কল্পবিজ্ঞানের সন্ধানে প্রাচ্যে:: এক বাঙালির ওয়ার্ল্ডকনের ডায়েরি
লেখক: দীপ ঘোষ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
প্রথম পর্ব
প্রাককথন:
ওয়ার্ল্ডকন ২০২৩, আড়ম্বরে এবং বিতর্কে যেকোনো আগের সম্মেলনকে এই বছর গুনে গুনে এক ডজন গোল দিতে পারে। কিন্তু কল্পবিশ্ব আর বাঙালি পাঠকের কাছে এই ওয়ার্ল্ডকনের গুরুত্ব অনেক এবং ভিন্ন কারণে। এই বছরেই প্রথমবার ভারত থেকে কয়েকজন আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন চিনের চেংডু শহরে ওয়ার্ল্ডকনে যোগদান করার জন্যে। কল্পবিশ্বের সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে আমিও ছিলাম তাদের মধ্যে। এবং ভারতের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আমি যোগ দিই চেংডু ওয়ার্ল্ডকনে।
কয়েকদিন আগে কল্পবিজ্ঞান লেখক সিদ্ধার্থ ঘোষের রচনা সংগ্রহের তৃতীয় খণ্ডের ভূমিকা লেখার সময় মনে পড়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক অভিজিতদার কথা। সিদ্ধার্থবাবুর নিকট পরিচিত অভিজিতদা জানিয়েছিলেন সিদ্ধার্থ নব্বইয়ের দশকে এক কল্পবিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দিতে বিদেশে যান। সেখানে তাঁর আলাপ হয় বিশ্ববিখ্যাত ফ্যান্টাসি লেখক টেরি প্র্যাচেটের সঙ্গে। ভূমিকা লেখার প্রয়োজনে খুঁজতে শুরু করি এই বিদেশ যাত্রার ইতিহাস। বিভিন্ন বিদেশি কল্পবিজ্ঞানের গ্রুপ থেকে জানা যায় যে সিদ্ধার্থ সুইডেনের স্টকহোম শহরে ফ্যান্টাসটিকা ৯২ নামের ইউরোপিয়ান সম্মেলনের অতিথি ছিলেন। সেই সময় নাকি তাঁর সঙ্গে প্র্যাচেটের ডিস্কওয়ার্ল্ড ও হিন্দু পুরাণ নিয়ে অনেক আলোচনাও হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই আলোচনা অথবা সিদ্ধার্থের বক্তৃতার বিষয়—কিছুই সংরক্ষণ করে রাখা হয়নি। সিদ্ধার্থ ঘোষের পরে বাংলার লেখক-সম্পাদকদের বিদেশে সায়েন্স ফিকশন বা ফ্যান্টাসি নিয়ে আলোচনার সুযোগ তেমন হয়েছে বলে জানা নেই। অদ্রীশ বর্ধন সুযোগ পেয়েছিলেন কলকাতায় আর্থার সি ক্লার্কের সঙ্গে দেখা করার। সত্যজিৎ রায় একবার ষাটের দশকে বিদেশে ফ্যান্টাসায়েন্স নামক একটি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন তা আশ্চর্যের পাতা থেকে জানা যায়। এছাড়া অনীশ দেব দক্ষিণ ভারতের একটি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু এঁদের এই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে প্রায় কোনো তথ্যই নেই, উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে সব হারিয়ে গেছে। সেই জন্যে মনে হল, আজকের জন্যে না হলেও ভবিষ্যতের কল্পবিজ্ঞানের পাঠক ও গবেষকদের জন্যে সমস্ত অভিজ্ঞতা লিখে রাখা প্রয়োজন।
বাংলা কল্পবিজ্ঞান এবং বিদেশি সায়েন্স ফিকশন নিয়ে আগ্রহ বহুদিন থাকলেও কোনোদিন কল্পবিজ্ঞানের সম্মেলন বা পুরস্কার নিয়ে মাথা ঘামাইনি। কল্পবিশ্ব ২০১৫ সালে শুরু করার পরে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়ার পরিধি অনেকটাই বাড়াতে হয়। আর সেই সূত্রেই নেট আর বই ঘেঁটে কিছু প্রবন্ধ লিখি কল্পবিশ্বের পাতায় হুগো পুরস্কার নিয়ে। তখনও মনে হয়নি যে বিশ্বের সবথেকে বড়ো ও নামি সায়েন্স ফিকশন সম্মেলনে ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবো।
উদ্যোগ পর্ব:
ভারতীয় সায়েন্স ফিকশনের সেরকম কোনো পাঠক-লেখকদের সংগঠন এখনও পর্যন্ত নেই। যা আছে তা হল সায়েন্স ফিকশন গবেষক ও কিছু শখের লেখকদের দুটি সংগঠন। ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোশিয়েশন ফর সায়েন্স ফিকশন স্টাডিজ’ ও ‘ইন্ডিয়ান সায়েন্স ফিকশন রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন’। দুটি সংগঠনই প্রায় তিরিশ বছরের পুরোনো এবং প্রতি বছরই এরা সায়েন্স ফিকশনের উপর অ্যাকাডেমিক কনফারেন্সের আয়োজন করে থাকে। যদিও এই সংগঠনগুলি অ্যাকাডেমিক দুনিয়ার বাইরে ভারতে সায়েন্স ফিকশনকে জনপ্রিয় করার জন্যে বেশি কিছু করে উঠতে পারেনি। যাই হোক, এমনই একটি গ্রুপ থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল মাস নাগাদ জানতে পারি যে চেংডু ওয়ার্ল্ডকনের জন্যে ভারত থেকে কিছু প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। আমাকে বলা হয় ওয়ার্ল্ডকন কতৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যে। এর মধ্যে ওয়ার্ল্ডকনের স্ট্রাকচারটি নিয়ে কিছু বলা দরকার।
ওয়ার্ল্ডকন শুরু হয়েছিল ওয়ার্ল্ড সায়েন্স ফিকশন সোসাইটির তত্ত্বাবধানে আমেরিকায়। কিন্তু এখন প্রতিটি ওয়ার্ল্ডকনের আলাদা কমিটি তৈরি হয়। এবং সেই কমিটি সেই বছরের অনুষ্ঠানটির জন্যেই দায়িত্ব পায়। বহু বছর ধরেই ওয়ার্ল্ডকন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই হয়ে আসছে। তবে এশিয়াতে এর আগে একমাত্র জাপানই ২০০৭ সালে ওয়ার্ল্ডকনের আয়োজন করার সুযোগ পায়। প্রতি বছরের সম্মেলনে আগামী দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছর কোন দেশে অনুষ্ঠান হবে তার জন্যে সেই দেশের সংগঠনগুলি আবেদন করে। সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে ঠিক হয় কারা সেই বছর অনুষ্ঠানটি করার সুযোগ পাবেন। যারা এই সময়ের বিদেশি সায়েন্স ফিকশন পড়ে থাকেন তারা জানেন গত এক দশকে রকেটের গতিতে চিনা সায়েন্স ফিকশনের উন্নতি ঘটেছে। এমনকী বলা যায় এই মুহূর্তে সায়েন্স ফিকশন হল চিনের সবথেকে বড় সাংস্কৃতিক রপ্তানিকৃত পণ্য। সুতরাং সেখানে ওয়ার্ল্ডকন অনুষ্ঠান হওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল। ‘সায়েন্স ফিকশন ওয়ার্ল্ড’ চিনা ভাষায় সবথেকে বড়ো সায়েন্স ফিকশন পত্রিকা। তারা নিয়মিত চারটি মাসিক সায়েন্স ফিকশন পত্রিকা প্রকাশ করে। তাদের হাত ধরে সিশিন লিউয়ের উত্থান। এছাড়াও চিনের প্রধান সায়েন্স ফিকশন পুরস্কার গ্যালাক্সি দেওয়া হয় প্রতি বছর অনুষ্ঠান করেই। সায়েন্স ফিকশন ওয়ার্ল্ড পত্রিকা ও ওয়ার্ল্ডকন কমিটিতে আমি নিজের পরিচয় দিয়ে চিঠি পাঠাই সেই সময়।
এরপর প্রায় মাস তিনেক কেটে গেছে। কোনো খবরই পাইনি এর মধ্যে। কল্পবিশ্বের সম্পাদক সদস্যদের ও কয়েকজন বাঙালি লেখককেও জানিয়েছিলাম তারা যদি আগ্রহী হয় যাওয়ার জন্যে। কিন্তু কাজের চাপে কেউই এক সপ্তাহের জন্যে বাইরের দেশে যাওয়ার জন্যে আগ্রহ দেখায়নি। যাই হোক, জুন মাসের শেষের দিকে একদিন হঠাৎ রিপ্লাই এল চিঠির। চিনা ওয়ার্ল্ডকন কমিটি সাগ্রহে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে আমায় সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্যে। সময়মতো তাঁরা সব কাগজপত্র পাঠাবে ও সম্পূর্ণ খরচ বহন করবে। আমার দিক থেকে যা কাগজ পাঠানোর সবই পাঠিয়ে রাখলাম। এর মধ্যে উক্ত দুটি ভারতীয় শাখার সভাপতি শ্রীনরহরি ও অরভিন্দ মিশ্র জানান যে বয়সের কারণে তাদের পক্ষে চিন যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তারা যেহেতু আগেও চিনে গেছেন একটি লোকাল কনফারেন্সে, তাই সম্পূর্ণ পদ্ধতিটি সম্পর্কে আমায় সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। সবথেকে বড়ো সমস্যা যেটা জানতে পারি সেটা হল চিনের ভিসা পাওয়া। যাই হোক আমি কলকাতার একটি সংস্থার সঙ্গে ভিসার জন্যে যোগাযোগ করি। এরপরে নানা কাজে অগাস্ট মাস চলে আসে দেখতে দেখতে। একদিন চিন থেকে ভিসার জন্যে প্রয়োজনীয় সব কাগজ মেইল করে দেওয়া হয় আমায়। অ্যাপ্লিকেশন করার সময় অনেকেই জানান যে অন্তত তিন মাসের আগে ভিসার ইন্টারভিউয়ের তারিখ পাওয়া সম্ভব নয়। শ্রীনরহরি এটাও জানান যে তার ভিসা করতে প্রচুর খরচ হয়েছিল। এসবের মধ্যেই অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন সাবমিট করে মাত্র এক মাসের মধ্যেই ভিসা ইন্টারভিউয়ের তারিখ পাই কলকাতার কনসুলেটে। খরচও পড়ে সামান্যই। সেপ্টেম্বরের মাঝের দিকে ইন্টারভিউয়ের তারিখ। এর মধ্যেই মেইল আসে ওয়ার্ল্ডকন ট্রাভেল ডিপার্টমেন্টের থেকে। আমার যাওয়ার টিকিট অক্টোবরের মাঝে। কিন্তু যাত্রার তারিখে আমার পাসপোর্টের এক্সপায়ারি ডেট নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। আমি তো আকাশ থেকে পড়ি। পরিষ্কার দেখেছি ২০২৪ পর্যন্ত পাসপোর্ট ভ্যালিড। খবর নিয়ে জানতে পারলাম পাসপোর্ট এক্সপায়ারি ডেটের শেষ ছয় মাসে মধ্যে কোনো আন্তর্জাতিক ভ্রমণ করার অনুমতি দেওয়া হয় না।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আর একমাস আছে যাওয়ার। এত কম সময়ে নতুন পাসপোর্ট করে আবার নতুন করে ভিসার অ্যাপ্লিকেশন করার সময় পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। তাও কপাল ঠুকে সেই দিনই রাত এগারোটায় তৎকালে পাসপোর্টের জন্যে অ্যাপ্লিকেশন করলাম। কপালে হয়তো ওয়ার্ল্ডকন লেখা ছিল। পরের দিন মঙ্গলবার বিকেল চারটের সময় পাসপোর্টের ইন্টারভিউয়ের ডাক পেলাম। ইন্টারভিউয়ের পরে আরেক সমস্যা। পাসপোর্ট আসবে ডাকযোগে আমার পুরোনো বাড়ির ঠিকানায়, ঠিকানা চেঞ্জ করলে নতুন ভেরিফিকেশনে আরও সময় লাগবে। ওদিকে পুরোনো বাসা তো তালা বন্ধ, কাজ ছেড়ে সেখানে সারাদিন বসে থাকাও সম্ভব নয়। বারবার ফোন করে পোস্ট অফিসে আর পুরোনো বাসায় খোঁজ নিতে লাগলাম। অবশেষে বৃহস্পতিবার দুপুর তিনটে নাগাদ ফোন এল পোস্টম্যানের—আপনার পাসপোর্ট এসেছে। ভদ্রলোককে প্রায় হাতে পায়ে ধরে বললাম আপনি ঘণ্টা খানেক ঘুরে আসুন, আমি আসছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তিনি জানালেন চারটে পর্যন্ত তিনি ওই অঞ্চলেই থাকবেন, এসে যেন তাঁকে ফোন করি। ওদিকে শুরু হয়েছে তুমুল বৃষ্টি। জল ভেঙে ঘণ্টা খানেক পরে এক পুকুর পাড় থেকে ধরলাম পোস্টম্যানকে। বাড়ি ফিরে পাসপোর্ট হাতে নিশ্চিন্ত, পরের দিনই ভিসার ইন্টারভিউ সেক্টর ফাইভে। হঠাৎ খেয়াল পড়ল, ভিসার অ্যাপ্লিকেশনে তো পাসপোর্ট নম্বর এখন মিলবে না। তা ছাড়া ইনভাইটেশন লেটারেও তো পাসপোর্ট নম্বর আলাদা এখন। চিনা ভিসা অফিসে ফোন করলাম, সব কিছু বুঝিয়ে বলতে তারা বললেন নতুন একটি অ্যাপ্লিকেশন পেপার ফিল আপ করে, প্রিন্ট করে নিয়ে চলে আসতে। তারপরে মেইল করলাম ওয়ার্ল্ডকন কমিটিতে, নতুন ইনভাইটেশন লেটারের জন্যে। কিন্তু চিনে তখন মাঝরাত্রি, তাই পরের দিন সকালের আগে কিছু হবে না সেটা বোঝাই গেল। পরের দিন তো হাজির হলাম এগারোটার সময় ভিসা অফিসে। কপাল ভালো আমার আগে আরও অনেকেরই লাইন ছিল। প্রায় ঘণ্টা খানেক অপেক্ষার পরে নতুন ইনভাইটেশন লেটারের মেইল পেলাম। ভিসা অফিসে জানিয়ে মেইলটি প্রিন্ট আউট করতে বাইরে যেতে হল। সব গুছিয়ে নিয়ে ফিরে এসে দেখলাম আমার ডাক চলে গেছে, এখন সবার শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আবার। তবে আরও ঘণ্টা খানেক পরেই ভিসা ইন্টারভিউ শেষ হল। কিন্তু ভিসা পাওয়ার ডেট দেখে আবার মাথায় হাত। আমার চিন যাওয়ার দু-দিন আগে হাতে পাওয়া যাবে ভিসা। মানে দু-দিন আগে আমি জানতে পারব আদৌ আমার কপালে চিন যাত্রা আছে কিনা।
ওদিকে আরেকটি সমস্যা সামনে এল। অল্প চেনা আর যারা যাচ্ছেন চিনে, তারা সকলেই এক বাক্যে জানালেন যে অবশ্যই উইচ্যাট অ্যাপটি ফোনে থাকা দরকার। চিনে ওই অ্যাপটি একই সঙ্গে গুগল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং পেটিএমের কাজ করে। এমনকী অফিশিয়াল ওয়ার্ল্ডকন গ্রুপটিও ওই অ্যাপেই আছে। এদিকে অ্যাপটি ভারতে নিষিদ্ধ আরও অনেক চিনা অ্যাপের সঙ্গেই। ইন্টারনেট ঘেঁটে এপিকে ফাইল ব্যবহার করে অ্যাপটি নামালাম। ইন্সটলও হল। কিন্তু রেজিস্টার করতে গেলে যে ফোন নম্বর লাগবে তাতে ভারতের নম্বর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আবার বন্ধুদের শরণাপন্ন হতে হল। কল্পবিশ্বের বন্ধু সৌবর্ণবাবু বললেন, কুছ পরোয়া নেই, উনি নিজের ইউরোপিয়ান ফোন নম্বর ব্যবহার করতে দিলেন। কিন্তু তাতেও আটকালো পরের ধাপে। নতুন উইচ্যাট ব্যবহারকারীকে একজন পুরোনো ব্যবহারকারীর রেকোমেন্ডেশন লাগবে। এবং পুরোনো ব্যবহারকারীকে অন্তত এক বছরের পুরোনো ইউজার হতে হবে উইচ্যাটে। এবার এগিয়ে এল রেজিনা ওয়াং। রেজিনা চিনা কল্পবিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। নরওয়েতে সে আমাদের বন্ধু বোধিসত্ত্ব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে গবেষণার কাজ করে। তাঁর উইচ্যাট থেকে সে আমাকে ভেরিফাই করাতে শেষ পর্যন্ত অ্যাপটিতে লগ ইন করা সম্ভব হল। দেখতে দেখতে দিন এগিয়ে আসছে। কিন্তু কপালে আরও দুর্ভোগ লেখা ছিল।
আমি অনেক আগেই জানতাম ভারত থেকে যেহেতু আমি ছাড়া আর কারও যাওয়ার সম্ভাবনা কম, তাই আমার প্রতি অনেকেরই আগ্রহ থাকবে ভারতীয় কল্পবিজ্ঞান নিয়ে। অনেক ডিবেট বা আলোচনার সঙ্গেও যুক্ত হতে হবে ভারতীয় সায়েন্স ফিকশন নিয়ে।
আলোচনার জন্যে ওয়ার্ল্ডকন পরিচালকদেরও মেইল করেছিলাম অনেক আগেই। এরপর আমার ফেরার দিন জানতে চাওয়ায় আমি ওয়ার্ল্ডকনের শেষ দিনের কথা বলি (সব মিলিয়ে পাঁচ দিন)। সেইমতো ফেরার প্লেন ছিল শেষ দিনের দুপুরে। অথচ যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে দেখি জানানো হয়েছে ভারতীয় কল্পবিজ্ঞান নিয়ে আমার আলোচনা রাখা হয়েছে শেষ দিন সকালে। এবার সকালে দশটার সময় এক ঘণ্টার আলোচনা সেরে সব গুছিয়ে একটার প্লেন ধরা অসম্ভব ব্যাপার। এটা তো অর্গানাইজারদেরই আগে থেকে দেখা উচিত ছিল। আর যদি এই আলোচনাটায় অংশগ্রহণ করতে নাই পারি তাহলে আমার যাওয়ার অর্থটাই আর থাকে না। অত্যন্ত অসহায়ভাবে আবার সংগঠকদের মেল করলাম আমার ফেরার টিকিট পালটানোর জন্যে। তারা জানালেন এখন আর পরের দিনে ফেরার টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। আর যা পাওয়া যাচ্ছে তার খরচ অনেক বেশি, সেই টিকিটের জন্যে আমায় নিজের পকেট থেকেই কয়েক লাখ টাকা দিতে হবে। আবার বেশ কয়েকজন বন্ধুকে জানালাম ঘটনাটির কথা, সবাই একবাক্যে বলল এই ভুল সংগঠকদের, তাদেরই এটি ঠিক করা উচিত। শেষ পর্যন্ত জানানো হল ওয়ার্ল্ডকন শেষ হওয়ার দু-দিন পরে আমার ফেরার টিকিট কাটা হবে সংগঠকদেরই তরফ থেকে। তবে বাকি দেড় দিনের থাকার ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে। এইটুকু তো অবশ্যই করে নেওয়া যায়। আমি রাজি হয়ে গেলাম।
এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল রোমিং অন করলাম ফোনে। সবাই পইপই করে বলে দিয়েছে চিনে ফেসবুক, গুগল বা হোয়াটসঅ্যাপ কিছুই চলে না। যদিও ইন্টারন্যাশনাল রোমিং-এর ইন্টারনেটে এগুলি নাকি চলে। তাও অনেকেই জানালো চিনের সেন্সরশিপ থেকে বাঁচতে ফায়ারওয়াল রাখা দরকার। সেটিও ইন্সটল করে নিলাম। চিনের ইউয়ান মুদ্রাও বেশ কিছু ভাঙিয়ে নেওয়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কার্ডগুলিতেও ইন্টারন্যাশনাল ট্র্যানজাকশন রেডি। এর মধ্যেই গ্রুপে জানা গেল একটি নয়, সব মিলিয়ে ছয়টি সেশনে আমায় যোগ দিতে হবে। সেগুলির জন্যে নোটস তৈরি শুরু করতে হল এর মাঝে। যাওয়ার আগেই যোগাযোগ হল আমেরিকা থেকে মিমি মন্ডল ও ইউরোপ থেকে শ্বেতা তানেজার সঙ্গে। দুজনেই আন্তর্জাতিক সায়েন্স ফিকশনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নাম করেছেন। অক্টাভিয়া বাটলারের জীবন ও পত্রাবলী নিয়ে বই সম্পাদনার সুবাদে মিমি ভারত থেকে প্রথম হুগো পুরস্কারের জন্যে মনোনীত হয়েছিলেন। শ্বেতা নিজে সুলেখিকা, এখন কাজ করছেন সায়েন্স ফিকশনের পত্রিকা লোকাসের সঙ্গে। (কল্পবিশ্বের এই সংখ্যায় তার একটি অত্যন্ত সুন্দর গল্পের বাংলা অনুবাদও আছে)। আমার সঙ্গেই যাওয়ার কথা ছিল ভারতীয় লেখক ও সম্পাদক গৌতম ভাটিয়ার। গৌতম পেশায় আইনজীবী হলেও নেশায় সায়েন্স ফিকশন প্রেমী। আন্তর্জাতিক সায়েন্স ফিকশন পত্রিকা স্ট্রেঞ্জ হরাইজনের সম্পাদক ও লেখক গৌতমের বইগুলি ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক মহলে বহুপ্রশংসিত এবং নবীন লেখক হিসেবে তিনি হুগো নমিনেশনও পেয়েছেন। কিন্তু ঠিক যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে জানা গেল ব্যক্তিগত কারণে তিনিও এবার যেতে পারছেন না।
ভারতীয় কল্পবিজ্ঞানকে ওয়ার্ল্ডকনে দেখানোর জন্যে আমি ঠিক করেছিলাম যতটা সম্ভব বাংলা আর ইংরেজি সায়েন্স ফিকশনের বই নিয়ে যাব। সেইমতো নিজের সংগ্রহ থেকে প্রচুর বই নিয়েছিলাম। সঙ্গে কল্পবিশ্বের বইও। কিছু বই শেষ মুহূর্তে খুঁজে না পাওয়াতে বন্ধুরা সেগুলি নিজের সংগ্রহ থেকে পাঠিয়েও দিয়েছিলেন। এর জন্যে আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। সব মিলিয়ে প্রায় চল্লিশটি বই আমি নিয়ে গিয়েছিলাম ওয়ার্ল্ডকনে। তা ছাড়াও কল্পবিশ্বের পোস্টার, কার্ড, বুকলিস্ট—যতটা সম্ভব সঙ্গে নিয়েছিলাম। দুঃখের বিষয় এটা আমার জানা ছিল না যে বইগুলি অনুষ্ঠানের মধ্যে দেখাতে গেলে আগে থেকে তা চিনা সরকারকে পাঠিয়ে সেইমতো অনুমতি নিতে হয়। তাই কনভেনশনে ভারতীয় সায়েন্স ফিকশনের বই দেখানোর জন্যে কোনো টেবিল আমি পাইনি। যদিও অন্যান্য দেশের অনেক কল্পবিজ্ঞানপ্রেমী, লেখক ও সম্পাদকদের হাতে আমি প্রচুর বই তুলে দিয়েছি। বাকি বইগুলি চিনা সায়েন্স ফিকশন সোসাইটিগুলির সদস্যদের হাতে দিয়ে এসেছিলাম।
যাত্রা শুরু:
সব কিছু গুছিয়ে সবার শুভেচ্ছা নিয়ে ১৬ অক্টোবরর বেরিয়ে পড়লাম প্লেনে। প্রথম স্টপ সিঙ্গাপুর। সেখানে ছ-ঘণ্টা অপেক্ষার পরে প্লেন আমায় নিয়ে যাবে চেংডু শহরে। সিঙ্গাপুরের এয়ারপোর্ট আমার চেনা, তাই সময় কাটাতে তেমন অসুবিধা হয়নি। বিরাট এয়ারপোর্ট আর ঝাঁ চকচকে দোকানগুলি দেখতে দেখতেই কেটে গেল সময়। পরের প্লেনে এসে পৌঁছলাম চেংডুর টিয়াইফু এয়ারপোর্টে। বিশাল বড়ো এয়ারপোর্ট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সদ্য তৈরি। কিন্তু মানুষজন কই? প্রায় পুরো এয়ারপোর্টই ফাঁকা। একটা প্লেন থেকে আমরা যতজন নামলাম সবাই প্রায় ভিড় জমাল, দুটো মাত্র কাস্টমসের লাইনের সামনে। প্রায় দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর পরে যখন সুটকেস টেনে বাইরে বেরোলাম, তখন ক্লান্ত বললে কম বলা হবে। এর আগে প্রায় কুড়ি ঘণ্টা জার্নি চলছে। সামনেই বেশ কিছু বাচ্চা চিনা ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অতিথিদের অপেক্ষায়, সবার গায়ে ওয়ার্ল্ডকনের লোগো দেওয়া সাদা জ্যাকেট। তাদের মধ্যেই একজন ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে আমায় স্বাগত জানাল। তারপর তার পিছনে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম এয়ারপোর্টের এক প্রান্তে। সেখানে এবার অপেক্ষা বাসের।
একটি বিশ্রামকক্ষে বসে আছি। সঙ্গে আরও বেশ কিছু চিনা অতিথি। তারা প্রায় সবাই নিজেদের মতো কথা বলছে না হয় ফোনে ডুবে আছে। আর এক গুচ্ছ অল্পবয়সি স্কুল কলেজে পড়া ভলিন্টিয়ার ছেলেমেয়ে ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যেই এক প্রৌঢ় এশিয়ান ভদ্রলোক এসে পৌঁছলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার চারদিকে ভিড় জমে গেল। ভদ্রলোককে দেখে লেখকের থেকে ফিল্ম স্টারই বেশি মনে হয়। সুন্দর চেহারা, মাথায় পনি টেল, প্রচণ্ড স্মার্ট। বোঝাই গেল এই ছেলেমেয়েরা তার বড়ো ভক্ত। অনেকেই অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়েও ধরল। মনে মনে যে একটু হিংসে হচ্ছিল না যে তা বলব না। তবে বাসে উঠে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করে সেসব দুঃখ কোথায় চলে গেল। লেখকবাবুর নাম তাইও ফুজি। জাপানের নামি লেখক। বহুবার এর আগে চিনে ঘুরে গেছেন। এখানকার ছেলেপুলেদের মধ্যে তাঁর লেখা আর স্টাইল খুব জনপ্রিয়। সঙ্গে আলাপ হল আরেকজন অনুবাদকের সঙ্গে, থাকেন সিঙ্গাপুরেই। চিনা আর ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। দুঃখের বিষয় এখন ভদ্রলোকের নাম আর মনে পড়ছে না। এছাড়াও আরও বেশ কিছু বিদেশি লেখকের ও পাঠকের সঙ্গে সম্ভাষণ বিনিময় হল।
বাস তখন চলছে ধুধু প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে। চারিদিকে ফাঁকা মাঠ আর উঁচুনীচু টিলা। শহরের নাম গন্ধ নেই। পড়েছিলাম চেংডু চিনের অন্যতম বড়ো ও জনবহুল শহরগুলির মধ্যে একটি। কথা বলে বুঝলাম শহরে পৌঁছতে অন্তত ঘণ্টা তিনেক লাগবে এই ফাঁকা হাইওয়েতেও।
ঘড়িতে তখন প্রায় আটটা ছুঁইছুঁই, চারিদিকে তখনও আলো আছে কিছুটা। বাস ঢুকল শহরের মধ্যে। পরিষ্কার ঝাঁ-চকচকে শহরের রাস্তা। কোথাও একটুও নোংরা নেই। লোকজন রাস্তায় খুবই কম। প্রচুর গাড়ি চলছে। হঠাৎ দেখলে পাশ্চাত্যের কোনো শহর বলে ভুল হতে পারে। চোখে পড়ল শহরে ঢোকার মুখেই বিরাট হোর্ডিং। ওয়ার্ল্ডকন ২০২৩-এ আপনাকে স্বাগত। এরপর ওয়ার্ল্ডকনের ছোটো-বড়ো হোর্ডিং, ব্যানার আর নোটিশে অত্যন্ত রুচিসম্মতভাবে পুরো শহরটা ঢেকে দেওয়া হয়েছে। চোখে পড়ল গোবদা একটি রোবট পান্ডার মূর্তি—এইবারের ওয়ার্ল্ডকনের ম্যাসকট। এইসব দেখতে দেখতে এসে পৌঁছলাম আমাদের হোটেলে। বাস থেকে নেমে সব ব্যাগ নিয়ে রিশেপসনে এন্ট্রি করে ঘরে ঢুকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বিরাট হোটেল রুম—আদর আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি করেনি এরা। চোখ মুখ ধুয়ে, জামা পালটে একটু গড়িয়ে নিয়ে বেরোনোর পরিকল্পনা করলাম। তখন প্রায় দশটা বাজে। খুবই খিদে পেয়েছে। সুটকেসে কিছু শুকনো খাবার ছিল, কিন্তু সেসব খেতে তখন ইচ্ছে করছিল না। নীচের লবিতে নেমে বুঝলাম হোটেলের রেস্টুরেন্ট সাড়ে আটটার মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়, সুতরাং খাবার কিছুই এখন পাওয়া যাবে না। ওদিকে লবির দুই প্রান্তে চিনা ভলিন্টিয়ার ছেলেমেয়েরা দুটো বুথ খুলে রেখেছে। তার একটির সামনে বেশ একটা জটলা তৈরি হয়েছে। সেখানে একটি ইউরোপিয়ান ছেলে হাত-পা নেড়ে অনেকগুলি বই হাতে করে কী যেন বোঝাচ্ছে ভলিন্টিয়ারদের, আরও কিছু বিদেশি অতিথিও তাদের ঘিরে রেখেছেন। উঁকি মেরে যা শুনলাম ছেলেটির নাম স্টিফান। রোমানিয়া থেকে এসেছে। সায়েন্স ফিকশনের অ্যাক্টিভিস্ট সেই দেশের। হাতে ম্যাগাজিনগুলো সত্তরের দশকের রোমানিয়ান সায়েন্স ফিকশন পত্রিকা। খুব উৎসাহ নিয়ে সে বাকিদের তাদের দেশের সায়েন্স ফিকশনের ইতিহাস বোঝাচ্ছিল। কিছুক্ষণ শুনে মুচকি হেসে সরে এলাম সেখান থেকে—বাবুমশাই তুমি কি জানো, তোমাদের দেশের দশ-পনেরো বছর আগে আমাদের অদ্রীশ, সত্যজিৎ, প্রেমেন্দ্র মিলে যে সায়েন্স ফিকশনের পত্রিকা বের করেছিল!
বাইরে বেরিয়ে তো একেবারেই মুশকিলে পড়লাম। কিছু লোক জানালো মিনিট দশেক হেঁটে গেলে নাইট মার্কেট পাবো, সেখানে সারা রাত খাওয়া দাওয়ার দোকান খোলা থাকে।
তার থেকে হোটেলের পাশেই একটা ম্যাকডোনাল্ড দেখে জয় মা বলে সেখানেই ঢুকে পড়লাম। দোকানটি বোধহয় বন্ধই হয়ে গেছিল। আমায় বিদেশি দেখে দয়া পরবশ হয়ে আবার কাউন্টার খুলল দোকানি। সেই রাতের মতো একটি বার্গার আর প্রচুর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দ্বারা আমার পিত্ত রক্ষা হল। পরের দিনের প্রোগ্রাম সিডিউলে চোখ বুলিয়ে সেদিনের মতো তলিয়ে গেলাম ঘুমের দেশে।
ক্রমশ…
Tags: দীপ ঘোষ, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা