দক্ষিণদেশ
লেখক: বিশ্বদীপ সেনশর্মা
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর সময়ে বেঁচে আছি। এই এক আশ্চর্য সময়। যখন আশ্চর্য বলে কোনো কিছু নেই।”
এক
ইথানের আজ ফিরতে দেরি হল। তার খেতে আবার পোকার উৎপাত শুরু হয়েছে। নিয়মমতো এক মাস আগেই স্প্রে করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, যে-কোনো কারণেই হোক, ভালো কাজ হয়নি। অগত্যা গাড়ি চালিয়ে পাশের শহর থেকে কেমিক্যাল কিনে এনে মুখোশ পরে কয়েক ঘণ্টা ধরে সে কাজটা করল। এই শীতের দুপুরেও ঘাম ছুটে গিয়েছিল। এসব কাজের জন্য লোক ডাকার ক্ষমতা তার নেই। এমনিতেই খরচখরচা বাদ দিয়ে ফসল ঘরে তুলে ক-পয়সাই-বা থাকে?
আভা দরজা খুলে তার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে হাসিমুখে বলল, “ইশ্, আজ খুব খাটুনি গেছে মনে হচ্ছে।”
“আর বোলো না।”
বাবার আসার শব্দ পেয়ে তাদের চার বছরের মেয়ে মিটি ছুটে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সে কোলে নিতে যাচ্ছিল, আভা বাধা দিয়ে বলল, “উঁহুঁ, তোমার গা থেকে এখনও কেমিক্যালের গন্ধ বেরোচ্ছে। আগে ভালো করে চান করে এসো।”
স্নান করে ফ্রেশ হয়ে এসে সে মিটি আর আভার সঙ্গে বাইরের ঘরে বসে ছিল। আভা চা আর হালকা কিছু খাবার নিয়ে এসেছে, সে তৃপ্তি করে খাচ্ছিল। মিটি তাকে সারাদিনের গল্প শোনাচ্ছে। একটু পরে আভা তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে পড়তে পাঠাল। স্বামী-স্ত্রী-র টুকটাক কথা চলতে লাগল।
আভা একসময় বলল, “আজ মিটির স্কুল থেকে ফোন করেছিল। ওর কেজি স্কুল তো এবার শেষ হয়ে যাচ্ছে, পরের ক্লাসের জন্য নতুন করে অ্যাডমিশন নিতে হবে। মাসের ফিজ়ও অনেক বেড়ে যাবে।”
ইথান একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “হয়ে যাবে।”
“কী করে?”
“আমাদের জমির পাশের জমিটা স্যাম আঙ্কলের। ওঁর বয়েস হচ্ছে, আর টানতে পারছেন না। আমাকে বলছিলেন, আমি যদি নিই, সস্তায় দিয়ে দেবেন, আস্তে আস্তে শোধ করলেই চলবে। দুটো পাশাপাশি জমি হলে চাষ করতেও সুবিধা হবে।”
আভা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। তারপর হঠাৎ বলল, “আজ জিভুর মা এসেছিলেন। ওরা নাকি সামনের মাসে ও দেশে চলে যাচ্ছে। ওখানে জিভু একটা খুব ভালো স্কুলে চান্স পেয়েছে। নামমাত্র খরচ, কিন্তু চমৎকার ব্যবস্থা।”
ইথানের মুখে চকিতে একটা ছায়া পড়ল। তারপর সে শান্ত গলায় বলল, “জানি।”
দুই
রিম স্টেডিয়াম থেকে বাড়ি ফিরছিল। ক্লান্ত শরীর, কিন্তু মুখে-চোখে তৃপ্তির ছাপ। আজ সারাদিন ধরে সিলেকশন ট্রায়াল হয়েছে। সে পিছিয়ে ছিল, শেষ রাউন্ডে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর টিমে ঢুকেছে। আজকাল খেলাধুলো মানুষের প্রধান কর্মকাণ্ড, গোটা দেশ জুড়ে বিশাল আয়োজন। সরকারও প্রচুর উৎসাহ দেন। অবশ্য এখানেও এআই কোচ আছে, খেলোয়াড়দের ডায়েট, এক্সারসাইজ়, ট্রেনিং সব তারাই ঠিক করে দেয়, তবু মাঠে নেমে খেলাটা মানুষকেই খেলতে হয়।
বাড়ি ফিরে সে দেখল, মিরান মন দিয়ে তার ট্যাবে একটা বই পড়ছে। মিরান দর্শনের অধ্যাপক। দর্শন বা সমাজবিদ্যার মতো মানবিক বিদ্যার কিছু বিষয় পড়ানোর দায়িত্ব মানুষ এখনও নিজের হাতেই রেখেছে।
রিম পোশাক পালটে হাত-মুখ ধুয়ে সোফায় তার পাশে এসে বসল। মিরান ট্যাব নামিয়ে রেখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ট্রায়াল কেমন হল?”
তাদের কাজের মেয়ে লিরা তাকে এক গ্লাস ফলের রস দিয়ে গেছে। রিম তৃপ্তির সঙ্গে একটা চুমুক দিয়ে হাসিমুখে বলল, “টিমে ঢুকে গেছি।”
মিরান খুশি হয়ে চোখ বলল, “সত্যি? যাক, কিছুদিন তোমার ভালো কাটবে।”
রিম ঘাড় নেড়ে হাসিমুখে বলল, “আশা করি।”
তাদের পাঁচ বছরের ছেলে রুথ মা-র গলা পেয়ে গুটিগুটি এসে দাঁড়িয়েছে। রিম তাকে কোলে নিয়ে আদর করে তার সারাদিনের গল্প শুনল। একটু পরে লিরা এসে তাকে পড়াতে নিয়ে গেল।
মিরানের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ টুকটাক গল্প করে রিম শোবার ঘরে গিয়ে দেওয়ালজোড়া স্ক্রিন চালু করে তার মা ও দাদার সঙ্গে গল্প করতে লাগল। গল্প অবশ্য অনেকটাই ছোটোবেলার। এখন জীবন অনেক নিস্তরঙ্গ, প্রতিদিন খুব একটা নতুন কিছু হয় না।
একটু পরে লিরা খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে খেতে ডাকল। আগে ডিনারের মেনু রিম নিজেই ঠিক করত। কিছুদিন হল, লিরাই করে। এতে সুবিধা হল তাদের পছন্দের খুঁটিনাটি, কোনো পদ কতদিন পরে আবার দিলে তাদের মুখে রুচবে, স্বাস্থ্য, পুষ্টি সব কিছু সে নির্ভুলভাবে খেয়াল রাখে। তাদের দুজনেরই মতে এই নতুন ব্যবস্থা আগের থেকে ভালো।
আজ যেমন একটা একেবারে নতুন নিরামিষ পদ করেছে। মিরান মুখে দিয়ে অবাক হয়ে বলল, “এ তো দারুণ খেতে। নতুন কোনো রেসিপি?”
লিরা হাসছিল। বলল, “আসলে আপনার পূর্বপুরুষরা যেখানে থাকতেন, সেখানে এই পদটি খুব জনপ্রিয় ছিল। আমরা ভেবেছিলাম, জেনেটিক্যালি আপনারও একটা টান থাকবে।”
তারা দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হেসে ফেলল। মিরান হাসতে হাসতেই হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে দু-দিকে মাথা নাড়ল।
খাওয়াদাওয়ার পর দুজনে কিছুক্ষণ টিভি দেখল। তারা দুজনেই পুরোনো দিনের সিনেমার ভক্ত। কয়েক বছর আগে থ্রিডি টিভি চালু হবার পর কিছুদিন দেখেছিল, এখন আবার ক্লাসিক সিনেমায় ফিরে এসেছে।
কিছুক্ষণ পর রিমের হাতের ঘড়ি বিপ বিপ করে জানান দিল। অর্থাৎ শুতে যাওয়ার সময় হয়েছে।
এরকম সতর্কবার্তা মাঝেমধ্যে আসে মদ্যপানের জন্য রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা বেড়ে গেলে কিংবা সারাদিনের ক্যালোরি ইনটেক বেড়ে গেলে। এগুলি উপেক্ষা করা যায়, অনেকে করেও, তবে পরে কিছু ব্যাখ্যা দিতে হয়। রিম এসব ঝামেলা এড়িয়ে চলে। সে উঠে রাতপোশাক পরে নিল। মিরান তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল, তার ঘুমের ঘণ্টী এখনও বাজেনি।
শোবার আগে শেষ কাজ। সারাদিনের গতিবিধি ও কার্যকলাপ, খাওয়াদাওয়া, অনলাইন অ্যাকটিভিটি ইত্যাদি যাবতীয় ডেটা কনফার্ম করা। কিছু কিছু তথ্য এরা সরাসরি কাজের লোকদের থেকেও পায়। সে শোবার ঘরের স্ক্রিন চালু করতেই যাবতীয় তথ্য ভেসে উঠল। রিম যান্ত্রিকভাবে চোখ বুলিয়ে গেল। সবশেষে সম্মতি চেয়ে একটা ফর্ম তার তথ্যগুলি সম্পূর্ণ সুরক্ষিতভাবে চিকিৎসা, প্রশাসন, গবেষণা ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হতে পারে। সে চটপট টিক দিয়ে দিল।
স্ক্রিন বলল, ধন্যবাদ। আপনার সারাদিনের ভাইটাল প্যারামিটার ও অন্যান্য রিপোর্ট দেখে আমরা মনে করছি, আপনার দিনটি ভালো কেটেছে।
রিম হাসিমুখে আবার টিক দিল।
তিন
ড. ওজাস রিজিয়নাল মেডিক্যাল সেন্টারে তাঁর ঘরে বসে ছিলেন। সামনে দেয়ালজোড়া স্ক্রিনে রোগীদের কেস হিস্ট্রি ও যন্ত্র মেধার ডায়াগনসিস অলসভাবে ভেসে যাচ্ছে। করণীয় সেরকম কিছু নেই। আগে কদাচিৎ দু-একটি রিপোর্টে ‘হিউম্যান ইনটারভেনশন রিকোয়্যারড’ লেখা থাকত, এখন তাও আসে না। তবে রিপোর্টগুলির ছোটো একটা স্যাম্পল এখনও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কাছে যায়।
স্ক্রিনের তলায় একটা মেসেজ ফুটে উঠল। ড. আলম কথা বলতে চান। আলম ওয়ার্ল্ড মেডিক্যাল কাউন্সিলের ডিরেক্টর। ওজাস কলটা নিলেন। প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পর আলম বললেন, “আপনাদের সেন্টারের গত তিন মাসের রিপোর্ট দেখছিলাম। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সিস্টেমের ডায়াগনসিসের সঙ্গে প্রায় প্রতিটি কেসে একমত।”
ওজাস মৃদু হেসে বললেন, “সেটাই তো স্বাভাবিক। মেশিনগুলি গত দুই দশক ধরে কোটি কোটি কেস স্টাডি করে চলেছে। ওরা এখন যে-কোনো চিকিৎসকের থেকে বেশি অভিজ্ঞ ও দক্ষ। অতি বিরল ও জটিল দু-একটি কেস ছাড়া যে-কোনো অসুখ ওরা অতিদ্রুত চিহ্নিত করতে পারে।”
আলম বললেন, “আমি ভাবছিলাম, আপনাদের সেন্টারটি এবারে বোধহয় পুনর্গঠন করা যেতে পারে। কুশলী কিছু চিকিৎসককে আমরা বিভিন্ন গবেষণাকেন্দ্রে পাঠাতে পারি। অন্যদের পরিবর্তে আমরা আরও বেশি সংখ্যক এজেন্ট ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারি। এতে রোগীদেরও সুবিধা।”
ওজাস এই আলোচনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। বললেন, “সাধারণ বুদ্ধি তা-ই বলে। একজন চিকিৎসকের তুলনায় একটি এজেন্টের উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ প্রায় শূন্য। এই বাড়তি খরচ কমিয়ে আনাই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এর একটি ঝুঁকির কথাও আমরা জানি, আলোচনাও করেছি।”
আলম চুপ করে রইলেন। এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে একমাত্র মেধাবী ও কুশলী কর্মীদেরই জন্যই নিয়মিত কাজ আছে। ধীরে ধীরে তাও কমে আসছে। অদূর ভবিষ্যতে মানুষের কর্মদক্ষতা ও সৃজনশীলতা কমে গিয়ে তাকে সম্পূর্ণভাবে যন্ত্রের উপর নির্ভর করতে হতে পারে। কিন্তু প্রশাসক হিসাবে তাঁর হাত-পা বাঁধা।
তিনি মুখে বললেন, “আমি সে ব্যাপারে একমত। আপনি লিস্ট পাঠান, আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।”
ওজাসের সম্মতি পেয়ে তিনি কল কেটে দিলেন। তাঁর পর্দায় আরেকটি রিপোর্ট ভেসে উঠল। হেল্থ রিসার্চ ব্যুরোর ত্রৈমাসিক রিপোর্ট। প্রযুক্তির কল্যাণে শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানই নয়, সামগ্রিক সামাজিক উন্নতির জন্য মানুষের গড় পরমায়ু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অপুষ্টি, দূষণ, মহামারির মতো অনেক সমস্যাই এখন ইতিহাস। অধিকাংশ মানুষ নীরোগ সুস্থ জীবনযাপন করে। সমস্যা যেটুকু আছে, মানসিক। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না-পারা। ওটা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।
চার
কাইডেন গত মাসের রিপোর্ট দেখছিলেন। সারা দেশের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক তথ্য সংগ্রহ করে এআই পাঠিয়েছে। প্রতিবারের মতোই আশাব্যঞ্জক রিপোর্ট। শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ছে, খরচ কমছে। কারখানাগুলি যন্ত্রমানুষেরাই চালায়, তাদের তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে যা খরচ, তার অনেকগুণ বেশি তারা উৎপাদন করে। কৃষিক্ষেত্রেও অনেকটা তা-ই। বিজ্ঞানীরা এমন সব ফসল বার করেছেন, যাতে পোকাই ধরে না। এ ছাড়া কখন কী চাষ কেমনভাবে করতে হবে, বৃষ্টি কেমন হবে, বীজ, সার ইত্যাদি কেমন কী লাগবে সব খুঁটিনাটি সরকারের কম্পিউটারই বলে দেয়। সেসবই অত্যুন্নতমানের, দামও নামমাত্র। কৃষকদের কাজ বলতে নজর রাখা আর ফসল পেকে উঠলে গোলায় তোলা। একজন কৃষক অনেক একর জমি এক হাতে সামলাতে পারে। সাধারণ নাগরিকদের সরকার যা ভাতা দেয়, তা দিয়ে মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, এমনকি বিনোদনের সামগ্রীও নামমাত্র মূল্যে কিনতে পারে।
দশ বছর আগে শাসনভার গ্রহণ করে কাইডেন সাফল্যের সঙ্গে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন।
তবে ব্যর্থতা যে নেই, তা নয়। এই গ্রহের ছোটো একটা অংশে মানুষ রহস্যময় কারণে উন্নত প্রযুক্তিকে এখনও এড়িয়ে চলে। সেই পৃথিবী যেন অতীতের একটা টুকরো, দারিদ্র্য, ব্যাধি ও হতাশায় ডুবে আছে। অনেক বুঝিয়েও কাইডেনের প্রশাসন তাদের মূলস্রোতে আনতে পারেনি। কৃষি ও ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন খরচ অত্যধিক, তাই জিনিসপত্রের দামও বেশি। রাস্তাঘাট, পরিবহন, শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসা সব কিছুতেই তারা পিছিয়ে। সমস্যাটা শুধু মানবিক নয়, ওখানে যা হয়, তার প্রভাব এ দেশেও পড়ে। কিছুদিন আগে ওখানে বিরল এক স্নায়বিক অসুখ ছড়িয়ে পড়েছিল, এদিকেও বেশ কিছু লোক আক্রান্ত হয়। এআই-এর কাছে এই সংক্রান্ত কোনো তথ্য ছিল না, কাজেই পূর্বাভাস বা প্রতিরোধ কিছুই করা যায়নি। তবে কাইডেন আশাবাদী, অবস্থা পালটাবে।
রিপোর্টের একেবারে শেষে এসে কাইডেনের ভ্রূ কুঁচকে গেল। তিনি স্ক্রিনে একটি অংশ হাইলাইট করে আরও বিস্তারিত রিপোর্টের জন্য নোট পাঠালেন।
পাঁচ
এমার আজ ফিরতে দেরি হল। স্কুলের প্রোজেক্ট। বাস স্টপ থেকে তাদের বাড়ি মিনিট দশেকের হাঁটা-পথ। নির্জন রাস্তায় স্ট্রিটলাইটগুলি টিমটিম করে হলুদ আলো ছড়াচ্ছে। আজকাল শহরে অপরাধ বাড়ছে। তাদের পাড়ায় সেরকম কিছু কোনোদিন হয়নি, তবু অস্বস্তি একটা থাকেই।
কাঁধের উপর ব্যাগটা রেখে সে হাঁটা শুরু করল। নিজের পায়ের শব্দ নিজেরই কানে লাগছে।
পিছনে একটা গাড়ির শব্দ শোনা গেল। হেডলাইট দুটো শ্বাপদের চোখের মতো জ্বলছে। সে দাঁড়িয়ে পড়ল। আরও কাছাকাছি এলে গাড়িটা চিনতে পেরে সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ইথান আঙ্কল কাজ সেরে ফিরছে। সে হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে হাত নাড়তে লাগল। গাড়িটা ঘ্যাঁচ করে বিকট শব্দে ব্রেক কষে তার পাশে এসে থেমেছে। ইথান হাত বাড়িয়ে তার দিকের দরজা খুলে দিয়ে হেসে বলল, তোমাকে আমি আগেই দেখেছি।
সে উঠে তার সিটে গুছিয়ে বসে দরজা বন্ধ করে প্রসন্নভাবে বলল, “চলো।”
যেতে যেতে টুকটাক কথা হতে লাগল। ইথান আঙ্কল মানুষটি বেশ ভালো, সৎ, পরিশ্রমী ও হাসিখুশি। বলল, “আজ এত দেরি করে ফিরছ?”
“স্কুলের প্রোজেক্ট ছিল। তবে তুমিও তো বোধহয় আরও আগে ফেরো।”
“হ্যাঁ, ক-দিন একটু খাটনি যাচ্ছে।”
তারপর সে হাসতে হাসতে বলল, “ও দেশে শুনি, মানুষকে প্রায় খাটতেই হয় না। আর আমাদের বিশ্রামের সময় ক্রমশ কমছে।”
এমার হঠাৎ কিছু মনে পড়ল। সে উত্তেজিতভাবে বলল, “জানেন আঙ্কল, ক-দিন আগে ইকনমিক্সের ক্লাসে মিস এই কথাই বলছিলেন, শিল্পবিপ্লবের পর থেকে প্রযুক্তির উন্নতির জন্য মানুষের কাজের সময় ক্রমশ কমে আসছে।”
ইথান চোখ টিপে বলল, “আর আমাদের?”
তারা দুজনেই হাসতে লাগল। একটু পরে ইথান বলল, “একটা খবর দেখেছ? এখন আর শুধু আমাদের দিক থেকে নয়, ওদিক থেকেও কিছু মানুষ নাকি এদিকে চলে আসছে, যদিও সংখ্যাটা নগণ্য।”
এমা বিস্মিতভাবে বলল, “সে কী?”
তারা পৌঁছে গেছে। ইথান কাদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বলল, “দেখা যাচ্ছে, আমাদের মতো মাথা-পাগল ও দেশেও কিছু আছে।”
গাড়ির শব্দ পেয়ে এমার মা মেলিয়া বেরিয়ে এসেছেন। তাঁকে দেখে হাসিমুখে বললেন, “তোর দেরি দেখে আমরা চিন্তা করছিলাম।” ইথানকে বললেন, “ভিতরে আসবে না?”
ইথান হেসে বলল, “না, দিদি। কাল মিটির পরীক্ষা আছে, আভা ওকে নিয়ে বসেছে। আমাকে একটু রান্নাঘরে ঢুকতে হবে। পরে আসব। এমা, তুইও আসিস মিটির পরীক্ষা শেষ হলে।”
হাত নেড়ে হেসে সে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
ছয়
মিরান বাইরের ঘরে সোফায় বসে পা দোলাচ্ছিল। রিম একটু আগে কিটসের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেছে। ফিরবে বিকেলে। রুথকে নিয়ে লিরা গেছে একটা নেচার ক্যাম্পে। ফাঁকা বাড়ি সকালের আলোয় ভাসছে। একটু আগে সে ব্রেকফাস্ট করেছে, মন ফুরফুরে। এবার একটু বইপত্র নিয়ে বসবে। পরশু তার কলেজে একটা সেমিনারে বলতে হবে, একটু বিদ্যাচর্চা দরকার।
সে দেয়ালের স্ক্রিন চালু করে পুরোনো দিনের আর্কাইভে ঢুকল। কয়েক শতাব্দীর সৃষ্টি এখানে ডিজিটাইজ় করে রাখা আছে, যা খুশি পড়া যায়। সে নিজে এগুলি পড়তেই পছন্দ করে, মানবিক সত্তার একটা ছোঁয়া যেন পাওয়া যায়।
একটা বইতে তার চোখ আটকাল। ডিপ ইউটোপিয়া। লেখক অতদিন আগে প্রযুক্তির কল্যাণে বিপুল সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা সঠিক লিখে গেছেন। কৃত্রিম বুদ্ধি বা এআই যে পৃথিবীর সম্পদ বাড়িয়ে দেবে—এ নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও চিন্তকরা ঠিকই অনুমান করেছিলেন, কিন্তু সেই সম্পদের বণ্টন নিয়ে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন না। বাস্তবে সেরকম কিছু হয়নি। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের অধিকাংশ মেধাস্বত্ব সরকার নিজের কাছেই রেখেছেন, তার সুফল সব শ্রেণির মানুষই পাচ্ছেন। ক্ষমতাশালী কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অবশ্যই আছেন, কিন্তু ভরকেন্দ্র অনেকটাই পুঁজি থেকে মেধার দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
সে সোফায় হেলান দিল। মানুষ অনেক কিছু পেয়েছে, তবে যাত্রা এখনও শেষ হয়নি। এখন বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন ব্রেন স্ক্যান করে তার ডিজিটাল কপি তৈরি করতে, যাতে সে মৃত্যুর পরেও ভার্চুয়াল জগতে বেঁচে থাকে। একদিন হয়তো তাকে শরীরও দেওয়া হবে।
কেমন হবে সে অমরত্ব?
কাল ড. ওজাস ফোন করেছিলেন। উনি মিরানের সঙ্গে একবার একটা কমিটিতে ছিলেন, সেই সূত্রে আলাপ। সিস্টেমে ওঁর কিছু পেশেন্টের কিছু সাইকোসোমাটিক সমস্যা ধরা পড়েছে, সে ব্যাপারে মিরানের মতামত জানতে চাইছিলেন। মিরান নিজে নানা কাজে ব্যস্ত থাকে, তার এই সমস্যা নেই। তবু ব্যাপারটা বোঝা কঠিন নয়। সেই আদিমকাল থেকে মানুষ প্রতিকূল বিপৎসংকুল পরিবেশে অনিশ্চয়তার মধ্যে তার ভাগ্যকে শিকার করে এসেছে। সে চায় মেধা ও শক্তি দিয়ে ভাগ্যকে জয় করে বারবার নিজেকে প্রমাণ করতে। প্রবৃত্তিগুলি রক্তে থেকেই গেছে, মাঝেমধ্যেই জানান দেয়। ধীরে ধীরে সে হয়তো মানিয়ে নেবে।
দরজা খোলার শব্দ হল। রিম ঘরে ঢুকল।
ঘর্মাক্ত ক্লান্ত চেহারা। ঈশানকে একঝলক হাসি দিয়ে সে ভিতরে ঢুকে গেল, একটু পরে পোশাক পালটে ফ্রেশ হয়ে এসে বসল। বলল, “বলো, কী করলে সকাল থেকে?”
ঈশান মৃদু হেসে বলল, “কিছু করা কেন জরুরি, সেটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম।”
রিম হাসল। টুকটাক কথাবার্তা চলতে থাকল। রিম একসময় বলল, “রুথের তো চার বছর হতে চলল।”
সে চোখ নাচাল। ঈশান হেসে বলল, “হ্যাঁ, আমিও ভেবেছি। রুথ স্কুলে চলে গেলে বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যায়। সিস্টেমে নাম তুলে দাও। তারপর ঘণ্টী বাজার অপেক্ষা করো।”
মাত্র কয়েক দশক আগে অধিকাংশ দেশে জনসংখ্যা হুহু করে কমছিল। অনেক দম্পতিই সংসার ও অফিসের কাজ সামলে সন্তানের দায়িত্ব নিতে রাজি ছিল না। এখন পরিস্থিতি পালটেছে। অধিকাংশ দম্পতিই একাকিত্ব কাটাতে সন্তানের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের দিক থেকে কোনো বিধিনিষেধ নেই, তবে পরামর্শ ও সহায়তার জন্য একটা সিস্টেম আছে।
তাতে নাম লেখালে কম্পিউটার দম্পতির বয়েস, স্বাস্থ্য, জেনেটিক প্রোফাইল, এমনকি তাদের শহরে শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত স্কুল, চিকিৎসক, খেলার মাঠ আছে কি না সব কিছু হিসাব করে পরামর্শ দেয়। অধিকাংশ দম্পতি সন্তানের স্বার্থে এটিই অনুসরণ করে। বাজারে একটা রসিকতা চালু আছে, এই সিস্টেম নাকি রাত দুটোর সময়ও সংগমের উপযুক্ত সময় মনে হলে ঘণ্টী বাজিয়ে দেয়, কিন্তু সেটা রসিকতাই।
রিম উঠে এসে দুই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখল, তারপর বলল, “কেমন মানুষ তুমি, রসকষ বলে কিছু নেই?”
সে মিরানের বুকে আছড়ে পড়ল। তার শরীরের কোমল সুগন্ধি প্লাবনে মিরান ভেসে গেল। পরে রিমের পাশে শুয়ে তার মনে হচ্ছিল, প্রকৃতি যৌনতাকে লোভনীয় করেছিল সন্তানের জন্মের জন্য। এখন অনেক শিশুরই আইভিএফ পদ্ধতিতে জন্ম হয়, কারণ এই পদ্ধতিতেই ভ্রূণের জিন-এডিটিং করে জন্মগত ত্রুটি সংশোধন করা সম্ভব। অন্য পদ্ধতিও জনপ্রিয় হচ্ছে। তবু যৌনতার অভ্যাস এখনও রয়ে গেছে। তবে প্রকৃতি অপ্রয়োজনীয় বোঝা টেনে চলে না তাই একদিন হয়তো যৌনতার প্রয়োজনও ফুরিয়ে যাবে।
আর প্রেম?
কথাটা কি পাশ থেকে রিম বলল? না সে নিজেই? সে মনে মনে হেসে ফেলল। সে জানে প্রেম আর যৌনতা এক নয়। তা ছাড়া, সব সূক্ষ্ম অনুভূতি চলে গেলে মানুষ কি আর মানুষ থাকবে?
সাত
মাটির অনেক উপরে কালো কাচ দিয়ে মোড়া উপবৃত্তাকার কনট্রোল রুমে সে বসে ছিল। তার সামনের মনিটরে অনেকগুলি সিসিটিভি-র ফিড থেকে সারাৎসার এসে জড়ো হচ্ছে। না দেখলেও চলে, কারণ কোনো সমস্যা হলে তৎক্ষণাৎ অ্যালার্ম বেজে ওঠে। তা ছাড়া গত দু-বছরে এ শহরে কোনো অপরাধ হয়নি।
তবু সে দ্যাখে। বহু বছরের মিলিটারি ট্রেনিং তাকে এই কাজের জন্য উপযুক্ত করেছে। কদাচিৎ অ্যালার্ম বাজলে তার কাজ জ়ুম ইন করে সন্দেহভাজন লোকটিকে দেখা এবং কথা বলা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় সন্দেহভাজন লোকটি নিরীহ।
একটু পরে কফি ব্রেক হল। সিস্টেম অটো-মোডে দিয়ে সে কফির কাপ নিয়ে কাচের সামনে দাঁড়াল। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, আকাশ থেকে আগুনে রং বাইরের কাচে ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে বাইরে থেকে দেখলে দেখা যাবে, কালো কাচের আড়ালে অনেকগুলি স্ক্রিন ও গ্যাজেটের মধ্যে নিঃসঙ্গ এক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।
তখনই পৃথিবীতে যুদ্ধবিগ্রহ প্রায় শেষ হয়ে আসছে। দেশগুলি সামরিক খাতে খরচা কমাচ্ছে। সেনাদের মূলত অভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষা ও সন্ত্রাসদমনে ব্যবহার করা হচ্ছে। তখনও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আসেনি, বরং প্রযুক্তির প্রাথমিক অভিঘাতে লক্ষ লক্ষ লোক কাজ হারাতে শুরু করেছে। পৃথিবী জুড়ে টালমাটাল অবস্থা। অপরাধ বাড়ছে, বিভিন্ন জঙ্গি বা অতিবাম গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
সে লড়াই বড়ো কঠিন ছিল। দুর্গম ঘন জঙ্গলে গুঁড়ি মেরে বা শহরে সরু গলিতে পিঠ ঠেকিয়ে শত্রুকে খোঁজার চেষ্টা। যে-কোনো মুহূর্তে নাম-লেখা সিসার টুকরো উড়ে আসবে। তবে ভয় কোনোদিন করেনি, শরীর-মন ছিলার মতো টানটান হয়ে কাজ করে যেত। সে বড়ো তীব্র আদিম অনুভূতি। ছুটিতে বাড়ি ফিরলে শিশুকন্যাটি ঝাঁপিয়ে এসে কোলে উঠত, রাতে পাশে শুয়ে স্ত্রী রুক্ষ শরীরে হাত রাখত। সকালে পাশের বাড়ির ন্যাওটা কিশোর ছেলেটি তার কাছে গল্প শুনতে আসত। সেসব বড়ো আনন্দের মুহূর্ত। সে বেশি পড়াশুনো করেনি, তবু অস্পষ্টভাবে বুঝতে পারত মানুষ সুখ নয়, রুদ্রর প্রসন্ন মুখ দেখতে চায়। পেয়ে নয়, অর্জন করেই মানুষের সুখ।
আবার সে কাচের সামনে ফিরে এল। এই ঘরটি অনেক উঁচুতে, আকাশছোঁয়া বিল্ডিংগুলি ছাড়িয়েও দিগন্ত দেখা যায়। সে শুনেছে, অনেক দূরে দক্ষিণে এক দেশে মানুষ প্রযুক্তির সর্বব্যাপী ব্যবহার মেনে নেয়। সেখানে নাকি অনেক সমস্যা।
সে এখানে ভালোই আছে। সরকারি ভাতা ছাড়াও সে এই কাজের জন্য টাকা পায়। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে সে টিভি-তে যন্ত্রমানুষদের তৈরি সিনেমা দ্যাখে। ছুটির দিন ভিডিয়ো গেম খ্যালে। স্ত্রী চলে গেছেন, এক মেয়ে এই শহরেই থাকে, মাঝেমধ্যে এসে বা ফোনে তার খবর নিয়ে যায়।
আর হাঁপিয়ে উঠলে সে চোখ বন্ধ করে তার স্মৃতির জগতে ফিরে যায়।
আট
এমা অনেকদিন থেকেই বলছিল, অবশেষে আজ ইথান সবাইকে তার খেত দেখাতে এনেছে। আভা, মিটি, এমা, মেলিয়া। এমার বাবা নেই, এমা যখন ছোটো ছিল, হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে চলে যান।
এখন ফসল প্রায় পেকে এসেছে, যতদূর চোখ যায়, টানা একটা হলুদের ঝলকানি। রোদ আছে, তবে চড়া নয়। মিটি মহা উৎসাহে এমাকে টানতে টানতে নিয়ে খেতের মধ্য দিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখছে। দুজনেই খাবারদাবারও আনা হয়েছে, একটু পরে গাছতলায় চাদর বিছিয়ে পিকনিক হবে। এখন প্রসন্ন মুখে টুকটাক গল্প চলছে। মনোরম পারিবারিক পরিবেশ।
একটু পরে এমা ক্লান্ত হয়ে মিটিকে নিয়ে ফিরে এল। ইথানের পাশে বসে বলল, “আঙ্কল, চাষের কাজ সব তুমি নিজের হাতে করো?”
ইথান মৃদু হেসে বলল, “তা-ই কি করা যায়? বীজ লাগানো আর ফসল তোলার সময় লোকজন লাগে। তবে যতটা পারি, করি।”
ফসল তোলার পর?
মান্ডিতে খবর দিই, ওরা এসে নিয়ে যায়। তবে দাম ওঠানামা করে। কোনোবার ফলন বেশি হলে কম দামে ছেড়ে দিতে হয়। কখনও ঝড়বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি হয়।
এমা বলল, “ও দেশে তো সব কিছু সরকারই ঠিক করে দেয়।”
সরকার মানে আজকাল কম্পিউটারই করে। অনেক বছরের চাহিদা, জোগান, আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতির তথ্য বিশ্লেষণ করে কবে কখন কীসের চাষ করতে হবে, সব আগেই ঠিক করা থাকে।
এমা একটু ভেবে বলল, “আঙ্কল, একটা কথা বলব? এইসব কাজে তো ওদের নিয়মকানুন, বিধিনিষেধ ইত্যাদি মেনে চলাই যায়।”
ইথান মৃদু হেসে বলল, “হয়তো যায়। কিন্তু মনে হয় ব্যাপারটা অত সহজ নয়। একবার শুরু করলে সব কিছুই ধীরে ধীরে সিস্টেমে ঢুকে যাবে। আর বাকি তো তুই জানিসই।”
এমা চুপ করে গেল। ইথান আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, আভা খেতে ডাকল।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে তারা আরেক প্রস্থ গল্প শুরু করেছে, এমার গায়ে জলের ফোঁটা পড়ল। উপরে তাকিয়ে সবাই চমকে উঠল। তারা খেয়াল করেনি, আকাশ কালচে হয়ে এসেছে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ইথান বলল, “চলো, ফেরা যাক।”
দ্রুত হেঁটে গাড়িতে উঠতে উঠতেই তারা অল্পস্বল্প ভিজে গেল। ইথান গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বিস্মিতভাবে বলল, “আজকে টিভি-তে বৃষ্টির কথা কিছু বলেনি।”
আভা বলল, “কবেই-বা বলে?”
বাড়ি মোটে পনেরো মিনিটের রাস্তা, তার মধ্যেই চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। বিকেল চারটে যেন মধ্যরাত্রি। সেই সঙ্গে মাটি-ফাটিয়ে-দেওয়া বৃষ্টি। এমা বলল, “আঙ্কল ক্লাউড বার্স্ট না কী বলে, তা-ই হয়েছে, মনে হচ্ছে।”
টানা বৃষ্টি চলল প্রায় ২৪ ঘণ্টা। বাড়ি থেকে বেরোনোর উপায় নেই। এর মধ্যেই বিদ্যুৎ চলে গেল। আরও কয়েক ঘণ্টা পরে মোবাইলও। বেরোনোর উপায় নেই, দোকানপাটও সব বন্ধ। ভূতুড়ে অন্ধকারে শহরে যেন পৃথিবীর জন্মলগ্নের মতো বৃষ্টি হয়েই চলেছে। বাড়িতে যা খাবারদাবার ছিল, তা দিয়ে কোনোরকমে চলছে।
গভীর রাতে ইথানের ঘুম ভেঙে গেল। কেউ যেন দুর্বল হাতে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। দূর থেকে অস্পষ্ট চিৎকার ও আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসছে। সে লাফিয়ে উঠে দেখল, ঘরে জল ঢুকছে। দ্রুত আভাকে জাগিয়ে আর ঘুমন্ত মিটিকে কোলে তুলে কোনোরকমে দরজা খুলে তারা বেরোল। সামনে হাঁটুসমান কালো জল। একপাশে দাঁড়িয়ে এমা ও মেলিয়া বৃষ্টিতে ও আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপছে। তাকে দেখে এমা ভয়ার্ত গলায় বলল, “আঙ্কল বাঁধ ভেঙেছে, মনে হচ্ছে।”
সে এক হাতে মিটিকে জড়িয়ে রেখে অন্য হাতে এমার হাত ধরে বলল, “চলো।”
অন্ধকার জলভূমিতে ভূতুড়ে জ্যোৎস্নায় চারজন নিঃশব্দে এগিয়ে চলল। দু-পাশে বাড়িগুলির বাইরে কালো জল দুলছে। আশপাশে মানুষের চিৎকার-চ্যাঁচামেচির শব্দ ভেসে আসছে, কিন্তু দৃষ্টিপথে কেউ নেই। তাদের দেখলে এখন ত্রস্ত আদিম মানুষ বলে ভ্রম হতে পারে।
একটু পরে ডানদিকে একটা দোতলা বাড়ি। দলটা সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সিঁড়িগুলি জলের তলায়। ইথান মিটিকে আভার কোলে দিয়ে ভিতরে ঢুকে সাবধানে পা ফেলে সিঁড়ি ঠাহর করল, তারপর মিটি আর আভাকে নিয়ে সাবধানে সিঁড়িতে পা রাখল। জল তারই প্রায় কোমরসমান। প্রাণপণে এক-পা এক-পা করে সিঁড়ি ভেঙে সে দুজনকে নিয়ে চাতালে উঠে শ্বাস ফেলল। একইভাবে সে মেলিয়াকেও নিয়ে এল।
এমা এখনও নীচে দরজায় দাঁড়িয়ে। জল ধীরে ধীরে বেড়েছে। এমা লম্বা নয়, জল তার প্রায় বুক ছুঁয়ে দোলা দিচ্ছে। অতিকষ্টে সে ভারসাম্য বজায় রাখছে। সে ভয়ার্ত গলায় বলল, “আমি পারব না, আঙ্কল।”
ইথান কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গিয়ে কোমর-জলে দাঁড়িয়ে এমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, “পারবি। মানুষ সব পারে। আয়।”
তার কণ্ঠস্বরে কিছু একটা ছিল, এমা তার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল।
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, বিশ্বদীপ সেনশর্মা
