চার আলোর চমৎকার
লেখক: সর্বান বন্দ্যোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
প্রাক্কথন
বক্রোদ্ধার ইষ্টবোধ পার্টির কয়েকজন সদস্য আগুনখোর, আর বাদবাকি মেনিমুখো। আজ অবধি মাত্র একজনকে এক ধরন থেকে অন্য ধরনে বদলে যেতে দেখা গেছে। তাকে নিয়েই এই গল্প।
বক্রোদ্ধার ইষ্টবোধ পার্টি তখন ভারতের উদীয়মান রাজনৈতিক দল হিসেবে অনেকের আলোচনায় উঠে আসছে। বাংলায় তার মুখ বলতে স্নেহাদ্রি শানমুগম। বিরোধীরা বহিরাগত বলে নিন্দে করলেও তার সভায় লোক জড়ো হয় প্রচুর। ছ-ফুটের উপর লম্বা স্নেহাদ্রির দিকে প্রত্যেককেই চোখ তুলে চাইতে হয়; যেখানেই যান, আপনা-আপনি তিনি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। চারদিকে রটে গিয়েছিল, শিগগির তাঁকে দলের রাজ্য সভাপতি করা হবে।
দলের মধ্যে যারা স্নেহাদ্রি শানমুগমের ঘনিষ্ঠ ছিল, রঘুবীর লঙ্কেশ তাদের একজন। পঞ্চায়েত থেকে বিধানসভা পর্যন্ত প্রয়োজনীয় খবরাখবর লোক লাগিয়ে জড়ো করে আনত সে। সভায় গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে ধন্যবাদজ্ঞাপনের সময়ে স্নেহাদ্রি সব সময়ই রঘুবীরের নাম নিত। পাতলা চুল সিঁথি করে, আঁচড়ানো মাথা হেলিয়ে, মুচকি হেসে কৃতজ্ঞতা জানাত রোগাটে চেহারার রঘুবীর লঙ্কেশ।
২৯ ফেব্রুয়ারি বক্রোদ্ধার ইষ্টবোধ পার্টি উত্তরপাড়া সিএ মাঠে সভা করল। রাজ্যে শিক্ষাব্যবস্থার দুর্দশা নিয়ে স্নেহাদ্রি ও আরও কয়েকজন নেতা অনেক সমালোচনা করল। সামনে ছিল ভোট; এই সভার খবর দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আশ্চর্যভাবে দেখা গেল, কোনো বড়ো চ্যানেল বা খবরের কাগজ এর খবর করল না। সোশ্যাল মিডিয়াও অদ্ভুতরকম চুপ। দু-একটা কাগজ ছোট্ট করে ফুটনোটের মতো উল্লেখ করল, ব্যাস!
এই দেখে নড়েচড়ে বসলেন সুগ্রীব সিনহা। ক্ষমতাসীন পূর্ব তস্কর পার্টির রাজ্য স্তরের নামজাদা নেতা সুগ্রীবের নজর এড়াত না কিছুই। তিনি আরও খেয়াল করলেন, ২৯ ফেব্রুয়ারির পর থেকে রঘুবীর লঙ্কেশ যেন রাতারাতি তার দলের মধ্যে ব্রাত্য হয়ে গেছে। আর কোনো সভায় তাকে মঞ্চে দেখা যায় না। সুগ্রীব ঠিক করলেন, ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে হবে। রঘুবীর লঙ্কেশকে যদি পূর্ব তস্কর পার্টিতে ভাঙিয়ে আনা যায়, সুগ্রীবের বহু দিক থেকেই সুবিধা হবে।
সে বছর জন্মাষ্টমীর দিন সন্ধেবেলা রঘুবীর লঙ্কেশ বাড়ি ফেরার সময়ে তার পথ আটকে দাঁড়াল কনক, সুগ্রীব সিনহার এক বিশ্বস্ত কর্মী। তার সঙ্গে মুশকো চেহারার গগন। একঝলক তাকালেই বোঝা যায়, কার মুখ চলে আর কার হাত।
রঘুবীর লঙ্কেশ তাদের দেখে ভয়েই যেন আধমরা হয়ে গেল। সুগ্রীব সিনহা নিজের বাড়িতে তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন—এ কথা তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। বিশেষ যত্নে কনক তার প্রাথমিক আতঙ্ক কাটিয়ে দিলে সে আমতা আমতা করে জানাল, অন্য দলের নেতার সঙ্গে তাকে দেখা গেলে তার মান-ইজ্জত থাকবে না। বক্রোদ্ধার ইষ্টবোধ পার্টি আর যা-ই হোক, তাকে বহিষ্কার তো করেনি!
কনক বুঝল, মানুষটা ঠ্যাঁটা। ফোন মারফত বস সুগ্রীবকে আপডেট দিয়ে সে মোলায়েম গলায় রঘুবীরের কাছে তার বাড়িতে বসে আলোচনা করার অনুমতি চাইল। তাকে অনুমতি না দেওয়ার সাহস দেখাতে পারল না রঘুবীর। তিনজন ভিতরে ঢুকে যাওয়ার পর রঘুবীরের বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
তারপর আর কনক ও গগনের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।
ফোন করলে দুজনের ফোনই ডেড বলছে। রঘুবীর লঙ্কেশ বাড়ির বাইরে থাকার সময়ে লোক লাগিয়ে বাড়ির আগাপাশতলা তল্লাশি করেও সুগ্রীব সিনহা তাঁর দুই অনুচরের হদিস পেলেন না। যেন দুটো জলজ্যান্ত মানুষ স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ সুগ্রীব রঘুবীরকে অপহরণ করার চেষ্টা করলেন; দুইবারে পাঠানো চারজন চর কনক ও গগনের মতোই বেপাত্তা হয়ে গেল।
সুগ্রীবের মনে এবার রাগ ও বিস্ময়ের পাশাপাশি দেখা দিল ভয়। রঘুবীর লঙ্কেশ যে সোজা লোক না, সেটা তাঁর কাছে তখন পরিষ্কার। কিন্তু ব্যাপারটা সামাল দেওয়া জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কনক ও গগনের পরিবার সুগ্রীবের কাছে প্রতিশোধের আর্জি নিয়ে এসেছিল; তারা নির্ঘাত হতাশ হয়ে অন্যদের কাছে সুগ্রীবের নিন্দে করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দেওয়া যায় না।
তাই নিরাপত্তার ঢালাও ব্যবস্থা করে সুগ্রীব সিনহা একদিন রঘুবীর লঙ্কেশের বাড়িতে সদলবলে হানা দিলেন।
উন্মোচন
সাদামাটা একতলা বাড়িকে রাতের অন্ধকারে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল সশস্ত্র বাহিনী। একইভাবে আকাশে পজিশন নিয়ে দাঁড়াল খান দশেক ড্রোন। সুগ্রীব সিনহা এগিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলেন।
রঘুবীর লঙ্কেশ দরজা খুলে থতোমতো খেয়ে গেল। আসুন, বসুন বলার ক্ষমতাটুকুও যেন তার রইল না। সুগ্রীব সিনহা তার তোয়াক্কা না করে সোজা ঘরের ভিতর ঢুকে পড়লেন। তাঁকে অনুসরণ করল এক ডজন বন্দুকধারী, বর্মধারী অনুচর।
ঘরের প্রতিটি কোনার দখল নিয়ে তারা নিশ্চল মূর্তিবৎ দাঁড়াল। তাদের মাঝখানে, বৈঠকখানায় রাখা এক সোফায় গুছিয়ে বসে নিরাপদ বোধ করলেন সুগ্রীব সিনহা। রঘুবীর খোলা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। কোথায় যাবে যেন বুঝতে পারছিল না। সুগ্রীবের আদেশে একজন তার নড়া ধরে টেনে এনে সুগ্রীবের মুখোমুখি বসিয়ে দিল।
সুগ্রীব তাঁর অভিযোগ পেশ করলেন। বাহিনীর উপস্থিতি তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। কনক আর গগন কোথায়, তিনি প্রথমে বিনীতভাবে জানতে চাইলেন। রঘুবীর ত্রস্তকণ্ঠে বলল, সে জানে না। সুগ্রীব জিজ্ঞেস করলেন, তাদেরকে খুঁজতে যে চারজন এসেছিল, তারাই-বা কোথায়? রঘুবীর জানাল, সে বুঝতে পারছে না, সুগ্রীববাবু কাদের কথা বলছেন।
সুগ্রীব সিনহার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। হাতের রিভলভার সোজা রঘুবীরের কপালের দিকে তাক করে তিনি হিসহিসে গলায় বললেন, “চোর-পুলিশ খেলা বন্ধ করে এক্ষুনি বল, কী করেছিস। আমার টিপ ফসকায় না। বাইরে আরও লোক আছে। বাড়ি গুঁড়ো করে দিয়ে যাব। তোর পরিবার যে যেখানে আছে, কেউ বাঁচবে না।”
কিছুক্ষণ কেউ কথা বলল না। তারপর রঘুবীর লঙ্কেশ তার ঠোঁট বাঁদিকে বাঁকিয়ে অদ্ভুতভাবে হাসল। তার চোখে খেলে গেল হলুদ আলোর চমক। সুগ্রীব সিনহার হাত থেকে রিভলভার মাটিতে পড়ে গেল। মনের ভিতর চাপা দিয়ে রাখা একটা স্মৃতি হঠাৎ করে প্রবল বেগে ফুঁসে উঠে তাঁকে বিহ্বল করে দিয়েছে।
সুগ্রীবের মনে পড়ল, ২৯ ফেব্রুয়ারির সভায় তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন। উত্তরপাড়া সিএ মাঠে ভিড় উপচে পড়ছিল। প্রেস, পুলিশ, সুগ্রীবের মতো ছদ্মবেশে আসা অন্য দলের প্রতিনিধি—কারও অভাব ছিল না। সুগ্রীবের সঙ্গে ছিল কনক। কনকের সঙ্গে ছিল তার একদল চ্যালা। তারা বক্রোদ্ধার ইষ্টবোধ পার্টির সভা ভেস্তে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।
মূল বক্তা স্নেহাদ্রি শানমুগম বলতে উঠলেন। ভিড়ের মধ্যে থেকে তুমুল হাততালি পড়তে শুরু করল। সুগ্রীবের পাশ থেকে কনক তার একজন চ্যালাকে ইঙ্গিত করল। ভিড়ের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন হঠাৎ স্টেজ লক্ষ করে টুকরোটাকরা জিনিস ছুড়তে আরম্ভ করল। চটি, ঢিল, সবজি, ডিম। একটা ডিম সোজা স্নেহাদ্রি শানমুগমের দিকে ধেয়ে গেল।
কিন্তু লক্ষ্য স্পর্শ করার আগেই মাঝপথে সেই ডিমে এসে পড়ল তীক্ষ্ণ লাল আলোর এক শিখা। ডিম এক লহমায় ছাই হয়ে উবে গেল।
চকিত প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় আলোর শিখার গতিপথ অনুসরণ করে সুগ্রীব সিনহা দেখলেন, স্টেজের উপর রঘুবীর লঙ্কেশ টানটান হয়ে বসে রয়েছে। তার চোখ থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে লাল আলোর ঝিলিক।
অনেকেই স্টেজের পিছনে দৈত্যাকার স্ক্রিনে রঘুবীর লঙ্কেশের চোখ দেখে ফেলেছিল। স্নেহাদ্রি শানমুগম হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। মাঠে ঠাসা ভিড় চিত্রার্পিত, নিঃশব্দ। রাজনৈতিক সভায় কি তারা এইমাত্র ম্যাজিক দেখল?
রঘুবীর লঙ্কেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। কয়েক মুহূর্ত কেটে যাওয়ার পর সে অনুনয়ের সুরে বলল, “আমি বুঝিয়ে বলছি। দয়া করে আমাকে বলতে দিন।”
কেউ কথা বলল না। স্টেজে বিছানো গালিচার উপর দিয়ে হেঁটে স্নেহাদ্রির পাশে এসে দাঁড়াল রঘুবীর লঙ্কেশ । ভিড়ের মধ্যে ঘাপটি-মেরে-থাকা সুগ্রীব সিনহার মাথায় সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। একটা ডিম অদৃশ্য করে দেওয়া নিশ্চয়ই তেমন কোনো আহামরি ম্যাজিক নয়; কিন্তু সুগ্রীবের মনে হচ্ছিল, এটা চিরাচরিত ম্যাজিকের আওতায় পড়ে না। এর মধ্যে রয়েছে অশুভের ইঙ্গিত। পূর্ব তস্কর পার্টির জাঁদরেল নেতা সুগ্রীব সিনহাকে তাঁর শত্রুরা অশুভের মূর্ত প্রতীক বলেই চিনত। সেই সুগ্রীব গূঢ়তর অশুভের ইঙ্গিত পেয়ে জীবনে প্রথমবার যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন।
স্টেজের উপর রঘুবীর লঙ্কেশের চোখে জ্বলে উঠল গনগনে হলুদ আলো। “দয়া করে ভুলে যান, এখানে কিছু দেখেছেন। আমরা শুধু মামুলি এক সভা করছি।”
একমাত্র স্নেহাদ্রি শানমুগম মুখ খুললেন। ধরা গলায় বললেন, “আমি ভুলতে চাই না, রঘুবীর। আমার কথা তুমি ফেলবে না।”
রঘুবীর তাঁর দিকে ফিরে না তাকিয়েই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। তারপর তার চোখ থেকে হলুদ আলো উজ্জ্বল ধোঁয়ার মতো, মেঘের মতো পাক দিয়ে উঠে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মাঠের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ছেয়ে ফেলল সেই আলো; ঢেকে দিল স্টেজে বসা ও ভিড়ে দাঁড়ানো প্রতিটি মানুষকে। সুগ্রীব নিজে মগজধোলাই হওয়ার আগে খেয়াল করলেন, স্নেহাদ্রি শানমুগমের চারদিকে একটা বুদ্বুদের মতো জায়গা খালি রয়েছে। একমাত্র সে-ই মনে রাখবে সব কিছু।
বিকট আওয়াজে রঘুবীর লঙ্কেশের বাড়ির বৈঠকখানায় সুগ্রীব সিনহার সংবিৎ ফিরল। তাঁকে রিভলভার ফেলে দিয়ে হতভম্ব হয়ে যেতে দেখে তাঁর অনুচরেরা রঘুবীর লঙ্কেশকে এলোপাথাড়ি গুলি করছে। পুকুরে ঢিল ছুড়লে যেমন হয়, প্রতিটা বুলেট রঘুবীরকে ছুঁয়ে তেমনি করে উজ্জ্বল সবুজ আলোর ঢেউ ছড়িয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে পাত্তাই দিচ্ছে না। সে বরং সুগ্রীবকে বলল, “মিটিং-এর কথা সবাই ভুলেই গিয়েছিল। আপনার বড়ো বেশি কৌতূহল। এখন আমি কী করি?”
এক-এক করে সবার বন্দুক খালি হয়ে গেল। তারা তখন দরজার দিকে ফিরে দিল ছুট। কিন্তু দরজা অবধি পৌঁছোতে পারল না। “আপনারা যাবেন না!” চেঁচিয়ে উঠে রঘুবীর লঙ্কেশ তাদের দিকে হাত ওঠাল। হাত থেকে সবুজ আলোর শিখা ঠিকরে গিয়ে লাগল অনুচরদের শরীরে। তাদের বর্ম ও অস্ত্র নিরেট পাথরে বদলে গেল। দৌড়ের মাঝপথে পাথরের পোশাকে আটকে গিয়ে তারা আছড়ে পড়ল মেঝেতে।
“আপনি আসুন আমার সঙ্গে।” বলে রঘুবীর লঙ্কেশ সুগ্রীবের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। “এতগুলো মানুষ আর যন্ত্র নিয়ে এসে আপনি আমার নিরিবিলিতে থাকার প্ল্যান ভেস্তে দিয়েছেন। আমাকে এবার সবার সামনে আসতেই হবে। আপনাকে আমি ডেমো দেওয়ার কাজে লাগাব। এটাই আপনার শাস্তি।”
আত্মপ্রকাশ
পরদিন সকালে রঘুবীর লঙ্কেশ কলকাতায় একটা সাংবাদিক সম্মেলন করল। সে শুধু জানিয়ে দিল কখন, কোথায় সে দেখা দেবে। সেইমতো সকাল ১০টায় গড়ের মাঠে উপচে পড়ল ভিড়। ড্রোন মারফত রেকর্ড-হওয়া খবর হানাদার বাহিনীর কেউ ইনটারনেটে ফাঁস করে দিয়েছিল; তাই রাতের ঘটনা কারও অজানা ছিল না। রঘুবীর লঙ্কেশ পরে জানিয়েছে, মানুষকে পরিস্থিতির বিশদ বিবরণ দিতেই এই সাংবাদিক সম্মেলনের প্রয়োজন ছিল।
প্রত্যাশিতভাবেই রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন শুরু হল। কিন্তু তাতে কারও আগ্রহ নেই। জাতির মনোযোগ শুধু ও শুধুমাত্র রঘুবীর লঙ্কেশের উপর নিবদ্ধ।
মাঠের মাঝে রঘুবীর লঙ্কেশ এক টেম্পোতে চড়ে উপস্থিত হল। টেম্পোর পিছনে ক্যারিয়ারে এক স্বচ্ছ কাচের বাক্সে বন্দি সুগ্রীব সিনহা। মাঠে আসার রাস্তায় গাড়ি লক্ষ করে অনেকে ঢিল ছুড়েছে; ছুড়েছে ঢিলের চেয়ে অনেক বেশি মারাত্মক অস্ত্রও। সেইসব অস্ত্র সবুজ আলোর ঢেউ তুলে মিলিয়ে গেছে গাড়ির গায়ে।
দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে গড়ের মাঠে স্টেজ বাঁধা হচ্ছিল। সেই স্টেজে উঠে রঘুবীর লঙ্কেশ একটা টুলে বসল। কিছু লোক সুগ্রীবের খাঁচাখানা গাড়ি থেকে নামিয়ে এনে স্টেজের সামনে রাখল।
সাংবাদিকদের সামনে রঘুবীর নিজের আশ্চর্য ক্ষমতার ইতিবৃত্ত শোনাল। অপরিচিত এক গ্রামে স্কুলে পড়ার সময়ে চারজন বুলির অত্যাচারের শিকার ছিল সে। স্কুল পরিসরে সুযোগ পেলেই তারা তার উপর চড়াও হত। রোগাপটকা, গোবেচারা রঘুবীর লঙ্কেশ নিষ্ফল আক্রোশে পুড়ত, কিন্তু আর কিছু করতে পারত না।
একদিন বাড়ি ফেরার পথে তারা রঘুবীরকে মারধর করে তার জামাকাপড় ছিঁড়ে দেয়। প্রভূত মজা উশুল করে তাকে রাস্তায় ফেলে রেখে যখন তারা চলে যাচ্ছে, তখন তাদের দিকে তাকিয়ে রঘুবীর আন্তরিকভাবে এই চারটি অপোগণ্ডের মৃত্যুকামনা করেছিল। অপ্রত্যাশিতভাবে সেই ইচ্ছা মনে দানা বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে রঘুবীরের চোখ থেকে লাল আলোর শিখা ঠিকরে গিয়ে চার বুলির পিঠে লাগে, এবং দেখতে দেখতে চারটি ছেলে চারটি পোড়া লাশে রূপান্তরিত হয়। সেই থেকেই রঘুবীর লঙ্কেশ চোখ এবং হাত থেকে চাররকম আলোর শিখা ইচ্ছামতো নিক্ষেপ করার ক্ষমতা পায়। সাংবাদিকদের কাছে এই ঘটনার সময় উল্লেখ করে সে সেই চারজনকে হত্যার দায় স্বীকার করল।
তারপর সে তার চাররকম আলোর গুণাগুণ আলোচনা করল।
“লাল আলোটা আগুনের মতো। পুড়িয়ে দেয়। অনেক সুপারহিরোর এই ক্ষমতা আছে।” রঘুবীর বলল। স্টেজ থেকে বেশ কিছুটা দূরে খাড়া-করা একটা বিলবোর্ড পুড়িয়ে দিয়ে সে এই আলোর ডেমো দেখাল। কেউ কেউ আঁতকে উঠল। রঘুবীর নিস্পৃহভাবে স্বীকার করল, সে অনেক দূর অবধি নিশানা করতে পারে বটে। তাকে দেখে আদৌ মনে হচ্ছিল না, সে পরিস্থিতি উপভোগ করছে।
“নীল আলোয় বস্তুর ভর বদলে যায়, মানে কোনো জিনিসকে ছোটো বা বড়ো করা যায়।” রঘুবীর পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার কয়েন বার করে হাতের চেটোয় রাখল। তারপর সেই চেটো ও হাতের আঙুল থেকে নীল আলোর শিখা সেই কয়েনকে জড়িয়ে ধরল। কয়েনের আয়তন বাড়তে লাগল। একটা থালার সমান হয়ে ওঠার পর আলোর প্রবাহ বন্ধ হল। কাছে থাকা সকলে দেখতে পেলেন, কয়েনের পিঠে মোলায়েম কারুকাজ বড়ো হয়ে ওঠার পর রুক্ষ মনে হচ্ছে। আরেকবার নীল আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল সেই কয়েন। ছোটো হতে হতে স্বাভাবিকে ফিরে গেল তার আয়তন। “আপনাদের জ্ঞাতার্থে বলে রাখি, আমি জানি না, এই নীল আলোয় নতুন অণু-পরমাণু সৃষ্টি ও ধ্বংস হয়, নাকি আগে থেকেই বর্তমান অণু-পরমাণুর ভর বাড়ে-কমে। দুটোতেই পদার্থবিদ্যার সূত্র লঙ্ঘিত হচ্ছে, কিন্তু আমার কিছু করার নেই।”
এরপর রঘুবীর বলল, “সবুজ আলোয় নতুন পদার্থ তৈরি হয় এবং এক পদার্থ অন্য পদার্থে পরিবর্তিত হয়। ভর ও শক্তির নিত্যতা সূত্র এতেও নির্ঘাত লঙ্ঘিত হচ্ছে।” সে হাতের ইশারা করল। তার আঙুল থেকে সবুজ আলোর শিখা বেরিয়ে এসে টুলের পাশে একটা জায়গা জুড়ে কয়েক মুহূর্ত ঘুরপাক খেল। সেই আলো স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল, মানুষ সমান উঁচু একটি অশোক স্তম্ভের অনুকৃতি সেখানে দণ্ডায়মান। ভিড়ের মধ্যে থেকে এবার অনেকের গলায় চমৎকৃত হওয়ার শব্দ শোনা গেল। শুকনো হাসি হেসে রঘুবীর বলল, “আমি আমার দেশ, আমার প্রজাতি, আমার গ্রহের ক্ষতি করতে চাই না। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা দয়া করে বুঝুন।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে আবার শুরু করল, “কিন্তু আমার মতে সব চেয়ে বিপজ্জনক হল হলুদ আলো। হলুদ আলো দিয়ে আমি অন্যদের মন বুঝতে পারি, আর বদলাতেও পারি।” প্রশমিত-হয়ে-আসা উৎকণ্ঠা আবার উপস্থিত লোকজনের চোখে-মুখে ফুটে উঠল। রঘুবীর তার সামনে রাখা কাচের খাঁচার দিকে ইশারা করল। সবুজ আলো ঝলক দিয়ে উঠল। সবাই দেখল, খাঁচা অদৃশ্য হয়ে গেছে। বন্দি সুগ্রীব সিনহা হঠাৎ ছাড়া পেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক তাকালেন, তারপর দিলেন ছুট। কিছুদূর যেতে-না যেতেই রঘুবীরের চোখ থেকে হলুদ আলোর শিখা চাবুকের মতো তাঁর পিঠে গিয়ে লাগল। সুগ্রীব একবার শিউরে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
“ওঁকে সাময়িকভাবে অচল করে দিলাম,” রঘুবীর লঙ্কেশ বলল, “হাঁটাচলা করার দিক্নির্দেশ তো মাথা থেকেই আসে, তাই মগজের কলকাঠি নেড়ে দিলে…”
আরেকবার হলুদ আলোয় সুগ্রীবকে চাবকে দিল রঘুবীর। বন্দি নেতা ধীরপায়ে হেঁটে ফিরে এলেন নিজের আগের জায়গায়। ভিড়ের সামনের দিকে থাকা অনেকে লক্ষ করলেন, সুগ্রীব সিনহার মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে।
রঘুবীর বলল, “আমি ওঁর মগজের সূক্ষ্মতর কাজকর্মগুলোকে আটকে রেখেছি। ওঁর দশা এখন রিমোট কনট্রোলড পুতুলের মতো। কনট্রোল আমার হাতে।”
ভিড়ের মধ্যে অসন্তোষের গুঞ্জন শুরু হল। কেউ চেঁচিয়ে বলল, “উনি একজন নাগরিক। ওঁকে আপনি এইভাবে অপদস্থ করতে পারেন না।”
রঘুবীর লঙ্কেশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “তা বটে। এবার হয়তো প্রশ্নোত্তরের পালা।”
প্রশ্নোত্তর
নির্বোধে পর্যবসিত সুগ্রীব সিনহার দিকে নির্দেশ করে রঘুবীর লঙ্কেশ বলল, “ইনি একজন ধর্ষক, সম্ভবত খুনি, ঘুস নেন এবং ঘুস দেন, চাকরির ইনটারভিউতে প্রহসনের ব্যবস্থা করে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করেন, তাঁবেদার অযোগ্য লোককে উচ্চপদে বসান, ঘুস খেয়ে রদ্দি মালমশলা দিয়ে ব্রিজ বানানোর হুকুম দেন, তারপর সেই ব্রিজ ভেঙে পড়লে দায় এড়িয়ে চলে যান। এই সব কিছুর শাস্তি দিতে এঁকে কি আমি খেলনা বানাতে পারি না?”
ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন কোলাহলে পরিণত হল। যিনি আপত্তি করেছিলেন, সেই নির্ভীক ব্যক্তি উত্তর দিলেন, “তবু উনি একজন নাগরিক। নাগরিকের শাস্তি নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনেই হওয়া উচিত।”
রঘুবীর লঙ্কেশ বলল, “কেন শয়তানের হয়ে ওকালতি করছেন? আমি পদ্ধতির বাইরে কিছু তো করছি না! সংবিধানে দেখাতে পারবেন, কোথায় রশ্মিপ্রয়োগপূর্বক মগজধোলাই করতে নিষেধ করা আছে?”
এই কথায় ভিড় একটু থমকে গেল। অতিমানব কি ঠাট্টা করছে? প্রশ্নকর্তা ব্যক্তিও চুপ রইলেন। রঘুবীর লঙ্কেশ পরের প্রশ্ন চাইল।
“আপনি এই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে কী করবেন?”
“ভালো প্রশ্ন,” রঘুবীর জবাব দিল, “আমি নিজেও এটা ঠিক করে উঠতে পারিনি। সেইজন্যই লোকসমক্ষে আসতে চাইছিলাম না। এই আলোগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হয়। আমি মাত্র কতকগুলো প্রাইভেট টিউশন পড়াই; প্রায় কোনো কিছুরই যথেষ্ট খুঁটিনাটি জানি না। সবুজ আলো দিয়ে কল্পনা থেকে জিনিস তৈরি করতে গেলে সেই জিনিসের ভিতরের গঠন নিয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হয়। এই যে একটা স্ট্যাচু বানাতে পারলাম, এর কারণ স্ট্যাচুর মধ্যে আছে কেবল নিরেট পাথর। কিন্তু ধরুন, একটা খেলনা গাড়ি বানাতে আমি পারব না কারণ খেলনা গাড়ির ভিতরে কীরকম কলকবজা থাকে, আমি জানি না। এই সব কিছুই আমি নিজের মতো করে শিখছিলাম। সেই সুযোগটা হারালাম; এবার থেকে কাজ করতে করতেই শিখতে হবে।” রঘুবীর সামান্য হাসল।
“আর… অন্য আলোগুলো নিয়ে কী ভাবছেন?”
“ওঃ হ্যাঁ, লালটা আপাতত আত্মরক্ষার জন্য রাখব। হলুদটাও, যদি না লোকজন…” বলতে গিয়ে যেন সামলে নিল অতিমানব। “না, আত্মরক্ষাই। হলুদ আলোও আত্মরক্ষার জন্যই থাকবে। নীল নিয়ে আরও ভাবনাচিন্তা করতে হবে। নিশ্চয়ই ওটা দিয়েও অনেক কিছু করা যাবে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে, বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।”
“এটাও কি আত্মরক্ষার জন্য করছেন?” একজন সাংবাদিক স্টেজের সামনে স্থাণুবৎ দাঁড়ানো সুগ্রীব সিনহার দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞাসা করলেন। রঘুবীর লঙ্কেশের বাচনভঙ্গি ও নিরীহ চেহারায় নিরাপত্তার আশ্বাস ছিল; সমবেত মানুষেরা তাঁদের প্রশ্ন রাখার আত্মবিশ্বাস পাচ্ছিলেন।
সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে রঘুবীর লঙ্কেশ ভ্রূকুটি করে, ঠোঁট কামড়ে ধরে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল। তারপর বন্দি নেতাকে হলুদ আলোর শিখায় বিদ্ধ করল। সুগ্রীব সিনহা হুঁশ ফিরে পেয়ে চিৎকার করলেন, তারপর মাঠ পেরিয়ে রাস্তার দিকে দৌড় দিলেন। রঘুবীর লঙ্কেশ প্রশ্নকর্তা সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।”
পরের প্রশ্ন এল, “কাজ করতে শুরু করার পর, আপনি কি সমালোচনা বরদাস্ত করবেন?”
“সৎ সমালোচনা চিনে নিতে আমার সময় লাগবে না। আমি এখনও অপরের মন নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না—করতে চাইও না, কিন্তু অপরের চিন্তা সহজেই পড়ে ফেলতে পারি। তাই আমি অনুরোধ করব, সৎ সমালোচনা করার থাকলে অবশ্যই করুন।”
“মহিলাদের ব্যাপারে আপনি কী মত পোষণ করেন?”
রঘুবীর লঙ্কেশ অবাক হয়ে তাকাল। তারপর বলল, “অঃ, বুঝেছি, আমাকে বিষমকামী ধরে নিয়ে আপনার এই প্রশ্ন। কিন্তু…” বলে সবুজ রঙের আলোর ঝলক এনে সে দু-হাতে এক বিশাল পতাকা তুলে ধরল। অনুভূমিকভাবে আটটা সমান ভাগে বিভক্ত পতাকার আট ভাগের রং, উপর থেকে নীচে দেখা গেল সবুজ, হালকা সবুজ, সাদা, ধূসর, কালো, ধূসর, সাদা ও গাঢ় বেগুনি। এই পতাকা ডাইনে-বাঁয়ে দুলিয়ে সে বলল, “আমি কোনো জীব বা জড়বস্তুর প্রতি দৈহিক অথবা রোমান্টিক আকর্ষণ অনুভব করি না। সকল মানুষই আমার চোখে মানুষ প্রজাতির এক-একজন একক।”
“আপনার ক্ষমতা কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে? এই মুহূর্তে আপনার ক্ষমতার ব্যাপ্তি কতদূর?”
“আমি জানি না। জানার চেষ্টা করতে পারিনি। লোকসমক্ষে এসে গেলাম, এবার ঠিকঠাক পরীক্ষা করে দেখতে পারব।”
“আপনি কি অমর?”
“মনে হয় না। আমার চুল পাকছে, অর্থাৎ শরীরের বয়স বাড়ছে। মৃত্যু তো বার্ধক্যেরই পরিণতি।”
“বিশ্বের কীরকম ভবিষ্যৎ দেখতে চান?”
রঘুবীর লঙ্কেশ কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, “সবাই সমান সুযোগ পাক। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার হোক।”
“বিশ্বের প্রতি আপনার বার্তা কী?”
“খাতায়-কলমে আমাদের ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই নিখুঁত। খাতা-কলম অনুযায়ী চলুন। আমি যাচাই করার চেষ্টা করব, খাতা-কলমের সঙ্গে কতখানি সামঞ্জস্য রেখে সকলে চলছেন।”
লীলা
নজিরবিহীন তৎপরতায় পৃথিবী জুড়ে সব সরকার দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেল। ভারত সমেত সার্ক, আরব দুনিয়া, লাইবেরিয়া বাদে আফ্রিকা, রাশিয়া, এবং অনেককে অবাক করে দিয়ে চিন, রঘুবীর লঙ্কেশের সঙ্গে সহযোগিতার বার্তা দিল। পাশ্চাত্য সমেত অবশিষ্ট বিশ্ব যুদ্ধ ঘোষণা করতে চাইল। রঘুবীর লঙ্কেশ পাশ্চাত্যের বড়ো বড়ো সেনাবাহিনীকে পঙ্গু করে দেওয়ার পরে তারা সহযোগিতার প্রস্তাবে রাজি হল।
এই পঙ্গু করে দেওয়ার প্রক্রিয়ার চমকপ্রদ সব ভিডিয়ো ও ছবি ইনটারনেট খুঁজলে পাওয়া যায়। আকাশ থেকে খসে-পড়া সাদা শোলার যুদ্ধবিমান, তুলোর ময়দানে আটকে-যাওয়া ট্যাংক, সমুদ্রে ইতস্তত ভাসমান শোলার বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ থেকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে নৌসেনা উদ্ধার, ছোট্ট হয়ে গুঁড়িয়ে-যাওয়া সশস্ত্র ট্যাংকের উপর বসে-থাকা ভ্যাবাচ্যাকা সৈনিক—বিশ্বের তাবড় মহাশক্তিদের সামনে আলোচনায় বসা ছাড়া অন্য পথ খোলা রইল না।
এই অতর্কিত আক্রমণের মধ্যে দিয়ে রঘুবীর লঙ্কেশ নিজের ক্ষমতার প্রথম ব্যাবহারিক অভিজ্ঞতা লাভ করল। নিজের সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন হয়ে সে জাতিসংঘের সভায় গেল। কতিপয় কূটনীতিক তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু যখন বোঝা গেল, সে-ও প্রভাব খাটাতে পারে, আর বিরক্ত হলে সে বড়ো দৃষ্টিকটু প্রভাব খাটায় (এক কূটনীতিকের শুঁড় গজাল, আরেকজনের এক হাতে আঙুলের বদলে ক্ষুর), তখন থেকে সকলে তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে শুরু করলেন।
এই ধরনের খুচরো সংঘর্ষের পরিস্থিতি আবার তৈরি হল, যখন রঘুবীর সমস্ত সরকারকে সুষম উন্নয়নের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনায় বসল। এঁদের মধ্যে ছিলেন শিল্পপতি, বৃহৎ কর্পোরেশনের প্রতিনিধি এবং সন্ত্রাসবাদীরা। এঁদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই নিজ নিজ ধর্মের অন্ধভক্ত প্রমাণিত হলেন—সকলের ধর্ম ঈশ্বরবিশ্বাস সংক্রান্তও ছিল না—এবং রঘুবীর এঁদেরকে বিকল্প অস্তিত্বের দিশা দেখাতে বাধ্য হল। “অসংশোধনীয় ভাবশত্রুকে প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত রাখা চলে না।” বলে সে তাঁদেরকে বিভিন্ন অভয়ারণ্যে গাছপালা ও বিপন্ন প্রজাতির বিভিন্ন প্রাণীতে রূপান্তরিত করল।
সুষম উন্নয়নের প্রকল্প কার্যকর হওয়ার পর থেকে নিয়মিত একশ্রেণির মানুষ রঘুবীর লঙ্কেশের কাছে নিজেদের পাহাড়প্রমাণ ব্যক্তিগত সম্পদ হারানোর শোক ভুলিয়ে দেওয়ার আর্জি নিয়ে আসতে লাগলেন। এঁদের চিকিৎসা হলুদ আলোর এক উৎকৃষ্ট প্রয়োগ হিসেবে অচিরেই প্রতিষ্ঠিত হল। বিশ্বের দরবারে রঘুবীরের ‘আত্মপ্রকাশের’ তিন বছর পুরো হতে-না হতেই মানবজাতি সমেত সকল প্রজাতির সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধির যুক্তি সর্বত্র অনুসৃত হতে লাগল। কিন্তু একশ্রেণির বিরুদ্ধভাবাপন্ন মানুষ এই সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অনড় রইলেন। তাঁরা একচ্ছত্র আধিপত্য, ক্ষমতার চূড়ান্ত অসাম্য, এই সমস্ত বিষয়কে ভিত্তি করে কিছু যথার্থ, কিছু কাল্পনিক অভিযোগ তুলে ধরে গলা ফাটাতে লাগলেন। গলা ফাটানোর বিরুদ্ধে রঘুবীর লঙ্কেশের কিছু বলার ছিল না, কিন্তু তাঁরা থেকে থেকে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য সক্রিয় অসহযোগিতার রাস্তাতেও হাঁটতে লাগলেন।
প্রথম প্রথম রঘুবীর লঙ্কেশের বিশ্বাস ছিল, একদিন সে নিজের অসীমসংখ্যক অনুকৃতি বা ক্লোন তৈরি করতে সমর্থ হবে; তখন সমস্ত অভিযোগকারীর সঙ্গে সে একই সঙ্গে অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে আলোচনা করতে পারবে। কিন্তু ক্রমশ তার প্রত্যয় দৃঢ় হতে লাগল যে, এই ক্ষমতা কোনোদিন তার অধিগত হবে না। সে নিজের শরীরের অনুকৃতি তৈরি করতে শিখল, যাদের মস্তিষ্কে নিউরনের বিন্যাস হুবহু তার নিজের মতোই হল, কিন্তু তাদের মধ্যে রঘুবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারল না।
কিন্তু সে আরেকটা কাজ করতে পারত। সে নিজের ইচ্ছামতো অন্য কারও মধ্যে নিজের ক্ষমতা সঞ্চার করতে পারত। প্রথমে সে ভেবেছিল, সময়-সুযোগ বুঝে তা-ই করবে। কিন্তু তার সুষম উন্নয়নের পথের ‘অযৌক্তিক’ বিরোধিতার বাড়বাড়ন্তে সে পিছিয়ে আসছিল।
হয়তো এই টানাপোড়েনের ফলেই রঘুবীর একদিন কথার খেলাপ করল। তার সাধের একাধিক প্রকল্পের ক্রমাগত বিরোধিতায় অতিষ্ঠ হয়ে সে প্রথমে গোটা পৃথিবীকে হলুদ আলোয় ধুইয়ে দিল। সেই আলোর উদ্দেশ্য ছিল, রঘুবীর লঙ্কেশ কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে মানুষকে তার প্রতিবাদে অক্ষম করা। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রঘুবীর সমালোচকদের সঙ্গে আলোচনায় বসত, সমালোচনা ‘সৎ’ কি না ঠিক করত। সৎ মনে না করলে সে হলুদ আলোর মাধ্যমে তার সিদ্ধান্তের সমর্থনের কোনো মন্ত্র সেই সমালোচকের মাথায় ঢুকিয়ে দিত। এই প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর ‘অযৌক্তিক বিরোধিতা’র ঘটনা রাতারাতি কমতে লাগল।
কমতে কমতে যখন রঘুবীর লঙ্কেশের ‘অসৎ সমালোচনা’ করার কেউ রইল না, তখন সে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মধ্যে তার চার আলোর ক্ষমতা সঞ্চার করল। সে আক্ষরিক অর্থে সর্বত্র বিরাজমান হতে পারেনি, কিন্তু গোটা মানবজাতিকে তার বিশ্বস্ত অনুচরে পরিণত করতে পেরেছে। অবশেষে রঘুবীর লঙ্কেশ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
উপসংহার
পৃথিবী—আরও নির্দিষ্ট করে বললে মানবজাতি—এখন নানা দিক থেকে সমৃদ্ধির শিখরে রয়েছে। কিন্তু উদারমনস্ক অনেকেই এই অবস্থাকে দুঃস্বপ্নের সমান মনে করতে পারেন। রঘুবীর লঙ্কেশ সকলের মনের মধ্যে একটা গণ্ডি কেটে দিয়েছে। সেই গণ্ডির বাইরে কেউ চিন্তা করতে শিখলে তার বিপদ হবে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউ সেই রাস্তায় হাঁটতে পারেনি বা হাঁটেনি, আর রঘুবীরের আকাশচুম্বী আত্মবিশ্বাস।
নিজের একাধিক সাধের প্রকল্প বাতিল করার মাধ্যমে রঘুবীর বুঝিয়ে দিয়েছে, সে অন্যের কথা শুনতে প্রস্তুত। যেমন, সে পৃথিবীর আহ্নিক গতির অভিমুখ উলটে পূর্ব থেকে পশ্চিমে করে দিতে চেয়েছিল। এর ফলে গ্রহ জুড়ে মরুভূমি কমে যেত, অধিকাংশ স্থলভাগ বাসযোগ্য ও কৃষিযোগ্য হত। কিন্তু নেতা ও বিজ্ঞানীরা তাকে বোঝান, সেই সঙ্গে ব্যাপক উদ্বাস্তু সমস্যা ও সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তিও দেখা দেবে। রঘুবীর তাই এই পরিকল্পনা বাতিল করে। আবার, সূর্য থেকে উপলব্ধ শক্তির মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি করার জন্য সূর্যের চারদিকে একটি ডাইসন চোঙা তৈরি করার সিদ্ধান্তও সে বাতিল করে, কারণ এখনই অত বিপুল শক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা মানবসভ্যতার নেই।
সহযোগিতার এইসব নিদর্শন সত্ত্বেও রঘুবীর লঙ্কেশ অনেকের কাছেই আর নির্ভরযোগ্য নয়। গড়ের মাঠে দেওয়া প্রথম প্রতিশ্রুতির খেলাপ করে সে যেদিন পৃথিবীকে হলুদ আলোয় ধুইয়েছে, সেদিনই সবার কাছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা সে খুইয়েছে।
আমি এসব লিখছি কীভাবে, এই কথা ভেবে যদি আপনি আশ্চর্য হন, আপনার জ্ঞাতার্থে বলি: আমি পৃথিবীতে থাকি না। মানবজাতির পীতরশ্মিস্নানের আগে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যে দলটা ছিল, আমি তাদের একজন। রঘুবীর লঙ্কেশ বিশেষ যত্ন নিয়ে আমাদেরকে এখানে অনির্দিষ্টকালের জন্য রেখে দিয়েছে। স্থায়ী কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ, উন্নত তেজস্ক্রিয়তা নিরোধক, সব কিছুই বিরাট স্কেলে তৈরি হচ্ছে। হয়তো সে চায়, এরকম বিবরণী আরও লেখা হোক।
Tags: দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সর্বান বন্দ্যোপাধ্যায়
