অনুশোচনা শূন্য শতাংশ
লেখক: জোহা কাজেমি অনুবাদ: যশোধরা রায়চৌধুরী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
[ইরানের লেখক জোহা কাজেমির ১৯৮২ সালে তেহরানে জন্ম, ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। ইরানে নারীবাদী স্পেকুলেটিভ ফিকশন, কল্পবিজ্ঞান, ফ্যান্টাসি ইত্যাদির রচয়িতা হিসেবে জোহা কাজেমি ইতিমধ্যেই অতি সম্মানিত ও বহুলপঠিত। ১৫টির অধিক প্রকাশিত বই আছে জোহার। Death industry, Rain born ইত্যাদি উপন্যাস ইতিমধ্যেই ইরানের স্পেকু ফিক পুরস্কার ‘নুফে’ জিতেছে। বর্তমান গল্পটা নেওয়া হয়েছে তাঁর সদ্যপ্রকাশিত ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য টাইম রাইডার’ থেকে। এই বইটিতে ২০২৩ সালের ‘ইউটোপিয়া অ্যাওয়ার্ড’ নমিনি একটি গল্প আছে তাঁর। এই গল্পটি অনুবাদের অনুমতি লেখক নিজেই দিয়েছেন। ‘রেইনবর্ন’ বা ‘বৃষ্টিজাতক’ অনেকেই পড়েছেন। এই গল্পটি মূল ফারসি গল্পের আমির সেফেরাম-কৃত ইংরেজি অনুবাদ (Remorse: Zero Percent) থেকে অনূদিত। এ গল্পের আখ্যান এক নতুন প্রযুক্তির দাসত্বে পৌঁছে যাওয়া মানবসভ্যতার স্পেকুলেটিভ কাহিনি। এক ধরনের ডিসটোপিয়া, এখানে এক নতুন প্রযুক্তি বা যান্ত্রিক উপায়ে অপরাধী শনাক্ত করার কথা বলা হয়েছে, এবং গোটা বিচারব্যবস্থা অন্ধের মতো সেই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে। রহস্য গল্পের আদলে তৈরি এই গল্পের শেষে পাঠক জন্য অপেক্ষা করছে একটা মৃদু ধাক্কা।]
চিফ ইনস্পেকটর নরোজি ফ্ল্যাটবাড়িটায় যতক্ষণে ঢুকলেন, ততক্ষণে সেন্ট্রাল সিকিউরিটির টিম মহিলার ঝুলন্ত দেহটাকে নামিয়ে ফেলেছে। সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে একটা চাপা হলওয়ের ওপারে লিভিং রুমের দরজাটা। পুরো ফ্ল্যাটটাকেই সদর দরজা থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। খোলা রান্নাঘরটা, বাথরুমের দরজাগুলো আর শোবার ঘরটা। ফরেনসিক টিমের যন্ত্রপাতি এদিক-ওদিক ছড়ানো রয়েছে। তা বাদে, ফ্ল্যাটটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নই তো লাগছে।
নরোজিকে দেখে, ইনস্পেকটর শিমা নাহাবান্দি ফরেনসিকের দলটা ছেড়ে তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন। সাদা রঙের ওভারঅল পরে আছেন শিমা। ওঁরা এতক্ষণ ঝাড়বাতি থেকে ফাঁসির দড়িটা খুলছিলেন।
অন্যদের সামনে নরোজি ওকে ওর উপাধি ধরেই ডাকে। ওর দিকে তাকিয়ে নরোজি আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন, ওর আবেগের মাত্রা কতটা। ভয় ও দুশ্চিন্তার পরিমাণটা নরোজিকে দেখেই ওর খানিকটা কমে গিয়েছিল। কিন্তু আবেগতালিকায়, শিমার মধ্যে শোক এখনও বেশ উঁচু মাত্রাতেই দেখা যাচ্ছে।
“মহিলার স্বামী ওর বডিটা প্রথম দেখেন সকালবেলায়।” শিমা তৎক্ষণাৎ রিপোর্ট দেবার কাজ শুরু করে দিল। মধ্যবয়সি, দীর্ঘদেহী, চওড়া কাঁধের একজন লোককে দেখাল সে, রান্নাঘরের কাউন্টারের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন।
“লেফটেনান্ট, আত্মহত্যার কেস বলেই মনে হচ্ছে। স্বামীটি কাল রাত্তিরে সাভেতে ছিলেন। আজ সকালে ফিরে এসে দেখেন স্ত্রী মৃত। সাভেতে ওঁর কর্পোরেট আবাসে ফোন করেছিলাম। ওঁরা জানিয়েছেন, সত্যিই রাত্রে উনি ওইখানে ছিলেন। আমরা এখনও মৃত্যুর সঠিক সময়টা জানি না অবশ্য। অটোপ্সির রেজ়াল্ট না-আসা অবধি…”
নরোজি ওর দিকে হাত নেড়ে ওকে পাশ কাটিয়ে স্বামীটির দিকে ধাবিত হলেন। শিমা তাঁর পিছনে পিছনে গেল।
“নাম?” নরোজি জিজ্ঞাসা করলেন।
“মহিলার নাম নাসিম। স্বামী শাহাব মিরজাই।” শিমা বলল।
লোকটির কাছাকাছি যাবার আগে লেফটেন্যান্ট নরোজি নিজের কপালের সেন্সরটা আঙুলের ডগা দিয়ে স্পর্শ করলেন। ওঁর রেটিনার ওপর শাহাবের একটা ক্ষুদ্র ছবির ছায়া পড়ল। অক্ষিগোলকটাকে ঘুরিয়ে, উনি শাহাবের আবেগগুলোর তথ্যের মেনুর আইটেমটা সিলেক্ট করলেন। ওর চারটি প্রধান আবেগ এই মুহূর্তে দৃশ্যগোচর হল। শোক ৮০%, প্রশান্তি ৯০%, তৃপ্তি ৫০% ও ক্লান্তি ৬৫%। কোনো ভয়, দুশ্চিন্তা বা অনুশোচনার চিহ্ন নেই ওর এই মুহূর্তের প্রধান আবেগগুলোর ভেতরে।
শাহাবের পাশ থেকে একটু সরে গেলেন নরোজি। টাক-পড়ে-যাওয়া ঈষৎ পৃথুল লোকটির সঙ্গ তাঁর অস্বস্তিকর মনে হচ্ছিল।
“ইনস্পেকটর নাহাবান্দি, মহিলাটির আবেগের তালিকাটা এখুনি বার করে আমাকে পাঠান।”
শিমা মাথা নাড়ল, “স্যার, ভদ্রলোকেরটা তো নিজেই দেখেছেন। স্বামী তো এ কাজ করতেই পারে না। ওর আবেগতালিকা খুনিদের সঙ্গে মিলছে না… ইয়ে… একজন খুনি তো সচরাচর…”
“সচরাচরের কথাটা থাক।” একটু বিরক্ত হয়ে নরোজি শিমাকে থামিয়ে দিলেন, “ওর আবেগতালিকা অস্বাভাবিক। যে লোকের স্ত্রী আত্মহত্যা করেছে, তার আবেগতালিকা যা হওয়া উচিত, তার সঙ্গেও মিলছে না। ওকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হোক। পুরো ফ্ল্যাট খানাতল্লাশিও করা হোক। লোকটির জামাকাপড় চেক করুন। মহিলা কি কর্মরতা ছিলেন?”
“হ্যাঁ, ছিলেন, স্যার। একটা বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করতেন। ওঁর বসই ওঁকে শেষ জীবিত অবস্থায় দেখেছিলেন। মিস্টার এহসান কামালি।”
***
আগের রাত্রি:
অফিস ছাড়ার আগে, নাসিম একবার এহসানের দিকে ফিরে তাকাল। এগজ়িকিউটিভ চেয়ারে বসে আছে এহসান। নিজের শার্টের বোতামগুলো লাগাচ্ছে। আবেগতালিকা দেখার দরকার পড়ে না, ওর অর্ধেক ফাঁক-হওয়া হাসি-হাসি ঠোঁট দুটি, শিথিল শরীর—এসবই স্পষ্ট ফাঁস করে দেয় ওর তৃপ্তি আর আনন্দকে।
তবু, কত শতাংশ, সেটা জানার দরকার আছে বই-কি। কপালের সেন্সরটা স্পর্শ করে সে পড়ে নেয়, এহসানের এ মুহূর্তের চারটি প্রবল আবেগ—আনন্দ ৮৭%, প্রশান্তি ৬৯%, তৃপ্তি ৫৮%, ক্লান্তি ৬৫%।
সে-ও ক্লান্ত ছিল। সারাদিনের কাজের চাপের কারণে তো বটেই, এবং তারপর এই সুখপ্রদ শরীরী ক্রিয়াকলাপেও, যা তার আনন্দ আর প্রশান্তিকে ৮০%-এর ওপরে তুলে দিয়েছে।
খালি হলঘরটার একমাত্র আলোটি আসছে তারই কিউবিক্ল থেকে। তার হাঁটার রাস্তাটাকে আলোকিত করে রেখেছে। পা দুটি কাঁপছিল নাসিমের। হাই হিলের ওপর নিজের শরীরের ভর রাখতে কষ্ট হচ্ছিল। দ্রুত হাঁটার সময় টলছিল। নিজের ডেস্কে বসে, কম্পিউটারের ডেস্কটপে ফাইল আর ফোল্ডারগুলোকে একে একে বন্ধ করল। ফোনটা বেজে উঠল ওর। শাহাবের ছবি স্ক্রিনের ওপর দেখে ওর আবেগের মাত্রাগুলো প্রতিটা দ্রুত পরিবর্তিত হতে লাগল। দুঃখ আর দুশ্চিন্তা, অনুশোচনা রেটিনার বাঁদিকে দৃশ্যমান আবেগতালিকাতে হুহু করে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। কিচ্ছু করার নেই। বড়ো করে শ্বাস ফেলে ও নিজের সদর্থক আবেগগুলোকে বাড়ানোর চেষ্টা করছিল, সুখের দৃশ্য কল্পনা করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু একমাত্র যে কল্পনাটা এখন ওকে সুখ দিতে পারত, তা এহসানের ওডিকোলনের সুগন্ধটা নাক ভরে নেওয়া। এহসানের হাসিমুখের দৃশ্য। ওর কাঁচাপাকা রোমভরা বুকটা ক্রমশ ঢেকে, খোলা শার্টের বোতাম যেভাবে লাগিয়ে নিচ্ছিল এহসান, সেই দৃশ্য। কিন্তু এসব ভেবে কোনো সুরাহা হল না। অনুশোচনা ওর আবেগতালিকার একেবারে ওপরে ঠাঁই নিল, ৮০%-এর ওপর। শাহাবের রাগ আরও বাড়বে, যদি না এখুনি ফোনটা ও ধরে।
নিজের কলারটা পাট পাট করে, চুলটা আলতো চাপড়ে ঠিকঠাক করে, ও ফোনটা ধরল। “আমি আর দু-চার মিনিটের মধ্যে বেরুচ্ছি।”
শাহাবের আবেগতালিকার দিকে না-তাকাতে খুব চেষ্টা করছিল সে। ফোনে ওর মুখের ছবিটির ঠিক পাশেই ছিল আবেগতালিকা, ওর প্রধান আবেগগুলোকে দেখা যাচ্ছিল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেখে নিল একঝলক, শাহাবের বিরক্তি আর অতৃপ্তি দেখে ও নিজে প্রভাবিত হল, অনুশোচনা ৯২% অব্দি উঠে গেল।
শাহাব জিজ্ঞাসা করল, “কী হল, তোমার অনুশোচনার কারণ কী?”
নাসিম কম্পিউটার বন্ধ করে, ড্রয়ার থেকে হ্যান্ডব্যাগ বের করে নিল। “এই যে, এত দেরি করে ফেলেছি। খারাপ লাগছে গো। ফিরছি এখুনি।” বলেই সে ফোন কেটে দিল, ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বাইরের দরজার দিকে চলল দ্রুতপদে।
***
জিজ্ঞাসাবাদের ঘরটার টেবিলে এহসান ঝুঁকে বসে ছিল। নরোজি দু-চার মিনিট আগে থেকে ওকে ওখানে একলা বসিয়ে রেখে শিমার সঙ্গে পাশের ঘরের কাচের জানালাটা দিয়ে নজর রাখছিল। ওর আবেগতালিকাটা ওখান থেকে দেখে, পলিগ্রাফ ব্যবহার করার জন্য অনুমতি জোগাড় করেছিল ওরা। লোকটার আবেগতালিকা দুটো ধরনের সঙ্গেই মিলে যাচ্ছে—একজন সন্দেহভাজন, এবং সদ্য কোনো প্রিয়জনের মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত।
কিন্তু যতক্ষণ জেরা চলবে, এহসানের আবেগতালিকার খুঁটিনাটিতে নজর রাখতে বা তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করতে চাইছিল না সে। পলিগ্রাফেই সে কাজ হয়ে যাবে। অনেক দ্রুত আর নিখুঁতভাবে।
ঘরটায় ঢুকে এবার এহসানের উলটোদিকে বসল সে।
নিজের পরিচয় দিয়ে সোজা প্রসঙ্গে এল নরোজি, “আপনার প্রাথমিক বক্তব্য পড়েছি। কিন্তু দু-তিনটে জিনিস মিলিয়ে নেবার দরকার আছে। আপনি নিশ্চিত যে আপনার কোনো আইনজীবীর সাহায্য প্রয়োজন নেই?”
“না, আমি আমার বক্তব্যে তো বলেইছি, নাসিম যখন মারা যায়…” নিজের শোক গিলে ফেলতে একটু সময় নিল এহসান… “আমি তখন একটা রেস্তোরাঁতে ছিলাম। আমার সহকর্মীরা সে তথ্যের প্রমাণ। আমার সঙ্গে নাসিমের মৃত্যুর কোনো যোগাযোগই নেই। তাই ওর স্বামীর সঙ্গেই আপনারা কথা বলে নিন, আমার সঙ্গে না।”
এহসানের রাগ ও ঘৃণার মাত্রা আবেগতালিকাতে বেড়ে যাচ্ছিল, তথাপি পলিগ্রাফ সূচক নিজের চোখের পর্দায় দেখে নিল নরোজি, সবুজই আছে সেটা।
“স্বামী দাবি করেছেন, নাসিম আত্মহত্যা করেছেন।” নরোজি বলল, ডেস্কের ওপর রাখা কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে, “বিগত তিন বছর ধরে নাসিম আপনার কোম্পানিতে কাজ করছিলেন, তা-ই না?”
“দু-বছর দশ মাস।” এহসান সংশোধন করে বলল, “আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্মী ছিল সে।”
“সচরাচর যেসব অধস্তনের বসেদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে, তারাই সাফল্যের চূড়ায় অতি দ্রুত পৌঁছোয়।” মিচকে হেসে নরোজি বলল।
এহসান মাথা নামিয়ে নিল।
“আপনিই কিন্তু শেষ ব্যক্তি, যিনি নাসিমকে জীবন্ত দেখেছিলেন। আর ফরেনসিক নিশ্চিত যে আপনার সঙ্গে তিনি সংগম করেছিলেন।”
এহসান উত্তর দিল না।
নরোজি বলে চলল, “নাসিমের অ্যাকিউট ডিপ্রেশনের ইতিহাস আছে। ওর স্বামীর কথা অনুসারে, কাজের জায়গায় যে চাপ ওকে সহ্য করতে হত, বিশেষত আপনার দিক থেকে ওকে শরীরী সম্পর্ক করতে যে বাধ্য করা হত, এগুলো ওর ডিপ্রেশনকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। ওর আবেগতালিকায় দেখা গেছে, আপনার সঙ্গে সহবাসের পরপর ওর অনুশোচনার স্তর খুব উঁচু মাত্রায় চলে গিয়েছিল।”
এহসান কিঞ্চিৎ ক্ষিপ্তভাবে বলল, “এটা দুজনের মধ্যে সম্মতিক্রমেই হয়েছিল। ও চেয়েছিল। আপনারা নিশ্চয়ই ওর পুরো আবেগতালিকার ইতিহাসটা পরীক্ষা করেছেন। আর আপনি এটাও দেখেছেন যে, আমরা যখন… ইয়ে… যখন আমরা একসঙ্গে ছিলাম, আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে, ওর ভালো লাগায় কোনো খামতি ছিল না। আমি ওর সুখের দিকে সর্বদা খেয়াল রাখতাম। ওর আবেগতালিকা বারবার চেক করতাম।”
পলিগ্রাফের সূচকের সবুজ বাতি এখনও জ্বলে চলেছে।
নরোজি আবার ব্যঙ্গের হাসি হাসল, “আমরা ওর স্বামীর আবেগতালিকাও খুঁটিয়ে দেখেছি। যখন নাসিম আত্মহত্যা করেন, সেই সময়ে, মানে সাড়ে ন-টা থেকে দশটার মধ্যে, ওঁর আবেগও স্বাভাবিকই ছিল। উনি বলেছেন, উনি তখন সাভের পথে ছিলেন। উনি দাবি করেছেন, নাসিমকে সারারাত ধরে উনি যোগাযোগ করার চেষ্টা করে চলেছিলেন, কিন্তু উত্তর পাননি, এবং সেজন্যেই পরদিন সকালে তিনি তেহরান ফিরে আসেন।”
এহসান মাথা ঝাঁকাল। “নাসিম মোটেই ডিপ্রেশনে ছিল না। ওর সমস্যা ছিল ওর স্বামীর সঙ্গে। শীতল, আবেগহীন, সহানুভূতিহীন লোক। অথচ নাসিমকে ডিভোর্সও দিচ্ছিল না। সারাক্ষণ ওদের ঝগড়া চলত, আমি জানি, আমার বিশ্বাস, আপনারাও জানেন। আপনাদের তদন্তে নিশ্চিত এটা জেনে ফেলেছেন এতক্ষণে।”
নরোজির বিশ্বাস অর্জন করতে চেয়ে, গলা নামিয়ে তারপর সে জুড়ে দিল, “নাসিম মোটেই ডিপ্রেসড ছিল না, এবং কিছুতেই ও আত্মহত্যা করতে পারে না। ওর স্বামীই আসল সন্দেহভাজন। নিশ্চিত ওকে ও আমাদের সম্পর্কটার কথা বলেছিল, আর সেটা মেনে নিতে পারেনি শুয়োরটা।”
“আমি আপনার কথা অবিশ্বাস করছি না। যা-ই হোক, জজসাহেব তো আবেগতালিকা দেখবেন, দুজনের মিলিত আবেগতালিকা কিন্তু আত্মহত্যার দিকেই নির্দেশ করছে। শেষ মুহূর্তে নাসিমের মনে বেদনা, ভয়, দুশ্চিন্তা এবং অনুশোচনা মিলেমিশে এই অবস্থার উদ্ভব করেছিল। শাহাবের কিন্তু অন্যদিকে কোনো নঞর্থক আবেগই ছিল না, রাগ না, ঘৃণা না, অনুশোচনা না। কেউ খুন করলে তার মধ্যে এইসব আবেগ আসবেই। এমনকি সাভে যাবার আগে শাহাবের সঙ্গে নাসিমের কোনো ঝগড়াঝাঁটির থিয়োরিও পরিত্যক্ত হয়েছে। কারণ বাড়িতে কোনো মারপিটের চিহ্ন নেই, আবেগতালিকাতেও নেই কোনো হদিস, দাম্পত্য কলহের। কাজেই বুঝতেই পারছেন আমার হাত বাঁধা। জজসাহেব আবেগতালিকা দেখেই বিচার করবেন, কারণ আজকের দিনে আবেগতালিকাই সব তথ্যের চাবিকাঠি বলে আমরা জানি। আবেগ হল বিশুদ্ধতম এবং সঠিকতম প্রমাণ, যা নিয়ে কেউ কোনো নটঘট করতে পারে না। কাজেই যদি আপনি কোনো শক্তপোক্ত প্রমাণ আমাদের দিতে পারেন, যা থেকে নিশ্চিত হবে, শাহাবই তার স্ত্রী-কে খুন করেছে, আমাদের উপকার হবে। অবশ্য তার পরেও দেখতে হবে, জিনিসপত্রের প্রমাণ আবেগতালিকার প্রমাণকে খণ্ডন করতে সক্ষম হচ্ছে কি না।”
এহসান খানিকক্ষণ ভাবল। একটু সময় নিয়ে, সে বলল, “ওদের ফোনের কথোপকথনের রেকর্ড… বা শাহাবের হাতের ছাপ, দড়ির ওপর…”
স্বগতোক্তির মতো নিজের ভাবনাগুলো সে জোরে বলছিল। আর পলিগ্রাফের সবুজ আলোটা ক্রমাগত জ্বলে সে যে সত্যি বলছে, তার নিশানা দিচ্ছিল।
“সব দেখা হয়ে গেছে। ওরা তো বিবাহিত দম্পতি, তাই মৃত্যুর জায়গার আশপাশে স্বামীর হাতের ছাপ থাকতেই পারে। ফোনের কল রেকর্ডেও কোনো অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি।”
ডেস্কের ওপরে কাগজগুলো গোছাতে গোছাতে নরোজি যোগ করলেন, “হ্যাঁ, তবে আপনি কিন্তু একজন উকিলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে রাখুন। ওঁর স্বামী আপনাকে এই মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত করতে চাইছেন… কাজেই আপনার ও আপনার কোম্পানির জন্য উকিল রাখাটা ভালোই হবে।”
এহসান হঠাৎ ভেঙে পড়ল।
নরোজি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। “যদি আর কিছু মনে পড়ে, আমাকে ফোন করবেন।” ওকে ওর নিজের ভিজ়িটিং কার্ডটা দিয়ে বললেন তিনি।
জেরাকক্ষের দরজা খুলে গেল। শিমা দরজাটা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। এহসানকে ওর সঙ্গে বেরুতে হাতের ইঙ্গিত করল।
***
আগের রাত্রিতে:
শাহাব রান্নাঘরের কাউন্টারের পাশে বসে, নিজের স্যান্ডউইচ চিবোচ্ছিল। নাসিম ঢুকে দু-চারটে কথা বলল, সে না-শোনার ভান করল। নাসিম ব্যাগটা দরজার পাশে রেখে তার দিকে ফিরল। তারপরই নাসিমের ঘৃণা মাত্রা ছাড়াল।
“আমার সঙ্গে ডিনার করার জন্য অপেক্ষাটুকু করতে পারলে না তুমি?” ক্ষিপ্ত হয়ে বলল নাসিম।
শাহাব থালাটা তুলে নিয়ে বেসিনের দিকে রাখতে চলল, নাসিমের দিকে একবারটিও না তাকিয়ে। থালাটা ধুয়ে সে জল ঝরানোর ঝুড়িটার ওপরে রেখে দিল। নাসিম ঘুরে গেল, দরজার দিকে চলল। ব্যাগটা নেবে বলে সে ঠিক হাতটা বাড়িয়েছে, সেই মুহূর্তে শাহাব তার সামনে গিয়ে লাফিয়ে পড়ল। তার পিঠের দিকে সে কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে।
নাসিম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বিস্ফারিত চোখে শাহাবকে দেখতে লাগল। তারপর একটা দ্রুত শ্বাস নিয়ে সে চিৎকার করে উঠল, “আমি দেরিতে বাড়ি ফিরেছি, তার একটা কারণ আছে। সবাই অফিস থেকে চলে যাওয়া অব্দি অপেক্ষা করছিলাম। সবাই বেরিয়ে যাবার পর, একা হতে পারলাম এহসানের সঙ্গে। তোমার সঙ্গে এক মুহূর্তও আর আমি সহ্য করতে পারছি না। আমি আর থাকব না তোমার সঙ্গে। তা তোমার ভালো লাগুক বা মন্দ।”
একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল সে শাহাবের দিকে।
শাহাব শান্ত এবং স্থির। তার আবেগতালিকায় কোনো বিশেষ প্রাধান্য পাচ্ছে না কোনো একটি আবেগও। কিন্তু নাসিমের নিজের নঞর্থক আবেগগুলো যে ক্রমশ সীমা ছাড়াচ্ছে। প্রধান আবেগের স্থান নেবার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে ঘৃণা, ক্রোধ আর উদ্বেগের ভেতরে। শাহাবের শীতল চাউনিটা তার অনুশোচনা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
শান্তভাবে শাহাব বলল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি, আর আমাদের এই যৌথ জীবনটাকেও।”
“আমি তোমার সঙ্গে সুখী নই, শাহাব, বহুবার তো বলেছি তোমাকে।” নাসিম অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল, “আমি তোমাকে আর ভালোবাসি না, এই জীবনটাও চাই না। বহুদিন ধরে তোমাকে ছেড়ে যেতে চেয়েছি, কিন্তু তুমি আমাকে ছাড়ছ না। এই বিয়ের খাঁচায় তুমি আমাকে দশ বছর ধরে বন্দি করে রেখেছ। আমি আর এ বাড়িতে থাকব না।”
“আমি কখনও তোমাকে আঘাত করেছি?” শাহাব যেন নিরীহভাবে বলল, কথা বলার টানটোনে সততা আর বিবেক ভুরভুর করছে।
নাসিমের কিছু বলার ছিল না। মাথা নীচু করে রইল খানিক, তারপর আবার মাথাটা তুলল, কিছু বলবে বলে, আবার মাথা নামিয়ে নিল। শেষ পর্যন্ত একটা শ্বাস নিয়ে সে বলল, “আমাকে সরাসরি আঘাত করার কথা নয়। তুমি একটা ভাবলেশহীন লোক। তোমার সঙ্গে থাকলে আমার কোনো ভালো অনুভূতিই তৈরি হয় না। সুখ না, উত্তেজনা না, শান্তি না। তুমি নিজেও এটা জানো। তুমি কখনও আমাকে সুখী করতে পেরেছ? এবার থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি সুখী হবই, কোনো অনুশোচনা ছাড়াই সুখী হব।”
শাহাব হাসল। এখন কোনো নিরীহ ভাব আর সে কণ্ঠস্বরে নেই: “সমস্যা তোমার নিজের। কখনও তুমি ডিপ্রেসড থাকো। কখনও আমাকে ঠকাও। তুমি সুখী হতে তো জানোই না, বাঁচতেই শেখোনি কখনো।”
নাসিম চোখ বুজে ফেলল। শীতল আর গভীর এক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। তারপর শাহাবের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘুরে দাঁড়াল দরজার দিকে। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে দরজার পানে চলল।
শাহাব শক্তভাবে, দৃঢ়ভাবে বলল, “বাড়ি ছেড়ে যেতে পারবে না তুমি।”
***
এহসান কোম্পানির দারোয়ানকে একদিনের ছুটি দিয়েছিল। শাহাবের সঙ্গে তার যে দেখা হচ্ছে, সে কথা সে কাউকে জানাতে চায়নি। টাকাগুলো গুনে নিয়ে সে টেবিলের ওপর একটা খামের ভেতর রাখল। শাহাবের জন্য সে অপেক্ষা করছিল, অন্ধকার হলঘরে ফাঁকা কিউবিক্লগুলো পেরিয়ে তার অফিসে আসতে শাহাবের বেগ পেতে হবে। ভয় ও উদ্বেগ তার অন্য আবেগগুলোকে চাপা দিয়ে দিচ্ছিল। হৃদ্যন্ত্র যেন ভীষণ জোরে দৌড়োচ্ছে। ঘামে ভিজে-ওঠা হাতের পাতা দুটি সে নিজের গাঢ় রঙের সুটের দামি কাপড়ে মুছল। শাহাব ভেতরে আসতেই অবশ্য এহসান দাঁড়িয়ে ওঠার বদলে নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। সে জানত, সে উঠে দাঁড়ালেও তার উচ্চতা শাহাবের বুক ছাড়িয়ে উঠবে না। নিজের উচ্চতার সুবিধা শাহাব পাক, সে চাইছিল না। এমনকি শাহাবকে বসতেও বলল না এহসান। অফিসঘরের দরজার কাছে শাহাব দাঁড়িয়ে থাকুক, এমনটাই সে চাইছিল। তার ডেস্কের থেকে চার মিটার দূরে দাঁড়িয়ে থাকুক। কিন্তু শাহাব ওইটুকু ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে এল ভারিক্কিভাবে, দৃঢ়পদে… যেন মাটি কেঁপে উঠছিল।
“নাসিমের জিনিসপত্রগুলো অফিসের অ্যাডমিন থেকে গুছিয়ে দিয়েছে।” অফিসঘরের দরজার কাছে রাখা একটা বাক্সের দিকে দেখিয়ে এহসান বলল, “ওই বাক্সোটায় আছে। আপনি ওটা নিয়ে যেতে পারেন।” শাহাব এক মুহূর্ত ঘাড় ঘুরিয়ে বাক্সোটার দিকে দেখল। এহসান ওই সময়টা নিজের চোখের কোণ দিয়ে শাহাবের যে চিত্রটা দেখল, সেটার আবেগতালিকা পড়ে নিল। কোনো আবেগই তার ত্রিশ শতাংশের বেশি নয়। রাগ এবং অন্যান্য নঞর্থক আবেগ দশ শতাংশের দাগ পার করেনি। এমনকি অহংকার, আত্মপ্রত্যয়, কোনোটাই নয়। শাহাবের এই উদাসীন নিষ্ক্রিয়তা ওর ভেতরে এনে দিল ক্রোধ। এহসান যদিও নিজের শ্বাসপ্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দনের মাত্রাকে কবজায় রাখতে চেষ্টা করছিল, সে বুঝতে পারছিল, শাহাব চাইলেই তার উঁচু তারে বাঁধা রাগ আর ঘৃণার মাত্রাগুলো পড়ে ফেলতে পারছে।
খামটা তুলে নিয়ে শাহাবের দিকে দেখাল সে। ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়েছে এসে শাহাব। “আমাদের মধ্যে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাতে এই টাকাটা আপনার অভিযোগ তুলে নেবার জন্য দেওয়া হচ্ছে। অবশ্যই আপনি জানেন যে নাসিমের আত্মহত্যার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগই নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মানসিক অবস্থায় এবং কোম্পানির স্বার্থে, এই অর্থহীন খেলায় আমি আর কোনোভাবে জড়িয়ে থাকতে চাইছি না।”
শাহাব খামটা তুলে নিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। বলল, “এক দম্পতির সুখের সংসার আপনি ছারখার করে দিলেন।”
এহসান মাথা নীচু করল।
শাহাব বলে চলল, “নাসিম আর আমি পরস্পরকে ভালোবাসতাম। খুব ভালোবাসতাম। আপনি আমাদের সব কিছু কেড়ে নিলেন।” সে তার বিশাল চামড়ার ব্রিফকেসটা ডেস্কের ওপরে রাখল।
এহসান ওপরে তাকাল এবার।
শাহাব ব্রিফকেসের ডালা খুলে খামটা ভেতরে ঠুসে দিল তার চওড়া পাঞ্জা দিয়ে। তারপর এক হাত ব্রিফকেসের ভেতরে রাখা অবস্থাতেই, স্ট্র্যাপটা সুবিশাল কাঁধের ওপর চড়িয়ে নিয়ে কেসটাকে টেবিল থেকে তুলে নিল।
“আপনি যদি আমাদের জীবনে নাক না গলাতেন, নাসিম এখনও বেঁচেবর্তে থাকত।” শান্তভাবে, নিরীহভাবে কথা ক-টি বলল শাহাব, “ওকে মৃত্যুদণ্ড আপনিই দিয়েছেন।”
“আমিও নাসিমকে ভালোবাসতাম।” এহসান আপত্তি জানাল, “আমি চাইনি, এমন কিছু হোক। বিশ্বাস করুন।” তার অনুশোচনা আবেগতালিকার একেবারে উপরিতল ছুঁয়ে ফেলল।
শাহাব এহসানের চেয়ারের কাছে হেলতে-দুলতে এসে ঠিক তার পিছনে দাঁড়াল। এহসানের সাহস হল না পিছনে ফিরে দেখে এই বিশালকায় লোকটার চোখের দিকে। চেয়ারের পিছনে তাকিয়ে শাহাবের ব্রিফকেসের ধপ করে মাটিতে পড়ার শব্দটা পেয়ে সে চমকে উঠল। তারপর নিজের পায়ের কাছে পড়ে-থাকা ব্রিফকেসের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেল ব্রিফকেসের ভেতরে একটা পাকানো লম্বা দড়ি। দড়িটার প্রান্ত নিশ্চিতভাবেই শাহাবের হাতে রয়েছে। এহসান কোনোভাবে প্রতিক্রিয়া দেবার, দাঁড়িয়ে ওঠার, দৌড়ে পালাবার সুযোগই পেল না। এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের ভেতরে তার গলায় একটা রূঢ় চাপ অনুভব করল এহসান। আর শাহাবের শান্ত শ্বাসের শব্দ সে শুনতে পেল।
শাহাব এহসানের মুণ্ডুটাকে দড়িটার হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে এল, যে টানে ওর শরীরটা চেয়ার থেকে মাটিতে ধরাশায়ী হল। এহসানের পা দুটো সহজেই শিথিল হয়ে গেল। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল সে। বাতাসের জন্য, আরেকবার শ্বাস নেবার জন্য, এক মুহূর্ত বাড়তি বাঁচবার জন্য সে আকুলিবিকুলি করল। কিন্তু শাহাব দড়িটা সজোরে টেনে ধরে রইল।
শাহাব একই রকম শান্তস্বরে জ্ঞান-হারাতে-বসা এহসানের কানে ফিশফিশ করে বলল, “তোমার মতো কাণ্ডকীর্তি করলে আমি লজ্জায় মরে যেতাম। আমি যদি তুমি হতাম, অপরাধবোধেই আত্মহত্যা করতাম। যেমন নাসিম করেছিল।”
***
এইবার নরোজি অপরাধের স্থানের প্রাথমিক তদন্তের সময়েই পলিগ্রাফের অনুমতি জোগাড় করে নিয়েছিল। নিজে ও অ্যাসিস্ট্যান্ট শিমা দুজনের জন্যেই। এহসানের অফিসে যতক্ষণে পৌঁছোল তারা, দেখল, ফরেনসিক টিম ততক্ষণে কাজ শুরু করে দিয়েছে। এহসানের অফিসে সরাসরি চলে গেল ওরা। শবদেহটা একটা প্লাস্টিকের আচ্ছাদনে ভরে সরিয়ে নেবার আগে, নরোজি ফরেনসিকের মাথাকে মৃতদেহের মুখটা একবার দেখাতে বললেন। এহসানের ভীতসন্ত্রস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে নরোজির আবেগতালিকায় দুঃখ তিরবেগে ঊর্ধ্বমুখী হল। তারপরই হতাশা আর অনুশোচনা। শিমা ঘরে ঢুকল।
“শাহাব মির্জাই কোথায়?”
“রান্নাঘরে,” শিমা বলল, “আপনার অনুমতি পেলে আমি ওকে জেরা করতে নিয়ে যাব।”
ফরেনসিক টিম বডিটা নিয়ে গেল। নরোজি শিমাকে জিজ্ঞাসা করল, “ও এখানে এসেছে কেন?”
“ও বলছে, এহসান নাকি ওকে ডেকেছিল। নাসিমের জিনিসপত্র নিতে।” শিমা দরজার পাশে বাক্সোটাকে দেখাল।
“ও কি শাহাব আসার কয়েক মিনিট আগেই ফাঁসিতে ঝুলে পড়েছে, যাতে শাহাবই এসে মৃতদেহটা দেখতে পায়?”
শিমা কাঁধ ঝাঁকাল, “তা-ই তো মনে হচ্ছে।”
এহসানের ডেস্কের ওপর রাখা খামটার দিকে নরোজির চোখ গেল। ফরেনসিক অফিসারকে ডেকে সে বলল খামটার ছবি তুলতে, যেভাবে খামটা রাখা ছিল ডেস্কের ওপর, আর মেঝেতে ছড়িয়ে-রাখা জিনিসপত্রের ছবিও তুলতে বলল। ছবি তোলা শেষ হলে, সে প্লাস্টিকের গ্লাভস পরে খামটা হাতে তুলে নিল। খাম থেকে টাকাটা সাবধানে ধরে বের করল সে। নরোজি আর শিমা দুজনের উত্তেজনা আর আশার পারদ তখন ঊর্ধ্বমুখী। একটা বড়ো এভিডেন্স ব্যাগ এনে, ফরেনসিক অফিসার তার ভেতরে খাম আর টাকাটা ভরে ফেললেন।
“দড়িতে নিঃসন্দেহে শাহাবের হাতের ছাপ পাওয়া যাবে।” শিমার দিকে চেয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে নরোজি বলল।
“কী করে?” শিমা অবাক।
নরোজি টেবিলের ওপরের হুক থেকে ঝুলন্ত দড়িটা দেখাল শিমাকে, বলল, “দ্যাখো, ডেস্ক থেকে দড়িটার দূরত্ব ঠিক কতটা।” তারপর সে শিমাকে দেখাল টেবিল থেকে ছিটকে মাটিতে পড়া কাগজ-কলম, আর অন্য টুকিটাকি জিনিসগুলোকে…
“ও যখন দড়িতে ঝুলছিল, ও নিশ্চিত টেবিলটার ওপরে পা রাখতে চেষ্টা করেছিল? তাই সব কিছু মেঝেতে ছিটকে পড়েছে? কিন্তু খামটা এতটুকু নড়েনি কেন? অর্থাৎ, খামটা ওর মৃত্যুর পরেই টেবিলের ওপর রাখা হয়েছে। ব্যাপারটা জটিল কিন্তু, এবারে মনে হচ্ছে, আমাদের পক্ষেই যাচ্ছে!” ব্যাখ্যা করল নরোজি।
শিমা মাথা ঝাঁকাল, “স্যার, কোর্ট কিন্তু শুধু ওই আবেগতালিকার ওপরেই ভরসা করবে, আপনিও জানেন সেটা।”
নরোজি থামাল ওকে, “শাহাবের আবেগ এখনও সব স্বাভাবিক, তা-ই কি?”
সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল শিমা।
“ঠিক এটাই আমি ভেবেছিলাম। ওর আবেগের মাত্রাগুলো সব স্বাভাবিক, আর এটাই বলে দিচ্ছে ব্যাপারটা গোলমেলে।”
নরোজি আত্মবিশ্বাসীভাবে কথাটা বলল। শিমা তার এই আকাশকুসুম ভাবনার স্রোতে বাধা দেবার চেষ্টা করলেও সে উপেক্ষা করল নরোজি, বলেই চলল, “শাহাব এহসানের নামে মামলা করেছিল, আমরা জানি। এহসান শাহাবকে চুপ করাতে চেয়েছিল, তাও জানি। শাহাব নাসিমকে যেমন মেরেছে, তার প্রেমিককেও তেমনই খুন করেছে। শাহাব চালাক-চতুর ছেলে। হয়তো সে জানত যে, অফিসে ঢোকার মুখের ক্যামেরাগুলো সব তার ছবি ক্যাপচার করে ফেলবে, অথবা আমরা এহসানের ডিএনএ-র কিছু না কিছু ট্রেস শাহাবের পোশাকে পাব, বা দড়িতে পাব ওর হাতের ছাপ। এহসানের মৃত্যুর পর ও পুলিশ ডেকে নিয়ে বলল, এহসানকে ও দড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় পেয়েছে, মৃত কি না বুঝতে পারছে না, এবং ওর শরীরটা নামিয়ে ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে, আমাদের আসার ঠিক আগেই ওর মনে পড়ল, খামে করে টাকাটা নিয়ে সে ব্যাগে ভরেছিল। তাই সে খামটা বার করে টেবিলে রেখে দিল, যাতে ওর জিনিসপত্রের মধ্যে টাকাটাসহ ও ধরা না পড়ে। কিন্তু ও ভেবে দেখেনি, টেবিল থেকে আর সব কিছু পড়ে গেলে, খামটাও পড়ে যাওয়া উচিত। ওইটেই ওর ভুল হয়েছে। আর ওতেই ব্যাটা পাকড়াও হবে!”
শিমা মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “আপনার থিয়োরি আমার কাছে খুবই যুক্তিযুক্ত, এক্কেবারে ঠিক লাগছে, স্যার। আঙুলের ছাপ বা অন্য প্রমাণগুলো সবই ওকেই দোষী বলে সাব্যস্ত করবে, তাও ঠিক। ওসব সাবেকি পদ্ধতিতে তো কোনো কথাই ছিল না, স্যার। কিন্তু…”
নরোজি বলল, “কিন্তু কী?”
শিমা মাথা তুলে বলল, “কিন্তু আমি ওকে জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে পলিগ্রাফ ব্যবহার করে দেখেছি, স্যার। একবারের জন্যও লাল আলোটা জ্বলেনি! অর্থাৎ এই অ্যাপকে ভরসা করলে, ও সত্যি কথা বলেছে সব। লোকটা পুরোই আবেগহীন। ফলে… এবার আমরা কী করব, স্যার?”
নরোজি এবার আর তুমুল আত্মবিশ্বাস, তুখোড় বুদ্ধির গর্ব, কিছু দিয়েই আত্মরক্ষা করতে পারল না। ভেঙে পড়ল সে। বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, দরজার দিকে হাঁটা লাগাল। দ্রুত। ছ্যাঃ, এই নতুন প্রযুক্তি!
শিমা আবার দেখে না ফ্যালে যে, তার ক্রোধ ও নৈরাশ্য মাত্রা ৯০%-এর ওপরে উঠে গেছে!
Tags: জোহা কাজেমি, দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, যশোধরা রায়চৌধুরী
