সরাই
লেখক: রবার্ট ই হাওয়ার্ড অনুবাদ: ঋজু গাঙ্গুলী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“কই হে! কেউ আছ?”
অন্ধকার জঙ্গলের ওপর নেমে আসছিল নৈঃশব্দ্য। তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে, ভয়-দেখানো প্রতিধ্বনি তুলে হুংকারটা ছড়িয়ে গেল চতুর্দিকে।
“মনে হচ্ছে জায়গাটা খুব একটা সুবিধের নয়।”
জঙ্গলের মধ্যে সরাইখানাটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল দুজন পুরুষ। ভারী কাঠ দিয়ে বানানো বাড়িটা খুব একটা উঁচু না হলেও বেশ লম্বা আর ছড়ানো চেহারার ছিল। তার ছোট্ট জানালাগুলো কাঠের তক্তা মেরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সামনের দরজাটাও ছিল বন্ধ। তবে দরজার মাথায় দু-ভাগ-হয়ে-যাওয়া খুলির ছবি দেখে ‘ফাটাখুলি সরাই’ নামটা বোঝা যাচ্ছিল।
ধীরে ধীরে খুলে গেল দরজা। শ্মশ্রুগুম্ফশোভিত একটি মুখ উঁকি দিল। মুখের মালিক নেহাত—অনিচ্ছাসত্ত্বেই যেন—পিছিয়ে গিয়ে তার অতিথিদের ভেতরে আসতে বলল। ভেতরে টেবিলের ওপর একটা মোমবাতি জ্বলছিল। ফায়ারপ্লেসে ধুকধুক করছিল আগুনের শিখা।
“আপনাদের নাম?”
“সলোমন কেইন।” দীর্ঘদেহী পুরুষটি সংক্ষেপে উত্তর দিলেন।
“গ্যাস্টন ল্য’আরমঁ।” কিঞ্চিৎ রূঢ়ভাবে বলল অন্যজন, “কিন্তু তা জেনে তোমার কী হবে?”
“এই জঙ্গলে আগন্তুকের সংখ্যা খুবই কম।” গজগজ করার মতো করে বলল সরাই মালিক, “সে তুলনায় চোর-ডাকাতের সংখ্যা অত্যধিক। টেবিলে বসুন; আপনাদের জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”
টেবিলে দুজনের বসার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, এরা অনেক ঘাটের জল-খাওয়া মানুষ। দীর্ঘদেহী শীর্ণকায় পুরুষটির পরনের কালো পোশাক আর পালকবিহীন টুপি তার রোদে পোড়া গম্ভীর মুখটাকে আরও তীক্ষ্ণ করে তুলেছিল। তার তুলনায় কমবয়সি অন্য পুরুষটি ছিল একেবারেই অন্যরকম। তার পরনের জমকালো পোশাকটা অবশ্য দীর্ঘ যাত্রার ধকলে কিছুটা মলিন হয়ে পড়েছিল। লোকটিকে সুদর্শনই বলা চলে; তবে বসার পরেও তার চোখজোড়া স্থির না থেকে চারদিকে ঘুরছিল।
রুক্ষ টেবিলের ওপর খাদ্য ও পানীয় সাজিয়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল সরাই মালিক। মনে হচ্ছিল, মানুষটি যেন কালচে কোনো ছবির মতো করে অন্ধকারে মিশে যেতে চাইছে। কাঁপতে-থাকা আগুনের আলোয় তার চেহারাটা মুহূর্তের জন্য স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছিল, আবার পরমুহূর্তেই আবছা হয়ে যাচ্ছিল। লোকটির দাড়ি দেখে কোনো জন্তুর গায়ের ঘন লোমের কথাই মনে হতে বাধ্য। তার ওপর জেগে ছিল একটা বিশাল নাক, আর নিষ্পলক ভঙ্গিতে টেবিলে বসা দুজনের দিকে তাকিয়ে-থাকা একজোড়া লাল চোখ।
“তুমি কে?” হঠাৎ প্রশ্ন করল কমবয়সি পুরুষটি।
“আমি ফাটাখুলি সরাইয়ের মালিক।” রুষ্ট গলায় উত্তর এল—যেন বক্তা অন্যজনকে বলছে, সাহস থাকলে সে যেন আরও প্রশ্ন করে।
“তোমার এখানে আরও অনেক অতিথি আছে নাকি?” গ্যাস্টন জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে গেল।
“খুব কম লোকই দুবার আসে এখানে।” গজগজ করল সরাই মালিক।
চমকে সোজা হয়ে ওই জ্বলন্ত লাল চোখজোড়ার দিকে তাকালেন কেইন—যেন কথাটার মধ্যে কোনো গোপন অর্থের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। সরাই মালিকের চোখজোড়ার আগুন ঢিমে হয়ে এল। ইংরেজটির শীতল দৃষ্টির সামনে তার গম্ভীর মুখটা একসময় মাটির দিকেই ঝুঁকে পড়ল।
“শুতে চললাম।” খাওয়া থামিয়ে, একরকম হঠাৎ করেই বলে উঠলেন কেইন, “কাল ভোরে আলো ফুটলেই আবার রওনা হতে হবে আমায়।”
“আমাকেও।” বলল ফরাসিটি, “ওহে সরাই মালিক, আমাদের ঘর দেখিয়ে দাও।”
একটা লম্বা, অন্ধকার হলঘরের মধ্য দিয়ে সরাই মালিককে অনুসরণ করে এগোল দুই অতিথি।
মোমবাতির আলোয় ঘরের দেওয়ালে কালো ছায়ারা থরথর করে কাঁপছিল। সরাই মালিকের খাটো অথচ চওড়া চেহারাটা সেই মৃদু আলোয় একবার বড়ো, পরক্ষণেই ছোটো হচ্ছিল; তবে তার পিছনে থাকা ছায়াটাকে লম্বা আর নিষ্ঠুর দেখাচ্ছিল।
একটা বিশেষ দরজার সামনে এসে থামল সরাই মালিক। ইশারায় সে বুঝিয়ে দিল, এই ঘরেই ঘুমোতে হবে দুই অতিথিকে। দুজনে সেই ঘরে ঢুকলে সরাই মালিক নিজের হাতে ধরা মোম থেকে আরেকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল। যে পথ ধরে সে এসেছিল, সেই পথ ধরেই সে আবার দুলতে দুলতে কোথাও চলে গেল।
ঘরে আসবাব বলতে ছিল গোটা দুয়েক বাংক, দুটো চেয়ার আর একটা ভারী টেবিল। দুই অতিথি একে অপরের দিকে তাকাল।
“দরজাটা কোনোভাবে বন্ধ রাখতে হবে।” বললেন কেইন, “সরাই মালিকের হাবভাব ভালো ঠেকছে না।”
“খিল লাগানোর জন্য খাঁজ বসানো আছে, দেখছি।” বলল গ্যাস্টন, “কিন্তু খিল তো নেই।”
“টেবিলটাকে ভাঙলে তার টুকরোগুলো দিয়ে খিলের কাজ চালানো যেতে পারে।” চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন কেইন।
“বাপ রে!” গ্যাস্টন বলে উঠল, “আপনি তো সাংঘাতিক লোক, মশাই।”
কেইনের ভ্রূ কুঁচকে গেল। রুক্ষভাবে তিনি বললেন, “ঘুমের মধ্যে খুন হওয়াটা কাজের কথা নয়।”
“তা বটে!” হেসে উঠল ফরাসিটি, “আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভালো লাগছে। অথচ সূর্য ডোবার ঠিক আগে জঙ্গলের রাস্তায় আপনাকে পেরিয়ে যাওয়ার আগে আমাদের কখনও দেখাই হয়নি।”
“আমি আপনাকে আগেও কোথাও দেখেছি।” উত্তর দিলেন কেইন, “তবে কোথায় দেখা হয়েছিল, তা মনে পড়ছে না। যা-ই হোক, আমি প্রত্যেককেই সজ্জন বলে মনে করি—যতক্ষণ না কেউ তার ‘দুর্জন’ চেহারাটা আমায় দেখায়। তা ছাড়া আমার ঘুম খুব পাতলা; এমনকি ওই অবস্থাতেও পিস্তলটা আমার নাগালেই থাকে।”
আবার হেসে উঠল ফরাসিটি।
“তা-ই বলুন। এদিকে আমি এই ভেবেই মরছিলাম যে, ভদ্রলোক কোন সাহসে একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির সঙ্গে একই ঘরে রাত কাটাচ্ছেন! তা বেশ, ইংরেজ মহাশয়। আপাতত আমরা অন্য ঘরগুলো খুঁজে দেখি, দরজা বন্ধ করার মতো খিল পাই কি না।”
মোমবাতি হাতে নিয়ে করিডরে বেরোল সরাইয়ের দুই অতিথি। নিথর নীরবতা থমথম করছিল সর্বত্র। ঘন অন্ধকারের মধ্যে মোমবাতির ছোট্ট লালচে শিখাটা দপদপ করে যেন কিছু বলতে চাইছিল।
“সরাই মালিকের অন্য কোনো অতিথি নেই; চাকরবাকরও নেই দেখছি।” বিড়বিড় করলেন কেইন, “ভারী অদ্ভুত সরাই! কী যেন নাম… বলতে গিয়েও জিবে আটকায়—ফাটাখুলি সরাই! এইরকম একটা রক্তাক্ত নাম কেন রাখা হয়েছে, কে জানে।”
প্রথমে পাশের ঘরটা দেখা হল, কিন্তু সেখানে কোনো খিল পাওয়া গেল না। খুঁজতে খুঁজতে করিডরের শেষ ঘরটাতে পৌঁছে তাতেই ঢুকল দুজন। এই ঘরটার দরজায় একটা গরাদ-বসানো অংশ ছিল। দরজার হাতলের সঙ্গে যুক্ত একটা ভারী খিল দিয়ে সেটা বন্ধ করা ছিল।
“ঘরটাতে একটা জানালা থাকা উচিত ছিল, কিন্তু নেই।” বলে উঠলেন কেইন, “এই দেখুন!”
মোমবাতির আলোয় দেখা যাচ্ছিল, ঘরটার মেঝেতে কালো কালো ছোপ ধরেছে। দেওয়াল আর একটা বাংক একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। বড়ো বড়ো কাঠের টুকরো ছড়িয়ে ছিল চারদিকে।
“এখানে একাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।” গম্ভীর গলায় বললেন কেইন, “দেওয়ালে একটা খিল রয়েছে, মনে হচ্ছে?”
“হ্যাঁ, কিন্তু জিনিসটা দেওয়ালে আটকে গেছে।” খিল ধরে টানতে লাগল ফরাসিটি, “এটা…”
দেওয়ালের একটা অংশ পিছনদিকে সরে গেল। বিস্ময়সূচক একটা মন্তব্য করল গ্যাস্টন। পিছনের ছোট্ট, লুকোনো ঘরটাকে, বিশেষভাবে তার মেঝেতে শুয়ে-থাকা জিনিসটার দিকে তাকাল সরাইয়ের দুই অতিথি।
“কঙ্কাল!” বলে উঠল গ্যাস্টন, “দেখেছেন, লোকটার পা মেঝের সঙ্গে শেকল দিয়ে বাঁধা আছে! ওকে এখানেই বন্দি করে রাখা হয়েছিল। সেই অবস্থায় থাকতে থাকতেই মরেছে নির্ঘাত।”
“উঁহুঁ।” মাথা নাড়লেন কেইন, “কঙ্কালের খুলিটা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। মনে হচ্ছে, সরাই মালিক বেশ ভেবেচিন্তেই এই নারকীয় সরাইয়ের নামকরণ করেছে। আমাদের মতো এই অঞ্চলে নবাগত এই লোকটিও নিশ্চয় তার অতিথি হয়েছিল।”
“হতে পারে।” নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলল গ্যাস্টন। ততক্ষণে সে কঙ্কালের পা থেকে শিকলের মস্ত বড়ো বলয়টা খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তাতে বিশেষ সুবিধে করতে না পেরে সে নিজের তরবারি বের করে তা-ই দিয়েই মেঝেতে গাঁথা শিকলটার গায়ে ভীষণ জোরে আঘাত করল। ছিন্ন হয়ে গেল শিকলটা।
“একটা শিকলকে কেন মেঝেতে বেঁধে রাখা হল?” আপন মনে বলল ফরাসিটি, “ভালো শেকল নষ্ট করা শুধুশুধু! তাহলে মান্যবর,” মেঝেতে পড়ে-থাকা হাড়ের স্তূপটার উদ্দেশে সে ব্যঙ্গভরে বলল, “আপনাকে বন্ধনমুক্ত করে দিয়েছি। এবার আপনি যেখানে খুশি, সেখানে যেতে পারেন!”
“এসব বলবেন না।” গম্ভীর গলায় বললেন কেইন, “মৃতকে ব্যঙ্গ করলে তার ফল ভালো হয় না।”
“তাহলে মৃতেরও নিজেকে বাঁচানো উচিত।” হেসে উঠল গ্যাস্টন, “আমাকে যদি কোনো মানুষ খুন করে, তাহলে আমার মৃতদেহ পাতাল থেকেও ফিরে আসবে বদলা নিতে।”
ঘর থেকে বেরোনোর দরজার দিকে যেতে চাইলেন কেইন। গ্যাস্টনের কথাবার্তার মধ্যে শয়তানি আর ডাকিনীবিদ্যার এমন একটা ছাপ ছিল, যেটা তাঁর একেবারেই সহ্য হচ্ছিল না। তা ছাড়া সরাই মালিকের মুখোমুখি হয়ে তার অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায় করাটাই ছিল তাঁর প্রথম লক্ষ্য।
ফরাসিটিকে পিছন রেখে ঘুরতেই ঘাড়ের কাছে ঠান্ডা ইস্পাতের স্পর্শ পেলেন কেইন। তিনি বুঝতে পারলেন, একটা পিস্তলের নল তাঁর মস্তিষ্কের ঠিক নীচেই চেপে বসেছে।
“নড়বেন না মহাশয়।” নীচু, তেলতেলে গলাটা বলছিল, “নড়বেন না। নইলে আপনার মগজে যেটুকু ঘিলু আছে, তাও এই ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাবে।”
রাগে কাঁপতে কাঁপতে নিজের দুটো হাত উপরদিকে তুললেন কেইন। তাঁর কোমরের খাপ থেকে পিস্তল আর তরবারি বের করে নিল গ্যাস্টন।
“এবার আপনি ঘুরে দাঁড়াতে পারেন।” একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল গ্যাস্টন।
সুবেশ ফরাসিটি টুপি খুলে ফেলেছিল। সেটা ধরা ছিল তার এক হাতে; অন্য হাতে ছিল লম্বা নলওয়ালা পিস্তলটা। সামনে ঝুঁকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকে দেখলেন কেইন।
“কসাই গ্যাস্টন!” শান্ত গলায় বললেন ইংরেজটি, “একজন ফরাসিকে বিশ্বাস করাটা আমার তরফে মূর্খামিই ছিল। তবে তুমি নিজের এলাকা ছেড়ে অনেক দূরে এসে পড়েছ, দেখছি। এবার আমার মনে পড়েছে। তোমাকে, আর তোমার মাথার ওই বিশাল টুপিটাকে আমি বেশ কয়েক বছর আগে ক্যালেতে দেখেছিলাম।”
“ঠিক বলেছেন। তবে আর আমাকে দেখতে পাবেন না আপনি। আ… ওটা কীসের শব্দ হল?”
“কঙ্কালটার হাড়গোড় খুঁড়ে দেখছে ইঁদুরের দল।” মন্তব্য করলেন কেইন। শিকারি বাজের মতো তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল পিস্তলের নলটার দিকে—যাতে সামান্যতম কাঁপুনিও তাঁর নজর না এড়িয়ে যায়, “ওগুলো হাড় নড়ার শব্দ।”
“হতে পারে।” বলল অন্যজন, “যা-ই হোক, আমি শুনেছি যে, শ্রীল শ্রীযুক্ত কেইন যাত্রাপথে বেশ ভালোরকম টাকাপয়সা নিজের সঙ্গে রাখেন। ভেবেছিলাম, আপনি ঘুমোলেই আপনাকে মেরে সেগুলো… তবে সুযোগ যখন এলই, তখন তো আর সেটা ছেড়ে দেওয়া যায় না। তবে আপনি কিন্তু বড্ড সহজে ঠকে গেলেন।”
“যে মানুষটির সঙ্গে বসে একই পাত্র থেকে রুটি নিয়ে খেলাম, তাকে সন্দেহ করার কথা মাথায় আসেনি আসলে।” ক্রোধ একটা মন্থর, কিন্তু সর্বগ্রাসী ঢেউয়ের মতো করে কেইনের কণ্ঠকে গ্রাস করছিল।
ব্যঙ্গভরে হাসল দস্যুটি। কুটিল চোখ কেইনের ওপর নিবদ্ধ রেখে, ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরোনোর দরজার দিকে পিছোতে লাগল সে। আপনা থেকেই কেইনের প্রতিটি পেশি টানটান হয়ে উঠল। প্রকাণ্ড একটি নেকড়ের মতো গ্যাস্টনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি। কিন্তু গ্যাস্টনের হাত একেবারে পাথরের মতো স্থির হয়ে ছিল।
“উঁহুঁহু, ওই সুযোগ আপনি আপনাকে দেব না, মহাশয়।” বলল গ্যাস্টন, “স্থির হয়ে দাঁড়ান। মরতে মরতেও কীভাবে একজন অন্যকে মারতে পারে, তা আমি দেখেছি। আমার আর আপনার মধ্যে আমি যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছি, যাতে আপনি তেমন কিছু করার সুযোগ না পান। আমার বিশ্বাস, আমি গুলি চালানোর সঙ্গে সঙ্গে আপনি ছুটে এসে আমার দিকে ঝাঁপ দেবেন। কিন্তু আমার নাগাল পাওয়ার আগেই আপনি মারা যাবেন, আর সরাই মালিকের সংগ্রহে আরও একটা কঙ্কাল যোগ হবে। তবে তার আগেই না সে আমার হাতে মারা যায়! লোকটা আমাকে চেনে না; সে অবশ্য আমিও তাকে…”
ফরাসিটি ততক্ষণে দরজায় পৌঁছে গিয়েছিল। পিস্তলের নলটা তাক করে, তার ওপর দিয়েই কেইনের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। দেওয়ালের একটা খাঁজে আটকে-দেওয়া মোমবাতিটা দপদপ করে একটা অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে দিলেও সেটা দরজার ওপাশে যেতে পারছিল না। সেই অন্ধকার থেকে, একেবারে মৃত্যুর মতোই অতর্কিতে, গ্যাস্টনের পিছনে সোজা হয়ে দাঁড়াল একটা বড়োসড়ো অথচ অন্ধকারে আবছা চেহারা। তারই সঙ্গে ঝলসে উঠল একটা ধারালো ধাতুর টুকরো।
সদ্য বলি-হওয়া কোনো ষাঁড়ের মতো ধীরে ধীরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল ফরাসিটি। ফেটে দু-ভাগ-হয়ে-যাওয়া তার খুলি থেকে ঘিলু বেরিয়ে আসছিল। তার ওপর ঝুঁকে পড়েছিল সরাই মালিক, যার হাতে ধরা ছিল একটা প্রকাণ্ড গজাল।
“ধীরে! ধীরে!” গর্জে উঠল সরাই মালিক, “পিছিয়ে যাও, বলছি!”
গ্যাস্টন কাবু হওয়ামাত্র লাফ দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন কেইন। কিন্তু নিজের বাঁ হাতে ধরা একটা বিশাল লম্বা নলের পিস্তল তাঁর মুখে প্রায় ঠুসে ধরেছিল সরাই মালিক।
“পিছিয়ে যাও!” বাঘের মতো গর্জে উঠল সে।
মৃত্যুবাহী অস্ত্র আর লাল দু-চোখে ধিকিধিকি জ্বলা উন্মাদনার আগুন থেকে একটু একটু করে পিছিয়ে এলেন কেইন। শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও তাঁর গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। ফরাসি দস্যুটির তুলনায় একটি গভীরতর, হয়তো-বা আরও ভয়ংকর কোনো বিপদের আভাস পাচ্ছিলেন তিনি। সামনে দাঁড়িয়ে বিকৃতভাবে হাসতে হাসতে দুলতে-থাকা মানুষটিকে দেখে মানুষ নয়, বরং কোনো পশুর কথা মনে হচ্ছিল তাঁর।
“কসাই গ্যাস্টন!” পায়ের কাছে পড়ে-থাকা দেহটাকে লাথি মেরে চিৎকার করে উঠল সরাই মালিক, “আহাহা, চাঁদবদন যে আর ডাকাতি করতে পারবে না! এই জঙ্গলের মধ্যে লুঠতরাজ-করে-চলা এই দস্যুটির নাম শুনেছিলাম বটে। কিন্তু এ কী হল? সোনা খুঁজতে এসে শেষে এই দশা! এখন যে তোমার সোনাটুকুও আমি নেব, চাঁদ। আর তারই সঙ্গে নেব বদলা!”
“আমি তোমার শত্রু নই।” শান্ত ভঙ্গিতে বললেন কেইন।
“দুনিয়ার সবাই আমার শত্রু! আমার কবজির এই দাগগুলো দেখতে পাচ্ছ? পায়ের গোড়ালির কাছে এই ক্ষতস্থানগুলো দেখা যাচ্ছে? আমার পিঠের দিকে একবার তাকালেই দেখতে পাবে চাবুকের গভীর দাগ। আর আমার মাথায়? সেই ক্ষতস্থান তো চোখে দেখা যায় না। কিন্তু বছরের পর বছর জেলের ওই নোংরা ঘরে বন্দি হয়ে থাকার ক্ষতই তো সব চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক—সে-ও আবার বিনা দোষে!”
বিকট কান্নার হাহাকারে ভেঙে পড়ল সরাই মালিক।
কেইন কোনো কথা বললেন না। ইউরোপের ভয়ংকর জেলখানায় বন্দিদশা কাটিয়ে বদ্ধপাগল-হয়ে-যাওয়া মানুষ তিনি এর আগেও দেখেছেন।
“কিন্তু আমি পালাতে পেরেছিলাম!” কান্নাটা উল্লাসে পরিণত হল এবার, “আর এই জঙ্গলের মধ্যে আমি দুনিয়াসুদ্ধ সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ… ওটা কীসের শব্দ হল?”
মুহূর্তের জন্য কী ওই বীভৎস, উন্মাদ চোখজোড়ায় আতঙ্কের ঝলক দেখতে পেলেন কেইন?
“আমার পোষা জাদুকরটি নিজের হাড় নিয়ে খেলাধুলো করছে নাকি?” ফিশফিশ করে উঠেই হাসিতে ফেটে পড়ল সরাই মালিক, “মরার সময়েও সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, তার হাড় দিয়েই নাকি সে আমার ওপর বদলা নেবে। সেজন্যই তো কঙ্কালটাকে মেঝের সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিলাম। রাত গভীর হলে শুনতে পাই, নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করছে কঙ্কালটা। সেই শব্দ শুনে আমি হোহো করে হাসি। ওর মতলবটা কি আর আমি বুঝতে পারি না নাকি? এই অন্ধকার সরাইয়ের মধ্যে রাজার মতো হেঁটে বেড়াতে চায় সেই ওঝা। আমি যখন ঘুমের মধ্যে তলিয়ে থাকি, তখন আমাকে খতম করে দেওয়ার খোয়াব দ্যাখে সে!”
হঠাৎ সেই উন্মাদ চোখজোড়া ধক করে জ্বলে উঠল, “তোমরা তো ওই গোপন ঘরটায় ঢুকেছিলে, তা-ই না? তুমি আর এই মূর্খ দস্যু… তখন তোমাদের কী বলেছিল ওই জাদুকর?”
নিজের অজান্তেই কেইনের সর্বাঙ্গ থরথর করে শিহরিত হল। এ কি শুধুই উন্মাদনা? নাকি এবার হাড় নড়ার শব্দই এল তাঁর কানে—যেন কঙ্কালটা নড়ে উঠেছে? অবশ্য ইঁদুরদের হাত থেকে ধুলো-মাখা হাড়ও রেহাই পায় না—কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজেকে এ কথাই বোঝাতে চাইলেন কেইন।
ততক্ষণে সরাই মালিক আবার হাসতে শুরু করেছিল। কেইনকে পাশ কাটিয়ে, পিস্তলের নলটা তাঁর দিকে একেবারে স্থির রেখে, অন্য হাত দিয়ে সে গোপন ঘরের দরজাটা খুলল। ভেতরে অন্ধকার জমাট বেঁধে ছিল। সেই অন্ধকারে মেঝেতে পড়ে-থাকা হাড়ের সাদাটে রংটুকুও কেইনের চোখে ধরা দিল না।
“দুনিয়ার সব্বাই আমার শত্রু!” জড়ানো, অসংলগ্ন ভঙ্গিতে বলে চলল উন্মাদ সরাই মালিক, “কাউকে ছাড়ব না আমি! কেন ছাড়ব? অপরাধ প্রমাণিত না-হওয়া সত্ত্বেও যখন আমায় বছরের পর বছর কার্লরুহ-এর জেলে বন্দি থাকতে হয়েছিল, তখন একজনও কি আমার হয়ে কিছু বলতে এসেছিল? তারপর থেকেই তো আমার মাথাটা… কেমন যেন হয়ে গেছে। পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় পাওয়ার পর থেকে আমিও এই জঙ্গলের নেকড়েদেরই একজন।
“আমার ভাইয়েরা এই ক-দিন পেট ভরে খেতে পেয়েছে। এই সরাইয়ে রাত-কাটানো মানুষেরা তাদের পেটপূর্তি খোরাক জুগিয়েছে। শুধু এই একটা লোক—রাশিয়া থেকে আসা এক জাদুকর—এর হাড়গুলো এই ঘরেই পচছে। তাকে জঙ্গলে ছুড়ে ফেলার ঝুঁকি নিতে পারিনি আমি। বলা তো যায় না! যদি মরা অবস্থাতেই সে আমার ওপর চড়াও হয়? মড়াকে তো মারা যায় না! তাই ওর কঙ্কালটাকে আমি এই ঘরেই বেঁধে রেখেছি। আমার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে—এতটা তাকত ছিল না লোকটার জাদুর। কিন্তু এ কথা কে না জানে যে, মরার পর জাদুকরের ক্ষমতা বিস্তর বেড়ে যায়? তাই…
“একদম নড়ার চেষ্টা কোরো না ইংরেজ! ওই গোপন ঘরে, আমার পোষা জাদুকরকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য তোমার হাড়গুলোকেও আম…”
উন্মাদটি ততক্ষণে গোপন ঘরের দরজার কাছে পৌঁছেছিল। দরজায় দাঁড়িয়ে পিস্তলটা সে আবার তুলে ধরেছিল কেইনের দিকে। হঠাৎ তার চেহারাটা অন্ধকারে হারিয়ে গেল—যেন সে চিত হয়ে পিছনদিকে পড়ে গেছে। তখনই দমকা হাওয়ার একটা ঝাপট ধেয়ে এল করিডর দিয়ে। তার ধাক্কায় গোপন ঘরের দরজা দড়াম করে বন্ধ হল; তারই সঙ্গে নিবে গেল মোমবাতিটা।
অন্ধকারে মেঝের ধুলোর মধ্যে হাতড়ে একটা পিস্তল খুঁজে পেলেন কেইন। সেটা হাতে নিয়ে, ওই ঘন অন্ধকারেই বন্ধ হয়ে দরজাটার দিকে পিস্তল তাক করে দাঁড়ালেন তিনি। তখনই ঘরটার ভেতর থেকে রক্ত-জল-করে-দেওয়া একের পর এক চিৎকার ভেসে আসতে লাগল। সেই আর্তনাদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল খটখটে শুকনো হাড় গড়াগড়ি যাওয়ার শব্দ। কিছুক্ষণ পর সব চুপচাপ হয়ে গেল; নেমে এল নিথর নৈঃশব্দ্য।
বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায় চকমকি পাথর আর ইস্পাতের সাহায্যে মোমবাতিটাকে জ্বালাতে পারলেন কেইন। এক হাতে সেটাকে, আর অন্য হাতে পিস্তল নিয়ে গোপন ঘরের দরজাটা খুললেন তিনি।
“হা ঈশ্বর!” বিড়বিড় করলেন কেইন। তাঁর মতো সাহসীরও ঘাম ছুটে গিয়েছিল দৃশ্যটা দেখে, “এর তো কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা হওয়া সম্ভবই নয়। অথচ সবটা তো আমার সামনেই ঘটল! দুটো শপথই পালিত হয়েছে, দেখছি। কসাই গ্যাস্টন বলেছিল, মরে গেলেও সে নিজের খুনিকে ছাড়বে না। আর তারই তরবারির ঘায়ে তো ছাড়া পেয়েছিল ওই রক্তমাংসহীন জাদুকর। তারপর সে…”
ফাটাখুলি সরাইয়ের মালিকের নিষ্প্রাণ শরীরটা পড়ে ছিল ওই গোপন ঘরের মেঝেতে। তার পাশবিক মুখে গভীর হয়ে ফুটে উঠেছিল সীমাহীন ভয়ের ছাপ। আর তার মটকানো গলায় গভীরভাবে গেঁথে বসেছিল জাদুকরের কঙ্কালের মাংসহীন আঙুলের হাড়গুলো!
মূল কাহিনি: র্যাট্ল অব বোনস, প্রথম প্রকাশ: ‘উইয়ার্ড টেলস’, জুন ১৯২৯
Tags: ঋজু গাঙ্গুলী, দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, রবার্ট ই হাওয়ার্ড
