দেশীয় ভাষায় সায়েন্স ফিকশনের স্থানীয় বিকাশের পথ
লেখক: বক্তা: জোহা কাজেমি অনুবাদ: সর্বান বন্দ্যোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
সম্পাদকের কথা: জোহা কাজেমি ইরানের কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের অন্যতম মুখ। দীর্ঘ দশ বছরে তিনি অসংখ্য ছোটোগল্প ও বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন। জোহার সঙ্গে কল্পবিশ্ব সম্পাদক দীপের আলাপ হয়েছিল ওয়ার্লডকন ২০২৩ সালে। নিম্নলিখিত আলোচনাটি ছিল ওয়ার্লডনের একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের অংশ। জোহা ছাড়াও বাকি অতিথিরা ছিলেন—
১) ফ্রান্সিস জন গুইলেম জিন-রো: ব্রিটিশ সায়েন্স ফিকশন অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক, লন্ডন সায়েন্স ফিকশন রিসার্চ কমিউনিটির প্রধান নেতা এবং ২০২৩ সালে আর্থার সি. ক্লার্ক পুরস্কারের ভাবী বিচারক
২) এমাদ এল-দিন আয়েশা: ফিলিস্তিনি-ব্রিটিশ সায়েন্স ফিকশন লেখক, সাম্প্রতিক বিষয়ের সমালোচক, সাংবাদিক, স্বাধীন গবেষক, অনুবাদক, শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পিএইচডি
৩) তাইয়ো ফুজি: জাপানি সায়েন্স ফিকশন নেবুলা পুরস্কার বিজয়ী, বেস্টসেলিং লেখক
৪) মেই জিফেং ফ্লিক্স মেয়ার জু ভেন: জার্মান সায়েন্স ফিকশন অ্যাক্টিভিস্ট, চিনা অনুবাদক
৫) ওয়াং কানিউ: তরুণ সায়েন্স ফিকশন লেখক এবং চিনা সায়েন্স ফিকশনে নেবুলা পুরস্কার বিজয়ী।
আলোচনার পরে জোহার উত্তরের ট্রান্সক্রিপ্ট থেকে অনুবাদ করা হল নীচের অংশটি। এটি অনুবাদ ও প্রকাশের জন্যে অনুমতি দেওয়ার জন্যে জোহার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আশা করি পাঠকরা এই আলোচনাটি পড়লে বুঝতে পারবেন বেশির ভাগ দেশের কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাস আমাদের ইতিহাসের কতটা কাছের।
ইংরেজিভাষী নয় এমন বেশির ভাগ দেশের কাছে সায়েন্স ফিকশন একটি ‘আমদানিকৃত পণ্য’। কোনো সাংস্কৃতিক সৃজনের সারবত্তাকে প্রায় কখনোই স্রষ্টার সামাজিক অবস্থানজনিত সূক্ষ্ম প্রভাব থেকে আলাদা করা যায় না। যখন বিভিন্ন সময়ে ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে জাপান, কোরিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং অন্যান্য জায়গায় সায়েন্স ফিকশন ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন কীভাবে বিদেশি এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সংঘর্ষে নতুন স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়?
বিষয় ১: সায়েন্স ফিকশনের সঙ্গে প্রথম পরিচয়
মূল বিন্দু: অতিথিরা প্রথম কবে সায়েন্স ফিকশনে প্রবেশ করেন এবং কখন তাঁদের দেশে (ইংল্যান্ড, মিশর, জাপান, জার্মানি, চিন) সায়েন্স ফিকশন প্রথম উপস্থিত হয়?
ভূমিকায় যেমন বলা হয়েছে, অন্যান্য অনেক ধারা ও রূপের কথাসাহিত্যের পাশাপাশি সাই-ফাইও বাস্তবিক পশ্চিম থেকে ইরানে আমদানি হয়েছিল।
আমরা অনুবাদের কাছে ভীষণভাবে ঋণী! ১৯৮০ এর দশক থেকে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানে ধারাবাহিকভাবে সর্বোত্তম ভবিষ্যকল্প সাহিত্যের বই অনুবাদ ও প্রকাশিত হয়ে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, আইজ্যাক আসিমভ, আর্থার সি. ক্লার্ক, রে ব্র্যাডবেরি এবং ফিলিপ কে. ডিকের মতো সাই-ফাই স্বর্ণযুগের লেখকদের লেখা বেশির ভাগ বই পাওয়া যায় এবং ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা ইরানের বাজারে বর্তমান।
দুঃখের বিষয়, ইরান আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইন মেনে চলে না। এর অনেক নেতিবাচক দিক থাকলেও এটা ইরানি প্রকাশক এবং পাঠকদের পক্ষে সুবিধাজনক। ইরানের বাজারে বিখ্যাত পশ্চিমা কিশোর সাহিত্য এবং পুরস্কারজয়ী বইগুলোর প্রকাশের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের হাতে তাদের অনুবাদ চলে আসে।
ইরানি সাই-ফাইয়ের কথা বলতে গেলে, প্রয়াত সাদেগ হেদায়াতের মতো বিখ্যাত কথাসাহিত্যিকরা আমাদের সম্পদ। তাঁরা ১৯৪০ এর দশক থেকে সাই-ফাই ছোটোগল্প লেখার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এই উদ্যোগ সুসংবদ্ধ এবং নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। হেদায়াতের চমকপ্রদ ছোটোগল্পের প্রকাশের পর থেকে এই ধারায় কেবলমাত্র ইতস্তত কিছু বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টাই চোখে পড়ে। কিন্তু গত দশ থেকে পনেরো বছরে ইরানি ভবিষ্যকল্প সাহিত্যের দুর্দান্ত বিকাশ ঘটেছে যা আমি এই প্যানেলে আলোচনা করব।
ব্যক্তিগতভাবে, আমি ক্লার্ক এবং আসিমভের অনুবাদ পড়ে বড়ো হয়েছি, কিন্তু খুব ছোটোবেলায় প্রথম স্টার ওয়ার্স দেখেই সাই-ফাইয়ের ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম।
বিষয় ২: সায়েন্স ফিকশন প্রবর্তনের সংকট
মূল বিন্দু: অ্যাংলো-আমেরিকান থেকে অ-ইংরেজিভাষী দেশে সাই-ফাই নিয়ে যাওয়ার অসুবিধাগুলি কী কী? (যেমন: ভাষা, সামাজিক গঠন, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পার্থক্য…)
বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ এবং ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষা থেকে, এবং আজকাল জাপান ও কোরিয়ার মতো এশিয়ান দেশগুলি থেকে অনূদিত বইয়ের সংখ্যা বরাবরই ইরানের চেয়ে বেশি।
আমাদের পাঠকরা অনূদিত কথাসাহিত্য পড়তে অভ্যস্ত এবং সোশ্যাল মিডিয়ার আগে তাঁরা বই পড়ে এবং সিনেমা দেখে বিভিন্ন দেশ এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে শিখেছেন। তাঁরা অন্যান্য দেশের কাজকে স্বাগত জানান যা বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং জীবনধারার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারে। সুতরাং, পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে এই পরিচিতির সমান্তরালভাবে তাঁদের আন্তর্জাতিক সায়েন্স ফিকশনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতেও কোনো সমস্যা হয় না।
ধারাটির স্থানীয়করণ করতে শুরু করার সময়ে আমরা প্রথম সমস্যার মুখোমুখি হই, যখন ইরানি ব্যক্তি ও স্থান ইত্যাদির নাম ব্যবহার করে আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ধারাটির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। প্রথমে এর বিরোধিতা হয়েছিল। পাঠকরা সাই-ফাই বইতে ব্যক্তিগত পরিসরে পরিচিত নাম এবং ধারণার চিহ্ন দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন না। ব্যাপারটা তাই তাঁদের কাছে অদ্ভুত ঠেকে। অবশেষে তাঁদের চেনা বিভিন্ন উদ্বেগ এবং দ্বন্দ্ব একটি সাই-ফাই গল্পে কীভাবে প্রতিফলিত হতে পারে বুঝতে পেরে, এবং বইগুলিতে চিত্রিত চরিত্রগুলির প্রতি আরও সহানুভূতি অনুভব করতে পেরে, তাঁরা এই বিরোধিতা পরিহার করেন।
আমার উপন্যাস পাইন-ডেড প্রকাশিত হওয়ার সময়ে অনেক পাঠক বলেছিলেন যে তাঁরা বইয়ের ফার্সি নামের সঙ্গে খুব কমই একাত্ম হতে পারছেন; এটি তাঁদের বিশ্রী লাগছে। কিন্তু সেইসঙ্গেই তাঁরা তাঁদের আধুনিক ইতিহাস, বিপ্লব এবং তৎপরবর্তী যুদ্ধ একটি সাই-ফাই গল্পে কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তা দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন এবং ভালোও বেসেছিলেন। সুতরাং, তাঁরা উপন্যাসটিকে একটা সুযোগ দিলেন। যখন কোভিড-১৯ ঘটল, তখন তাঁরা বিষয়টাকে আরও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে শুরু করলেন। বইটাতে একটা বিশ্বব্যাপী মহামারীর কথা আছে, এবং পাঠকরা উপলব্ধি করেন যে এই ধারাটি প্রকৃতই তাঁদের বর্তমান এবং নিকট ভবিষ্যতের সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারে যে সমস্ত সমস্যা নিয়ে তাঁরা হয়তো এখনও সচেতন নন।
ইরানি পাঠকদের এই নতুন ধারার উপর আস্থা রাখতে কিছুটা সময় লেগেছে, এবং এক দশক পরে আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি যে ইরানি পাঠকরা অনুবাদের চেয়ে মৌলিক ইরানি সাই-ফাই পছন্দ করেন বেশি। আমার উপন্যাস দ্য জুলিয়েট সিনড্রোম বাজ পাবলিকেশন্সের বেস্টসেলার, এবং তার বিক্রি বিখ্যাত পশ্চিমা লেখকদের অনুবাদের চেয়ে বেশি। আমরা আমাদের পাঠকদের আস্থা অর্জন করেছি এবং এখন তাঁরা আরও ইরানি ভবিষ্যকল্প সাহিত্য পড়ার আশা করছেন।
বিষয় ৩: সায়েন্স ফিকশন প্রবর্তনের সুযোগ
মূল বিন্দু: সায়েন্স ফিকশন সাহিত্য কীভাবে অতিথিদের দেশ/অঞ্চলে ঢোকার সমস্ত অসুবিধা কাটিয়ে উঠল? এই প্রবর্তনের নেপথ্য কাহিনি কী? (সামাজিক কারণ, সাংস্কৃতিক কারণ, মিডিয়া বিকাশের কারণ…)
ইরানের একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং গৌরবময় সাহিত্য রয়েছে যা দশ শতাব্দীরও বেশি প্রাচীন, কিন্তু ইরানের আধুনিক কথাসাহিত্য আন্দোলন ১৯৪০ এর দশকে বাস্তবসম্মত এবং কখনও কখনও প্রকৃতিনির্ভর গল্প দিয়ে শুরু হয়েছিল, যা ছিল দেশের সামাজিক সমস্যার প্রতিফলন। এই গল্পগুলি বর্তমান পরিস্থিতির খতিয়ান এবং সমালোচনার উপর বেশি মনোযোগ দেয়। বেশির ভাগ ইরানি সমসাময়িক লেখকরা বিশ্বাস করেন যে আমাদের বাস্তবতা সামাজিক সংকটে পূর্ণ, তাই আরও কল্পনার প্রয়োজন নেই। আমরা কেন ভবিষ্যতের কাল্পনিক সম্ভাবনা নিয়ে লিখব, যখন বর্তমান জটিলতার সমাধানই বার করতে পারছি না? বিগত দশক পর্যন্ত এটা ছিল ইরানের কথাসাহিত্য লেখার মানসিকতা ও পদ্ধতির অংশ।
কিন্তু পৃথিবী বদলাচ্ছে। গত তিন দশকে জন্মগ্রহণ করা মিলেনিয়াল এবং জেন জি পাঠকরা আর প্রতিক্রিয়াশীল-বাস্তববাদী কল্পকাহিনির সঙ্গে একাত্ম নন, এবং ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের অবাধ প্রবেশ। তাঁরা আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি এবং ভাষার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং নতুন ও কল্পনাধর্মী সৃজন চান। এঁদের আমলে ভবিষ্যকল্প সাহিত্যের উত্থান অনিবার্য। এই ধারাটি বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সমস্যাগুলিকে আরও সৃজনশীল উপায়ে মোকাবেলা করতে পারে এবং পাঠকরা তা পছন্দ করেন।
ক্রমশ, প্রায় দশ বছর আগে এই নতুন প্রজন্মের দ্বারা ফ্যান্টাসি অ্যাকাডেমির মতো ফ্যান ফিকশন ফোরাম তৈরি করা হয়, এবং সেইসঙ্গে লেখকরা সক্রিয়ভাবে ভবিষ্যকল্প সাহিত্য লিখতে শুরু করেন। যে স্বাধীন প্রকাশকরা ইতিমধ্যে এসএফ অনুবাদগুলি থেকে লাভবান ছিল, তারা এই নতুন উৎসাহী শ্রোতাগোষ্ঠী এবং প্রতিশ্রুতিমান বাজারের আশীর্বাদধন্য ধারার ইরানি লেখকদের সমর্থন করতে শুরু করে।
আমি নিজে দশ বছর আগে সায়েন্স ফিকশন লেখা এবং প্রকাশ করা শুরু করেছি। অন্য লেখকরা (এখনও খুব কম) এই পথে আমার সতীর্থ হয়েছেন।
এই উপস্থাপনার শেষে তাঁদের উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ আপনাদের দেখাতে পারব।
শুধু প্রকাশনাই যথেষ্ট ছিল না। আমাদের বইগুলি সাহিত্য পুরস্কারে গৃহীত হয়নি এবং সমালোচকরা আমাদের রচনাগুলিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কারণ এই ধারা সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা ছিল না। আমরা তবু লেগে থেকেছি, কারণ ভক্ত এবং পাঠকদের প্রতি আমাদের আস্থা ছিল।
পাঁচ বছর আগে, ভবিষ্যকল্প সাহিত্যের জন্য একটি বিশেষ পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়: বছরের সেরা ভবিষ্যকল্প উপন্যাসের জন্য “নুফ” পুরস্কার, যা আমি দু-বার জিতেছি এবং আমার প্রথম সাই-ফাই উপন্যাস পাইন ডেড-ও এর দাবিদারদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।
কিন্তু ধারাটির সম্পর্কে আমাদের কিছু ভুল ধারণা সংশোধন করতে হয়েছিল।
ইরানের বেশির ভাগ পাঠক মনে করেন যে ভবিষ্যকল্প সাহিত্য শুধুমাত্র কিশোর ও তরুণদের জন্য উপযুক্ত; তাঁরা এই ধারাটিকে গুরুত্ব দেন না। অন্য কিছু পাঠক বিশ্বাস করেন যে ভবিষ্যকল্প সাহিত্য আসলে একরকম সাহিত্যমূল্যবিহীন, পলায়নপর সাহিত্য। আমাদের একটা কঠিন কথা প্রমাণ করার দায়িত্ব ছিল যে, ভবিষ্যকল্প সাহিত্যেরও সাহিত্যমূল্য থাকতে পারে এবং তা প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদেরও উপযুক্ত হতে পারে। এই মুহূর্তে আমি বলতে পারি যে আমরা এই লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছেছি, কারণ ভবিষ্যকল্প সাহিত্যের অনুরাগীর সংখ্যা বেড়েছে এবং ভবিষ্যকল্প সাহিত্যের বই কথাসাহিত্যের চেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে।
আমাদের যা অতিক্রম করতে হয়েছে:
● | প্রতিষ্ঠিত কথাসাহিত্যের (সামাজিক-বাস্তববাদী কথাসাহিত্য) প্রবাহের বিপরীতে যাওয়া |
● | অ্যাকাডেমিক এবং সমালোচকদের চূড়ান্ত উপেক্ষা |
● | দর্শকদের বয়স সম্পর্কে ভুল ধারণা (কিশোর ও তরুণ পাঠকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ) |
● | সাহিত্যের মূল্য সম্পর্কে ভুল ধারণা (পলায়নপর সাহিত্য হিসেবে খারিজ) |
● | পুরস্কার এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থনের চূড়ান্ত অভাব |
● | চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য মিডিয়াতে সাহিত্য থেকে রূপান্তরের অভাব |
যা আমাদের পক্ষে গেছে:
● | মিলেনিয়াল এবং জেন জি-এর উৎসাহী এবং অনুরাগী পাঠককুল |
● | অনূদিত সাই-ফাই থেকে লাভবান স্বাধীন প্রকাশক |
● | সোশ্যাল মিডিয়া |
● | নতুন প্রজন্মের লেখকদের উত্থান |
● | নতুন বিশেষ পুরস্কার এবং প্রতিযোগিতার উত্থান |
বিষয় ৪: ‘গ্রামাঞ্চলে’ সায়েন্স ফিকশন
মূল বিষয়বস্তু: বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, সামাজিক গঠন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইত্যাদির বিভিন্ন স্তর রয়েছে। যদি সায়েন্স ফিকশন সাহিত্য এমনকি সায়েন্স ফিকশন শিল্পও তাদের প্রাণশক্তি বজায় রাখতে চায় এবং পুনরুজ্জীবিত হতে চায়, তাহলে সেই সমস্ত ক্ষেত্রেও অনুরূপ রূপান্তরজনিত পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য। এই পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য কী কী? কেন এই পরিবর্তনগুলি ঘটে?
আমি এই প্রশ্নটি এড়িয়ে যাব কারণ তৃতীয় প্রশ্নটির জন্য আমার আরও সময় লাগবে।
বিষয় ৫: সায়েন্স ফিকশনের স্থানীয় বিকাশ
মূল বিষয়বস্তু: বিদেশি সায়েন্স ফিকশনের প্রভাবে, স্থানীয় সায়েন্স ফিকশনের দর্শকরাও ধীরে ধীরে পরিণত হবেন। স্থানীয় সায়েন্স ফিকশন লেখকরা তাঁদের বিকাশের জন্য ব্রিটিশ এবং আমেরিকান সায়েন্স ফিকশন সাহিত্য থেকে কী কী মূল অনুপ্রেরণা পান? অধিকন্তু, কোন কোন নতুন উপাদান ইতিমধ্যেই বিকশিত হয়েছে?
যেহেতু আমরা সাই-ফাই আমদানি করেছি, আমরা সৃজনশীলভাবে আমাদের বর্তমানকে নতুন করে কল্পনা করার এবং ভবিষ্যতের কল্পনা করার এই নতুন ঐতিহ্য নিয়ে এসেছি। পশ্চিমা সায়েন্স ফিকশন প্রায়শই ভবিষ্যৎ এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সম্পর্কে অনুমান করে। ইরানের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক সমস্যার কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর মতো ভবিষ্যৎকে সেভাবে দেখা হয় না। ইরানি লেখকরা এই ধারার বিভিন্ন উপধারাকে কাজে লাগিয়ে তাঁদের নিজস্ব থিমগুলিকে তাঁদের সায়েন্স ফিকশন গল্পে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করেছেন যা তাঁদের পক্ষে সবচেয়ে বেশি উপকারী হতে পারে। অতএব, শেষ উপস্থাপনায় দেখা গেছে (অন্তত এখন পর্যন্ত) ইরানি সাহিত্যে রচিত বেশির ভাগ সাই-ফাই-ই হল ডিস্টোপিয়ান ফিকশন।
এই উপধারাটি ইরানি পাঠকদের মধ্যে এতটাই জনপ্রিয় যে গত কয়েক বছরে জর্জ অরওয়েলের 1984 সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। এছাড়াও, দ্য হাঙ্গার গেমস, দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল এবং অন্যান্য ডিস্টোপিয়ান ফিকশন এখানে খুব জনপ্রিয়।
ডিস্টোপিয়ান কথাসাহিত্য আমাদেরকে একটি পুনঃকল্পিত সমাজ তৈরি করতে দেয় যেখানে আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি তাদের জয় করার বিভিন্ন পদ্ধতির চর্চা করতে পারি এবং নিজেদের গভীর ভীতির জায়গাগুলোকেও খতিয়ে দেখতে পারি।
আপনারা জানেন যে ইরানে আমাদের কঠোর সেন্সরশিপ রয়েছে। তবে সাই-ফাই গল্পে নতুন প্রযুক্তি ও পুনঃকল্পিত সমাজের আড়াল আমাদেরকে নিরাপদ রাখে। আমরা এর সুবিধা নিয়ে থাকি এবং নিজেদের সামাজিক-রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় উদ্বেগ এবং সমালোচনাগুলিকে একটি আপাত-অপরিচিত বিশ্বের গল্পে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করি।
এই উপশৈলীতে মনোযোগ দিয়ে আমরা উত্তেজনাপূর্ণ (এবং ভয়ানক) নতুন উপাদান খুঁজে পেয়েছি যা সমাজকে ডিস্টোপিয়ার দিকে নিয়ে যেতে পারে। আমাদের গল্পগুলিতে উপস্থাপিত কিছু কাল্পনিক প্রযুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি অনন্য এবং মৌলিক কারণ সেগুলি বর্তমানের অশান্ত মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের বসবাসের ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে।
এআই নির্মাণ, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি অন্যান্য উপধারাগুলির ক্ষেত্রে আমরা কল্পনা করি আমাদের ভৌগোলিক অঞ্চলে সেই সমস্ত বিষয়ের প্রভাব কেমন হতে পারে। আমাদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা এই কল্পনার অঙ্গ।
বিষয় ৬: ইংরেজিভাষী নয় এমন দেশগুলিতে সায়েন্স ফিকশনের প্রভাব (সায়েন্স ফিকশনের বিশ্বায়ন)
মূল বিন্দু: অ-ইংরেজিভাষী দেশগুলিতে বিকশিত, স্থানীয় স্বাদে সমৃদ্ধ সায়েন্স ফিকশন কি অ্যাংলো-আমেরিকান সায়েন্স ফিকশনকে কিছুটা হলেও প্রতিহত করবে এবং সায়েন্স ফিকশনের উৎপত্তিস্থলেই সায়েন্স ফিকশনের উপর প্রভাব ফেলবে? কীভাবে বিভিন্ন ভাষা, দেশ এবং অঞ্চলে সাই-ফাইয়ের বিকাশ বিশ্বব্যাপী সাই-ফাইয়ের বিকাশে অবদান রেখেছে?
পশ্চিমা সায়েন্স ফিকশনের কণ্ঠস্বর দীর্ঘ সময় ধরে প্রভাবশালী ছিল, যা পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করত এবং বিশ্বের বাকি অংশকে করত অবজ্ঞা। কিন্তু বাস্তব হল এটাই যে ভবিষ্যৎ আমাদের সবার। মানবজাতির এক বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে বাদ দিয়ে আঁকা ভবিষ্যতের ছবি অন্যায় এবং অপূর্ণ বলে মনে হয়। এছাড়াও, নিজেদেরকে পশ্চিমা সায়েন্স ফিকশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করলে আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতির বাইরে তৈরি হওয়া অনেক নতুন স্বাদ এবং মূল ধারণা থেকে বিশ্বকে বঞ্চিত করব। এর বিপরীতে সাই-ফাইয়ের বিশ্বায়ন তাকে পুনরাবৃত্তিমূলক ধারণা এবং কল্পনার মধ্যে অনন্তকাল আবর্তিত হওয়া থেকে বাঁচাবে এবং তার সীমানার প্রসারে সাহায্য করবে।
এইভাবেই সাই-ফাইয়ের বিশ্বায়ন, সমগ্র মানবজাতিকে একত্র করবে, আমাদেকে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন করবে এবং বৈশ্বিক সমস্যাগুলি কাটিয়ে উঠতে একসঙ্গে কাজ করতে উৎসাহিত করবে।
আজকাল, সমস্ত জাতি এবং লিঙ্গকে মর্যাদা দেওয়ার একটি বিশ্বব্যাপী আহ্বান প্রচারিত হয়ে থাকে। আমরা সমস্ত সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছি। ইরানের মতো স্বল্প প্রতিনিধিত্বের দেশগুলির মানুষের কণ্ঠস্বর যদি আমরা ছড়িয়ে দিতে পারি তবে তা হবে এক দুর্দান্ত পদক্ষেপ। আমার ধারণা আমাদের দেশের বাইরের অনেক মানুষই জানত না যে ইরানেও স্বাধীন সাই-ফাই লেখক আছে। বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমে আমাদের নিয়ে যা দেখানো হয় তা হল মধ্যপ্রাচ্যের অন্তহীন সংগ্রাম। কিন্তু সায়েন্স ফিকশন লেখক হিসেবে, আমরা সবাই সায়েন্স ফিকশনের বৈশ্বিক অগ্রগতিতে এবং তজ্জনিত বৈশ্বিক সমৃদ্ধির আনয়নে সাহায্য করতে চাই। যদি আমাদের বিশ্ব বাজারে সুযোগ দেওয়া হয়, আমরা হয়তো এই ধারায় অবদান রাখতে এবং নতুন কিছু দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে সক্ষম হতে পারি।
আমি ব্যক্তিগতভাবে আজকের এই প্যানেলে অংশ নেওয়ার এবং ইরানের সাই-ফাই কাজগুলি সম্পর্কে কথা বলতে সক্ষম হওয়ার সুযোগটির মূল্য সম্পর্কে সম্যক অবহিত।
আমি আশা করি যে ইরানি সাই-ফাই লেখকরা তাঁদের কাজ বিশ্ব বাজারে পৌঁছানোর সুযোগ পাবেন; সকলে আমাদের গল্প পড়ার এবং আমাদের কণ্ঠস্বর শোনার সুযোগ পাবেন।
Tags: জোহা কাজেমি, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সর্বান বন্দ্যোপাধ্যায়