ড. রবি রায়ের বক্তৃতা
লেখক: নিরঞ্জন সিংহ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
গতকাল ড. রবি রায়ের সঙ্গে মেক্সিকো সিটি শহরে এসে পৌঁছেছি। কয়েকদিন বাদে এখানে এক বিরাট বিজ্ঞান অধিবেশন শুরু হচ্ছে। আমি একজন বিজ্ঞান-সাংবাদিক। এই সুদূর দেশে আসার উদ্দেশ্য বিজ্ঞান অধিবেশনকে কভার করা। কাগজের সম্পাদক মশায় আমাকে এত খরচপত্র করে পাঠাতেন কি না সন্দেহ। কারণ কোনো বিজ্ঞান অধিবেশন কভার করার কোনো দায়িত্ব কোনো দৈনিক সংবাদপত্রের আছে বলে কোনো সম্পাদকই মনে করেন না। আমার মেক্সিকো সিটি আসার পিছনে রয়েছে ড. রবি রায়ের হাত।
ড. রবি রায়ের পরিচয় নতুন করে দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। বৈজ্ঞানিক মহল থেকে সাধারণ মানুষও এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষটির নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। মেক্সিকো সিটির বিজ্ঞান অধিবেশনে ড. রবি রায়ও আমন্ত্রিত হয়েছেন। কথাটা ওঁর মুখ থেকেই শুনলাম আমি। এত বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং যথেষ্ট ব্যস্ত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও উনি আমার মতো একজন সাধারণ সাংবাদিককে বড্ড ভালোবাসেন। এ আমার পরম সৌভাগ্য৷ আমার বিজ্ঞান-সাংবাদিক হিসেবে একটু নাম-টাম করার পিছনে ড. রায়ের অবদান সব চাইতে বেশি।
প্রথম জীবনে, আমি যখন এ কাগজ-ও কাগজে পপুলার সায়েন্সের ফিচার-টিচার লিখতাম, সেই সময় হঠাৎ এক বিজ্ঞানপত্রিকার সম্পাদক বললেন যে আমি যদি ড. রবি রায়ের একটা সাক্ষাৎকার জোগাড় করতে পারি তাহলে উনি সাগ্রহে তা ওঁর কাগজে ছাপবেন এবং একটু ভালো সম্মানদক্ষিণাও দেবেন।
ড. রবি রায় সম্পর্কে তখন আমি বিশেষ কিছু জানতাম না। তবে এইটুকু শুনেছিলাম, নোবেল পুরস্কারের জন্য ওঁর নাম ওঠার সম্ভাবনা যথেষ্ট। যা হোক, অল্প বয়সে সাহসটা একটু হয়তো বেশিই থাকে। ব্যাপারটা আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ বলে মনে হল। বিশেষ কিছু ভাবনাচিন্তা না করেই ড. রবি রায়ের বাড়ি গিয়ে একদিন হাজির হলাম।
আমাকে বসতে বলে জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? আমি ওঁকে সব কথা খুলে বললাম।
সাক্ষাৎকার! আমার সব কথা শুনে যেন একটু বিব্রত হয়ে কথাটা উচ্চারণ করলেন ড. রবি রায়।
আমি একটু দমে গেলাম। ভাবলাম, এবার বোধহয় না করে দেবেন। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলেন, আজ তো হবে না। তুমি এক কাজ করো, আগামী রবিবার সকাল দশটায় চলে এসো।
আমি কৃতার্থ হয়ে নমস্কার করে উঠে পড়লাম। এবং পরের রবিবার ড. রায়ের বাড়ি গেলাম সময়মতো। সেই শুরু। সাক্ষাৎকার নেওয়া কাকে বলে, তার কিছুই তখন ভালো জানতাম না। ড. রায় আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করলেন সাক্ষাৎকার নেওয়ার ব্যাপারে। সেই সাক্ষাৎকার পেয়ে সম্পাদক মশাই তো প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। ছাপা হল পরের সংখ্যায়। আমারও একটু নাম-টাম হল। কিন্তু এরপর থেকে ড. রবি রায় আমাকে যে কী চোখে দেখলেন, তা ভগবানই জানেন। আমি হয়ে গেলাম ওঁর ভক্ত-শিষ্য। আমার বহু লেখায় যে ওঁর কলমের ছোঁয়া আছে, তা অনেকেই জানেন না।
যা হোক, আসল কথায় আসি। এই অধিবেশনে আসার জন্য আমার সম্পাদক মশাইকে বলে দিলেন উনি। তাতেই কাজ হল। পাসপোর্ট করাই ছিল; ভিসা, প্লেনের টিকিট আর রিজ়ার্ভ ব্যাংক থেকে ফরেন এক্সচেঞ্জের সব ব্যবস্থাই সুষ্ঠুভাবে করে দিলেন অফিসের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়।
কলকাতা থেকে রওনা হওয়ার দু-দিন আগে ড. রায় যা বললেন, তা শুনে সাদা কথায় আমার পিলে চমকে উঠল। আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে বিজ্ঞানীমহলেও এরকম হিন্দি সিনেমার ভিলেনের মতো ভিলেনরা রয়েছেন।
ড. রায়ের কথা শুনে নিশ্চয়ই আমার মুখের অবস্থা খুব করুণ হয়ে উঠেছিল। ড. রায় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনের অবস্থা এক মুহূর্তে বুঝে ফেলেছিলেন। তারপর বলে উঠেছিলেন, কী ব্যাপার, জয়ন্ত! মনে হচ্ছে, আমার কথা শুনে তুমি খুব ভয় পেয়ে গেছ?
ভয় যে পেয়েছি, সে কথা গোপন করে কোনো লাভ নেই। বললাম, হ্যাঁ, স্যার। আপনার কথা শুনে সত্যিই ভীষণ ভয় করছে। যে লোকটা আপনাকে এরকম সাংঘাতিক চিঠি লিখতে পারে, সে যে কী সাংঘাতিক লোক তা আন্দাজ করতে পারছি।
ড. রায় আমার পিঠে চাপড় মেরে বললেন, এইটুকু সামান্য ব্যাপারে ভয় পেয়ে গেলে বড়ো সাংবাদিক হবে কী করে? তারপর একটু হেসে বললেন, ঘাবড়িয়ো না, ভয়ের কিছু না। যে ব্যাটা এই চিঠি লিখেছে, সে কিছু করতে পারবে না। অধিবেশনে আমি নির্বিঘ্নে বক্তৃতা দিয়ে আসব।
ড. রায়ের কাছ থেকে চিঠিখানা চেয়ে নিয়ে ভয়ে ভয়ে চোখ বুলোলাম:
ড. রবি রায় সমীপেষু,
আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি যে আপনি মেক্সিকো সিটির বিজ্ঞান অধিবেশনে বক্তৃতা করতে আসছেন। একটা কথা আপনাকে পরিষ্কারভাবে জানাতে চাই, তা হচ্ছে, আপনার সাম্প্রতিকতম আবিষ্কারের ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট খবর সংগ্রহ করেছি এবং ওই আবিষ্কার সম্পর্কে আমরা বিশেষভাবে আগ্রহী। এ সম্পর্কে আপনি আগেও আমাদের চিঠি পেয়েছেন; কিন্তু তার কোনো জবাব আপনি দেননি। তাই স্বাভাবিকভাবে আমরা ধরে নিচ্ছি যে আপনি আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে রাজি নন। ব্যাপারটা আমরা মোটেও ভালো চোখে দেখছি না এবং আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করার ফলও হাতেনাতেই পাবেন। মেক্সিকো সিটির অধিবেশনে আপনি বক্তৃতা দিতে পারবেন না।
শেষবারের মতো আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, এখনও ভেবে দেখুন। আপনার আবিষ্কার সম্পূর্ণ আমাদের হাতে তুলে দেবেন কি না। টাকার অঙ্ক সম্পর্কে কোনো আলোচনায় আগ্রহী থাকলে জানাবেন।
ইতি—এক্স
বক্স নম্বর 110, মেক্সিকো টাইমস।
এইরকম একখানা ভয়ংকর চিঠি পেয়েও ড. রবি রায় এতটুকু ভয় পাননি, এটা লক্ষ করে আমি বেশ অবাক হলাম। আমিও এবার মনে একটু সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করলাম।
চিঠিটা ড. রায়কে ফেরত দিয়ে বললাম, লোকটা কে হতে পারে, তা কি আপনি বুঝতে পেরেছেন, স্যার?
ড. রায় একটু রহস্যময় হাসি হেসে বললেন, এইসব মহাপুরুষকে কি চট করে চেনা যায়? এরা হচ্ছে বর্ণচোরা আম। তা ছাড়া যে চিঠি দিয়েছে, সে হয়তো ভাড়াটে গুন্ডা। পিছন থেকে কে যে কলকাঠি নাড়ছে, তা বলা বেশ মুশকিলের ব্যাপার।
—তাহলে কী হবে, স্যার?
—কী আবার হবে? কোনো গুন্ডার হুমকি কি কোনো সত্যিকারের বিজ্ঞানীকে তার কাজ থেকে সরিয়ে রাখতে পারে? আর তা ছাড়া তুমি তো সঙ্গে থাকছ তাহলে আর ভয়টা কীসের? বলে আবার হাসলেন ড. রায়।
এ কথা শুনে আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করলাম, এই লোকটা আগেও আপনাকে চিঠি দিয়েছিল?
—হ্যাঁ, সুপার-কনডাকটিভিটি নিয়ে যে গবেষণা আমি চালিয়ে যাচ্ছিলাম, সেই ব্যাপারে এই লোকটা বা দলটা যথেষ্ট আগ্রহী।
—সুপার-কনডাকটিভিটির উপরেই তো আপনি অধিবেশনে বক্তৃতা দেবেন, তা-ই না স্যার?
—হ্যাঁ।
—কিন্তু লোকগুলো৷ সুপার-কনডাকটিভিটি সংক্রান্ত গবেষণার সব কিছু কেনার জন্য টাকার লোভ অথবা প্রাণের ভয় দেখাচ্ছে কেন? প্রশ্ন করলাম আমি।
—কারণ এর একটা বিরাট ব্যাবসায়িক দিক রয়েছে। বললেন ড. রায়।
—সে তো আপনাকে রয়ালটি দিতেও করতে পারে।
—আসলে কী জানো জয়ন্ত, পৃথিবীতে কিছু মানুষের লোভ হয় আকাশ-ছোঁয়া। টাকা ও সুনাম দুইই তারা পুরোপুরি হজম করতে চায়৷
—আপনি ব্যাপারটা পুলিশে রিপোর্ট করেছেন কি?
ড. রায় একটু হেসে বলেছিলেন, পুলিশ এ ব্যাপারে এক্ষুনি আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারবে না। তবে সময়মতো সব ওদের জানাতেই হবে।
মেক্সিকো সিটির আবহাওয়া প্রায় আমাদের দেশের মতো। এখানে যখন দিন বারোটা, তখন ভারতে রাত বারোটা। একপাশে প্রশান্ত মহাসাগর, অন্যদিকে গাল্ফ অব মেক্সিকো। সেটা পেরুলেই আটলান্টিক মহাসাগর। এই সেই লাতিন আমেরিকা। কিছু দূরেই রয়েছে বিখ্যাত মায়া সভ্যতার প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ। এখন অনেক পণ্ডিত বলছেন যে এই দেশই ছিল নাকি আমাদের পৌরাণিক পাতাল৷
যা হোক, একটা চোদ্দোতলা হোটেলে কনফারেন্সের বিজ্ঞানীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ড. রবি রায়ের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য স্থানীয় কাগজের এক সাংবাদিক যোগাযোগ করতেই ওকে জানিয়ে দিলাম যে উনি একা কোনো সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেন না। ভদ্রলোক একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ফোন ছেড়ে দিলেন।
ড. রায় আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন অধিবেশনের পর মায়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য চিচেনইৎজা, জিবিল, সুলতান প্রভৃতি জায়গা দেখিয়ে নিয়ে আসবেন। আমি তো দারুণ খুশি হলাম।
সেই মারাত্মক চিঠিটার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ সে রাতে বাইরে থেকে ঘুরে এসে হোটেলের ঘরে ঢুকে আমরা রীতিমতো চমকে উঠলাম। সারা ঘর কেউ যেন ওলট-পালট করে রেখেছে। দেখলেই বোঝা যায়, কোনো লোক বিশেষ কিছুর জন্য এরকমভাবে সব কিছু তছনছ করেছে।
আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোনে ম্যানেজারকে আমাদের ঘরে আসতে বললাম। ভদ্রলোক সব দেখেশুনে রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে প্রায় ড. রবি রায়ের পায়ে ধরার উপক্রম। পুলিশে সব জানালে তার হোটেলের বদনাম হয়ে যাবে। দেশের বদনাম। যা ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দিতে লাগল ভদ্রলোক বারবার।
ড. রায় সব ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, আমার পেপারটাই ওরা চুরি করতে এসেছিল বলে মনে হচ্ছে। অন্য কিছুই টাচ করেনি।
শুনে তো আমি চমকে উঠলাম। মনে পড়ল সেই মারাত্মক চিঠির কথা। তাহলে ওরা আমাদের পিছু নিয়ে হোটেল পর্যন্ত ধাওয়া করেছে।
ম্যানেজার নিজে খোঁজখবর করে যেটুকু উদ্ধার করতে পারল, তাতে জানা গেল, আমরা যখন বেরিয়ে গিয়েছিলাম, সেই সময় একজন সাংবাদিক আমাদের খোঁজ করে। আমরা ঘরে নেই শুনে লবির সোফায় বসে অপেক্ষা করতে থাকে। তারপর আর রিসেপশনিস্ট লক্ষ রাখেনি।
গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় দেখলাম, একজন লোক খুব দ্রুতহাতে আমাদের সব জিনিসপত্র তন্নতন্ন করে খুঁজছে৷
কী চাও তোমরা? চিৎকার করে উঠলেন ড. রবি রায়। যে লোকটা জিনিসপত্র ঘাঁটছিল, সে তার কাজ থামিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ড. রায়ের দিকে।
—আমরা কী চাই, তা তোমার অজানা নয়, ড. রায়। ভালোয় ভালোয় বক্তৃতার কপিটি আমাদের হাতে তুলে দাও।
—সে তো তোমরা দুপুরে এসে নিয়ে গেছ৷
—না, আমরা কোনো কাগজপত্র খুঁজে পাইনি। তাই আসতে হল।
—তাহলে ভালো করে শোনো। বক্তৃতার কোনো টাইপ কপি তোমরা পাবে না। কারণ তা আমি তৈরি করিনি।
—তাহলে কি স্মৃতি থেকে বক্তৃতা দেবেন ড. রায়? লোকটা ব্যঙ্গ করে উঠল।
—ঠিক তা-ই। আমার স্মৃতিশক্তি খুব একটা খারাপ নয়। আর তা ছাড়া এই প্লেটটা আছে, বলে বিছানার নীচে থেকে পোস্টকার্ড সাইজ়ের একটি বিচিত্র প্লেট বের করলেন ড. রায়।
যে লোকটা দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সে আরও শক্ত হয়ে উঠল। অন্য লোকটি চিতাবাঘের মতো লাফিয়ে এসে পড়ল ড. রায়ের ঘাড়ের উপর। উদ্দেশ্য ওই বিচিত্র প্লেটখানা কেড়ে নেওয়া। সঙ্গে সঙ্গে ড. রায় একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলেন, প্লেটখানা জোরে ছুড়ে দিলেন ঘরের দেওয়ালে। প্লেটখানা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
আমি নিজের অজান্তেই বোধহয় চিৎকার করে উঠেছিলাম। লোকটা দ্রুত ফিরে ওর হাতের রিভলভারের বাঁট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করল। আমি বিছানা থেকে উলটে পড়ে গেলাম মেঝের উপর। তারপর আর কিছু জানি না। জ্ঞান ফিরলে পর দেখলাম, ড. রায় মাথার কাছে বসে আছেন। মনে গভীর উৎকণ্ঠা! সম্মেলন কি হয়ে গেছে? ড. রায় ইশারায় আশ্বস্ত করলেন, সম্মেলন হয়নি, বক্তৃতাও উনি ঠিকই দেবেন।
অধিবেশনের দিন মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলাম। ড. রায়ের বক্তৃতা শুনতে গেলাম। ড. রায় সুপার-কনডাকটিভিটির উপর এক দীর্ঘ ও বিশদ বক্তৃতা দিলেন। বিজ্ঞানীমহল হতভম্ব অধিবেশনকক্ষে সুচ পড়লেও বোধহয় তখন তার শব্দ শোনা যেত। বক্তৃতা শেষ হতেই হাততালি আর অভিনন্দনের পালা শুরু হল। কিন্তু তার মধ্যেই ড. রায় মঞ্চ থেকে নেমে আমাকে নিয়ে খুব দ্রুত হোটেলে ফিরে এলেন। প্লেনের টিকিটেরও সব ব্যবস্থা উনি দেখলাম, আগে থাকতেই করে রেখেছিলেন। হোটেল থেকে চটপট বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা এয়ারপোর্টে ছুটলাম আমরা।
আমি কিছু বলার আগেই ড. রায় বলে উঠলেন, এবার তোমাকে মায়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ দেখাতে পারলাম না। এখন আমাদের পালাতে হচ্ছে। না হলে হয়তো ভাগ্যে আছে বুলেট, বুঝেছ?
এ কথা না-বোঝার মতো বোকা আমি নই। প্রাণ বড়ো প্রিয়, সে কথা ক-দিন আগে খুব ভালো করেই বুঝেছিলাম।
নির্বিঘ্নে প্লেনে উঠে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। ড. রায় বললেন, আপাতত নিশ্চিন্ত।
—স্যার, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
ড. রায় একটু হাসলেন। বললেন, আমি জানি, তুমি কী জিজ্ঞাসা করবে। কী করে আমি অধিবেশনে বক্তৃতা শেষ করলাম, তা-ই না?
—হ্যাঁ স্যার। ব্যাপারটা আমার কাছে রীতিমতো রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে।
—রহস্যের বিশেষ কিছু নেই। হলোগ্রাফির ব্যাপারটা জানো তো। বদমাইশদের ভয়ে বক্তৃতার টাইপ কপি তৈরি না করে আমি ওটার হলোগ্রাম তৈরি করেছিলাম। হলোগ্রাম প্লেট দেখে সাধারণভাবে কিছু বোঝা যাবে না। যে ধরনের লেজ়ার বিম দিয়ে হলোগ্রাম তৈরি করা হয়, ঠিক সেই লেজ়ার বিম থাকে রেফারেন্স লাইট বলে, সেই রেফারেন্স লাইটের সাহায্যে হলোগ্রাম প্লেট থেকে পুরো জিনিসটা রিপ্রোডিউস বা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।
—কিন্তু প্লেটটা তো আপনি দেওয়ালে ছুড়ে ভেঙে ফেললেন?
—ওটা ইচ্ছে করেই করেছিলাম। তার কারণ, হলোগ্রামের একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য এই যে সামান্য একটা টুকরো থেকেও পুরো জিনিসটা পুনরুদ্ধার সম্ভব। স্লেটটা ভেঙে যাওয়াতে গুন্ডাটা ওটা নেড়েচেড়ে দেখে কিছু বুঝতে না পেরে ওগুলোয় লাথি মেরে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যায়। এবার আমি নিশ্চিন্ত মনে মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় ওদের হলোগ্রাফ যন্ত্রে আমার বক্তৃতার পুরোটাই উদ্ধার করে নিলাম। তার পরের ব্যাপার তো তুমি জানোই।
প্লেন এতক্ষণে মেঘের উপর উঠে পড়েছে। মায়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ এবার দেখা হল না বলে এখন আর খুব একটা দুঃখ হচ্ছেও না।
প্রথম প্রকাশ: কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, সেপ্টেম্বর ১৯৮৯
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, নিরঞ্জন সিংহ