খগেনবাবুর স্পেস-টাইম
লেখক: অনিন্দ্য বসু
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
শিয়ালদা স্টেশন থেকে শেষ ট্রেনটা ধরে বাড়ি ফিরছিল দীপ্তার্ক। ডালহৌসি পাড়ার একটা মাঝারি অফিসের কেরানি। মফস্সলের বাসিন্দা অতএব ‘ডেইলি পাষণ্ড’। আজ হঠাৎ অফিস থেকে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে দেখা হয়ে গেল স্কুলজীবনের এক বন্ধুর সঙ্গে। প্রায় এক যুগ পরে দেখা! অতএব একটু তো গপ্প-আড্ডা হবেই! বাস স্ট্যান্ডের পাশেই একটা চায়ের দোকান, কয়েক গ্লাস চা সহযোগে স্মৃতিচারণ। সেই করতে গিয়ে কথা উঠল স্কুলজীবনের নানান বিষয়ে। বেশির ভাগটাই বিভিন্ন মাস্টারমশাই আর সহপাঠীর খবরাখবর ইত্যাদি নিয়ে। আর তখনই উঠল খগেনবাবুর নাম। বন্ধুটি মনে পড়িয়ে দিল, ‘আমাদের সেই ইলেভেনের ফাইনালের আগের দিন থেকে সেই যে খগেনবাবু নিপাত্তা হয়ে গেলেন, আর ভদ্রলোকের কোনো হদিস মিলল না! মনে আছে, কী হইহই হল সেই নিয়ে?’ তারপর আরও পাঁচরকম গপ্প করতে করতে দেরি হয়ে গেল। ফলে সাতটা পাঁচের লোকালটা ধরা হল না। বদলে আটটা দশের লোকালটায় উঠতে হল। দীপ্তার্কর অন্য সহযাত্রীরা আজ আর সঙ্গে নেই। সবাই আগের ট্রেন ধরে ফিরে গেছে। দীপ্তার্ক জানলার ধারের একটা সিট পেয়ে, সেটায় আরাম করে বসল। ট্রেন শিয়ালদা স্টেশন ছেড়ে এগুতে শুরু করেছে আর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। অঝোর জলের ধারার ভেতর দিয়ে ঝাপসা বাইরেটা দেখতে দেখতে দীপ্তার্ক ফিরে যাচ্ছিল তার স্কুলজীবনে।
গরমের ছুটির পর প্রথম দিন ফিজ়িক্স ক্লাসে এসে দীপ্তার্ক দেখল, মাস্টারমশাই বদলে গেছে! ছুটির আগে অবধি পড়াচ্ছিলেন সুবোধবাবু। বয়স্ক, ভারী চেহারার বেঁটেখাটো মানুষ। আস্তে আস্তে থেমে থেমে কথা বলেন। ব্ল্যাকবোর্ডের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত লিখে চলেন নানান ফর্মুলা কিংবা অঙ্কের সমাধান। কিন্তু ছাত্ররা তার কতটা বুঝল, সে নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই। খালি মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতেন, ‘সব নোট করে নিয়েছ তো?’ আর আজকে যাকে দেখল, তিনি একেবারে অন্য ধাঁচের। লম্বা, রোগা, মাথায় এলোমেলো চুল, চোখে পুরু কাচের চশমা। আর চশমার আড়ালে দুটো জ্বলজ্বলে অথচ ভাবুক চোখ! ক্লাসঘরের প্রাথমিক গুঞ্জন থেমে গেলে এই নতুন মাস্টারমশাই একটু গলাখাঁকারি দিয়ে সামান্য হেসে বললেন, ‘তোমরা নিশ্চই ভাবছ এ আবার কে! সুবোধবাবু কোথায়?’ তোমাদের জানিয়ে রাখি। সুবোধবাবু গরমের ছুটির সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং এখন লম্বা ছুটিতে আছেন। আর তাঁর জায়গায় আমি এসেছি তোমাদের অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে। আমার নাম খগেন্দ্রনাথ মিত্র।’
দীপ্তার্কর এমনিতে ফিজ়িক্স খুব একটা ভালো লাগে না। তার একটা কারণ টেক্সট বইগুলো ভীষণ বোরিং। আর সুবোধবাবু পড়াতেনও ভীষণ রসকষহীনভাবে! কিন্তু খগেনবাবুর পড়ানোর ধরন একেবারে আলাদা। মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে নিউটনের তত্ত্বটা ব্যাখ্যা করতে করতে বললেন, ‘আসলে কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ নয়, কারণ খুব বড়োসড়ো মাপের বস্তুর চারপাশের যে স্পেস, সেটা বেঁকেচুরে যায়। আর তাই সেই বস্তুর কাছাকাছি অপেক্ষাকৃত ছোটোখাটো বস্তু এসে গেলে সেই বাঁক বরাবর চলবে। এইটে ভেবেচিন্তে বার করেছিলেন আইনস্টাইন!’ এ তো ভারী মজার ব্যাপার! এটা দীপ্তার্ক জানত না! সেই শুরু। তারপর প্রায় তিনটি মাস জুড়ে ক্লাসে পড়ানোর সময় খগেনবাবু আরও কত কত মজার, অদ্ভুত সব বৈজ্ঞানিক তথ্য আর তত্ত্ব দারুণ ইনটারেস্টিং করে গল্পের মতো শোনাতেন! আর ছেলেরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত। একদিন খগেনবাবু ক্লাসের লেকচার শেষ হওয়ার পরে বললেন, মানুষের মতো তারাদেরও জন্ম আর মৃত্যু হয়, জানো তো? দীপ্তার্ক তো শুনে অবাক। সে আবার হয় নাকি? তারারা তো চিরকাল ছিল আর থাকবে, এমনটাই ভাবত সে। সেদিনের মতো স্কুলের ক্লাস সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর বাইরে সেদিনও ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। বাড়ি ফেরার তেমন তাড়া কারোই ছিল না। ক্লাসের মধ্যে আধো অন্ধকার কাটাতে খগেনবাবু আলোটা জ্বেলে দিয়েছিলেন। খগেনবাবুর চশমার কাচে সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে মাঝে মাঝে চোখ ধাঁধাচ্ছিল। আর কালো বোর্ডে সাদা চক দিয়ে খগেনবাবু এঁকে এঁকে বোঝাচ্ছিলেন, কেমন করে গ্যাস আর ধুলো মিশে একাকার হয়ে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে জোট বেঁধে জন্ম দেয় এক-একটা তারার! আর যখন তাদের শক্তি শেষ হয়ে যায়, তখন আসে তারাদের অন্তিম লগ্ন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিন ক্লাসের সবাই সেই গল্প শুনেছিল। দীপ্তার্কর মনে আছে, পরের কয়েকটা দিন কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কেটেছিল!
আর তারপর আরেকটা ক্লাসে, সেদিন বেশি ছেলে আসেনি কী একটা কারণে! বোধহয় সিলেবাস শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই। খগেনবাবু গল্প করার মুডে ছিলেন। আর শুনিয়েছিলেন সেই আশ্চর্য কথা। যে, কোনো কোনো তারা মৃত্যুর পর এক সম্পূর্ণ অন্ধকার গহ্বরে পরিণত হয়, যার থেকে আলো পর্যন্ত পালাতে পারে না! ব্ল্যাকহোল নামের সেই রহস্যময় মহাজাগতিক বিস্ময়কথা শুনে দীপ্তার্ক হাঁ হয়ে গিয়েছিল। সত্যি বলতে কী, দীপ্তার্কর বাড়ি অতি সাধারণ বাড়ি। বাবা একটি বেসরকারি অফিসের কেরানি। সাত কুলে কেউ ফিজ়িক্স বা অঙ্ক বা অন্য কোনো বিজ্ঞানের শাখায় পড়াশুনো করেনি। অতএব, আর পাঁচটা শিক্ষিত বাড়ির ছেলেপুলেরা যতটা খবর রাখে, দীপ্তার্ক তার ধারকাছেও নয়। তাই এইসব গপ্প তার কাছে একটা স্বপ্নের জগৎ খুলে দিয়েছিল! আর খগেনবাবু বলতেও পারতেন ভীষণ সুন্দর করে। ফলে, খুব শীঘ্রই দীপ্তার্ক হয়ে উঠল খগেনবাবুর একনিষ্ঠ ভক্ত। এবং যখন শুনল যে, খগেনবাবু ওদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে পুরোনো মল্লিক-বাড়িতে থাকেন, তখন সে আসতে আস্তে নানা সময় পড়া বুঝে নেওয়ার অজুহাতে খগেনবাবুর বাড়ি যাওয়া শুরু করল। খগেনবাবুও তার সঙ্গে খুব আন্তরিকভাবে কথা বলতেন।
এইরকম কথা বলতে বলতেই দীপ্তার্ক জানতে পেরেছিল যে, খগেনবাবু পড়ানোর বাইরে খুব গভীরভাবে এক ধরনের গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। ওঁর লেখা অনেক রিসার্চ পেপার দেশ-বিদেশের বহু পত্রিকায় বেরোয়। উনি তখন ব্ল্যাকহোল নিয়েই গবেষণা করছিলেন। ইউরোপের একটি গবেষকদলের সঙ্গে ওঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ইমেলের মাধ্যমে বা কখনো-কখনো অনলাইন চ্যাটের মাধ্যমে উনি ওই দলটির সঙ্গে একটা কোনো ভীষণ উত্তেজনাকর আবিষ্কার নিয়ে প্রায়ই আলোচনা করতেন। তার আভাস দীপ্তার্ক ওঁর নানা কথায় পেত। এইভাবে বেশ চলছিল। তারপর হঠাৎই সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল!
শীতের ছুটির কয়েকদিন আগে খগেনবাবুর বাড়ি গিয়েছিল দীপ্তার্ক! অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কা দেওয়ার পর খগেনবাবু অতি সন্তর্পণে দরজা খুলে দীপ্তার্ককে একরকম টেনে ভেতরে নিয়ে এলেন। ওঁর চোখে-মুখে কেমন একটা ভয়! দীপ্তার্ক একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। একটু সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে, স্যার? আপনাকে এরকম দেখাচ্ছে?’
‘আমায় আজ কিছুক্ষণের মধ্যেই এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে, দীপ্ত!’
‘সে কী? কেন? আপনি ফিরবেন কবে?’
‘ফেরা হয়তো আর হবে না। তোমায় সবটা বলে যাচ্ছি। আমার তো তিন কুলে কেউ নেই। এ ক-মাসে তোমার সঙ্গে একটা অসমবয়সি বন্ধুত্ব হয়েছে। তাই বলছি।’
এরপর খগেনবাবু কিছুটা আগুপিছু করে যে গল্পটা বলেছিলেন, সেটা দীপ্তর কাছে একই সঙ্গে প্রায় অবিশ্বাস্য অথচ রোমাঞ্চকর লেগেছিল! আমাদের সৌরজগতের সীমানায় নাকি একটি প্রাইমোর্ডিয়াল ব্ল্যাকহোলের সন্ধান (যা কিনা বিশ্ব সৃষ্টির সময় থেকে রয়েছে) পাওয়া গেছে! আর খগেনবাবু যে বিজ্ঞানী দলটির সঙ্গে কাজ করেন, তারা খুব সংগোপনে একটি মহাকাশযান তৈরি করেছে, যা আলোর গতির কাছাকাছি দ্রুততায় চলতে পারে! এই অসামান্য কাজটি খুবই গোপনে করতে হয়েছে, কারণ পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলো এর খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে একে ছিনিয়ে নেবে। এই মহাকাশযানে চড়ে খগেনবাবু আর তাঁর বিজ্ঞানী বন্ধুরা পাড়ি দেবেন সেই রহস্যময় ব্ল্যাকহোলের সন্ধানে! তাই গোপনে খগেনবাবু সব ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু আজকেই খবর এসেছে যে, তাদের যাওয়াটা এগিয়ে এসেছে, কারণ কয়েকটি বিদেশি গুপ্তচর সংস্থা কী করে যেন ওদের অভিযানের খবর পেয়ে গেছে এবং চেষ্টা করছে সেটি ভন্ডুল করে দেওয়ার। অতএব, হাতে আর সময় নেই। খগেনবাবু আজকেই বেরিয়ে পড়ছেন তাঁর বিজ্ঞানী বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিতে। জায়গার নাম বলা বারণ। কারণ, কে কোথায় খবরের সন্ধানে ঘুরছে, বলা যায় না।
অতঃপর, দীপ্ত ফিরে গিয়েছিল নিজের বাড়িতে। আর সেই রাত্রির পর থেকে খগেনবাবুর আর কোনো খবর কেউ পায়নি।
কতকাল আগের কথা! প্রায় বিশ-তিরিশ বছর হয়ে গেল! চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে বাইরের বৃষ্টিমুখর অন্ধকার দেখতে দেখতে দীপ্তার্ক চলে গিয়েছিল তার ছাত্রজীবনে। ট্রেনটা আস্তে আস্তে একটা স্টেশনে এসে দাঁড়াল। দীপ্তার্কর চেনা এই সব ক-টা স্টেশন। এই সময় সাধারণত কেউ এই ট্রেনটায় ওঠে না। লোকে নামে। আজও কিছু লোক নামল। প্ল্যাটফর্মের নিবুনিবু আলোয় কিছু লোকের ছাতা হাতে দ্রুত চলাফেরা নজরে এল। একেবারে শেষ মুহূর্তে হঠাৎই একজন বর্ষাতি-পরা ভদ্রলোক এই কম্পার্টমেন্টে প্রায় ছুটতে ছুটতে উঠে পড়লেন। ট্রেনটা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিল। আর সেই ভদ্রলোক দীপ্তার্কর উলটোদিকের বেঞ্চিটাতে বসে পড়লেন। ভিজে বর্ষাতিটা ইতিমধ্যে খুলে ফেলেছেন ভদ্রলোক। আর ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল দীপ্তার্ক! এ কী করে সম্ভব? এ যে একেবারে সেই পঁচিশ বছর আগে দেখা খগেনবাবুর মুখ অবিকল! সেই এলোমেলো চুল। সেই চশমার পিছনে উজ্জ্বল দুটি চোখ! দীপ্তার্কর অজান্তেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘খগেনবাবু!’
আর দীপ্তার্কর সামনে বসা ভদ্রলোকও ততোধিক চমকে বলে উঠলেন, ‘আপনি কে? আমায় চিনলেন কী করে?’
দীপ্তার্কর হতভম্ব ভাবটা কাটতে কিছুটা সময় লাগল। ইতিমধ্যে খগেনবাবু কিন্তু সামলে নিয়েছেন।
তীক্ষ্ণ চোখজোড়ার কাছে দীপ্তার্কর বয়সের রেখা মুছে গিয়ে ভেসে উঠল তিরিশ বছর আগের এক কিশোরের মুখ। তারপর কতকটা ফিশফিশিয়ে খগেনবাবু বলে উঠলেন, ‘দীপ্তার্ক না?… তোমার মুখটা অনেকটা বদলে গেছে। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক!’
গলায় একরাশ বিস্ময় নিয়ে দীপ্তার্ক বলে উঠল, ‘কিন্তু আপনি এই পঁচিশ বছরে এক রইলেন কী করে? এ যে অসম্ভব ব্যাপার!’
বাইরে বৃষ্টির জোরটা একটু বেড়ে উঠেছে ইতিমধ্যে! বৃষ্টির ঝাপটা এসে মাঝেমধ্যে মুখে এসে লাগছে! দীপ্তার্কর শরীরটা একবার যেন শিউরে উঠল।
খগেনবাবু হাত বাড়িয়ে জানলার কাচ নামিয়ে দিলেন। তারপর চশমাটা খুলে জামার খুঁট দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন, ‘তোমার মনে আছে, আমি যখন চলে যাই, তখন আমি তোমায় একটা মহাকাশ অভিযানের কথা বলেছিলাম?’
দীপ্তার্কর তো সবটাই মনে আছে। ওর সাদামাটা বিরস কেরানির জীবনে ওইটুকুই তো রূপকথার মতো রয়ে গেছে!
‘সেই অভিযানে আমি শামিল হতে পেরেছিলাম। আলোর গতির কাছাকাছি দ্রুত একটি মহাকাশযানে আমি আর আমার কয়েক বিজ্ঞানী পাড়ি দিয়েছিলাম সৌরজগতের সীমায় ঘূর্ণায়মান সেই ব্ল্যাকহোলের উদ্দেশে।’
‘দীপ্ত, তুমি জানো কি যে, প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণের কাছাকাছি গেলে সময়ের গতি কমে যায়। অর্থাৎ একটা ব্ল্যাকহোলের কাছাকাছি থেকে তুমি যদি কয়েক মিনিট সময় কাটাও, এই পৃথিবীর মাটিতে ততদিনে হয়তো কয়েকটা মাস বা বছর কেটে যেতে পারে। আমরা সেই মহাকাশযানে ব্ল্যাকহোলটির অনেকটা কাছাকাছি চলে গেছিলুম। তবে, লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করিনি। অর্থাৎ, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে “ইভেন্ট হরাইজ়ন” পেরোইনি। কারণ তাহলে আর ফিরতে পারতাম না। কিন্তু আমরা ফিরে এলাম। সেটার কারণ পরে বলছি। কিন্তু আমাদের কাছে যেটা সর্বসাকুল্যে বছর দু-এক সময় ছিল, পৃথিবীর মাটিতে সেটাই তিরিশ বছর হয়ে দাঁড়াল। আমরা সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। তাই এখানে ফিরে খুব একটা অসুবিধে হয়নি। আমি ফেরার পর কয়েকটা দিন আমার আর-এক সহযাত্রী ও বিজ্ঞানীর কাছে, ইটালিতে একটি গ্রামে কাটিয়ে কালকেই ফিরেছি এ দেশে। তবে, খুব শিগগির আবার বেরিয়ে পড়ব।’
খগেনবাবুর কথা শুনতে শুনতে দীপ্তার্কর মনে পড়ে যাচ্ছিল, খগেনবাবু বোধহয় একবার ক্লাসেই সময়ের গতি কমে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। সেসব কবেকার কথা! খগেনবাবু চলে যাবার পর দীপ্তার্কর খুব ইচ্ছে হয়েছিল ফিজ়িক্স নিয়ে পড়ার। কিন্তু, এর কয়েক মাসের মধ্যেই দীপ্তার্কর বাবা মারা গিয়েছিলেন। আর, হঠাৎই সংসার নামক জাঁতাকলের মধ্যে দীপ্তার্ক চলে গিয়েছিল। তড়িঘড়ি কমার্সের একটা গ্র্যাজুয়েশন করে একটা কোম্পানির কেরানি হয়ে ঢুকে গিয়েছিল। অতএব, সব স্বপ্নের ইতি সেখানেই। আজ আবার এতদিন পর, এই নাটকীয়ভাবে খগেনবাবুর আবির্ভাবে দীপ্তার্কর মনের মধ্যে ঘুমিয়ে-থাকা সেই স্বপ্নটা এপাশ-ওপাশ করছিল। বিক্ষিপ্ত মনটাকে জোর করে ফিরিয়ে এনে ও মন দিয়েছিল সামনে বসে-থাকা মূর্তিমান বিস্ময় খগেনবাবুর দিকে।
খগেনবাবু বলছিলেন, ‘আমরা যাকে ব্ল্যাকহোল ভেবে এগিয়েছিলাম, সেটার কাছাকাছি পৌঁছে, আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করে আমরা বুঝলাম এটা আসলে একটা ওয়র্মহোল। অর্থাৎ, এই গহ্বর আসলে মহাকাশের অতিদূর একপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়ার রাস্তা। তবে, এটি সব সময় খুব স্থিতিশীল নয়। তাই এর ভেতরে প্রবেশ করলে কী হতে পারে, কেউ জানে না! তাই আমরা ফিরে এলাম আরও ভালো করে প্রস্তুতি নিতে। কারণ মহাকাশের যে প্রান্তে আমরা পৌঁছোব, তা শত শত আলোকবর্ষ দূর হতে পারে। এই ওয়র্মহোলের কথা অনেক বিজ্ঞানী বলে গেছেন। কিন্তু, আমরাই প্রথম এরকম একটি বিস্ময়ের মুখোমুখি হব। আর কিছুদিনের মধ্যেই আমি আবার ফিরে যাব ইটালিতে। খালি আমার জাগতিক সব কিছুর একটা বিলিব্যবস্থা করে যেতে চাই। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই হল। আমার তো তিন কুলে আর কেউ বেঁচে নেই। কিন্তু আমার কিছু বিষয়সম্পত্তি আছে। তুমি নেবে?’
হায়! কোথায় মহাজাগতিক অভিযান, আর কোথায় এই পার্থিব সম্পত্তির হিসেব! দীপ্ত বলতে চাইল, না না, আমি সম্পত্তি চাই না। আমি আপনার সঙ্গে সেই অজানার অভিযানে পাড়ি দিতে চাই। এই বস্তাপচা কেরানির জীবন ছুড়ে ফেলে দিয়ে, মহাশূন্যের অপার বিস্ময়কে প্রত্যক্ষ করতে চাই, মাস্টারমশাই! কিন্তু, স্টেশন এসে গেল। দীপ্ত সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসি, মাস্টারমশাই! সম্পত্তি আপনি কোনো অনাথ আশ্রমকে দান করে দিন। আমার দরকার নেই। আপনার আসন্ন অভিযানের জন্য শুভেচ্ছা রইল। আর তো আমার জীবদ্দশায় আপনার সঙ্গে দেখা হবে না। আপনি আমায় স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন। তার জন্য আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ!’
Tags: অনিন্দ্য বসু, দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
