রা রি রুম
লেখক: নয়ন বসু
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ক্রায়োজেনিক চেম্বারের ঢাকনাটা আস্তে আস্তে খুলে যেতে রা চোখে ঝাপসা দেখল। স্পেস প্রোগ্রামের একদম শুরুর দিকে এগুলো পড়ানো হয়, তাই রা ঘাবড়াল না। এই মুহূর্তে ওকে চুপটি করে শুয়ে থাকতে হবে। বেশ খানিকক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হলে সে আস্তে আস্তে উঠে বসবে।
তার হিসেবমতো পৃথিবীর হিসেবের এক বছর সে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। তার সঙ্গে আরও একজনের থাকার কথা। সে কে হতে পারে, রা জানে না। স্পেস কাউন্সিলের নতুন নিয়ম। আগে থেকে ক্রিউ জানানো হবে না। আগে থেকে জানাজানি হলে অনেকে নিজের পছন্দমতো ক্রিউ দাবি করছিল। সেক্ষেত্রে নতুনদের কেউ নিতে চাইছিল না। তাই এই নিয়ম।
রা-ও নতুন। সুতরাং তার কাছে এই নিয়ম অনেকটা আশীর্বাদের মতো। মাথাটা একটু ঘুরছে এবার। সামান্য বমি-বমিও পাচ্ছে। প্রায় তিরিশ মিনিট এভাবে কাটানোর পর রা আস্তে আস্তে উঠল।
উঠে পড়ে সে যে দৃশ্য দেখল, তার জন্য রা প্রস্তুত ছিল না। রা দেখল, ফুটফুটে পরির মতো একটি মেয়ে তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। পৃথিবীতে এত সুন্দর মহিলা থাকতে পারে, রা-এর ধারণা ছিল না। তার মনে হল, অনন্তকাল ধরে সে এই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে পারে।
মেয়েটি একটু বাদে সামান্য অবাক-করা গলায় বলল, “এই প্রথম কাউকে ক্রায়োজেনিক চেম্বার থেকে উঠতে দেখলাম!” বলে মেয়েটি একটা মিষ্টি হাসি হাসল। পুরোনো পৃথিবীর রোগের মধ্যে ডায়াবেটিস বলে একটা রোগের কথা রা পড়েছিল। খুব মিষ্টি খেলে ওই রোগটা হত। রা-এর মনে হল এইরকম হাসি ডায়াবেটিসের আসল কারণ।
পরক্ষণেই ওর মনে পড়ল সে বিবস্ত্র। খুব সম্ভবত রা-কে চমকে উঠতে দেখেই মেয়েটিরও হুঁশ ফিরল। সে মাথা নীচু করে বলল, “আপনি রেডি হয়ে নিন, আমি কনট্রোল চেম্বারে অপেক্ষা করছি। আসলে প্রথমবার তো, কীভাবে একজন মহাকাশচারী ক্রায়োজেনিক চেম্বার থেকে উঠে দেখার লোভ সামলাতে পারিনি।” এই কথা বলে মেয়েটি আবার আগের মতো ডায়াবেটিস করে-দেওয়া হাসি হেসে হল থেকে বেরিয়ে গেল।
রা আরও কিছুক্ষণ সময় নিল ধাতস্থ হওয়ার জন্য। কথা শুনে মনে হচ্ছে এই মেয়েটিও নতুন। সে-ও তা-ই। দুজন আনকোরা মহাকাশচারীকে এত গুরুত্বপূর্ণ মিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে! ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে রা-এর।
ঘণ্টাখানেক সময় লাগল রা-এর পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে। ভিটামিন চেম্বার থেকে ঢকঢক করে একটা জুসের পাউচ গলায় ঢেলে একটু স্বস্তি হল। নীল স্পেস ড্রেসটা পরে আয়নায় নিজেকে দেখে ভালো লাগল। ওর আজীবনের স্বপ্ন ছিল এই ড্রেসটা পরার। আজ সেটা পূর্ণ হল। আয়নার দিকে তাকিয়ে রা একবার তৃপ্তির হাসি হাসল।
কনট্রোল রুমে ঢোকার আগে রা একবার কেশে গলা পরিষ্কার করল। সে সেকেন্ড ইনচার্জ। মেয়েটি তার ক্যাপটেন।
কনট্রোল রুমে ঢুকে রা গম্ভীর গলায় বলল, “স্পেস ক্যাডেটরা রিপোর্টিং টু স্পেসশিপ আগাপি!”
মেয়েটি একবার অবাক চোখে তাকাল। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠল। সে হাসি আর থামতে চায় না। রা একটু বিব্রত বোধ করল। এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, অ্যাকাডেমিতে তাকে শেখানো হয়নি।
বেশ খানিকক্ষণ বাদে হাসি থামিয়ে মেয়েটি বলল, “ও মা, তোমরা সবাই এরকম করে কথা বলো নাকি!”
“ম্যাম, প্রোটোকল তো এটাই!”
“নিকুচি করেছে তোমার প্রোটোকলের, আরেকবার এরকম করে কথা বললে আমি তোমায় স্পেসশিপ থেকে ছুড়ে বাইরে ফেলে দেব! ম্যাম ম্যাম বলে মহাকাশে সাঁতার কাটতে থাকবে। হি হি!”
রা-কে মাথা নীচু করে থাকতে দেখে বোধহয় মেয়েটির দয়া হল। নরম গলায় বলল, “আমি রি। আমরা এখানে দুজন আছি। একসঙ্গে হিসেবমতো আট বছর থাকতে হবে। এমন করে কথাবার্তা বললে আট মিনিটেই আমার দমবন্ধ লাগবে!”
“কিন্তু ম্যাডাম, প্রোটোকল…”
“তোমার মাথা থেকে এই প্রোটোকলের ভূতটা আগে নামাও। আমার এসব ভালো লাগে না। আর ম্যাম কী? রি বলবে আমায়। আমি তোমায় রা বলব।”
“ওকে ম্যা… রি।”
“এই তো, উন্নতি হচ্ছে। গুড!”
রা এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না, ব্যাপারটা কী হচ্ছে। এই মেয়েটি নয় পাগল, নয় মহাকাশযাত্রার অনুপযোগী। সব কিছুর একটা সিস্টেম থাকে। এরকম গুরুত্বপূর্ণ মিশনে এইরকম আধপাগল একটা মেয়েকে পাঠানোর কী মানে?
“রি, আপনি মিশনটা সম্পর্কে কী জানেন?”
“শোনো রা, তোমাদের মিশন-টিশন নিয়ে আমার কোনোই মাথাব্যথা নেই।”
“মানে? তাহলে এসেছেন কেন?”
“তুমি অর্চগসের নাম শুনেছ?”
“অবশ্যই, রি! ওঁর নাম কে না জানে! স্পেস কাউন্সিলের হেডের নাম না-জানাটা একটা অপরাধ আমার মতে!”
“ভদ্রলোক আমার বাবা হন।”
রা-এর মনে হচ্ছিল, সে বিস্মিত হওয়ার শেষ সীমানায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়েটি অর্চগসের মেয়ে! সমস্ত মহাকাশের নিঃসন্দেহে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অর্চগস। তার মেয়ের সঙ্গে সামান্য কেবিন ক্রিউয়ের ছেলে রা এক মহাকাশযানে পাড়ি দিচ্ছে! এ-ও হতে পারে!
“বাবার পর আমাকেই বসতে হবে ওই চেয়ারে। বুঝতেই পারছ। তার জন্য একটা অফিশিয়ালি স্পেস প্রোগ্রামের অংশ হতে হবে। তাই বাবা জোর করে এখানে পাঠিয়ে দিল।”
“ম্যাম, ইট’স অ্যান অনার ফর…”
“আরে, এ তো আজব ছেলে! বলছি, এরকম ছাগলের মতো ম্যা ম্যা করবে না!”
“সরি ম্যা… রি!”
“গুড।”
রি খুব অবলীলায় বলল, “তুমি আর্থ কনট্রোল রুমে জানিয়ে দাও, আমি উঠে পড়েছি সময়মতো। আমার একদিন পর তোমার ঘুম ভেঙেছে। আমি নেচার চেম্বারে গেলাম। আর হ্যাঁ, জানিয়ে দিয়ো, তোমার কোনো একজন পূর্বপুরুষের নাম ছিল কুম্ভকর্ণ।”
“কুম্ভকর্ণ কে, রি?”
“এহ্, পড়াশোনা কিছুই করোনি, দেখছি! অনেক আগের একটা মিথলজিতে কুম্ভকর্ণ বলে একটা ক্যারেকটার ছিল। সে শুধু ঘুমোত! ঠিক তোমার মতো! হিহি!”
রি প্রজাপতির মতো ফড়ফড় করে বেরিয়ে গেল কনট্রোল রুম ছেড়ে। রা অনেকক্ষণ চেষ্টা চালাল পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার, কিন্তু কোনো কারণে যোগাযোগ করা গেল না। ব্যাপারটা খুব গুরুগম্ভীর না হলেও গুরুতর তো বটেই। মাঝে মাঝে যান্ত্রিক সমস্যা হতে পারে। রি-কে জানানো দরকার। কিন্তু সে কি আর এসবে পাত্তা দেবে? একটু আগে রি-র প্রতি মুগ্ধতাটা একটু কমল যেন। বড়োলোকের আদুরে মেয়ে, একটা কোনো দায়িত্ববোধ নেই!
নেচার চেম্বারে গিয়ে রা দেখল, রি যে রিয়েলিটিটা এই মুহূর্তে তৈরি করেছে, এরকম কিছু সে আগে কোনোদিন দেখেনি। দেখতে সুন্দর লাগছে। কিন্তু গাছগুলো, বাড়িগুলো যেন অনেক আগে কোথাও দেখেছে। এখনকার সময়ের নয়।
“রি, আর্থ কনট্রোলের সঙ্গে সংযোগ করা যাচ্ছে না।”
“ওকে, কাল ট্রাই কোরো।”
“কিন্তু ব্যাপারটা গুরুতর। এরকম সাধারণত হওয়ার কথা নয়।”
“এখন মাথা খেয়ো না তো। এই নদীটা চেনো?”
“না তো।”
“এই নদীটার নাম তিস্তা। কী সুন্দর নামটা না?”
“হ্যাঁ, সুন্দর।”
“প্রায় পাঁচশো বছর আগে এই নদীটাতে শেষ জল ছিল। তখনও বাঘ ছিল জঙ্গলে, হরিণ জল খেতে আসত।”
“রি, আর্থ কনট্রোলে যোগাযোগ না…”
“তিস্তার ধারে বসে থাকতে ভালো লাগে না?”
রা হাল ছেড়ে দিল।
“হ্যাঁ, সুন্দর দৃশ্য। ওটা কী?”
“ওটা সেই সময়কার ওয়াচটাওয়ার। লোকে ওখানে উঠে জন্তুজানোয়ার দেখত। আমি মাঝে মাঝে বাড়ির নেচার চেম্বারে গিয়ে তিস্তার পাশে বসে থাকি।”
“বাবাঃ, তোমার বাড়িতে নেচার চেম্বার আছে!”
রা বুঝতে পারল, কথাটা বলে ভুল হয়ে গেছে। মহাকাশের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ঘরে আরও অনেক কিছু থাকতে পারে, যেটা সে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে না। রি একটু বিষণ্ণ হাসল। রি-কে দেখে মনে হচ্ছে, তার বাড়ির কথা মনে পড়ছে। রা-এর একটু আগে যে রাগটা হয়েছিল, সেটা আর মনে রইল না। রা মনে মনে বলল, ‘রি, তুমি চিন্তা কোরো না, আমি তোমায় এখানে সবরকম মন-খারাপ থেকে দূরে রাখব।’
দু-চার দিনের মধ্যেই রা আর রি ভালো বন্ধু হয়ে গেল। আর খারাপ কথাটা হল, আর্থ কনট্রোল রুমের সঙ্গে তখনও যোগাযোগ করা যায়নি। রি-কে একটু চিন্তিত দেখিয়েছে এই কারণে। রা-এর মনে হয়েছে, শুরুতে মেয়েটাকে যতটা ক্যাজ়ুয়াল দেখিয়েছে, মেয়েটা ততটাও ক্যাজ়ুয়াল নয়। তার যা যা কাজ করার, কোনো যন্ত্র ম্যালফাংশন করছে কি না, মাদারবোর্ড ঠিক করে চলছে কি না—সবই রি নিখুঁতভাবে করে।
রিও একদিন বলে বসল, “রা, তোমার এটা অদ্ভুত লাগছে না?”
রা ঠিক এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। হাজার হোক, অর্চগসের মেয়ের সামনে তার বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। রি বলছে, “আমাদের মিশন হল ক্যালুম নক্ষত্রের অষ্টম গ্রহ ইউস থেকে এজেন্ট এক্স রিট্রিভ করা, রাইট?”
“একদম ঠিক।”
“এজেন্ট এক্স কী?”
“খুব ভালো বুঝিনি, ক্লাসে পড়িয়েছিল।”
“আরে, সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করেছি নাকি? যেটা মনে আসছে, বলো-না।”
“এজেন্ট এক্স এমন একটা ভাইরাস, যেটা মানুষের শরীরে ইনজেক্ট করলে অসহিষ্ণুতা কমে যায়।”
“উফফ, আবার ভুলভাল বকছে ছেলেটি!”
“আরে বলছি তো, মানে এই ভাইরাস নিয়ে আসতে পারলে আমাদের পৃথিবীতে সবাই সবাইকে বিশ্বাস করবে, ভালোবাসবে, অন্যের খারাপ চাইবে না…”
“থাক থাক, অনেক হয়েছে। হ্যাঁ, তাহলে এটা আনার জন্য ক-টা স্পেসশিপ যাচ্ছে?”
“একটা।”
“তাতে কতজন ক্রিউ আছে?”
“দুজন।”
“তাদের অভিজ্ঞতা কত?”
“নেই।”
রি এবার চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “আমার মনে হচ্ছে, আমি মরে গেছি আর আমি একটা স্বপ্ন দেখছি। প্রাচীন ভুডু জাতীয় পুথিতে পুনর্জন্মের কনসেপ্ট ছিল, এই স্বপ্নটা ভেঙে গেলে আমি আবার দেখব, পৃথিবীতে জন্মেছি!”
রা মুখ-চোখ কুঁচকে বলল, “মাথাটা কি একেবারেই গেছে? ঠান্ডা মাথায় ভাবো, এই মুহূর্তে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আর্থ কনট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা।”
“আরে, করা যাচ্ছে না তো!”
“সমস্যাটা কী?”
“আমার ধারণা, আর কোনোদিনই আর্থের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে না।”
“মানে?”
“স্পেস ট্রাভেলের ইতিহাসে একটানা তিন দিন যোগাযোগ করা যায়নি, এরকম হয়নি। সুতরাং আমার ধারণা, ওরা ইচ্ছে করে যোগাযোগ হতে দিচ্ছে না।”
“কিন্তু কেন? তোমার বাবা স্পেস কাউন্সিলের হেড! তিনি নিজের মেয়ের সঙ্গে কেন এরকম করবেন?”
“হয়তো পৃথিবীতে বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়েছে।”
“বিদ্রোহ জিনিসটা আবার কী?”
“ও আগে হত, ইতিহাসে আছে। শেষ রিপোর্টেড বিদ্রোহ হয়েছিল আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে।”
“তারপর কী হল?”
“কী আবার হবে, বিদ্রোহীদের কাউন্সিলে কয়েকটা সিট দিয়ে দেওয়া হল। বিদ্রোহ শেষ।”
“আরে, এখন আমরা কী করব?”
দুজন মিলে কেউই এর কোনো সদুত্তর দিতে পারল না। দু-সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরও যখন যোগাযোগ হল না, রা এবং রি দুজনেই বুঝে গেল, যোগাযোগ আর হবে না।
তারপর ওরা চেক করল, ওদের গন্তব্য ঠিকঠাক আছে কি না। সব ঠিক আছে। আট বছরের মাথায় ওরা ইউস গ্রহে পৌঁছোবে। সেখানে এর আগে কোনো মানুষের পা পড়েনি। রা একবার বলেছিল স্পেসশিপ ঘুরিয়ে পৃথিবীর দিকে ফিরে যেতে। কিন্তু রি ক্যাপটেন হওয়া সত্ত্বেও সিস্টেম ওভাররাইট করে ডেস্টিনেশন চেঞ্জ করতে পারেনি। তাদের ইউস গ্রহে যেতেই হবে।
দ্বিতীয় চিন্তা খাবার। দুজনে মিলে লক্ষ করল, যা খাবার আছে, আট কেন, আশি বছর পর্যন্তও ওদের কোনো অসুবিধে হবে না। এটা খুব একটা আশ্চর্যের কিছু নয়, অধিকাংশ স্পেস ট্রাভেলেই প্রচুর খাবার মজুত করা থাকে। হয়তো কাছাকাছি কোনো স্পেসশিপ খারাপ হয়ে গেছে, তাদের উদ্ধার করতে হবে। কি কোনো কারণে প্রয়োজনের থেকে বেশি দিন যদি থাকতে হয়। কিন্তু তাও রি পাংশু মুখে বলল, “ব্যাপার সুবিধের বুঝছি না, রা!”
রা ঢোঁক গিলে একবার মাথা নাড়ল।
রা আর রি দুজনে মিলে তন্নতন্ন করে গোটা স্পেসশিপ খুঁজে দেখল, কোথাও কোনো সমস্যা আছে কি না। সমস্ত প্রোগ্রাম আবার করে চেক করা হল। মাদারবোর্ড থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা স্ক্রু পর্যন্ত। গোটা স্পেসশিপ মানে ছোটোখাটো ব্যাপার নয়। একটা ছোটোখাটো শহর। অর্চগসের মেয়ের জন্য পাঠানো স্পেসশিপ, এটা ওবি থ্রি গোত্রের। এটাই সব চেয়ে উন্নততর স্পেসশিপ। নিজস্ব পাওয়ার জেনারেটর থেকে শুরু করে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ সব কিছু করতে পারে এ। অসম্ভব তাপ থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের শীতলতা সব সইতে পারে ওবি থ্রি। এই যন্ত্র থেকে এক মাসের ওপর আর্থ কনট্রোলে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না, এটা একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
রা প্রত্যেকদিন দ্যাখে, রি আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে। এখন আর রি-কে বড়োলোকের আদুরে মেয়ে বলে মনে হয় না রা-এর। নিজের মতো আরেকজন মানুষ বলেই মনে হয়। অবাক হয় শুনে রি আর রা-র জীবন খুব আলাদা কিছু নয়। রি-র জীবনে যা যা ছিল, রা-র জীবনেও তা-ই তা-ই ছিল। বন্ধুবান্ধব, বাবা-মা, বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিক, প্রথম প্রেম, জীবনের স্বপ্ন সব। রা অনেক সময় বুঝতে পারে না এখন সে বেশি ভাগ্যবান না রি। রি-র বাবা কোনোদিন মেয়ের কাছে থাকতে পারে না। সেখানে রা-র জীবনে বাবাই ছিল সব। মাঝে মাঝে এখন রা-র মনে হয়, সে বেশি সুন্দর একটা জীবন কাটিয়েছে। রি-র বিষণ্ণ মুখটার দিকে চেয়ে রা মনে মনে বলে, ‘আমি আছি তো রি, আমি আছি! আমি ঠিক তোমায় পৃথিবীতে পৌঁছে দেব।’
রি অবাক হয়ে রা-কে দ্যাখে। কী অমানুষিক পরিশ্রম করতে পারে ছেলেটা! মাঝে মাঝে দেখে মনে হয়, ভূতে পেয়েছে। সেদিন একটানা বারো ঘণ্টা প্রোগ্রাম চেকিং-এর পর রি বলেছিল, “এবার ঘুমোতে যাও রা!” রা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলেছিল, “না, আরেকটু সময় দাও। তোমায় আমি ঠিক পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাব।” রি-র হঠাৎ লজ্জা লাগে। সেদিন অনেকক্ষণ রি তিস্তার ধারে গিয়ে বসে রইল। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। এই জল পৃথিবীতে না ফিরে যেতে পাওয়ার জল নয়। এই জল কেন, কীসের জন্য, রি কিছুতে বুঝতে পারে না। তখন ওর আরও জোরে কান্না পায়।
সেদিন ওরা দুজন কনট্রোল রুমের স্ক্রিন দিয়ে সামনের মহাকাশ দেখছিল। মহাশূন্যের সীমা এখনও বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পারেনি। শেষের পরেও শেষ থাকে। মহাকাশ নাকি আরও তীব্রতর গতিতে বেড়ে চলেছে। স্থানের পরিসীমা আরও বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হচ্ছে। দূরে ছোটো ছোটো তারা মিটমিট করছে। অনেকটা পৃথিবীর আকাশের মতোই। ওরা দুজনেই জানে, মাঝেমধ্যে ওরা কোন গ্রহ কি গ্রহাণুর কাছ দিয়ে যাবে। তখন সামনের কালো স্ক্রিনের একটা বিশাল অংশ জুড়ে থাকবে নানান রকমের রং। কিন্তু সেসব খুবই কম। নিঃসীম মহাকাশের অধিকাংশ স্থানই ফাঁকা, শূন্য। কিছুই নেই তাতে। একশো ভাগের মধ্যে শতকরা পঁচানব্বই ভাগ মহাকাশই শূন্য।
রি আলগোছেই বলল, “রা?”
“বলো।”
“আমরা যদি আর না ফিরি?”
“মানে?”
“মানে আবার কী?”
“ইউস থেকে এজেন্ট এক্স নিয়ে…”
“আমরা ইউস থেকে যদি না ফিরি?”
“পাগল-টাগল হলে নাকি?”
“আমি আর পৃথিবীতে ফিরতে চাই না।”
“তাহলে কী করবে?”
রি একটুখানি চুপ করে থেকে বলল, “তুমি একটা গাধা। গাধা চেনো তো? অনেক বছর আগে পৃথিবীতে গাধা বলে একটি প্রাণী ছিল। তুমি তাদের বংশধর।”
রা বলতে গেল, “কিন্তু আমার পূর্বপুরুষ…”
রি রা-এর মুখ হাত দিয়ে থামিয়ে রা-কে জড়িয়ে ধরল। রা প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর সে চোখ বন্ধ করে রি-এর চুলের গন্ধ নিতে থাকল।
ওরা আর পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও করে না। খায়দায়, তিস্তার পারে গিয়ে বসে থাকে। রা মাঝে মাঝে সমুদ্র করে দেয়, যেখানে গিয়ে সব তিস্তা মিশেছে। সমুদ্রের সাদা সাদা ঢেউ এসে ঝাপটে পড়ে ওদের পায়ের কাছে। রি খিলখিল করে হেসে ওঠে। রা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে রি-র দিকে। রি চোখ পাকিয়ে বলে, “কী দেখছ?”
“তুমি ছাড়া আর কেউ আছে নাকি এখানে দেখার?”
“থাকলে তুমি দেখতে নাকি?”
“দেখলে কী করতে?”
“চোখ গেলে দিতাম, এই বালি নিয়ে ঘষে দিতাম দুটো চোখে। মেয়ে দেখার শখ জন্মের মতো ঘুচে যেত!”
“তাহলে তো তোমাকেও দেখতে পেতাম না!”
“দরকার নেই দেখে, আমি তোমায় দেখছি এই ঢের।”
তারপর ওরা কৃত্রিম সূর্যের আলোয় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। দুজনের পায়েই কিচকিচ করে ভেজা বালি।
প্রথম ঝামেলা শুরু হল কয়েক মাস পর থেকে। রি তার পুরোনো বয়ফ্রেন্ডের কথা বলছিল। বলতে বলতে হয়তো এমন কিছু বলে ফেলেছিল, যাতে রা-র মনে আঘাত লেগেছে। রি-র পুরোনো প্রেমিক কাউন্সিলের একজন মেম্বারের ছেলে ছিল। নিজেরাই নিজেদের পছন্দ করেছিল। তিন-চার মাসের বেশি সম্পর্ক টেকেনি।
রা মুখ ভার করে বলল, “ওসব বড়োলোক ছেলেদের চালিয়াতি আমার দেখা আছে! নিজের যোগ্যতায় তো কিছু করতে হয়নি জীবনে!”
রি অবাক হয়ে দেখল রা-র দিকে। বলল, “এর মধ্যে বড়োলোক-গরিব লোকের কী হল? আমিও তো বড়োলোক। তুমি আমায় ভালোবাসো না?”
রা অপ্রস্তুত হয়ে বলে, “তুমি আর ওই ছেলেটা এক হল?” রি হঠাৎ করে উঠে চলে গেল। রা একটা স্ক্রিনে দেখতে পেল, রি নেচার রুমে একটা উঁচু পাহাড়ের ওপর বসে আছে। রা একবার ভাবল, যাই, তারপর ভাবল, আমার কী দোষ? আমি কেন আগে যাব?
সাত দিনের মাথায় এই ঝগড়া মিটল। এই সাত দিন রা মাথার চুল ছিঁড়েছে, একটা ঘরের সামান্য অংশ নিজের মনে ভাঙচুর করেছে। বেশি কিছু ভাঙচুর করতে পারেনি সব জিনিসপত্র শক্ত ধাতুর বলে। কিন্তু যখন রা হাতুড়িটা দিয়ে ঘা মারছিল, তার গলা দিয়ে একটা জান্তব আওয়াজ বেরোচ্ছিল। রি একবার সেই দৃশ্যটার দিকে বিরক্তিভরে তাকিয়েছে। তারপর নিজের বাগানের দিকে চলে গেছে একা একা। রি একটা বড়ো হলঘরে নিজের একটা বাগান করার চেষ্টা করছে।
আট দিনের দিন সকালে একটা দুধসাদা পাহাড়ের সামনের ঘুম থেকে উঠতে উঠতে রা রি-কে বলল, “সরি, আর কোনোদিন এরকম হবে না।” রি গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে রা-কে জড়িয়ে ধরল।
এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। রি বুঝতে পেরেছে সে সন্তানসম্ভবা। রা বলেছিল নষ্ট করে ফেলতে। মেডিক্যাল কিটে একটু প্রোগ্রামিং এদিক-ওদিক করে দিলে এটা পাঁচ মিনিটের একটা যন্ত্রণাহীন কাজ। রা-র যুক্তি হল, তারা কোথায় তাদের সন্তানকে আনবে? তারা খুব সম্ভবত আর কোনোদিন পৃথিবীতে ফিরতে পারবে না। ইউস গ্রহ সম্বন্ধে তাদের শুধু এটুকু বলা হয়েছিল, সেখানে অক্সিজেন আছে, নল ছাড়া স্বাভাবিকভাবে নিশ্বাস নেওয়া যায়। কিন্তু সেই গ্রহ বসবাসযোগ্য কি না তারা কিছুই জানে না। সুতরাং একটা প্রাণ আনা মানে তাকে সারাজীবন এই স্পেসশিপ ওবি থ্রি-র মধ্যে বন্দি করে রাখা। এর কোনো অর্থ হয় না।
রি অবাক এবং আহত হয়ে তাকিয়ে থেকেছে। রা কীভাবে এরকম করে ভাবতে পারে? তাদের ভালোবাসার প্রথম চিহ্ন, তাকে নষ্ট করে ফেলতে হবে? এ-ও হয়? ভাবল কী করে রা? সব যুক্তি যদি মেনেও নেওয়া যায়, তাহলেও রি-র যুক্তি হল, তারা যেভাবে বেঁচে আছে, তাদের ছেলেমেয়েও সেভাবেই বেঁচে থাকবে। বরং পৃথিবীর আলো আর কালোর মধ্যে যে কালোর ভাগ বেশি, সেটা কোনোদিন এদের স্পর্শ করবে না।
রা-র কাছে মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু তারপরেই তার নতুন কাজ আরম্ভ হয়েছে। একটা বট গাছের বীজ নিয়ে রা কৃত্রিম উপায়ে তাকে তাড়াতাড়ি বড়ো করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ছেলে কি মেয়ে যা-ই হোক-না কেন, একটা ট্রি হাউস লাগবে তার। রা যখন গাছের পিছনে লেগে থাকে, একবার এই করে, একবার সেই করে, রি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে, এই লোকটাই বাচ্চা নষ্ট করে দিতে বলেছিল! সত্যি, বাবা হওয়া কী বিচিত্র একটি ব্যাপার! রি-র নিজের বাবার কথা মনে পড়ে যায়। নেচার রুমে এসে একটা গাছের তলায় চুপটি করে সে তখন বসে থাকে। রা পিছন থেকে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরলে রি শক্ত করে চেপে ধরে রা-র হাতটা।
রুম যেদিন জন্মাল, রা আর রি দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদল। কারণ এর চেয়ে সুন্দরতর কোনো কিছু তারা আজ অবধি দেখেনি। খুব সুন্দর কিছু দেখলে মানুষ হাসে না, কাঁদে। অসম্ভব সুন্দর যে-কোনো কিছুর মধ্যেই একটা গভীর বেদনার বোধ থাকে। রি বলল, “তুমি একটা গাধা।” রা বলল, “তুমি একটা গোলাপ ফুল।” রুম ককিয়ে কেঁদে ওঠে জানান দিল, সে-ও আছে।
তারপর তাদের জীবনটাই পালটে গেল। রুমের পিছনেই সমস্ত সময় চলে যায়। স্পেসশিপে সব কিছুর ব্যবস্থা আছে। বাচ্চার খাবার, ন্যাপি, ক্রিম, কাঁথা সব। রুম যখন দু-বছরে পা দিল, রা-র ট্রি হাউস শেষ হল।
রুমকে কী পড়ানো হবে, তা নিয়ে মাঝে মাঝে দুজনের মধ্যে ঝামেলা হয়। কারণ, বড়ো হয়ে রুমকে কোন পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে, সেটা কেউই জানে না। রি-র ধারণা ইউস গ্রহ বাসযোগ্য। সেখানে তারা প্রথম বসতি স্থাপন করবে। আদম আর ইভের মতো। রা বলে, ইউস বাসযোগ্য হবে না। প্রপারভাবে বাসযোগ্য হলে সেখানে বসতি ইতিমধ্যেই থাকত এবং তারা আসার সময় তাদের জানিয়ে দেওয়া হত স্থানীয় লোকজনের কথা।
কিন্তু মনে মনে রা-ও চায়, রি যেন ঠিক হয়। মেয়ের ফুটফুটে মুখটার দিকে রা তাকিয়ে থাকে আর মনে মনে বলে, ‘আমি তোকে একটা নতুন পৃথিবী দেব মা, দেবই দেব।’
রা-র মনে পড়ে যায় শুরুর সময়ের কথা। রি-কেও ও কথা দিয়েছিল, তাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। রা ভাবে, আর কেঁপে কেঁপে ওঠে। রি বুঝতে পারে রা-র মনের কথা। রা-র মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, ফিশফিশ করে কানে কানে বলে, “আমরা ঠিক একটা পৃথিবী খুঁজে পাব রা, তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোরো না।”
ছোট্ট রুম স্পেসশিপে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে ঘুরে বেড়ায়। কৃত্রিম অভিকর্ষ একদিন বন্ধ করে রা আর রি তাকে একদিন চমকে দিয়েছে। রুম এখন জানেম, সে সেদিন যেমন করে উড়তে পেরেছিল, তেমনি করে কিছু প্রাণী উড়তে পারে। তাদের পাখি বলে। রুমের খুব পাখি হওয়ার শখ।
রা আর রি রুমের জন্য একটা আলাদা ঘর দিয়েছে। সেই ঘর থেকে মহাকাশ দেখা যায়। রাতে একা একা ঘুম ভেঙে গেলে রুম জানলার ধারে বসে থাকে, তারা দ্যাখে। রুমের কোনো বন্ধু নেই। তাই রুমের একা লাগে না, বন্ধু কাকে বলে, সে তা-ই জানে না।
রি একবার রুমকে জানলার ধারে একা একা বসে থাকতে দেখেছিল। ফিরে এসে রা-কে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “তুমি ঠিক বলেছিলে। আমরা মেয়েটাকে বড্ড কষ্ট দিচ্ছি।”
রুম অবাক হয়ে দ্যাখে, তার ঘুমের সময় বাবা এসে তাকে কোলে তুলে কাতুকুতু দিচ্ছে আর তারপর ঘাড়ে করে মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। রুম খিলখিল করে হাসতে থাকে। রা বলে, “তুমিও এরকম শব্দ করে হাসো কিন্তু!” রি-র মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
আট বছর যত এগিয়ে আসতে থাকে, রা আর রি চঞ্চল হয়ে উঠতে থাকে। এখন আর তাদের কারোই কোনো সন্দেহ নেই তারা কী চায়। তারা দুজনেই চায়, ইউস তাদের নতুন পৃথিবী হোক। সেখান থেকে তারা আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করবে। ইউস নিয়ে অনেক পড়াশোনাও করতে থাকে দুজনে। কিন্তু মুশকিল হল ইউস গ্রহটার যেন কোনো অস্তিত্বই নেই! একটা গ্রহ আছে, সেখানে নিশ্বাস নেওয়ার মতো অক্সিজেন আছে এটুকুই। এর বাইরে কোনো তথ্য কম্পিউটারের মাদারবোর্ডে নেই। অথচ ক্যালুম নক্ষত্র নিয়ে একশো পাতার তথ্য আছে। রি আর রা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। রুম তার নতুন পুতুল নিয়ে ব্যস্ত। বাবা তাকে বানিয়ে দিয়েছে। বলেছে, একে কুকুর বলে। রুম তার নাম দিয়েছে কালু। নামটা মা সাজেস্ট করেছিল।
দেখতে দেখতে সময় কাটতে থাকে। বট গাছ এখন স্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। তার শরীর বেয়ে অনেক বাকল নেমেছে। রুম সেগুলো ধরে টারজানের মতো ঝুলতে থাকে। মাঝে মাঝে পড়ে যায়। আবার ওঠে, আবার বাকল বেয়ে ঝুলতে থাকে। রা আর রি হাত ধরাধরি করে মেয়ের খেলা দ্যাখে।
অবশেষে দেখা যায়, ক্যালুম নক্ষত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রা স্ক্রিন দেখে, আলাদা কোনো বৈশিষ্ট খুঁজে পায় না। সূর্যের মতোই আয়তনের স্বাভাবিক একটা নক্ষত্র। মোট তেইশটা গ্রহ আছে ক্যালুমের। ইউস তার মধ্যে অষ্টম। আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তারা ইউস দেখতে পাবে। তারপর অবতরণ।
রুম দেখে মা আর বাবা দুজনেই অসম্ভব চুপ করে আছে। কী যেন ভাবছে। একবার জিজ্ঞেস করায় মা বলেছে, “আমরা একটা নতুন বাড়ি যাচ্ছি। ওখানেই আমরা এরপর থেকে থাকব।” বাবা বিরক্তিভরে বলেছে, “কেন মেয়েটাকে ফালতু আশা দিচ্ছ? যদি সেরকম কিছু না হয়?” মা ছলছল চোখে তাকিয়ে বলেছে, “এজেন্ট এক্স?”
বাবা বলেছে, “এখনও তোমার মাথা থেকে এজেন্ট এক্সের ভূত নামেনি? সব মিথ্যে ছিল, সব। আমাদের পৃথিবী থেকে এমন একটা অপরাধে বের করে দেওয়া হয়েছে, যেটা আমরা আর কোনোদিন জানতে পারব না।”
মা চুপ করে গেছে।
রা ভাবে, মিশনের কথা মেনে চলতে হলে ইউসে তাদের নামতেই হবে। কিন্তু এজেন্ট এক্সকে সে চিনবে কী করে? ট্রেনিং-এর সময় বলেছিল, দেখলেই চিনে যাবে তারা। কীভাবে, কী উপায়ে, সে জানে না। রি-কেও একই কথা বলা হয়েছিল।
আস্তে আস্তে একটা বিন্দু থেকে বড়ো হয়ে উঠছে ইউস গ্রহ। কম্পিউটার ডেটা এখনও শুধু দেখাচ্ছে, ব্রিদিং এয়ার আছে। খনিজ সম্পদের চিহ্নে বিপ বিপ করছে। কিন্তু জল আছে কি না দেখাচ্ছে না। জল না হলে কী করে তারা থাকবে! মাটি থাকতে হবে তো! নইলে খাবে কী! গাছ থাকতে হবে।
ইউস গ্রহ এবার খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রা আর রি পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। রুম কালুকে কোলে নিয়ে মা-বাবার পিছনে দাঁড়িয়ে।
ধূসর একটা কালো বল খালি। কোথাও কোনো সবুজ নেই, কোথাও কোনো নীল জলের রেখা নেই। কম্পিউটার ডেটা এতক্ষণে আরও খানিকটা তথ্য দিয়েছে। অক্সিজেন আছে মাটিতে মাইক্রোস্কোপিক মস আছে বলে। জল আছে, কিন্তু সেটা পৃথিবীর মতো নদীনালা নয়। সামান্য কাদা-কাদা জল। মাটি চাষের জন্য তিন শতাংশ উপযোগী দেখাচ্ছে। রা আর রি দুজনেই ভালো করে জানে, চল্লিশ শতাংশ উপযোগী না-দেখালে কোনো মাটিতে চাষ হয় না।
কিন্তু এজেন্ট এক্স কোথায়? গোটা গ্রহে কোথাও কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। কম্পিউটার দেখাচ্ছে, মাইক্রোস্কোপিক ভাইরাস আছে, কিন্তু সেটা হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ আছে। কোটিও হতে পারে। তার মধ্যে এজেন্ট এক্সকে খোঁজা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
রা মাথা নীচু করে বলল, “আমি হেরে গেলাম, রি!”
রি খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। একবার রুমের দিকে তাকাল। তারপর বলল, “রুম ওই দেখ তোর জন্মদিনের গিফট! পছন্দ হয়েছে নতুন ঘর?”
রুম হাততালি দিয়ে উঠে বলল, “কী সুন্দর, কী সুন্দর!”
রা একবার সামনের গ্রহটার দিকে তাকাল। তারপর রুমের দিকে। তারপর রি-র দিকে। রি-র মুখ অনির্বচনীয় প্রশান্তিতে ভরে আছে। রা মনে মনে বলল, ‘তুমি একটা গোলাপ ফুল।’
তারপর তারা দুজনে মিলে ল্যান্ড বোতামটা টিপল।
***
অর্চগস চেঁচিয়ে উঠল, “ফ্রিজ সিমুলেশন।”
পাশ থেকে রি বিড়বিড় করে বলল, “পারফেক্ট টাইমিং, বাবা।”
অর্চগসের গলা আবার শোনা গেল, “কত নম্বর ক্লোন এরা?”
সামনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল ওবি ৭৯২৮। সামনে রাখা অসংখ্য ক্রায়োজেনিক চেম্বারের মধ্যে থেকে দুটো চেম্বার সামনে বেরিয়ে এল।
“এগজ়্যাক্ট এই মোমেন্টের ব্রেন ম্যাপিং করো দুটো ক্লোনের। এত ভালো এমপ্যাথি ইন্ডিকেটর এর আগে কোনো ক্লোনে পাইনি আমরা। ম্যাপিং কমপ্লিট হয়ে গেলে দেখতে হবে, কোন এজেন্ট দিয়ে ওই পারফেক্ট ব্রেন ম্যাপিং আনা যায়। ভাগ্য ভালো থাকলে এবার আমরা এজেন্ট এক্সের ফর্মুলা ঠিক বের করে ফেলতে পারব।”
রা-এর সামনে দুটো ক্রায়োজেনিক চেম্বার এসে নামল। ব্রেন ফাংশন ফ্রিজ করে সে অর্চগসের দিকে তাকিয়ে ওকে সিগন্যাল দেয়।
দূর থেকে অর্চগস থামস আপ দেখায় রা-কে।
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, নয়ন বসু
