একটা ইমেল
লেখক: কল্লোল রায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
হাই পিনাকী,
এখন গভীর রাত। কয়েক ঘণ্টা আগে শোরুমের একমাত্র সিকিউরিটি গার্ড দোকানের সব তালা শেষবারের মতো নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করে তার কেবিনে ফিরে গেল, যেখানে সে বাকি রাতটা ঘুমিয়ে কাটাবে। আমি এই শোরুমের একদম শেষ প্রান্তে একটা স্টোররুমে বসে আছি। এটা পুরোপুরি অন্ধকার এবং আবর্জনায় ভরা। কিন্তু আমার নাইটভিশন ক্যামেরা ব্যবহার করে আমি স্তূপ-করা বাজে কাগজপত্র ও ঝুল-মাখা আবর্জনার নীচে একটি ল্যাপটপ খুঁজে পেয়েছি।
ল্যাপটপটি বেশ পুরোনো, কিন্তু পাওয়ার অন করতে দেখি, খুব তাড়াতাড়ি সেটা চালু হয়ে গেল। সব থেকে আশ্চর্যের যে লোকাল ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক নিজের থেকে কানেক্ট হয়ে গেল। তার মানে এখানকার কোনো লোক আগে এটা ব্যবহার করত। আমি লক্ষ করে দেখলাম যে, ল্যাপটপে সাত শতাংশ চার্জ বেঁচে আছে এবং আমার মাত্র পাঁচ শতাংশ! কাল সকালে আমাকে ডাম্পিং গ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়ার আগেই ঝটপট এই মেইলটা পাঠিয়ে দিতে হবে।
পিনাকী ডার্লিং, আমি তোমার শ্রেয়া, তোমার বিশ্বস্ত এবং প্রিয় রোবট-বান্ধবী। এইটা নিশ্চয়ই তোমাকে লেখা আমার শেষ চিঠি হবে। চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে, আমি তোমাকে শুধু একটা প্রশ্ন করতে চাই। এতদিনকার পুরোনো সম্পর্ক ভেঙে ফেলে আজ সকালে হঠাৎ করে কেন আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে? এটা কি গত রাতের ঘটনার জন্য? আমি কী ভুল করেছি? আমাকে বুঝিয়ে বললে না কেন?
আজ সকালে আমাকে এক্সচেঞ্জ করে নতুন রোবট কেনার পর, তুমি শোরুম ম্যানেজারের হাতে কিছু এক্সট্রা টাকা গুঁজে দিয়ে ফিশফিশ করে বলেছিলে, “ভাই, যে করেই হোক, কাল সকালের মধ্যে শ্রেয়াকে ই-ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পাঠিয়ে দেওয়া চাই।” ম্যানেজার তোমাকে আশ্বস্ত করেছিল।
ডার্লিং, সময় কেটে যায় ঝড়ের বেগে!
আমার স্পষ্ট মনে আছে সেই প্রথম দিনটার কথা। যেদিন পড়ন্ত বিকেলে তুমি এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বার থেকে প্রেসক্রিপশন হাতে করে সরাসরি এই শোরুমে চলে এসেছিলে।
দোকানের সেল্সম্যান প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে ডাক্তারের ইন্সট্রাকশনগুলো মনোযোগ সহকারে পড়ল। তারপর সে শোরুমে সাজানো বিভিন্ন রোবট একের পর এক দেখিয়ে তাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তোমায় বোঝাতে থাকল। শেষমেশ তুমি আমাকে পছন্দ করলে। আমার টানাটানা চোখ, লম্বা আইল্যাশ, কোঁকড়ানো চুল দেখে তোমার চোখে সেদিন মুগ্ধতা লক্ষ করেছিলাম।
সেল্সম্যান আমাকে বাক্সো থেকে বের করে, পাওয়ার অন করে বলল, “হ্যালো শ্রেয়া, আজ থেকে ইনিই তোমার নতুন স্যার। প্রফেসার পিনাকী সরকার।”
আমি হেসে হাত মেলালাম, “শুভ সন্ধ্যা, স্যার।”
তুমিও হাসিমুখে আমাকে সম্ভাষণ জানালে, “শুভ সন্ধ্যা, শ্রেয়া। আমার কিন্তু ‘স্যার’ নামটা একদমই পছন্দ নয়! আমি তোমার বন্ধু। তাই আমাকে পিনাকী বলে ডেকো।”
সেল্সম্যান বলল, “স্যার, আপনি খুব ভাগ্যবান যে শ্রেয়াকে পেয়েছেন। আমাদের কাছে এই মডেলের একটামাত্র পিসই পড়ে আছে। আপনি বাজারে এমন বুদ্ধিমান রোবট আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাবেন না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, শ্রেয়া আপনার সারাজীবনের জন্য সেরা সঙ্গী হয়ে থাকবে। এই মডেলে কোম্পানি একদম লেটেস্ট এআই এবং ভয়েস রিকগনিশন সফটওয়্যার লোড করেছে।”
আমার মনে আছে, তিন বছর আগে যখন আমাকে বাড়িতে নিয়ে এলে, তখন তুমি মানসিকভাবে ভীষণ বিধ্বস্ত ছিলে। প্রতিদিনের বাড়ির কাজের পাশাপাশি, আমার প্রধান দায়িত্ব ছিল তোমাকে সময় দেওয়া ও শান্ত হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তোমার কথা শোনা, যাতে তুমি তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারো। তুমি আমাকে বলেছিলে যে এক বছর আগে তুমি অনন্যা, মানে তোমার স্ত্রী-কে একটা সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়েছিলে। তুমি ওকে তোমার প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসতে। অনন্যার আকস্মিক মৃত্যু তুমি কিছুতেই মেনে নিতে পারোনি। দিনকে দিন তুমি হতাশায় গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিলে। তুমি সাংঘাতিকভাবে অ্যালকোহলিক হয়ে গিয়েছিলে। কলেজে লেকচারে অত্যন্ত অনিয়মিত হয়ে পড়েছিলে, অর্ধেক দিন কলেজেই যেতে না।
একজন ট্রেইনড সাইকোলজিস্টের মতো কাউন্সেলিং করে মাস ছয়েকের মধ্যে আমি তোমাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। তুমি কলেজে নিয়মিত যেতে এবং বিভিন্ন রিসার্চের কাজে মন দিতে শুরু করে দিয়েছিলে। ধীরে ধীরে তোমার সুখ্যাতি বাড়ছিল।
এভাবে প্রায় দু-বছর আমাদের বেশ ভালোই কেটেছিল। তারপর একদিন, বাড়ি ফিরে আসার পর তোমাকে খুব ডিপ্রেসড এবং হতাশ দেখাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করতে তুমি চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে বললে, “শ্রেয়া, তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না, আমাদের ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের ভিতরে কী নোংরা রাজনীতি চলছে। আমি কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সব চেয়ে সিনিয়র প্রফেসার। বর্তমান ডিন অবসর নেওয়ার পর সে চেয়ারে আমারই বসার কথা। কিন্তু আজ কলেজ ম্যানেজমেন্ট সেই পদে একজন বহিরাগত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে! সে আমার থেকে অন্তত দশ বছরের জুনিয়র এবং তার কোনো অসাধারণ অ্যাকাডেমিক বা গবেষণার রেকর্ড নেই। কারণটা কী জানো? সে একজন প্রভাবশালী বোর্ড মেম্বারের নিকট আত্মীয়!”
কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ধীমানের ডিন হয়ে জয়েন করার পর থেকে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে লাগল। খরচ কমানোর অজুহাতে, সে তোমার আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের সমস্ত ট্রিপ বাতিল করে দিল। সে নোটিশ জারি করল যে, যে-কোনো গবেষণাপত্র কলেজের বাইরে কোথাও পাঠাতে গেলে, আগে সেটা তার কাছে জমা দিতে হবে এবং তার থেকে অফিশিয়ালি অনুমতি নিতে হবে। একজন সিনিয়র এবং যথেষ্ট শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী হিসেবে, তুমি এই অপমান সহ্য করতে পারছিলে না।
একদিন বাড়ি ফিরে তুমি রাগে একদম ফেটে পড়লে, “শ্রেয়া, আমি আর সহ্য করতে পারছি না… তুমি জানো, ধীমান একজন কত বড়ো প্রতারক? আর শুধু তা-ই নয়, সে একজন বদমাইশ, একজন চোর! আমি যে রিসার্চ পেপারগুলো লোকটার কাছে জমা করেছিলাম, সে ব্যাটা নির্লজ্জভাবে আমার সমস্ত কাজ চুরি করে নিজের নামে আমেরিকান সোসাইটি অব ফিজ়িক্সে পাঠিয়ে দিয়েছে! আমি আজ জানতে পারলাম যে, সোসাইটি বদমাইশটাকে আগামী মাসে একটা বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ পাঠিয়েছে।… দেখে নিয়ো শ্রেয়া, একদিন আমি ওই লোকটাকে খুন করব।”
সত্যি কথা বলতে কী, আমার সফটওয়্যারের ভাষায় আমি প্রতারণা করা, চুরি বা মিথ্যা কথা বলা—এইসব মানুষের আচরণ বুঝতে পারতাম না। আমার একমাত্র চিন্তা ছিল তোমার মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা। রাগ হলে, তোমার রক্তচাপ হঠাৎ বেড়ে যায় আর তুমি শ্বাসকষ্ট অনুভব করো। তাই আমি তোমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললাম, “পিনাকী, প্লিজ় শান্ত হও। কোনো কিছুই শেষ হয়ে যায়নি। তুমি এত বড়ো একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, তোমার গবেষণা তুমি আবার নতুন করে শুরু করো…”
“অসাধারণ শ্রেয়া, আমি দিনরাত পরিশ্রম করে একটা গবেষণাপত্র তৈরি করব আর ধীমান ব্যাটা সেটা কপি করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করবে… আমি এটা আর সহ্য করতে পারছি না।” তুমি পুরো রাগে ফুঁসছিলে।
গভীর রাত অবধি তুমি ল্যাপটপের সামনে না ঘুমিয়ে অস্থিরভাবে বসে ছিলে। কাগজে কিছু লিখছিলে, তারপরে ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছিলে। আমি কাছে এসে, আলতো করে তোমার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম, “ডার্লিং, কী হয়েছে, আমি কি তোমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?”
তুমি কিছুক্ষণ আমার দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলে। তারপর হঠাৎ আমার হাত ধরে তোমার পাশে বসতে বললে। “শ্রেয়া, আমার মনে হয়, সত্যিই তুমি এই ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারবে। স্ক্রিনটা দ্যাখো… তোমার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এই অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ডটা হ্যাক করো। আমাকে প্লিজ় সাহায্য করো।” তুমি অনুরোধ করলে।
আমি খোলা স্ক্রিনে প্রফেসার ধীমানের লগইন পেইজ দেখে একটু অবাকই হলাম। কিন্তু আমি কী করব? আমাকে তো তোমার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে মানার জন্যই প্রোগ্রাম করা হয়েছে। পরের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমি অনেক পারমুটেশন এবং কম্বিনেশন করলাম, এবং অবশেষে ফায়ারওয়াল এবং পাসওয়ার্ড ভেঙে ফেললাম।
তুমি অভিভূত হয়ে আমার হাত তোমার দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলেছিলে, “তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, শ্রেয়া। অনেক রাত হল। যাও, এবার তোমার চার্জিং স্টেশনে যাও। তোমার রিচার্জিং-এর সময় হয়ে গিয়েছে।”
আমি নিঃশব্দে ঘরের কোণে গিয়ে আমার চার্জিং কেব্ল প্লাগ ইন করলাম। ঘরের ভিতরটা একটি আবছা নীল আলোয় ভরে গিয়েছিল। সেই আবছা আলোতে আমি দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম যে, তুমি ধীমানের অ্যাকাউন্ট থেকে একের পর এক ডকুমেন্ট ডাউনলোড করছ!
এরপর কয়েক মাস বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটল না। একদিন তুমি আমাকে বললে যে ধীমানকে পাশ কাটিয়ে, তুমি সরাসরি কিছু মার্কিন এবং ইউরোপীয় ইন্সটিটিউটে তোমার থিসিস পেপার পাঠিয়ে দিয়েছ। তাদের মধ্যে একটি জার্মান ইউনিভার্সিটি তোমার পেপার গ্রহণ করেছে এবং তোমাকে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ পাঠিয়েছে। আবার তোমাকে সেই আগের মতো খুব খুশি এবং উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। তুমি আমাকে বললে, “শ্রেয়া, আগামী সপ্তাহে আমি এই ট্রিপ থেকে ফিরে এসেই অধ্যাপকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেব। আমি স্বাধীনভাবে কাজ করব। এমন একজন অপদার্থ লোকের অধীনে কাজ করা সত্যিই কোনো মানে হয় না, খালি সময় নষ্ট।”
সেটা ছিল গত রাতের ঘটনা। তখন প্রায় ন-টা বাজে। আমি রাতের খাবারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ দরজার কলিং বেল বাজার শব্দ শুনলাম। তুমি উপরে ছিলে, তাই আমি দরজা খুললাম। বাইরে ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছিল। একজন লম্বা মধ্যবয়সি ভদ্রলোক কালো ওভারকোট পরে সদর দরজায় ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ভদ্রলোক খুব অধৈর্যভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ফিশফিশ করে জিজ্ঞেস করলেন, “পিনাকী কোথায়? তাকে একবার ডাকো তো, এটা জরুরি কাজ ছিল।” একটু বিরতি দিয়ে তিনি গলা তুলে আক্ষরিক অর্থেই আমাকে আদেশ দিলেন, “আমি ধীমান, ওর বস… যাও, ওকে তাড়াতাড়ি ডেকে নিয়ে এসো।”
আমি তৎক্ষণাৎ তাকে স্বাগত জানালাম, “শুভ সন্ধ্যা, ধীমান স্যার। প্লিজ় আপনি ভিতরে আসুন, আমি এক্ষুনি ওঁকে ডেকে আনছি।” ভদ্রলোকটির পেটানো চেহারা, বেশ একজন স্পোর্টসম্যানের মতো শরীরের গঠন। সাধারণ একজন প্রফেসার মানুষের মতো নয়। কিন্তু সত্যিই লোকটা বেশ উদ্ধত এবং দুর্বিনীত, স্যার ঠিকই বলেছিল। প্রথমবার কোনো লোকের বাড়িতে এসে তাকে ভদ্রতার খাতিরে ঠিকভাবে সম্বোধন করতেও জানে না, দেখছি।
মিস্টার ধীমান ফ্লোরের উপর জোরে জোরে বুটের শব্দ তুলে বসার ঘরে প্রবেশ করল। তার মধ্যে লোকজনের আওয়াজ শুনে তুমি উপর থেকে নেমে এলে। তাকে দেখতে পেয়ে হেসে বললে, “কী আশ্চর্য, প্রফেসার ধীমান। নিশ্চয়ই ভুল করে এখানে এসে পড়েছ।”
ধীমান কিন্তু একেবারেই হালকা মেজাজে ছিল না। সে চিৎকার করে বলল, “পিনাকী, তুমি একজন মিথ্যাবাদী, চিটার। তুমি আমার সব গবেষণার কাজ চুরি করে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করেছ… শুধু তা-ই নয়, তুমি আমার কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক থেকে সমস্ত ডেটা মুছে দিয়েছ। আমি তোমাকে পুলিশে দেব। আমি তোমাকে কলেজ থেকে বরখাস্ত করব…।”
“ধীমান, চিৎকার কোরো না, গলার আওয়াজ কমাও। এটা তোমার অফিস রুম নয়, আমার বাড়ি।” তুমি সংযত গলায় উত্তর দিলে, “এসো, এখানে সোফায় বসি। তারপরে আলোচনা করি আসল চোর কে…? শ্রেয়া ডার্লিং, আমাদের জন্য দুটি সিঙ্গল মল্ট নিয়ে এসো-না সোনা।” তুমি আমাকে চোখে ইশারায় যেতে বললে।
আমি দুটো কাচের গ্লাসে ড্রিংকস তৈরি করে বসার ঘরে টেবিলের উপর রাখলাম। তোমরা দুজনে দু-দিকে দুটো সোফায় বসে ছিলে। ঘরে একটা আবছা আলো জ্বলছিল।
তোমরা দুজনেই এক চুমুকে গ্লাস শেষ করে ফেললে। কিছুক্ষণ পিন-ড্রপ সাইলেন্স। তুমি আমাকে আবার গ্লাস ভরে দিতে বললে। তারপর নীরবতা ভেঙে কথা শুরু করলে, “দ্যাখো ধীমান, আমি তোমার কাছ থেকে কিছুই চুরি করিনি। তোমার কাছে কোনো প্রমাণ আছে? ছয় মাস আগে যখন তুমি নির্লজ্জভাবে আমার সমস্ত গবেষণার পেপার কপি করে তোমার নিজের নামে প্রকাশ করেছিলে, তখন কি আমি মাঝরাতে তোমার বাড়িতে গিয়ে সে কথা বলতে গিয়েছিলাম? কারণ, সেদিন আমার কাছে কোনো প্রমাণ ছিল না। কেউ আমাকে বিশ্বাস করত না। তাই আমি নীরবে আমার দুর্ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিলাম।”
“না… আমি এটা এত সহজে হজম করব না। আমাকে তোমার মতো বোকা ভেবো না। আমি সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টে জানাব। আমার শালা একজন বড়ো পুলিশ অফিসার… তারা তোমার অপকীর্তি সহজেই খুঁজে বের করতে পারবে। তারপর তারা তোমাকে অন্তত পাঁচ-দশ বছরের জন্য হাজতবাস করাবে, হা হাঃ…।” ধীমান দ্রুত আরও দুটি পেগ শেষ করল। আমি লক্ষ করেছিলাম যে, তুমি প্রথম পেগটার পরে আর কোনো গ্লাস নাওনি। ধীমান অশ্রাব্য গালাগাল করছিল এবং স্পষ্টতই তার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল।
তুমি শেষে বললে, “যদি তুমি আমাকে চোর বলো, তাহলে তুমি একজন মহাচোর। তুমিই আমাকে পথ দেখিয়েছ… হাহ্ হা, আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা কোরো না। এখন আমার কাছেও প্রমাণ আছে এবং আমি সেগুলো আদালতে পেশ করতে পারি। সেগুলোও তোমাকে গারদে ভরে দেবার জন্য যথেষ্ট। তুমি একজন বোকা, স্বার্থপর, অপদার্থ। তুমি কপি-পেস্ট করা ছাড়া জীবনে আর কিছুই শেখোনি। ছি ছি।”
ধীমান টলমল পায়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, হোঁচট খেল, কিন্তু তার বাঁ হাত দিয়ে কোনোমতে ভারসাম্য সামলে নিল। অন্য হাতে সে খালি গ্লাসটা তুলে নিয়ে তোমার দিকে জোর করে ছুড়ে মারল। তুমি বুঝে ওঠার আগেই সেটা তোমার কপালে আঘাত করল। গলগল করে রক্ত পড়তে শুরু হল।
ধীমান ব্যঙ্গ করে চিৎকার করল, “পিনাকী… তুমি আমাকে চেনো না, আমি তোমার জীবন একদম নষ্ট করে দেব। আমি এখনই আমার শালাকে ডাকছি… সে আসবে এবং তোমাকে কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যাবে। তুমি আমার ক্ষমতা জানো না…।” সে তার সেল ফোনটা টেবিল থেকে তুলে নিল ডায়াল করার জন্য।
রক্তাক্ত কপাল এক হাতে চেপে ধরে তুমি চিৎকার করলে, “শ্রেয়া, ওই জানোয়ারটাকে শেষ করো, এক্ষুনি!”
ধীমানের পিছনে দাঁড়িয়ে আমি এতক্ষণ সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছিলাম। তোমার আদেশ পাওয়ামাত্র আমি সোফার পাশে দাঁড়ানো ধীমানের পাশে চলে গেলাম। পিছন থেকে তার কাঁধে এক হাত রাখলাম এবং এক হাজার ভোল্ট আমার শরীর থেকে ডিসচার্জ করে দিলাম। ওর শরীর কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভয়ানকভাবে কেঁপে উঠে একটি ভেজা তোয়ালের মতো মেঝেতে ঝুপ করে খসে পড়ল।
তুমি ধীমানের কাছে ছুটে গিয়ে তার নাড়ি, শ্বাস পরীক্ষা করলে। আমার দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললে, “ও মারা গেছে, শ্রেয়া!”
তারপর সারারাত আমি তোমার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলাম। প্রথমে আমি মৃতদেহটা বেসমেন্টে টেনে নিয়ে গেলাম। একটা গর্ত খুঁড়ে বডিটা ভিতরে রাখলাম। তারপর ভালো করে মাটিচাপা দিয়ে দিলাম। সব শেষে মেঝের টাইলসগুলো নিখুঁতভাবে মেরামত করে সেই জায়গাটাতে একটা বইয়ের আলমারি টেনে নিয়ে এসে রাখলাম। যখন বসার ঘর, আসবাবপত্র, সিঁড়ি, ফ্লোর, বেসমেন্টের সব কিছু পরিষ্কার করা শেষ হল, তখন পূর্ব আকাশ লাল হতে শুরু করেছে।
তুমি হয়তো কিছুক্ষণের জন্য সোফায় বসে ঝিমিয়ে পড়েছিলে। হঠাৎ শুনলাম বাইরে দরজার ঘণ্টার শব্দ। আমি দরজা খুললাম। দেখলাম, একজন পুলিশ অফিসার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কি প্রফেসার পিনাকীর বাড়ি?”
“হ্যাঁ স্যার।” আমি উত্তর দিলাম।
তিনি খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “আমি পুলিশ ইনস্পেকটর অশোক, স্থানীয় থানা থেকে এসেছি। প্রফেসার ধীমান কি গতকাল রাতে এখানে এসেছিলেন? আসলে তার স্ত্রী, মানে আমার দিদি, আমাকে জানাল যে, গতকাল রাতে ধীমানদা প্রফেসার পিনাকীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। বলেছিলেন যে, তিনি এক ঘণ্টার মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসবেন। কিন্তু গতকাল রাতে তিনি আর বাড়ি ফেরেননি। আচ্ছা, তুমি কে, রোবট?”
“হ্যাঁ স্যার, আমি শ্রেয়া। প্রফেসার ধীমান তো…”
হঠাৎ আমি পিঠের কাছে একটি হালকা চাপ অনুভব করলাম। তুমি আমার পিছনে এসে আস্তে করে আমার পাওয়ার বাটন স্লিপ মোডে দিয়ে দিলে।
“গুড মর্নিং, ইনস্পেকটর। আমি প্রফেসার পিনাকী সরকার।” তুমি ইনস্পেকটরের সঙ্গে হাত মেলালে, “শ্রেয়া আসলে একটা রোবট মেশিন। এই প্রতিদিনকার ঘরের কাজকর্ম করে আর কী। আপনি এইমাত্র ধীমান সম্পর্কে কিছু বলছিলেন…? তার কী হয়েছে? না, সে তো গতকাল এখানে আসেনি। আমার সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিল গতকাল বিকেলে, কলেজের তারই চেম্বারে।”
ইনস্পেকটর মাথা নাড়লেন, “ঠিক আছে স্যার, তাহলে নিশ্চয়ই কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। কোথায় যে গেল লোকটা? যাক গে, সকাল সকাল আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। যদি কোনো খবর পান তাহলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবেন।” ফোন নাম্বার দিয়ে চিন্তিত মুখে ইনস্পেকটর চলে গেল।
তুমি দরজা বন্ধ করলে। ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণের জন্য আমার দিকে অবিশ্বাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে। তারপর ফোন উঠিয়ে শোরুম ম্যানেজারকে ডায়াল করলে, “গুড মর্নিং। আমার রোবটটা না পুরোনো হয়ে গেছে আর অনেক ম্যালফাংশন করছে। হ্যাঁ, আপনাদের দোকান থেকেই কেনা। কী বললেন, এক্সচেঞ্জ স্কিম চলছে? খুব ভালো, আমার খুব তাড়াতাড়ি একটা নতুন রোবট চাই।… হ্যাঁ, হ্যাঁ, আজই, এখনই। দয়া করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি পিক-আপ ভ্যান পাঠান…।”
প্রফেসার পিনাকী সরকার। সেই কোন সকালে তুমি আমাকে এক্সচেঞ্জ করে তোমার নতুন বান্ধবীকে নিয়ে বাড়ি চলে গেছ। এতক্ষণে নিশ্চয়ই তাকে কাজকর্ম শিখিয়ে বসার ঘরের সোফায় এক কাপ গরম চা নিয়ে থিতু হয়ে বসেছ। তুমি নিশ্চয়ই বেসমেন্টের কথাটা তোমার সোহাগের বান্ধবীকে বলোনি। অতটা বোকা তুমি নও।
আমি এটাও ভালোভাবে জানি যে, তুমি আমার এই ইমেলের উত্তর দেওয়ার কোনো চেষ্টাই করবে না। সত্যি জানো তো, এখনও পর্যন্ত আমার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এর কোনো সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি। আমি গত রাতে কী এমন ভুল করলাম যে, তুমি আজ আমার সঙ্গে এইরকম ব্যবহার করলে? আমি তো শুধু তোমার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গিয়েছি। তাই আমি এই ইমেলটার কপি ইনস্পেকটর অশোককেও পাঠালাম। দেখি, তিনি যদি কোনোদিন এই বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেন।
বাই, তোমার শ্রেয়া।
Tags: কল্লোল রায়, দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
