বাঁচতে দাও
লেখক: রণেন ঘোষ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
যুদ্ধ! মানবসভ্যতার এক কলঙ্ক। শুধু কলঙ্ক নয়, সে তার জন্মদাতা মানবসমাজকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বারে বারে হাত বাড়াচ্ছে নানা রূপে, নানা আকারে। আদি-অনন্তকাল ধরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলেছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষালাভ করেও নিজেদের আমরা সংযত করতে পারি না। মনের মধ্যে পশুটা বারবার শিকল ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ভিয়েতনাম তার জ্বলন্ত নজির। স্বাধীনতা, দেশপ্রেম, মাতৃভূমি প্রভৃতি কথার আসল অর্থ কি আমরা কোনোদিনও বুঝতে পারব না? নিজেদের ছোটো ছোটো গণ্ডির মধ্যে আটকে রেখে কেবলই কি আমরা পাশববৃত্তির দাসত্ব করব?
বিকেলের পড়ন্ত রোদ তার সোনা-গলা গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে চতুর্দিকে। নির্মেঘ আকাশে সুদূরের আহ্বান। বসন্তের ফুরফুরে হাওয়ায় মনপ্রাণ সব ভরিয়ে তোলে। ফোমের গদি-আঁটা চেয়ারে বসে আছে ডোনাল্ড রাসেল। চোখে-মুখে পরম শান্তি। চাওয়া-পাওয়ার সমস্ত হিসাবনিকাশই সাফল্যের সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে। অর্থ, মান, সম্মান, স্ত্রী-পুত্র সবই আছে। না, জীবনের কোনো আশাই অপূর্ণ থাকেনি। পাইপের আগুনটা বোধহয় নিবে এসেছিল। আবার নতুন করে তামাক ভরে আগুন ধরিয়ে নিলেন। সামনেই নিউ ইয়র্কের মনোরম দৃশ্যপট। নানান আকারের আকাশ-ছোঁয়া রংবেরঙের বাড়ি আর বাড়ি। ঠিক যেন রূপকথার রাজপুরী।
রাসেল একজন নামকরা স্থপতি। সত্যি একজন জাতশিল্পী রাসেল। নিউ ইয়র্কের অনেক নামকরা বাড়ির জন্মদাতাও এই রাসেল। যে বাড়িতে এখন বাস করছে, এর স্থাপত্যকলাও এর করা। এই মেটাল বিল্ডিং সত্যি এক দেখার মতো জিনিস। ৮১ তলা এই বাড়ির উপরের ফ্ল্যাটটা নিজের পছন্দমতো তৈরি করেছে। নিউ ইয়র্কের সব মনোরম দৃশ্যই দেখা যায় এখান থেকে। স্বচ্ছ অ্যালুমিনো-কোয়ার্জ দিয়ে তৈরি এই ফ্ল্যাটের সব দেয়াল। মাঝে মাঝে দেওয়ালের মধ্যেই আছে শক্তিশালী লেন্স-লাগানো জানলা। দূরের অতি ক্ষুদ্র বস্তুও বড়ো হয়ে দেখা যায় এর মাধ্যমে। অল্প স্বচ্ছ ফেরো-কংক্রিটের ব্লক দিয়ে তৈরি হয় এখানকার সব বাড়িঘর৷ ফলে আকাশ-ছোঁয়া বাড়ির বিভিন্ন ফ্ল্যাট থেকে ভেতরকার আলোর রেশ গোটা নিউ ইয়র্ককে স্বপ্নপুরী করে তুলেছে। নীল আকাশের বুকে রুপোলি মদের মতো সাঁতরে বেড়াচ্ছে অনেকগুলো এয়ারপ্লেন। মাটির উপর দিয়ে যাতায়াতের চেয়ে আকাশপথে যাতায়াত অনেক সুবিধে। তাই হেলিপ্লেন, হেলিকপ্টার আর ছোটো ছোটো এয়ারপ্লেনের ছড়াছড়ি এখন।
একটি কথাই কেবলই মনে হচ্ছে রাসেলের… কী সুন্দর এই পৃথিবী। কত সুন্দর এই মানুষেরা। নিজেকে মানুষ বলে ভাবতেও গর্ব হয় এখন। মানুষ! মানুষ! মানুষ! কী মিষ্টিমধুর সুন্দর কথা। বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে বড়ো আপনজন বলে মনে হল। শিক্ষায়, সভ্যতায়, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে বলীয়ান মানুষই তো পৃথিবীকে শান্তির স্বর্গ করে তুলেছে।
শান্তি—শান্তি—শান্তি! কী অনাবিল শান্তি চারদিকে। স্বৰ্গ যদি কোথাও থাকে তা এখানেই… আপন মনেই কথাগুলো বলে উঠল রাসেল।
কী… কী বলছ? কিছু বলছ নাকি আমাকে? পাতলা ধাতুর তৈরি বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে জিজ্ঞাসা করল স্ত্রী।
স্ত্রী-র কথায় তন্ময় ভাবটা কেটে গেল। নড়েচড়ে ঠিক হয়ে বসল রাসেল।
না, তোমাকে কিছু বলিনি, ডোরা। যত দেখছি, ভাবছি ততই, আর যেন মোহিত হয়ে পড়ছি। ওই দ্যাখো-না… ছোটোবড়ো নানা আকারের আকাশচুম্বী বাড়িময় নিউ ইয়র্কের দিকে হাত দিয়ে দেখাল রাসেল। জানো ডোরা, যত দেখছি, ততই ভাবছি। তিল তিল করে তিলোত্তমা। শুধু আমাদের দেশেই নই, সমস্ত পৃথিবীটাই বুঝি এগিয়ে চলেছে স্বর্গের দিকে৷ কী অনাবিল শান্তি চারদিকে। শান্তিতেই সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠবে আমাদের ছেলেমেয়েরা। সামনে খেলনা প্লেন নিয়ে খেলা করছিল ছ-বছরের ছোটো ছেলে পল। গভীর মমতাভরা চোখে ওর দিকে তাকাল রাসেল।
হুঁ, যতসব বাজে কথা। তোমার স্বপ্ন, স্বপ্নই থাকবে। কর্কশ গলার আওয়াজে চমকে উঠল দুজনে। বাবার উপস্থিতির কথা মনেই ছিল না ওদের। মৃদু হেসে আবার বই পড়তে শুরু করল ডোরা। বৃদ্ধ শ্বশুরের কথাবার্তাই এইরকম।
আমায় কিছু বলছেন আপনি? না। শান্তস্বরে বলল রাসেল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমাকেই বলছিলাম। কানে কি কম শুনছ আজকাল। সব ভুল, সমস্তটাই একটা বিরাট ধাপ্পা। ভ্রূ-র চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে। কোটরে ঢোকা দু-চোখে অবিশ্বাসের আগুন ধকধক করে জ্বলে উঠল। শোনো রাসেল, তোমার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে। কোনোদিনও সত্যি হবে না। যুদ্ধ আবার হবেই৷ আর সেই যুদ্ধে তোমার এই সভ্যতা, স্থাপত্যকীর্তিমায় সমস্ত মানবসমাজ কোথায় মিলিয়ে যাবে, কে জানে! তারপর অন্য কোনো গ্রহ থেকে সার্ভে পার্টি আসবে কোনো একদিন। মাটির বহু নীচে খুঁজে পাওয়া যাবে তোমাদের সভ্যতার ফসিলগুলো। নিরাপত্তা! শান্তি! যতসব! একটু কেশে নিয়ে আবার বললেন, বড়ো বড়ো গালভরা কথা ছাড়া ওগুলো আর কিছু নয়, বুঝলে?
ভালো ভালো কথা বলে তুমি-আমি-সবাই সবাইকেই কেবল ঠকিয়ে চলেছি। আমি তোমাকে বলছি, শুনে রাখো রাসেল, মাত্র কয়েক বছর পরেই সব শেষ।
রাসেলের চোখে-মুখে অবিশ্বাসের ভাব ফুটে উঠতেই বৃদ্ধ পিটার আবার বলতে শুরু করলেন, বিশ্বাস হচ্ছে না? বিশ্বাস করবে কেন। আচ্ছা, একটা প্রশ্নের জবাব দিতে পারো রাসেল? পৃথিবী জুড়ে প্রতিটি দেশ কেন হাজারে হাজারে রকেট, আণবিক বোমা, আরও কত নাম-না-জানা মারণাস্ত্র তৈরি করে চলেছে? স্বয়ং ঈশ্বরও বোধহয় জানেন না, কোন দেশ কী তৈরি করে চলেছে। পৃথিবী জুড়ে যখন শান্তি, তখন কীসের প্রয়োজনে মারাত্মক ধ্বংসের অস্ত্র তৈরি হয়? এত দল, গোষ্ঠী গড়ারই বা দরকার কীসের? ইউনাইটেড ইউরোপ, সাইনো রুশ, অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকা। কেন সবাই বলতে পারল না আমরা সবাই এক। আমরা পৃথিবীর লোক। তারপর আরও যেন তোমরা কী তৈরি করেছ রাসেল। রেডাইট এক্সপ্লোসিভ, ওই দিয়ে বোমা তৈরি করলে একটা বোমাই এতো বড়ো শহরের পক্ষে যথেষ্ট। তা ছাড়া মারাত্মক বিষাক্ত গ্যাস তো রয়েছে। কেন, কীসের জন্যে এগুলো তৈরি করে চলেছে? শান্তি রক্ষার জন্যে? ধ্বংসের অস্ত্রের উপর কি নির্ভর করবে শান্তি? শুধু একটিমাত্র স্ফুলিঙ্গ—ব্যাস, তারপরেই চক্ষের নিমেষে জ্বলে উঠবে সমস্ত পৃথিবী। তোমরা কি এখনও বুঝতে পারছ না, এ কোন ভবিষ্যতের দিকে চলেছ। জানো রাসেল, ভূতের পা থাকে পিছনে। ভূত যদি মনে করে, সামনের দিকে চলবে, সে ততই চলে পিছনের দিকে। তোমরাও চলেছ এক সর্বাত্মক ধ্বংসের দিকে।
এত কথা বলার পর উত্তেজনায় হাঁপাতে লাগল পিটার। সাদা চুলগুলো কপালের উপর ঝুঁকে পড়েছে। অল্প অল্প হাওয়ায় দু-একটা ফুরফুর করে উড়ছে।
আচ্ছা বাবা, আপনি তো জানেন, বেশি কথা বললেই আপনি দুর্বল হয়ে পড়েন। আর এই বয়সে সব কিছুই হালকাভাবে নিতে হয়। আপনি ভয় পাচ্ছেন মিছিমিছি। আপনাদের যুগের চেয়ে আমরা অনেক বেশি রিজ়্নেবল। তা ছাড়া বিজ্ঞান সভ্যতাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। আজকের দিনে যুদ্ধ এক অবাস্তব, অসম্ভব কল্পনা। শুধু তা-ই নয় বাবা, যুদ্ধ এক জঘন্য ব্যাপার। আপনাদের সময়ের যুদ্ধ, আপনাদের কাছে মধ্যযুগীয় বীভৎস হত্যালীলা ছাড়া আর কিছু নয়। মানুষ মানুষকে হত্যা করবে—এ যে চিন্তা করা যায় না এখন।
স্মিত মুখে স্বামীর দিকে তাকাল ডোরা। এই তো কথা। শ্বশুরমশাইয়ের চিন্তাধারা সেই মান্ধাতার যুগের।
পিটার কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ছেলের দিকে। তারপর শান্তস্বরে বলল, শোনো রাসেল, তোমাকে একটা কথা বলি। কোনো পরিবর্তন ঘটেনি মানুষের স্বভাবের। আমার বিশ্বাস, হাজার চেষ্টা করেও কেউ পালটাতে পারবে না। আমরাও ঠিক তোমার মতো চিন্তা করতাম, বলতাম। তা সত্ত্বেও মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়নি। আমরা বিশ্বাস করতাম, ওগুলো কিছুই না। যুদ্ধ অসম্ভব। কিন্তু আমাদের এই বিশ্বাসকে বিদ্রুপ করে সত্যি সত্যিই শুরু হল যুদ্ধ। আমিও যোগ দিয়েছিলাম যুদ্ধে। যুদ্ধ যে কী তা আমি হাড়েহাড়ে জানি। শুনে বা বই পড়ে তুমি কল্পনা করতেই পারবে না যুদ্ধের সেই ভয়ংকর বীভৎস তাণ্ডবলীলা। মানুষের সঙ্গে বনের পশুর কোনো তফাত ছিল না তখন। বড়ো বড়ো পশুও বোধহয় এত নির্মম নিষ্ঠুর নয়। কিন্তু মনে করে দ্যাখো রাসেল, এখনকার তুলনায় তখনকার অস্ত্রশস্ত্রগুলো তো একেবারেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের।
অথচ আজও দেখি, দেশে দেশে চলেছে মারণাস্ত্র তৈরির অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা। আজ হোক বা কাল হোক, একদিন না একদিন কোনো একজন বা একটি দল বোকার মতো কাজ করে বসবে আর তার ফলে দেশে দেশে শুরু হয়ে যাবে ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা। তা ছাড়া আমার তো…
একই কথা বারবার শুনতে ভালো লাগল না কারও। ডোরাও তাই বিরক্ত হয়ে উঠল মনে মনে। ঘনঘন ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে। রাত এখন আটটা।
আশ্চর্য! এত দেরি করছে কেন অ্যালান? ফোটোফোনে তো জানিয়েছিল, সাতটার মধ্যেই এসে যাবে।
রাসেল ডোরার বড়ো ছেলে অ্যালান। আমেরিকার সিক্রেট সার্ভিসের পদস্থ অফিসার।
না না, ডোরা, চিন্তা কোরো না। হয়তো-বা কোনো জরুরি কাজে আটকে পড়েছে ওয়াশিংটনে। এসে পড়বে এক্ষুনি। ডোরাকে সান্ত্বনা দিল রাসেল।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল ডোরা। উঃ, শুধু দেখার জন্যে কবে থেকে অপেক্ষা করে আছি। অথচ থাকবে তো মাত্র কয়েকদিন। মায়ের কথা কি একবারও মনে পড়ে না ওর।
সরকারি চাকরি করলে মা-বাবাকে ত্যাগস্বীকার করতে হবে, ডোরা৷ কত কাজ ওদের। দেশের কাজে ও সব সময়ে ব্যস্ত।
বালক পলের দৃষ্টি এখন আকাশের দিকে। হঠাৎ আকাশের বুকে ছোটো একটা আলোর বিন্দু দেখা গেল। ক্রমেই বড়ো হচ্ছে। চাপা গুঞ্জন ভেসে আসছে। হাততালি দিয়ে নেচে উঠল পল।
মা, দ্যাখো দ্যাখো। ওই তো দাদা আসছে। দাদা আসছে৷ দাদা আসছে। কী মজা!
সোজা নেমে আসছে হেলিকপ্টার। মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল রাসেল।
ডোরা! ডোরা! ঠিকই বলেছে পল। অ্যালেন আসছে বলে মনে হচ্ছে।
বিরাট দুর্ভাবনার হাত থেকে মুক্তি পেল ডোরা। একমাত্র মা-ই বুঝতে পারবে ওর মনের অবস্থা। ক্ষণেক্ষণে কেউ যেন মোচড় দিতে থাকে হৃৎপিণ্ডটাকে। ছোটো পল হাততালি দিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে রাসেল। অ্যালেন যে ওদের পরিবারের সকলের প্রিয়।
সামান্য দূরে হেলিপ্যাডের উপর নামল হেলিকপ্টারটা। নিখুঁত সুট-পরা অ্যালেন নামতেই খুদে খুদে হাতে জড়িয়ে ধরল পল। কোলে তুলে নিয়ে আদর করল অ্যালেন। ডোরাও দু-হাতে জড়িয়ে ধরল অ্যালেনকে। দাদু, বাবা, মা, ভাই, সকলের আদরের চোটে অস্থির হয়ে উঠল সে।
এত দেরি করলি কেন বল তো? আমার কথা কি তোর একবারও মনে পড়ে না?
মা-মামণি, তোমাদের কি ভুলতে পারি? আজকে তো আসাই হত না, অনেক কষ্টে এসেছি৷
এতক্ষণ চুপ করে ছিল বৃদ্ধ পিটার। শুধু অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার প্রশ্ন করল, কেন বাবা অ্যালেন, আসা হত না কেন?
না না, এমন কিছু নয়। আর সে কথা বলাও যাবে না, দাদু।
অ্যালেন!
দাদুর গম্ভীরস্বরে চমকে উঠল সকলে।
কী—কী দাদু?
কী এমন কথা যে আমাদের বলা যাবে না!
না না, দাদু। ও কিছু নয়৷ ও কিছু নয়।
ননসেন্স! আমাকে ধাপ্পা দেবে তুমি। মনে রেখো অ্যালেন, আমিও তোমার মতো বড়ো চাকরি করতাম। বেশ বুঝতে পারছি, কথাটা বলতে ভয় পাচ্ছ। কীসের ভয়! কার ভয়! নির্ভয়ে বলো আমাদের।
দ্বিধার ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠল ওর চোখে-মুখে। লাল হয়ে উঠল কান দুটো।
মানে… মানে আধ ঘণ্টার মধ্যেই ওয়াশিংটনে ফিরে যেতে হবে আমাকে। অনেক জরুরি কাজ পড়ে আছে।
কিন্তু অ্যালেন, তোমার তো পনেরো দিনের ছুটি শুরু হবার কথা আজ থেকে। তুমি তো নিজেই বলেছিলে… অভিমানে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল ডোরার।
মা—মাম্মি, তা-ই তো ঠিক ছিল, কিন্তু এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেল যে। আর তাই তো বাতিল হয়ে গেল সব ছুটি। তবে সামনের সপ্তাহের দিকে…
অ্যালেন, আমার কাছে এসো। আদেশের সুরে বলল পিটার। পায়ে পায়ে দাদুর কাছে এসে দাঁড়াল ও।
অ্যালেন, সামনের সপ্তায়ও তোমার আসা হয়ে উঠবে না।
না না দাদু, তা ঠিক নয়। গলার স্বরে কেমন আত্মসমর্পণের ভাব।
অ্যালেন, আমার কোলেই মানুষ হয়েছ তুমি। কোনোদিনও কোনো কথা গোপন করোনি আমার কাছে। আর আজ তুমি…
বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে ওর সারা মুখে। কেমন যেন এক দুশ্চিন্তার ভাব সর্বাঙ্গে। বাবা-মা দুজনেই ওর দিকে তাকিয়ে। এমনকি ছোটো পলও হতবাক হয়ে গেছে ওদের আচরণে।
নীচের ঠোঁট কামড়ে কী যেন ভাবল অ্যালেন। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল একবার। একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এল ওর বুকের মধ্যে থেকে। প্রচণ্ড অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত ও।
তোমরা তো জানো, আমি চাকরি করি সিক্রেট সার্ভিসে। এখানকার কোনো কথাই কারও কাছে বলা উচিত নয়। কিন্তু তোমাদের কাছে… মানে… কিছুই চেপে রাখতে পারছি না আমি। আমরা, মানে আমাদের গভর্নমেন্ট আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই যুদ্ধের আশঙ্কা করছে।
বাজ পড়ল যেন! বজ্রাহতের মতো সকলে স্তব্ধ হয়ে গেল। এ অবিশ্বাস্য। অসম্ভব। না না, শোনার ভুল নয় তো।
যুদ্ধ!! একসঙ্গে বলে উঠল রাসেল আর ডোরা৷
পরক্ষণেই হো হো করে হেসে উঠল রাসেল। ছেলের পিঠ চাপড়ে বলে উঠল, অ্যালেন, তোমার নিশ্চয় বিশ্রামের প্রয়োজন? আচ্ছা, বাবা-মা-কে ঠকাতে পারবে না তুমি। তোমার সঙ্গে নিশ্চয় তোমাদের বড়ো কর্তারা ঠাট্টা করেছে। যুদ্ধ! হাঃ হাঃ হাঃ… আমাদের মতো সভ্য জগতে যুদ্ধ! অসম্ভব! সম্পূর্ণ অবাস্তব। কীসের জন্য? কার সঙ্গে? বলতে পারো তুমি? ননসেন্স!
হাসি ফুটে উঠল ডোরার মুখে। ছেলের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, অ্যালেন, কিছুদিন তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন। কয়েকদিনের জন্যে দেশের বাড়িতে চলো। ওয়াশিংটনে ফোন করে তোমার ছুটির জন্যে বলে দিচ্ছি আমি।
ছোটো পল হাঁ করে সকলের কথা শুনছিল। এবার সে বলে উঠল, যুদ্ধ! সে আবার কী! যুদ্ধ মানে কী, দাদা?
কী বলবে সে? কী বললে বিশ্বাস করবে সকলে? নিরুপায় হয়ে সকলের মুখের দিকে তাকাল অ্যালেন। এখনও কি কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না! অবশ্য সে-ও পারেনি প্রথমে। পরপর কয়েকদিন গোপন বৈঠক হয়েছিল ক্যাবিনেটের। তারপর কথাটা শুনেছিল সে। সে-ও বিশ্বাস করতে পারেনি প্রথমে। কিন্তু ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি।
বৃদ্ধ পিটারের দৃষ্টি আকাশের দিকে। সারা আকাশ জুড়ে ফেরি প্লেনের আনাগোনা। নিরবচ্ছিন্ন শান্তি চারদিকে।
এ আমি জানতাম। একটু আগেই যখন বলেছিলাম, তখন বিশ্বাস হয়নি আমার কথায়। এটাই মানুষের চরিত্র। আদি-অনন্তকাল ধরে একই রয়ে গেছে। বাইরের চাকচিক্য আর গালভরা কিছু কথা শিখেছি। বাইরেটা যতই সাজিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে অন্তরের মধ্যে জমেছে জমাট অন্ধকার। তা ছাড়া অনেকদিন শান্তির মধ্যে কেটেছে। বৈষয়িক উন্নতিও হয়েছে প্রচুর। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে জমাট অন্ধকারের লীলা। বোকা লোকেদের সহ্য হল না এই শান্তি। মনে হল এসব কিছু নিরর্থক। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা।
কেউ কোনো কথা বলল না। পুরানো দিনের যুদ্ধের ভয়ংকর স্মৃতিগুলো বুঝি জীবন্ত হয়ে উঠল ওর সামনে সেইসব ভয়ংকর দিন। বিশ্বযুদ্ধ! কতদিনই বা হবে। ষাট বছর আগের স্মৃতিগুলো সব দগদগে ক্ষতের মতো যন্ত্রণাদায়ক। কানফাটানো গোলাগুলির আওয়াজ যেন স্পষ্ট শুনতে পেল পিটার। মনের স্মৃতিপটে ছবির মতো মিছিল করে চলেছে সেইসব ভয়ংকর মুহূর্ত।
রাসেল বা অ্যালেন কেউ দেখেনি সেই যুদ্ধ। সেই ভয়ংকর আত্মঘাতী উন্মাদনা।
অ্যালেন, সত্যি করে বলো তো, এসব সত্যি?
হ্যাঁ বাবা, সব সত্যি। অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। মাথা নীচু করে মৃদু গলায় বলল অ্যালেন। গত সপ্তাহে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বোরডেক্স রকেট ফিল্ডে প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে পাঁচশোর উপর রকেট ধ্বংস হয়ে যায়। এর জন্যে আমাদেরই সম্পূর্ণরূপে দায়ী করে ইউরোপের কর্মকর্তারা। আমরা অবশ্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম ওদের বোঝাতে। কিন্তু পরের দিন পিকিভে প্রায় হাজার প্লেন ধ্বংস হয় একই রকম বিস্ফোরণে। সাইনোরুশ জোটও একযোগে আমাদেরই সম্পূর্ণরূপে দায়ী করে ইউরোপের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, এইসব কার্যকলাপের জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী আমরা।
কিন্তু আমরা নিরুপায়। তারা অপমানজনক পত্র দেয় দূত মারফত। আমরা বলি, এ জঘন্য কাজ আমরা করতে পারি না। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যে পরের দিন অস্ট্রালাসিয়াও একইভাবে অভিযুক্ত করে আমাদের, এক রহস্যময় বিস্ফোরণে কয়েক হাজার প্লেন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সিডনি এয়ারপোর্টে।
শুধু তা-ই নয় বাবা, ইউএনও কাউন্সিলে গিয়েও আমরা আমাদের বক্তব্য রাখতে চেয়েছিলাম। বোঝাতে চেয়েছিলাম যে আমরা নিরপরাধ।
কিন্তু আমাদের এই সৎ প্রস্তাবকে ওরা সবাই একটা চাল বলে ধরে নেয়। আর তারপরই আমাদের ডেনভারে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে পনেরোশো রকেট, প্রচুর বম্বার এবং দশ হাজার লোক মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায়। আর জানো বাবা, মিস্টার ঘোষ—আমার বন্ধু রকেট এক্সপার্ট মি. রণেন ঘোষও ছিল তখন ডেভেনে। ওর গলাটা বেশ ভারী হয়ে এল শেষের কথাগুলো বলার সময়।
হে ভগবান! এসব কী বলছ অ্যালেন! এত কাণ্ড ঘটে গেল অথচ কিছুই জানতে পারলাম না আমরা।
তুমি ঠিকই বলেছ, বাবা। প্রত্যেক দেশ খুব গোপনে রেখেছে ব্যাপারটাকে। একেবারে টপ সিক্রেট।
কিন্তু… কিন্তু… আমরা সবাই তো অনেক সভ্য হয়েছি। কেউ কি একবারও ভেবে দেখল না যে ওদের সিদ্ধান্তের পিছনে কোনো যুক্তি আছে কি না। শুধু পরস্পর পরস্পরকে কেবল দোষই দেব আমরা। ওরা কি একবারও ভাবল না যে এগুলো হয়তো নিছক দুর্ঘটনা—অ্যাক্সিডেন্ট! অথবা যুদ্ধ বাধাবার জন্যেই হয়তো কেউ সুপরিকল্পিতভাবে এই জঘন্য অপরাধ করে চলেছে। তা ছাড়া একসঙ্গে না বসলেও টেলি-রেডিয়ো মারফত তো আলোচনা চলতে পারে। তা-ই না অ্যালেন?
রাসেলের মনে হল বুঝি অ্যালেনকে বোঝাতে পারলেই যুদ্ধের আশঙ্কা দূর হয়ে যাবে। সমস্ত মানবসমাজের হয়ে যেন বক্তব্য রাখল রাসেল।
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল অ্যালেন। কেমন রুক্ষ-কঠোর সে হাসি।
হ্যাঁ হ্যাঁ, বিদেশি বোকারা খুব ভালো করেই জানে যে ওদের ওই সামান্য বিস্ফোরণের জন্য আমরা দায়ী নই। কিন্তু ডেভেনের ভয়ংকর বিস্ফোরণ যারা ঘটিয়েছে, তাদের আমরা ভালো করেই চিনি।
কে—কারা এ কাজ করেছে অ্যালেন? ডোরার প্রশ্নে ভয়ের ছোঁয়াচ।
আশ্চর্য মা! এখনও বুঝতে পারছ না, কারা এ কাজ করতে পারে? ইউনাইটেড ইউরোপ আর সাইনোরুশ জোটই দায়ী এর জন্য।
পাগল! একেবারে আজগুবি। অবিশ্বাসে ফেটে পড়ল রাসেল। কেমন করে বুঝলে তোমরা? কী কী প্রমাণ পেয়েছ বলো তো?
অনেক অনেক প্রমাণ। শান্তস্বরে বলল অ্যালেন। মাত্র একজন রক্ষা পায় ডেভেনের দুর্ঘটনার পর। সে বলেছে, যে বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ আগে সেন্ট্রাল হ্যাঙারের সামনে একজনকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছিল।
তাতে কী হল।
কী হল মানে? সেই লোকটি একজন চিনা। ঘৃণা ফেটে পড়তে চাইল অ্যালেনের কণ্ঠস্বরে। চিন আমাদের চিরশত্রু। চিনেটা অবশ্য টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল বিস্ফোরণে, নয়তো… রাগে ওর হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল।
রাসেল অবাক হল অ্যালেনের কথায়। এই অ্যালেন তো? ওর ছেলে ঠিক তো? ওর ছেলের পক্ষে কি এই যুক্তি মানায়? কোথায় গেল অ্যালেনের সদাহাস্যময় মুখ? কোন মন্ত্রবলে এর পরিবর্তন সম্ভব?
আচ্ছা অ্যালেন, বিশ্বযুদ্ধের পক্ষে কি এই একটা কারণই যথেষ্ট? এই একটামাত্র সামান্য প্রমাণের উপর নির্ভর করে কি আমরা মারাত্মক ভুল করছি না?
বাবা! এর পরেও কি আপনি প্রমাণ চাইবেন? বিদেশি কুকুরদের শিক্ষা দেবার এই তো উপযুক্ত সময়। চোখে-মুখে হিংস্র ভাব ফুটে উঠল অ্যালেনের।
কিন্তু তাহলে অন্য দেশ কেন যুদ্ধ করতে চাইবে? শেষ অবলম্বন আঁকড়ে ধরল রাসেল।
ভুল, ভুল। সম্পুর্ণ ভুল। তোমার ধারণা, গুপ্তচরে গুপ্তচরে ছেয়ে ফেলেছে সব দেশ। ওদের মারফত যা খবর পাচ্ছি, তা মারাত্মক। প্রচণ্ড তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে ওদের প্রতিটি রকেট পোর্টে।
তাহলে অ্যালেন, তোমার মতে সম্পূর্ণ মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করার পক্ষে এই অস্পষ্ট অসংগত যুক্তিটাই যথার্থ এবং ন্যায়সংগত। কোটে কেটে কথাগুলো বলল ডোরা।
অস্পষ্ট! অসংগত! কী বলছ মা তুমি। উত্তেজিতভাবে বলে উঠল অ্যালেন। আমাদের দেশকে আক্রমণ করবে, অসম্মান করবে আর আমরা ভীরুর মতো, কাপুরুষের মতো সহ্য করব। আমরা না এক স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক।
দেশপ্রেম, স্বাধীন দেশের নাগরিক, স্বাধীনতা। আজ থেকে ষাট বছর আগে এই অনুভূতি বৃদ্ধ পিটারের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। প্রতিটি রক্তকণিকা স্বাধীনতা রক্ষার জন্য অন্য দেশের স্বাধীনতায় হাত দিয়েছিল। খ্যাপা কুকুরের মতো এক দেশকে অন্য দেশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবার পক্ষে এই কথাগুলোই যথেষ্ট। কী আশ্চর্য এই শব্দগুলো। যে-কোনো সভ্য মানুষকে আদিম যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ওই শব্দের টোপগুলো। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণ্ডিতে বাঁধা পড়েছে সকলে।
আপন মনে বিড়বিড় করে উঠল বৃদ্ধ পিটার। স্বভাবের কোনো পরিবর্তন নেই। সে পালটায় না। পালটায়নি। শুধু ঢাকা পড়ে থাকে সভ্যতার জামাকাপড়ে। সময় বুঝে সে তার হিংস্র নখ, দাঁত বের করে। হায় রে মানুষ! কী দাম তোমার সভ্যতার। ওই অদ্ভুত শব্দগুলোর জন্যে হাসিমুখে প্রাণ দিতে আর প্রাণ নিতে ছুটে যায় কচি কচি তাজা প্রাণ৷ হে ভগবান! এ কী তোমার লীলা।
অ্যালেন, অ্যালেন, তুমি যেয়ো না। যেতে দেব না আমি। অ্যালেনকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল ডোরা।
মুহূর্তের জন্যে ম্লান হয়ে উঠল ওর মুখ। সে-ও দু-হাতে মা-কে জড়িয়ে ধরল। বলল, মা—আমার মামণি। যেতে তো আমাকে হবেই।
না না, চারপাশের নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ হয়ে গেল ডোরার হাহাকারে।
যাওয়া তোমার হবে না, অ্যালেন। আদেশের সুরে বলে উঠল রাসেল।
আমাকে যে যেতেই হবে, বাবা। আজকেই। ঠিক রাত বারোটায় নিউপোর্টে রিপোর্ট করতে হবে। দেশের অসম্মান যে তোমার-আমার সকলের অসম্মান, বাবা।
রাতের আকাশে অজস্র প্লেনের যাতায়াত। শান্তির নেশায় বুঁদ হয়ে আছে পৃথিবী। হাসি, তামাশা, আনন্দের কোনো বিরাম নেই কোনোখানে। বাক্যহারা ওরা চারজন। কী বলে আর আটকাবে সন্তানকে। স্নেহ, মমতা, আদেশ সব তুচ্ছ ওর কাছে।
এবার আমি যাই, বাবা৷
কাছে এগিয়ে এল পিটার৷ ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, হ্যাঁ, তুমি তো যাবেই। আর কোনোদিনও দেখা হবে না আমাদের। কতকগুলো মানুষের পাগলামিটাই আজ বড়ো হল। আর তার ফলেই তোমরা চলেছ পৃথিবী ধ্বংস করতে। কী লাভ হল, বলতে পারো, সভ্যতার অগ্রগতিতে?
দাদু, তোমার মাথার ঠিক নেই। কী যা-তা বকছ। দেখতে-না দেখতে শেষ হয়ে যাবে যুদ্ধ। আমাদের আক্রমণে শত্রুদের সব শহর ধ্বংস হয়ে যাবে। সমস্ত প্ল্যান হয়ে গেছে আমাদের। তখন বাধ্য হয়ে ওরা শান্তি চাইবে৷
আর বিপক্ষ রকেট আমাদের ছেড়ে দেবে, না?
কিছুই করতে পারবে না ওরা। আমাদের চারপাশে রয়েছে এক দুর্ভেদ্য নেটওয়ার্ক। একশো মাইলের মধ্যে আসতে পারবে না ওরা৷
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল রাসেল। কিন্তু রিস্ট ওয়াচে সময় দেখে চমকে উঠল অ্যালেন।
গুডবাই। রাত ১১টা। আর দেরি করতে পারছি না। আমি চলি।
একরকম দৌড়ে হেলিকপ্টারের কাছে চলে গেল অ্যালেন। ডোরাও পাগলের মতো ছুটে গেল ওর দিকে।
অ্যালেন—অ্যালেন—আমাদের ছেড়ে যাসনে বাবা! ফিরে আয় অ্যালেন।
না-শোনার ভান করল অ্যালেন। হেলিকপ্টারের মধ্যে ঢুকে পড়ে একটা লিভার টেনে ধরল তাড়াতাড়ি৷ মাথার উপরে মোড়া ডানাগুলো খুলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে সোজা উপরে উঠে গেল প্লেনটা! পরক্ষণেই অগণিত নক্ষত্রের মাঝে উধাও হয়ে গেল৷
…বাকি রাতটুকু দু-চোখের পাতা এক হল না কারও। যন্ত্রের মতো যে যার কাজ করে গেল। ওদের সংবিৎ ফিরল ভোরের আলোয়, ঘড়ির কাঁটা ছ-টায়৷
এসব আমি বিশ্বাস করি না, ডোরা। নিশ্চয় অনেক বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলেছে অ্যালেন। জোর করে মনের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করল রাসেল।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠল পল।
মা, মা, এদিকে এসো। কী সব অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস সব ঠেলে নিয়ে আসছে পথ দিয়ে।
জানলার ফিউজ়্ড কোয়ার্টজ় লেন্সের মধ্য দিয়ে নীচের দিকে তাকাল ওরা। লেন্সের জন্যেই এত উঁচু থেকেও রাস্তার প্রতিটি খুঁটিনাটি জিনিস স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সমস্ত রাস্তা, পার্ক সব জায়গায় ব্যস্ততা। ছোটো ছোটো দু-চাকা গাড়ির উপর বসানো লম্বা লম্বা লোহার নল। অনেকটা কামানের নলের মতো। একটা-দুটো নয়, অনেকগুলো। ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসছে লোকেরা। উপর থেকে মনে হচ্ছে বুঝি অজস্র শানিত বর্ষা আকাশপানে মুখ করে রয়েছে। প্রতিটি নলের মাঝে স্তূপীকৃত ছোটোবড়ো নানান আকারের সেল। চিনতে পারল রাসেল সব ক-টাকে, এগুলোকে বলে ডোনাগান সেল। যে-কোনো উচ্চতায় এগুলোকে ওলটানো অবস্থায় বিস্ফোরিত করা যায়। আর বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে এক কিউবিক মাইলের মধ্যে সমস্ত কিছু নিমেষেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এদের মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো গাড়ির উপর আস্তে আস্তে ঘুরছে ডাইরেকশনাল বিম কাস্টার। বিপক্ষ দলের রকেট লক্ষ করে একবার সুইচ টিপলেই মুহূর্তের মধ্যে রকেটের পাওয়ারওয়েভ অকেজো হয়ে পড়ে। আর তার ফলেই মাটিতে মুখ থুবড়ে ভেঙে পড়ে রকেটগুলো। খাকি পোশাক-পরা ভাবলেশহীন মুখে বহু সৈন্য ঘোরাফেরা করছে। এইসব দেখে লোকও জমতে শুরু করেছে। বহু লোক উঁকি মারছে আশপাশে বাড়ির জানলা দিয়ে। সকলের চোখে-মুখে কৌতূহল, ভয় আর অজানা আতঙ্কের শিহরন।
মাথার উপরে আকাশের দিকে তাকাতেও অবাক হয়ে গেল রাসেল। ঘণ্টায় পাঁচশো মাইল বেগে সারা আকাশ পর্যায়ক্রমে চষে বেড়াচ্ছে পাহারাদার প্লেনগুলো। গাদা গাদা ট্রেসার সেল নিয়ে ঘুরছে ওরা। নির্ধারিত সীমানার মধ্যে বিপক্ষ দলের বিমানের সন্ধান পাওয়ামাত্র মুহূর্তের মধ্যে ছুটে যায় ট্রেসার সেলগুলো। এগুলো ফাটার সঙ্গে সঙ্গে অজস্র ছোটো ছোটো পলিথিনের টিউব, জোঁকের মতো ছেঁকে ধরে বিপক্ষ দলের বিমানকে। তারপর সেই টিউব থেকে বেরিয়ে আসবে তৈলাক্ত এক বিষাক্ত গ্যাস, যার হাত থেকে কেউ কোনোদিন বাঁচতে পারে না।
অবিশ্বাসের শেষ রেশটুকুও উঠে গেল রাসেলের মন থেকে। অনেক চিন্তা ভিড় জমাচ্ছে মাথার মধ্যে।
তাহলে অ্যালেনের কথাই সত্যি। অসম্ভব অবাস্তব বলে আর কিছু রইল না ডোরা। একটা চাপা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে এল ওর বুক থেকে।
আমার অ্যালেন, অ্যালেনের কী হবে? অসহায়ভাবে প্রশ্ন করল ডোরা।
আর ভেবে কিছু লাভ নেই, ডোরা। আমাদের যা হবে, সকলের যা হবে, তার থেকে কি বাদ যাবে অ্যালেন? শুধু আমরা কেন, ধ্বংস হয়ে যাবে সমস্ত পৃথিবী। এই তো তোমাদের উন্নতির সভ্যতার আশীর্বাদ৷ এবার আর কেউ বৃদ্ধ পিটারের কথায় প্রতিবাদ করল না।
না না, ডোরা, নিরাশ হবার কিছুই নেই। অ্যালেন তো বলে গেল যে বিপক্ষ দল কিছুই করতে পারবে না আমাদের। আর ওদের ব্যবস্থা দেখেও তো তা-ই মনে হচ্ছে। ডোরাকে না নিজেকে ঠিক কাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল রাসেল, তা ঠিক বোঝা গেল না।
…টেলি-রেডিয়ো নবটা ঘুরিয়ে দিল রাসেল। রেডিয়োতে হয়তো সত্যি খবর পাওয়া যেতে পারে। এগুলো হয়তো নিছক মহড়াও হতে পারে। আবার হয়তো শেষ মুহূর্তে রাষ্ট্রগুলো নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। শেষ পর্যন্ত হয়তো ঠেকানো যাবে যুদ্ধের ভয়ংকর বীভৎসতাকে।
একটু টিউন করতেই সংবাদ ঘোষকের ত্রিমাত্রিক ছবি দেখা গেল। ঘোষকের মাথায় মিলিটারি হেলমেট। গলার স্বর থেকে বেশ উত্তেজনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে ওরা। এইমাত্র ডাইরেকশনাল ভাইব্রেটার মারফত বিপক্ষের একঝাঁক রকেটের সন্ধান পাওয়া গেছে। চল্লিশ হাজার রকেট স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের মধ্য দিয়ে ঘণ্টায় বারোশো মাইল বেগে ছুটে আসছে সাইনো রুশ পোর্টগুলো থেকে। মাত্র দু-ঘণ্টার মধ্যেই ওরা এসে পড়বে আমাদের প্রতিরক্ষা বেষ্টনীর মধ্যে। ত্রিশ হাজার ইউরোপিয়ান প্লেন এইমাত্র যাত্রা শুরু করল। অস্ট্রালাসিয়া থেকে দশ হাজার প্লেন ছুটে আসছে দক্ষিণ আমেরিকার দিকে। পৃথিবীর সমস্ত শক্তি আমাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভয় পাবার কিছু নেই।
কমান্ডিং জেনারেল সিরিয়াস একটি বিবৃতি পাঠিয়েছেন আমাদের জন্য। আমি পড়ছি।
আমেরিকার মহান জনগণের প্রতি। আমাদের মাতৃভূমিকে ধ্বংস করার জন্য ওরা বদ্ধপরিকর। আমাদের দেশ আজ আক্রান্ত। আমাদের দুর্লভ স্বাধীনতায় ওরা হস্তক্ষেপ করেছে। বন্ধুত্বের মুখোশের আড়ালে ওরা বরাবরই বিরুদ্ধাচরণ করে আসছিল। আর তাই কোনোরকম যুদ্ধ ঘোষণা না করেই আমাদের মাতৃভূমি আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে ওদের রকেট। চুক্তি, পৃথিবীর শান্তি সব কিছুই আজ মূল্যহীন ওদের কাছে। বাজে কাগজের জঞ্জালমাত্র।
ওদের হীন চক্রান্ত বুঝতে দেরি হয়নি আমাদের। ওরা ভেবেছিল, সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় আক্রমণ করবে আমাদের। কিন্তু ওদের আশা দুরাশামাত্র। আমাদের অজেয় রকেট ফোর্স আর বীর সেনানীরা ঘড়ির কাঁটা ধরে মাতৃভূমি পাহারায় রত। ওদের আক্রমণের আশঙ্কায় প্রতিমুহূর্তে নিজেদের প্রস্তুত রেখেছি আমরা। আপনারা শুনে নিশ্চয় সুখী হবেন যে নিজেদের প্রস্তুত রেখেই ক্ষান্ত হইনি আমরা। আমেরিকার মহান জনগণ ও তার সরকার একটা নীতিতেই বিশ্বাসী। আর সেই নীতি হল ঝটিকাবেগে সর্বপ্রথম আক্রমণই আত্মরক্ষার মূলকথা। তাই প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলেছে আমাদের রকেটবাহিনী। বিরুদ্ধ পক্ষের প্রতিটি শহরই আমাদের লক্ষ্যবস্তু। আর সরকারের স্থির বিশ্বাস, কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে শহরগুলো।
আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটি দেশপ্রেমিক আমেরিকাবাসীর পূর্ণ সমর্থন আছে এই ঐতিহাসিক অভিযানের পিছনে। দেশপ্রেমিক আমরা দেশবাসীরা মাতৃভূমি রক্ষায় আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাদের এই ঘৃণ্য আক্রমণের যোগ্য প্রত্যুত্তরই দেব আমরা। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
কমান্ডিং জেনারেল মিরিয়াম। সর্বাধিনায়ক আমেরিকার সশস্ত্র বাহিনী।
না, সবাই পাগল হয়ে গেছে। আমরা নাকি যুদ্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ৷ শুনলেও হাসি পায়৷ আমাদের মতামতের কোনো দাম দেয় না সরকার। অথচ ডোরা, ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সব কিছুই হয় মহান জনগণের ইচ্ছানুসারেই। মহান জনগণ! সব মিথ্যে! সব ধোঁকাবাজি! জনগণের নামে কী নির্লজ্জ মিথ্যে কথা। আখেপের সুরে বলে উঠল রাসেল।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ডোরা। থেকে থেকে ফুলে ফুলে উঠছে দেহটা৷
অ্যালেন—অ্যালেনের কী হবে, রাসেল?
কী আর হবে। মহান জনগণের মহান দায়িত্ব পালন করেছে অ্যালেন। এতক্ষণে হয়তো সে হাজার হাজার প্লেনের সঙ্গে ছুটে চলেছে বিরুদ্ধ পক্ষের নিরপরাধ অসহায় জনগণের উপর বোমা আর বিষাক্ত গ্যাসের বন্যা নামিয়ে দিতে। ওরা আজ খেপে উঠেছে সমস্ত সভ্যতা ধ্বংস করার জন্য। দেশপ্রেম, মাতৃভূমির স্বাধীনতা, মহান জনগণের ইচ্ছা ইত্যাদির কথার নেশায় ওরা আজ অন্ধ। জানি না, কবে এইসব কথার সত্যিকারের অর্থ বুঝতে পারবে ওরা। কবে বুঝবে সমস্ত পৃথিবীই ওদের মাতৃভূমি, পৃথিবীর প্রতিটি লোক ওদের স্বদেশবাসী।
রাখো তোমার বক্তৃতা। এখন বলো, কী করব আমরা। শুনলে তো, মাত্র দু-ঘণ্টার মধ্যেই আক্রমণ শুরু হবে। একটু বিরক্ত হয়ে বলে উঠল ডোরা।
ডোরা, কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। সব কিছু যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। ওদের আক্রমণের খবরের সঙ্গে সঙ্গে ওরা যে কিছুই করতে পারবে না তাও বলেছে। তাই তো ভাবছি, কোন কথাটা ওদের বিশ্বাস করব।
সকলে চুপচাপ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলছে ওরা। কে বলবে, কোন পথে গেলে মঙ্গল হবে।
এক কাজ করো ডোরা। দরকারি জিনিসপত্র সব তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও। শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়াই বোধহয় ভালো।
পল—পল কোথায়৷ এই যে, তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে নাও। একসঙ্গে সবাইকে তাড়া দিল রাসেল।
না না বাবা, কোথাও যাব না আমি। একরাশ লালচে চুলে ভরতি মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করে উঠল পল। কী সুন্দর প্লেন দ্যাখো তো! নীচে কত সুন্দর সুন্দর যন্ত্র।
না পল, এখানে থাকা আর উচিত নয়। তৈরি হয়ে নাও তাড়াতাড়ি। নয়তো দুষ্ট লোকেরা মেরে ফেলবে আমাদের।
মেরে ফেলবে? কাউকে ভয় পাই না আমি। ছোট্ট বুক ফুলিয়ে বাবার সামনে দাঁড়াল পল।
এত ভাবনার মধ্যেও পলের বুক ফুলিয়ে দাঁড়ানো দেখে হাসি পেল রাসেলের। হায় রে অবোধ শিশু।
ক্ষণেক্ষণে পালটাচ্ছে রাস্তার চেহারা। চারদিকে ভীতসন্ত্রস্ত জনতার ব্যস্ততা। সকলের চোখে-মুখে ধ্বংসের করাল ছায়া। কোথায় যাবে? কোনদিকে? কে বলবে কাকে?
গগনচুম্বী বাড়ির ছাদ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে হেলিকপ্টার উঠছে আকাশে। সবাই পালাতে চায় শহর ছেড়ে। তাড়াতাড়ি করার ফলে অনেক হেলিকপ্টারই দৈত্যাকার বম্বার আর পাহারাদার প্লেনের পথের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, আর সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা লেগে আহত পাখির মত ঘুরতে ঘুরতে মাটির উপর মুখ থুবড়ে পড়ছে হেলিকপ্টারগুলো। শুধু এরাই নয়, একটা বম্বারও ধাক্কা লাগার ফলে প্রচণ্ড আওয়াজ করে মহাকাশেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
তাড়াতাড়ি হেলিকপ্টারের মধ্যে ঢুকে পড়ল রাসেল পরিবার। শেষবারের মতো সব কিছু দেখে নিল রাসেল।
হঠাৎ টেলি-রেডিয়ো যেন জীবন্ত হয়ে উঠল ঘরের মধ্যে। তাড়াতাড়িতে বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল ডোরা।
সকলকে সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে। থমকে দাঁড়াল রাসেল। আপনাদের ভীরুর মতো আচরণ প্রচণ্ড বাধা দিচ্ছে আমাদের শহর রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কাজে। এত বেশি হেলিকপ্টার আকাশে উড়ছে যে আমাদের বিমানবহরের ওড়ার মতো জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই প্রতিটি হেলিকপ্টারকে স্ব স্ব স্থানে নেমে আসার আদেশ দেওয়া হচ্ছে। কেউ যেন আর ওড়ার চেষ্টা না করেন৷ যে যার নিজেদের বাড়িতে শান্তভাবে থাকুন। এই আদেশ অমান্য করলে প্রতিটি ব্যক্তিগত প্লেনকে গুলি করে নামানোর আদেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়তে চাইল রাসেল। ঘোষকের ছবিটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলার ইচ্ছে হল, কিন্তু নিরুপায় হয়ে সকলে আবার নেমে এল ছাদের উপর। অনেকেই এই আদেশে ভয়ে পাগল হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি প্লেন নিয়ে পালাতে চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গে উড়ন্ত বম্বার থেকে গুলিবৃষ্টি হল ঝাঁকে ঝাঁকে। মুহূর্তের মধ্যে বিকট আওয়াজ করে খণ্ড খণ্ড হয়ে যেতে লাগল প্লেনগুলো। ভীতিবিহ্বল হাজার হাজার জনতার সামনে এই বীভৎস আত্মঘাতী দুর্ঘটনা ঘটে চলল একের পর এক।
এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল পল। মা-কে জড়িয়ে ধরে তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
ত্রিমাত্রিক পর্দায় আবার ভেসে উঠল ঘোষকের মূর্তি। চোখে-মুখে ওর দারুণ উত্তেজনা।
এইমাত্র পাঁচশো মাইল দূরে তাড়িয়ে দিয়েছি বিরুদ্ধ পক্ষের রকেটগুলোকে। হাজারে হাজারে রকেট ছুটে আসছে আমাদের প্রতিটি শহর লক্ষ করে। দু-হাজার রকেট ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে নিউ ইয়র্ক অভিমুখে। হিসেবমতো মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে আঘাত হানবে ওরা। আকাশের বুকেই ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করব আমরা। জয় আমাদের হবেই। সে বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ।
নিঃসন্দেহ। জয়! আরও কত কী। জয় এত সোজা। ব্যঙ্গ করে বলে উঠল বৃদ্ধ পিটার৷
পাঁচশো পাহারাদার প্লেন সোজা দশ মাইল উঠে গেল আকাশের বুকে। তারপর সেখানেই মহাকাশের বুকে পঙ্গপালের মতো ইতস্তত ভেসে বেড়াতে লাগল। দৈত্যকার বম্বারগুলো পাঁচ মাইল উপরে স্ব স্ব স্থানে চক্রাকারে উড়ছে।
হঠাৎ ঘোষকের উত্তেজিত স্বর ভেসে এল।
আপনারা শুনুন। দারুণ খবর শোনাচ্ছি আপনাদের। আমাদের রকেটগুলো ইউরোপে দারুণ আঘাত হেনেছে। লন্ডন এখন এক ধ্বংসস্তূপ মাত্র। দাউদাউ করে জ্বলছে প্যারিস। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে বার্লিন। আর রোমের কোনো অস্তিত্বই নেই এখন। আনন্দে দু-হাত তুলে এক পাক নেচে ফেলল ঘোষক।
হার রে সভ্য মানুষের দল! কী অন্যায় করেছিল লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ আবালবৃদ্ধবনিতা। আপন মনেই বিড়বিড় করে বলে চলল পিটার।
হঠাৎ যেন খেপে উঠল রাসেল। বাবার কাছে গিয়ে চিৎকার করে উঠল। বলিনি—বলিনি তোমাকে যে আমরাই জিতব। শুনলে তো জিতেছি আমরা। জয় হয়েছে আমেরিকার।
দপ করে জ্বলে উঠল পিটারের চোখ দুটো। ওঃ জিতেছ তোমরা! তা-ই না? শুনে রাখো রাসেল, জিতলেও হারতে হবে সকলকে। দ্যাখো দ্যাখো, চেয়ে দ্যাখো।
সূর্যের আলোয় চকচকে পেনসিলের মতো ছোটো ছোটো আলোর তির অর্ধগোলাকৃতি আকারে নেমে আসছে নিউ ইয়র্কের উপর। একটা দুটো তিনটে… শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে।
…রকেট!!
ক্রমেই ওগুলো বড়ো হয়ে উঠছে। ওদের দিকে তাকালেও বুক শুকিয়ে যায়। মহাকাশের বুক চিরে প্রচণ্ড বেগে নেমে আসছে ধ্বংসের দেবতা, হতভাগ্য শহরের উপরে।
পাহারাদার প্লেনগুলো একইভাবে উড়ে চলেছে। সুযোগ খুঁজছে ওরা।
ভীমবেগে ডানা মেলে ছুটে আসছে হাজার ফুট দৈর্ঘ্যের রকেটগুলো।
চক্ষের নিমেষে পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রতিরক্ষাবাহিনী ওদের উপর। বিকট আওয়াজ আর ধোঁয়ায় ভরে উঠল সমস্ত আকাশ। হাজারে হাজারে ছোটো ছোটো টুকরো আগুনের গোলা হয়ে ছিটকে পড়ল মহাকাশের বুকে। সমস্ত আকাশ জুড়ে মৃত্যুর তাণ্ডব। বিরুদ্ধ পক্ষের রকেটগুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে সমস্ত আকাশ ছেয়ে ফেলল।
তা সত্ত্বেও প্রচণ্ড বেগে আরও নীচে নেমে এল বেশির ভাগ রকেট। সঙ্গে সঙ্গে অতিকায় বম্বারের কাজ শুরু হয়ে গেল। প্রত্যেক বম্বার থেকে জ্বলন্ত আগুনের গোলা বেরিয়ে আসতে শুরু করল। দেখতে দেখতে বিরাট এক জ্বলন্ত নরককুণ্ডে পরিণত হল সমস্ত আকাশ। ওর মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল রকেটগুলো।
গলিত ধাতুর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ওদের রকেট আর বম্বারগুলো মরণপণ সংগ্রামে ব্যস্ত। মাটি থেকে লোহার নল থেকে ঘনঘন অগ্নিবর্ষণ শুরু করল। টন টন মারাত্মক ডোনাগান সেল মহাশূন্যে উৎক্ষেপিত হতে লাগল। এক ঘণ্টা বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যেতে শুরু করল। এ দল-ও দল কাউকেই রেহাই দিল না।
সমস্ত আকাশ জুড়ে জ্বলন্ত আগুনের ছোটাছুটি। ক্ষণেক্ষণে প্রচণ্ড আওয়াজে কান তালা লাগে। ছাদের উপর রাসেল পরিবার ভয়ে, আতঙ্কে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে, এই ভয়ংকর মরণ সংগ্রাম দেখতে লাগল৷
এখন আর হাজার হাজার নয়, কয়েকশো মাত্র বিরুদ্ধ পক্ষের রকেট ধীরে ধীরে নেমে আসছে নিউ ইয়র্কের উপর। ওরা যেন স্থিরপ্রতিজ্ঞ, ওরা নামবেই। মৃত্যুদূত মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে অবিচল গতিতে নামছে—নামছে। রেডাইট টিউব গর্জাচ্ছে অনবরত। রকেটগুলোর উপর ইগলের মতো ছোঁ মেরে মাঝে মাঝে নেমে আসছে পাহারাদার প্লেনগুলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা একটা রকেট সশব্দে ভেঙে চূর্ণ হয়ে গেল, কিন্তু কতগুলোকে নষ্ট করবে? সংখ্যায় যে ওরা অনেক।
রাসেলের কাছে সব কিছু পরিষ্কার এখন। তাড়াতাড়ি পলকে কোলে তুলে ডোরার হাত ধরে চিৎকার করে উঠল, নীচে চলো! নীচে চলো তাড়াতাড়ি৷
হ্যাঁচকা টান মেরে রাসেলকে আটকাল পিটার।
তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। এক্ষুনি বোমা ফেলবে ওরা৷ আর বোমার মধ্যে থাকবে বোধহয় বিষাক্ত গ্যাস। সুতরাং…
শ্বশুরের কথায় সায় দিল ডোরা। কথা বলার সব শক্তি যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। আর কারও কথা শোনাও সম্ভব নয়। ক্ষণেক্ষণে বিস্ফোরণের আওয়াজে থরথর করে কাঁপছে সমস্ত বাড়িঘর। কানের পর্দা বোধহয় ফেটে যাবে। ভূমিকম্পের মতো কেঁপে কেঁপে উঠছে, সমস্ত নিউ ইয়র্ক। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল রাসেল। কে বিচার করবে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ।
এবার একের পর এক ডিমের মতো বোমা নেমে আসতে শুরু করল রকেটগুলোর পেটের মধ্যে থেকে। প্রচণ্ড গতিতে বোমাগুলো আঘাত হানতে শুরু করল লক্ষ্যবস্তুর উপর। আকাশ-ছোঁয়া বাড়িগুলো এক-এক বোমার আঘাতে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে আরম্ভ করল। চক্ষের নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে গেল বিখ্যাত এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং আর মিউজ়িয়াম অব অ্যান্টিকুইটি।
দেখতে দেখতে দেখতে শহরের অর্ধেকের উপর বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। তবুও কিন্তু যন্ত্রের মতো কাজ করে চলেছে সৈন্যরা। পার্ক, রাস্তাঘাট জুড়ে কেবল শত শত, হাজারে হাজারে দোমড়ানো-মোচড়ানো খণ্ডবিখণ্ড মৃতদেহের স্তূপ। টন টন রাবিশের মধ্যে চাপা পড়ে গেছে আরও কত মৃতদেহ, কে জানে৷
হঠাৎ রকেটগুলো নীচে আর না নেমে স্থির হয়ে দাঁড়াল কয়েক মুহূর্ত। আর অজস্র কালো কালো ডিম বেরিয়ে এল ওগুলোর পেটের মধ্যে থেকে। কালো ডিমগুলো ধীরে ধীরে নামছে নীচে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আশঙ্কায় দু-হাতে কান ঢাকল রাসেল।
আশ্চর্য! কোনো বিস্ফোরণই ঘটল না।
না না, ফাটল না—ফাটল না—বলে আনন্দে রাসেল চিৎকার করে উঠল৷
আরও আশ্চর্যের বিষয়, রকেটগুলো এবার সোজা উঠে মেঘের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
ভয়ংকর কোনো কিছুর আশঙ্কায় শিউরে উঠল বৃদ্ধ পিটার৷ কোনো কিছুর বলার চেষ্টা করেও বলতে পারল না। ঠোঁট দুটো শুধু একটু নড়ে উঠল।
রকেটগুলো অদৃশ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল রাসেল। মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল ওর সমস্ত ভয়-ভাবনা।
আমরা জিতেছি—জিতেছি। বেঁচে গেলাম আমরা। ওই তো—ওই তো পালিয়ে যাচ্ছে ওরা। ধেইধেই করে নেচে উঠল রাসেল। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার আনন্দে মানুষ বুঝি সত্যি এমন করে পাগল হয়ে ওঠে। মৃত্যুদূতগুলো পালিয়ে গেছে। সেটাই তো যথেষ্ট।
কী বোকা! কী বোকা! এখনও তুমি বুঝতে পারছ না, রাসেল? এদিকে এসে দ্যাখো একবার। তারপর ছেলের হাতটা শক্ত করে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল জানলার সামনে। হঠাৎ এক অদ্ভুত ব্যপারে চমকে উঠল রাসেল। প্রত্যেকের কথাই এখন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কাউকেই আর জোরে চিৎকার করতে হচ্ছে না। কিন্তু হঠাৎ সব থেমে গেল কেন?
এই নিস্তব্ধতা যেন বড়ো বেশি অস্বস্তিকর। মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের প্রচণ্ড আওয়াজ যেন কোন মন্ত্রবলে স্তব্ধ হয়ে গেছে। মৃত্যুর নিস্তব্ধতার চারপাশে পলের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ এখন সুস্পষ্ট। বেশিক্ষণ ভাবার সময় পেল না ও।
—দ্যাখো, দ্যাখো রাসেল—নীচের দিকে দ্যাখো।
রাসেল দেখল৷ সঙ্গে সঙ্গে কেউ যেন সজোরে চেপে ধরল হৃৎপিণ্ডটাকে। মাথাটা ঘুরে উঠল। কেমন যেন বমি-বমি ভাব। অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে বাবার কথা।
নীচে যতদূর দেখা যাচ্ছে এক গাঢ় সবুজ কুয়াশা। অল্প অল্প করে কাঁপছে। সবুজ কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেছে সব কিছু। চতুর্দিকে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। দ্বীপের মতো কয়েকটি গাছের মাথা জেগে আছে কুয়াশার মাঝে।
ফ্যালফ্যাল করে বাবার দিকে তাকাল একবার।
বিষাক্ত গ্যাস!
হ্যাঁ রাসেল! বিষাক্ত গ্যাস!
নীচের দিকে আবার তাকাতেই চমকে উঠল। বীভৎস! ভয়ংকর! অবিশ্বাস্য! কোথায় গেল গাছের মাথাগুলো। কুয়াশার সমুদ্র গ্রাস করেছে ওদের। ক্রমেই আয়তনে বেড়ে বেড়ে উপরে উঠে আসছে গাঢ় তেলের মতো সবুজ কুয়াশা৷
ডোরাও ঝুঁকে পড়ল জানলার লেন্সের উপর। পরক্ষণেই আর্তনাদ করে উঠল, কী… কী ওটা?
কী বলবে ডোরাকে? বুঝিয়ে বলার কি কোনো দরকার আছে আর?
গ্যাসটা ক্রমেই উপরে উঠে আসছে।
তার মানে…
মানে? এখনও কি মানে বুঝতে দেরি হচ্ছে, ডোরা? বাঁচার মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে আমাদের। জীবনকে তো ভোগ করেছি আমরা তাই দুঃখ হয় না মরতে, কিন্তু এরা… বলে পলের দিকে তাকাল রাসেল। ছোটো পলের দু-চোখ ভরে জল টলটল করছে। অজানা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ওর মুখ।
দু-হাতে পলকে সজোরে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল ডোরা।
ঠিকই বলেছ তুমি। কিন্তু… এরা… এদের তো জীবনের শুরু… আর বলতে পারল না ডোরা। টসটস করে জল গড়িয়ে পড়ল ওর দু-চোখ দিয়ে।
এখানকার বাতাসও ভারী হয়ে উঠছে। কেমন যেন কটু গন্ধ চারপাশে। আরও উপরে উঠে আসছে সবুজ কুয়াশা। কাশতে শুরু করল বৃদ্ধ পিটার। দু-হাতে মা-কে জড়িয়ে ধরেছে পল।
মা, মা… নাক, মুখ জ্বালা করছে, মা। বড্ড কষ্ট… মরে যাচ্ছি, মা… বাঁচাও…
সামান্য একফোঁটা বিশুদ্ধ বাতাসের জন্যে বালক কণ্ঠের হাহাকার আকাশ-বাতাস মথিত করে তুলল। কিন্তু কে শুনছে—কী আসে যায় ওই সামান্য হাহাকারে। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে সবুজ কুয়াশা ক্রমেই উপরে উঠে আসছে। তাকে জিততেই হবে।
না, আর সহ্য করা যাচ্ছে না ছোট্ট পলের বাঁচার আকুতি। ডোরা আর পলকে নিয়ে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরল রাসেল। দু-হাতে বুক চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে পিটার।
…আরও… আরও… উপরে উঠে আসছে তৈলাক্ত কুয়াশা।
হঠাৎ পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল পিটার। মিথ্যা! মিথ্যা! সমাজ, সভ্যতা, উন্নতি সব ধাপ্পা। সভ্যতা তো একটা মেকি আওয়াজ। হে ভগবান, মানুষ নামে তুমি পশু তৈরি করলে কেন? সেই পশু আজ জেগেছে। এতদিনেও তাকে মারতে পারেনি হাজার হাজার বছরের শিক্ষা, সভ্যতা! হাঃ হাঃ হাঃ।
মৃত্যুর মুহূর্ত গুনছে পিটার, রাসেল, ডোরা আর পল। ভূত, ভবিষ্যৎ আর বর্তমান।
বিষাক্ত গ্যাসে তলিয়ে যাচ্ছে সমাজ, সভ্যতা, সংস্কার, হাজার হাজার বছরের বিবর্তনে সভ্য মানবসমাজ…
প্রথম প্রকাশ: বিস্ময় সায়েন্স ফিকশন! মার্চ-এপ্রিল ১৯৭৩
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, রণেন ঘোষ