অনৈতিক
লেখক: বিশ্বদীপ সেনশর্মা
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ঘুম ভাঙার পর একটা হালকা আমেজ শরীরে-মনে লেগে থাকে। কিছুক্ষণ সেটা উপভোগ করে সুমন চোখ খুললেন। মারিয়াকে ডেকে বললেন কফি দিতে। তারপর ব্রাশে পেস্ট চাপিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলেন, মারিয়া শুকনো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁকে দেখে বলল, সামথিং রং…। আই কান্ট স্টার্ট দ্য কফি মেশিন।
সুমন কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, মেশিন খারাপ হবে হয়তো।
মারিয়া বলল, মনে হয় না। প্যানেল থেকে কোনো কমান্ড দেওয়াই যাচ্ছে না। আমি আভেনে চেষ্টা করলাম, সেখানেও একই সমস্যা।
তাঁর ঘরের প্রায় প্রতিটি জিনিস ইনটারনেটে যুক্ত। আজকাল নেটওয়ার্ক না-থাকার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য, তাই অধিকাংশ কোম্পানি খরচা বাঁচাতে মেশিনগুলির সফটওয়্যার তাদের সেন্ট্রাল সার্ভারে রাখে। তাই কানেকশন থাকা জরুরি।
তিনি মারিয়াকে বললেন বাকি গ্যাজেটগুলি চেক করতে। মারিয়া দেখে এসে জানাল, এসি, গিজ়ার, ফ্রিজ কোনোটাই কাজ করছে না।
তিনি শেষ চেষ্টা হিসাবে লিভিং রুমে গিয়ে দেয়ালের ডিসপ্লে অন করলেন।
সত্যিই নেট কানেকশন নেই দেখাচ্ছে। এরকম আগে কখনও হয়নি। শহরে কি বড়ো কোনো যান্ত্রিক গোলযোগ হয়েছে? কিন্তু সেটা বোঝা যাবে কী করে?
তিনি মোবাইল হাতড়ে তাঁর ফ্ল্যাটের অটোমেশন কোম্পানির নম্বর বার করে ডায়াল করলেন। কল লাগছে না। তাঁর মোবাইলও ওয়াই-ফাই রাউটারে যুক্ত, নেট কাজ না করলে সে-ও করবে না। বস্তুত, আজকাল রাস্তাঘাটেও কয়েক হাত দূরে দূরে ওয়াই-ফাই বসানো থাকায় সবাই তা-ই ব্যবহার করে, অন্তত শহরের মধ্যে মোবাইল টাওয়ারের বিশেষ দরকার পড়ে না৷
তাঁর মনে হল, তাঁর বাড়ির নেটওয়ার্ক কেউ হ্যাক করেনি তো? সেটাও প্রায় অসম্ভব। তাঁর নিজের কোম্পানিই দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নেটওয়ার্ক সিকিউরিটির দায়িত্বে আছে। একই উন্নত প্রযুক্তি তাঁর ফ্ল্যাটের নেটওয়ার্কেও।
এখন নীচে নেমে সাহায্য চাওয়া ছাড়া উপায় নেই। যদিও বাস্তবে কাজটা কঠিন হবে। তিনি নিশ্চিত, তাঁর গাড়িও কাজ করবে না। একমাত্র উপায় টাওয়ারে কারও বাড়িতে নক করে সাহায্য চাওয়া। কিন্তু এ ছাড়া অন্য উপায় নেই।
তিনি মারিয়াকে ব্যাপারটা বলে জামাকাপড় বদলে নিলেন। ফ্ল্যাটের দরজায় গিয়ে অ্যাকসেস কার্ড ছোঁয়ালেন। সবুজ আলোর বদলে কয়েক মুহূর্ত পরে ডিসপ্লে প্যানেলে মেসেজ এল, ইনভ্যালিড কার্ড। অ্যাকসেস ডিনায়েড।
দরজাটা ধরে প্রাণপণে টানাটানি করতে করতে তাঁর মনে হল, এটা হাই-সিকিউরিটি ট্যাম্পারপ্রুফ সলিড মেটালের দরজা। জোর করে খোলা বা ভেঙে ফেলা প্রায় অসম্ভব।
দুই
সুমনের সঙ্গে এই ফাঁকে আলাপটা সেরে নেওয়া যাক। সুমন একটি বিখ্যাত সাইবার সিকিউরিটি সংস্থার কর্ণধার। তাঁদের কাজ হল ক্লায়েন্টের নেটওয়ার্কে হ্যাকিং, ভাইরাস বা ম্যালওয়ার অ্যাটাক ইত্যাদির থেকে সুরক্ষা দেওয়া। কয়েক বছর আগে তাঁর প্রতিষ্ঠা করা এই সংস্থাটি এখন আকারে ও খ্যাতিতে বেড়েছে। বেশ কিছু নামি সংস্থার সাইবার নিরাপত্তার ভার তাঁদের হাতে। জনা কুড়ি ছেলেমেয়ে কাজ করে। সুমন নিজে এখন টেকনিক্যাল কাজের বদলে মার্কেটিং ও অন্যান্য ব্যাবসায়িক কাজেই বেশি সময় দেন।
আপাতত তিনি সোফায় বসে ফলের রস খাচ্ছেন। সামনে একটি প্লেটে কিছু ফল ও চিজ় রাখা আছে। তবে ওই সামান্য খাবারটুকু ছাড়া আর বিশেষ কিছু নেই। আজকেই মারিয়ার ফ্রিজ স্টক করার দিন ছিল।
সুমনকে দেখে অবশ্য বিশেষ উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে না। বরং খাওয়া শেষ করে তিনি গলা দিয়ে একটি তৃপ্তিসূচক আওয়াজ করলেন। মারিয়া এসে গ্লাস ও প্লেট নিয়ে গেল। তিনি সোফায় আধা হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন।
তাঁর অফিসে এখন কী হচ্ছে? ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই আসতে শুরু করেছে। তাঁর সুকন্যার কথা মনে হল। তাঁর টিমের সব থেকে তুখোড় ও বুদ্ধিমতী মেয়ে। সম্প্রতি তিনি ওকে প্রোমোশন দিয়ে নিজের এগজ়িকিউটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট করেছেন। তিনি ব্যাবসায়িক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাঁর হয়ে বিভিন্ন টেকনিক্যাল প্রোজেক্ট ও-ই দেখাশুনো করে। কোনোভাবে যদি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা যেত।
তিনি সোফা ছেড়ে উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন। অনেক নীচে কালো কালো চলন্ত ফুটকি দেখা যাচ্ছে। জনবহুল শহরের ঠিক মাঝখানে অভিজাত আবাসনে তিনি অসহায়ভাবে আটকে রয়েছেন ভেবে বেশ মজা লাগল। অফিস থেকে কেউ কি যোগাযোগ করতে আসবে? না-ও আসতে পারে। তিনি মাঝেমধ্যেই অজ্ঞাতবাসে চলে যান, মোবাইল অফ করে রাখেন। কেউ না এলে কী হবে? হ্যাকার যদি যোগাযোগ না করে, বহুদিন পরে কি পুলিশ এসে ফ্ল্যাট থেকে তাঁর কঙ্কাল উদ্ধার করবে? ভাবতে গিয়ে সুমনের মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। লোকে অকারণে ভয় পায়, তাঁর ক্ষেত্রে উলটোটা হচ্ছে। মন বলছে, কিছু একটা হবে।
এই সময় বিদ্যুৎচমকের মতো তাঁর মনে পড়ল, সুকন্যা কিছুদিন আগে তাঁর ও অন্য ডিরেক্টরদের ফ্ল্যাটে অফিসের সঙ্গে ভিপিএন কনেকশন দিয়েছে। এটি হ্যাক করা প্রায় অসম্ভব। ব্যাবসা সংক্রান্ত খুব সেন্সিটিভ তথ্য বা কথাবার্তার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। নেট না থাকলেও এটির কাজ করা উচিত।
তিনি প্রায় দৌড়ে গিয়ে বসার ঘরের দেওয়ালজোড়া স্ক্রিনে ভিপিএন আইকনটি ক্লিক করলেন। স্ক্রিনে প্রোটোকলের আদানপ্রদান শুরু হল।
একটু পরেই পর্দায় সুকন্যার মুখ ভেসে উঠল। তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। সুকন্যা উদ্বিগ্নভাবে বলল, হোয়াট হ্যাপেন্ড স্যার, আর ইউ ও.কে.?
তিনি দ্রুত সব বললেন। সুকন্যার চোখ কপালে উঠে গেল। সে বিড়বিড় করে বলল, এত সহজে হ্যাক করে নিল?
তারপর সে বলল, স্যার, আধ ঘণ্টা সময় দিন। দেখি, আইপি অ্যাড্রেসটা (আইপি হল ইনটারনেট প্রোটোকল, অনেকটা কম্পিউটারের ঠিকানা বলা যেতে পারে।) ট্রেস করা যায় কি না।
সে চলে গেল।
আধ ঘণ্টা পরে ফিরে এসে বলল, স্যার, যা ভেবেছিলাম, হ্যাকার অনেকগুলি প্রক্সি সার্ভারের আড়ালে আছে। এখন যে আইপি অ্যাড্রেসটা পাচ্ছি, সেটা ইউরোপের কোথাও। কিন্তু আসলে হয়তো এই শহরেই কোথায় আছে। তা ছাড়া এরা ঘনঘন আইপি বদলাতেও থাকে। আমি কি সরকারের সাইবার সেলের সাহায্য নিতে পারি? ওরা অনেক বেশি রিসোর্সফুল।
সুমন দাঁতের ফাঁকে হিসহিস করে বললেন, বোকার মতো কথা বোলো না। আমরা সিকিউরিটি সলিউশন বেচে খাই, জানাজানি হলে ব্যাবসা লাটে উঠবে।
সুকন্যা অপ্রস্তুত হয়ে চুপ করে গেল। তারপর বলল, ঠিক আছে স্যার, আমি নিজেই ট্রেস করছি। তবে সময় লাগবে। আমি অবশ্য ওকে যোগাযোগ করতে বলে একটা মেসেজও পাঠিয়েছি।
সুকন্যা চলে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পর্দায় একটি ছেলের মুখ ভেসে উঠল। তেকোনা মুখ, চাপা চোয়াল, চওড়া কপাল। বোধহয় চল্লিশের কাছাকাছি বয়েস হবে। মুখে একটা নির্লিপ্ত উদাসীন ভাব। তবে চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে। ছেলেটি হেসে বলল, ভালো আছেন স্যার? অনেকদিন পরে দেখা হল।
প্রথমে না চিনলেও ওই চোখ দেখেই সুমনের মনে পড়ে গেল। তন্ময়। যখন কোম্পানি চালু করেছিলেন, অনেকদিন তার সঙ্গে কাজ করেছে। তাঁদের বিভিন্ন প্রোডাক্টের বেসিক ডিজ়াইন ওরই হাতে করা। ছেলেটা অনেক দূর যেতে পারত। কিন্তু হঠাৎ একদিন সব ছেড়েছুড়ে কোথায় চলে যায়। এবং এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে বেমালুম গায়েব হয়ে যায়।
ওর বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীরা অনেক চেষ্টা করেও ওর খোঁজ পায়নি।
ভাবতে ভাবতে তাঁর হঠাৎ খেয়াল হল, তন্ময়ই তাহলে হ্যাকার। তন্ময় তাঁকে লক্ষ করছিল। সে লজ্জিতভাবে বলল, হ্যাঁ স্যার, কাজটা আমিই করেছি। আপনাকে একটু কষ্ট দিলাম ঠিকই, কিন্তু না হলে আপনি সমস্যাটা বুঝতেন না। আপনি একসময় হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিলেন, কিন্তু এখন দুনিয়া পালটে গেছে। আমার মতো হ্যাকাররা নিত্যনতুন কায়দাকানুন বার করছে। আমার মনে হয় আপনাদের আরও সাবধান হওয়া উচিত। তাই ভাবলাম, এইভাবে কাজটা করলে আপনি ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝবেন। আপনাদের সিকিউরিটি সিস্টেমে ঠিক কী কী সমস্যা রয়েছে, আমি আপনাকে পাঠিয়ে দেব। আপনাদের ওই সুকন্যা বলে মেয়েটি খুব স্মার্ট, ঠিক সামলে নেবে।
সুমন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তন্ময় হেসে বলল, স্যার, এটা আমার গুরুদক্ষিণা ধরে নিন। আপনার নেটওয়ার্ক ইতিমধ্যেই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছি আর নিশ্চিন্ত থাকুন, আমরা যে আপনাদের নেটওয়ার্ক ব্রিচ করেছিলাম—এ কথা কাকপক্ষীতেও জানবে না।
সুমন উঠে গিয়ে দরজায় কার্ড লাগালেন, দিব্যি কাজ করছে। মারিয়াকে কফি বানাতে বলে সুমন ফিরে এলেন। বললেন, তুমি ‘আমরা’ বললে… মানে তুমি এখন কোথায় কাজ করছ?
তন্ময় হাসল, বলল, আপনাকে বলতেই পারি। ‘আনএথিক্যাল’ বলে একটা সংস্থার নাম শুনেছেন?
সুমন চমকে উঠলেন। তাদের লাইনে ‘আনএথিক্যাল’-এর নাম কে না শুনেছে? শোনা যায়, এরা অর্থের বিনিময়ে নামিদামি কোম্পানির এমনকি সরকারেরও ওয়েবসাইট ও ডেটাবেস হ্যাক করে। তবে এরা কারা, কোথা থেকে বা কীভাবে কাজ করে—এই গোটা ব্যাপারটাই রহস্যে মোড়া। অনেক দেশের সরকার অনেক চেষ্টা করেও এদের খোঁজ পায়নি। এমনকি বাস্তবে আদৌ এদের অস্তিত্ব আছে কি না, তা নিয়েও অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখে তন্ময় মৃদু হাসল, বলল, হ্যাঁ স্যার, আমরা সত্যিই আছি। তবে যা শোনেন, সেভাবে নয়। খরচা চালানোর জন্য টাকা নিয়ে কিছু কাজ আমরা করি ঠিকই, তবে আমাদের আসল কাজ অন্য। আপনি তো জানেন, আজকাল সাইবার ওয়ার্ল্ডে রীতিমতো টাকার খেলা চলছে। এই শতাব্দীর শুরুতে ইনটারনেট সমাজের একটা শ্রেণির মানুষকে উঠে আসতে সাহায্য করেছিল। এখন ছবিটা পালটে গেছে। অধিকাংশ ওয়েবসাইট এখন আর ফ্রি নয়, যাদের পয়সা আছে, শুধু তাদের জন্য। যেন পাড়ায় পাড়ায় বিনামূল্যে লাইব্রেরি খুলে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ভালো বই পড়তে গেলে পয়সা চাই। এমনকি ফায়ারওয়াল, অ্যান্টিভাইরাস—এসবও বেশ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। সেই সঙ্গে যে-কোনো উন্নত পরিষেবা যেমন ইনটেলিজেন্ট সার্চ বা এআই বেস্ড অ্যাপ্লিকেশনও ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকার কিছু জিনিস ফ্রি-তে বা কম পয়সায় ব্যবস্থা করে দেয় বটে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
সে একটু থামল, তারপর বলল, প্রযুক্তির কল্যাণে এখন বহু সমস্যার সমাধান হয়েছে, প্রোডাকটিভিটি বেড়েছে, সরকারের হাতে অর্থের অভাব নেই। কিন্তু মানুষ তো দু-বেলা দু-মুঠো খেতে পেলে আর মাথার উপর ছাদ থাকলেই সুখী হয় না, সে চায় নিজের মতো করে ভালো করে বাঁচতে। এ যুগে ইনটারনেট, এআই বা সাইবার সিকিউরিটি এগুলো হল, জল-বিদ্যুৎ-রাস্তাঘাটের মতো, ওগুলো না পেলে মানুষকে আটকে থাকতে হয়।
তন্ময় একটু থামল, তারপর বলল, তো আমরা চেষ্টা করি, এই কোম্পানিগুলির দুর্বলতা ও ফাঁকফোকর খুঁজে বার করে তাদের উপর পলিসি পালটানোর জন্য চাপ দিতে। কখনও কাজ হয়, কখনও হয় না। তবে চেষ্টা করে যাই। অনেকে বলেন, আমরা না থাকলে নাকি অবস্থা আরও খারাপ হত।
সুমন অবাক হয়ে শুনছিলেন। বললেন, তোমরা… মানে… কোথা থেকে কাজ করো?
তন্ময় হেসে ফেলল। বলল, অনেকেই ভাবেন, আমরা কোনো নির্জন দ্বীপে ঘাঁটি গেড়ে কাজ করি। আসলে আমরা সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছি। যারা আমাদের মতো ভাবে, সেইরকম কিছু ছেলেমেয়ে। এদের অনেকেরই আলাদা সামাজিক পরিচয় আছে। আপনি শুনলে অবাক হবেন, কিছু দেশে উচ্চপদস্থ সরকারি আমলারাও আমাদের সাহায্য করেন। তবে আমাদের বিপ্লব করা বা ক্ষমতা দখল করে নেবার কোনো বাসনা নেই। কারণ ক্ষমতার স্বাদ পেলে মানুষ পালটে যায়। এভাবেই চলুক। তা ছাড়া আমাদের চিন্তাভাবনাই যে একশো ভাগ ঠিক তা-ই বা কে বলতে পারে? এটাও তো ঠিক যে সমস্যা সত্ত্বেও মানুষ গত কয়েক দশকে অনেক এগিয়েছে। যেটা দরকার তা হল ভারসাম্য বজায় রাখা। আমরা সেটুকু করতে পারলেই খুশি।
সুমন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছেন। তাঁর মনে পড়ছে, অনেক বছর আগে একটা একচিলতে ঘরে তিনি, তন্ময়, আরও কেউ কেউ টার্মিনালের সামনে ঝুঁকে পড়ে বসে আছেন। তখন স্বপ্ন দেখতেন কম খরচে সকলের সাধ্যের মধ্যে নেট সিকিউরিটির ব্যবস্থা করা। কিন্তু ব্যাবসা একটু বড়ো হবার পর দেখলেন ব্যাংক, শেয়ারহোল্ডার, সরকার সকলেই চায় লাভ, আরও বেশি লাভ। ব্যাবসায় টিকে থাকতে হলে সে দাবি মানতেই হবে।
তন্ময় একটু পর বলল, চলি, স্যার। আবার কখনও দেখা হয়ে যাবে। ভালো থাকবেন।
ছবিটা মিলিয়ে গেল। একটু পরেই সুকন্যা কল করল। উত্তেজিতভাবে বলল, স্যার, এই লোকটি একটি জিনিয়াস। আমি শেষ পর্যন্ত ওকে ট্রেস করেছি, কিন্তু লাভ হল না। কিন্তু ও দেখছি, রেস্টোর করে দিয়ে গেছে।
সুমন হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ।
সুকন্যা বিস্মিতভাবে বলল, কিন্তু কেন করেছিল? রেস্টোরই বা করল কেন? আপনাকে কি কল করেছিল?
সুমন বললেন, হ্যাঁ। সে অনেক গল্প। পরে কখনও বলব। এখন বলো, ওর আসল লোকেশন কি বার করতে পেরেছিলে?
সুকন্যা এবার ফিক করে হেসে ফেলে বলল, সে ভারী মজার গল্প, স্যার। আমারও প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। ও আসলে কাজ করছিল আপনার ফ্ল্যাট থেকে।
সুমনের মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল। সুকন্যা হাসতে লাগল। তারপর বলল, আসলে কিছুদিন আগেই ও নেটওয়ার্কে ঢুকে মারিয়ার ব্রেনে কিছু প্রোগ্রাম ডাউনলোড করে দিয়ে যায়। আমার ধারণা, সেটা আজ সকালে সক্রিয় হয়ে মারিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। তারপর নির্দেশ অনুযায়ী পুরো হ্যাকিং-এর কাজটা মারিয়াই করেছে। ও কোথা থেকে কবে কাজটা করেছিল, সেটা এখন বার করা প্রায় অসম্ভব।
সুমন একটুক্ষণ চুপ করে থেকে হোহো করে হাসতে শুরু করলেন। হাসি আর থামেই না। সুকন্যা সন্দিগ্ধ গলায় বলল, স্যার, আপনি কি এঁকে চেনেন?
সুমন হ্যাঁ ও না-র মাঝামাঝি একটা হাসি দিলেন। সুকন্যা বলল, স্যার, এঁকে আমাদের টিমে নিয়ে আসা যায় না? অনেক কিছু শেখা যেত।
তিন
শহরের বাইরের একটি বসতি। কিছুদিন আগেও এখানে বস্তি ছিল। এখন সরকার সবাইকে পাকা বাড়ি করে দিয়েছেন। জল, বিদ্যুৎ, চিকিৎসার ব্যবস্থাও আগের থেকে অনেক ভালো। অবশ্য শহরের মানুষ এখনও এদিকে বিশেষ আসে না।
রাত্রি দুই প্রহর। পাড়া ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু পাড়ার কুকুরগুলি হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে উঠছে। একটি আবাসনের দোতলায় এখনও আলো জ্বলছে। নীচ থেকে দেখা যাচ্ছে, জানালার কাচে ছায়া পড়ছে। তন্ময়ের দীর্ঘ চেহারাটা ল্যাপটপের উপর ঝুঁকে আছে। পিছনে মশারির মধ্যে তার স্ত্রী ও আট বছরের ছেলে সোহন ঘুমিয়ে আছে।
একটু পরে সে ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে এসে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। আজ আকাশে মেঘ নেই, তারাগুলি হাসিমুখে ফুটে আছে। দূরে শহরে আকাশ-ছোঁয়া আবাসনগুলির আলো দেখা যাচ্ছে। লক্ষ জীবন, লক্ষ আশা আকাশের তারার মতোই দপদপ করছে।
হালকা পায়ের শব্দ শোনা গেল। সে মুখ ঘোরাবার আগেই সোহন এসে তার পা জড়িয়ে ধরেছে। সে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। সোহম তার বুকে মুখ ডুবিয়ে রইল। একটু পরে প্লেনের শব্দ শুনে সে মুখ তুলে তাকাল। অনেক উঁচু দিয়ে একটা জেট প্লেন উড়ে যাচ্ছে, এগজ়স্ট থেকে সাদা ধোঁয়ার স্রোত বেরিয়ে তীক্ষ্ণ শলাকার মতো আকাশ চিরে দিয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য পুরোনো হয় না।
সোহন খুশির গলায় বলল, বিউটিফুল, না বাবা?
তন্ময় হেসে মাথা ঝাঁকাল। সোহন বলল, জানো বাবা, স্কুলে হিস্ট্রি ম্যাম বলছিলেন, অনেক বছর আগে নাকি কলের জল, আলো, টিভি, কম্পিউটার—এসব কিছু ছিল না। ভালো রাস্তাঘাট ছিল না। অসুখ করলে ওষুধ ছিল না। অনেকে পেট ভরে খেতে পেত না। ট্রু, বাবা?
তন্ময় মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ বাবা…।
সোহন দূরের আলো-ঝলমল আকাশ-ছোঁয়া শহরের দিকে হাত দেখিয়ে বিস্ময়ের গলায় বলল, আর এখন এইসব কে বানাল, বাবা?
তন্ময় হেসে বলল, সবাই মিলে… অনেকদিন ধরে…. একটু একটু করে। তবে কাজ ফুরোয় না।
তারপর সে সোহনের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল, তুমিও বড়ো হয়ে অনেক কিছু বানিয়ো, কেমন?
সোহন কী বুঝল, কে জানে। তবে খুশি হয়ে ঘাড় নাড়ল।
Tags: কল্পবিজ্ঞান, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, বিশ্বদীপ সেনশর্মা