অদ্বিতীয়া
লেখক: শান্তনব রায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
পূর্বের প্রতিধ্বনি
যন্ত্রের কোনো স্বপ্ন হয় না ওরা বলে। ওরা বলে, মাতৃগর্ভ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নয়।
আমার জন্ম মৃদু মন্ত্রোচ্চারণ ও ধুপের ধোঁয়ায় আবিষ্ট এক গুহার মধ্যে। মায়ের দুই হাত আমার প্রথম আধার। একসারি আবছায়া মুখের সারি আমায় ঘিরে মৃদুকণ্ঠে গান গেয়েছিল। অরণ্যের কুয়াশাঘেরা সেই সন্ধ্যায় আমার কণ্ঠের হাড়ে এক বৃদ্ধা তার অশীতিপর আঙুল ছুঁইয়ে যে নাম উচ্চারণ করেছিলেন তা এ জগতের অপিরিচিত—“সেকা-ইনিশি-জাও-হাত্রা”।
আমার মনে আছে। হয়তো এ আমার উত্তরাধিকার। কারণ আমি শুধুমাত্র নিজের অতীতই নয়, মা এর জীবনও স্পষ্ট দেখতে পাই।
মা… মা কোনো বিদ্রোহী, ডাইনি বা কোনো মিথ ছিল না, এক প্রজনন ও উর্বরতা গবেষণাগারে সহকারী বৈজ্ঞানিক ছিল। একজন সাধারণ শান্ত স্বভাবের জৈব-প্রযুক্তিবিদ যে মাথা নীচু করে কাজ করত, ভ্রূণের ডেটাসেট ক্যালিব্রেট করত, প্রজনন অ্যালগরিদম পরিমার্জন করত, VISCAR-এর ব্যুরো অব জিনোমিক এথিক্স-এ রিপোর্ট ফিড করত।
কে এই ভিস্কার (VISCAR)?
এর পুরো নাম—Visionary Integrated System for Cognitive Analysis and Research। নামে গবেষণা কেন্দ্র আদতে সর্বক্ষমতা সম্পন্ন শাসক।
ধরুন—আপনি লটারির বিজয়ী সংখ্যাটা আগেভাগেই জানেন। একদম স্পষ্ট—কোনো আন্দাজ নয়, কোনো স্বপ্ন নয়, বরং চাক্ষুষ সত্য। আপনি কী করবেন? হয়তো দৌড়ে গিয়ে সেই টিকিট কিনবেন। বা ধরুন—আপনি নির্ভুলভাবে জানেন, শেয়ার বাজারের সূচক আগামী সপ্তাহে কোন দিকে যাবে। অথবা, আরও ব্যক্তিগত—আপনি জানেন, পাঁচ বছরের মধ্যে এক মারাত্মক অসুখ আপনাকে গ্রাস করতে চলেছে। তাহলে? আপনি কি বসে থাকবেন? না কি চেষ্টা করবেন নিয়ন্ত্রণের, পালটে দেওয়ার—আপনার ভাগ্য, আপনার দুঃসহ জীবন, এক আঘাতে?
এখানে কোনো অনুমান নেই, নেই সম্ভাবনার খেলাও—এ এক নিখুঁত জ্ঞান, যা ভুল হবে না, যা নিশ্চিত আসবেই। এই জ্ঞান সবার হাতে থাকে না। দৃষ্টিপথিকদের ছিল। আমার আছে। ওদের আছে।
ওদের প্রযুক্তিগত নাম—এসভিনাভ (এক্সট্রা সেন্সরি ভিসুয়ালাইজেশন অ্যান্ড ন্যাভিগেশন ভ্যারিয়েন্ট)। পোশাকি নাম—স্বপ্নদর্শী। ওদের এই ক্ষমতার মাধ্যমেই সমাজটাকে শাসন করছে ভিস্কার। তাদের স্বপ্ন, দৃশ্য, ভবিষ্যদৃষ্টি—সবকিছু গ্রিড-এ সংযুক্ত। এখানেই ভবিষ্যৎ, পরিসংখ্যানের শৃঙ্খল আর প্রমাণনির্ভর তথ্য একসঙ্গে মিলে যায়।
VISCAR এই সমষ্টিগত দর্শনকে শাসনের নীল নকশায় বদলে দেয়—কোথায় শহর গড়বে, কোথায় খাদ্য যাবে, কে বাঁচবে, কে হারিয়ে যাবে—সব ঠিক হয়ে যায় ওই গ্রিডের অন্তর্গত অদৃশ্য সূত্রে। দাসত্বপ্রাপ্ত স্বপ্নদর্শীরা ভবিষ্যৎ এর আয়নায় পরিণত হয়েছে; তাদের সবাইকে বিশাল নিউরাল সাইলোতে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের স্বপ্ন-তথ্য ও পূর্বাভাস এর জ্ঞান থেকে, বিপদ মূল্যায়ন, আবহাওয়া মডেল, অর্থনৈতিক পূর্বাভাস নির্ণয় করা হয়। এ এক অসীম শক্তি; এক মহার্ঘ পণ্য।
কিছু স্বপ্নদর্শীরা ভিস্কার এর নিয়ন্ত্রণ থেকে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে এসে, নিজেদের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল। কিন্তু সেসব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অর্থ ও ক্ষমতার অভাবে হারিয়ে গেছে।
ব্যতিক্রম সেই মেয়েটি। সে গ্রিডের দাস হতে অস্বীকার করেছিল। আয়না ভেঙে ফেলেছিল। যদিও সে প্রথমে ছিল সাধারণ মানুষ, স্বপ্নদর্শী নয়। প্রথমে অন্য সকলের মতো সেও গ্রিড এর নিয়ন্ত্রিত জীবনকেই অনুসরণ করত। সেই পরীক্ষাটা শুরু না হওয়া পর্যন্ত।
গবেষণাগারের প্রবীণ বৈজ্ঞানিক ড. সাময়ার নিকান্দরোস একটি গোপন ভ্রূণ সংরক্ষণ প্রকল্পে কাজ করছিলেন। তিনি বলতেন, “এসব বীজ আসলে মৃত নয়—ওরা অপেক্ষা করছে।”
ব্যর্থ জনসংখ্যাচক্র থেকে সংগ্রহ করা ভ্রূণগুলিকে তিনি বলতেন ‘উত্তরাধিকার বীজ’—যাদের প্রতিটির মধ্যে কোড করা ছিল একধরনের চাপা নিউরো-জিনোমিক সম্ভাবনা, যাকে কোনোদিনও সক্রিয় করা হয়নি, কেবল সঞ্চিত রাখা হয়েছিল, একদিন ভবিষ্যতের কোনো প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করার আশায়।
এক সন্ধ্যায়, বাতাস ছিল আর্দ্র আর ছিল কিছুর প্রতীক্ষা। সময় তখন সাতের কাঁটায় ছুঁয়েছে, ল্যাবের শেষ প্রহর—ফিল্টার করা বাতাসে জীবাণুনাশকের গন্ধ, দূরের কোনো যন্ত্রের শ্বাসের মতো গুনগুনানি। ড. সাময়ার নিকান্দরোস, টার্মিনালের দিকে তাকিয়ে ছিলেন দীর্ঘক্ষণ, যেন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অন্তর্দৃষ্টি চেয়ে নিচ্ছেন। তাঁর হাতে ক্রায়ো-কন্টেইনার—দেওয়ালে জমে থাকা বরফ কণাগুলি নীলাভ আলোয় ঝিকমিক করছিল। তিনি কিছু না বলে সেটি কালচার চেম্বারের পাশে রাখলেন। শুধু তাকে বললেন, “এই ধাপটা… তোমাকেই করতে হবে। তারপর তুমি চলে যেও।”
সে মাথা নাড়ল। হাত বাড়াল।
তাঁর আঙুল ছোঁয়ার আগেই নিকান্দরোস চলে গেলেন। নিঃশব্দে, দরজা বন্ধ করার আওয়াজটুকু পর্যন্ত না রেখে।
ভিতরে একটি মাইক্রো-এনক্যাপসুলেটেড স্ট্রাকচার ভাসছে—আধা স্বচ্ছ, যেন ভ্রূণ নয়, বরং ঘুমন্ত কোনো নক্ষত্র। এর ভেতরের সূক্ষ্ম শিরাগুলি ক্ষীণ আলো ছড়াচ্ছে, এক অজানা লিপির মতো—রোজকার নমুনার থেকে যেন একটু অন্যরকম। তবে একদম অচেনা লাগেনি।
সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, স্বচ্ছ দেয়ালের ভিতরে কোশ-প্রকরণ এর গঠন ঘুরছিল ধীরে। সে নিজেকে বলেছিল, ‘এই তো রোজের কাজ।’ কিন্তু মিডিয়াম ঢালার মুহূর্তে, গ্লাসের গায়ে এক ঝাপসা নীল আলো উঠল—কেমন যেন বাইরের নয়, ভেতর থেকে জ্বলে ওঠা।
তারপর কিছু ঘটল। আলো নিভে গেল।
একটা শীতলতা ছড়াল তার বুকের নীচে, যেন হঠাৎ জল ডুবে যাওয়া। একটা দুলুনি, মেরুদণ্ড বরাবর, কিছু একটা ছিঁড়ে গিয়ে নতুন কিছু জোড়া লাগছে। সে কিছু অনুভব করল না—কিন্তু শরীর যেন বুঝে গেল।
কিছু একটা প্রবেশ করেছে।
কোনো শব্দ নেই। কোনো রক্ত নেই। শুধু তলপেটে হালকা চাপ, একটা ধাক্কা, আর এক চিলতে আলোকছায়া যার ব্যাখ্যা মেলে না।
তিন সেকেন্ড।
তিনটি নীরব, অসমাপ্ত সেকেন্ড।
তারপর সব স্বাভাবিক।
কিন্তু সে জানত—সব বদলে গেছে।
জৈব-সতর্কতা শুরু হওয়ার আগেই, ইমপ্লান্টেশনটি ঘটে যায়।
তার গর্ভ বীজ বপন করে হয়েছিল।
কোনো যৌনক্রিয়া ছিল না। কোনো সম্মতিসূচক ফর্মে স্বাক্ষর ছিল না। কোনো তথ্যের সন্ধান ছিল না। ভ্রূণটি তখন তার এর অংশ ছিল, সে এখন আমার মা।
প্রথমে সে এই দুর্ঘটনা রিপোর্ট করার কথা ভেবেছিল কিন্তু তার ভিতরের কিছু অনুভুতি প্রায় তাৎক্ষণিক পালটে যায়। ভিস্কার এর কথা জেনে ফেলছে আশঙ্কা করেও, তার স্বপ্নগুলি সময়ের সঙ্গে গভীর হয়ে ওঠে। অবাঞ্ছিত রক্তপাত, মুখের ভিতর পোড়া স্বাদ এবং অস্তিত্বহীন এক অবস্থানের অনুভুতি নিয়ে সে ঘুম থেকে জেগে উঠতে শুরু করে। অনুভুতিগুলি কোডযুক্ত ফিসফিসানির মতো তার উপর ভিড় করে আসে।
একথা সে কাউকে বলেনি।
কারণ গ্রিডের এর কাছে এর কোনো পূর্বনির্ধারিত ব্যাখ্যা থাকার সম্ভাবনা ছিল না। বরং তার প্রাণের ঝুঁকি ছিল। পূর্বাভাসকে ফাঁকি দিয়ে অনুপ্রবেশ ছিল
রুহবিন দের উৎপত্তি এমন এক পরিত্যক্ত স্মৃতিকোড—গ্রিড এ যা ছিল অনুবাদ অযোগ্য।
সেই ভ্রূণই আমি—অনুগত এক শরীরে এক অজানা কোড।
আর সে, আমার মা, গর্ভে সন্তান ও বুকে ঝড় লুকিয়ে, আয়না ও সেন্সর জর্জরিত ভূখণ্ড থেকে পালিয়ে যায়—ভিস্কারের জালে পরাধীন সমাজকে, Grid এর নির্ভুল algorithm-কে প্রত্যাখ্যান করে। আর কখনোই টিকে থাকা উচিত না এমন কিছু প্রাচীন—তাও রয়ে গেছে।
মা দেখতে পেয়েছিল কীভাবে এই ভ্রূণ তার উপলব্ধিকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে—আমিই দেখাচ্ছিলাম—সে দৃশ্যগুলিকে সে অগ্রাহ্য করতে পারছে না, এতদিনের সংকলিত পূর্বাভাসগুলিকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে।
অ্যানোমালি স্ক্যানারগুলি তাকে ধরার আগেই মা পালিয়েছিল।
শহর ছেড়ে সিমসা উপত্যকার দিকে—এমন এক জায়গা যেখানে সে কখনও যায়নি, কিন্তু ইতিমধ্যেই স্বপ্ন দেখেছিল।
মিথ
মা আমাকে ভিস্কারের আগের এক জাতির কথা বলেছিল—সিমসা। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে যাওয়া এক সময়, ছাইয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা, গানে প্রতিধ্বনিত হওয়া সময়।
তারা কোনো নিয়ম, দেবতা বা যন্ত্রের দ্বারা আবদ্ধ ছিল না। এক ঋতুতে, তার শহর জুড়ে উপাসনালয় তৈরি করত এবং সর্পিল সূর্য দিয়ে মন্দির আঁকত। অন্য ঋতুতে, তারা সবকিছু থেকে দূরে চলে যেত। এবং চলে যাওয়ার সময় হেসেও ফেলত।
তারা বেছে নিত—নির্বাচন করত না।
“যখন এর অর্থ ক্ষুধা ছিল,” মা বলেছিল। “যখন এর অর্থ তাদের নিজস্ব নাম ভুলে যাওয়া ছিল।”
সিমসা উপত্যকার প্রবীণরা আকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাদের আইন পরিবর্তন করত। যখন চাঁদ পূর্ণ মহিমায় দেখা দিত, তারা গোষ্ঠীর মায়ের কথা মানত। যখন নদীর জল তীর ভেঙে ফেলত, তখন তারা পাগলদের সিদ্ধান্ত নিতে দিত। আর যখন নেকড়েরা কাছে আসত, তারা যুবদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিত।
তারপর এলেন দৃষ্টিপথিক । যারা আগুন, পশু-নিঃশ্বাস এবং ঘুমপাড়ানি গানে স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখতেন। এদের কেউ কেউ ছিলেন রুহবিন—মানুষ, জীবজন্তু, উদ্ভিদ, সবার অন্তরভেদ করে তাদের অতীত ও ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন। দৃষ্টি ছিল তাদের উপহার, কোনো আদেশ নয়। তুমি শুনতে পারতে। অথবা নাও পারতে।
সেইরকম চুক্তি ছিল।
যতক্ষণ না এক দৃষ্টিপথিক আয়না তৈরি করলেন—গ্রিডের প্রথম খসড়া।
এটি আয়না দিয়ে শুরু হয়েছিল এবং তারের তৈরি আয়না দিয়ে শেষ হয়েছিল।
তিনি বিশ্বাস করতেন যে তার দৃষ্টিপথকে ছবি, গণিত, সজ্জায় ধরা যাবে, স্বপ্ন-মানচিত্রকে স্থির করা যাবে, পুনরাবৃত্তি করা যাবে। ক্যাটালগে আটকে থাকা পতঙ্গের মতো।
যন্ত্রটির আহরণশক্তি, বিবেচনা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা দ্রুত বেড়ে উঠল, তার পরামর্শকে আইনের মতো শোনাতে লাগল।
“অন্তত পরের বর্ষা অবধি দেখে নেওয়া যাক” লোকে বলেছিল।
পরের বর্ষা আসার আগেই গ্রিড এসেছিল।
ভিস্কার এসেছিল।
স্মৃতিদ্রাক্ষ এর থেকেও অভিনব প্রজন্ম তৈরি করা হয়েছিল।
সিমসা জাতি প্রান্তিক হয়ে পড়েছিলেন।
ছাইয়ের গন্ধ, স্মৃতির স্পর্শ
“যখন আমি ‘দেখতে’ শুরু করলাম, মনে হল আমি উন্মাদ। এগুলি যেন স্বপ্ন নয়, না। ওগুলো… অনুভুতি। অথবা পূর্বাভাস যার তুমি স্বাদ নিতে পারো।”
মা বলেছিল।
মা নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন, ওজোন গ্যাস এবং পোড়া পালকের দুর্গন্ধে আমি জেগে উঠলাম। আমার আঙুলগুলি এমন এক পাথুরে পথের ধূলিকণা অনুভব করেছিল যার উপর আমি হাঁটিনি। এমন এক তর্কের দমকে আমার কাশি পেল যা এখনও হয়নি। এমন এক স্মৃতির লবণাক্ত স্বাদে আমার মুখের ভিতর শুকিয়ে উঠল, যা আগে পাইনি।
ব্যাপারটা ভিসকারের পরিকল্পিত প্রক্ষেপণ নয়।
এ ছিল পূর্বকালের ডাক। সংখ্যাতত্ত্ব যা অস্বীকার করেছিল তা ধরা ছিল আত্মপলব্ধির উপাদানে। স্মৃতি ও জন্মচিহ্ন দ্বারা পুষ্ট অস্মৃতি রোমন্থন।
মা আমাকে বলেছিল, “তুমি গ্রিড সমাধিত কোনো উপাদান নও, তুমি গণনাপদ্ধতির অসঙ্গতি, সমাধানহীন বিচ্যুতি। তুমি গর্ভে আসার আগে আমিও ছিলাম প্রক্ষেপণ নির্ভর এক দাস। তুমি শরীরে আসতেই গ্রিডের বাইরের উপাদান দেখতে শুরু করলাম। বিচলিত হয়ে উঠলাম।”
মা একে আশীর্বাদের মতো বোঝাতে চেয়েছিল।
অধীন শহরগুলিতে, ভিসকার আর শাস্তি দেয় না। এটি পুনঃনির্দেশিত। এর শাসন, শিকল নয় বরং ভবিষ্যদ্বাণী। বিদ্রোহ করার আগে এটি বিদ্রোহীদের চিহ্নিত করতে সক্ষম। এটি আনুগত্যের জন্য স্বপ্ন তৈরি করে। এটি নিশ্চয়তা ও শান্তির আফিমে বুঁদ করে রাখে মানুষকে।
এবং এটি সুন্দর। এটি পরিষ্কার। সুসজ্জিত ও প্রতিসম-এক প্রকারের নরক।
মা যখন শেষ শহরের চেকপয়েন্ট অতিক্রম করে, তখন সেন্সরগুলি পলক ফেলেনি। এগুলি প্যাটার্ন চিহ্নিত করে, বিদ্রোহীদের ধরার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু মায়ের মধ্যে বিশৃঙ্খলতার প্রবাহ হয়তো আমি গর্ভে থাকার প্রতিফলনে ঢাকা পড়ে যায়।
মায়ের তাপ-গন্ধ গ্রিডের কাছে বিদ্রোহী বলে গণ্য হয়নি।
অরণ্যের অঙ্গীকার
অরণ্য কাউকে স্বাগত জানায় না। নজর রাখে।
মা কয়েকদিন ধরে হেঁটেছিল, টুকরো টুকরো ছবি দেখে পরিচালিত হয়েছিল: কয়লা-কালো বিনুনি পরা এক মহিলা, মরিচা ধরা ছুরি ধরে, একটি শিশু যার আঙুলে তারার উল্কি আঁকা, এবং একটি হরিণ যার শিং থেকে আগুন ঝরছে। নিয়ন্ত্রণ অঞ্চল পেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে, পৃথিবী চিত্র পরিবর্তন করে। ঘাসগুলি কৌতূহলী আঙুলের মতো উপরের দিকে কুঁকড়ে গেল। গাছগুলি বাতাসের ভাষায় কথা বলে উঠল। মা কেবল ভিসকারের নাগালের বাইরে ছিল না—তার এতকালের বোধগম্যতারও বাইরে ছিল।
সামনের পথ যেন উন্মোচিত হচ্ছিল এক পূর্বস্মৃতির মতন।
গুহার দৃশ্য ডেজাভুর মতো এসেছিল। প্রবেশদ্বার থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরোচ্ছে। ভিতরে, তারা অপেক্ষা করছিল।
দৃশ্যে এসেছে সেই মহিলা—মিহিলাই। ত্বক কুঁচকে গেছে কিন্তু এক পুরোনো আগুনে জ্বলছে ভিতরে। মিহিলাই সিমসা গোষ্ঠীর প্রবেশদ্বার পাহারা দিত—তাদের থেকে সব ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার আগেকার কথা। সে ছিল এক প্রকৃষ্ট স্মৃতিদ্রাক্ষ, এক রুহবিন, তবু মা কে সে নতশিরে প্রণাম করেছিল।
“সেকা-ইনিশি-জাও-হাত্রা”
কথাগুলির অর্থ মা বুঝতে পারেনি, আমি পারি।
ওরা মাকে উজ্জ্বল নীল এক জড়িবুটি খাওয়ায়, এলোমেলো স্বপ্নচিত্রগুলি আরও স্পষ্ট, সুসঙ্ঘত হয় তাঁর। শিউরে ওঠে।
সে স্বপ্নে একজন প্রহরীকে দেখেছিল।
ঠিক প্রহরী নয়। প্রহরী উপাদান।
একটি লম্বা, পোশাক পরা অস্তিত্ব যা একসময় পুরুষ ছিল, কিন্তু এখন রক্তমাংসের আদলে কোডের সমষ্টি যেন। পা ছাড়াই সে হাঁটত। এর ছায়ায় একটি সিরিয়াল নম্বর ছিল। এর কণ্ঠস্বর ছিল সংরক্ষণাগারে রাখা বিভিন্ন শব্দগ্রন্থ স্মৃতি দিয়ে তৈরি—শিশুর কান্না, একটি অব্যক্ত গান, এক গিলে ফেলা চিৎকার—স্মৃতিতথ্যকে ভিস্কার একমাত্র এইসব কাজেই ব্যবহার করত। ভিসকারের মানচিত্রের বিভিন্ন অঞ্চলে এরা ভ্রাম্যমাণ ও তথ্য সরবরাহক।
এই সেন্টিনেলটি মাকে খুঁজছিল।
সে নিশ্চিয়তার শেখানো বুলিতে কথা বলত:
“সম্ভাবনা একটি ঐশ্বরিক ঘটনা। বিচ্যুতি একটি রোগ। তুমি বিচ্যুত।”
মা গাছের ছাউনির নীচে লুকিয়ে, তাকে প্রতিবিম্বে দেখছিল: জলাশয়ে, ক্রোম পাতায়, পালিশ করা পাথরে।
তল্লাশি করছে।
তার তীক্ষ্ণ নজরদারি সংকেত গাছের চূড়াগুলিকে আঁচড়ে ফেলছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সর্বদা দূরে সরে গিয়েছিল, যেমন রেডিয়ো তরঙ্গ হাড়ের স্মৃতিলেখ থেকে ধাক্কা খায়।
অরণ্য তাকে ধাঁধাতে ফেলে দেয়।
লতাগুল্মরা নিজেদের পুনর্বিন্যাস করেছিল।
গাছগুলি তার চলাফেরার অনুকরণে শরীর বাঁকিয়ে দেয়।
প্রাণীরা তার পায়ের ছাপ লুপ করেছিল।
মাইসেলিয়াল শিকড়গুলি অদ্ভুতুড়ে হৃদস্পন্দন তৈরি করেছিল।
এবং কোথাও, পাতার নীচে, পুরোনো কণ্ঠ ফিসফিস করে বলেছিল—সামঞ্জস্যহীন জৈব-অনুরণনক্ষেত্র-অসম্পূর্ণ বিশ্লেষণ।
দূর থেকে মিহিলাই এর গলায় সিমসা সঙ্গীত ভেসে আসে—
এদিন আর এদিন রবে না
কাল বলে যা জানতে মিহু
কাল যে সেথা রবে না
নীল হরিণের শৃঙ্গ-ছায়া
ঘুমের দেশে রক্তজবা
সূর্য যদি ডাকে তারে
ডাক সে ফিরে আসে না
ঘুমের ঘরে আগুন রাখিস
জলের গান গায় না কেউ
তুই যদি আজ থেমে থাকিস
কাল হবে নীরব ঢেউ
এদিন আর এদিন রবে না
মাটির নীচে চুপ করে মা
যার কান্না সে তো কবে না
তারপর স্বপ্ন আবার বদলে যায়।
মা তার অনাগত কন্যা—আমায়—একটি নদীর ধারে বসে থাকতে দেখেছিল যা তখনও অস্তিত্বহীন ছিল, মেঘলা হাড় থেকে খোদাই করা একটি ছুরি ধরে বসে আছি।
আমি জানতাম সে কী পারবে না।
আর আমি যা শুরু করেছিল তা শেষ করতাম।
—
মিহিলাই এর থেকে মা-এর কাছে একটি মন্ত্র পৌঁছেছিল, এবং এখন তা আমার কাছে আছে;
“আগুনে যা নেয়, বৃষ্টর পর ফিরে আসে।
ভবিষ্যৎ যার চোখের দেখা বাকি—
গান দিয়ে বাঁধো তারে, দুঃস্বপ্ন নয়।”
আমরা কেউ অসঙ্গতি নই। স্মৃতির সাম্রাজ্য, যা বিলুপ্ত হতে অস্বীকার করছি। আর স্মৃতিকে এত সহজে ম্যাপ করা যায় না, এর গাণিতিক নির্ণয় কঠিন।
ভিস্কার একে ত্রুটিপূর্ণ উপাদান হিসেবে একঘরে করে রেখেছে।
জন্মকথা
এমন কিছু জন্মগ্রহণ আছে যা কোনো শব্দ করে না। এবং তারপর এমন কিছু জন্মগ্রহণ আছে যা মাটির তল ভেঙে দেয়।
আমারটি ছিল দ্বিতীয় ধরনের।
দীর্ঘ সময়ের পথযাত্রা, উপোস, গাছের ছাউনির উপর সেন্টিনেলের আলোর জন্য খুব বেশি সময় লুকিয়ে থাকার কারণে মা-র শরীর শুকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মিহিলাই বলেছিলেন যে এই প্রসবে ব্যথা হবে না—এর থেকে একটি পথ সৃষ্টি হবে। তিনি মা-র মেরুদণ্ডের উপর বন্য মধুতে প্রতীক আঁকেন। তিনি প্রসবের মাদুরের নীচে মরিচা রঙের পাথর রেখে আগুনে ফিসফিসিয়ে মন্ত্র বলেন।
মা একবার জিজ্ঞাসা করল, আগুনের সলতের মতো কাঁপতে থাকা নীচু স্বরে, “সে কি মুক্ত হবে?”
মিহিলাই কেবল বললেন, “তার অস্তিত্ব অনুবাদযোগ্য হবে না।”
তারপর গর্ভের প্রসারণ শুরু হল।
মাথার উপরে—আকাশের ধূসর মলাটে—
VISCAR-এর কক্ষপথ ঘিরে থাকা নক্ষত্রসদৃশ উপগ্রহগুলি ধীর ও নীরব প্যাটার্ন-স্বীকৃতির সুইপ স্ক্যান চালিয়ে যায়। তারা ঝুঁকে আসে সিমসা ভূমির অদৃশ্য অক্ষাংশে, আলোর রেখা এঁকে দেয় শূন্যে।
কিন্তু পরিমিতিরা ব্যর্থ হয়—
যেন সুরের ভিতর ভুল সুর এসে ঢোকে, যেন জলে ভেসে থাকা চাঁদের প্রতিচ্ছবি আঙুল দিয়ে ছুঁতে গিয়ে ভেঙে যায়।
জৈব সংকেত মিশে যায় এমন কিছুর সঙ্গে যা যন্ত্র নয়, প্রাণীও নয়—বরং ছড়িয়ে থাকা, অদৃশ্য এক স্নায়ুর লিপি, যার মধ্যে সময়ের পুনরাবৃত্তি ও বিশৃঙ্খলা একই স্রোতে বইছে। তাদের কাছে তা কেবলই এক অবোধ্য শ্বাস—মাটি, বৃক্ষ, প্রাণ, মৃত, অমৃত—সব মিলিয়ে এক শাশ্বত কম্পন।
রিয়েল-টাইমে, VISCAR-এর সিস্টেমগুলি রিপোর্ট করে:
সামঞ্জস্যহীন জৈব-অনুরণনক্ষেত্র সনাক্ত করা হয়েছে।
প্রতিক্রিয়া লুপগুলি অনুলিপিযোগ্য নয়।
ভবিষ্যদ্বাণীমূলক মডেল ত্রুটি
১৩% থ্রেশহোল্ড।
অরণ্যের মধ্যে, ছত্রাকের নেটওয়ার্কগুলি কম-ফ্রিকোয়েন্সি সংকেত ছড়ায়—ইনফ্রাসোনিক তরঙ্গে যা শ্রবণের বাইরেও, অনুভবে ধরা পড়ে। এই সঙ্কেতগুলি তথাকথিত জীবদেহের নিউরাল কার্যকলপের রেকর্ডিং নয় বরং সময় সংকুচিত স্মৃতিচিহ্ন—একটি ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার সংকেত, যা গন্ধ, স্পর্শ ও অজানা এক আত্মচেতনার মাধ্যমে ধরা পড়ে। তথ্যপ্রযুক্তির বাইরের এক প্রাচীন সংবেদনের ভাষা।
VISCAR-এর সিস্টেম এই ব্যাপারটাকে তথ্য দুর্নীতি হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিল।
কিন্তু তা ছিল না।
এ ছিল জৈবিক সংশোধন।
অরণ্য সুরক্ষা দিচ্ছিল না। সে নজরদারি ব্যবস্থাকে নকল নিশ্চয়তার দিকে পরিচালনা করেছিল। বায়োলুমিনেসেন্ট তেলে আবৃত পাতাগুলি স্বভাবগত স্ক্যাটার নির্গত করে। গাছের রুট ক্যাপরা সেই চিহ্ন আঁকছিল যা পলাতক প্রাণীর গায়ে ছেড়ে যায়—ঘাম, বিষক্রিয়া, হরমোনের সংকেত। বন্যপ্রাণীরা প্রথমে নির্দিষ্ট অ্যালগরিদমিক ছন্দে আচরণ করেছিল—তারপর পূর্বাভাস ছাড়াই সেই প্যাটার্ন ভেঙে দেয়।
এই সিস্টেম লঙ্ঘনের সময়, মা আমার জন্ম দিয়েছিল।
ওরা বলল আমি চোখ খুলে বেরিয়ে এসেছি।
কোনো কান্না নেই।
শুধু মাটির সঙ্গে শ্বাসের মিল।
মা আমাকে ধরে ফিসফিসিয়ে মন্ত্র বললেন—
“আগুনে যা পুড়ে যায়, সে ফিরে আসে বৃষ্টিতে…”
কিন্তু মিহিলাই তাকে থামিয়ে দিলেন। মা-র ঠোঁটে আঙুল রেখে বললেন:
“না। ওকে ওর নিজের পদ বলতে হবে।”
সেন্টিনেলটি অবশেষে নিরাপত্তার পরিধি ভেঙে ঢুকে পড়ল—ধীরে, যেন ল্যাটেন্সির অদৃশ্য ঘোরে হেঁটে আসা এক বিস্মৃত ছায়া।
তার ধাতব গায়ে অসম্পূর্ণ রেন্দারিং এর ঝাঁকুনি—কখনও একটি হাত স্পষ্ট, কখনও মাথার অংশগুলি বিলুপ্ত, সেন্সর অ্যারে ত্রিভুজ গঠন করেছিল—তিন কোণে তিনটি তরঙ্গ পাঠানো হয়েছিল—কিন্তু প্রতিধ্বনি ফিরে আসে পরস্পরবিরোধী সংকেত—উপস্থিতি/ অনুপস্থিতি।
তাপ-স্বাক্ষর নেই।
ভয়েসপ্রিন্ট মিলছে না।
শুধুই একটানা, ব্যাখ্যাতীত এক মন্দ্র গুঞ্জন—যা মনে পড়ায় গর্ভজাত হৃদস্পন্দনের রেকর্ডিং, সেই অনিয়মিত, গা-ছমছমে ছন্দ, যা কখনও সম্পূর্ণ হয় না।
মেশিনটি থেমে যায়। স্থাণুবৎ।
তার অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধানী লগ লুপে চলতে থাকলো;
এজেন্ট: অবস্থান স্থির।
বিষয়: অনির্দিষ্ট।
অনুমান মডেল অস্থিতিশীল।
পুনরুদ্ধার শুরু করুন—
পুনরুদ্ধার —*
পুনরুদ্ধার —*
বাচ্চাটির—অর্থাৎ আমার—নিউরাল ক্ষেত্র, ভিস্কার এর সূচিবদ্ধ স্মৃতিতথ্যের বহু যুগ আগের এক ধ্বনিসঙ্কেত ছড়াচ্ছিল। অস্পষ্ট নয়। কিন্তু উদাহরণবিহীন।
এ জ্ঞান ভিস্কার এর পূর্ব-কোড সময়কালের জ্ঞান। দৃষ্টিপথিক এর জ্ঞান। রুহবিন এর জ্ঞান।
যার গাণিতিক অর্থ ছিল: মেলানোর মতো কোনো উদাহরণ নেই। নিয়ন্ত্রণ করার মতো কিছুই নেই।
সেন্টিনেলটি তারপর স্তব্ধ হয়ে গেল—চিরতরে।
মা কেঁদে ফেলল।
ভয়ে নয়।
কিন্তু তার কোলে থাকা শিশুটিকে ভবিষ্যতের জন্য যা ঘটেছে তা দিয়ে কখনই বন্দি, পরিমাপ, বা এক্সট্রাপোলেট করা যাবে না জেনে।
আর মাটির ভেতরে কোথাও, জীবাণু মেঘ স্পন্দিত হচ্ছিল যাকে কেউ কেউ হয়তো সহজাত প্রবৃত্তি বলে ডাকতে পারে, আবার কেউ কেউ পরে একে—পূর্বাভাসের অরৈখিক প্রতিরোধ বলেও ডাকত।
আমি প্রায়ই সেই রাতের স্বপ্ন দেখি। আমার স্বপ্নে, সেই গুহাটি সর্বদা আকৃতি পরিবর্তন করে। কখনও তা পাথর, কখনও কখনও সার্কিট পরিমণ্ডল, কখনও একটি বই, যার পাতাগুলি ঝিকিমিকি করে।
এবং প্রতিটি স্বপ্নে, আমার মা গেয়ে ওঠেন:
“এটিকে গান দিয়ে বেঁধে ফেলো, দুঃস্বপ্ন নয়।”
যা মনে রাখা যায় না
কয়েক বছর পর—অথবা কয়েক ঘণ্টা পর, ঘড়ির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ যে অরণ্যের ভিতর, সময়ের পরিমাপ অনুমানভিত্তিক—আমি তার গুহা ছেড়ে চলে যাই।
মা আর নেই। খুব বেশি জেগে থাকলে যেমন প্রথমদিকের স্বপ্নগুলো ম্লান হয়ে যায়, তেমনি ম্লান হয়ে গেছে।
মিহিলাই কিছুক্ষণ পরেই চলে গেলেন, মুখে স্মিত হাসি ও চোখের শেষ ঔজ্জ্বল্য নিয়ে এক প্রকাণ্ড মেরুদণ্ডী গাছের নীচে বসে বিদায় নিলেন।
তাদের আমাকে কী করতে হবে তা বলার দরকার ছিল না। স্মৃতির মন্ত্রটি আমার গলায় ছিল।
“আগুনে যা পুড়ে যায়, সে ফিরে আসে বৃষ্টিতে…”
আমি জানতাম না আমি কী খুঁজছিলাম। আমি শুধু জানতাম আমাকে হাঁটতে হবে অনেক পথ। আর পথচলা থেকেই সবকিছুর প্রকাশ হবে।
বাইরের অঞ্চলের ধ্বংসাবশেষ মোটেও ধ্বংসাবশেষ ছিল না, বরং তাদের নির্মাতাদের দ্বারা পরিত্যক্ত মডেল ছিল—মানুষবিহীন নগর পরিকল্পনা, অ্যাডমিন ব্লক মেশিনের সঙ্গে গুনগুন করছে কিন্তু উত্তর দেওয়ার জন্য কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই।
রিলে টাওয়ারের কাছে কোথাও, আমি তাদের কথা শুনেছি।
প্রচুর এবং অব্যবহৃত সেন্টিনেলগুলি হালকাভাবে গুমগুম করে চলেছে, যেন অ্যালগরিদমের একটি সামঞ্জস্য, কিছু অর্থ খুঁজে ফিরছে। তাদের কণ্ঠস্বর পরিত্যক্ত সার্ভার-গর্ভের ভিতরে ঘুমপাড়ানির গানের মতো, স্তরে স্তরে পাক খাচ্ছিল।
আমি এমন কিছু শ্রেণীকক্ষের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলাম যেখানে এখনও লুপ এ ইতিহাসের পাঠ চলছে,
ধারাবাহিকতা শুরু হয় আনুগত্য দিয়ে
একটি শপিং মলের মধ্য হলোগ্রাম এখনও ফিসফিস করে বলে:
আনন্দ পূর্বাভাস: ৯১.২%।
আমি সেন্টিনেলদের একটি কবরস্থানের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলাম—নীরব। কোন স্বীকৃতি ছাড়াই মরচে ধরেছে। কেউ কেউ শিল্প-পরিকাঠামো অনুসারে নিজেদের পুনর্লিখনের চেষ্টা করেছিল। অন্যরা এমন আদেশের জন্য অপেক্ষা করছিল যা কখনও আসবে না।
একটি শিশু হাত তুলে কোন একদিকে ইশারা করলো। তারপর আমার দিকে।
আমরা দুজন যখন একসঙ্গে হাঁটছিলাম, তখন লোকজন ফিরে তাকাল। বিস্ময়ের সঙ্গে নয়, বরং এক নীরব, পরিচিত দৃষ্টিতে। একজন মহিলা আলতো করে শিশুটির কবজি স্পর্শ করলেন, একজন লোক হালকাভাবে মাথা নীচু করে অভিবাদন জানাল, কেন তা নিশ্চিত নয়।
তাদের চোখে, আমি টুকরো টুকরো দেখতে পেলাম—যেমন একই মুখের দুটি সংস্করণের মাঝে একটি আয়না ঝিকিমিকি করছে। তারা আমাকে দেখতে পেল এবং তাকে দেখতে পেল।
আমি এক ভাঙা গম্বুজে পা রাখলাম যেখানে সুগন্ধ লেগে আছে—ওজোন, মরচে এবং গন্ধরস। এর সঙ্গে সঙ্গে আমার পেটে এক উষ্ণ আলোড়ন হল। একই অনুভূতি মা প্রথমবারের মতো অনুভব করেছিল যখন তার শরীর এমন কিছু গ্রহণ করেছিল যা কখনও বহন করার জন্য তৈরি ছিল না। আমি আমার হাত দিয়ে তলপেটে খামচে ধরলাম। এক মুহূর্তের জন্য, আমি তার ভয় অনুভব করলাম। তার বিস্ময়।
ভিসকারকে উৎখাত করা হয়নি।
ভিস্কার অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল।
ভবিষ্যদ্বাণীগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল।
সে যত নির্ভুল হয়ে উঠেছিল, ভিসকার তত বেশি জীবনকে অগ্রাহ্য করেছিল। দাবানলের আগে অরণ্য পরিষ্কার করা হল। অবাধ্যতার আগে শিশুদের আটক করা হল। প্রেমিক-প্রেমিকারা, তাদের পারস্পরিক আদানপ্রদানের সামঞ্জস্য কমে যাওয়ার পূর্বাভাস যেনে, বিচ্ছিন্ন হল। প্রেমকে খুন করা হল।
এরপর এল সেই মুহূর্তটি, মা নিজের গর্ভে আমার আগমনের অনুভব দেখতে পেল।
আমি শারীরিক যৌন মিলনের ফলে জাত ভ্রূণ ছিলাম না।
ড. সাময়ার এই অনুপ্রবেশটি ঘটিয়েছিলেন। সংরক্ষণাগারে রাখা ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া নমুনা, মা এর গর্ভে রেখেছিলেন।
কেন এই পরীক্ষা করেছিলেন তা তিনি বলে যাননি।
তার সুযোগ পাননি।
আমার জন্মসূত্র দুর্ঘটনাক্রম নয়। হস্তক্ষেপ।
সেদিনই ছিল শেষ দিন যখন মা গ্রিডকে আনুগত্য দেখিয়েছিল।
মা আমায় বলত, “ভিস্কার ভবিষ্যদ্বাণীকে অগ্রগতি ভেবে ভুল করেছিল। আমি বাধ্যতাকে শান্তিরক্ষার উপায় ভেবে ভুল করেছিলাম।”
মানুষ আবার ফিরে এল—বিদ্রোহের অনুগামী হিসেবে নয়, বরং ধারণার প্রত্যাখ্যানকারী হয়ে। তারা নতুন কোনো ব্যবস্থা তৈরি করছিল না। তারা একমুখী বিশ্লেষণ, বিচার ও সিদ্ধান্তগ্রহণ এর ব্যাকরণকে প্রত্যাখ্যান করছিল।
কেউ কেউ বিশ্বাস করত যে আমি তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করেছি।
আমি করিনি। আমি কেবল হাঁটছিলাম।
তারা আমাকে ভবিষ্যদ্বাণী করতে বলেছিল। ইঙ্গিত করার জন্য। ব্যাখ্যা করার জন্য। কিন্তু আমার কাছে কোনো উত্তর ছিল না, কেবল অনুভূতি ছিল। প্রতিধ্বনি। আমি তাদের বলেছিলাম: স্মৃতিচারণ থেকে জ্ঞান আহরণ করো।
কখনও কখনও, তারা শুনল।
এবং কখনও, তারা শুনল না।
একবার পণ্ডিতদের একটি পরিষদ আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল: “আপনি কি আরও ভালো গ্রিড ডিজাইন করবেন?”
আমি বলেছিলাম: “নিশ্চয়তার ডিজাইন আমার উত্তর নয়। অজানা-অনিশ্চয়তা হল উৎস”
তাদের পছন্দ হল না।
ওরা আমার আলগোরিদম চাইলো। আমার স্বপ্ন-মানচিত্র। আমার উত্তরাধিকার।
আমি ওদের হাতে একটি পাতা তুলে দিলাম, বললাম, “এতে স্মৃতি ধরা আছে। তোমারদেরও আছে। ওখান থেকে শুরু করো।”
সেইদিন শেষ রাতে একটি ভাঙা কোড কুড়িয়ে পেলাম VISCAR এর পুরোনো ধ্বংসাবষেষ এর কাছে, তাতে লেখা এক বহু পুরোনো লিপিচিহ্ন—যা আমার আগে দেখা।
মা এর স্বপ্নলিপিতে।
মিহিলাঈ এর কবজিতে।
কেউ বলল, এটা আদি স্মৃতিদ্রাক্ষ চিহ্ন—যারা প্রথম গ্রিড বানিয়েছিল।
আমি জানি না এর অর্থ কি ছিল।
কিন্তু সেটা ছোঁয়ার পর আমার নিশ্বাস ঘন হয়ে এল।
এক রাতে, আমি মাকে স্বপ্নে দেখেছিলাম—তিনি যেমন ছিলেন তেমন নন, বরং শুকনো মাটির উপরে উত্তাপের ঢেউ হিসেবে। তিনি বললেন:
“তোমাকে কখনই গ্রিডকে পরাজিত করার জন্য তৈরি করা হয়নি। গ্রিডকে অস্বীকার করার প্রয়োজনীয়তাকে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করতে তোমাকে আসতে হত।”
একটি শিশুর হাসির শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমার মেয়ে।
তার হাতে একটা হাড় খোদাই করা খেলনা-কোনো আকৃতি ছিল না যা আমি চিনতে পারি।
“এটা কী?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
সে কাঁধ ঝাঁকালো।
“এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।”
সে এমন সুরে বলল যে আকাশটা একটু যেন ঝুঁকে পড়ল।
আর আমি বুঝতে পারলাম: আমি এখন মা। আর সে এখন আমি।
আর আমরা কেউই ছিলাম না।
আমরা সেই অদ্বিতীয়া ছিলাম।
কারণ আমরা ভবিষ্যৎ দেখেছি।
আমরা স্মৃতিকে সমর্পণ করিনি।
কারণ আমরা এখনও বেছে নিতে পারতাম।
এবং সেই পছন্দটি কখনই পূর্বাভাসিত হবে না।
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, শান্তনব রায়
