রামঅ ঘুরে এল অ্যালেন দম্পতি
লেখক: অদ্রীশ বর্ধন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
সে এক আজব দেশ। সেখানে ঘড়ি চলে উলটোদিকে, দোকানে জিনিস কিনলে হাতে টাকা গুঁজে দেয় দোকানি। চাকরি করে টাকা গুনে দিয়ে আসতে হয়! ব্যাকওয়ার্ড ইকনমিক্স নিয়ে লেখা এরকম অভিনব কাহিনি পড়ে ছেলে-বুড়ো-মেয়েরা প্রত্যেকেই চমৎকৃত হয়ে ভাবতে বসবে আহারে,… এমনটি কেন হয় না!
দরজার ওপর নাকটা চেপে ধরে ক্রুদ্ধ হুঙ্কার ছাড়ল জেফ অ্যালেন।
কাচের খানিটা অংশ বাষ্প-মলিন হয়ে ওঠে তার চেঁচানিতে। রীতিমতো গর্জন করে বউকে বললে ও—“একটা বোমা পেলেই কেল্লাফতে। এমন বোমা হওয়া চাই যার আওয়াজটা হবে বেশ জোরালো, এবং বাড়িটাকে ভূমিসাৎ না করে শুধু অফিসটাকে একেবারেই নিশ্চিহ্ন করে দেবে ওই জায়গা থেকে। অ্যান, বোমাটা কোথায় পাওয়া যায় বলো তো?”
টাইপ রাইটারের ওপর থেকে চোখ তুলে মিষ্টি হাসল অ্যান। বলল—“আর হাসিও না। তিলকে তাল বানিয়ে তুলছ তুমি।”
বোঁ করে ঘুরে গিয়ে দড়াম করে কাউন্টারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে অ্যালেন। “তিল থেকে তাল বানাচ্ছি? তার মানে বলতে চাও কিছুই হয়নি? দু-দুটো ট্র্যাভেল এজেন্সিকে ভরণপোষণ করার মতো বড়ো জায়গা যে ‘সেন্ট্রালিয়া’ নয়, তা তুমি ভালো করেই জানো। বেশ তো করে খাচ্ছিলাম আমরা। এখন যদি ব্যাবসা অর্ধেক হয়ে যায়, তাহলে তো উপোস করে মরতে হবে আমাদের।”
“ও এজেন্সি খোলার পর থেকে আমাদের ব্যাবসা এতটুকু কমেনি। সত্যি কথা বলতে কি, বেড়েছে।”
“অ্যান, ব্যাবসার এই উন্নতিটা, যে নেহাতই সাময়িক, তা তো তুমি জানো। ব্যাবসা পড়বেই। ও যতটুকু ব্যাবসাই করুক না কেন, সেইটুকুই বাদ যাবে আমাদের ব্যাবসা থেকে। অন্য কোনো জায়গা থেকে তো আর ওর ব্যাবসা আসতে পারে না। কাজেই, বোমাটা কোথায় পাওয়া যায় বলো তো?”
হেসে ফেলল অ্যান। বিমর্ষমুখে আবার টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে অ্যালেন। বেড়িয়ে-নিয়ে-পরে-টাকা-দিন পরিকল্পনা অনুযায়ী বেশ দু-পয়সা গুছিয়ে নিচ্ছিল ওরা দুজনে। পরিকল্পনা বেশ সাড়া জাগিয়েছিল টুরিস্টদের মধ্যে। আর পনেরোশো ডলার জোগাড় হলেই ক্যালিফোর্নিয়া রেডউডের রাঞ্চ বাড়িটা কিনে নিতে পারবে ও। সবশুদ্ধ দশটা ঘর আছে বাড়িটায়। সামনের দিকে আছে একটা বিশাল সরোবরের অপরূপ দৃশ্য। তিন বছর আগে বিয়ের পর থেকেই একটিমাত্র লক্ষ্য সামনে রেখে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চলেছে ওরা স্বামী-স্ত্রীতে। সে লক্ষ্য হল ব্যাবসাটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমন একটা অবস্থায় আনা যখন ক্লার্ক আর পার্সোনাল সেক্রেটারির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করবে বধূ অ্যান। তারপর সর্বান্তকরণে আত্মনিয়োগ করবে আদর্শ গৃহিনী হয়ে ওঠার কাজে।
সমস্ত প্ল্যানটাই কেঁচে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে লালচে-বাদামি দাড়িওয়ালা, টেকোমাথা ওই লোকটার আবির্ভাবে। বলা নেই কওয়া নেই, দুম করে একদিন যেন মাটি ফুঁড়ে সেন্ট্রালিয়াতে এসে হাজির হল ও। এসেই খুলে বসল একটা নতুন ট্র্যাভেল এজেন্সি। আর তাও কিনা অ্যালেনের ‘গ্লোব ট্র্যাভেল এজেন্সি’-এর ঠিক উলটোদিকে রাস্তার ওপারে। এমনই দুর্জয় সাহস ওর যে এর পরে ব্যাবসার নাম দেয় কিনা ‘গ্লুব ট্র্যাভেল এজেন্সি’।
অ্যান শুধোয়—“চেম্বার অফ কমার্স কী বলে?”
“হতভম্ব হয়ে গেছে ওরা।” জবাব দেয় অ্যালেন। ‘গ্লুব’ যে ‘গ্লোব’ এরই অপভ্রংশ, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলেও চলে। পক্ষান্তরে, ও বলে ওর নামটাই নাকি গ্লুব। কাজেই ওরা তো আর ওর নিজের নাম ব্যবহারে আপত্তি জানাতে পারে না? ওরা অবশ্য শিগগিরই তদন্ত করবে এ সম্পর্কে। আমি একদিন মি. গ্লুবের সঙ্গে কিছু কথাবার্তাও বললাম। লোকটা তো আমার সঙ্গে আলাপ করে বাস্তবিকই খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠল। আমরা যে মিলেমিশে দিব্বি ব্যাবসা চালিয়ে যাব, এ সম্পর্কেও ওর মনে কোনো সংশয় নেই। যে ধরনের ব্যাবসা ওর নাগালের বাইরে, আমার কাছে তা পাঠিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিলে লোকটা। আর তা শুনেই বুঝলাম পৈশাচিক ঠাট্টা করার বুদ্ধিতে টেকোমাথার জুড়ি মেলা ভার।” বলতে বলতে মাথা ঝাঁকিয়ে কথাটা শেষ করলে অ্যালেন—“আমার মনে হয় কী, ডোরিসকে বিদেয় দেওয়া যাক—মানে, নোটিস দেওয়া যাক এখনই।”
“কিন্তু ব্যাবসা তো এখনও চোট খায়নি। দেখাই যাক না কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়। যথেষ্ট সময় আমরা পাবো—”
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন এতটুকু চেহারার একজন বুড়ি। মাথার সব চুলই ধূসর। ঘরে ঢুকেই ক্ষিপ্র পদক্ষেপে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
বললেন—“আমি সরিপ্যা যেতে চাই। এখুনি সিট বুক করা দরকার।”
ভ্রূকুটি করে অ্যান। “কোথায় যেতে চান? জায়গাটার নাম?”
“সরিপ্যা।”
“কোন দেশের মধ্যে আছে জায়গাটা?”
চট করে মাথাটা কাত করে হতভম্ব চোখে গোটা অফিসটা একবার দেখে নিলেন বৃদ্ধা। পরক্ষণেই আচম্বিতে বলে উঠলেন—“ওহো, দুঃখিত আমি! নিশ্চয় ভুল…”
বলেই, চটপট পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন। বোঁ করে দরজাটা ঘুরে গিয়ে বন্ধ হয়ে যেতেই সোনালি মাথা নামিয়ে অ্যান ঝুঁকে পড়ল একটা মানচিত্রের ওপর। “রুমানিয়াতে সইরেট বলে একটা জায়গা আছে বটে, কিন্তু সেটা তো একটা নদী।”
অ্যালেন বলে উঠল—“ভদ্রমহিলার চালচলন কীরকম যেন সন্দেহজনক! বলে, জানলার কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেল আড়াআড়িভাবে রাস্তাটা পেরিয়ে গেলেন বৃদ্ধা। আর, তার পরেই কোনো দ্বিধা না করে হনহন করে ঢুকে পড়লেন গ্লুব ট্র্যাভেল এজেন্সির ভেতরে। ভদ্রমহিলা আর বেরোলেন না বটে, কিন্তু অফিসের ওপর থেকে নজর না সরানোর জন্যই অল্পক্ষণের মধ্যে ও দেখতে পেল ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন কায়দাদুরস্ত এক ভদ্রলোক। সরাসরি রাস্তাটা পেরিয়ে গ্লোব ট্র্যাভেল এজেন্সির দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের আঘ্রাণ নিলেন বুক ভরে এবং এমনভাবে ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন যেন আমেজটা ভালোই লেগেছে তাঁর।
এই ভালো-লাগাটা এবার সরবেই ঘোষণা করেন ভদ্রলোক। বলেন, “বেশ লাগছে জায়গাটা।” বলে, সটান কাউন্টারের সামনে এগিয়ে গিয়ে ছোট্ট করে হাসলেন অ্যানের দিকে তাকিয়ে। “সারা আমেরিকা ট্যুর করার একটা বন্দোবস্ত করতে চাই আমি। আমার হয়ে সব কিছু আয়োজন আপনি করতে পারবেন কি?”
রুদ্ধশ্বাসে বলে অ্যান। “পারব, স্যার।”
“আমি যেভাবে টুর শুরু করতে চাই, তা এই—ডেট্রয়ে একহপ্তা থাকবার পর ক্লিভল্যান্ডে…”
গুম গুম করে যাত্রাপথের বর্ণনা দিয়ে চললেন ভদ্রলোক। আর, ক্ষিপ্তের মতো তা লিখে নিতে লাগল অ্যান। তারপর বললে—“বন্দোবস্ত করতে একটু সময় লাগবে। আপনার সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে কোথায় বলুন তো?”
“সেন্ট্রালিয়া হোটেলে।”
“অল রাইট, মি.—”
“স্মিথ। জন স্মিথ।”
“মি. স্মিথ। এ সম্পর্কে এখুনি কাজ শুরু করছি আমি।”
“মাপ করবেন,” বলে ওঠে অ্যালেন, “আপনাকে গ্লুব ট্র্যাভেল এজেন্সি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম না?”
ঘুরে দাঁড়ালেন মি. স্মিথ। হাসিমুখে তাকালেন অ্যালেনের পানে। বলেন, “ঠিকই দেখেছেন আপনি। ওই ভদ্রলোকই সুপারিশ করলেন আপনাদের।”
টেবিলে ফিরে এল অ্যালেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে দারুণভাবে পেনসিল চিবুতে শুরু করে দিলে।
এর পরেই এলেন গাঁট্টাগোট্টা চেহারার টাকমাথা এক ভদ্রলোক। বিদেশি উচ্চারণে নার্ভাসভাবে চটপট গোকাশি পৌঁছোতে চাইলেন তিনি। দেখা গেল মাঝবয়েসি এক ভদ্রমহিলাকে। ধীর, স্থির, প্রশান্ত প্রকৃতি তাঁর। তিনি অবশ্য চুপচাপই ছিলেন আগাগোড়া। কথাবার্তা চালিয়ে গেল দুজন তরুণী। দু-রকমের ফিক ফিক হাসির মাঝে মাঝে তারা খোঁজ নিলে নড্ল্যাইয়া নিক জায়গাটা বাস্তবিকই করয়ইউনি-এর ধারে কাছে কিনা এবং নলিক্ব্রু হয়ে সেখানে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব কিনা। এ ছাড়াও অনেকেই এল এইভাবে।
শেষকালে ম্যাপ হাতড়ানো বন্ধ করল অ্যান। এই ধরনের বিদঘুটে গন্তব্যস্থানের খোঁজখবর নিতে কেউ এলেই কাঁপা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিতে লাগল রাস্তার ওপারে মি. গ্লুবের সাইনবোর্ডটা। এবং তা দেখামাত্র অকপট উৎসাহে সাঁৎ করে রাস্তা পেরিয়ে সেইদিকে উধাও হতে লাগল লোকগুলো।
এরই ফাঁকে ফাঁকে সবরকম যুক্তিসঙ্গত অনুপাত ছাড়িয়ে হু-হু করে বৃদ্ধি পেতে লাগল গ্লোব ট্রাভেল এজেন্সির ব্যাবসা। রাঞ্চবাড়ির বকেয়া টাকাটা মিটিয়ে দিল অ্যালেন। এরপর অ্যান বেঁকে বসল। ব্যাবসার চাপ যে রকম বেড়েছে, এখন ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময় তার নেই। কাজে-কাজেই আরও দুজন অফিস-গার্ল বহাল করল অ্যালেন।
হপ্তা দুয়েক পরে একদিন অ্যানকে বলল অ্যালেন—“একটা জিনিস লক্ষ করেছে? আমাদের খদ্দেরদের শতকরা আশিভাগই সেন্ট্রালিয়ার বাসিন্দা নয়।”
“ব্যাপারটা লক্ষ করে আমিও কম অবাক হইনি।”
“আরও লক্ষ করেছ কি যে, আজকাল ওই ধরনের উদ্ভট জায়গা সম্বন্ধে খোঁজখবর নেওয়াটা অনেক কমে এসেছে?”
“গতকাল শুধু একজনই এসেছিল খোঁজ নিতে। আজকে এখনও কেউ আসেনি।”
বলতে বলতে থেমে গেল অ্যান। ফুটপাতের ওপর থমকে দাঁড়ালেন শুভ্রকেশ এক ভদ্রলোক। চোখে মুখে পাণ্ডিত্যের ছাপ। জানলার মধ্যে দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে এদেরকে দেখছিলেন ভদ্রলোক। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে অফিসের মধ্যে ঢুকে করয়ইউনি যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে রিজার্ভেশন চাইলেন। কোনো কথা না বলে আঙুল তুলে গ্লুব-এর সাইনবোর্ডটা দেখিয়ে দিল অ্যান। বিড় বিড় করে ক্ষমাভিক্ষা করে অফিস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
আপন মনেই বলে ওঠে অ্যালেন—“করয়ইউনি! জায়গাটার নাম এর আগেও শুনেছি আমি।”
“আমিও,” বলে অ্যান।
“এ ব্যাপারের তলা পর্যন্ত না দেখে আমি ছাড়ছি না। সাড়ে বারোটার সময়ে লাঞ্চে বেরিয়ে যান মি. গ্লুব। পৌনে একটার সময়ে গ্লুব ট্র্যাভেল এজেন্সিতে যাচ্ছি আমি। তারপর দেখাই যাক না, চটপট করয়ইউনি যাওয়ার কোনো বন্দোবস্ত করা যায় কি না।”
“আমাকে বাদ দিয়ে তোমার যাওয়া হচ্ছে না কিন্তু,” বলে ওঠে অ্যান।
ডোরিস বেচারি হতভম্ব হয়ে গেল এদের হুকুম শুনে। যদি ওদের ফিরতে দেরি হয়, তাহলে ডোরিস যেন টাকাকড়ি নিয়মিত ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দেয়। দরকারি চেক সই করার সীমাবদ্ধ ক্ষমতাও ওকে দিয়ে যায় অ্যালেন। তারপর রাস্তা পেরিয়ে দুজনে আক্রমণ করেন গ্লুব ট্র্যাভেল এজেন্সিকে। ওদের দেখেই সাদরে অভ্যর্থনা জানায় একজন হাসিমুখ সহকারী।
অ্যালেন বলে—“করয়ইউনি। চটপট করুন।”
নম্রভাবে সহকারীটি বলে—“দুজন। বাষট্টি ডলার পঞ্চাশ সেন্ট।”
তৎক্ষণাৎ বাষট্টি ডলার পঞ্চাশ সেন্ট গুনে দেয় অ্যালেন।
“বদল করার মতো কোনো টাকা আছে?”
“কেন—ইয়ে—না,” বলে অ্যালেন।
“মালপত্র নেই?”
“না। দেখুন—”
“বুঝেছি। এই তো ভালো। এবার কাগজপত্রগুলো—”
বলেই ক্ষিপ্র হাতে অ্যালেনের ডান হাতটা তুলে নিয়ে বুড়ো আঙুলটা কালিতে ভিজিয়ে কাগজের পরিষ্কার করে মুছে দিলে বুড়ো আঙুলটা। “এবার আপনি, প্লিজ,” বলে পরক্ষণেই অ্যানের আঙুল নিয়েও ছাপ তুলে নিলে ও। “ধন্যবাদ। সুন্দর হয়ে উঠুক আপনাদের এই ট্যুর।”
“হয়তো দেখবেন বেশ পিছিয়ে আছে ওখানকার বাসিন্দারা।”
খুশি-খুশি মুখে অ্যালেন বললে—“তাতে কিছু এসে যায় না।”
“বেশির ভাগ লোকই এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। এইদিকে প্লিজ।”
পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় লোকটা। পেছন পেছন আসে ওরা দুজনে। লিফটয়ে চেপে নেমে যায় একদম নীচের তলায়। তারপর এসে দাঁড়ায় দেওয়ালের গায়ে লাগানো মস্ত বুদ্বুদের মতো একটা ধাতব ঘরের সামনে। দরজা খুলে ধরে সহকারী।
“বসুন। দরজা না খোলা পর্যন্ত বসে থাকবেন।”
ওরা বসে পড়ে ।
হাসিমুখে লোকটা আবার ওদের আসতে বলে। তারপরেই বন্ধ হয়ে যায় দরজাটা। ঘরটা অনেকটা চোঙার মতো। মেঝে থেকে বেঁকিয়ে তোলা ছ-সারি আসনের একদিকে বসেছিল ওরা।
অ্যান বলে—“এ যেন একটা কার্নিভাল। পঁচিশ সেন্ট দিলেই ঘুরিয়ে আনবে বিভীষিকা কক্ষের ভেতর দিয়ে। ভূগর্ভ গাড়িও হতে পারে।”
“হতে পারে। কিন্তু সেন্ট্রালিয়াতে এর কী দরকারটা শুনি? ইন্টার-স্টেট কমার্স কমিশন এ জিনিসের অস্তিত্ব জানে কিনা, সে বিষয়ে দারুণ সন্দেহ হচ্ছে আমার।”
ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি। এত সামান্য যে আগে থেকেই কোনোকিছুর জন্যে সজাগ হয়ে না থাকলে ওরা বুঝতেই পারত না। দপ করে একটা লাল আলো জ্বলে উঠেই মিলিয়ে গেল আস্তে আস্তে। হাঁ করে ওরা দুজনে তাকিয়ে থাকে পরস্পরের দিকে। তারপরেই দরজাটা খুলে যায়। উঁকি মারে আর একজন তরুণ।
“নিছক খানিকটা গাড়ি চড়া হল আর কি,” বলে ওঠে অ্যালেন।
“করয়ইউনি টার্মিনাল। বেরিয়ে আসুন, প্লিজ।”
ওরা বেরিয়ে আসে। তারপর এগিয়ে যায় পিছু পিছু।
“এইদিক দিয়ে কাস্টমসয়ে যেতে হবে,” বলে ছোকরা।
‘কাস্টমস’ লেখা একটা টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা।
একজন তরুণী লিখে নেয় ওদের কোনো মালপত্র নেই। অ্যানের পার্স খুলে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয় ভেতরকার জিনিসপত্রে। তারপর হাত নেড়ে নির্দেশ দেয় এগিয়ে যাওয়ার। ওরা এসে দাঁড়ায় বাইরে। যানবাহনের টার্মিনালের মতোই বিরাট জায়গাটা। টিকিটের জানলা রয়েছে। ট্যুরিস্টরা ব্যাগ নিয়ে এদিকে সেদিকে ঘুরছে। গাড়ি পৌঁছোনোর এবং ছেড়ে যাওয়ার একটা বিরাট সময়তালিকা ও চোখে পড়ল ওদের। জায়গাগুলোর নাম কিন্তু সবই বিদ্ঘুটে, উচ্চারণ করতে গেলে রসনার রীতিমতো কসরৎ দরকার। যে দরজা দিয়ে এইমাত্র বেরিয়ে এসেছে ওরা পেছন ফিরে সেদিকে তাকায় অ্যান।
মস্তবড়ো একটা সাইনবোর্ডে লেখা ছিল “‘বগ্লু’ ইনকরপোরেটেড, আশ্চর্য পর্যটক বিশেষজ্ঞ।”
“কথাটা মিথ্যা নয়,” বলে অ্যালেন।
পায়ে পায়ে ভিড় পেরিয়ে আসে ওরা।
অনেকদূর এসে বসে পড়ে দুটো আসনের ওপর। ভারী বেয়াড়া সিট দুটো, মোটেই জুত করে বসতে পারে না ওরা। আশপাশে চোখ বুলোতে গিয়েই বড়ো বড়ো চোখে একটা ঘড়ির দিকে তাকায় অ্যালেন।
“এখানকার সময়-টময়গুলোও বিদ্ঘুটে দেখছি। ওই ঘড়িটায় এগারোটা বেজে পাঁচ মিনিট। কিন্তু আমার ঘড়িতে একটা বাজতে পাঁচ মিনিট। তোমার ঘড়ি কী বলে?”
“একটা বাজতে পাঁচ,” বলে অ্যান।
“তা হলে এখন কী করা যায় বলো? করয়ইউনি নামে একটা জায়গা যে সত্যিই আছে, তা তো আমরা প্রমাণ করেছি। এবার ফিরে গেলে কেমন হয়?”
“এখুনি ফিরে গেলে লোকে হাসবে।”
“ঠিক। তাহলে আমরা প্রমাণ করলাম যে করয়ইউনি বলে একটা জায়গা আছে! কিন্তু কোথায় সে জায়গাটা? আমি জানতে চাই… কী ব্যাপার?”
আচমকা অ্যানের কনুইয়ের দারুণ খোঁচায় চমকে ওঠে অ্যালেন।
“ঘড়িটার সেকেন্ডের কাঁটাটা পেছন দিকে ঘুরছে।”
চোখ পাকিয়ে তাকায় অ্যালেন। “মিনিটের কাঁটাও ঘুরছে।” কয়েক মিনিট পরে, “ঘণ্টার কাঁটাটাও।”
ঘড়ির দিকে তাকায় অ্যান। “তাহলে আমাদের ঘড়িতে যখন একটা বাজে, ওদের ঘড়িতে তখন এগারোটা বাজে! আমাদের যখন—”
“দুটো, ওদের তখন দশ। ওইভাবেই চলবে পিছুহাঁটা। আমাদেরই সময়ের মতো—শুধু যা গতিটা বিপরীত দিকে।”
“‘বগ্লু, ইনকরপোরেটেড’—এর সাইনবোর্ডটা পড়ছিল অ্যান। এবার বলে ওঠে, “আচ্ছা, উলটোদিক থেকে পড়ো তো শব্দটা”… অ্যালেন পড়ল। খুব আস্তে আস্তে পড়ল। তারপরেই ফিরে তাকাল অ্যানের পানে—“বগ্লু! দি গ্লুব ট্র্যাভেল এজেন্সি।”
“আর এই শহরটা। করয়ইউনি। এটা কি তাহলে…”
“নিউ ইয়র্ক!”
“নিশ্চয় তাই।”
“এটা কি তাহলে কারও একটা বিরাট ঠাট্টা!”
“কিন্তু আমরা তো এখানেই রয়েছি, নয় কি?”
“কিন্তু ‘এখানটা কোথায় শুনি? সেন্ট্রালিয়া থেকে খুব জোর বিশ সেকেন্ড আসতে লেগেছে এখানে। কিন্তু নিউ ইয়র্ক রয়েছে প্রায় ছশো মাইল দূরে। তারপরেও, কোনদিকে গেছিলাম আমরা? পুবে, পশ্চিমে, সিধে না নীচে?”
“গ্লুবের অ্যাসিস্ট্যান্ট যা বলেছিল, আমি এখন তাই ভাবছি। মনে পড়ে তোমার? ও বলেছিল, হয়তো দেখবেন বেশ পিছিয়ে আছে ওখানকার বাসিন্দারা।”
ঘাড় ঝাকিয়ে অ্যালেন বললে—“চটপট শহরটা দেখে এলে হয় না?”
“মন্দ হয় না। কোনোদিন নিউ ইয়র্কে আসিনি আমি।”
“এখনও নিউ ইয়র্কে আসোনি তুমি।”
লিফটে চড়ে তিনতলায় উঠে এলো ওরা। সামনেই পেল বেরোবার পথ।
দরজার কাছে আসতেই ইউনিফর্ম পরা একজন লোক এসে বললে—“ট্যাক্সি?”
“ইংরেজি বলে এরা,” অ্যালেন বলল অ্যানকে।
“উলটোদিকেও বলে না। ঈশ্বরের অশেষ করুণা,” বলে অ্যান।
রাস্তাটা আসলে একটা সুড়ঙ্গ ছাড়া কিছুই নয়। মস্ত সুড়ঙ্গ। খুব উঁচু উঁচু বেঁকানো ধনুকের মতো খিলেন। বিস্তর আলোয় দিনের মতোই ঝলমল করছে গোটা টানেলটা। বহুলোক হাঁটছে—ফুটপাতের ওপর দিয়ে। রাস্তার ওপরেও যানবাহনের স্রোত বয়ে চলেছে।
অ্যান বললে—“নীচের তলা থেকে। জলের ওপর যেমন প্রতিবিম্ব দেখা যায়, সেইরকমও হতে পারে। খুব সম্ভব ঠিক ওপরেই কোথাও হয়তো রয়েছে আসল নিউ ইয়র্ক।”
দাঁড়িয়ে পড়েছিল অ্যালেন। বাসে উঠছিল কয়েকজন যাত্রী। সেই দিকেই তাকিয়ে ছিল অ্যালেন।
অ্যান বললে—“উঁহু, ও বাসে চড়ার উপায় নেই আমাদের। তুমি তো ডলার বদল করে আনোনি।”
“এরকম কিম্ভুতকিমাকার জায়গায় আসব, তা জানব কী করে বলো? সে যাই হোক; আমি এমনিই তাকিয়ে ছিলাম ওদিকে। লক্ষ করো, এখানকার গাড়ি চলে রাস্তার ভুল দিক দিয়ে। বাসের ড্রাইভার বসে বাসের পেছন দিকে। কোনদিকে চলছে, তা বোঝে কী করে?”
“খুব সম্ভব সামনের দৃশ্য দেখার জন্যে আয়না আছে সামনে।”
বাসটা বেরিয়ে যাওয়ার পর ওরা আবার হাঁটতে শুরু করে। সুড়ঙ্গস্থিত রাস্তার পর রাস্তা পেরিয়ে চলল ওরা। মনে হল, না জানি কত মাইলই হাঁটা হয়ে গেল। লক্ষ্যহীনভাবে পথ চলছিল ওরা। যেতে যেতে বাড়ির নাম, রাস্তার নাম, জায়গার নামগুলো পড়ছিল পেছন দিক থেকে। চেনাশুনো কিছু কিছু নাম পেয়ে যাচ্ছিল ওরা এইভাবে। চোখে পড়ল ব্রডওয়ে, ফিফ্থ অ্যাভিন্যু! তারপর টস্টে রম্পায়াএ বিল্ডিং। পৃথিবীর ‘গভীরতম’ বাড়ি এটি। বাড়িটার মধ্যে পরিদর্শন গ্যালারি দেখার লোভ সামলে নেয় ওরা।
অ্যান বললে—“বিরাট একটা শহর ছাড়া আর কিছুই নয়। বড়ো বেশি লোক, বড়ো বেশি ভিড়, আর বড়ো বেশি গোলমাল।”
“আর, নেই নীল আকাশ,” বললে অ্যান। “আকাশটা নিশ্চয় অন্য কোথাও আছে। কোথায় রেখেছে বলে মনে হয় তোমার?”
এরপর যখন সময় সম্বন্ধে হুঁশ হল ওদের তখন পাঁচটা বেজে গেছে, অথবা করইউনি সময় অনুসারে সাতটা বাজেনি। এ শহর ছেড়ে লম্বা দেওয়ার ব্যাপারে আর কোনোরকম দ্বিমত ছিল না ওদের মধ্যে।
সুড়ঙ্গ পথ চিনে আবার ওরা ফিরে এল টার্মিনালে। সেখান থেকে টিকিট বিক্রির জায়গায়। আচম্বিতে ঘুরে দাঁড়ালো অ্যান। সজোরে অ্যালেনের বাহু আঁকড়ে ধরে বলে উঠল—“টিকিট কিনবে কী করে।”
“প্রচুর ডলার রয়েছে আমার পকেটে।”
“ডলার। কিন্তু ডলারগুলো বদলে নাওনি তুমি। ওরা যদি ডলার না চায়?”
“ডলার যে কেউ নেবে। আসবার সময়ে এরাই তো ডলার নিয়েছে, তাই নয় কি? তা ছাড়া না নিলেও, অন্য কোথাও নিশ্চয় ডলার বদলে নেওয়ার কোনো বন্দোবস্ত আছে!”
অ্যান বলব—“তোমার কথাই সত্যি হোক। পেছনদিকে চিন্তা করার মজা একটা বিকেলের পক্ষেই যথেষ্ট। কিন্তু স্থায়ীভাবে এ মজা লুটবার মতো বয়স আমার নেই, যথেষ্ট বুড়িয়ে গেছি আমি।”
‘বুড়িয়ে যাওয়া’ তাজা ফুলের মতো মুখখানার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠল অ্যালেন।
তারপর দুজনে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যায় বগ্লু করপোরেটেড অভিমুখে অভিমুখে। দরজার সামনেই থমকে দাঁড়িয়ে যায় ওরা। বন্ধ হয়ে গেছে বগ্লু ইনকরপোরেটেড। দরজার ওপর লেখা রয়েছে ‘৩টা থেকে ৭টা’। আঙুল গুনে অ্যালেন বললে—“তার মানে ৯টা থেকে ৫টা। আমার ঘড়িতে বাজে পাঁচটা কুড়ি।”
অ্যান বললে—“তাহলে এখন কি করা যায়? সারারাত স্টেশনে বসে থাকব?”
“নিশ্চয় না। হোটেলে উঠব।”
“হোটেল বিল দেবে কী করে?”
“কাল সকালে কিছু ডলার বদলে নেওয়ার ব্যবস্থা করব ‘খন।”
“ঠিক আছে,” বলে অ্যান।
বেশ আত্মসচেতনভাবে ওরা গুটি গুটি গিয়ে দাঁড়ায় রটালস্ট্যা হোটেলের রেজিস্ট্রেশন টেবিলের সামনে। ওদিক থেকে কেরানি ভদ্রলোক ভ্রূকুটি করে দুজনের আপদমস্তক নিরীক্ষণ করে নেয়, সন্দিগ্ধভাবে লক্ষ করে ওদের কোনো মালপত্রই নেই। তারপর যেন ঘৃণায় নাক কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “নিঃসন্দেহে বিবাহিত?”
অপমান বোধ করে অ্যালেন। গরম হয়ে গিয়ে বলে—“বিবাহিত তো বটেই, তিন বছর হল বিয়ে হয়েছে আমাদের।”
কেরানি ভদ্রলোকের ওপর যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল, তার জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিল না অ্যালেন। দেখতে দেখতে টকটকে লাল হয়ে উঠল লোকটার মুখ। থুথু করে খানিকটা থুথু ছিটিয়ে ভয়ংকরভাবে হাত দুলিয়ে উঠতেই ওদিক থেকে আরও দুজন কেরানি এসে দাঁড়াল তার পাশে। আঙুল তুলে এদের দেখিয়ে বোমার মতো ফেটে পড়ল ভদ্রলোক—“বিবাহিত!”
“তুমি কি বলতে চাও ওরা তা স্বীকার করছে?”
“সাহস দেখেছ—তাও কিনা একটা প্রথম শ্রেণির হোটেলের মধ্যে। আমাদের ভাবে কী ওরা?”
“পুলিশ ডাকো।”
অ্যানের হাত ধরে টেনে দৌড় মারল অ্যালেন। দরজার বাইরেই ওদের দাঁড় করালে হোটেলের এক বয়। একটা কাগজে খসখস করে কী লিখে তুলে দিলে অ্যালেনের হাতে।
বললে—“এখানে চেষ্টা করুন। খারাপ নয় হোটেলটা। আর এসব নিয়ে অত মাথাও ঘামায় না। তবে আপনারা যে বিয়ে করেছেন, সেটা ওদেরকে না বললেই ভালো করবেন। ওরা যাই ভাবুক না কেন, তাতে কিছু এসে যায় না। কিন্তু যখনই আপনি নিজেই এসে সে কথা বলেন…”
“ধন্যবাদ,” বলে অ্যালেন।
“উল্লেখের প্রয়োজন নেই। আমি নিজেও একবার বিয়ে করেছিলাম।”
হোটেলটা ছোটোখাটো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং পরিবেশটাও বেশ ভদ্ৰ। রেজিস্টারে অ্যালেন সই করার সময়ে এখানকার কেরানিও নাক ঠোঁট কুঁচকে তাকিয়ে ছিল বটে, কিন্তু মুখে কিছু বলেনি। অ্যালেন বুঝিয়ে দিলে, শুধু রাতটা কাটাতে চায় ওরা। এক রাতের জন্যে পনেরো রলাড খুব বেশি বলে মনে হল না। হাসিখুশি চেহারার একজন হোটেলবয়ের হাতে ওদের সঁপে দিলে কেরানিটি। বয়ের পিছু পিছু ওরা যে লিফটে ঢুকল, সেটা ওপরের দিকে না গিয়ে নেমে গেল নীচের তলায়।
ফিসফিস করে অ্যান শুধোয়—“কী ব্যাপার?”
“ভাবছি বয়টাকে কীভাবে বখশিস না দিয়ে ভাগানো যায়।”
ঘরে পৌঁছে দ্রুত চোখ বুলিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিলে বয়টা। ইচ্ছে করেই ওর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ায় অ্যালেন। আর ঠিক তখনি অ্যালেনের হাতে কী গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে যায় লোকটা।
দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতেই বোমার মতো ফেটে পড়ে অ্যালেন—“একি অপমান! ওকে বখশিস না দেওয়ার মতলবে ছিলাম বলেই—ও আমাকে তিন ডলার বখশিস দিয়ে গেল।”
একটা নোট তুলে নিল অ্যান। বলল—“নটশিংয়াও-র ছবিটা তো ভারী সুন্দর। তোমার কি মনে হয় এ দিয়ে আমাদের খাবারের দামটা দেওয়া যাবে?”
“খুব সম্ভবত নয়—অন্তত ভালো খাবার পাওয়া যাবে না তিন রলাডে। খিদেও পেয়েছে বেশ। আমরা বরং খাবারের অর্ডার পাঠিয়ে দিই। দামটা বিলের সঙ্গেই জুড়ে দেবে’খন। মেনুটা এখানেই থাকতে পারে।”
খাবার এসে পৌঁছল।
নিয়ে এল সেই দাঁতবারকরা বয়টা। অ্যালেন তো মহাচিন্তায় পড়ল কীভাবে ওরই দেওয়া রলাড তিনটে আবার গছিয়ে দেওয়া যায় ওকে। লোকটা কিন্তু কোনো সুযোগই দিল না অ্যালেনকে। ক্ষিপ্ৰহাতে টুক করে কয়েকটা নোট ট্রে-র ওপর রেখে সরে পড়ল চটপট।
অ্যালেন এবার রীতিমতো লাফাতে থাকে—“আবার বখশিস দিয়ে গেল আমাকে। এবার পাঁচ রলাড!”
“এ নিয়ে আর হামলা করো না লক্ষ্মীটি।” বলে অ্যান। “হোটেল বিলের খানিকটা তো এই দিয়ে মিটিয়ে দেওয়া যাবে।”
“উহুঁ, ও সব হচ্ছে না। এই আমি রাখলাম রলাডগুলো ট্রে-র ওপর। রলাডগুলো যে ওর হাতে তুলে দিচ্ছি না, এই যথেষ্ট।”
ট্রে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আবার এল বয়টা। খুব সন্তর্পণে ট্রে থেকে রলাডগুলো তুলে নিয়ে সে রেখে দিলে টেবিলের ওপর। পরে অ্যালেন তা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখলে রলাডের পরিমাণ আর আট নেই, এগারো হয়ে গেছে।
সারা দিনটা দারুণ পরিশ্রম হয়েছে। কাজেই অকাতরে ঘুমালো দুজনে। ঘুম যখন ভাঙল, তখন ন-টা বেজে গেছে—করয়ইউন সময় অনুসারে তিনটে নয়। বয়টার হাতে পাছে আরও অপমানিত হতে হয়, তাই এবার ব্রেকফাস্ট খেলো হোটেলের খাবার ঘরে। চেকটা হোটেল-বিলের সঙ্গে জুড়ে দিতে নির্দেশ দেওয়ার পর অ্যান ফিরে গেল। আর, অ্যালেন পায়চারি করতে করতে টার্মিনালে পৌঁছল কিছু ডলার বদল করে নিয়ে সেন্ট্রালিয়া ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে।
বগ্লু ইনকরপোরেটেড-এর তরুণটি সহানুভূতির সঙ্গে বললে—“নিয়মকানুন খুবই কড়া আমাদের। কাজেই ব্যতিক্রম হতে দিতে পারি না আমরা। আসবার সময়েই অন্য প্রান্তে ডলার বদলে রলাড করে নেওয়া উচিত ছিল আপনার। তা যখন করেননি, আমি দুঃখিত, কোনোরকম সাহায্য করতে পারব না আমি।”
একটা চেয়ার খুঁজে নিয়ে আস্তে আস্তে বসে পড়ল অ্যালেন।
ওর বিমর্ষ মুখচ্ছবি দেখে হতভম্ব হয়ে যায় তরুণ ট্রাভেল এজেন্ট। বলে—“ডলার খরচ করার জন্যেই যখন আপনার এত আগ্রহ, তখন আর একবার বেড়িয়ে এসে ওগুলো খরচ করে ফেললেই পারেন।”
অ্যালেনের চোখে মুখে আবার রোশনাই দেখা যায়—“ঠিক বলেছেন। তাই করাই ভালো। সেন্ট্রালিয়ার দুটো টিকিটের জন্যে কত ডলার দিতে হবে?”
ধৈর্যের সঙ্গে বলে তরুণটি—“আপনাকে তো বললাম, বিদেশি অর্থের লেনদেন শুধু বিদেশি টার্মিনালেই হয়। এখানে রলাড ছাড়া আর কিছু চলে না। দুটো টিকিটের জন্যে এক হাজার রলাড। কখন যেতে চান?”
“ভেবে দেখি,” বলে অ্যালেন।
হোটেলে ফিরে আসার পর দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইল নির্বাক হয়ে।
তারপর অ্যালেন বললে—“বয়টাকে অশেষ ধন্যবাদ। এগারোটা রলাড দিয়ে যাওয়ার জন্যে। হোটেলের বিল হবে পনেরো প্লাস খাবারের দাম, কম করে পঁচিশ। আর, ফিরে যাওয়ার জন্যে আমাদের দরকার এক হাজার।
“মাথায় কোনো মতলব আসছে নাকি?”
মাথা নাড়ল অ্যান—“মনে হচ্ছে বহুদিন এখানে থাকতে হবে আমাদের। মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্যে থাকা নয়! কাজ করতে হবে দুজনকে। খেটে রোজগার করতে হবে পাথেয়।”
অ্যালেন বলল—“সিধে ম্যানেজারের কাছে গিয়ে সব স্বীকার করা ভালো। খুব সম্ভব আমাদের কাজ জুটিয়ে দিতে পারবেন ভদ্রলোক।”
“এখানেই থাকলে কেমন হয়?”
“খরচ খুব বেশি হবে। শুধু ঘণ্টার জন্যেই হপ্তায় একশো রলাডেরও বেশি। তার ওপর খাবারের দাম আছে। পোশাকের খরচও আছে। এই বিদ্ঘুটে দুনিয়ায় ক-জন লোক যে খেটে যায়, সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই নেই।”
থমথমে মুখে ওরা নেমে আসে কেরানির কাউন্টারে। ওদের দেখেই বলে ওঠে লোকটা—“চলে যাচ্ছেন তো? ওই জানলায় গিয়ে হিসেব মিটিয়ে ফেলুন।”
নির্দিষ্ট জানলায় বসেছিলেন একজন তরুণী। বিলের বিষয়গুলো পরপর সাজিয়ে জোরে জোরে ওদের পড়ে শোনাল সে। “ঘর, একদিন, পনেরো রলাড। ডিনার, ঘরে দিয়ে আসা হয়েছে, এগারো রলাড।” ভুরু কুঁচকোয় অ্যালেন। “ব্রেকফাস্ট, তিন রলাড। সব সমেত, উনত্রিশ রলাড। বিলটা রিসিভ করুন।”
“আবার কেন?” শুধোয় অ্যালেন।
কী যে হচ্ছে, তা বুঝবার আগেই ওর ডান হাতের বুড়ো আঙুলে কালি মাখিয়ে টিপ সই নিয়ে আঙুলটা ফের মুছে পরিষ্কার করে দেয় মেয়েটি। অ্যানকেও দিতে হয় টিপসই। আর মাত্র এগারো রলাড-এর বেশি অর্থ যে তার কাছে নেই, এই কথাটাই বুঝিয়ে বলার উপযুক্ত শব্দ খুঁজতে যখন ব্যস্ত অ্যালেন, ক্ষিপ্র হাতে নোট গুনে গুনে কাউন্টারের ওপর ফেলতে থাকে মেয়েটি।
“কুড়ি, পঁচিশ, উনত্রিশ। অনেক ধন্যবাদ, স্যার। আশা করি, পরের বার এ শহরে এলে আমাদের এখানেই পায়ের ধুলো দেবেন।”
টলতে টলতে জানলা থেকে সরে আসে দুজনে। হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এসে আধখানা ব্লক পেরিয়ে না আসা পর্যন্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারে না দুজনে।
তারপর অ্যালেন বলে উঠল—“ওরাই আমাদের বিল মিটিয়ে দিল।”
অ্যান কোনো কথা বলল না।
“শুধু তাই নয়, বখশিসও দিয়েছে ওই বয়টা।”
থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে একটা দোকানের দিকে আঙুল তুলে দেখালো অ্যান। বলল—“মেয়েদের পোশাকের দোকান। আমার অন্তর্বাসটা পালটানো দরকার।”
দোকানে ঢুকল দুজনে। ছোটোখাটো দু-চারটে জিনিস কেনার পর ওদের হাতে ছ-টা রলাড গুঁজে দিলে কেরানি ভদ্রলোক। দোকান থেকে বেরিয়ে এল ওরা।
“আর একটা হোটেলে?” শুধোয় অ্যালেন।
“নিশ্চয়। সবচেয়ে বেশি দামের হোটেল যেটা, সেখানে!”
“দম্পতি-স্যুট চাইলেই তো পারি?”
“দারুন শক পাবে ওরা। ভাববে আমরা বিয়ে করেছি।”
“হোটেলের স্যুট ছাড়া বেশি দামের কি কিছু নেই? চল, বাড়ি ভাড়ার হদিশ দিতে পারে, এমন কোনো এজেন্টের কাছে যাওয়া যাক।”
এরকম একজন এজেন্টকে খুঁজে পেতে বার করল ওরা। ওদের জন্যে জমকালো ফ্ল্যাট ঠিক করে দিল সে এক হপ্তার মেয়াদে। ভাড়া একশো রলাড। ভাড়াটা অগ্রিম দিয়ে দেওয়া হল ওদের। এমনকী এজেন্সির কমিশন বাবদ চল্লিশ রলাড সে তুলে দিলে এদের হাতে। একজন পরিচারিকা আর রাঁধুনিও ঠিক করে দিয়েছে সে। কাজে যোগদান করার সময়ে মহানন্দে তারা তাদের এক হপ্তার মাইনে গুঁজে দিলে অ্যালেন-দম্পতির হাতে।
তারপর অ্যালেন আর অ্যান বেরোলো এক বেপরোয়া কেনাকাটার অভিযানে। মালপত্র কেনার পর বুড়ো আঙুলের ছাপ দিলে ওরা এবং প্রতিদানে পেল একশো পঞ্চাশ রলাড।
ভারী সুন্দর একটা স্যুট পছন্দ করল অ্যালেন। কেরানি তো ওর পছন্দ দেখে মহাখুশি। হাসিমুখে ওর বুড়ো আঙুলের ছাপ নিয়ে হাতে তুলে দিলে পঁচানব্বই রলাড। ফিটফাট থাকার সবরকম পোশাক কেনা সাঙ্গ হলে দুজনে ফিরে এল ওদের ফ্ল্যাটে।
অ্যালেন বললে—“এক হাজার রলাড হয়ে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে এদেশ ছেড়ে এবার সরে পড়তে পারি আমরা।”
ঝলমলে লিভিং-রুমের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল অ্যান। বিষণ্ণ চোখে দূরের কোণে রাখা উচ্ছ্বল ফোয়ারাটার দিকে তাকিয়ে বলল—“হ্যাঁ, তা তো পারি।”
“সত্যি সতিই আমাদের এবার ফিরে যাওয়া দরকার। ডোরিস বেচারি একা সামলাতে পারছে না হয়তো।”
“খুব সম্ভব পারছে না।”
অ্যানকে এবার দু-হাতে ধরে সজোরে ঝাঁকানি দিয়ে বলে উঠল অ্যালেন—“গোল্লায় যাক ডোরিস। কোনোদিনই আয়েশ করে মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে পারিনি আমরা। এবার তা করা যাক। এক হপ্তার জন্যে ও অনায়াসেই সামলে নিতে পারবে। কাজের চাপ পছন্দ করবে না জানি, কিন্তু বেসামালও হবে না।”
আনন্দ উপছে পড়ে অ্যানের কণ্ঠে—“তাই ভালো। এ ধরনের পরিবেশ আবার কবে পাবো, তা কি কেউ বলতে পারে?”
সপ্রেম আলিঙ্গনে অ্যানকে বেঁধে ফেলে বলে অ্যালেন—“স্বর্গ!”
“অমরা!” আবেশ জড়ানো গলায় বললে অ্যান।
“উহুঁ,” শুধরে দিলে অ্যালেন—“রামঅ!”
যেভাবে একটা হপ্তা ওরা কাটানো, তা বাস্তবিকই মনে রাখার মতো। এক নাইট ক্লাব থেকে আর এক নাইট ক্লাবে উড়ে উড়ে বেড়াতে লাগল দুজনে। চক্ষুস্থির করার মতো বিলগুলোর ওপর অম্লান বদনে টিপসই বসিয়ে মোটা অর্থ নিয়ে বেরিয়ে এল প্রতিবার। প্রচুর পরিমাণে ওদের বখশিস দিতে লাগল ওয়েটাররা। থিয়েটারে গেল ওরা। টিকিটের সঙ্গে পকেটে পুরল এক গাদা নগদ অর্থ। প্রথমবারে কেনাকাটা করার বিভীষিকা মুছে গেছিল ওদের মন থেকে। তাই এবার সহজ মনে দোকানে গেল অল্প-স্বল্প কয়েকটি শুধু অতি মূল্যবান জিনিস কিনতে। সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার মতলব নিয়েই জিনিসগুলো কিনল ওরা। ভোজের অস্তে যে মিষ্টি খাওয়ার রীতি, সেই মিষ্টি প্রথমে খাওয়া এবং যে ক্ষুধাবর্ধক ভোজের প্রথমে খাওয়ার রেওয়াজ, তা অন্তে খাওয়ার অভ্যাসটা মোটামুটি রপ্ত করে নিল দুজনে। আস্তে আস্তে সবই সয়ে গেল ওদের। ঘড়ির কাঁটার পিছন দিকে ঘোরা, ক্যালেন্ডারের বিপরীত হিসাব আর পঁয়তাল্লিশ তলা নীচে নেমে যাওয়ার পিলে চমকানো অভিজ্ঞতা নিতান্তই পুরোনো হয়ে গেল ওদের কাছে। অমরা-ই বটে এ শহর।
কেটে গেল পুরো একটা হপ্তা। লাগামবিহীন উদ্দাম আনন্দের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল ওরা। সাত দিন পরে তাই এমন স্ফূর্তি-উচ্ছ্বল মনে অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেশে ফিরে কাজকর্ম নিয়ে মাথা ঘামানোর চিন্তা আনতে হল ওদের। ঘটনাবহুল সপ্তম দিনে আচম্বিতে লোহার মুগুরের মতো একটা ভারী মুঠির দমাদম শব্দে কেঁপে উঠল ওদের ফ্ল্যাটের দরজা। তারপরেই, ভয়ার্ত পরিচারিকাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকল গম্ভীর মুখ অফিসার-চেহারার দুই ভদ্রলোক। এবং স্থির পলকহীন দৃষ্টিশরে গেঁথে ফেলল দুজনকে।
“আই.বি.এফ.” পরিচয়পত্র দেখিয়ে একজন বলে উঠল “বিশ্বস্তসূত্রে জেনেছি, আপনারা দুজনেই বেকার। কথাটা সত্যি?”
“হ্যাঁ, আমরা বেকার।” বলে অ্যালেন।
“চাকরি-ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে কথা বলার জন্যেই আমরা এসেছি।”
নির্বোধের মতো খুক খুক করে হেসে ওঠে অ্যান বিড় বিড় করে অ্যালেন বলে—“এও কিন্তু রামঅ!”
“আপনার অতীত রেকর্ড ঘেঁটে আমরা দেখেছি, আজ পর্যন্ত আপনাদের সব বিল মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে কি না। কিন্তু আপনি যে গত হপ্তার ক্ষতিপূরণ এক্কেবারেই দেননি, তাও আমরা জেনেছি। এই ক্ষতিপূরণ আদায় করতেই এসেছি আমরা। আপনাদের দুজনের মিলিয়ে মোট দাঁড়াচ্ছে সাত হাজার রলাড। নগদ অথবা চেক, প্লিজ?”
আচমকা নেহাতই অকারণে এমন মুখভঙ্গী করে অ্যালেন, যেন বাতাসের অভাবে আঁকুপাঁকু করছে ওর বুকের ভেতরটা। তারপর মুখ ফেরায় অ্যানের নিরক্ত সাদা মুখপানে। “আপনি বলতে চান, এতগুলো ডলার আমাকে দিতে—।”
আই.বি.এফ. এজেন্ট বলে ওঠে—“হামেশাই গভর্ণমেন্টকে ফাঁকি দিয়ে সরে পড়ার চেষ্টা করে অনেকে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই এরা বুঝতে পারে কাজটা খুবই খরচসাপেক্ষ। আমার উপদেশ শুনুন। সুবোধ নাগরিকের মতো যেখান থেকে এসেছেন, সেখানে ফিরে গিয়ে কাজ করুন এবং পাওনা-গন্ডা যা আছে কড়ায়-গন্ডায় মিটিয়ে দিন। আপাতত আমি এখুনি চাই সাত হাজার রলাড।”
গুঙিয়ে ওঠে অ্যালেন—“ইনকাম ট্যাক্সটা কত দাঁড়াবে আমি এখন তাই ভাবছি।”
মূহূর্তের জন্যে থতমত খেয়ে যায় এজেন্ট ভদ্রলোক। “ইয়ে, আচ্ছা,—ওটা পরে হিসেব করে দেখা যাবে ‘খন। এখন তো পাওনাটা মিটিয়ে দিন, তারপর দেখা যাবে কত দাঁড়ায় আপনার ইনকাম ট্যাক্স।”
মানিব্যাগ বার করে গুনতে বসল অ্যালেন—”চার হাজার পাঁচশো কুড়ি রলাড আছে আমার।” দারুণ মুষড়ে পড়ে বেচারি অ্যান।
ততক্ষণে পার্স হাতড়াতে সুরু করে দিয়েছে অ্যান। বলল, “একুশশো রলাড।”
“তিনশো আশি কম পড়ছে এখনও,” বলে আই.বি.এফ. এজেন্ট।
অ্যালেন বলে—“আমাদের সঙ্গে যদি বেরোন তো দু-একটা জিনিস কিনে বাকি রলাডগুলো দিয়ে দেবো।”
অ্যানের জন্যে হীরের আংটি কেনা হল। অ্যানের তৃতীয় আংটি এটি। আই.বি.এফ. লোক দুটোর পাওনা চুকিয়ে দিয়ে দারুণভাবে দমে গিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে এল ওরা এসে দেখলে এদের অপেক্ষায় বসে রয়েছে এ ফ্ল্যাটের হদিশ দিয়েছিল যে, সেই এজেন্ট ভদ্রলোকটি। মানুষটি শান্তশিষ্ট, চুলগুলো ধবধবে সাদা। চোখমুখে বাৎসল্যের অভিব্যক্তি। এখন কিন্তু সে মুখে বিষাদ মাখানো।
ওদের দেখেই বলে ওঠে ভদ্রলোক, “আপনারা দুজনেই নিরাশ করেছেন আমাকে।”
“কীভাবে?” শুধোয় অ্যালেন।
“ভেবেছিলাম, গ্রীষ্মের দিন ক-টাও এ ফ্ল্যাটে থাকবেন আপনি। কিন্তু এখন…” মাথা নাড়তে থাকে সে। “একাজ কেন করলেন আপনারা?”
“কী করলাম?”
“এরকম বেপরোয়াভাবে সংযমের কোনো বালাই না রেখে কেন এ ক-টা দিন কাটালেন আপনারা? আপনার জীবিকায় কত মাইনে আপনি দেন তা আমি জানি না। কিন্তু সে অর্থের পরিমাণ আর পাঁচজনের চাইতে অনেক বেশি হলেও জানবেন কয়েক বছরের আমোদ-প্রমোদ আর বিলাসিতা বাবদ বৃত্তি আপনি এই সাতদিনেই শেষ করে এনেছেন। এত তাড়াতাড়ি না করলেও জোর করে আপনাকে বাধা দেওয়া হত তো বটেই। এক হপ্তার মধ্যে এরকম বেহিসেবি হওয়াটা, কী সর্বনাশ! রিপোর্টগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে এখন। কাজেই মানে মানে সরে পড়ুন।”
“এসব আপনি জানলেন কী করে?” শুধোয় অ্যালেন।
“মাই ডিয়ার ইয়ংম্যান, প্রত্যেকবার কেনাকাটা করার সময়ে আপনাদের বুড়ো আঙুলের ছাপ নেওয়া হয় তাহলে কী জন্যে? সব বিলই চলে যায় কেন্দ্রীয় হিসাবদপ্তরে। তারপর মোট কেনাকাটার একটা সম্পূর্ণ তালিকাও তৈরি করে ফেলা হয় সেখানে। অবশ্য বখশিস এবং জাতীয় রলাড যার জন্যে টিপসই দেওয়া হয় না, সে সবেরও একটা মোটামুটি হিসেব ধরা হয় এই তালিকায়। আপনি তো সবই জানেন মশায়।”
“ইয়ে, হ্যাঁ, জানি বৈকি!” আমতা আমতা করে অ্যালেন।
“কাজেই আপনারা চলে যান। দীর্ঘদিনের জন্যে যেটুকু প্রয়োজন, ঠিক সেইটুকু প্রাপ্যের ওপর দিন চালাতে হবে আপনাদের। হিসাব-পত্ৰ চুকেবুকে গেলে আবার আমার সঙ্গে দেখা করতে পারেন। চমৎকার ফ্ল্যাট আবার আপনাদের জোগাড় করে দিতে পারি। তবে আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে বেহিসেবী উচ্ছ্বৃঙ্খল জীবনের পথে একদম পা দেবেন না দুজনের কেউই।” দুপুরের মধ্যেই ফ্ল্যাট খালি করে বেরিয়ে পড়তে হবে, যাওয়ার সময়ে বিড়বিড় করে জানিয়ে গেল এজেন্ট ভদ্রলোক!
“হপ্তায় চারশো রলাডের ইতি এইখানেই,” বলল অ্যান।
অ্যালেন বলল—“তা বটে। এক হাজার হতেও এখন অনেক দেরি। হাজার হওয়া মাত্র সরে পড়া উচিত ছিল আমাদের।”
অ্যান বলে—“কথাটা ভাবতেও বিচ্ছিরি লাগছে আমার। তবুও যথা সময়ে লম্বা দিলেই ভালো হত। যাই হোক, মজা মন্দ লাগছে না।”
“এখন করি কী বলো তো?”
এ প্রশ্নের উত্তর এল জলতরঙ্গের মতো মিষ্টি দরজার ঘণ্টাধ্বনি থেকে। শমন নিয়ে এসেছে একজন ডিটেকটিভ। এক ঘণ্টার মধ্যেই কোর্টে পৌঁছে গেল ওরা। সওয়া এক ঘণ্টার মধ্যে ওদের বিচার শেষ করা হল। দোষী সাব্যস্ত করা হল এবং একটা গুরুগম্ভীর বক্তৃতাও শুনিয়ে দিলেন বিচারপতি মশায়।
বক্তৃতাটা শোনার পর এ দেশের আজব কাণ্ডকারখানার রহস্যটা অনেক পরিষ্কার হয়ে আসে ওদের কাছে। অ্যালেনের ভাষায় যার নাম ‘Backward Economics’ অর্থাৎ ‘পিছুহাঁটা অর্থনীতি’—তার মূল সূত্রগুলো মোটামুটি বুঝতে পারে ওরা। বিচারপতি অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় ওদের জানিয়ে দিলে মূল ধরে নাড়া দিয়ে এই বিরাট অর্থনৈতিক কাঠামোটা ধূলিসাৎ করার চেষ্টা করেছে ওরা দুজনে। ওদের অপরাধ—প্রথম, মাইনে হিসেবে যত অর্থ ওরা দিয়েছে, তার চাইতেও অনেক বেশি অর্থ লুটেছে কেনাকাটার মধ্যে দিয়ে; আর দ্বিতীয়, ওরা বেকার এবং সেই কারণেই বেতন হিসেবে কোনো অর্থ খরচ করেনি।
হঠাৎ তড়বড় করে প্রতিবাদ জানায় অ্যালেন—“কিন্তু, ইওর অনার, আমি তো চাকরি পাইনি।”
রাগের চোটে লাল হয়ে গেলেন হিজ অনার। দারুণ শব্দে হাতুড়ির এক ঘা বসিয়ে দিয়ে বাজের মতো চিৎকার করে উঠলেন—“এসব আজগুবি গল্প এ আদালত সহ্য করবে না। আপনি খুব ভালো করেই জানেন, চাকরি পেতে অক্ষম যে কোনো নাগরিক তার মাইনেটা সরকারের দপ্তরে জমা দিয়ে দিতে পারে।”
অ্যালেন একবার ভাবলে সে বলে যে, ওরা এখানকার নাগরিকই নয়। তারপর কথাটা চেপে যাওয়াই মঙ্গল মনে করে আর উচ্চবাচ্য করল না।
দুজনের ওপর যে শাস্তির বিধান দেওয়া হল, তা কিন্তু মোটেই কঠোর বলে মনে হল না ওদের কাছে। ধর্মাধিকরণ ওদের দু’জনকেই অবেক্ষায় অর্থাৎ Probation-এ রাখলেন। তারপর দড়াম করে আর একবার হাতুড়ি হাঁকিয়ে পরবর্তী কেস হাজির করতে হুকুম দিলেন!
চটপটে চেহারার একজন পুলিশ অফিসার ওদের নিয়ে গেল আদালত কক্ষের বাইরে। ছোট্ট একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে সঁপে দিলে সাদা আলখাল্লা পরা কয়েকজন কারিগরের হাতে। একটা টেবিলের সামনে বসানো হল ওদের। তারপর কী ঘটতে যাচ্ছে, তা বোঝবার আগেই ওদের ডান হাতের বুড়ো আঙুল দুটো খটাং করে বন্দি হল ছোট্ট দুটো বাক্সের মতো যন্ত্রের মধ্যে।
বেশ অপমানিত সুরে বলে ওঠে অ্যালেন—“জজ সাহেব অপেক্ষায় রাখার হুকুম দিয়েছেন। বুড়ো আঙুলে স্ক্রু লাগানোর নির্দেশ তো দেননি।”
“বড়ো চৌকোস দেখছি যে?” কণ্ঠে ঘৃণার গরল ঢেলে পুলিশ অফিসারটা গর্জে ওঠে।
হঠাৎ একটা তীব্র যন্ত্রণার ধাক্কা লাগে অ্যালেনের বুড়ো আঙুলে—আর কিচ্ছু না। ঠিক সেই মুহূর্তে অ্যানও চোখ মুখ কুঁচকে তাকাল ওর পানে। চাহনি দেখে মনে হল বেজায় ঘাবড়ে গেছে।
পুলিশ অফিসারটা বলে ওঠে—“ঠিক আছে। এবার যেতে পারেন আপনারা।” তারপর একটু শুকনো হেসে আবার বলেন—“এ কাজ আর করবেন না।”
আদালত ভবনের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে থমকে দাঁড়াল দুজনে। বুড়ো আঙুলটা তুলে ধরলে চোখের সামনে। দুজনেরই আঙুলে সুন্দরভাবে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে Probation-এর ছোট্ট ‘P’ হরফটি।
বজ্রাহতের মতো বলে অ্যালেন—“কী সর্বনাশ! এরা যে দাগী করে দিলে আমাদের।”
বাড়িভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল যে এজেণ্টটি, তার কাছে গেল দুজনে। ওদের দেখেই স্পষ্ট বিরক্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে লোকটার মুখে। বলে—“এবার কী মতলব?”
অ্যালেন বললে—“কোথাও মাথা গোঁজার আশ্রয় চাই। ভাবলাম আপনি হয়তো…”
“আপনাদের মতো স্তরের লোকেদের সঙ্গে কাজ কারবার আমি করি না।”
“অন্য কারও কাছে পাঠাতেও কি পারেন না?”
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কলিং বেল টিপে সেক্রেটারিকে ডেকে আনল এজেণত ভদ্রলোক লোক।—“এরা দুজন Probation-য়ে রয়েছে। কিছু করতে পারেন কি না দেখুন।”
কাঁধের ওপর দিয়ে ওদের দিকে এক ঝলক ঘৃণা-কঠোর দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে প্রস্থান করল সেক্রেটারি।
বুড়ো আঙুলটা তুলে ধরে অ্যালেন বললে—“একটা উদ্ভট প্রশ্ন করব আপনাকে। এই Probation রহস্যটা আমায় বুঝিয়ে দেবেন কি?”
“কিছু কেনবার চেষ্টা করলেই হাড়ে হাড়ে বুঝবেন। বোঝবার জন্যে বেশি দেরি করতে হবে না। ডান হাতের বুড়ো আঙুলের ছাপ না দিয়ে কোনো জিনিসই কিনতে পারবেন না আপনারা। আদালতের সরকারি প্রমাণপত্র দাখিল করে Probation যে নাকচ করা হয়েছে, তা প্রমাণ করতে না পারলে Probation টিপসই গ্রাহ্য হবে না।”
গরম হয়ে বলে অ্যালেন—“ওরা কি করতে চায়? না খাইয়ে মারতে চায় আমাদের?”
“যে জিনিস না কিনলেই নয়, শুধু তাই কিনতে পারেন আপনি। যে কোনো একটা দোকানে নাম রেজিষ্টার করে রাখুন শুধু খাবার-দাবার কেনার জন্যে জামাকাপড়ও কিনতে পারেন, তবে তা আপনার কাজের উপযুক্ত হওয়া চাই। বাড়তি পোশাক একটিও নয়। তাও কিনতে হলে আপনাকে যিনি চাকরিতে বহাল করবেন, তাঁর সুপারিশ থাকা চাই। আপনার বাড়তি অর্থের সঠিক হিসেব অবশ্য আমি জানি না, কিন্তু এইটুকুই শুধু বলতে পারি যে কয়েক বছর সংযমী হয়ে জীবন যাপন করতে পারলেই আদালত নিশ্চয় বিবেচনা করবে আপনাদের কেস।”
“বটে,” বলে অ্যালেন। “আচ্ছা, ধার দেওয়ার কোনো প্রতিষ্ঠান ধারে কাছে আছে কি?”
“বুঝলাম না।”
“ব্যাঙ্ক, কর্জ কোম্পানি—”
“ওহো! ধার নেওয়ার প্রতিষ্ঠানের কথা বলছেন তো? নিশ্চয় আছে—আশপাশে এরকম বিস্তর প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু এ কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
“এক হাজার রলাড ধার নেবো আমি।”
“মাই ডিয়ার ইয়ং ম্যান। আপনি কি গতকাল ভূমিষ্ঠ হয়েছেন?
সব প্রতিষ্ঠান থেকে আপনাকে ধার দেওয়া হয় না—আপনার কাছ থেকেই নেওয়া হয়।”
“আরে, তাই তো, ঠিকই বলেছেন,” ঢোঁক গিলে বলে অ্যালেন।
সেক্রেটারি ফিরে এসে অ্যালেনের হাতে এক টুকরো কাগজ দিয়ে বললে—“ঠিকানা দিলাম। খুব বেশি নয়। ফার্নিচারসমেত ছোট্ট একটা ঘর। প্রতিবেশীরা গরীব। পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করতে হয়। এর চাইতে ভালো কিছু পাবেন বলে তো মনে হয় না আমার।
অ্যালেন বলে, “এত করার জন্যে অশেষ ধন্যবাদ। আমাদের কেনা জিনিসগুলোও কি গভর্নমেন্ট বাজেয়াপ্ত করবে?”
“নিশ্চয় না,” জবাব দিলে এজেণ্ট ভদ্রলোক। “বাড়তির হিসেব না মেটা পর্যন্ত গভর্নমেন্টের কাজ শুধু আপনি যাতে আর কিছু না কেনেন, তা দেখা।
মালপত্রগুলো ট্যাক্সিতে করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল ওরা। কিন্তু অ্যালেনের বুড়ো আঙুলের ঠিক মাঝখানে পরিষ্কার ছাপানো P অক্ষরে একবার শুধু চোখ বুলিয়ে নিয়েই ওদের ফেলে রেখেই গাড়ি হাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল ট্যাক্সি ড্রাইভার। চারবার বাস বদল করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছল ওরা এবং পৌঁছোনোর পর জানতে পারল সারা হপ্তার প্রাপ্য চারবারেই শেষ করে ফেলেছে দুজনে। নতুন বাড়িউলী বেজায় মোটা, মুখখানা পেঁচার মতো এবং দৃষ্টিতে সন্দেহের কুৎসিত অভিব্যক্তি।
অ্যালেনের টিপসইটা দেখতে দেখতে বেঁকা স্বরে বলে উঠল সে—“বটে, ওদেরই একজন দেখছি। ঠিক আছে, ঠিক আছে। কিন্তু আগে থেকেই বলে রাখি বাছা, এটা ভদ্রবাড়ি। পুলিশকে যদি এখানে ছোঁক ছোঁক করতে দেখি, তাহলে তোমাদেরও পথ দেখতে হবে।” বলে এক হপ্তার অগ্রিম বাড়িভাড়া ছ-টা রলাড ওদের দিয়ে দিলে বাড়িউলী।
সাদাসিদে ঘরটায় ঢোকার পর রীতিমতো দমে নিয়ে নিঃসঙ্গ চেয়ারটাকে দখল করল অ্যালেন, আর শয্যার ওপর টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অ্যান।
অনেকক্ষণ পর অ্যালেন বলল—“কিছু খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা দরকার।”
“আমার খিদে নেই।”
“তাহলেও কিছু খাবার কেনা দরকার। না কিনলে আমাদের মাইনে দেওয়ার মতো অর্থও জোগাড় করে উঠতে পারব না, চাকরিও পাব না। আর চাকরি না করলে আবার এই হপ্তার শেষে বেকার থাকার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ সাত হাজার রলাড দিতে হবে গভর্নমেন্টকে। এই সাত হাজার রলাড কোন চুলোয় পাবো শুনি?”
অবসন্ন দেহটাকে কোনোমতে টেনে তুঙ্গল অ্যান। বলল—“ঠিক আছে। খাবার কিনব বটে, কিন্তু আমি তা খাব না। এবার উঠে পড়ে চাকরি খোঁজা যাক।”
কাছেরই একটা মুদিখানায় নাম রেজিস্ট্রি করল দুজনে। সারা হপ্তার উপযুক্ত খাবার-দাবার একসঙ্গে কিনে নিলে। রান্নার হাঙ্গামা এড়ানোর জন্যে টিনভরতি খাবারই বেশি কিনল। তারপর মানপত্র আর সতেরোটা রলাড নিয়ে ফিরে এল ঘরে।
অ্যালেন বললে—“তেইশ রলাড রয়েছে আমাদের। তার মানে এমন চাকরি জোটাতে হবে যেখানে মাথাপিছু সাড়ে এগারো রলাভের বেশি দিতে পারব না।”
উদারভাবে অ্যান বলে—“তুমি তেরো নাও। আমি দশ নেব।”
খুঁজে পেতে একটা এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি বার করল ওরা। তারপর প্রত্যেকেই পৃথকভাবে ইন্টারভিউ দিলে, নাম লেখাও হল পৃথক বিভাগে। জ্বলজ্বলে ছাপমারা বুড়ো আঙুলের টিপসই দেখে অ্যালেনের ইন্টারভিউ যে ভদ্রলোক নিয়েছিলেন, তিনি তো ভুরু-টুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ অ্যালেনের পানে তাকিয়ে এমনভাবে দু-কাঁধ ঝাঁকালেন যেন মহা আপদ এসে জুটেছে।
মুখে বললেন—“আপনাদের মতো লোকেদের পেছনে আমাদের সবটুকু পরিশ্রমই জলে যাবে, কোনো কাজে আসবে না। আপনার দরকার সবচেয়ে কম ডলারের কোনো চাকরি। সেল্সম্যানের চাকরি হলেই উপযুক্ত হয়। যা কিছু বিক্রি করবেন আপনি, তার ওপর গ্যারান্টি দেওয়া সামান্য মাইনে আর কমিশন আপনাকে চুকিয়ে দিতে হবে। খুব বেশি বিক্রি না করলেও দিন কেটে যাবে আপনার। খুব ব্যয়বহুল নয় বলেই এই কাজই আপনার পক্ষে ভালো। তার কারণ কোনো হপ্তায় বেশি বিক্রি করা মানেই আপনার দফারফা হওয়া। কবরখানার জমি বিক্রি করুন—আপনার উপযুক্ত কাজ। এই নিন ঠিকানা। আর এই নিন—” অ্যালেনের হাতে পাঁচটা রলাড তুলে দিলেন ভদ্রলোক—“এজেন্সির পারিশ্রমিক। আশা করি আবার দেখা হবে না আমাদের।”
সেদিন সন্ধ্যায় অ্যালেন ফিরে এসে দেখলে অ্যান তার আগেই ফিরে এসেছে ঘরে। বিছানার ওপর মুখ গুঁজরে শুয়ে ছিল। অ্যালেন ঘরে ঢোকার পরেও মুখ তুলল না বেচারি। চেয়ারটার ওপর বসে পা দুটো বিছানার ওপর তুলে দিলে অ্যালেন।
বললে—“আমি সেল্সম্যান। কবরখানার জমি বিক্রি করাই আমার কাজ। প্রত্যেকটা প্লটের দাম দেড়শো রলাড। অর্থাৎ এ জমি যে কিনবে, তাকে দিতে হবে দেড়শো রলাড। মাইনে আর কমিশন, এই দুই-ই দিতে হবে আমায়। আমার মনিবকে প্রতি হপ্তায় পনেরো রলাড দিচ্ছি আমি। এবং প্রত্যেকটা প্লট বিক্রি করার জন্যে দেড়শো রলাডের পনেরো রলাড দিতে হচ্ছে প্রতি খদ্দেরকে। আর প্লট বিক্রি করার ইচ্ছে নেই আমার।”
বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে অস্পষ্ট স্বরে অ্যান বললে—“আমি কেরানি। ফাইল করাই আমার কাজ। এর চাইতে ভালো কাজ আমি পেতে পারি না এবং এ কাজের মাইনে হপ্তায় পঁচিশ রলাড। আমার পঁচিশ রলাড ছিল না। কাল সকালে বাকি রলাড না নিয়ে গেলে আমি ছাঁটাই হয়ে যাব। আমার কাছে পনেরোর বেশি ছিল—দশ মুদিখানা থেকে, আর পাঁচ এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি থেকে। আর একটু হলেই চাকরি যেত আমার। কেন না, উলটো দিক থেকে অক্ষর পড়ার অভ্যাস তো আমার নেই। মাথা গুলিয়ে গেছিল তাই।”
“নতুন পোশাক কৌশলটা খাটিয়েছিলে?”
উঠে বসল অ্যান। “সেটা কি?”
“মনিবকে বললাম, এইটাই আমার একমাত্র পোশাক। পোশাকটা তাঁর ভালোই লাগল—লাগতেই হবে, কেন না নগদ দুশো রলাড নিয়ে কিনতে হয়েছে স্যুটটা—তারপর বললেন, সেল্সম্যানের একাধিক স্যুট থাকা দরকার। ওঁর লেখা সুপারিশ নিয়ে চল্লিশ রলাড দামের একটা নতুন স্যুট কিনলাম। এর চাইতে বেশি দামের স্যুট আমাকে দিতে রাজি নন তিনি। কাজেই আমরা সামলে নিতে পারব। তোমার বকেয়া দশ রলাড কাল সকালে দিয়ে দিও আর—”
নিরুত্তাপ নির্বিকার স্বরে অ্যান বলল, “এই ঘরটার জন্যে প্রতি হপ্তায় আমরা ছ-রলাড পাচ্ছি। মুদিখানা থেকে আসছে সতেরো। সবশুদ্ধ তেইশ হল। কিন্তু মাইনে হিসেবে আমাকে দিতে হবে পঁচিশ, আর তোমাকে পনেরো। প্রতি হপ্তায় যদি সতেরো রলাডের ফাঁক থেকে যায়, তাহলে এক হাজার রলাডও কী করে জমাবো আমরা?”
“তুমি চেষ্টা করে দেখো মনিবের কাছ থেকে নতুন জামাকাপড়ের জন্যে সুপারিশ আদায় করতে পারো কিনা। আমিও ফাঁকি দেব সমানে। ভেবে দেখি আরও কিছু মতলব বার করা যায় কি না। এমনও হতে পারে, মাঝেসাঝে বাইরে ডিনার খাওয়ার সুযোগ দেবে ওরা। ওইভাবে কিছু রলাড রোজগার করতে পারব আমরা। তারপর কোনদিক দিয়ে কী সুযোগ আসে তা কি কেউ বলতে পারে?”
পরের দিন একটা বিপর্যয় হয়ে গেল। কবরখানার একটা প্লট বিক্রি করে ফেলল অ্যালেন। বাড়ি ফিরে প্রায় আর্ত কান্নার সুরে বললে—“আমার কাছ থেকে একরকম জোর করেই ছিনিয়ে নিয়ে গেল জমিটা। আমি লোকটাকে অপমান করলাম, জমিটার ওপর লাথি মারলাম এবং যা যা মাথায় এল, সবই করলাম। কিন্তু কিছুতেই আটকাতে পারলাম না। বেরিয়ে গেল পনেরো রলাড।”
অ্যান বললে—“পঁচিশ রলাড দামের পোশাক কিনেছি আমি। কাজেই এ চোট সামলে নেওয়া যাবে। আমার মাইনেও পরের হপ্তায় আবার দেব। কিন্তু তুমি আর কিছু বিক্রী করো না।”
“তা আর বলতে,” প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলে অ্যালেন। “এবার পিছু ফিরেই টেনে দৌড়োব।”
সম্মানজনকভাবে পরের হপ্তার মাইনে মিটিয়ে দিয়ে কাজ শুরু করল ওরা। বাড়তি যা রইল, তা দিয়ে তৃতীয় হপ্তাটাও চলে গেল। এর মধ্যে অবশ্য অ্যালেন আর জমি বিক্রি করেনি। তারপর যে কী হবে, সে বিষয়ে বিন্দুবিসর্গ ধারণা ছিল না ওদের।
তিরিক্ষে মেজাজ নিয়ে ঘরে ফিরে এল অ্যালেন। সেদিনই সকালে আর একটু হলেই একটা জমি বিক্রি করে ফেলেছিল ও। কোনোমতেই পালিয়ে বেঁচেছে। কিন্তু ফাঁকি দেওয়ার কৌশলগুলো এমনই প্রকট হয়ে পড়েছে যে, খদ্দেরটি গিয়ে নালিশ রুজু করেছে তার নামে তার মনিবের কাছে। অ্যালেনের বিক্রির হিসেব মোটেই আশাপ্রদ নয় দেখে মনিব ভদ্রলোক তাকে বরখাস্ত করার হুমকি দিয়েছেন। অবসাদে, হতাশায়, গ্লানিতে অ্যালেনের দেহ যেন আর চলছিল না। তার ওপর টিন খুলে ঠান্ডা খাবার পাওয়ার কথা ভাবতেই গা বমি বমি করছিল ওর। নীল আকাশ দেখার জন্যে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্যে হাহাকার করছিল ওর সারা মন।
টলতে টলতে দরজা ঠেলে ঢুকেই নিদারুণ বিষয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল ও।
অ্যানের সঙ্গে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন। বিশাল বপু, দাড়িওলা, টাকমাথা লোকটা অশক্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। অ্যালেন ঘরে ঢুকতেই দুর্বোধ্য শক্ত চাহনি দিয়ে যেন গেঁথে ফেললেন ওকে। ভদ্রলোক গ্লুব ট্র্যাভেল এজেন্সির মি. গ্লুব।
দোষারোপ করার ভঙ্গিমায় তর্জনী তুলে মি. গ্লুব বলে উঠলেন—“এ কাজ করা উচিত হয়নি আপনার।”
“আপনি একথা বলছেন আমাকে!” অ্যালেনও বলে ওঠে ফস করে।
উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠে অ্যান। “এইমাত্র ফিরলাম আমরা। রাস্তায় ওঁকে দেখতে পাই আমি। আমাকে এড়িয়ে গা-ঢাকা দেওয়ার মতলবে ছিলেন উনি । বোধ হয় গোটা দুই ব্লক ওঁর পেছন পেছন দৌড়েছিলাম আমি।”
“তিনটে ব্লক,” বললেন মি. গ্লুব। “অজানা অচেনা মেয়েদের নিয়ে যেন একদম মাথা না ঘামাই, সে বিষয়ে মা আমাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল। তাই ওঁকে এড়িয়ে যাওয়ার তালে ছিলাম। অবশ্য পারিনি। ওঁকে চিনতেই পারিনি আমি। কিন্তু এ কাজ করা উচিত হয়নি আপনার। আমাদের অ্যাকাউন্টিং ডিপার্টমেন্টে যে কি নিদারুণ সমস্যার সৃষ্টি করেছেন আপনি, সে সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নেই আপনার। দু-দুটো রিটার্ন টিকেট, অথচ ফিরতি যাত্রার নাম গন্ধ নেই। তিন-তিনটে জরুরি মিটিং করে ফেললেন ডাইরেক্টররা। অথচ সমস্যার এতটুকু সমাধান হওয়া তো দূরের কথা, হবে বলেও মনে হয় না। সবারই মাথা গুলিয়ে গেছে এ ব্যাপারে। যাই হোক, আপনাদের যেতেই হবে এখান থেকে। প্রতিশ্রুতি দিন এ ব্যাপারের বিন্দুবিসর্গ কাউকে বলবেন না। গোপন রহস্য ফাঁস করার অঙ্গীকার দেওয়ার পর এখুনি এ শহর ছেড়ে ফিরে চলুন নিজের দেশে। কিছুতেই এর অন্যথা হতে দেবো না আমি।”
“আমিও না,” খুশিতে ডগমগ হয়ে বলে উঠল অ্যান।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘরটা দেখতে শুরু করেছিলেন খুব। এবার বলেন—“এ রকম অদ্ভুত আস্তানায় উঠেছেন কেন বলুন তো? মাঝে মাঝে অবশ্য প্রায়ই ভাবি, আপনাদের জগতের মানুষরা সভ্যতার মধ্যে এসে পড়লে না জানি কি কাণ্ডই করবে। কিন্তু এ রকমটি একেবারেই কল্পনা করিনি আমি।”
“আমরাও এ রকমটি কল্পনা করিনি,” বলে অ্যালেন। তারপর সংক্ষেপে খুলে বলে তাদের হপ্তাব্যাপী উচ্ছ্বৃঙ্খল মধুচন্দ্রিমা যাপন এবং তার করুণ পরিণাম।
অপরিসীম আতঙ্কে দুই চোখ কপালে তোলেন গ্লুব—“সর্বনাশ! করেছেন কী! কিন্তু আপনাদের অপেক্ষায় রাখতে দিলেন কেন ওদেরকে? সেন্ট্রালিয়া ফিরে গেলেই তো পারতেন?”
“কি করে যাবো?” ফোঁস করে ওঠে অ্যালেন। “আমাদের কাছে টাকাপয়সা যা ছিল, পকেট নিংড়ে তার সবটুকু নিয়ে গেল আই.বি.এফ.-এর লোকেরা। টিকিট কেনার মতো হাজার রলাডও রইল না কাছে।”
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন গ্লুব। “মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড অ্যালেন। দু-হপ্তা আমাদের সভ্যতার মধ্যে থেকেও আমাদের রীতিমতো এখনও বুঝে উঠতে পারেননি, এ বড়ো তাজ্জব কথা! টিকিট কেনার জন্যে আপনাকে হাজার রলাড দিতে হয় না। আমরাই আপনাকে গুনে দিই পুরো এক হাজার রলাড!”
“লাভ?”
তোৎলাতে শুরু করে অ্যালেন—“কিন্তু… ইয়ে… আমি ভাবলাম… মানে আসবার সময়ে সেন্ট্রালিয়াতে আপনারা টিকিটের দাম নিয়েছিলেন। কাজে কাজেই—”
“আমি তল্পি-তল্পা গুটোনো শুরু করছি,” বলে অ্যান।
“আমিও হাত লাগাচ্ছি,” বলে অ্যালেন।
শূন্যে এক হাত তুলে গ্লুব বললেন—“এক সেকেন্ড। এত তাড়াতাড়ি না করলেও চলবে। জিনিসটা আপনারা যেমন মনে করছেন, তার চাইতেও অনেক বেশি গুরুতর। প্রোবেশনে রাখার আগে যে কোনো মুহূর্তে বিদেয় নিতে কোনো ঝামেলাই ছিল না। কাউন্টারে হাজির হয়ে একটা টিপসই দিলেই ল্যাঠা চুকে যেত। কিন্তু এখন তো আর আপনারা টিপসই দিতে পারবেন না। ফূর্তি করার প্রাপ্য বৃত্তি সবই তো ফুঁকে দিয়েছেন এই ক-টা দিনের মধ্যে। কাজেই অনেক… অনেক দিন লাগবে আবার আপনাদের টিপসইয়ের সম্মান ফিরে পেতে।”
“তার মানে আপনি বলতে চাইতেন এখানে আটক পড়লাম আমরা?”
“এগজ্যাক্টলি তাই বলতে চেয়েছি। আমাদের অর্থনীতি সম্বন্ধে কোনো জ্ঞানই নেই আপনার। থাকলে এরকম সাত হাত গভীর পাঁকে আটকে হাঁকপাঁক করতেন না। এখানকার প্রত্যেকটি মানুষ কড়ায় গন্ডায় হিসেব রাখে তাদের কেনা কাটার। বগ্লু ট্যুরের মতো বিশেষ ধরনের বিলাসিতা করার প্রয়োজন হলে আগে থেকেই প্রাপ্য বৃত্তি সঞ্চয় করতে থাকে তারা, অথবা ট্যুর থেকে ফিরে আসার পরেই দুম করে কমিয়ে ফেলে বিলাস সংক্রান্ত খরচপত্র। আপনারা যে কাণ্ড করলেন, তা বড়ো একটা দেখা যায় না। অত্যন্ত গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে ফেলা হয় এ ধরনের আচরণকে। সেই কারণেই শাস্তির বহরটাও এত কড়া।”
বেশ কিছুক্ষণ থমথমে স্তব্ধতা বিরাজ করতে থাকে ঘরটার মধ্যে। কটমট করে অপলক চোখে অ্যালেন তাকিয়ে থাকে গ্লুব-এর পানে। আর, অ্যান শান্ত চোখে নিরীক্ষণ করতে থাকে মেঝেটা।
তারপর অ্যালেন বলে—“ঠিক আছে। অ্যান, যথেষ্ট কেলেঙ্কারি হয়েছে। আর নয়। কাল সকালে উঠে প্রথম কাজই হবে কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলা এবং যেভাবেই হোক এদেশ থেকে আমাদের বার করে দেওয়ার অনুরোধ করা।”
লাফিয়ে উঠলেন গ্লুব—“না, না, না! ওটি আপনি করবেন না। তাহলেই বগ্লু ইনকরপোরেটেডের বিরুদ্ধে যাচ্ছেতাই পাবলিসিটি হয়ে যাবে, নাম ডুববে কোম্পানীর। ব্যাবসা করার অধিকারও ছিনিয়ে নিতে পারে গভর্নমেন্ট। আপনাদের দুনিয়ায় আমাদের তৎপরতা যে সম্পূর্ণ গোপন রাখা হবে, সে বিষয়ে কথা দিয়েছিলাম আমরা।”
অ্যালেন বললে—“কঠিন পরিস্থিতি। মাপ করবেন, মি. গ্লুব, আমাদের আবার এক্ষুনি কয়েকটা জিনিস প্যাক করা দরকার।”
“শুনুন, শুনুন। হুড় হুড় করে ব্যাবসা বেড়ে চলেছে আমাদের। ইউরোপ আর সাউথ আমেরিকাতেও নতুন টার্মিনাল বসানোর তোড়জোড় চলছে। আপনি দেখছি সবই ভণ্ডুল করে দেবেন। খুব জোর, যুক্তরাজ্যের টার্মিনালটা আমরা বন্ধ করে দিতে পারি। কিন্তু সেইটাই তো ট্যুরিস্টদের সবচেয়ে লোভনীয় জায়গা। এ জগতের বাসিন্দাদের কাছে এসব ট্যুর যে কতখানি, তা আপনি জানেন না। হোটেলের বিলের টাকা নিজে না নিয়ে দেওয়া, গাড়িভাড়া দেওয়া খাবারের দাম দেওয়া, কাজ করে অন্নদাতার কাছ থেকে বেতন আদায় করা… আহা, সে যে কি…”
“অত্যন্ত ন্যক্কারজনক লজ্জাকর অভিজ্ঞতা।” তৎক্ষণাৎ একমত হয় অ্যালেন। “আচ্ছা, এবার যদি মাপ করেন আমাদের…”
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন গ্লুব। “অল রাইট। যেভাবেই হোক এ ব্যাপার আমি সামলে নেব’খন। যান, প্যাক-ট্যাক যা করবার চটপট সেরে ফেলুন।”
একটা স্যুটকেশের দিকে হাত বাড়ালে অ্যালেন। “এই সামান্য ব্যাপারে এত সমস্যা পাচ্ছেন কোথায়, তাই তো ছাই বুঝছি না আমি। আপনাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে কোনোরকমে চুপিসাড়ে আইনের চোখে ধুলো দিয়ে আমাদের এখান থেকে লোপাট করে নিয়ে যাওয়া। এভাবে স্মাগল করে নিয়ে যাওয়ার আগে আমাদের এক হাজার রলাডও দিতে হবে না আপনাকে। কী করব আমরা ও-টাকা নিয়ে?”
“হুম ঠিক,” বললেন গ্লুব। “দপ্তরে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ না রেখে খুব সম্ভব তা আমি করতে পারব। দেখা যাক কী করতে পারি।”
দরজার ওপর ভারী ঘুসি পড়ার দমাদম শব্দ শোনা গেল এবং পরক্ষণেই ভেসে এল খ্যানখেনে গলায় বাড়িউলীর চেঁচানি—“মি. অ্যালেনের টেলিফোন এসেছে।”
চমকে উঠল অ্যালেন। “আমি তো কাউকে এখানে চিনি না। কে ফোন করবে বলুন তো?”
“সাড়া দিয়েই দেখে এসো না কে?” বলে অ্যান।
তিন ধাপ সিঁড়ি টপকে ভয়ে ভয়ে রিসিভারটা তুলে নিল অ্যালেন—“হ্যালো।”
“আই.বি.এফ.-এর এজেন্ট সিনোজ বলছি। হপ্তাখানেক আগে বেকার ট্যাক্স সম্বন্ধে আপনার সঙ্গে কী কথাবার্তা হয়েছিল, নিশ্চয় তা মনে আছে আপনার?”
অ্যালেন বললে—“আপনাকে জানিয়ে রাখি, আমি এখন চাকরি করছি।”
“আমি তা জানি। সেই সময়ে আপনি ইনকাম ট্যাক্স সম্বন্ধে কথা পেড়েছিলেন। তদন্ত করে দেখা গেল, গত পাঁচ বছর যাবৎ কোনো ইনকাম ট্যাক্স পাননি আপনি। পাঁচ বছরের আগে যা বাকি পড়েছে, আইন অনুযায়ী তা নিয়ে গভর্নমেন্টের কাছে কোনো দাবি দাওয়া করা চলে না। কিন্তু এই পাঁচ বছরের রেকর্ড ঘেঁটে আপনার প্রাপ্য সম্বন্ধে আমরা নিঃসন্দেহ হওয়ার পর আপনার দাবি সম্পর্কিত গোলমালটা মিটিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।”
“আপনার অশেষ দয়া,” বিড় বিড় করে বলে অ্যালেন।
“জানি না কি করে এ কাণ্ড ঘটল। যাই হোক, ঘটেছে যখন, তখন আমার ইচ্ছে, দরকারি কাগজপত্র সই করে চেকটা নিয়ে হিসেব আপ-টু-ডেট করে দিন আপনি।”
“কত টাকার চেক?”
“সুদ আর দণ্ড সমেত—পঁচিশ হাজার রলাড।”
“তাই নাকি। আপনার অফিসের ঠিকানাটা দিন। কাল সকালেই দেখা করব আমি।”
“আজ রাতে নয় কেন?” শুধোলেন এজেন্ট ভদ্রলোক।
“বড়ো ব্যস্ত এখন। খাওয়ার সময় কিনা!”
“ঘণ্টাখানেক পরে হলে কি হয়?”
“দু-ঘণ্টা পরে।” ঘড়ির ওপর চোখ রেখে আঙুল গুনে অ্যালেন বললে—“চারটের সময়ে।”
“বড্ড দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু… ঠিক আছে… চারটের সময়ে আসছি আমি।”
হুড়মুড় করে সিঁড়ি পেরিয়ে ঘরে ফিরে এল অ্যালেন।
বলল—“আই.বি.এফ.। ইনকাম ট্যাক্স বাবদ ওরা পঁচিশ হাজার রলাড দিতে চায় আমাকে।”
“গুড হেভেন্স।” যেন দম বন্ধ হয়ে আসে গ্লুবের। “ঠাট্টা করছেন না তো?”
“নিশ্চয় না। চারটের সময়ে ভদ্রলোক আসছেন এখানে।”
“তার আগেই এখান থেকে আপনাদের বার করে নিয়ে যেতে হবে। গভর্নমেন্ট যদি অত টাকা আপনাদের দেয়, তাহলে জানবেন টাকাটা খরচ করার উপযুক্ত চাকরিও দেবে আপনাদের। তার মানেই দায়িত্বপূর্ণ কোনো উচ্চপদ। সেক্ষেত্রে কোনোদিনই এদেশ থেকে আর বেরোতে পারবেন আপনারা। আসুন, চটপট প্যাক করুন, আমিও হাত লাগাচ্ছি।”
ঝড়ের মতো বেরিয়ে পড়ল ওরা। উল্কার মতো সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে পোর্চে দাঁড়াল কিছুক্ষণ। গ্লুব রাস্তায় গেলেন একটা ট্যাক্সি ডেকে আনতে।
আর ঠিক সেই সময়ে হলের মধ্যে থেকে বাড়ি কাঁপিয়ে বেরিয়ে এল বাড়িউলী।
তারপরেই চিলের মতো এক চিৎকার—“উঞ্ছ, হাড়হাভাতে কোথাকার যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই! আমাকেই বুড়ো আঙুল দেখানোর মতলব! কিন্তু আমিও চোখ খোলা রেখেছিলাম আগাগোড়া বুঝলে বাছা, আগাগোড়া চোখ খোলা ছিল আমার। এই নাও—বিনা নোটিশে সরে পড়ার জন্যে এক হপ্তার ভাড়া।”
অ্যালেনের হাতে ছ-টা রলাড তুলে দিলে বাড়িউলি।
সেন্ট্রালিয়ায় ফিরে এল ওরা। আবার দেখতে পেল গ্লোব ট্র্যাভেল এজেন্সি। এসে পৌঁছল ক্যালিফোর্নিয়া রেডউডের দশঘরওয়ালা রাঞ্চ বাড়িতে—যার সামনে আছে নয়নসুন্দর সরোবরের অপরূপ দৃশ্য। এইখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করল ওরা। সুখ, শান্তি, সম্পদ উথলে উঠতে লাগল ওদের দাম্পত্য জীবনে। রহস্যময় অন্তর্ধান সম্বন্ধে আলোচনা করার কোনো স্পৃহাই দেখা যায়নি ওদের মধ্যে। ওদের প্রথম খোকার নাম রেখেছিল করয়ইউন এবং এই বিদ্ঘুটে দাঁতভাঙা নাম নিয়েও কোনো বন্ধুবান্ধব কৌতূহল প্রকাশ করেনি—অন্তত ওদের কানে এরকম কানাঘুসো কোনোদিন আসেনি।
করয়ইউন নামটা পছন্দ করেছিল অ্যান এবং অ্যালেনের বিষম প্রতিবাদও খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে তার জেদের কাছে।
ব্যাবসার সহকর্মী এবং অন্তরঙ্গ বন্ধু মি. গ্লুবের কাছে আপিল করেছিল অ্যালেন। বলেছিল—“এরকম পিছিয়ে যাওয়া নাম নিয়ে কোনোদিনই জীবনে উন্নতি করতে পারবে না খোকা। আপনি কী বলেন, তাই নয় কি?”
অবাক হয়ে চোখ মিট মিট করে শুধিয়েছিলেন মি. গ্লুব—“করয়ইউন-এর পিছিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কি মশায়?”
(বিদেশি ছায়ায়)
Tags: অদ্রীশ বর্ধন, দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
