মৃগয়া
লেখক: সুমন মিশ্র
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
তিনজন ভীত, সন্ত্রস্ত, সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। মলিন, ধূলিধূসর তাদের বেশভূষা, মাথার চুল উশকোখুশকো। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু সেই ক্লান্তিকে ছাপিয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে এক অজানা ভয়। সারারাত তারা গভীর উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছে। যদিও এটা রোজকারই ঘটনা। গোপন ডেরায় লুকিয়ে রাতটা কোনোমতে কাটিয়েই তারা ভোরবেলা বেরিয়ে পড়েছে অনির্দিষ্টের পথে।
তিনজনের মধ্যে প্রথমজন বছর পঁচিশের যুবক। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, পেশিবহুল চেহারা। চোখের মধ্যে এক অদ্ভুত গভীরতা আছে। তার নাম ‘এইচএস ২৭৮০ কে’। এটা তার নথিভুক্ত নাম। গত তিন শতাব্দী ধরে এভাবেই মানুষের নাম রাখার নিয়ম।
তার নিজের অবশ্য এমন বিদঘুটে নাম পছন্দ নয়। রোজকার ব্যবহারের জন্যে তার একটা সহজ নামও আছে। তার মা তাকে ভালোবেসে রুদ্র নামে ডাকত। সেই নামটাই তার বড়ো প্রিয়, বড়ো কাছের। যদিও তার নাম যারা জানত, সেই নাম ধরে ডাকত, তাকে আপন মনে করত, তাদের কেউই আজ আর বেঁচে নেই।
দ্বিতীয়জনের বয়েস প্রায় পঁয়ত্রিশ। লোকটির সহজ নাম জিকো। রুগ্ণ দোহারা চেহারা, ত্বকের রং ফ্যাকাশে, দেখে মনে হয়, রক্তশূন্যতায় ভুগছে। মাথার চুল পাতলা। অতিরিক্ত অনাহারে তার চোখ যেন কোটরে ঢুকে গিয়েছে।
তৃতীয়জন দলের নেতা, বছর পঞ্চাশের এক প্রৌঢ়। মাথা ভরতি ধূসর চুল, মুখে হাজারো বলিরেখা তার জীবনের অভিজ্ঞতার নীরব সাক্ষী। তার নাম পশুপতি।
প্রত্যেকের মুখ থমথমে, সতর্ক তাদের দৃষ্টি। প্রত্যেকের হাতেই কোনো না কোনো অস্ত্র রয়েছে। কিন্তু সেগুলো আধুনিক নয়, বড্ড পুরোনো ধাঁচের। মানুষগুলো যতটা সম্ভব দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এরা কেউ কারও সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। যাযাবরের মতো অনির্দিষ্টের পথে চলতে চলতে এরা একে অন্যকে খুঁজে পেয়েছে। এদের মধ্যে একটাই সম্পর্ক, এরা সবাই বাঁচতে চায়।
এই দলে আরও দশজন সদস্য ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই আর বেঁচে নেই। তারা কোনো বন্যজন্তুর শিকার হয়নি। বন্যজন্তুদের কবল থেকে তাও বেঁচে ফেরা যায়। কিন্তু যখন তাদের থেকেও ভয়ংকর কেউ পিছু নেয়, তখন আর মুক্তির পথ থাকে না।
চারপাশে নিবিড় জঙ্গল, আদিম বুনো গন্ধ। শত শত বর্ষব্যাপী বিনা বাধায় বৃদ্ধি পেয়ে চারপাশের গাছগুলি কালের অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ছায়াঘন বিশাল আকার দেখে মনে হয় যেন সভ্যতার কোনো গোপন রহস্যকে তারা সযত্নে নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। জঙ্গল এখানে এতটাই গভীর যে দিনের বেলাতেও গা ছমছম করে।
প্রাচীন বৃক্ষের দল অবাধে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে মাথার উপরে সবুজের গালিচা তৈরি করেছে। সূর্য এখন মধ্যগগন থেকে পশ্চিমে হেলে পড়তে শুরু করেছে, কিন্তু মাথার উপরের সবুজের বর্ম ভেদ করে রোদ তেমন প্রবেশ করতে পারছে না। ডালপালার জাল ভেদ করে যেটুকু সূর্যরশ্মি প্রবেশ করছে, তা যেন চলার পথে আলোছায়ার অলংকরণ তৈরি করছে। চারপাশে এক অদ্ভুত শীতলতা। কতরকম বন্যজন্তুর ডাক ভেসে আসছে চারপাশ থেকে। গাছের শাখাপ্রশাখা কতশত পাখির কলতানে মুখরিত। বাঁদরের দল কিচকিচ শব্দ করে গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে ঝাঁপাঝাঁপি করছে। দু-একবার বহু দূর থেকে বাঘের গর্জন ভেসে এল।
বাঘের ভয় এই তিনজনের কেউই আর পায় না। তাদের আসল ভয় হোমো ইনটেলেক্টাসদের নিয়ে।
পশুপতি চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি চালনা করল। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল রাস্তার ধারে। আগাছায় ঢেকে-যাওয়া একটা সাইনবোর্ড। পশুপতি একটু এগিয়ে গিয়ে টেনে ছিঁড়ে আগাছাগুলোকে সরিয়ে দিতেই বিস্মৃতপ্রায় এক সতর্কবাণী বেরিয়ে এল। ‘মৃগয়াভূমিতে স্বাগত। বাঁচতে পারলে বাঁচো।’
দুই
‘মানুষ’ বললে আজকাল পুরোটা বুঝিয়ে বলা হয় না। বলতে হয় হোমো স্যাপিয়েন্স। কারণ আজ হোমো স্যাপিয়েন্সরা বিলুপ্ত প্রায়। সংখ্যায় তারা নগণ্য। যারা টিকে আছে, তারা এভাবেই জঙ্গলে জঙ্গলে প্রাণ বাঁচিয়ে ঘুরে বেড়ায়। একসময় যারা পৃথিবী শাসন করত, আজ তারা মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলে যাযাবরের জীবন কাটাচ্ছে।
তাদের জায়গায় এই পৃথিবীর দখল নিয়েছে মানুষের নতুন এক প্রজাতি, হোমো ইনটেলেক্টাস। বুদ্ধিমান, উন্নত, কিন্তু পাশবিক।
এই সব কিছুর সূত্রপাত ২০৬৫ সালে। সেই সময়ে পৃথিবীর অর্থনীতি প্রায় তলানিতে এসে পৌঁছেছিল। দারিদ্র্য ও অনাহারের সূচকে কে প্রথম হবে, তা-ই নিয়েই যেন দেশগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। মানুষের হাতে কাজ নেই, ঘরে ঘরে অন্নাভাব এবং সব কিছু ছাপিয়ে প্রকট হয়ে উঠছিল দেশে দেশে অরাজকতা। বিশ্বায়ন শব্দটা শুনতে কৌতুক মনে হত, কারণ দেশগুলি নিজেদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে স্বাভাবিক বাণিজ্যব্যবস্থাকেই মৃতপ্রায় করে তুলেছিল।
এরই মধ্যে হঠাৎ নর্থ কোরিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করল আমেরিকার বিরুদ্ধে। সেই শুরু। যুদ্ধ চলল পরের দশ বছর। এই সুযোগে বিভিন্ন দেশ নিজেদের মধ্যে যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় মেতে উঠল। কিন্তু একে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলা চলে না, কারণ যুদ্ধগুলি বিক্ষিপ্তভাবে চলতে থাকল। সারা পৃথিবী জুড়ে শুধুই হাহাকার। পারমাণবিক অস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার, বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ারের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবী যখন আবার শান্ত হল, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা হ্রাস পেয়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হয়ে গিয়েছে। সভ্যতার পশ্চাদপসরণ শুরু হয়ে গিয়েছে। যারা বেঁচে আছে, তাদের মধ্যে সীমিতসংখ্যকেরই সামর্থ্য ছিল সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলার।
ঠিক তখনই বিভিন্ন দেশে এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা শুরু হল। জিন ইঞ্জিনিয়ারিং–এর মাধ্যমে এক উন্নততর মানবপ্রজাতির সৃষ্টির চেষ্টা। জিন ইঞ্জিনিয়ারিং আগেও ছিল, কিন্তু তার ব্যবহার ছিল সীমাবদ্ধ। মানুষের জিনগত রোগের চিকিৎসায় ক্রিসপার পদ্ধতি ব্যবহার করে জিনের গঠনের ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা আগেও প্রচলিত ছিল। আবার বায়ো হ্যাকাররা সেই পদ্ধতিকে ব্যবহার করত নিজেদের লাভের জন্যে। অর্থের বিনিময়ে তারা বেআইনি ক্লিনিক খুলে বসত, যেখানে জিনের হেরফের ঘটিয়ে মানুষের চোখের রং, ত্বকের রং থেকে শুরু করে বংশগত রোগনিরাময় পর্যন্ত করা হত।
কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী নতুন যুগে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে বাঁক নিল। ক্রমাগত চেষ্টা চালানো হচ্ছিল মানুষের জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে এমন এক নতুন উন্নত প্রজাতি সৃষ্টির, যারা সর্বক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ হবে। বুদ্ধিতে, শক্তিতে, নেতৃত্বে তারা হবে হোমো স্যাপিয়েন্সের থেকে উন্নততর। তারা মানবজাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে নতুন ভবিষ্যতের দিকে। কিন্তু কাজটা অতটাও সহজ হল না। বারংবার ব্যর্থতা বাধা হয়ে দাঁড়াল সফলতার পথে।
এ ছাড়া একশ্রেণির মানুষ ক্রমাগত এই নতুন মানবপ্রজাতি সৃষ্টির বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, এই নতুন মানবপ্রজাতি কখনোই হোমো স্যাপিয়েন্সদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারবে না। ঠিক যেমন হোমো স্যাপিয়েন্সরা অতীতে বাকি মানবপ্রজাতিদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারেনি। তারা এ-ও আশঙ্কা করেছিল যে ভবিষ্যৎ সুন্দর নয়, বরং শ্রেষ্ঠত্বের যুদ্ধে রক্তাক্ত হয়ে উঠবে।
তাদের কথাকে পরিবর্তনপন্থীরা সকলেই হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজ মনে হয়, সেই দিন তাদের কথা শুনলে আজ এই অন্ধকার যুগ আসত না।
ক্রমাগত ব্যর্থতার পরে অবশেষে ২০৯১ সালে প্রথম সাফল্য এসেছিল। কানাডার মেরু অঞ্চলের নেকড়ের জিন মানুষের জিনের সঙ্গে সংযোগ করে যে প্রজাতির সৃষ্টি হল, তা ছিল একেবারে অন্যরকম। এরা বুদ্ধিমান, কর্মদক্ষ। সাহসে, শক্তিতে অনেক উন্নত। কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতাও তাদের সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশি।
তাদের নাম দেওয়া হল হোমো ইনটেলেক্টাস। ইনটেলেক্টাসদের প্রথম প্রজন্মকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করা হয়েছিল, যাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা পারদর্শী হয়ে ওঠে।
তাদের দ্বিতীয় প্রজন্মকে সরাসরি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে লাগানো শুরু হল। দেখা গেল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, রাজনীতি, ক্রীড়া সব জায়গায় তাদের পারদর্শিতা সকলকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। এমনকি সামরিক ক্ষেত্রেও তারা অসামান্য। দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা, সহজাত নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা, দ্রুত নতুন জিনিস শিখে নিয়ে তা কার্যক্ষেত্রে ব্যবহারের পারদর্শিতা তাদের সঙ্গে হোমো স্যাপিয়েন্সদের একটা বড়ো পার্থক্য তৈরি করে দিচ্ছিল।
প্রথমে কয়েক প্রজন্ম হোমো ইনটেলেক্টাস, হোমো স্যাপিয়েন্সদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমস্ত কাজ করত, কিন্তু ক্রমশ দেখা গেল, বেশির ভাগ সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে তারা নিজেদের পারদর্শিতায় হোমো স্যাপিয়েন্সদের পিছনে ফেলে দিচ্ছে। ক্রমশ একটা সময় এল, যখন সমস্ত বড়ো সংস্থার শীর্ষে বসে গেল হোমো ইনটেলেক্টাস। ধীরে ধীরে সংস্থাগুলিতে হোমো স্যাপিয়েন্সদের সরিয়ে দিয়ে সর্বস্তরে হোমো ইনটেলেক্টাসদের জায়গা পাকা হয়ে গেল। ক্রমশ কোণঠাসা হতে হতে পরের পাঁচ দশকে স্যাপিয়েন্সরা সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির অন্তর্গত হয়ে গেল।
আর তখনই শুরু হল আসল খেলা। এতদিন ধরে যে হিংসা, দ্বেষ, বর্বরতা ইনটেলেক্টাসরা গোপনে জমিয়ে রেখেছিল, তা প্রকাশ করতে শুরু করল। ইতিমধ্যে কয়েক প্রজন্মের ব্যবধানে ইনটেলেক্টাসদের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। তাদের জিনে লুকিয়ে-থাকা পাশবিক প্রবৃত্তি ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছিল। উগ্র, বন্য, আদিম সেই প্রবৃত্তি। তারা সরাসরি আক্রমণ করতে শুরু করল স্যাপিয়েন্সদের উপর। অবাধে চালাল হত্যালীলা। স্যাপিয়েন্সদের হাহাকারে গুঞ্জরিত হল চরাচর। তারা যে শুধুই স্যাপিয়েন্সদের হত্যা করল, তা নয়। এই হত্যালীলাকে তারা এক খেলার পর্যায়ে নিয়ে গেল। দলবদ্ধভাবে আচম্বিতে আক্রমণ করে তারা ঘিরে ফেলত স্যাপিয়েন্সদের এলাকা। তারপর খুঁজে খুঁজে জান্তব অত্যাচার চালাত প্রতিটি সদস্যের উপর। ধীরে ধীরে অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দিত তাদের। তারপর রুধিরাক্ত দেহগুলিকে বেঁধে ফেলে রাখত নিয়তির ভরসায়।
এলাকার পর এলাকা ক্রমশ স্যাপিয়েন্সশূন্য হয়ে যেতে শুরু করল। শহরের পর শহর খালি হয়ে যেতে লাগল। শহরগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থেকে ক্রমশ প্রকৃতির গ্রাসে জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ল। ইনটেলেক্টাসরা কিন্তু স্যাপিয়েন্সদের শহরে বাস করল না। তারা বলত এসব আদিম প্রযুক্তির আবর্জনা। তারা উঁচু পাঁচিল-ঘেরা নিজেদের আধুনিক দুর্গনগরী স্থাপন করল।
নগর ছেড়ে স্যাপিয়েন্সরা অরণ্যের আশ্রয়ে চলে যেতে বাধ্য হল। কিন্তু তাতেও মুক্তি নেই। ইনটেলেক্টাসদের মধ্যে জান্তব প্রবৃত্তি ততদিনে সীমাহীন হয়ে উঠেছে। এদিকে ততদিনে স্যাপিয়েন্সরা সংখ্যায় নগণ্য। অনেক খুঁজে তবে জঙ্গলের গভীরে তাদের দেখা পাওয়া যায়। তাই ইনটেলেক্টাসরা এক নতুন খেলায় মেতে উঠল। ট্রফি হান্টিং, মৃগয়া। স্যাপিয়েন্সরাও একসময়ে এই খেলা খেলত, কিন্তু এখন ব্যাপারটা একটু পালটে গিয়েছে। তারা এখন আর শিকারি নয়, বরং তারাই শিকার। স্যাপিয়েন্সদের যত বড়ো শহর পরিত্যক্ত, জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় পড়ে ছিল, সেই শহরগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠল মৃগয়াভূমি। ইনটেলেক্টাসরা বন্দি স্যাপিয়েন্সদের এই জঙ্গলে ছেড়ে দেয়, তারপর পিছু ধাওয়া করে খুঁজে খুঁজে তাদের শিকার করে। পরিত্যক্ত শহরে যেহেতু লুকোনোর জায়গা বেশি তাই শিকারের আনন্দও বেশি।
তিন
পশুপতি একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল সাইনবোর্ডটার দিকে। তার হাত-পা যেন অসাড় হয়ে আসছে। যে বিপদকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল সে, নিজের অজান্তেই সেই বিপদের সামনে এসে পড়েছে।
সাইনবোর্ডের উপরে একটা খুলি ঝুলছে। অবশ্যই সেটা কোনো এক হতভাগ্য স্যাপিয়েন্সের। পশুপতি কয়েক মুহূর্ত একদৃষ্টে সেই খুলিটার দিকে তাকিয়ে রইল।
রুদ্র দেখল, জিকোর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। সে বিড়বিড় করে কী সব বলে চলেছে।
পশুপতি রুদ্রর দিকে তাকিয়ে গম্ভীরস্বরে বলল, “ভাগ্য খারাপ, আমরা ঘুরতে ঘুরতে ওদের মৃগয়াভূমিতে ঢুকে পড়েছি। আমাদের অত্যন্ত সতর্ক হয়ে পথ চলতে হবে।”
“হয়তো ওরা জানার আগেই আমরা এই এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারব। এখনও তো দিনের আলো বাকি আছে।”
কথাটা রুদ্র ভুল বলেনি। ইনটেলেক্টাসদের একটাই দুর্বলতা তাদের সূর্যের আলোয় কষ্ট হয়। তাই তারা সারাদিন দুর্গের ভিতরে কাজ করে, আর রাত নামলেই শিকারে বের হয়। তবে রাতে তাদের দৃষ্টি অত্যন্ত প্রখর হয়ে ওঠে, সঙ্গে জান্তব প্রবৃত্তিও পাল্লা দিয়ে বেড়ে যায়।
পশুপতি মাথা নাড়ল, “ভুলে যেয়ো না এটা শীতের দুপুর। এখনই চারপাশ কেমন নিঝুম হয়ে এসেছে। সূর্য মাঝ-আকাশ থেকে পশ্চিমে হেলে পড়েছে অনেকক্ষণ। আর ঘণ্টাখানেক পরই ঝুপ করে সন্ধে নামবে। আমাদের হাতে একদম সময় নেই।”
জিকো কাঁপা গলায় বলল, “আমরা বরং যে পথ দিয়ে এসেছি, সেই পথে ফিরে যাই, তাহলেই ওরা আমাদের কথা জানতে পারবে না।”
পশুপতি ভ্রূকুঞ্চিত দৃষ্টিতে একবার তাকাল, তারপর তাচ্ছিল্য-মেশানো গলায় বলল, “ওরা তোমার মতো নিম্নবুদ্ধির প্রাণী নয়। আমরা এই এলাকায় ঢুকেছি, সেই খবর ওদের কাছে ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে। ওদের মৃগয়াভূমির নানান জায়গায় লুকোনো ক্যামেরা ও লেজ়ার সেন্সার আছে। এখানে ওদের অজান্তে কেউ লুকিয়ে ঢুকতে পারে না।”
“আমি মরতে চাই না।” জিকো আঁতকে উঠল।
“আমারও তেমন কোনো ইচ্ছে নেই।” প্রৌঢ় নির্বিকার গলায় বলল, “কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূল।”
“আমাদের দ্রুত একটা লুকোনোর জায়গা খুঁজতে হবে।” রুদ্র বলল।
ঠিক তখনই পশুপতি ইশারায় সবাইকে থামতে বলল। সে কান খাড়া করে কিছু শোনার চেষ্টা করল। তার দেখাদেখি বাকিরাও মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করল। একটা অস্পষ্ট আওয়াজ। একটানা নয়। থেমে থেমে বাজছে।
পশুপতি চমকে উঠল, “ওরা জেনে গিয়েছে আমাদের কথা। দুর্গের মধ্যে সাইরেন বাজাচ্ছে।”
রুদ্র বলল, “আর সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। আমাদের দ্রুত লুকোনোর জায়গা খুঁজতে হবে।”
তিনজনে আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত জঙ্গলাকীর্ণ পথ ধরে ছুটতে শুরু করল। জঙ্গলের মধ্যে এমনিতে পথ খুঁজে পাওয়া মুশকিল, কিন্তু এই জঙ্গলটির মাঝবরাবর একটা বহুকালের পরিত্যক্ত রাজপথ চলে গিয়েছে। সেই পথের পিচ ও কংক্রিটের আস্তরণ বহুকাল আগেই ঝড়, জল, বৃষ্টিতে ধুয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। বহুকাল ব্যবহার না-হওয়ায় জঙ্গল ও আগাছায় রাস্তাটি প্রায় ঢাকা পড়ে গেলেও, পথের চিহ্ন বুঝতে সমস্যা হয় না। হয়তো এই পথ কোনো পরিত্যক্ত শহর পর্যন্ত নিয়ে যাবে। বেশ কিছুক্ষণ দৌড়োনোর পর তারা যেখানে উপস্থিত হল, সেখানে জঙ্গল অপেক্ষাকৃত পাতলা।
প্রৌঢ় পথের দু-ধারে জঙ্গলের মধ্যে কিছু অনুসন্ধান চালাল। তারপর ফিরে এসে বলল, “যা ভেবেছিলাম, ঠিক তা-ই। এখানে পরিত্যক্ত শহরের চিহ্ন বর্তমান, চারপাশে ধ্বংসপ্রাপ্ত ইমারতের ইট ছড়িয়ে আছে। আর-একটু এগিয়ে দেখা যাক, যদি মূল শহরটা খুঁজে পাওয়া যায়।”
বেশি দূর যেতে হল না। মাইলখানেক হাঁটার পর দেখা পাওয়া গেল পরিত্যক্ত শহরটির। বিশাল বিশাল অট্টালিকা ঢাকা পড়ে গিয়েছে বড়ো বড়ো গাছের নাগপাশে। পলেস্তারা খসে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ইটের পাঁজর। তার উপর প্রকৃতি পরম মমতায় লেপে দিয়েছে শ্যাওলার প্রলেপ, প্রাচীন খড়খড়ির জানলাগুলি রোদে-জলে পচে খসে পড়েছে। ইটের পাঁজরে গজিয়ে-ওঠা বট-অশ্বত্থের বিপুল ভারে বেশির ভাগ বাড়িরই অনেকাংশ ভেঙে পড়েছে। কোনো কোনো বাড়ির ছাদ ভেঙে গিয়েছে, কোনো কোনো বাড়ির শুধু থামটুকুই অবশিষ্ট আছে। যদিও সবটাই কষ্ট করে দেখতে হচ্ছে, জঙ্গল ও আগাছায় সবটাই ঢাকা পড়ে গিয়েছে। এই শহর কত যুগ ধরে যেন অপেক্ষায় ছিল কোন আগন্তুকের। রুদ্ররা শহরের পরিধিতে ঢুকতেই জঙ্গলের মধ্যে অসংখ্য পাখির কিচিরমিচিরে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠল। মানুষের কোলাহলবর্জিত বিশাল বিশাল ইমারতকে কালের অমোঘ নিয়মে প্রকৃতি গ্রাস করেছে। যে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে মানুষ শহর তৈরি করেছিল, সেই প্রকৃতি শুধু যে মানুষকে রাজার আসন থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে, তা-ই নয়, তার সাম্রাজ্যকেও আত্মস্থ করেছে।
পশুপতি বলল, “আমি বহুকাল আগে একটা বই পড়েছিলাম, অক্ষরগুলো প্রাচীন এক ভাষার লেখা ছিল, যা আজ আর কেউ তেমন ব্যবহার করে না। আমার বাবা জানতেন সেই ভাষা। তিনি আমায় শিখিয়েছিলেন। সেই বইতে আমি এমন সব ইমারত দেখেছিলাম। কিন্তু এই ধরনের ইমারত বিংশ শতাব্দীতে তৈরি হত। আমাদের একবিংশ শতাব্দীর কোনো ইমারত খুঁজতে হবে। সেগুলি স্থাপত্যের দিক থেকে জঘন্য। কিন্তু সেগুলিতে কক্ষের সংখ্যা অনেক। আমাদের লুকিয়ে থাকতে সুবিধা হবে।”
রুদ্র কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু পশুপতি তাকে ইশারায় থামিয়ে বলল, “শুনতে পাচ্ছ?”
রুদ্র মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করল। অনেক দূরে একটা শিঙা বাজছে।
রুদ্র আকাশের দিকে তাকাল, গোধূলিবেলা, ক্রমশ অন্ধকার নেমে আসছে। রুদ্র অস্ফুটে বলল, “ওরা এসে পড়েছে। শিকারের খেলা শুরুর আগে শিঙায় ফুঁ দিয়ে ঘোষণা করছে। আর সময় নেই।”
পশুপতির ভ্রূকুঞ্চিত হল, সে চিন্তামগ্ন কণ্ঠে বলল, “দ্রুত একটা সুরক্ষিত জায়গার খোঁজ করতে হবে। সতর্ক থাকো, হাতের অস্ত্র নিয়ে তৈরি থাকো। অত সহজে কারও শিকার হব না। মরতে হলে, মেরে মরব।”
জিকো বলল, “আমরা যদি বড়ো বড়ো গাছের উপরে চড়ে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারি তাহলে? এই ঘন জঙ্গলে ওরা আমাদের খুঁজেও পাবে না।”
পশুপতি দলপতি মাথা নাড়ল, “খোলা জায়গায় থাকলে আমাদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। এ ছাড়া রাতের বেলায় বন্যজন্তুরও ভয় আছে। আমাদের কোনো একটা পরিত্যক্ত বহুতলেই আশ্রয় নিতে হবে।”
রুদ্র বলল, “তোমরা দুজনে পিছন পিছন এসো। আমি এগিয়ে গিয়ে দেখছি, কোথায় লুকোনোর জায়গা পাওয়া যায়।”
রুদ্র জঙ্গলে ঢাকা রাজপথ ধরে ছুটতে শুরু করল।
বেশ কিছুক্ষণ ছুটে আসার পর, ক্রমশ ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর আরও বেশি চোখে পড়তে শুরু করল। রুদ্র খুঁজতে খুঁজতে একটা বহুতলের সামনে উপস্থিত হল। বহুতলটি জরাজীর্ণ, জঙ্গলাকীর্ণ হলেও এখনও ভেঙে পড়েনি। রুদ্র হাতের অস্ত্রটিকে শক্ত করে ধরল। তার হাতে তিরধনুক এবং কোমরে ছোরা।
একসময় স্যাপিয়েন্সরা অনেক অত্যাধুনিক অস্ত্র বানাতে পারত। কিন্তু ইনটেলেক্টাসরা আইন করে নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সমস্ত অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করে নেয়। যারা অস্ত্র বানাতে পারত, তাদের কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। ফলত স্যাপিয়েন্সদের বাধ্য হয়েই মধ্যযুগীয় পুরাতন অস্ত্রের ব্যবহারে ফিরতে হয়েছিল।
রুদ্র সন্তর্পণে বাড়িটির মধ্যে প্রবেশ করল। ঢুকেই বড়ো হলঘরের মতো জায়গা, পুরোটাই আগাছা, পচা পাতা আর শ্যাওলায় ঢাকা। অন্ধকার হয়ে এসেছে। হঠাৎ দুটো চারপেয়ে প্রাণী তার চোখে পড়ল। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। ভালো করে ঠাওর করার আগেই সেগুলি তার পাশ কাটিয়ে বাইরে জঙ্গলে পালিয়ে গেল। দুটো শেয়াল।
হলের শেষ প্রান্তে একটা সিঁড়ি। রুদ্র সিঁড়ি ধরে সন্তর্পণে উপরে উঠতে শুরু করল। চারতলায় পৌঁছে দেখল, তারপরে উপরে ওঠার সিঁড়ি ভেঙে পড়েছে। সে চারতলার ঘরগুলো ভালো করে দেখল। বারান্দায় দাঁড়ালে অনেক দূর অবধি দেখা যায়। যে রাস্তা ধরে সে এসেছিল, সেই রাস্তার শেষ প্রান্তে দলের বাকি দুজনকে দেখা যাচ্ছে, দ্রুতপায়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে। উঁচু উঁচু গাছের ডাল প্রায় চারতলার বারান্দায় ঢুকে পড়েছে। রুদ্র ঠিক করল, এখানেই আশ্রয় নেবে আজ রাতের জন্যে। অন্তত এখান থেকে আগত শত্রুর উপর নজর রাখা যাবে। সে মুখ দিয়ে সাংকেতিক শব্দ করে দলের বাকিদের তার অবস্থান জানিয়ে দিল।
চার
রাত্রি নেমেছে, ঘণ্টাখানেক হয়ে গিয়েছে। এখানে গাছগাছালির ঘনত্ব আপেক্ষাকৃত কিছুটা কম হওয়ায় চাঁদের আলো মাটি ছুঁতে পারছে। ধূসর জ্যোৎস্নায় চারপাশের অন্ধকার কিছুটা হলেও তরল হয়েছে। রুদ্র রাস্তার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে প্রহরায় বসে আছে। একটা মিহি কুয়াশার আস্তরণ দৃষ্টিপথে অস্পষ্টতা সৃষ্টি করছে। চারপাশের শতাব্দীপ্রাচীন বনভূমি অশরীরী ছায়ার মতো তাদের যেন গ্রাস করতে আসছে। প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার আতঙ্কে তিনজনেরই যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে।
জঙ্গলের মধ্যে এতক্ষণ বেশ অসংখ্য রাতজাগা পাখির ডাক, বন্যজন্তুদের গর্জন ভেসে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ সমস্ত শব্দ একসঙ্গে থেমে গিয়ে এক অসীম নৈঃশব্দ্য নেমে এল চরাচর জুড়ে। বনবাসী সমস্ত প্রাণী যেন কোনো করাল আতঙ্কে একসঙ্গে চুপ করে গিয়েছে।
পশুপতি চিন্তামগ্ন কণ্ঠে বলল, “বিপদ আমাদের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। ইনটেলেক্টাসদের উপস্থিতিতে জঙ্গলের বাকি প্রাণীরা চুপ করে গিয়েছে।”
রুদ্র বলল, “ওরা কতদূরে বোঝা যাচ্ছে না বটে, তবে আমরা যদি এখানেই লুকিয়ে সারারাত্রি কাটিয়ে দিতে পারি তাহলে…”
প্রৌঢ় ইশারায় রুদ্রকে থামতে বলল, তারপর ফিশফিশ করে বলল, “শুনতে পাচ্ছ?”
রুদ্র শুনতে পেল, একটু দূরেই একটা পাখি একটানা ডেকে চলেছে। এই পাখির নাম কাজিয়াল। ইনটেলেক্টাসরা জিন থেরাপির মাধ্যমে এদের তৈরি করেছিল স্যাপিয়েন্সদের উপর নজর রাখার জন্যে, কিন্তু বন্য পরিবেশে মুক্তি দেওয়ার পর এরা উলটো আচরণ করতে শুরু করে। ইনটেলেক্টাসরা কাছাকাছি থাকলেই এরা একটানা ডেকে সকলকে সতর্ক করে দেয়।
রুদ্র তাড়াতাড়ি বারান্দায় গিয়ে নিজেকে যতটা সম্ভব আড়াল করে রাস্তার দিকে নজর রাখতে শুরু করল।
জ্যোৎস্না-মাখা রাস্তার শেষ প্রান্তে দুটি ছায়ামূর্তি নজরে এল। ক্রমশ তারা আরও কাছে এসে রুদ্রদের ডেরার একটু দূরে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের পরনে কালো রঙের শিকারের পোশাক, হাতে অত্যাধুনিক লেজ়ার বন্দুক। অন্ধকারেও তাদের চোখ জ্বলজ্বল করছে। তাদের আকার-আকৃতিও সাধারণ মানুষের থেকে বেশ বড়ো ও পেশিবহুল। তাদের মধ্যে একজন একটা যন্ত্র বের করে কী যেন দেখল, হয়তো এই মৃগয়াভূমির ডিজিটাল নকশা। আরেকজন জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে স্যাপিয়েন্সদের ঘ্রাণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করল এবং কয়েক মুহূর্ত পরেই সে হঠাৎ থেমে গিয়ে তার সঙ্গীকে কিছু একটা বলল।
“ওরা কি আমাদের ঘ্রাণ পেয়ে গেল? তাহলে তো শেষ আঘাতের জন্যে প্রস্তুত হতে হয়।” পশুপতি কখন যে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, রুদ্র খেয়ালই করেনি।
হঠাৎ সেই দুজন শিকারি দুটো আলাদা বাড়ির মধ্যে দ্রুত ছুটে ঢুকে পড়ল। আর তারপরই একটা গুলির শব্দ শোনা গেল।
আর সময় নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা রুদ্রদের বহুতলেও আসবে শিকারের খোঁজ চালাতে।
রুদ্র উদ্বেগ প্রকাশ করে বলল, “আমার কাছে একটা পরিকল্পনা আছে, তাতে দলের বাকিদের প্রাণ বাঁচতে পারে।”
“কী পরিকল্পনা?” পশুপতির গলায় চিন্তার ছায়া।
“আমি রাস্তায় বের হয়ে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। ওরা আমার পিছু নিলে আমি ওদের এখান থেকে যতটা সম্ভব দূরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। তোমরা দুজন সেই সুযোগে এখান থেকে বেরিয়ে, যে আবাসনগুলোয় ওরা ইতিমধ্যেই তল্লাশি চালিয়েছে, সেখানে গিয়ে লুকিয়ে পড়বে।”
“আর তোমার কী হবে?” পশুপতি গম্ভীর গলায় বলল।
রুদ্র এক মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল। তারপর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, “আমি ওদের হাত থেকে বাঁচতে পারলে ভালো। আর যদি না ফিরি তাহলেও অসুবিধা নেই। ওরা আশা করি, একই জায়গায় বারবার তল্লাশি করবে না। কোনোমতে লুকিয়ে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারলেই তোমরা বিপন্মুক্ত হয়ে যাবে।”
পশুপতি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল, “তুমি আমাদের জন্যে প্রাণের ঝুঁকি নেবে?”
রুদ্র কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই রাস্তার দিকে তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গিয়েছে। দুজন শিকারি দুটি আবাসন থেকে বেরিয়ে এসেছে। একজনের হাতে একটা মৃত শেয়াল। দৃশ্যতই এত ছোটো শিকারে তারা খুশি নয়। তারা ধীরপায়ে রুদ্রদের আবাসনের দিকে এগিয়ে আসছিল, কিন্তু হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। রুদ্র দেখল, তাদের আবাসন থেকে একজন বেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। চাঁদের আলোয় সে স্পষ্ট দেখল সেই মানুষটিকে। সেই রুগ্ণ চেহারা তার চেনা। জিকো। সে এই আবাসনে ঢোকার পর থেকে তেমনভাবে কারও সঙ্গে কথাই বলেনি। আতঙ্কে জড়সড়ো হয়ে এককোনায় বসে ছিল।
কিন্তু অন্ধকারে কখন যে সে চুপিসারে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গিয়েছে, রুদ্ররা খেয়ালই করেনি। সে কি রুদ্রর পরিকল্পনা শুনে নিজেই তার জায়গায় আত্মত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিল? নাকি শিকারিরা এরপরে এই আবাসনে ঢুকবে এই আতঙ্কে, সে চুপিসারে আরও দূরে পালিয়ে যাবে বলে রাস্তায় নেমেছিল? কারণ যা-ই হোক, এই মুহূর্তে শিকার ও শিকারি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।
রুদ্র তিরধনুক বের করে দ্রুত লক্ষ্য স্থির করার চেষ্টা করল, কিন্তু পশুপতি তাকে বাধা দিল। এতদূর থেকে তিরের আঘাতে শিকারিদের কতটা ক্ষতি হবে জানা নেই, কিন্তু তারা রুদ্রদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যাবে।
রুদ্র ও পশুপতি দুজনেই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকল, কী হয় দেখার জন্যে।
দুজন শিকারির চোখ শিকারকে দেখে চকচক করছে।
জিকোর মুখ দিয়ে গোঙানির মতো শব্দ বেরোল। তারপর সে উলটোদিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করল। শিকারিরা ধীর গতিতে ছুটে এসে রুদ্রদের আবাসনের ঠিক নীচে দাঁড়াল। তারপর তাদের মধ্যে একজন মাথা তুলে তাকাল। তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় তাদের মুখ পরিষ্কার দেখা না গেলেও রুদ্রর মনে হল, সে শিকারি যেন সরাসরি তার দিকেই তাকাল। সঙ্গে সঙ্গেই রুদ্রর শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত বয়ে গেল।
শিকারিটা তার সঙ্গীকে যেন কী বলল, তারপর সে দ্রুতপায়ে রুদ্রদের আবাসনে ঢুকে পড়ল। আর তার সাথি পাশবিক উল্লাসে চিৎকার করে জিকো যেদিকে গিয়েছে, সেদিকে দ্রুতগতিতে ছুটে গেল।
পাঁচ
আবাসনের সিঁড়ি বেয়ে শিকারিটির পদধ্বনি ক্রমশ উপরে উঠে আসছে। পশুপতি ফিশফিশ করে বলল, “আজ মরলে চলবে না। আজ প্রতিশোধের রাত। শিকারির শিকার হওয়ার রাত।”
বারান্দা দিয়ে চাঁদের আলো এসে ঘরের মাঝখানে পড়েছে। বাকি অংশে জমাট বেঁধে আছে অন্ধকার।
পশুপতি রুদ্রকে ইশারায় ঘরের এককোনায় মসিকৃষ্ণ অন্ধকারে লুকিয়ে দাঁড়াতে বলল। তারপর সে হাতের বল্লমটা শক্ত করে ধরে শিকারির প্রতীক্ষায় দরজার সোজাসুজি, জ্যোৎস্নার আলোয় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শিকারির পদশব্দ যখন প্রায় ঘরের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছে, ঠিক সেই সময় দূর থেকে পরপর গুলির শব্দ ভেসে এসে অরণ্যের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খানখান করে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় একসঙ্গেই ভেসে এল এক আর্তনাদের শব্দ এবং এক জান্তব উল্লাসের হর্ষধ্বনি। রুদ্রর বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। তাহলে কি…?
ঠিক সেই মুহূর্তে শিকারিটি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। পশুপতিকে সামনে দেখেই সে মুখ থেকে যে জান্তব উল্লাসধ্বনি বের করল, তা অবিকল নেকড়ের মতো। ভয়ংকর সেই শব্দ যেন হৃদয়ে কাঁপন লাগায়। তার চোখে বর্বর, পাশবিক প্রবৃত্তি জ্বলজ্বল করছে। সে তার লেজ়ার বন্দুক তাক করেছে পশুপতির দিকে। বন্দুকের ট্রিগার সে টিপতে যাবে, ঠিক সেই সময় রুদ্র ছোরা হাতে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একের পর এক ছোরার আঘাতে সে শিকারিকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলল।
পশুপতিও সেই সুযোগে হাতের বল্লম দিয়ে আঘাত করল শিকারির পায়ে। তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল শিকারিটি। সে রুদ্রকে এক হাতে তুলে ধরল। তারপর খোলামকুচির মতো অনায়াসে ঘরের কোনায় ছুড়ে ফেলে দিল।
এই প্রথমবার রুদ্র সরাসরি ইনটেলেক্টাসদের শারীরিক শক্তির নমুনা দেখল। তীব্র আঘাতের ফলে সে কয়েক মুহূর্ত সংজ্ঞাহীনের মতো পড়ে রইল।
শিকারিটি নিজেকে সামলে নিয়ে আবার পশুপতির দিকে বন্দুক তাক করতে যাবে এমন সময় পশুপতি সর্বশক্তি দিয়ে হাতের বল্লমটা ছুড়ে মারল। বল্লমটা শিকারির বুকে বিদ্ধ হতেই সে বনভূমি কাঁপিয়ে এক তীব্র চিৎকার করে উঠল। কিন্তু সেই অবস্থাতেও সে শেষ আঘাতটা করে গেল। বন্দুকের ট্রিগারটা টিপে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গেই পশুপতির শরীর ঝাঁজরা হয়ে গেল।
রুদ্র ততক্ষণে নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ালেও চোখের সামনে পশুপতির মৃত্যু দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। শিকারিটি মাটিতে পড়ে থাকলেও তখনও বেঁচে আছে। সে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে উঠে বসে আবার রুদ্রর দিকে বন্দুক তাক করতে গেল। কিন্তু রুদ্র সেই সুযোগ দিল না। ছুটে এসে ছোরাটা বসিয়ে দিল শিকারির কণ্ঠদেশে।
রুদ্র জানে, শিকারিটির সঙ্গী কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে। তখন রুদ্রর একার পক্ষে তাকে আটকানো সম্ভব হবে না। সে পশুপতির নিথর দেহের দিকে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার চোখ ছলছল করে উঠল। কিন্তু সে জানে এটা দুর্বল হয়ে পড়ার সময় নয়। তাকে এখুনি এখান থেকে পালাতে হবে।
সে শিকারির বন্দুকটা হাতে তুলে নিল। যদিও এটার ব্যবহার সে জানে না, তবে বিপদের সময় এটা কাজে দিতে পারে। সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে শুরু করল। দোতলায় পৌঁছোতেই অনতিদূরে জঙ্গলের মধ্যে বাঘের গর্জন শুনতে পেল।
ইনটেলেক্টাসদের হাত থেকে পালাতে গিয়ে শেষে কি বাঘের মুখে পড়তে হবে?
রুদ্র ভাবল, এইভাবে বিপদের ভয়ে লুকিয়ে বাঁচা যায় না, তার চেয়ে ভালো সেটার মুখোমুখি হওয়া।
সে দ্রুতপায়ে আবাসন থেকে বেরিয়ে এসে জংলা গাছে ঢাকা রাস্তার উপর এসে দাঁড়াল। জ্যোৎস্নার আলোয় রাস্তার উপর বহু দূর অবধি দেখা যাচ্ছে। পথের শেষ প্রান্তে অস্পষ্ট কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। রুদ্র মনোযোগ দিয়ে দেখল সেইদিকে। ক্রমশ অস্পষ্ট ছায়ামূর্তিটি খানিক স্পষ্ট হল। সেই দ্বিতীয় ইনটেলেক্টাস শিকারিটি ফিরে আসছে। সে-ও হয়তো রুদ্রকে দেখতে পেয়েছিল, তাই মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়িয়েছিল।
রুদ্র এর মধ্যেই ভেবে নিল, তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। সে দ্রুত রাস্তা পার করে উলটোদিকের ঘন জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। জঙ্গল এখানে বেশ গভীর। চাঁদের আলোও এসে পৌঁছোচ্ছে না ঠিকমতো। অন্ধকারে পথ খুঁজে পাওয়া শুধু যে মুশকিল তা-ই নয়, লতাপাতায় বেশির ভাগ দিকেই রাস্তা প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যেই রুদ্র দৌড়োতে শুরু করল ছুরি দিয়ে সামনের ডালপালা, লতাপাতা যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে সে দৌড়ে চলল। চারপাশে ঝিঁঝিপোকার ডাক, সাপের হিসহিস আর বন্যজন্তুদের ডাক। আর সব কিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে দ্রুত ছুটে-চলা রুদ্রর পায়ের শব্দ।
মাঝে মাঝে দম নেওয়ার জন্যে সে দাঁড়াচ্ছে। তার বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে শুনতে পাচ্ছে দূরে অন্য আর-একজনের দ্রুত ছুটে আসার অস্পষ্ট শব্দ। শিকারি শিকারের ক্রমশ কাছে আসছে। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে আবার ছুটতে শুরু করতে হচ্ছে। সে জানে না, কতক্ষণ এমন পালিয়ে বাঁচতে পারবে সে। রাত এখনও অনেক বাকি।
হঠাৎ সে এক জঙ্গলের মধ্যে এক অদ্ভুত স্থাপত্যের সামনে এসে হাজির হল। মূল প্রবেশদ্বার ভেঙে পড়েছে। বুনো আগাছা-ঢাকা, শ্যাওলা-মাখা একটা সিংহের মূর্তি পড়ে আছে প্রবেশদ্বারের পাশে। শতাব্দীর বিস্মৃতিতে মূর্তিটার এক-তৃতীয়াংশ মাটির নীচে চলে গেছে। রুদ্র সন্তর্পণে বসে একবার মূর্তিটার গায়ে হাত রাখল। শ্বেতপাথরের তৈরি। একসময় এই বিশ্রামরত সিংহমূর্তির রাজকীয় জৌলুস কেমন ছিল, তা আজ আর কল্পনাও করা যায় না।
হঠাৎ একটা বিছে মূর্তিটার গা বেয়ে উঠে এল, সঙ্গে সঙ্গেই রুদ্র ভয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে ছিটকে উঠে দাঁড়াল। আশপাশে জঙ্গল অত্যন্ত ঘন। একটা সরু রাস্তার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, রুদ্র সেই পথেই ছুটে এগিয়ে চলল। মাঝে একটা ছোটো মঞ্চের মতো জায়গা নজরে পড়ল। বেশ কিছু সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে তার উপরে উঠতে হবে। উপরে কী আছে, ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না। ঘন জঙ্গলে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। রুদ্র আবার সেই শিকারির পদধ্বনি শুনতে পেল অস্পষ্টভাবে। জঙ্গলের শুকনো ডালপালা তার পায়ের চাপে মড়মড় করে ভেঙে যাচ্ছে। সে খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে রুদ্ররই দিকে।
রুদ্র দৌড়োনোর বেগ বাড়িয়ে দিল, কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না। হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে সে একটা অট্টালিকার সামনে হাজির হল। রুদ্র বিস্মিত হয়ে গেল। কী অপরূপ, কী বিশাল সেই স্থাপত্য। এ কি কোনো রাজপ্রাসাদ ছিল? মানুষের পক্ষে কি এত সুন্দর প্রাসাদ বানানো সম্ভব?
প্রাসাদের সর্বত্র কালের বিস্মৃতি। বড়ো বড়ো গাছে ঢেকে গিয়েছে সর্বাঙ্গ। প্রাসাদের একাংশ প্রকৃতির গ্রাসে ভেঙে পড়েছে। তবুও জ্যোৎস্নার মায়া-আলোয় এই প্রাসাদের প্রাচীন গৌরব অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না। শ্বেতপাথরে কালের ছোপ পড়লেও আভিজাত্য হারিয়ে যায়নি।
প্রাসাদে ঢোকার মুখে বিস্তৃত সোপানশ্রেণি জংলা গাছে ঢাকা। তাতে হরেকরকম বুনোফুল ফুটে আছে। একটা মিঠে গন্ধ নাকে আসছে। হয়তো ফুলগুলো থেকে। রুদ্র সন্তর্পণে সেই প্রাসাদে প্রবেশ করল।
প্রাসাদটা অদ্ভুত। মানুষ যদি বসবাসের জন্যেই এটা বানিয়ে থাকবে তাহলে কক্ষ কোথায়? জঙ্গলে ঢাকা একটা বিশাল গোলাকৃতি হলঘর। মেঝেটা শুকনো পাতায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে। ঘরের মাঝে একটা শূন্য বেদি। মেঝেতে এক নারীমূর্তির ভগ্নাবশেষ পড়ে আছে। ডানদিকে অপেক্ষাকৃত ছোটো একটা হলঘর। উপরে তাকালে বোঝা যায় প্রাসাদের মাথার গম্বুজ অবধি ছাদটা বিস্তৃত। বামদিকের হলঘরটির ছাদ ভেঙে পড়েছে, সেইদিকটা জঙ্গলাকীর্ণ। জ্যোৎস্নার আলো এসে সেই জায়গাটাকে আলোকিত করেছে। সেই আলোয় গোলাকার হলঘরটিও আলোকিত হয়েছে কিছুটা। দোতলায় একটা টানা বারান্দা দেখা যাচ্ছে। বারান্দাটা হলঘরের দিকে মুখ করা এবং হলঘরের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বৃত্তাকারে বিস্তৃত। স্থানে স্থানে তার রেলিং ভেঙে গিয়েছে। দোতলায় কোনো ঘর আছে নাকি বোঝা যাচ্ছে না, জঙ্গলে ঢেকে রয়েছে।
এটা মানুষের থাকার জন্যে হতেই পারে না, হয়তো এটা কোনো সভাগৃহ ছিল। রুদ্র দোতলায় ওঠার সিঁড়ির খোঁজ করতে শুরু করল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সে তার পিছনে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ শুনতে পেল। শিকারি তার পিছু নিয়ে এখানে হাজির হয়েছে।
শিকারি রুদ্রকে বাগে পেয়ে মুখ থেকে নেকড়ের মতো জান্তব উল্লাসধ্বনি বের করল। রুদ্র এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তার হাতে ধরা বন্দুকের ট্রিগার টিপে দিল। কিন্তু গুলি বেরোল না।
শিকারি ইনটেলেক্টাস রুদ্রর হাতে হঠাৎ বন্দুক দেখে এক-পা পিছিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু গুলি না-চলায় সে হেসে উঠল। এক অদ্ভুত কৌতুক-মাখা শয়তানি হাসি। সে এইবার ধীরেসুস্থে নিজের হাতের বন্দুকটা রুদ্রর দিকে তাক করল। তারপর কয়েকটা বোতাম টিপতেই বন্দুকটার নল বরাবর একটা সব্জে আলো জ্বলে উঠল।
রুদ্র বুঝতে পারল, গুলি ছুড়তে হলে আগে বন্দুকটিকে সক্রিয় করতে হয়, কিন্তু এখন দেরি হয়ে গিয়েছে। শিকারিটি রুদ্রর দিকে বন্দুক তাক করে আছে। যে-কোনো সময়ে গুলি তার শরীর ভেদ করে যাবে। রুদ্র শেষের অপেক্ষায় নিজের চোখ বুজল।
ঠিক সেই সময় বাম পাশে ভেঙে-পড়া হলঘরের জঙ্গল থেকে চারপাশ কাঁপিয়ে গর্জনের আওয়াজ ভেসে এল। চাঁদের আলোয় কালো হলদে ডোরাকাটা শরীরটা ধীরেসুস্থে বেরিয়ে এল জঙ্গল থেকে। বাঘটার হিংস্র ক্ষুধার্ত চোখ তখন দুটো শিকারকে সামনে পেয়ে চকচক করছে।
ইনটেলেক্টাসটি হঠাৎ এই অনভিপ্রেত আগন্তুকের আগমনে চমকে তাকাল। স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় তার বন্দুকের নল ঘুরে গেল বাঘটির দিকে। রুদ্রও চমকে তাকিয়েছে, হাতের বন্দুকটা ফেলে দিয়ে কোমরে বাঁধা ছোরার হাতল শক্ত করে ধরেছে। কিন্তু বাঘটা রুদ্রর দিকে ফিরেও তাকাল না। সে হিংস্র চাহনিতে একবার ইনটেলেক্টাসটির দিকে তাকাল। তার মুখ দিয়ে রাগে গরগর শব্দ বেরিয়ে এল। পরক্ষণেই প্রবল হুংকার করে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইনটেলেক্টাসটির দিকে। শিকারিটিও এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ট্রিগার টিপে দিল।
গুলি বাঘটিকে বিদ্ধ করল নাকি বোঝা গেল না। কিন্তু বাঘটির থাবার সজোরে আঘাতের ফলে শিকারিটির হাত থেকে বন্দুক ছিটকে এসে পড়ল রুদ্রর পায়ের কাছে।
বাঘটি সঙ্গে সঙ্গেই শিকারির কাঁধে মরণ কামড় বসিয়ে সজোরে ঝাঁকুনি দিল। শিকারিটিও তার ডান হাতে লাগানো প্রতিরক্ষা বর্মে একটা ঝাঁকুনি দিতেই সেখান থেকে মৃদু ধাতব শব্দ করে ছোটো তরোয়ালের মতো ধারালো দ্বিফলা একটা অস্ত্র বেরিয়ে এল। সেটা দিয়ে সে বারবার বাঘটাকে আঘাত করতে শুরু করল। বাঘটা রক্তাক্ত হয়ে গেলেও সহজে তাকে ছাড়ল না। বেশ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি চলার পর বাঘটা এক ঝটকায় ইনটেলেক্টাসটিকে কিছুটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিল। তারপর টলমল পায়ে একটু এগিয়ে শুকনো পাতার উপর পড়ে গেল। বোঝা গেল, তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে।
ইনটেলেক্টাসটি তখনও বেঁচে। সাধারণ মানুষ হলে এই চরম আঘাত সহ্য করা সম্ভব হত না, কিন্তু এরা গঠনগতভাবে সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশি মজবুত। রুদ্র দেখল, ইনটেলেক্টাসটি গোঙাতে গোঙাতে উঠে বসার চেষ্টা করছে। নিজেকে ছেঁচড়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে রুদ্রর দিকে। তার চোখে আগের সেই জান্তব বর্বরতা ফিকে হয়ে এলেও একেবারে নিবে যায়নি।
রুদ্র সঙ্গে সঙ্গে ইনটেলেক্টাসটির বন্দুক হাতে তুলে নিল। সেটার নলে তখনও সবুজ আলো জ্বলছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনটি গুলি এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করে দিল ইনটেলেক্টাসটির শরীরকে।
ক্লান্ত শরীরে ধীরপায়ে রুদ্র বেরিয়ে এল প্রাসাদ থেকে। প্রাসাদের বাইরে সোপানের শেষ ধাপে গিয়ে সে বসে পড়ল। বন্দুকটা পাশে রেখে দিল শ্লথগতিতে। একবার আকাশের দিকে তাকাল সে। আজকের জন্যে মৃগয়া কি তাহলে শেষ হল নাকি আরও শিকারি এই জঙ্গলে লুকিয়ে আছে? রাত শেষ হতে যে এখনও অনেক দেরি। তারা কি রুদ্রকে খুঁজে বের করবে?
রুদ্রর খুব ক্লান্ত লাগছে, মনে হচ্ছে, যা হবে হোক, সে একটু ঘুমোতে চায়, একটু শান্তি চায়।
তার চোখ পড়ল প্রাসাদের কেন্দ্রীয় গম্বুজের একদম শীর্ষে। একটা পরির মূর্তি। দু-দিকে ডানা বিস্তৃত করে সে ট্রাম্পেট হাতে দাঁড়িয়ে যেন জয়ের ঘোষণা করছে কোন এক বিস্মৃতকাল থেকে। অপর হাতে তার একটি মুকুট ধরা, যেন বিজয়ীর মাথায় সে সেটা পরিয়ে দেবে। রুদ্রর মনে হল পরিটা তার জন্যেই সেই মুকুট হাতে অপেক্ষমাণ। পরিটির রং কালচে, হয়তো ব্রোঞ্জের তৈরি। লতানো গাছ তাকে পেঁচিয়ে আছে। চাঁদের আলো তার গা চুইয়ে পড়ছে। রুদ্রর মা তাকে বলত যে, ওর পূর্বপুরুষেরা এমন এক শহর থেকে এসেছিল যে, শহরের মাঝখানে এক শ্বেতপাথরের প্রাসাদ ছিল, তার মাথায় এক পরির মূর্তি ছিল। মা সেই শহরের নাম বলতে পারেনি, অনেক শতাব্দী আগেকার কথা বলে সেই নাম সবাই ভুলে গিয়েছে। রুদ্রর মনে হল, সে হয়তো তার পূর্বপুরুষদের শহরেই ফিরে এসেছে। তার অবসন্ন শরীর জুড়ে এক অপার শান্তি নেমে এল। সে অবসন্ন শরীরে শুয়ে পড়ল সেই সোপানের উপর। ঘুম তার আসবে না। এখনও দীর্ঘ রাত তাকে কাটাতে হবে। হয়তো অনেক পথ ছুটতেও হবে। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের জন্যে সে ভুলে যেতে চায় এটা ইনটেলেক্টাসদের মৃগয়াভূমি। সে কিছুক্ষণ এখানে চুপ করে বসতে চায়, বিশ্বাস করতে চায় এটাই তার পূর্বপুরুষদের স্মৃতির শহর। অনুভব করতে চায় তাদের মায়া-মাখা স্পর্শ।
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সুমন মিশ্র
