দাও ফিরে সে অরণ্য
লেখক: ঋষভ চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“মাটিতে যাদের পড়ে না চরণ…”
কত রকমের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হয়ে গিয়েছে আজকাল। এক কোপে একসঙ্গে দশ-বারোটা মোটা মোটা গাছকে একেবারে মূলসুদ্ধ উপড়ে ফেলে দিচ্ছে। মোটা শক্ত চেন ধরনের একটা যন্ত্র—মেশিন চালালেই গুল্ম জাতীয় গাছের ঝাড়কে মিনিটের মধ্যে মাটির থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। চোখের নিমেষে দূর্ভেদ্য, ঘন জঙ্গল সাফ! নাছোড় গাছগাছড়া হেঁচড়ে তুলে ন্যাড়া করে দিচ্ছে প্রান্তরটাকে, নীচের কঙ্কালসার লাল মাটিটা বেরিয়ে পড়ছে। আর কী কী সব নাম সে সব যন্ত্রের। চেইন শ, এক্সকাভেটর—এসবের সঙ্গে মান্ধাতা আমলের বুলডোজার তো আছেই।
দুটো একেবারে নতুন ধরনের ডোজার দাঁড়িয়ে রয়েছে ফুট কুড়ি দূরে। গায়ের গাঢ় কমলা রংটার থেকে সকালের কড়া রোদ ঝিলিক মারছে চোখে। এরকম ডোজার তিনি আগে কোনোদিন দেখেননি। ঝুরিওয়ালা, বিশালাকার মোটা গুঁড়ির যে অবাধ্য গাছগুলো সাধারণ ডোজারের ধাক্কায় মাটি থেকে দুমড়ে মুচড়ে উলটে পড়ে না, তাদের জন্য এই ব্যবস্থা। এই অত্যাধুনিক ডোজার দুটো বিরাট বিরাট লম্বা ধাতব হাত দিয়ে গাছটাকে মরণ বেষ্টনে জাপটে ধরে নেয়। হাত দুটোর ঠিক নীচেই থাকে লোহার অসংখ্য তীক্ষ্ণ দাঁত-বসানো দুটো বড়ো বড়ো চোঙা। এই চোঙা দুটো চেপে ধরে গাছের একেবারে গোড়াটা। ইলেকট্রিকের স্রোত বয়ে আসামাত্র প্রবলবেগে বনবন করে ঘুরতে শুরু করে চোঙা দুটো। তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো বারবার খুবলে নিতে থাকে গাছটার শরীর থেকে মাংস। ভারী চোঙা দুটো পিষে দিতে থাকে বুনো শরীরটাকে। মূল দুর্বল হয়ে আসে অতিকায় গাছটার, তখন টেনে মাটির উপর তুলে ফেলে লোহার দুটো হাত।
সকাল থেকে শ-খানেক ফোন অ্যাটেন্ড করার ফাঁকে ফাঁকে এইসবই খুঁটিয়ে দেখছিলেন হরি। আনন্দ-বিস্ময়ে শিশুর মতো হাসি ফুটে উঠছিল তাঁর মুখে। বিশুদ্ধ কৌতূহলে পায়চারি করছিলেন যন্ত্রগুলোর আশপাশ দিয়ে। নেশার মতো লাগছিল এই বিরাট বিরাট দানবদের আক্রোশলীলা দেখতে, বেখেয়ালেই হয়তো বারবার বেশি কাছে চলে আসছিলেন তাদের।
“স্যার, আপনি প্লিজ একটু এদিকে সরে আসুন। কাঠের টুকরো উড়ে আসছে, দুম করে কোনো ডাল ভেঙে গায়ে এসে পড়লে…” তটস্থ গলায় বলছিল সাই বারবার। বহু জনকে, বহু প্রকারের তৈল মর্দন করে তবে এই কনট্র্যাক্টটা পাওয়া গিয়েছে। একটা কিচ্ছু এদিক থেকে ওদিক হলে ওর কাছে দুঃস্বপ্নের মতো হবে। শেষমেশ যদি গাছের ভারী ডাল মাথায় পড়ে খোদ এই লোকটার কিছু হয়ে যায়, বউ-ছেলে নিয়ে পথে বসতে হবে ওকে।
কম ঝক্কি তো পোহাতে হয়নি সাইকে। রায়দূর্গ থেকে নাগল, সুলতান বাজার থেকে সেকেন্দ্রাবাদ অবধি অন্তত খান পনেরো প্রভাবশালী কনট্র্যাক্টর এই একটা প্রজেক্টের পিছনে আদা-জল খেয়ে পড়েছিল। নতুন দু-হাজারি গোলাপির অন্ত রাখেনি সাই, বিদেশি হুইস্কি থেকে সিঙ্গেল মল্টের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। প্রত্যুত্তরে উলটোদিক থেকে খালি “দেখছি, দেখব” শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু লোক চরিয়ে খায় সে—এসব লোককে চিনতে বেশিদিন লাগে না ওর। লোকটার চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে নিয়েছিল। একদিন হাই-টেক সিটিতে শপিং করতে যাওয়ার নাম করে ক্লাস নাইনে পড়া ভাইঝিটাকে সঙ্গে করে নিয়ে খোদ লোকটার বাড়িতে গিয়ে হাজির। সানভীর দিকে লোকটার চোখ পড়ামাত্র সাই বুঝে গিয়েছিল কনট্র্যাক্ট ওর হাতের মুঠোয়। ঠিক তিন দিনের মধ্যে ফোন করে সব পেপারস রেডি করতে বলেছিল হরি। কনট্র্যাক্টের কাজ যত এগোচ্ছিল, সানভীর জন্য খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ছটফট করতে শুরু করেছিল জানোয়ারটা। ততদিনে দাদা বউদির সঙ্গে এন্তার ঝগড়াঝাঁটি করে সানভীকে পুরোনো স্কুল থেকে ছাড়িয়ে চেন্নাইয়ের বোর্ডিং স্কুলে ভরতির ব্যবস্থা করে ফেলেছে সাই। এই হায়দ্রাবাদ শহরে থাকলে সানভীর কী হাল হতে পারে, সেটা ওর থেকে ভালো আর কেউ জানে না।
কিন্তু হায়নার মুখের সামনে মাংস দুলিয়ে গ্রাস কেড়ে নেওয়া যায় না, সেটা ভালোমতোই বুঝতে পারছিল সে। সানভীর তামিলনাড়ুতে বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলে ক-দিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে বড়োজোর। কাজের চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মধুপুরায় যাতায়াতটাও ক্রমেই কমে এসেছে সাইয়ের। আগে হলে এত কাঠখড় পোড়াতে হত না। কোঠির মালকিন অনেকদিনের চেনা, তাই প্রায় দ্বিগুন টাকা দিতে পাওয়া গেল একজনকে। বয়েস পনেরো বছর পাঁচ মাস। ভার্জিন। মুখটা দেখে একটা শ্বাস পড়েছিল শুধু সাইয়ের বুক থেকে। গাড়িতে করে নিয়ে লোকটার বাড়ি যাওয়ার সময় পুরো রাস্তাটা একটাও কথা বলেনি সাই। একবারও মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে সাহস হয়নি ওর—তাকালেই বারবার সানভীর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। আর ভেসে উঠছিল একটা নরকের কীটের মুখ—হরি! হরি ভাগবাতুলে! আরবান ডেভলপমেন্ট মিনিস্টার হরি ভাগবাতুলে।
সাইয়ের বারংবার করতে থাকা অনুরোধে কাজ কিন্তু হচ্ছিল না মোটেই। বডিগার্ডরা হরির চারপাশে ছুটে চলেছে, হরিকে অনুরোধ করছে তার জন্য তৈরি করা ছাতা ঢাকা উঁচু প্ল্যাটুটায় এসে গদিআঁটা চেয়ারটায় বসতে। কিন্তু হরিকে তখন নেশায় পেয়েছে। শক্তপোক্ত বিশাল বিশাল গাছগুলোকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে উপড়ে পড়তে দেখার নেশা! হিসেবে কষছেন হরি, বেট লাগাচ্ছেন নিজের সঙ্গেই নিজের—এই গাছটার ভাঙতে কতক্ষণ লাগবে, এইটা মনে হচ্ছে একটু বেশি দুর্বল। এই তো, এই তো এইটা বেশ ঢ্যাঁটা আছে, সহজে নড়ানো যাচ্ছে না—যে জিনিস যত শক্তি দেখায়, তাকে গুড়িয়ে ফেলাটাই তো তত আরামের। মড়মড় করে আওয়াজ হচ্ছে চারপাশ থেকে, চুরচুর হয়ে ভেঙে যাচ্ছে জেদি হাড়গোড়গুলো। কালিন্দীর গমরঙা নরম তুলতুলে শরীরটাকে দু-হাতের মধ্যে ভেঙেচুরে দিতে কী এতটাই আরাম হয়? সঙ্গমের মুহূর্তের চেয়েও বেশি তৃপ্তি কি সেই ভেঙেচুরে দেওয়াতে? নিজের অজান্তেই হাতের মুঠোদুটো শক্ত হয়ে ওঠে হরির। নখ বসে যায় তালুতে। শিরা ফুলে ওঠে রগের।
“স্যার, আপনি ঠিক আছেন?” চা নিয়ে এসেছে সাই। নিজেকে সামলান হরি। ইন্দ্রিয়সুখের জন্য আরও কয়েকটা ঘণ্টা অপেক্ষা করতেই হবে। কালিন্দী দিন তিনেকের জন্য ছুটি চেয়েছে, ক্যান্সারে ভোগা বাবাকে নিয়ে ভেলোর গিয়েছে। এইটুকু মেনে নিতেই হয় হরিকে।
হালকা মাথা নেড়ে চা নেন হরি। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে উপভোগ করতে থাকেন সামনে ঘটতে থাকা দৃশ্যটা। যন্ত্রের ভয়ে ভীরু শিশুর মতো পিছু হটতে শুরু করেছে এত বড়ো জঙ্গলটা, একটু একটু করে গুটিয়ে নিচ্ছে থাবা। বিজ্ঞানের কী ক্ষমতা, ভাবতে ভাবতে চায়ে চুমুক দেন হরি ভাগবাতুলে।
এরকম করেই দিনটা কাটছিল—সূর্যটা ধীরে ধীরে মাথার উপর উঠছিল একটু একটু করে। দৃশ্যটা বদলাতে শুরু করল বারোটা থেকে। একটা হইহই রইরই শব্দ অনেকক্ষণ ধরেই পাচ্ছিলেন হরি। সেই শব্দটা ক্রমাগত এগিয়ে আসছে এদিকে। অবাক কিন্তু এতটুকুও হননি হরি। খবর ছিল অনেক আগে থেকেই—তাই জন্যই তো দরকারের চেয়ে অনেক বেশি পুলিশফোর্স, রাফ, আধা-সামরিকবাহিনী তৈরি করেই রেখেছিলেন। তিনটে পুলিশ ভ্যানও দাঁড় করানো আছে সামনেই। স্টুডেন্টদের দলটা গলাটা সপ্তমে তুলে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসছে পাঁচিলের ধার ঘেঁষে। স্লোগানগুলো কানে ঢুকতেই নিজের যুবা বয়েসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে হরির। সামনের মনোরম দৃশ্যটা থেকে চোখ না সরিয়ে মন দিয়ে স্লোগানগুলো শোনার চেষ্টা করেন হরি।
কিছুক্ষণ শোনার পর হতাশায় মুখটা সামান্য বিকৃত হয়ে যায় তাঁর। ধুর! নির্বিষ, জোলো, ছেলেমানুষি স্লোগান সব। কোনো আগুন নেই, আক্রোশ নেই, আগ্রাসন নেই—অতিরিক্ত ভদ্র। এত ভদ্রতা করলে রাজনীতি হয় নাকি? কোথায় তাঁর সময়ের স্লোগান আর কোথায় এসব বেঁড়েপাকাগুলোর মিয়াও মিয়াও? ঠোঁটের কোণটা বিদ্রুপে চওড়া হয় আরও। বেশ লাগছে কিন্তু। স্লোগানের সুরের তালে তালে মাথাটা অল্প নাচাতে শুরু করেন হরি।
ওদিকে পুলিশ ব্যারিকেড বসাতে শুরু করেছে পরপর। আগে থেকেই কিছু লোহার গার্ডরেল বসানো ছিল, এখন বাকিগুলোও বসানো হচ্ছে পরপর। শক্ত দড়ি দিয়ে সেগুলোকে একে অপরের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে দূর্ভেদ্য প্রাচীর। ছাত্রছাত্রীদের কলরবের মাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যাচ্ছে তাদের সংখ্যাটাও বাড়ছে। আকাশে উৎক্ষিপ্ত মুঠো করা হাতের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে তাল মিলিয়ে।
“উই আর রিয়েলি সরি ফর দি ইনকনভ্যানিয়েন্স, স্যার।” এস.পি নাগেশ এগিয়ে এসেছে পাশে।
“হোয়াট?” হেসে উঠে বলে ওঠেন হরি। “কী যে বোলো নাগেশ! এসব তো আমাদের কাছে রোজকার জিনিস, এ তো জলভাত। একটু টুকটাক স্লোগান টোগান উঠবে, ছাত্রছাত্রীরা চিৎকার করে প্রতিবাদ করবে, তবেই না একটু গণতন্ত্র গণতন্ত্র ফিলটা আসবে। নাহলে তো…” ইঙ্গিতপূর্ণ হাসছেন হরি।
“স্যার, আমার ফোর্স পুরো তৈরিই আছে। যতক্ষণ ব্যারিকেডের ওপারে লাফ-ঝাঁপ করছে, ঠিক আছে; ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করলেই মেরে একেবারে শেষ করে দেব শয়তানগুলোকে।” নাগেশ নিজের আনুগত্যের প্রমাণ দাখিলে মরিয়া।
“আরে… তুমি বড়োই অধৈর্য হও নাগেশ। আচ্ছা, একটা কথা বলো তো? আমরা এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছি?”
“পিপলস ইউনিভার্সিটি অব হায়দরাবাদে।”
“রাইট। আর এই যে জঙ্গলটা কাটা হচ্ছে তার পুরো আয়তনটা কত?”
“কমবেশি ওই চারশো একর, স্যার।”
“এবার বলো, এই জঙ্গলটা কোথায় অবস্থিত?”
“ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের মধ্যেই।”
“তাহলে? ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের মধ্যে এতো বড়ো একটা জঙ্গল কেটে দেওয়া হবে, আর স্টুডেন্টসরা কিছুই বলবে না? এটা আবার হয় নাকি? আমাদের কাজে বিঘ্ন না ঘটিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে একটু আন্দোলন আন্দোলন খেলে নিক, অসুবিধে কী আছে?”
সাইকে ডেকে বললেন, ব্যারিকেডের বাইরে যতই, যা খুশি আন্দোলন হয়ে যাক, কাজের গতি যেন এতটুকু কমে না যায়। কিন্তু অসুবিধে শেষমেশ হল। যখন কথা বলছিলেন হরি এস.পির সঙ্গে তখনই বোঝা যাচ্ছিল, ব্যারিকেডের বাইরে আরও ছাত্রছাত্রীদের ভিড় বাড়ছে। শুরুতে যে সংখ্যাটা পঞ্চাশ ছিল, সেটা এখন বেড়ে প্রায় তিনশো পেরিয়ে গিয়েছে। তারা সম্মিলিতভাবে লোহার ব্যারিকেড কাঁপাতে শুরু করেছে। প্রবল ধাক্কায় ব্যারিকেড জায়গায় জায়গায় টলে উঠছে, পুলিশ চেষ্টা করেও তাদেরকে আটকে রাখতে পারছে না। জঙ্গলের যে অংশে সবার আগে হাত পড়েছে, সেই পুরো এলাকাটা জুড়ে এই মুহূর্তে থিকথিক করছে কমবয়েসিদের ভিড়। এইসব প্রতিবাদ, হরতাল, মিছিলে চট করে ত্রিশের ওপারের লোকজনদের বড়ো একটা দেখতে পান না হরি কোনোদিনই; দু-বেলা অফিস করতে হলে এসব পরিবেশ নিয়ে আলগা পিরিত পশ্চাৎদ্দেশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর সব জায়গায় থাকে কিছু সাদা চুলের বুদ্ধিজীবী। হাসি পায় হরির—এদের তো তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকল, এখনও এসব ছেলেমানুষি না ছাড়লে হাসি পাবে না।
তবে এই ভিড়ের সকলেই যে প্রতিবাদী তা নয়, সেটা খুব ভালো করেই জানেন হরি। সামনের কয়েকজন বোড়ের মতো পুলিশের লাঠি-বুট খাবে, পিছনে যারা আছে তারা যাকে বলে স্পিরিটে সঙ্গে আছে। এই স্পিরিটে সঙ্গে থাকার বকলমে অর্থ হচ্ছে—নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে মজা দ্যাখা, ভিডিয়ো করে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া, এবং লাঠিচার্জ শুরু হওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাঠ ফাঁকা করে দেওয়া। সমস্যা স্রেফ সামনের দু-তিনশো জনকে নিয়ে।
সার বেঁধে দাঁড় করানো ব্যারিকেডের উপরে খান দশেক ছেলে উঠে পড়েছে এবার। কয়েকজন মিলে নীচে থেকে ঠেলে তুলে ফেলার চেষ্টা করছে কড়া হলুদ রঙের রেলগুলো। মিনিটখানেকের মধ্যে গাছ কাটার গগনভেদী আর্তনাদ আর ছাত্রছাত্রীদের নাগাড়ে স্লোগানিয়ারিংয়ের আওয়াজে দু-ফুট দূরে দাঁড়ানো মানুষের কথা শোনা কঠিন হয়ে পড়ল। ইচ্ছে না থাকলেও বিক্ষোভের দিকে চোখ ফেরাতে হচ্ছে হরিকে।
মিনিট কুড়ি পরে স্টুডেন্টদের চাপে দুটো গার্ডরেল ভেঙে পড়ল। শব্দটা পাওয়া মাত্র আড়চোখে তাকালেন হরি—এতটা তিনি আশা করেননি। সঙ্গে সঙ্গে সুনামির স্রোতের মতো ছাত্রছাত্রীরা পুলিশকে টপকে ঘেরাটোপের মধ্যে ঢুকতে শুরু করল। মুহূর্তের জন্য চমকেছিলেন হরি। তার বডিগার্ডরা সবাই তাঁকে ধরে, আড়াল করে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে গেল।
পুলিশের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গিয়েছে। কয়েকজন পুলিশের সঙ্গে হ্যাঁচড়প্যাঁচড় করতে করতেই বুলডোজারের দিকে এগোনোর চেষ্টা করছে। দশ-বারোটা ছেলেমেয়ে বুলডোজার দুটোর সামনে গিয়ে দু-হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে আর স্লোগান দিচ্ছে। কয়েকজন এখনও দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোকে বেড় দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। প্রতিক্রিয়াবশত হরির চোখ চলে যায় ডোজারের দুই ড্রাইভারের দিকে। কী করবে বুঝতে না পেরে ভ্যাবলার মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে বেচারারা। এতক্ষণের বিনোদনটা শুকিয়ে ছিবড়ে হয়ে গেল। রাগটা পায়ের নখ থেকে উপরে উঠতে উঠতে মাথা অবধি পৌঁছে যাচ্ছে এবার। হরি বিড়বিড় করে বললেন, “নাও ইজ দ্য টাইম নাগেশ। ডু ইট।”
মিনিট দশেক কেটে গেল। ধস্তাধস্তি এই কয়েক মিনিটে লাফিয়ে লাফিয়ে মাত্রা বাড়িয়েছে। স্টুডেন্টদের মুখ থেকে অবিশ্রাম ছিটকে আসছে শাসক দল তথা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ধিক্কার। নিজের নামও বেশ কয়েকবার শুনলেন হরি। কাজ একেবারে থেমে গিয়েছে এখন। কিন্তু যেটা তিনি চাইছেন, সেটা এখনও হতে দেখছেন না কেন? আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না হরি। ফোন করলেন নাগেশকে। নাগেশ একটা টিলার উপরে দাঁড়িয়ে লোকাল পুলিশকে নির্দেশ দিচ্ছিল, আর তার মাঝে মাঝে একটা মাইকে করে হাস্যকর রকমের সাবধানবাণী শোনাচ্ছিল স্টুডেন্টদের। ফোন পেতেই মাইক নামিয়ে ওঁর দিকে তাকাল। হরি নিঃশব্দে একবার মাথাটা উপর থেকে নীচে নামালেন। নাগেশ একটা ‘যথা আজ্ঞা’ গোছের মাথা নোয়ানো ভাব করে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, “লাঠি চার্জ!”
বুকের মধ্যে একটা উত্তপ্ত ভাব অনুভব করছেন হরি। অনেক বছরের জমানো রাগটা আজ পাথর সরিয়ে গলগল করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সামনে যে দৃশ্যটা ঘটতে চলেছে, সেটা দেখার জন্য ছটফট করছেন তিনি। নিয়মমতো পুলিশের লাঠি ভার্টিক্যালি নয়, হরাইজন্টালভাবে চালানোর কথা। কোমরের উপরের অংশে মারার নিয়ম নেই। এসব নিয়ম শুনে হাসি পায়! ধস্তাধস্তি ঠেলাঠেলির মধ্যে একটা গরিব মাসমাইনের কনস্টেবল নাকি ভাববে কোথায় লাঠি চালাবে! চোখ দিয়েই ক্যামেরার মতো জুম ইন করে করে দেখছেন হরি। একটা লাঠির বাড়ি এসে পড়ল একটা মেয়ের শিরদাঁড়ার আড়াআড়ি। মেয়েটি কাটা কলাগাছের মতো ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল। তিনটে পুরুষ পুলিশ এসে তাকে চ্যাংদোলা করে ধরেছে। দুজন দুটো পা, আরেকজন একটা হাত। মাটির উপর দিয়ে ঘষটাতে ঘষটাতে তাকে এনে ফেলে দিল উলটে পড়ে থাকা ব্যারিকেডের উপর। হরি চোখ ঘোরালেন ঘটনার কেন্দ্রস্থলে—একটা ছেলের পেটে সজোরে লাথি মারল একটা ভারী বুট, বাঁচাতে আসছে একটি মেয়ে। মেয়েটি তর্জনী তুলে চিৎকার করছে পুলিশটির সামনে—হঠাৎ কী যেন একটা হয়ে গেল—পুলিশটা ডান্ডাটা তুলে এক মুহূর্তের জন্য আকাশেই থেমে গেল। বোধহয় ভাবছিল মহিলার গায়ে পুরুষ পুলিশের হাত তোলার নিয়ম নেই। পরমুহূর্তেই সব দ্বন্দ্ব কাটিয়ে কাঁধে মারল সজোরে একটা ধাক্কা। মেয়েটি লুটিয়ে পড়ল সদ্য জঙ্গল কেটে ফেলা ন্যাড়া লাল মাটিটার উপরে।
শরীরের অনেকটা জায়গায় বড্ডো আরাম পাচ্ছে হরির। শক্ত হয়ে উন্মত্ত হয়ে উঠছে এক একটা পেশি। যে রাজনৈতিক দলের স্টুডেন্টস উইংয়ের প্রচ্ছন্ন মদতে এরা আজকে বিপ্লব করতে এসেছে, সেই দলটাই ক্ষমতায় ছিল হরির ছাত্রাবস্থায়—বিধানসভায়, লোকসভায় দু-জায়গাতেই। তখন ওদের পুলিশ, আর পুলিশ সাজা লেঠেলদের হাতে এত মার, এত মার খেতে হয়েছে তাঁকে, যে শরীরের কিছু কালশিটে এখনও চান করতে গেলে দেখতে পান হরি। যখন সেগুলোতে হাত বোলান একাকী সময়ে, তখন সেই জান্তব রাগটা গুমরে ওঠে ভিতরে। হরি জানেন, ক্যাবিনেটে তাঁর অন্য ঘনিষ্ঠেরা এইসব পরিস্থিতি এড়িয়ে চলেন—এতক্ষণে তাঁরা লালবাতি গাড়িতে উঠে পড়তেন। কিন্তু হরি ভাগবাতুলে অন্য জিনিস—তিনি এই দৃশ্য চোখ-ছাড়া হতে দেবেন না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবেন সবটুকু।
মার! মার শয়তানদের! আরও মার! এমন মার যেন আর উঠে দাঁড়াতে না পারে কোনোদিন!
একটা মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। তার সঙ্গীসাথীরা তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। ধস্তাধস্তিতে একটা পুলিশ মেয়েটার চুড়িদারের কলার ধরে হ্যাঁচকা টান দিল, ছিঁড়ে গেল কাঁধের উপরের জামার খানিকটা অংশ। সঙ্গীদের হাত থেকে ওকে ছাড়িয়ে নিল পুলিশ। হরির সামনে দিয়েই ঘষটে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। হরির সঙ্গে দূরত্ব যখন ফুট দশেক মেয়েটা হরির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল তেলেগুতে—“পুলিশদেরকে মলেস্ট করতে কী আপনারা ক্যাবিনেটেই শেখান, স্যার?”
থমকে গেলেন হরি। সাহস আছে বলতে হবে মেয়েটার। পুলিশের মার খেতে খেতেও তাঁর চোখে চোখ রেখে কথা বলছে। মেয়েটার সঙ্গী একটা ছেলে দৌড়ে বাঁচাতে আসছে, দুজন উর্দিধারী তার কলার ধরে মাটিতে পেড়ে ফ্যালে। হাতের ইশারায় পুলিশগুলোকে থামতে বলেন হরি। তারপর উঁচু জায়গাটা থেকে নেমে আসেন নীচে। ছেলেমেয়েদুটোকে সামনে নিয়ে আসতে বলেন।
মেয়েটাকে ভালো করে উপর থেকে নীচে পর্যন্ত দেখেন। উশকোখুশকো ধুলোমাখা রুক্ষ চুল। ফুটিফাটা ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত জমাট বেঁধেছে। গলার শিরা ফুলে উঠেছে। পরনে সস্তার চুড়িদার। পায়ের চপ্পলটা রাবারের। মেয়েটার কোমর থেকে ধীরে ধীরে চোখটা উপরে তোলেন হরি। চুড়িদারের ছেঁড়া অংশটার নীচে ছাইচাপা আগুনের মতো ঝলসে উঠছে কালো চামড়াটা। ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে আসা দু-ফোঁটা রক্ত পড়েছে কণ্ঠার হাড়ের ঠিক নীচে। লতপত করতে থাকা ছেঁড়া কাপড়টার পাশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে ম্লান হলদে রঙের সস্তা ব্রা-টা। ব্রায়ের ফাঁক দিয়ে হাপরের মতো ফুঁসে উঠছে কষ্টিপাথরের মতো স্তন। মুহূর্তের মধ্যে দৃষ্টি সরিয়ে নেন হরি। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ, চারপাশে ক্যামেরা—কখন যে কে ছবি তুলে ছেড়ে দেবে তার ঠিক নেই।
“নাম কী?”
“স্বপ্না!” হাঁফাতে হাঁফাতে বলে মেয়েটি, “স্বপ্না কাম্বলি।”
মুহূর্তের মধ্যে চোখ দুটো কুঁচকে যায় হরির। মুখে ফুটে পথে একটা তীব্র বিরক্তির রেখা। এক ঝটকায় মুখটা ঘুরিয়ে নেন তিনি। কয়েক সেকেন্ড ঘেন্নাটাকে সামলে মুখ ফেরান।
“কেন এসব করছ স্বপ্না? এত বড়ো ইউনিভার্সিটিতে পড়ছ, সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ—নিজের পায়ে কুড়ুল মেরো না। যারা তোমাদের উস্কাচ্ছে, তারা কেউ কিন্তু…”
“তেলেগুতে বলুন না, স্যার। আপনি তো তেলেগু জানেন।” কথা শেষ করতে দেয়না মেয়েটি। “শুধু শুধু হিন্দি কেন?”
কড়া চোখে তাকিয়ে আছেন হরি। কয়েক সেকেন্ড পরে তেলেগুতেই বলেন, “আমাদের বিরোধীরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে তোমাদের ব্যবহার করছে, সেটা বুঝতে পারছ না তোমরা?”
“কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে আজকে আমরা নামিনি, স্যার। ইউনিভার্সিটিতে থাকা দলগুলোর একটাও আজকের জমায়েতের ডাক দেয়নি। ডাক দিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন। তবে হ্যাঁ, ভার্সিটিতে থাকা সব ক-টা রাজনৈতিক দল আজকের এজেন্ডাটাকে সমর্থন করেছে।”
“শুধু শাসক দলের ছাত্র সংগঠন ছাড়া।” ফুট কাটার ভঙ্গিতে বলে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি। “আসলে এক দশক ধরে ওরা তো ইউনিভার্সিটির ইলেকশনে কল্কে পায় না, তাই ওদের হ্যাঁ, না-তে তেমন জোর নেই।”
বেশ একটু জোরেই হেসে উঠলেন হরি, “তা তোমাদের ছাত্র রাজনীতি যখন এতই শক্তিশালী, তখন এই ক্যাম্পাসটার বাইরে বেরোলেই কেন ফুস হয়ে যাও তোমরা? আপামর জনগণ কেন বোঝে না বলো তো তোমাদের? শোনো, এইসব ‘ছাত্র রাজনীতি দলীয় রাজনীতির বৃত্তের বাইরে’ এসব জ্ঞান আমাদের সিনিয়ারাও দিত। ঝান্ডা তুলে সরকারকে গালি দেওয়া অনেক সহজ, আসল রাজনীতিটা বোঝো।”
“বুঝলাম, স্যার।” মেয়েটির গলায় শ্লেষ ফুটে উঠছে—“শুধু একটাই জিনিস বুঝতে পারছি না। গত বছর ইলেকশন ক্যাম্পেনের সময় আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া আপনাদের এজেন্ডার লিস্টে দুই নম্বরে ছিল পরিবেশ রক্ষায় হতে চলা কাজকর্মর ফিরিস্তি। বছর ঘুরতেই কয়েকশো বছরের পুরোনো একটা বিশাল বনভূমি কাটতে উঠে পড়ে লাগলেন?”
মৃদু হাসলেন হরি, “ওই যে বললাম, আসল রাজনীতিটা বুঝলে এটা জিজ্ঞেস করতে না।”
“আর কী কী বুঝব স্যার?” নির্বিকার দৃষ্টিতে বলে ওঠে ছেলেটা, “এটাও কী বুঝতে হবে যে পাবলিককে ‘বিকাশ’ বলে ঘোল খাইয়ে, এই বনভূমি কেটে যে ফ্যাক্টরিটা বসাতে চাইছেন, সেটা আসলে আপনার পার্টি সুপ্রিমোর তরফ থেকে তাঁরই প্রিয় বন্ধু শিল্পপতিকে উপহার?”
চোয়ালটা অস্বাভাবিকরকম শক্ত হতে শুরু করেছে হরি ভাগবাতুলের। ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে ছেলে মেয়েদুটোর মাথা টপকে পিছনে তাকান, চোখের ইশারায় ডাকেন নাগেশকে।
“নাগেশ, এদের দুজনকে ভ্যানে তোলো। এদের সঙ্গীসাথীরা কেউ আটকাতে এলে তাদেরকেও ভ্যানে তুলবে। আর কী কী চার্জেস দেবে জানো তো?”
“জানি স্যার। ওই তো সরকারি কর্মচারীকে কাজ করতে বাধা, পুলিশের উপর শারীরিক আগ্রাসন, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা আর… ও হ্যাঁ ভায়োলেন্ট প্রোটেস্ট।”
“ব্যাস, ব্যাস যথেষ্ট।” হাত তোলেন হরি। “তুমি দেখছি এবার ইউ.এ.পি.এ-ও লাগিয়ে ছাড়বে। রাজনীতি করতে এসেছ তো তোমরা? একটু আইনটাও তো জানতে হবে। এই চার্জগুলোর মধ্যে মিল কোথায় জানো?”
জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটা তাঁর দিকে, “সব ক-টা নন-বেলেবেল চার্জ!”
“সাব্বাস! যাও, এবার চুপচাপ ভালো মেয়ের মতো গাড়িতে ওঠো।”
ছেলেটাকে নিয়ে যায় পুলিশ। মেয়েটাকে নিয়ে এগোতে যাবে, হরি এগিয়ে আসেন মেয়েটার দিকে। একটা শান্ত, ক্রূর গলায় ধীরে ধীরে বলেন, “স্বপ্না, তোমার জঙ্গলে থাকার অভ্যাস আছে মানে সবার জঙ্গলে থাকতে ভালো লাগে তা তো নয়। এই শহরের লোক ডেভেলপমেন্ট চায়, জংলি হতে নয়। তোমার জঙ্গল এত ভালো লাগলে, জেল থেকে বেরিয়ে আদি বাড়িতে ফিরে যেও।”
আধ ঘণ্টার মধ্যে পিটিয়ে ভিড়কে ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। জনা কুড়ি ছেলেমেয়েকে ভ্যানে তোলা হয়। বাকিরা রক্তাক্ত দেহে, ছেঁড়া জামাকাপড় নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে মাঠের উপর। পাঁচশো বছর বয়সি এক বুড়ো বনভূমির শবব্যবচ্ছেদ শুরু হয়ে যায় আবার। চাটুকার ও বডিগার্ড পরিবৃত হয়ে বাড়ির পথ ধরেন হরি।
গাড়ির দিকে এগোতে যাবেন, হঠাৎ কোনো এক অদ্ভুত যোগাযোগে চোখ পড়ে একটা বুড়ির দিকে। অশীতিপর বুড়ি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে আসছে তাঁরই দিকে, বুড়ির ঠিক পিছনে দেখা যাচ্ছে একটা অ্যাসবেসটস, কিছু কাঠ আর টিনের ভগ্নস্তূপ। সদ্য ভাঙা হয়েছে ছোট্ট টিনের ছাউনি দেওয়া তির্পল টাঙানো কুঁড়েঘরটাকে। এই বনভূমির মধ্যে খান কুড়ি ঘর মানুষের বাস আছে সেটা পি.এ. ভেনুগোপাল জানিয়েছিল বটে। সব মিলিয়ে একশোর কাছাকাছি সংখ্যক আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ এই জঙ্গলের মধ্যে থাকে। যতদিন জঙ্গলের বয়েস, ততদিন ধরে তারা নাকি এই জঙ্গলের বাসিন্দা। বুড়ি এগিয়ে আসছে খুব ধীর গতিতে, হরি হঠাৎ খেয়াল করলেন কোনো অদ্ভুত কারণে তিনি চোখ সরাতে পারছেন না বুড়ির দিক থেকে। যেন তিনি একরকম অপেক্ষাই করছেন বুড়িটার তার কাছে এগিয়ে আসার। তিনি শুনতে পারছেন ভেনু তাঁকে বলছে, “স্যার, চলুন… গাড়ি অপেক্ষা করছে।” সাই এসে দাঁড়িয়েছে বিদায় জানাতে, সেও স্যারের এই আচমকা স্থানু হয়ে যাওয়ার কারণ কিছুই বুঝতে পারছে না।
অনন্ত অপেক্ষার শেষে বুড়িটি হরির ফুট দশেক দূরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখ দুটো যেন ভাঁটার মতো জ্বলছে। তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হরি এগিয়ে যায় তাঁর দিকে—“মা জি, আপনি চিন্তা করবেন না। ক-টা দিন একটু কষ্ট করে কাটিয়ে নিন। ফ্যাক্টরি তৈরি হয়ে গেলেই আপনাদের চাকরি আর পুনর্বাসন দুটোই দেওয়া হবে।”
হরির কথায় বুড়ির চোখেমুখে কোনো ভাবান্তর দেখা যায় না। কয়েক মুহূর্তের অস্বস্তিকর নীরবতার পর বুড়ি হঠাৎ কথা বলে ওঠে। কণ্ঠস্বরটা অদ্ভুত রকমের ঠান্ডা—যেন কালের কোনো অজানা গবহর থেকে উঠে আসছে, যেন বরফের চাঙড়ের মধ্যে থেকে কেউ কথা বলছে। গা-টা শিরশির করে ওঠে হরির। বিশুদ্ধ তেলেগুতে বুড়িটা বলছে, “যাদের মাটির থেকে আলাদা করেছিস, তারাই তোকে মাটির সঙ্গে জুড়ে দেবে!”
পরপর দুবার এই অদ্ভুত কথাটা বলে বুড়িটা। সকলে নির্বাক, হতবাক। কী বলা উচিত, কী করা উচিত কেউই বুঝতে পারছে না যেন। হঠাৎ বুড়িটা উলটোদিকে ঘুরে যায়। তারপর আগের থেকে অনেক বেশি দ্রুত পদে উলটোমুখে হাটতে শুরু করে। একটা হাত উপরে তুলে চিৎকার করে বলতে থাকে “যাদের মাটির থেকে আলাদা করেছিস, তারাই তোকে মাটির সঙ্গে জুড়ে দেবে!” ওই শীর্ণ, অনুচ্চ স্বরটা যেন দিগন্তকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। শতসহস্র উদ্ভিদের লাশ শুইয়ে রাখা খাঁখাঁ প্রান্তরের মাঝে ওই চিৎকারটা যেন চামড়ার মধ্যে বিঁধে যায় হরির। ভর দুপুরবেলা, খান ত্রিশেক আজ্ঞাবহ দ্বারা ঘিরে থাকা অবস্থাতেও কেন যেন একটা তীব্র অস্বস্তির অনুভূতি হয় হরির। এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য হলেও, ভয় পান আরবান ডেভেলপমেন্ট মিনিস্টার, রাজ্যের দাপুটে নেতা হরি ভাগবাতুলে।
গাড়িতে ওঠার মিনিট দশেকের মধ্যে কিন্তু দূর হয়ে যায় এই অমূলক, উদ্ভট ভয়টা। আরও মিনিট দশেক পর একটা পছন্দের চিন্তায় মনটাকে নিয়ে যেতে সক্ষম হন হরি। চোখ বন্ধ করলেই চোখের সামনে বারবার রূপ নিচ্ছে লটপত করতে থাকা ছেঁড়া চুড়িদারের পাশ থেকে উঁকি মারা নরম কালচে রঙের স্তন। চিন্তাটা মনের মধ্যে বারকয়েক ঘুরপাক খেলো বটে। কিন্তু শেষমেশ সেটাকে রিজেক্ট করারই সিদ্ধান্ত নিলেন হরি। এই কারখানাটা হওয়া নিয়ে ঝামেলা কম হচ্ছে না চারিদিকে। বিরোধীরা ছেঁকে ধরেছে একদম। মিডিয়াকে প্রায় পুরোটাই কিনে ফেলা গেলেও রেহাই নেই, এখন তো সবাই জার্নালিস্ট। একটা ক্যামেরা ফোন জোগাড় করে ভিডিয়ো বানিয়ে ফেসবুকে ছেড়ে দিলেই হল—মিডিয়ার থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার জার্নালিজমকে লোকে আজকাল বেশি ভরসা করে। এরকম উত্তপ্ত অবস্থায় একটা মেয়ে হুট করে পুলিশ কাস্টডিতে রেপ হয়ে গেলে ঝামেলা সামলানো মুশকিল হবে। আর যে সে মেয়ে তো নয়—একে স্টুডেন্ট, তাই আবার দলিত। পরের ইলেকশনে সিটটা না চলে যায়!
“হায় ছায়াবৃতা, কালো ঘোমটার নীচে…”
রক্তরাঙা টুনির আলোয় ভেসে যাওয়া নিজের বেডরুমের নরম মখমলের মতো বিছানাটায় কালিন্দীর নরম উর্ধাঙ্গকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছেন হরি। ওর মতো আরও অনেকে থাকলেও কালিন্দীকে হরির ভালো লাগে কারণ কালিন্দী পেশাগতভাবে বেশ্যা নয়, ভদ্রবাড়ির মেয়ে। কালিন্দীর শরীরটাকে কারোর সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয় না, যখন ইচ্ছে হয় ভোগ করা যায় যদিও। স্রেফ নিজের অধিকারের, নিজের উপভোগের জন্য রাখা আছে একটা তরতাজা শরীর যাকে দিয়ে যা ইচ্ছে করিয়ে নেওয়া যায়—এই ব্যাপারটার মধ্যেই কী একটা বুনো পৌরুষের আরাম আছে বলে মনে হয় হরির। কালিন্দীর চেয়ে বহুগুন বেশি উত্তেজক, সেক্সি শরীরের কলগার্লদের মধ্যে সে জিনিস বহুবার খুঁজেও হতাশ হতে হয়েছে হরিকে। হরি বোঝেন শুধু ভালো মাংসটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কার মাংস সেটাও জরুরি।
কালিন্দী কলেজে পড়ত যখন ওর দাদা মহাজনের উপদ্রবে বিশাল ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে হরির ছেলেদের কাছে সাহায্য ভিক্ষা চেয়েছিল। এমনিতে এসব পোকামাকড়ের লাইফে না জড়াতে নির্দেশ দেওয়া আছে ছেলেদের, কিন্তু মহাজনটা বিরোধীদের ইলেকশন ফান্ড করে। তাই এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে মালটার ঘাড়ে ক’টা এক্সটরশনের কেস চাপানোর সুযোগ ছাড়তে চাননি হরি। ব্যাপারটা সেখানেই মিটে যেত, কালিন্দী সিনেই আসত না যদি না ও পাড়ার কাউন্সিলারের ছেলের বিয়েতে গিয়ে কালিন্দীকে এক ঝলক দেখতে পেতেন হরি। বাড়িতে ক্যান্সারে মর মর বাবা, বেকার দাদা আর আটকে যেতে বসা পড়াশুনো—ওকে বিছানায় তুলতে বেশি বেগ পেতে হয়নি হরিকে। আর হরিও সবদিক থেকে ভরিয়ে দিয়েছেন কালিন্দীকে। মাস গেলে যে থোক টাকা ব্যাংকে ঢোকে, সেকেন্দ্রাবাদের টপ কলগার্লদের অত আয় হয় না। মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডি করছে কালিন্দী এখন, সঙ্গে অধ্যাপনা। বাবার চিকিৎসা হচ্ছে ফাইভ স্টার হসপিটালে, দাদা শাসকদলের মাসমাইনে পাওয়া কর্মী। হরির শর্ত শুধু একটাই—কালিন্দীর শরীরে অন্য কোনো পুরুষের স্পর্শটুকুও লাগানো যাবে না। আর যখন, যে কোনো মুহূর্তে ওকে ডাকলে সব কিছু ফেলে চলে আসতে হবে; শরীরের কাজে কোনোদিন কখনও না বলা যাবে না। বছর চল্লিশের হরির সবটুকু নিষিদ্ধ ফ্যান্টাসি পূরণের জমি হয়ে থাকতে হবে। ব্যাস এইটুকু!
প্রথম প্রথম হরির রগরগে অত্যাচারে কুঁকড়ে যেত কালিন্দী, কাঁদত শব্দ করে, সেটা মন্দ লাগত না হরির। কিন্তু তারপর কয়েক মাস পর থেকেই কেমন যেন পাথরের মতো হয়ে গেল—একটা মাংসের তালের মতো পড়ে থাকত বিছানার উপর, হরি যা যা করতে চাইত যন্ত্রের মতো করতে দিত। সবকিছু চিমসে হয়ে নেতিয়ে যাচ্ছিল হরির মধ্যে। একদিন চরম সঙ্গমের মুহূর্তে ওর পাথুরে নিস্পৃহতা দেখে সপাটে একটা থাপ্পড় মেরেছিলেন হরি। তাতেও কী ভাবলেশহীন মেয়েটা। শুধু একবার ছিটকে উঠেছিল চড়টা খেয়ে, তারপর স্রেফ চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে এল একটা রেখা। কালো কালো ডাগর ডাগর দুটো চোখ নিয়ে তাকিয়ে ছিল জানলার বাইরে দিয়ে ফ্লাইওভারটার দিকে। ব্যর্থতার চরম আক্রোশে ফেটে পড়ছিলেন তিনি। কালিন্দীর চুলের মুঠি ধরে ওকে চেপে ধরেছিলেন দেয়ালে—“দ্যাখ কালিন্দী, তুই মরা মাছের মতো পড়ে থাকলেও তোর সঙ্গে যা যা হওয়ার, সব হবে। সব। তার চেয়ে নিজেও এনজয় কর, নাহলে কষ্ট হবে বেশি।”
পরের দিন সাতেক যে কে সেই! তারপর একদিন হঠাৎ কালিন্দীর ভাবগতিক পালটে গেল আমূল। বাড়িতে ঢুকল গলা থেকে পা অবধি ঢাকা একটা গাউন মতো জিনিস পরে, বেডরুমে আসতেই সেটা টান মেরে খুলে ফেলল—নীচে যে পোশাকটা ছিল সেটা দেখে হরি লজ্জায় শুকিয়ে গেলেন। কিছু পোশাকের থেকে যে নগ্নতাও কম অশ্লীল সেটা সেদিন বুঝেছিলেন হরি। সেদিন থেকে কালিন্দীর চোখের তাকানো বদলে গিয়েছিল—হরির মনে হত চোখ দিয়ে খোদ তাকেই যেন উলঙ্গ করে দিচ্ছে কালিন্দী। ওর চোরা চাউনিতে মনে হত ভরতি রাস্তার মাঝে কেউ তার জামা প্যান্ট খুলে নিয়েছে। কালিন্দীর নির্লজ্জতা দিনের পর দিন বাড়তে লাগল—ঘরভরতি লোকের মাঝে পর্যন্ত সরাসরি হরির কোমরের নীচের দিকে লোলুপ চোখে তাকিয়ে থাকত। হরির মনে হত আস্ত হরি ভাগবাতুলে মানুষটাকেই কালিন্দী যৌনাঙ্গে পরিণত করে ফেলেছে। সেই দিনগুলোতে কালিন্দীর জন্তুর মতো উদ্দাম চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে হরি বুঝেছিলেন, অসহায়তার শেষ সীমায় চলে গেলে মানুষ অসহায়তাকেই উপভোগ করতে শুরু করে।
কিন্তু আজ জিনিসটা একটু আলাদা হরির জন্য। কালিন্দী যথাবিধি নির্লজ্জতম, নিম্ফোর মতো জান্তব সঙ্গম করে চলেছে। হরির শরীর কথা বলছে বহু চেনা একটা শরীরের সঙ্গে, কিন্তু হরির মন পড়ে আছে অন্য কারোর কাছে—একটা সম্পূর্ণ অচেনা শরীরের কাছে। হরির মন এখন নিবিষ্ঠভাবে একটা একটা করে পোশাক ছিঁড়ে খুলে নিচ্ছে স্বপ্নার গা থেকে। অর্ধেক ছেঁড়া গিফট র্যাপের মতো ছেঁড়া চুড়িদারটাকে টেনে ফালাফালা করে ফেলছেন, বের করে আনছেন তরতাজা নতুন খাবারকে। তার নতুন গন্ধ, নতুন স্পর্শ নতুন বাধা দেওয়াকে তারিয়ে তারিয়ে কল্পনা করছেন হরি। চোখদুটোকে পারতপক্ষে বন্ধ করেই রেখেছেন তিনি। দেখতে চাইছেন না ঠোঁট ফাঁক করা কালিন্দীর কামার্ত মুখটাকে। মনেপ্রাণে কল্পনা করতে চাইছেন সঙ্গমরত স্বপ্নাকে কেমন দেখতে হতে পারে!
চরম মুহূর্তের ঠিক আগে, কালিন্দীকে বুকে জাপ্টে ধরে রেখে ওর মুখটা নিজের মুখের সামনে নিয়ে এলেন হরি। হঠাৎ না চাইতেই খুলে গেল চোখের পাতা। আর সঙ্গে সঙ্গে কেউ যেন তাঁকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল কিং সাইজ খাটের একটা কোনায়। একটা জান্তব, নরক থেকে উঠে আসা আর্তনাদ বেরিয়ে গেল তাঁর গলা ছিটকে, মুহূর্তের মধ্যে কালিন্দীকে খাটে ছুড়ে ফেলে পেছনদিকে লাফিয়ে পড়লেন। এত তীব্র সে ঝাঁপ, যে ভরবেগ সামলাতে না পেরে খাটের উপর থেকে উলটে পড়লেন নীচে, মাথাটা ঠুকে গেল খাটের কোনায়। পুরো শরীরটার মধ্যে দিয়ে যেন কেউ বিদ্যুৎ প্রবাহ চালিয়ে দিয়েছে, সারাটা শরীর থরথর করে কাঁপছে। কয়েক সেকেন্ড আগের চরম সুখানুভুতি সম্পূর্ণ অদৃশ্য, তার দখল নিয়েছে একটা মারণ, সিঁটিয়ে যাওয়ার মতো ভয়। ঘষটে ঘষটে পিছোতে শুরু করেছেন হরি।
এটা কী দেখলেন তিনি? এটা কী দেখে ফেললেন? কেন দেখলেন? এটা কী করে সম্ভব?
খাটের উপর কালিন্দীর দিকে আঙুল তুলে প্রবলভাবে খাবি খেতে খেতে কিছু বলার চেষ্টা করলেন হরি, পারলেন না। থুথু গড়িয়ে আসছে কষ বেয়ে, জিবটা ল্যাতপ্যাতে করছে। আকস্মিক বিস্ময় কাটিয়ে খাটের উপর ধীরে ধীরে উঠে বসল কালিন্দী।
নঃ! নঃ! কালিন্দী না! কোথায় কালিন্দী? খাটের উপর যে বসে আছে সে তো কালিন্দী নয়! ওই তো লম্বা, কিঞ্চিৎ স্থূলকায় পা দুটো, লম্বাটে পায়ের পাতা তো একদম কালিন্দীর মতো! তাহলে? ধীরে ধীরে চোখ ওর শরীর বেয়ে আরও উপরে তোলার চেষ্টা করছেন হরি। কোমর… কোমরটা? হ্যাঁ, হ্যাঁ এই কোমর কতবার জড়িয়ে ধররেছেন, বিলক্ষণ চেনেন—কালিন্দী! উদর বেয়ে উপরে উঠে আসছেন হরি—এই স্তনযুগল আর কারোর হতেই পারে না—এ তো কালিন্দী! কিন্তু… কিন্তু…
স্তনের উপরে আর চোখ তুলতে সাহস হচ্ছে না হরির। তবু কেউ যেন চুলের মুঠি ধরে মাথাটা উপর দিকে তুলে দিচ্ছে। আর হরি দেখতে পাচ্ছেন একটা অশীতিপর, বলিরেখায় ভরা, কুঁচকানো, বিশ্রী মুখের বুড়িকে। তার ধূসর খয়েস্তা চুলগুলো মাথার দু-পাশে উড়ছে। আর বুড়িটা একটা শয়তানি মাখা স্বরে বলে উঠছে, “যাদের মাটির থেকে আলাদা করেছিস, তারাই তোকে মাটির সঙ্গে জুড়ে দেবে।”
মার্বেলের ঝকঝকে মেঝেটার উপর এক ধাক্কায় অনেকটা বমি করে বসলেন হরি।
লাশকাটা ঘরের বৃত্তান্ত
সারাদিন তর্জন গর্জনের পর জড়বৎ লোহার একটা কিম্ভুত কৌটোর মতো নেতিয়ে পড়ে আছে ডোজারগুলো। ইউনিভার্সিটির পশ্চিম প্রান্তের যে ক-টা নিম, বট, অশ্বত্থ, টিক মৃত্যুদণ্ডের আসামীর মতো ঘণ্টা গুনছিল, তাদেরই মধ্যে দুজনের শক্তপোক্ত মোটা ডালের সঙ্গে বাঁধা হয়েছে একটা করে হ্যাজাক আলো। সেই ইন্টারোগেশন রুমের হলুদ আলোর বৃত্তের মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাই ভাবছিল গাছেরা কী ঘণ্টা গুনতে পারে? সময় অনুভব করতে পারে? নাকি সময় তাদের কাছে নেহাতই একটা পরিবর্তনশীল চিরকালীন অস্তিত্ব? নাকি গাছেদের সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা মানুষের থেকে অনেক বেশি দীর্ঘ? অনেক বেশি সময়কে মাপতে পারে কী গাছেরা? মানুষ বাঁচে আশি বছর, নব্বই বছর, তাই সে ষাট সেকেন্ডে মিনিট গুনে ফেলে চটজলদি। কিন্তু এই গাছগুলো তো কয়েকশো বছর ধরে বেঁচে আছে, সাইদের আগে থেকে আছে, ওদের পরেও থেকে যাওয়ার কথা ছিল—ওদের কী তাহলে তিনশো সেকেন্ডে মিনিট হয়? ওদের হিসেবে ওদের আয়ু আর কতক্ষণ?
হ্যাজাকের হলুদ আলোর ছায়া পড়েছে চারটে হলুদ তির্পলের তাঁবুর উপরে। লেবারদের তাঁবু। তাঁবুর পাশ দিয়ে ঘন হয়ে গিয়েছে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে খুঁজলে এক একটা ছোটো ছোটো পাথর পাওয়া যাবে যাদের শরীরের কালচে হয়ে যাওয়া রক্তের দাগ ধরে গিয়েছে—তাজা, যুবা রক্ত! আরও একটু এগোলে পাওয়া যাবে কিছু ছেঁড়া স্যান্ডেল, শুকতলা উঠে আসা একটা জোড়াহীন স্নিকার, চেক চেক ছেঁড়া শার্টের হাতা আর একটা ঘড়ির ছেঁড়া রিস্টব্যান্ড—হয়তো বা পাওয়া যেতেও পারে একটা লাল মাটিমাখা সাদা বা গোলাপি ওড়না। এইসব পেরিয়ে আরও একটু এগিয়ে গেলে হ্যাজাকের আলো যেখানে আসতে ভয় পায়, সেরকম একটা কোনায় দেখতে পাওয়া যাবে তুবড়ে পড়ে থাকা কয়েকটা ঢেউ খেলানো, মরচে ধরা করোগেটেড শিট। তার নীচে পড়ে আছে ক’টা ভাঙা কাঠের টুকরো, নীচটা কালচে হয়ে যাওয়া ফ্যাটফ্যাটে সাদা হাঁড়ি-কুড়ি আর একটা পায়া নড়বড়ে খাট। কালকের মধ্যে এইসব সবকিছু তুলে নিয়ে যেতে হবে, না হলে যত্ন করে তুলে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে।
এই স্তূপীকৃত আবর্জনার ঠিক পাশে একটা শক্ত গুঁড়ির গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে ছিল জুয়ান। চোখের দৃষ্টিতে অপার শূন্যতা। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে শরীর কেটে যাওয়া গাছগুলোর নগ্ন গুঁড়িগুলোর দিকে। কিন্তু ও কী দেখছে সেগুলো? মানুষ যেদিকে তাকিয়ে থাকে, তাকেই কী দেখে সে? মুন্নি যে বাড়িতে কাজ করে, তার কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছে—ওদের বস্তিতে যদি একটা এক কামরা ভাড়া মেলে অন্তত এক মাসের জন্য। গাছটার গুঁড়িতে দু-হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় জুয়ান। অন্ধকারেই তাকায় গাছটার দিকে, বোঝার চেষ্টা করে মরণোন্মুখ মানুষের স্নায়ুর ইথার তরঙ্গ। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় তাঁবুগুলোর দিকে। পথ আটকায় কমলা বুলডোজারটা। কয়েক সেকেন্ড যন্ত্রটার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে জুয়ান। তারপর ছ্যাৎ করে অনেকটা থুতু ছুড়ে দেয় দানবের মুঠোটার দিকে।
হঠাৎ করে তার খেয়াল হয় মা কোথায়? মাকে তো অনেকক্ষণ দেখছে না। আশপাশে ইতিউতি তাকাচ্ছে জুয়ান। কই মা তো নেই!
ঠিক সেইসময় জুয়ানদের প্রাক্তন ঝুপড়িটার পিছনে প্রায় তিনশো মিটার দূরে, জঙ্গল যেখানে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে ন্যাড়া, সেখানে একটা ধুনি জ্বলছিল। পটপট করে শব্দ হচ্ছিল ছোটো ডালপালা পোড়ার। একটু পরে ধুনিটার এক পাশে একটা ত্রিশূলের মতো ছোটো কিন্তু শক্ত ডাল মাটির মধ্যে গেঁথে গেল, তারপর ধুনীর অন্যপাশে একইরকম একটা ডাল গেঁথে গেল মাটির ভিতর। তিন নম্বর ডালটা আড়াআড়ি বসল দুটো ডালের উপর। তিন নম্বর ডালের মাঝখান থেকে ঝুলছে একটা ছোট্ট তোবড়ানো হাড়ি। তরল একটা কিছু ছলাৎ ছল করে উঠছে হাড়ির মধ্যে। ধুনীর নিভুনিভু আগুনে ছিটকে এসে পড়ল কিছু শুকনো পাতা আর ডাল। নিমেষে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। হলদে বেগুনি শিখাগুলো গ্রাস করতে শুরু করল হাড়িটাকে। ভেতরের তরলতার মধ্যে যেন একটা ঘুমন্ত রাক্ষস জেগে উঠল। প্রচণ্ড শব্দে ফুটছে তরলটা, কেঁপে উঠছে হাড়িটা।
ধুনীর সামনে বসে আছেন একজন অশীতিপর মানুষ। মুখে তাঁর অজস্র বলিরেখা, তার ধূসর খইস্টা চুল উড়ছে দমবন্ধ গরম হাওয়ায়। মানুষটার গনগনে অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল চোখদুটোর উপর নেচে বেড়াচ্ছে বেগুনি শিখা।
“আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই…”
আজ আর কোনো রিস্ক নেয়নি পুলিশবাহিনী। জঙ্গল যেখানে শুরু হচ্ছে তার প্রায় এক কিলোমিটার আগেই ব্যারিকেড বসিয়ে দিয়েছে। প্রায় বারো ফুট উঁচু গার্ডরেল তুলে দিয়ে, তাদেরকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে দূর্ভেদ্য পাঁচিল তৈরি করেছে। আজকেও ছাত্রছাত্রীদের একাংশ প্রতিবাদ করতে এসেছে, তাদের অনেকেরই হাতে, মাথায়, পিঠে ব্যান্ডেজ বাঁধা—কিন্তু আজকে তাদের জঙ্গলের দিকে এগোনোর সব রাস্তাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মিডিয়াও আজকে জড়ো হয়েছে প্রচুর। কিন্তু তাদেরও এগোনোর অনুমতি ওই গার্ডরেল অবধিই।
হরি নাগেশের থেকে স্বপ্না আর তার সঙ্গীর জামিন না-মঞ্জুর হওয়ার ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। ঘড়িতে এখন বিকেল চারটে। আজ সকালেই পশ্চিমের জঙ্গল পুরো সাফ করে দক্ষিণের গুল্ম জাতীয় ঝোপকাটার দিকে এগোনো হয়েছে। যত লাল মাটি বেরিয়ে পড়ছে চোখের সামনে, তত বেশি করে ফ্যাক্টরির ছবিটা তৈরি হচ্ছে হরির মনের মধ্যে। এসব কিছু নিয়ে ভাবতে ভাবতে কাল রাতের ঘটনার কথা ভুলেই গিয়েছিলেন হরি। হঠাৎ যে কী হয়ে গেল কাল কে জানে? সঙ্গম সুখের এমন চরম মুহূর্তে এ কী দেখে ফেললেন তিনি? কালিন্দীর মুখের জায়গায় স্বপ্নার মুখ কল্পনা করার চেষ্টা করছিলেন; তাহলে হঠাৎ করে কালকের ওই বুড়িটার ওই বীভৎস, বিশ্রী মুখটা কীভাবে দেখে ফেললেন তিনি?
কাল ওই ঘটনার আকস্মিকতায় কামভাব পুরোপুরি উবে গিয়েছিল হরির। অন্যদিন কালিন্দীকে উলঙ্গ করে পাশে শুইয়ে রাখতেই পছন্দ করেন তিনি। কাল কী হল কে জানে ওর নগ্ন শরীরটা দেখলেই কেমন যেন ভয় করতে শুরু করল। ওর বুক পেটের দিকে যদি বা তাকাতে সাহস পাচ্ছিলেন, মুখের দিকে তাকানোর কথা তো ভাবতেই পারছিলেন না। ওকে তাড়াতাড়ি বিদায় করে ভেনুকে ডেকে একটা ঘুমের বড়ি খেলেন। তাতে ঘুম হল বটে, কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙল অসহ্য মাথাব্যথা নিয়ে। ব্রেকফাস্ট, স্নান, তৈরি হওয়া পুরো সময়টা জুড়ে নিজের মনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটার পর একটা যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করছিলেন তিনি। খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম তো হয়েই থাকে তাঁর, সঙ্গে ঘুমও নানা সময়ে পর্যাপ্ত হয় না—হয়তো সে সবের জন্যই এরকম অদ্ভুত একটা হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকবে। এসব কথার তলায় যে কথাটা জোর করে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি, সেটাই যে সবচেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য কথা তা হরি নিজেও বুঝতে পারছিলেন। হয়তো সেজন্যই সেটাকে চাপা দেওয়ার প্রাণপন চেষ্টা করছিলেন। ওই বিশ্রী মুখের বুড়িটার মধ্যে কিছু একটা ছিল, এমন কিছু যেটা কোনো কারণে হরিকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল সেই অদ্ভুত কথাটা যার কোনো মাথামুণ্ডুই হয় না। সব মিলিয়ে একটা অস্বস্তিকর, আনক্যানি অনুভূতি রয়ে গিয়েছিল মনের ভিতরে—সেটাই হয়তো বেমক্কা বেরিয়ে এসেছিল তখন।
কিন্তু হঠাৎ এই কথাটা হরির এখন মনে পড়ছে কেন? আজ সকাল এগারোটায় এখানে এসেছেন তিনি, সব কাজকর্ম তদারক করেছেন, সাইকে নির্দেশ দিয়েছেন। নাগেশকে জিজ্ঞেস করেছেন বুড়িটার ব্যাপারে, নাগেশ জানিয়েছে যে বুড়ি ছেলে-বৌমার সঙ্গে পত্রপাঠ বিদায় নিয়েছে। হরিও নিশ্চিন্ত মনে কাজ তদারকিতে মন দিয়েছেন। অনেকক্ষণ এখানে আছেন, অস্বস্তিকর কিছুই তো হয়নি এতক্ষণ ধরে। তাহলে এখন আবার কাল রাতের কথাটা হঠাৎ এত বেশি করে মনে পড়ছে কেন? চিন্তাটাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে ডান দিক বাঁ দিকে একবার মাথাটা ঝাঁকালেন হরি। আর সেটা করতে গিয়েই নজরটা পড়ল কাঁধের পিছনে।
ওঁর পিছনে, গা ঘেঁষে, বড়োজোর ফুট দুয়েক দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে—সেই বুড়িটা। কালকের সেই বুড়িটা। চোখদুটো কালকের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল, একটা লালচে কালো ছোপ যেন দেখলেন চোখের মণিদুটোতে। ওইরকম ছোপ মানুষের চোখে থাকতে পারে না। সাদা চুলগুলো মুখের চারপাশে যেন জাল বিস্তার করে রয়েছে। বুড়িটা হঠাৎ মুখটা ফাঁক করতেই বেরিয়ে এলো একটা ঘন কৃষ্ণবর্ণ জিব।
মুহূর্তের আতঙ্কে, চমকে ছিটকে উঠে পিছোতে গেলেন হরি, মাটির উপরে সামান্য উঠে থাকা গাছের শিকড়ের নীচে জড়িয়ে গেল একটা পা। প্রচণ্ড বাজেভাবে হোঁচট খেয়ে, ছিটকে মুখ থুবড়ে মাটির উপর পড়লেন। পড়ামাত্র পা-টা কোনোমতে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন শিকড়ের জাল থেকে, পারলেন না। তিনি শুনতে পাচ্ছেন দূর থেকে ভেনুর “স্যার “বলে চিৎকার, পেরিফেরাল ভিশন দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন তাঁর দুটো বডিগার্ড দৌড়ে আসছে এদিকে। কিন্তু এ কী! সামনে কিছু দেখতে পাচ্ছেন না কেন হরি। চোখের সামনেটা সম্পূর্ণ ব্লার হয়ে আছে কেন তাঁর? উনি কী করে বুঝবেন ওঁর ঠিক কতটা কাছে চলে এসেছে সেই কুৎসিত বুড়ি? শরীর কুঁকড়ে যাওয়া ভয়ে মরিয়া হয়ে পা-টাকে ছুড়তে লাগলেন শিকড়ের জালটার মধ্যে। দু-হাত দিয়ে টেনেহিঁচড়ে বের করতে চেষ্টা করছেন পা-টা। ভেনু আর ওঁর বডিগার্ডরা আসতে এত দেরি করছে কেন? এতটা দূরে কী তিনি আদৌ চলে এসেছিলেন? নিজের চারপাশটা বাকি সবার থেকে এত দূরে কেন মনে হচ্ছে ওঁর? মাথার মধ্যে চিন্তার স্রোত পাকিয়ে উঠছে। মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি যে বুড়িটাকে দেখে কোনো কারণে চরম ভয় পেয়েছিলেন তিনি। হ্যাঁ, এটাই, এটাই একদম ঠিক যুক্তি। কিন্তু কেন? হঠাৎ একটা গরীব, শীর্ণ হা-ভাতে বুড়িকে দেখে খোদ হরি ভগবাতুলের এরকম শিউরে ওঠা ভয় হবে কেন?
গলায় দলা পাকানো ভয় নিয়েই সামনে তাকালেন হরি। বুড়িটা ওঁর একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লন্ড্রি করা নতুন ধুতিটা লুটোচ্ছে কাদায়…. সেই ধুতির পাড়ের উপর দুটো পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুড়িটা। এক সেকেন্ডের জন্য হরির আর ভয় করল না, হাত দুটো আপনিই ছেড়ে গেল পা থেকে, একটা অপরিসীম শূন্যতা কাজ করল অনুভূতির কেন্দ্রস্থলে। বুড়িটার হাতে একটা তোবড়ানো ছোটো হাড়ি দেখতে পেলেন হরি। পরমুহূর্তেই তরল কিছু সারা মুখে, বুকে, পেটে, হাতে, পায়ে ছড়িয়ে যাওয়ার অনুভূতি হল। স্বাভাবিক প্রতিবর্তে চোখদুটো কুঁচকে বন্ধ করে ফেললেন তিনি। কয়েক মুহূর্ত পরে চোখদুটো কষ্ট করে খোলার চেষ্টা করলেন।
খুলতে পারলেন কী? বুঝতে পারছেন না হরি। কিছুতেই বুঝতে পারছেন না কী ঘটছে তাঁর সঙ্গে। এটুকু বুঝতে পারছেন চোখের সামনে ছিদ্রহীন অসীম অন্ধকার। তিনি কী চোখ দুটো খুলতে পারছেন না? নাকি খুলে ফেলেছেন, তা সত্ত্বেও ঘন অন্ধকারই দেখছে চোখ? তিনি কী… তিনি কী অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন? বুড়িটা কি এমন কিছু ছুড়ে দিল তাঁর চোখে যাতে মানুষের দৃষ্টি চলে যায়? একটা অন্তহীন যন্ত্রণার ভবিষ্যৎ চিন্তায় ভয়াবহ উৎকণ্ঠা হচ্ছে তাঁর। ঠিক সেই সময় সেই অসীম অন্ধকার ভেদ করে একটা তীক্ষ্ণ চেনা কণ্ঠস্বর কানে এল তাঁর—“যাদের মাটির থেকে আলাদা করেছিস, তারাই তোকে মাটির সঙ্গে জুড়ে দেবে।”
বারবার বারবার! উফফ! কী অসহ্য এই কণ্ঠস্বর, কী ভয়ানক এই অর্থহীন শব্দগুলো। মুখ দিয়ে একটা অসহায় প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলেন হরি। লাভ হল না, একটা গোঙানির শব্দ ছাড়া কিচ্ছু বেরিয়ে এল না। কয়েক সেকেন্ড পরে তিনি অনুভব করলেন স্পর্শ—তাঁর কাঁধ আর দুই হাতে। একাধিক মানুষ মিলে তাঁকে তুলে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। তাদেরকে অসহায়ের মতো আঁকড়ে ধরে কোনোমতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
আশপাশ থেকে অনেকগুলো “স্যার, আপনি ঠিক আছেন?”, “স্যার, জল খাবেন?” ধেয়ে আসছে। হাঁফাতে হাঁফাতে মাথাটা দুদিকে ঝাঁকালেন তিনি।চোখের সামনে ধীরে ধীরে অল্প অল্প আলো ফুটে উঠছে—যেন শতাব্দী কাটিয়ে এইমাত্র একটা লম্বা টানেলের মধ্যে থেকে বেরোলেন। অর্ধেক ঝাপসা দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তিনি দেখলেন বুড়িটাকে মাটির উপর দিয়ে ঘষটাতে ঘষটাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওঁর দুটো ষন্ডামার্কা বডিগার্ড। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে বুড়িটার চোখেমুখে এতটুকু যন্ত্রণার লেশ অবধি নেই—বরং বুড়িটা উচ্চস্বরে হেসে চলেছে শয়তানের হাসি। আর থেকে থেকে চিৎকার করে চলেছে—
“যাদের মাটির থেকে আলাদা করেছিস, তারাই তোকে মাটির সঙ্গে জুড়ে দেবে!”
“হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া”
চানঘরের প্রমাণ সাইজের দেয়াল জোড়া আয়নাটার দিকে ভ্রু দুটো কুঁচকে হতবাক চোখে তাকিয়ে আছেন হরি। এটা কী?
কালকের ঘটনার পর ওঁকে গাড়িতে তুলে সোজা বাসভবনে নিয়ে আসা হয়। হাউস ফিজিশিয়ান পট্টনায়েক ততক্ষণাৎ পরীক্ষা করেন। সব চেক করে বলেন যে ছুড়ে দেওয়া তরলতার মধ্যে অ্যাসিডিক কিছু ছিল, তবে তার তীব্রতা খুবই সামান্য। চোখ তেমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবে শরীরের কোনো কোনো জায়গায় ছোটো ছোটো ফোসকা মতো হয়েছে। সেখানে সামান্য জ্বালাও অনুভব করছেন হরি। কিছু অয়েনমেন্ট আর বেসিক কিছু ওষুধ ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছুই দেওয়ার নেই বলে জানান তিনি।
সত্যি বলতে ওই সামান্য জ্বালাটুকু বাদে আর কোনো সমস্যা এই ত্রিশ ঘণ্টায় হয়নি হরির। ভেবেছিলেন জ্বালাটা বাড়তে পারে, কিন্তু কপাল ভালো তেমন কিছু ঘটেনি। বরং ফোসকাগুলো একদিনেই মিলিয়ে গিয়ে ওইসব জায়গাগুলোতে একটি ঠান্ডা অনুভূতি হচ্ছে। আর বাথটবে চান করার সময় ওই ফোসকার জায়গাগুলোয় জল লাগলে বড়োই আরাম অনুভব করছেন হরি। কালকের বিষয়টা নিয়ে ভাবার মতো অনেক কিছুই আছে, অনেক প্রশ্নই তোলা যায়। বুড়িটা এরকম করল কেন? এতটা সাহস কী করে হল? ধরা পড়লে কী চরম নিপীড়ন সহ্য করতে হতে পারে সেটা জেনেও এটা করল কেন? কিন্তু এইসব প্রশ্নের সহজ এবং সঠিক উত্তর হরি জানেন। বাড়ি ভেঙে দেওয়ার রাগে মন্ত্রীমশাইকে আক্রমণ করেছে। কিন্তু একটা প্রশ্ন কিছুতেই শান্তি দিচ্ছে না হরিকে। আর সেটা হল আক্রমণের ধরণটা। মন্ত্রীতন্ত্রীদের লোকে সাধারণত কালি-টালি ছোড়ে, জুতো-টুতো মারে, চড়থাপ্পড় অবধি খাবার ঘটনাও তো কম ঘটে না এদেশে। জনগণের সেবা করলে এইটুকু আশীর্বাদ পেতেই হবে জেনেই তো এই খেলাটা খেলতে আসা। কিন্তু গায়ে মুখে কী একটা অদ্ভুত তরল ছিটিয়ে দেওয়া এ আবার কেমন কথা বাপু? বুড়ি করতে চাইলটা কী? মানে ঠিক কী ক্ষতিটা করতে চাইল তাঁর এইটেই ভেবে পাচ্ছেন না হরি।
এসব ভাবতে ভাবতেই স্নান সেরে বেরোতে যাবেন, হঠাৎ চোখ পড়ল বিরাট আয়নাটায়। পিঠের উপর, কাঁধের ঠিক নীচে সরু এক চিলতে লোমের মতো কী ওটা? লোমের মতো কিন্তু লোম তো নয়। জিনিসটাকে সহজেই আলাদা করে চোখে পড়ছে কারণ হরির পিঠের দিকে লোম একেবারেই নেই। আর তা ছাড়া এই জিনিসটা সাধারণ লোমের মতো অত সরুও না, সামান্য একটু মোটা আর লোমের থেকে একটু লম্বাও বটে। জিনিসটাকে হাত দিয়ে ছুঁতেই চুল ছোয়ার মতো লাগলও না। এক ঝটকায় সেটাকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলেন একবার—হয়তো ময়লা লেগেছে কোনো। কিন্তু সেই চেষ্টা করেই বুঝতে পারলেন জিনিসটা ঝেড়ে ফেলা সম্ভব না কারণ জিনিসটা তাঁর শরীরের সঙ্গে সেঁটে বসে আছে—ডগাটা হাওয়ায় দুলছে, কিন্তু গোড়াটা চামড়ার সঙ্গে যুক্ত। আয়নার মাথার লাইটটা জ্বাললেন হরি, জিনিসটার রংও ঠিক লোমের মতো কালো না, একটু যেন সবজেটে কালো।
চামড়ার সঙ্গে চিটে আছে বুঝতে পেরে জিনিসটাকে একটু জোরে টান দিতেই ব্যথা অনুভব করলেন। আরও একবার চেষ্টা করলেন ওটাকে টেনে তোলার, ওটার সঙ্গে সঙ্গে চামড়া উপরে উঠে আসছে, ঠিক যে রকম লোম টানলে হয় সেরকম অনুভূতি। বিস্ময়ের মাত্রাটা ক্রমেই বেড়ে চলেছে হরির। এদিকে জিনিসটা পিঠের এমন জায়গায়, যে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। হরি তাক থেকে ছোট্ট কাঁচিটা তুললেন, কচ করে জিনিসটা গোড়া থেকে কেটে ফেললেন, ব্যথা হল না মোটেই। টাইলসের মেঝে থেকে জিনিসটা কুড়িয়ে একটু নেড়ে ঘেটে দেখে ফেলে দিলেন কমোডে।
সেই মুহূর্তে জিনিসটা একটু অদ্ভুত লাগলেও কাজের চাপে পরের একটা দিন এই বিষয়টা মাথায়ই এল না হরির। পরদিন রাতে ঘুমোতে যাচ্ছেন, এপাশ ওপাশ করতেই পিঠের দু-তিনটে জায়গায় মশমশ শব্দ হল। শব্দটা ঠিক নরম গদিতে আদরের মেদ ঘষে যাওয়ার শব্দের মতো না, বরং অনেকটা ঘাসের উপর রাবারের জুতো বা স্নিকার ঘষে যাওয়ার মতো। একটা অদ্ভুত পেলব অনুভূতি, সঙ্গে একটা চুলকানিও। উঠে বসলেন হরি, যে জায়গাগুলো চুলকাচ্ছে সেখানে নখ দিয়ে আঁচড় দিতে গিয়েই চমকে উঠলেন। আবার সেই পেলব অনুভূতি, কোনো গাছের পাতার গোড়াটা ছুঁলে যে রকম অনুভূতি হয় অনেকটা সেই রকম। জিনিসটাকে টেনে তুলে ফেলার চেষ্টা করলেন হরি আর সঙ্গে সঙ্গে সেদিনের মতো লোম টানার অনুভূতি হল। নিজের শরীরের সঙ্গে কী হচ্ছে সেটা বুঝতে না পারা একটা অদ্ভুত অস্বস্তিকর অনুভূতি—ঠিক সেই অনুভুতিটা ক্রমেই চেপে ধরছে হরিকে। টান মেরে খুলে ফেললেন নাইট গাউন, এক দৌড়ে হাজির হলেন টয়লেটে। বিশাল আয়নাটার সামনে পিছন ফিরে দাঁড়াতেই মনে হল কেউ যেন কাটা হাই ভোল্টেজ তারের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাঁকে। সেদিন যে রকম সবজেটে কালো জিনিসটা দেখেছিলেন, পিঠের উপরে পাঁচটা আলাদা আলাদা জায়গায় সেইরকম পাঁচটা জিনিস আটকে রয়েছে। উত্তেজনায় এক ঝটকায় আয়নার উপরের আলোটা জ্বালিয়ে ফেললেন। চোখটা প্রায় ঢুকিয়ে ফেললেন আয়নার কাচে।
তবে তার প্রয়োজন ছিল না একেবারেই। কারণ যে জিনিসগুলো তাঁর চামড়ার উপর সেঁটে রয়েছে, সেগুলো যে আগের দিনের থেকে অনেক বেশি পুরু আর শক্ত সেটা খালি চোখেই বোঝা যায়। কাঁপা কাঁপা হাতে ঘাড়ের সবচেয়ে কাছেরটায় স্পর্শ করলেন হরি। আগের দিনেরটা লোমের থেকে সামান্য পুরু ছিল, কিন্তু আজকের গুলো… নিজের শরীরটা আয়নায় দেখতে দেখতে আতঙ্কে শুকিয়ে গেলেন হরি। আজকের গুলো সত্যি সত্যি কোনো পাতার গোড়ার অংশটার মতো মোটা আর পেলব, আর এগুলোর রঙে কোনো কালচে ছোপ নেই; এগুলো ঘন, উজ্জ্বল সবুজ। ঠিক যেন গাছে নতুন পাতা গজানোর আগের অবস্থা।
মাথাটা বাই করে ঘুরে গেল হরির। তোয়ালে রাখার হ্যাঙ্গারটা ধরে কোনোমতে টাল সামলে কমোডের উপরে বসে পড়লেন তিনি। ওগুলোকে ছুঁতেও ভয় লাগছে তাঁর। এসব কী হচ্ছে তাঁর সঙ্গে? পুরো শরীরটা থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে—তাঁর কী প্যানিক এটাক হচ্ছে? সেটাও কী সম্ভব? হরি ভাগবাতুলের মতো শক্ত নার্ভের মানুষেরও কী প্যানিক এটাক হতে পারে? টয়লেট সিটটাকে দু-হাতে, দশ আঙুলে আঁকড়ে ধরে শরীরের অসহ্য কম্পনটা থামানোর চেষ্টা করেন হরি। শ্বাস পড়ছে ভয়ানক দ্রুত গতিতে, রগের শিরা কপাল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে বুঝতে পারছেন হরি। মুখটাকে হা করে ভেনু ভেনু বলে ডাকার একটা আপ্রাণ চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। সারা টয়লেটটা বনবন করে ঘুরছে চোখের সামনে।
মিনিট পাঁচেক এইভাবে চলার পর ধীরে ধীরে শরীরের কম্পন কমে এল। আরও মিনিট দুয়েক পর কম্পন একেবারে থেমে গেল। এক হাতে কমোড, আরেকহাতে হ্যাঙ্গারটা ধরে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন হরি। ধীরে ধীরে স্নায়ুর উপরে স্বাভাবিক কনট্রোল ফিরে পাচ্ছেন। হাত দুটো যদিও এখনও ঈষৎ কেঁপে চলেছে। ওই কাঁপা কাঁপা হাতেই কাঁচিটা তুলে নিলেন। দু-আঙুলে সবুজ জিনিসটার ডগাটা ধরে চালিয়ে দিলেন গোড়াটার উপরে, খুব একটা লাভ হল না। জিনিসটা কাটলো তো না-ই, উলটে কাঁচি ধরা আঙুলের উপরে অনেক বেশি প্রতিরোধ অনুভব করলেন তিনি। এবার মরিয়া হয়ে আরেকবার জোরে কাঁচি চালালেন, কচ করে কেটে পড়ে গেল জিনিসটা। মরিয়া ভাবটা বেড়ে গেল হরির। উন্মাদের মতো কাঁচি চালাতে লাগলেন কাঁপা কাঁপা হাতে অন্য জিনিসগুলোর উপরে। দুটো কেটে পড়ে গেল, চার নম্বরটা পিঠের এমন জায়গায় যেখানে হাত পৌঁছনো মুশকিল। ভুল আঙ্গেলে কাঁচিটা চালিয়ে দিতেই কাঁচির তীক্ষ্ণ মুখদুটো বসে গেল চামড়ার মধ্যে। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেন হরি। গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এল কাটা জায়গাটা থেকে থেকে। কাঁচিটা ফেলে দিয়ে আয়নার দিকে তাকালেন হরি। দুটো সবুজ জিনিস এখনও চিটে রয়েছে শরীরে, তার মধ্যে একটা সাপের মতো ট্যারা ব্যাকা। বেসিনটা খামচে ধরে চিৎকার করে উঠলেন হরি—“ভেনু! ভেনু!”
গলা সম্পূর্ণ শুকিয়ে গিয়েছে, কাশি উঠে আসছে। কাশতে কাশতেই নজর পড়ল নীচের মেঝেতে। যে তিনটে জিনিস শরীর থেকে ছিঁড়ে মাটিতে ফেলেছেন তিনি, সেগুলোকে সাধারণভাবে দেখলে একশো বারের মধ্যে একশোবার তিনি কোনো গাছের ছেঁড়া পাতার অংশই বলতেন। আবার আয়নার দিকে তাকালেন তিনি। কাঁধের কাছের যে জায়গাটায় সবার আগে কাঁচি চালিয়েছিলেন, সেখানে লোম ছিঁড়ে নেওয়া লোমকূপের মতো একটা ছোট্ট ফুটো হা হয়ে আছে। আর সেই হা মুখের ভিতরে সবুজ রঙের একটা কিছুকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন হরি। সবুজ গাছের পাতার বোটার মতো জিনিসগুলো তার শরীরে লেগে নেই; তার চামড়ার ভিতর থেকে, শরীরের মধ্যে থেকে গজিয়ে উঠছে!
আতঙ্কের শেষ সীমায় পৌঁছে গলার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন হরি, “ভেনু!”
ভেনুর চোখে মুখে যে জিনিসিটা খেলা করে যাচ্ছে, সেটা বিশুদ্ধ বিস্ময়। একটা মানুষের চামড়ার রোমকূপ থেকে পাতার ডাঁটি গজিয়ে উঠছে, তাও আবার একবার নয়, বারবার—এটা কীভাবে সম্ভব? দুটো অক্ষত ডাঁটি ভেনুকে দেখিয়ে তাদের ছেঁটে ফেলেছেন হরি। হা হয়ে থাকা প্রতিটা রোমকূপের ভেতরেই সবুজ কিছুর একটা অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। ওই শূন্য রোমকূপগুলোর দিকে তাকালেই হরির মনে হচ্ছে ওরা রক্তবীজের ঝাড়। যতবারই কাটো, ওরা আবার গজিয়ে উঠবে। মিনিট দশেক হল নাইট গাউন আবার টাইট করে পরে নিয়েছেন হরি, কিন্তু ভেনুর চোখ থেকে হতবাক ভাবটা এখনও যাচ্ছে না।
“হা করে ভ্যাবলার মতো বসে না থেকে, কিছু একটা করো। ডু সামথিং।” দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠেন হরি। ফার্স্ট এড করা হলেও কাঁচিতে কেটে যাওয়া জায়গাগুলো এখনও বেশ জ্বালা করছে।
“ইয়ে… মানে, স্যার…” কুতিয়ে কুতিয়ে ভেনু শেষমেশ বলে, “এরকম কিছু তো কোনোদিন কখনও দেখিনি, শুনিওনি। তাই…”
“সে তো আমিও কখনও শুনিনি… এরকম উদ্ভট জিনিস কী করে হওয়া সম্ভব? খোস, পাঁচড়া, একজিমা এরকম কত রকমের চর্মরোগের কথা শুনেছি কিন্তু…” বলেই থমকে যান হরি। “ভেনু, ভেনু আমার স্কিন ক্যান্সার ট্যানসার…?”
“স্যার, এখনই এতদূর ভাববেন না প্লিজ। আমি ডাক্তার পট্টনায়েককে ডেকে পাঠিয়েছি, গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি, উনি চলে আসবেন এক্ষুনি। আপনি একটু ধৈর্য ধরুন প্লিজ!”
টয়লেটের মেঝেতে পড়ে থাকা ডাঁটিগুলোকে পরীক্ষা করে আর হরির পিঠের পাঁচটা শূন্য রোমকূপকে পরীক্ষা করে ডাক্তার পট্টনায়েকের মুখের অবস্থাও ভেনুর মতোই হল। “আপনি ঠিক বলছেন এই জিনিসগুলো আপনার স্কিন থেকে গজিয়ে উঠেছিল?”
“নাহলে কী আমি রাত দুপুরে তোমাকে ডেকে পাঠিয়ে মজা করছি ডাক্তার?” মুখচোখ বিকৃত করে বলেন হরি।
একটা চিন্তানিত্ব দীর্ঘশ্বাস পড়ে পট্টনায়েকের। “স্যার দেখুন, আমি তো জেনারেল ফিজিশিয়ান, ডার্মাটোলজিস্ট নই। তবে আমার ধারণা থেকে বলতে পারি এরকম উদ্ভট কোনো স্কিন ডিসিজের কথা আমি অন্তত কোনোদিন শুনিনি। আমি কালকেই শহরের সবচেয়ে বড়ো ডার্মাটোলজিস্টের সঙ্গে কথা বলছি। আপনি চিন্তা করবেন না।”
“আমাকে কী যেতে হবে নাকি?”
“ডক্টর তো এক্ষুনি এখানে চলে আসবে কিন্তু ডায়াগনোসিস এর জন্য তো টেস্টস করতে হবে কিছু। সেগুলোর জন্য তো ফেসিলিটিজ লাগবে। আমি সব ব্যবস্থা করে রাখছি, আপনি শুধু একবার আসবেন, সঙ্গে সঙ্গে টেস্টস করেই আপনাকে ছেড়ে দেব।”
“ডক্টর এটা স্কিন ক্যান্সার নয় তো?”
“অনেক রকম স্কিন ক্যান্সারের কথা শুনলেও, এরকম কিছুর কথা তো…যাই হোক, ব্যায়োপ্সিও কালকেই করিয়ে নেব আমরা।”
“কিন্তু হঠাৎ এসব হচ্ছেই বা কেন আমার?”
পট্টনায়েক ইতস্তত করে একবার হরির দিকে, একবার ভেনুর দিকে তাকাচ্ছেন। বলবেন কি বলবেন না ঠিক করতে পারছেন না। ভেনুর মুখেও কিঞ্চিৎ অস্বস্তি।
“আরে কী হল বলো… ভেনুর দিকে কী দেখছো?”
“ইয়ে মানে…আপনার যে পাঁচ জায়গা থেকে জিনিসগুলো গজিয়েছে, তার চারপাশে বৃত্তের মতো ফোসকার দাগ রয়েছে। কদিন আগে যেখানে যেখানে আপনার ফোসকা পড়েছিল, সেই জায়গাগুলো থেকেই গজিয়েছে জিনিসগুলো।”
“হোয়াট?” সটান উঠে বসেছেন হরি, “তার মানে তুমি বলছি ওই শয়তান ডাইনিটা আমাকে যে লিকুইডটা ছুড়ে মেরেছে, সেইটার এফেক্টই এসব হচ্ছে?” গলার পারা এক ধাক্কায় অনেকটা উপরে উঠে গিয়েছে হরির।
“স্যার, প্লিজ আপনি একটু শান্ত হন।” ভেনু কথা বলার চেষ্টা করে। মাঝেই কেটে চিৎকার করে ওঠেন হরি, “আরে কী শান্ত হব?” বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পড়েছেন হরি। ভেনুর মুখের সামনে মুখ নিয়ে এসে উন্মত্তের মতো চিৎকার করছেন, “একটা কোথাকার কোন নোংরা জংলি বুড়ি গায়ে এসে কী ছিটিয়ে চলে গেল আর এখন তার জন্য আমার গা থেকে লতাপাতা গজাচ্ছে আর তোমরা বলছ আমাকে শান্ত হতে? এগজাক্টলি হাউ মাচ স্টুপিড আর ইউ?”
ভেনু মেরুদণ্ড বেকিয়ে হেলে পড়েছে পিছনে। পট্টনায়েক নরম সুরে বলে ওঠেন, “স্যার, প্লিজ আমার কথাটা একটু শুনুন। এখনই কোনো কনক্লুশন ভেবে নেওয়া ঠিক হবে না। হয়তো দুটো ঘটনা জাস্ট সমাপতন, হয়তো এদের মধ্যে আসলেই কোনো সম্পর্ক নেই।”
“তাহলে আমার শরীরে এসব হওয়ার কোনো যুক্তিগত, বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা আছে তোমার কাছে? বলো আছে? ওই ডাইনি আমার গায়ে এমন কোনো একটা কেমিক্যাল ছুড়ে মেরেছে, যেটার জন্য আমার গা থেকে লতাপাতা গজাচ্ছে—এই তো সহজ ব্যাখ্যা। এই কথাটুকু তোমাদের মাথায় ঢুকছে না কেন, আমি বুঝতে পারছি না।”
পট্টনায়েক কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু লাভ হবে না বুঝতে পেরে চুপ করে গেলেন। হরি দ্রুত পায়ে চক্রাকারে বিশাল ঘরটার মধ্যে পায়চারি করে চলেছেন আর গজগজ করে যাচ্ছেন—“পাঁচ-পাঁচটা ষন্ডামার্কা বডিগার্ড, জেড প্লাস সিকিউরিটি” ভেনুর দিকে দৃষ্টি হেনে যোগ করেন, “আর একটা ওয়ার্থলেস পি.এ.—সবাই হা করে দাঁড়িয়ে রইল, আর একটা উটকো জংলি বুড়ি এসে গায়ে কী না কী ছিটিয়ে দিয়ে চলে গেল—বাহ্!”
মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভেনু। হরি তর্জনী তুলে হুঙ্কার দেন, “শোনো, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাসা না দেখে এক্ষুনি লক আপে যাও। ওই ডাইনিকে থার্ড ডিগ্রি দেবে না গলায় রুল ঢোকাবে আমি জানি না, আমি শুধু এইটুকু জানি যে কাল সকালের মধ্যে ওর মুখ থেকে এটা বের করে আনবে যে ও আমার গায়ে ঠিক কী লিকুইড ছুড়েছিল আর কী করলে এই উদ্ভট রোগটা সারবে। বুঝতে পেরেছ?”
“ইয়েস স্যার।” বলে ত্বরিৎ পায়ে বেরোতে যাচ্ছিল ভেনু। হরি পিছন থেকে বলে উঠলেন, “আর শোনো, মারতে মারতে আবার মেরে ফেলো না যেন। এই রোগটা সারা না অবধি ওই ডাইনির বেঁচে থাকাটা জরুরি। যাও, এবার বিদেয় হও।”
বাইরে এসে গাড়িতে উঠছিল ভেনু, ডক্টর পট্টনায়েক পেরিয়ে যাচ্ছিলেন পাশ দিয়ে। ভেনু হাঁক দিল, “ডক্টর সাহাব…”।
“বোলিয়ে ভেনুগোপাল।” এগিয়ে আসেন পট্টনায়েক।
“একটা কথা বলুন। স্যার যেটা বলছেন আপনি কী তার সঙ্গে একমত? ওই লিকুইডটার জন্যই স্যারের গা থেকে এসব লতাপাতা…”
একটা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়েন পট্টনায়েক। “দেখিয়ে ভেনুগোপাল, যেটা উনি বলছেন সেটা যে হওয়া সম্ভব না, এটা হাইস্কুল লেভেলের বিজ্ঞানের জ্ঞান থাকলেই বলা যায়।”
“ডক্টর সাহাব!” গলাটা ভারী আর ওজনদার হয়ে যায় ভেনুর। “যারা সামালকে বাত কিজিয়ে! ও আপ কে কই রান্ডম পেশেন্ট নাহি হ্যাঁ।”
পট্টনায়েক নিজের বিরক্তি চাপা দিয়ে সামলানোর চেষ্টা করেন, মৃদু গলা খাকারি দিয়ে বলেন, “সরি। দেখুন, উদ্ভিদ আর মানুষের শরীরের কেমিক্যাল স্ট্রাকচারের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে। মানুষের শরীরে অন্য কোনো স্তন্যপায়ীর বা অন্য কোনো মেরুদণ্ডী প্রাণীর বৈশিষ্ট্য, বা নিদেনপক্ষে কোনো প্রাণীর বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠলেও উঠতে পারে—লাখে একবার হয়তো সেরকম হওয়া সম্ভব বলে তর্ক করা যায়—কিন্তু উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় গঠনের এলিমেন্ট মানুষের শরীরে ফুটে ওঠা শুধু অস্বাভাবিক নয়, বৈজ্ঞানিকভাবে অসম্ভব। মানে আমি বলতে চাইছি…”
“আধুনিক বিজ্ঞানের পরিচিত কোনো রাসায়নিক দিয়েই এই জিনিস ঘটানো সম্ভব না, তাই তো?”
“ইয়েস। ইট ইজ ইভন থিয়োরিটিক্যালি ইম্পসিবল।”
“থ্যাঙ্ক ইউ, ডক্টর সাহাব। প্লিজ অ্যারেঞ্জ এভরিথিং টুমোরো।” গাড়িতে উঠে পড়ে ভেনু।
গুপ্তবিদ্যা
প্রথমেই গায়ে হাত তোলা যাবে না। বুড়ির যা বয়েস আর শরীরের যা হাল, মুখে রুল ঢোকালে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। আগে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে সুঝিয়ে আদায় করতে হবে কথা। যদি অনেক চেষ্টাতেও ফল না মেলে, তখন দেখতে হবে কী করা যায়। এসব ভাবতে ভাবতেই গাড়ি চালাচ্ছিল ভেনু। থানায় ঢুকতেই উর্দিধারী এগিয়ে এল।
“আইয়ে, স্যার,” থানার ডিউটিরত অফিসার কোমর ঝুঁকিয়ে বলে, “আপ কে লিয়ে হি ওয়েট কর রাহা থা।”
“চলিয়ে।” ভেনুর গলায় কেজো গাম্ভীর্য। অফিসারের আগে আগেই হাঁটা শুরু করে সে লক আপের দিকে।”
“স্যার, কুচ আজিব হো গায়া হ্যাঁ।”
“ক্যা হুয়া?” হাঁটা না থামিয়েই বলে ভেনু। একটু ইতস্তত করছে অফিসার, “স্যার, আপ খুদ হি দেখ লিজিয়ে।”
কপালে ঈষৎ ভাঁজ নিয়ে লক আপে ঢোকে ভেনু। হলুদ মরা আলোটা উপর থেকে ঝুলছে। সেই আলোতে যেটা দেখতে পায় সে, তাতে করে ওর হৃৎপিণ্ডটা বুকের ভিতরে সেঁধিয়ে যায়। বিপদ যেন রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। চাকরিটা না চলে যায় এবার তার। হলুদ আলোর বৃত্তের একটু বাইরে, লক আপের অন্ধকার যেখানে সবে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে, সেখানে হাত-পা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে সেদিনের সেই বুড়িটা। মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরিয়ে ঠোঁটের কষ বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছে লক আপের ধুলোভরা ধূসর মেঝের উপরে।
ধপ করে লক আপের রেলিং ধরে পাশে রাখা হাবিলদারের ছোটো টুলটার উপরে বসে পড়ে ভেনু। দু-আঙুলে মাথার রগটা চেপে ধরে। সর্বনাশ হয়ে গেল। যে একজন মানুষ ছিল যার পেট থেকে স্যারের রোগ সারানোর উপায় বের করা যেত, সেই চলে গেল। পট্টনায়েক বলছেন বিজ্ঞানের হিসেবে এই আজব কিসিমের রোগের ব্যাখ্যা হয় না। তাহলে কী…? ভাবনাটা ধাক্কা খায় ভেনুর। নজর পড়ে সামনে কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ডিউটি অফিসারের দিকে। ক্ষমতার মতো ক্রোধের গতিপথও চিরকালই নিম্নমুখী। উর্দ্ধতন থেকে অধস্তনের দিকেই ক্রোধ নেমে আসে। তা ছাড়া এত বছর হরির সঙ্গে গা ঘসাঘসি করে কিছু গুণ তো রক্তে সেঁধিয়েছেই ভেনুর।
এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে অফিসারের কলারটা ধরে ধাক্কা মেরে দেওয়ালে চেপে ধরল ভেনু। দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে বলে উঠল, “আমি ফোন বলেছিলাম আমি না-আসা অবধি টর্চার না করতে? বলেছিলাম কি বলিনি?” পুলিশটা এই আকস্মিক আক্রমণে টলমল হয়ে কোনোমতে অংবং বকার চেষ্টা করছে। ভেনু ওকে দেওয়ালে দুবার ঠুকে দিয়ে তর্জনী উঁচিয়ে বলে ওঠে, “তাহলে মালটাকে মারতে গেলি কেন? এখন কি জবাব দেব আমি স্যার কে?”
“স্যার, আমরা বুড়ির গায়ে হাত দিইনি, স্যার।” কোনোমতে শব্দগুলো উচ্চারণ করে অফিসার। লোকটার থুতনিটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরেচে ভেনু, “তাহলে কী বুড়িটা এমনি এমনি গ্যাঁজলা তুলে মরে গেল?”
“স্যার, স্যার…” লোকটা খাবি খাচ্ছে, “বিষ, বিষ ছিল স্যার ওর শাড়ির ভাঁজে।”
কবজিটা আলগা হয়ে গেল ভেনুর। হাতটা নামিয়ে নিয়ে অবাক গলায় বলল, “কী?”
“ইয়েস স্যার। সু—সুইসাইড স্যার।” লোকটা হাফাচ্ছে। মুখটা সটান পিছনে ফিরিয়ে বুড়িটার দিকে তাকায় ভেনু। আবার এদিকে ঘুরে মুখটা বিকৃত করে চিৎকার করে ওঠে, “পুলিশ কাস্টডিতে লুকিয়ে বিষ নিয়ে ঢুকে সুইসাইড করছে কয়েদি আর তোমরা বসে খৈনি ডলছ হারামজাদা?”
লোকটার মাথা নেমে আসছে নীচে। উর্দির দু-তিনটে বোতাম ছিঁড়ে ভেতরের স্যান্ডো গেঞ্জি দেখা যাচ্ছে। ভেনু আবার তর্জনী উঁচিয়ে বলে ওঠে, “তোর আর তোর সঙ্গে ডিউটিতে থাকা সব ক-টার চাকরি যদি থেকেছে, তো আমার নামও ভেনুগোপাল নয়।”
“স্যার, স্যার প্লিজ এরকম করবেন না। বাড়িতে বউ বাচ্চা আছে স্যার… আমার একার রোজগারে সংসার চলে।” লোকটা হঠাৎ ভেনুর পায়ে পড়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করে ভেনু। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার এইটুকুই তো মজা। পরের আগুনে নিজেকেও একটু সেঁকে নেওয়া যায়। কষিয়ে একটা লাথি মারে ভেনু। একটা কাঁচা অপশব্দ ব্যবহার করে বলে, “হ্যাট সালা, দূরে যা।”
গটগট করে লক আপে ঢুকে পড়ে ভেনু। বুড়ির কাছে আসতেই ধক করে বুকে একটা ধাক্কা লাগে। মরা লাশটার চোখ বন্ধ নয়, সে সটান তাকিয়ে আছে ভেনুর দিকে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে এগিয়ে যায়। নীচু হয়ে পালস পরীক্ষা করে, পালস পাওয়ার আগেই শরীরের উত্তাপ জানিয়ে দেয় বুড়ি মরে বরফ হয়ে গিয়েছে। গ্যাঁজলাটার পাশ দিয়ে সাবধানে বুটটাকে সরিয়ে নিয়ে সাইডে সরে আসে। বুড়ির শরীরটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে, ভেনু পা রাখে বুড়ির কোমরে, তারপর হালকা ঠেলা মেরে বডিটাকে সোজা করে দেয়। হাত দুটো ছিটকে পড়ে দু-দিকে। আর তখনই জিনিসটা নজরে পড়ে ওর। বুড়ির দু-হাতেরই কনুই থেকে কবজি অবধি লম্বালম্বি চিরে ফেলা হয়েছে। লাল কাটা দাগটা হলুদ ম্লান আলোতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দু-হাতে। মোবাইলটা বের করে টর্চটা জ্বালিয়ে প্রথমে ডান হাত, তারপর বাঁ হাতের কাটা দাগদুটোর উপরে ফেলে। বাঁ হাতের দাগটা অপেক্ষাকৃত পুরোনো। দাগের রেখাটা এখনও থাকলেও তার উপরে চামড়া গজাতে শুরু করেছে। আর সেখান থেকে আপাতত কোনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে না। ডান হাতের দাগটা একেবারে নতুন। সম্ভবত এক ঘণ্টারও কম আগে কাটা হয়েছে—রক্তের রেখা এখনও ফুঁসে উঠছে চামড়ার উপর দিয়ে। কয়েক ফোঁটা রক্ত কাটা দাগটার পাশে চামড়ার উপর শুকিয়ে কালচে হয়ে রয়েছে।
হাত বাড়িয়ে ঝুলন্ত আলোটাকে এদিকে ঘুরিয়ে নেয় ভেনু। বুড়ির লাশটার থেকে সামান্য দূরে মেঝের উপর ধুলোর মাঝে চকচকে তরল কিছু একটা নজরে পড়ে ভেনুর। আলোটা সেদিকে ফেরাতেই ভেনুর মনে হয় ওর পা দুটোকে কেউ যেন দুটো পাথর দিয়ে বেঁধে ফেলেছে। হলদে ম্লান আলোতে যেটা ও দেখতে পাচ্ছে, সেটার দিকে এগোনোর বিন্দুমাত্র সাহস হয় না ওর। গত তিন ঘণ্টা ধরে যা যা কিছু ঘটে চলেছে, সে সব আজগুবি, অদ্ভুত লাগলেও পুরো বিষয়টার পিছনে যে এইরকম কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে এটা একবারও মনে হয়নি ওর। কিন্তু এই মুহূর্তে এই একটা লোকাল থানার, অবহেলায় পড়ে থাকা লক আপে, একটা দু-হাত চেরা আদিবাসী মহিলার লাশের পাশে মেঝের উপর টকটকে লাল রঙে আঁকা ওই চিহ্নটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর মনের সবটুকু সংকোচ মিলিয়ে যাচ্ছে। যা যা কিছু হচ্ছে তার এই একটা, এবং শুধুমাত্র এই একটিই ব্যাখ্যা হতে পারে। ওই কালচে তাজা লাল রংটা যে রক্ত সেটা বলে দিতে ডাক্তার হতে লাগে না। সেই রক্তরঙে আঁকা রয়েছে দুটো সরু, সর্পিল লম্বা লতা, লতা দুটো শঙ্খলাগা সাপের মতো জড়িয়ে রয়েছে একে অপরের সঙ্গে, আর তাদের সরু শরীরদুটো থেকে গজিয়ে উঠেছে ছোট্ট ছোট্ট লাল পাতা।
একটা ঢোক গিলে এক ছুটে লক আপ থেকে বেরোতে যায় ভেনু। বেখেয়ালে ঝুলন্ত আলোটার সঙ্গে মাথা ঠুকে যায়। আলোটাকে ধরে তার দোলন বন্ধ করতেই একটা কথা খেয়াল হয়, আরেকবার ঘুরে তাকায় আঁকাটার দিকে। একদৃষ্টে দ্বিধানিত্ব চোখে তাকিয়ে থাকে ভেনু, তারপর পকেট থেকে ফোনটা বের করে আঁকাটার একটা ছবি তুলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে ভেনু। ডিউটি অফিসার দৌড়ে এসে “স্যার প্লিজ বাড়িতে বউ বাচ্চা আছে” বলে এক ঘ্যান ঘ্যান ফের শুরু করে। ভেনুর কানে সেসব কথা ঢুকছেই না। মুখচোখ আমূল বদলে গিয়েছে তার। সেরকমই চোখে সে তাকায় পুলিশটার দিকে, যেন কিছু মনে পড়েছে এরকমভাবে পুলিশটার কাঁধে হাত রাখে—“সরি। সরি। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। ইউর জব ইজ সেফ।” কাঁধে দুটো ভরসার চাপড় মেরে অন্যমনস্কভাবে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় ভেনুগোপাল।
“গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে”
“স্যার, আমার কথাটা বিশ্বাস করুন, প্লিজ! আমি নিজের চোখে…” জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করে ভেনু, কিন্তু বরাবরের মতো হরির মেজাজের সামনে দাঁড়াতে পারে না।
“কী বিশ্বাস করব শুনি? হ্যাঁ? কী বিশ্বাস করব? তুমি এতটাই অপদার্থ, এতটাই অযোগ্য… হাউ ক্যান ইউ লেট দিস হ্যাপেন? হাউ ক্যান শি জাস্ট কিল হারসেল্ফ লাইক দ্যাট? তুমি কী করছিলে?”
বাক্যের স্রোত মাথার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ভেনুর। সে খুব ভালো করেই জানে ঠিক চার ঘণ্টা আগেও ওই বুড়িটা মরে গেলেও তার স্যারের কিচ্ছু এসে যেত না, উলটে বরং খুশি হতেন তিনি। বুড়িকে যে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে নিজের জন্যই, সেটা কয়েক ঘণ্টা আগেও একবারও মনে হয়নি তাঁর। যদি ভেনুকে আলাদা করে সেরকম নির্দেশ দেওয়া হত, তাহলে ও বুড়ির লক আপের সামনে আলাদা পাহারা বসাতে পারত। কিন্তু এইসব যুক্তিপূর্ণ কথাবার্তা বলার কোনো মানেই হয় না এখন। পাঁচ বছর হয়ে গেল এই কাজে, পি.এ. এর কাজে যে স্রেফ ঠিকঠাক যুক্তি দিলেই হয় না সবসময়, কখনও কখনও স্রেফ নতমস্তকে মালিকের পানচিং ব্যাগ সেজে থাকতে হয়, সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছি এতদিনে। এই মুহূর্তেও তাই করে চলেছে সে। চিৎকার করতে করতে কয়েক সেকেন্ড দম নেওয়ার জন্য হরি থামতেই, ভেনু কথাটা বলে ওঠে।
“স্যার, আপনার প্রবলেমটা… মানে, সাধারণ উপায়ে বোধহয় সারবে না।”
“মানে? সারবে না মানেটা কী? কী বলতে চাইছ তুমি?” চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন হরি।
একটু দম নেয় ভেনু। কী বলবে, কীভাবে বলবে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, “স্যার, এটা কোনো কেমিক্যাল রিয়াকশনের ব্যাপার নয়। কোনো সাধারণ… মানে ল্যাবরেটরিতে তৈরি কোনো জিনিসের প্রভাবে আপনার শরীরে এসব হচ্ছে না। তাই সাধারণ আলোপ্যাথি বা সার্জিক্যাল পথে আপনার এই সমস্যা সারবে না, স্যার।” বলতে বলতেই চোখ নামিয়ে নেয় ভেনু।
“তুমি কী বলতে চাইছ আমি এক বর্ণও বুঝতে পারছি না। ঝেড়ে কাশো তো!”
একটু গলা খাকারি দেয় ভেনু। “আপনার উপর বুড়িটা গুপ্তবিদ্যা প্রয়োগ করেছে।”
“হোয়াট?” উচ্চস্বরে আওয়াজটা এলেও ভেনু বুঝতে পারল স্যারের গলায় রাগের থেকে বিস্ময় বেশি।
“স্যার, আমি থানায় লক আপে দেখে এসেছি স্যার।”
“তুমি কী এখনও তোমার গ্রামের অশিক্ষিত লোকগুলোর মতোই হয়ে আছো? ইউনিভার্সিটিতে পড়েছ, একজন মন্ত্রীর পি.এ. তুমি। লজ্জা করছে না এসব বলতে? একদিকে আমাদের পার্টি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেন করছে, আরেকদিকে তোমার মতো কিছু লোক… ডিসগাস্টিং!”
“স্যার, আমার কথা বিশ্বাস করুন প্লিজ।” করুন স্বরে আর্তি জানায় ভেনু। “আমি আজ ওখানে যা দেখেছি, ওই জিনিস আমি চিনি… আমি জানি… আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না এসব কী করে শহরের বুকে… কিন্তু,” খাবি খেতে খেতে যোগ করে ভেনু, “এমন অনেক বিদ্যা আছে স্যার যেখানে বিজ্ঞান এখনও পৌঁছয়নি। সেসব বিদ্যা নেহাত কুসংস্কার নয়। সেগুলোও বিজ্ঞানের সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তবে বিজ্ঞান এখনও অতদূর পৌঁছয়নি। উদ্ভিদের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বহু প্রাচীন, আধুনিক বিজ্ঞান তখনও জন্মায়নি। সেই সময়কার জ্ঞান ব্যবহার করে আপনার উপর…”
“চুপ! একদম চুপ! আমার মাথা ভয়ানক গরম হয়ে আছে। আমি আর এক মুহূর্ত তোমার কথা শুনতে চাই না।”
মরিয়া হয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করে ভেনু, “স্যার, এই ছবিটা আপনি একবার একটু দেখুন প্লিজ…”
“টু হেল উইথ ইউর ফোটো এন্ড টু হেল উইথ ইউর ব্ল্যাক ম্যাজিক। আমার শরীরে একটা কেমিক্যাল রিয়্যাকশন হয়েছে, আর পাঁচটা শারীরিক অসুস্থতার মতোই সেটা। আর পাঁচটা শারীরিক অসুস্থতার মতোই সেটা ওষুধে বা সার্জারিতে সারবে। এটাই সত্যি, এটাই ঠিক, বুঝতে পেরেছ? নাও লিভ। জাস্ট লিভ। আমাকে একা ছেড়ে দাও।”
তবু কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকে ভেনু। তারপর মাথা নামিয়ে ধীরে ধীরে বিদায় নেয়।
“লেট দেয়ার বি লাইট”
“স্যার, বিষয়টা যে খুবই অদ্ভুত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এরকম কোনো কেস নিজের চোখে দেখা তো দূর, কোনো মেডিক্যাল জার্নাল বা কেস হিস্ট্রিতে পড়েছি বলেও মনে পড়ছে না। তবুও আমরা একবার ভালো করে লাইব্রেরি ওয়ার্ক করে দেখব, খুঁজে দেখব এর কাছাকাছি কোনো ঘটনার কথা জানতে পারা যায় কিনা! যদি আপনার সমস্যার সঙ্গে সামান্যও মিল পাওয়া যায়, তাহলে সেখান থেকে এই রোগ সারানোর ব্যাপারেও কিছু আইডিয়া পাওয়া যেতে পারে।” হরির দিকে সরাসরি তাকিয়ে কথাগুলো বলেন ডক্টর শ্রীবাস্তব।
“কিন্তু এসব রিসার্চ টিসার্চ করতে তো অনেক সময় লাগবে। ততদিন আমাকে এই অসহ্য গা ঘিনঘিনে বিষয়টা সহ্য করতে হবে?” হরির গলায় উষ্মা স্পষ্ট।
ডক্টর শ্রীবাস্তব স্থির চোখে তাকিয়ে আছেন হরির দিকে। “স্যার, পার্ডন মি ফর সেয়িং দিস, বাট ইউ নিড টু বি আ লিটল পেশেন্ট অ্যাবাউট দিস। আপনার এই প্রবলেমটা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে আনপ্রিসিডেন্টেড। তাই আমাদের একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। আর আপনি চিন্তা করছেন কেন? আমি একা তো আর রিসার্চ ওয়ার্ক করব না। আমরা অলরেডি একটা টিম তৈরির কথা ভেবেছি—সেখানে আমরা গোটা দেশের বেস্ট ডার্মাটোলজিস্টদের রাখব। আপনি তো আর কোনো সাধারণ মানুষ নন, আপনার সুস্থতার জন্য কোনো কসুর…”
“মেক শিউর ইউ গেট অল দি বেস্ট পিপল অন বোর্ড, ওকে? মনে রাখবেন মানুষের ভোট নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধির জীবনের প্রশ্ন এটা।” শেষ বাক্যটায় একটু বেশি জোর দেন হরি।
“ডেফিনিটলি, স্যার।”
“যদি কোনো ডাক্তার বেশি ট্যান্ডাই ম্যান্ডাই করে, আমার পি.এ. কে জানাবেন। ও জানে কী করে লোককে লাইনে আনতে হয়।” সকাল থেকে প্রায় পনেরো-কুড়িটা টেস্ট হয়েছে শরীরে। গোটা গা-হাত-পা ম্যাজ ম্যাজ করছে, জ্বালা জায়গায় জায়গায়। ঘন ঘন সারা গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বাকি কথাটা বলেন হরি, “আরেকটা কথা, আপনাকে ভেনু গোপনীয়তার বিষয়টা বলেছে নিশ্চই। টিমে আসার আগে অবধি কাউকে আসল বিষয়টার কথা জানানো যাবে না। টিমে আসার পরে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে ভেনু কথা বলবে আলাদা করে। একজন বিধানসভার মেম্বারের সারা গায়ে লতাপাতা গজাচ্ছে এটা জানলে পরের বার আর পার্টি নিজেই… যাই হোক!”
“আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। কোনো খবর মিডিয়ার কাছে যাবে না।”
“গুড।”
এবার কথা বলে ওঠে ভেনু। “ডক্টর, এবার যদি একটু বলেন যে স্যারের আসলে হয়েছেটা কী।”
“আই ওয়াজ কামিং টু ইট।” ডক্টর শ্রীবাস্তব পেছনের এল.ই.ডি স্ক্রিনটায় একটা ছোট্ট স্টিক নিয়ে ইঙ্গিত করছেন। “এই ডায়াগ্রামটা একটু ভালো করে দেখুন আপনারা। এই হচ্ছে আমাদের স্কিনের লেয়ারগুলো। এইরকম জায়গা থেকে আমাদের স্কিনে লোম গজায়। আপনার শরীরে যে জিনিসগুলো গজিয়ে উঠছে, সেগুলোও গজাচ্ছে এই জায়গাটা থেকেই।”
“কিন্তু এগুলো তো…”
“লোম নয়, রাইট? দেখুন, মানুষের শরীরে যে লোম গজায় সেখানে মূলত পাঁচটা এলিমেন্ট থাকে। কার্বন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন আর সালফার—একসঙ্গে ‘কোহনস’ বলা হয়। এছাড়াও জিঙ্ক, আয়রন, কপার, ম্যাগনেশিয়ামের মতো এলিমেন্টও থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের চেনা বেশির ভাগ গাছের পাতা বা পাতার ডাঁটিতে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, আয়রন, জিঙ্ক আর ম্যাগনেশিয়াম থাকে। অবশ্য তার সঙ্গে সঙ্গে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, বোরন, ক্লোরিনের মতো আরও কিছু এলিমেন্টও থাকে। কিন্তু জরুরি কথা হল এটা যে, মানুষের লোম আর গাছের পাতার গঠনমূলক ইউনিটে অনেক কমন এলিমেন্ট রয়েছে। বলাই বাহুল্য যে এসব এলিমেন্ট নিয়ে যে কেমিক্যাল কম্পোজিশন তৈরি হয়, সেটা দুই ক্ষেত্রে এতটাই আলাদা যে মানুষের লোম আর গাছের পাতার মধ্যে কোনো মিলই পাওয়া যায় না বাইরে থেকে।” উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর শ্রীবাস্তব।
“কিন্তু আমার শরীরে তো পাতা গজায়নি, গজিয়েছে পাতার ডাঁটির মতো কিছু জিনিস।”
“তার কারণ আপনি ওদেরকে প্রি-ম্যাচিউর অবস্থায় কেটে ফেলেছেন। আমি নিশ্চিত ওদেরকে না কাটলে পাতা গজিয়ে উঠত অচিরেই।”
দু-হাত দিয়ে মাথাটাকে ধরে বসে আছেন হরি। গা গুলিয়ে উঠছে কথাবার্তাগুলো শুনেই। ডক্টর শ্রীবাস্তব বলে চললেন, “এবারেই হচ্ছে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটা। আপনার উপর আমরা যা যা টেস্ট করলাম, তার ভিত্তিতেই এইটা বলতে পারছি আপনাকে। আপনার শরীরে কোনো জাদুমন্ত্রবলে হিউম্যান বডি হেয়ারের কম্পোজিশনগুলো ভেঙেচুরে গাছের পাতার কম্পোজিশনে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। ফলে লোমের বদলে গাছের পাতা গজাচ্ছে আপনার চামড়ায়। আর তাই আপনি যতবারই তাদের ছেঁটে ফেলুন, তাতে লাভ কিছুই হবে না। লোম কেটে দিলেও যেরকম আবার কিছুদিন পর ঠিক গজিয়ে যায়, ঠিক সেইভাবেই এগুলো যতবারই আপনি কাটবেন, ততবারই গজিয়ে উঠবে।”
“তাহলে কি এর থেকে কোনো মুক্তি নেই? আমি কি এইভাবেই… এইভাবেই একটা গাছের মতো…?” প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন হরি।
“দাঁড়ান, দাঁড়ান। শান্ত হন। আগে পুরোটা শুনে নিন, তারপর বলছি আমরা কীভাবে আপনাকে সুস্থ করার কথা ভেবেছি। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল কোনো আশ্চর্য প্রক্রিয়ায় আপনার স্কিনে ক্রমাগত ক্লোরোফিল তৈরি হয়ে চলেছে।”
“হোয়াট?”
“এগজাক্টলি! মানুষের শরীরে ক্লোরোফিল কী করে তৈরি হতে পারে? এটাই আমাদেরও ভয়ানক চমকে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবকে তো মানতেই হয়। ক্লোরোফিল না তৈরি হলে আপনার শরীরে পাতা গজালেও তাদের রং সবুজ হত না। আপনি যে ক-টি ডাঁটি কেটে ফেলেছেন এবং যে ক-টি আজ সকাল থেকে গজিয়েছে সব ক-টার রং সবুজ। তা ছাড়া আমরা আপনার ত্বকের মধ্যে ক্লোরোফিল তৈরি হওয়ার লক্ষণও দেখতে পাচ্ছি।” একটু থেমে ডক্টর যোগ করেন—“ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনার ত্বকের রংও সবুজ হতে শুরু করবে।”
“আপনি কী শুধু আমাকে আমার সর্বনাশের কথাগুলোই শোনাবেন? না আমার সেরে ওঠার উপায়টাও বলবেন?” মরিয়া হয়ে চিৎকার করে ওঠেন হরি।
“বলছি। একটা মানুষের শরীরে কেন হঠাৎ ক্লোরোফিল তৈরি হতে শুরু করল, কেন হঠাৎ তার লোমের কম্পোজিশন ভেঙে গাছের পাতার কম্পোজিশন তৈরি হয়ে গেল এগুলোই সবচেয়ে বড়ো রহস্য আমাদের কাছে। এগুলোর উত্তর এক্ষুনি পাওয়া সম্ভব না। আমাদেরকে পরিকল্পনা করে আপনার উপরে অনেকগুলো পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হবে; যে যে কারণের জন্য এগুলো হতে পারে সেইসব কারণগুলোকে বাজিয়ে দেখতে হবে। যে মুহূর্তে আমরা আসল কারণটা বা কারণগুলোকে বুঝতে পারব, সেই মুহূর্তেই আমরা সেই কারণগুলোকে এলিমিনেট করব। ব্যাস! তাহলেই এই পুরো ব্যাপারটাই থেমে যাবে।”
“কীভাবে এলিমিনেট করবেন ডক্টর?” ভেনুর প্রশ্ন। হরি আর প্রশ্ন করার মতো অবস্থায় নেই।
“অনেকরকমভাবে করা যেতে পারে—নির্ভর করছে কারণটা কী তার উপর। যদি দেখা যায় কোনো গ্ল্যান্ড এর জন্য দায়ী, তখন সেটাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে; যদি দেখা যায় স্কিনে কোনো ভাইরাসের আক্রমণের জন্য এটা হচ্ছে তাহলে সেই ভাইরাসটাকে মারতে হবে, যদি অপারেট করা যায় এমন কোনো অংশ ইনফেক্টেড হয়ে যায়, তাহলে সেটাকে অপারেট করে বাদ দিতে হবে।”
“ওকে! আপাতত কী করা যেতে পারে ডক্টর?”
“আপাতত একটাই জিনিস করতে হবে। আপনার শরীরে গজাতে থাকা এই পাতাগুলোকে প্রপারলি মূলসুদ্ধ তুলে ফেলতে হবে। আর সেটা একটা মেডিক্যাল প্রসিডিউর, লে ম্যানের পক্ষে করা সম্ভব না। তাই প্লিজ আপনাকে অনুরোধ করছি কালকের মতো নিজে থেকে এগুলোকে কেটে ফেলবেন না।” একটু থেমে ডক্টর এলইডি স্ক্রিনটাকে ওদের দিকে ঘোরালেন, “এই দেখুন—আপনার স্কিনের এক্সরে। ভালো করে দেখুন—যে পাতার ডাঁটিটা গজিয়েছে তার এতটা যেমন স্কিনের উপরে, তেমনি এতটা স্কিনের ভেতরেও রয়েছে। মূলটা স্কিনের কত গভীর অবধি গিয়েছে দেখুন। আপনি জিনিসটা কাটতে পারলেও মূলটা কাটতে পারবেন না। ওটা আমাদেরকে মেডিক্যালি প্লাক আউট করতে হবে। আপনি নিজে করলে সেপটিক হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।”
“তাহলে এখন উপায় কী?”
“উপায় একটাই। যতদিন না আমরা আপনার শরীরের এই প্রসেসটাকে থামানোর কোনো রাস্তা বের করতে পারছি, ততদিন রোজ আপনাকে হসপিটালে এসে নতুন গজানো জিনিসগুলোকে তুলিয়ে যেতে হবে।”
কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা হয় না। তারপর হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে একটা ঘুসি আছড়ে পড়ে ডক্টর শ্রীবাস্তবের টেবিলটার উপরে।
“স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবোই!”
অদ্ভুত একটা ভাষা শুনতে পাচ্ছেন হরি। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন কতগুলো জাল—ছোটোবেলার জীবন বিজ্ঞান বইতে আঁকা ছবির মতো। নুড়ি পাথরের মতো পরপর স্তরে স্তরে সাজানো একটা শরীর। ধীরে ধীরে জুম আউট হয়ে আসছে ছবিটা, একটা খসখসে, উঁচুনীচু, রুক্ষ কোনো শরীর স্পষ্ট হয়ে উঠছে সামনে।
এ কী! এটা তো একটা গাছের কাণ্ড! একটা মোটা শক্ত গাছের কাণ্ড। কাণ্ডটার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে কী তাঁর দৃষ্টি? নীচে, নীচে, আরও নীচে! গাছটার গোড়া থেকে বেরিয়েছে অনেক ক-টা মূল, ছড়িয়ে রয়েছে তারা চারিপাশে, জড়িয়ে রয়েছে একে অপরের সঙ্গে, জুড়ে জুড়ে তৈরি হয়েছে একটা বিশাল নেটওয়ার্ক। সেই নেটওয়ার্কের গোলকধাঁধাঁয় ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁর শরীরহীন অস্তিত্ব। একটা মৃদু শব্দ শুনতে পাচ্ছেন হরি। কোথা থেকে আসছে শব্দটা? দৃষ্টি সরে এল মূলটার একটা অংশে। একটা মৃদু শব্দতরঙ্গ কী বয়ে যাচ্ছে মূলটার ভিতর দিয়ে? সেই শব্দতরঙ্গ পৌঁছে যাচ্ছে নেটওয়ার্কের অন্য প্রান্তে। অন্য প্রান্ত থেকে বয়ে আসছে অন্য একটা একইরকম মৃদু শব্দতরঙ্গ। ধীরে ধীরে আরও অগণ্য অসংখ্য শব্দতরঙ্গ অনুভব করতে পারছেন হরি। তাঁর চেতনা ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে প্রতিটা তরঙ্গ। একটু পরে নেটওয়ার্কের সব ক-টা মূলের শরীর বেয়ে বয়ে আসতে থাকল নিরন্তর শব্দতরঙ্গ। গাছেরা কী নিজেদের মধ্যে কথা বলছে? এটা কী গাছেদের ভাষা? গোটা বনভূমিটাই কী কথা বলছে নিজেদের মধ্যে? গাছগুলো কী ওঁকে কিছু বলার চেষ্টা করছে? যেটা উনি শুনছেন বলে মনে হচ্ছে সেটা কী সত্যিই গাছেরা বলছে ওঁকে, নাকি নিতান্তই ওঁর কল্পনা?
হঠাৎ চোখটা খুলে গেল হরির। নিজের বিশালাকার বেডরুমটা দেখতে পাচ্ছেন আবছাভাবে, একটা হালকা সবুজ আলোয় ভরে আছে পুরো গাছটা। ঘরের কোণের টবে রাখা গাছটা বিরাট রূপ ধারণ করে সিলিং ছুঁয়ে ফেলেছে। টেবিলের উপরের বনসাইটার কাণ্ডটা মোটা হয়ে ঘরের মাঝখানটা জুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওরা কী ওঁকে ডাকছে? ওঁকে কী যেতে হবে ওদের কাছে?
খাট থেকে উঠে মাটিতে নেমে পড়লেন হরি। সবুজ আলোর মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন, ঘর থেকে বেরিয়ে করিডোর, করিডোর পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন টয়লেটের দিকে। টয়লেটে ঢুকে আয়নাটার দিকে তাকালেন—আয়নাটার ভিতর থেকে কাচ ফাটিয়ে বেরিয়ে আসছে একটা গাছের ডাল। ডালের শেষপ্রান্তটা সাত-আটটা আঙুলে ভেঙে গিয়েছে, আঙুলগুলো এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। নাইট গাউনটা খুলে ফেলে দিলেন হরি। সম্পূর্ণ উলঙ্গ মূর্তিটা দেখা যাচ্ছে ভাঙা আয়নাটায়। সেই উলঙ্গ মূর্তির বুকের ঠিক মধ্যিখানে একটা চামড়া চিরে ফাঁক হওয়ার অনুভূতি হল তাঁর, কিন্তু ব্যথা হল না মোটেই। বিকেলে ডাক্তাররা সব ক-টা পাতার ডাঁটিকে চামড়ার ভেতর ছুঁচ ঢুকিয়ে উপড়ে ফেলেছে। কিন্তু ওরা চলে যায়নি, যাবে না, ওরা বারবার ফিরে ফিরে আসবে। বুকের চিরে যাওয়া চামড়াটা থেকে বেরিয়ে আসছে একটা সরু লম্বা লতা, লতার গা বেয়ে গজিয়ে উঠছে ছোট্ট সবুজ পাতা। তারপর ছাতির নীচটা চিরে বেরিয়ে এল আরেকটা, ডান দিক থেকে আরও একটা, গলার নীচে থেকে চামড়া ফাটিয়ে বেরোচ্ছে একটা।
কতক্ষণ এভাবে চলছিল কে জানে! সময়ের মাপ করার মতো অবস্থায় ছিলেন না হরি। খানিকক্ষণ পর আয়নায় নিজের ছবিটা স্পষ্ট দেখতে পেলেন—কাঁধ বেয়ে, পুরো বুক জুড়ে, কোমর অবধি গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য লতাপাতা, তারা ক্রমাগত আরও আরও ঘন হচ্ছে। হরি এবার শেভিং কিটটা খুলে ফেললেন, বের করে আনলেন ব্লেডটা। ডান হাত দিয়ে বা হাতের উপরে ধরলেন, তার চোখ একদৃষ্টে আয়না ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা গাছটার দিকে নিবদ্ধ। বা হাতের কবজির উপরে ব্লেডটা ছুইয়ে চাপ দিলেন, অল্প একটু রক্ত বেরিয়ে এল, কিন্তু ব্লেডটা ডুবে গেল চামড়ার মধ্যে। তারপর ব্লেডটাকে এঁকেবেঁকে অদ্ভুতভাবে কনুইয়ের কাছ অবধি টানলেন। তৈরি হল সাপের মতো আঁকাবাঁকা একটা লতানে রক্তের রেখা। তারপর সেই রেখার পাশে, তার গা জড়িয়ে আরও একটি সর্পিল রক্তের রেখা আঁকলেন।
হঠাৎ কিছু একটা হয়ে গেল যেন। যেন একটা গভীর ঘুম ভেঙে যাচ্ছে কোনোভাবে। আয়নাটার ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসা গাছটাকে আর দেখা যাচ্ছে না তো। কাঁধ, বুক, পেটের উপর গজিয়ে ওঠা লতাগুলো যদিও একইরকম আছে। ধীরে ধীরে চেতনা ফিরে পাচ্ছেন হরি। আর সেই সঙ্গে তীব্র একটা জ্বালা অনুভব করছেন হাতের কবজি থেকে কনুইতে। সেদিকে তাকাতেই ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। জ্বালাটা প্রতি মুহূর্তে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আর্তনাদ করছেন হরি।
কয়েক মিনিট পরে টয়লেটের দরজা খুলে ঢুকে এল ভেনু। পেছন ফিরে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকা উলঙ্গ হরিকে দেখে হতবাক হয়ে গেল। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় হরি সামনে ফিরলেন। হরির সম্পূর্ণ উর্ধাঙ্গ জুড়ে গভীর ঘন লতাপাতার ঝোপ কিলবিল করছে। আতঙ্কে, ভয়ে, ঘেন্নায় আর্তনাদ করে উঠে টয়লেটের বাইরে ছিটকে পড়ে গেল ভেনু।
“হেল্প মি ভেনু! প্লিজ প্লিজ হেল্প মি!” কাঁদো কাঁদো চোখে আর্তনাদ করছেন হরি।
তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলালো ভেনু। শুকিয়ে যাওয়া গলায় বলে উঠল, “ই… ইয়েস স্যার। নার্স, নার্স!”
ভেনু তাড়াতাড়ি দৌড়ে স্টোর রুম থেকে একটা টাওয়েল নিয়ে এলো। এসে হরিকে কোমর থেকে জড়িয়ে বেঁধে দিল শক্ত করে। নার্সরা দৌড়ে এসেছেন ভেনুর চিৎকারে। এসে দৃশ্যটা দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠিক সেই সময়ে হরির বাঁ হাতের দিকে নজর পড়ল ভেনুর। সঙ্গে সঙ্গে দু-পা পিছিয়ে গেল সে।
প্রাথমিক শুশ্রুষার পর হাতে ফার্স্ট এড লাগিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে হরিকে। ব্লেডের কাটা খুব সূক্ষ্ম, স্টিচ করতে লাগবে না। পেনকিলার দেওয়া হয়েছে। বাকি যা ওষুধ কাল হসপিটালে ডক্টর দেবেন। সারা বুক জুড়ে লতাপাতা গজিয়ে উঠলেও সেগুলোকে ডাক্তারের সুপারভিশন ছাড়া কাটা যাবে না। হরিকে শুইয়ে পাশের চেয়ারটায় বসেছে ভেনু।
“স্যার, আপনি এখনও বিশ্বাস করবেন না যে এটা নিতান্তই কোনো রাসায়নিক বিষের কারসাজি নয়? এর পিছনে অন্য কিছু আছে?”
ক্লান্ত, হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছেন হরি সিলিঙের দিকে। স্বভাবচিত রাগ, মেজাজ, ক্ষমতা দেখানো সবকিছু যেন চুপসে, মিইয়ে গিয়েছে। কোনো কথাই বলতে পারছেন না ঠিক করে। ভেনুই কথা বলে, “স্যার, লতাপাতা আবার গজাবে সেটা ডক্টর শ্রীবাস্তব বলেইছিলেন। কিন্তু আপনি যে ব্লেড দিয়ে মাঝরাতে ঘুমন্ত অবস্থায় হাতে ওই চিহ্নটা আঁকলেন, এটার কী কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে?”
খুব দুর্বল গলায়, এবং আরও বেশি দুর্বল ভঙ্গিতে হরি বলার চেষ্টা করলেন, “কেন? হতেও তো পারে এই জিনিসটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে মনের উপর চাপ পড়েছে। তাই হয়তো আমি হ্যালুসিনেট করে…”
ভেনু জানত এই লোকটা এতটাই জেদি যে এতকিছুর পরেও ভাঙবে তবু মচকাবে না। পকেট থেকে ফোনটা বের করে গ্যালারি ওপেন করে একটা ছবি বের করল, তারপর বলল, “তাই যদি হয় তাহলে যে নকশাটা আপনি কোনোদিন দেখেননি, সেই নকশাটাই হাতের উপর আঁকলেন কী করে?”
“আমার কী তখন হুঁশ ছিল আমি কী আঁকছি হাতের উপর? হুঁশ থাকলে কোনো মানুষ এসব করে?”
“ঠিক কথা। কিন্তু তাহলে আমাকে একটু বলবেন স্যার, আপনার আঁকা নকশা আর বুড়ির সুইসাইড করার আগে থানার মেঝেতে রক্ত দিয়ে আঁকা নকশা হুবহু মিলে গেল কী করে?” ভেনু হরির বা হাত আর ফোনের ছবিটাকে একেবারে পাশাপাশি রাখল। হরি তাকালেন ছবিটার দিকে, ভ্রু দুটো কুঁচকে উঠল, তারপর ধীরে ধীরে ধনুকের ছিলার মতো প্রসারিত হল তারা। একবার ভেনুর দিকে আরেকবার ছবির দিকে তাকালেন তিনি, এক ঝটকায় ফোনটা কেটে নিলেন হাত থেকে। জুম করে চোখ ছোটো করে ছবিটা দেখছেন আর হাতের সঙ্গে মেলাচ্ছেন। চরম অবিশ্বাসকে শেষ সম্বল হিসেবে আঁকড়ে থাকা মানুষের মতো ঘন ঘন মাথা নাড়ছেন দু-দিকে।
“হাউ ইজ দিস পসিবল?”
“আমি আপনাকে আগেই সাবধান করেছিলাম স্যার।”
“তুমি আমাকে কী করতে বলছ?”
“আমার আদি গ্রামে একজন ওঝা আছে স্যার, সেই এই গুপ্তবিদ্যা ভাঙার উপায় জানে। আমাকে একবার তাঁর কাছে যাওয়ার অনুমতি দিন। আমি কাল গিয়ে কালই ফিরে আসব। ও কিছু মন্ত্রপূত ওষুধ দিতে পারে। আপনাকে ডাক্তাররা যা করতে বলছে করুন, তার সঙ্গে এই মন্ত্রপূত ওষুধ খেতে কোনো ক্ষতি তো নেই।”
চোখেমুখে একটা মরিয়া অসহায়তা ফুটে উঠছে হরির। নিজের কাছেই যেন হেরে যাচ্ছেন, নিজের সাহস, তেজ, মেজাজ সব দুর্বল হয়ে নেতিয়ে পড়ছে ক্রমশ। প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি হেরে গিয়েছি, তোমরাই জিতে গিয়েছি। আমি বিশ্বাস করছি, করছি বিশ্বাস। করো, যা পারো কারো—আমাকে এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও।”
লোকটার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকল ভেনু খানিকক্ষণ। লোকটার অবস্থাটায় একটা নৃশংস উল্লাস অনুভব করবে, নাকি কষ্ট পাবে নিজের মনই ঠিক করে উঠতে পারছে না।
লড়কে লেঙ্গে
পাঁচ জন ডাক্তারের টিম যখন হরির বুক, পেট, পিঠ থেকে অজস্র লতাপাতাকে সমূলে উৎপাটিত করছেন, হরির মুখের দিকে তাকিয়েছিল ভেনু। ব্যথায় চমকে চমকে উঠছে লোকটা। কোথায় হারিয়ে গিয়েছে সেই ক্রূর মুখের রেখাচিত্র। প্রতি মুহূর্তে যেন একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে লোকটার সবটুকু আত্মবিশ্বাস, অহংবোধ। অ্যানাস্থেসিয়া দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ত্বকের গভীরতম স্তর অবধি পৌঁছে গিয়েছে এই গজিয়ে ওঠা লতাপাতার মূল। সেখান থেকে তাদেরকে তুলে বের করতে হলে অনুভূতিহীন নার্ভের উপরেও সামান্য আঘাত পড়ছেই। ভেনু লক্ষ করেছে গত কয়েক দিনের মধ্যে খুব দ্রুত বেড়ে গিয়েছে এই লতাদের গজিয়ে ওঠার হার। আগে তিন-চারটে করে গজাচ্ছিল সারাদিনে, এখন একদিন সব সাফ করে ফেলার পরের দিনেই আবার পুরো উর্ধাঙ্গ ঢেকে যায়। ব্যাপারটা ডক্টর শ্রীবাস্তবকে বলল ও, ডক্টর নিজেও মেনে নিলেন বিষয়টা। আপাতত ডাক্তারদের টিম এইটুকু বুঝতে পেরেছে যে হরির শরীরে কিছু অস্বাভাবিক রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয়েছে, তারই ফলস্বরূপ তৈরি হচ্ছে ক্লোরোফিল। কিন্তু সেই বিক্রিয়ার উৎস কোথায়, শরীরের কোন অঙ্গ তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, এসব কিছু বুঝতে না পারলে সেই বিক্রিয়াকে থামানোর উপায় বের করা অসম্ভব।
প্রায় এক ঘণ্টা পরে সব গজিয়ে ওঠা লতাকে তুলে ফেলা গেল। হরির স্বাভাবিক উর্ধাঙ্গটা দেখতে ভেনুর কেমন যেন অবাকই লাগছে। চোখের ভ্রমে চামড়ার উপরেই যেন ফুটে উঠছে শরীর থেকে সদ্য বিচ্ছিন্ন করা লতাগুলো। নার্সরা অ্যান্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিচ্ছেন সব ক-টা জায়গায়। হরির মাথা ঝুঁকে আছে বুকের উপর। ধীরে ধীরে সেই ঝুঁকে থাকা মাথা উপরে উঠে এল, বোজা চোখের পাতা দুটো খুলল একটু একটু করে, তারপর সটান ভেনুর দিকে তাকালেন হরি। চোখের ইশারায় কাছে ডাকলেন তাকে। ভেনু এগিয়ে কাছে যেতে একটা হাত রাখলেন ভেনুর কাঁধে, শক্ত করে চেপে ধরলেন ভেনুর কাঁধ। হরির চোখে একটা আগুন দেখতে পাচ্ছে ভেনু, একটা চেনা কিন্তু পুরোনো, অধুনা প্রয়োজনহীন আগুন—ধিকিধিকি রাগে জ্বলছে চোখদুটো। পরমুহূর্তেই একটা সাপের মতো হিসহিসে গলা শুনতে পেল ভেনু।
“আই এম গোয়িং টু ফাইট দিস, ভেনু। দ্যাট ডার্টি ওল্ড বিচ ডাজন্ট নো হোয়াট আ বিস্ট হরি ভাগবাতুলা ইজ।” চোয়াল শক্ত হচ্ছে হরির। দাঁতে দাঁত ঘসছেন তিনি, “আই উইল শো হোয়াট আই এম মেড অফ।”
কী বলবে খুঁজে পায় না ভেনু। সাহস দেওয়ার দরকার ছিল কি, পাশে আছি বলা উচিত কি? পি.এ-র কাজ এই মুহূর্তে কী হওয়া উচিত? আচ্ছা, মানুষ হিসেবে কী করা উচিত তার? মানুষ হিসেবে? নিজের মনেই হেসে ফ্যালে ভেনু। মানুষ হিসেবে তার সঙ্গে, এত এত মানুষের সঙ্গে কী ব্যবহার দিনের পর দিন করেছেন হরি ভাগবাতুলা? লোকটার এই দশা দেখে নিজের কী অবস্থান হওয়া উচিত ঠিক করতে কেন বারবার ব্যর্থ হচ্ছে ভেনু?
ওদিকে হরি বলে চলেছেন, “অনেক চেষ্টা করেছে অনেকে, অনেক অনেক ষড়যন্ত্র করেছে লোকে—বিরোধীরা, নিজের দলের লোকেরা কেউ বাদ নেই। দুর্নীতির অভিযোগ, মিথ্যা মামলা, সত্যি সেক্স স্ক্যান্ডাল!” হালকা করে বাঁকা হেসে ওঠেন। “তুমি তো সবই জানো। সব কিছু সামলে অটল দাঁড়িয়ে আছি। একটা উদ্ভট রোগ এসে আমাকে ভেঙে ফেলবে? এত সোজা?” শেষ দুটো শব্দ বেশ জোর দিয়ে বলেন।
এবার আপনা থেকেই উপর নীচে বেশ জোরে জোরে মাথা নাড়ে ভেনু। “লিসন টু মি ভেনু। আই ট্রাস্ট ইউ। আমি বিশ্বাস করছি তোমাকে, বিশ্বাস করছি তোমার অনুমানকে—আমার এই অবস্থার পেছনে সত্যিই হয়তো কোনো তন্ত্রমন্ত্র… কিন্তু তার মানে তো এটা নয় যে আমি হার মেনে নেব। মানুষকে ভয় পাইনি কোনোদিন, অ-মানুষকে পাবো কেন? যাক গে, শোনো, তুমি জলদি বেরিয়ে পড়ো তোমার গ্রামের বাড়ির জন্য। কোনো মন্ত্রপূত ওষুধ যদি পাও, নিয়ে এসো।”
“ইয়েস স্যার, আমি এখুনি বেরিয়ে পড়ছি।”
অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন হরি ভেনুর দিকে, ধীরে ধীরে বলে উঠলেন, “ইউ আর উইথ মি ইন ইট, রাইট?”
কিছু একটা ছিল হরির গলায়। আবেগ? যে মানুষটা সামনে বসে কথা বলছে সেই লোকটার গলায় আর যাই হোক আবেগ থাকতে পারে না। হরি সামনে বাড়িয়ে দিয়েছেন তার ডান হাত, সেই হাতের তালুতে অসংখ্য ছোটো ছোটো ফুটো। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ভেনু, নিজের অজান্তেই তার হাতটা এগিয়ে যাচ্ছে হরির হাতের দিকে। এক সেকেন্ড পরেই দুটো হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরল একে অপরকে।
“অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান”
“স্যার, এটার কী খুব দরকার ছিল? আপনি সুস্থ হয়ে গেলে তারপর না হয়… আর তা ছাড়া আজকে তো আর কোনো বিল পাশ হওয়ার ব্যাপার নেই। আজ আপনি না থাকলেও…” ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে ইংরেজিতে বলে ওঠে ভেনু, যাতে ড্রাইভার খুব একটা বুঝতে না পারে।
“আজকেই এটা দরকার ছিল ভেনু। পার্টির জন্য না, আমার নিজের জন্য।” বুলেটপ্রুফ কাচের জানলার বাইরে তাকিয়ে ইংরেজিতেই জবাব দেন পিছনের সিটে বসা হরি। “তুমি বুঝতে পারছ না ভেনু—এই অভিশাপটা, এই রোগটা আমার স্বাভাবিক বেঁচে থাকা, আমার কাজকর্ম সবকিছুকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চাইছে। আমাকে একটা ঘরের কোনায় কুঁকড়ে বসে থাকা জড়ভরতে পরিণত করতে চাইছে। ডাক্তারদের টিম নিজেদের মতো করে চেষ্টা করছে ঠিক, কিন্তু আমার লড়াইটা তো আমাকেই লড়তে হবে। আর তা ছাড়া তোমার এনে দেওয়া মন্ত্রপূত জল তো ভালোই কাজ করছে।”
“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।”
“তুমি লক্ষ করেছ ওই জলটা গায়ে লাগানোর পর থেকে লতাপাতার গজানোর রেট আগের থেকে অনেকটা কমে গিয়েছে?”
“রাইট স্যার। ইনফ্যাক্ট এটা কিন্তু ডক্টর শ্রীবাস্তবও কাল বললেন।”
“ওয়েল ডান, ভেনু।”
“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।”
একমনে কী যেন একটা ভাবছেন হরি। দূরের মাঠঘাটগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। হঠাৎ বললেন, “হরি ভাগবাতুলা কে ভেনু?”
“স্যার…”
“হরি ভাগবাতুলা হচ্ছে সেই লোকটা যার উপর ক্যাবিনেটের বাকি সবার থেকে বেশি ভরসা করেন স্বয়ং সি.এম, সেই লোকটা অ্যাসেম্বলিতে যার একার স্পিচে বিল পাশ হবে কি না হবে নির্ধারণ হয়ে যায়, সেই লোকটা যে স্টুডেন্টস, সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্ট সবার বিরোধিতা পায়ে মাড়িয়ে ফ্যাক্টরি দাঁড় করিয়ে দেয়, যার উলটোদিকে বিরোধী দলের কেউ প্রার্থী হয়ে দাঁড়াতেই ভয় পায়—এই সবকিছুই তো আমাকে আমি বানায়। যা কিছু আমাকে আমি বানায়, সেই সব কিছুকে যদি আমার থেকে কেড়ে আমাকে ঘরবন্দি পুতুল বানিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আর আমি বেঁচে রইলাম কই?”
একটু না, অনেকটাই চমকায় ভেনু। দার্শনিক কথাবার্তা এই পাঁচ বছরে লোকটাকে পাঁচ বার বলতে শুনেছে কিনা মনে পড়ে না। একটা দায়সারা “রাইট স্যার” বলে রিয়ারভিউ মিররে একবার তাকায় সে। হরি ঠিক ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। গত কয়েকদিনে আরও দু-বার হসপিটালে যেতে হয়েছে হরিকে। লতাগুলোকে কেটে তুলতে তো বটেই, সঙ্গে বেশ কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন ডাক্তারেরা। এই মুহূর্তে হরির শরীর একদম স্বাভাবিক আছে—সাদা পাঞ্জাবির উপরে গরদের প্রিয় কোর্টটা পরেছেন আজ।
গাড়ি যখন গেটে ঢোকার মুখে ঠিক তখনই খুব নীচু স্বরে বলা কথা শুনতে পেল ভেনু, হরি কিছু একটা বিড়বিড় করছেন। “বিধানসভায় আজ খুব সাদামাটা একটা দিন ঠিকই, কিন্তু…” একটা শ্বাস ছাড়েন হরি, “কিন্তু আমার কাছে এটা নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দিন।”
বিধানসভার মেইন এন্ট্রান্সের সামনে এসে থামে হরির কনভয়। আর্মড বডিগার্ডরা এসে দরজা খুলে দেয় দুজনকে। কালো শার্ট পরা ষণ্ডা লোকগুলোর মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে এসেম্বলি হলে ঢুকে যান হরি। ভেনু চলে যায় তার যেখানে থাকার কথা সেখানে—পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টদের জন্য নির্দিষ্ট করা ঘরে।
নিজের জন্য নির্দিষ্ট জায়গার দিকে এগোতে এগোতেই চোখাচোখি হয় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। সেই চেনা ভরসা, সেই চেনা প্রত্যাশা ফুটে উঠছে মানুষটার মুখে। অল্প হেসে মাথা ঝোঁকান হরি। নিজের চারপাশে না তাকালেও অনেক তরঙ্গ অনুভব করতে পারছেন তিনি। বিরোধীদের দুশ্চিন্তা, নিজের দলের কিছু লোকের হিংসা, আর কিছু লোকের সমীহ সব ক-টা রং গায়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁর। এই গোটা ঘরটার মধ্যে তাঁকে অন্তর থেকে ভালোবাসে এমন কেউ নেই তিনি জানেন, অন্তর থেকে ঘৃণা করেন এমন লোক প্রচুর তাও জানেন। কিন্তু সেগুলো বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা এটা যে না চাইলেও এই ঘরের প্রতিটা লোককে তাঁকে গুরুত্ব দিতে হয়, হবেও—আর সেটা অ্যাসেম্বলির সৌজন্যের বাইরে গিয়েও। নিজেকে আবার কমফোর্ট জোনে খুঁজে পাচ্ছেন হরি। গত দশ-বারোটা দিনে এই অনুভূতিটাই কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল।
নিয়মমাফিক সভা শুরু হয়। এক এক করে এক একজনের বক্তব্য হচ্ছে। সময়মতো হরির বক্তব্যের সুযোগ আসে। ভেনু আর সৈইদ মিলে জবরদস্ত একটা স্পিচ লিখেছে—বিরোধীদের একেবারে ছারখার করে দেবে। বক্তব্য শুরু করেন হরি। আজ যেন একটু বেশি উজ্জীবিত অনুভব করছেন, একেবারে আগুন ঝরানো বক্তব্য রাখছেন। ক্রমাগত টেবিল চাপড়ানোর আওয়াজ ভেসে আসছে দলের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে।
স্পিচ যখন মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছেছে, তখনই প্রথম ব্যাপারটা অনুভব করলেন হরি। পিঠের ঠিক মাঝখানে, শিরদাঁড়ার ঠিক পাশটায় হঠাৎ একটা তীব্র ব্যথা অনুভব করছেন। যেন কিছু একটা শিরদাঁড়ার ঠিক পাশের চামড়াটা ভেদ করে বেরোতে চাইছে। প্রথমে বিষয়টাকে ইগনোর করার চেষ্টা করলেন হরি। সম্পূর্ণ মনটা স্পিচের উপরে নিবিষ্ট করার চেষ্টা করলেন। একটু পরেই শিরদাঁড়ার অপর পাশ দিয়ে একইরকম যন্ত্রণা মালুম হল। এবার একসঙ্গে দু-জায়গায় কিছু একটা যেন কিলবিল করে বেরিয়ে আসছে চামড়া ফুঁড়ে।
প্রাণপনে স্পিচটা শেষ করার চেষ্টা করছেন হরি। কথা গুলিয়ে যাচ্ছে, বলার ধরনে সেই চেনা জোর, চেনা তেজ যেন ক্রমেই কমে আসছিল। এবারে আসতে আসতে ইংরেজি উচ্চারণ ভুল হতে শুরু করল। অল্প গুঞ্জন শুরু হল বিরোধীদের মধ্যে। অসহ্য যন্ত্রণায় পিঠটা চিরে যাচ্ছে হরির। তার মধ্যেই দাঁতে দাঁত চেপে কথা বলে যাচ্ছেন বা বলা ভালো বলার চেষ্টা করছেন। এবারে কথা জড়িয়ে যেতে শুরু করল। বিরোধীদের মধ্যে বেশ জোরে হাসাহাসি শুরু হয়ে গিয়েছে এবার। এক দুটো চটুল মন্তব্যও উড়ে এল। হরির কথা থেমে গেল, হরি লক্ষ করলেন বিব্রত চোখে মুখ্যমন্ত্রী তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে। হরি আবার বলা শুরু করার চেষ্টা করলেন, আর ঠিক তখনই বুকের উপরদিকে ছোট্ট একটা জায়গা চিরে ফাঁক হয়ে গিয়ে পাতাসমেত একটা লতা বেরিয়ে এল।
ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন হরির সামনে, পিছনে আর পাশে বসা কয়েকজন। তারা এরকম বিশ্রী, কিম্ভূতং দৃশ্যে হতচকিত হয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সকলে দ্রুত যতটা পারা যায় তফাতে চলে গেলেন হরির থেকে। প্রায় গোটা বিধানসভা উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে, স্পিকার প্রথমে কয়েকবার সকলকে শান্ত হতে বললেও এই মুহূর্তে নিজেই গোল গোল চোখ করে হরির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। হরিকে কেন্দ্রে রেখে একটা গোল তৈরি হয়ে গিয়েছে।
এদিকে যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত হয়ে গিয়েছে হরির। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে শেষমেশ আর্তনাদ করে মাটিতে ছিটকে পড়লেন তিনি, গড়িয়ে গেলেন প্ল্যাটফর্ম থেকে সিঁড়ির উপর। গোটা বিধানসভা জুড়ে প্রচণ্ড চিৎকার, সবাই কিছু না কিছু বলছে কিন্তু এরকম অকল্পনীয় দৃশ্যের সামনে কী করা উচিত ভেবে উঠতে পারছেন না কেউই। সিঁড়ির উপরে ঘষটে ঘসটে উঠে দাঁড়ানোর মরিয়া একটা চেষ্টা করলেন হরি। ঠিক সেই মুহূর্তে ওঁর চোখ পড়ল ঠিক সামনে স্পিকারের আসনের পিছনে রাখা বিরাট এলইডি স্ক্রিনটার উপর—বিধানসভার সেশনের লাইভ টেলিকাস্ট দেখা যাচ্ছে ওখানে।
বাসভবনে ফিরে আসার পর ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলছিল ভেনু। স্যারকে গাড়িতে তুলে সোজা হসপিটালেই যেতে চেয়েছিল সে, কিন্তু হরি উন্মাদের মতো চিৎকার করতে থাকেন—“কী হবে? কী হবে গিয়ে? ওদের উপড়ে ফেলা যাবে না, ওই শয়তানগুলোর একটাকেও উপড়ে ফেলা যাবে না। যতবার, যতবার উপড়ে ফেলবে, ততবার আরও বেশি করে ওরা গজিয়ে উঠবে।” স্যারের আদেশ অমান্য করে কীভাবেই বা কাজ করবে ভেনু! বাধ্য হয়েই অনিচ্ছা সত্ত্বেও পেনকিলার দিয়ে ব্যথা কমিয়ে হরিকে বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছে সে।
ডাক্তার শ্রীবাস্তবের সঙ্গে কথা বলেই ফোনটা রাখতে যাচ্ছিল সে, ঠিক তখনই দৌড়ে এল বেয়ারাদের একজন, “ভেনু ভাইয়া, একবার আসুন না। বাবু কী রকম পাগলামি করছেন।” সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে দোতালায় উঠে এল ভেনু। স্যারের ঘরে ঢোকার আগে থেকেই একটা চাপা গোঙানির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল। ঘরে ঢুকে যেটা দেখল সেটা একটা বীভৎস দৃশ্য। হরি মাটির উপর হাটু মুড়ে বসে উন্মাদের মতো টেনে হিঁচড়ে সদ্য গজিয়ে ওঠা লতাগুলোকে চিরে ফেলার চেষ্টা করছেন। একটা বড়ো কাঁচি জোগাড় করে এলোপাথাড়ি সেটা চালাচ্ছেন শরীরের উপর। কাঁচির ভুলভাল আঘাতে শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্ত পড়ছে টপ টপ করে বুক পেট কাঁধ থেকে। জোর করে লতাগুলোয় টান দেওয়ার ফলে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরছে। গোঙাতে গোঙাতে আর্তনাদ করতে করতে নিজের সঙ্গেই নিজে যেন যুদ্ধ করে চলেছেন হরি।
ভেনু ছুটে গিয়ে হাত দুটো চেপে ধরে হরির। হরি চিৎকার করে ওঠে, “ছাড়ো আমাকে ভেনু, ছাড়ো। কোনো ডাক্তার লাগবে না, এই আগাছার ঝাড়কে আমি নিজে হাতেই শেষ করে ছাড়ব আজ।” ভেনু কাঁচিটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু হরি যেন হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত রুগীর মতো এদিক সেদিক কাঁচি চালাচ্ছে।
“ছেড়ে দিন স্যার, প্লিজ… কাঁচিটা দিয়ে দিন, প্লিজ। আপনার সেপটিক হয়ে যাবে, প্লিজ হসপিটাল চলুন।”
“কেন যাবো রে? কেন যাবো?” দাঁত মুখ খিচিয়ে তেড়ে আসেন হরি ওর দিকে। “অপদার্থ জানোয়ারের দল! কী করতে পেরেছে তোর ডাক্তারগুলো এখনও অবধি? কী করতে পেরেছে?” বলতে বলতে ভেনুর বুকে ধাক্কা দিতে থাকে। ভেনু বুঝতে পারে এই মুহূর্তে এভাবে সামলানো যাবে না হরিকে। আগে ওঁকে শান্ত করতে হবে। চিৎকার শুনে বাড়িতে সর্বক্ষণের জন্য রাখা নার্সরা ছুটে এসেছিল। উৎকণ্ঠা ভরা চোখে তাকিয়ে আছেন তাঁরা এদিকে। ভেনু ওদের দিকে তাকিয়ে একবার অর্থপূর্ণভাবে মাথা নাড়ল। একজন নার্স ছুটে বেরিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন একটু পরেই।
ভেনু এটা সেটা কথা বলে ব্যস্ত রাখছিল হরিকে। নার্সকে ফিরে আসতে দেখেই অতর্কিতে পিছন থেকে হাত দুটোকে ধরে ফেলল। হরি প্রচণ্ড ছটফট করলেও ভেনু কোনোমতে শক্ত করে ধরে রইল তাঁকে। নার্স এসে সিডেটিভ পুশ করলেন। আরও মিনিট খানেক ছটফট করার পর ধীরে ধীরে ভেনুর কোলে ঢলে পড়লেন হরি। বেডরুমে নিয়ে এসে শুইয়ে দিল ভেনু।
“দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে”
“স্যার, এখন কেমন বোধ করছেন?”
জিজ্ঞেস করল ভেনু। ঘণ্টা চারেক ঘুমোনোর পর সবে জেগে উঠে বসেছেন হরি। ভেনুর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে সরলভাবে জিজ্ঞেস করছেন, “আমার কী হয়েছিল ভেনু? আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না কেন?”
ভেনু একে একে সকাল থেকে সব ঘটনা গুছিয়ে বলে হরিকে। ধীরে ধীরে হরির মুখে একটা কালো ছায়া ঘনিয়ে আসে। মাথা দু-হাতের মধ্যে গুঁজে ফেলেন তিনি।
“হ্যাজ ইট বিন টেলিকাস্টেড অল ওভার দ্য স্টেট ভেনু?” মাথাটা হাতের মধ্যে গুঁজে রেখেই বলেন তিনি।
“আপনি এখন এসব নিয়ে একদম ভাববেন না স্যার। এই সব কিছু সামলে নেওয়া যাবে, শুধু আপনার সুস্থ হয়ে ওঠাটা বড়ো দরকার।”
চুপ করে আছেন হরি, তাকিয়ে রয়েছেন টেবিলের উপর রাখা বনসাইটার দিকে। ওদিকে তাকিয়ে বললেন একটু পরে, “আমি কী আর আদৌ কোনোদিন সুস্থ হব?”
“কেন হবেন না স্যার? নিশ্চই হবেন। আমি তো সেই দুপুর থেকে আপনাকে বলছি প্লিজ হসপিটালে চলুন।”
এবার মুখ তুলে তাকালেন হরি। হঠাৎ অদ্ভুত একটা জিনিস করলেন। দুটো হাত প্রার্থনা করার ভঙ্গিতে জড়ো হয়ে এল, তারপর বললেন, “আমাকে ছেড়ে দাও ভেনু। যে অবস্থায় আছি, তাতেই ছেড়ে দাও। আর কষ্ট দিও না এই শরীরটাকে।” তারপর হাতে করে বুক থেকে গজানো লতাগুলোকে ঠুকে ঠুকে বললেন, “ওরা যাবে না ভেনু, ওরা যাবার নয়। ওরা আমাকে শেষ করে তবে যাবে।”
অনেক কষ্টে হরিকে শান্ত করে আরও একটু বিশ্রাম করতে বলে বেরিয়ে এল ভেনু। কিন্তু কিছুতেই হসপিটাল যাওয়ার জন্য রাজি করতে পারল না। ঘণ্টাখানেক পরে ডাক পড়ল তার আবার।
“বলুন স্যার। এখন কি একটু বেটার লাগছে?”
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হরি যেটা বললেন সেটাই রীতিমতো চমকে গেল ভেনু।
“কালিন্দীকে ডাকো, ভেনু!”
“কালিন্দী? এখন? ”
“কেন? ওকে মাঝরাত্রে গাড়ি পাঠিয়ে ডেকে পাঠাইনি আমি আগে?”
“না স্যার, সেজন্য বলিনি। মানে আপনার শরীরের এরকম অবস্থা… এ অবস্থায়…?”
“কেন?” একটা মৃদু তেরিয়াভাব ফুটে ওঠে হরির মুখে, “গায়ে আগাছা গজিয়েছে বলে আমি পারব না? কী মনে হয়?”
“না, না স্যার। আমি সেভাবে বলতে চাইনি। মানে বলছিলাম যে আজ এত ধকল গেল শরীরের উপর দিয়ে, তাই…”
“সেইজন্যই তো কালিন্দীকে চাই। ওর মতো ভালো ওষুধ আর একটাও আছে? তুমি গাড়ি পাঠিয়ে দাও।”
“ওকে স্যার।” যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল ভেনু। ঘুরে বলল, “স্যার, আরও একটা ব্যাপার ভাবছিলাম… ইয়ে মানে, কালিন্দী তো আপনাকে এভাবে…”
“কী? আমার এই ঝোপজঙ্গল ভরতি কুৎসিত, বীভৎস শরীরটা আগে দেখেনি তাই তো?”
“না, মানে আমি ঠিক ওভাবে…”
“তুমি ওভাবেই বলতে চেয়েছ। আর একদম ঠিক বলতে চেয়েছ। শোনো ভেনু, কালিন্দী না মাস গেলে পয়সা নেয় কাড়ি কাড়ি। বিনা পয়সায় কিচ্ছু দিচ্ছে না ও। কালিন্দী আমার প্রপার্টি, বুঝতে পেরেছ? সে আমার গায়ে আগাছা গজাক, কী আমি মানুষটাই একটা রাক্ষসে পরিণত হয়ে যাই, ওকে ওর কাজ করতে হবে। যাও আর দেরি করো না।”
ভেনু চলে গেল ব্যবস্থা করতে। কিন্তু যতটা রোয়াব দেখিয়ে কথাটা বললেন হরি, ততটা আত্মবিশ্বাস নিজের উপরেই করতে পারছেন না। ড্রেসিং টেবিলের সামনের বড়ো আয়নাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে এই চেহারাটা নিয়ে কালিন্দীর সামনে যেতে। কিন্তু কেন? পয়সা যখন দিচ্ছেন, উসুল তো করে নেবেনই। এই ভয়ানক চেহারাটা দেখে হয়তো একটু ভয় পাবে কালিন্দী, হয়তো একটু কাঁদবে, হয়তো একটি কষ্ট হবে যখন ঘষে যাবে শরীরটা ওর গায়ে। তাতে কী এসে যায়?
কিন্তু বেশিক্ষণ আয়নাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। সরে এলেন ওখান থেকে। ঘণ্টাখানেক পরেই দরজা খুলে ঢুকে এল ভেনু। খবর দিল কালিন্দী এসে গিয়েছে। হরি চোখের ইশারায় ওকে চলে যেতে বললেন।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে কালিন্দী। ওর হিল টক টক করে আওয়াজ করছে সিঁড়িতে। বুকের ভিতরটা পাম্পের মতো ওঠানামা করছে। নিজের বুক পেটের দিকে তাকিয়ে আছেন হরি। এমনিতেই আজকাল তার কালিন্দীকে যেন কেমন কেমন লাগে। যবে থেকে কালিন্দী একেবারে নির্লজ্জ, বেহায়া হয়ে গিয়েছে, তবে থেকে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে হরির। মেয়েটা আজকাল ওকে বিছানায় পেলেই যা করে, তাতে হরিরই নিজের লজ্জা লাগে। নিজেকেই এক দলা মাংস বলে মনে হতে থাকে সঙ্গমের সময়। কে যে কার মালিক গুলিয়ে যায়! খেলাটার শুরুতে তাঁর হাতেই ছিল খেলার রাশ, এখনও কী তাঁর হাতেই আছে? এক একটা চরম মুহূর্তে হঠাৎ আবিষ্কার করেন তিনিই একটা ক্ষুধার্ত হাঙ্গরকে তৃপ্ত করার অন্তহীন চেষ্টা করে চলেছেন।
হিলের শব্দটা দরজার একেবারে কাছে চলে এসেছে। শেষ মুহূর্তে হাত বাড়িয়ে নাইট গাউনটা পরে নিলেন হরি।
ঘরে ঢুকে এল কালিন্দী। একটা লাল রঙের পাতলা চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে নিজেকে, সেটা সরিয়ে ছুড়ে ফেলল ঘরে ঢুকেই। যে পোশাকটা বেরিয়ে এল ভেতর থেকে সেটা পরে যে কেউ রাস্তায় বেরোতে পারে, ভাবলেও ঘেন্না হয়। গলা থেকে পায়ের পাতা অবধি ফিনফিনে ট্রান্সপারেন্ট একটা কাপড়, শুধু কোমরের নীচটুকু আর বুকের জায়গাটা সামান্য একটু কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা।
উঠে দাঁড়ালেন হরি। কোমর বাঁকিয়ে হেঁটে আসছে কালিন্দী।
“একটু আগে ডাকতে পারতেন, আমরা বেশি টাইম পেতাম।”
“কখনও ডাকব এটা তোমার ডিসিশন নয় কালিন্দী, ভুলে যেওনা।”
কালিন্দী ঘন হয়ে এসে কানের কাছটায় আলতো কামড় দিল। হরি বলে উঠলেন, “যেটুকু যা পরে আছ, ওটা তো পরে থাকার কোনো মানে হয় না। খুলে ফ্যালো।” কালিন্দী কানের কাছে মুখ ঘষতে থাকে, হাত রাখে নাইট গাউনের কলারে, “আপনিও খুলে ফেলুন। আবার গাউন পরা হয়েছে আমি আসছি জেনেও?”
“নাঃ! একদম না।” এক ঝটকায় কালিন্দীকে ঠেলে সরিয়ে দেন হরি। টেনশনের বসে একটু জোরেই হয়ে গিয়েছে ধাক্কাটা। কালিন্দী সামলাতে না পেরে ড্রেসিং টেবিলে পড়ে যায়। মুখে একটা তীব্র বিরক্তির ভাব ফুটে ওঠে। এতক্ষণের ঢলানিগিরি মুহূর্তে মুছে যায় চোখ থেকে। হরি বলে ওঠেন, “আমি কিছুই খুলব না। আজ আমার এভাবেই ইচ্ছে করছে।”
একটা বিরক্তির চাউনি হেনে কাপড় ছেড়ে ফেলে কালিন্দী। উঠে যায় বিছানায়। ওর চওড়া কোমর আর মোয়ালেম জংঘাদেশ মুহূর্তের মধ্যে শরীরের সব জ্বালা ভুলিয়ে দেয় হরিকে। দৃঢ় পায়ে সে এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। লাস্যময়ী ভঙ্গিতে শরীরের ভাঁজগুলোকে প্রকট করে শুয়ে আছে কালিন্দী। দু-হাতের মধ্যে ওকে তুলে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন হরি। তীব্র শরীরী আরামে বহুদিন পর শরীর জুড়ে একটা আরামের আমেজ বয়ে যেতে শুরু করে হরির। ফোর প্লে তে বেশি সময় নষ্ট না করে দ্রুত কালিন্দীর শরীরে প্রবেশ করেন হরি।
কালিন্দীর মধ্যে যেন প্রেত ভর করেছে। আছড়ে কামড়ে শেষ করে দিচ্ছে হরিকে। ওর আঙুল বারবার হরির পিঠের দিকে যেতে চাইছে, মুখ ঘষতে শুরু করেছে গলার কাছটায়। হরি সরিয়ে দিচ্ছেন বারবার। একবার, দুবার। বাধা পেয়ে রাগান্বিত আওয়াজ খসে পড়ছে কালিন্দীর গলা থেকে। তারপর হঠাৎ “খুলে ফেলুন না এটা “বলে এক টান মেরে ছিঁড়ে ফেলে নাইট গাউনটা।
স্তম্ভিত হয়ে পাথর হয়ে যায় হরির পুরো শরীরটা। একগুচ্ছ জংলি আগাছা ঝাঁপিয়ে পড়ে কালিন্দীর মসৃন, পেলব মুখটার উপর। ভয়ানক আতঙ্কে উন্মাদের মতো চিৎকার করে ওঠে কালিন্দী। প্রথম কয়েক মুহূর্ত বুঝতে পারে না যে ঠিক কী দেখছে ও চোখের সামনে। বুঝতে পারামাত্র সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চায় হরিকে।
হরি ওকে দু-হাতে চেপে ধরে বলতে থাকে—“কালিন্দী, কালিন্দী, প্লিজ আমার কথাটা শোনো। প্লিজ! আমি তোমাকে সব বলব। সব জানাব। তুমি প্লিজ আমার অবস্থাটা একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমার কথা শোনো, কালিন্দী…”
কিন্তু কালিন্দী তখন কোনো কথা শোনার মতো অবস্থাতেই নেই। গা ঘিনঘিনে একটা অনুভূতিতে বমি উঠে আসছে তার। ভয়ে ঘেন্নায় কাঁদতে শুরু করেছে বেচারি। গলা দিয়ে আর চিৎকার বের হচ্ছে না, একটা চিৎকারের চেষ্টা বের হচ্ছে কেবল। হরি হঠাৎ ওকে সজোরে চেপে ধরেন খাটের উপর, চিৎকার করে ওঠেন “বলছি না কালিন্দী, আমার কথা শোনো!”
মাথায় রক্ত উঠে যায় কালিন্দীর। নিজের শরীরের সবটুকু শক্তি জড়ো করে দু-পা দিয়ে সজোরে একটা লাথি মারে হরির বুকে। হরি ছিটকে পড়েন খাট থেকে। কালিন্দী পাগলের মতো ছিটকে নেমে পড়ে খাট থেকে, বিছানার নীচে থেকে একটা চাদর তুলে নিয়ে শরীরের চারপাশে জড়িয়ে, খুলে ফেলা পোশাকটা তুলে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
“কালিন্দী, কালিন্দী… আমার কথা শোনো প্লিজ! আমি এখনও শেষ হয়ে যাইনি। কালিন্দী!”
বিশাল শূন্য বেডরুমটা জুড়ে হরির আর্তনাদ পাক খেতে থাকে বনবন করে।
দশটা দিন কেটে গিয়েছে মাঝে। এই ক’দিনের মধ্যে হরির মধ্যে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন লক্ষ করেছে ভেনু। পরিবর্তনটা খুব প্রকট না, বাইরের কেউ দেখলে হয়তো বুঝতেও পারবে না, কিন্তু সর্বক্ষণ সঙ্গে থাকে যে মানুষ, তার নজর এড়াবে না। হরি নিজের স্বভাবের একেবারে বিপরীত মুখে চলে গিয়েছেন। কথা প্রায় বলেনই না আজকাল, খালি জানলার বাইরে তাকিয়ে কী যেন ভেবে যেতে থাকেন। আর দিনের একটা বিরাট সময় লন পেরিয়ে বাড়ির চারপাশে যে বাগান সেখানে গিয়ে বসে থাকেন, একমনে মালির কাজ দেখেন। দোতালার বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে ভেনু খেয়াল করেছে চার-পাঁচ মিনিট টানা অদ্ভুত দৃষ্টিতে বাগানের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন হরি। হঠাৎ দেখে মনে হবে যেন নীরবে কথোপকথন চলছে গাছগুলোর সঙ্গে হরির। প্রায়দিন বাগানের নরম ঘাসের উপর পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে শুয়ে অনেকটা সময় কাটিয়ে দেন। কোনো মানুষের সঙ্গেই কথা বলায় বিশেষ আগ্রহ দেখান না একেবারেই। সেদিন বিধানসভার ওই ঘটনার পর অনেক হোমরাচোমরা লোকজন দেখা করতে, খোঁজ নিতে এসেছিলেন, হরি কারোর সঙ্গেই দেখা করতে রাজি হননি। সব কিছু ভেনুকেই সামলাতে হয়েছে। এক অর্থে বলাই যায় হরির পলিটিক্যাল কেরিয়ারের যেটুকু যা বেঁচে আছে সেদিনের পরে, সেটাকে একা হাতে ভেনুই ধরে রেখেছে।
আরেকটা বিরাট পরিবর্তন লক্ষ করেছে ভেনু। গায়ে গজিয়ে ওঠা আগাছাগুলোকে উপড়ে ফেলার ব্যাপারে একেবারেই উৎসাহ দেখাচ্ছেন না হরি। ভেনুকেই জোর করে হসপিটাল নিয়ে যেতে হয়েছে একদিন অন্তর। যদিও তাতে লাভ খুব একটা হচ্ছে না বললেই চলে—ডক্টর শ্রীবাস্তবের টিম একটা ডেড এন্ডে আটকে গিয়েছেন। শরীরের কোন কোন অঙ্গ বা সিস্টেম ক্লোরোফিল তৈরিতে ইন্ধন দিচ্ছে সেটা বুঝতে পারলেও কীভাবে সেই প্রক্রিয়া বন্ধ করা যাবে, বুঝতে পারছেন না তারা। এখনও অবধি দু-রকম ওষুধের কম্বিনেশন পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে, অন্তত দৃষ্টিগত দিক থেকে তাতে একেবারেই কাজ হয়েছে বলে মনে তো হচ্ছে না। ভেনুর আদি গ্রামের তন্ত্র সাধকের টোটকাও কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে, বোঝাই যাচ্ছে।
কিন্তু অদ্ভুতভাবে এসব নিয়ে হরির কোনোই হেলদোল নেই। সেই খুনে মেজাজ, সেই তীক্ষ্ণ বিরক্তি, সেই লড়কে লেঙ্গে অ্যাটিচিউড সব কোথায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে যেন এই ক-দিনে। না কোনো উদ্বেগ, না দুশ্চিন্তা, না কিছু দাবিদাওয়া। মানুষটা একেবারেই সন্ন্যাসী গোছের হয়ে গিয়েছেন যেন। ভেনুর মনে হচ্ছে ও যদি কোনোদিন আগাছা তুলে ফেলার জন্য হসপিটাল যাওয়ার কথা নাও বলে, হরি তাহলেও কিছুই বলবেন না। এদিকে পুরু ঝোপের আড়ালে হরির মনুষ্য শরীরটাকে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না আর। অথচ হরির মুখে কোনো কষ্ট নেই, যেন ওই আগাছাগুলো আসলেই তাঁর শরীরের অংশ, এই কিম্ভুত বিশ্রী চেহারাটা আসলেই তাঁর নিজের। হরি কী মেনে নিয়েছেন নিজের এই ভবিতব্য? নাকি মেনে নেওয়ার থেকেও অনেক বেশি কিছু ঘটে চলেছে ওঁর মধ্যে?
আরও দুটো পরিবর্তন ঘটেছে হরির মধ্যে, তবে সেগুলো একেবারেই শারীরিক। এই দশ দিনে খাওয়াদাওয়া প্রায় পুরোপুরিই ছেড়ে দিয়েছেন হরি। প্রথমদিকে একটা, তারপর দুটো মিল স্কিপ করছিলেন; কিন্তু এখন তো সারাদিনে প্রায় কিছুই মুখেই তুলছেন না। সাজিয়ে দেওয়া রকমারি খাবার প্লেটেই পড়ে থাকছে, হরি সামনে বসে একমনে বাগান দেখছেন। ডক্টর পট্টনায়েক এসে বলে গিয়েছেন যে এভাবে খাওয়াদাওয়া না করে দুর্বল হয়ে পড়লে এবার স্যালাইন চালাতে হবে। আর এইখানেই সবথেকে অবাক লাগছে ভেনুর। দিন পাঁচেক প্রায় উপোষ করে থাকার পরেও হরির শরীর একটুও ভাঙছে না, দুর্বল হচ্ছে না, নেতিয়ে পড়ছে না। এটা কী করে সম্ভব? শেষ পরিবর্তনটা হল হরির শরীরে গাঢ় সবুজ রং ধরা। যেসব জায়গায় আগাছা গজায়নি বেশি, সেইসব জায়গাতেও একটা সবজেটে রং ধরেছে চামড়ায়।
পর্দা সরিয়ে জানলাটা হাট করে খুলে দিলেন হরি। বেশ চড়া রোদ উঠেছে আজকে। রোদের দিকে পিঠ করে বসলেন, পিঠে গজিয়ে ওঠা অসংখ্য লতাপাতারা মৃদুমন্দ হাওয়ায় আলতো করে দুলছে। রোদের উত্তাপটা পিঠের উপর থাকা সমস্ত ক-টা আগাছার শরীর দিয়ে অনুভব করছেন হরি। আঃ! কী ভীষণ আরাম হচ্ছে তাঁর। একটু বাদে উলটো হয়ে রোদের দিকে নিজের বক্ষদেশ এগিয়ে দিলেন হরি। আলো এসে পড়ল তার অনাবৃত উর্ধাঙ্গজুড়ে।
সারা শরীর কী ভীষণ তরতাজা লাগছে হরির! এত সজীব, এত পরিপূর্ণ, এত তৃপ্ত অনেকদিন পরে মনে হচ্ছে তাঁর নিজেকে।
সেদিন রাত দশটা নাগাদ হঠাৎ কী মনে হতে বাগানে নেমে গেলেন হরি। ফুলের সারিগুলোর পরে একটা জায়গায় গোল গোল করে মাটি কুপিয়ে রেখেছে মালি। ছোটো ছোটো গর্ত হয়ে আছে কয়েকটা। সেইরকম একটা গর্তের উপরে পা রাখলেন হরি। তারপর খানিকক্ষণ ওইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কী যেন ভেবে বেশ জোরে চাপ দিলেন গর্তটার উপর। ভেজা নরম মাটি ভেঙে চুরচুর হয়ে গেল, হরির পা-টা ঢুকে গেল মাটির সামান্য ভিতরে। আরও চাপ দিতে ধীরে ধীরে হরির পায়ের অনেকটাই ঢুকে গেল মাটির মধ্যে। একটু পরে আঙুলের ডগায় একটা শক্ত, প্যাচানো, দৃঢ় কিছুর ছোঁয়া পেলেন। কী এটা? কোনো গাছের মূল মনে হচ্ছে! সামনের ওই শাল গাছটার মূল কি? পায়ের ডগাটা শিকড়টার উপর ছোয়াতেই আবার সেদিনের মতো অনুভূতি হল তাঁর। যেন চেতনার দরজা খুলে যাচ্ছে একটার পর একটা। একটা সম্পূর্ণ অচেনা ভাষা একটু একটু করে বুঝতে শিখছেন যেন। মাথার মধ্যে শিরা-উপশিরায় যেন আগুন লেগে গিয়েছে, মনে হচ্ছে মাথার ভেতরের সব কিছু ওলটপালট হয়ে নতুন একটা ব্রেন তৈরি হচ্ছে। যেন যুগ যুগ প্রাচীন উদ্ভিদ জগতের সঙ্গে গভীর একটা সংযোগ স্থাপিত হয়ে গিয়েছে।
ট্রানসের মধ্যে থাকা হরি টেরও পেলেন না যে দোতালায় দাঁড়িয়ে অবাক চোখে চেয়ে থাকা ভেনু বিড়বিড় করে বলে উঠল, “লোকটার মানসিক ভারসাম্যটা একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।”
“স্যার, আপনি আরেকটু সহ্য করুন। আমরা এসে গিয়েছি, এই তো আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাব।” পিছনের সিটে আকুলিবিকুলি করতে থাকা হরিকে উদ্দেশ্য করে বলে ভেনু। ড্রাইভারকে আরও দ্রুত গাড়ি চালানোর নির্দেশ দেয় সে।
ঠিক মিনিট চল্লিশ আগে ফোন করে ভেনুকে বেডরুমে ডাকেন হরি। রাত্রি আড়াইটার সময় কী দরকার হল ভেবে পাচ্ছিল না ভেনু। ছুটে ঘরে এসে দেখল বিছানায় শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন হরি, পেটে নাকি হঠাৎ ভয়ানক ব্যথা শুরু হয়েছে। চেনা ওষুধপত্র দিল ভেনু, কিন্তু এমন কাটা কলাগাছের মতো ছটফট করছেন হরি, যে সামলানো যাচ্ছে না। তাই হসপিটালে নিয়ে আসাই বেস্ট বলে মনে হল।
ডক্টরসদের টিম তৈরিই ছিল। ওরা হসপিটালে পৌঁছতেই, হরিকে হুইলচেয়ারে করে সটান নিয়ে গেল এমার্জেন্সি রুমে। ভেনু শুনতে পেল যে কিছু বেসিক ওষুধ দিয়েই সনোগ্রাফি করা হবে হরির।
ঘণ্টাখানেক পরে স্পেশাল রুমে ডাক পড়ল ভেনুর। এই টিমের ডাক্তারদের অনেকেই ডক্টর শ্রীবাস্তবের পরিচিত। সুতরাং চটজলদি সব পরিষেবা পেতে একেবারেই দেরি হয়নি আর হরির রিসেন্ট শারীরিক অবস্থা সম্পর্কেও তাঁরা ওয়াকিবহল হয়ে গিয়েছেন।
ডাক্তার মাধবন বেশ গম্ভীর মুখে গ্রিট করলেন। পাশের বেডেই হরি শুয়ে আছেন, ব্যথা যে আপাতত কমেছে সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। মাধবন বলা শুরু করলেন, “ওঁর স্টমাকে একটা টিউমার হয়েছে—একটা সিম বীজের মতো। আর সেটা খুবই বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে, ওটাকে জলদি না উপড়ে ফেললে জীবন নিয়ে টানাটানি হয়ে যাবে।”
“কিন্তু ডক্টর, গত কয়েকদিনে তো একবারও উনি পেটে কোনো ব্যথার কথা বলেননি। তাহলে হঠাৎ টিউমার কোথা থেকে…?”
“দ্যাটস একচুয়ালি ভেরি স্ট্রেঞ্জ। টিউমার এই পর্যায়ে আসার আগে সাধারণত একটা ইঙ্গিত দিয়ে থাকে। যাই হোক, ওঁকে আমরা এখনই এডমিট করে নিচ্ছি। কাল কিছু টেস্ট করব আমরা, পরশুই অপারেট করব।”
আরও একটা বিনা মেঘে বজ্রপাত! একের পর এক অভিঘাতে ভেনুরই অবস্থা কাহিল। স্যারের কীরকম লাগছে ভেবে ওঁর দিকে তাকাতেই বড়ো অদ্ভুত লাগল ওর। হরি একটা নির্লিপ্ত, বিচ্ছিন্ন দৃষ্টি নিয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
পরের দিন রাত্রে
জানলার ভিতর দিয়ে পাঁচিলের ধারের গাছটা অনেকক্ষণ ধরেই হাত বাড়াচ্ছিল। ঠিক দু-মিনিট আগে হাত ঢুকিয়েই ফেলল ঘরের মধ্যে। ঘুম ভেঙে গেল হরির। হাসপাতালের বিছানা থেকে নেমে তিনি এগিয়ে গেলেন গাছটার দিকে, ছুঁয়ে ফেললেন হাতটাকে, আঙুলে চেপে ধরলেন আঙুল। তারপর হঠাৎ তাঁর হাতের মুঠো থেকে খসে মাটিতে পড়ে গেল গাছের হাতটা। একটা জলজ্যান্ত, তরতাজা গাছের শরীর থেকে নির্মমভাবে কেটে চিরে নেওয়া একটা শিরা-উপশিরা বেরিয়ে থাকা কাটা হাত!
বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠল হরির। কয়েক মুহূর্ত করুন সজল চোখে কাটা গাছের হাতটার দিকে তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলেন নিজের রুম থেকে। রাত প্রায় একটা বাজছে। নার্স, ডাক্তারদের নজর এড়িয়ে পায়ে পায়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেলেন হরি। লিফটে উঠে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বোতাম টিপলেন। কোনোদিকে না তাকিয়ে মেন গেটের সামনের পার্কিং-এর দিকে এগোতে লাগলেন। একটু আগেই ভেনু এসে দেখা করে গিয়েছে ওঁর সঙ্গে; আজ সারাদিন নানারকম মিটিং করতে ব্যস্ত ছিল বেচারা, সকালের পর আর হরিকে দেখতে আসার সময় হয়নি। হরি যদি খুব ভুল না করেন তাহলে ভেনু এখনও এই হসপিটাল ক্যাম্পাসেই আছে, সম্ভবত ডাক্তারদের সঙ্গে কথা চালাচালি করছে। তার মানে হরির গাড়িটাও আছে এখানেই।
মেন গেটের সামনের পার্কিং-এ পৌঁছে নিজের এম জি হেক্টরটাকে খুঁজে পেতে মোটেই সময় লাগল না হরির। ড্রাইভার সিটেই বসে আছে। জলদি পায়ে এদিকে এগিয়ে গিয়ে গেট খুলে ড্রাইভারের পাশে বসে উঠে বসলেন হরি।
“স্যার, আপনি, আপনি এখানে?” ভয়ানক চমকেছে ড্রাইভার।
“গাড়ি স্টার্ট করো।” হরির গলায় স্বভাবচিত আদেশ দেওয়ার ভঙ্গি।
“স্যার, ইয়ে মানে…” এদিক ওদিক তাকিয়ে ভেনুকে খোঁজার চেষ্টা করছে ড্রাইভার কৃষ্ণা। “মানে ভেনু ভাইয়াকে না বলে এইভাবে আপনাকে নিয়ে…”
“কৃষ্ণা, স্টার্ট দ্য ড্যাম কার। আমি তোমাকে বলছি গাড়ি স্টার্ট করো।”
“স্যার… আপনি এভাবে হসপিটাল থেকে…”
“শাট ইউর ফাকিং মাউথ এন্ড স্টার্ট দ্য ড্যাম কার!” ভয়ানক জোরে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন হরি।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে ডক্টর মাধবনের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত থাকা ভেনু ঘুরে তাকাল এদিকে। গাড়িটা ব্যাক করেই সোজা গেটের দিকে ধেয়ে গেল। ভেনু কিছু বোঝার আগেই গাড়ি গেট ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসে ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করল ভেনু। যখন বুঝতে পারল, তখনই সঙ্গে সঙ্গে কল করল হরির বডিগার্ডদের। হরি উপরে বলে বডিগার্ডরা একটু হালকা দিয়েছে ডিউটিতে। ভেনুর কল পেয়ে তারা খলবল করে দৌড়ে এল। দুটো সটান গাল পেড়ে ভেনু ওদের বলল পুরো ঘটনাটা। ডক্টর মাধবন কাছেই ছিলেন, তাড়াতাড়ি নিজের গাড়ির চাবিটা ভেনুর হাতে দিয়ে বললেন “গো অন! ফলো হিম! দেরি করবেন না। পেটে একটা বিপজ্জনক টিউমার নিয়ে এইভাবে রাত বিরেতে বাইরে ঘুরলে বিপদ ঘটে যেতে পারে কোনো।”
এক সেকেন্ড ভেবে চাবিটা হাতে নিয়ে মাধবনের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল ভেনু। দুজন বডিগার্ডকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। কিন্তু যাবে কোথায়? স্যারের গাড়ি এতক্ষণে কতদূর এগিয়ে গিয়েছে তার ঠিক আছে? হাতে ফোনটা তুলে নিল কৃষ্ণকে কল করবে বলে। ফোন রিং হয়ে কেটে গেল, কৃষ্ণা ধরল না। আবার করল, কিন্তু কৃষ্ণা আবারো ধরল না। ভেনু বুঝতে পারছে কৃষ্ণাকে ফোন ধরতে দেওয়া হচ্ছে না। কী করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না, এরকম সময়ে হোয়াটস অ্যাপ একটা টিং করে শব্দ ভেসে এল। ওপেন করতেই চমকে উঠল ভেনু। কৃষ্ণা লাইভ লোকেশন পাঠিয়েছে বুদ্ধি করে।
মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেল। বেশ জোরেই চালাচ্ছে ভেনু—একটা ভয়ানক দুশ্চিন্তা কাজ করছে মনের মধ্যে। মানুষটার মনের মাথার একেবারেই ঠিক নেই এখন, কী যে করতে চাইছেন ঈশ্বর জানেন। ধীরে ধীরে দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে ভেনু! মিনিট পনেরো এইভাবে চলার পর একজন বডিগার্ড বলে উঠল—“ওই তো! ওটা স্যারের গাড়ি না? ওই যে দূরে?”
গাড়িটা নজরে পড়েছে ভেনুরও। দেখে তো হরির মডেলটাই মনে হচ্ছে, তবে আরও কাছে গেলে বোঝা যাবে। গাড়িটা এখনও অন্তত পঞ্চাশ মিটার দূরে আছে। স্পিড বাড়িয়ে দেয় ভেনু। আরও খানিকক্ষণ চলার পর ভেনু প্রায় নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারে হরির নির্দেশে গাড়িকে কোথায় নিয়ে যেতে চলেছে কৃষ্ণা। আরও মিনিট দশেক পরে দূরে পিপলস ইউনিভার্সিটির মেইন গেট নজরে পড়ল। কিন্তু হরির গাড়ি সেই গেট ঝড়ের বেগে পেরিয়ে গেল। ঠিক এটাই আশা করছিল ভেনু।
একে একে দুই, তিন, চার নম্বর গেট পেরোনোর পর পাঁচ নম্বর গেটের কাছে আসতেই গাড়ির স্পিড কমে এল। গাড়ি ধীরে ধীরে রাস্তা ক্রস করে ঢুকে পড়ল ইউনিভার্সিটির মধ্যে। একজন গার্ড ছিল, সে হরিকে দেখেই দরজা খুলে দিচ্ছে। হরির গাড়ি ঢোকার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভেনুর গাড়ি ঢুকে পড়ল।
গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে বাকিটুকু রাস্তা পেরিয়ে এগিয়ে গেল ভেনু। জঙ্গল যেখানে কাটা হচ্ছে সেখানে যাওয়াটা পাঁচ নম্বর গেট দিয়েই সবচেয়ে সহজে হয়। কিছুটা এগোতেই ছিটকে দাঁড়িয়ে পড়ল ভেনু। এরকম অদ্ভুত দৃশ্য জীবনে কখনও দেখতে পাবে বলে কল্পনাও করতে পারেনি ও। হরি নিজের হসপিটালের পোশাকটা একটানে খুলে ফেললেন। হরি এখন সম্পূর্ণ নগ্ন। হরির বুক পেট থেকে গজিয়ে ওঠা বিপুল পরিমাণ লতাপাতা আগাছার জঙ্গল হ্যাজাকের হলুদ আলোতে ঝলসে উঠছে। মাঝরাত্রে অকস্মাৎ দু-দুখানা গাড়ির পরপর শব্দে ঘুম ভেঙে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এসেছে শ’খানেক শ্রমিক। তাঁরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়েছে হরির দিকে। নিজেদের মধ্যে গুঞ্জন উচ্চকিত সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে। কয়েকজন তো আতঙ্কে ভয়ে ঈশ্বরের নাম নেওয়াও শুরু করেছে।
হরি এগিয়ে যাচ্ছেন ঠিক যেখানে সব উপড়ে ফেলা গাছগুলোর লাশ পড়ে আছে সেখানে। শেষ পথটুকু প্রায় দৌড়ে অতিক্রম করে একেবারে কাছে চলে এলেন হরি। হরির পিছন পিছন ভেনু আর শ্রমিকরা দৌড়ে এল। দুজন বডিগার্ড এগিয়ে যেতে যাচ্ছিল হরির দিকে, ভেনুই থামাল। স্যার কী করতে চাইছেন, কী উদ্দেশ্যে এখানে আসা সেটা জানা খুব জরুরি।
দাঁড়িয়ে থাকা সকলকে হতবাক করে দিয়ে হরি ঝাঁপিয়ে পড়লেন কেটে ফেলে রাখা গাছগুলোর উপরে, নিজের নগ্ন শরীরটাকে নিয়ে। দু-হাতে আঁকড়ে আঁকড়ে ধরছেন কাটা গাছগুলোকে, আর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে ভুতে পাওয়া মানুষের মতো তীব্র আর্তনাদ। নিজের বুকের পেটের, পিঠের লতাপাতাগুলো সযত্নে বুলিয়ে দিচ্ছেন হরি প্রতিটা গাছের ভাঙা কাণ্ডে, বারংবার জড়িয়ে ধরছেন তাদেরকে। উপর্যপুরি আছাড় খেয়ে কেঁদে চলেছেন, যেন নিজের কোনো আত্মীয়কে হারিয়ে ফেলেছেন সারাজীবনের জন্য। আশপাশের সব লোক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছে।
এরকম আছাড় খেয়ে খেয়ে কান্না আর আর্তনাদ কতক্ষণ চলত বলা যায় না, কিন্তু হঠাৎ দৃশ্যপটে একটা পরিবর্তন হয়ে গেল! কান্নার মাঝেই হরি নিজের পেটটাকে আঁকড়ে ধরলেন, প্রবল ব্যথার চিৎকার করে আছড়ে পড়লেন একটা কাটা গাছের উপরে। ভেনু ছুটে গেল ওঁর দিকে। উনি পেটটা আঁকড়ে ধরে ছটফট করছেন।
“স্যার, স্যার, আপনার পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। প্লিজ প্লিজ উঠে আসুন।” বলে ওঠে ভেনু।
হিস্টিরিয়াগ্রস্থের মতো দু-দিকে ঘন ঘন মাথা নাড়তে থাকেন হরি। পেট জাপটে ধরে ককিয়ে উঠছেন। গতকাল রাতে টিউমার ডিটেক্ট হওয়ার পর আগাছা লতাপাতা কেটে দেওয়া হয়েছিল, তারপর আজ সারাদিন গজালেও পেটের ওই অংশে কোনো আগাছা গজায়নি। সেখানটায় খিচড়ে ধরে আর্তনাদ করে চলেছেন হরি।
মাথার উপরে অনন্ত আকাশটাকে যেন উলটো করে দেখতে পাচ্ছেন হরি। কিন্তু মাথার উপরে একটাও গাছের ডাল বা পাতা দেখতে পাচ্ছেন না—তারা ছিল, এখানেই ছিল, ক-দিন আগে অবধিও ছিল, এখন আর নেই। এখন তাদেরই লাশের উপরেই শুয়ে কাতরাচ্ছেন হরি। একটা হাত দিয়ে প্রাণপনে জড়িয়ে ধরে রয়েছেন একটা কাটা গুঁড়িকে। অসম্ভব যন্ত্রণায় পেট ফেটে যাচ্ছে তাঁর, মনে হচ্ছে যেন পেট চিরে কিছু একটা উপরে উঠে আসার প্রবল চেষ্টা করছে। ছোটো ছোটো হাত দিয়ে ছিড়ে ফেলতে চাইছে মাংস চামড়ার দূর্ভেদ্য দেওয়াল।
ভেনু বুঝতে পারল যা করার এখনই করতে হবে, নাহলে বড্ডো বেশি দেরি হয়ে যাবে। এরপর আর বাঁচানোই যাবে না হয়তো মানুষটাকে। একটা শেষ চেষ্টা। সটান মুখটা পিছনে ঘুরিয়ে হাঁক দিল—“সিকিউরিটি, কুইক”। ধূসর পোশাকের বডিগার্ডরা এতক্ষণ হতবাক হয়ে পুরো দৃশ্যটা দেখছিল। এখন ভেনুর ডাকে তড়িঘড়ি দৌড়ে এল এদিকে। লেবারদের দিকে তাকিয়ে জোর চিৎকার করে উঠল, “আপনারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবেন? প্লিজ হেল্প করুন আমাদের।”
জনা চারেক লেবার দৌড়ে এগিয়ে এল। সাত-আটজন মানুষ মিলে দু-হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করলেন হরিকে। কিন্তু হরি কিছুতেই সায় দিলেন না। পাগলের মতো দু-হাতে আঁকড়ে ধরে রইলেন গাছের গুঁড়িগুলোকে, একটা গুঁড়ি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলে আরেকটাকে আঁকড়ে ধরেন। হরির কোমর ধরে টেনে হিঁচড়ে নিজের সর্বশক্তি ব্যবহার করে ওঁকে তোলার চেষ্টা করতে করতে ভেনুর মনে হল হরির ওজন যেন হঠাৎ করে কয়েকগুন বেড়ে গিয়েছে। ওর স্পষ্ট মনে হল হরিকে নিজেদের দিকে শুধুমাত্র তারাই টানছে না; টানছে এই রুখু মাটির উপরে শুয়ে থাকা লম্বা লম্বা মোটা গুঁড়িগুলো। হরি যত তাদের জড়িয়ে ধরেন, ততই তারাও যেন কোনো অদৃশ্য বন্ধনে বুকে টেনে নেয় হরিকে। তারা হরিকে নিজেদের কোল থেকে কেড়ে নিতে দেবে না। হরির নগ্ন আগাছা, লতা ভরতি গায়ে হাত দিয়ে থাকতে থাকতে ভেনুর মনে হল লতাগুলো যেন হাত লম্বা করে বেড় দিয়ে ধরছে গাছের গুঁড়িগুলোকে। মিনিট পাঁচেক ধরে সাত-আটটা জোয়ান মানুষ মিলে হিমশিম খেয়ে গেল একটা রোগা পাতলা সাড়ে পাঁচ ফুটের মানুষকে তুলতে।
ভোরের আলো ফুটে উঠছে সবে দিগন্তে। দূরে ইউনিভার্সিটির বাউন্ডারির সামান্য উপরে অন্ধকার ডিঙিয়ে উঠে আসছে একটা কমলা রঙের সূর্য। তিরতির করে কাঁপছে সেই আদিম প্রভাতের আলো দিগন্তের বাতাসে।
এত ভোরেও লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছে বনভূমি গুঁড়িয়ে যাওয়া ন্যাড়া প্রান্তরটা। এক কোণে নেতিয়ে পড়ে আছে হলুদ তির্পলের চারটে লেবারদের তাঁবু। তার একটু দূরে দেওয়াল ঘেঁষে থাবা গুটিয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে পাঁচটা নির্লিপ্ত বুলডোজার। ইউনিভার্সিটির উত্তর কোণের সেই সুবিশাল পাথরটার মাথায় দাঁড়িয়ে কেউ যদি দেখে, চোখের আন্দাজ অন্তত হাজার দুই লোকের কথা তো বলবেই। এই হাজার দুয়েকের মধ্যে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-অধ্যাপক, ঠিকে শ্রমিক, স্থানীয় লোকজন, পুলিশ, মাতব্বর, রাজনৈতিক দাদা দিদি, নেতা আমলা, সাংবাদিক কেউ বাদ নেই। এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে এরা প্রত্যেকেই অন্যের মুখ থেকে যা শুনে এই সাত সকালে এখানে দৌড়ে এসেছে, সেই শোনা কথায় এরা একবিন্দুও বিশ্বাস করেনি। এরা যাদেরকে এই শোনা কথাটা আবার রিপিট টেলিকাস্ট করে শুনিয়েছে, তারাও এক বাক্যে সে কথা বিশ্বাস করেনি। এই পুরো ভিড়টার অপার কৌতূহলী দৃষ্টি যেদিকে, সেই জায়গাটার চারপাশে কর্ডন করে পুলিশ গার্ডরেল বসিয়ে দিয়েছে।
এই গার্ডরেলের বৃত্তের ঠিক কেন্দ্রে মর্গের লাশের মতো পাশাপাশি শুইয়ে রাখা সদ্য কাটা বট, অশত্থ, টিকদের উপর দু-হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে একটা নগ্ন মৃতদেহ। মানুষের মৃতদেহ! বিধানসভার মন্ত্রী, রাজ্যের আরবান ডেভেলপমেন্ট মিনিস্ট্রির হত্তা-কত্তা হরি ভাগবাতুলার মৃতদেহ। হরির নগ্ন শরীরের নাভির উপর এসে পড়েছে ভোরের প্রথম নরম আলো। সেই প্রথম আলোয় দেখা যাচ্ছে নাভিমূল থেকে গজিয়ে উঠেছে একটা ছোট্ট সবুজ চারাগাছ; তার ছোট্ট নরম পাতার ডগায় ডগায় লেগে রয়েছে এক-দু-ফোঁটা রক্ত। সূর্যের লাল মিশে যাচ্ছে সেই লালে।
লালের আভা মাখা সেই সবুজ চারাগাছটা সকালের শীতল হাওয়ায় আলতো করে মাথা দোলাচ্ছে।
কাব্যঋণ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকান্ত ভট্টাচার্য, জীবনানন্দ দাস, আলেক্সান্ডার পোপ
Tags: ঋষভ চট্টোপাধ্যায়, দশম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
