১৫০০৪
লেখক: সামি আহ্মাদ খান অনুবাদ: রাকেশকুমার দাস
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
দেউরিয়া সদর রেলওয়ে স্টেশন, উত্তর প্রদেশ
স্থানীয় সময়: 2100 Hrs
“যাত্রীগণ কৃপয়া ধেয়ান দেঁ, গোরখপুরসে চল কর, অলাহাবাদকে রাস্তে কানপুর জংশন তক জানেওয়ালি এক-পাঁচ-শূন্য-শূন্য–চার চৌরি চৌরা এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্ম চার পর আ রহি হ্যায়।”
অতি পরিচিত, হালকা বিহারী-টানের ঘোষণাটি শুনেই একটা আতঙ্ক যেন আমাকে গ্রাস করে নিতে লাগল। চারদিকে এলোমেলো পায়ের ভিড়, তেলচিটে নোংরা প্ল্যাটফর্মের মেঝে, পায়খানা আর বাদামখোলার তীব্র গা-ঘোলানো গন্ধ—এসবের মধ্যেও আমি যেন ভয়ে হতচকিত হয়ে গেলাম। একটা অদ্ভুত, অস্বাভাবিক কুয়াশা বা ধোঁয়ার পুরু আস্তরণ যেন ছোট্ট, ব্যস্ত রেলস্টেশনটিকে ঢেকে ফেলল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির লোকজনও এই ধোঁয়ায় ঢাকা পড়ে গেল। যেন একটা সাইরেন জোরে জোরে বাজতে শুরু করে দিলে আমার মাথায়।
গন্ধটা ঠিক সুবিধের ঠেকছে না।
আমার নাকের ডগাও যেন বিনাকারণে জ্বালা করে উঠল। হঠাৎ আমার দাদাজি’র পেল্লায় নাকের কথা মনে পড়ে গেল। তার কোলে বসে প্রায়ই দুই-আঙুলের মধ্যে গোল আলুর মতো নাকের ডগাটা নিয়ে খেলা করতাম। উনি প্রায়ই বলতেন, ডিং-আন-সিক। চোখের দেখা আর প্রকৃত বাস্তব—দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। দাদাজি’র কথাবার্তার সবকিছু সেভাবে মাথায় না ঢুকলেও তাঁর শান্ত, সুরেলা কণ্ঠ প্রায়ই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিত পরম শান্তিতে। ডিং-আন-সিক, দাদাজি’র বলা এই কথাটা কেবলমাত্র আমার স্মৃতিতে রয়ে গেছে তখন থেকে। এর অর্থ আজও আমি জানি না, তবে চিত্তাকর্ষক পুরোনো গানের সুরের মতো মাঝে মাঝে মনে উদয় হয়।
ধোঁয়াতে কিছুই প্রায় দেখতে পাচ্ছিলাম না। বারকয়েক পিটপিট করে চোখটাকে পরিষ্কার করে নিলাম।
সংশয়ে পড়লে চেনা-পরিচিতদের উপর ভরসা করতে হয়। বিশাল কাঁটাওয়ালা একটা ঘড়ি প্ল্যাটফর্মের অপর প্রান্তে টিকটিক করছে, বৃদ্ধ এক কুলি হাঁপাতে হাঁপাতে তার মাথার চারটে ঢাউশ সুটকেস ব্যালেন্স করছে আর সেই সঙ্গে দেখছে কিভাবে মেঝেতে এক পরিবারের পাঁচজন একটা ছেঁড়া কম্বলের মধ্যে গাদাগাদি করে রয়েছে। প্ল্যাটফর্ম থেকে কয়েক ফুট দূরেই প্রাচীন এক শিবমন্দির, সেখান থেকে আশ্বাসধ্বনীর মতো খঞ্জনির শব্দ ভেসে আসছে। আগুনের সামনে জড়ো হয়ে থাকা কিছু বৃদ্ধ মানুষের ছায়ামূর্তি আমার সামনেই দুলতে লাগল, তাদের চরস-প্রণোদিত দুলুনি কথক-নৃত্যের মতই মন্থর, নদীর স্রোতের মত লাবন্যমণ্ডিত লাগছিল।
সারা প্ল্যাটফর্ম জুড়ে অস্বাভাবিক একটা নীরবতা নেমে এল যেন। একটা ভাসমান বাষ্পের চাদর আমার চারপাশটা ঢেকে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাস্তববোধের শিকড়টাতেও যেন কামড় বসাল। চারপাশটা এতটাই নিস্তব্ধ হয়ে উঠল যে আমার কানে একটা মৃদু ফোঁপানির আওয়াজ ধরা পড়ছিল যেটা ক্রমে একটা গোঙানির রূপ নিল। এটা আমার মোটেই স্বাভাবিক বলে মনে হল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথাও সেই স্টেশনের ঘেয়ো, মাছিপড়া কুকুরগুলোকে দেখা গেল না। মনে মনে যুক্তি দাঁড় করালাম যে এই অদ্ভুত ধোঁয়াশা আর হিমশীতল বাতাসের ধাক্কায় বেচারারা হয়তো ইঁদুরদের গোপন, ভূগর্ভস্থ বাসায় আশ্রয় নিয়েছে।
ইঁদুর!
ইঁদুরের কথা মাথায় আসতেই দুটো কালো উলের মোজার ভিতর আমার ডান পায়ের পাতাটা যেন বিদ্রোহে কেঁপে উঠল। বিমর্ষ হয়ে চুপচাপ বসে থাকা মায়ের দিকে মাথাটা হেলিয়ে তার ভাবলেশহীন মুখটা এক ঝলক দেখে নিলাম। পথচলতি মানুষ মা’কে তন্বী, সুন্দরী বলে ভাবলেও আমার কাছে মা নেহাতই একজন ভয়ানক বাতিকগ্রস্ত মহিলা।
“এত তাড়াতাড়ি এখান থেকে কেন চলে যাচ্ছি আমরা বুঝলাম না।” নিজের প্রতিবাদ জানানোর জন্য ঘ্যানঘ্যান করাটা বন্ধ করতে পারার মতো বয়স আমার এখনও হয়নি। “থেকে গেলেই ভালো হত। তোমরা…”
ছুটিতে ঘুরতে এসে মাঝপথে এরকম ফিরে যাওয়ার মতো অত্যন্ত অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আমার বাক্যবাণ যেন আরও ঝলসে উঠতে চাইল, কিন্তু সেটা আর হতে পারল না। কারণ ততক্ষণে আমার বদমেজাজি বাবা ফিরে এসেছে তার টেকো মাথা আর চব্বিশ-ঘণ্টা গোমড়া হয়ে থাকা মুখটা নিয়ে। জানি না বাবার বিশাল ছয়-ফুটিয়া দৈত্যাকার চেহারাতে এমন কিছু ‘অবাঙমনসগোচর’ ব্যাপার আছে যার ফলে বাবার সামনে এলেই আমি কেমন যেন নার্ভাস হয়ে যাই। সারাক্ষণ গোল করে রাখা ঠোঁটটাও নিশ্বাসের সিগারেটের গন্ধ ঢাকতে পারে না। বেশ দেমাকি চালে আমাদের কাছে এসে আমার মাথায় একটা হালকা চুমু খেল, তারপর হাতে একটা সোহান হালুয়ার প্যাকেট ধরিয়ে দিল।
মা আমাকে সান্ত্বনা দিতে আমার কোমরে হাত জড়িয়ে আমাকে কাছে টেনে নিতে চাইল, আমি প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সরে এলাম। মায়ের হাতে আঁচড়ের বেগুনি দাগ চোখে পড়ল। বুঝলাম ফাউন্ডেশনের অনেক স্তর লেপে মা সেগুলোকে ঢাকার চেষ্টা করেছে। ছোটোভাই কবীর মায়ের বেনারসির আঁচলের তলায় নিজের মুখ লুকিয়ে রয়েছে। আমি একটু চোখটা মেলে আমার চারপাশের কুয়াশাময় আঁধার আর আমাদের পরিবারের এখনও নির্বাক থাকা সদস্যটিকে দেখার চেষ্টা করলাম। ওকে বেশিদিন আর চুপ করে থাকার কষ্ট সহ্য করতে হবে না, এখন বাচ্চারা খুবই দ্রুত বড়ো হয়ে ওঠে।
যেমনটা আমি বড় হয়ে উঠেছিলাম।
ডান পায়ের আঙুলের কাঁপুনিটা যেন আরও বেশি করে হতে লাগল। আমি অন্য পায়ের আঙুল দিয়ে বেশ কয়েকবার জোরে জোরে ঘষে দিলাম যাতে কাঁপুনিটা কমে। হঠাৎই আমার মনে হল এই ধোঁয়াশার স্বাদ কেমন সেটা জানা দরকার। তাই আমি মুখটা খুলে জিবটা ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে দিলাম। দাদাজি একবার লাল রঙের বালুবোরা সাপ ধরেছিল বাংলোতে, আমার মুখটা ঠিক যেন সেই সাপটার লেজের মতো লাগছিল। গঁদের আঠার সরু লেই-এর মতো সাপটার আছাড়িপিছাড়ি করার দৃশ্যটা যেন আমি চোখ দিয়ে গিলছিলাম। দাদাজি’র কথাতেই সাপটাকে করঞ্জীগাছের ডালে ঝুলিয়ে কেরোসিন দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল যাতে বাড়িতে কোনো অশুভ প্রভাব না পড়ে।
সাপটির পুড়তে থাকা আঁশওয়ালা চকচকে চামড়া, আগুনের আঁচে ফুটে গলে পড়তে থাকা তার চর্বি আর জ্বলন্ত চিতার টোকো গন্ধের স্মৃতিটা কোনোরকমে মাথা থেকে বের করে জিবটা লকলক করে আমি বেশ একপ্রস্থ ঝগড়া করে নিলাম ধোঁয়াশার সঙ্গে।
স্বাদটাও আমার সুবিধের লাগল না।
ডিং-আন-সিক।
প্ল্যাটফর্মটা ততক্ষণে খালি হয়ে গেছিল। ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেনটা অন্য প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে বেরিয়ে গেছিল, রক্তস্রাবের মতো পথে ফেলে রেখে যাচ্ছিল পায়খানা, আবর্জনা, ডিজেল আর কালো ধোঁয়া। যেন আহত এক যুদ্ধের ঘোড়া প্রবল যন্ত্রণায় নিজের দেহটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে জলের অভিমুখে, শেষবারের মতো।
হঠাৎ দূর থেকে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিবাণ যেন স্নাইপারের নিশানার মতো আমার ঘাড়ে এসে পড়ল আর নরম মাংসে গেঁথে বসল। প্রবল বিরক্তি আর ক্রোধের একটা দমকে আমার ভেতরটা যেন ঘুলিয়ে উঠল। আমার ভিতরে কী ঢুকল না ঢুকল সে বিষয়ে একটা ভয় যেন গ্রাস করে নিতে চাইছিল, আর আমি বার বার মাথা ঝাঁকিয়ে বর্তমানে ফিরে আসতে চাইছিলাম। রেললাইনের আলোটা ক্ষীণ থেকে ক্রমশ জোরালো হতে লাগল, তার হুইসিল যেন আমার কানের পর্দায় প্রবল বেগে আছড়ে পড়তে লাগল। আমি চোখ বুজে ফেললাম আর মনে মনে আকুল প্রার্থনা করতে লাগলাম এই ট্রেনটা যেন না আসে!
সেই ট্রেনটা আসেওনি।
২
গৌরী বাজার রেলওয়ে স্টেশন, দেউরিয়া, উত্তর প্রদেশ
স্থানীয় সময়: 2130 Hrs
WDM-3A ইঞ্জিনের ট্রেনটার গতি ধীরে ধীরে কমতেই সেখান থেকে লাল ঝলমলে একটা ঢেউ, সঙ্গে একরাশ ধূলিকণা আর বিরক্তিকর উন্মাদনা—একসঙ্গে বেরিয়ে এল ভোঁস করে। চৌরি চৌরা এক্সপ্রেসের গতির সঙ্গে বায়ুপ্রবাহের গতিপথ আর থুতু ফেলার কোণ সব মিলিয়ে মুখ থেকে ছোড়া একদলা পানের পিক মিশ্রিত থুতু হাওয়ায় ঘুরে এসে লাগল মাঝ-চল্লিশের এক গড়পড়তা চেহারার ব্যক্তির জামায়।
“আরে বেহেনচোদ!”
মাড় দেওয়া আকাশি রঙের জামার চেরা স্থানের উপর লাল রঙের ছোপ সংক্রমিত হতে দেখে রামনাথ সিং একেবারে যেন ফেটে পড়ল হাজারটা কদর্য শব্দের বিস্ফোরণে। এই ঠাসাঠাসি গোন্ডাগামী ট্রেনের চালকের কামরায় পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এক যুবক, সিংজির বিরক্তি দেখে অট্টহাস্য করে উঠল সে।
অমর ফ্র্যাংকলিন হল রামনাথ সিং-এর কো-পাইলট, চেহারা স্থূলকায়, বয়স চব্বিশ হবে। সে-ও রামনাথ সিং-এর মতোই একই পোশাক পরেছিল, তবে তার এক সপ্তাহের না-কাটা দাড়ি আর চোখের তুলনায় বেঢপ একটা চশমায় তাকে অনেকটা অগোছালো দেখাচ্ছিল।
“আর-বি বাবু, তুমি নামেই রাজস্থানের লোক আছ মাইরি, আসলে দেখছি তুমি আমাদেরই ভাই, পাক্কা এলাহাবাদি! সারা ইন্ডিয়া জুড়ে এই পান খাওয়ার অভ্যেসটা বন্ধ বন্ধ করার কোনো প্ল্যান আছে কি?”
“বন্ধ করব যেদিন তুই লেডিজ দেখলে সিটি মারা বন্ধ করবি।” কিছুটা থুতুর সঙ্গে কথাগুলো ছিটকে বেরল।
অমর মনে হল বেশ মজা পেল।
রামনাথ সিং বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুই তো এখনও প্রোবেশনে আছিস, চাকরি পাকা না হওয়া অবধি মুখ সামলে থাকবি শালা।”
তার মেজাজ আগে থেকেই বিগড়ে ছিল। খারাপ আবহাওয়া, চাকরির প্রতি বিতৃষ্ণা আর পারিবারিক ঝামেলা—এতকিছু সামলানো একজন কর্মক্লান্ত, প্রাপ্যের তুলনায় কম বেতনপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরের কাছেই সাধ্যের বাইরে ছিল, এই ইঁচড়েপাকা জুনিয়ার তো কোন ছার!
রামনাথ ভেবে দেখল অমর তাও রেল কোম্পানির এমন একটি জায়গায় কাজ করে যেটাকে সে তার নিজের জায়গা বলে ভাবতে পারে, অথচ সে পারে না। নিজের পরিবারের কাছাকাছি থাকার যাবতীয় প্রচেষ্টার ফল একেবারে শূন্য। একাধিকবার সে উত্তর-পশ্চিম রেলওয়েতে ট্রান্সফারের জন্য আবেদন করেছে, যাতে সে তার পিতৃপুরুষের গ্রামের কাছাকাছি থাকতে পারে। গোরখপুরের তেলমাখা বাবুরা সব একেকটা দুমুখো সাপ, “মিষ্টির খরচ” জাতীয় সবরকমের আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও তার আবেদন ওপর মহলে পাঠিয়েছে কি না সন্দেহ! উপরন্তু তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করে যেন সে একটা ফেঁসে যাওয়া ফুটবলের মতোই অপ্রয়োজনীয়।
তবে এই ফুটবল বাস্তবে এখনও ট্রেন চালায়।
পিত্তের মতো একটা তিক্ততা গলায় উঠে এল, সিংজি সেটাকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। জীবনের ভুল সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে পস্তানোর সময় নয় এটা। তার দক্ষতা, কার্যকারিতা আর সজাগ-সতর্ক থাকার উপর অনেক মানুষের জীবন নির্ভর করছে। চেয়ারের হাতলে একটা চাঁটি মেরেই সে পারিপার্শ্বিক জগতে মন দিল। মনে হল চালকের কেবিনের সবুজ তেলচিটে অভ্যন্তর, তৈলাক্ত যন্ত্রপাতির স্তূপ আর নোংরা মিটারগুলো যেন এতক্ষণ তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। মিটারের কোনো কাঁটাই সতর্কতার লাল অঞ্চলে পৌঁছায়নি, কোনো অ্যালার্মও বেজে ওঠেনি, সংঘর্ষের কোনো বার্তা শোনা যায়নি—এমনকি ট্র্যাক পরিবর্তন হওয়ার কোনো সংকেতও আসেনি। সিংজি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা আর নিজের কাজে মনোনিবেশ করাটাই তাকে স্বস্তি দেয় বরাবর। মানুষের মন আর বদলির আবেদন—দুটো বড়োই অনিশ্চিত, কখন কী হবে বলা যায় না, বরং যন্ত্ররা মোটেই সেরকম নয়।
সিংজি চালকের জানলা দিয়ে মাথা বের করে পরের সিগনালটা দেখার চেষ্টা করল। তেমন কিছু দেখতে না পেয়ে আর ক্রমশ ঠান্ডা বাড়তে থাকায় বেশ শঙ্কিত হয়ে উঠল। পাশের আসনে তাকাতেই দেখতে পেল অমর বসে বসে তার নতুন কেনা মোবাইলে খুটখাট করছে।
হঠাৎ একটা বিড়ি ধরানোর প্রবল ইচ্ছা পেয়ে বসল তার। কর্তব্যরত অবস্থায় এই সব খেলে যেকোনো সময়ে ওপর মহল থেকে চিঠি চলে আসতে পারে, এমনকী সে সাসপেন্ডও হয়ে যেতে পারে। বড়োজোর একটা পান খাওয়া যেতে পারে। মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল, তখনই এই উৎকৃষ্ট, বা নিকৃষ্ট—চিন্তাটা তার মাথা থেকে বেরল। বাইরে গিয়ে ধোঁয়াশা মেশানো বায়ুটাই আপাতত সেবন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে।
“এই অমর,” নিরুত্তাপ মুখে বলল, “মেয়েদের পরে হোয়াটস্যাপ করবি, এখন ওঠ, কন্ট্রোলে বস। আমার প্রকৃতির ডাক এসেছে।”
মোবাইল ঘাঁটায় এহেন ছেদ পড়ায় অমরের চোখেমুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। বিড়বিড় করে যেন কিছু উচ্চারণ করল। তবে সিনিয়র অফিসারকে অসম্মান করার ছেলে সে নয়, বিশেষ করে যাকে সে গুরু বলে মানে। সে তড়াক করে উঠে সিংজির থেকে ওয়াকিটকিটা নিয়ে নিল আর নিজের হাতে ট্রেনের হাল ধরল। সিংজি ততক্ষণে বাঁদিকের দরজা সরিয়ে তার লাল হয়ে যাওয়া তৃষ্ণার্ত মুখ ভরে কয়েক ঢোঁক ধোঁয়াশা পান করে ফেলল।
শীতল, স্বচ্ছ বাতাস দেহে প্রবেশ করতেই তার মনে হল তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো যেন সতেজ হয়ে উঠল, অনেকটা বল পেয়ে গেল যেন। ফুসফুসটাও অনেক হালকা হয়ে গেল যেন। এক মুহূর্তের জন্য তার মনটা যেন শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেল। অজানা দিগন্তের পানে চেয়ে রইল তার চোখ। পাশের লাইনেই সার বেঁধে মানুষ পায়খানা করছে সেটা ভ্রুক্ষেপই করল না।
সুতোর জটের মতো একটা বিদ্যুতের ঝলক যেন এসে পড়ল দূরান্তের ধোঁয়াশার মধ্য থেকে। সিংজি চিৎকার করে উঠল, ভারসাম্য হারিয়ে পড়েই যাচ্ছিল প্রায়। বিদ্যুতের চমকের মতোই আকাশে যেন চিড় ধরে যাচ্ছিল।
তার পর আর কিছু দেখা গেল না।
সিংজি চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ঠিক বুঝতে পারছিল না যা দেখেছে তা ঠিক দেখেছে কি না। দূরের সাদা শূন্যতায় ঠায় তাকিয়ে রইল, যতক্ষণ না চোখ টনটন করে উঠল। নাঃ আর কিছু দেখা গেল না। শেষমেশ ভুল দেখেছে ভেবে নিয়েই মনে মনে কয়েকটা গালিগালাজ দিয়ে নিল। সে একজন ক্লাস ২ স্তরের চালক, যাত্রীবাহী এবং পণ্যবাহী—দু’রকম ট্রেন মিলিয়ে, ইলেকট্রিক হোক বা ডিজেল ইঞ্জিন, দেশের ১৬টি অঞ্চল জুড়ে পঁচিশ হাজার ঘণ্টা চালানোর অভিজ্ঞতা আছে তার ঝুলিতে। এরকম ধোঁয়াশা, প্রবল বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, তুষারপাত, গনগনে লু—সবরকম প্রতিকূল আবহাওয়াতেই ট্রেন চালিয়েছে সে। কিন্তু এই বারেরটা সম্পূর্ণ আলাদা। ধোঁয়াশা হঠাৎ এত তাড়াতাড়ি কীভাবে কেটে গেল আর কেনই বা প্রতি মুহূর্তে ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছিল বাতাস—যেন আরেকটু হলেই ধূসর, গাঢ়, হিমশীতল সুপে পরিণত হতে চলেছিল—এটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না।
সিংজি রাগে গজগজ করে উঠল। ধোঁয়াশা মানেই আরও দেরি। আবার দেরি!
যাত্রীদের রাগ হলে কিছু করার নেই, তারা এসে দেখুক এই দমবন্ধ করা আবদ্ধ স্থানে ঘাম, প্রস্রাব আর ডিজেলের গন্ধ নিয়ে কীভাবে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। তাও কীসের জন্য? কোনোমতে পেটের জন্য রুটি জোগাতে?
সিনিয়র সিংজির থেকে অমরের আজকের শিক্ষণীয় লাইন হল, চুলোয় যাক রেলওয়ের বাবুরা, চুলোয় যাক যত অফিসার।
দিনের শুরুটা কিন্তু এমন ছিল না, সিংজির মনে পড়ল। কয়েক ঘণ্টা আগেই সূর্যটা শুকনো হলুদ কিসমিসের মতো আড়মোড়া ভাঙছিল। বিধ্বস্ত দিগন্তে ছিল বাদামি আভা। পায়ে হেঁটে ছ’বছরের ছেলেকে বাসস্টপে দিয়ে এসেছিল সে। একটা হলুদ ডেইজি ফুলের রঙের স্কুলবাস, যার গায়ের লাল স্টিকারে হর্ন না বাজানোর হুঁশিয়ারি, ছেলেটিকে নিজের পেটে চালান করে নিয়ে চলে গেছিল। ফেলে রেখে গেছিল একটা চাপা ঘড়ঘড় ধ্বনি আর তীক্ষ্ণ চিৎকারের হালকা রেশ। সন্ধেবেলা ডিউটিতে যাওয়ার আগে একটু বিশ্রাম নিতে সিংজি বাড়ি ফিরেই একটু ঘুমিয়ে নিয়েছিল। রাত নামতেই শহর যেন অদ্ভুত একটা ধোঁয়াশার সঙ্গে হাড়কাঁপানি ঠান্ডার কবলে পড়ে গেল। বাড়ি থেকে স্টেশনে আসতে অন্য দিন কুড়ি মিনিটের বেশি লাগে না, আজ পাক্কা একঘণ্টা লেগে গেল।
ট্রেনটি ঝাঁকুনি দিয়ে লাইন পরিবর্তন করতেই সিংজিও চটকা ভেঙে বর্তমানে ফিরে এল। আরেক প্রস্থ লাল পিক ফেলে জামাটা ঝেড়ে নিল। নাও এখন কুয়াশাও সামলাও।
কোনো ঘটনা ছাড়াই কিছুটা সময় কেটে গেল। চারপাশ ততক্ষণে অনেকটাই ঝাপসা হয়ে এসেছে। ১৫০০৪ ট্রেনটি ধীরে ধীরে লাইন ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল। সিগনালগুলি পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল করল যে সেগুলো হঠাৎ লাল হয়ে গেল। সিংজি আবার কেবিনেই ফেরত চলে আসছিল, কিন্তু ইঞ্জিনের অবিরাম কানে তালা লাগানো হট্টগোল ছাপিয়ে হালকা একটা আওয়াজ তার কানে এল। জানলা দিয়ে মাথা বের করতে উপর থেকে একটা মৃদু গুঞ্জন শুনতে পেল।
“অমর!” নিজের গলার আওয়াজেই একটা চাপা উদ্বেগ ধরা পড়ল, যদিও সেটা ঠিক কী নিয়ে সেটা পরিষ্কার করে বুঝতে পারল না সিংজি।
“হ্যাঁ স্যার!”
“এখানে আয়। কী যেন একটা কানে আসছে, কিছু হল কী না কে জানে। আমি চালাচ্ছি বরং।” সিংজি নিজের জায়গায় অমরকে ডেকে তার জায়গায় নিজে গিয়ে বসল ট্রেন নিয়ন্ত্রণ করতে। অমর পা টিপে দ্রুত দরজার সামনে গিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। তারপর বাইরের রেলিং-এর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে কানে এল মৃত ভেড়ার দেহাবশেষ ঘিরে উত্তেজিত মৌমাছির ঝাঁকের সুতীব্র ভনভন শব্দের মতো আওয়াজ। মনে হল ওপর থেকে আসছে আওয়াজটা।
একটু যেন কেঁপে উঠল অমর। রেগেও উঠল কিছুটা আশ্চর্যজনকভাবে।
“হ্যাঁ সিংজি!” কণ্ঠের উষ্মা গোপন করতে চেষ্টা করল অমর, “মনে হচ্ছে ওভারহেড তার থেকে আওয়াজটা আসছে। কারেন্ট অনেক বেড়ে গেছে মনে হয়।”
“তা কী করে হয়!” মিটারে চোখ রেখে সিংজি বলল, “সেরকম তো কিছু হওয়ার কথা নয়।”
অমর ধীরে ধীরে বুঝতে পারল সিংজির মুখে চোখে কেন এমন অবাক হওয়ার ভাব ফুটে উঠছে।
“এ লাইনে তো এখনও কারেন্টই আসেনি। তার পাতা হয়েছে বটে, কিন্তু বিদ্যুতের কোন সংযোগ দেওয়া হয়নি এখনও। যার জন্য আমরা এখানে ডিজেল ইঞ্জিন নিয়ে এসেছি, ইলেকট্রিক না।”
“জানি স্যার। হয়তো ইঞ্জিনিয়াররা কিছু পরীক্ষা-টরিক্ষা করছে? নতুন কোনো প্রযুক্তি হতে পারে।”
সিংজি অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়লেন।
“আমি কি ফোন করে জিজ্ঞাসা করব?
“না, সেসব আমাদের দেখার জিনিস না।” সিংজি অন্যের কাজে নাক না গলানোই শ্রেয় মনে করলেন। “ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করে বস। কেবিনের ভেতরে ঠান্ডা ঢুকে পড়ছে।”
মাথা নেড়ে অমর ফিরে আসতে গিয়ে হঠাৎ যেন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মনে হল বুকের মধ্যে কিছু একটা যেন নড়ছে। একটা অমঙ্গলের আশঙ্কা তাকে এক মাইক্রোসেকেন্ডের জন্য স্থবির করে দিল, যেমন তার ছোটোবেলায় মৃগীর প্রকোপ পড়ত। ভয়ে পেট চেপে ধরে খিঁচুনির অপেক্ষা করতে করতেই অনুভূতিটা কেটে গেল। শঙ্কা আর স্বস্তি প্রায় একই সঙ্গে তাকে প্লাবিত করে দিল।
অমরকে আসার পথে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে কিছুটা অসহিষ্ণু হয়েই সিংজি “আরে কী হল আবার?” বলে ঝেঁঝে উঠল।
অমর পেট চেপে ঢোঁক গিলে দম বন্ধ অবস্থায় মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। হঠাৎই এত ক্লান্ত লাগল তার, যেন কেউ তার শক্তির শেষ বিন্দু পর্যন্ত চুষে খেয়ে নিয়েছে।
“বস এখানে, জল খা একটু। ট্রেন আমি দেখছি।” সিংজি নিজে দায়িত্ব নিয়ে আলতো করে ধরে অমরকে বসিয়ে দিল।
এরকম হওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক নয় বলেই মনে হল সিংজির। এত ঘণ্টা ধরে কাজ করতে হয়, ক্লান্তিকর খাটুনির কাজ—তার উপর লোকো-পাইলটরা যে পরিষেবা পায় তার অবস্থা অত্যন্ত করুণ, এতে নিজেদের সিস্টেমই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যথেষ্ট বিশ্রাম, নিয়মিত জলের সরবরাহ আর কাজের দায়িত্বে একটু হাত-বাটোয়ারা—এটুকু পেলেই তাদের চলে যায়।
অভ্যাসবশে সুড়ুৎ করে ঠোঁটের কোন থেকে থুতু টেনে নীল রুমালে মুখটা মুছেই সিংজি আবার ৩১০০ অশ্বশক্তির ভি-১৬ ডিজেল ইঞ্জিনটির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নিল। অমর খাসা ছেলে, বেশ শক্তপোক্ত। কিন্তু এই বয়সেই সে যদি এরকম অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে দীর্ঘমেয়াদী যাত্রাগুলোয় তার সহ্যক্ষমতা নিয়ে কিছুতো প্রশ্ন উঠবেই।
তখনই অমরের মাথা ঘোরার থেকেও বড়ো চিন্তার ব্যাপার সামনে এল। ব্রেকগুলো যেমনটা কাজ করার কথা ঠিক তেমনটা কাজ করছে না। সেটা কানপুরের রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীদের জন্য লগবুকে লিখতে মনস্থ করতেই বেতার বাগড়া দিয়ে দিল। বার্তা মাঝপথেই বিঘ্নিত হল খড়খড় শব্দে।
১৫০০৪ ট্রেন স্টেশনে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢোকার অনুমতি পেয়ে গেল।
সিংজি অমরের দিকে তাকিয়ে একটু উৎসাহিত করার চেষ্টা করল, “আবার সেই চার নম্বরেই দিয়েছে, প্রতিবার চারেই দেয়।”
উত্তরে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ছাড়া আর কিছুই শোনা গেল না। সিংজি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। প্রতিবার দেউরিয়া সদরের চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢোকার সময় নির্দিষ্ট একজন বিক্রেতার থেকে লিট্টি-চোখা কেনার জন্য বায়না ধরবেই অমর।
“আজ আমি খাওয়াব তোকে লিট্টি”। সিংজির কথার কোন উত্তর এল না। একটা পিতৃসুলভ সহানুভূতিভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কি খুব ব্যথা করছে নাকি অমর?”
উত্তরে অমর শুধু মৃদু ঘড়ঘড় আওয়াজ করল। ট্রেনের মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে সে নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছিল তখন। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল, মাথাটাও ঘুরছিল। চারপাশটা যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে ভালো দেখতে না পেলেও ঘ্রাণশক্তি আর শ্রবণশক্তি যেন আগের থেকে আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে গেছে। সেই ধোঁয়াশা—মিষ্টি ও সুস্বাদু কোলয়েড তার নাক ও কান দিয়ে তার শরীরে হানা দিচ্ছিল আর সেই হানা রুখতে তার নিউরোন-সেনাও যে অকল্পনীয় দ্রুততায় যাবতীয় বন্দুক চালাচ্ছিল সেটাও দিব্যি টের পেল সে। ইঞ্জিনের ধুকধুক, বিদ্যুৎবাহী তারের বোঁ-বোঁ গুঞ্জন, ট্রেনের ঝিক-ঝিক, ওয়াকিটকির খরখর শব্দ—সব তার কানে আসছিল; সঙ্গে নাকে এসে লাগছিল চারপাশ থেকে ভেসে আসা নানারকম গন্ধ।
অমর আরও বাতাস গ্রহণ করার জন্য জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল। আরও ধোঁয়াশা চাই তার, আরও ধোঁয়াশা। এতে যদি এই অস্থিরতা কিছুটা কমে।
“কী হল বল দেখি তোর?”
অমর ফ্র্যাংকলিন কোনো উত্তর দিল না। ঘষটে ঘষটে একটু কোনার দিকে চলে গেল। বাঁই করে হাত চালিয়ে কিছু একটা তুলে নিয়েই একটা হাড়-হিম করা চিৎকার দিল।
সিংজির পিলে চমকে উঠল চিৎকারে, কোনোরকমে ঘুরে তাকাল পিছনে। দেখল চোখ লাল করে অমর মেঝেতে বসে আছে দাঁত বের করে, তার হাতে একটা টিকটিকি।
“আরে কী করছিসটা কী?”
অমর সজ্ঞানে থাকলেও এর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। এরকম অনুভূতি সে আগে কখনও অনুভব করেনি। চরম ঘৃণা। টিকটিকিটার লেজ খসে পড়ল, টিকটিকিটার মাথাটা মুঠোর মধ্যে চেপে থেঁতলে দিতে দিতে টের পেল তার শিরা-উপশিরা দিয়ে যেন তীব্র ঘৃণা বয়ে চলেছে।
অসহায়, ভীত প্রাণীটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অমর। হঠাৎ তার মধ্যে সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দখল করে নেওয়ার তীব্র বাসনাটা আবার প্রবলভাবে চাগাড় দিয়ে উঠল। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা!
“না, না অমর, এটা করিস না,” সিংজি চেঁচিয়ে উঠল।
সেই সময়ে অমরের কানে যেন কে বলছিল, “এ তো অন্য জাতের প্রাণী, আমাদের এলাকায় ঢুকে পড়ার সাহস পায় কী করে?”
সিংজি ব্রেক কষা বা রেলওয়ে পুলিশের কাছে রেডিয়ো মারফৎ সাহায্য চাওয়ার আগেই অমর ক্ষেপে গিয়ে সজোরে কামরার জানলায় সপাটে চাপড় মারল।
কড়াৎ!
জানলার কাচ লাল হয়ে গেল। সিংজি সাধারণত যে লালের সঙ্গে অভ্যস্ত এটা সেই লাল নয়, কিঞ্চিৎ আলাদা। কাচটা ভেঙে না যাওয়া অবধি অমর চাপড় মারতেই থাকল। কাচের একটা টুকরো সোজা অমরের হাতের মুঠিতে ঢুকে গেল। গভীর ক্ষত থেকে রক্ত চুঁইয়ে মেঝেতে পড়তে লাগল। তার হাতের তালুতে থাকা টিকটিকিটা আর নেই, শুধু একটু মাংসের দলা পড়ে আছে।
“হে ভগবান!”
ভীতসন্ত্রস্ত সিংজি বুঝতে পারল সেই অমর, তার খাস প্রিয় অমর, সদাশয়, বশংবদ, সবসময় খুশি করতে চাওয়া ছেলেটা আর নেই, সে এখনই একটা টিকটিকি ধরে জানলার কাচে পিষে দিয়ে তাকে গৌরবময় মৃত্যু প্রদান করেছে। অমরের দিকে তাকাল সিংজি। সে তখন মেঝেতে হতবাক হয়ে পড়ে আছে মুখে একরাশ বিস্ময় আর ক্রোধের মিশ্র অভিব্যক্তি নিয়ে। তার দেহ বার বার খিঁচুনি দিচ্ছে। মুখে কী যেন বিড়বিড় করে বলছে।
সিংজি রেডিয়োর কাছে পৌঁছতে পোঁছতে টের পেল অমর একটা কথাই আউড়ে যাচ্ছে। তার শরীরের অন্তঃস্থল যেন কেঁপে উঠল একটা ভয়ে।
অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে অবধি অমর বলে যাচ্ছিল, “মার শালাকে, মার, মেরে ফেল, একেবারে মেরে ফেল।”
৩
দেউরিয়া সদর রেলওয়ে স্টেশন, উত্তর প্রদেশ
স্থানীয় সময়: 2145 Hrs
দুম!
ভয়ে চমকে উঠে আমি ডানদিকে তাকালাম। মন্দিরটা তখনও বেশ সরগরম। কুকুরগুলো এসে পাশে কুঁইকুঁই করছে। এক যুবক চা বিক্রি করতে শুরু করেছে। একজন ট্রেন ধরার তাগিদে পাশের প্ল্যাটফর্ম থেকে লাইনের উপর দিয়ে ছুটে এসে এই প্ল্যাটফর্মে লাফিয়ে উঠে পড়ল। ধোঁয়াশায় ভেজা ছাইয়ের গন্ধ আমার ছোট্ট নাকের ভিতর দিয়ে একেবারে যাকে বলে মরমে পশিল।
ততক্ষণে আমি শব্দের উৎসটা খুঁজে বের করেছি। একটা বেপরোয়া, বেদনাতুর ট্রেন হৃদয়-বিদারক শব্দ করে কামরাগুলিকে আলাদা করে ফেলেছিল। দাদাজি বলত, মানুষও রেলের কামরার মতোই। ট্রেনের যেমন সব কামরার গন্তব্য এক হয় না, আলাদা আলাদা হতে পারে। তাদের এক ইঞ্জিনের বন্ধন থেকে মুক্ত করে অন্য ইঞ্জিনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। মানুষও তেমনই তাদের মতো এক কামরা ছেড়ে অন্য কামরার সঙ্গে যুক্ত হয়, যতক্ষণ তারা বিস্মৃত হয় তাদের আসল পরিচয় কী আর কী-ই বা তাদের গন্তব্যস্থল। যে ইঞ্জিন তাদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যায় সেটা হল তাদের কিসমত! নিয়তি!
“আর একদিন থেকে গেলে কী হত? মাত্র একদিন তো! মেলা-নুমাইশ সবে শুরু হয়েছে মাত্র, তা ছাড়া কাল রবিবার। নাস্তায় বেশ শম্ভুর পুরি-সবজি খাওয়া যেত মজা করে! আর কালকেই মুইর রোডে বিক্রিবাটা শুরু হত! তুমিও তো ওখানে কেনাকাটা করতে ভালোবাস, তাই না?” আরও কিছু অভিযোগ আমি যোগ করে রাখলাম, কিন্তু নির্দিষ্ট কাউকে লক্ষ্য করে সেটা বলা হল না।
মা শুধু একবার আমার দিকে নিঃস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকাল, কাঁধ নাড়িয়ে আবার ছোটো ভাইকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সে আবার মায়ের পা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল স্থির হয়ে। মা’র মুখে উদ্বেগ, আত্মসমর্পণ আর হতাশার অদ্ভুত এক মিশ্র অভিব্যক্তি ধরা পড়ে গেল, যা হয়তো খুব সূক্ষ্মভাবে জানাচ্ছে যে, “আমি বিবাহিত জীবনে সুখী নই। আমার কাছে খরচা করার মতো যথেষ্ট টাকা আর ফুটফুটে দুটি সন্তান পাওয়ার সৌভাগ্য থাকলেও আমি শেষমেশ একজনের স্ত্রী… আর সেটা সুখের জন্য যথেষ্ট নয়।”
আমি এতটাই ছোটো আর সরল ছিলাম যে তার চোখ থেকে খুশির আলো নিভে যাওয়াটা আগে লক্ষ করিনি। সেটা অবশ্য হঠাৎ করে একদিন হয়নি, রান্নাঘরে বা শোয়ার ঘরে যেভাবে ড্যাম্প ধরে সেইভাবে ধীরে ধীরে পচন ধরেছিল দাম্পত্য জীবনে। মা হয়তো তখন বছর কুড়ি বা বাইশের যুবতি, ভেবেছিল জীবনটা হবে একেবারে ফাঁকা মসৃণ সড়কের মতো, কোনো খানাখন্দ থাকবে না, থাকবে না কোনো ট্রাফিক জ্যাম বা সিগনালের লালবাতিও। এই ভাবনাই হয়তো ভেবে চলত যতদিন না টের পেল মা সেই রাস্তা পেরিয়ে একটা প্রবল যানজটে আক্রান্ত, দমবন্ধ করা দাম্পত্যের চত্বরে ঢুকে পড়েছে যা থেকে তার কোনো নিস্তার নেই। জীবন নিয়ে যা স্বপ্ন ছিল সব তখনই ঘুচে গেছে। তারপর থেকে যাত্রা কেবলই অধোগামী।
ফট, ফট, ফট, ফট।
ঘুরে তাকাতেই দেখলাম বছর কুড়ির একটা ছেলে জোরে জোরে একটা নোংরা কেরোসিন স্টোভ পাম্প করতে লেগেছে। মুখটা তেমন কিছু মনে রাখার মতো নয়, দাঁতটা দেখে মনে হয় নিয়মিত গুটখা সেবন করার অভ্যাস আছে। চা-ওয়ালাটির পরনে ছেঁড়া হালকা নীল রঙের প্যান্ট আর কঙ্কালসার গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকা একটা হলুদ সোয়েটার। এরকম বিশেষত্বহীন মুখের ছেলে এই দারিদ্র্যপীড়িত শহরের অলিগলিতে খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। সে একটা ধোঁয়া-ওঠা কাঠ আর জ্বলন্ত কয়লা ভরা লোহার পাত্রের উপর একটা অ্যালুমিনিয়ামের কেটলি বসিয়ে কাঠে আগুন জ্বালিয়ে দিল। আমার গলা হঠাৎ একটু চা-এর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল, সেই চিনি দেওয়া দুধ চা—যাতে যথেষ্ট পরিমাণে ইউরিয়া, ডিটারজেন্ট আর ফরম্যালিন মিশে থাকবে।
বাড়ির লোকেদের থেকে একটু সরে এসে চা-ওয়ালার হাতে একটা চকচকে পাঁচ টাকার নোট ধরিয়ে দিলাম আর চায়ের ভাঁড়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
চা-ওয়ালা মাটির ভাঁড়ে চা ঢেলে বলল, “এ বাবুনি, এ লে লা”।
সাদাটে-ধূসর ধোঁয়াশা চারপাশ থেকে প্ল্যাটফর্মের উপর যেন ঢেউ-এর মতো ভেসে আসছিল, প্রতি মুহূর্তে যেন আরও ঘন হচ্ছিল। ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছিল না, তাও আমি ভাঁড়টা নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালাম। ছেলেটার চোখে চোখ পড়ল, এবং তার পর কিছুটা অনিবার্যভাবেই তার দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টি আমার চোখ থেকে নেমে নীচের দিকে গেল। উপেক্ষিত ও ক্ষুধার্ত এক নেকড়ের ধূর্ত, কুটিল সেই দৃষ্টি।
তার সন্ধানী দৃষ্টি আরও নীচে নামতেই আমি যেন তার অভিসন্ধি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলাম। আমার পরনে নীল সালোয়ার-কামিজ, তার উপর বর্ধমান উলের সোয়েটার। কিন্তু এই সব সম্মান, শিষ্টাচার আর সৌজন্যবোধের আবরণের নীচে আমাদের শরীরের সেই পাশবিক প্রবৃত্তিটা মজ্জায় মজ্জায় রয়ে গেছে।
ডিং-আন-সিক।
পাঁচ টাকার কয়েনটা তার তৃষ্ণার্ত হাতের পুরোপুরি দখলে যাওয়ার আগেই আমি ধোঁয়া-ওঠা চায়ের ভাঁড়টা কেড়ে নিয়ে দ্রুতবেগে ফিরে এলাম। ঠান্ডা বাতাস যেন আমার চোখ টিপে একফোঁটা অশ্রুজল বের করে দিল। আমার কেন জানি না নিজের ওপরেই একটু লজ্জা বোধ হতে লাগল। ঠিক করলাম ওর দিকে আর ফিরে তাকাব না। বাড়ির লোক যেখানে বসে আছে সেই সুরক্ষিত ত্রিভুজাকার স্থানের দিকে হাঁটা লাগালাম।
মা আর কবীর একসঙ্গে গুটিসুটি হয়ে বসেছিল। মায়ের খোলা আঁচল আঁকড়ে ধরে ছিল ভাই। বাবা একটু দূরে কাঠের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর তার আঙুলগুলো কোটের পকেটে রাখা লাইটারের ঢাকনাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল।
হঠাৎ অবাঞ্ছিত একটা হাসির আওয়াজে আমার দৃষ্টি গেল ডানদিকের বেঞ্চের দিকে, যেখানে বসেছিল একসঙ্গে, যেন পচনধরা খোলার মধ্যে একসারি কড়াইশুঁটি। বারোটা চোখ আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে দেখল, একেবারে জুতোর ফিতে থেকে মাথার মেরুন মাফলার অবধি। শুরুর দিকে ব্যাপারটা খুবই সরল ছিল; আমার শরীরটা একটু অস্বাভাবিকভাবেই গরম হয়ে উঠেছিল, আর চামড়ার নীচে মৃদু দপদপ অনুভব করছিলাম। যেন চাইনিজ বামের মতো কোনো মলম আমি গিলে ফেলেছি আর আর সেটা গলে গিয়ে তার ঝাঁজ আমার গলা থেকে মাথার খুলি অবধি জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। একটা গরম বাষ্প যেন হামাগুড়ি দিয়ে আমার মস্তিষ্ককাণ্ডে এসে জমা হচ্ছিল, আর চামড়ার ঠিক তলায় একটা উসখুসানির মতো তৈরি করছিল। আমার আঙুলের ডগা কাঁপতে শুরু করে দিল, আর প্রবল হাঁচি শুরু হল। ধোঁয়াশার জেরে আমার নাকের পথ বার বার শুকিয়ে যাচ্ছিল আর মুখের লালার স্বাদ যেন ক্ষারীয় লবণদানার মতো ঠেকতে লাগল।
চারপাশটা কেমন যেন বদলে যেতে থাকল। প্রচণ্ড ভয়ে পেয়ে গেলাম। চোয়াল আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল। ওই ছয়জনের উষ্ণ ঘাড়ের নরম মাংস আমার সুন্দর সুন্দর গোলাপি নখ দিয়ে ছিঁড়ে ফেলার একটা অবর্ণনীয় আকাঙ্খা জেগে উঠল। শুধু ওই ছ’জনেরই নয়, যত পুরুষমানুষ আছে সবার।
আমি চোখে যা দেখছি সেটা প্রতি মুহূর্তের নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিক দৃশ্যপটের প্রবাহের মতো আমার কাছে আসছিল না, বরং একগুচ্ছ আলোকচিত্রের সমাহারে তৈরি মন্তাজের মতো ঝলসে ঝলসে উঠছিল। হোঁচট খেতে খেতে আমি সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। মা ততক্ষণে স্টেশন চত্বরে আমার জন্য খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছিল। আঙুলে মায়ের স্পর্শ পেতেই আমি হাঁটা থামালাম।
আমার বাঁদিকে কিছু একটা আচমকা নড়েচড়ে উঠতেই আমার ঘোরটা যেন কেটে গেল। সারা হাতে কেমন একটা ঝিলমিল ধরে গেল, হাতটা অবশ মনে হতে লাগল। সেই চা-ওয়ালাটা এখানে আবার ঘুরে এসেছে, আর এবার তার হাতে একটা কুঠার।
লোকজন ততক্ষণে ওখান থেকে চলে গেছিল, চারপাশটা বেশ নিস্তব্ধ ছিল। বাবা-মা আতঙ্কে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগল। ছেলেটা লাফিয়ে বাবার কাছে চলে গেল। তার দাঁত বেরিয়ে রয়েছে, ফেনা বেরোচ্ছে মুখ থেকে। মা চেঁচিয়ে উঠল। বাবা ছেলেটির দিকে ফিরে চাইতেই তার মুখে এমন একটা ভাব দেখতে পেলাম যা তার উদ্ধত আর নিষ্ঠুর মুখে কখনোই দেখতে পাইনি আগে—সেটা হল ভয়।
চা-ওয়ালা সোজাসুজি বাবার সামনে দাঁড়িয়ে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে চকচকে কুঠারটা চালিয়ে দিল। কী অদ্ভুত, বাবাও বয়স আর স্থূলতার তোয়াক্কা না করে চট করে মাথা সরিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে নিল। তারপরেই বাবা পালটা আঘাত করল ছেলেটাকে। কুঠারটাকে লাথি মেরে দূরে সরিয়ে ছেলেটাকে পেছন থেকে পাকড়ে ফেলল বাবা, আর তার শ্বাসনালীটা নিজের লৌহমুষ্টিতে পিষে ফেলতে লাগল।
ছেলেটা মাটিতে পড়ে যেতেই বাবা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিজের বিশাল ওজনটা তার উপর চাপিয়ে দিয়ে তাকে আর উঠতে দিল না। বাবা এখানেই থামল না যদিও। ক্রোধে তার মুখ বিকৃত হয়ে উঠল। ছেলেটার পচতে থাকা হলুদ দাঁতের পাটি লক্ষ করে একটার পর একটা ঘুষি মেরে তার মুখ থেঁতলে দিতে লাগল।
আমি লাফ দিয়ে এসে কবীরকে জড়িয়ে ধরলাম। সেও আতঙ্কে বিপর্যস্ত। ওকে কিছুক্ষণ জাপটে ধরে থেকে কপালে চুমু খেলাম। প্রার্থনা করলাম আমি যেন আমার মনের অন্ধকারকে প্রতিরোধ করতে পারি। কিছুক্ষণ পর পুলিশের হুইসল শুনতে পেলাম। চারদিক থেকে শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ, চিৎকার-চেঁচামেচি, মাইকে ঘোষণা—এসব আবার কানে আসতে শুরু করল ধীরে ধীরে। কিছু সরকারি পোশাক পরা রক্ষী আমাদের কাছে উপস্থিত হল।
ততক্ষণে আমাদের ট্রেনটাও দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হল পৃথিবীটা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে। যেন একটা দুঃস্বপ্ন থেকে আমি জেগে উঠলাম, এই ভয়ংকর দু-মিনিট বাস্তবে কখনোই ঘটেনি। কবীর আরও শক্ত করে আমাকে আঁকড়ে ধরল, তারপর কপালের শিরার স্পন্দন আমি ঘাড়ে অনুভব করলাম। আমিও তার পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিলাম যে সব ঠিক হয়ে যাবে এখুনি। তাকে একদমই ছাড়তে ইচ্ছা করছিল না। আমার ভিতরে কেউ যেন বা কিছু একটা চাইছিল আমি যেন তাকে এমনি করেই ধরে রাখি।
ডিং-আন-সিক।
নয়তো কীভাবে এই ছোট্ট ছেলেটার বড়ো বড়ো বাদামি চোখগুলো খুবলে বার করে নিয়ে সেটা জুতো দিয়ে পিষে দেব? এখনই একটা খালি ঘর পেলে বড়ো ভালো হত, আর একটা ছুরি শুধু। তাহলেই ওর ছোট্ট, মোলায়েম পেটটা শান্তিতে কেটে ফেলতে পারি।
ধীরে সুস্থে, শান্তিতে।
ভাইটাকে না মেরে ফেললে আর চলছে না।
আর আমি চাই যে সে বুঝতে পারুক তার মৃত্যু আসন্ন।
৪
চৌরি চৌরা এক্সপ্রেসের ভিতর, দেউরিয়া, উত্তর প্রদেশ
স্থানীয় সময়: 2200 Hrs
১৫০০৪ ধীরে ধীরে দেউরিয়া স্টেশনে ঢুকছে। বাইরের কেবিন দেখা যাচ্ছে, প্ল্যাটফর্মও শিগগিরি নজরে চলে আসবে। অন্তত সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে তেমনটাই হওয়ার কথা। একটু আগে অমর যা করেছে, বা বলা ভালো অমর যা হয়ে গেছে—সেই ঘটনার ধাক্কায় এখনও সিংজির মাথা ঘুরছে। দেউরিয়া স্টেশনে ইতিমধ্যেই সে বেতারে জানিয়ে দিয়েছে তারা যেন একটা মেডিকেল টিম তৈরি রাখে। আড়চোখে অমরের দিকে তাকাল সিংজি। আচমকা খিঁচুনি আসার পর এখন ছেলেটা নোংরা মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
প্ল্যাটফর্ম প্রায় চলে এসেছে, এদিকে ট্রেন দ্রুতগতিতেই এগিয়ে যাচ্ছিল। সিংজি তাড়াতাড়ি এসে ব্রেকের লিভারটা টেনে নামিয়ে দিল। কিন্তু কিছুই হল না। সিংজির আত্মা প্রায় গলার কাছে চলে এল, হাঁপাতে হাঁপাতে আবার লিভারে টান দিল, কিন্তু ট্রেন সেই একই বেগে চলতে লাগল।
সিংজির চারপাশের জগৎ যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ট্রেন থামানোর পুরো পদ্ধতিটা সে পুনরায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনুসরণ করল টায়ে টায়ে, কিন্তু ফল সেই একই রয়ে গেল। “আরে কী যে হল…”
এবার সিংজি সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল। সামনে রেললাইনে বেশ অনেক লোকজন ছিল যারা এক প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্য প্ল্যাটফর্মে যাচ্ছিল, তারা ধরেই নিয়েছিল যে ট্রেন ঠিক থেমে যাবে। ভগবান যেন ট্রেন থেমে যায়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেল তার, বুকটাও জোরে জোরে ধড়ফড় করতে লাগল। সে আর চিন্তা করতে পারছিল না কিছু, স্রেফ প্রবৃত্তিবশে এমার্জেন্সি কনসোলে চলে গেল তার হাত আর তার ঢাকনা খুলে বড়ো লাল বোতাম যেটায় লেখা ছিল “এমার্জেন্সি স্টপ: ইউজ উইথ কশান” সেটা শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে টিপে দিল। বেঁচে থাকার লড়াইয়ের প্রক্রিয়ায় সে ঢুকে পড়েছিল ততক্ষণে।
ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে, অনেক যুদ্ধ করে ট্রেনটির গতি কমতে শুরু করে দিল সঙ্গে সঙ্গে। কামরার নীচ থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বেরোতে লাগল, আর ট্রেনের গতিজাড্য সিংজিকে সামনের দিকে ছিটকে ফেলে দিল। সময় যেন তার স্বাভাবিক প্রবাহে ফিরে এল।
চার নম্বর প্ল্যাটফর্মটি বাঁদিকে স্পষ্ট হয়ে উঠতেই একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সিংজি। জরুরিভিত্তিতে থামানো সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল ট্রেনটি স্বাভাবিক গতিতেই সূচি অনু্যায়ী ঠিক সময়ে থামবে। ট্রেনটি নিরাপদে স্টেশনে থামছে এটা নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরেই সিংজি পরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টায় মন দিলো।
খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে ধোঁয়াশা কেবিনের ভিতর ঢুকে পড়েছিল। সিংজি তার চারপাশের মৃদু আওয়াজগুলি আরও জোরে জোরে শুনতে পাচ্ছিল। ভয় আর দুশ্চিন্তায় মুখ ভরে বাতাস গিলে নিল সে। এতে কিছুটা মন শান্ত হল, বাতাসটা যেন বর্তমান উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিল। বাতাসটা এক নিশ্বাসে টেনে নিতেই যেন পারিপার্শ্বিক অনেকটা ঝাপসা হয়ে গেল, আশপাশে কী চলছে সেগুলোতে আর মনোনিবেশ করতে পারছিল না। ট্রেনটা পুরোপুরি থামতে মিনিট দুয়েক সময় লাগবে। ক্রমশ মন্থর হয়ে আসা প্ল্যাটফর্মও বেমালুম আবছা হয়ে আসল। সিংজি কেবলমাত্র একটি জিনিসই দেখতে পাচ্ছিল আর তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারছিল তার চারপাশে, সেটি হল অমর ফ্র্যাংকলিন।
তার সামনেই অমরের দেহটা পড়ে আছে—অচেতন, রক্তে মাখামাখি। অসহায়।
তার ভিতরে কী যেন একটা ঢুকে বাসা বেঁধেছে। এই ছেলেটাকেই সে নিজের যোগ্য শিষ্য মনে করত, একেই তার নিজের জায়গায় বসানোর জন্য তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে আগ্রহী ছিল—এসব কথা এখন আর মনে পড়ল না রামনাথ সিং-এর। এখন সামনে যে পড়ে আছে সেটা শুধুই এ. ফ্র্যাংকলিনের দেহ।
একটা গর্জন করে সিংজি অমরের দেহ’র উপর ঝুঁকে পড়ল। টুলবক্সের গহীন থেকে পাওয়া স্ক্রু-ড্রাইভারটি তার কাঁপা হাতে খেলা করছে এখন। হৃৎস্পন্দন শান্ত হতে হতে প্রায় নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে, আর শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ ক্রমে প্রকট হয়ে উঠছে। যেন তার নিজস্ব প্রবৃত্তি তার অন্দরে ঢুকে পড়া দানবের সঙ্গে লড়াই করতে চাইছে, কিন্তু তার নিজের শরীরই বিশ্বাসঘাতকতা করছে—প্রতি প্রশ্বাসে আরও, আরও বেশি বিষাক্ত ধোঁয়াশা টেনে নিয়ে।
সিংজির কানে কিছু চিৎকার ভেসে এল। ট্রেন আওয়াজ করে পুরোপুরি থেমে যাওয়ার উপক্রম করছে, ওদিকে মাইকে কিছু ঘোষণা চলছে। তার অবচেতন মন জানিয়ে দিল স্টেশন মাস্টার কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো মেডিকেল টিম নিয়ে হাজির হবে। একবার মনে হল বেতারে কিছু একটা নির্দেশ পাঠিয়ে দেয়, কিন্তু একটা সুতীব্র যন্ত্রণায় সে চোখে অন্ধকার দেখে মেঝেতে পড়ে গেল। অমরের পাশেই তার দেহটা পড়ে খিঁচুনি দিতে লাগল। কলজে-ফাটা চিৎকার দিয়ে উঠল সিংজি। তারপরেই সব অন্ধকার।
ঠিক এক মিনিটের মাথায় যখন স্টেশন মাস্টার এল WDM-3A কামরায়—কাঁপা হাতে অব্যবহৃত ইমার্জেন্সি মেডিকেল কিট আর ফ্যাকাসে মুখে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে—দেখত পেল ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠতে থাকা অমর ফ্র্যাংকলিনের দেহের উপর সিংজি ঝুঁকে আছে।
কেবিনের নতুন অতিথিকে খেয়ালও করেনি সিংজি। তখনও স্ক্রু-ড্রাইভারটা দিয়ে অমরের চোখগুলো খুঁচিয়ে যাচ্ছিল সে। শোকে চিৎকার করতে করতে তার চারপাশের দুনিয়াকে শাপ-শাপান্ত করে যাচ্ছিল প্রবল গর্জনে।
বুটের প্রতিধ্বনি শোনা গেল। স্টেশন মাস্টার কোনোরকমে লাফ দিয়ে কেবিন থেকে নেমে এল তার ভগবানকে ডাকতে ডাকতে। সকল মানবজাতিকে অভিসম্পাত করতে করতে সে উদ্ধারের জন্য চিৎকার করতে লাগল।
নরক থেকে ট্রেন এসে হাজির।
৫
৪ নং প্ল্যাটফর্ম, দেউরিয়া সদর রেলওয়ে স্টেশন, উত্তর প্রদেশ
স্থানীয় সময়: 2230 Hrs
রক্ত।
অস্থিমজ্জা।
নাড়িভুঁড়ি।
রক্ত, অস্থিমজ্জা, নাড়িভুঁড়ি। সারা প্ল্যাটফর্ম জুড়ে এসবই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল। আমাদের প্ল্যাটফর্মটায়।
প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা তাদের নির্দিষ্ট কোচে ওঠার জন্য মালপত্র তোলার আগেই চৌরি চৌরা এক্সপ্রেসের দরজা খুলে গেল। জোয়ারের ঢেউয়ের মতো অভিশপ্ত যাত্রীদের একটা প্রবল জনস্রোত এসে প্ল্যাটফর্মে আছড়ে পড়ল। ট্রেনটি থামতে না থামতেই তার উদর থেকে মানুষের জানা সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী, দাহ্য ও বিপজ্জনক অস্ত্রটি উগরে দিল, সেটি হল মানুষ।
আমার চারপাশে এখন শুধু কান্না, চিৎকার, চেঁচামেচি, আর্তনাদ আর হাহাকার। ধোঁয়াশা যেন নিজেই কোথাও চলে গেছে। আর আমি যা দেখলাম তা কোনোদিনও আর ভুলতে পারব না। চারপাশের ছবি আমার মস্তিষ্ককে ঝলসে দগ্ধ করে দিয়েছিল, তারপর বোধ হয় কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছিল পুরোপুরি।
লোহালক্কড় দিয়ে পিটিয়ে মাংসের দলা পাকানো, ধারালো জিনিস দিয়ে হাড় থেকে রক্ত, স্নায়ু আর পেশিতন্তু আলাদা করা। চোখের নিমেষে স্টেশনটা যেন মধ্যযুগের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হল। মানুষ একে অপরকে ভারী জিনিস দিয়ে পিটিয়ে পিষে মারতে লাগলো, কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগলো, ধারাল অস্ত্র দিয়ে চিড়ে ফালাফালা করতে লাগলো, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেঁতলে দিয়ে—ধড় থেকেই আলাদা করে দিয়েছে। প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য এক ছিল, সামনের মানুষটাকে খতম করে দেওয়া।
“পরের কাম, জাহান্নাম,” বাবা প্রায়ই এই কথাটা বলত, বিশেষ করে যখন মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হত আর মা কাঁদতে কাঁদতে শোবার ঘরে গিয়ে খিল তুলে দিত।
সত্যিই আজ যেন এখানেই জাহান্নাম নেমে এসেছে।
বাবাকে দেখলাম বিজয়ীর ভঙ্গিতে চা-ওয়ালা ছেলেটার মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে। তারই কুঠার দিয়ে তার গলা কেটে ফেলেছে বাবা। তার অপবিত্র, ছিন্নভিন্ন গলা থেকে এখনও একটা ভগবানের লকেট ঝুলছে। এরপর বাবা সেই ছয়জনের মধ্য থেকে দু’জনকে ঘাড় ধরে নিয়ে এল, তাদের রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত নাকে নিজের মাথা দিয়ে ক্রমাগত ঢুঁসো মারতে লাগল। হঠাৎ একটা গর্জন করেই আমার দিকে সরাসরি তাকাল বাবা। ভয়ে আমার প্রাণ শুকিয়ে গেল।
আমার মা দেখি চুলের মুঠি ধরে একটি বাচ্চা মেয়েকে পাকড়ে তার তলপেটে লাথির পর লাথি চালাচ্ছে সর্বশক্তি দিয়ে। আমি জিবে ধাতব কিছু একটার স্বাদ পেলাম। কবীর রক্তের পুকুরে শুয়ে রয়েছে, আর সেই পুকুরটা ক্রমাগত বড়ো হচ্ছে। যেন কোন সরীসৃপের চোখের লাল মণি, ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে। আমি মুচকি হাসলাম। ভাইটাকে আর বিব্রত করলাম না।
উন্মত্ততা। মাত্র পনেরো মিনিটের উন্মত্ততা।
এখনও মনে পড়ে সেই দিনের কথা।
হতাহতের সরকারি তালিকা বহুদিন পরে প্রকাশিত হয়, কিন্তু আমার কাছে, তারা, আমরা, সবাই মৃত। বহুদিন আগে থেকেই।
গোবিন্দরাজ স্বামী, বয়স ২৮, একজন সাবানবিক্রেতা। দেউরিয়া স্টেশনে সে-ই সরকারি হিসেবে প্রথম মৃত ব্যক্তি। তাকে প্ল্যাটফর্ম থেকে চলন্ত ট্রেনের সামনে ফেলে দেওয়া হয়। যারা মেরেছিল তাদের ভাষা বলতে পারত না সেই সাবানবিক্রেতা। তাদের প্রধান ভাষা কি হওয়া উচিৎ সেই নিয়ে দুইপক্ষ একমত হতে পারেনি।
বাহাত্তর বছরের সৈয়দ আলি রিজভি, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল, তাকে মরতে হয়েছিল এর ঠিক পরেই। ভোঁতা কোনো অস্ত্র দিয়ে তার মাথার পেছনে বার বার আঘাত করে তাকে মেরে ফেলা হয়। তার খুনি ছিল একজন অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ। পাকিস্তানি সেনার বুলেট যা করতে পারেনি, তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল সেই খুনি।
মুরলী গুপ্তা, স্ক্র্যাপের বিজনেস ছিল তার। বয়স ৩৫। মৃতদের ক্রমতালিকায় তৃতীয়। এক কড়াই সামোসা ভাজা ফুটন্ত তেল তার মুখের উপর ছুড়ে মারা হয়। আক্রমণের আগে সরলমনা ব্যক্তি সামান্যতম সন্দেহও করতে পারেনি যে কী হতে চলেছে। প্রচণ্ড দহনযন্ত্রণায় সে মারা যায় কিছুটা হতবাক হয়েই। তাকে যারা মেরেছে তারা তার সমগোত্রীয় ছিল না, সমাজের একই শ্রেণিতে তাদের বসবাস ছিল না। তা ছাড়া সে যে মোটরবাহনে যাতায়াত করত, সেটাও খুনিদের সঙ্গে মেলেনি।
চতুর্থজন যিনি মারা গেছিলেন তিনি হলেন বছর সাতচল্লিশের বিজয় কাশ্যপ। উচ্চপরিবাহী তার দিয়ে বিদ্যুতপৃষ্ট করে তাকে হত্যা করা হয়। সে ভগবানকে ডাকত, আর তার খুনিরা গডকে। ল্যাটিনে একটা কথা আছে: Fiat justitia ruat cælum—আকাশ ভেঙে পড়লেও ন্যায়বিচার দিতে হবে। সেদিন আকাশ ভেঙে পড়েছিল বই কি, কিন্তু ন্যায়বিচার সে পায়নি।
লিপেশ্বর প্রসাদ পাঁচ নম্বর লোক যে সেদিন মারা গেছিল। পঞ্চান্ন বছরের হিন্দিশিক্ষক, স্থানীয় বিদ্যালয়ে পড়ান। একজন লোক ধারালো কিছু দিয়ে তার পেট ফাঁসিয়ে দিয়েছিল। জাতে ভিন্ন ছিল সেই খুনি।
ছ’নম্বরে আসে অপর্ণা দাসের নাম। এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটিতে এম.এ. পড়ত মেয়েটি। তাকে বেঁধে, ধর্ষণ করে, শ্বাসরোধ করে মারা হয়। তবে এই কাজগুলো যেই ক্রমে লেখা হল সেই ক্রমেই যে করা হয়েছিল সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না। মেয়েটি একটি মেয়েকে ভালোবাসত। যে তাকে মেরেছে, সেও একটি মেয়েকে ভালোবাসত।
৩৯ বছর বয়সি ক্রিশান্তি দয়াবীরা এই তালিকে সপ্তম। মহিলা একজন পর্যটক। স্টিলের পাইপ দিয়ে পিটিয়ে তাকে খুন করা হয়েছে। তাকে যে খুন করেছে তার দেশ আর ক্রিশান্তির দেশ এক নয়। বসুধৈব কুটুম্বকম মন্ত্রে সবাই বিশ্বাস করে না। এই বসুধা কেবলমাত্র একটি পরিবারই নয়—একটি উন্মত্ত, মানসিক বিকারগ্রস্ত, হত্যাকারীদের পরিবার।
ব্যাঙ্কের অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার ডেভিড মেইতেই মৃত্যুর ক্রমতালিকায় অষ্টম। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু। তার গলার ভিতরে একটা ভাঙা বলপয়েন্ট পেন পাওয়া যায়। যে মেরেছে সে ডেভিডের জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত ছিল না।
ওমবীর রানা একজন ৪৯ বছর বয়সি আখচাষী। ন’নম্বরে এর মৃত্যু। রেললাইনের পাশের থামে এর মাথা ঠুকে ঠুকে থেঁতলে দেওয়া হয়। শোনা যায় এর খুনি যে দলকে ভোট দেয় সে সেই দলকে ভোট দিত না।
গুরপ্রীত কৌর, বয়স ১৯, একজন শিক্ষানবিস মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান। দশ নম্বরে এর স্থান। ভোঁতা দাঁতের পাটির সাহায্যে মেয়েটির শ্বাসনালী কামড়ে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে। হত্যাকারীর লিঙ্গ আলাদা ছিল এক্ষেত্রে।
প্রত্যেকটা হত্যাই আলাদা, হত্যাকারীও আলাদা, কিন্তু সব ক-টিই হয়েছে একই স্থানে, একই সময়ে। অনুমান করা যেতে পারে, কোনো বহিরাগত কারণে এরা সবাই খুন করতে উদ্যত হয়েছে।
পরের কাম, জাহান্নাম।
জাহান্নাম তৈরি হয় অন্যলোকের বিচার ও দৃষ্টিকোন থেকে। এই জাহান্নামকে ধ্বংস করতেই হবে।
মারো, মেরে ফেল। একবারে মেরে ফেল।
ঘটনাক্রমে যারা মারা গেছে তারা সবাই মোটামুটি ভদ্র, ভালোমানুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, যে জগৎ যোগ্যতমের উদ্বর্তন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়মে চলে সেখানে এই ভদ্রতা বা ভালোমানুষির কোনো বাস্তব উপযোগিতা নেই। এমনকী এও দেখা গেছে দুজন মানুষ একে অপরকে হত্যা করেছে, তাদের দলেরই তৃতীয় কোনো ব্যক্তির দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আগে।
“খুনি ও তার শিকারের নামকে একসঙ্গে যুক্ত কর আর একাধিক উত্তরের মধ্য থেকে সঠিক খুনি ও শিকারের জুটিটি চিহ্নিত কর।” আমি যখন CAT পরীক্ষায় বসব, তখন ডেটা ইন্টারপ্রিটেশন অ্যান্ড লজিক্যাল রিজনিং বিভাগের জন্য হয়তো এটা উপযুক্ত প্রশ্ন হয়ে উঠবে। আমি এটা ভেবে একটু হাসলাম।
গ্রুম!
আকাশে কী যেন একটা বস্তু কানফাটানো আওয়াজ করে উড়ে যাচ্ছিল। আমি উপর দিকে তাকাতেই একটা বিস্ফোরণ। আমি ভয়ে চোখ ঢেকে ফেললাম। মাটিতে শুয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কোনোরকমে রেলের কামরার দিকে এগোতে লাগলাম।
ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে।
৬
দেউরিয়া সদর রেলওয়ে স্টেশনের অনেক উপরে, উত্তর প্রদেশ
স্থানীয় সময়: 2300 Hrs
শুষ্ক, ধূলিধূসর অঞ্চলটি সর্পিল পথে পেরিয়ে যখন ট্রেনটি একটি প্রবল ঘৃণাঅধ্যুষিত জনপদে পৌঁছাল, তখনই স’অল্কের মনে পড়ে গেল কেন এই ধ্বংসযজ্ঞের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। যানটি হঠাৎই নানারকম শব্দ করে জেগে উঠল, যেন আগেভাগেই বুঝতে পেরে গেছে যে স’অল্ক ইতিমধ্যেই সাফল্যের সুবাস পেতে শুরু করে দিয়েছে। এখন সামান্য একটু বিরতি নেওয়া যেতে পারে ভাবল স’অল্ক, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার সামনের কম্যান্ড মডিউলে আলো জ্বলে উঠল। সোটেম এর সময় হয়ে গেছে।
এই অনুশীলনটিতে এমন একটা যন্ত্র ব্যবহার করা হয় সেটা শব্দ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, আর এই শব্দ ও তাপমাত্রাকে তাদের মানের অগণিত ভিন্ন ভিন্ন বিন্যাস আর সমন্বয়ের প্রয়োগে একজন কা’হাকের মস্তিষ্ককে একটা পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত চেতনার স্তরে উন্নীত করে দেয়। এতে একবার মজে গেলে এর থেকে বেরোনো প্রায় অসম্ভব। সোটেম যন্ত্রটি যানের তাপমাত্রা কমিয়ে আর বাড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের শব্দতরঙ্গ ছুড়ে দিল তার দিকে।
স’অল্ক পরম আনন্দে চোখ বন্ধ করে শিস দিতে লাগল। সেকেন্ড খানেক পর তার চোখটা পট করে খুলে গেল এবং অভ্যাসবশত ট্রেনটার দিকে তাকাল। উপর থেকে মনে হল যেন একটা ভীত ওয়াংকা যেন তার মায়ের স্নেহপাশ কাটিয়ে পালাচ্ছে। এইভাবে পালানোই উচিত—কিছুটা মজা পেয়েই হাসল স’অল্ক। ওয়াংকা মায়েদের এই দারুণ অপত্যপ্রেমের পিছনে মূল কারণ যে পেটের সুখ সেটা কারোর অজানা নয়।
আরেকটা ছবি ভেসে উঠল তার সোটেমায়িত মস্তিষ্কে। এভাবে উপর থেকে একটা ট্রেনকে ধাওয়া করে যাওয়াটা মনে করিয়ে দিল তাদের নিজেদের ঘরের মাঠে পাগশা শিকারের কথা। আহা সেই ডুরান তির! কা’হাকদের জগতে দুই উপগ্রহের নরম আলোয়ে সেই রুপোলি মৃত্যুবাণের ঝিকিমিকি আবার দেখতে মনটা উতলা হয়ে উঠল তার। উপর থেকে সেই ডুরান তির একদম পাগশা’র মাংসের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার মজাই কিছু আলাদা। সেই পাগশা মাংসেই চলত কা’হাকদের পুষ্টিসাধন।
এ সবই অতীতের কাহিনি। মহাশুদ্ধি অভিযানের পর সব বদলে গেছে। এখন আর ততটা অযৌক্তিক শিকার করা হয় না।
যোগাযোগের মাধ্যমগুলি সব চালিয়ে দিল স’অল্ক। নীচের স্টেশন থেকে তীক্ষ্ণ-স্বরের চিৎকার-চেঁচামেচি ভেসে আসছে। মানুষের চিৎকার তার মনে ভয় বা আনন্দ জাগায় না, তার লালসাকে জাগ্রত করে তোলে। যে মুহূর্তে একজন শিকারি শিকারে পরিণত হয়, সেই মুহূর্তটা প্রত্যক্ষ করায় যে তুরীয় আনন্দ হয় তার থেকে বেশি আনন্দ বোধ হয় আর কিছুতেই নেই। এতকাল মানুষ ভেবে এসেছে তাদের গ্রহে তারা যা খুশি তাই করতে পারে।
আপাতত তারা আর যা খুশি তাই করতে পারছে না। স’অল্ক টের পেল তার মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। যে এ-আইটিকে সে তৃতীয় স্তরের সতর্কতার কাজে লাগিয়েছিল সেটি চারপাশের আকাশ নিরীক্ষণ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। তার বদলে সমস্ত প্রসেসিং পাওয়ার পাঠিয়ে দিয়েছিল প্রাপ্ত ফলাফলের উপর একটা সিম্যুলেশন চালানোর কাজে। পরিসংখ্যানও চলে এল, যেমনটি আন্দাজ করা গেছিল তেমনটাই হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি আর হতাহতের সংখ্যা পূর্বনির্ধারিত মানগুলির মধ্যেই রয়েছে, কোনো ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। মূল জনসংখ্যার এক-দশমাংশ মানুষকে জীবিত রাখা হয়েছে। এদের HoV1 সংক্রামিত করার পর সবাইকে একত্র করে বৈদেশিক সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। অতএব আরও একটি জয়, এবং এটাকে বেশ সহজ জয় বলা যায়।
HoV1 হল পরিবর্তনের মসীহা, সত্যবাদীতার মহৌষধ। কা’হাক জাতির লক্ষ্যকে বাস্তবে পরিণত করতেই কা’হাক বিজ্ঞানীরা এটিকে নিখুঁতভাবে গড়ে তুলেছে; সেই লক্ষ্য হল—এক বিশ্ব, এক জাতি, এক মানসিকতা।
HoV1 এনেছিল এক নতুন সূর্যোদয়ের প্রতিশ্রুতি। অযৌক্তিক, নির্বোধের মতো জাতিবৈষম্যের লড়াই তাদের প্রায় বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছিল। HoV1 ছিল তারই অমোঘ নিরাময়। যখন প্রায় সবকিছু হারিয়ে গেছিল, তখনই এক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগার থেকে বেরিয়েছিল এটি, আর কা’হাকদেরই বানিয়েছিল তার প্রথম লক্ষ্য।
ফলাফলও এল অভূতপূর্ব। সমজাতিক সমস্ত ধারণা প্রথমেই বাতিল করা হল। সমস্ত ভিন্ন প্রজাতি সত্যি সত্যি এক হয়ে উঠল। এক সত্ত্বা, এক জাতি, এক লিঙ্গ, এক শ্রেণি, এক আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, এক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, এক বর্ণ এবং এক দেশ। ব্যক্তিগত লক্ষ্য, স্বার্থ আর দৃষ্টিভঙ্গি ছাপিয়ে শৃঙ্খলা, পরিকাঠামো আর শান্তি রক্ষাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। কা’হাক-সমাজকে সর্বোত্তম উপায়ে পরিচালনা করার জন্য নতুন সাংগঠনিক দৃষ্টান্ত তৈরি করা হল। জিনভিত্তিক প্রজননকে হাতিয়ার করে স্বতন্ত্র জীবিকা তৈরি করা হল যা তাদের সামগ্রিক চাহিদা পূরণ করতে পারে। সমাজ যেমনটি চাইত, একজন কা’হাক ঠিক তেমনটি হয়ে উঠত। আলাদা পছন্দ বেছে নেওয়ার মতো ভিন্নতা তৈরি হওয়ার কোন জায়গাই রাখা হল না। অভিন্নতাই ক্ষমতা উৎস, আনুগত্যই শক্তির উপাদান , সম্প্রসারণই জীবনের আস্বাদ।
কয়েক ‘ডাক’ সময়ের মধ্যেই কয়েক প্রস্থ মহাশুদ্ধি কার্যক্রম পালিত হয়, তাতেই সমস্ত যুদ্ধরত কা’হাক গোষ্ঠীগুলি একে অপরের সঙ্গে শান্তিস্থাপন করে নেয়, আর তখনই হাইভ বা চক্রগোষ্ঠীর সূচনা হয়। এই HoV1—হোমোজেনিটি রেট্রোভাইরাস—আর এর থেকে উদ্ভূত মহাশুদ্ধি কার্যক্রম, এই দুইয়ে মিলে সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, আর এমন একটি সাম্রাজ্যের সূচনা করেছিল যা প্রায় অর্ধেক ছায়াপথ দখল করে একাঙ্গীভূত করেছিল। এখান থেকেই কা’হাকাম শান্তিযুগের সূচনা হয়।
কা’হাকরা এটাও বুঝতে পেরেছিল যে তাদের প্রাচীন জ্ঞান ও সংস্কৃতি শুধু তাদের মধ্যে কুক্ষিগত করে রাখলে চলবে না, সমস্ত গ্যালাক্সি তথা মহাবিশ্বে সেটা ছড়িয়ে দিতে হবে। দরকার পড়লে বলপ্রয়োগও করা যেতে পারে। ফলস্বরূপ, ভাইরাসটির অনেকগুলো নতুন ধরন তৈরি করতে হল যাতে সেটা নানা গ্রহের ভিন্ন ভিন্ন সচেতন জীবদের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় উপায়ে আক্রান্ত করতে পারে। তবে এর প্রভাব মোটামুটি একই ছিল সবক্ষেত্রে। এটি যে জীবজাতিকে সংক্রমিত করে তাদের মাথা থেকে বহুত্বের ধারণা, জাতিবৈচিত্র্য আর বহুসংস্কৃতি গ্রহণ করার ক্ষমতাকে চিরতরে নষ্ট করে দেয়।
এটা নিয়ে কোনো নৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে হয়নি। স’অল্ক মনে করে দেখল অতীতের কথা। এই মহাবিশ্ব, জানা মতে, এক। জীবনও এক। চেতনাও এক।
অনেক নয়, এক।
যে কোনো মূল্যেই এই ধারণা বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। এই কারণেই প্রয়োগকারীদের নির্মাণ করা হয়েছে।
এখন থেকে সাত ‘কেক’ সময় আগে, সে নিজে আর তার মতো আরও নয়জন প্রয়োগকারী তাদের নিজস্ব টেরহপ যানকে সল-৩ এর স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে সমান দূরত্বের স্থানাঙ্কে স্থাপন করেছিল। প্রত্যেককে আলাদা আলাদা এলাকা ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। তাদের কাজ শেষ হওয়ার আগে এই জগৎটার সম্পর্কে আরও তথ্য জানার চেষ্টা করেছিল সে। স’অল্ক সেক্টর এমএক্স-১৯/সোল-৩ থেকে কাজ সেরে ফিরে আসছিল। সেখানে সে মানবজাতির সুপ্রাচীন একটি ধর্মস্থানের নির্জন ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া কিছু নিয়মবহির্ভূত লিপি নিয়ে তদন্ত করছিল। তার স্নায়ুতন্ত্রে বসানো যন্ত্র এখানকার স্থানীয় প্রযুক্তিগুলির সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে। দেখা যায় ‘ইন্টারনেট’ বলে একটি তথ্যভাণ্ডার আছে, পৃথিবীর সম্পর্কে জানার জন্য এটি একেবারে রত্ন যাকে বলে। এটা ঘেঁটে স’অল্কের মহাশুদ্ধির আগের হাইভ-পূর্ববর্তী যোগাযোগ ব্যবস্থার কথাই মনে পড়ে গেল।
স’অল্কের চোখের কর্নিয়াতে বসানো ডিসপ্লে তে নানারকম ভিনগ্রহী শব্দবন্ধ ভেসে আসছিল, যেমন মহাপরিনির্বাণ, ইয়িন-ইয়াং, ডিং আন সিক ইত্যাদি। উদ্ধারস্থান থেকে সংগ্রহ করা ওমট্রনিক বিকিরণ এর মানগুলিকেও ভালো করে বিশ্লেষণ করে নিয়েছিল সে।
মানুষের প্রতি স’অল্কের এইরকম আগ্রহ অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। তার অন্দরের এআই এর কাছে এর স্বপক্ষে অনেক কারণ ছিল। প্রয়োগকারীর কাজ ছিল তার গৌণ জিনের ফলাফল, আসলে তার জিনের মূল কাঠামো ছিল একজন শিক্ষার্থীর। তাই অজানাকে জানার লোভ সম্বরণ না করতে পারায় বিস্মিত হওয়ার কিছু ছিল না, তা সে যতই কঠোর নিয়মকানুনের গণ্ডিতে কাজ করুক না কেন।
নতুন সংগ্রহ করা তথ্যগুলোকে প্রসেস করিয়ে সরাসরি তার নিজের সেরিব্রামে ঢুকিয়ে নিচ্ছিল স’অল্ক, ঠিক তখনই তার টেরহপ যানটি দুলে উঠল আর নজরে এল একটি নতুন শিকার—মানবজাতির একটি গণ-পরিবহন যান—১৫০০৪ নম্বর দেওয়া একটি ট্রেন।
“হিক’সা!”
যানের ভিতরটা নিজের থেকেই নড়ে উঠল। ধীরে ধীরে যানটি একটি পূর্ণগোলকের চেহারা নিল। বাইরের ধাতব, ঈষৎ ঢেউখেলানো আবরণটি দেখে যেন সজীব কোনো প্রাণী মনে হবে। স’অল্ক বুঝে গেল কী হতে চলেছে। টেরহপ যানটি এখন পুরোপুরি সমরযানে পরিণত হয়েছে, আর যে নিয়ন্ত্রণগুলি হাতে করে করা যেত, এখন সেগুলো আর হাতে করা যাবে না—প্রধান যানের এ-আই সেটার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। এখন আর সে শিক্ষার্থী নেই, এখন থেকে সে পুরোপুরি প্রয়োগকারী। সে এখন মৃত্যু ও শান্তির প্রতিষ্ঠাতা, বিনাশ ও শৃঙ্খলা আরোপের একটি হাতিয়ার। জৈবজীবন বড়োই বিশৃঙ্খল, মৃত্যু তা নয়।
ট্রেনটি স্টেশনে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই জাহাজের বাইরের স্তরটি সরে একেবারে মিলিয়ে গেল আর তার নীচে সবুজাভ শৈবালের মতো একটি আবরণ দেখা গেল। এই দ্বিতীয় স্তরটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে আসার কয়েক মিনিটের মধ্যেই বর্ণহীন ধোঁয়ার মতো বাতাসে মিশে গেল। ঝলমলে, ঘূর্ণায়মান গোলকটি থেকে একটি সাদা বাষ্প বেরিয়ে এসে আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। মনে হল পচতে থাকা গর্তের মতো একটি ঘা গিলে নিতে আসছে শত শত কর্ষিকা।
যানের স্পিকার থেকে ছড়িয়ে পড়া নীচের শত শত মানুষের চিৎকার, আর্তনাদ ও হাহাকারের শব্দে যেন স’অল্কের চটকা ভেঙে গেল, বাস্তবে ফিরে এল তার মন। আগে থেকেই বোঝা গেছিল পৃথিবীতে তার জন্য কী অপেক্ষা করে রয়েছে। নীল-সবুজ গ্রহটা যেন মূর্তিমান অসঙ্গতি, প্যারাডক্স। স্থান-কালের জালে একটা বেয়াড়া ছিদ্র, যেটা দ্রুত মেরামত না করলেই নয়। কা’হাক জীবনশৈলী আর চিন্তাধারার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অপমান এটি। একই গ্রহে একাধিক সচেতন প্রজাতির যুগ যুগ ধরে একসঙ্গে থাকাটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তার থেকেও ভয়ংকর ব্যাপার হল, এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী যে প্রজাতি, হোমো সেপিয়েন্স, যারা প্রায় সব দিক থেকেই একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, তারাও এই বিষমজাতীয় সহাবস্থানকে স্বাভাবিক বলেই মেনে নিয়েছে। তারা বরং এই বৈচিত্র্যকেই শক্তির উৎস বলে মনে করত।
স’অল্ক ফোঁসফোঁসিয়ে উঠল। আর বেশিক্ষণ নয়। এই নগণ্য গ্রহের বাসিন্দারা আসন্ন কা’হাক আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পারবে না। আর বেশিক্ষণ নয়।
হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে সম্বিৎ ফিরল স’অল্কের। একটা বিপদঘণ্টি কোথায় যেন বাজতে লেগেছে। মনে মনেই সে মূল জাহাজের এ-আইয়ের কাছে বর্তমান পরিস্থিতির সাম্প্রতিক তথ্য জানার জন্য অনুরোধ করল, আর সেই এ-আইকে প্রাথমিক স্তরের সতর্কতার দায়িত্বে বহাল করল। ঠিক এই মুহূর্তে মেঘের স্তর ভেদ করে একটি চকচকে যুদ্ধবিমান এসে উপস্থিত হয়েছে যার লেজে একটি তেরঙা চাকতি বসানো।
এ-আই ও আর চুপ করে থাকল না, স’অল্কের গৌণ মস্তিষ্কে এই সহসা ধাওয়া করা Su-30 MKI মডেলের বিমানটির ছবি আর সেই সঙ্গে তার গতি, অভিমুখ, আক্রমণের সম্ভাব্য কোনগুলি পাঠাতে থাকে। নিমেষে একটি ধোঁয়ার লম্বা লেজ দেখা যায়। আবার ঝাঁকুনি! সংঘর্ষের বিপদঘণ্টি!
স’অল্কের সোটেমায়িত চোখের মণি ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠছিল, পুকুরে ঢিল ছোঁড়া ঢেউয়ের মতো। অস্ত্র – ‘আকাশ-থেকে-আকাশে’ নিক্ষেপযোগ্য ঝকঝকে একটা ক্ষেপণাস্ত্র তাকে মাঝখান থেকে ঝলসে দিয়েছিল।
ডিং আন সিক।
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, রাকেশকুমার দাস, সামি আহ্মাদ খান
