শ্যাওলা
লেখক: তৃণময় দাস
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
I am terrified by this dark thing
That sleeps in me;
All day I feel its soft, feathery turnings, its malignity.
“Elm”, Sylvia Plath
স্বর্গদ্বার থেকে বেরিয়ে, গর্জন-করতে-থাকা সমুদ্রকে বামদিকে রেখে, এগিয়ে চলল সুস্মিতা।
এখানে সমুদ্রতট তেমন ফাঁকা নয়, অসংখ্য স্টল মাশরুমের মতো গজিয়ে রয়েছে। জামাকাপড়, গয়নাগাটি, খাবার। লোকজন গিজগিজ করছে পুরো। রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে যে শান্তিতে হাঁটবে, সেটার উপায় নেই। ফুটপাথের দুইদিকে স্টল, গুমটি আর ঠ্যালাগাড়ি। লোকজন হাঁটার রাস্তা আটকে শঙ্খ কিনছে, ঝিনুকের হার কিনছে, জামাকাপড় নিয়ে দরাদরি করছে, মশলা-মাখানো মাছ খাচ্ছে, আর সেই মাছের কাঁটা ফুটপাথের উপরেই ফেলছে।
পুরী সি-বিচের সেই সৌন্দর্য বিচ মার্কেটের আশপাশে দেখতে পাওয়া যায় না।
সুস্মিতার এই ভিড়ে দমবন্ধ হয়ে আসছিল। সে আরও দ্রুত এগিয়ে চলল৷ হোটেল থেকে বেরোনোর পর ওর হাত-পা কেমন ভারী-ভারী লাগছিল, যেন ওর শিরা-উপশিরার মধ্যে আর রক্ত নয়, গরম সিসা বইছে। এখন এই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। “কীসের জন্য এত কান্না?” জিজ্ঞাসা করল সমুদ্র। সুস্মিতার কাছে সেটার কোনো উত্তর নেই। সে চোখ দুটো মুছে এগিয়ে যাচ্ছে।
কিছুটা হাঁটার পর রাস্তার ভিড় যেন একটু পাতলা হয়ে এল, যদিও ফুটপাথের দুইপাশে এখনও পরপর স্টল, গুমটি ইত্যাদি। বামদিকে, সমুদ্রতটের দিকে উঁকি দিল সুস্মিতা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকটা চায়ের দোকান। সমুদ্রমুখী সারি সারি চেয়ার (“না দিদি, বসতে হলে ঘণ্টায় ২০ টাকা লাগবে।”) রাস্তার পাশে বড়ো বড়ো স্ট্রিটলাইটের আলো বালিতে পড়ে আলো-আঁধারির জন্ম দিয়েছে। সেই ভূতুড়ে পরিবেশে কয়েকটা উট রংচঙে জামা পরে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের পিঠে টুরিস্টরা বসে রাজস্থানের স্বপ্ন দেখছে।
ছোটোবেলার পুরী কত বদলে গেছে, ভাবছিল সুস্মিতা। সমুদ্রপ্রিয় বাঙালিদের কমার্শিয়ালাইজ়ড ইউটোপিয়া। এই তো, সামনেই মিত্র কাফে নিয়নের হাতছানি দিচ্ছে। রাস্তার ওই পারে, সুস্মিতার ডানদিকে, বড়ো বড়ো বাঙালি রেস্তোরাঁ, বার্গার জয়েন্ট, পিৎজ়া প্লেস… প্রভাত বলেছিল যে, একদিন মিত্র কাফেতে খেয়ে আসবে। “বেড়াতে যখন এসেছি, ভালোমন্দ খাবই খাব। বাকি সব পরে ভাবা যাবে।” প্রভাতের কথা শুনে সুস্মিতার বান্ধবী নীলিমা আর নীলিমার ভাই গৌরব সায় দিয়েছিল।
প্রভাতের কথা ভাবতেই বুকের ভেতরটা জ্বলে উঠল৷ এক মুহূর্তের জন্য সুস্মিতার দমবন্ধ হয়ে এল। সে নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে, কারণ ওর ফুসফুস দুটো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অবুঝ চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গালে দাগ কেটে নেমে আসছে, মিলিয়ে যাচ্ছে নোংরা রাস্তায়।
নিজেকে কেন জানি একটা অপরাধী মনে হচ্ছে সুস্মিতার। ও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, ওর মা হিসহিসিয়ে বলছে, “দেখনদারি করছিস? দেখনদারি? তোর এইসব নাটক আমি বুঝি না, ভাবছিস! কান্নাকাটি করে খালি নিজের দিকে অ্যাটেনশন নিয়ে আসা। খুব ভাল্লাগে, বল তখন? ইউ নার্সিসিস্ট বি…”
“ও দিদি, দোকানের সামনে থেকে সরে দাঁড়ান।”
সুস্মিতা চমকে উঠল। নিজের অজান্তেই ও কখন হাঁটা থামিয়ে দিয়েছে। দোকানদারের থেকে মুখটা আড়াল করে আবার হাঁটতে শুরু করল। পার্স থেকে ইতিমধ্যেই একটা রুমাল বেরিয়ে এসেছে। সুস্মিতা সেটা দিয়ে এমনভাবে চোখ দুটো ডলছে, যেন পারলে নিজের চামড়া তুলে ফ্যালে। তখন থাকবে শুধু মাংসপেশি। লাল টুকটুকে মাংসপেশিতে আবেগের চিহ্ন বোঝা যাবে না।
মিত্র কাফের বিঘত বিল্ডিংটা পার হতেই লাইটহাউসটা চোখে পড়ল। বেঁটেমোটা লাল লাইটহাউস। পুরীর স্ট্রিটলাইট আর বাজারের আলোর রোশনাইয়ের জন্য লাইটহাউসের মাথায় লাগানো ঘুরন্ত আলো তেমন বোঝা যাচ্ছে না৷
এইদিকে আর ভিড় তেমন নেই। অনেক দোকানের ঝাঁপ নামানো। সমুদ্রতটও অনেকটা ফাঁকা। সুস্মিতা সমুদ্রের দিকে ঘুরে গেল।
ফুটপাথ পার হতেই বালি। ঠান্ডা, আরামদায়ক বালি। সুস্মিতার ইচ্ছে হল একমুঠো বালি ওর বুকে মেখে নিতে, তাহলে হয়তো ওই গুমরে-ওঠা বেদনাটা কিছুটা হলেও কমবে।
সদ্য-কেনা প্লাস্টিকের চপ্পল হাতে নিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে শুরু করল সুস্মিতা। আহ্, কী আরাম! আঙুলগুলো বালিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে থপথপ করে এগিয়ে চলল সুস্মিতা।
ওর সামনে এখন সমুদ্র। অসীম, অনন্ত, প্রাচীন। গর্জন করছে। ঢেউগুলো হাঁ করে সরসরিয়ে এগিয়ে আসছে, তারপর বাজ পড়ার মতো আওয়াজ করে বালিতে আছড়ে পড়ছে, অবশেষে সাপের মতো হিসহিস আওয়াজ করে হামাগুড়ি দিয়ে কিছুটা এগিয়ে, আবার পিছিয়ে গিয়ে মূল দেহের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
এইরকম এক অসহ্য সুন্দর জায়গার সামনে সুস্মিতার সব জ্বালাযন্ত্রণা তুচ্ছ হয়ে গেল। অনেকটা নোনতা বাতাস নিজের বুকে টেনে নিল ও।
দত্ত। দয়ধ্বম। দাম্যত।
শান্তি, শান্তি, শান্তি।
এদিকে লোক তেমন না থাকলেও সারি সারি চেয়ার অপেক্ষা করে রয়েছে, তাদের শূন্যতায় কেমন বিষাদ মেশানো। সুস্মিতা এদিক-ওদিক তাকাল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। অবশেষে একটা চেয়ারে নিজের গা এলিয়ে দিল। যার চেয়ার, সে এলে আসবে, তখন না হয় টাকা নিয়ে কথা বলা যাবে৷ সুস্মিতা একটু বসতে চায়৷ কিছুক্ষণের জন্য সব কিছুর থেকে বিরতি চায়।
রাস্তার আলো লেগে সমুদ্রের সাদা ফেনা জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু আরেকটু দূরে তাকালে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সেখানে সমুদ্র আর আকাশের চক্রবাল অন্ধকারের দলা পাকিয়ে রেখেছে। ওখানে যেন মানুষের দৃষ্টিনিক্ষেপ করা বারণ। প্রাচীন দেবতারা তাদের দিবানিদ্রা থেকে উঠে এসে উপরিতলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুযোগ পেলে তারা হুউউউ করে অনেকটা প্রশ্বাস টেনে আবার সমুদ্রের গভীরে চলে যাবে। তাদের অসংখ্য চোখ একটি বারের জন্য আকাশের তারাগুলোর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করবে। কত বিরহ মিশে রয়েছে সেই দৃষ্টিতে?
সুস্মিতার হুঁশ ফিরল। কী অদ্ভুত চিন্তা, ধুস। একটা সিগারেট ধরালে হত। কিন্তু…
পার্সের ভেতরটা নেড়েচেড়ে দেখল…
সিগারেট তো সব শেষ।
“দিদি, এঠি বসিবা পাইন পয়সা দেবাকু পড়িবা।”
খনখনে গলা। বুড়িটাকে দেখতেও ভূতের গল্পের কেয়ারটেকারদের মতো। সমুদ্রের নোনা হাওয়া লেগে তার শাড়ির আঁচল অল্প অল্প উড়ছে।
“পয়সা লাগবে?” সুস্মিতা জিজ্ঞেস করল, “কত?”
বুড়ি ভিক্টরি সাইন করে বলল, “বিশ, বিশ।”
অন্য সময় হলে প্রভাত দরাদরি করে সেই ভাড়া পনেরো টাকায় নামিয়ে আনত, কিন্তু আজ সুস্মিতা একা, একটা চুপসে-যাওয়া বেলুনের মতো।
বুড়ির হাতে একটা পঞ্চাশের নোট গুঁজে দিয়ে ও বলল, “আর সঙ্গে দশ টাকার ফ্লেক।”
বুড়ি অদ্ভুতভাবে একবার সুস্মিতার দিকে তাকাল—যেমনভাবে প্রায় সবাই তাকায়, যখন একটা মেয়েমানুষ সিগারেট খেতে চায়—তারপর বালিতে ফটফট করে চপ্পল ফেলে কাছের একটা চায়ের ঝুপড়ির দিকে চলে গেল।
সুস্মিতা আবার প্লাস্টিকের চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। বুড়ি যেভাবে তাকিয়ে ছিল, সেই দৃষ্টি ওকে চিরকাল ধাওয়া করে গেছে। স্কুলে, অফিসে, রাস্তাঘাটে, নিজের বাড়িতে। ঘেন্না-মেশানো দৃষ্টি। বিচারকদের দৃষ্টি। “সামাজিক দায়বদ্ধতা আর নীতিবোধের অবনতি ঘটানোর জন্য এই মেয়েটিকে দোষী সাব্যস্ত করা হল।” তারপর হাতুড়ির বাড়ি মারো, দুউউউম!
শুধু প্রভাত কিছু মনে করেনি। গঙ্গার ঘাটে দুজনে চুপচাপ বসে নিজেদের সুখ-দুঃখের মতো একটা সিগারেটও ভাগ করে নিত। এইজন্যে কি সুস্মিতা ওর প্রেমে পড়েছিল?
বুড়ি এসে ফ্লেক আর একটা নেতিয়ে-যাওয়া কুড়ি টাকার নোট দিয়ে গেল। সুস্মিতা পার্স থেকে লাইটারটা বার করে সিগারেটটা ধরাতে যাবে, অমনি…
‘মুক্তোর মালা, দিদি। একদম রিয়েল।”
চলে এসেছে। আপদগুলো ঠিক চলে এসেছে।
সুস্মিতা উত্তর না দিয়ে সিগারেটটা জ্বালিয়ে একটা লম্বা টান দিল, তারপর লোকটার দিকে কটমট করে তাকাল। লোকটা সেই দৃষ্টির সামনে পড়ে একটা নার্ভাস ঢোঁক গিলে সামনে থেকে কেটে পড়ল। কিন্তু একজন ফেরিওয়ালা যখন এসেছে, ক্যানসার সেলের মতো অন্যরাও আসতে শুরু করবে। হলও তা-ই।
“জয় জগন্নাথ! জগন্নাথ মন্দিরের ছবি, দিদি। পঞ্চাশ টাকা।”
“ঝিনুক নেবেন?”
“কান পরিষ্কার, দুই টাকা।”
“মুড়ি, মুড়ি, ঝালমুড়ি।”
শেষের জনকে সুস্মিতা হাত নেড়ে কাছে ডেকে নিল। লোকটা পোর্টেবল আলো নিজের মালমশলার উপর ফেলে অত্যন্ত ঝাল এক ঠোঙা মুড়ি মেখে দিয়ে চলে গেল। সিগারেট শেষ করার পর সুস্মিতা সেই মুড়ি খেতে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই হুসহাস করতে শুরু করল। বাব্বা! যে মেয়ে কলকাতায় সব ফুচকাওয়ালাকে বলে, “দাদা, এ কী ফালতু আলু মেখেছ, আরেকটু ঝাল দাও,” সেই মেয়ে পুরীর এক ঠোঙা ঝালমুড়িতে কাত হয়ে গেল। হঠাৎ সুস্মিতার খুব হাসি পেল। ঝালের গুঁতোয় চোখ গড়িয়ে জল পড়ছে, কিন্তু মুখে চওড়া হাসি। সমুদ্রের ঢেউগুলো যেন রেগে গিয়ে আরও জোরে গর্জন করে আছড়ে পড়ল। “আমাদের সামনে মশকরা?”
এবং অবশ্যই, মুডে জল ঢেলে দেওয়ার জন্য, ঠিক সেই সময়ে মোবাইল ফোনে কলটা ঢুকল, বিষের মতো।
প্রভাত।
সুস্মিতা হাসি থামিয়ে অপলক দৃষ্টিতে কলার আইডি-র দিকে চেয়ে রইল। লেখা রয়েছে, ‘হোনে ওয়ালা হাবি’, হাবি মানে হাজ়ব্যান্ড। প্রভাত নিজের এই নাম দেখে নাক কুঁচকে বলেছিল, “ক্রিঞ্জ।” তারপর সুস্মিতাকে আলিঙ্গন করে গলায় নাক ঘষেছিল।
সেই প্রভাত।
ঠগ, জোচ্চোর… চিটার!
“হ্যালো।” সুস্মিতার গলাটা একটু কেঁপে উঠল। কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি কেন? আমি তো ভুল কিছু করিনি?
“কোথায় তুই?”
“জাহান্নামে। কী চাই?”
“কিছু না।”
এক মুহূর্তের নিঃশব্দতা। প্রভাতের নিশ্বাসের আওয়াজ। কেমন ঘড়ঘড়ে শোনাচ্ছে। যখন ও সুস্মিতার গলা চেপে ধরেছিল, তখন সুস্মিতা রাগে, যন্ত্রণায় পাগল হয়ে ওর নাকে জোরে একটা ঘুসি মারে। ফাটা নাক থেকে কিছুটা রক্ত সুস্মিতার আঙুলগুলোয় ছিটকে এসে পড়ে। সেই আঙুলগুলোয় এখন মোবাইল ফোনটা ধরে রয়েছে। রক্ত শুকিয়ে গিয়ে অল্প আলোতে ময়লার ছোপের মতো লাগছে।
“স্মিতা, তুই ফিরে আয়। আয়াম সরি, ওকে? তুই জাস্ট হোটেলে ফেরত আয়।”
“কেন?”
“কিছু কথা ছিল তোর সঙ্গে। সব খুলে বলছি। তুই শুধু…”
“যা বলার, ফোনে বল।”
“সব কথা ফোনে বলা যায় না, সেটা তুইও ভালো করে জানিস।”
“সেইসব কথা বলার প্রিভিলেজ তুই হারিয়েছিস, প্রভাত।”
আবার কিছুক্ষণের বিরতি।
“আমার ভুল হয়ে গেছে, সুস্মিতা। অনেক অন্যায় করেছি। কিন্তু আমার দিকটা একটু শুনে যা।”
“কী আর শোনার বাকি আছে, প্রভাত? বিয়ের আগে আমার সঙ্গে শুতে দিইনি বলে, তুই অন্যদের সঙ্গে শুয়েছিস। তারপর যখন ধরা পড়েছিস, তখন উলটে আমাকেই দোষ দিয়ে আমার উপর অ্যাসল্ট করেছিস। আর কী শুনব?”
“অ্যাসল্ট?” প্রভাতের গলা উষ্ণ হয়ে ওঠে, “অ্যাসল্ট? আর ইউ ফাকিং কিডিং মি?”
“আমার গলায় এখনও তোর আঙুলের ছাপ, প্রভাত।”
“ওটাকে তুই অ্যাসল্ট বলছিস!”
“আচ্ছা, দেওয়ালে আমার মাথা ঠুকে আদর করছিলি, বল?”
“দ্যাট ওয়াজ়…” প্রভাতের গলা আবার মিইয়ে গেছে, “আমি জাস্ট খুব রেগে গিয়েছিলাম, স্মিতা। আই ডিড নট মিন ইট। তুই যেভাবে আমাকে ওই কথাগুলো বললি… তুই তো জানিস আমার টেম্পার কেমন? পুরো ব্যাপারটাই অ্যাক্সিডেন্ট।”
“ওহ্, অ্যাক্সিডেন্ট। তার মানে বলতে চাইছিস, অ্যাক্সিডেন্টালি ইয়োর ডিক গট ইনসাইড হার পুসি।”
“স্মিতা, তুই ওভাররিঅ্যাক্ট…”
আরও কী বলছিল হয়তো প্রভাত, কিন্তু সুস্মিতা ফোনটা কেটে দিল। তারপর একটা জোরে শ্বাস নিয়ে মোবাইলটা সমুদ্রের দিকে ছুড়ে দিল। মোবাইলটা বক্ররেখা বরাবর উড়ে গিয়ে কিছু দূরের ভেজা বালিতে একটু দেবে গেল।
“ড্রামা কুইন।” মা ওর বাম কানে ফিশফিশ করে বলে উঠল।
সুস্মিতার খুব ইচ্ছে করছে বুক ফাটিয়ে একবার চিৎকার করতে। কাঁদতে। বালিতে শুয়ে বাচ্চাদের মতো হাত-পা ছুড়তে। কিন্তু সে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে। শরীরটা কেমন অবশ হয়ে আসছে। সামনে সমুদ্র। রহস্যময়ী জলধারা। সমুদ্রের কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই; নৈতিকতার ধার সে ধারে না। এই যে গর্জন করে সে প্রতিদিন নিজের ক্রোধ প্রকাশ করে—কই, কেউ তো ওকে কিছু বলে না। কেউ বলে না, “সমাজে থাকতে হলে আমাদের কিছু জিনিস মেনে চলতে হয়,” অথবা, “ট্যান্ট্রাম করবে না আমার সামনে।”
মায়ের কথা। যে মায়ের থাবা থেকে সুস্মিতা বেরিয়ে এসেছিল স্বাধীনতার আশায়। সেই আশা দেখিয়েছিল প্রভাত। কিন্তু সেই স্বাধীনতাটাও মিথ্যে। সুস্মিতার মাথা আবার দপদপ করছে। এতটা হতবুদ্ধি নিজেকে কোনোদিন লাগেনি। তাহলে কি ওর মা ঠিকই বলেছিল? মেয়েদের শুধু ঠাকুরঘরের চন্দনকাঠ হয়ে থাকা জানতে হয়?
আর কিছুক্ষণ পর সুস্মিতা চেয়ার থেকে উঠে নিজের মোবাইলটা কুড়িয়ে আনল। বেশি দূরে পড়েনি বলে সমুদ্র টেনে নিতে পারেনি। মোবাইলের গা থেকে ভিজে বালি ঝাড়তে ঝাড়তে নিজের চেয়ারের দিকে এগুচ্ছে, অমনি কে একজন পথ আগলে দাঁড়াল।
“নাইস কঞ্চ, ম্যাডাম। নাইস কঞ্চ, অইস্টার শেল, পার্লস।” বাবা, এ যে ইংরেজিতে কথা বলছে! অন্ধকারে সুস্মিতাকে বিলাতি মনে হচ্ছে নাকি?
অন্য সময় হলে সুস্মিতা এই ফেরিওয়ালার দিকে তাকাতও না। কিন্তু আজ… আজ নিজের সমস্ত ব্যক্তিগত চিন্তা থেকে সে মুক্তি চায়। সুস্মিতা বলল, “আচ্ছা, কত করে?” বাংলাতেই বলল।
ফেরিওয়ালা হাসল। এইরকম অদ্ভুতদর্শন ফেরিওয়ালা এখানে কখনও দেখেনি সুস্মিতা। কুঁজো শরীর, মুখটা ছায়াতে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। গায়ে শালের মতো কী যেন একটা জড়ানো রয়েছে। এক হাতে লন্ঠন। না ইলেকট্রিক নয়, সেই পুরোনো আমলের সলতেওয়ালা বিঘত লন্ঠন। অন্য হাতে একটা চটের বস্তার মাথা ধরা; বস্তাটা পিঠের উপর ঝুলছে। নুলিয়া সান্টা ক্লজ়।
ফেরিওয়ালা বলল, “কঞ্চ, শেল অর পার্ল, ম্যাডাম?” সুস্মিতা লোকটার পরিষ্কার ইংরেজি উচ্চারণ শুনে একটু অবাক হল। শুধু গলাটা যদি এত ফ্যাসফেসে না হত…
“কঞ্চ।” সুস্মিতা বলল।
“গুড চয়েস, ম্যাডাম।” বলে লোকটা ভেজা মাটিতেই থপ করে বসে পড়ল। “মেনি কঞ্চেস আই হ্যাভ।”
লোকটার লম্বা লম্বা আধভেজা চুল কোঁকড়ানো সামুদ্রিক শ্যাওলার মতো নেমে এসেছে। আঙুলগুলোও কেমন সরু সরু, মাকড়সার মত। না, মাকড়সা না, কাঁকড়ার পায়ের মতো। সেই সরু সরু আঙুল অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে বস্তার মুখে বাঁধা দঁড়ির গিঁট খুলে ফেলল। তারপর লন্ঠনটা সামনে রেখে বের করে আনতে থাকল নানা আকারের, নানা ধরনের, নানা রঙের… শঙ্খ।
লন্ঠনের আলোয় ভেজা বালিতে সেজে উঠল ফেরিওয়ালার পসরা।
সুস্মিতা হাঁটু গেড়ে বসে একটা শঙ্খ হাতে তুলে নিল। জিনিসটার রং মিশকালো, কিন্তু জায়গায় জায়গায় আলো লেগে চিকচিক করে উঠছে। এইরকম শঙ্খ এখানকার বাজারে কোথাও দেখেনি।
“এটার দাম কত?” সুস্মিতা জিজ্ঞেস করল।
“নট ফর ইউ।”
“মানে?”
“ইউ ওন্ট লাইক দিস।”
এ কীরকম ফেরিওয়ালা? পসরা সাজিয়ে রেখে এখন নিজেই বিক্রি করতে চাইছে না! সুস্মিতা নিজের বিরক্তি না লুকিয়ে বলল, “আপনি নিজের ভাষাতেই কথা বলুন-না। এত ইংরেজি কেন?” যত্তসব আপদ।
লোকটা অদ্ভুতভাবে সুস্মিতার দিকে তাকাল। তারপর অচেনা একটা ভাষায় কী যেন বলল। অন্ধকারে তার উচ্চারিত শব্দগুলো সমুদ্রের গর্জনের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে গেল।
“কী?”
“মাই ওন ল্যাঙ্গুয়েজ।”
লোকটার মাথায় ছিট আছে নাকি? সুস্মিতা একবার ডানদিকে দেখল। অনতিদূরে ফাঁকা চেয়ারগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আরেকটু দূরে বুড়ি তার চায়ের স্টলে বসে মাছি তাড়াচ্ছে, আর মাঝে মাঝে স্মিতার দিকে সন্দিগ্ধভাবে তাকাচ্ছে। নাহ্, খুব একটা বিপদের মধ্যে ও নেই।
অন্যদিন হলে ও এতক্ষণে উঠে চলে যেত হয়তো, কিন্তু এই শঙ্খগুলো এত অদ্ভুত।
সুস্মিতা আরেকটা শঙ্খের দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিল দেখে, ফেরিওয়ালা হঠাৎ মাথা নেড়ে বলল, “দিস ওয়ান, ম্যাডাম, দিস ওয়ান।”
যেটার দিকে ইশারা করছে, সেটাকে দেখতে মোটেই সুন্দর নয়। এবড়োখেবড়ো গা। তার উপর জায়গায় জায়গায় শ্যাওলার ছোপ। জিনিসটাকে দেখে তেমন রুচিশীল মনে হয় না।
শঙ্খটার গায়ে কে বা কারা অসংখ্য চোখ খোদাই করে রেখেছে। ছোটোবড়ো, নানা আকৃতির। লন্ঠনের কাঁপা কাঁপা শিখায় চোখগুলোকে বড়ো জীবন্ত দেখাচ্ছে।
“ইউ হ্যাভ পেইন, ম্যাডাম।” ফেরিওয়ালা ফ্যাসফেসে গলায় বলল, “ইট ফ্রি ইউ ফ্রম পেইন। অল পেইন। ভালো জিনিস।” শেষ শব্দ দুটো বাংলাতে বললেও, উচ্চারণ খুবই অস্পষ্ট।
সুস্মিতা লোকটার কথা শুনে একটু চমকে উঠল। সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। ওর চেহারা দেখে কি সব বোঝা যাচ্ছে? ছোটোবেলা থেকে যে মা ট্রেনিং দিয়েছিল, মেয়েদের সমস্ত আবেগ রুচিশীলতার জন্য লুকিয়ে রাখতে হয়? সেই ট্রেনিং কাজে দিল না?
সুস্মিতা হাতে তুলে দেখল শঙ্খটা। জিনিসটার ভেজা শরীরে বুড়ো আঙুল ঘষতে ওর গলার পিছনের লোমগুলো হঠাৎ খাড়া হয়ে গেল। অদ্ভুত একটা অনুভূতি। যেন সমুদ্রের সেই স্বাধীনতার উৎস সে হাতে ধরে রয়েছে। একবারে ঠোঁটে লাগিয়ে বাজালেই সে মুক্ত হয়ে যাবে।
মোবাইলটা আবার বাজছে। কলার আইডি-তে এবার নীলিমার নাম। সুস্মিতা মোবাইল সুইচ অফ করে বলল, “হাউ মাচ ইজ় দিস?”
ফেরিওয়ালা দাঁত বার করে হাসল। তারপর নিজের দু-হাত তুলে দশটা আঙুল দেখাল।
মালটা বলতে চাইছে কী? কী আপদ রে বাবা!
“হাউ মাচ ইজ় দিস? টেন হোয়াট?”
লন্ঠনের আলোয় লোকটার ধারালো দাঁতগুলো চিকচিক করছে। দশটা আঙুল দশটা দাঁড়ার মতো উত্থিত। সুস্মিতার তখন মনে পড়ল, নিজের পার্স তো ও চেয়ারে ফেলে এসেছে।
পাগল ফেরিওয়ালার উদ্দেশে সে একবার, “দাঁড়ান, পার্সটা আনতে ভুলে গেছি।” বলে চেয়ারের দিকে দৌড় মারল। তখন ও খেয়াল করেনি, ওর হাতে শঙ্খটা ধরা রয়েছে।
এক মিনিটও লাগেনি। চেয়ারে পৌছে, পার্সটা তুলে, কিছু টাকা বার করে, সমুদ্রের দিকে ফিরতে। এক মিনিটও না।
কিন্তু কোথায় কে? ফাঁকা সমুদ্রতট। বিস্ফোরক সমুদ্র। ফেরিওয়ালা আর নেই।
***
ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা বেজে গেল। রাস্তাঘাট শুনশান। চৈতন্য মহাপ্রভুর মূর্তি একাকী দাঁড়িয়ে আছেন দু-হাত তুলে। সেখান থেকে বামদিক ঘুরে একটু হাঁটলেই হোটেল।
প্রেতের মতো নিঃশব্দে সুস্মিতা দোতলায় উঠল। তারপর নিজের হোটেল রুমের দরজা ঠেলে দেখল, খোলা আছে।
“কোথায় ছিলি তুই? কতবার কল করলাম?” নীলিমা বিছানায় বসে আছে। “এইভাবে বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে ফট করে চলে যাবি না স্মিতা। কী যে করিস তুই!”
“আমি কচি খুকি না, নিলু।”
“কচি খুকি না হতে পারিস, কিন্তু এতদূরে ঘুরতে আগে কোনোদিন আসিসনি। আর যখন একা বেরোবিই, তখন অ্যাট লিস্ট ফোন তো ধরবি।”
সুস্মিতা কিছু না বলে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল।
নীলিমা বলে চলেছে, “আমি তো আর-একটু হলেই তোর বাবাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম।”
সুস্মিতা বেসিনে মুখ ধুতে গিয়ে দেখতে পেল, পার্স আর মোবাইল বিছানায় ফেলে এলেও ওর হাতে সেই অদ্ভুত শঙ্খটা ধরা রয়েছে। বাথরুমের লেড লাইটে খোদাই-করা চোখগুলোকে আর জীবন্ত লাগছে না।
নীলিমা আরও কী সব বলে চলল। বিকালে ও আর ওর ভাই গৌরব একসঙ্গে ঘুরতে গিয়ে ফিরে এসে দ্যাখে, প্রভাত নাকি মেঝেতে বসে হাউ হাউ করে কাঁদছে। ওর নাক থেকে রক্ত ঝরে চারদিক মাখামাখি হয়ে রয়েছে। ও নাকি গৌরব আর নীলিমাকে সব খুলে বলেছে।
“সব খুলে বলেছে?” সুস্মিতা বাথরুম থেকে জিজ্ঞেস করল। বেসিনের ট্যাপের নীচে ও তার শঙ্খটা ধুচ্ছে। এই শ্যাওলার ছোপগুলোকে কি ঘষে ঘষে তোলা সম্ভব?
নীলিমা ততক্ষণে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, “দেখ, চিট করার কথা ও স্বীকার করেছে। অ্যান্ড আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড ইয়োর রিঅ্যাকশন টু ইট। কিন্তু তুই ওর নাক ফাটিয়ে দিয়েছিস, স্মিতা! ও এত ব্লিড করছিল যে, ডাক্তার ডেকে আনতে হল।”
“আর ও যে আমার গলা টিপে দেওয়ালে মাথা ঠুকেছে, সেটার কথা বলেছে?”
“হোয়াট?”
সুস্মিতা ভেজা শঙ্খ হাতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। ওর নিষ্পলক দৃষ্টির সামনে নীলিমা কুঁকড়ে গেল একটু।
“কী বলছিস তুই?”
সুস্মিতা মাথা উপরে তুলে বলল, “ভালো করে দেখ নিলু। দেখতে পাচ্ছিস। গলার দিকে তাকা।”
“আমি, আমি…”
“ইউ ফাকড হিম, ডিডন্ট ইউ?”
“কীহ্…”
“আমি ওর হোয়াট্সঅ্যাপ দেখেছি, নিলু। ইনবক্সে ভালো করেই লুকিয়ে রেখেছিল, আর্কাইভে। এখানে আসার পরেও তুই ওকে টেক্সট করেছিস। হাঁদাটা ডিলিট করেনি কিছুই। অনেকদিন ব্যাপার তো তোদের। পুরো রগরগে উপন্যাস হয়ে যাবে, তাও ইলাস্ট্রেটেড।”
“আমি… স্মিতা শোন, প্লিজ়।”
“ওকে বুঝতে দিইনি যে, তোর মেসেজগুলোও দেখেছি। আমার হবু বর তো ক্যাসানোভা রে।”
সুস্মিতা শক্ত হাতে শঙ্খটা ধরে রয়েছে। কীসের যেন একটা অনুভূতি ওর শরীর জুড়ে বয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। আছড়ে পড়তে গিয়েও পড়ছে না। কিছু একটার জন্য যেন অপেক্ষা করছে।
অপেক্ষা করছে, সুস্মিতা কখন শঙ্খে ফুঁ দেবে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে, ফুসফুসের সমস্ত বায়ু এই শঙ্খের মুখে ঢেলে দেবে। তাহলে কী হবে?
আজ নিজেকে অসম্ভব ক্ষমতাশালী মনে হচ্ছে সুস্মিতার। যেন ও ইচ্ছে করলেই নীলিমাকে নলখাগড়ার মতো উপড়ে ফেলতে পারবে। আহ্, কী শান্তি হবে তাহলে! শুধু একবার শঙ্খটা বাজাতে হবে।
“প্রভাত কোথায়?” সুস্মিতা শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, “পাশের রুমে?”
নীলিমার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। কী শান্তির দৃশ্য।
“প্রভাত কোথায়?” সুস্মিতা এবার বেশ জোর গলায় জিজ্ঞাসা করল।
নীলিমা কথা বলার জন্যে মুখ খুলল, কিন্তু কোনো আওয়াজ বেরিয়ে এল না। নিঃশব্দে কাঁদছে ও।
“আমি বলব, তুইও পাশের রুমে চলে যা। ডাবল বেডরুম হতে পারে, কিন্তু তিনজন ঠিক এঁটে যাবি। লিভ মি অ্যালোন। কাল আমি এই হোটেল থেকে চলে যাব। উফফ, তোদের সঙ্গে আরেকটা দিন কাটালে আমার দমবন্ধ হয়ে যাবে।”
“স্মিতা…”
সুস্মিতা প্রায় হামলে পড়ল নীলিমার উপর, “কথা কানে যায়নি? হুমম? তোর মতো সাপের পাশে শোয়ার কথা ভাবতেই আমার বমি পাচ্ছে।”
নীলিমা আর কিছু না বলে বেরিয়ে গেল।
শঙ্খ আঁকড়ে ধরে সুস্মিতা নিজের শরীর হোটেলের সাদা বিছানাতে ফেলে দিল। মুখ ধুতে গিয়ে চুলের কিছু অংশ ভিজে গেছে, কিন্তু উঠে বসে যে মুখ আর মাথা মুছবে, সেটা করার এনার্জি আর নেই। ভেবেছিল, নীলিমাকে এইভাবে মুচড়ে দেওয়ার পর ওর খুব ভালো লাগবে, কিন্তু কোথায় সেই ভালো-লাগা?
গুমরে-ওঠা কান্নাকে আর বাধা না দিয়ে শঙ্খটাকে বুকের কাছে টেনে এনে, সুস্মিতা ঘুমিয়ে পড়ল।
কী জানি, সেদিন রাতে সে স্বপ্নে ঢেউয়ের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল কি না।
***
খুব ভোরে ঘুম ভাঙল। বেশি জামাকাপড় আনেনি সুস্মিতা। তার উপর গতকাল সকালে ওরা সবাই মিলে বিচে চান করতে গিয়েছিল। হোটেল রুমের ছোটো ব্যালকনিতে বালি-মাখা একটা লেগিংস টাঙানো রয়েছে। অতএব, কাল রাতের পরা কাপড় পরেই সে রাকস্যাক গুছিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ল। আজ প্ল্যান ছিল সবাই মিলে কোনার্ক, নন্দনকানন—এইসব দেখতে যাবে, কিন্তু সুস্মিতার টুরিস্ট-টুরিস্ট খেলার ইচ্ছে আর একদম নেই। আরও দু-দিন পরে ট্রেনের টিকিট। এই দু-দিন ও পুরীতে দিব্যি একা একা কাটিয়ে ফেলবে। নিজের মোবাইল অ্যাপ থেকে ট্রেনের টিকিট কাটা, অতএব অন্য কেউ যে সেটা ক্যানসেল করবে, সেই ভয় নেই।
পুরীতে হোটেলের অভাব নেই, কিন্তু কয়েকটা হোটেল ঘোরার পর সুস্মিতা বুঝতে পারল, ওর মতো একা মেয়েকে কেউ রুম দিতে সহজে রাজি হচ্ছে না।
অতএব যতক্ষণে ও সিঙ্গল বেডের একটা রুম পেল, ততক্ষণে সমুদ্রের জলে রোদ গলে গলে পড়তে শুরু করেছে। বিচে ভিড় নেই, বরং নুলিয়ারা তাদের ছোটো ছোটো নৌকা স্রোতের বিরুদ্ধে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, মাছ ধরতে যাবে সব। অনেকগুলো বাচ্চা সকালেই বালি মাখছে, হাসছে। তাদের শরীরে ভেজা বালি চিকচিক করছে, ঠিক যেন মাছের আঁশ।
শঙ্খটা রাকস্যাক থেকে বার করে আনল সুস্মিতা। জানালা থেকে একচিলতে রোদ এসে পড়েছে বিছানার সাদা চাদরে। সেই বাঁকা চতুর্ভুজ রোদের মাঝে শঙ্খটা রাখল সে। চোখগুলো এখন আরও জীবন্ত লাগছে যে দেখে! একটা চোখের মণির উপর হাত বোলাল সে। উফফ, এখনও কেমন ভেজা-ভেজা লাগছে।
চোখটা একবার পলক ফেলল।
কী???
সুস্মিতা তার হাত ঝট করে সরিয়ে নিল।
কিছুক্ষণ দমবন্ধ করে সে তাকিয়ে রইল শঙ্খটার দিকে। সব ক-টা চোখের খোদাই-করা মণিগুলো কি আগে থেকেই ওর দিকে ঘোরানো ছিল?
আরও কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। চোখগুলোর মধ্যে কোনো গতিবিধি নজরে এল না।
উফফ, কী যে আবোল-তাবোল ভাবছি! ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল সুস্মিতা। আসলে ঘুম ভালো হয়নি তেমন। চিনচিনে ব্যথা চোখ দুটোর পিছনে। আরেকটু ঘুমিয়ে নেবে কি?
মোবাইল ফোন কাঁপছে। কলার আইডি-তে বাবার নাম। সুস্মিতা মোবাইল সাইলেন্ট মোডে রেখে কলটা উপেক্ষা করে গেল। ভালো লাগছে না এখন। নীলিমা বা প্রভাত কি ওর বাড়িতে ফোন করেছিল?
সত্যি বলতে, সুস্মিতার আর কিছু যায়-আসে না। যা হবে, ভাবা যাবে। মা, প্রভাত, নীলিমা—সবাই যেন ওকে এতদিন ধরে ছেঁড়া কাগজের মতো কচলিয়ে গেছে। নিজেদের সুবিধাটুকু মিটলেই বলেছে, “ওভাররিঅ্যাক্ট করছিস।” আর না, আর না…
আচ্ছা, আজ দিনটা কীভাবে কাটানো যায়?
কিছুক্ষণ ভাবার পর সুস্মিতার মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল।
২
কাল থেকে কী যে হচ্ছে, গৌরব কিছুই বুঝতে পারছে না। গতকাল ওরা হোটেল রুমে ফিরে দ্যাখে, প্রভাতদা মেঝেতে শুয়ে কুকুরের মতো কুঁইকুঁই করে কাঁদছে। তখন ভাসাভাসাভাবে যা শুনল, তাতে বুঝল, প্রভাতদা আর সুস্মিতাদির মাঝে ঝগড়া হয়েছে।
তবে বেশি কিছু শুনতে পারেনি। একটু পরেই, তার দিদি নীলিমা যেন ওকে ঘর থেকে প্রায় তাড়িয়ে দেওয়ার মতো করে বলেছিল, “ডাক্তার খুঁজে আন। ব্লিডিং থামবে না।”
এই পর্যন্ত তো সবই ঠিক ছিল। কিন্তু রাতের দিকে দেখল, নীলিমা ফোঁপাতে ফোঁপাতে ওদের ঘরে এসে ঢুকেছে। গৌরব বারবার জিজ্ঞেস করেছিল, কী হয়েছে, কিন্তু নীলিমা উত্তর দিল না। গৌরব শেষে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হয়েছিল, “এই, তোর গায়ে হাত দিয়েছে?”
নীলিমা ভাঙা গলায় বলেছিল, “এত কথা না বলে ঘুমো।”
আচ্ছা, সুস্মিতাদি যে এইরকম বদরাগি, সেটা গৌরব তো আগে বোঝেনি। চুপচাপ একটা মেয়ে, নিজেকে গুটিয়ে রাখত বেশির ভাগ সময়। বেঁটেখাটো দেহ, মলিন মুখ, সরু ঠোঁটে তেমন হাসি নেই। শুধুমাত্র প্রভাতদার সঙ্গে থাকলে সুস্মিতাদির চোখ দুটো চিকচিক করে উঠত। গৌরবের তখন খুব বলতে ইচ্ছে করত, “দিদি, তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে।” হয়তো কাব্য জানলে সেগুলোও কপচাত, কিন্তু ভগবান গৌরবকে সাহিত্যপ্রীতি বা কল্পনাশক্তি কোনোটাই দেয়নি।
প্রায় সারারাত গৌরব ভেবে চলল। সুস্মিতাদির মতো মেয়ে এইরকম কেন করবে? নিশ্চয় খুব বাজে কিছু হয়েছে। দোষটা যে প্রভাতদার বা ওর নিজের দিদির নয়, সেটাই-বা ও কী করে জানবে?
আজ সকালে ও আরও হতভম্ব হয়ে গেল, যখন প্রভাতদা বলল, “এইভাবে হোটেলে না থেকে, চল, ঘুরে আসি সবাই।”
কিন্তু সুস্মিতাদি কোথায়? ওর ব্যাপারে কেউ কিছু বলছে না কেন? গৌরব কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। নীলিমার চোখ দুটো টকটকে লাল। প্রভাতদার নাকে একটা বিকট ব্যান্ডেজ লাগানো। কেমন বুনো-বুনো দেখাচ্ছে তাকে।
অতএব, বড়োরা যখন নিজেরা প্ল্যান করতে বসল, কাছাকাছি কোথায় বেড়িয়ে আসা যায় (কোণার্ক, নন্দনকানন ক্যানসেল, কারণ প্ল্যান ছিল, চারজনে গাড়ি ভাড়া শেয়ার করবে), তখন গৌরব সিগারেট খাওয়ার অজুহাত দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল। পাশের রুমেই দিদি আর সুস্মিতাদি ছিল। গৌরব উঁকি মেরে দেখল, কেউ নেই। নীলিমার কিছু জামাকাপড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, কিন্তু দেয়ালের আংটা থেকে সুস্মিতাদির নেভি-ব্লু রাকস্যাকটা আর নেই। গৌরব চুপচাপ নিজের রুমে ফিরে এল।
***
সারাটা রাস্তা প্রভাতদা আর নীলিমা ভাট বকে গেল। কলেজজীবনের কথা, উত্তর কলকাতার রকে আড্ডা দেওয়ার কথা, কফি হাউসে প্রথমবার ইনফিউশন খাওয়ার কথা। গৌরবের খুব একঘেয়ে লাগছিল। সেই শালা একই ধরনের শহুরে নস্টালজিয়া আর রোমান্টিসাইজ়়েশন। বারবার মনে হচ্ছিল, সুস্মিতাদি এখন কোথায়।
নিজের ভেতরের এই অস্থিরতায় ও নিজেই অবাক। মুখচোরা গৌরব, যে জীবনে মেয়েদের দিকে তেমন ঘুরেও তাকায়নি, সেই গৌরব তার নিজের দিদির এক বান্ধবীর জন্য এত উদ্বিগ্ন!
পুরী থেকে রঘুরাজপুর যেতে বেশিক্ষণ লাগে না। চল্লিশ মিনিটমতো। গুগ্ল করে নীলিমাই বার করেছে জায়গাটা। হেরিটেজ ক্রাফ্ট ভিলেজ। পুরো একটা গ্রামের সবাই নাকি চিত্রকর। ওদের মধ্যে কারোই ওড়িশার পটচিত্র সম্বন্ধে ধারণা নেই, কিন্তু হোটেলে বসে থাকার থেকে এই প্ল্যানটাই বেশি ভালো।
বেশ কিছুক্ষণ বাদশাহি রোড ধরে উত্তরদিকে এগুনোর পর, ডানদিকে ঘুরে অনেক সরু রাস্তা পার হয়ে সেই গ্রামে যখন ওরা পৌঁছোল, তখন সূর্য মধ্যগগনে।
ঢোকার মুখেই একটা সাদা মন্দির, সেই মন্দিরের ডানে-বামে দুটো রাস্তা চলে গেছে। দু-রাস্তার দু-ধারে পরপর বাড়ি। একবার ঢুকলে কেমন মোহগ্রস্তের মতো লাগে। দেয়াল জুড়ে অসংখ্য ছবি আঁকা, সেই গ্রাফিতি বেশির ভাগই পুরাণভিত্তিক। জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রার কত রকমের রূপ। রাস্তার পাশেই, বাড়িগুলোর খোলা বারান্দাতে পসরা সাজানো। রং-করা কেটলি, বুকমার্ক, বাঁশপাতার সেপাই (এই ঘোরাও, ওই ঘোরাও, দ্যাখো, দ্যাখো, কেমন নাচে রে সেপাই), টেবিল কোস্টার, গঞ্জাপার গোলাকার তাস… আরও কত কী। কিন্তু যে জিনিসটা সকল চিত্রকর গছানোর জন্য উঠে-পড়ে লাগল, সেগুলো হল তাদের পটচিত্র। মোটা কাগজে প্রাকৃতিক রঙের ঝরনা। বাজেট কম হলে অ্যাক্রিলিক রঙে আঁকা পটচিত্রও রয়েছে।
সবাই প্রায় ছেঁকেই ধরল গৌরবদের। একটু ঘোরাঘুরি করার পরেই নীলিমা আর প্রভাতদা একটা দোকানে ঢুকে গেল।
“তোমরা দ্যাখো এইদিকে, আমি একটু ঘুরে আসি।” বলে গৌরব একপ্রকার পালিয়েই এল। আসলে ওদের সঙ্গ বেশ অস্বস্তির উদ্রেক করছে গৌরবের মনে। ও খালি ভাবছে সুস্মিতাদির কথা। একা মেয়ে, প্রথমবার এতদূর বেড়াতে এসেছে। কোথায় যে চলে গেল।
একবার কল করে দেখবে?
বুকটা ঢিপঢিপ করতে শুরু করল গৌরবের। সুস্মিতাদির নাম্বার সেভ করা নেই, কিন্তু ওরা একই হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে রয়েছে। সেখান থেকে নাম্বার খুঁজে বার করে কল করাই যায়।
একবার কল করে দেখবে?
গৌরব অন্যমনস্ক হয়ে হেঁটে হেঁটে গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। এইদিকে সব ক-টা বাড়ির দেয়ালে ছবি আঁকা নেই। নগ্ন, বোবা, মেটে দেওয়াল। দরজাগুলো যদিও খোলা। সেখান থেকে কয়েকজোড়া উৎসুক চোখ ওর গতিবিধির উপর নজর রাখছে। কেউ অবিশ্যি বেরিয়ে আসছে না, বলছে না, “দাদা, নাইস কোস্টার, নাইস আর্ট।” বোধহয় গ্রামের এইদিকের লোকেরা চিত্রকর নয়। সাধারণ মানুষ।
একবার কল করে দেখবে?
নাহ্, নাহ্, চিন্তাটা বারবার ফিরে আসছে, কিন্তু নাহ্। প্রয়োজন নেই। সুস্মিতাদির চেহারাটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে গৌরব, কিন্তু অসংখ্য ভাসাভাসা দৃশ্য আরও জাপটে ধরে ওর মনকে। মলিন মুখ হলেও লাবণ্য রয়েছে সুস্মিতাদির, জল খাওয়ার পর ঠোঁট দুটো ভেজা থাকলে…
গৌরব ঢোঁক গেলে।
ফাক!
তার সঙ্গে আরেকটা জিনিসও খেয়াল করে। রাস্তাটা ডানদিকে ঘুরতেই একটা বাড়ি রয়েছে। আর ওই বাড়ির গায়ে অদ্ভুত সব গ্রাফিতি।
রঘুরাজপুরের পটচিত্রগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে তুলির টান। সুন্দর, মসৃণ তুলির টান মোটা সুতির ক্যানভাসকে রঞ্জিত করে তোলে। ফুটে ওঠে জগন্নাথের কৃষ্ণমূর্তি, নইলে কৃষ্ণের মিষ্টি মুখ, নইলে অরণ্যমাঝে কামধেনু। আয়তাকার ক্যানভাসের চারদিকে ফুল, লতা অথবা পাকানো আলপনার মতো সুন্দর নকশা থাকে, যেন শাড়িতে পাড় দেওয়া হচ্ছে। বাড়ির দেওয়ালে যখন পটচিত্রের অনুকরণ করে গ্রাফিতি করা হয়েছে, তখন এইরকমভাবেই সব আঁকা রয়েছে। এই একটু আগেই গৌরব দেখেছে কোনো এক বন্দুকধারী অচেনা দেবতার রুদ্রমূর্তি।
কিন্তু এই বাড়িটার দেওয়ালে আঁকা ছবিগুলো কেমন যেন অদ্ভুত। বিশৃঙ্খল। তুলির সেই মসৃণ টান এই দেওয়ালে নেই, নেই কোনো পুরাণের দৃশ্য। আছে অনেকটা ছায়া। আছে অনেকগুলো রক্তিম চক্ষু। সমুদ্রের অন্ধকার ঢেউ থেকে বেরিয়ে এসেছে অদ্ভুত সব জীব। আবেদন জানাচ্ছে রাতের নক্ষত্রদের।
ভালো করে আরও কিছু দেখার আগেই, কে যেন পিছন থেকে বলল, “সার, সেহি ঘড়কু যা নেহি।”
গৌরবের পা দুটো সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেল না। আরও কয়েক পা এগিয়ে, তারপর দাঁড়িয়ে, ও পিছনে তাকাল।
একটা শুকনো নেড়িকুকুরকে রুটি খেতে দিয়েছে একটা যুবক। সুঠাম দেহে ধুলোর আস্তরণ। ক-টা দুটো চোখ সার্চলাইটের মতো গৌরবের দিকে ঘোরানো।
ভাঙা উচ্চারণে বলল, “পাগল আছে।”
গৌরব বুড়ো আঙুল বাড়িটার দিকে ঘুরিয়ে বলল, “পাগল?”
“পাগল আছে। দয়া করে যা নেহি।”
গৌরব ওর সানগ্লাসটাকে একটু নাকের উপরে তুলে নিয়ে বাড়িটার দিকে ঘুরে হাঁটতে লাগল।
কোথাকার কোন ছ্যাঁচড়, ওর কথা শুনবে কেন? তা ছাড়াও, এই গ্রামের মাঝে অমন অদ্ভুত আর্ট ওর বেশ ভালো লেগেছে। আধাচেনা দুঃস্বপ্নের মতো আঁকাগুলো। মনে হয় যেন জেনেটিক মেমোরিতে লুকিয়ে ছিল এতদিন, এখন চোখের সামনে দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে সব। দু-লক্ষ বছর আগে, গৌরবের কোনো পূর্বপুরুষ হয়তো দেখেছিল এদের, অচেনা এক সমুদ্রতটে বসে থেকে। হয়তো এরা এসেছিল মহাবিশ্বের কোনো রহস্য ভাগ করে নিতে।
গৌরব বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল।
খোলা দরজাটার ওই পারে অন্ধকার। কেউ বাড়িতে নেই বুঝি? যে কুকুরটা রুটি খাচ্ছিল, সে এখন ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে। গৌরবের মাথার উপর দিয়ে একটা কালো পাখি সাঁই করে উড়ে চলে গেল… সমুদ্রের দিকে। বিশ্রামের আগে এখনও অনেক মাইল বাকি…
অন্ধকার থেকে বাতুল হাসির ঝলকানি, উপরের পাটিতে একটা দাঁত আবার নেই। এত পরিষ্কার দাঁত গৌরব আগে কখনও দেখেনি। গায়ের রং মিশকালো। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন বাড়ির বুকের অন্ধকারটাই দাঁত বার করে হাসছে।
“ছবি নেবেন স্যার?” লোকটা বলল। পরিষ্কার বাংলা।
চশমাটা নাকের উপরে একটু তুলে নিয়ে গৌরব বলল, “গঞ্জাপার কার্ড আছে?”
“আছে, স্যার। আসুন, স্যার। আসুন।”
গৌরব একটু ইতস্তত করল। এক সেকেন্ডের বেশি না। কুকুরটা খুবই চিল্লাচ্ছে। গৌরব ইচ্ছে করে, ওই ধুলো-মাখা যুবকটার দিকে তাকাচ্ছে না। ছেলেটার ক-টা চোখগুলোয় বড্ড ধার।
গৌরব পা বাড়ায়। অন্ধকার ওকে টেনে নেয়।
***
রড লাইটটা হেঁচকি খেতে খেতে জ্বলে উঠল। দেওয়াল জুড়ে অন্ধকার ছবি। ফ্রেমবন্দি। মেঝেতে কেনার জন্য নানা রকমের সুভেনির। কালো লোকটা ফোকলা হাসি হাসতে হাসতে গৌরবের হাতে একটা ফ্রেম ধরিয়ে দিল। ভেতরে একটা নিউজ়পেপার কাট। ইংরেজিতে লেখা: “Raghurajpur Artist Wins The NGA Art Show.” কাগজটার রং তামাটে হয়ে গেছে বলে ছবিটাও খুব অস্পষ্ট হয়ে গেছে। সেই ছবিতে বয়স অনেক কম হলেও লোকটাকে চেনা যাচ্ছে। মাথা ভরতি চুল। হাসছে। একজন বিদেশি লোকের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছে।
গৌরব চিত্রকরের দিকে তাকিয়ে বলল, “ইম্প্রেসিভ।”
“সেই একবারই বিদেশ গিয়েছিলাম। অস্ট্রেলিয়া। আট বছর হতে চলল।” আট বছরে লোকটার চুল অনেকটা পাতলা হয়ে গেছে, সেই ঝাঁকড়া ভাবটা আর নেই। গাল দুটোও শুকিয়ে গেছে। চক্ষু কোটরগত। শুধু হাসিটা বদলায়নি।
গৌরব একটু আনসোশ্যাল টাইপের। এরপর ঠিক কী বলা উচিত, ওর মাথায় কিছুতেই এল না। তাই একটু মুচকি হেসে লোকটাকে ফ্রেমটা ফেরত দিয়ে, ও পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেওয়ালের ছবিগুলো দেখতে শুরু করল। বাইরের দেওয়ালের মতো করেই আঁকা, তবে এগুলোয় ডিটেলিং অনেক সূক্ষ্ম। চিত্রকর সুযোগ বুঝে দাম হাঁকাতে শুরু করল। চার হাজার, পাঁচ হাজার, দশ হাজার। কিন্তু বাবু যেহেতু এত কষ্ট করে এসেছেন, তাই আরেকটু দাম কমাতে সে রাজি আছে। একদম ন্যাচারাল কালার ব্যবহার করেছে। তবে আরও সস্তা কিছু চাইলে অ্যাক্রিলিক ছবি আছে। একটা সিন্দুক থেকে অনেকগুলো অ্যাক্রিলিকের ছবি বার করে সে গৌরবকে দেখায়। এগুলোর ডিটেলিং তেমন ভালো না। জায়গায় জায়গায় রং ধেবড়ে গেছে। কালো সমুদ্রের ঢেউ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। ওহ্, বাবু যেন কী দেখতে এসেছিলেন?
“গঞ্জাপার কার্ড।” গৌরব মনে করাল।
লোকটা আবার ফোকলা হাসি হাসল। ধারালো হাসি। দাঁতগুলো সরু সরু, তাই বোধহয়।
“দু-ধরনের তাস আছে, দেখবেন?”
“দেখি।”
লোকটা সরু সরু দাঁত যেন ঠোঁটের আড়ালই হতে চায় না। গৌরবকে শতরঞ্চির উপর বসতে বলে, সে একটা দরজা বেয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে গেল, গঞ্জাপার খোঁজে।
গৌরব কিছুক্ষণ বসার পর উশখুশ করতে শুরু করল। সামনেই একটা তালপাতার সেপাই ছিল, সেটাকে তুলে ঘোরাতে শুরু করল।
তালপাতার সেপাইয়ের পুতুল হলেও, বানানো হয়েছে অজানা সামুদ্রিক জন্তুর আদলে। আটটা শুঁড়। একবার ঘোরালেই কিলবিল করে লাফিয়ে উঠছে। মাথার জায়গায় কালো বৃত্ত, তাতে ত্রিভুজাকৃতির চোখ। লাল। ঘোর লাগে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে।
চিত্রকর কিছুক্ষণ পরেই গঞ্জাপার তাস নিয়ে ফিরে এল। রংবাহারি চাকতি। একদিকে লাল রং করা। অন্যদিকে সুন্দর সূক্ষ্ম কাজ। পরিধি জুড়ে সরু নকশা। মাঝে দেবতারা বসে রয়েছেন।
“এগুলো দশরূপী।” গোলাকার কার্ড। দশটা। “বিষ্ণুর দশ রূপ, এই যে।”
গৌরব দেখে মনে করার চেষ্টা করল কোন অবতারের নাম কোনটা।
“নৃসিংহ, বামন, কচ্ছপেরটার নামটা কী যেন, আর এইটা…”
“মৎস্য, বরাহ, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ আর কল্কি। আর ওই কচ্ছপের নাম কূর্ম।” গড়গড় করে বলে গেল চিত্রকর।
“রাইট, রাইট।” গৌরব এমন করে মাথা নাড়ল, যেন ওর সব ক-টা নাম মনে ছিল। “এই ক-টা কার্ড দিয়েই খেলা যায়?”
চিত্রকর হেসে বলল, “তা-ই কি হয়, স্যার? আসলে তাস লাগে ১৪৪টা। প্রতিটা অবতারের আন্ডারে বারোটা তাস থাকে। দশ রূপের সঙ্গে গণেশ আর কার্তিকও থাকে। তাই বারোটা দেবতার আন্ডারে বারোটা তাস, মোট ১৪৪টা।”
“বাপ রে। তা সেগুলো দেখছি না যে?”
“আপনি সত্যি ফুল সেট কিনবেন? খেলা কিন্তু বেশ কঠিন। যদি চান তো শিখিয়ে দিতে পারি।”
“ফুল সেটের দাম কত?”
চিত্রকর দাম বলল।
“বাপ রে।”
“এই দশ অবতারকে যদি নেন, তো অনেক কমে পেয়ে যাবেন। সুভেনির হিসাবে ভালো। যদি বলেন তো কার্তিক আর গণেশের কার্ডটাও দিয়ে দিতে পারি।”
“বাহ্। কিন্তু আপনি বলেছিলেন, আরেক ধরনের তাস আছে।”
চিত্রকর আবার হায়নার মতো হেসে প্লাস্টিকের র্যাপার থেকে আরেক গোছা তাস বার করে আনল। এগুলোর রং কালো আর লাল, সংখ্যাতেও কম। ছয়টামাত্র। চিত্রকর একটা একটা কার্ড তুলে নামগুলো বলল।
কালো তাস। ত্রিনেত্র বিভীষিকা। পরিধিতে রক্তের ফোঁটার মতো প্যাটার্ন। “রিঢ়ুপন্থ।”
লাল তাস। সব্জেটে গুল্ম মানুষ। পরিধিতে কালো কাঁটা। “গার্গুনাজ।”
কালো তাস। সমুদ্র, ঢেউয়ে অসংখ্য চোখ। পরিধিতে লালচে শ্যাওলা। “শতনেত্রক।”
লাল তাস। মাংসল চাঁদ। পরিধিতে অসংখ্য কালো বিন্দু। “বিবমিষ্যান্ন।”
কালো তাস। নগ্ন মাঠ, তার মাঝে মরা গাছ। পরিধিতে লাল দড়ি। “মধ্যপান্থ।”
লাল তাস। অসংখ্য শুঁড়। পরিধিতে কালো লাইন। “থুল্লুম।”
চিত্রকর একেকটা কার্ড গৌরবের চোখের সামনে এনে ধরছিল, আর গৌরবের মনে হচ্ছিল, তাসের রংগুলো যেন গলে গলে বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। অজ্ঞেয় এই দেবতারা এখনও জীবন্ত। শুধু একবার আহ্বানের অপেক্ষা।
“এগুলো কোন মিথের অংশ? হিন্দুধর্মের তো না?”
চিত্রকর হাসল, “প্রাগৈতিহাসিক ধর্ম বললে হয়তো ঠিক হবে।”
গৌরব এইবার চিত্রকরকে ভালো করে জরিপ করল। টেরিলিনের জামা-পরা, আদ্যিকালের ধুতি। মাথায় চুল কমে গেছে, কিন্তু সেটা তেলে চপচপ করছে। কোটরগত চোখ দুটো সামান্য হলুদ, কিন্তু সেটাই বুদ্ধি আর জ্ঞানের ঝিলিক রয়েছে। হাতের নখগুলো ধারালো, ওর দাঁতের মতোই। একটা অস্পষ্ট আঁশটে গন্ধ নাকে আসছে মাঝে মাঝে। সেটা লোকটার গা থেকে নাকি ঘর থেকে, তা বুঝতে পারল না গৌরব।
“নামগুলো বড্ড অদ্ভুত।”
“পছন্দ হয়েছে?”
গৌরব গাল চুলকাল। খরচ করতে ইচ্ছে করছে না এত, কিন্তু তাসগুলো বড্ড টানছে। সেই অদ্ভুত স্মৃতিটা মনে পড়ছে। সমুদ্র থেকে উঠে আসছে এক দেবতা।
“শতনেত্রক।” বলে কার্ডটা হাতে তুলে নিল গৌরব। বড্ড জীবন্ত চোখগুলো।
এই বুঝি চোখের পলক ফেলবে।
“এগুলো দিয়েও কি তাস খেলা হয়?”
“হয়, তবে ঠিক তাস নয়। দেবতাদের দর্শন পাওয়ার জন্যে ব্যবহার করা হয়। সোজা নিয়ম।”
তিনটে তিনটে করে দু-সারিতে তাসগুলো উলটো করে সাজায় চিত্রকর। উলটো পিঠে লাল রঙের মাঝে কালো ত্রিভুজ। পকেট থেকে একটা কড়ি বার করে সেটাই চুমু খায় চিত্রকর। তারপর, সেই কড়ি তাসগুলোর দিকে ছুড়ে দেয়।
“যে তাসটার উপর কড়ি পড়েছে, সেটা তুলুন।”
গৌরব তুলল। মাংসল চাঁদ।
চিত্রকর কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, “মা বিবমিষ্যান্ন তো রোজই আসেন। এ আর নতুন কী?”
গৌরবের হঠাৎ খুব অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। কিছু একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। এই এক্ষুনি ঘটেছে। গৌরবের সচেতন মন ধরতে না পারলেও অবচেতন মন ধরতে পেরেছে। চিৎকার করে কিছু বলছে। অথবা কিছুই বলছে না, শুধু আতঙ্কে গোঙাচ্ছে।
“কিনবেন?” হাসছে চিত্রকর। যেন ব্যঙ্গ করছে গৌরবকে।
গৌরব উঠে দাঁড়াল। “ন্-না, মানে…”
“দাম কমিয়েই বলছি, দুটো সেট মিলে এগারোশোতে দিয়ে দেব।”
“না, আসলে আমি…”
“হাজার?”
“আসলে এমনি দেখতে এসেছিলাম…”
চিত্রকর প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, “দাদা, আটশোর নীচে যেতে পারবনি। বউনি হয়নি আজকে।”
গৌরবের গলায় কিছু একটা আটকে গেছে। কথা বেরুচ্ছে না। পা দুটো মেঝেতে দেবে গেছে যেন।
“স্যার, প্লিজ়…”
***
দশ মিনিট পর একটা ক্যারি ব্যাগে গঞ্জাপার তাস নিয়ে বেরিয়ে এল গৌরব। কী করে জানি, শেষমেশ কিনেই ফেলেছে কার্ডগুলো।
বাইরে ওই ছেলেটা এখনও রয়েছে। খালি গা। ছায়ার নীচে বসে আছে, তবু দরদর করে ঘামছে। ছেলেটার ছুরির মতো দৃষ্টি গৌরবের কালো রঙের ক্যারি ব্যাগটার উপর পড়ল। পিচিক করে থুতু ফেলল ছেলেটা। কিন্তু কিছু বলল না।
গৌরব হাঁটতে হাঁটতে যখন তার দিদি আর প্রভাতদাদের আবার দেখতে পেল, তখনও ওই দুজন ছবি তুলতে ব্যস্ত। প্রভাতদার চোখ দুটোয় অচেনা কৌতুক জমেছে। হাসছে সে, যেন ওর ফিয়ন্সের সঙ্গে আগের দিন কোনো ঝগড়াই হয়নি। নীলিমা প্রভাতদার সামনে নানান অঙ্গভঙ্গি করে পোজ় দিচ্ছে। নতুন করে মেকআপ করেছে বোধহয়। চোখে আইলাইনার আগে ছিল না। গৌরবের শরীর খারাপ করতে শুরু করল। কেমন একটা অদ্ভুত দিন, আকাশে মেঘ জমেছে অল্প। কোথাও বেড়াতে যেতে আর ইচ্ছে করছে না৷
নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে সে ভাবল, এই তো কালকে শুধু, তারপর পরশু ট্রেন। বাড়ি ফিরে আবার শান্তিতে নিশ্বাস।
তারপর অসভ্যের মতো চিন্তাটা…
সুস্মিতাদি কোথায়?
প্রশ্নটা মনে জায়গা করে নেওয়ার আগেই গৌরবের মনে পড়ে গেল, ওই চিত্রকরের বাড়িতে ঠিক কীসের জন্য ওর অস্বস্তি লাগছিল। ঠিক যখন বিবমিষ্যান্নের কার্ডটা ও হাত দিয়ে ধরেছিল, তখন—ঠিক এক সেকেন্ডের জন্য—ওর মনে হয়েছিল ওটা কাগজের তৈরি কার্ড নয়, বরং একতাল মাংস৷ রক্তাক্ত, ভেজা, জীবন্ত কিছু। ধুকপুক করছিল সেই মাংসের তাল…
একাকী হৃৎপিণ্ডের মতো।
৩
ছেলেটা সুস্মিতার পিছনে সুন্দর ব্যালান্স করে দাঁড়িয়ে আছে। সুঠাম দেহ, কৃষ্ণবর্ণ। কমলা লাইফ জ্যাকেটের নীচে সস্তা শার্ট আর ছেঁড়া জিন্স। চোখে স্পোর্টস সানগ্লাস। সুস্মিতা বসে থেকে জেটস্কির হ্যান্ডেল ধরে আছে বটে, কিন্তু ছেলেটা মাঝে মাঝে সামনের দিকে ঝুঁকে সুস্মিতার পথ ঠিক করে দিচ্ছে।
ওদের দুজনের চারদিকে সমুদ্র, রত্নাকর, আমার, তোমার, সব্বার।
বোঁওওও আওয়াজ করছে জেটস্কিটা, যেন বন্যজন্তুর রাশ টেনে ধরে রেখেছে সুস্মিতা। গায়ে জলের ছাট, বারংবার। আজ সমুদ্র উন্মাদ প্রেমিকার রূপ নিয়েছে, আদর করতে চাইছে। সুস্মিতা অনেকক্ষণ হল, হাসছে, হেসেই চলেছে। নিজের মনেই। গলা ছেড়ে। ড্রাইভার ছেলেটা কী ভাবছে, কে জানে। পাগলও ভাবতে পারে৷ সুস্মিতার কিচ্ছু যায়-আসে না।
আজ সুস্মিতা মুক্ত।
২০ মিনিট চালানো যাবে জেটস্কিটা। তবে বেশি গভীরে যেতে দিচ্ছে না আজ। আবহাওয়া খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আকাশে মেঘ তেমন নেই। তবে সূর্যকে কেমন মনমরা দেখাচ্ছে।
“আর পাঁচ মিনিট, ম্যাম।” ছেলেটা বাংলায় বলল৷ ছেলেটাকে দেখতে সুন্দর, সুস্মিতার থেকে বয়সে কমই হবে৷ পুরু ঠোঁটের উপর একটা তিল রয়েছে, আর তার উপরে সরু গোঁফের রেখা। জেটস্কিতে ওঠার আগে, সুস্মিতা ডগডগে চোখে ছেলেটাকে জরিপ করে বলেছিল, “তুমি পারবে তো ভাই আমাকে সামলাতে? মাঝসমুদ্রে ডুবে মরব না তো?”
ছেলেটা কেমন লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল। সুস্মিতাও নিজের কথা শুনে নিজেও অবাক হয়েছিল। আজ গা-হাত-পা-ছাড়া লাগছে নিজেকে। টি-শার্ট পরেছে সুন্দর, সবুজ নীল। নীচে দামি লেগিংস। সঙ্গে একটা ফ্যানি প্যাক (ছোটো একটা বোতল, মেস স্প্রে, লিপ বাম, লিপস্টিক, পকেট মিরর, সানস্ক্রিন… আর সেই শঙ্খটা), কোমরে ঝোলানো রয়েছে। প্রভাতের চড়া মেকআপ পছন্দ নয়, তাই এতদিন হালকা লিপস্টিক পরত সুস্মিতা, কিন্তু আজ গাঢ় মেরুন রঙে রঞ্জিত ঠোঁট দুটোয় সুন্দর আবেদন রয়েছে। চোখের আইলাইনার পুরু, আইশ্যাডোর হালকা ছোঁয়া।
সমুদ্রমাঝে হাসছে সুস্মিতা। আজ বামদিকে পুরী শহর চোখ রাঙাচ্ছে। ডানদিকে সমুদ্রের সম্মোহনী হাতছানি। মরা সূর্যের নীচেও কী সুন্দর নীল রং।
ফেনার মধ্যে অসংখ্য চোখ।
হাত কেঁপে উঠল সুস্মিতার। আরেকটু হলেই জেটস্কিটা উলটে যেত, কিন্তু ছেলেটা বিদ্যুতের মতো হামলে পড়ে বোটের হ্যান্ডেল দুটো ধরে ফেলল।
“এভরিথিং ওকে, ম্যাম?”
“হ্যাঁ, সরি।”
ফেনার সাদায় চোখ তো নেই। ভুল দেখছে সুস্মিতা। উফফ, চমকে গিয়েছিল বড্ড। ভয় পায়নি, চমকে গিয়েছিল।
ছেলেটা এখনও হ্যান্ডেল দুটো ধরে রয়েছে। ওর নিশ্বাস সুস্মিতার কাঁধে পড়ছে।
“বিচের দিকে ঘুরিয়ে দিই?” সুস্মিতা বলল। হাসছে না আর।
“হ্যাঁ, ম্যাডাম।” ছেলেটা গলা খাঁকরিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সুস্মিতা পটু হাতে জেটস্কিটা ডানদিকে ঘুরিয়ে নেয়। দূরে বিচ মার্কেটটাকে জঞ্জালের মতো দেখায়। মানুষগুলো কেমন জলপোকার মতো গিজগিজ করছে। প্লাস্টিকের উচ্ছিষ্ট, বিশ্রী দেখতে ছাতা। হঠাৎ সুস্মিতার কেমন ঘেন্না লেগে গেল।
যদি জেটস্কিটাকে সোজা চালিয়ে দু-তিনজন টুরিস্টকে গুঁতিয়ে দেয়, ব্যাপারটা মন্দ হবে না।
একটা হেঁচকির মতো শব্দ।
সুস্মিতার চিন্তার সুতো কেটে গেল।
আবার।
ছেলেটা হঠাৎ বসে পড়েছে। হাত দুটো বাড়িয়ে সুস্মিতার উপর রাখে।
ফুল থ্রট্ল।
“হলটা কী?” বলতে গিয়েও সুস্মিতা থেমে গেল।
ফেনার মাঝে চোখ। অসংখ্য। আশপাশেও। যেদিকে চোখ যায়। নক্ষত্রের মতো অজস্র।
চোখের ভুল নয়। ছেলেটাও দেখেছে। নিশ্বাস দ্রুত হয়েছে। সুস্মিতার সঙ্গে পুরো গা লাগিয়ে ফেলেছে।
আতঙ্কের ঘ্রাণ শ্যাওলা।
সমুদ্রের তলায় কিছু একটা নড়ছে। প্রাগৈতিহাসিক কিছু। সুস্মিতার মনে হল, সাপের মতো কিছু একটা জেটস্কির পাশে সাঁতার কাটছে।
ছেলেটা খুব ভয় পেয়েছে। কিছু একটা জপ করছে ফিশফিশ করে, ভগবানকে ডাকছে বোধহয়।
সুস্মিতার কিন্তু একদম ভয় লাগছে না। সে ডানে-বামে চেয়ে চেয়ে দেখছে। ওই তো, আরেকটা সাপ। নাহ্, সাপ নয়। শুঁড়। তবে অক্টোপাসের মতো নয়। শ্যাওলার মতো কিছু?
ফেনার চোখগুলো কেমন কাঁকড়ার মতো ধাওয়া করছে জেটস্কিটাকে। বুদ্বুদ যেমন ফোটে আর জন্মায়, ঠিক তেমনভাবে চোখগুলো ফুটে যাচ্ছে আর জন্মাচ্ছে। সেই জন্মমৃত্যুর মাঝে সব ক-টা চোখ সুস্মিতাকে দেখছে।
হঠাৎ জল ফুলেফেঁপে উঠল। ছেলেটা সেই জেটস্কিটাকে বামদিকে ঘুরিয়ে আবার উত্তর-পশ্চিমমুখী করল। সমুদ্রতটের অনেকটা কাছে চলে এসেছে দুজনে। ওই তো, ছেলেটার হেল্পারগুলোকে দেখা যাচ্ছে। ওরা হাত নাড়ছে কেন জানি, চিৎকার করে কিছু বলছে। জেটস্কি আর স্রোতের আওয়াজে কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না।
জেটস্কিটা বাজেভাবে দুলে উঠল।
সমুদ্রের কোনো দেবতা যেন নিজে বলিগ্রহণ করতে এসেছে৷ টেনে নিতে এসেছে সুস্মিতাকে।
ওর কিন্তু এখনও ভয় করছে না। চিৎকার করেনি একবারও। শুধু ওর ফ্যানি প্যাকটা শক্ত করে ধরে রেখেছে ও।
ছেলেটা চিৎকার করে কিছু বলছে ওড়িয়াতে। বিচের একদম কাছে চলে এসেছে। এইবার…
তখনই পৃথিবীটা পাক খেল।
এক মুহূর্তের জন্য দিক্চক্রবালটা উলটে গেল। উপরে সমুদ্রের মুক্ত বুক, নীচে গভীর নীল আকাশ। তারপর আবার সব উলটে-পালটে গেল। কালো জল গিলে নিল সুস্মিতাকে।
***
দু-লক্ষ বছর আগে অসুস্থ মানুষটা দেবতার সামনে উবু হয়ে প্রণাম করছিল। সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে এসেছিল তখন, কালির মতো অন্ধকার ছিটিয়ে দিচ্ছিল আকাশে।
মানুষটা জানত না, ঠিক কী মারণ রোগ তার শরীরে বাসা বেঁধেছে। সে শুধু জানত, তার দলের লোক এই সমুদ্রতটে তাকে ফেলে গেছে, যাতে ওর মৃত্যু দলের বাসস্থান থেকে অনেক দূরে হয়। মৃত্যুকে ওরা বড্ড ভয় পায়।
দেবতার শ্যাওলাগুলো মানুষটার শরীরকে জড়িয়ে ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল সমুদ্রে, সেই আদিম র’লেহের মাঝে।
দশটা সূর্যাস্তের পর মানুষটা যখন আবার ডাঙায় ফেরত আসে, তখন সে বদ্ধ উন্মাদ।
তারা সারা শরীরে শ্যাওলার ছোপ, একটা চোখ অন্ধ—কোনো মাছে খেয়ে নিয়েছে হয়তো।
নিজের দলের কাছে যখন ও পৌঁছেছিল, তখন ওরা হয়তো ওকে মেরেই ফেলত।
কিন্তু মানুষটা বমি করার মতো কিছু শব্দ বার করেছিল গলা থেকে। সেই শব্দগুলোর জন্ম সময়েরও আগে।
সেদিন রাতে সেই মানুষ তাদের আগুন জ্বালাতে শিখিয়েছিল।
প্রায় দু-লক্ষ বছর বেঁচে ছিল এই মানুষ। এক না-মানুষের জন্মের ঠিক ২,২২৭ বছর আগে এই উন্মাদের মৃত্যু হয়, ব্যাবেলের টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার দিন।
শতনেত্রক সেদিন কেঁদেছিল সমুদ্রের গভীরে।
***
লাইফ জ্যাকেটটা ইনফ্লেটেবল। জলের চাপ পড়তেই ফুলেফেঁপে উঠেছে। নোনতা জল এক-দু-ঢোঁক গিলেই উপরে ভেসে এল সুস্মিতা। সঙ্গে সঙ্গেই ঘাড়ে একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল। আবার ঘোলাটে রং, জিবে নোনতা জল। জেটস্কিটা উলটে যাওয়ার সময় সুস্মিতা যখন সোজা জলে পড়ে গিয়েছিল, তখন মনে হয়েছিল যেন ইটের একটা দেওয়ালের সঙ্গে ওর ধাক্কা লেগেছে। এখন শরীরে চিনচিনে ব্যথা।
ছেলেটা কই? দেখতে পাচ্ছে না। শুধু হাবুডুবু খাচ্ছে জলে। আরেকটা ঢেউ এগিয়ে আসছে দানোর মতো। সমুদ্রের কাম-রূপ বদলে গেছে সহসায়। এখন একটার পর একটা মৃত্যুরূপী ঢেউ বয়ে আনবে সে, ক্লান্তিহীন যমদূত।
ঢেউটা আছড়ে পড়ার আগেই, কে যেন তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। আরও অনেকে এগিয়ে আসছে এদিকে। চিৎকার-চ্যাঁচামেচি শোনা যাচ্ছে এইবার।
লোকগুলো প্রায় ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে সুস্মিতাকে সমুদ্রতটে এনে ফেলল। সমুদ্রের নোনতা জলের পর পুরীর বালি উষ্ণ ঠেকল ওর পায়ের পাতায়।
“আর ইউ ওকে, ম্যাম?” কে একজন জিজ্ঞেস করছে। সেই ছেলেটাই কিনা বুঝতে পারল না সুস্মিতা। সব কিছু কেমন ঘোলা দেখাচ্ছে, শুধু সমুদ্রের ঢেউগুলো বড্ড পরিষ্কার, বড্ড কাছে, প্রেমিকার ঘনিষ্ঠ হাতছানি।
সুস্মিতার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে, লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কী সব বলাবলি করতে শুরু করল। ওড়িয়া ভাষায় কথা বলছে, অত্যন্ত দ্রুত। আস্তে আস্তে কথা বললে তাও একটা-দুটো কথা বোঝা যায়, কিন্তু এখন ওদের আর সুস্মিতার মাঝে ভাষার অদৃশ্য দেওয়াল উঠে গেছে।
সুস্মিতা খোনা গলায় টাকার কথা তুলল, কিন্তু কেউ খুব একটা পাত্তা দিল না। লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করেছে, যেন সুস্মিতাকে ভুলেই গেছে। ড্রাইভার ছেলেটাও বোধহয় ওদের সঙ্গে আছে। কোথায় যাচ্ছে ওরা? লাইফ-গার্ডের কাছে? জেটস্কিটাই-বা কোথায় গেল?
সুস্মিতা কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারল, কেউই আসলে ওর উপর নজর রাখেনি। সি-বিচের বেশির ভাগ টুরিস্ট কোনো ব্যাপার খেয়ালই করেনি। শুধু দুটো ছেলে এক বোতল কোকা-কোলা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করতে করতে সুস্মিতার দিকে তাকাচ্ছিল, তবে তারা হয়তো একটু আগের ঘটনাটা দেখেনি, বরং অন্য কারণে সুস্মিতার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। সুস্মিতা ফ্যানি প্যাক দিয়ে বুকটা ঢেকে উঠে দাঁড়াল।
সমুদ্রের ফেনায় চোখগুলো আর নেই, সেই অদ্ভুতদর্শন শুঁড়গুলোও না। মেঘ উঠেছে অনেক। ঝড় আসবে হয়তো। হুহু করে হাওয়া দিতে শুরু করেছে। দাঁত বসাচ্ছে সুস্মিতার গায়ে।
ঠান্ডা লাগছে বড়ো। একাও লাগছে।
প্রভাতকে মিস করছে সুস্মিতা। এত কিছু হওয়ার পরেও সেই ছেলেটাকে মিস করছে। কেন? কেন? কেন? দু-চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। অবুঝ, নির্বোধ জল। ভেজা গালে মিশে যায় সবার অলক্ষে।
কোকা-কোলা ছেলে দুটো সুস্মিতার দিকে এগিয়ে আসছে, কিছু বলতে চায় হয়তো। সুস্মিতা পালিয়ে আসে। ভিড়ের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে চায়। ওর সর্বাঙ্গ ভিজে সপসপ করছে। জামা আর জুতোর মধ্যে বালি ঢুকে গেছে। চুলগুলো সেঁটে আছে খুলির সঙ্গে। নিশ্চয় মেকআপের অবস্থাও খুব একটা ভালো না।
কান্নাটা গোঙানির মতো বেরিয়ে এলেও কেউ কিছু শুনতে পায় না। ভিড়ে সব হারিয়ে যায়। খুব কাছেই একটা এটিভির গর্জন শোনা যায়। চার চাকা চতুর্দিকে বালি ছেটাতে ছেটাতে এগিয়ে যাচ্ছে।
সুস্মিতা কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে বিলিয়ে দেয় এই শহরের কাছে। ভিখারির মতো।
৪
দেখা হয়ে যায় অদ্ভুতভাবে। ভিড়ের মধ্যে। আধখাওয়া দোসাটা প্রায় একরকম ফেলে দিয়েই গৌরব দৌড়োনোর চেষ্টা করে। কিন্তু দোকানির গালিগালাজ শুনে মনে পড়ে, আরে, টাকাই তো দেওয়া হয়নি!
টাকা দেওয়ার পর গৌরব আবার খোঁজার চেষ্টা করে। বিকাল এখনও, তবে মনমরা আকাশের রং, সূর্য বেপাত্তা। দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি বলে বিচ মার্কেটে এসেছিল খেতে। ওর দিদি আর প্রভাতদা বলেছে, ওরা আর বেরোবে না। হোটেলে আছে।
কী করছে ওরা হোটেলে? ভাবনাটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করেও পারছে না গৌরব। সব কিছু এত তাড়াতাড়ি তাসের দেশের মতো ভেঙেচুরে যাচ্ছে। থই পাচ্ছে না গৌরব।
অসংখ্য মুখ। অসংখ্য শরীর। কত হাজার হাজার শরীর আমায় রোজ ছুঁয়ে যাচ্ছে…
“সুস্মিতাদি!” হাত নাড়ে গৌরব। ছয়ফুটিয়া ও। একটু ঢ্যাঙা দেখতে। ছাগলদাড়ি রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। চোখে এখনও সানগ্লাস। “সুস্মিতাদি!”
সুস্মিতাদির ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, আবছা আলোতে পুরো কালো দেখাচ্ছে। একটা নীল সালোয়ার-কামিজ পরেছে, ফর্মাল। ভিড়ের মাঝে ছোট্ট হবিট লাগছে দেখে। তবে আগের মতো সেই মলিন চেহারা নেই, জীবন্ত হয়ে উঠেছে অনেক। চোখ দুটো চিকচিক করছে কেমন।
“গৌরব,” হাসি ফুটিয়ে বলে সুস্মিতাদি, “কী ব্যাপার? একা একা এদিকে?”
সুস্মিতাদি এমনভাবে কথা বলছে যেন কাল সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত অদ্ভুত কিছুই হয়নি। যেন ওরা চারজন এখনও একসঙ্গে পুরীতে ঘুরছে। যে প্রশ্নগুলো জিবের ডগায় এসেছিল, সেগুলোকে একপ্রকার গিলে নিল গৌরব।
“খেতে বেরিয়েছিলাম একটু।”
সুস্মিতাদি মুচকি হেসে চোখ নাচায়। “তা খেলি কিছু? আইসক্রিম খাবি? আমি কিন্তু খাব। আয় এদিকে।”
তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করে দিল।
গৌরব পিছু নেয়। “না মানে… তুমি আছ কোথায় এখন?”
“আছি-খন এক জায়গায়। চিন্তা করিস না। কালকের পরই তো ট্রেন। অসুবিধা হবে না। খাজা খাবি?”
আইসক্রিমের পর সোজা খাজা? সুইট-টুথ একেবারে। গৌর মাথা নাড়াল, হ্যাঁ খাবে।
সুস্মিতা বকবক করে চলেছে নিজের মনে। “বুঝলি তো, বিকালে বেরিয়েছিলাম, কয়েকটা দোকানের স্যাম্পল টেস্ট করার জন্য। কাকতাড়ুয়াতে ফার্স্টে গেলাম, তারপর নৃসিংহে। নতুন যে গাঙ্গুরাম খুলেছে…”
গৌরব মুগ্ধ হয়ে সুস্মিতাদিকে দেখাচ্ছে। প্রভাতদার ছায়ার বাইরে এসে মেয়েটা জোনাকির মতো জ্বলছে আর নিবছে। বিষণ্ণতার দাগ যায়নি চেহারা থেকে, তবু দৃঢ়তা এসেছে চিবুকে, কাঁধের ভঙ্গিমাতে। নিজের মনে বকতে বকতে সুস্মিতাদি হাতের প্যাকেট থেকে একটা খাজা বার করে গৌরবের হাতে ধরিয়ে দিল। এখনও গরম, রসে টইটম্বুর। হাত চিটচিট করবে গৌরবের। জল আনেনি সঙ্গে, টিস্যুও নেই।
খাজায় কামড় বসাল গৌরব। মিষ্টি, অত্যন্ত মিষ্টি। এত মিষ্টি খায় না গৌরব। আরেকটা কামড় বসাল। সুস্মিতাদি নিশির মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে, ভিড় পেরিয়ে তারা একটা আইসক্রিমের দোকানের সামনে দাঁড়াল, সি-বিচ রোডের পাশেই।
“ম্যাগনাম খাবি?”
“কাপ। ছোটো কাপ।”
“ডাবল সার্ভিং?”
“না, না। সিঙ্গল।”
“হেল্থ কনশাস।” হাসে সুস্মিতাদি।
নিজেদের আইসক্রিম নিয়ে তারা সমুদ্রতটের দিকে এগোয়। এটা গোল্ডেন বিচের একদম প্রান্তে, উত্তর-পূর্ব মাথায়। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছে।
ভিড় কম বলে সমুদ্রতটও অপেক্ষাকৃত কম নোংরা। তবুও প্লাস্টিকের টুকরোটাকরা দাঁতের মতো জেগে রয়েছে বালির মধ্যে থেকে। গৌরবের হাতে স্ট্রবেরি আইসক্রিম। স্ট্রবেরি ওর ভালো লাগে না, কিন্তু সুস্মিতাদি এটাই কিনল। আর গৌরবের জিব যেন ওর আলটাকরার সঙ্গে লেগে গেছে, কথা বেরোচ্ছে না মুখ থেকে।
ধপ করে ওই বালিতেই বসে পড়ল সুস্মিতাদি। তারপর গৌরবের মনের কথাটা বুঝতে পেরে, “কী রে, তোর স্ট্রবেরি তেমন ভালো লাগে না, বল?”
“না, না, সেরকম কিছু না।” গৌরব এক স্কুপ স্ট্রবেরি কোদালের মতো মুখে চালান দেয়। হাত দুটো সত্যিই চ্যাটচ্যাট করছে।
“বোস।”
“বালিতেই?”
“বালিতেই।”
গৌরব দু-হাত দূরে বসে। বালিটা শুকনো, এই যা বাঁচোয়া।
“কিছু বলবি?” সুস্মিতাদি ম্যাগনামে কামড় দিতে দিতে গৌরবের দিকে ঘুরে বসেছে। চোখ দুটো সার্চলাইটের মতো তাগানো।
গৌরব তোতলায়। এই এক সমস্যা। কথা বলতে পারে না। মগজের যে অংশ চিন্তাকে জারণ করে মুখের কথায় পরিবর্তন করে, সেই অংশ ঠিকঠাক কাজ করে না।
ওর মুখ থেকে কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে আসে, মিসফায়ার্ড বুলেটের মতো, “আমি—তুমি—মানে কালকে—প্রভাতদা—” গতকাল থেকে জমা দুশ্চিন্তা আর ফ্রাস্ট্রেশন ঝরে পড়ে ওর গলার আওয়াজে।
সুস্মিতাদি মট করে আইসক্রিমে কামড় দিয়ে বলে, “তোকে কেউ কিছু বলেনি, বল?”
গৌরব মাথা নাড়ায়। কথা বলার আশা ছেড়ে দিয়েছে।
“নীলিমা আর প্রভাত কোথায় রে? হোটেলে?”
গৌরব একটু ইতস্তত করে। তারপর ইতিবাচক মাথা নাড়ায়।
“আজ যাসনি কোণার্কের দিকে?”
“কী করে যাব? তুমিই তো কোথায় চলে গেলে।” গৌরবের গলায় অনেকটা খেদ।
মলিন হাসি হাসে সুস্মিতাদি।
“তোমাদের বিয়ে তো দু-মাস পর?” গৌরবের গলা থেকে কথাগুলো হড়বড়িয়ে বেরিয়ে আসে। এখনও খেদ। এখনও রাগ। কীসের এত রাগ? সুস্মিতা তোর কে হয় রে?
“সেই বিয়ে আর হবে না।” সুস্মিতাদি বলে। তারপর আবার মট করে কামড় বসায় আইসক্রিমে।
গৌরব বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। হাতের আইসক্রিম গলতে শুরু করেছে।
সুস্মিতাদি গৌরবের চোখে চোখ রেখে বলে, “হি চিটেড অন মি।”
গৌরব চোখ নামিয়ে নেয়। স্ট্রবেরি আইসক্রিমটা খেতে আর ভালো লাগছে না।
“আরও শুনবি?”
“না।”
“গেস করতে পারছিস অল্প?”
“হ্যাঁ।”
“সরি রে।”
মানুষ অদ্ভুত৷ সুস্মিতাদির হবু বর ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল, আর সুস্মিতাদিই ওকে সরি বলছে। কেন বলছে?
“তুমি ফেরত আসবে না?” গৌরব শুধায়।
“নাহ্। চিন্তা করিস না। হোটেলে আছি একটা। কাছেই। ভালো হোটেল। আইসক্রিমটা খাবি না?”
স্ট্রবেরি আইসক্রিম গলে জল। বাটিটাও একটু তুবড়ে গেছে। সুস্মিতাদি ছোঁ মেরে সেই বাটি কেড়ে নেয়।
যে চামচে গৌরব খাচ্ছিল, সেই চামচটা সুস্মিতাদি তার গোলাপি জিবে ঠেকায়। গৌরব ঘেমে ওঠে। সমুদ্রের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
“কী ভাবছিস?” সুস্মিতাদি মুচকি হাসছে।
মাথা নাড়ায় গৌরব। কিছু বলে না। বলার কিছু নেই। যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ, সবই অব্যক্ত।
“তোর গার্লফ্রেন্ড আছে রে?”
গৌরব ঝাঁকুনি খায়। হুইপল্যাশ। মিনমিন করে বলে, “না।”
“যদি হয়, একটা জিনিস প্রমিস করবি?”
“বলো।”
“কোনোদিন জেনে-বুঝে কষ্ট দিবি না মেয়েটাকে। আমাদের অনেক দুঃখ রে। মেয়ে হয়ে জন্মানোয় অনেক দুঃখ। আমরা শুধু ভালো থাকতে চাই, সেটাও কারও সহ্য হয় না। তাই সেই দুঃখের বোঝা বাড়াস না ইচ্ছে করে।”
গৌরব চুপ করে থাকে। এক মুহূর্ত পর সে মাথা নাড়ায়৷ বুঝেছে।
সুস্মিতাদির গলায় আবার দুষ্টুমি ফেরত আসে। “তোর সত্যি গার্লফ্রেন্ড নেই? মিথ্যে কথা।”
“ন্-না। সত্যি বলছি।”
“লম্বা ছেলেদের মেয়ে জোটাতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।”
গৌরব তোতলায়। সন্ধ্যা নেমে গেছে পুরোদমে। তবে বিচ আর রাস্তা বর্ডার বেয়ে যে স্ট্রিটলাইটগুলো রয়েছে, সেগুলো এখনও জ্বলে ওঠেনি। অন্ধকার নামছে। গৌরব আর সুস্মিতাদি অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সামনে সমুদ্র আর আকাশ মিলেমিশে একাকার।
সুস্মিতাদি ফ্যানি প্যাকের চেইন খুলে কী একটা বার করে আনল।
“কাল কিনেছি, দেখ।”
গৌরব হাতে নিয়ে দ্যাখে একটা শঙ্খ। বড্ড অদ্ভুত দেখতে, এবড়োখেবড়ো কেমন। মোটেই সুন্দর নয়। সাদা-ধূসর রঙের, কিন্তু ময়লার মতো কী যেন গায়ে লেগে রয়েছে।
গৌরব খুঁটে তোলার চেষ্টা করে।
শ্যাওলা।
“আজ কী হয়েছে, জানিস। দুপুরের দিকে জেটস্কি চেপেছিলাম। ভালোই চলছিল। কিন্তু তারপরেই ঝড়মতো এল…”
“এটা কী, সুস্মিতাদি?”
“শঙ্খ রে, হাঁদা। আগে দেখিসনি?”
“এমন অদ্ভুত, কী একটা খোদাই করা আছে।”
“অদ্ভুত বলেই তো কিনলাম। কী জানি, আজকাল অদ্ভুতদের ভালো লাগছে।’’
গৌরব মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে।
“তারপর শোন-না। আমি তো জেটস্কিটা সমুদ্রের দিকে ঘোরালাম। কিন্তু ততক্ষণে সমুদ্রের ঢেউ বাড়তে শুরু করেছে…”
শঙ্খের চোখগুলো একসঙ্গে গৌরবের দিকে ঘুরে তাকাল। ক্রিক ক্রিক করে আওয়াজ ভেসে আসে, যেন জং-ধরা একটা স্ক্রু-কে কেউ ঘুরিয়ে আলগা করছে।
গৌরব চিৎকার করে শঙ্খটাকে ছুড়ে ফেলে লাফিয়ে উঠল।
“আরে কী হল? এ কী?”
সুস্মিতাদিও চমকে উঠেছে, তবে গৌরবের চিৎকার শুনে।
“ওটা কী?”
“আরে শঙ্খ, বললাম তো।”
“ন্-না, জ্যান্ত কিছু।”
ফ্ল্যাশলাইটের মৃদু আলোয় শঙ্খটাকে কাঁকড়ার মতো দেখাচ্ছে। শ্যাওলা-মাখা অদ্ভুত একটা কাঁকড়া।
সুস্মিতাদি হেসে বলল, “ধ্যাত।” তারপর শঙ্খটা তুলে নিল। “ভেজা বালি লেগে গেছে। দাঁড়া।” বলে সমুদ্রের দিকে দৌড় দিল।
গৌরব কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সুস্মিতাদি অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন গোটা সমুদ্র তাকে গিলে ফেলবে৷ সুবিশাল এক রাক্ষস, মুখ হাঁ করে অপেক্ষা করছে মেয়েটার জন্য।
গৌরবও দৌড় দিল।
“সুস্মিতাদি,” সমুদ্রের গর্জনে সেই চিৎকার হারিয়ে গেল: “সুস্মিতাদি।”
একটু এগোতেই দেখতে পেল তাকে। লেগিংস প্রায় হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে সমুদ্রের জলে পা ভেজাচ্ছে দিদি। চুল উড়ছে অল্প। হাতে ভেজা সেই শঙ্খ।
গৌরবকে দেখতে পেয়ে অদ্ভুত একটা মুখভঙ্গি করে মুচকি হাসে সুস্মিতাদি। এক মিনিটে একটা চেনা চেহারা কেমন অস্বাভাবিক হয়ে গেছে।
“দেখ কী সুন্দর।” সুস্মিতাদি বলে। ভেজা শঙ্খটা হালকা হালকা কাঁপছে। চোখগুলোর খোদাই-করা মণি উন্মাদের মতো পাক খাচ্ছে, পাক খাচ্ছে। কেমন বিবমিষা জাগে দেখলে। কিন্তু এই চোখগুলো যে বড্ড চেনা। আজকেই দেখেছে গৌরব।
“দিদি, তুমি ওটাকে ফেলে দাও।”
“কেন রে?”
“জাস্ট ফেলে দাও,” গৌরবের বড্ড ভয় করছে, “ইট’স… ইট’স অ্যালাইভ!”
“জানি তো।” সুস্মিতাদির মুখ আরও অচেনা হয়ে যায়।
সমুদ্রের ঢেউ হিসহিসিয়ে ধেয়ে আসে৷ গৌরব প্যান্ট গোটানোরও সময় পায়নি। ওর চপ্পল আর প্যান্ট ভিজে যাচ্ছে। উফফ, কী ঠান্ডা লাগছে হঠাৎ।
সুস্মিতাদি আরও একটু সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যায়। অজান্তেই হয়তো। জীবন্ত শঙ্খটা ক্রিক ক্রিক আওয়াজ করে ডাকে। তার মালিক অদূরেই রয়েছে৷ অপেক্ষা করছে।
“সুস্মিতাদি, ওদিকে যেয়ো না। জোয়ার আসছে।”
সুস্মিতাদি উত্তর দেয় না। শঙ্খ হাতে মোহগ্রস্তের মতো জল ভেঙে সমুদ্রের দিকে হাঁটতে থাকে।
গৌরব পিছু নেয়।
আকাশে আজ নক্ষত্র নেই, চাঁদ নেই। দিনের আলো মুছে গেছে।
গৌরব সুস্মিতাদির হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারে।
সুস্মিতাদির গায়ে তেমন জোর নেই যেন৷ পাটকাঠির মতো। গৌরবের টান খেয়ে উলটে পড়ে গৌরবের গায়ে। কিন্তু এখনও শক্ত করে শঙ্খটা ধরে রয়েছে।
“দেখি ওটা।” গৌরব শঙ্খটা নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু সুস্মিতাদি গোঁ গোঁ করে দু-হাত দিয়ে শঙ্খটাকে আঁকড়ে ধরে।
“নিস না, নিস না,” সুস্মিতাদি গৌরবের বুকে মুখ গুঁজে ফেলেছে, “নিয়ে নিস না, বড্ড কষ্ট হবে নইলে।”
গৌরব উপেক্ষা করার চেষ্টা করে সুস্মিতাদির ঘ্রাণ, তার শরীরের ওম, তার কান্না-ভেজা গাল।
পারে না।
“আগে পিছিয়ে এসো৷ এদিকে এসো।”
টেনে বালির উপর নিয়ে আসে সুস্মিতাদিকে।
সুস্মিতাদি কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। “ছেড়ে দে আমাকে, ছেড়ে দে। ডাঙার উপর বড্ড ক্লান্তি। ছেড়ে দে আমাকে।”
গৌরব ছাড়ে না। আরও ভেতরে টেনে এনে সুস্মিতাদিকে বালির উপর বসায়।
সুস্মিতাদি কাঁপছে। থরথর করে। এখনও শঙ্খটা চেপে ধরে রয়েছে। চোখগুলো আর নড়ছে না।
গৌরব সুস্মিতাদির সামনে বসে। “তুমি চলো আমার সঙ্গে।”
“না, আমি যাব না।”
“এইরকম সিচুয়েশনে তোমাকে আমি একা ছাড়তে পারব না, দিদি, কিছুতেই না।”
লাজুক ছেলেটার অমন দৃঢ় গলা শুনে সুস্মিতাদিও অবাক হয়৷ ভেজা দৃষ্টি গৌরবের দিকে ফেরায়। ওদের পিছনে বিচ স্ট্রিটের লাইটগুলো একসঙ্গে জ্বলে উঠেছে। গৌরবের কোমল চোখ দুটো চিকচিক করছে।
“চলো তুমি আমার সঙ্গে। তোমার রুমটা ফাঁকা পড়ে রয়েছে৷ চলো।”
সুস্মিতাদির মৃদু আপত্তিগুলোকে অপেক্ষা করে গৌরব একপ্রকার পাঁজাকোলা করে সুস্মিতাদিকে বালি থেকে তুলল।
“চলো, চেক আউট করবে তোমার নতুন হোটেল থেকে৷ বেড়াতে এসে এইভাবে তুমি আলাদা থাকলে আমার চিন্তা হয়ে হয়ে অম্বল হবে।”
তেতো হাসি হেসে সুস্মিতাদি বলে, “বেট, প্রভাত ইজ় কমপ্লিটলি ফাইন।”
গৌরব উত্তর দেয় না৷ উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
***
সুস্মিতা গৌরবের কীর্তিকলাপ দেখে একটু অবাক। লাজুক স্বভাবের ছেলেটা এতটা ফরওয়ার্ড হয়ে সুস্মিতার হাত ধরে ভিড় ঠেলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দুজনে আধভেজা, বালি-মাখা হাত-পা। গৌরবের সঙ্গে আগেও অনেকবার দেখা হয়েছে, কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই সে মাথা তুলে কথা বলেনি। সুস্মিতা নীলিমার বাড়ি গেলে আরও গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে, এক-দুবার ‘হাই-হ্যালো’ বলে নিজের ঘরে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থেকেছে।
সেই গৌরবের সঙ্গে এই গৌরবের পার্থক্য এক-সমুদ্র জল।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর গৌরব বললে, ‘‘ইয়ে, আসলে তোমার হোটেলটা কোনদিকে?”
সুস্মিতা বলে, “বলছি, হাতটা ছাড়। পালাব না, প্রমিস করছি।”
“ওহ্।” গৌরব তাদের হাতের দিকে তাকায়। শক্ত হাতে ধরে রেখেছে সুস্মিতাকে৷ ‘“ওহ্।”
এক ঝটকায় নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় সে৷ “সরি, সরি, আমি আসলে—”
“ইট’স ওকে। আয় তুই।”
সুস্মিতা শঙ্খটা নিজের ফ্যানি প্যাকে চালান দিয়ে গৌরবের সামনে সামনে হাঁটতে শুরু করল।
“জেটস্কির ব্যাপারে কী যেন বলছিলে?”
“ওহ্,” সুস্মিতা নির্বিকার গলায় বলে, “আর বলিস না, ডাঙায় ফেরত আসার সময় জেটস্কিটা উলটে গিয়েছিল।”
“হোয়াট?”
“কিছু হয়নি, চিন্তা করিস না। সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো রেসকিউ করেছিল আমাকে।”
সুস্মিতা হাসার চেষ্টা করে। পারে না। গৌরবকে পুরো ঘটনাটা বলা যাবে না।
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে পুরী শহর আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ভিড়ভাট্টার চোটে নতুন হোটেলে গিয়ে চেক-আউট করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মূর্তির কাছে আসতে আসতে পাক্কা এক ঘণ্টা লেগে গেল। মাঝে বেশ কয়েকবার সুস্মিতা গৌরবকে জোর করে দাঁড় করিয়ে স্টলের জিনিস দেখেছে, পণ্য ঘেটেছে। একজোড়া সস্তা কানের দুলও কিনে নিয়েছে। গৌরব কিছু বলেনি, বিরক্তি প্রকাশ করেনি, শুধু চোখে-মুখে জিজ্ঞাসা ফুটে উঠেছে। ও হয়তো বুঝতে পারেনি, যে মেয়ে এই কিছুক্ষণ আগেই সমুদ্রে ডুবে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল, সেই মেয়ে এখন হাসিমুখে টুকিটাকি জিনিস কিনছে কী করে?
ওহ্, পুয়োর ম্যান, উইমেন হ্যাভ মেনি সেল্ভস। মার্গারেট এটউড পড়িসনি?
গৌরব বোধহয় তেমন বই-টই পড়ে না। প্রভাতের উলটো। কলেজে প্রভাত রোজ একটা করে নতুন বই বয়ে আনত। সিলেবাস-বহির্ভূত। টিবেট্যান বুক অব দ্য ডেড। ডাগন। গ্র্যাভিটজ রেইনবো। পিছনের সারিতে সুস্মিতার পাশে বসে বই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করত।
নাহ্, প্রভাতকে নিয়ে আর ভাববে না। ভাল্লাগছে না। সুস্মিতা ফ্যানি প্যাকটা আঁকড়ে ধরে। ভেতরে শঙ্খটা ওর সব কথা শুনছে, বুঝছে।
মূর্তি থেকে ডানদিকে ঘুরে গলির তস্য গলিতে গিয়ে সেই হোটেলটা, যেখানে চারজনে মিলে উঠেছিল। ছিমছাম, এসি আছে, অল্প সি-ভিউ রয়েছে। সব থেকে বড়ো ব্যাপার: সস্তা।
সুস্মিতা চুপচাপ নিজের রুমে এসে ঢুকল। এলোমেলো বিছানা, তবে নীলিমার জামাকাপড়গুলো আর নেই। একবার বোধহয় রুম সার্ভিস হয়ে গেছে, মেঝে পরিষ্কার। গৌরব সুস্মিতার নেভি-ব্লু রাকস্যাকটা বয়ে আনছিল, সেটা দেয়ালের আংটায় টাঙিয়ে বলল, “তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি একটু ওই ঘর…”
বাক্যটা শেষ হয় না। মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে যায়।
“আচ্ছা, যা।” বিষণ্ণ হাসি সুস্মিতার, “আমি আছি। প্রমিস করলাম, কোনোরকম বোকামো আমি করব না।”
গৌরব ঠোঁট কামড়ায়। অনেকগুলো প্রশ্ন মনে ভিড় করে এসেছে। প্রভাতদার ব্যাপারে, জেটস্কির ব্যাপারে… ওই শঙ্খটার ব্যাপারে। কিন্তু কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
চোখগুলো তাড়িয়ে বেড়ায় গৌরবকে।
***
প্রভাত খালি গায়ে শুয়ে আছে। নাকে এখনও সেই ব্যান্ডেজ। ছোটো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নীলিমা সিগারেট টানছিল। গৌরবকে ঢুকতে দেখে তড়িঘড়ি করে ভেতরে ঢুকল।
“কোথায় ছিলি?”
“বাইরে।”
“ফোনটা তো ধরবি?”
“দেখিনি।”
“কিছু খাবার এনেছিস ভাই?” প্রভাত বিছানায় উঠে বসে বলল, “শালা খিদে পেয়ে গেছে বড্ড।”
“বললাম তো, সুইগি করে দিচ্ছি।” নীলিমা বলল।
“ধুর বাল, আর সুইগি।” হাই তোলে প্রভাত, “দেখি, আরেক পেগ টানি।”
গৌরব এতক্ষণে দেখতে পায়। কফি টেবিলের উপর দামি ব্লেন্ডেড হুইস্কির বোতল, দুটো প্লাস্টিকের কাপ, বাদাম। বাদামের খোলস যত্রতত্র পড়ে রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, শুভকার্য অনেকক্ষণ ধরে হচ্ছে।
“আরে এ কী!” গৌরব চিৎকার করে, “এগুলো এখানে কী করছে?”
নীলিমা বিড়ালের মতো হিস্স্ করে বলে, “চেল্লাস না তো বাবা। ভাল্লাগে না।”
গৌরব চুপ করে না। গ্লাসগুলোর তলা থেকে দুটো গঞ্জাপার তাস বার করে বলে, “এগুলো কোস্টার নয়, এগুলো গঞ্জাপার তাস। ইয়ারকি মারছিস তোরা।”
প্রভাত খিলখিল করে হাসছে, অসহায় বাচ্চার মতো। “এ আবার কী ধরনের তাস, ভাই?”
গৌরব কিছু বলে না। মুখ কালো হয়ে গেছে ওর। অনেকগুলো গালি মুখে পিত্তরসের মতো জমেছে।
দুটো কার্ডই হুইস্কিতে ভেজা। গৌরব পরম যত্নে, কার্ড দুটো মুছে বলল, “বাকি তাসগুলো কই?”
প্রভাত পা দিয়ে ইশারা করল। বিছানায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। গৌরব দাঁতে দাঁত চেপে তাসগুলো গোছাতে শুরু করল।
“তো, বাওয়া, তাস যখন কিনলি, খেলা হয়ে যাক।” জড়ানো গলায় প্রভাতদা বলছে।
“খেলার জন্য কিনিনি, দাদা।”
“আরে ধুর ধুর, চল-না, খেলি। শালা মদ টেনে টেনে একঘেয়ে লাগছে সারাদিন।”
“ওহ্, আমি একঘেয়ে হয়ে গেলাম এত তাড়াতাড়ি।” নীলিমা হড়বড় করে কথাগুলো উগলে দিল।
গৌরবের কান দুটো গরম হয়ে গেল। মনে হল, ঘর থেকে এক্ষুনি বেরিয়ে যায়, পালিয়ে যায় এই হোটেল থেকে। সমুদ্রসৈকতের নরম বালিতে গা এলিয়ে ঘুমিয়ে যায়।
“আহ্, সবেতেই ঘ্যানঘ্যান করিস না তো নিলু। ওইভাবে মিন করিনি।” প্রভাত হেঁচকি তুলল।
“ঘ্যানঘ্যান? কাল তো কুত্তার মতো কাঁদছিলি, তখন আমার কথা ঘ্যানঘেনে লাগেনি?”
“ধুর বাল। চুপ কর। এই গৌরব, গোছাচ্ছিস কী? দে, তাসগুলো দে।”
টলমলে অবস্থায় দাঁড়িয়ে গৌরবের হাত থেকে তাসগুলো খামচে কেড়ে নেয় প্রভাত।
“আহ্ দাদা, হচ্ছেটা কী?” গৌরবের গলা করুণ শোনায়। প্রভাতদার প্রতি জমানো শ্রদ্ধা সব খরচ হয়ে যাচ্ছে আজ।
“দেখি, দেখি। বাবা কী সব বিদঘুটে ছবি। লাভক্রাফ্টিয়ান একেবারে।”
নীলিমা মুখ গোমড়া করে বিছানায় উঠে বসেছে।
“কত খরচ করেছিস গোরু এগুলোর জন্য? বাপিকে বলব?” নীলিমা একটা তাস নেড়েচেড়ে দ্যাখে, “বিদঘুটে যত্তসব।”
অদ্ভুত সেই ছ-টা কার্ডই ছড়িয়েছে প্রভাত আর নীলিমা। ক্লাসিক গঞ্জাপার কার্ডগুলো এখনও ঠিক আছে।
থ্যাংক গড।
“আরে ভাই, বল-না, বল-না,” প্রভাত কার্ডগুলো ‘কাট’ করতে করতে বলল, “খেলব কী করে?”
“এগুলো খেলার জন্য না। এগুলো সেরেমনিয়াল তাস। এইসব অপদেবতাকে ডাকার জন্যে।”
“ও বাবা!” প্রভাতদা জিব বার করে ঠোঁট চাটে, “কিউরিয়োসার টু কিউরিয়োসার। তো দেখা-না, কী করে ডাকে?”
গৌরবের মনে হল, প্রভাতদাকে সাঁটিয়ে একটা চড় মারে। একটা মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব জানিয়ে পুরীতে সেলিব্রেট করতে নিয়ে এল। এখন সেই মেয়ে মরল কি বাঁচল, সেটা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই, মাতাল হয়ে তাস খেলা শিখতে চায়।
আর নীলিমা… নিজের দিদির দিকে তাকাতেও পারছে না গৌরব, লজ্জা লাগছে।
“তাসগুলো দুটো সারিতে সাজাও।” গৌরব অবশেষে হাল ছেড়ে দেয়, “কারও কাছে কড়ি আছে?”
“আছে, আছে।” প্রভাত হাত তুলে দেয়, চৈতন্যদেবের মতো। “এই, এই, নিলু, তোমার—মানে ইয়ে, তোর পার্সে দেখ-না৷ রঘুরাজপুরে কয়েকটা কিনে দিলাম তো।”
নীলিমা ওঠার আগেই গৌরব নীলিমার পার্সটা মেঝে থেকে তুলে নেয়। ভেতরে কয়েকটা রং-করা কড়ি। একটার গায়ে কৃষ্ণর বাঁশি আঁকা। সেটাকে বার করে আনল।
প্রভাত আর নীলিমা তাসগুলো সাজানোর চেষ্টা করছে।
“উঁহুঁ, দু-সারিতে সাজাতে হবে,” গৌরব ঠিক করে দেয়, “আর উলটো করে সাজাতে হবে।”
“তারপর?” নীলিমা বলে।
“তারপর…” গৌরব চুমু খায় কড়িতে, বাঁশির উপরে। ছুড়ে দেয় সেই কড়ি তাসগুলোর দিকে।
একটা তাসের ঠিক মাঝখানে কড়িটা পড়ে।
প্রভাত ছোঁ মেরে তাসটা তুলে নেয়। “বাওয়া, এটা কী, ভাই?”
লাল রঙের সব্জেটে একটা গুল্ম-মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চারদিকে কাঁটা।
“গার্গুনাজ।” গৌরব বিড়বিড় করে বলে।
“কী নাম?” নীলিমা হাসতে শুরু করেছে।
“গাগু-গাগা?” প্রভাতও হাসছে।
“কী ছাইপাঁশ।” নীলিমা বলে।
“আমিও ট্রাই করি।” প্রভাত বলে।
গৌরব তার কার্ডটা নামিয়ে এলোমেলো করে দেয় সব৷ তারপর আবার সাজায়। প্রভাত নীলিমার দিকে তাকিয়ে কড়িতে চুমু খায়। নীলিমা খিলখিল করে হাসে। প্রভাতের ছোড়া কড়িটা একটা কার্ডের গা ছুঁয়ে পড়ে।
গৌরব তুলে দ্যাখে। বুকটা ধক করে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে। আবার সেই চোখ, পিটপিট করছে যেন।
“শতনেত্রক।”
“মানে কী এইসবের?” প্রভাত জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করে। ঝিমুতে শুরু করেছে।
“জানি না।” গৌরব নিজের মনেই বলে, “কী হচ্ছে, কিচ্ছু বুঝছি না।”
নীলিমা কড়িটা তুলে নিয়ে চুমু খায়। “আমিও দেখি।”
“দাঁড়া, আগে এই কার্ডটা রাখি নীচে।”
কিন্তু নীলিমা কথা না শুনেই কড়িটা ছুড়ে দেয় বাকি পাঁচটা কার্ডের দিকে।
“কই দেখ, কার্ডে কী আছে।”
গৌরব তাসটা তুলে দ্যাখে।
দেখতেই থাকে।
মাথাটা অল্প ঘুরছে।
একই তাস। ঢেউয়ের মাঝে চোখ।
“শতনেত্রক।”
“বাবা, আমিও একই পেলাম।” নীলিমা ঘোলা চোখে প্রভাতের দিকে তাকায়, “শুনলি, আমরা দুজনে সেইম কার্ড পেয়েছি। এই ওঠ-না, ওঠ। একই অপদেবতা দর্শন দিতে আসবে। হিহি।”
গৌরবের দু-হাতে হুবহু একই ধরনের তাস। শতনেত্রকের চোখগুলো অতল মায়ায় সিক্ত।
কী করে হল এটা? একটাই তো কার্ড ছিল। বাকি কার্ডগুলোর উপর হামলে পড়ে গৌরব।
শতনেত্রক, শতনেত্রক, শতনেত্রক, শতনেত্রক।
গৌরব নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে।
“দারুণ ট্রিক তো!” নীলিমাও তলিয়ে যাচ্ছে নেশার সমুদ্রে। প্রভাতের অচেতন শরীরে নিজেকে মিশিয়ে দিচ্ছে। “কী করে করলি রে, গোরু?”
ঘামতে শুরু করেছে গৌরব। এসি রুমেও। শ্যাওলায় ঢেকে যাচ্ছে ওর দৃষ্টি। দেবতার চোখগুলো সব নীলিমা আর প্রভাতের দিকে ঘোরানো। সেই একই রকম করুণাময়। যেন ওই দুজনের মধ্যে তাল তাল বিষণ্ণতা জমে রয়েছে।
“শোন দিদি,” গৌরব শান্ত গলায় বলে, “সুস্মিতাদিকে আমি ফেরত নিয়ে এসেছি। ও নিজের ঘরে রয়েছে।”
কেউ উত্তর দেয় না। কোথা থেকে ঘণ্টার আওয়াজ ভেসে আসছে। ধূপের গন্ধ নাকে আসে গৌরবের।
রাত হল অনেক।
বিরতি: নীলিমা মজুমদার আর প্রভাত চক্রবর্তী
নীলিমার হিংসে বিষের মতো। অম্বলের মতো। জ্বলিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দেয় সব। নীলিমা স্বপ্নে কলেজের প্রথম দিনগুলোয় ফিরে যায়। সুস্মিতার সঙ্গে দেখা। বেঁটে শান্ত মেয়েটা সেকেন্ড বেঞ্চে চুপ করে বসে ছিল। সেখান থেকে বন্ধুত্ব। এমনভাবেই, কোনোরকম ভণিতা ছাড়া। নীলিমার প্রচ্ছন্ন একটা অহংকার ছিল। আর্থিক দিক থেকে, পড়াশোনার দিক থেকে সে সুস্মিতার থেকে সব সময় এগিয়ে। সেই অহংকার অবচেতন থেকে সচেতন মনে এলে কারুণ্যে মিউটেট করে যেত। সুস্মিতাকে সব কিছুতে সাহায্য করার একটা ইচ্ছে, অনেকটা দেখনদারির পর্যায়ে। বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে আসা। ক্যান্টিনের খাবারের পয়সা না-দিতে-দেওয়া। “এই, সিনেমা দেখবি? পয়সা নেই? পয়সা তোর থেকে কে চাইল? চল, চল। নোটস নেই তোর? মেটাফিজ়িক্যাল পোয়েটদের ক্লাসটা মিসও করেছিস। আমার খাতাটা জ়েরক্স করে নে।” সুস্মিতা, মিষ্টি সুস্মিতা নীলিমার ছায়ায় ছিল কলেজে। বেশ তো ছিল।
তো কোন সাহসে এই মেয়ে নীলিমাকে ডিঙিয়ে প্রভাতের মাথা খেয়ে নিল? এইটুকু গতরে এত রস কোথা থেকে আসে? প্রভাত, ক্লাসের টপার, মাঝারি হাইটের হলেও দেখতে বয়স্ক প্রফেসারদের মতো৷ ধারালো চোয়ালে হালকা দাড়ি, পুরু গোঁফ, চোখ দুটো ছুরির মতো। নীলিমা প্রথম দিন থেকেই চাপ খেয়েছিল। প্রভাত ক্লাসের কাসানোভা, প্রফেসারদের মাই ডিয়ার। বাজের মতো গলা। প্রভাত, প্রভাত, একবার এদিকে তাকাও। প্লিজ়। প্লিজ়। প্লিজ়।
কিন্তু প্রভাত নীলিমার দিকে তাকায় না। প্রভাত সুস্মিতার দিকে তাকিয়ে আছে। ওই মাগির দু-পয়সার মুরোদ নেই, প্রভাত৷ আমাকে দ্যাখো। আমি আজ পুরু আইলাইনার লাগিয়েছি। প্লিজ়, প্লিজ়। সুস্মিতা আমাকে এইভাবে হারিয়ে দিতে পারে না, পারে না। আমি মেনে নেব না সেটা, কিছুতেই না, কিছুতেই না।
স্বপ্নে গোঙাতে থাকে নীলিমা।
***
হাই স্কুলে প্রভাত একবার একটা মেয়েকে চুমু খেয়েছিল। কোএড স্কুল। বাথরুমের দিকটা ফাঁকা। সেখানে মেয়েটাই তাকে ডেকেছিল টিফিন পিরিয়ডের শেষে।
মেয়েটা প্রেমে পড়েছে। প্রভাতের লেখা কবিতা স্কুল ম্যাগাজ়িনে বেরিয়েছে। প্রভাত কি সেখানে একটা অটোগ্রাফ দেবে, প্লিজ়?
প্রভাত তাই চুমু খেয়েছিল। জোর করে। মেয়েটা বুঝতে পারেনি, ওর সঙ্গে ঠিক কী হচ্ছে। এক-দুবার না বলার পর শেষে মেনে নিয়েছিল। প্রভাত ওর বুকে হাত দিয়েছিল। নরম ঘেমো চামড়ায়। মেয়েটা কাঁদতে শুরু করেছিল ততক্ষণে।
হাই স্কুলে এইরকম ঝামেলা প্রায় লেগে থাকে। তাই সুপারিন্টেন্ডেন্ট মিস্টার নিউম্যান ঝামেলা না করে প্রভাত আর প্রভাতের মা-কে ডেকেছিলেন তাঁর অফিসে। যতই হোক, প্রভাতের বাবা জাঁদরেল পুলিশ অফিসার, এই স্কুলে ফি-বছর মোটা ডোনেশন পাঠান।
“এইসব ফালতু ব্যাপারে আমাদের সময় নষ্ট করবে না নিউম্যান।” প্রভাতের মা চিৎকার করেছিল, “আমার ছেলে এইরকম ছোটোলোকামি করবে? আর ইউ কিডিং উইদ মি? মাই সন ইজ় পারফেক্ট।”
নিউম্যান তবু বলেছিল, “মেয়ের পরিবার অভিযোগ যখন এনেছে, আমার কর্তব্য আপনাকে সব খুলে বলার৷ ওঁরা থানা-ফানা করবে, বলেছিলেন তো।”
বাঁকা হাসি হেসেছিল প্রভাতের মা, “ওহ্, লেট দেম ট্রাই।”
প্রভাতের কানে শুধু বেজেছিল, “মাই সন ইজ় পারফেক্ট।”
স্কুলের স্পোর্টস ইভেন্টে একজনের হাঁটুতে লাথি মেরে মালাইচাকি ফাটিয়ে দিয়েছিল। “মাই সন ইজ় পারফেক্ট।”
ডিনার টেবিলে বাবা বলছে, “মেন আর প্রিডেটর বাই নেচার, প্রভাত। পৃথিবীতে কিছু নিতে হলে খামচে নিয়ে নিতে হবে।” “মাই সন ইজ় পারফেক্ট।”
সুপ্রিয়াদির বিয়েতে প্রভাত দিদিকে “আই লাভ ইউ” বলেছিল। সেই নিয়ে ক্যাঁচাল হল অনেক৷ প্রভাতের মা সবার সামনে চেঁচিয়ে বলল, “ওই মাগি আমার ছেলের মাথা খেয়েছে, মাই সন ইজ় পারফেক্ট।”
প্রভাত যা যা কুকীর্তি করেছে, সেগুলোর জন্য মা তাকে একবারও শাসন করতে আসেনি।
“মাই সন ইজ় পারফেক্ট।”
প্রভাত জানে না, তার অবচেতন মন শাস্তির অপেক্ষা করছে।
“মা, মা, আমি এখনও পারফেক্ট? মা, আই হেট ইউ। মা, আই হেট ইউ।”
কিন্তু কাল আবার মা-কে ফোন করে “লাভ ইউ, মম” বলবে ঠিকই৷ রোজই বলে একবার।
প্রভাত কাঁপতে থাকে ঘুমন্ত অবস্থায়।
৫
ভোরে কেউ খঞ্জনি বাজাচ্ছে। নীচের রাস্তা থেকেই আওয়াজ আসছে।
মুঁ শ্রীক্ষেত্রবাসী
মুঁ শ্রীক্ষেত্রবাসী
মুঁউউউ শ্রীক্ষেত্রবাসী
বাকি কথাগুলো বোঝা যায় না। সুস্মিতার তন্দ্রাটা পুরো কেটে গেছে। ঘুম হয়নি সারারাত। ও বিছানা থেকে নেমে পড়ল। শুয়ে শুয়ে পচতে ভালো লাগছে না।
আজ শেষ দিন।
রুমের পুঁচকে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। আশপাশে অনেকগুলো বাড়ি, বেশির ভাগই হোটেল অথবা ধর্মশালা। দুটো বিল্ডিং-এর ফাঁক দিয়ে একটু সমুদ্রতট দেখা যাচ্ছে বটে। বালি চিকচিক করছে।
ডানদিক থেকে কাশির আওয়াজ শুনতে পেয়ে সুস্মিতা ঘুরে দেখল, গৌরব পাশের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তার সিগারেটটা লুকোনোর চেষ্টা করছে। পারেও বটে ছেলেটা।
সুস্মিতা দেখে ফেলেছে বলে লুকোনোর হাল ছেড়ে দিল গৌরব।
“মর্নিং, সুস্মিতাদি।”
“আরেকটা হবে নাকি?” সুস্মিতা চোখ নাচায়।
“কী? না? আমি সিগারেট খাই না তো তেমন।”
“গুল কম মারবি, একটা ছুড়ে দে এদিকে। আরে, জ্বলন্ত সিগারেটটা ছুড়তে যাচ্ছিস কেন? হিহিহি। প্যাকেট থেকে আরেকটা দে।”
গৌরব ছুড়তে গিয়ে আন্দাজে ভুল করে ফেলল। সুস্মিতার মাথার উপর দিয়ে ব্যালকনি পেরিয়ে নীচে কোথাও হারিয়ে গেল।
“যাহ্।”
গৌরব আরেকটা ছুড়তে যাচ্ছিল, সুস্মিতা দু-হাত তুলে বলল, “থাক, আরও বেঁড়েপাকামো করতে হবে না। আমার রুমে আয়। লাইটার থাকলে আনিস, আমারটায় গ্যাস শেষ। দেশলাইয়ে তেমন সুবিধা করতে পারি না।”
গৌরব যে ইতস্তত করল না, তা নয়। তবে শেষমেশ ব্যালকনি থেকে নিজের রুমে ঢুকে গেল।
এক মিনিট পর গৌরব আর সুস্মিতা এই রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। সুস্মিতা চোখ বুজে টান দিচ্ছে, যেন তামাকের পুরো মৌতাত নিজের শরীরে শুষে নিতে চায়। আগের রাতে অল্প কাজল পরেছিল, সেটা চোখ দুটোকে ঢেকে রেখেছে ছায়ার মতো। পাতলা ঠোঁট গোলাপি, অল্প ফেটে গেছে। একটা-দুটো চুল গালে লতার মতো জড়িয়ে রয়েছে। গলা ঘামে চিকচিক করছে। হাত দুটো মসৃণ।
গৌরব বলে, “তোমাকে একটা জিনিস দেখাব, সুস্মিতাদি।”
“ম্মম…” সুস্মিতা এখনও চোখ বুজে। ওর সামান্য ফাঁক-করা ঠোঁট দুটো থেকে ধোঁয়া পাক খেয়ে বেরিয়ে আসছে শীতের কুয়াশার মতো। কাল কীসের একটা স্বপ্ন দেখেছিল। সমুদ্রের গভীরে প্রবালের জগতে শ্যাওলাগুলো শুঁড়ের মতো তাকে জড়িয়ে রেখেছিল, আদর করছিল। বলছিল, সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে। প্রবালের প্রাচীর পেরিয়ে একটা খাদ। সেই খাদে বিশাল এক শহর। সুস্মিতার শরীরে শ্যাওলা জমতে শুরু করেছিল। ওর স্তনবৃন্তে দুটো সাগর কুসুম ফুটছিল। পিঠে প্রবালের সারি। দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অভাবনীয় সুখানুভূতি।
“জয় জগন্নাথ!”
কয়েকজন তীর্থযাত্রী চান করতে সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে।
“বলো জয় জগন্নাথ।”
বাঙালি। দেখে বোঝা যায়।
“কী দেখাবি যেন বলছিলি?” সামান্য জড়ানো গলায় সুস্মিতা জিজ্ঞেস করে।
দাঁতে সিগারেটটা কামড়ে ধরে গৌরব পকেট থেকে চাকতির মতো কয়েকটা জিনিস বার করে সুস্মিতার হাতে ধরিয়ে দেয়।
“বাহ্, সুন্দর আর্ট তো। কোথা থেকে পেলি?”
গৌরব রঘুরাজপুরের সব কথা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সুস্মিতাকে বলল। কাল রাতের অদ্ভুত ঘটনাটাও।
“তুইও কয়েক পেগ টেনেছিলি, বল?”
“সুস্মিতাদি, আমি ইয়ারকি মারছি না, ব্যাপারটা সিরিয়াস।”
“আরে, মনের ভুল হতেই পারে, গৌরব। ডোন্ট বি সিলি।”
“কালকে সন্ধ্যার ব্যাপারটাও পুরোটা মনের ভুল?”
সুস্মিতার মুখ কালো হয়ে গেল, “নট ফানি।”
“তোমার শঙ্খটা কোথায়?”
সুস্মিতার শরীর কাঠের মতো আড়ষ্ট হয়ে গেছে।
“খালি শঙ্খ শঙ্খ করছিস কেন সাতসকালে?”
“একবারই তো বললাম।”
“এমনি একটা সুভেনিরকে নিয়ে এত মাথাব্যথা।”
সুস্মিতা মিথ্যেটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। পারলে সারাজীবন এই মিথ্যেকে বয়ে নিয়ে বেড়াবে।
“আচ্ছা, শঙ্খের কথা বাদ দাও। তুমি তাসগুলো দ্যাখো।”
সুস্মিতা অদ্ভুতদর্শন গঞ্জাপার তাসগুলো মন দিয়ে দেখল। তারপর শতনেত্রকের তাসটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
“চেনা-চেনা লাগছে তো? লোকটা বলেছিল প্রাগৈতিহাসিক কোনো ধর্মের দেবতা। আর কিছু ডিটেইলস জানলেও আমাকে বলেনি।”
দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
“তুমি শঙ্খটা ঠিক কোথা থেকে পেলে?”
“আমার মাথাটা ধরেছে। তুই এইবার আয়।”
গৌরব হঠাৎ সুস্মিতার কাঁধ দুটো ঝাঁকিয়ে বলল, “সুস্মিতাদি, হোয়াটএভার ইজ় গোয়িং অন হিয়ার, এইভাবে জীবনের উপর হাল ছেড়ে দিয়ো না। প্লিজ়। প্লিজ়। প্লিইজ!”
শেষ প্লিজ়টা গলা থেকে চিৎকারের মতো বেরিয়ে এল। আহত হরিণের ডাক।
“মর্নিং।”
প্রভাত অন্য ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। আদুড় গা, পেটানো চেহারা। নাকে সেই ব্যান্ডেজ। আজ নাকের আশপাশের চামড়া আরও কালো দেখাচ্ছে।
সুস্মিতা কিছু না বলে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
***
“কখন এল?” গৌরব রুমে ঢুকতেই প্রভাত ছেঁকে ধরল।
“আমিই কাল নিয়ে এসেছি।” গৌরব উত্তর দিল।
“কোথায় ছিল?”
প্রভাত হাত নাড়িয়ে কিছু একটা অস্পষ্ট, অর্থহীন ইশারা করল, তারপর কিছু না বলেই প্রভাতের পাশ কাটিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। নীলিমা এখনও ঘুমোচ্ছে। হাঁ-করা মুখ, নাক ডাকছে।
প্রভাতের চোখ দুটো লাল। তাকিয়ে আছে গৌরবের দিকে। চোয়াল শক্ত।
“ঠিক আছে তো এমনি?”
“হ্যাঁ, সুস্মিতাদি ঠিক আছে।” গৌরব ইচ্ছে করে নামটা বলে। জোর দিয়ে। প্রভাত কুঁকড়ে যায়।
মিনমিন করে “মুখ ধুই।” বলে বাথরুমে ঢুকে পড়ে।
সুস্মিতাদি কী করবে? প্রভাতদাকে দেখে আবার পালিয়ে যাবে না তো? ঝট করে রুম থেকে বেরিয়ে সুস্মিতাদির দরজায় টোকা দেয় গৌরব।
সুস্মিতাদি সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খোলে। “আছি রে আমি, চিন্তা করিস না৷ কোথাও পালিয়ে যাব না।”
গৌরবের কণ্ঠাটা দুলে ওঠে।
“আমি আসছি একটু পর।’’
“আসিস।”
“আমার সঙ্গেই বেরোবে।”
সুস্মিতা মুচকি হেসে গৌরবের গাল টিপে দেয়।
“যা তুই। চিন্তা করিস না।”
গৌরব আবার নিজের রুমে যখন ঢোকে, তখন নীলিমা জেগে গেছে।
উশকোখুশকো চুল। লিপস্টিকটা ধেবড়ে গেছে। ঘুম হয়নি ভালো করে, বোঝায় যাচ্ছে। চোখ দুটো হালকা লাল।
প্রভাতদা এখনও বাথরুম থেকে বেরোয়নি।
“কোথায় গেছিলি সকালবেলা?” নীলিমা ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করে।
“সুস্মিতাদির রুমে।”
“ওহ্, হ্যাঁ। আমার একটা টপ ওই ঘরে থেকে গেছে বোধহয়। আজ আমি আর তুই ওই ঘরে শিফট হয়ে যাই, চল।”
“সুস্মিতাদিকে জিজ্ঞেস করছি তোমার টপের কথা।”
“সুস্মিতাকে কী জিজ্ঞেস করবি…” নীলিমার বুঝতে একটু সময় লাগল, “ওহ্।”
“হ্যাঁ,” গৌরব শুকনো গলায় বলল, “দেখা করতে গিয়েছিলাম এখন।”
নীলিমা কিছু বলল না। মুখ গোমড়া করে মোবাইল ঘাঁটতে শুরু করল।
ঠিক এই সময় প্রভাতদা বাথরুম থেকে বেরিয়ে, লম্বা একটা আড়মোড়া ভেঙে বলল, “তবে আজকের কী প্ল্যান?”
নীলিমা চোখ নাচিয়ে বলল, “শুনেছিস?”
“দেখেছিও।” প্রভাতদা বলে, “ওইসব বাদ দে। তার থেকে চল, তিনজনে ঘুরে আসি।”
“সিরিয়াসলি?” গৌরব আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারল না। “সিরিয়াসলি, প্রভাতদা? পাশের ঘরে তোমার ফিয়ন্সে একা রয়েছে, আর তুমি এখানে আমাদের সঙ্গে ঘোরার প্ল্যান করছ!”
প্রভাতদা হাসি-হাসি মুখ রেখে বলল, “বেড়াতে যখন এসেছি, ঘুরেই নিই-না। তারপর বাড়ি ফিরে দেখা যাবে সব।”
“সুস্মিতাদির সঙ্গে তোমার বিয়ে হওয়ার কথা, প্রভাতদা। ঝামেলা হওয়ার পর একবারও আর কথা বলার চেষ্টা করেছ?’’
“করেছিলাম, ফোনে, গালি দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে।”
“ব্যাস, একটা কল?”
“উফফ, তুই বড়োদের ব্যাপারে এইভাবে নাক গলানো—”
“হ্যাঁ, বড়োদের ব্যাপারই তো। চিট তো বয়সে বড়ো লোকেরাই করে।”
“গৌরব, বাড়াবাড়ি করছিস কিন্তু এবার।” নীলিমার চোখ দুটো জ্বলে ওঠে।
“আর দিদি, তুইও প্রভাতদার সঙ্গে ড্যাংড্যাং করে ঘুরছিস। আবার সারাক্ষণ বলতিস সুস্মিতাদি তোর বিএফএফ।”
প্রভাতের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। কপালের রগটা দপদপ করছে অল্প।
“তোর যখন এতই ফাটছে,” প্রভাত চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “যা-না, যা৷ সুস্মিতার সঙ্গে ঘোর। সকালে তো দেখলাম, মাখামাখি করছিলি সিগারেট হাতে।”
“অবভিয়াসলি দিদির সঙ্গেই থাকব, প্রভাতদা।” গৌরব অনুকম্পার হাসি হেসে উঠে দাঁড়াল, “তোমাদের সঙ্গে ঘুরতে আমার ঘেন্না করছে। বমি করে দেব, মনে হচ্ছে।”
নীলিমা কথাগুলো শুনে কেমন হতভম্ব হয়ে গেল। নিজের ভাই, সে এইরকম একটা কথা বলে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। “গোরু…”
“আর শোন,” প্রভাত চ্যাঁচাচ্ছে এইবার, “আমার হবু বউকে বলে রাখিস, এই নাকের ঘুসির বদলা আমি নেব। ওহ্ ইয়েস। আমি কার ছেলে, সেটা বোধহয় ও ভুলে গেছে। খুব আদরে ছিল তো এতদিন, সতী মাগিটা। কলকাতায় ফিরি…”
চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে প্রভাতের গলা ভেঙে গেল, কিন্তু ঘর থেকে বেরোনোর সময় গৌরব একবারও পিছন ফিরে তাকাল না।
নীলিমা হাঁটু দুটো জড়ো করে চিবুকের নীচে টেনে এনেছে। সে বলল, “একবার কি যাব?”
“যা,” প্রভাত খোনা গলায় উত্তর দিল, “সবাই চলে যা ওর কাছে। আফটার অল, ওর তো কোনো ফল্ট নেই, তা-ই না?”
“উফফ, আমি কি কারও ফল্টের কথা তুলেছি?”
প্রভাত গজগজ করতে করতে জামা কাপড় বদলাতে শুরু করল।
নীলিমা কিন্তু বিছানা থেকে নড়ল না৷ চুপ করে বসে রইল, দৃষ্টি রুমের বন্ধ দরজার দিকে। একচিলতে রোদ দরজার নীচের মেঝেতে হুটোপুটি খায়৷
আজ দিনটা সুন্দর।
৬
কচুরির তরকারিটা টক-টক। তার উপর খুবই ঝাল। গৌরব কয়েকবার মুখে দিয়েই হুসহাস করতে শুরু করেছে। সুস্মিতা দিব্যি গিলছে। বড্ড খিদে পেয়েছে ওর। কাল রাত থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। গৌরবেরও না। ওদের সামনে বড়ো বড়ো কড়াইয়ে অনেকগুলো খাজা তেলের সমুদ্রে সাঁতার কাটছে। ভাজা ময়দার গন্ধে চারদিক ম ম। মাছির মতো লোক জমছে নাম-না-থাকা এই দোকানটায়। লোকাল থেকে টুরিস্ট, সবাই।
“সারাদিন কী করবি, ঠিক করলি?” সুস্মিতা তার ঝোল-মাখা অনামিকাটা চুষে মুখ থেকে বার করে জিজ্ঞেস করল।
গৌরব ঠোঁট ওলটায়৷ প্রভাতের কথাগুলো ওর কানে বাজছে। তলপেটটা গুড়গুড় করছে অল্প। সুস্মিতাকে এখনও কিছু বলেনি।
“প্ল্যান না থাকলে ওদের সঙ্গে ঘুরে আয়-না।” সুস্মিতা বলে, “আমি প্রমিস করছি, নিজের রুমে মটকা মেরে পড়ে থাকব।”
এত দুশ্চিন্তার মাঝেও গৌরব হেসে ফেলল, “ওদের সঙ্গে ঘোরার ইচ্ছে নেই। এমনি বিচের আশপাশে হেঁটে কাটিয়ে দিই। মিত্র কাফেতে খাবা?”
“বাবা, ট্যাঁকে অত পয়সা নেই।”
“ধুর, ম্যানেজ হয়ে যাবে।”
“নাহ্, নাহ্। থাক। দাঁড়া, আমি গুগ্ল ম্যাপে ভালো খাওয়ার জায়গা দেখছি।”
দুজনে এইভাবে আজেবাজে কথা বলতে বলতে ছয়-ছয়খানা কচুরি খেয়ে ফেলল। ততক্ষণে গৌরবের চোখ থেকে জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
“ডান হাত দিয়ে চোখ মুছতে যাস না। হিতে বিপরীত হবে।” সুস্মিতা বলে।
গৌরবের হঠাৎ মনে হয়, এই স্মৃতিটা না, ওর অনেকদিন মনে থেকে যাবে। অনেক, অনেকদিন। এইরকম তুচ্ছ স্মৃতিগুলো মেঘলা দিনের রোদের মতো মৃত্যুর দিকে পথযাত্রাটাকে সহনীয় করে তুলবে।
বর্তমানের আকাশে চড়া রোদ। দুজনে খাবারের দাম মিটিয়ে গোল্ডেন বিচের দিকে রওনা দিল।
***
প্রভাত কোথাও ঘুরতে যায়নি। নীলিমা বলল, ওর মাথা ধরেছে। বিছানায় শুয়ে থাকবে সারাদিন। প্রভাত তাই জামাকাপড় পরে বেরিয়ে এসেছে হোটেল থেকে।
রাস্তায় লোকজন তাকাচ্ছে প্রভাতের দিকে। নাকের ব্যান্ডেজটার উপর। প্রভাতের মুখ কালো। মনে হচ্ছে, কিছু কিছু লোক ভাবছেও, ‘শালা মুখপোড়া বাঁদর।’
প্রভাতের ইচ্ছে করছে, এদের কয়েকজনকে পিটিয়ে তক্তা করে দিতে। একসময়ে জিম ফ্রিক ছিল৷ এখন আর যায় না, তবে শরীর এখনও মজবুত। প্রভাতের জীবনে প্রাচুর্যের সীমা নেই, তবু তেতো লাগে সব।
স্মিতা কোথায়?
স্বর্গদ্বারে সর্বদা ভিড়। প্রভাত ভেতরে ঢোকে না। ওর ক্রিপি লাগে জায়গাটা। মৃত্যুকে নিয়ে এত আড়ম্বরের কী প্রয়োজন ও বোঝে না। প্রভাত ইঁদুরের মতো পালিয়ে আসে।
বিচে ভিড়। এটিভি ভাড়া পাওয়া যায়। বালির উপরে শ্বাপদের মতো হিসহিস করে এগিয়ে যাচ্ছে এটিভিটা। ড্রাইভার সিটে একটা বাচ্চা ছেলে। কালো চশমা পরে আছে, বয়স ১৫-ও হবে না। “লুক, মামি, লুক।” বলে ছেলেটা এটিভিটা একটা উটের ঘাড়ের উপর তুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে হইহই, জটলা। কে একজন এই যুগে ভুভুজেলা বাজাচ্ছে।
প্রভাত এই সার্কাসের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাহ্, এই ভিড়ভাট্টা-চ্যাঁচামেচিতে সুস্মিতা থাকবে না। ও বেশির ভাগ সময় শান্ত জায়গা পছন্দ করে।
প্রভাত আবার সুস্মিতাকে খুঁজছে কেন? ও নিজেও আসলে জানে না। নাকে ভোঁতা ব্যথা, চোখে যেন কেউ পেরেক ঠুকছে ক্রমাগত। কী যেন একটা না-পাওয়ার তাগিদ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে।
লাইটহাউসটার দিকে হাঁটতে হাঁটতে ওদের অবশেষে দেখতে পেল। দুজনে পাশাপাশি বালির উপর হাঁটছে। খালি পায়ে। হাতে বেশ কয়েকটা ক্যারি ব্যাগ। গৌরবের অঙ্গভঙ্গি কেমন বদলে গিয়েছে। নিজেকে গুটিয়ে রাখছে না আর, ছয়ফুটিয়া শরীর আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে যেন। চারটে পায়ের পাতা স্নিগ্ধ হাইরোগ্লিফ ফেলছে তপ্ত বালির উপর।
শালা তাল গাছচোদা শকুনটা তো সুযোগ বুঝে লাইন মারতে শুরু করেছে স্মিতাকে।
“মেন আর প্রিডেটর বাই নেচার, প্রভাত।” বাবা প্রভাতের কানে ফিশফিশ করে বলে, “উই টেক অ্যান্ড টেক, অ্যান্ড দ্যাট’স দ্য রুল।”
প্রভাত ওদের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে হাঁটতে থাকে। কোনো প্ল্যান নেই, কিছু নেই, শুধু ওদেরকে চোখে চোখে রাখতে চায়।
সুস্মিতা হাত নেড়ে নেড়ে কী সব বলছে। আজকে গাঢ় লিপস্টিক পরেছে। প্রভাত বারণ করে, তাও শোনে না। কেমন বিশ্রী লাগে অত মেকআপ করলে।
বাবা আবার পিছন থেকে বলে, “শি লুকস লাইক এ হোর। এইরকম সস্তা রুচির মেয়েকে আমি বাড়িতে তুলতে দেব না।”
“অব কোর্স, বাবা।”
“ফিক্স ইট।”
শেষ কথা দুটো কানে আসতেই কুঁকড়ে উঠল প্রভাত। বাবার মেটাল স্কেলের আওয়াজ শুনতে পায়। কাঠের স্কেল বাতাস কাটলে যেরকম আওয়াজ হয়, মেটাল স্কেলের আওয়াজ সেইরকম হয় না। মেটাল স্কেলের বাতাস কাটার আওয়াজ অনেকটা ঠান্ডা, অনেকটা ক্রূর। চামড়া কাটতে ভালোবাসে এই স্কেল।
“উই চ্যাটার্জি মেন ফিক্স আওয়ার মিসটেকস। ফিক্স ইট।”
কিন্তু এই ঝামেলা ‘ফিক্স’ কী করে করবে, প্রভাত বুঝতে পারছে না।
এই বিয়েতে কারও মত ছিল না। না প্রভাতের মা-বাবার, না সুস্মিতার৷ তবু দুজনে প্রায় বুলডোজ়ারের মতো সমস্ত বাঁধার পাঁচিল ভেঙে এই জায়গায় এসেছিল। তারপর অনেকটা পয়সা খরচ করে একটা এনগেজমেন্ট পার্টিও হয়ে গেছে। না, বিয়ের রেজিস্ট্রি এখনও হয়নি, তবু বাবা যে খুব একটা খুশি হবে, তা তো মনে হয় না। সবাই এসেছিল তো এনগেজমেন্ট পার্টিতে। মামানরা, কাকুরা, বাবার হেডকোয়ার্টারের কিছু মাই ডিয়ার অফিসার, মায়ের ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজ়েশনের কিছু ম্যানেজার গোছের লোক, কলকাতা পলিটিক্সের বাঘা বাঘা মানুষ।
আর এখন নাকি এই বিয়ে ভেঙে যেতে পারে। কারণ? ছোটো কয়েকটা মিসটেকের জন্য। কে জানত, সুস্মিতা প্রভাতের মোবাইল ঘাঁটতে যাবে?
সুস্মিতা নীচু হয়ে বালি থেকে কী একটা তুলে গৌরবের হাতে তুলে দেয়। প্রভাত বুঝতে পারে বিয়ে ভাঙাটাই শুধু একমাত্র সমস্যা নয়। সুস্মিতা কারণ হিসাবে এইসব চিটিং-এর কথা তুললে অল্প জলঘোলা হতে পারে। মিডিয়ার লোক অনেক সময় ছোঁকছোঁক করে এইসব রসালো খবরের জন্য। প্রভাতের পেট মুচড়ে ওঠে।
শালা, এই গরমে বালিতে হাঁটছে কী করে এই দুজন?
দুজন যেন প্রভাতের কথা শুনেই ডানদিকে ঘুরে যায়। বিচের পাশে অনেকগুলো ছোটো ছোটো রেস্তোরাঁ আছে। সেগুলোর একটাই ঢুকে যায়।
প্রভাত রোদের নীচে বেবুনের মতো সামনের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকে। সুস্মিতা খেতে অনেকক্ষণ নেবে। পাশের একটা রেস্তোরাঁতে প্রভাত কিছু তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে পারে, তারপর আগের মতো অনুসরণ করা যাবে। কিন্তু অনুসরণ কেন করছে, সেটা এখনও স্পষ্ট নয় ওর নিজের কাছেই।
প্রভাতের হঠাৎ মনে হল, সমুদ্র ওর পায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। অসংখ্য চোখ নিয়ে। চোখগুলো বলছে, “অনেক কষ্ট বুঝি তোমার?”
পলক ফ্যালে একবার। চোখে ধাঁধা লেগেছে রোদের। চারদিক কেমন সাদা। প্রভাত টলমল পায়ে একটা রেস্তোরাঁতে ঢুকে যায়।
***
বিরিয়ানি এত শুকনো যে রায়তা মেখেও খাওয়া যাচ্ছে না। সুস্মিতা আলুটা ভাঙতে গিয়ে দ্যাখে, একটা দিক সেদ্ধই হয়নি। গৌরব নান অর্ডার দিয়েছে। সেটাও যে আহামরি কিছু হয়নি, সেটা ওর চিবোনোর ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছে।
“বাবা রে, মিত্র কাফে গেলেই হত।” সুস্মিতা ফিশফিশ করে বলল, “কিন্তু যা দাম দেখলাম…”
গৌরব কিন্তু “বলেছিলাম তোমাকে” জাতীয় কিছু না বলে মিচকি হাসল।
এতক্ষণ দুজনে বিচে ঘোরাঘুরি করছিল। একবার এটিভিতে চেপেছিল সুস্মিতা, কিন্তু ওইভাবে গাড়ি চালিয়ে তেমন মজা পায়নি। তাই বাকিটা সময় দুজনে কেনাকাটি করে কাটাল। আরেকবার জগন্নাথ মন্দিরের দিকে যাওয়ার কথা উঠেছিল (পুরীতে আসার প্রথম দিনেই চারজন একবার ঘুরে এসেছিল), কিন্তু সেই প্ল্যান ক্যানসেল করে তারা এই রেস্তোরাঁতে খেতে ঢুকেছিল। অতঃপর…
দুজনে কোনোরকমে অল্প খেয়ে, অল্প ছড়িয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এল। বাইরের জগৎটা আরও তেতে গেছে।
“বাপ রে, এই গরমে হাঁটব কী? হোটেলে ফিরে যাই, চলো।”
“দাঁড়া-না। আরেকটু এগোয়। ওইদিকটাই একদম লোকজন নেই। পুরো ফাঁকা। বিচ সুন্দর না হলেও সমুদ্র আছে তো। অল্প গা ভিজিয়ে আসব।”
“তারপর এতটা রাস্তা ভেজা জামাকাপড়ে হেঁটে আসব? ঠান্ডা লেগে যাবে, সুস্মিতাদি।”
সুস্মিতা খুব সিরিয়াস মুখভঙ্গি করে গৌরবের চোখে চোখ রেখে বলল, “গৌরব ভাইটি, আপনি খুব বেশি চিন্তা করেন।”
“হুমম।”
“ঠান্ডা লাগলে লাগবে, সে পরের কথা।”
“হুমম।”
“আগে অল্প বেঁচে নিতে শিখি দুজনে।”
“হুমম।”
গৌরবের গাল টিপে সুস্মিতা লাইটহাউসের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
আজ শঙ্খের কথা সুস্মিতার মাথায় এল না। সমুদ্র থেকে চোখগুলো আর ডাকল না। ওর ভেতরের বিষকে অন্য কেউ যেন টেনে নিচ্ছে।
আজ সমুদ্র বড্ড নীল।
***
শিব আর পার্বতী শুয়ে রয়েছে বালিতে। একে অপরকে আলিঙ্গন করে। কারও স্যান্ড আর্ট। দেখতে মন্দ নয়। অন্য সময় হলে প্রভাত ক্যামেরা বার করে পটাপট ছবি তুলতে শুরু করত।
(স্মিতা, এইভাবে দাঁড়াও। উঁহুঁ, ওইভাবে না। কাঁধটা উঁচু করো। এইদিকে তাঁকাও। পারফেক্ট। বালির উপর হাত রাখো। আরে, কিছু বলবে না, রাখো-না তুমি।)
একটা ফোটোগ্রাফির পেজ আছে ফেসবুকে। আর ইনস্টাগ্রামে বই রিভিউয়ের। ভালোই সোশ্যাল প্রেজ়েন্স। সেই তুলনায় সুস্মিতার সেইরকম প্রেজ়েন্স নেই, পোস্টও কালেভদ্রে করে৷ সুস্মিতা অনলাইন জগৎ থেকে হারিয়ে গেলে কেউ বুঝতেও পারবে না।
রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে একটা ঠ্যালাগাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল প্রভাত। সুস্মিতা আর গৌরব তাদের রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এলে, আবার পিছু নিয়েছে।
স্যান্ড আর্ট পেরিয়ে, লাইটহাউস পেরিয়ে অনেকটা পথ চলে এসেছে ওরা। বিচে মানুষ নেই। নুলিয়াদের নৌকাগুলো উলটো হয়ে শুয়ে রয়েছে, সানবাথ করছে। অস্পষ্ট আঁশটে গন্ধ চারদিকে।
বালিয়াড়ির মতো ঢেউখেলানো সমুদ্রতট। সেই বালির ভাঁজে সুস্মিতা আর গৌরব হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রভাতের মাথাব্যথা করছে প্রচণ্ড। মাঝে মাঝে কালো কালো ছোপ দেখতে পাচ্ছে চারদিকে। হাঁটছে অনেকটা খুঁড়িয়ে। দুজনকে তো আর দেখা যাচ্ছে না। কোথায় গেল?
***
সুস্মিতা ফ্যানি প্যাক আর হাতের ক্যারি ব্যাগগুলো বালিতে রেখে সমুদ্রের দিকে ছুট দিল। গৌরব কিছু বলার আগেই।
তারপর হাসতে হাসতে আলিঙ্গন করল সমুদ্রকে। স্রোতের লোনা জল তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কিচ্ছু হবে না, কিচ্ছু হবে না। দুঃখ আবার আসবে, বারবার আসবে। কিন্তু তবু সুস্মিতার কিচ্ছু হবে না। ঠিক বেঁচে যাবে।
গৌরব কিন্তু ভিজছে না। সুস্মিতাকে দেখছে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে। সুস্মিতা ওর দিকে এগিয়ে হাত ধরে টান দিল।
“আয় বাঁদর, আয় এদিকে। ভয় পাচ্ছিস?”
***
প্রভাত একটা বালির ঢিপি পার হতেই ওদের দেখতে পেল। সুস্মিতা গৌরবের হাত ধরে টেনে টেনে সমুদ্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গৌরবের চোখ-মুখ ভয়ে সাদা।
সুস্মিতা চ্যাঁচাচ্ছে, “কিচ্ছু হবে না। কিচ্ছু হবে না।”
দু-দিন আগে এই মেয়ে ওর নাকে ঘুসি মেরেছিল। সেই বিষের ছায়াটুকু চেহারায় নেই। উজ্জ্বল সব কিছু।
প্রভাত দাঁতে দাঁত চেপে ওদের দুজনকে দেখল। দেখতেই থাকল। মাথায় তার এক মন চিন্তা।
***
ভেজা শরীরে দুজন ফিরছে। আজ যেন উলটো ছবি। গৌরব নিজের মনে কী সব বকে চলেছে। আর সুস্মিতা পাশে চুপ করে হাঁটছে। ওদের পায়ে বালি লেগে রয়েছে আদুরে স্মৃতির মতো।
সুস্মিতা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “গৌরব, তুই কি আমাকে পছন্দ করিস?”
কাছে একটা আস্ত পারমাণবিক বোমা ফাটলেও গৌরব এতটা চমকাত না। আমতা আমতা করে কী বলবে, বুঝতে পারল না সে। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠছে।
“দেখ, আমি একদম জাজমেন্ট ছাড়া জিজ্ঞেস করছি। বল আমাকে। ডু ইউ লাইক মি?”
গৌরব ঢোঁক গিলল, “যাহ্, দিদি। না আমি—”
“কারণ, আমি তোকে ওইভাবে লাইক করি না। বুঝছিস? তোকে ভাই হিসাবে দেখি।”
গৌরবের মনে হল, ওর তলপেটে কে একশোটা ঘুসি মেরেছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
“আমি এখন ইমোশনালি খুবই ভালনারেবল, রে। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তোর মতো একটা ভালো ছেলেকে কোনোভাবে আমি লিড করতে চাই না।”
গৌরব “হুম” বলে থপথপ করে হাঁটতে শুরু করে।
“তুই মাইন্ড করলি?”
“না।” তারপর একটা বড়ো শ্বাস নিয়ে, “না, দিদি।”
“আমি বলছি, তুই শুধু ক্রাশ খেয়েছিস আমার উপর। ওইরকম হয়ে থাকে।”
“হ্যাঁ। তা-ই হয়তো।”
“যাহ্। পুরোটা রাস্তা এইরকম মুখ গোমড়া করে থাকবি?”
“নাহ্, আমাকে জাস্ট সামলাতে সময় দাও একটু।”
“সরি।”
দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে হাঁটল।
“দিদি, ওই শঙ্খটা কই?”
“কেন রে?”
“দাও আমাকে।”
সুস্মিতা বিনা বাক্যব্যয়ে শঙ্খটাকে ব্যাগ থেকে বার করে আনল।
গৌরব সুস্মিতার হাত থেকে শঙ্খটা একপ্রকার কেড়ে নিয়ে সমুদ্রের দিকে ছুড়ে দিল।
“এই, এইইইই,” সুস্মিতা চিৎকার করে উঠল, “আরে অত সুন্দর শঙ্খটা—”
“ফাক ইট।” গৌরব বলল, “বাড়ি গিয়ে ওই তাসগুলোকেও পুড়িয়ে ফেলব শালা। ফাক ইট অল।”
সুস্মিতা মন দিয়ে গৌরবের চোখ দুটো দেখল। কান্না-ভেজা। অনুযোগ, অভিমান, হতাশা জমা হয়েছে অল্প। কিন্তু সুস্মিতাকে গালি দেয়নি। বলেনি, “হোয়াই ডোন্ট ইউ লাইক মি?”
গৌরব নিজেই জানে না ও কত ভালো ছেলে।
বাকি রাস্তাটা দুজনে চুপ করে রইল।
***
প্রভাত এক বোতল জল কিনে মাথায় ঢেলেছে। সমুদ্রের জলে নিজেকে ভেজাতে ইচ্ছে করছে না, কারণ ওইদিকটা কেমন অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে।
চোখ, চোখ, চোখ, স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসছে সমুদ্রতটের দিকে। কারা যেন ডাকছে।
“এই যে এদিকে, এই যে এদিকে।”
গৌরব কী একটা সমুদ্রের দিকে ছুড়ে দিতেই, প্রভাত পা চালাতে শুরু করল। কী ছিল ওটা? কী ছুড়ল শালাটা?
সুস্মিতা আর গৌরব এগিয়ে যেতে প্রভাত সেখানে গিয়ে দাঁড়াল। সমুদ্রের দিকে তাকাতে ভয় করছে, তবুও ভ্রূ কুঁচকে ঢেউগুলোর দিকে তাকাল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চোখগুলো উগলে দিল শঙ্খটাকে। যেন প্রভাতেরই অপেক্ষা করছিল।
ঘোরের মধ্যে তুলে নিল শঙ্খটাকে প্রভাত। খোদাই-করা চোখগুলোয় আরও শ্যাওলা জমে গেছে।
আকাশে সূর্যের নগ্ন তেজ বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে।
শেষ রাত—বিদায় পুরী
টোকা শুনতে সুস্মিতা মাথাটা মুছতে মুছতে দরজাটা খুলল। প্রভাত দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণে প্রায় বিকেল। প্রভাতকে কেমন অসুস্থ দেখাচ্ছে। সুস্মিতা চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইল প্রভাতের দিকে।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর প্রভাত মুখ খুলল, “কিছু বল?”
সুস্মিতা কিছু না বলে, চোখ না সরিয়ে, তোয়ালেটা দিয়ে চুল মুছতে থাকল।
“কিছু বলবি না?” প্রভাতের গলায় আর্তি।
সুস্মিতা এখনও চুপ।
“আচ্ছা, আমিই বলছি। ক্যান উই ডিসকাস দিস আফটার গোয়িং ব্যাক টু কলকাতা? আজকে শেষ দিন, আর এইভাবে আলাদা আলাদা ঘুরতে আর ভালো লাগছে না। ক্যান উই জাস্ট গো সামহোয়্যার কোয়ায়েট? চারজনেই।”
“আমাদের আর কিছু ডিসকাস করার নেই, প্রভাত। দিস…” সুস্মিতা প্রভাত আর নিজের দিকে ইঙ্গিত করে, “দিস ইজ় ওভার। কলকাতায় গিয়ে আর এক্সট্রা নাটকের প্রয়োজন নেই।”
“কাম অন। এইসব কী বলছিস। পাবলিক একটা এনগেজমেন্ট হয়েছে আমাদের। থিংক অ্যাবাউট আওয়ার পেরেন্টস। ইমেজ বলে একটা জিনিস আছে।”
“তোর পেরেন্টস আর সমাজের কথা তুই ভাব, প্রভাত। তাদের সবাইকে বুঝিয়ে বল, হাউ ইউ লাইক টু চিট। আমি তোদের জন্য নিজের পুরো জীবন বিসর্জন দিতে পারছি না।”
প্রভাতের চোখে-মুখে হায়নার মতো ক্রূর কিছু একটা ক্ষণিকের জন্য দেখা গেল। তারপর এক সেকেন্ডের মধ্যেই সেই মুখভঙ্গি একটা মুখোশের আড়ালে হারিয়ে গেল।
এই সেই প্রভাত, যে কিনা ফেমিনিজ়্ম নিয়ে জ্ঞান দিতে আসত। এতদিন একটা পেপার ম্যাশে মুখোশের ঘোরে সুস্মিতা ড্যাংড্যাং করে নাচছিল। পুরীর সমুদ্রের জলে সেই পেপার ম্যাশে গলে যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে প্রভাতের আসল রূপ।
ছি।
প্রভাত নিজেকে সামলে নিয়ে বলছে কিছু।
“…পরে কথা বলা যাবে। আজ সন্ধ্যাতে কোথাও যাওয়া যাক, চল।”
সুস্মিতা তোয়ালেটা প্রভাতের মুখের সামনে ঝেড়ে বলল, “বেশ। তবে তোর অ্যাপলজি আর বিয়ে নিয়ে ঘ্যানঘ্যানানি শুনলে আমি স্ট্রেইট নিজের রুমে চলে আসব।”
প্রভাত হাসে। সেই হায়নার মতো হাসি। সুস্মিতার হঠাৎ মনে হয়, ওকে না বলে দিই। যাব না কোথাও। মাথার মধ্যে লাল বাতি জ্বলছে হঠাৎ।
“এক ঘণ্টা পর বেরুচ্ছি তাহলে।”
সুস্মিতা কথা না বলে প্রভাতের মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দেয়।
***
একটা থার। ড্রাইভার নেই, প্রভাত নাকি নিজেই চালাবে। এত দামি গাড়ি রেন্ট কেন করা হল, সেটা গৌরব বুঝল না।
নীলিমা কথা বলছে না, মোবাইলে রিল দেখছে। সুস্মিতাও চুপচাপ। পিছনের সিটে গৌরবের দু-দিকে এই দুজন। গৌরব অল্প ঘামছে। অস্বস্তিকর একটা ব্যাপার।
প্রভাত গাড়ি চালাচ্ছে। এই গরমেও গায়ে একটা ঢাউস ব্লেজ়ার পরে রয়েছে। “আধা ঘণ্টা লাগবে। রাতটা ভাবছি, বালিঘাইতেই কাটিয়ে দেব। সুন্দর গেস্ট হাউস রয়েছে। কল করেছিলাম।”
নীলিমা এতক্ষণে মোবাইল থেকে চোখ তুলল, “আমাদের লাগেজ-টাগেজ তো ওখানেই থেকে গেল।”
“আরে থাকুক-না৷ এমনিও কালকে পর্যন্ত টাকা দেওয়া আছে।”
“এই নতুন গাড়ির রেন্ট, গেস্ট হাউস—ট্যাঁকে কত টান পড়বে?”
“বাদ দে, ইট’স অন মি।”
“বাবা গো আমাদের গৌরী সেন।”
প্রভাত হাহাহা করে শুকনো হাসি হাসে। দু-দিকে অন্ধকার এখন। অস্পষ্ট সব কিছু। লোকালয় ছাড়িয়ে অনিশ্চিতের দিকে এগুচ্ছে গাড়িটা।
সুস্মিতা চোখ বুজে গান শুনছে। ইয়ারবাড থেকে মৃদু আওয়াজ আসছে, শুনতে পাচ্ছে গৌরব। গৌরবের ঘাড় শক্ত হয়ে রয়েছে, পিঠে যেন লোহার রড ভরা রয়েছে।
একটা ব্রিজ পার হল, হুহুহু আওয়াজ। আরেকটু পরেই আরেকটা ব্রিজ। এটার দৈর্ঘ্য আগেরটার থেকে কম। হুহু আওয়াজ।
গৌরবের ক্লান্তি নেমে আসছে শরীরে। রোদে অতক্ষণ হাঁটল আজ, অভ্যেস তেমন নেই। প্রভাতদা গুনগুন করে গান গাইছে। নীলিমা ঘুমিয়ে পড়েছে।
কীরকম অদ্ভুতভাবে এই ট্রিপটা শেষ হচ্ছে, ভাবছিল গৌরব। আসার সময় ট্রেনে সবাই কী আড্ডাটাই-না মারছিল! চাইনিজ় খাবার পার্সেল করে নিয়ে এসেছিল প্রভাত। ২এ-র একদিকটায় চারজনে বসে খাবার খাচ্ছিল, আর মাঝে মাঝে সুস্মিতা আর নীলিমা খিলখিল করে হাসছিল। কত আলো ছিল সেদিন চারজনের মাঝে। এখন গাড়ির মধ্যে শুধু অন্ধকার। ড্যাশবোর্ডের আলো প্রভাতের মুখটাকে অপার্থিব করে তুলেছে। লোকালয় পেরিয়ে কোন অচিন দেশে এল এবার?
কিছুক্ষণ পর মোহটা ভেঙে যায়। ইলেকট্রিক আলো এসে জানান দেয় এটা অচিনপুর নয়, সাধারণ মরজগৎ। তারপর আবার অন্ধকার ফিরে এল।
গাড়ি ডানদিকে দুবার বাঁক নিয়ে একটা সরু রাস্তা ধরেছে। কাঁচা রাস্তা, অল্প খারাপ, তবে গাড়িতে ঝাঁকুনি তেমন বোঝা যাচ্ছে না। নীলিমা ঘুমের ঘোরে কী একটা বলে। “স্টপ স্মিতা, স্টপ।” অথবা তেমন কিছু।
তারপর অন্ধকার চিরে একটা গেস্ট হাউস, অচিন সমুদ্রের মাঝে। গৌরবের বোধহয় একটু তন্দ্রামতো এসেছিল, কারণ ওর মনে হল, একপ্রকার পাতাল ফুঁড়েই এই গেস্ট হাউসটা ওদের রাস্তা আটকে ফেলেছে।
প্রভাত ইতিমধ্যেই নেমে গেছে গাড়ি থেকে। গেস্ট হাউসের দুজন স্টাফ এগিয়ে আসছিল। লাগেজ তেমন নেই দেখে আবার ফিরে গেল।
সুস্মিতা গাড়ি থেকে নেমে একটা আড়মোড়া ভাঙল।
“কী শান্ত জায়গাটা।”
“তা-ই না?” প্রভাত জিজ্ঞেস করল। কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারল, কথাটা সুস্মিতা গৌরবকে উদ্দেশ করে বলেছে। প্রভাতের মুখ কালো হয়ে যায়। গৌরবের কান দুটো লাল হয়ে গেছে। ভাগ্যিস অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
গৌরব ধাক্কা দিয়ে নীলিমার ঘুম ভাঙায়। প্রভাত গলাটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলছে, “এই মোরাম-বিছোনো রাস্তাটা বেয়ে এগোলেই বালিঘাই বিচ।”
সুস্মিতা উত্তর না দিয়ে গেস্ট হাউসের দিকে পা বাড়ায়। হাউসের জানালার আলো ওর শরীরে পড়ে ওর সৌন্দর্যকে অপার্থিব করে তুলেছে। চতুর্দিক থেকে ঢেউয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। স্নিগ্ধ আবহাওয়া।
“গৌরবভাই,” প্রভাতের গলায় যেন চিনি জমে আছে, “সুস্মিতাদিকে বলে দিস, ডিনারটা আসলে বিচের উপরেই হবে। স্পেশাল ব্যবস্থা করেছি।”
গৌরবের বড্ড অসহায় লাগে। কেন যে রাজি হল আসার জন্যে। এর থেকে পুরীতে থাকলেই ভালো হত। এই নতুন জায়গায় সব কিছু কেমন প্রতিকূল দেখাচ্ছে। অন্ধকারেরও ধারালো দাঁত রয়েছে।
গেস্ট হাউসের একটা বড়ো রুমে রাতে থাকার ব্যবস্থা করেছে প্রভাত। ছয়টা সিঙ্গল বেড। টেবিল, চেয়ার একপাশে। ঘরে অসংখ্য জানালা। একদিকে জ্যোৎস্নাস্নাত সমুদ্রতট দেখা যাচ্ছে। সুস্মিতার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়৷ এত সুন্দর৷ এত একাকী। বালিগুলো চিকচিক করতে করতে আকাশের নক্ষত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অন্ধকারের মধ্য থেকে সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসে।
ব্যাপারটা কত সুন্দর হতে পারত, মধুর হতে পারত। কোনো সমান্তরাল মহাবিশ্বে, যেখানে প্রভাত এতটা নীচ নয়, সেখানে আজকের রাতটা মিষ্টি হতে পারত। সুস্মিতার বুকটা হুহু করে ওঠে।
অবুঝ মন, তুই কিছু বুঝতে চাস না।
সমুদ্র গর্জিয়ে সায় জানায়।
নীলিমা, গৌরব, প্রভাত একে একে রুমে ঢুকল। মৃদুস্বরে কিছু কথা। চুপচাপ নিজেদের গুছিয়ে নেওয়া। মুখ ধোয়া। জুতো থেকে বালি ঝাড়া। রুমটার তাপমাত্রা যেন মেরুদেশের মতো। নীলিমা কেঁপে কেঁপে ওঠে।
এক ঘণ্টা পর যখন ওরা সমুদ্রতটে নামল, তখনও সেই নিস্তব্ধতা চারজনকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।
গেস্ট হাউসের লোকেরা বালির উপর গালিচা পেতে তার উপর পেল্লায় একটা টেবিল বয়ে এনেছে। চারটে সরু সরু, সাদা চেয়ার। উপরে একটা ছাউনির ব্যবস্থা, সেখান থেকে ব্যাটারিচালিত কতকগুলো লন্ঠন ঝুলছে। একপাশে একটা লম্বা স্ট্যান্ড ফ্যান। হুইস্কির ব্যবস্থা হয়েছে। গেস্ট হাউসের ম্যানেজার বারবার ক্ষমা চাইছে, ওয়াইনের ব্যবস্থা করতে পারেনি।
সুস্মিতার বিরক্ত লাগছে। হায় তুলছে বারবার। প্রভাত কেন জানি, সমুদ্রের দিকে তাকাচ্ছে। ওর চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, যেন অনেকটা নেশা করেছে ও।
ডিনার সেল্ফ সার্ভ।
নীলিমা মাটন সবার পাতে দিচ্ছিল, এমন সময় প্রভাত হুইস্কি খেতে খেতে প্রায় চিল্লিয়ে বলল, “ওহ্, ফর গড’স সেক, আমরা কি একটাও কথা বলব না।”
“উফফ, প্রভাত, প্লিজ়। তোর এই ঘ্যানঘ্যানানি আর ভালো লাগছে না।” নীলিমা অনেকটা ঝোল প্রভাতের হাতেই ঢেলে দিল।
“ঘ্যানঘ্যানানি কী করলাম? আরে এতদূরে যখন এসেছি, এত সুন্দর জায়গা, সবাই মুখ গোমড়া করে বসে থাকব?”
সুস্মিতা মাটনের একটা ছোটো টুকরো চিবুতে চিবুতে বলল, “বেশ, যখন কথা বলার এতই ইচ্ছে, তুইই বল-না কিছু।”
প্রভাত আসলে আশা করেনি, সুস্মিতা মুখ খুলবে। তাই একটু থতোমতো খেয়ে গিয়েছিল। নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে বলল, “আমি তো বলতেই চাইছিলাম তোর সঙ্গে কথা, কিন্তু তুই বললি আর বলার মতো কিছু নেই।”
“সেই বিষয়ে বলার মতো কিছু সত্যিই নেই। ওটা ছাড়াও অনেক সাবজেক্ট আছে বকবক করার।”
গৌরব কাশছে। নীলিমা তাড়াতাড়ি ওর গ্লাসে জল ঢেলে দিল।
“বলার কিছু নেই কেন? হোয়াই?”
“তুই আসলে ঝগড়াই করতে চাস, বল? তাই এতদূর টেনে এনে এত ড্রামাটিক হচ্ছিস। এর থেকে পুরীর হোটেলেই আরেক রাউন্ড চেঁচিয়ে নিতাম তিনজনে। গৌরবকে বেকার টেনে আনলি।”
“ওহ্, গৌরব। খালি গৌরব। ফাক গৌরব।”
“মুখ সামলে!” কথাটা নীলিমার দিক থেকে এল। ওর চোখ দুটো বাঘিনির মতো জ্বলে উঠল, “আমার ভাইকে এইসব ঝামেলা থেকে বাইরে রাখ প্রভাত।”
“রাখতেই তো চাই। তোর ভাইই তো আমার ফিয়ন্সের গায়ে ঢলে ঢলে পড়ছে।”
“আমি কারও ফিয়ন্সে নই,” সুস্মিতার হিমশীতল গলায় বলল, “তখনই তো বললাম। গবেট মাথায় ঢুকছে না কথাটা? উই আর ওভার।”
“ওইভাবে বললেই ওভার হওয়া যায় না।” প্রভাতের গলা ভেঙে যাচ্ছে, ব্লেজ়ারের তলায় ঘামছে ও, “এমনভাবে, একটা সামান্য ভুলের জন্য…”
“এটা সামান্য ভুল হলে, বড়ো ভুল কেমন হবে, সেটা ভাবতেই ভয় করছে, প্রভাত। থ্রি সেপারেট গার্লস, তার মধ্যে একজন আমার ‘প্রিয় বান্ধবী’।”
নীলিমা নিজের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে, তার কাঁধ দুটো তিরতির করে কাঁপছে। প্রভাতের শরীরটা ব্লেজ়ারের তলায় যেন গুটিয়ে যাচ্ছে।
“আর এতটাই কনফিডেন্ট, ন্যুডসগুলোও ডিলিট করিস না, বাহ্ রে, বাহ্। আমার মোবাইল দেখবি প্রভাত? এই নে, দেখ। এক্ষুনি গৌরবকে নিয়ে যেমন খোঁটা দিলি, বুঝছি তোর ওয়ার্ল্ডভিউটা তোর প্রেমের সংজ্ঞার মতোই টুইস্টেড। নে, আমার মোবাইলটাও দেখ। দেখে নে, আমি বেশ্যাগিরি করছিলাম কি না।”
প্রভাত হয়তো ভেবেছিল, বালিঘাইয়ের এই নির্জন সমুদ্রসৈকতে গ্র্যান্ড কিছু একটা করবে। হয়তো ভেবেছিল, এই কথোপকথনের লাগাম ওর হাতেই থাকবে, কিন্তু কিছুই পারছে না। সুস্মিতার মনোবল এখনও দৃঢ়, কিছুতেই সেই বর্ম ভেদ করতে পারছে না প্রভাত। এমন অসহায় সে কখনও অনুভব করেনি। মা-বাবা ওকে এইরকম পরিস্থিতিতে পড়তে দেয়নি। নিজের জগতে প্রভাত ভগবান ছিল, ত্রিমূর্তির তিন রূপ ছিল। আজ এই সমুদ্রের জলে সব ধুয়ে-মুছে যাচ্ছে।
প্রভাত হঠাৎ টেবিলে নিজের হাত দুটো মুঠো করে নামিয়ে আনল। প্লেট চামচের ঝনঝন আওয়াজ থেমে যাওয়ার আগেই গৌরবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ও। উন্মত্ত কুকুরের মতো।
“সব তোর জন্য, সব তোর জন্য হল! কে বলেছিল আমার বউয়ের সঙ্গে লটরপটর করতে! ইউ শিট!”
গৌরবের চেয়ার উলটে যেতেই প্রভাত আর গৌরব গালিচায় জড়াজড়ি হয়ে পড়ল, তারপর প্রভাতের একটা ঘুসি গৌরবের চোখে নেমে এল।
নীলিমা আর সুস্মিতা চিৎকার করে দুজনের কাছে গিয়ে প্রভাতকে গৌরবের থেকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করল, কিন্তু তা প্রায় অসম্ভব। পাগল ষাঁড়ের মতো শরীরের পেশিগুলো ফুলে উঠেছে প্রভাতের। মুখে অশ্রাব্য গালাগাল। ঘুসির পর ঘুসি নেমে আসছে গৌরবের মুখে।
“ইউ শিট। ইউ শিট।” গৌরব চেষ্টা করছে ঘুসিগুলো আটকানোর। গলা টিপে ধরার চেষ্টা করছে প্রভাতের, কিন্তু পারছে না।
সুস্মিতা পাগলের মতো গেস্ট হাউসের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করল, “কেউ আছেন? কেউ আছেন? প্লিজ় হেল্প।”
কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ওরা চারজন যেন পৃথিবীর শেষ মানুষ।
সুস্মিতা উপায়ান্তর না দেখে ফ্যানি প্যাক থেকে তার মেস স্প্রে-টা বার করে আনল।
নীলিমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে, প্রভাতের রক্তিম চোখ দুটোয় ঢেলে দিল বিষ। তৎক্ষণাৎ প্রতিকার।
প্রভাতের চিৎকার সমুদ্রের গর্জনকেও ছাড়িয়ে গেল। গৌরবের উপর থেকে সরে গিয়ে মাটিতে শুয়ে একটা আরশোলার মতো হাত-পা ছুড়তে শুরু করল সে।
সুস্মিতা তাও প্রভাতের দিকে আরেক দফা স্প্রে করে দিল।
“শালি,” প্রভাতের মুখ থেকে লালা বেরিয়ে আসছে, চোখ দুটো বন্ধ—“শালি, ভেবেছিস, কলকাতা গিয়ে পার পেয়ে যাবি? এই ঘুসি মারার শোধ নেব আমি। জানিস, আমরা কী করতে পারি? জানিস আমাদের ইনফ্লুয়েন্স? আমি… আমি…”
আর কিছু বলে না প্রভাত। ধুঁকতে থাকে গালিচার উপর৷ কান্না বেরিয়ে আসে গোঙানির মতো।
“গৌরব? এই?” সুস্মিতা গৌরবকে টেনে তোলে।
“আমি ঠিক আছি।” গৌরব জড়ানো গলায় বলে।
“কই, এইদিকে তাকা।”
“আমি ঠিক আছি তো।”
“তুই চল আমার সঙ্গে। গেস্ট হাউসে চল। আমরা আজই পুরী ফেরত যাচ্ছি।”
“না, না। আমি ঠিক আছি। এত রাতে আর কোথায় যাব।”
গৌরব নীলিমা আর সুস্মিতার কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তিনজনে একসঙ্গে গেস্ট হাউসের দিকে হাঁটা দিল, জড়সড়ো হয়ে। নীলিমা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ‘সরি’ বলতেও পারছে না। গলায় যেন মাংসের হাড় আটকে রয়েছে।
গালিচায় শুধু প্রভাত পড়ে থাকে।
“স্মিতা, স্মিতা, কোথায় গেলি? এইভাবে ছেড়ে যাস না।”
সমুদ্র থেকে শতনেত্রক ডাক দেয়। প্রভাতের ব্লেজ়ারের মধ্যে লুকিয়ে-থাকা শঙ্খটা ক্রিক ক্রিক আওয়াজ করে প্রভাতকে উঠে দাঁড়াতে বলে।
“স্মিতা, আমি জানি না আমি এমন কেন।”
কিন্তু কেউ কোত্থাও নেই। শুধু অতল সমুদ্র রয়েছে। আর সমুদ্রের সেই একাকী দেবতা।
অসংখ্য চোখ অন্ধ চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে।
“স্মিতা, তুই কোথায়?”
লন্ঠনগুলো নিবে যাচ্ছে, একে একে।
***
গেস্ট হাউসের লোকগুলো পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ডিনার স্পটে এসে দ্যাখে কেউ সেখানে নেই। অদূরে একটা নুলিয়া একটা বোঝা টানতে টানতে হাঁটছিল, তাকে দেখে একজন স্থানীয় ভাষায় শুধায়, “এখানে কাউকে দেখেছিস?”
নুলিয়াটা ভাঙা গলায় হেসে পরিষ্কার ইংরেজিতে উত্তর দেয়, “No, there is no one here except the sea.”
দূর থেকে শঙ্খের আওয়াজ ভেসে আসছে।
Tags: তৃণময় দাস, দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
