটো ‘মাল’ পাওয়ার কথা ছিল আজ। এই এলাকায় এখন আবার নতুন কাউকে ফিট করতে হবে শিকার ধরার জন্য। সেটা মহাঝামেলার কাজ। ওদিকে শিলিগুড়ির হোটেলে পার্টিরা বসে ওদের অপেক্ষা করছে। এতসব ঝক্কি এখন পোহাবে কে? তার মধ্যে গোদের ওপর বিষফোড়া সেই আধখাওয়া দেহটায় কালো মাছির ভনভনিয়ে-ওঠা দৃশ্যটা বারবার চোখের সামনে ফিরে ফিরে আসছে। উফফফ!
খগেন বিরক্ত মুখে ফোন বার করল। নাম্বার ডায়াল করেই কানে গুঁজে জানালা দিয়ে পাশের পাতলা জঙ্গলের দিকে তাকাল।
“হ্যাঁ স্যার, আমি খগেন অধিকারী বলছি, স্যার… বলছি, একটা প্রবলেম হয়ে গেছে… আজ মাল ডেলিভারি দেওয়া যাবে না…”
শুদ্ধ বাংলায় কথা শেষ করে সে একবার হাতঘড়িটা দেখে নিল। সাড়ে এগারোটা বাজে। এখান থেকে শিলিগুড়ি যেতে কমসে কম তিন ঘণ্টা লাগবে।
“সুমিত, হরিশের ব্যাপারে আর কোনো কথা না। এই চ্যাপটার ক্লোজ়। ঠিকাসে?”
“ঠিকাসে, বস।”
সুমিতকে কথা বলতে বারণ করে খগেন পকেট হাতড়ে সিগারেট বার করল। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে হেলান দিল ব্যাকসিটে।
টোটোন রাস্তা ফাঁকা পেয়ে স্পিডে গাড়ি ছোটাচ্ছে। এদিকে রাস্তাটা ভালো। জোরে চালানো যায়। যদিও রাস্তা কিছুক্ষণ পরপর বাঁক নেওয়ায় তেমন স্পিড তোলা যাচ্ছে না।
আধ ঘণ্টা চুপচাপ চলল তারা। কিছুক্ষণ পরেই খয়েরবাড়ি ফরেস্টের একটা অংশ রাস্তায় পড়বে। এখন দু-পাশে চা-বাগান। একটু দূরেই থমথমে জঙ্গল যেন তাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
হেমন্তের হালকা রোদ্দুর ওঠায় প্রকৃতি খুবই মনোরম। কিছুক্ষণ পর একটা ছোট্ট গঞ্জের মতো পড়ল। সাতপুকুরিয়া। নেমে চা খেল সবাই। তারপর নেক্সট স্টপেজ একবারে শিলিগুড়ি, এই মানসিকতা নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল খগেনরা। চা খেয়ে বমি-বমি ভাবটা কেটে গেছে তার।
বেশ কিছুটা চলার পর ব্যাপারটা প্রথম লক্ষ করল ড্রাইভার টোটোন। তাদের গাড়ির গুগ্ল ম্যাপ কাজ করছে না। এদিকের রাস্তাটা সে খুব একটা ভালো চেনে না। শিলিগুড়ির পথে এদিকে জঙ্গলের এত ভেতরের রাস্তা তো পড়ার কথা না? অথচ তাদের গাড়ি এখন যে রাস্তায় চলেছে, তা গভীর জঙ্গলের ভেতর একটা সংকীর্ণ পথ। বড়ো গাড়ি বলতে শুধু জিপ চলতে পারে। এটা কোন রাস্তায় ঢুকে পড়ল তারা?
“কী হইল, টোটোন? এই রাস্তাটা তো চেনা-চেনা না! কোথায় নিয়ে এলি?”
খগেনের কথায় থমথমে মুখ করে টোটোন বলল, “বস, আমি এদিকের রাস্তাটা ভালো চিনি না। আজকেই তো প্রথম আসলাম। বুঝতে পারতেসি না। ইদিকে গুগুল ম্যাপও কাজ দিচ্ছে না। নেট নাই।”
চকচকে টাকের মধ্যেও যেন ভাঁজ পড়ে যাবে এমন মুখ করে তার দিকে তাকাল খগেন। তারপর মোবাইলে নেটের অবস্থা দেখে বুঝতে পেরে গেল, সত্যিই তারা ভুল পথে ঢুকে পড়েছে। এটা খয়েরবাড়ি ফরেস্টের একদম ডেন এরিয়া। সেইজন্যই এখানে নেট কাজ করছে না।
“খাইসে রে! তোকে বললাম, তাড়াতাড়ি শিলিগুড়ি যাইতে হবে! পার্টির সঙ্গে ডিল আসে! তোকে আজ নিয়ে আইসেই ভুল হইছে আমার!” গজগজ করতে লাগল খগেন, “রাস্তাঘাট এখনও কিসু চিনিস না ক্যান? ঘোরা গাড়ি!”
গাড়ি ততক্ষণে বেশ গভীরে ঢুকে পড়েছে জঙ্গলের। একটাও গাড়ি অনেকক্ষণের মধ্যে দেখা যায়নি এই রাস্তায়। টোটোন গাড়ি ঘোরাল। সময় দুপুরের দিকে গড়িয়ে গেছে। জঙ্গল এতটাই গভীর যে রোদ ঢুকছে না ভালো করে। মাল ডেলিভারি যাদের করা হবে, তারা চিনের দালাল। আজ রাতেই তারা ভুটানে ফিরে যাবে। ঠিক সময়ে পৌঁছোতে না পারলে বড়ো দাঁও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। রাগে হাত-পা ছুড়তে ইচ্ছা করছে খগেনের। কাদের নিয়ে টিম বানিয়েছে সে?
বড়ো নালার মতো খাড়িটার কালভার্টের ওপর এসে হঠাৎ ভীষণ পেচ্ছাব পেয়ে গেল খগেনের। গাড়ি থামাতে বলে সে নেমে খাড়ির পাশ ধরে জঙ্গলের ভেতরদিকে গেল।
সুমিত আর টোটোনও নেমে এল। এ জঙ্গলে গাড়ি থামানো সত্যিই বিপজ্জনক। বেআইনিও বটে। তবে কোমরের অটোমেটিকটায় হাত দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েই তারা নেমেছে। গাড়িতে হেলান দিয়ে দুটো সিগারেট সদ্য যখন ধরিয়েছে ওরা, তখনই রক্ত-জল-করা চিৎকারটা কানে গেল।
“বস!” দুজনে একসঙ্গে কথাটা বলেই ছুটল জঙ্গলের ভেতর।
দৌড়ে খাড়ির ধারে, খগেন যেখানে গিয়েছিল, সেখানে এসে পৌঁছোল তারা। কিন্তু কোথায় কী? না তাদের বস, না অন্য কেউ। কোথাও তো কেউ নেই? তাহলে বস কোথায় গেল?
কোমর থেকে রিভলভারটা বের করে সতর্ক হল সুমিত। তারপর অতি সন্তর্পণে একটু এগিয়ে গেল সামনের ঝোপটার দিকে। ঠিক তখনই তার পেছন থেকে ভেসে এল টোটোনের প্রাণান্তকর চিৎকার। চমকে পেছনে তাকাতেই সে যা দেখল, তা কোনো সুস্থ মানুষেরও হৃৎপিণ্ড বন্ধ করে ফেলতে পারে।
একটা বিরাটাকার কুমিরের মতো প্রাণীর মুখের ভেতর অর্ধেকটা ঝুলছে টোটোন। শুধু তার দুটো পা ছটফট করতে দেখা যাচ্ছে।
ভয়ানক আতঙ্কে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল সুমিত। সে বুঝতে পারছে না, কী করবে! এরকম পরিস্থিতিতে পড়লে কী করতে হয়! এটা কোন রাক্ষুসে প্রাণী তার সামনে?
তারপর আচমকাই তার মধ্যে প্রচণ্ড সাহস এসে ভর করল। একটুও দেরি না করে বন্দুক তুলে গুলি চালাতে চালাতে ছুটল রাস্তা লক্ষ করে। যে করেই হোক, তাকে এখন গাড়িতে উঠতে হবে। উঠতেই হবে। এ ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো বাঁচার আশা নেই।
উদ্ভ্রান্তের মতো গুলি চালাতে চালাতে দৌড়োল সে। প্রাণীটার গায়ে গুলি লাগছে কি না, সেদিকে নজর নেই তার।
কোনোরকমে রাস্তায় এসেই গাড়িতে উঠে পড়ল সুমিত। উত্তেজনায় স্টার্ট দিতেও পারছে না। জানালার দিকে তাকাল। সিনেমায় দেখা ডাইনোসরের মতো প্রাণীটা তার দিকে ধেয়ে আসছে গাড়ি লক্ষ করে। বিরাট মুখের ভেতর থেকে বিভীষিকার মতো একটা চেরা জিব বেরিয়ে আসছে ঘনঘন।
প্রাণীটা যখন একদম গাড়ির সামনে চলে এসেছে, ঠিক তখনই হঠাৎ গাড়িটা স্টার্ট নিয়ে ফুল স্পিডে বেরিয়ে গেল সামনের রাস্তার দিকে।
বেশ কিছুটা রাস্তা প্রাণ হাতে নিয়ে চালানোর পর সুমিত ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল একবার। প্রাণীটিকে আর দেখা যাচ্ছে না। কোনো কিছু না ভেবে সে সোজা রাস্তায় শক্ত হাতে গাড়ি চালিয়ে দিল।
হরিশ রায়ের শোচনীয় মৃত্যুর কারণ এতক্ষণে সুমিতের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আর-একটু হলে তো সে নিজেই…
চার
“ভ্যারেনাস কার বিজ্ঞানসম্মত নাম, জানো?”
ফরেস্ট রেঞ্জার সাহেব অতুল সুরের প্রশ্নে কাঠের রেলিং-এর ওপর চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখল অসিত। তারপর বলল, “গুইসাপের না?”
গতকাল সন্ধ্যায় এখানে আসার পর থেকে আজ সকাল অবধি অসিত বেশ উত্তেজিত বোধ করছে। এরকম গভীর জঙ্গলের ভেতর রেঞ্জার সাহেবের অদ্ভুত বাংলোয় কজনেরই বা থাকবার সৌভাগ্য হয়!
বাংলোটা কাঠের। চারটে মোটা আরসিসি পিলারের ওপর নির্মিত এই সুদৃশ্য বাংলো বাইরে থেকে দেখলে যে-কেউ আকৃষ্ট হবে। একটা বাঁশের মই বেয়ে উপরে উঠতে হয়। রাতের বেলা সেটাকে যাতে উপরে টেনে তুলে রাখা যায়, সে ব্যবস্থাও আছে। এ জঙ্গল হিংস্র জানোয়ারের আঁতুড়ঘর। তাদের কেউ মই বেয়ে একবার উপরে উঠে পড়লেই হয়েছে আর কী! চার মানুষ সমান উঁচু পিলারের ওপর কাঠের বাংলোটায় দুটিমাত্র ঘর, যার একটির মধ্যে রান্নাবান্না ও থাকার ব্যবস্থা, অন্যটি অতুলবাবুর গবেষণার ঘর। তিনি যে শখের জীববিজ্ঞানী, এটা জানে অসিত।
“গুড! তা গুইসাপ সম্পর্কে তোমার ধারণা কী?”
চুরুটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে তিনি প্রশ্নটা করলেন। অসিতরা এখন সেই টংঘর বাংলোর রেলিং-ঘেরা পাতলা একচিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সূর্য উঠলেও তার ছিটেফোঁটা ছাড়া এই অরণ্যে কিছুই প্রবেশ করতে পারেনি। কিন্তু সকালবেলার অরণ্য বেশ টাটকা সতেজ হয়। গত রাতে বাস্তুতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য যারা দেহপাত করেছে, তাদের প্রতি প্রকৃতির এতটুকু শোক পালন করার ইচ্ছা নেই। সব কিছু ধোয়া-মোছা ঝকঝকে ব্যাপার।
“গুইসাপ এক ধরনের সরীসৃপ প্রাণী। ডুয়ার্সের জঙ্গলসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এদের দেখা পাওয়া যায়। খুবই নিরীহ প্রাণী এরা, এটুকুই জানি।”
অসিতের উত্তরে উপর থেকে এবার সরাসরি নীচের দিকে তাকালেন অতুলবাবু, “এটাই বেসিক ধারণা। ঠিকই আছে। কিন্তু তাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কিছু জানো কি?”
“বর্তমান অবস্থা মানে?”
চুরুটে লম্বা একটা টান দিয়ে তিনি বললেন, “এই প্রাণী বর্তমানে বিলুপ্তির বিপজ্জনক ইনডেক্সে চলে যাচ্ছে, যার জন্য দায়ী মানুষের অপরিসীম লোভ ও কুসংস্কার।”
এরকম একটা কথা অসিত কলকাতায় থাকাকালে শুনেছিল। ‘শুনেছিল’ বললে ভুল হবে, পড়েছিল। তাদেরই সংবাদপত্রের ডুয়ার্সের প্রতিনিধি একটা বেশ বড়ো প্রতিবেদন লিখেছিলেন স্বর্ণগোসাপ নিয়ে।
“হ্যাঁ, এরকম একটা খবর পড়েছি বটে আমি। এগজ়্যাক্ট ডিটেইলটা জানি না।”
“তোমাদের সুন্দরবন এলাকাতেও এ ধরনের কর্মকাণ্ড চলছে। গ্রামের গরিব মানুষগুলোকে টাকার লোভ দেখিয়ে, গুইসাপ ধরিয়ে সেগুলো পাচার করা হয়।” গমগমে কণ্ঠে অতুলবাবু বলতে লাগলেন।
“কিন্তু কেন এই প্রাণী পাচার? এরা কী কাজে লাগে?”
অসিতের কথায় তার দিকে তাকালেন অতুল সুর। তাঁর পঞ্চাশোর্ধ্ব শরীরে কোনো বলিরেখার চিহ্ন নেই। শক্তসমর্থ মুখে একটা ঘৃণা ফুটিয়ে তুলে তিনি বললেন, “চিনের কিছু ধনকুবের বৃদ্ধ মানুষের অন্ধবিশ্বাস আছে যে তক্ষক ও গুইসাপের ত্বক-মাংস দিয়ে একপ্রকার ওষুধ তৈরি হয়, যা খেলে নাকি অসামান্য জীবনীশক্তি লাভ করা যায়।”
“আর সেজন্যই আমাদের দেশের লোকেরা উঠে-পড়ে লেগেছে এগুলো পাচারের জন্য?”
“এগজ়্যাক্টলি। এই পোচারদের অত্যাচারেই তো জেরবার হলাম।” দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন অতুল সুর, “যে খাড়ি দিয়ে তুমি এখানে এলে, তার আশপাশের ঝোপঝাড়গুলোতেই ওদের বসবাস। কিন্তু দিনে দিনে ওরা সংখ্যা লঘু হয়ে পড়ছে। কিছুতেই আটকাতে পারছি না।”
তাঁর গলায় প্রকৃতই বেদনার সুর ফুটে উঠেছে। অসিতের মনে হল, যোগ্য মানুষই ফরেস্ট রেঞ্জার অফিসারের চাকরিটা পেয়েছে। অরণ্য ও তার সন্তানদের প্রতি যাদের মমত্ববোধ নেই, তারাই ফরেস্ট রেঞ্জার হয়ে চোরাশিকার ও গাছ চুরির মদত দেন প্রচ্ছন্নভাবে।
“তোমায় যেজন্য ডেকেছি, সেটা বলি এবার।”
এই কথায় নীচের জঙ্গল থেকে চোখ সরাল অসিত। সে অতুল স্যারকে ছোটো থেকে চেনে। তাদের পাড়াতেই বাড়ি। স্কুলবেলায় জীবনবিজ্ঞান পড়তে যেত ওঁর বাড়ি। জঙ্গল ভালোবাসতেন বলে যেচে এরকম চাকরি নিয়ে এখানে চলে আসেন। অসিতরা ওঁর জীববিজ্ঞানের প্রতি অসাধারণ মেধা দেখে ভেবেছিল, উনি হয়তো পরবর্তীতে জুয়োলজির প্রফেসার হবেন।
“ডুয়ার্সের এই গোসাপ পাচার নিয়ে একটা দীর্ঘ প্রতিবেদন লিখতে হবে তোমায়। এবং এতবার করে লিখতে হবে, যাতে সরকারের টনক সত্যিই নড়ে। তারা যাতে পদক্ষেপ নেয়। এভাবে আমরা ওদের বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখতে পারব না, অসিত!”
অসিত ভেবে পেল না, এই সামান্য কারণের জন্য তাকে এতদূর জরুরি তলব দিয়ে টেনে আনার মানে কী? ফোনে ডিটেইলস বলে দিলেই তো সে লিখে ফেলতে পারত! আর যতই লেখালেখি হোক, সরকারের টনক নড়ানো কি সোজা কথা নাকি! সরকার মাথা ঘামালেও এখানকার সুবিধাভোগী রক্ষকেরাই তো আসল ভক্ষক!
“হ্যাঁ স্যার, অবশ্যই লিখব আমি। আপনি আমাকে আরও ডিটেইলস জানিয়ে দেবেন!”
অসিতের সম্মতি দেখে আশ্বস্ত হলেন অতুলবাবু। অসিত ভাবল, ইনি কত মমত্বের সঙ্গে চাইছেন, এই প্রাণীরা বেঁচে থাকুক। এরা পৃথিবী থেকে লুপ্ত হলে মানুষের কি সত্যিই কিছু যায়-আসবে?
মনে মনে হাসে সে। কলেজে পড়ার সময় একটা কবিতা পড়েছিল। মার্কিন কবি সারা টিসডেলের লেখা। সেখানে কবি বলেছেন, ‘কেউ কিছু মনে করবে না, পাখি-গাছ কেউ না, যদি মানুষ একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।’
এমন যদি হয়? যদি আজ এই গুইসাপ, তক্ষকের জায়গায় মানুষ বিলুপ্তপ্রায় হত তাহলে কি তারাও মানুষের জন্য তাদের মতোই ভাবত?
পাঁচ
অনেক রাতে মানুষের কথাবার্তার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল অসিতের। সে আজ দুপুরে অতুল স্যারের সঙ্গে জঙ্গলের বেশ কিছুটা অংশ ঘুরেছে। বাংলোর নীচে রাখা স্যারের ব্যাটারিচালিত জিপে চড়ে বেশ রোমাঞ্চ লাগছিল তার। কিছু চিতল হরিণের দর্শনও পেয়েছে। কিন্তু এখন এই এত রাতে জঙ্গলের মধ্যে কাদের গলার শব্দ!
বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা তুলে নিয়ে অসিত দেখল রাত বারোটা বাজে। স্যার গতকাল রাতেও গবেষণাঘরে ঘুমিয়েছিল। এখন সে ঘর থেকে কাঠের দেওয়ালের সরু ফাঁক দিয়ে লন্ঠনের আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে না।
বিছানায় উঠে বসে জানালার পাল্লা হালকা সরাল সে। যা দেখল, তাতে বিস্মিতই হল। তাদের বাংলো থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে একটা জিপ স্টার্ট বন্ধ করে হেডলাইট জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কথাবার্তার শব্দ সেখান থেকেই আসছে।
ওটা কার জিপ? কৌতূহল হল অসিতের। এই জঙ্গলে এত রাতে কারোই ঢোকার অনুমতি নেই। ওটা কি স্যারের জিপটাই? কিন্তু স্যারের জিপ তো এত বড়ো না? তা ছাড়া অন্য মানুষের গলার স্বরই বা আসবে কী করে?
হঠাৎ ভীষণ বাগ্বিতণ্ডার আওয়াজ ভেসে এল। এবং অসিত স্পষ্ট শুনল তার স্যারের উত্তেজিত গলা। আর তারপরই দুটো লোক জিপ থেকে লাফিয়ে নেমে এসে রাইফেল তাক করল স্যারের দিকে। এবার আরেকটা হোঁতকামতো লোক নেমে এসে কলার চেপে ধরল।
“চুপচাপ আমাদের কথা শোন। কেন বেঘোরে প্রাণটা দিবি?”
লোকটার বাজখাঁই গলা নিস্তব্ধ জঙ্গল ভেদ করে অসিতের কানে এসে পৌঁছোল। স্যারের কাছে কী চাইছে ওরা?
স্যার প্রত্যুত্তরে কী বলল, শুনতে পেল না অসিত। লোকটা এবার স্যারকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতেই অসিতের মেজাজ গেল গরম হয়ে। দুদ্দাড় করে সে যেই নীচে নামতে গেল, অমনি গোটা বাংলোটা মুহূর্তের জন্য যেন একটু কেঁপে উঠল। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল অসিত। দেওয়ালের পেরেকে ঝোলানো নিবুনিবু লন্ঠনটা থরথর করে কাঁপছে।
ধপ! ধপ! ধপ!
শব্দটা যতবার শুনল অসিত, ততবার স্পষ্ট কম্পন অনুভব করতে পারল। এবং সেই শব্দটা যেন আস্তে আস্তে এদিকেই এগিয়ে আসছে।
জিপের লোকগুলোও এই আচমকা শব্দ ও কম্পনে থমকে গেছে। এ ওর মুখের দিকে চাইছে।
“সুমিতদা! এটা কীসের শব্দ?” ভয়ার্ত গলায় একজন রাইফেলধারী বলে উঠল।
তারপরই সুমিত নামের হোঁতকা লোকটার ভয়ানক আর্তনাদ শোনা গেল, “এএএএটা এইখানেও কী করে আসলো?”
অসিত যখন বারান্দায় বেরিয়ে এসে সোজাসুজি তাকাল, তখনই প্রথম প্রাণীটাকে দেখতে পেল সে। এই অতিকায় প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ার এখনও টিকে আছে? এ কী করে সম্ভব? অন্ধকারের মধ্যেও কেমন ঝকঝক করছে তার শরীর! সোনালি রঙের অতিকায় কুমিরের মতো প্রাণীটা খাড়ির দিক থেকে এবার বেশ স্পিডেই থপথপ করে দৌড়ে এল গাড়িটার কাছে। গরগর করে তার নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
সুমিত সীমাহীন আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, “এই শয়তানটাই খগেনদা আর টোটোনরে খাইসে। তার আগের দিন হরিশরে। আমি অল্পের জন্য বাইচে গেসি রে ভোলা। গাড়ি স্টার্ট দে!! শিগ্রি!”
সঙ্গী দুজন আতঙ্কে মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছে না এখন কী করা উচিত!
“আজ দুপুরেই আমি এর খপ্পরে পড়সিলাম। তোদের বললাম, তোরা তো বিশ্বাসই করলি না আমার কতা! গাড়িতে ওঠ, পালা পালা! এটা শয়তান! মূর্তিমান শয়তান!”
অসিত দেখল, অতুলবাবু মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালেন। গা-হাত-পা ঝাড়লেন নিশ্চিন্ত মনে। তারপর একবার সেই অতিকায় প্রাণীটার দিকে তাকালেন। প্রাণীটা তাঁকে কোনো পাত্তাই দিল না। তার নজর ওই মহেন্দ্রা জাইলোর দিকে। সে আস্তে আস্তে সেদিকে এগোচ্ছে এবার।
স্যার হেঁটে হেঁটে এগিয়ে এলেন বাংলোর দিকে। অসিত চট করে অন্ধকারে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়াল। স্যারের গতিবিধি নজরে রাখতে হচ্ছে। ওই প্রাণীটা স্যারকে কিছু করল না কেন?
অতুলবাবু নিজের গবেষণাঘরে ঢুকে কিছু একটা নিয়ে বের হলেন। অস্পষ্ট হলেও অসিত বুঝল স্যারের হাতে একটা খাঁচা। তাতে একটা ছোটো প্রাণী নড়াচড়া করছে। তিনি আবার মই বেয়ে নীচে নেমে গিয়ে খাঁচার দরজা খুলে দিলেন। তারপর অত্যন্ত দক্ষ হাতে বুকপকেট থেকে একটা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ বের করে প্রাণীটির শরীরে পুশ করলেন। তারপর ছেড়ে দিলেন তাকে। ছাড়া পেয়েই প্রাণীটা তড়িঘড়ি পাশের ঝোপে ঢুকে পড়ল।
একটা গুইসাপ!
অসিত লক্ষ করল, সেই বিরাটাকার প্রাণীটা এবার ওই ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার শরীরে এখন পূর্ণ জ্যোৎস্নার আলো। চমকে উঠল অসিত। এ তো ইন্দোনেশিয়ার জঙ্গলের সেই বিখ্যাত কোমোডো ড্রাগন? এ এখানে কী করে এল! অতুলবাবু যে কখন উঠে অসিতের একদম পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তা বুঝতেই পারেনি সে।
“গুইসাপ বড়ো হলে কত ভয়ংকর হয়ে ওঠে, তা-ই না অসিত?”
হতবাক অসিত স্যারের দিকে তাকাল। অন্ধকারে তার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
“ভ্যারানিডি গোত্রের প্রাণী এটি। ছোটো সাইজ় গুইসাপ। বড়ো হলেই দেখতে সেই বিখ্যাত কোমোডো ড্রাগনের মতো লাগে। কেউ ছোটো থাকলে কত নিরীহ আর বড়ো হলেই কত ভয়ানক হয়ে যায়!” নিজের মনেই বলে চলেছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ফরেস্ট রেঞ্জার অতুল সুর।
“এতদিনকার পরিশ্রমের পর অবশেষে আমি আবিষ্কার করেছি সেই ওষুধ। জাস্ট জেনেটিক মডিফিকেশন। মানুষ ওদের আইন করেও বাঁচাতে পারবে না। নিজেদেরই আত্মরক্ষা শিখতে হবে ওদের। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। তাই ওদের ফিটেস্ট বানিয়ে দিলাম আমি।”
অসিত অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে, সেই হোঁতকামতো লোকটা ছুটে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়তে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কারণ সেদিকের জঙ্গল থেকেও এবার আরেকটি কোমোডো ড্রাগনসদৃশ গুইসাপ বেরিয়ে এসেছে।
তারপর আরেকটি।
তিনটি প্রাণী তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে ওদের। অসহায় মানুষগুলোর অন্তিম অবস্থা আসন্ন। গাছ কেটে কেটে যে জায়গাটা ফাঁকা মাঠের মতো হয়ে আছে, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে লোকগুলো। একটা গুইসাপ এবার এগিয়ে গিয়ে বিরাট ল্যাজের এক ঝটকায় মহেন্দ্রা জাইলোকে উলটে ফেলে দিল। তারপরই শুরু হল প্রকৃতির নিষ্ঠুর বাস্তুতন্ত্র। মানুষ তিনটির অন্তিম আর্তনাদে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। চোখ ফিরিয়ে নিল অসিত সঙ্গে সঙ্গে। এ ভয়ংকর দৃশ্য সিনেমায় দেখা যায়। বাস্তবে তা প্রত্যক্ষ করা অসম্ভব!
ছয়
“ডুয়ার্সের যেসব জায়গায় গুইসাপ পাওয়া যায়, সব জায়গায় ওদের ছেড়ে দিয়েছি। এরপরে সুন্দরবনেও ছেড়ে আসব। আমার এই যুগান্তকারী আবিষ্কারই মানুষের অপরিসীম লোভের হাত থেকে নিরীহ প্রাণীগুলোকে বাঁচাতে পারবে।”
গর্বিত গলায় বলে উঠলেন অতুল সুর। চারদিকের পরিবেশ থমথমে হয়ে আছে। গুইসাপেরা এখনও তাদের আহার শেষ করেনি।
ভীষণই উত্তেজিত হয়ে অসিত বলল, “কিন্তু স্যার, এরা তো মানবসভ্যতার পক্ষে ভয়ংকর হয়ে দাঁড়াবে? মানুষেরা বাঁচতেই পারবে না আর!”
অসিতের প্রশ্নে তার দিকে ফিরলেন অতুল সুর। তারপর গভীর নিশ্বাস ফেলে বললেন, “কী করব, বলো! মানুষ নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে যা ইচ্ছা তা-ই করেছে। তাদেরকে শাস্তি কে দেবে? তাদেরও তো লোভের একটা সীমারেখা দরকার। এই নিরীহ প্রাণীগুলো বাদ দাও, শুধুমাত্র ছবি আঁকার জন্য যে তুলি, সেই তুলির জন্য প্রতিবছর গড়ে কত বেজি হত্যা করা হয়, তুমি জানো? ১ লক্ষ! বেজি আজ একেবারেই প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে। এভাবে মানুষ সবাইকে শেষ করে দিতে থাকবে—এ তো আর চোখের সামনে বসে দিনের পর দিন দেখা যায় না!”
“কিন্তু এটা তো পাগলামো, স্যার! আপনি এই প্রাণীদেরকে বাঁচানোর জন্য এভাবে মানবসভ্যতাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারেন না!”
অসিত অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না, তার প্রাইভেট টিউশনের স্যার এরকম মারাত্মক একটা জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছে, যার ভয়ংকর পরিণতির কথা চিন্তা করলে মাথা খারাপ হয়ে যায়!
“এখনও পর্যন্ত এরা আমার নিয়ন্ত্রণেই আছে। আমার দেখানো শত্রুদেরই ওরা নিকেশ করেছে। সমস্ত পাচারকারীকেই আমি ধরে ধরে হত্যা করব!” দাঁত চিপে চিপে রীতিমতো গজরাতে গজরাতে তিনি বললেন।
“কিন্তু এতেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে? যারা গাছ কাটে, তাদের সংখ্যা তো প্রচুর!”
“আমি গাছের শরীরেও একটা কেমিক্যাল ইনজেকশন দিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছি। নিরীহ গাছকে রাক্ষুসে গাছ বানানোর পরীক্ষা। কেউ গাছ কাটতে এলেই গাছ তাকে খেয়ে ফেলবে। কী ভালোই-না হবে! আর কয়েকদিনের মাত্র ব্যাপার। আমি এটাও আবিষ্কার করে ফেলতে পারব। হা হা হা হা হা!”
এ কথা শোনার পর অসিত আর কোনো কথা না বলে নীচে নেমে এল। এই পাগল বিজ্ঞানীর সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। এই অতুল স্যারকে সে চেনে না। এক্ষুনি গিয়ে প্রশাসনকে জানাতে হবে এই পাগলামির কথা। এখনও সময় আছে সবাইকে বাঁচানোর।
“তুমি এখন কোত্থাও যাবে না, অসিত। ওরা কিন্তু এখনও এখানেই আছে। আমার কথার অবাধ্য হলেই ওরা রেগে যায়। তোমার বেঁচে থাকাটা অত্যন্ত জরুরি! নয়তো আমার এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা কে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেবে!”
উপর থেকে বিদ্রুপের স্বরে চিৎকার করে উঠলেন অতুল সুর। তাঁর কণ্ঠে এখন উন্মাদনা প্রকাশ পাচ্ছে। তার মানে এইজন্যই এত জরুরি তলব দিয়ে তাকে এখানে ডেকে আনা! কিন্তু এ খবর প্রকাশিত হলে তো স্যারই বিপদে পড়বেন!
চাবিটা নিয়েই নেমেছিল অসিত। স্যারেরই ব্যাটারিচালিত জিপের। ড্রাইভিং সিটে বসে ইগনিশনে চাবি ঢোকাল। যেভাবেই হোক, তাকে এখান থেকে পালাতে হবে। এই নারকীয় ঘটনা থামাতেই হবে তাকে।
কিন্তু গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। হঠাৎ অসিত দেখতে পেল, একটা বড়োসড়ো আকারের গুইসাপ গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। এটাই কি স্যারের সেই ছেড়ে-দেওয়া গুইসাপটা? এর গায়েই কি স্যার সেই ইনজেকশনটা পুশ করেছিল? এত তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে গেল কী করে সেটা?
অন্তিম মুহূর্তে গাড়িটা স্টার্ট নিতেই ছুটিয়ে দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে বড়ো গুইসাপটা তাকে তাড়া করে গাড়ির পেছনে পেছনে ছুটল। সামনের ওই অতিকায় কোমোডো ড্রাগনের মতো প্রাণীগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু তার পেছনে ছুটে আসছে প্রতিমুহূর্তে বৃহৎ-হতে-থাকা ভ্যারানিডি গোত্রের কোমোডো ড্রাগনরূপী সেই ‘গুইসাপ’।
“বাঁচাও অসিত, বাঁচাও। দেখি, লোভী মানবসভ্যতাকে বাঁচানোর তোমার কত ক্ষমতা! বাঁচাও!”
জ্যোৎস্নার কুচিকুচি আলোয় জঙ্গলের টংঘরের বাংলো থেকে অরণ্যপ্রেমী উন্মাদ বিজ্ঞানী কাম ফরেস্ট রেঞ্জার অফিসার অতুল সুরের অট্টহাসি চারদিকের জঙ্গলে প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এই হাসি যেন সম্রাট নেরোর হাসি।
অসিত জানে না, সে পালাতে পারবে কি না। কিন্তু চেষ্টা করতে হবে। হ্যাঁ হ্যাঁ, করতেই হবে। সমস্ত জীবজগৎ যদি এভাবে মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করে তাহলে সত্যিই মানুষের আর বেঁচে থাকা হবে না। অতুল সুর আবার তাদেরকে আদিম যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। যে যুগের আইন বড়ো নিষ্ঠুর ও একরোখা। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট।
গল্পের আবহ তৈরির খাতিরে কিছু নৃশংসতার উল্লেখ থাকলেও, তা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর চিন্তাকে প্রচার করার উদ্দেশে লেখা নয়। লেখক পরিবেশপ্রেমী। কাহিনিতেও সেটারই বিচ্ছুরণ আছে।
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, রঙ্গন রায়