অন্তিমকাল
লেখক: শ্রীজিৎ সরকার
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ডায়েরি: এক
নাম: সুচরিতা বসু
পরিচয়: মানুষ—স্ত্রী—স্বাভাবিক
স্থিতি: পরীক্ষাধীন আবাসিক
একটু আগেই জানতে পারলাম, আমি এখন সম্পূর্ণ বিপন্মুক্ত। যে চিকিৎসক আমার তত্ত্বাবধান করছিলেন, তিনি আমাকে অভিনন্দন জানালেন। আর এই ডায়েরিটা দিয়ে বললেন, “আপনার এই ক-দিনের যা অভিজ্ঞতা, সেটা নিজের মতো করে এই ডায়েরিতে লিখে রাখবেন।”
পৃথিবীতে আমি ডায়েরি লিখতাম। বাবার মতো নিয়মিত নয়; তবু যেদিন যেদিন মনটা কোনো কারণে আবেগতাড়িত হয়ে থাকত বা একটু অন্যরকম কিছু ঘটত—সেদিন সেদিন লিখতাম। অবসরে সেগুলো পড়তাম। কখনও মজা লাগত, কখনও আবার মন-খারাপ হত।
আজ আর পুরোনো কথা মনে করে লাভ নেই। বরং এগিয়ে যাওয়ার কথাই ভাবি।
কোয়ারেন্টাইন ক্যাপসুলে আজ আমার শেষদিন। আমি নিজেও জানি না যে, কতটুকু সংক্রামক জীবাণু বা তেজস্ক্রিয় কণা নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম! সেসব তথ্য জমা আছে পরীক্ষকদের কাছে। তবে যা কিছুই আনি-না কেন—এই ক্যাপসুলের infrared disinfectant management আর radiation diminishing system মিলে, গত এক সপ্তাহে যে তার সবটুকুই নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে—সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই! তবুও আজ রাতটা আমাকে রেখে দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত সাবধানতা হিসাবে—পাছে অবশিষ্ট কিছু যদি থেকেও থাকে—তবে যেন সেটুকুও নষ্ট হয়ে যায়।
উফফ! একা একা এই এক সপ্তাহ কাটানোটা যে কী দুর্বিষহ ব্যাপার ছিল…
আজ এক অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে আমার। আর তো মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা… তারপরই, সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ, নতুন এক জীবন শুরু হবে আমার। ভাবলেও রোমাঞ্চ হচ্ছে!
অথচ আমার তো এখানে থাকার কথা ছিল না! থাকবেই বা কীভাবে? শারীরিক সক্ষমতা এবং বৌদ্ধিক সূচকের দিক থেকে চিরকাল আমি অতি সাধারণদের দলেই পড়ে এসেছি। অশিক্ষিত হয়তো নই, তবে বড়াই করার মতো এমন কিছু উচ্চশিক্ষিতও নই—দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়েছি; সেই সঙ্গে লাইব্রেরি সায়েন্সের একটা ছোটো ডিপ্লোমা আছে, যার জোরে সরকার গ্রন্থাগারে একটা চাকরি পেয়েছিলাম। সেখানে এই অত্যাধুনিক উপনিবেশ—যেখানকার অধিবাসীদের নির্বাচন করা হয়েছে অতি যত্নে, বহু চিন্তাভাবনা করে—সেখানকার নাগরিকত্ব কেমন করে পেতাম আমি?
অথচ আমিও কি বাকি সকলের মতো পরিচিতদের আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাইনি? একশোবার চেয়েছিলাম। আর সেইজন্যই তো চিরচেনা ওই গ্রহটা ছেড়ে পালিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, যেখানে আমার পরমাত্মীয়দের থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছিল দ্রুত…
সে এক দিন গেছে! কত মানুষ যে দাঁড়িয়ে থাকত ইমিগ্রেশন অফিসের বাইরে… তারা প্রত্যেকে চাইত, যত দ্রুত সম্ভব নিজের নিজের নামগুলো তালিকায় নথিভুক্ত করতে। অবশ্য সেটাই তো স্বাভাবিক। তাদের সঙ্গে আমিও তো সেই লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম, ফর্ম ভরার সময় যথাসম্ভব ‘বিশেষ’ভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করেছিলাম (যদিও iq index লেখার সময়ই বুঝে গিয়েছিলাম, আমার special category পাওয়ার আশা আর নেই)।
চাকরি, সংসার ইত্যাদি মিলিয়ে কাজের আমার অভাব ছিল না। এইসব ব্যস্ততা নিয়ে রোজকার জীবনে আমি যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতাম। তবে বাবা আর দাদা বোধহয় বুঝতে পারত আমার হতাশাটা। ওরা সব সময় চেষ্টা করত মনোবল জোগানোর। আমিও এই ভেবে খুশি থাকার চেষ্টা করতাম যে—আমি সাধারণ হলেও, আমার বাবা আর দাদা তো অসাধারণ। ওদের মতো radiologist আর immunologist এই সময় কজন আছে? সুতরাং, ওরা যে ভবিষ্যৎ নগরীর নাগরিকত্ব পাবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? না হয় বাকি জীবনটার জন্য আমি একা থেকেই গেলাম… একা একা কি কোনো মানুষ বেঁচে থাকে না নাকি? ওরা যে এক ঐতিহাসিক প্রকল্পের অংশীদার হতে পারছে, সেখানে যে ওদের সক্রিয় ভূমিকা থাকতে চলেছে—তা-ই বা কম কী?
তবে ওরা যে আমাকে পারমিট পাইয়ে দেওয়ার জন্য অনেকরকম চেষ্টা করছিল এবং কোনোভাবেই সফল হচ্ছিল না, সেটাও ওদের কথাবার্তা শুনে টের পেতাম।
একদিন পর্দার পিছনে দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম, বাবা দাদাকে খুব হতাশ হয়ে বলছে, “সুচরিতার ব্যাপারটায় কিচ্ছু হচ্ছে না রে! ইমিগ্র্যান্ট অফিসারকে ঘুস দিয়েও কিছু করা যাচ্ছে না। আমার মেয়েটাকে কি তবে নিয়ে যেতে পারব না?”
আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম, দাদার মুখটা অন্ধকার হয়ে উঠেছিল। তবু বাবাকে সাহস দেওয়ার জন্য ও বলেছিল, “কী বলছ বাবা? ও আমাদের সঙ্গে যাবে। আমিও খোঁজ নিচ্ছি আর তুমিও খোঁজ নাও—কোনো কোটায় স্পেশাল পারমিশন জোগাড় করা যায় কি না… আর সুচরিতা যদি পারমিট না পায়, তবে আমিও কোত্থাও যাব না।”
সেই মুহূর্তে খুব কাঁদতে ইচ্ছা করেছিল আমার। আত্মহত্যা করার কথাও ভেবেছিলাম।
কিন্তু জীবন যে আমার জন্য কী সাজিয়ে রেখেছে, তা কি তখন ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিলাম?
সেই সকালটার কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে আমার।
কয়েকদিন ধরেই কোনো একটা সংক্রমণে ভুগছিলাম আমি। প্রথমে অতটা গুরুত্ব দিইনি। দাদা যে ওষুধ দিয়েছিল, তা-ই খাচ্ছিলাম। তবে ফল তেমন একটা হচ্ছে না দেখে ও-ই শেষমেশ রক্ত পরীক্ষা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কীসের কীসের পরীক্ষা যে করতে দেওয়া হয়েছিল—আমি নিজেও জানি না! তবে ও বলেছিল, রিপোর্ট হাতে পেতে অন্তত দিন চারেক সময় লাগবে। বিষয়টা নিয়ে আমার খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। বরং সরকার থেকে সমস্ত গ্রন্থাগারিকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের যে তালিকা বানানোর নির্দেশ এসেছিল, আমি সেরকমই একটা ক্যাটালগ বানানোয় বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
সেদিন আমার শরীরটা বেশ ভালো ছিল। মাথাটা হালকা লাগছিল, শরীরটাও চনমনে হয়ে উঠেছিল আগের থেকে। মন দিয়ে সেদিনের খবরের কাগজ পড়ছিলাম আমি। নিজের অজান্তেই আমি মন দিয়েছিলাম সেই নিবন্ধে, যেখানে আলোচনা করা হয়েছিল নতুন উপনিবেশ নিয়ে। ইতিমধ্যেই স্থানান্তরিত বাসিন্দারা সেখানকার নতুন পরিবেশের সঙ্গে কতটা খাপ খাওয়াতে পারছে, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কতটা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে, শক্তি উৎপাদন প্রযুক্তি সঠিকভাবে কাজ করছে কি না, মহাজাগতিক দুর্যোগ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সে সক্ষম হচ্ছে কি না—এসব নিয়েই আমার বেশি চিন্তা হচ্ছিল।
এমন সময় দাদা বাড়ি ফিরে এসেছিল। খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল ওর মুখটা। আমার মনে হয়েছিল, হয়তো আমার রিপোর্টে খারাপ কিছু পাওয়া গেছে!
আমি তবু হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “কী হয়েছে?”
“ব্লাড রিপোর্ট ভালোই এসেছে। আর কোনো ইনফেকশন নেই।”
যত-না খুশি হয়েছিলাম, তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছিলাম আমি।
দাদা বলেছিল, “কোনো ওষুধপত্র নয়, বরং তোর innate immunity তোকে সুস্থ করে তুলেছে। You have genetically something very special!”
আরও কিছু খুচরো কথা ও বলেছিল। কিন্তু আমি তো ইতিহাসের ছাত্রী; হারিয়ে-যাওয়া অতীত আর ফুরিয়ে-যাওয়া সময় নিয়ে আমি কারবার। আমার সারাজীবন বিজ্ঞানকে ভয় পেয়ে আসা মাথায় ওসব খটমট জিনিস ঢুকবে কেন? আমি শুধু এইটুকুই বুঝেছিলাম যে—ওই বিরল অনাক্রম্যতা আমাকে কেমন অসুখ থেকেই সুস্থ করেনি, বরং সে আমাকে বাঁচিয়ে দিতে চলেছে আসন্ন দুর্বিপাক থেকেও।
যে প্যাথলজিস্ট আমার রক্ত পরীক্ষার report নিশ্চিত করেছিলেন, তিনি নাকি রিপোর্টের একটি কপি স্বাস্থ্যমন্ত্রকে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে একটা বিশেষ বোর্ড বসেছিল। তাঁরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, নতুন উপনিবেশে আমাকে প্রয়োজন। যদি সেখানে নতুন ধরনের কোনো সংক্রামক অসুখ দেখা যায়—সেক্ষেত্রে আক্রান্তদের স্বাভাবিক অনাক্রম্যতাকে শক্তিশালী করে তুলতে আমার জিন প্রয়োজন হতে পারে। তাই বিশেষ আপৎকালীন কোটায় আমার নতুন নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে দেওয়া হয়েছিল; সেই সঙ্গে এখানকার কোন এক বাচ্চাদের স্কুলে গ্রন্থাগারিকের চাকরিও পাকা করে দেওয়া হয়েছিল।
এক হিসাবে, আমার ভূমিকা গিনিপিগেরই সমান! তবু আমার আনন্দ হয়েছিল। বাঁচার আনন্দ।
তুলনামূলক দেরিতে আমার নাম নথিভুক্ত হলেও, ডাক পড়ে গিয়েছিল দাদা আর বাবার আগেই। প্রায় দু-মাস ছিলাম আমি ট্রেনিং সেন্টারে। যদিও এখনকার যাত্রীবাহী মহাকাশযানগুলোর সঙ্গে supersonic aircraft-এর বিশেষ পার্থক্য নেই, বিভিন্নরকম emergency situation সামলানোর জন্য প্রচুর দক্ষ কর্মীও থাকে; তবু, মহাকাশযাত্রা তো! তাই সেখানে আমাদের শেখানো হয়েছিল নানান খুঁটিনাটি, শারীরিক জটিলতা এড়ানোর বিভিন্ন পন্থা, এবং অবসাদগ্রস্ত না-হওয়ার কৌশল…
যাত্রাপথ নিয়ে বিশেষ কিছু লেখার নেই। নতুন জায়গায় যাওয়ার উত্তেজনা আর চিরকালের জন্য পৃথিবী ছেড়ে আসার দুঃখটুকু বাদ দিলে—ওরকম একঘেয়ে ভ্রমণ আমি অন্তত জীবনে কখনও করিনি! এখানে থাকাটাও তা-ই।
আশা করছি, আর কিছুদিনের মধ্যেই বাবা আর দাদা এখানে এসে পড়তে পারবে। তারপর, বড়োজোর এক সপ্তাহের নিভৃতবাস। তারপরই আমরা আবার একসঙ্গে আমাদের জীবনটা কাটাতে পারব। যার যার নিজস্ব কাজের সময়টুকু বাদ দিলে, একসঙ্গে বসে গল্প করতে পারব, খাওয়াদাওয়া করব, হাসিঠাট্টা করব, নিজেদের অভিজ্ঞতাগুলো ভাগ করে নিতে পারব…
হলই বা এখানকার সব কিছু নতুন, সব কিছু অন্যরকম। মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার পৃথিবী তো চিরকাল ঘুরেছে ওই দুজনকে কেন্দ্র করে। সুতরাং ওরা আমার কাছে থাকবে, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে?
ডায়েরি: দুই
নাম: প্রবাল বসু
পরিচয়: মানুষ—পুরুষ—স্বাভাবিক
স্থিতি: মহাকাশযাত্রী
করার মতো বিশেষ কিছু না পেয়ে ডায়েরি লিখছি। যদিও এসবের অভ্যাস আমার একেবারেই নেই। সুচরিতাকে মাঝেমধ্যে দেখেছি লিখতে। বাবা তো রোজই লিখত। ওই hectic schedule-এর মধ্যেও যে বাবা কী করে এসবের জন্য সময় বের করত, ভেবেই আশ্চর্য হয়ে যাই! মা অবশ্য বলত: সময় হয় না, সময় করে নিতে হয়। তবে বাবার ভাষার বাঁধুনিও চমৎকার ছিল। নিয়মিত বাংলা লেখার অভ্যাস ছিল বলে আমার মতো এত কাটাকুটিও হত না।
অবশ্য আমার রোজকার লেখা মানে Research Report আর Articles… ওতে আর লিখনশৈলী কত উন্নত হবে?
যদিও সাহিত্য-টাহিত্যের ব্যাপারে আমি least interested… অত ধৈর্যও নেই, আকর্ষণও নেই। তবে বাবার লেখা প্রবন্ধ পড়তে পড়তে আমার মাঝেমধ্যেই মনে হত, he could easily be an author! আমার এসব তো নেহাত উটকো শখ, মুখ বদল করার জন্য… নামার আগে এটাকে কমোডে ফ্লাশ করে দিয়ে যাব।
কয়েক ঘণ্টা হল, উড়ে চলেছি। যা বুঝছি, এখনও অন্তত আড়াই দিন এভাবে চলতে হবে। তাতে অবশ্য খুব একটা অসুবিধা নেই। এখানে গানবাজনা এবং audiobook শোনা, বই পড়া, ছবি দেখা ইত্যাদি নানান বিনোদনের বন্দোবস্ত আছে। আর তা ছাড়া কেবিনের লাগোয়া একটা Walking passage-ও আছে। খুব চওড়া নয়। তবে পাশাপাশি দুজনের হাঁটাচলা করার জন্য যথেষ্ট। যখনই কোমরটা খুব টনটন করবে, তখনই একটু পায়চারি করে এলেই হবে। সিটগুলোও বেশ আরামদায়ক। প্রায় Business class-এর মতোই। ঘুমোতে বিশেষ অসুবিধা হবে না বলেই মনে হয়। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও খারাপ নয়। তা ছাড়া আমি অত ভোজনরসিক নই। যা হোক, পেট ভরানোর মতো এবং সহজ পথ্য সহজপাচ্য কিছু পেলেই আমি খুশি।
এর আগে গবেষণার কাজে দিনের পর দিন laboratory-তে কাটিয়েছি। সূর্যের আলোর মুখও দেখিনি। তখন কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু তার সঙ্গে এই অবস্থার আকাশ-পাতাল পার্থক্য! সে ছিল কাজ আর ব্যস্ততা নিয়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। আর এ যেন জোর করে নিজেকে আলাদা করে রাখা। ওখানে কখন সময় কেটে যেত, বুঝতেই পারতাম না! খাওয়া-ঘুমের কথা অবধি মনে থাকত না। প্রত্যেকটা মুহূর্ত পার হয়ে যেত উত্তেজনা আর আশঙ্কার মধ্যে। আর এখানে সময় যেন কাটছেই না! বিরক্তি এসে যাচ্ছে, along with a bit of depression!
আশপাশের মানুষদের সঙ্গে অবশ্য কথাবার্তা বলাই যায়। তারা তো দিব্যি নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছে। ওরা যে আমার একেবারে অচেনা, সে কথাও বলা চলে না। মাসের পর মাস একসঙ্গে ট্রেনিং নিতে নিতে সবার সঙ্গেই অল্পবিস্তর পরিচয় হয়েছে। কিন্তু তবুও, আমি এখনও অন্তরঙ্গ ঘেরাটোপের বাইরে আড্ডা দিতে খুব একটা আগ্রহী নই। কর্মক্ষেত্রেও এরকমই ছিলাম। সহকর্মীদের সঙ্গে সেই অর্থে আড্ডা দিতাম না বললেই চলে। এখানেও ‘শরীর ঠিক আছে তো’, ‘খাওয়া হল’ ইত্যাদি ধরনের গতে বাঁধা সৌজন্যালাপ আর খুব সামান্য কিছু বার্তাবিনিময়, আমাদের conversation-এর বেশি আর এগোচ্ছে না!
এতদিন ভাবতাম, ডায়েরি লেখাটা খুবই সহজ ব্যাপার। খসখস ঘচঘচ করে লিখে গেলেই হল। কিন্তু এখন দেখছি, ব্যাপারটা দেখছি, অতটাও সোজা নয়! মনের মধ্যে এত কিছু চলছে, অথচ লিখতে গিয়ে কিছুরই থই পাচ্ছি না। আর যা লিখছি, তাও খুব unorganised হয়ে যাচ্ছে। সাহিত্যিকরা যে কেমন করে বানিয়ে বানিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে চলেন, জানি না! অবশ্য ওসব গালগল্পে আমার আগ্রহ নেই। সুতরাং জানার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করছি না।
কী লিখব… কী লিখব…
আচ্ছা বেশ, সামনের ড্যাশবোর্ডে যা আছে, আপাতত সেটাই লিখি। বেশ একটা documentation হবে! অবশ্য এর আর কী-ই বা মূল্য আছে? একটু পরেই তো এটা নষ্ট হয়ে যাবে।
Speed: 56, 000 km/hour
Passenger: 358
Temperature: 18 °C
Atmospheric Pressure: 101.3 kPa
আমার পাশে যে ভদ্রমহিলা বসে আছেন, তিনি পেশায় sociologist এবং অধ্যাপিকা। একটু আগেও তিনি কাঁদছিলেন। না, বাড়ির লোকের কথা ভেবে নয়। তাঁর স্বামী আর ছেলে আগেই চলে গেছে। তিনি কাঁদছিলেন পোষা কুকুরটার কথা ভেবে। She is quite emotional!
আমি আবার কোনোদিনই খুব একটা আবেগপ্রবণ নই। বরং ক্ষেত্রবিশেষে কঠোর বস্তুবাদী বাস্তববাদী। বাবা, বোন, গুটিকতক বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী আর কাজের জগৎ—এই নিয়েই আমার পৃথিবী। এর বাইরে অন্য কিছু নিয়ে বিশেষ আগ্রহও নেই, উচ্ছ্বাস তো নেইই। এমনকি কাছের লোকেদের জন্যও আমার বিভিন্নরকম গণ্ডি কাটা আছে।
তবে আবেগ-টাবেগ থাক আর না-ই থাক, এই ঐতিহাসিক প্রকল্পের অংশ হতে পেরে মৃদু উত্তেজনা definitely হচ্ছে।
সেই কোন শৈশবকাল থেকে শুনে আসছি যে, পৃথিবীর বাইরে কতকগুলো বিকল্প পৃথিবী তৈরি হচ্ছে! বিভিন্ন দেশের শ্রেষ্ঠ মেধারা এই প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। খরচ হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। জনবিস্ফোরণ এবং দূষণের শিকার পৃথিবীকে একটু স্বস্তি দিতেই এই বিরাট খরচাবহুল প্রকল্পের আয়োজন। ব্যাপার আর কিছুই নয়, সমুদ্রে ভাসমান কৃত্রিম দ্বীপের মতো মহাকাশে চলমান কতকগুলো কৃত্রিম জনপদ আর কী! তারাও সূর্যকে ঘিরে পাক খাবে (যদিও দূরত্ব অনুযায়ী সময়ের হিসাবের কিছু তারতম্য থাকবে)। সেখানেও বাস্তুতন্ত্র এবং জলবায়ুচক্র থাকবে (যদিও সবটাই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত)। স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজব্যবস্থা থাকবে।
Space Employment Department থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমাকে আপাতত একটি হাসপাতালে immunologist হিসাবে যোগ দিতে হবে। পরবর্তীতে যখন সেখানে পঠনপাঠন শুরু হবে, তখন হয়তো অধ্যাপনার দায়িত্বও নিতে হবে। সুচরিতা তো librarian হবে, ঠিকই হয়ে আছে। তবে বাবা হাসপাতালে যোগ দেবে নাকি গুরুত্বপূর্ণ কোনো গবেষণার দায়িত্ব পাবে, সে ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। যদিও সীমিত লোকসংখ্যার কারণে সকলকেই ওখানে একাধিক কাজ করতে হবে (যেমন আমার এই fellow passenger-টিকেই সরকারের advisory board এবং social reformation wing—এই দুই দায়িত্বই সামলাতে হবে), তবে বয়সজনিত কারণে বাবা কিছু ছাড় পেলেও পেতে পারে।
আজ যে আমার মনটা একটু খারাপ হয়ে উঠছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছি। যতদিন পৃথিবীতে থেকেছি, ততদিন এই ব্যাপারটা অনুভব করতে পারিনি। কিন্তু আজ বিষণ্ণ (এই শব্দটা কি এক্ষেত্রে সঠিক?) লাগছে। সত্যিই আমি চিরদিনের মতো আলাদা হয়ে যাচ্ছি আমার সেই চিরদিনের চেনা জগৎটা থেকে? সত্যিই আর কখনও ফিরতে পারব না সেখানে? সেইসব রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, আমার study, bedroom, chamber, আমাদের ছোট্ট বাগানে মায়ের লাগানো আম গাছ আর কাঁঠালিচাঁপার ঝোপ… এসব আর কোনোদিন দেখতে পাব না?
আমার দুঃখ হচ্ছে সেসব মানুষের কথা ভেবেও, যারা এই নতুন যাত্রার অংশীদার হতে পারল না, অথচ তাদের পরম আত্মীয়দের হয়তো তাদের ছেড়ে চলে আসতে হল। অবশ্য দুঃখ পেয়েই বা কী হবে? সবার ভাগ্যে কি আর সব কিছু জোটে? আমি যে নিজের ক্ষেত্রে অন্তত এমন পরিস্থিতিকে আটকে দিতে পেরেছি, এ-ই যথেষ্ট। বাকিদের জন্য আমার আর কী-ই বা করার আছে?
কথাটা কি স্বার্থপরের মতো শোনাল?
শোনালেও কিছু করার নেই। হ্যাঁ, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, আমি স্বার্থপর। I am somehow oversensitive about my family. বিশেষ করে, বোনের প্রতি আমার অতিরিক্ত দুর্বলতা আছে। ওর মুখের দিকে তাকালে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। ও কাছে থাকলে মনে হয়, মা আমার কাছে আছে। মায়ের জন্য আমি কিচ্ছু করতে পারিনি। সেই দুঃখ আমাকে আজও ক্ষতবিক্ষত করে। কিন্তু ওকে সব সময় আমি আগলে আগলে রাখি। ও খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে। তাই আমি প্রতিমুহূর্তে ওর সুখ-দুঃখের হদিস পাওয়ার চেষ্টা করি।
মুখে সব কথা বলা যায় না। তবে লিখতে তো কোনো বাধা নেই, বিশেষ করে যে document কখনও কারও হাতে পড়ার সম্ভাবনাই নেই! তাই আজ আমি স্বীকার করে যাচ্ছি যে, আমার বোনের জন্য, আমি জীবনে প্রথমবার শঠতার আশ্রয় নিয়েছি।
আমি প্রথমেই বুঝে গিয়েছিলাম যে, ওর পক্ষে cosmic passport পাওয়া সম্ভব হবে না। তবুও আমি আর বাবা চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। কিন্তু এই একটা জায়গা, যেখানে কোনো ছিদ্র আমরা বের করতে পারিনি। অথচ আমার বোন একা পড়ে থাকবে, তার সঙ্গে আর কখনও দেখাটুকু পর্যন্ত হবে না, এ-ও আমি মেনে নিতে পারিনি। তাই ওর blood report-এ আমি কারচুপি করেছিলাম। ব্যাপারটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। And it was against my morality too. কিন্তু আমার আর কিছু করার ছিল না।
হ্যাঁ, আমিই পরীক্ষা করেছিলাম ওর রক্ত। সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা লিখেছিলাম আমি। ওর IRF3 এবং MIR136 জিন আর পাঁচজনের মতোই সাধারণ। নতুন ধরনের ভাইরাল অসুখের সঙ্গে লড়াই করার এমন কিছু remarkable ক্ষমতা তাদের নেই। Alpha Beta interferon-এর কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো বিশেষ সক্ষমতাও তাদের নেই। এসবই আমার বানানো।
তবে চিকিৎসক মহলে আমার যতই গ্রহণযোগ্যতা থাকুক-না কেন, এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যে আমার কথাই শেষকথা নয়, ওর রক্তের নমুনা যে নতুন করে পরীক্ষা করে দেখা হবে, সেসব কথা আমি জানতাম। সেইজন্যই তো যখন টেস্টের জন্য রক্তের নমুনা পাঠাতে বলা হয়েছিল, তখন আমি ভায়ালে করে খানিকটা প্রকল্পিত সিরাম পাঠিয়েছিলাম, যার মধ্যে ছিল Synthetically Mutated Gins। ওটাই তো ছিল আমার নতুন গবেষণার বিষয়: Imputed Innate Immunity বা I3, ইতিমধ্যেই যা প্রায় সাফল্যের কাছাকাছি এসে গেছে। আশা করি, ওখানে কাজে যোগ দেওয়ার পর আর বেশি দিন লাগবে না গবেষণার বাকি কাজটুকু শেষ করতে। তখন নতুন কোনো সংক্রমণ হলেও সুচরিতাকে নিয়ে আর টানাহ্যাঁচড়া করার প্রয়োজন হবে না। আর যেহেতু একবার ওখানকার নাগরিকত্ব পেয়ে গেলে আর তাকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠানোর নিয়ম নেই, তাই ও আমৃত্যু আমাদের সঙ্গেই থাকতে পারবে।
আশা করি, সুচরিতার quarantine শেষ হয়ে এসেছে। এবার ওর probation period চলছে হয়তো। শুনে এসেছি, বাবাদের যাত্রা আগামী পরশু শুরু হবে। তার মানে, আর দিনকয়েকের অপেক্ষা। তারপরই আমরা আবার একসঙ্গে হতে পারব।
উফফ, এই একঘেয়ে বিরক্তিকর voyage যে কখন শেষ হবে…
অনেক লিখে ফেলেছি। আর ভালো লাগছে না। যাই, কাগজটা নষ্ট করে দিয়ে আসি।
ডায়েরি: তিন
নাম: সূর্যবংশ বসু
পরিচয়: মানুষ—পুরুষ—অস্বাভাবিক
স্থিতি: অকৃতকার্য মহাকাশযাত্রী
শেষ ফেরিটা চলে গেছে কিছুদিন আগে। এতদিনে সে-ও বোধহয় গন্তব্যের অনেকখানি কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
আপাতত আমি একা। একেবারে একা।
তবে সত্যিকারের ‘একাকিত্ব’ বলে কি আদৌ কিছু হয়? গতিবেগ এবং অবস্থানের মতো সে-ও তো আপেক্ষিক। সময়বিশেষে, ব্যক্তিভেদে তার সংজ্ঞা বদলে বদলে যায়।
আসলে, এক হিসাবে মানুষ আজন্ম একা—তাকে তার জীবনের প্রত্যেকটা উত্থান-পতনের মোকাবিলা নিজেকেই করতে হয়। শোক, দুঃখ, আনন্দ, উচ্ছ্বাসের সাক্ষী নিজেকেই হতে হয়। আবার, আরেক হিসাবে মানুষ সদা সঙ্গীবেষ্টিত—পৃথিবীর চিরকালীন জীবনধারা সব সময় তাকে ঘিরে রাখে, কারও না কারও অস্তিত্বের ছায়া সদাসর্বদা তার জীবনে পড়ে। যে নিজেকে যে পরিপ্রেক্ষিত থেকে দ্যাখে, সে নিজেকে সেভাবেই আবিষ্কার করে।
তবে দ্বিতীয় হিসাবে আমিও ‘একা’ নই। যারা কোনো না কোনো অসামর্থ্যের কারণে নতুন উপনিবেশে যাওয়ার সুযোগ পেল না (তাদের সংখ্যাই বেশি)—আমৃত্যু আমি তাদের সঙ্গেই বেঁচে থাকব! এখন থেকে তারাই আমার বন্ধু।
তবে এখন আর এ কথা স্বীকার করতে সামান্যতম দ্বিধাও নেই যে, এই যেতে না-পারা নিয়ে আমার আর বিন্দুমাত্র আপশোশও নেই। বর্তমানে আমার বয়স বাহাত্তর বছর সাত মাস। আর কতদিনই বা বাঁচব আমি? যদি দীর্ঘায়ুও হই—তবু, জীবনের দীর্ঘতম অংশটা যে পার করে ফেলেছি—সে ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ নেই। বরং এতদিনের চেনা পরিবেশে যে বাকি জীবনটা কাটাতে পারব, এটা একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। এখানেই তো আমার মা, বাবা, স্ত্রী, নানান আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের স্মৃতি রয়ে গেছে—যারা জীবনের কোনো না কোনো সময়ে আমার হাত ছেড়ে দিয়েছে। সময় কাটানোর জন্য স্মৃতিরোমন্থনের চেয়ে ভালো আর কী আছে?
তবে প্রবাল আর সুচরিতার কথা ভেবে খারাপ লাগছে। বেচারিরা নিশ্চয়ই এই আশা নিয়ে আছে যে, আমি খুব দ্রুতই ওদের সঙ্গে যোগদান করতে চলেছি। কিন্তু তা যে আর কোনোদিন কোনোভাবেই সম্ভব নয়—সে কথা যদি একবার ওরা জানতে পারত… অবশ্য আজ না হোক কাল, জানতে তো সব কিছু পারবেই। আশা করি, ততদিনে ওরা নিজেদের সামলে নিতে শিখে যাবে। তা ছাড়া ওরা যেখানে গেছে, সেখানে একবার প্রবেশ করলে আর নিষ্ক্রমণের পথ নেই। সেই মর্মেই চুক্তি হয়েছে।
যারা পৃথিবীতে রয়ে গেল, তাদের অধিকাংশই খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। মুখে যে প্রকাশ করছে, তা নয়। তবে কথাবার্তায় একটা চাপা হতাশা তো ফুটে উঠছেই।
মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হচ্ছে সব চেয়ে ভালোটুকু অধিকার করতে চাওয়া, সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ সুযোগসুবিধাগুলো গ্রহণ করা, প্রতিটা ক্ষেত্রে অন্যদের থেকে নিজে অন্তত এক পদক্ষেপ এগিয়ে থাকা… সুতরাং উত্তরাধুনিক ওই মহাকাশ নগরীর নাগরিকত্ব না-পাওয়া যে তাদের দুঃখী করে তুলবে, তাতে আর আশ্চর্য কী?
তবে এদের জন্য এখনও আশা আছে। নতুন মহাকাশ নগরীগুলো তৈরি হয়ে গেলে আবার নাগরিকত্বের আবেদন নেওয়া শুরু হবে; তখন এদের মধ্যে অনেকে নিশ্চয়ই সুযোগ পাবে। তবে সেটা যে কবে হবে এবং পূর্বনির্ধারিত কোটা (যার মধ্যে অধিকাংশই রয়েছে শিল্পপতিদের জন্য—যারা এই প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে) পেরিয়ে যে কতজন সাধারণ মানুষ সুযোগ পাবে, সেটা যথেষ্ট চিন্তার বিষয়।
এদের অনেকেরই বদ্ধমূল ধারণা—রাষ্ট্রের যত অর্থ এবং প্রযুক্তি, সব এবার থেকে ওই মহাকাশ নগরীর উন্নতিকল্পেই ব্যয় হবে। আর আমাদের এই পৃথিবী বঞ্চিত হতে হতে একসময় চলে যাবে পরিত্যক্তের তালিকায়।
শেষ ধারণাটি যেমন পুরোপুরি সত্য নয়, তেমন একেবারে মিথ্যাও হয়তো নয়। পৃথিবীকে তো এখনও একেবারে বাতিল ঘোষণা করা হয়নি। এমনকি প্রত্যেক মহাদেশের সাম্প্রতিক বাজেটগুলো শুনেও বুঝলাম—যদিও নিজস্ব মহাকাশ নগরীগুলোর জন্য তারা বিপুল অঙ্ক বরাদ্দ করেছে (সেটা খুব একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার মোটেই নয়), তবু পার্থিব সভ্যতাকে একেবারে অপ্রাপ্তির খাতায় এখনও পর্যন্ত ফেলে দেওয়া হয়নি। স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার জন্য তো নতুন কিছু পরিকল্পনাও শুনলাম। যদিও, সেসব বাস্তবায়ন হতে এখনও বহু বাকি। তবে আমি এখনই এসব নিয়ে খুব একটা দুশ্চিন্তা করতে রাজি নই।
যেহেতু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা আর ক্রমহ্রাসমান প্রাকৃতিক সম্পদের কথা ভেবে, বিকল্প হিসাবে কৃত্রিম জনপদগুলো তৈরি করা হয়েছে—স্বভাবতই সেগুলো যথাসম্ভব স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। পৃথিবীর সাহায্য ছাড়াই তারা নিজের মতো চালিত হতে পারবে।
ঠিক স্পেস স্টেশনের ধাঁচে মহাকাশ নগরীর চারদিকে বিরাট বিরাট সোলার প্যানেল লাগানো আছে। সেখানে যেমন আছে মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে শক্তি এবং অক্সিজেন উৎপাদনব্যবস্থা, তেমনই আছে বর্জ্য জলকে ক্রমাগত পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার প্রযুক্তি। স্বভাবতই, এমন সভ্যতাকে আরও সমৃদ্ধ এবং ত্রুটিমুক্ত করে তোলার জন্য যে মহাদেশের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবানদের নিয়ে যাওয়া হবে—তাতে আর আশ্চর্য কী? এক্ষেত্রে যে একটা চাপা অন্তর্মহাদেশীয় প্রতিযোগিতার ব্যাপারও থেকে যাচ্ছে, সে কথাও তো অস্বীকার করা যায় না। প্রত্যেক মহাদেশই চাইবে—যেন তার উপনিবেশই প্রযুক্তি এবং প্রশাসনের দিক থেকে সর্বোত্তম হয়। এবং যাদের হাতে সেই দায়িত্ব দেওয়া হবে, তারাও চাইবে নিজের কাজের প্রতি যথাযোগ্য সুবিচার করতে। মানব-ইতিহাসে এমন সোনালি অবদান রাখার সুযোগ কি বারবার আসে?
আমি তো আজও নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি যে, আমিও সেই তালিকায় জায়গা পেয়েছিলাম! আমিও হতে চলেছিলাম এশিয়ার মহাকাশ নগরী ইন্দ্রপ্রস্থ ৪৬-এর একজন গর্বিত নাগরিক।
তবু, ভাগ্য এবং সক্ষমতা সুপ্রসন্ন থাকলেও—কেন যে আমি শেষ পর্যন্ত যেতে পারলাম না—সে কথা আমার সন্তানরা হয়তো কোনোদিনই জানতে পারবে না। শুধু সন্তানরা কেন? এই পৃথিবীর কেউই জানতে পারবে না। এই গোপনীয়তা যাতে শুধু আমার স্মৃতিতেই আবদ্ধ থাকে, আমি তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করব। আকাশের অসংখ্য তারার থেকে কোনো একটা খসে গেলে যেমন কিছুই আসে-যায় না—তেমন মানবজীবনের অগুনতি লুকোনো সত্যির থেকে কোনো একটা হারিয়ে গেলেও কালপ্রবাহে কিছুই প্রভাব পড়ে না। বরং কখনো-কখনো বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে কিছু ঘটনার চিহ্নটুকুও নষ্ট করে দিতে হয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে—যার গোপনীয়তা নিয়ে এত মাথাব্যথা, সেসব আবার লিখছি কেন? তার কারণ, নিজের কাছে একটা স্বীকারোক্তি থাকা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। যেহেতু আমি আমার জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই এই ডায়েরিতে লিখে রাখি, তাই এটাও লিখে রাখছি।
সুচরিতার নাগরিকত্ব পাওয়া নিয়ে যে আমি কতখানি দুশ্চিন্তায় ছিলাম, সে কথা যেমন এই ডায়েরিতে আগেও একাধিকবার লিখেছি; তেমনই সব চেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে এবং আমি আর প্রবাল নিজেদের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে প্রায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি—সেই সময় বিশেষ কোটায় ওর সুযোগ পেয়ে যাওয়া যে আমাকে কতখানি আনন্দ (এবং স্বস্তিও) দিয়েছিল—সেই অনুভূতিও সংক্ষেপে ব্যক্ত করে রেখেছি।
সুচরিতা গিয়েছিল দ্বিতীয় অন্তিম ফেরি—অর্থাৎ যাতে চেপে আমার আর প্রবালের যাওয়ার কথা ছিল—ঠিক তার আগের ফেরিতে। ক্রিতক ১৬ তার নাম। তখন আমরা দুজনেই সক্ষমতার শংসাপত্র পেয়ে গিয়েছি; প্রাথমিক অনুমোদনও হাতে এসে পৌঁছেছে। আমরা পুরোদমে যাওয়ার তোড়জোড় করছি। ব্যস্ততা তুঙ্গে। ঠিক সেই সময় আমি জানতে পেরেছিলাম এক গোপন তথ্য।
এ কথা আমরা সকলেই জানি যে, মহাকাশ নগরীগুলোর ধারণক্ষমতা সীমিত। ইচ্ছামতো সেখানে বাড়িঘর তৈরি করা তো চলবেই না; এমনকি সরকারি অনুমতি ছাড়া বাসিন্দাদের একটা গাছ পর্যন্ত লাগানোর অধিকার নেই… এবং যেহেতু সেখানকার পরিকাঠামো এখনও পরীক্ষামূলক স্তরে আছে, তাই একজনও অতিরিক্ত নাগরিক নেওয়ার ঝুঁকি কোনো সরকারই নেবে না। গোপন সূত্রে (নাম এবং পদ উল্লেখ করে তাকে আর নতুন করে বিড়ম্বনায় ফেলতে চাই না) আমি জানতে পেরেছিলাম—যেহেতু সুচরিতা যাত্রীতালিকায় হিসেব-বহির্ভূত নাম, তাই অবশ্যম্ভাবীভাবে সেই খামতি পূরণ করার জন্য আমাদের ফেরি থেকে ছেঁটে ফেলা হবে কোনো একজনকে।
প্রতিমুহূর্তে আমার আশঙ্কা হচ্ছিল যে, প্রবালকেই না ছেঁটে ফেলা হয়! তার সংগত কারণ ছিল এই যে, ইতিমধ্যেই সেখানে দুজন অতি দক্ষ অনাক্রম্যতাবিশারদকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আমি আর কোনো ঝুঁকি নিতে চাইনি।
চাকরি থাকার সুবাদে, তখনও আমাকে নিয়মিত পরীক্ষাগারে যাতায়াত করতে হত। সবার অগোচরে, নিজেকে আমি রেডিয়েশন চেম্বারে উচ্চমাত্রার গামা রশ্মির সান্নিধ্যে সম্পূর্ণ অসুরক্ষিত অবস্থায় রেখে দিয়েছিলাম। তাও চার দিন।
না, আমার অনুমান ভুল হয়নি। যাত্রা শুরুর ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা আগে যে চূড়ান্ত পর্যায়ের শারীরিক পরীক্ষা হয়—সেখানে আমার কোশে বিবিধ অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েছিল এবং তৎক্ষণাৎ আমাকে অকৃতকার্য ঘোষণা করা হয়েছিল।
আমিই কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম, যেন প্রবালকে এসব না-জানানো হয়! ওকে যেন বলা হয়, বিশেষ কারণে আমার যাত্রা কয়েকদিন পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং আগামী কিছুদিনের মধ্যেই নতুন ফেরিতে আমি যাত্রা শুরু করব।
আমি কৃতজ্ঞ যে, কর্তৃপক্ষ আমার এইটুকু অনুরোধ রেখেছিলেন! প্রবাল রওনা হয়ে গেছে। এখন আমার আর কোনো চিন্তা নেই। এমনকি সে যদি মাঝপথেও জানতে পারে যে, এই পৃথিবী থেকে আপাতত আর কোনো যাত্রীর যাওয়ার সম্ভাবনা নেই—তবুও তার আর কিছু করার থাকবে না।
সম্ভবত খুব শিগগিরই আমার শরীরে ক্যানসারের পূর্বলক্ষণগুলো দেখা যাবে। যাক। দীর্ঘ জীবন বেঁচে এসেছি আমি, অনেক খ্যাতি-যশ-সম্মান পেয়েছি, কল্পনাতীত সাফল্য দিয়েছে ভাগ্য আমায়। কোনো কিছু না-পাওয়া নিয়ে আমার আর সামান্যতম দুঃখও নেই। এমনকি আমি যদি আর কোনো কাজও না করি, তবে সঞ্চয়ের সুদে বাকি জীবনটুকু স্বচ্ছন্দে কেটে যাবে।
এবার আমি যতদিন বাঁচব, প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওই আম গাছটার নীচে গিয়ে বসব, কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে তারা দেখব, আম গাছে মুকুল ধরার অপেক্ষা করব আর আমার সন্তানদের সুখী ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা জানাব।
ডায়েরি: চার
নাম: লিপিকর ৫২
পরিচয়: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—স্বয়ংক্রিয়—কর্মক্ষম
স্থিতি: সক্রিয়
আমার অভ্যন্তরীণ Vehicle Updater জানাল, কিছুক্ষণ আগেই শেষ ফেরিটা চলে গেল। এতে চড়ে পৃথিবী ছাড়লেন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনেতারা। তাঁদের সঙ্গে গেল নির্বাচিত কিছু পারিষদ, কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ, মন্ত্রণালয়ের সব চেয়ে দক্ষ কিছু সচিব এবং আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ আমলা। নতুন জনপদে তাঁদের নতুন পদে পুনর্বহাল করা হবে।
তবে এই যাওয়াটা একটা গোপন মিশন। সাধারণ মানুষের পক্ষে তো আর Space Centre-এর ভিতরে ঢুকে কিছু দেখা সম্ভব নয়; আর অন্যভাবে মহাকাশযানের গতিবিধির খবর রাখা তো অসম্ভব। তাই এমনভাবেই এর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে যে, কেউ ঘুণাক্ষরেও এর কথা জানতে পারবে না।
ইতিপূর্বে প্রত্যেকটা মহাকাশযাত্রার ধারাবিবরণী সম্প্রচারিত হয়েছে। কখন উৎক্ষেপণ হল, কতক্ষণ চলল, যাত্রাপথে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটল কি না, কখন তারা পৌঁছোল—প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দেশ জুড়ে। অথচ এবারের কথাটা কাউকে জানতেই দেওয়া হল না! তারা প্রত্যেকে জানল, শেষ ফেরি চলে গেছে কিছুদিন আগেই।
যারা স্পেস স্টেশনে বসে ছিল এবং উৎক্ষেপণের জন্য প্রয়োজনীয় ধাপগুলো সম্পন্ন করল—তাদের বাদ দিলে, বিষয়টা শুধু জানলাম আমি—যার মধ্যে এই মিশনের প্রত্যেকটা ধাপ সম্পর্কে উপযুক্ত জ্ঞান এবং গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতা pre-install করে দেওয়া হয়েছিল কোনো একদিন।
তবে এই কর্মকাণ্ড নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহও নেই, উচ্ছ্বাসও নেই। আছে শুধু দায়বদ্ধতা। সত্যকথনের দায়বদ্ধতা।
বাস্তবে আমি ছিলাম এক কৃত্রিম পুনরুদ্ধারকারী। জাদুঘরে সংরক্ষিত পুরোনো scripture-গুলোর বৈদ্যুতিন অনুলিপি তৈরি করা এবং তাদের সম্পর্কে বিশদ রিপোর্ট তৈরি করাই ছিল আমার প্রধান কাজ; তা ছাড়া কোনো শিলালেখ দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে, কোনো চিত্রলেখর রং নষ্ট হয়ে যাচ্ছে—এসব অগ্রিম জানানও দিতে পারতাম আমি। আমার মডেল ছিল: Anulekhak 23, যারা প্রসিদ্ধ ছিল, তাদের ইতিহাসচেতনা এবং রং ও রেখার সূক্ষ্মতম তারতম্য চিহ্নিত করার সক্ষমতার জন্য।
তারপর, আজ থেকে বহু বছর আগে—একজন বিজ্ঞানী আমার programming এবং algorithm আমূল পালটে ফেলে, Sensory Circuit Board-এর চূড়ান্ত রদবদল ঘটিয়ে—আমাকে লিপিকর হিসাবে রূপান্তরিত করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, সভ্যতার অগ্রগতি এবং ধ্বংস পর্যন্ত ক্রমপরিণতি সংক্ষেপে নথিবদ্ধ করে রাখা। তিনি বুঝেছিলেন, মানুষের পক্ষে এই কাজ করা অসম্ভব। কারণ মানুষের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব করার একটা প্রবণতা আছে (যে কারণে, যে-কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাকে বিবেচনা করার জন্য কোনো একটা ইতিহাস বইয়ের বিবৃতিতে প্রামাণ্য হিসাবে মানা হয় না)। কিন্তু যন্ত্রের চেতনা এবং অনুভূতি যেহেতু সংজ্ঞাবদ্ধ, সেখানে হরমোনের অনিয়ন্ত্রিত প্রভাবও নেই আর অবচেতন নামক রহস্যময় সত্তাটাও অনুপস্থিত—সুতরাং, একমাত্র যন্ত্রই পারে যতদূর সম্ভব নির্লিপ্তভাবে গোটা সময়রেখার সারসংক্ষেপ ধরে রাখতে।
আমি সেই থেকে অক্লান্তভাবে নিজের কাজ করে চলেছি। এখনও পর্যন্ত কোনো গোলযোগ দেখা দেয়নি। তিনিও নিশ্চয়ই আমার কাজে খুশি ছিলেন। যে কারণে আমাকে reference বানিয়ে এই সিরিজ়ের আরও কিছু রোবট তিনি বানিয়ে ফেলেছিলেন এবং সেগুলো যথেষ্ট সফলও হয়েছিল।
মানুষের একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল—তারা যেমন কাছে টানতে পারে, তেমন দূরেও সরিয়ে দিতে পারে। আর এই কাছে টানা বা দূরে সরানোর ব্যাপারটা এবং এর সঙ্গে জড়িত কার্যকারণ সূত্রটা সাংঘাতিক অননুমেয়। এই কয়েক মাসে তো দেখলাম—কত মানুষ সব পিছুটান ফেলে রেখে, আনন্দ করতে করতে মহাকাশ নগরীতে চলে গেল। তারা একবারও ভেবে দেখল না যে, এই চিরস্থায়ী অনুপস্থিতির দরুন তাদের আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের মানসিক অবস্থা কী হতে পারে। বরং তাদের উৎফুল্লতা দেখে মনে হচ্ছিল, তারা বোধহয় প্রবাস শেষ করে নিজের দেশে ফিরছে।
যেমন আমার স্রষ্টার কথাই ধরা যাক। বিশ্ববিখ্যাত সেই Robotic Programmer—নতুন সভ্যতায় যিনি প্রশাসনিক কাজে সহায়ক যন্ত্রমানব তৈরির দায়িত্বে আছেন—আমাকে তিনি স্রেফ জঞ্জাল হিসাবে ফেলে রেখে গেছেন।
যেহেতু সপ্রাণ Commander বর্তমানে অনুপস্থিত, সেহেতু আমি আর চুক্তিমতো কাজ করতে বাধ্য নই (আন্তর্জাতিক রোবোটিক্স আইনের বাইশ নম্বর উপধারা: যদি যন্ত্রের আইনি মালিক মৃত হয় বা স্থায়ীভাবে তাকে ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়, তবে সেই যন্ত্রের উপর বলবৎ থাকা যাবতীয় মালিকানাধীন শর্ত অকার্যকর হয়ে যাবে)। তবু নিজের কর্মনীতিকে মর্যাদা দিতে আমাকে লিখে যেতেই হবে।
এ কথা সকলেই জানে যে, বিগত ষাট বছর ধরে আটটি মহাদেশের প্রচেষ্টায় পাঁচটি মহাকাশ নগরী নির্মাণ করা হয়েছে (এশিয়ার একটি, আফ্রিকার একটি, উত্তর আমেরিকা ও আন্টার্কটিকার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি, দক্ষিণ আমেরিকা ও আর্কটিকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি, ইউরোপ ও ওশিয়ানিয়ার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি) এবং আরও চারটির কাজ চলছে (এশিয়ার একটি ও তিনটি জোটশক্তির প্রতিটির একটি করে)। আশা করা যায়, শেষ চারটির কাজ বছর সাত-আটের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।
প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল, অন্তত এক লক্ষ মানুষকে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু নগরীগুলোর আনুষ্ঠানিক দারোদ্ঘাটন হয়ে গেলেও, এখনও পর্যন্ত সেগুলোকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হিসাবে ঘোষণা করা যায়নি। তার সংগত কিছু কারণও আছে। প্রথমত, আবাসনগুলো এখনও সম্পূর্ণ তৈরি নয়; দ্বিতীয়ত, কয়েকটা Oxygen plant-এ নগণ্য কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা যাওয়ায় বাতাসের ভারসাম্য সামান্য বিঘ্নিত হচ্ছে; তৃতীয়ত, মহাকাশ নগরীগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক গণপরিবহন হিসাবে যে স্পেস বাস চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, বিভিন্ন অন্তর্দেশীয় জটিলতার ফলে সেটা আপাতত স্থগিত রয়েছে।
আর তা ছাড়া, মহাকাশ নগরীর কাজ নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছুটা পরে শেষ হওয়ায় উপযুক্ত যাত্রী নিয়ে যাওয়ার সময়ও হয়নি। সম্ভবত ছেষট্টি হাজারের কিছু বেশি মানুষকে এখনও পর্যন্ত স্থানান্তরিত করা সম্ভব হয়েছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা কয়েকশো কোটি। অতএব, সাধারণ চোখে মনে হচ্ছে যে, পৃথিবীর জনসংখ্যা আদৌ কিছু কমেনি। রাস্তায় রাস্তায় এখনও একই রকম যানজট, দোকানে আগের মতোই ভিড়, চারদিকে অবিকল কোলাহল। তবে বিগত কয়েকদিনে দেখছি, মানুষের স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্য অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে। হয়তো যেতে না-পারার দুঃখ তাদের একটু বেশিই ভারাক্রান্ত করে তুলেছে!
এরই মধ্যে গতকাল থেকে সমস্ত যোগাযোগব্যবস্থা একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে। প্রথমে বিষয়টাকে কেউ অতটা আমল দেয়নি। এরকম Server Down বা Network error-এর ঘটনা তো আকছার ঘটেই থাকে। কিছুক্ষণ সমস্যা করে, তারপর আবার ঠিকও হয়ে যায়। কিন্তু এবার বহুক্ষণ পরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। ফলে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাই অনেকক্ষণ ধরে অচল! অক্সিজেন প্ল্যান্ট বন্ধ থাকায় হাসপাতালগুলো পড়েছে সব চেয়ে দুর্বিপাকে।
এখন জায়গায় জায়গায় এসব নিয়ে বিচ্ছিন্ন বিক্ষোভ হচ্ছে। যদিও অন্তর্জাল সংযোগ অকার্যকর হয়ে পড়ায় বিরোধীরা সেভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না, তবে রাস্তা দিয়ে নানারকম মিছিল ইত্যাদি যাচ্ছে। বোধহয় টেলিকম মন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করা হবে বা তথ্য ও সম্প্রচার দফতরে বিক্ষোভ দেখানো হবে।
ওরা জানেও না, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের এসব আন্দোলন, মিছিল ইত্যাদি নিরর্থক হয়ে যেতে চলেছে।
আমার মধ্যে একটা Disaster Presuming System আছে—যার মূল কাজ হচ্ছে ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদির মতো বড়ো কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আভাস নির্ণয় করা। সে আমাকে জানাচ্ছে: সেই প্রকাণ্ড গ্রহাণুটা—আজ থেকে সত্তর বছর আগে যার গতিবিধি নির্ণয় করা হয়েছিল এবং তার অব্যবহিতকাল পর থেকেই মহাদেশগুলো আরম্ভ করে দিয়েছিল মহাকাশ নগরী স্থাপন করার কাজ, যার আগমনবার্তা সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছিল বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর থেকে (বস্তুত গুটিকয়েক বৈজ্ঞানিক এবং রাষ্ট্রনেতা ছাড়া, আর সকলেই এই প্রকল্পের মূল কারণ সম্পর্কে আজও সম্পূর্ণ অন্ধকারে; তাদের মধ্যে যারা মহাকাশ নগরীর নাগরিক, তাদের কাছে হয়তো ঘটনাটাকে নিছকই এক মহাজাগতিক দুর্যোগ হিসাবে উপস্থাপিত করা হবে)—সে এগিয়ে আসছে দ্রুত বেগে। তার প্রভাবেই একে একে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কৃত্রিম উপগ্রহগুলো, আর ধসে যাচ্ছে Networking system—এতদিন যে মাকড়সার জালের মতো জুড়ে রেখেছিল গোটা পৃথিবীকে।
আর মাত্র কিছু সময়ের অপেক্ষা।
যেসব উড়োজাহাজ এই মুহূর্তে আকাশে উড়ছে, তাদের ধ্বংসাবশেষগুলো আছড়ে পড়বে মাটিতে; গ্রহাণু থেকে বিচ্ছিন্ন-হতে-থাকা টুকরোগুলো জ্বলন্ত উল্কা হয়ে বর্ষিত হতে থাকবে; আর তারপরই তার সঙ্গে চূড়ান্ত সংঘর্ষ হবে এই পৃথিবীর। মুহূর্তের মধ্যে সভ্যতা এবং প্রাণের শেষ অস্তিত্বটুকুও মুছে যাবে।
যে-কোনো যন্ত্রের মতো আমার মধ্যেও আছে Self sestroying mode, যার সাহায্যে আমিও নিজেকে যখন-তখন ধ্বংস করে ফেলতে পারি। ধ্বংস মানে অবশ্যই কোনো বিপজ্জনক বিস্ফোরণ নয়। নিজেকে স্থায়ীভাবে বিকল করে ফেলা। সুতরাং এই সংঘর্ষের আগে আমি অকেজো হয়ে যাব আর আমার এই দিনলিপিও হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে।
তবু সৌভাগ্যের বিষয় এ-ই যে, এত কিছুর পরও মানবজাতির একটা মেধাবী অংশ টিকে থাকবে। মহাকাশ নগরীর সুরক্ষিত বলয়ে তারা বহন করবে প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তার শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য; তারা আবার ওড়াবে সভ্যতার বিজয় নিশান, উন্নতি আর উন্নয়নের চাকা আবারও ঘুরবে তাদের ইশারায়; পরিব্যক্তির সূত্র মেনে তাদের উত্তরসূরিরা কালের বুকে খোদাই করবে আরও আশ্চর্য সব কীর্তিগাথা। হয়তো কৃত্রিম জনপদকেই তারা একদিন জীবনচক্রের সার্বিক মাধ্যম হিসাবে গড়ে তুলবে, এই সৌরজগতের পরিধি পেরিয়ে তারা পা রাখবে আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে; আর আমারই মতো অন্য কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা লিপিবদ্ধ করে রাখবে তাদের সেইসব অতুল কীর্তি।
ওই যে, আকাশ কালো হয়ে আসছে। গ্রহাণু থেকে ছিটকে আসছে জ্বলন্ত পাথরের টুকরো। একটা জ্বলন্ত হেলিকপ্টার ঘুরতে ঘুরতে আছড়ে পড়ছে বাড়ির ছাদে।
এসে গেছে শেষ সময়: অন্তিমকাল!
এই অন্তিমকাল পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে রাখাই ছিল আমার দায়িত্ব। আমি আমার কাজ করে ফেলেছি। এই পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য; এবং আমিও এবার আমার খাতা বন্ধ করছি। আবার যখন লক্ষ লক্ষ বছর পর এই পৃথিবী বাসযোগ্য হবে, আবারও জলবায়ু নির্মল হবে, আবার প্রাণের হাত ধরে সভ্যতা বিকশিত হবে—তখন নতুন যুগের ইতিহাস লিখে রাখবে সেই প্রজন্মের প্রতিভূরা। আমার দায়িত্ব শেষ।
এবার বিদায়।
Tags: কল্পবিজ্ঞান, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, শ্রীজিৎ সরকার