হরেনবাবু ও ব্ল্যাকহোল
লেখক: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
হরেনবাবুর আজকে দিনটা বড়োই খারাপ যাচ্ছে। অবশ্য প্রত্যেকটা দিনই তাঁর বেশ খারাপ যায়, সেটা নতুন কিছু নয়, কিন্তু আজকের দিনটা একটু বেশিরকমই খারাপ। সকালে উঠেই কাজের লোক অ্যাবসেন্ট। ওদিকে গিন্নির কোমরের ব্যথাটা আবার তাক বুঝে বেড়ে উঠেছে। কাজেই ঘুম ভেঙে উঠে প্রথমেই একগাদা বাসন মাজতে হল। তারপর মেয়েটাকে ইশকুলে দিয়ে এসে মাছের ঝোলভাত রেঁধে রেখে নিজে চানখাওয়া সেরে ইশকুলে যখন পৌঁছোলেন ততক্ষণে ফার্স্ট পিরিওডের অর্ধেক পেরিয়ে গেছে। টেন বি-তে ক্লাশ ছিল। ঢুকতে গিয়ে দেখেন হেডমাস্টার হরভৈরব গাঙ্গুলি পাঁচটা ছেলেকে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে লাইন দিয়ে বেত লাগাচ্ছেন। হরেনবাবুকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে বললেন, “এতক্ষণে আসবার সময় হল হরেনবাবু? এদিকে রোজ রোজ আপনার ক্লাশ ম্যানেজ করতে গিয়ে যে ইশকুল ম্যানেজ করতে ভুলতে বসেছি! এরপর থেকে ঠিক সময়ে আসতে না পারলে বরং আর আসবেনই না।”
এখানেই শেষ নয়। দুপুরে টিফিনের সময় খবর পেলেন কো অপারেটিভের লোনটা মঞ্জুর হয়নি। লাস্ট পিরিওডে সেভেন বি-র ছেলেরা চেয়ারে চিউইং গাম সেঁটে রেখেছিল, টিচার্স রুমে ফিরে সেটা ঘসে তুলতে গিয়ে পাঞ্জাবির নিচের দিকটা একটা ফুটো হয়ে গেল। বড়োশালার গত পুজোয় দেয়া পাঞ্জাবি। গিন্নির চোখে পড়লে আজ আর রক্ষা নেই।
আরো আছে। বাড়ি ফিরে ঘেমো পাঞ্জাবিটাকে গিন্নির নজরের আড়ালে লুকিয়ে রেখে চারজনের মতন রান্না করা, তারপর মশারি টাঙিয়ে ছোটোটাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রান্নাঘর সাফসুতরো করা, ফের বাসন মাজা—উফ্ফ্-
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে চলেছিলেন হরেনবাবু। হঠাৎ সামনে কমলা পার্কের গেটটা দেখে তাঁর কী যে হয়ে গেল, রাস্তা ছেড়ে সটান গিয়ে পার্কের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। আজ একটা বিদ্রোহ করতেই হবে। তাঁর নিজের বাড়ি। তিনিই মালিক। ঠিক সময়ে না ফিরলে কে তাঁকে কী বলবে?
একটা সিমেন্টের চেয়ারে জুত করে বসে বাদামওলাকে ডেকে একেবারে কুড়িটাকার বাদাম কিনে বসলেন। কালকের বাজার খর্চা থেকে খসল খানিক। হোক গে যাক। কুছ পরোয়া নেই।
(২)
বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে মাথাটা একটু ঠান্ডা হয়ে আসতে হরেনবাবুর খানিক দুঃখ হল। কয়েক বছর আগেও থেকে থেকে মনে হত এইবারে বিশ্বজয় করতে পারেন ইচ্ছে হলেই। ইদানিং আর সে’রকমটা মনে হচ্ছে না। ছাপোষা গেরস্ত মানুষ। মাথায় পাঁচ ফুট পাঁচ। পাখির মত বুকের খাঁচা। রোজ রাতে শোবার সময় অ্যান্টাসিড দিয়ে মিষ্টিমুখ করতে হয়। ছ্যাঃ।
ঠিক এমন সময় তাঁর পাশ থেকে কে যেন খুক করে হাসল। হরেনবাবু চমকে উঠে তাকিয়ে দেখেন, কোত্থেকে একটা ইয়া তাগড়া জোয়ান এসে পাশে বসেছে। মুখটা ভীষণ চেনা চেনা। সেদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছেন দেখে লোকটা একগাল হেসে বলে, “কী? চেনা চেনা ঠেকছে? তা ঠেকবেই তো! এই দ্যাখো-”
এই বলে ঝোলা থেকে একটা আয়না বের করে এনে সামনে ধরল সে। তাতে দুজনের মুখের ছবি পাশাপাশি পড়তে হরেনবাবুর চোখদুটো গোলগোল হয়ে উঠল। দুখানা মুখই হুবহু একরকম! শুধু এই লোকটার মুখ একটু বেশি ঝাঁ-চকচকে। ওঁর মত শুঁটকোপানা নয়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মশাইয়ের পরিচয়?”
“আমার নাম হরেন শাসমল। পিতা দ্বিজেন শাসমল।”
হরেনবাবু রেগে উঠে বললেন, “আমার আর আমার বাবার নাম নিয়ে মশকরা করা হচ্ছে?”
লোকটা হেসে বলল, “ধুস্! তা কেন? আপনিও যা, আমিও তাই। শুধু আমার দুনিয়াটা একটু আলাদা এই যা।”
“মানে?”
লোকটা বলল, “সমান্তরাল দুনিয়া কাকে বলে জানেন?”
“সে আবার কী বস্তু?”
“সেসব খুবই খটোমটো ব্যাপার। তবে মোদ্দা কথাটা হল, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালটাতাল নিয়ে এই যে আমাদের দুনিয়াটা সেটা আসলে একটাই দুনিয়া নয়। একই জায়গায় একই সময়ে কোটি কোটি সমান্তরাল দুনিয়া রয়েছে মশাই। তাদের কোনোটাতে পৃথিবীতে কখনো যুদ্ধবিগ্রহই হয়নি। কোনোটাতে আবার অ্যাটমবোমাটোমা পড়ে মানুষ বিলকুল উবে গেছে। কোনোটাতে আবার মানুষ আসেইনি এখনো।”
হরেনবাবু অবাক হয়ে বললেন, “কোটি কোটি টাইপের পৃথিবী একই জায়গায়? কই, টের পাইনা তো!”
“সেইটাই তো মজা!একটা সমান্তরাল পৃথিবীতে যে থাকে অন্যগুলোর খবর সে পায় না। মধ্যে মধ্যে হাইপার স্পেসের দেয়াল তোলা রয়েছে যে! তবে সে’সব অংকবিজ্ঞানের কথা থাক এখন। গল্পটা শুনুন। এইরকম একখানা সমান্তরাল দুনিয়ায় আমি, হরেন শাসমল, মাধ্যমিকের পর সায়েন্স না পড়ে ছবি আঁকতে গিয়েছিলুম। দেখা গেল, ছবি আঁকায় আমার বেজায় হাত। যা-ই আঁকি, লোকে বুঝুক না বুঝুক, ধন্য ধন্য করে। কয়েকবছরের মধ্যে বেশ বিখ্যাত হয়ে গেলাম। কোটি কোটি টাকা। অনেক নামডাক।”
“বলেন কী মশায়? ছবি এঁকে কোটি কোটি? এই পশ্চিমবঙ্গে বসে?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। আমাদের ওখানকার পশ্চিমবঙ্গে লোকজন বেশ বড়োলোক তো! আর্টের কদর তাই বেশি। বিজ্ঞানও বেজায় উন্নত। তারাটারায় যাওয়াটা কোন ব্যাপারই নয়। লোকজন শুধু ছবি কেনে তাই নয়, সুবিধেমত দামে পেলে গ্রহনক্ষত্রও দেদার কিনে ফেলে ঘুরতে বেরোয়। আমিই যেমন ধরুন না, দুটো গ্রহ কিনলাম গতবছর। তা, গেল মাসে কাগজে বিজ্ঞাপন দেখলাম, হাইপার স্পেসের দেয়াল পেরিয়ে সমান্তরাল দুনিয়ায় যাবার নতুন যন্ত্র বেরিয়েছে। ওমনি ছবি আঁকা মুলতুবি রেখে বেশ ক’খানা সেই যন্ত্র কিনে নিয়ে যতগুলো সমান্তরাল দুনিয়ায় আমি, মানে হরেন শাসমল রয়েছি, সেগুলো দেখতে বেরিয়েছি। আপনি হলেন গিয়ে তার মধ্যে পঞ্চান্ন নম্বর হরেন শাসমল।”
হরেনবাবু চোখ গোলগোল করে শুনছিলেন। গ্যাঁজাখোর নয়তো? লোকটা দম নেবার জন্য একটু থামতে সেই ফাঁকে বললেন, “তা, সেই যন্ত্রটা কোথাও দেখছি না যে?”
“দেখবেন কী করে? পকেটের ভেতর রয়েছে যে!” বলতে বলতে লোকটা পকেট থেকে একটা চৌকোমতন নস্যির ডিবে বের করে ওঁর সামনে ধরল। সাধারণ স্টিলের বাক্স একখানা। তবে বেজায় ভারী, আর একটু কেমন যেন গরমগরম ঠ্যাকে। হরেনবাবু ডালাটা টেনে খুলতে যাচ্ছিলেন তা লোকটা ওমনি হাঁ হাঁ করে উঠল, “খবরদার। অনেক হিসেব করে ও ডালা খুলতে হয়। ওর মধ্যে একটা মিনি ব্ল্যক হোল ভরা আছে। তার ভেতর দিয়েই তো যাতায়াতের পথ!”
হরেনবাবু তাড়াতাড়ি বাক্সটা ফিরিয়ে দিতে যাবেন তা লোকটা একগাল হেসে বলল, “আরে না, না, ওটা আপনার জন্য উপহার। আমার নিজের আলাদা বাক্স আছে সঙ্গে।”
এই বলে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে পার্কের অন্ধকার কোণের দিকে চলে গেল দুনম্বর হরেন। খানিক দূর গিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, “তবে একটা কথা। উপহারের বাক্সগুলো খানিক সস্তার তো, তাই ওতে চড়ে সমান্তরাল কোথাও গেলে আপনি কিন্তু আমার মতন আলাদা হয়ে থাকতে পারবেন না। ওখানে যে হরেনবাবু আছেন তাঁর সঙ্গে এক হয়ে যাবেন। এইটে একটু খেয়াল রাখবেন মশাই।”
এই বলে ফের হনহন করে হাঁটা লাগালেন দু নম্বর হরেন। মিনিটদুয়েক পর পার্কের অন্ধকার কোণটার থেকে বেগুনি আলোর ঝলক দেখা গেল একটা। হরেনবাবু তাড়াতাড়ি উঠে সেদিকে গিয়ে দেখেন, কেউ কোত্থাও নেই। সব ভোঁ ভাঁ।
(৩)
রাত্রে বাড়ি ফিরে সবাই শুয়েটুয়ে পড়লে হরেনবাবু বসবার ঘরে গিয়ে বাক্সটা নিয়ে পড়লেন। ডালার ওপরে বাংলায় খুদে খুদে অক্ষরে অনেককিছু লেখা ছিল। লেন্স ধরে ধরে পড়ে দেখেন কৌটো ব্যবহারের কায়দাকানুন লেখা রয়েছে সেখানে। বেশ সহজ ব্যাপার। দুতিনবার পড়তেই সব জলের মতন পরিষ্কার হয়ে গেল তাঁর কাছে।
জোড়াসনে বসে বাক্সটাকে সামনে ধরে তার দিকে তাকিয়ে হরেনবাবু মনে মনে একখানা ছবি ভাবতে শুরু করলেন। ঠিক যেমনটা হলে তিনি সুখী হতে পারতেন—চিরটাকাল ইচ্ছে ছিল ইংরিজি নিয়ে পড়াশোনা করবেন। কিন্তু বাবার গুঁতোয় সায়েন্স নিয়ে পড়তে হল শেষমেষ। এম এস সি পাশ করে এখন কাত্যায়নি মেমোরিয়াল ইশকুলে মাস্টারি করে দিন কাটছে। টিউশনি করে কটা টাকা উপরি আয় হচ্ছিল, তা সরকারের খামখেয়ালে সে-ও এখন বন্ধ হয়ে গেল। ইশকুলের মাইনে পেয়ে তারপর টিউশন করলে নাকি পুলিশে ধরবে।
আর্টিস্ট হরেন লোকটা সুবিধের নয়। নিজের জন্য দামি জিনিস কিনে উপহার দেয় সস্তার জিনিসটা। তবে তাতে হরেনবাবুর কোন আপত্তিই নেই। এই খেঁকি মাস্টার অবতারে বাঁচতে কে চায়!
বাক্সের সামনে বসে হরেনবাবু মনে মনে ভাবলেন, ইংরিজি নিয়ে এম এ পাশ করে গোল্ড মেডেল পেয়ে তারপর আই এ এস পরীক্ষায় পাশ করে একেবারে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে বসেছেন। সকালে ডিম পাউরুটি মাখন ডবল ডিমের মামলেট আর গন্ধ চা খেয়ে ঢাউস গাড়িতে চেপে পেল্লাই অফিসে গেছেন। সেখানে খানসামা, বেয়ারা, সেপাই সব সেলাম ঠুকছে—আ-হা-
ছবিটা পষ্টাপষ্টি যেই মনে মধ্যে দেখতে পাওয়া, অমনি বাক্সের ভেতর থেকে একটা গুণগুণ আওয়াজ উঠল। বাক্স জানান দিচ্ছে সে রেডি। এবারে রওনা হলেই হয়। হরেনবাবু এইবার নীচু হয়ে তার মুখের ঢাকনাটা খুলে দিলেন। ভেতরে মটরদানার সাইজের কালো কুচকুচে একখানা বল ভাসছে—একমুহূর্তের জন্য শুধু হরেনবাবু দেখতে পেয়েছিলেন সেটাকে, তারপর একটা ভয়ানক হ্যাঁচকা টানে তিনি ফিতের মতন সরু হয়ে সেঁধিয়ে গেলেন বলটার ভেতর।
ছোট্ট ব্ল্যাকহোলটা তাঁকে গোটাগুটি টেনে নিয়ে, বাক্সের গায়ে আঁটা মিনিকমপুটারে ধরে রাখা হরেনবাবুর ইচ্ছেটা যে সমান্তরাল পৃথিবীতে সত্যি হয়েছে সেইখানে ছুঁড়ে ফেলল এক নিমেষের মধ্যে—-
(৪)
চোখ খুলেই হরেনবাবু আবিষ্কার করলেন, ঢাউস একটা টেবিলের একপাশে একটা গদি আঁটা চেয়ারে তিনি বসে আছেন। খাঁড়ার মতন নাকওয়ালা একটা বেয়ারা পাশে দাঁড়িয়ে বলছে, “কী হল স্যার? হঠাৎ নস্যির ডিবে হাতে করে ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?”
হরেনবাবু চমকে উঠে কৌটোটা তাড়াতাড়ি বুকপকেটে লুকোলেন। তারপর তাকিয়ে দেখলেন টেবিলের ওপর একপাঁজা ফাইল। সব ইংরিজিতে লেখা। হরেনবাবু এখন ইংরিজিতে এম এ। অতএব সেসব ফাইলের ইংরিজি তাঁর কাছে আর কোন সমস্যাই হল না। দশ মিনিটের মধ্যে সব ফাইলে সইটই করে জবাবটবাব লিখে ফেরৎ পাঠিয়ে দিলেন।
ফাইলগুলো শেষ করে যেই না একটুখানি হাঁফ ছেড়ে বসেছেন ওমনি দুখানা টেলিফোন একসাথে বেজে উঠল। হরেনবাবু দু কানে দুটো টেলিফোন লাগিয়ে শুনলেন, একটায় বলছে রামপুর বাজারে আগুন লেগেছে। শিগগির ভিজিটে যাওয়া দরকার। নইলে সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। আর অন্যটায় খবর আসছে মহানন্দা নদীতে বান এসেছে। এক্ষুনি তিনি স্পটে না গেলেই বাঁধ ভেঙে গিয়ে সব জলের তলায় চলে যাবে। হরেনবাবু পড়িমড়ি করে ছুটলেন।
ঘন্টাদশেক বাদে সব বিপদআপদ কাটিয়ে জিভ বের করে হ্যা হ্যা করে হাঁফাতে হাঁফাতে অফিসে ফিরে এসে দেখেন, রাইটার্স থেকে স্বাস্থমন্ত্রীর একটা ভয়ানক কঠিন প্রশ্ন এসে পড়ে আছে সেই বিকেল থেকে। পরদিন সকালেই তার জবাব চাই।
অফিস তখন শুনশান। প্রায় মাঝরাত অব্ধি একলা জেগে বসে হরেনবাবু সে প্রশ্নের উত্তর বানালেন। বানাত বানাতেই কমপিউটার হ্যাং হল চারবার। প্রিন্টার বসে গেল দু বার। শেষমেষ প্রায় দিস্তাখানেক কাগজ নষ্ট হবার পর একটা উত্তর খাড়া করে রেখে অফিস থেকে বের হলেন হরেনবাবু।
আলোয় আলোয় সাজানো ডি এম বাংলোর সামনে তাঁর ঢাউস গাড়িটা যখন এসে থামল রাত তখন ঠিক দুটো। পথে আসতে আসতে মোবাইলে কলকাতা থেকে হোম সেক্রেটারির কাছে বেজায় ধমক খেয়েছেন, গত হপ্তায় প্রাক্তন মন্ত্রীমশাইয়ের ভিজিটের সময় সাদা এস্টিম গাড়ির বদলে ক্রিম রঙের মারুতি ভ্যানের ব্যবস্থা করেছিলেন বলে। বলেন, “প্রাক্তন মন্ত্রী আপনার আচরণে ব্যথিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে কলকাতায় ফিরেছেন। আপনি মশাই লোক সুবিধের নন দেখছি।” তারপর হরেনবাবু কোন সাফাই দেবার আগেই ফোন রেখে দিয়েছেন ঘটাং করে।
“ধুত্তোর নিকুচি করেছে চাকরির!” এই বলে হরেনবাবু গাড়ির দরজা খুলে নীচে পা বাড়ালেন। মাথাটা ঝনঝন করছে। এবারে স্নানটান করে একেবারে বেলা আটটা অবধি ঘুম একখানা— আহ-
কিন্তু সেই আরামের শব্দটা হরেনবাবুর মুখ থেকে পুরোপুরি বের হবার আগেই ফের সড়াৎ করে ভেতরে ঢুকে গেল। কারণ, গেট থেকেই বারান্দায় লোকাল থানার বড়োবাবুর টুপিটা নড়তেচড়তে দেখা গেছে। গাড়ির শব্দ শুনে বড়োবাবু দৌড়ে এলেন। তারপর হরেনবাবুকে বিশাল একটা সেলাম ঠুকে বললেন, “একবার একটু আসতে হবে যে স্যার!”
হরেনবাবু চিঁ চিঁ করে বললেন, “কোঁথাঁয়?”
“হাইওয়ের মোড়ে স্যার। ওখানে সন্ধেবেলা একটা মিসহ্যাপ হয়ে গেছে। রান ওভার কেস। একটা নেড়ি কুকুর ট্রাকে চাপা পড়েছে। ট্রাকের ড্রাইভার মুসলমান, আর কুকুরটা হল গিয়ে কালীবাড়ি চৌহদ্দির নেড়ি। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। দাঙ্গা এক্ষুণি শুরু হল বলে স্যার। আপনি গিয়ে একবার সামনে দাঁড়িয়ে টেনশান ডিফিউজ না করলে—”
অ্যাক্সিডেন্টের স্পটে গিয়ে দেখা গেল, ব্যাপার গুরুতর। অত রাতেও হাজার হাজার লোক এসে জড়ো হয়েছে। হাইওয়ে অবরোধ চলেছে। একপাশে একটা অবস্থান মঞ্চ বানানো চলেছে। মাইকে এক মহিলার গলায় আবেগদীপ্ত ভাষণে হিন্দু মা বোনেদের জাতিধর্ম বাঁচাবার জন্য এই সরকারকে অবিলম্বে ফেলে দেবার আবেদন জানানো চলছে। তিনি বলছেন, “এই সরকারের তৈরি রাস্তায় আজ গাড়ির চাকার তলায় পিষে কালীবাড়ির কুকুর মরেছে। কেন মরল? এটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়। দাল মে জরুর কুছ কালা হৈ। ভেবেচিন্তে ধর্মের ওপর আক্রমণ। কাল লাদেনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ওরা গোটা কালীবাড়ি উড়িয়ে দেবে। এইসব ছুপা রুস্তমদের আমরা চিনে ফেলেছি। কাজেই বন্ধুগণ–”
রাস্তার ওপরে ততক্ষণে কোথাও কোথাও তাসের আড্ডা বসে গেছে। অবরোধকারীদের ফাঁকে ফাঁকে চিনেবাদামওয়ালারা লম্ফ হাতে ঘোরাঘুরি করছে। চাঁদের আলোয় পথের দুধারে যতদূর চোখ চলে সার সার ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। দু চারটে হাতবোমাও নাকি পড়ে গেছে এর মধ্যে। হরেনবাবু স্পটে গিয়ে ঢুকতেই ভদাম করে শব্দ হল একটা। সামনের সিটে বসা দুটো বডিগারড পুলিশের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল, শব্দটা হাতবোমার না পাইপগানের। খানিক চুলচেরা বিশ্লেষণের পর পাইপগান জিতল।
ডি এম সাহেব হরেনবাবু এসে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে প্রশাসনের ত্রুটি মেনে নিতে এবং দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেবার প্রতিজ্ঞা করতে দাঙ্গাভাব একটু কমল বটে, কিন্তু এইবারে তার চেয়েও বড়ো একটা ঝামেলা দেখা দিল। গাড়িচাপা কুকুর রাস্তার ওপর দাঁত ছিরকুটে রাজার মতন শুয়ে। পেটটা ফেটে গেছে। সেখান থেকে কতগুলো নীল নীল নল বেরিয়ে ছড়িয়ে আছে চারপাশে। কালীবাড়ি এলাকার নেতা মাতঙ্গ শর্মার দাবি, তাঁর পাড়ার ছেলেরা মরা কুকুর সরাবে না। সরাতে হবে দোষী ট্রাকড্রাইভারকে। তা যদি না হয় তাহলে দরকার পড়লে তাঁর ছেলেরা লাশ নিয়ে অনির্দিষ্টকাল পথ অবরোধ করে থাকবে। ওদিকে ট্রাকড্রাইভারের সমর্থনে এগিয়ে আসা স্থানীয় মুসলমান পল্লীর ছেলেরা একযোগে জিগির তুলেছে জান যায় সে-ও ভি আচ্ছা, কিন্তু কালীবাড়ির মুর্দা কুত্তায় ড্রাইভারকে তারা হাত লাগাতে দেবে না।
কালেক্টরির কোন জমাদারকে দিয়ে লাশ সরানো যেত বটে, তাতে একটা সরকারী টাচ থাকত, সবাই মেনেও নিত হয়ত, কিন্তু উপস্থিত সে রাস্তাও বন্ধ। কারণ জমাদাররাও মানুষ। তাদেরও একটা জীবন ও একাধিক ইউনিয়ন আছে। অতএব রাত তিনটের সময় তাকে কাজ করতে ডাকলে ডি এম এর ঠ্যাং খোঁড়া হতে বাধ্য। ওদিকে কুকুর না সরালে অবরোধ উঠবে না। অবরোধ না উঠলে সকালে তেলমন্ত্রী নবকান্ত বারুই বাই রোড কলকাতা থেকে এসে সকাল দশটার মধ্যে নিজের বাড়িতে ঢুকতে পারবেন না। ঢুকতে না পারলে তাঁর বাড়ির মান্থলি নারায়নপুজোর লগ্ন বয়ে যাবে। আর লগ্ন বয়ে গেলে—-
হরেনবাবু মনে মনে কর্তব্য স্থির করে নিলেন। তারপর, গায়ের কোটটা খুলে গাড়িতে রাখলেন। রুমালে নাক বেঁধে নিয়ে একগাছা দড়ি নিয়ে এগিয়ে এলেন কুকুরটার কাছে—
(৫)
কাঁধের ওপর নাইলনের দড়িটা কেটে বসছিল। হরেনবাবু কুঁজো হয়ে দড়িবাঁধা কুকুরটাকে টেনে সরাচ্ছিলেন রাস্তা থেকে। বেশ ভারী কাজ। মাছের ঝোলের কড়াই অথবা পরীক্ষার খাতার বান্ডিল টেনে তুলতে অতটা কষ্ট হত না। আঃ! কী সব সুখের দিন ছিল সে’সব! সকালে বাজার করে ফিরে ইশকুল, তারপর—
–হঠাৎ চড়াৎ করে হরেনবাবুর মনটা স্থির হয়ে গেল। ডানহাতে দড়ির মুঠটা ধরে বাঁহাত বুকপকেটে ঢোকাতেই হাতে ঠেকল বাক্সটা। একটু একটু কাঁপছে সেটা। গুণগুণ শব্দ উঠতে শুরু করে দিয়েছে তার ভেতর থেকে। হরেনবাবুর ইচ্ছেটা ঠিক বুঝে ফেলেছে তার মিনিকমপ্যুটার—
ডানহাতে দড়িটা ধরে রেখেই কৌটোটা বাঁহাতে বের করে নিয়ে এসে তার ডালাটা খুলে ধরলেন হরেনবাবু। তারপর ভেতরে ভাসমান ব্ল্যাকহোলটার প্রচন্ড টানে একটা ফিতের মতন সরু হয়ে ফের ঢুকে গেলেন মটরদানার সাইজের সেই অন্ধকার তারার মধ্যে। লক্ষকোটি সমান্তরাল দুনিয়ার ভিড়ে হাজার হাজার ‘হলেও হতে পারত’ হরেন শাসমলের ভেতর থেকে তাঁর প্রিয় , বেঁটেখাটো ইশকুলমাস্টার হরেন শাসমলের দুনিয়াটাকে ঠিক খুঁজে এনে দেবে সেই ইচ্ছাপূরণের কালো তারা।
শেষমেশ
পরদিন সকালবেলা রান্নাবান্না সেরে ইশকুল যাবার পথে ব্যানার্জিপুকুরপাড়ে এক মিনিটের জন্য দাঁড়ালেন হরেনবাবু। তারপর আস্তে আস্তে পকেট থেকে নস্যির ডিবের মত বস্তুটাকে বের করে এনে গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে ছুঁড়ে মারলেন পুকুরের মাঝ বরাবর। একটা ঝকমকে হিরের টুকরোর মতন আলোর ঝিলিক দিয়ে উড়ে গিয়ে সেটা ঝপাৎ করে ডুবে গেল পুকুরের জলে। জলের তলায়,নরম নরম অনব্ধকার পাঁকেরমধ্যে ঘুমিয়ে থাক ব্যাটা দুঃস্বপ্নের যন্ত্র।
পাড়ের দিকে এগিয়ে আসা ছোটোছোটো ঢেউগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন হরেনবাবু। তারপর অ্যাবাউট টার্ন করে ছাতা হাতে হনহনিয়ে ইশকুলের পথে রওনা দিলেন। আজও ফের একটু দেরিই হয়ে গেল বোধ হয়।
Tags: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, হরেনবাবু ও ব্ল্যাকহোল