ডাকিনী গৃহের স্বপ্নজাল
লেখক: এইচ পি লাভক্র্যাফট অনুবাদ: সুমিত বর্ধন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
মূল গল্প: The Dreams in the Witch House
স্বপ্নের চোটে জ্বর এসে গিয়েছিল, নাকি জ্বরের চোটে স্বপ্নের আবির্ভাব হয়েছিল, সে কথা ওয়াল্টার গিলম্যানের জানা ছিল না। এখানে সব কিছুর পেছনে গুঁড়ি মেরে থাকে এক চিন্তাগ্রস্ত, পচনোন্মুখ আতঙ্ক। আতঙ্ক সেই প্রাচীন শহরের আর এই বাড়ির চালের নীচের ছাতা-পড়া অশুচি চিলেকোঠাটার। যে চিলেকোঠায় ওয়াল্টার যখন তার যৎসামান্য লোহার খাটটার ওপর ছটফট করে না, তখন সে লিখতে থাকে, পড়াশোনা করে, আর মল্লযুদ্ধ করে চলে সংখ্যা আর ফর্মুলার সঙ্গে। তার শ্রবণশক্তির অনুভূতি বেড়ে যাচ্ছে এক অতিপ্রাকৃতিক, অসহনীয় মাত্রায়। সস্তার ম্যান্টেল ক্লকটা সে বন্ধ করে দিয়ছে অনেকদিন আগেই। সেটার টিকটিক শব্দ তার কানে বাজত কামান গর্জনের মতো। রাতের বেলা অস্পষ্ট আলোড়ন হত বাইরের অন্ধকার শহরে, ঘুণ-ধরা পার্টিশনে চলত ইঁদুরের শয়তানি ছোটাছুটি, ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে উঠত শতাব্দীপ্রাচীন বাড়ির গোপন কড়িকাঠ। কেবল এতেই তার অনুভূতি হত এক কর্কশ কোলাহলের। রাত ভরে থাকত যত ব্যাখ্যাতীত শব্দে। কিন্তু তাও মাঝেমধ্যে ভয়ে কাঁপত সে। পাছে কমে আসে তার শুনতে-পাওয়া শব্দগুলো, ব্যবস্থা করে দেয় বিশেষ অন্য কিছু আবছা শব্দ শুনতে পাওয়ার। যেসব শব্দ, তার সন্দেহ, ওঁত পেতে আছে তার শুনতে-পাওয়া শব্দদের পেছনেই।
গিলম্যানের বাস ছিল পরিবর্তন থমকে-থাকা, কিংবদন্তির প্রেতগ্রস্ত আর্কহ্যাম শহরে। যেখানে ভিড়-করে-থাকা দু-পাশে ঢাল-দেওয়া ছাদেরা সব টাল খায়, বসে যায় চিলেকোঠাদের ওপর। সেই সমস্ত চিলেকোঠা, যেখানে এই প্রদেশের আদ্যিকালে রাজ-অনুচরদের থেকে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকত ডাকিনীরা। গিলম্যানকে আশ্রয়-দেওয়া এই চিলেকোঠাটার চাইতে শহরের আর অন্য কোনো জায়গাই ছিল না, যা এমন বীভৎস স্মৃতিতে পরিপূর্ণ। কারণ এটাই সেই বাড়ি আর সেই ঘর, এককালে যা আশ্রয় দিয়েছিল বুড়ি কেজিয়া মেসনকেও। সেই কেজিয়া মেসন, যার সালেম জেল থেকে পালানোর ব্যাখ্যা কখনও কেউ দিতে পারেনি। সে ১৬৯২ সালের কথা। উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল জেলার। বকবক করে বলে গিয়েছিল কেজিয়ার কয়েদঘর থেকে অতি দ্রুত ছুটে বেরিয়ে-আসা খুদে, লোমশ, সাদা শ্বদন্তের একটা প্রাণীর কথা। লাল আঠালো কোনো তরল দিয়ে ধূসর পাথরের দেওয়ালে লেপে দেওয়া হয়েছিল সব বক্ররেখা আর কোণ। তাদের ব্যাখ্যা দিতে পারেননি খোদ কটন ম্যাথারও14।
গিলম্যানের হয়তো অত মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করা উচিত হয়নি। অ-ইউক্লিডীয় ক্যালকুলাস আর কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা এমনিতেই যে-কোনো মগজকে প্যাঁচে ফেলার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু এরপর কেউ যদি তাকে মেশায় লোককথার সঙ্গে, সেই সঙ্গে বহু ডাইমেনশনের অস্তিত্বের যে বিচিত্র পৃষ্ঠভূমি, তার সন্ধান করতে যায় হাড়-হিম-করা গল্পগাছার নারকীয় ইঙ্গিত আর আগুন পোয়ানোর অবকাশের লাগামছাড়া ফিশফিশানির পেছনে, তাহলে মানসিক উদ্বেগ থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়ার আশা মোটেও করা যায় না। এসেছিল গিলম্যান হেভারহিল থেকে। তবে কেবল আর্কহ্যামের কলেজে ভরতি হওয়ার পরেই সে তার গণিতের সঙ্গে জুড়তে আরম্ভ করে প্রাচীন জাদুবিদ্যার সব কল্পনাশ্রয়ী কিংবদন্তিদের। এই বৃদ্ধ শহরের বাতাসের কোনো কিছু অগোচরে প্রভাব ফেলেছিল তার কল্পনায়। মিসকাটনিকের প্রফেসাররা তাকে অনুরোধ করছিলেন কিছুটা ঢিলে দিতে। স্বেচ্ছায় তার কোর্স কমিয়েও দিয়েছিলেন বেশ কয়েকটা জায়গায়। তা ছাড়া ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির একটা ভল্টে তালাচাবি দিয়ে রাখা নিষিদ্ধ রহস্যের ওপর কিছু সন্দেহজনক বই নিয়ে তার ঘাঁটাঘাঁটিও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এইসব সতর্কতা এসেছিল বড়ো দেরিতে। ততদিনে শূন্যতার বৈশিষ্ট আর জানা-অজানা ডাইমেনশনের সংযোগের ওপর তার নিজের যেসব জটিল ফর্মুলা ছিল, গিলম্যান তার সঙ্গে যোগসূত্রের কিছু ভয়ানক ইঙ্গিত পেয়ে গেছে। পেয়েছে আবদুল আলহাজরেদের ভয়ংকর নেক্রোনমিকন, অসম্পূর্ণ এইবনের কেতাব, আর ভন জুনজটের চেপে-দেওয়া বই উনআউসপ্রেখলিখেন কুল্টেন থেকে।
গিলম্যান জানত তার ঘরখানা পুরোনো ডাকিনী বাড়ির অংশ। সত্যি বলতে কী, সেইজন্যেই ঘরটা নিয়েছিল সে। এসেক্স কাউন্টির রেকর্ডে অনেক কিছু ছিল কেজিয়া মেসনের বিচার সম্বন্ধে। চাপে পড়ে অইয়ার এবং টার্মিনারের কোর্টকে সে যা যা বলেছিল, তার ওপর আকর্ষণের অন্ত ছিল না গিলম্যানের। বিচারক হ্যাথর্নকে কেজিয়া মেসন বলেছিল রেখা আর বক্ররেখাদের কথা। তাদের দিশা দেখাতে বাধ্য করা যায় শূন্যতার দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে অন্য পারের শূন্যতাদের দিকে যাওয়ার। ইঙ্গিত দিয়ছিল, সেইসব রেখা আর বক্ররেখা প্রায়ই ব্যবহার হয়ে থাকে মেডো হিল পেরিয়ে সাদা পাথরের কালো উপত্যকায় আর নদীর বিজন দ্বীপে বিশেষ কিছু মাঝরাতের বৈঠকে। বলেছিল কৃষ্ণমানবের কথা, তার শপথের কথা, বলেছিল তার নিজের নতুন গোপন নাম নাহাবের কথা। তারপরে উধাও হয়ে গিয়েছিল তার কয়েদঘরের দেওয়ালে ওই নকশাগুলো এঁকে দিয়ে।
কেজিয়া সম্বন্ধে অদ্ভুত ব্যাপারগুলো বিশ্বাস করত গিলম্যান। একটা বিচিত্র রোমাঞ্চ অনুভব করেছিল সে কেজিয়ার বাসস্থানটা ২৩৫ বছরের পরেও দাঁড়িয়ে আছে জেনে। আর্কহ্যামের চাপা ফিশফিশ থেকে তার কানে এসেছিল অনেক কিছু। পুরোনো বাড়িটা আর সরু রাস্তাগুলোতে কেজিয়ার একটানা উপস্থিতি। সেই বাড়িটা আর অন্যান্য বাড়িতে বাছা বাছা ঘুমন্ত লোকের শরীরে এবড়োখেবড়ো দাঁতের দাগ। মে-ইভ15 আর হ্যালোমাসের16 কাছাকাছি সময়ে কানে আসা শিশুদের কান্না। সেই ভয়ানক মরশুমের ঠিক পরেই পুরোনো বাড়িটার চিলেকোঠায় প্রায়শ নাকে উৎকট দুর্গন্ধ আসা। ভোরের আলো ফোটার আগে মানুষের শরীরে অদ্ভুতভাবে নাক-ঘষা একটা খুদে, লোমশ, তীক্ষ্ণদন্ত প্রাণী, যা বাড়িটার পচন-ধরা কাঠামো আর শহরটাকে ত্রস্ত করে রাখে। এসব শুনে গিলম্যান ঠিক করে নিয়েছিল যে-কোনো মূল্যে বাড়িটাতে থাকার। বাড়িটার অপবাদ ছিল, সহজে ভাড়া দেওয়া যেত না। সস্তার ভাড়াটে বাসাবাড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটা বহুকাল ধরেই। অতএব ঘর পাওয়া গিয়েছিল সহজেই। সেখানে সে কী পাওয়ার আশা করছে, তা গিলম্যানের পক্ষে বলা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এই বাড়িটাতেই কোনো এক পরিস্থিতি সপ্তদশ শতাব্দীর এক মাঝারি মেধার বৃদ্ধাকে আচমকাই এনে দিয়েছিল গণিতের গভীরতার এক অন্তর্দৃষ্টি, যা হয়তো প্ল্যাংক, হাইসেনবার্গ, আইনস্টাইন আর ডি সিটারদের17 একেবারে আধুনিক চর্চাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। সুতরাং গিলম্যান জানত যে এখানেই সে থাকতে চায়।
বাড়িটাতে নাগাল পাওয়া যায় এমন যে-কোনো জায়গায় যেখানে যেখানে দেওয়ালের কাগজ উঠে গেছে, সেখানে প্লাস্টার, কড়িকাঠ খুঁটিয়ে দেখত গিলম্যান। খোঁজ করত সাংকেতিক নকশার। পুবদিকের যে চিলেকোঠার ঘরে শোনা যায়, কেজিয়া তার মন্ত্রের সাধনা করত, সেই ঘরটা এক সপ্তাহের মধ্যেই পেয়ে গিয়েছিল সে। শুরু থেকেই খালি পড়ে ছিল ঘরটা, সেখানে কেউ কোনোদিন টানা থাকতে চাইত না। পোলিশ বাড়িওয়ালাটিও সেটা ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে পড়েছিল। তবে প্রায় জ্বরটা না-আসা অবধি গিলম্যানের তেমন কিছু হয়নি। বিষণ্ণ গলিপথ আর কামরাগুলোর মধ্যে দিয়ে লঘুপায়ে দ্রুত ছুটে যায়নি কোনো ভৌতিক কেজিয়া। তার যাচ্ছেতাই টঙের বাসাটাতে চুপিচপি তাকে নাক দিয়ে গুঁতোতে আসেনি কোনো খুদে, লোমশ প্রাণী। তার অবিরাম তল্লাশির পুরস্কার হিসেবে জোটেনি কোনো ডাকিনীর জাদুমন্ত্রের দলিল। মাঝে মাঝে ছায়া-পড়া কাঁচা গলিঘুঁজির জটের বাসি গন্ধের মধ্যে দিয়ে হাঁটা দিত গিলম্যান। সেখানে মান্ধাতার আমলের বিদঘুটে বাদামি বাড়িগুলো হেলে পড়ে, নড়বড় করে। আর উপহাসের বাঁকা হাসি হাসে ছোটো ছোটো শার্সি-বসানো সরু জানলাগুলো দিয়ে। গিলম্যান জানত, এখানে এককালে ঘটে গিয়েছিল অদ্ভুত সব ঘটনা। বাইরের আবরণের পেছনে সেই ভয়ানক অতীতের সব কিছু যে হয়তো এখনও একেবারে লুপ্ত হয়ে যায়নি, তার একটা আবছা ইঙ্গিত আছে এখানে। অন্তত সব চাইতে অন্ধকার, সব চাইতে সরু, সব চাইতে জটিল আঁকাবাঁকা গলিগুলোতে। নদীর দুর্নাম দ্বীপটাতে নৌকো বেয়ে গিয়েছিল সে দু-দুবার। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেসব শ্যাওলা-পড়া ধূসর পাথর, উদ্ভব যাদের কোনো এক অস্পষ্ট, স্মরণাতীতকালে, স্কেচ করে নিয়েছিল তাদের অনবদ্য কৌণিকতার।
গিলম্যানের ঘরখানা আকারে বড়োসড়ো ছিল বটে, কিন্তু আকৃতি ছিল তার কেমন অদ্ভুতভাবে বাঁকাচোরা। স্পষ্ট বোঝা যেত, ঘরের উত্তরদিকের দেওয়ালটা বেঁকে এসেছে বাইরের থেকে ভেতরের দিকে। নীচু ছাদটাও হালকা ঢালু হয়ে ছিল একই দিকে। বাড়ির উত্তরদিকে বাইরের সোজা দেওয়ালটা, আর এই হেলানো দেয়ালটার মধ্যে যে ফাঁকা জায়গাটা থেকে থাকবে, সেখানে ঢোকার কোনো পথ ছিল না। এমনকি আগেও যে তেমন কিছু ছিল, তারও কোনো নিদর্শন ছিল না। ছিল কেবল একটা খোলা ফোকর, স্পষ্টই ইঁদুরের, আর কয়েকটা বুজিয়ে-দেওয়া ফোকরের চিহ্ন। এ ছাড়া বাইরে থেকে দেখলে চোখে পড়ত একটা জানলা, যা তক্তা মেরে এঁটে দেওয়া হয়েছে বহুকাল আগে। ঘরের ছাদের ওপর একটা মাচা ছিল। তার মেঝেটাও নিশ্চয়ই ঢালু হয়ে থাকবে। কিন্তু সেটাতেও ঢোকার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মইতে চড়ে মাকড়সার জালে ঢাকা ছাদের বাকি অংশের মাচাটাতে উঠেছিল গিলম্যান। দেখেছিল, একটা আদ্যিকালের প্রবেশপথ আছে বটে, তবে তাকে মান্ধাতা আমলের তক্তা দিয়ে শক্তপোক্তভাবে এঁটেসেঁটে বন্ধ করে, আটকে দেওয়া হয়েছে। আটকানো হয়েছে ঔপনিবেশিক আমলের কাঠের কাজে প্রচলিত মোটা মোটা কাঠের খোঁটা দিয়ে। নির্বিকার বাড়িওয়ালাকে হাজার বুঝিয়েসুঝিয়েও গিলম্যান রাজি করাতে পারেনি তাকে ওই দুটো বন্ধ জায়গার অন্তত একটাকে একবার তত্ত্বতালাশ করে দেখতে দিতে।
যত সময় যেতে লাগল, তার ঘরের আঁকাবাঁকা দেওয়াল আর ছাদের প্রতি নিবিষ্ট আকর্ষণটা বাড়তে লাগল গিলম্যানের। তাদের অদ্ভুত কৌণিকতায় তার চোখে ধরা পড়ছিল এক গাণিতিক গূঢ় অর্থ। মনে হচ্ছিল, সে অর্থের মধ্যে আছে এদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কিছু অস্পষ্ট সমাধানসূত্র। গিলম্যান চিন্তা করে দেখেছিল, বুড়ি কেজিয়ার যে এমন বিচিত্র কৌণিক চরিত্রের একটা ঘরে ছিল, তার নিশ্চয়ই যথেষ্ট কারণ ছিল। কেজিয়া কি দাবি করেনি, যে সে কিছু নির্দিষ্ট কোণের মধ্যে দিয়ে চলে গিয়েছিল আমাদের পরিচিত শূন্যতার যে জগৎ, তার সীমানার বাইরে? তবে হেলে-থাকা সমতলক্ষেত্রটার পেছনের যে অজ্ঞাত শূন্যতা, তার থেকে তার আগ্রহ ক্রমশ সরে যেতে থাকে। সে বুঝতে পারে, ওই সমতলগুলোর যা উদ্দেশ্য, সে উদ্দেশ্যের সম্পর্ক আছে, যেদিকের অংশটায় সে ইতিমধ্যেই রয়েছে, সেইদিকের সঙ্গেই।
মস্তিষ্ক-জ্বর আর স্বপ্নগুলো ছোঁয়া লাগতে শুরু করল ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিক থেকেই। বেশ কিছু সময় ধরেই গিলম্যানের ঘরে অদ্ভুত কোণগুলো তার ওপর একরকম বিচিত্র, সম্মোহনের মতো প্রভাব ফেলছিল। বিষণ্ণ শীতকাল যত গড়াতে লাগল, গিলম্যান খেয়াল করল, সে তত বেশি করে নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছে সেই কোণটার দিকে, যেখানে ছাদ নীচে ঢালু হয়ে এসে মিলেছে ভেতরদিকে কাত-হয়ে-থাকা দেওয়ালের সঙ্গে। এই সময়টাতে নিজের পাঠক্রমের পড়াশোনায় মন দিতে না-পারাটা বড়ো বেশি দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল তাকে। বছরের মাঝখানের পরীক্ষাটা নিয়ে তার আশঙ্কা উঠে গিয়েছিল চরমে। তার বাড়াবাড়ি রকমের শ্রবণশক্তিও কম বিরক্তির কারণ ছিল না। জীবন পরিণত হয়ে দাঁড়িয়েছিল নাছোড়বান্দা, অসহ্য এক কোলাহলে। তার ওপর শ্রবণশক্তির একেবারে অন্তিম সীমানায় কম্পিত-হতে-থাকা অন্য আরও সব শব্দের এক অবিরাম, ভয়ংকর ইঙ্গিত পেত সে। হয়তো-বা জীবনের অপর পারের সব অঞ্চল থেকে আসত সেসব। আর বাস্তবে শুনতে পাওয়া যায়, এমন শব্দের কথা যদি ওঠে, তাহলে তার মধ্যে আদ্যিকালের পার্টিশনের পেছনের ইঁদুরগুলো ছিল সব চাইতে খারাপ। তাদের আঁচড়ানোর শব্দ কেবল চোরাগোপ্তা নয়, ইচ্ছাকৃত বলেও মনে হত। শব্দটা যখন আসত হেলে-থাকা উত্তরের দেওয়ালের পেছন থেকে, তখন তার সঙ্গে মিশত একটা শুকনো খড়খড় আওয়াজ। আর শব্দটা যখন আসত ঢালু ছাদের শ-খানেক বছর আগের বন্ধ মাচা থেকে, তখন যেন কোনো আশঙ্কায় সর্বদা সিঁটিয়ে যেত গিলম্যান। আশঙ্কা এমন এক বিভীষিকার, যা নেমে এসে তাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলার আগে ধৈর্য ধরে সুযোগের অপেক্ষা করছে কেবল।
স্বপ্নগুলো সব ছাড়িয়ে গিয়েছিল মানসিক সুস্থতার সীমানা। গিলম্যানের মনে হয়েছিল যে সেসব তার পাশাপাশি গণিত আর লোককাহিনি নিয়ে পড়াশোনার ফল। অনেক কিছু নিয়ে বড়ো বেশি মাথা ঘামিয়ে ফেলেছিল সে। ভাবনাচিন্তা করেছিল তার ফর্মুলা অনুযায়ী আমাদের পরিচিত তিনটে ডাইমেনশনে পেরিয়ে যা যা অস্পষ্ট অঞ্চল থাকা সম্ভব তা নিয়ে। ভেবেছিল, অনুমান করা যায় না এমন কোনো শক্তির সাহায্যে কেজিয়া মেসন সত্যি সেখানে পৌঁছোনোর প্রবেশপথ খুঁজে পেয়েছিল কি না, তার সম্ভাবনা নিয়েও। কাউন্টির হলদে-হয়ে-যাওয়া নথিপত্রে ছিল কেজিয়া মেসন আর তার বিরুদ্ধের ফরিয়াদিদের জবানবন্দি। মানুষের অভিজ্ঞতার বাইরের ব্যাপারস্যাপারের জঘন্য সব ইঙ্গিত ছিল তাতে। আর ছিল কেজিয়ার তাঁবেদার প্রেতের ভূমিকা-পালন-করা একটা লোমশ প্রাণীর বর্ণনা। যে বর্ণনার খুঁটিনাটি অবিশ্বাস্য লাগলেও, যা ভয়ানকভাবে সুস্পষ্ট।
প্রাণীটা একটা বড়োসড়ো ইঁদুরের চাইতে আকারে বড়ো নয়। শহরবাসীরা তার মজাদার নাম রেখেছিল বাদামি জেনকিন। এটা খুব সম্ভব পরের পাল্লায় পড়ে অসাধারণ এক দলগত ভ্রান্তিতে ভোগার ফসলই হয়ে থাকবে। কারণ ১৬৯২ সালে কমপক্ষে এগারোজন লোক সাক্ষী দিয়েছিল সেটার দর্শন পাওয়ার। যদিও সাম্প্রতিককালের গুজবেরও অভাব ছিল না। সব ক-টা গুজবের মধ্যের একই মিল হতভম্ব করে দেয়, অস্বস্তিতে ফ্যালে। সাক্ষীরা বলেছিল বস্তুটার আকৃতি ইঁদুরের মতো, পশম তার লম্বা। কিন্তু তার শ্বদন্ত আর দাড়ি সমেত মুখখানা কুটিলদর্শন মানুষের। আর থাবাগুলো মানুষের খুদে খুদে হাতের মতো। বুড়ি কেজিয়া আর শয়তানের মধ্যে বার্তা দেওয়া-নেওয়া করত সেটা। লালিত হত ডাকিনীটির রক্তে। সে রক্ত সেটা চুষে নিত ভ্যাম্পায়ারের কায়দায়। কণ্ঠস্বর তার একটা জঘন্য খিকখিক হাসির মতো, কথা বলতে পারত সব ভাষায়। গিলম্যানের স্বপ্নে আসত বিচিত্র, ভয়ানক অনেক কিছুই। তবে তাদের মধ্যে সব চাইতে বেশি আতঙ্ক আর বিবমিষায় তাকে ভরিয়ে তুলত এই অভিশপ্ত, খুদে সংকর জীবটিই। প্রাচীনকালের নথিপত্র আর বর্তমানের ফিশফিশানি থেকে তার জাগ্রত মন অনুমান করতে পেরেছিল অনেক কিছুই। কিন্তু সেসবের চাইতে হাজারগুণ ঘৃণিত এক মূর্তি নিয়ে তার দৃষ্টির সামনে দিয়ে সরে সরে যেত এটার ছবি।
গিলম্যানের স্বপ্ন মূলত ছিল অসীম অতলের মধ্যে দেওয়া ঝাঁপ। এমন সব অতল, যার রঙিন গোধূলির রঙের কোনো ব্যাখ্যা নেই, হতবুদ্ধি করে দেয় যার বিশৃঙ্খল শব্দ। সেসব অতলের পদার্থের কিংবা মাধ্যাকর্ষণের প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। ব্যাখ্যা করা সম্ভব ছিল না তাদের সঙ্গে তার নিজের সত্তার সম্পর্কও। সে হাঁটত না বা চড়ত না, উড়ত না বা সাঁতারাত না, হামা দিত না বা কিলবিলও করত না। অথচ সর্বদা টের পেত এক ধরনের গতি, যা আংশিক স্বেচ্ছাকৃত, আংশিক অনিচ্ছাকৃত। ভালো করে বুঝতে পারত না নিজের অবস্থাটাও। দৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিত অদ্ভুতভাবে উলটো-পালটা হয়ে যাওয়াতে সর্বদা বাদ পড়ে যেত তার হাত, পা আর শরীরের দৃশ্য। তার মনে হত, তার শরীরের কাঠামো আর মনোবুদ্ধিকে কোনো এক আশ্চর্যজনকভাবে টানটান করে পরোক্ষভাবে প্রক্ষেপ করা হয়েছে স্বপ্নের মধ্যে। যদিও তখন রয়ে গেছে তার স্বাভাবিক শারীরিক বৈশিষ্ট্য আর অনুপাতের সঙ্গে কিছুটা কিম্ভূত সম্পর্ক।
অতলগুলো কোনোমতেই খালি নয়। সেখানে ভিড় করে থাকত অপার্থিব বর্ণের আর পদার্থের আশ্চর্য সব কোণবিশিষ্ট পিণ্ডরা। তাদের মধ্যে মনে হত কিছু জৈব আর কিছু অজৈব। কিছু জৈব বস্তু তার মনের কোণে জাগিয়ে তুলত অস্পষ্ট স্মৃতি। তারা সাদৃশ্যের, ইঙ্গিতের উপহাসে কিছু বোঝাতে চাইত। কিন্তু তা যে কী, সজ্ঞানে তার ধারণা করতে পারত না গিলম্যান। তবে পরের দিকের স্বপ্নে এই জৈব বস্তুগুলোর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে শুরু করে সে। বুঝতে পারে, তাদের মধ্যে আছে আলাদা আলাদা শ্রেণিবিভাগ। এবং এইসব শ্রেণির আচার-আচরণ এবং প্রবণতাও আলাদা। তার মনে হয়েছিল, এদেরই মধ্যে একটা শ্রেণিতে কিছু আলাদা ধরনের বস্তু আছে। অন্যান্য শ্রেণির বস্তুদের নড়াচড়াটা যেমন যুক্তিহীন, এই শ্রেণিতে তেমনটা নয়। তবে জৈব হোক বা অজৈব, অসাধ্য ছিল বস্তুগুলোর বর্ণনা দেওয়া, বা তাদের বুঝতে পারা। অজৈব পিণ্ডগুলোর সঙ্গে গিলম্যান মিল পেত প্রিজ়্ম, জট, ঘনক ও তক্তির গুচ্ছ আর এবড়োখেবড়ো পাথরের চাঁইয়ে গড়া ইমারতের সঙ্গে। জৈব বস্তুগুলোকেও তার এক-একরকম মনে হত—বুদ্বুদের তাল, অক্টোপাস, তেঁতুলে বিছে, জীবন্ত দেবমূর্তি, আর সর্পিল ভঙ্গিতে জীবন্ত-হয়ে-ওঠা আরব্য আলপনা। যা কিছু তার চোখে পড়ত, সেসবের ভীষণতা, ভয়াবহতা বর্ণনার বাইরে। যখনই কোনো জৈব সত্তার নড়াচড়া দেখে মনে হত, সেটা তাকে নজর করছে, এমন একটা নগ্ন, বীভৎস আতঙ্ক বোধ হত তার, যে সাধারণত এক ধাক্কায় ঘুম ভেঙে যেত। এই জৈব সত্তারা কীভাবে নড়াচড়া করত, তার পক্ষে বলা সম্ভব ছিল না, ঠিক যেমন কিছু বলা সম্ভব ছিল না তার নিজের নড়াচড়া সম্বন্ধে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা রহস্য নজরে পড়তে শুরু করে তার। কিছু কিছু সত্তার শূন্যস্থান থেকে আচমকা আবির্ভাব হওয়া, আবার তেমন আচমকাই সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা ছিল। শব্দের যে চিৎকার, গর্জন আর কোলাহলে ব্যাপ্ত হয়ে থাকত অতল, তার সুর, ধ্বনিগুণ, তাল সমস্ত বিশ্লেষণের বাইরে। কিন্তু মনে হত জৈব হোক বা অজৈব, নির্ণয় অসাধ্য সব কিছু বাহ্যিক চেহারা আবছা পরিবর্তিত হচ্ছে, সেই শব্দের সঙ্গে যুগপৎ একই লয়ে। শব্দটা অস্পষ্ট, বিরামহীন, অনিবার্যভাবে ওঠাপড়া করত, আর একটানা আতঙ্কে ভুগত গিলম্যান, পাছে তেমনই কোনো এক ওঠাপড়ার সময়ে সেটা চড়ে যায় অসহ্য কোনো মাত্রার তীব্রতায়।
কিন্তু বাদামি জেনকিনকে গিলম্যান এই সামগ্রিক বিজাতীয়তার ঘূর্ণির মাঝে দেখেনি। ঘুমের পূর্ণ গভীরতায় তলিয়ে যাওয়ার আগে যে কিছু কিছু লঘু, তীব্র স্বপ্নের আঘাত নেমে আসত তার ওপরে, কেবল তাদের জন্যেই সংরক্ষিত ছিল সেই পিলে-চমকানো আতঙ্ক। সে যখন অন্ধকারে শুয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করত জেগে থাকার, তার মনে হত, শতাব্দীপ্রাচীন ঘরখানার চারপাশ এক মৃদু কাঁপা-কাঁপা উদ্ভাসে আলোকিত হয়ে উঠেছে। ভয়ানক কুটিলতায় তার মগজের দখল নিয়েছিল যে হেলে-থাকা সমতলক্ষেত্রগুলো, তাদের কৌণিক মিলন দেখা যেত এক বেগুনি কুয়াশার মধ্যে দিয়ে। আর বিভীষিকাটি আচমকাই আবির্ভূত হত কোণের ইঁদুরের গর্ত থেকে। চওড়া তক্তার বসে-যাওয়া মেঝের ওপর দিয়ে খুটখুট করে এগিয়ে আসত গিলম্যানের দিকে। তার দাড়ি-বসানো খুদে মানুষের মুখখানা শয়তানি প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ। নারকীয় শ্বদন্তগুলো তীক্ষ্ণ। ঈশ্বরের কৃপা, সেটা তাকে নাক দিয়ে গুঁতোনোর মতো কাছাকাছি আসার আগেই মিলিয়ে যেত তার স্বপ্নটা। ইঁদুরের গর্তটা রোজই বুজিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত গিলম্যান। কিন্তু যা দিয়েই বোজানো হোক-না কেন, পার্টিশনের আসল বাসিন্দারা দাঁতে কেটে ফেলত সেটাকে। বাড়িওয়ালাকে দিয়ে একবার তার ওপর পেরেক মেরে টিন চাপা দিইয়েছিল গিলম্যান। কিন্তু পরের দিন ইঁদুরে দাঁতে কেটে আর-একটা নতুন গর্ত বানিয়ে ফ্যালে। আর তা করতে গিয়ে ঘরের মধ্যে ঠেলে দেয় বা টেনে আনে হাড়ের একটা অদ্ভুত টুকরো।
নিজের জ্বরের কথাটা ডাক্তারকে বলেনি গিলম্যান। যে সময়টা তার কাছে পড়া মুখস্থ করার জন্যে প্রতিটি মুহূর্ত জরুরি। সে জানত, তখন তাকে যদি কলেজের হাসপাতালে ভরতি হতে নির্দেশ দেওয়া হয়, তাহলে সে পরীক্ষায় পাস করতে পারবে না। তবে তাতেও ক্যালকুলাস ডি আর উচ্চ সাধারণ মনোবিজ্ঞান পরীক্ষাতে ফেল করে যায় সে। অবশ্য টার্ম শেষ হওয়ার আগে হারানো জমি ফেরত পাওয়ার আশাটুকু তখনও বজায় থাকে তার। এল মার্চ মাসে। তার শুরুর দিকের হালকা স্বপ্নে এবার যোগ হল এক নতুন উপাদান। বাদামি জেনকিনের দুঃস্বপ্নের আকৃতির সঙ্গী হতে লাগল অস্পষ্ট এক কুয়াশার ছোপ। ক্রমশ সেটা রূপ নিতে শুরু করল কুঁজো-হয়ে-পড়া এক বৃদ্ধার। যতটা উচিত ছিল, তার চাইতে তাকে অনেকটাই বেশি অস্বস্তিতে ফেলেছিল এই নতুন সংযোজন। পরিত্যক্ত জেটির কাছে অন্ধকার অলিগলির জটের মধ্যে সে আদতে দু-দুবার বয়সের গাছপাথর নেই এমন এক বুড়ির মুখোমুখি পড়েছিল। সে অবশেষে সিদ্ধান্তে এল তার স্বপ্নে দেখা চেহারাটা অনেকটা ওই বুড়িটার মতো। এই দুই মোলাকাতেই তাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল সেই জাহাঁবাজ বুড়ির উদ্দেশ্যহীন তিক্ত কুদৃষ্টি। বিশেষত প্রথমবার, যখন পাশের একটা ছায়া-ঘেরা গলির মুখ দৌড়ে পেরিয়ে গিয়েছিল একটা কেঁদো ইঁদুর। কোনো যুক্তি ছাড়াই তাকে মনে পড়িয়ে দিয়েছিল বাদামি জেনকিনের কথা। তার এবার মনে হল, সেই স্নায়বিক ভয়েরই প্রতিফলন পড়ছে তার অরাজক স্বপ্নে।
পুরোনো বাড়িটার প্রভাব যে আদৌ স্বাস্থ্যকর নয়, তা গিলম্যানের অস্বীকার করার উপায় ছিল না। কিন্তু তার প্রথমদিকের অসুস্থ আগ্রহের অবশেষটুকু তাও আটকে রেখেছিল তাকে সেখানে। নিজেকে সে বুঝিয়েছিল যে তার রাতের উদ্ভট কল্পনার জন্যে দায়ী কেবল তার জ্বরটাই। জ্বর ছেড়ে গেলেই সে মুক্তি পাবে সেইসব ভয়ংকর দর্শনের থেকে। কিন্তু সেইসব দর্শন ছিল জঘন্যভাবে প্রাণবন্ত, দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে দিত তারা। জেগে উঠলেই তার মনে রয়ে যেত একটা হালকা অনুভূতির রেশ। যেন তার যতটুকু মনে আছে, তার চাইতে অনেক বেশি কিছুর মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। কয়েকটা ব্যাপারে বীভৎসভাবে নিশ্চিত ছিল সে—মনে না-পড়া স্বপ্নে সে কথা বলেছে বাদামি জেনকিন আর বৃদ্ধা মহিলা দুজনের সঙ্গেই। আর তারা তাকে তাগাদা দিয়েছে তাদের সঙ্গে কোথাও গিয়ে আরও ক্ষমতাবান তৃতীয় কোনো একজনের সঙ্গে দেখা করার।
মার্চের শেষের দিকে পোক্ত হতে শুরু করল তার গণিত, যদিও ক্রমশ বাড়তে লাগল অন্যান্য বিষয় নিয়ে সমস্যা। রাইম্যান18 সমীকরণ নিয়ে একটা সহজাত দক্ষতা দেখা দিল তার মধ্যে। চতুর্থ ডাইমেনশন আর অন্যান্য যা যা জটিল প্রশ্ন কুপোকাত করে ফেলত ক্লাসের বাকি সকলকে, সেসবের ওপর নিজের দখল দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সে প্রফেসার আপহ্যামকে। এক বিকেলে আলোচনা হয়েছিল শূন্যতার উদ্ভট বক্রতার সম্ভাবনা নিয়ে। আর আলোচনা হয়েছিল আমাদের অংশের মহাজগৎ তত্ত্বগতভাবে যেসব সুদূর অঞ্চলের কাছাকাছি, এমনকি সংস্পর্শেও আসতে পারে, সেইসব নিয়েও। সেসব অঞ্চল অতি দূরের যত নক্ষত্র হতে পারে, নীহারিকাদের মাঝের দুস্তর ব্যবধান হতে পারে, এমনকি যাদের ঠিকঠাক কল্পনা করা যায় না, অবিশ্বাস্য রকমের দূরের, সম্পূর্ণ আইনস্টাইনীয় দেশকাল অনবচ্ছিন্নতার পারের সেইসব মহাজাগতিক এককও হতে পারে। এইসব বিষয়বস্তু গিলম্যান যেভাবে সামলেছিল, তাতে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল সকলেই। তবে সে তার আনুমানিক ব্যাখ্যার কয়েকটা উদাহরণ দিয়েছিল। তার ফলে তার স্নায়ুর আর একাকিত্বের খ্যাপাটে ভাবটা নিয়ে যেসব প্রচুর কেচ্ছা চালু ছিল, বেড়ে গিয়েছিল সে সমস্ত। ছাত্ররা অবিশ্বাসে মাথা ঝাঁকিয়েছিল তার একটা ঠান্ডা মাথার থিয়োরিতে। মহাজাগতিক নকশাতে অসীম সংখ্যায় নির্দিষ্ট বিন্দু আছে। তার কোনো একটাতে যদি কোনো মহাকাশ বস্তু থাকে, তাহলে পৃথিবী থেকে সেখানে স্বেচ্ছায় পদার্পণ করতে পারে যে-কেউ। তবে থাকতে হবে গণিতের এমন জ্ঞান, যা খুব সম্ভব মানুষের অর্জনের বাইরে।
গিলম্যানের মত ছিল, এমন পদার্পণের কেবল দুটো ধাপ আছে। প্রথম, আমাদের পরিচিত এই ত্রিমাত্রিক গোলকটা থেকে বেরোনোর একটা পথ, এবং দ্বিতীয়, আর-একটা বিন্দুর ত্রিমাত্রিক গোলকে ফের প্রবেশ করার পথ। যে গোলকটা আছে হয়তো কোনো অসীম দূরত্বে। বহু ক্ষেত্রেই খুব সম্ভব এ কাজটা প্রাণের ঝুঁকি ছাড়াই করা যায়। ত্রিমাত্রিক ব্যাপ্তির যে-কোনো প্রাণী সম্ভবত চতুর্থ ডাইমেনশনে টিকে যেতে পারে। তবে তার দ্বিতীয় ধাপে টিকে যাওয়াটা নির্ভর করবে সে ত্রিমাত্রিক ব্যাপ্তির কোনো বেমিল অংশকে বেছে নিয়েছে পুনঃপ্রবেশের জন্যে। কিছু কিছু এমন গ্রহ থাকতে পারে, যাদের অধিবাসীরা হয়তো টিকে থাকতে পারে অন্যান্য কিছু গ্রহে, টিকে থাকতে পারে, এমনকি হয়তো অন্য নীহারিকার গ্রহগুলোতেও, কিংবা আলাদা স্থানকাল অনবচ্ছিন্নতার সমতুল্য অন্য কোনো ডাইমেনশনের মতন দশাতেও। আবার মহাকাশের এমন অনেক বস্তু বা অঞ্চলও থাকতে পারে, যা গাণিতিকভাবে সংলগ্ন হলেও একে অপরের দিক থেকে বসবাসের অযোগ্য।
বহু বাড়তি ডাইমেনশন বা অসংযতভাবে সংখ্যাবৃদ্ধি হওয়া সব ডাইমেনশনের অজানা, অবোধ্য অঞ্চল আছে। সেখানে অন্য যে-কোনো ডাইমেনশনের অঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রবেশ করে টিকে যেতে পারাটাও হয়তো সম্ভব। তা সে সমস্ত ডাইমেনশন স্থানকাল অনবচ্ছিন্নতার ভেতরেই থাকুক বা বাইরে। এমনকি হয়তো সম্ভব এর উলটোটাও। এসব কিছুই অবশ্য পূর্বানুমান। তবে গিলম্যান প্রায় নিশ্চিত ছিল একটা বিষয়ে। এক ডাইমেনশনের স্তর থেকে তার ঠিক ওপরের ডাইমেনশনের স্তরে অতিক্রমণ করলে, তাতে এক ধরনের রূপান্তর আসে। যদিও তাতে আমরা যাকে জীবদেহের অখণ্ডতা বলে বুঝি, তার বিনাশ হয় না। এই শেষ অনুমানের ব্যাপারে গিলম্যানের যুক্তিগুলো অবশ্য খুব একটা পরিষ্কার ছিল না। তবে বাকি জটিল বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে তার ধারণা ছিল একেবারে স্পষ্ট। এতটাই স্পষ্ট যে সেই অস্বচ্ছতাকে পুষিয়ে দিয়েছিল বিপরীত দিকে বাড়তি ভারসাম্যের কাজ করে। অনির্বচনীয় কোনো এক অতীতে যেসব মানব এবং প্রাক্-মানব ছিল, তাদের মহাজগৎ আর মহাজগতের নিয়মকানুনের বোধ ছিল আমাদের চাইতে অনেক বেশি। তাদের থেকে সঞ্চারিত হয়েছে জাদুবিদ্যার পুরুষানুক্রমিক যে জ্ঞান, তার কিছু পর্যায়ের সঙ্গে উচ্চগণিতের যে গভীর মিল আছে, তা ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছিল গিলম্যান। বিশেষ পছন্দ হয়েছিল সেটা প্রফেসার আপহ্যামের।
চাপা জ্বরটা না-ছাড়ায় পয়লা এপ্রিল নাগাদ বড়ো ভাবনায় পড়ে গেল গিলম্যান। এ ছাড়া তার সাথি বাসিন্দাদের মধ্যে কয়েকজন তার ঘুমের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করা নিয়ে যা বলেছিল, তাতেও দুশ্চিন্তা হয়েছিল তার। সে নাকি প্রায়ই তার বিছানায় অনুপস্থিত থাকে। এ ছাড়া রাতের কিছু বিশেষ বিশেষ ঘণ্টায় তার মেঝের ক্যাঁচকোঁচ শব্দ নিয়ে মন্তব্য করেছিল ঠিক নীচের ঘরের একজন। এ-ও বলেছিল, সে নাকি রাতের বেলা জুতো-পরা পায়ের শব্দ শুনতে পায়। গিলম্যানের অবশ্য মনে হয়েছিল, লোকটার নিশ্চয়ই ভুল হয়ে থাকবে, কারণ সকালে তার জুতো সমেত বাকি পোশাক-আশাক পাওয়া যেত সঠিক জায়গাতেই। এই পুরোনো অস্বাস্থ্যকর বাড়িটাতে শোনার ভুলের বাতিক যে কারোই হতে পারে। গিলম্যানের নিজেরও কি এখন আজকাল নিশ্চিত মনে হয় না যে হেলানো দেওয়াল আর হেলানো ছাদের পেছনের অন্ধকার শূন্যতা থেকে ভেসে আসছে ইঁদুরের আঁচড়ানো ছাড়াও অন্য শব্দ? এমনকি দিনের আলোতেও? আদ্যিকালে এঁটে বন্ধ করে রাখা মাথার ওপরের মাচায় আবছা পায়ের শব্দ শোনার জন্যে উৎকর্ণ হয়ে থাকতে লাগল তার অসুস্থতার পর্যায়ে চলে-যাওয়া শ্রবণশক্তি। আর মাঝেমধ্যে এমন বিভ্রম সত্যিই বাস্তব বলে মনে হত।
তবে গিলম্যান জানত যে সত্যিই সে ঘুমের মধ্যে হাঁটাচলা করছে। কারণ দু-দুবার রাতের বেলা শূন্য ছিল তার ঘর, অথচ তার সব কাপড়চোপড় ছিল যথাস্থানেই। ব্যাপারটার যে সত্য, তা নিশ্চিত করেছিল ফ্রাংক এলউড। ফ্রাংক এলউড তার একমাত্র সহপাঠী, যে দরিদ্রতার দায়ে বাসা নিয়েছিল ওই নোংরা, মানুষের চক্ষুশূল বাড়িটাতেই। মাঝরাতের পর পড়াশোনা করছিল এলউড, ওপরে উঠে এসেছিল ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাসের একটা সমীকরণ নিয়ে সাহায্য চাইতে। কিন্তু এসে দেখেছিল গিলম্যান নেই। ধাক্কা দিয়ে সাড়া না পেয়ে এঁটে-না-রাখা দরজাটা তার খোলাটা অবশ্যই উচিত হয়নি। কিন্তু তার সাহায্যের বড়ো দরকার হয়ে পড়েছিল, আর সে এ-ও ভেবেছিল, একটা হালকা খোঁচা মেরে তুলে দিলে গিলম্যান কিছু মনে করবে না। দুবারই কিন্তু গিলম্যান ছিল না। কেবল রাত-পোশাকে খালি পায়ে সে যে কোথায় ঘুরতে গিয়ে থাকতে পারে, ব্যাপারটা শোনার পর গিলম্যানের নিজের মনেই সে প্রশ্ন উঠেছিল। মনস্থির করে নিয়েছিল, তার ঘুমের ঘোরে হাঁটার অভিযোগ যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ব্যাপারটা সে খতিয়ে দেখবে। ভেবে রেখেছিল, করিডরের মেঝেতে ময়দা ছিটিয়ে রাখবে, তার পায়ের ছাপ কোনদিকে যায় দেখার জন্যে। বেরোনোর পথ বলতে ছিল একমাত্র দরজাটাই, কারণ সরু জানলাটার বাইরে পা রাখার জায়গা ছিল না।
একতলার একটা ঘরে থাকত কুসংস্কারে ভোগা তাঁত-মিস্ত্রি জো মাজুরেভিচ। এপ্রিল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বরের চোটে তীক্ষ্ণ-হয়ে-ওঠা গিলম্যানের শ্রবণশক্তিকে এবার পীড়া দিতে শুরু করল লোকটার নাকিসুরে একটানা প্রার্থনা। বুড়ি কেজিয়ার ভূত আর লোমশ, ক্ষুরধার দাঁতের, নাকে গুঁতোনো প্রাণীতাকে নিয়ে লম্বা, অসংলগ্ন সব গল্প বলত মাজুরেভিচ। বলত, মাঝেমধ্যে নাকি ভয়ানক ভূতুড়ে অভিজ্ঞতা হয় তার। সে সময়ে তাকে স্বস্তি দিতে পারে একমাত্র তার রুপোর ক্রুশটা। যেটা ঠিক এই প্রয়োজনের জন্যেই তাকে দিয়েছিলেন সেন্ট স্টানিস্লস চার্চের ফাদার ইভানিটস্কি। এই সময়টা তার প্রার্থনা করতে থাকার একটা কারণ আছে। এগিয়ে আসছে ডাকিনী সাবাটের19 সময়। মে-ইভ হল ওয়ালপুর্গিসের20 রাত। সে সময়ে নরকের যত তিমিরাচ্ছন্ন পাপ টহল দেয় পৃথিবীতে। শয়তানের দাসেরা জড়ো হয় সব অবর্ণনীয় আচার-অনুষ্ঠান আর ক্রিয়াকর্মের জন্যে। আর্কহ্যামে এ সময়টা সর্বদাই খারাপ। তা সে মিস্কাটনিক অ্যাভিনিউ, হাই স্ট্রিট আর স্যালটন স্ট্রিটের ভদ্দরলোকেরা যতই এসব কিছু না-জানার ভান করুন-না কেন। কিছু দুষ্কর্ম হবে, হয়তো হারিয়ে যাবে দু-একটা শিশুও। এসব ব্যাপার জো জানে। তার পুরোনো দেশে তার ঠাকুমা এসব শুনেছিল তার নিজের ঠাকুমার কাছ থেকে। প্রার্থনা করা আর মালা জপাটাই এ মরশুমে বুদ্ধিমানের কাজ। মাস তিনেক ধরে কেজিয়া আর বাদামি জেনকিন তার ঘরের কাছে আসেনি, আসেনি চয়েনস্কির ঘরের কাছে বা অন্য কোথাও। তাদের এভাবে নিজেদের চেপে রাখাটা আদৌ ভালো লক্ষণ নয়। নিশ্চয়ই কোনো ফন্দি আঁটছে তারা।
মাসের ১৬ তারিখে একজন ডাক্তারের অফিসে ঢুঁ মেরেছিল গিলম্যান। অবাক হয়ে গিয়েছিল জেনে যে সে যতটা ভেবেছিল, তার টেম্পারেচার ততটা বেশি নয়। ডাক্তারটি চোখা চোখা প্রশ্ন করেছিলেন তাকে, তারপরে পরামর্শ দিয়েছিলেন একজন নার্ভ স্পেশালিস্টকে দেখাতে। সে যে ভাগ্যিস কলেজের অত্যধিক কৌতূহলী ডাক্তারটিকে দেখায়নি ভেবে স্বস্তি পেয়েছিল গিলম্যান। বুড়ো ওয়ালড্রনই আগে তার কাজকর্ম ছেঁটে দিয়েছিল। এবার অতি অবশ্যই তাকে বিশ্রাম নিতে পাঠাত। তার ফর্মুলার দুরন্ত ফলাফলের এত কাছে পৌঁছে বিশ্রাম নেওয়াটা এখন অসম্ভব। পরিচিত ব্রহ্মাণ্ড আর চতুর্থ ডাইমেনশনের মাঝের যে সীমানা, তার কাছাকাছি অবশ্যই রয়েছে সে। কে বলতে পারে, সে আরও কতদূর যেতে পারে?
তার এই চিন্তাগুলো আসতে আসতেই, তার এই অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসের উৎস প্রশ্ন তুলল তার মনে। দিনে দিনে পাতা ভরতি করে ফেলা ফর্মুলা থেকেই কি আসছে আসন্ন কোনো কিছুর এক ভয়ানক অনুভূতি? ঘাবড়ে দিচ্ছে ওপরের এঁটে-বন্ধ-করা মাচায় মৃদু, অলক্ষিত, কল্পিত পদশব্দও। এর ওপর তাকে কেউ যে অবিরাম প্ররোচিত করে চলেছে ভয়ানক এমন একটা কিছু করতে, এমন একটা কিছু, যা তার করা উচিত নয়, এইরকম একটা অনুভূতিও তার ইদানীং বেড়েই চলেছে। ঘুমের মধ্যে হাঁটার ব্যাপারটারই বা কী? মাঝেমধ্যে রাতের বেলা কোথায় যায় সে? পরিচিত আওয়াজের পাগল-করে-দেওয়া কোলাহলের ভেতর থেকে যে শব্দটার অস্পষ্ট ইঙ্গিত মাঝেমধ্যে চুইয়ে আসে, আসে এমনকি ভরা দিনের বেলা আর সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থাতেও, সেটাই বা কী? সে শব্দের ছন্দ মেলে না পৃথিবীর কোনো কিছুর সঙ্গেই। যদি না তার তুলনা করা যায় কিছু অকথ্য সাবাথ মন্ত্রের সুরের ওঠাপড়ার সঙ্গে। কখনো-কখনো তার আশঙ্কা হত তার স্বপ্নের বিজাতীয় অতলের অস্পষ্ট সেই তীক্ষ্ণ চিৎকার বা গর্জনের সঙ্গে মিল আছে শব্দটার।
ইতিমধ্যে নির্মম হয়ে আসছিল স্বপ্নগুলো। প্রাথমিক পর্যায়ের হালকা স্বপ্নের অশুভ বৃদ্ধার রূপ হয়ে উঠেছিল অমানুষিক। গিলম্যান জানত, এই মহিলাই তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল বস্তির মধ্যে। তার ঝুঁকে-পড়া পিঠ, লম্বা নাক আর শুকিয়ে-আসা থুতনিকে ভুল করার উপায় নেই। তার বেঢপ বাদামি পোশাক-আশাকও ঠিক সেইরকম যেমন তার মনে ছিল। মুখে তার বীভৎস বিদ্বেষ আর উচ্ছ্বাসের ছাপ। ঘুম ভাঙলে গিলম্যানের মনে পড়ে যেত একটা দাঁড়কাকের মতো কর্কশ কণ্ঠস্বরের কথা। তাকে জোরাজুরি করত, ভয় দেখাত সেটা। বলত, তাকে দেখা করতে হবে কৃষ্ণমানবের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে যেতে হবে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার কেন্দ্রে আজাজথের দরবারে। স্বাধীনভাবে তার গবেষণা এগিয়ে গেছে অনেক দূর। এবার তাই নিজের রক্তে তাকে স্বাক্ষর করতে হবে আজাজথের কেতাবে, নিতে হবে নতুন নাম। যে বিশৃঙ্খলার দরবারে তীক্ষ্ণ সুরে বাঁশি বেজে চলে উদ্দেশ্যহীনভাবে, বাদামি জেনকিন আর অন্যজনের সঙ্গে সেখানে যায়নি সে একটাই কারণে। ‘আজাজথ’ নামটা চোখে পড়েছিল তার নেক্রোনমিকনে। সে জানত বর্ণনা করার পক্ষেও অতি ভয়ংকর এক আদিম অমঙ্গলের প্রতীক ওই নাম।
নীচে হেলে-থাকা ছাদ আর ভেতরে হেলে-থাকা দেওয়াল যেখানে মিলেছে, সেখানে সর্বদা হাওয়া থেকে আবির্ভাব হত বৃদ্ধার। মেঝের চাইতে বরং ছাদের কাছেই জমাট বেঁধে উঠত সে। প্রতিরাতেই স্বপ্নটা সরে যাওয়ার আগে সে আরও একটু প্রকট হয়ে আসত, সরে আসত আরও একটু কাছে। প্রতিবারের চাইতে আরও একটু করে আগে এগিয়ে আসত বাদামি জেনকিনও। সেই অস্বাভাবিক বেগুনি প্রভায় আঁতকে দিয়ে চকচক করত তার হলদেটে-সাদা শ্বদন্তগুলো। তার তীক্ষ্ণ, জঘন্য খিকখিক আরও বেশি করে আটকে যেত গিলম্যানের মাথায়। আর ‘আজাজথ’ আর ‘নিয়ারলাথোটেপ’ শব্দ দুটো সে যেভাবে উচ্চারণ করত, সকালে তা মনে পড়ে যেত তার।
গাঢ় স্বপ্নেও একইভাবে আরও প্রকট হয়ে উঠছিল সব কিছু। গিলম্যানের মনে হয়েছিল তার চারপাশের গোধূলিটা চতুর্থ ডাইমেনশন ছাড়া অন্য কিছু নয়। এখানকার কিছু কিছু জৈবিক সত্তার মধ্যে স্পষ্টত যুক্তিহীন, উদ্দেশ্যহীনভাবে নড়াচড়াটা মনে হত সব চাইতে কম। সেগুলো আমাদের নিজস্ব গ্রহের জীবিত প্রাণীদের প্রক্ষেপণ, যার মধ্যে আছে মানুষও। অন্যগুলো তাদের নিজেদের ডাইমেনশনের গোলকে বা অন্য গোলকে আসলে কী, তা নিয়ে চিন্তা করার চেষ্টা পর্যন্ত করার সাহস তার হয়নি। কম যুক্তিহীনভাবে নড়াচড়া করছে, এমন দুটো বস্তুর নজরে পড়ে গিয়েছিল সে। একটা নড়াচড়ায় রং পালটানো, লম্বাটে ডিমের মতো বুদ্বুদের বেশ বড়োসড়ো থোকা, অন্যটা তার চাইতে অনেক ছোটো একটা অজানা বর্ণের পলকাটা নিরেট বস্তু, তার পিঠের কোণগুলো ঘনঘন বদলায়। সে যখন দৈত্যাকার পিরামিড, জট, ঘনক আর তক্তির গুচ্ছ আর আপাত-ইমারতের মধ্যে দিয়ে দিক পরিবর্তন করত, তার আগে আগে কিংবা পিছু পিছু চলত এই দুটো। আর সর্বদা সেই তীক্ষ্ণ চিৎকার আর গর্জন উত্তরোত্তর বেড়ে চলত উচ্চ থেকে আরও উচ্চগ্রামে। যেন সেটা উঠে যাচ্ছে চরম অসহ্য তীব্রতার কোনো ভয়ানক অন্তিম পরিণতির দিকে।
নতুন ঘটনাটা ঘটল এপ্রিল উনিশ-কুড়ির রাতের বেলা। গিলম্যান তখন আধা-অনিচ্ছাকৃতভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে যত গোধূলি অতলে। তার আগে আগে ভেসে যাচ্ছে বুদ্বুদের থোকা আর পলকাটা খুদে বস্তুটা। এমন সময়ে তার নজরে পড়ল আশপাশের কিছু দানবিক প্রিজ়্মগুচ্ছের ধারগুলো মিলে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত সাধারণ কোণ। আর এক সেকেন্ডের মধ্যে সে অতল থেকে বেরিয়ে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে পড়ল তীব্র সবুজ আলোর আভায় ভেসে-যাওয়া এক পাথুরে পাহাড়ের গায়ে। তার খালি পা, পরনে রাতের পোশাক। হাঁটার চেষ্টা করে সে টের পেল যে ঠিক করে তার পা পর্যন্ত তুলতে পারছে না। ঠিক সামনের ঢালু জমিটুকু ছাড়া পাক-খাওয়া কুয়াশা ঢেকে রেখেছে বাকি সব কিছু। সেই কুয়াশার মধ্যে থেকে যে কী শব্দ ভেসে আসতে পারে, তার কথা চিন্তা করেই আতঙ্কে গুটিয়ে গেল সে।
তারপর সে দেখতে পেল, তার দিকে কষ্টেসৃষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে দুটো আকৃতি। সেই বৃদ্ধা মহিলা আর খুদে লোমশ বস্তুটা। কষ্ট করে হাঁটুতে ভর দিয়ে শরীরটাকে তুলে ধরল স্কিয়ে যাওয়া বুড়ি, কোনোমতে হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে আনল অদ্ভুতভাবে। স্পষ্টত কষ্ট করেই সামনের মানুষের মতো ভয়ানক থাবাটা তুলে ধরে বিশেষ একদিকে ইঙ্গিত করল বাদামি জেনকিনও। বৃদ্ধা মহিলার হাতের ভঙ্গির কোণ আর খুদে দানবটার থাবার ইঙ্গিত-করা দিকে নিজেকে হিঁচড়ে নিয়ে গেল গিলম্যান এমন কোনো প্রবৃত্তির তাড়নায়, যার উৎপত্তি তার ভেতর থেকে আসেনি। কিন্তু পা টেনে টেনে তিন কদম যেতে-না যেতেই সে ফের পৌঁছে গেল সেই সমস্ত গোধূলি অতলে। তার চারপাশে সেখানে তখন ফেনিয়ে উঠছে সব জ্যামিতিক আকৃতি। মাথা-ঘোরা অবস্থায় বিরামহীনভাবে সেখানে পড়তে থাকল সে। এবং অবশেষে জেগে উঠল প্রাচীন মায়াবী বাড়িটার উন্মাদ কোণের চিলেকোঠায় তার নিজের বিছানাতে।
সেদিন সকালে সে আর কিছু করার মতো অবস্থাতে ছিল না। কামাই করল সব ক-টা ক্লাসই। কোনো অজানা আকর্ষণ তার নজরকে টানছিল এমন একদিকে, যা আপাতদৃষ্টিতে উদ্দেশ্যহীন। মেঝের একটা বিশেষ ফাঁকা জায়গার দিকে না তাকিয়ে পারছিল না সে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পালটাতে লাগল তার শূন্যদৃষ্টির ফোকাস, এবং অবশেষে দুপুর নাগাদ পরাস্ত হল তার শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকার তাগিদটা। দুটো নাগাদ সে বাইরে বেরোল লাঞ্চের জন্যে। শহরের সরু অলিগলিগুলোতে পাক খেতে খেতে তার খেয়াল হল যে সে সর্বদা ঘুরে যাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্বদিকে। চার্চ স্ট্রিটের একটা কাফেটেরিয়াতে তাকে থামতে হল বেশ চেষ্টা করেই। খাওয়ার পর সেই অজানা টানটা সে টের পেতে লাগল আরও বেশি করে।
এবার বোধহয় তাকে কোনো নার্ভ স্পেশালিস্ট দেখাতেই হবে। এসবের সঙ্গে খুব সম্ভব তার ওই ঘুমিয়ে-হাঁটা রোগের কোনো সম্পর্ক আছে। কিন্তু তার মধ্যে তাকে নিজেই ওই অসুস্থ ঘোরটা ভাঙার অন্তত চেষ্টা করতে হবে। সেই টানটা থেকে দূরে সরে যাওয়ার ক্ষমতা তার নিঃসন্দেহে তখনও ছিল। অতএব প্রচুর মনের জোর খাটিয়ে গিলম্যান রওনা দিল তার ঠিক উলটোদিকে। নিজেকে জোর করে টেনে নিয়ে চলল গ্যারিসন স্ট্রিট ধরে উত্তরদিকে। মিস্কাটনিকের ওপর ব্রিজে যতক্ষণে সে গিয়ে উঠল, ততক্ষণে এক শীতল ঘাম দেখা দিয়েছে তার শরীরে। লোহার রেলিং আঁকড়ে সে তাকিয়ে রইল নদীর উজানের সেই দুর্নাম দ্বীপের দিকে। সেখানে বিকেলের রোদে তখন নীরবে অমঙ্গলের পূর্বাভাসের মতো দাঁড়িয়ে প্রাচীন পাথরগুলোর অচল রেখাগুলো।
আর তারপরেই চমকে উঠল গিলম্যান। সেই নির্জন দ্বীপে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এক জীবিত আকৃতি। দ্বিতীয় নজরে সে বুঝতে পারল যে সেটা অবশ্যই সেই অদ্ভুত বৃদ্ধা, যার অভিচারী চেহারাটা দুর্বিপাকের মতো ঢুকে পড়েছে তার স্বপ্নে। নড়ছিল তার কাছের লম্বা ঘাসগুলোও, যেন জমির কাছাকাছি হামা দিচ্ছে অন্য আর-এক জীবন্ত প্রাণী। বৃদ্ধা তার দিকে ঘুরতে আরম্ভ করলে সে আচমকাই পালাল ব্রিজ থেকে। আশ্রয় নিল শহরের তটের গলিঘুঁজির জটে। দ্বীপটা অনেক দূরে বটে, কিন্তু তাও তার মনে হচ্ছিল, সেই বাদামি পোশাক-পরা ঝুঁকে-পড়া প্রাচীন অবয়বের বিদ্রুপের স্থিরদৃষ্টি থেকে বয়ে আসতে পারে কোনো ভয়ংকর অজেয় অমঙ্গল।
তখনও বজায় রয়েছে সেই দক্ষিণ-পূর্বদিকের টান। কেবল মারাত্মক মনের জোর খাটিয়েই তবে গিলম্যান সক্ষম হল প্রাচীন বাড়িটার মধ্যে নিজেকে টেনে এনে নড়বড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে যেতে। চুপচাপ বসে রইল সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার দৃষ্টি ক্রমশ সরে যেতে থাকল পশ্চিমদিকে। ছ-টা নাগাদ তার তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তিতে ধরা পড়ল দুটো তলা নীচের জো মাজুরেভিচের একটানা নাকিসুরের প্রার্থনা। হতাশায় মরিয়া হয়ে ছোঁ মেরে টুপিটা তুলে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল সূর্যাস্ত সোনালি রাস্তায়। এইবার প্রত্যক্ষ-হয়ে-ওঠা টানটাকে তাকে বয়ে নিয়ে যেতে দিল, যেখানে সেটা নিয়ে যেতে চায়। ঘণ্টাখানেক বাদে দেখা গেল, সে পৌঁছে গেছে হ্যাংম্যান’স ব্রুক পেরিয়ে খোলা মাঠে। সামনে তার ঝকঝক করছে বসন্তের ঝিলমিলে তারারা। তার হাঁটা দেওয়ার তাগিদটা তখন ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে রহস্যজনকভাবে শূন্যে লাফিয়ে ওঠার ইচ্ছেয়। সহসা সে বুঝতে পারল সেই টানটার উৎস কোথায়।
সে টানের উৎস আকাশে। তারাদের মাঝের একটা বিশেষ বিন্দুর দাবি আছে তার ওপর। সেটাই ডাক দিচ্ছে তাকে। খুব সম্ভব বাসুকি21 মণ্ডল আর অর্ঘ্যপোত22 মণ্ডলের মাঝামাঝি কোথাও সেই বিন্দু। গিলম্যান বুঝতে পারছিল যে ভোর হওয়ার খানিক পরে ওঠা থেকেই সেটার উদ্দেশে যাওয়ার তাগাদা পাচ্ছে সে। সকালে সেটা ছিল পায়ের তলায়। বিকেলে সেটার উদয় হচ্ছিল দক্ষিণ-পূর্বে। এখন এটা মোটামুটি দক্ষিণে, তবে ঘুরে যাচ্ছে পশ্চিমের দিকে। এই নতুন ব্যাপারটার অর্থ কী? সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? কতক্ষণ স্থায়ী হবে এটা? ফের মনের জোর একত্রিত করে পেছনে ফিরল গিলম্যান। নিজেকে টেনে নিয়ে গেল সেই অনিষ্টচারী বাড়িটাতে।
দরজায় তার জন্যে অপেক্ষা করছিল মাজুরেভিচ। মনে হচ্ছিল, তাজা কোনো কুসংস্কারের টুকরো ফিশফিশিয়ে বলতে সে একই সঙ্গে উদ্গ্রীব এবং অনিচ্ছুক। ব্যাপারটা ডাকিনী আলোক নিয়ে। আগের রাতে জো বাইরে ছিল উৎসব উদ্যাপন করতে। সে দিনটা ছিল ম্যাসাচুসেট্সের দেশপ্রেমিক দিবস। বাড়ি ফিরেছিল সে মাঝরাতের পর। বাইরে থেকে বাড়িটার ওপরের দিকে তাকিয়ে তার প্রথমে মনে হয়েছিল গিলম্যানের জানলাটা অন্ধকার। তারপর তার চোখে পড়েছিল ভেতরের আবছা বেগুনি আভা। তার মনে হয়েছিল বাবুকে আভাটার ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া দরকার। কারণ আর্কহ্যামের সবাই জানে এ হল কেজিয়ার ডাকিনী আলো। এ আলো খেলা করে বাদামি জেনকিন আর খোদ বহুকেলে বুড়িটার প্রেতের কাছে। এসব কথা সে আগে উল্লেখ করেনি বটে, কিন্তু এবার এ ব্যাপারে তার বলা দরকার। কারণ এর মানে হল, কেজিয়া আর তার লম্বা দাঁতাল প্রেত দাদাবাবুর ঘাড়ে চাপছে। তার, পল চয়েন্সকি আর বাড়ির মালিক ডমব্রাওস্কির মনে হয়েছিল, দাদাবাবুর ঘরের মাথার সিল-করা মাচাটার ফাটল দিয়ে চুইয়ে পড়ছে সেই আলোটা। যদিও তারা সবাই মিলে ঠিক করেছিল, এ ব্যাপারে তারা কোনো কথা বলবে না। তবে অন্য আর-একটা ঘর নেওয়া, আর ফাদার ইভানিটস্কির মতো কোনো ভালো পাদরির কাছ থেকে একটা ক্রুশ নিয়ে আসাটাই বোধহয় বাবুর পক্ষে ভালো হবে।
লোকটা বকবক করে যাওয়ার মধ্যেই গিলম্যানের মনে হচ্ছিল, কোনো অজানা আতঙ্ক তার গলা চেপে ধরেছে। সে বুঝতেই পারছিল যে জো যখন আগের রাতে বাড়ি ফিরেছিল, তখন সে নিঃসন্দেহে আধ-মাতাল ছিল। কিন্তু তাও, তার উল্লেখ-করা চিলেকোঠার জানলায় বেগুনি আলোর কথাটার একটা ভয়ংকর অর্থ ছিল। গিলম্যানের অজানা অতলে ঝাঁপের আগে ভূমিকাস্বরূপ থাকত যেসব হালকা, স্পষ্ট স্বপ্নগুলো, তাতে ওই বৃদ্ধা আর লোমশ প্রাণীটাকে ঘিরে সর্বদা খেলা করত ওইরকমই মৃদু আভা। একজন জাগ্রত দ্বিতীয় ব্যক্তিও যে সেই স্বপ্ন প্রভা দেখতে পাবে, সে চিন্তাটাই ছিল মানসিক সুস্থতার সীমানার একেবারে বাইরে। কিন্তু এ লোকটা এমন অদ্ভুত ধারণা পেলই বা কোথা থেকে? গিলম্যান কি নিজেই ঘুমের ঘোরে হাঁটার সময়ে এইসব কথা বলেছে? জো জানাল, না সে বলেনি। কিন্তু তাও এই ব্যাপারটা গিলম্যানের একবার খুঁটিয়ে দেখা দরকার। হয়তো ফ্রাংক এলউড কিছু বলতে পারবে, যদিও তাকে জিজ্ঞাসা করাতে তার মোটেও রুচি ছিল না। জ্বর। উদ্দাম স্বপ্ন। ঘুমের ঘোরে হাঁটা। শব্দের বিভ্রম। আকাশের এক বিন্দুর দিকে টান। আর তার ওপর পাগলের মতো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলার সন্দেহ। তাকে অতি অবশ্যই পড়াশোনা বন্ধ করতে হবে, দেখাতে হবে কোনো নার্ভ স্পেশালিস্টকে। নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে নিজেকে। দ্বিতীয় তলাটায় উঠে সে থমকে দাঁড়াল এলউডের দরজায়। কিন্তু দেখতে পেল এলউড ঘরে নেই। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে উঠে গেল নিজের চিলেকোঠার ঘর অবধি, বসে রইল অন্ধকারে। তার দৃষ্টিকে তখনও দক্ষিণ-পশ্চিমদিকটা টানছে বটে, কিন্তু সে এ-ও খেয়াল করল যে সে মনঃসংযোগ দিয়ে কান পেতে রয়েছে ওপরের বন্ধ মাচা থেকে আসা কোনো শব্দের আশায়। প্রায় কল্পনা করছে যে নীচু, হেলানো ছাদের একটা অতি ক্ষুদ্র ফাটল থেকে চুইয়ে আসছে অশুভ বেগুনি আলো।
সেই রাতে, গিলম্যান যখন ঘুমিয়ে, সেই আলো তার ওপর আছড়ে পড়ল অধিকতর তীব্রতায়। বৃদ্ধা ডাকিনী আর খুদে লোমশ প্রাণীটা এগিয়ে এল আগের চাইতে আরও কাছে। তাকে ব্যঙ্গ করতে লাগল অমানুষিক তীক্ষ্ণ চিৎকার আর নারকীয় অঙ্গভঙ্গি দিয়ে। তারপরে আবছা গর্জনের গোধূলি অতলে তলিয়ে যেতে পেরে খুশিই হয়েছিল সে। যদিও সেই নড়াচড়ায় রং-পালটানো বুদ্বুদের তাল আর ক্যালাইডোস্কোপের মতো বর্ণময় খুদে পলকাটা নিরেট বস্তুটা যে তার পিছু নিচ্ছিল, তার সেটা ভয়ংকর এবং বিরক্তিকর লেগেছিল। তারপরে এল পরিবর্তন। তার ওপরে-নীচে বিকটভাবে প্রকট হয়ে উঠল একই বিন্দুতে মিলন অভিমুখী কোনো পিচ্ছিল বস্তুর সব সুবিশাল তক্তি। সেই পরিবর্তন সমাপ্ত হল বিদ্যুৎচমকের মতো প্রলাপে আর-এক অজানা, আগন্তুক আলোর ঝলকানিতে। যে আলোর মধ্যে উন্মত্ত, জটিলভাবে মেশানো হলুদ, গাঢ় লাল আর গভীর নীল।
তারপর গিলম্যান দেখল, একটা উদ্ভট ধরনের খাটো থামের রেলিং-বসানো একটা উঁচু চত্বরের ওপর আধশোয়া হয়ে সে পড়ে। তার নীচে অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য সব শিখর, ভারসাম্য রাখা তক্তি, গম্বুজ, মিনার, আর কৃশকায় চুড়োয় ভর রাখা আড়াআড়ি চাকতির এক সীমাহীন জঙ্গল। আর সে সমস্ত কিছুর চাইতেও উদ্দাম আরও অগণন আকৃতি। তাদের কিছু পাথরের, কিছু ধাতুর। এক বহুবর্ণের আকাশের মিশ্র, প্রায় ঝলসানো আভায় জমকালোভাবে ঝকঝক করে সেগুলো। ওপরে তাকিয়ে সে দেখতে পেল তিনটি বিস্ময়কর রকমের প্রকাণ্ড অগ্নিবলয়, তাদের প্রতিটির বর্ণ আলাদা। অসীম দূরত্বে নীচু পাহাড়ের বক্র দিগন্তের ওপর তাদের উচ্চতাও আলাদা। তার পেছনে, যতদূর চোখ যায়, থাকে থাকে উঠে গেছে চত্বরের শ্রেণি। নীচের শহরটা ছড়িয়ে গেছে দৃষ্টির সীমানা অবধি। গিলম্যান ভাবে, সেখান থেকে কোনো আওয়াজ উপচে উঠে না এলেই ভালো হয়।
চত্বর থেকে নিজেকে টেনে তুলতে পারল গিলম্যান অনায়াসেই। সে চত্বর গড়া এমন এক শিরা দেওয়া, পালিশ-করা পাথরে যা শনাক্ত করতে পারা ছিল তার ক্ষমতার বাইরে। সে চত্বরের টালিগুলো কাটা উদ্ভট সব কোণ সমেত আকারে। সেসব আকার দেখে তার মনে হয়েছিল যে তাতে যত-না অসামঞ্জস্য আছে, তার চাইতেও আছে এমন এক অপার্থিব সামঞ্জস্য, যার নিয়মকানুন বোঝা তার পক্ষে অসাধ্য। খাটো থামের রেলিংটা বুক অবধি উঁচু, আকর্ষণীয় নির্মাণ তার অদ্ভুত। রেলিং-এর মাথায় স্বল্প ব্যবধানে বসানো ছিল খুদে খুদে মূর্তি। গড়ন তাদের কিম্ভূতকিমাকার, কারিগরি তাদের সূক্ষ্ম। মূর্তিগুলো খাটো থামের রেলিং-এর মতোই তৈরি কোনো চকচকে ধাতুতে। সেই মিশ্র দীপ্তিতে তার রং যে কী তা আন্দাজ করা কঠিন। তাদের প্রকৃতিও অনুমানের সম্পূর্ণ বাইরে। আকৃতি তাদের খাঁজকাটা পিপের মতো। মাঝখানের একটা রিং থেকে স্পোকের মতো আড়াআড়ি বেরিয়ে এসেছে শিকের মতো বাহু। পিপের মাথা এবং গোড়া থেকে লম্বালম্বি বেরিয়েছে গাঁট বা আবের মতো কিছু। এই গাঁটগুলো প্রত্যেকটা একটা করে চক্রের নাভিকেন্দ্র। পাঁচটা করে লম্বা, চ্যাপটা, ক্রমশ সরু-হয়ে-আসা ত্রিকোণ প্রত্যেকটা গাঁটের চারপাশে সাজানো তারামাছের বাহুর মতো। বাহুগুলো প্রায় জমির সঙ্গে সমান্তরাল, তবে ঈষৎ বেঁকে গেছে মাঝের পিপে থেকে। নীচের গাঁটের তলাটা লম্বা রেলিং-এর সঙ্গে জোড়া। সে জোড়ের স্পর্শ এমনই সূক্ষ্ম যে ভেঙে উধাও হয়ে গেছে বেশ কয়েকটা মূর্তি। উচ্চতায় মূর্তিগুলো সাড়ে চার ইঞ্চি। খোঁচা খোঁচা বাহু সমেত তাদের ব্যাস আড়াই ইঞ্চির বেশি হবে না।
উঠে দাঁড়াতে গিলম্যানের খালি পায়ে টালিগুলোকে গরম বলে মনে হল। সেখানে সে সম্পূর্ণ একা। তার প্রথম কাজ হল রেলিং অবধি হেঁটে গিয়ে প্রায় দু-হাজার ফুট নীচে পাথরের চাঁইতে গড়া সীমাহীন শহরটার দিকে একটা নজর দেওয়া। তাতে মাথা ঘুরে গেলেও। কান পেতে শুনতে শুনতে তার মনে হল, নীচের সরু রাস্তাগুলো থেকে উঠে আসছে মৃদু সংগীতের বিশৃঙ্খল ছন্দ। আর তা আসছে সুরের ওঠাপড়ার এক প্রসারিত বিস্তৃতিকে প্রকাশ-করা বাতাসিয়া বাদ্যযন্ত্র থেকে। তার ইচ্ছে হতে লাগল জায়গাটা বাসিন্দাদের চেনার। কিন্তু দৃশ্যটাতে কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথা ঘুরতে লাগল তার, সহজাত প্রবৃত্তির বশে ঝকঝকে রেলিংটা আঁকাড়ে না ধরলে চত্বরের ওপর হয়তো পড়েই যেত। উঁচিয়ে-থাকা একটা মূর্তির ওপর পড়েছিল তার ডান হাতটা, তাকে অল্প সুস্থির করেছিল সেই স্পর্শ। কিন্তু ধাতুর বিচিত্র, অচেনা, সূক্ষ্ম কারিগরির পক্ষে তা সহ্য করা সম্ভব হয়নি, মুঠোয় ভেঙে চলে এসেছিল গজালের মতো মূর্তিটা। তখনও তার একরকম বিহ্বল অবস্থা তার, মুঠোতে আঁকড়েই রইল সে সেটাকে। তার বাঁ হাতটা চেপে ধরল মসৃণ রেলিং-এর একটা খালি জায়গা।
এবার পেছনে কিছু ধরা পড়ল গিলম্যানের অতি সজাগ কানে। সমতল চত্বরটা পেরিয়ে পেছনে তাকাল সে। আপাতদৃষ্টিতে কোনোরকম লুকোচুরি ছাড়াই মৃদু গতিতে তার দিকে এগিয়ে আসছে পাঁচটি চেহারা। তাদের মধ্যে দুটি সেই অনিষ্টাচারী বৃদ্ধা আর সেই দাঁতাল, লোমশ খুদে প্রাণীটা। কিন্তু তার চৈতন্য লোপ হল বাকি তিনটের জন্যে। কারণ তিনটেই আট ফুট উঁচু জীবন্ত প্রাণী, আকৃতি ঠিক তাদের রেলিং-এর গজালের মতো মূর্তিগুলোর মতো। নীচের গোছার পাঁচটা তারামাছ বাহু মাকড়সার মতো মুচড়ে মুচড়ে নিজেদের সামনে চালিয়ে আনছে তারা।
নিজের বিছানায় জেগে উঠল গিলম্যান, শরীর ভিজে গেছে তার ঠান্ডা ঘামে। জ্বালা করছে মুখ আর হাত-পা। মাটিতে লাফিয়ে নেমে, মুখ ধুয়ে পোশাক পরে নিল সে একেবারে তাড়াহুড়ো করে। যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা তার পক্ষে খুব জরুরি। সে কোথায় যাবে, তার জানা ছিল না, তবে মনে হয়েছিল, আরও একবার তাকে ক্লাসের মায়া ত্যাগ করতে হবে। বাসুকি আর অর্ঘ্যপোত মণ্ডলের মাঝের সেই বিন্দুটার প্রতি সে অদ্ভুত টানটা কমে গিয়েছিল বটে, কিন্তু তার জায়গা নিয়েছিল তার চাইতেও শক্তিশালী অন্য আর-একটা টান। তার মনে হচ্ছিল, তাকে যেতে হবে উত্তরে—একেবারে অনন্ত উত্তরে। যে ব্রিজটা থেকে মিস্কাটনিকের নির্জন দ্বীপটা দেখা যায়, সেটা পার হতে তার অত্যন্ত ভয় করছিল। সুতরাং পিবডি অ্যাভিনিউয়ের ব্রিজটা পেরোল সে। বারংবার হোঁচট খেতে হল তাকে, কারণ তার শ্রবণ-দর্শন তখন আটকে উন্মুক্ত নীল আকাশের একটা সুউচ্চ বিন্দুতে।
প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে নিজেকে আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারল গিলম্যান। আর তারপর খেয়াল করল, সে এসে পড়েছে শহর থেকে অনেক দূরে। তার চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে নোনা জলার ঊষর শূন্যতা। সামনের সরু রাস্তাটা এগিয়ে গেছে ইন্সমাউথ অবধি—সেই প্রাচীন, প্রায় পরিত্যক্ত শহরটা, আর্কহ্যামের মানুষ অদ্ভুতভাবে যেখানে যেতে চায় না। উত্তরমুখী টানটা যদিও তখনও কমেনি, অন্য টানটাকে সে যেমন আটকাতে পেরেছিল, এটাকেও সে তেমনভাবে প্রতিহত করতে লাগল। এবং অবশেষে আবিষ্কার করল যে একটাকে অন্যটার বিপরীতে ব্যবহার করে ভারসাম্য রাখা যায়। পা ঘষে ঘষে শহরে ফিরে এল সে। একটা সোডার দোকানে কফি খেয়ে নিজেকে টেনে নিয়ে গেল পাবলিক লাইব্রেরিতে। উদ্দেশ্যহীনভাবে পাতা ওলটাতে লাগল সব হালকা পত্রিকার। একবার দেখা হয়ে গিয়েছিল কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে। তারা মন্তব্য করেছিল, তাকে কেমন অদ্ভুতভাবে রোদে পোড়া দেখাচ্ছে। কিন্তু তার হাঁটা দেওয়ার কথাটা তাদের বলেনি সে। তিনটে নাগাদ একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে লাঞ্চ খেল গিলম্যান। লক্ষ করল, টানটা হয় কমে এসেছে কিংবা ভাগাভাগি হয়ে গেছে। তারপর সময় নষ্ট করল একটা সস্তার সিনেমা শো-এ গিয়ে। অন্তঃসারহীন অভিনয়টা এতটুকু মনোযোগ না দিয়েই দেখতে থাকল বারংবার। রাত ন-টা নাগাদ একরকম অলসভাবে ঘরমুখো হল সে। হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল প্রাচীন বাড়িটাতে। জো মাজুরেভিচ তখন নাকিসুরে অবোধ্য প্রার্থনা আওড়াচ্ছে। এলউড ঘরে আছে কি নেই না দেখেই তাড়াতাড়ি তার চিলেকোঠার ঘরে উঠে গেল গিলম্যান। ধাক্কাটা এল টিমটিমে ইলেকট্রিক আলোটা সে জ্বালাতেই। সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখে পড়ল, টেবিলে এমন একটা কিছু পড়ে রয়েছে, যেটা সেখানে থাকার আদৌ কথা নয়। দ্বিতীয়বার তাকাতে আর সন্দেহের কোনো অবকাশই রইল না। কাত হয়েই পড়ে আছে সেটা, খাড়া দাঁড়ানো সম্ভব নয় বলে। বস্তুটা সেই অজানা ধরনের বিচিত্র গজালের মতো মূর্তিটা, তার ভয়ানক স্বপ্নে সে যেটা ভেঙে ফেলেছিল সেই উদ্ভট রেলিং থেকে। খামতি নেই তাতে কোনো খুঁটিনাটির। খাঁজকাটা, পিপের মতো মধ্যভাগ, প্রসারিত সরু সরু বাহু, প্রান্ত দুটির গাঁট, সেই গাঁট থেকে বাইরের দিকে সামান্য বেঁকে-যাওয়া তারামাছের বাহু, কোনোটাই বাদ নেই। ইলেকট্রিক আলোতে সেটার বর্ণকে মনে হয়েছিল সবুজ শিরা সমেত রং-পালটাতে-থাকা ধূসর। তার আতঙ্ক আর হতভম্ব ভাবের মধ্যেই গিলম্যান দেখতে পাচ্ছিল, তার স্বপ্নের রেলিং-এর সঙ্গে জোড়ের পুরোনো জায়গাটার সঙ্গে সংগতি রেখে একটা গাঁট শেষ হয়েছে খোঁচা খোঁচা ভাঙনে।
বিহ্বল অসাড় হয়ে যাওয়ার প্রতি তার একটা প্রবণতা ছিল। সেটাই তাকে সজোর চিৎকার করে উঠতে দেয়নি। অসহ্য লাগছিল তার স্বপ্ন আর বাস্তবের এই সংমিশ্রণ। সেই বিহ্বল অবস্থাতেই গজালের মতো বস্তুটা আঁকড়ে ধরল গিলম্যান। টলমল করতে করতে নীচে নেমে গেল বাড়িওয়ালা ডমব্রাওস্কির ঘরে। কুসংস্কারগ্রস্ত তাঁত-মিস্ত্রিটার নাকিসুরের প্রার্থনা তখনও শোনা যাচ্ছে ছাতা-ধরা করিডরগুলোতে, কিন্তু এবার আর তা গিলম্যানের অপছন্দ হচ্ছিল না। ঘরেই ছিল বাড়িওয়ালা, তাকে আপ্যায়ন করল অমায়িকভাবে। না, সে ওই জিনিসটা আগে কখনও দেখেনি, আর ওটার ব্যাপারে কিছু জানেও না। কিন্তু তার গিন্নি বলছিল, দুপুরবেলায় ঘরগুলো পরিষ্কার করার সময়ে একটা বিছানায় টিনের অদ্ভুত কিছু একটা পেয়েছিল। সেটা হয়তো এটাই হতে পারে। ডমব্রাওস্কি তাকে ডাক দিতে থপথপিয়ে দুলে দুলে হাজির হল সে। হ্যাঁ এই জিনিসটাই। দাদাবাবুর বিছানায় এটা পেয়েছিল সে। দেওয়ালের দিকটায়। তার কাছে এটা খুবই অদ্ভুত ঠেকেছিল বটে, কিন্তু এমনিতেই দাদাবাবুর ঘরে অনেক কিছু অদ্ভুত জিনিস থাকে। বই, কিউরিয়ো, ছবি আর কাগজে আঁকিবুকি। এটার ব্যাপারে সে মোটেও কিছু জানে না।
অতএব ফের মানসিক অশান্তি নিয়ে ওপরে উঠে গেল গিলম্যান। সে তখন নিশ্চিত হয় যে সে তখনও স্বপ্ন দেখছে, কিংবা তার ঘুমিয়ে হাঁটার রোগ চড়ে গেছে অবিশ্বাস্যরকম চরমে। তাকে লুঠতরাজের জন্যে নিয়ে গেছে অজানা জায়গায়। এই বিকট জিনিসটা সে পেল কোথা থেকে? আর্কহ্যামের কোনো মিউজ়িয়ামে সে এটা দেখেছে বলে তো তার মনে পড়ে না। অবশ্য এটা নিশ্চয়ই কোথাও ছিল। ঘুমের ঘোরে ছিনিয়ে আনার সময় এটাকে দেখে ফেলার জন্যেই হয়তো এসেছিল খাটো থামের রেলিং-এর স্বপ্নটা। পরের দিন তাকে সাবধানে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। হয়তো নার্ভ স্পেশালিস্টকেও দেখাতে হবে একবার।
আর ইতিমধ্যে তার ঘুমিয়ে-হাঁটা রোগের ওপর সে নজর রাখার চেষ্টা করবে। ওপরে উঠে চিলেকোঠার দিকের গলিপথটা ধরে যেতে যেতে গিলম্যান কিছুটা ময়দা ছড়িয়ে দিল। এটা সে খানিক আগেই তার বাড়িওয়ালার থেকে চেয়ে এনেছে, সত্যি কথা বলেই। আসার সময়ে সে একবার এলউডের দরজায় থেমেছিল বটে, কিন্তু দেখেছিল ভেতরে সব অন্ধকার। ঘরে ঢুকে গজালের মতো জিনিসটাকে টেবিলে নামিয়ে রাখল সে। চূড়ান্ত মানসিক আর শারীরিক ধকল নিয়ে শুয়ে পড়ল পোশাক ছাড়ার অপেক্ষা না করেই। তার মনে হল, হেলানো ছাদের ওপরের বন্ধ মাচা থেকে সে শুনতে পাচ্ছে একটা মৃদু আঁচাড়ানোর আর থাবড়ানোর শব্দ। কিন্তু সে তখন এমন এলোমেলো হয়ে রয়েছে যে সেটাকে অপছন্দ করার মতো অবস্থাতেও সে নেই। উত্তরের সেই ধাঁধার মতো টান তখন ফের জোরালো হয়ে উঠছে, যদিও মনে হচ্ছিল, সেটা তখন আসছে আকাশের কিছুটা নীচু কোনো জায়গা থেকে।
স্বপ্নের চোখধাঁধানো বেগুনি আলোতে ফের হাজির হল বৃদ্ধা আর দাঁতাল, লোমশ প্রাণীটা। এল পুরোনো ঘটনাগুলোর তুলনায় অনেক বেশি স্পষ্ট অবস্থায়। এবারে সত্যি তার কাছে পৌঁছে গেল তারা। গিলম্যান টের পেল, বুড়ি তার হাত আঁকড়ে ধরেছে শুকিয়ে-যাওয়া পাঞ্জায়। বিছানা থেকে তাকে টেনে তুলল উন্মুক্ত শূন্যতায়। এক মুহূর্তের জন্যে তার কানে এল ছন্দবদ্ধ গর্জন। চোখে এল তার চারপাশে ফেনিয়ে-ওঠা আবছা অতলের গোধূলি নিরাকৃতি। কিন্তু সে মুহূর্ত ছিল অত স্বল্পই। সঙ্গে সঙ্গেই সে হাজির হল একটা বেখাপ্পা জানলাহীন ছোট্ট পরিসরে। তার ঠিক মাথার ওপর চুড়োর মতো উঠে গেছে রুক্ষ তক্তা আর কড়িকাঠ। পায়ের নীচে মেঝেটা হেলে রয়েছে অদ্ভুতভাবে। সেই মেঝের ওপর গোঁজ দিয়ে সোজা করে দাঁড়-করানো নীচু আলমারি। প্রাচীনত্ব এবং জীর্ণতার প্রতিটি স্তর-পেরোনো বইতে সেসব ঠাসা। মাঝখানে রাখা একটা টেবিল আর একটা বেঞ্চ, দেখে মনে হয়, দুটোই স্বস্থানে আটকে রাখা আছে। আলমারিগুলোর ওপরে সাজানো অজানা সব আকৃতি-প্রকৃতির ছোটো ছোটো বস্তু। গিলম্যানের মনে হল যে গজালের মতো জিনিসটা তাকে ভয়ানকভাবে ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল, জ্বলন্ত বেগুনি আলোতে তারই একটা প্রতিরূপ সে দেখতে পাচ্ছে। বাঁদিকে মেঝেটা নেমে গেছে আচমকাই, রেখে গেছে একটা কালো ত্রিকোণাকৃতি গহ্বর। এক সেকেন্ড শুকনো খটখট আওয়াজের পরে পরেই সেখান থেকে উঠে এল হলুদ শ্বদন্ত আর দাড়ি-বসানো মুখ সমেত সেই জঘন্য খুদে লোমশ প্রাণীটা।
আকর্ণ শয়তানি হাসি-হাসা জাহাঁবাজ বুড়ি তখনও তাকে আঁকড়ে রয়েছে। আর টেবিলের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এমন একটা চেহারা, যা গিলম্যান আগে কখনও দেখেনি। একটা লম্বা, রোগা লোক। বর্ণ তার কুচকুচে কালো, যদিও মুখশ্রীতে আফ্রিকীয় ধাঁচের কোনো চিহ্ন নেই। চেহারায় তার চুল-দাড়ি দুইই অনুপস্থিত, এবং তার পরনের একমাত্র পোশাক কোনো ভারী কালো কাপড়ের একটা বেঢপ আলখাল্লা। টেবিল আর বেঞ্চির জন্যে তার পা আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল না বটে, কিন্তু সে পায়ে নিশ্চয়ই জুতো ছিল, কারণ সে জায়গা পালটালেই একটা খটখট আওয়াজ আসছিল। কোনো কথা বলেনি লোকটা। তার সাধারণ মুখে ফুটে ওঠেনি কোনো অভিব্যক্তিও। টেবিলে খুলে-রাখা একটা বিশাল আকারের বইয়ের দিকে সে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছিল কেবল। জাহাঁবাজ বুড়িটা গিলম্যানের হাতে গুঁজে দিয়েছিল একটা বিরাট পালকের কলম। আর এই সব কিছুকে শবের আচ্ছাদনের মতো ঢেকে রেখেছিল চরম উন্মাদ-করে-দেওয়া এক ভয়। এরপর পরিণতি উঠে গেল তুঙ্গে। লোমশ প্রাণীটা গিলম্যানের পোশাক বেয়ে কাঁধে উঠে, তার বাঁ হাত দিয়ে নেমে এসে অবশেষে জামার কাফের নীচেই তার কবজিতে একটা ছুরির মতো কামড় বসিয়ে দিল। তার ক্ষত থেকে গলগলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতেই চেতনা হারাল গিলম্যান।
বাইশ তারিখের সকালে গিলম্যান ঘুম থেকে উঠল কবজিতে একটা ব্যথা নিয়ে। দেখল, তার জামার কাফটা শুকনো রক্ত লেগে বাদামি হয়ে আছে। তার স্মৃতি খুবই এলোমেলো হয়ে ছিল বটে, তবে তার মধ্যে সেই অজানা পরিসরে কৃষ্ণবর্ণ লোকটার দৃশ্যটা একবারে ছবির মতো অবস্থায় রয়ে গিয়েছিল। ঘুমের ঘোরে তাকে নিশ্চয়ই ইঁদুরে কামড়ে দিয়ে থাকবে। তার ফলেই ভয়ানক স্বপ্নটার ওইরকম পরিণতি হয়ে থাকবে। দরজা খুলে সে দেখতে পেল গলিপথের মেঝের ময়দাটাতে কোনোরকম হেরফের হয়নি, কেবল চিলেকোঠার অন্য প্রান্তে বাস করা অভব্য লোকটার বড়ো বড়ো পায়ের ছাপ ছাড়া। অর্থাৎ এইবারে সে ঘুমিয়ে হাঁটছিল না। তবে এই ইঁদুরগুলোর ব্যাপারে কিছু একটা করা দরকার। এদের নিয়ে সে বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলবে। হেলে-থাকা দেওয়ালের তলায় ফুটোটা আর-একবার বোজানোর চেষ্টা করল গিলম্যান। দেখে মাপসই মনে হয় এমন একটা মোমবাতি গুঁজে দিল সেখানে। তার কান তখনও ভয়ানকভাবে ভোঁ ভোঁ করছে। যেন রয়ে গেছে স্বপ্নে শোনা কোনো ভয়ংকর শব্দের প্রতিধ্বনির অবশিষ্ট।
চান করে পোশাক পালটানোর সময়ে বেগুনি আলোয় আলোকিত দৃশ্যটার পর সে স্বপ্নে আর কী দেখেছিল, মনে করার চেষ্টা করল গিলম্যান। কিন্তু স্পষ্ট কিছু তার মনে দানা বাঁধল না। সে দৃশ্যটা অবশ্যই খাপ খায় মাথার ওপরের সিল-করা মাচাটার সঙ্গে। এই মাচাটাই ইদানীং তার কল্পনাকে আক্রমণ করা শুরু করেছে হিংস্রভাবে। কিন্তু এর পরের স্মৃতিগুলো ছিল অস্পষ্ট, ঝাপসা। তার মধ্যে ইঙ্গিত ছিল আবছা, গোধূলি অতলের, আর তাদের পেরিয়ে আরও বিশাল, আরও অন্ধকার সব অতলের। সেই সমস্ত অতল, যেখানে উধাও হয়ে যায় আকৃতির নির্দিষ্ট যত ধারণা। সর্বদা তার পিছু নিয়ে থাকে যে বুদ্বুদের তাল আর পলকাটা নিরেট বস্তুটা, তারাই নিয়ে গিয়েছিল তাকে সেখানে। কিন্তু এই দূরের চরম অন্ধকারের শূন্যতায় তার মতো তারাও পরিণত হয়েছিল নামমাত্র আলোকিত দুধসাদা কুয়াশার টুকরোয়। তাদের আগে এগিয়ে গিয়েছিল অন্য আর-একটা কিছু। কুয়াশার বড়ো একটা টুকরো। মাঝেমধ্যে সেটা জমাট বেঁধে যাচ্ছিল আকৃতির অনামা অনুরূপে। গিলম্যানের মনে হচ্ছিল, তাদের সামনের দিকে এগোনোটা সরলরেখায় হয়নি। হয়েছিল কোনো ইথারীয় ঘূর্ণির বক্ররেখা আর কুণ্ডলীপথ ধরে। সেসব এমন সব নিয়মের অধীন, যে নিয়ম কল্পনা করা যায় এমন কোনো মহাজগতের পদার্থবিদ্যা আর গণিতের অজানা। অবশেষে পাওয়া গিয়েছিল নানা ইঙ্গিত। লাফাতে-থাকা বিশাল সব ছায়া। শব্দপ্রায় দানবিক স্পন্দন। দৃষ্টির অগোচর কোনো বাঁশির লঘু বৈচিত্র্যহীন ধ্বনি। কিন্তু কেবল ওইটুকুই। গিলম্যান নেক্রোনমিকনে বোধবিকারহীন সত্তা আজাজথ সম্বন্ধে কিছু কিছু পড়েছিল। সে সিদ্ধান্তে এল, এই শেষোক্ত ধারণাটি তার হয়েছে সেখান থেকেই। সেই আজাজথ, যে সমগ্র স্থানকাল শাসন করে বিশৃঙ্খলার কেন্দ্রে তার অদ্ভুতভাবে পরিবেষ্টিত কৃষ্ণ সিংহাসন থেকে।
রক্তটা ধুয়ে ফেলার দেখা গেল কবজির ক্ষতটা অতি সামান্যই। তবে দুটো ক্ষুদ্র ছিদ্রের অবস্থান নিয়ে কিছুটা ধাঁধায় পড়ে গেল গিলম্যান। তার খেয়াল হল, বিছানায় যেখানে সে শুয়ে ছিল, সেখানে কোনো রক্ত নেই। তার চামড়ায় আর জামার কাফে যতটা রক্ত ছিল, সেই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। সে কি ঘরের মধ্যেই ঘুমিয়ে হাঁটছিল? আর কোনো চেয়ারে বসে থাকার সময়ে, বা অন্য কোনো কম সম্ভাব্য অবস্থায় থাকার সময়ে তাকে কি কামড়ে দিয়েছিল ইঁদুরটা? বাদামি ফোঁটা বা ছাপের জন্যে প্রতিটি কোনা খুঁজে দেখল গিলম্যান, কিন্তু পেল না কিছুই। তার মনে হল, দরজার বাইরে ছাড়াও ঘরের ভেতরেও ময়দা ছড়িয়ে রাখলে বোধহয় ভালো হয়। অবশ্য তার ঘুমের মধ্যে হাঁটার কোনো বাড়তি প্রমাণের আর দরকার নেই। সে যে হাঁটে, সে কথা সে জানেই। এখন প্রয়োজন কেবল এবার এটাকে বন্ধ করার। তাকে ফ্রাংক এলউডের কাছে সাহায্য চাইতে হবে। এই সকালে মনে হচ্ছিল, শূন্য থেকে আসা টানগুলো কমে গেছে। যদিও তাদের জায়গা নিয়েছে এমন এক অনুভূতি, যা তাদের চাইতেও ব্যাখ্যা করা কষ্টকর। তা হল নিজের জায়গা ছেড়ে উড়ে যাওয়ার একটা আবছা নাছোড়বান্দা প্রবৃত্তি। যদিও সে যে ওড়ার ইচ্ছে ঠিক কোনদিকে, তার আদৌ কোনো আভাস ছিল না। টেবিল থেকে গজালের মতো জিনিসটা তুলে নেওয়ার সময় তার মনে হল, সামান্য বেড়ে গেছে পুরোনো উত্তরমুখী টানটা। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেটাকে সম্পূর্ণ ছাপিয়ে বহাল রইল নতুন আর আরও বেশি হতভম্ব-করে-দেওয়া ঝোঁকটা।
তাঁত-মিস্ত্রিটার নাকিসুর তখন উঠে আসছে একতলা থেকে। তার গুঁতোর বিরুদ্ধে নিজেকে শক্ত করে গজালের মতো মূর্তিটাকে সে নিয়ে গেল নীচে এলউডের ঘরে। কপালজোরে এলউড ঘরেই ছিল, মনে হল, ঘুম থেকে উঠেও পড়েছে। ব্রেকফাস্ট আর কলেজের জন্যে বেরিয়ে পড়ার আগে হাতে খানিকটা সময় ছিল। সুতরাং গিলম্যান তাড়াহুড়ো করে উগরে দিয়েছিল তার সাম্প্রতিককালের স্বপ্ন আর ভয়ের কাহিনি। বেশ সহানুভূতি দেখিয়েছিল তার বন্ধু। কিছু যে করা প্রয়োজন, মেনেও নিয়েছিল সে কথা। অতিথির শুকনো বিধ্বস্ত চেহারাটা আঁতকে উঠেছিল সে। অন্যরা সব আগের সপ্তাহে তার যে বিদঘুটে, অস্বাভাবিক রোদে পোড়াটা নিয়ে কথা তুলেছিল, লক্ষ করেছিল সেটাও। যদিও আর বেশি কিছু সে বলতে পারেনি। গিলম্যানকে সে কখনও তার ঘুমিয়ে হাঁটার অভিযানে যেতে দেখেনি। অদ্ভুত মূর্তিটা যে কী, সে ব্যাপারেও তার কোনো ধারণা নেই। তবে গিলম্যানের নীচেই যে ফরাসি-কানাডীয়টি বাস করে, তাকে এক সন্ধেয় সে মাজুরেভিচের সঙ্গে কথা বলতে শুনেছে। আর দু-একদিনের মাথাতেই এসে-পড়া ওয়ালপুর্গিসের রাতটাকে তারা যে কেমন ভয়ানকভাবে ভয় পাচ্ছে, পরস্পরকে সে কথা বলছিল তারা। সর্বনাশ-হতে-যাওয়া বেচারা দাদাবাবুটিকে নিয়েও কাতর মন্তব্য বিনিময় করছিল। দেরশে, গিলম্যানের ঘরের নীচে থাকা লোকটা, বলেছিল নানান কথা। রাতের বেলা খালি পা আর জুতো-পরা, দু-রকমের পায়ের শব্দ পেয়েছিল সে। একরাতে গিলম্যানের দরজার চাবির ফুটো দিয়ে উঁকি মারবে বলে চুপিচুপি ভয়ে ভয়ে ওপরে উঠে দেখতে পেয়েছিল বেগুনি আলো। দরজার চারপাশের ফাটলের মধ্যে দিয়ে আসা সেই আলো দেখে তার আর উঁকি মারার সাহস হয়নি। এ ছাড়া ছিল শান্ত কণ্ঠের কথাবার্তা। এটার বর্ণনা দিতে গিয়ে লোকটার গলার আওয়াজ কমতে কমতে নেমে এসেছিল অস্ফুট ফিশফিশে।
সে এমন কী ব্যাপার, যার চোটে এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রাণীগুলো মেতেছিল এমন কেচ্ছায়, তা ছিল এলউডের কল্পনার বাইরে। তবে তার ধারণা হয়েছিল একদিকে গিলম্যানের রাত্রি জাগরণ, ঘুমের ঘোরে চলা আর কথা বলা, আর অন্যদিকে পরম্পরাগতভাবে ভয় পেয়ে চলা মে-ইভের কাছাকাছি এসে পড়া, এই দুয়ে মিলে ইন্ধন জুগিয়েছিল তাদের কল্পনাকে। গিলম্যান যে ঘুমের মধ্যে কথা বলে, সে কথা তো একেবারে পরিষ্কার। আর এ-ও স্পষ্ট যে দেরশের চাবির ফুটোয় আড়ি পাতা থেকেই চারপাশে ছড়িয়েছে বেগুনি আলোর বিভ্রম। এই সাদামাটা লোকগুলো অদ্ভুত যা কিছু শুনেছে, সেগুলোকেই দেখতে পেয়েছে বলে ঝপ করে কল্পনা করে নিয়েছে। এবার এখন কী করতে হবে, তার কথা যদি ওঠে, তাহলে ভালো হয় যদি গিলম্যান এলউডের ঘরে নেমে আসে, আর একা একা শোয়া থেকে দূরে থাকে। ঘুমের ঘোরে সে উঠে দাঁড়ালে, কিংবা কথা বললে, এলউড যদি জেগে থাকে তাহলে তাকে উঠিয়ে দিতে পারবে। এ ছাড়া তার খুব তাড়াতাড়ি স্পেশালিস্টও দেখা দরকার। ইতোমধ্যে এলউড ওই গজালের মতো মূর্তিটা মিউজ়িয়ামে, আর বিশেষ কিছু প্রফেসারের কাছে নিয়ে যাবে। চেষ্টা করবে জিনিসটাকে শনাক্ত করার। বলবে, সেটা কোনো এজমালি ডাস্টবিন থেকে পাওয়া গেছে। এ ছাড়া দেওয়ালের ইঁদুরগুলোকে বিষ দেওয়ার ব্যাপারে ডমব্রাওস্কিকেও নজর দিতে হবে।
এলউডের সাহচর্যে বল পেয়ে সেদিন ক্লাস করল গিলম্যান। অদ্ভুত সব প্রবৃত্তি তখনও তাকে টান দিচ্ছিল বটে, কিন্তু সেগুলো বেশ সাফল্যের সঙ্গে এড়িয়ে যেতে পারল সে। একটা ফ্রি পিরিয়ডের সময় সেই অদ্ভুত মূর্তিটা দেখাল কয়েকজন প্রফেসারকে। তাঁরা সবাই সেটার ব্যাপারে গভীর আগ্রহ দেখালেন বটে, কিন্তু কেউই তার প্রকৃতি বা উৎপত্তির ব্যাপারে কোনো আলোকপাত করতে পারলেন না। এলউড বাড়িওয়ালাকে দিয়ে দোতলার ঘরে একটা সোফা আনিয়েছিল। সে রাত্রে তাতেই ঘুমোল গিলম্যান। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই প্রথম সে নিষ্কৃতি পেল অস্থির-করা সব স্বপ্ন থেকে। তবে রয়ে গেল জ্বর-জ্বর ভাবটা। তাঁত-মিস্ত্রির নাকিকান্নার প্রভাবও ছিল বিচলিত করে দেওয়ার মতো।
পরের কয়েকটা দিন গিলম্যান বিভীষিকার বহিঃপ্রকাশ নিবারণ হওয়ার সুখ ভোগ করেছিল। এলউডের কথায়, সে ঘুমের মধ্যে কথা বলার বা উঠে দাঁড়ানোর কোনো প্রবণতা দেখায়নি। এ ছাড়া ইতিমধ্যে বাড়িওয়ালাও সর্বত্র ইঁদুরের বিষ ছড়াচ্ছিল। অশান্তির একমাত্র উপাদান ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরদেশিদের মধ্যে কথাবার্তা। উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল তাদের কল্পনাশক্তি। ক্রুশ ধারণ করার জন্যে তাকে সর্বদা চাপ দিত মাজুরেভিচ। এবং অবশেষে তাকে গছিয়েই ছেড়েছিল একটা। বলেছিল, সেটা নাকি ভালোমানুষ ফাদার ইভানিটস্কি আশীর্বাদ করে দিয়েছেন। দেরশেও বলতে ছাড়েনি। দাবি করেছিল গিলম্যানের অনুপস্থিতির প্রথম আর দ্বিতীয় রাতে তার ওপরের যে ঘরটা ইদানীং খালি, তাতে শোনা গেছে সাবধানি পদশব্দ। পল চয়েন্সকির মনে হয়েছিল, করিডর আর সিঁড়িতে রাতে সে আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। দাবি করেছিল যে আলতো করে তার করে দরজা ঠেলা হয়েছে। ডমব্রাওস্কি-গিন্নি দিব্যি খেল যে সে অল-হ্যালোসের23 পর প্রথমবার বাদামি জেনকিনকে দেখেছে। কিন্তু এইসব বোকা-বোকা খবরের অর্থ ছিল সামান্যই। অতএব গিলম্যান সস্তার ধাতব ক্রুশটাকে অলসভাবে ঝুলিয়ে ফেলে রাখল তার বন্ধুর ড্রেসারের একটা গোল হাতল থেকে।
গজালের মতো অদ্ভুত মূর্তিটা কী তা বুঝতে গিলম্যান আর এলউড তিন দিন ধরে ঘোরাঘুরি করল স্থানীয় মিউজ়িয়ামগুলোতে, কিন্তু অসফল হল প্রত্যেকবারই। প্রত্যেক জায়গাতে যদিও আগ্রহ ছিল তীব্র। কারণ বস্তুটার সম্পূর্ণ বিজাতীয়তা বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের কাছে দেখা দিয়েছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে। কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে-থাকা ছোটো বাহুগুলোর একটা ভেঙে রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা হয়েছিল সেটার। তার ফলাফল নিয়ে আজও আলোচনা হয় কলেজের লোকজনের মধ্যে। সে অদ্ভুত মিশ্র ধাতুতে প্ল্যাটিনাম, লোহা আর টেলারিয়াম খুঁজে পেয়েছিলেন প্রফেসার এলেরি। কিন্তু তার সঙ্গে মনে হয়, মেশানো ছিল উচ্চ পারমাণবিক ওজনের কম করে আরও তিনটি উপাদান। রসায়নশাস্ত্রের ক্ষমতা ছিল না তাদের কোনো শ্রেণিতে ফেলা। কোনো পরিচিত মৌলের সঙ্গে তাদের সাদৃশ্য তো দেখাই যায়নি, উপরন্তু পর্যায় সারণিতে সম্ভাব্য মৌলের জন্যে সংরক্ষিত আছে যেসব শূন্যস্থান, তাদের সঙ্গেও সেটা খাপ খায়নি। আজ পর্যন্ত কিনারা হয়নি এই রহস্যের, যদিও মূর্তিটা রাখা আছে মিস্কাটনিক ইউনিভার্সিটির জাদুঘরের প্রদর্শনীতে।
এপ্রিল ২৭ তারিখের সকালবেলা, গিলম্যান যে ঘরে অতিথি, সেখানে আবির্ভাব হল একটা তাজা ইঁদুর গর্তের। তবে দিনের বেলা সেটাকে টিনের পাত দিয়ে চাপা দিয়ে দিল ডমব্রাওস্কি। বোঝাই যাচ্ছিল যে বিষে তেমন কাজ হচ্ছে না। কারণ দেওয়ালের ভেতরে ছোটাছুটি আর আঁচড়ানোর আওয়াজ প্রায় কম হয়নি বললেই চলে। এলউড রাত অবধি বাইরে ছিল, তাই তার জন্যে অপেক্ষা করে রইল গিলম্যান। একটা ঘরে তার একলা ঘুমোনোর কোনো ইচ্ছে ছিল না। বিশেষত তার যখন মনে হয়েছিল যে জঘন্য বৃদ্ধার ছবিটা ভয়ংকরভাবে এসে পড়েছে তার স্বপ্নে, সন্ধের গোধূলি আলোয় তাকে একঝলক দেখতে পেয়েছে সে। কয়েকটা প্রশ্ন জেগেছিল গিলম্যানের মনে। কে সেই বৃদ্ধা? আর তার কাছে একটা কুৎসিত উঠোনের মুখে জঞ্জালের গাদায় টিনের কৌটোর মধ্যে যা খটখট করছিল, সেটাই বা কী? মনে হয়েছিল, বুড়িটা তাকে লক্ষ করেছিল। একটা নারকীয় ব্যঙ্গের হাসি হেসে হেসেছিল তার প্রতি। অথবা হতে পারে এটা তার কল্পনা।
পরের দিন বড়ো ক্লান্তি বোধ করছিল দুই যুবকই। বুঝতে পারছিল, রাতের বেলা মড়ার মতো ঘুমোবে তারা। যার মধ্যে সম্পূর্ণ ডুবে গিয়েছিল গিলম্যান, হয়তো নিজের ক্ষতি করেই, সেইসব গাণিতিক বিষয়বস্তু নিয়ে ঘুম-চোখে আলোচনা করেছিল তারা। প্রাচীন জাদুবিদ্যা আর লোককাহিনির সঙ্গে সেসবের যোগসূত্রকে বিপজ্জনকভাবে সম্ভব বলে মনে হচ্ছিল তাদের। তা নিয়েও আন্দাজ অনুমানের আলোচনা হল তাদের। কথা উঠল কেজিয়া মেসন নিয়েও। গিলম্যানের ধারণা ছিল, কেজিয়া হয়তো অদ্ভুত এবং গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলেছিল। এর পেছনে যে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে, সে কথা মেনে নিল এলউড। এই ডাকিনীরা যেসব গোপন কাল্টের অংশ ছিল, প্রাচীন, বিস্মৃত যুগের বিস্ময়কর সব রহস্য তারা প্রায়শ রক্ষা করে তারপর দিয়ে যেত উত্তরাধিকারসূত্রে। কেজিয়া যে ডাইমেনশন দ্বারের মধ্যে দিয়ে পার হওয়াটা সত্যি সত্যি রপ্ত করে ফেলেছিল, এমন হওয়াটা আদৌ অসম্ভব নয়। প্রাচীন সংস্কারই তো জোরালো দাবি করে যে জাগতিক যে-কোনো অবরোধ ডাকিনীদের পথরোধ করার পক্ষে অক্ষম। আর ডান্ডা-দেওয়া ঝাঁটায় চড়ে রাত্রি জুড়ে যাত্রা করার পুরোনো গল্পের নীচে যে কী লুকিয়ে আছে, তা-ই বা কে বলতে পারে?
কেবল গণিতের গবেষণা থেকে একজন আধুনিক ছাত্র আদৌ কখনও একই রকম ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে কি না, তা দেখার বিষয়। এ ব্যাপারে কোনো এক অকল্পনীয়, বিপজ্জনক পরিস্থিতি এসে পড়তে পারে সাফল্য থেকে। সংলগ্ন, অথচ সাধারণভাবে যাওয়া অসম্ভব, এমন কোনো ডাইমেনশনকে ছেয়ে রেখেছে কী ধরনের অবস্থা, তা আগে থেকে কে বলতে পারে? অন্যদিকে আবার আকর্ষণীয় সম্ভাবনার সংখ্যাও প্রচুর। শূন্যের কিছু কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে সময় বিরাজ করতে পারে না। এমন একটা অঞ্চলে প্রবেশ করে অনির্দিষ্টকালের জন্যে যে-কেউ টিকিয়ে রাখতে পারে তার জীবন, ধরে রাখতে পারে বয়েস। নিজের বা অনুরূপ কোনো ডাইমেনশনে যাবার ফলে সামান্য একটু ছাড়া তাদের আর কোনোরকম জৈব প্রক্রিয়া বা ক্ষয়ের কবলে পড়তে হয় না। এ ছাড়া কেউ সময়হীন কোনো ডাইমেনশনে প্রবেশ করে পৃথিবীর কোনো সুদূর অতীতে বেরিয়ে আসতে পারে আগের মতো নবীন বয়সেই।
কেউ কখনও আদৌ এসব করতে পেরেছিল কি না, নির্ভরযোগ্যভাবে তা আন্দাজ করা সম্ভব নয়। পুরোনো কিংবদন্তিগুলো সব অস্পষ্ট, আবিল। এর ওপর ঐতিহাসিককালে নিষিদ্ধ ব্যবধান অতিক্রম করার সব প্রচেষ্টা জটিল দেখায় বহির্জগতের প্রাণী আর বার্তাবাহকদের সঙ্গে অদ্ভুত আর ভয়ংকর সব আঁতাত থাকার ফলে। স্মরণাতীতকাল থেকে আছে এক চরিত্রের কথা। গুপ্ত, ভয়ংকর শক্তির অগ্রদূত বা প্রতিনিধি সে। ডাকিনী কাল্টের সেই কৃষ্ণমানব আর নেক্রোনমিকনের নিয়ারলাথোটেপ। তার ওপরে আছে হতবুদ্ধি করে দেওয়া আর-একটা সমস্যা। গৌণ বার্তাবাহক আর মধ্যস্থতাকারীরা। এরা সেইসব পশুপ্রায় আর বিচিত্র সংকর প্রাণী, কিংবদন্তিতে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে ডাকিনীদের তাঁবেদার প্রেত বলে। ঘুমের চোটে আর তর্কবিতর্ক করতে না পেরে শুয়ে পড়ল এলউড আর গিলম্যান। শুনতে পেল, প্রায় মাতাল অবস্থায় পাক খেয়ে বাড়িতে ঢুকছে জো মাজুরেভিচ। তার নাকিসুরের প্রার্থনার মরিয়া উদ্দামতায় শিউরে উঠল তারা।
সে রাতে ফের বেগুনি আলোটা দেখল গিলম্যান। স্বপ্নে পার্টিশনের ভেতরে পেল আঁচড়ানো-কামড়ানোর আওয়াজ। মনে হল, কেউ আনাড়ি হাতে হাতড়াচ্ছে দরজার ল্যাচটা। তারপর দেখতে পেল, সেই বুড়ি আর লোমশ প্রাণীটা তার দিকে এগিয়ে আসছে কার্পেট-ঢাকা মেঝের ওপর দিয়ে। জাহাঁবাজ বুড়িটার মুখটা জ্বলজ্বল করছিল এক অমানবিক উল্লাসে। ঘরের উলটোদিকে অন্য কৌচটাতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন এলউডের চেহারাটার দিকে ইঙ্গিত করে উপহাসের চাপা হাসি হাসল হলুদ দাঁতের খুদে মূর্তিমান বিকৃতিটা। ভয়ের অসাড়তা রুদ্ধ করে দিল গিলম্যানের চিৎকার করে ওঠার সব প্রচেষ্টা। আগের মতো বীভৎস বুড়িটা আঁকড়ে ধরল তার কাঁধ। হ্যাঁচকা মেরে বিছানা থেকে টেনে তুলল উন্মুক্ত শূন্যতায়। ফের তার পাশ দিয়ে সবেগে বেরিয়ে গেল তীক্ষ্ণ চিৎকার-করা সব গোধূলি অতলের অসীমতা। কিন্তু আর এক সেকেন্ডে তার মনে হল, সে রয়েছে একটা পচা দুর্গন্ধময়, অন্ধকার, কর্দমাক্ত একটা অজানা গলিতে। তার চারপাশে উঁচু হয়ে উঠে গেছে প্রাচীন সব বাড়ির পচন-ধরা দেওয়াল।
তার সামনে সেই আলখাল্লা গায়ে সেই কালো লোকটা, যাকে গিলম্যান দেখেছিল অন্য স্বপ্নটার চুড়োর নীচের পরিসরটায়। একটু কম দূরত্ব থেকে বৃদ্ধা মহিলা তখন তার দিকে হাত নাড়ছে আর মুখবিকৃতি করছে উদ্ধতভাবে। আদুরে ভঙ্গিতে খেলাচ্ছলে কালো লোকটার গোড়ালিতে গা ঘষছে বাদামি জেনকিন। যদিও সে গোড়ালি কাদায় একরকম ঢেকে ফেলেছে। ডানদিকে একটা অন্ধকার খোলা দরজা। নীরবে তার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করল কালো লোকটা। সেদিকে পা বাড়াল মুখবিকৃতি করতে-থাকা শুকনো বুড়িটা, সঙ্গে গিলম্যানকে টেনে নিয়ে গেল তার রাত-পোশাকের জামার হাতা ধরে। ভেতরে বিপজ্জনকভাবে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ-করা একটা উৎকট দুর্গন্ধময় সিঁড়ি। মনে হল, তাতে চড়ার সময়ে একটা মৃদু বেগুনি আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল বুড়ি। সিঁড়ির মাথার চাতালে একটা দরজা। তার ল্যাচ হাতড়াল বুড়ি, ঠেলে খুলে দিল পাল্লা। গিলম্যানকে অপেক্ষা করার একটা ইশারা করে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই অন্ধকার রন্ধ্রের অভ্যন্তরে।
তরুণটির অতি সজাগ কানে এল একটা ককিয়ে-ওঠা কান্না। খানিক বাদে জাহাঁবাজ বুড়িটা ঘর থেকে বেরিয়ে এল সংজ্ঞাহীন একটা খুদে আকৃতি ধরে। সেটাকে সজোরে বাড়িয়ে ধরল তার দিকে, যেন তাকে সেটা বইতে হুকুম করছে। সে আকৃতি আর তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে কেটে গেল মন্ত্রের ঘোর। চিৎকার করে ওঠার পক্ষে তখনও সে বিহ্বল অবস্থায়। কেবল বেপরোয়াভাবে সশব্দ সিঁড়ি বেয়ে হুড়মুড় করে নেমে এল বাইরের কাদাতে। থামল কেবল যখন কালো লোকটা তাকে আঁকড়ে ধরে ফেলে শ্বাস রুদ্ধ করে ফেলল তার। চৈতন্য লোপ পেতে পেতে সে শুনতে পেল দাঁতাল, ইঁদুরের মতো মূর্তিমান অস্বাভাবিকতার অস্পষ্ট, তীক্ষ্ণ খিকখিক।
২৯ তারিখের সকালে গিলম্যানের ঘুম ভাঙল আতঙ্কের এক ঘূর্ণির মধ্যে। চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝতে পারল, ভয়ংকর কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। সে ফেরত চলে এসেছে হেলানো ছাত আর দেওয়ালের তার পুরোনো চিলেকোঠার ঘরে। ছড়িয়ে পড়ে আছে না-পাতা বিছানার ওপর। কোনো অজানা কারণে ব্যথা করছে তার গলাটা। ছটফটিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করতে গিয়ে সে আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ করল, তার পা আর নিম্নাঙ্গের রাত-পোশাক বাদামি হয়ে রয়েছে মাটির শুকনো পরতে। সে মুহূর্তে তার স্মৃতির অবস্থা নৈরাশ্যজনকভাবে অস্পষ্ট। কিন্তু কমপক্ষে সে এইটুকু বুঝতে পারছিল যে অতি অবশ্যই ঘুমের ঘোরে হেঁটে থাকবে। এলউড হারিয়ে গিয়েছিল এত গভীর ঘুমের তলায়, যে তার আওয়াজ শুনতে পায়নি, তাকে থামাতেও পারেনি। মেঝেতে এলোমেলো কাদা-মাখা পায়ের ছাপ ছিল বটে, কিন্তু অদ্ভুতভাবে, সেগুলো একেবারে দরজা অবধি এগোয়নি। যত তাদের দিকে তাকাল গিলম্যান, তত বিচিত্র মনে হতে লাগল সেগুলো। কারণ যেগুলো সে নিজের বলে চিনতে পারছিল, সেগুলো ছাড়াও ছিল কয়েকটা ছোটো ছোটো গোল দাগ। যেমন বড়ো চেয়ারের বা টেবিলের পায়া থেকে হয়। তবে পার্থক্য যে তাদের বেশির ভাগই ছিল প্রায় দু-ভাগে বিভক্ত। অদ্ভুত কিছু ইঁদুরের পায়ের কাদার ছাপও ছিল। সেগুলো একটা নতুন ছ্যাঁদা থেকে বেরিয়ে এসে ফের সেখানেই ফেরত গিয়েছিল। টলতে টলতে দরজা অবধি গিয়ে গিলম্যান দেখতে পেল বাইরে কোনো কাদা-মাখা পায়ের ছাপ নেই। চরম হতভম্ব অবস্থা আর পাগল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে খেল তাকে। তার বীভৎস স্বপ্নটা যত মনে পড়তে লাগল তার, তত আরও আতঙ্কে ডুবে যেতে লাগল সে। দুটো তলা নীচে জো মাজুরেভিচের করুণস্বরে আওড়ানো প্রার্থনা আরও বাড়িয়ে তুলল তার হতাশা।
এলউডের ঘর অবধি নেমে এল গিলম্যান। সে তখনও ঘুমিয়ে। তাকে ঘুম থেকে তুলে নিজেকে সে কী অবস্থায় পেয়েছে, বলতে শুরু করল সে সমস্ত কথা। কিন্তু কী হয়েছিল, সে ব্যাপারে এলউডও কোনোরকম ধারণা করতে পারল না। গিলম্যান কোথায় গিয়ে থাকতে পারে, করিডরে পায়ের ছাপ না ফেলে সে কীভাবেই বা ঘরে ফেরত এল সে, চিলেকোঠার ঘরে তার পায়ের ছাপের সঙ্গে কীভাবে মিশে গেল আসবাবের মতো কাদার দাগ—এসবই ছিল এলউডের অনুমানের বাইরে। এর ওপর ছিল গিলম্যানের গলার কালো কালশিটেগুলো। যেন নিজেই সে নিজের গলা টিপতে চেষ্টা করেছিল। হাতটা তুলে তাদের ওপর রাখল গিলম্যান, কিন্তু দেখল, সেগুলো মোটামুটিওভাবেও খাপ খাচ্ছে না। তারা কথা বলতে বলতেই এসে পড়ল দেরশে। বলল, মাঝরাতের পরের অন্ধকারে মাথার ওপরে একটা ভয়ংকর খটখট শব্দ শুনতে পেয়েছিল সে। না, মাঝরাতের পর সিঁড়িতে কেউ ছিল না। যদিও মাঝরাতের ঠিক আগে সে মৃদু পায়ের শব্দ পেয়েছিল চিলেকোঠায়। আর পেয়েছিল সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নামার আওয়াজ, যা তার মোটেও ভালো লাগেনি। আর্কহ্যামের জন্যে এ বড়ো বাজে সময়, জানাল সে। জো মাজুরেভিচ যে ক্রুশটা দিয়েছে, সেটা দাদাবাবু পড়ে থাকলেই ভালো। দিনের বেলাটাও নিরাপদ নয়। ভোরের পর অদ্ভুত সব শব্দ শোনা গেছে বাড়িতে। বিশেষত একটা তীক্ষ্ণ শিশুর চিৎকার, যা রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল আচমকাই।
সে দিন সকালে যন্ত্রের মতো ক্লাস করেছিল গিলম্যান। তবে পড়াশোনায় পুরো মন দিতে পারেনি। একটা ভয়ংকর আশঙ্কা আর প্রত্যাশার বোধ গ্রাস করেছিল তাকে। যেন সে অপেক্ষা করছিল তাকে বিনাশ করে দেওয়ার মতো একটা আঘাত তার ওপর নেমে আসার জন্যে। দুপুরবেলা সে লাঞ্চ খেতে গেল ইউনিভার্সিটির স্পা-এ। মিষ্টির জন্যে অপেক্ষা করতে করতে পাশের সিট থেকে তুলে নিল একটা খবরের কাগজ। তবে মিষ্টি খাওয়া আর তার হল না। কাগজের প্রথম পাতার একটা খবর দেখে তার শরীর অবশ হয়ে এল, চোখে দেখা দিল তীব্র আতঙ্কের ছাপ। বিল চুকিয়ে টলতে টলতে এলউডের ঘর অবধি ফেরত আসার মতো ক্ষমতাটুকু কেবল অবশিষ্ট ছিল তার।
আগের রাতে অপহরণের একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেছে অর্নের গলিতে। সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেছে আনাস্টাসিয়া ওলেজকো নামের এক হাবাগোবা লন্ড্রি কর্মীর দু-বছরের বাচ্চাটা। যা বোঝা যাচ্ছে, এই ব্যাপারটা যে ঘটতে পারে, তার মা সেই ভয় বেশ কিছুদিন ধরেই করছিল। কিন্তু তার ভয়ের পেছনে তার যে কারণগুলো ছিল, সেসব এতই কিম্ভূত যে কেউ সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়নি। তার কথামতো সে নাকি মার্চের শুরু থেকে জায়গাটাতে বাদামি জেনকিনকে দেখেছে। তার মুখ বাঁকানো আর খিকখিক থেকেই আনাস্টাসিয়া বুঝেছিল যে ছোট্ট লাডিসলাস ওয়ালপুর্গিস রাতের ভয়ানক সাবাটের বলি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে। বাচ্চাটাকে বাঁচানোর জন্যে সে পড়শি মেরি জানেককে সে ঘরে ঘুমোতে বলেছিল, কিন্তু মেরির সাহস হয়নি। পুলিশকেও সে কিছু বলতে পারেনি, কারণ পুলিশ এসবে বিশ্বাস করে না। তার যতদূর অবধি মনে আছে, প্রতিবছর এইভাবেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে বাচ্চাদের। তার বন্ধু পিট স্টোয়াস্কিও সাহায্য করেনি, কারণ এমনিতেও সে বাচ্চাটাকে পথ থেকে সরাতে চাইত।
কিন্তু গিলম্যানকে ঠান্ডা ঘামে চুবিয়ে দিল আর-একটা খবর। মাঝরাতের ঠিকে পরেই গলির মুখটা পেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল একজোড়া ফুর্তিবাজ। তারা স্বীকার করেছে বটে, তারা মাতাল ছিল, কিন্তু তাও দুজনে দিব্যি দিয়ে বলেছে, তারা পাগলাটে পোশাক-পরা তিনজনকে অন্ধকার গলিটাতে চুপিচুপি ঢুকতে দেখেছে। তাদের কথামতো, তাদের মধ্যে ছিল আলখাল্লা-পরা এক বিশালদেহী কৃষ্ণাঙ্গ, ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকে এক ছোটোখাটো বুড়ি, আর রাত-পোশাক পরনে এক শ্বেতাঙ্গ যুবক। যুবককে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল বুড়িটা, আর কৃষ্ণাঙ্গটার পায়ের কাছের বাদামি মাটিতে একটা পোষা ইঁদুর উলটে-পালটে গা ঘষছিল।
সারাটা বিকেল হতভম্ব হয়ে বসে রইল গিলম্যান। এর মধ্যে খবরটা দেখেছিল এলউড, ভয়ংকর সব ধারণা করেছিল তার থেকে। ফিরে এসে গিলম্যানকে সেই অবস্থাতেই দেখতে পেল সে। এইবার দুজনের কারোই সন্দেহ রইল না যে তাদের চারপাশে গুটিয়ে আসছে বীভৎস কোনো সংকট। দুঃস্বপ্নের অলীক মায়া আর জাগতিক বাস্তবের মধ্যে দানা বেঁধে উঠছে কোনো ভয়ানক, অকল্পনীয় যোগসূত্র। আরও ভয়ানক সব ঘটনাক্রম এড়ানো যেতে পারে কেবল বিস্ময়কর মাত্রায় সতর্ক থাকতে পারলে। আজ হোক বা কাল, গিলম্যানকে স্পেশালিস্ট দেখাতেই হবে। তবে ঠিক এখনই নয়, যে সময় সংবাদপত্র ছেয়ে রয়েছে অপহরণের খবরে।
ঠিক কী ঘটেছিল, তা ছিল পাগল করে দেওয়ার মতো অস্পষ্ট। কয়েক মুহূর্ত ধরে নিজেদের মধ্যে যত উদ্দাম থিয়োরির আদানপ্রদান করল দুজনে। গিলম্যান তার পড়াশোনা থেকে স্থান আর তার ডাইমেনশন সম্বন্ধে যা জানে, অচেতনভাবে তার চাইতে কি বেশি সাফল্য পেয়ে গেছে? সে কি সত্যিই আমাদের এই গোলকটা থেকে অলক্ষিতে পৌঁছে গিয়েছিল এমন সব বিন্দুতে, যা সমস্ত কল্পনা আর অনুমানের বাইরে? যদি সে আদৌ গিয়ে থাকে, তাহলে কোথায় গিয়েছিল সে, সেইসব নারকীয় অস্বাভাবিকতার রাতে? সেইসব গর্জন-করা গোধূলি অতল, সেই পাহাড়ের সবুজ ঢাল, ঝলসে-দেওয়া সেই চত্বর, সেই নক্ষত্রের আকর্ষণ, সেই চরম অন্ধকার ঘূর্ণি, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষটা, কর্দমাক্ত গলি আর সিঁড়ি, বুড়ি ডাকিনী, আর দাঁতাল, লোমশ বিভীষিকা, বুদ্বুদের তাল আর খুদে পলকাটা বস্তুটা, অদ্ভুতভাবে রোদে ঝলসে-যাওয়া, কবজির ক্ষত, সেই মূর্তিটা, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই, কাদা-মাখা পায়ের ছাপ, গলার দাগ, কুসংস্কারগ্রস্ত পরদেশিদের গল্প আর ভয়, কী মানে এই সমস্ত কিছুর? এমন একটা ব্যাপারে কতদূর অবধি প্রয়োগ করা যায় মানসিক সুস্থতার নিয়মকানুন?
সে রাতে ঘুম হল না দুজনেরই। দিনের বেলা ক্লাস কামাই করে ঝিমিয়ে নিল দুজনেই। এ হল এপ্রিলের ৩০ তারিখ। গোধূলি নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে আসবে নারকীয় সাবাটের সময়। যাকে ভয় পায় পরদেশিরা আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন বুড়োরা। ছ-টায় বাড়ি ফিরল মাজুরেভিচ। বলল, কারখানার লোকজন চাপা গলায় বলাবলি করছিল, ওয়ালপুর্গিসের উৎসব হবে মেডো হিল ছাড়িয়ে অন্ধকার গিরিখাতটাতে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে পুরোনো সাদা পাথরটা। যে জায়গাটায় অদ্ভুতভাবে অনুপস্থিত কোনোরকম উদ্ভিদজীবন। তাদের কেউ কেউ পুলিশকে জানিয়েছে, আর পরামর্শ দিয়েছে হারানো ওলেজকো বাচ্চাটাকে সেখানে খুঁজে দেখতে। কিন্তু পুলিশ যে কিছু করবে, সে কথা তারা বিশ্বাস করে না। জো জোরাজুরি করতে লাগল, যাতে সে নিকেলের চেন-দেওয়া ক্রুশটা পরে নেয়। তার কথা রাখতে সেটা পরে শার্টের ভেতরে ঢুকিয়ে নিল গিলম্যান।
গভীর রাতে দেখা গেল, চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছে দুই তরুণ। নীচের তলার তাঁত-মিস্ত্রির প্রার্থনার ছন্দ শান্ত করে এনেছে তাদের। ঢুলতে ঢুলতেই গিলম্যানের অতিপ্রাকৃতভাবে প্রখর শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ছিল। যেন অপেক্ষা করছিল প্রাচীন বাড়িটার সব শব্দের বাইরে কোনো আবছা, ভয়ানক বিড়বিড় আওয়াজের জন্যে। উঠে আসছিল নেক্রোনমিকন আর কালো কেতাবের অসুস্থ সব স্মৃতি। সে খেয়াল করল, সে দোল খাচ্ছে নাম নেওয়ার পক্ষে অতি ন্যক্কারজনক এক ছন্দের সঙ্গে। সে ছন্দের সম্পর্ক সাবাটের তামসতম অনুষ্ঠানের সঙ্গে। যে স্থানকাল আমাদের বোধগম্য, তার বাইরে এর উৎপত্তি।
খানিক বাদে সে বুঝতে পারল, সে কী শোনার চেষ্টা করছে। দূরের অন্ধকার উপত্যকা থেকে আসা উদ্যাপনকারীদের নারকীয় মন্ত্রোচ্চারণ। তাদের প্রত্যাশা যে কী, তার ব্যাপারে সে এত কথা জানল কী করে? কী করে সে জানল যে কৃষ্ণকুক্কুট আর কৃষ্ণছাগের পর কোনো সময়ে নাহাব আর তার অনুচর বয়ে নিয়ে আসবে কানায় কানায় পূর্ণ পাত্র। সে দেখল, ঘুমিয়ে পড়েছে এলউড, চেষ্টা করল তাকে ডাক দিয়ে তুলতে। কিন্তু কোনো কিছু বন্ধ করে দিল তার গলা। সে আর তার নিজের মালিক নয়। তাহলে সে কি অবশেষে কৃষ্ণমানবের বইতে স্বাক্ষর করেই দিয়েছে?
তারপর তার উত্তেজিত, অস্বাভাবিক শ্রবণশক্তিতে ধরা পড়ল দূর থেকে হাওয়ায় ভেসে-আসা স্বরগুলো। মাইলের পর মাইল পাহাড়, মাঠ, গলি পেরিয়ে তারা এল বটে, কিন্তু তাতেও তাদের চিনতে অসুবিধে হল না। আগুনগুলো নিশ্চয়ই জ্বালানো হয়ে গেছে, নাচিয়েরা নিশ্চয়ই শুরু করতে যাচ্ছে। নিজের যাওয়া সে কীভাবে আটকাবে? তাকে যে সম্পূর্ণ জড়িয়ে ফেলেছিল, সেটা কী? গণিত, লোককথা, বাড়িটা, বুড়ি কেজিয়া…
এবার গিলম্যান দেখতে পেল তার পাশের দেওয়ালে একটা টাটকা ইঁদুরের গর্ত। দূরের মন্ত্রোচ্চারণ আর কাছের জো মাজুরেভিচের প্রার্থনা ছাপিয়ে এল আর-একটা শব্দ। পার্টিশনের ভেতরে একটা চোরাগোপ্তা, মন দিয়ে আঁচড়ানোর আওয়াজ। গিলম্যান আশা করতে লাগল যেন ইলেকট্রিকের আলোগুলো না নিবে যায়। তারপর সে ইঁদুরের গর্তে দেখতে পেল সেই শ্বদন্ত আর দাড়ি সমেত মুখখানা। সেই অভিশপ্ত মুখখানা, যা দেখে এবার সে উপলব্ধি করল যে সেটার সঙ্গে এমন একটা ব্যঙ্গের মতো সাদৃশ্য রয়েছে, বুড়ি কেজিয়ার যা চমকে দেয়। আর তারপর শুনতে পেল অস্পষ্ট দরজা হাতড়ানো।
আর্তনাদ-করা গোধূলি অতলগুলো সব সবেগে বেরিয়ে গেল তার চোখের সামনে দিয়ে। নড়াচড়ায় রং-পালটানো বুদ্বুদের তালের আকারহীন বন্ধনের মধ্যে নিজেকে অসহায় মনে হতে লাগল তার। তার সামনে তখন ছুটে চলেছে খুদে, ক্যালাইডোস্কোপের মতো রঙের পলকাটা বস্তুটা। উথালপাতাল শূন্যতার সর্বত্র তখন লয় আর তীব্রতা ক্রমশ চড়ে যাচ্ছে আবছা সুরের ওঠাপড়ার নকশাটার। যেন পূর্বাভাস জানাচ্ছে কোনো অকথ্য, অসহ্য পরিসমাপ্তির। তার মনে হল, কী আসতে চলেছে, তা তার জানা আছে। ঘটবে ওয়ালপুর্গিস ছন্দের এক দানবিক বিস্ফোরণ। আর তার মহাজাগতিক ধ্বনিগুণে কেন্দ্রীভূত হবে সেই সমস্ত আদিম, চরম স্থানকালের ফেনিলতা, যার স্থান পদার্থ গোলকদের স্তূপের পশ্চাদ্ভাগে। এবং যা কখনো-কখনো তুমুলভাবে নিষ্ক্রান্ত হয়ে আসে তালবদ্ধ অনুনাদে। সেই অনুনাদ অস্পষ্টভাবে প্রবেশ করে সত্তার প্রতিটি স্তরে, বিশেষ কিছু ভয়ংকর কালখণ্ডকে বীভৎস গুরুত্ব দেয় নানা জগৎ জুড়ে।
কিন্তু এই সব কিছু মিলিয়ে গেল এক সেকেন্ডে। সে আবার হাজির হল বেগুনি আলোয় আলোকিত সেই সংকীর্ণ জায়গাটায়। যেখানে ছাদ চুড়োর মতো, মেঝে হেলানো, আর যেখানে রয়েছে প্রাচীন বইয়ের খাটো আলমারি, বেঞ্চি আর টেবিল, অদ্ভুত সব বস্তু, আর একপাশে একটা ত্রিকোণ গহ্বর। টেবিলের ওপরে পড়ে একটা ছোট্ট সাদা দেহ। একটা দুধের শিশু। নগ্ন, জ্ঞানহীন। অন্য পাশে দাঁড়িয়ে সেই ভয়ানক বুড়ি, মুখে ব্যঙ্গের হাসি। ডান হাতে তার বীভৎস বাঁট-বসানো একটা ঝকঝকে ছুরি। আর বাঁ হাতে ধরা সর্বাঙ্গে বিচিত্র পেটাই নকশা-করা অদ্ভুত অনুপাতের একটা বিবর্ণ বাটি, তার গায়ে আড়াআড়ি পলকা হাতল বসানো। তার গলায় সুর ওঠাপড়া করছিল কোনো কর্কশ আচারের। তার ভাষা বুঝতে পারছিল না গিলম্যান। তবে মনে হল এমন কিছু, যা রেখেঢেকে উদ্ধৃত করা আছে নেক্রোনমিকনে।
দৃশ্যটা পরিষ্কার হয়ে আসতে গিলম্যান দেখতে পেল, প্রাচীন বুড়িটা সামনে ঝুঁকে বাটিটা বাড়িয়ে ধরছে টেবিলের ওপর দিয়ে। নিজের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে সে-ও অনেকটা হাত বাড়িয়ে দু-হাতে ধরল বাটিটা। খেয়াল করল সেটা অনেকটাই হালকা। ঠিক একই মুহূর্তে বাদামি জেনকিনের জঘন্য চেহারাটা হাঁচড়পাঁচড় করে উঠে এল তার বাঁদিকের কালো গহ্বরের কিনারা বেয়ে। বুড়িটা এবার তাকে ইশারা করল বাটিটাকে একটা বিশেষ জায়গায় ধরতে। সে তারপর তার বীভৎস ছুরিটা উঁচিয়ে ধরল তার খুদে, সাদা শিকারের ওপর তার ডান হাত যতটা ওঠে, সেখান থেকে। দাঁতাল, লোমশ প্রাণীটা খিকখিক করে বজায় রাখল অজানা আচারের ধারাবাহিকতা। তার ঘৃণ্য প্রত্যুত্তর এল ডাকিনীর বায়সকণ্ঠে। গিলম্যানের মনে হল, তার মন আর আবেগের অসাড়তার মধ্যে দিয়ে সবেগে দৌড়ে গেল একটা দন্তাঘাতের মতো মর্মস্পর্শী ঘৃণা। ধাতুর হালকা বাটিটা কেঁপে গেল তার হাতের মধ্যে। এক সেকেন্ড বাদে নীচে নেমে-আসা ছুরির গতি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দিল ঘোর। ঘণ্টার মতো ঢংঢং শব্দের প্রতিধ্বনির সঙ্গে সে ফেলে দিল বাটিটা। পৈশাচিক কাজটা থামানোর জন্যে ক্ষিপ্তের মতো ছিটকে গেল তার হাত দুটো।
মুহূর্তের মধ্যেই হেলানো মেঝে ধরে এক ঝটকায় টেবিলের প্রান্তটাকে বেড় দিয়ে সে ছুরিটা সজোরে কেড়ে নিল বুড়ির থাবা থেকে। ঝনঝন শব্দে সেটাকে পাঠিয়ে দিল সরু ত্রিকোণ গহ্বরের কিনারা পার করে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই উলটে গেল ব্যাপারটা। সেই খুনি থাবা এবার চেপে বসল তার নিজের গলার চারপাশে। বুড়ির বলিরেখা-পড়া মুখটা তখন বেঁকে গেছে উন্মত্ত ক্রোধে। সে টের পেল, তার গলায় ঘষা খাচ্ছে সস্তা ক্রুশের চেনটা। বস্তুটা দেখতে পেলে অশুভ প্রাণীটার ওপর কী প্রভাব পড়বে, বিপদে পড়ে সে প্রশ্ন উঠল তার মনে। বুড়ির শক্তি অমানুষিক, কিন্তু সে যখন গলা টিপেই চলেছে, তার মধ্যেই দুর্বলভাবে জামার মধ্যে হাত গলিয়ে গিলম্যান টেনে বের করল ধাতুর প্রতীকটা। চেনটা একটানে ছিঁড়ে খুলে আনল সেটাকে। সেটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল আতঙ্কের একটা ধাক্কা খেল ডাকিনী। যেটুকু সময়ের জন্যে শিথিল হয়ে এল তার থাবা, সেটাকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলার সুযোগ হিসেবে গিলম্যানের কাছে সেটুকুই ছিল যথেষ্ট। ইস্পাতের মতো থাবাটা ঘাড় থেকে টেনে তুলল সে। জাহাঁবাজ বুড়িটাকে টেনে গহ্বরের ওপারে হয়তো ফেলেও দিত, যদি না থাবাটা নতুন শক্তি পেয়ে ফের চেপে বসত। এবার সে স্থির করল একইভাবে জবাব দেওয়ার। তার নিজের হাত দুটো এগিয়ে গেল বুড়ির গলার দিকে। সে কী করতে যাচ্ছে, বুড়ি দেখতে পাওয়ার আগেই ক্রুশের চেনটা জড়িয়ে দিল তার গলায়। এবং মুহূর্তের মধ্যেই তার দম আটকে দেওয়ার মতো টানটান করে ফেলল সেটাকে। বুড়ির শেষ ছটফটানির সময়ে গিলম্যান টের পেল, তার গোড়ালিতে কিছু কামড়াল। দেখল, বুড়িকে সাহায্য করতে এসেছে বাদামি জেনকিন। একটা সপাট লাথিতে মূর্তিমান বিকৃতিটাকে সে পাঠিয়ে দিল গহ্বরের কিনার পার করে অন্যদিকে। তার গোঙানি শুনতে পেল অনেক নীচের কোনো স্তর থেকে।
প্রাচীন, শুকিয়ে-যাওয়া বুড়িটাকে সে মেরে ফেলেছে কি না বুঝতে পারছিল না গিলম্যান। কিন্তু তাও মেঝেতে যেখানে সে পড়ে গিয়েছিল, তাকে শুইয়ে রাখল সেখানেই। তারপর সে যখন মুখ ফেরাচ্ছে, টেবিলের ওপর তার নজরে এল এমন একটা কিছু, যা প্রায় ছিন্ন করে ফেলল তার বিচারবুদ্ধির অন্তিম সূত্রটুকু। ডাকিনী যখন তার গলা টিপে ধরছিল, ব্রাউন জেনকিন তার শক্তপোক্ত পেশি আর দানবীয় দক্ষতার চারটে হাত নিয়ে তার নিজের কাজ সারছিল। তার সমস্ত প্রচেষ্টা বৃথা গেছে। শিকারের বুকে যা করা থেকে ছুরিটাকে আটকাতে পেরেছিল সে, লোমশ মূর্তিমান অভিশাপটার হলুদ শ্বদন্ত একটা কবজিতে সমাধা করে ফেলেছে সেই কাজ। যে বাটিটা খানিক আগে পড়েছিল মাটিতে, এখানে সেটা প্রাণহীন ছোট্ট শরীরটার পাশে বসানো পরিপূর্ণ অবস্থায়।
তার স্বপ্ন প্রলাপের মধ্যেই গিলম্যান শুনতে পেল অসীম দূরত্ব থেকে আসা সাবাট মন্ত্রোচ্চারণের নারকীয় অস্বাভাবিক ছন্দ। বুঝতে পারল, সেখানে নিশ্চয়ই সেখানে আছে সেই কৃষ্ণমানব। তার গুলিয়ে-যাওয়া স্মৃতি মিশে গেল তার গণিতের সঙ্গে। তার মনে হল, তার অবচেতন মনে ধরা আছে সেই কোণগুলো। তাদের প্রয়োজন স্বাভাবিক দুনিয়ায় ফেরত যাওয়ার পথ চেনাতে। আর এই প্রথমবার তাকে ফিরতে হবে একা, কোনো সাহায্য ছাড়াই। সে যে তার নিজের ঘরের ওপরের বিস্মৃত কালের সিল-করা মাচাতেই রয়েছে, সে ব্যাপারে সে নিশ্চত ছিল। কিন্তু সে যে আদৌ হেলানো মেঝেটা দিয়ে, বা বহুকাল আগে বন্ধ-করে-দেওয়া প্রবেশপথটা দিয়ে বেরোতে পারবে কি না, সে বিষয়ে তার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তা ছাড়া স্বপ্নের মাচা থেকে পালানোটা কেবল তাকে স্বপ্নের বাড়িটাতে নিয়ে যাবে না কি? বাস্তবে যে জায়গাটা সে খুঁজছে, তার একটা অস্বাভাবিক প্রক্ষেপে? তার প্রতিটি অভিজ্ঞতাতেই স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে সে সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি থেকেছে।
অস্পষ্ট গহ্বরের মধ্যে দিয়ে যাওয়াটা ভয়ংকর হবে। কারণ তখন কম্পন হবে ওয়ালপুর্গিস ছন্দের। আর যেটাকে সে ভয়ানক ভয় পায়, এর আগে যা ছিল আবরিত, সেই মহাজাগতিক স্পন্দন তাকে শুনতে হবে। ঠিক তখনই সে টের পাচ্ছিল একটা হালকা দানবিক স্পন্দন। আর তার লয় যে কী হবে, সে ব্যাপারে ভালোই সন্দেহ ছিল তার। সাবাটের সময় সর্বদা চড়ে যায় এটা। সমস্ত বিশ্বের মধ্যে দিয়ে প্রসারিত হয় সদ্য দীক্ষিতদের অনামা আচারে তলব করতে। অর্ধেক সাবাট মন্ত্র আবছা কানে আসা এই স্পন্দনকে ভিত্তি করেই তৈরি। পার্থিব কোনো কান সহ্য করতে পারে না এর আবরণহীন ব্যাপ্তিজোড়া সম্পূর্ণতা। গিলম্যানের মনে এ প্রশ্নও উঠল, সে কি শূন্যের ঠিক জায়গায় ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্যে তার সহজাত প্রবৃত্তিকে বিশ্বাস করতে পারে? কী করে সে নিশ্চিত হবে যে সে গিয়ে পড়বে না সেই দূর গ্রহের সবুজ আলোয় ভাসা পাহাড়ের ঢালে? কিংবা গ্যালাক্সিপারের বহুশুণ্ড দানবদের খুদে টালি-বসানো চত্বরে? অথবা বিশৃঙ্খলতার চরম শূন্যতার শঙ্খবৃত্তাকার কৃষ্ণ আবর্তে, যেখানে রাজত্ব করে বোধবুদ্ধিহীন দানব সুলতান আজাজথ?
সে ঝাঁপ দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে নিবে গেল বেগুনি আলো, তাকে ফেলে গেল অন্ধকারে। অর্থাৎ মারা গেছে ডাকিনী, কেজিয়া বা নাহাব। গিলম্যানের মনে হল, দূর থেকে আসা সাবাটের মন্ত্রোচ্চারণ আর গহ্বরের তলা থেকে আসা বাদামি জেনকিনের গোঙানির সঙ্গে মিশছে অজানা গভীরতা থেকে আসা একটা আরও উদ্দাম একটানা নাকিসুরের আওয়াজ। জো মাজুরেভিচ। ধীরগতি বিশৃঙ্খলার বিপরীতে সব প্রার্থনা এবার পরিবর্তিত হচ্ছে ব্যাখ্যাতীত বিজয়ের এক তীক্ষ্ণ চিৎকারে। ব্যঙ্গময় বাস্তবের সব জগৎ চড়াও হচ্ছে জ্বরাক্রান্ত স্বপ্নের ঘূর্ণির ওপর। ইয়ে! শাব নিগার্যাথ! সহস্র সন্তানসহ ছাগ!
ভোর হওয়ার অনেক আগেই গিলম্যানকে পাওয়া গিয়েছিল তার অদ্ভুত সব কোণের পুরোনো চিলেকোঠার ঘরের মেঝেতে। ভয়ংকর আর্তনাদটা সঙ্গে সঙ্গে টেনে এনেছিল দেরশে, চয়েনস্কি, ডমব্রাওস্কি আর মাজুরেভিচকে। এমনকি জাগিয়ে তুলেছিল চেয়ারে বসে আঘোরে ঘুমোনো এলউডকেও। গিলম্যান জীবিত, তার খোলা চোখ দুটোও একদৃষ্টে তাকিয়ে, কিন্তু তাও তাকে মূলত অচেতন বলেই মনে হয়েছিল। তার গলায় কোনো খুনি হাতের ছাপ, আর গোড়ালিতে ইঁদুর কামড়ানোর যন্ত্রণাক্লিষ্ট দাগ। জামাকাপড় তার বাজেভাবে কুঁচকোনো, উধাও জোয়ের ক্রুশটাও। কাঁপতে লাগল এলউড, তার বন্ধুর ঘুমিয়ে হাঁটা যে কোন নতুন রূপ নিয়েছে, তা অনুমান করতেও ভয় করছিল তার। মাজুরেভিচকে প্রায় হতভম্ব দেখাচ্ছিল। কারণ তার প্রার্থনার উত্তরে কিছু সংকেত পেয়েছে সে। হেলানো পার্টিশনের পেছন থেকে একটা ইঁদুরের তীক্ষ্ণ চিৎকার আর গোঙানি আসতে নিজের বুকে তাড়াহুড়ো করে ক্রুশ এঁকে নিল সে।
এলউডের ঘরে তার কোচে গিলম্যানকে শুইয়ে দেওয়ার পর ডাক্তার ম্যালকাওস্কিকে ডেকে পাঠানো হল। তিনি স্থানীয় ডাক্তার, কাউকে লজ্জায় ফেলতে পারে এমন কোনো কাহিনির পুনরাবৃত্তি তিনি করবেন না। তিনি গিলম্যানকে দুটো ইনজেকশন দেওয়ায় সে অনেকটা স্বাভাবিক তন্দ্রাতে আরামে এলিয়ে পড়ল। দিনের বেলা মাঝেমধ্যে চেতনা ফিরে আসতে লাগল তার। সে তখন তার একেবারে নতুন স্বপ্নগুলোর কথা ছেঁড়া-ছেঁড়া ভাবে এলউডকে বলত। সমস্ত প্রক্রিয়াটা ছিল বড়ো বেদনার। আর তার শুরুতেই বেরিয়ে এল একেবারে নতুন এবং অস্থির-করে-দেওয়া একটা ব্যাপার।
গিলম্যান, কিছুদিন আগেও যার শ্রবণেন্দ্রিয় ছিল অস্বভাবিক রকমের প্রখর, এখন পরিণত হয়েছে বদ্ধকালাতে। ফের তাড়াহুড়ো করে ডেকে আনা হল ডাক্তার ম্যালকাওস্কিকে। তিনি এলউডকে জানালেন যে ফেটে গেছে গিলম্যানের দুটো কানের পর্দাই। যেন মানুষের ধারণা এবং সহ্যের বাইরের কোনো বিশাল উঁচু আওয়াজের ফলে। সমস্ত মিস্কাটনিক উপত্যকাকে তুলে না দিয়ে গত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কী করে গিলম্যান যে সে সেই আওয়াজ শুনে থাকবে, ভালোমানুষ ডাক্তারটি সে কথা বলতে পারলেন না।
নিজের কথোপকথনের অংশটা কাগজে লিখত এলউড, তাতে সুগম হয়ছিল ভাব আদানপ্রদানটা। দুজনের কেউই বুঝতে পারছিল না সমস্ত অরাজক ব্যাপারটার মানে কী। তাই তারা ঠিক করল, ব্যাপারটা নিয়ে যত কম ভাবা যায়, ততই ভালো। দুজনেই অবশ্য মেনে নিল যে যত তাড়াতাড়ি বন্দোবস্ত করা যায়, এই প্রাচীন অভিশপ্ত বাড়িটা তত তাড়াতাড়ি ছেড়ে যাওয়াটাই মঙ্গল। সন্ধের খবরের কাগজে বেরোল একটা খবর। ভোরের ঠিক আগে মেডো হিল পেরিয়ে একটা গিরিখাতে অদ্ভুত উৎসব উদ্যাপনকারীদের ওপর পুলিশ হানা দিয়েছিল। সেখানকার সাদা পাথরটা নাকি বহু যুগ ধরে কুসংস্কারগ্রস্ত শ্রদ্ধার পাত্র। কেউ ধরা পড়েনি বটে, কিন্তু যারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পালাচ্ছিল, তাদের মধ্যে নজরে পড়েছিল এক বিশালদেহী কৃষ্ণাঙ্গকে। কাগজের আর-একটা অংশ জানিয়েছিল, হারিয়ে-যাওয়া শিশু লাডিসলাস ওলেজকোকে তখনও পাওয়া যায়নি।
চূড়ান্ত বিভীষিকা এল সেই রাতেই। তার কথা কোনোদিন ভুলতে পারবে না এলউড। সেটা থেকে তার যা নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছিল, তার জেরে তাকে টার্মের বাকি সময়টা কলেজ বাদ দিতে হয়েছিল। সারা সন্ধে ধরেই তার মনে হয়েছিল যে পার্টিশনের ভেতরে ইঁদুরের আওয়াজ পাচ্ছে, কিন্তু সেদিকে বড়ো একটা মনোযোগ দেয়নি। তারপর, সে আর গিলম্যান দুজনে শুয়ে পড়ার অনেক বাদে, শুরু হল বীভৎস গলা-ফাটানো চিৎকার। লাফিয়ে উঠে আলো জ্বালল এলউড, ছুটে গেল তার অতিথির কোচের কাছে। গিলম্যান তখন প্রায় অমানুষিক ধরনের আওয়াজ করছে। যেন বর্ণনার অতীত কোনো যন্ত্রণা ছিঁড়ে খাচ্ছে তাকে। ঢাকার নীচে সে তখন ছটফট করেছে, আর একটা বড়ো লাল ছোপ ফুটে উঠছে কম্বলে।
তাকে ছোঁয়ার সাহস হল না এলউডের। তবে ক্রমশ কমে এল গলা-ফাটানো চিৎকার আর ছটফটানি। ইতিমধ্যে ডমব্রাওস্কি, চয়েন্সকি, দেরশে, মাজুইরেভিচ, ওপরতলার বাসিন্দাটি, সবাই ভিড় জমিয়েছে দরজায়। বাড়িওয়ালা তার গিন্নিকে পাঠাল ডাক্তার ম্যালকাউস্কিকে ফোন করতে। আর তারপরেই তারস্বরে চিৎকার করে উঠল সবাই। একটা বড়োসড়ো ইঁদুরের মতো আকৃতি আচমকা লাফিয়ে বেরিয়েছে রক্ত-মাখা বিছানার ঢাকার তলা থেকে। তরতর করে সেটা ছুটে গেল পাশের একটা নতুন খোলা গর্তে। যখন ডাক্তার এসে টেনে নামাতে শুরু করলেন ঢাকাগুলো, ততক্ষণে মারা গেছে ওয়াল্টার গিলম্যান।
গিলম্যান কীভাবে মারা গিয়েছিল, সেটার ইঙ্গিত দেওয়ার চাইতে বেশি কিছু বলাটা বর্বরতা হয়ে যাবে। তার শরীরের মধ্যে দিয়ে কার্যত একটা সুড়ঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। কিছুতে খেয়ে ফেলেছিল তার হৃৎপিণ্ডটা। ইঁদুরের বিষ দেওয়ার একটানা প্রচেষ্টার ব্যর্থতাতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল ডমব্রাওস্কি। বাড়ির লিজ়ের সব চিন্তাভাবনা ত্যাগ করে এক সপ্তাহের মধ্যে পুরোনো বাসিন্দাদের পাঠিয়ে দিয়েছিল ওয়ালনাট স্ট্রিটের একটা নোংরা কিন্তু কম প্রাচীন বাড়িতে। বেশ কিছুকাল জো মাজুরেভিচকে চুপ করিয়ে রাখাটাই ছিল সব চাইতে ঝামেলার কাজ। গুম-হয়ে-থাকা তাঁত-মিস্ত্রিটা মদ না খেয়ে থাকতে পারত না। সর্বদাই সে ঘ্যনাঘ্যান, বিড়বিড় করত ভৌতিক আর ভয়ানক সব ব্যাপার নিয়ে।
মনে হয়, মাজুরেভিচ সেই বীভৎস রাতে গিলম্যানের কোচ থেকে পাশের গর্তটা অবধি ইঁদুরের পায়ের রক্তলাল ছাপটা ঝুঁকে দেখেছিল। কার্পেটের ওপর দাগগুলো বড়ো একটা স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু কার্পেটের কিনারা আর দেওয়ালের নীচের পটির মাঝে খানিকটা ফাঁকা মেঝে ছিল। সেখানে সে ভয়ানক কিছু একটা দেখেছিল। অথবা সে মনে করে, সে দেখেছিল, কারণ সেই ছাপগুলো অনস্বীকার্যভাবে অদ্ভুত ছিল বটে, কিন্তু তাও কেউ তার সঙ্গে একমত হতে পারেনি। মেঝের ছাপগুলো নিঃসন্দেহে সাধারণ ইঁদুরের পায়ের দাগের থেকে একেবারেই আলাদা। কিন্তু এমনকি চয়েনস্কি আর দেরশে পর্যন্ত স্বীকার করতে রাজি হয়নি যে সেগুলো চারটে খুদে খুদে মানুষের হাতের ছাপের মতো।
বাড়িটা আর কোনোদিন ভাড়া দেওয়া হয়নি। ডমব্রাওস্কি ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিত্যক্ততার অন্তিম অবস্থার শববস্ত্র নেমে আসতে শুরু করে বাড়িটার ওপর। তার পুরোনো অখ্যাতি আর নতুন পূতিগন্ধের জন্যে লোকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে সেটাকে। তবে অতীতের বাড়িওয়ালার ইঁদুরে বিষ হয়তো অবশেষে কাজ দিয়ে থাকবে। কারণ তার বিদায় নেওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই জায়গাটা পল্লির আপদ হয়ে দাঁড়াল। স্বাস্থ্য দফতরের অফিসাররা পুবের চিলেকোঠার ঘরের ওপরের আর পাশের বদ্ধ জায়গায় খুঁজে পেলেন গন্ধটার উৎস। মরা ইঁদুরের সংখ্যাটা যে বিশাল হবে, সে কথা মানলেন বটে, তবে সিদ্ধান্ত নিলেন দীর্ঘদিন ধরে সিল-করা জায়গাগুলোকে কুপিয়ে খুলে জীবাণুমুক্ত করাটা তাঁদের সময়ের অপচয়। কারণ চড়া গন্ধটা মিলিয়ে যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না। এমনিতেও এলাকাটাও এমন নয়, যা চুলচেরা বাছবিচারের উৎসাহ জোগায়। আর তা ছাড়া মে-ইভ আর হ্যালোমাসের ঠিক পরেই ডাকিনী বাড়ির ওপরতলার ব্যাখ্যাতীত দুর্গন্ধ নিয়ে ভাসাভাসা স্থানীয় গল্প তো ছিলই। পড়শিরা নিমরাজি হয়ে এই আলসেমি মেনে হয়তো নিয়েছিল, কিন্তু দুর্গন্ধটা বাড়িটার বিরুদ্ধে হয়ে দাঁড়াল আর-একটা বাড়তি অপছন্দ। শেষের দিকে বাড়িটাকে অবাসযোগ্যে বলে রায় দিলেন বিল্ডিং ইনস্পেকটর।
গিলম্যানের স্বপ্ন আর তাদের আনুষঙ্গিক পরিস্থিতিগুলোর ব্যাখ্যা করা যায়নি কোনোদিনই। সমস্ত পর্বটা নিয়ে এলউডের চিন্তাভাবনা ছিল পাগল করে দেওয়ার মতো। পরের হেমন্তে সে কলেজে ফেরত আসে, স্নাতক হয় জুন মাসে। সে দেখেছিল, শহরে যথেষ্ট কমে গেছে ভূতুড়ে গুজব। কিছু খবর অবশ্য ছিল যে পরিত্যক্ত বাড়িটাতে শোনা যায় ভূতুড়ে খিকখিক। আর সেটা জারি ছিল বাড়িটা টিকে থাকা অবধি। কিন্তু তাও গিলম্যানের মৃত্যুর পরে থেকেই বুড়ি কেজিয়া বা বাদামি জেনকিনের কোনো নতুন দর্শনের কথা কেউ আর চুপিচুপি বলেনি। সেই বছরের পরের দিকে কিছু বিশেষ ঘটনা আচমকাই ফের জাগিয়ে তোলে প্রাচীন আতঙ্ক নিয়ে সেখানকার ফিশফিশ কথাবার্তা। ভাগ্যের কথা, এলউড তখন আর্কহ্যামে ছিল না। অবশ্য ব্যাপারটা পরে তার কানে এসেছিল। ফলে মন ভাঙা, ধন্দে-ফেলে-দেওয়া আন্দাজ-অনুমানের অবর্ণনীয় অত্যচার সহ্য করতে হয়েছিল তাকে। তবে বাস্তবে সেইসব ঘটনার কাছাকাছি থাকা, বা কিছু নজরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনার চাইতে অন্তত সেটা খারাপ ছিল না।
১৯৩১ সালের মার্চ মাসে শূন্য ডাকিনী বাড়ির ছাদ আর বিরাট চিমনিটা নষ্ট হয়ে গেল প্রবল বাতাসে। চূর্ণবিচূর্ণ ইট, কালো, শ্যাওল-ধরা কাঠের টালি, আর পচা তক্তা আর কড়িকাঠের একটা অরাজকতা হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল মাচার ওপর, ভেঙে পার হয়ে এল সেটার নীচের তলা অবধি। সম্পূর্ণ চিলেকোঠার তলাটা বুজে গেল ইমারতি জঞ্জালে। তবে জরাজীর্ণ কাঠামোটা অনিবার্যভাবে ভেঙে সাফ করে দেওয়ার আগে অবধি কেউ আর কষ্ট করে সেই আবর্জনায় আর হাত দিতে চায়নি। সেই চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হল পরের ডিসেম্বরে। আর যখন গিলম্যানের পুরোনো ঘরটা সাফ করে ফেলল অনিচ্ছুক, আশঙ্কায় ভোগা শ্রমিকরা, তখনই শুরু হল গুজব।
প্রাচীন হেলানো ছাদটা ভেঙে নেমে এসেছিল যে সমস্ত আবর্জনা, তাদের মধ্যে ছিল এমন কয়েকটা জিনিস, যে শ্রমিকদের কাজ থামিয়ে পুলিশ ডাকতে হল। এরপর পুলিশও ডেকে পাঠাল করোনার আর ইউনিভার্সিটির কয়েকজন প্রফেসারকে। পাওয়া গিয়েছিল হাড়। খুব বাজেভাবে গুঁড়িয়ে যাওয়া, চ্যালা হয়ে যাওয়া বটে, কিন্তু সেগুলো মানুষের বলে পরিষ্কারভাবে চিনতে পারা যাচ্ছিল। হাড়গুলোকে গোপন করে রাখার একমাত্র জায়গা হয়ে থাকবে ওপরের হেলানো মেঝের মাচাটা। সেখানে সিল করে বন্ধ করে দেওয়া ছিল মানুষ প্রবেশের সমস্ত পথ। কিন্তু অনুমান অনুযায়ী সেটা করা হয়েছিল সুদূর অতীতে, আর হাড়গুলো সন্দেহাতীতভাবে ছিল সাম্প্রতিককালের। এ ছিল হতভম্ব করে দেওয়ার মতো এক পরস্পরবিরোধী ব্যাপার। করোনারের ডাক্তার সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে এর মধ্যে কয়েকটা কোনো ছোটো শিশুর। আর আরও কয়েকটা, যেগুলো পাওয়া গিয়েছিল হালকা বাদামি রঙের পচা ন্যাকড়ার টুকরোর সঙ্গে, বেশ ছোটোখাটো, ঝুঁকে-পড়া কোনো বৃদ্ধা নারীর। সাবধানে জঞ্জাল পরীক্ষা করে পাওয়া গিয়েছিল ধসের মধ্যে আটকে-পড়া ইঁদুরদের ছোটো ছোটো হাড়। আর পাওয়া গিয়েছিল পুরোনো ইঁদুরের হাড়, যা চিবোনো হয়েছিল কোনো খুদে শ্বদন্তে। সে চিবোনোর ধরন এমনই যে মাঝেমধ্যেই তা ইন্ধন জোগায় তর্কবিতর্ক আর চিন্তাভাবনার। আর যা যা পাওয়া গিয়েছিল, তার মধ্যে ছিল একসঙ্গে মিশে-যাওয়া বহু বই আর কাগজপত্রের টুকরো। তার সঙ্গে ছিল তাদের চাইতেও পুরোনো বই আর কাগজের সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়ার ফসল খানিকটা হলদে রঙের ধুলো। মনে হয়েছিল কোনো ব্যতিক্রম ছাড়া সব ক-টার বিষয়ই সব চাইতে উন্নত এবং ভয়ংকর সব ধরনের ব্ল্যাক ম্যাজিক। কিছু কিছু জিনিসের স্পষ্ট সাম্প্রতিক সময়কালও ছিল রহস্যের। সমসাময়িককালের মানুষের হাড়গুলোর মতোই তা আজও রয়ে গেছে অমীমাংসিত। তার থেকেও ছিল একটা বড়ো রহস্য। বিপুল ধরনের সব কাগজের অবস্থা আর জলছাপ দেখে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল যে তাদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য কম করে দেড়শো থেকে দুশো বছর। কিন্তু তাদের সবার ওপর পাওয়া ঠাসবুনোট, অপাঠ্য প্রাচীন হাতের লেখাগুলো ছিল সম্পূর্ণ পার্থক্যহীন। তবে কারও কারও কাছে সব চাইতে বড়ো রহস্য ছিল ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-থাকা বস্তুগুলো। ক্ষয়ক্ষতির বিভিন্ন অবস্থায় পাওয়া-যাওয়া সেগুলো। ব্যাখ্যা করা যায়নি সেইসব আলাদা আলাদা ধরনের জিনিসকে। তাদের আকার, উপাদান, কারিগরির প্রকৃতি, উদ্দেশ্য ব্যর্থ করেছে সমস্ত অনুমানকে। তাদের মধ্যে একটা জিনিস মিস্কাটনিকের কয়েকজন প্রফেসারকে উৎসাহিত করেছিল গভীরভাবে। বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দানবিক সেই বস্তুটা। তবে তার স্পষ্ট সাদৃশ্য ছিল গিলম্যানের কলেজ মিউজ়িয়ামকে দেওয়া অদ্ভুত মূর্তিটার সঙ্গে। যদিও পার্থক্যও ছিল। এই বস্তুটা আকারে বড়ো, ধাতুর বদলে এক অদ্ভুত নীল পাথরে তৈরি। তাতে ছিল একটা অনবদ্য কোণের বেদি, যার ওপরের হায়ারোগ্লিফিক্সের পাঠোদ্ধার করা যায়নি। আর ছিল চাপে দুমড়ে-যাওয়া একটা হালকা ধাতুর বাটি। এর গায়ের উদ্ভট পেটাই নকশার ব্যাখ্যা এখনও দেওয়ার চেষ্টা করছেন প্রত্নতাত্ত্বিক আর নৃতাত্ত্বিকরা। এটা যখন পাওয়া গিয়েছিল, এর ভেতরের দিকে ছিল হালকা বাদামি রঙের ভয়ানক ছোপ। এ বাদে মিলেছিল আবর্জনার সঙ্গে মিশে-থাকা ছেঁড়া চেন সমেত একটা আধুনিক নিকেলের ক্রুশ, যা নিয়ে পরদেশিরা আর সরলবিশ্বাসী ঠাকুমারা আজও সমান তালে অনর্গল বকে চলেছে। কাঁপতে কাঁপতে সেটাকে শনাক্ত করেছিল জো মাজুরেভিচ। এটা সেই ক্রুশটাই, যেটা সে বহু বছর আগে দিয়েছিল বেচারা গিলম্যানকে। কেউ কেউ বিশ্বাস করে সিল-করা মাচাটাতে ক্রুশটা ইঁদুরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ ভাবে, ওটা গিলম্যানের পুরোনো ঘরের কোনো কোণে মেঝের ওপরেই পড়ে ছিল চিরকাল। জো সমেত কেউ কেউ কপচায় এমন সব থিয়োরি, যা ঠান্ডা মাথায় বিশ্বাস করার পক্ষে বড়োই উদ্দাম এবং কল্পনাশ্রয়ী।
এরপর উপড়ে ফেলা হয়েছিল গিলম্যানের ঘরে হেলানো দেওয়ালটা। দেখা গিয়েছিল পার্টিশন আর বাড়ির উত্তরের দেওয়াল মাঝখানের যে এককালে সিল-করে-দেওয়া ত্রিকোণ আকৃতির পরিসরটা রয়েছে, সেখানে পরিমাপের অনুপাতে ঘরটার চাইতে ইমারতি আবর্জনা কম। তার বদলে ছিল পুরোনো কিছুর এমন এক ভয়ানক স্তর, যা দেখে ভয়ে অসাড় হয়ে গিয়েছিল বাড়ি-ভাঙতে-আসা লোকজন। সংক্ষেপে বলতে গেলে সেখানে মেঝেটা প্রকৃতপক্ষে পরিণত হয়েছিল শিশুদের হাড়ের অস্থিপাত্রে। এইসব হাড়ের মধ্যে কিছু প্রায় সমসাময়িক, কিন্তু বাকিগুলোর বয়স এক অসীম ক্রমবিন্যাসে বিস্তৃত অতীতের কোনো সময়কাল অবধি। সে অতীত এতই সুদূর, যে প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এসেছিল তাদের গুঁড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া। হাড়ের এই গভীর স্তরের ওপর পড়ে ছিল একটা বিশাল ছুরি। ছুরিটা সুস্পষ্টভাবে প্রাচীন। উদ্ভট, অতি অলংকৃত, আর অপরিচিত রকমের বিচিত্র তার রূপ। আর এইসবের ওপর চাপা ছিল ইমারতি আবর্জনা।
এবং সেই ইমারতি আবর্জনার মধ্যে ছিল আরও একটা জিনিস। একটা খসে-পড়া তক্তা আর বিনষ্ট চিমনির সিমেন্ট-লাগা ইটের পাঁজার মধ্যে গোঁজা ছিল সেটা। এমন একটা জিনিস, যেটার ভবিতব্য ছিল সেই ভূতুড়ে, অভিশপ্ত বাড়িটা থেকে আর যা কিছু পাওয়া গিয়েছিল, সেসবের চাইতে অনেক বেশি বিভ্রান্তি, চাপা ভয় আর খোলাখুলি কুসংস্কারের কারণ হয়ে ওঠা। বস্তুটা একটা বিরাট রোগগ্রস্ত ইঁদুরের আংশিক গুঁড়িয়ে-যাওয়া কঙ্কাল। সেটার আকৃতি এমনই অস্বাভাবিক, যে তা আজও মিস্কাটনিকের তুলনামূলক শারীরবিদ্যা বিভাগের সদস্যদের কেবল বিতর্কের বিষয়ই নয়, এক অসাধারণ নীরবতার উৎসও হয়ে রয়েছে। কঙ্কালটার ব্যাপারে ফাঁস হয়েছে খুব সামান্যই। তবে যেসব শ্রমিকে এটা খুঁজে পেয়েছিল, তারা আঁতকে-ওঠা নীচুস্বরে বলে থাকে এটার আনুষঙ্গিক হালকা বাদামি রঙের লম্বা রোমগুলোর কথা।
গুজব, খুদে থাবাগুলোর হাড় নাকি ইঁদুরের চাইতে কোনো অতি ক্ষুদ্র বাঁদরের ধাঁচের দিকেই ইশারা করে। হলুদ রঙের হিংস্র শ্বদন্ত সমেত খুলিটাও ছিল চূড়ান্ত রকমের বেখাপ্পা। কিছু বিশেষ দিক দিয়ে দেখলে তাকে মনে হত যেন মানুষের খুলির বিকটভাবে হীন-করা এক অতি ক্ষুদ্র ব্যঙ্গময় রূপ। এই অভিশপ্ত জিনিসটা পেয়ে আতঙ্কে বুকে ক্রুশ এঁকেছিল শ্রমিকেরা। কিন্তু সেই তীক্ষ্ণ, ভূতুড়ে খিকখিক আর তাদের শুনতে হবে না মনে হওয়ায় পরে কৃতজ্ঞতার মোমবাতি জ্বালিয়েছিল সেন্ট স্টানিস্লস গির্জায়।
Tags: এইচ পি লাভক্র্যাফট, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সুমিত বর্ধন