প্রফেসার ম্যাকাওয়ের আশ্চর্য অভিযান
লেখক: স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
প্রফেসার ম্যাকাওয়ের সঙ্গে ঝিমলি চ্যাটার্জির পরিচয় খুব বেশি দিন নয়।
গত বছর নিউটাউনে হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির এক কনভেনশনে ঝিমলি যখন তার বক্তব্য রাখছিল, তখনই তার চোখে পড়েছে, সেমিনার ঘরের শেষের সারিতে বসে এক অদ্ভুত চেহারার শ্রোতা তার বক্তব্য মন দিয়ে শুনছেন।
এরপর ঝিমলি যখন অডিটরিয়াম থেকে বেরিয়ে আসছে, তখন সেই অচেনা মানুষটি এসে ঝিমলিকে তার বক্তব্যের জন্যে সাধুবাদ জানালেন।
এবার বলি, মানুষটিকে ঝিমলির কেন অদ্ভুত বলে মনে হয়েছে।
অদ্ভুত ভদ্রলোকের অবয়ব। বয়স পঞ্চাশের ধারেকাছে হবে। চেহারাটা শিড়িঙ্গে। খাড়া নাক। মাথাজোড়া টাক। আর সেটা ব্যালেন্স করার জন্যেই বোধ করি নাকের নীচে ঝাঁটা গোঁফ। চোখে সোনালি ফ্রেমের গোল চশমা। তার ভেতরে উজ্জ্বল দুটো চোখ। তবে সে দৃষ্টি কার দিকে তা বোঝার উপায় নেই। কারণ সোজা কথায় তিনি ট্যারা। পরনে প্যান্ট-শার্ট।
সেদিন ভদ্রলোক ঝিমলির ইতিহাস গবেষণার বক্তব্যের প্রশংসা করে আত্মপরিচয় দিলেন। তিনি প্রফেসার ম্যাকাও।
—ম্যাকাও! আপনি বাঙালি? ঝিমলি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল।
—একেবারে ডাল-ভাতের বাঙালি মিস চ্যাটার্জি। প্রফেসার বলেছেন, আমার আসল নাম মানিককুমার ওঝা। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই এ নাম আমার অপছন্দ। তার উপর একজন বিজ্ঞানীর এমন সাদাসাপটা নাম হলে সে পাত্তা পাবে? তাই তো নামটা ভেঙে ‘ম্যাকাও’ করেছি। ঠিক করেছি কি না এটা?
—আপনি বিজ্ঞানী? ঝিমলি ভদ্রলোককে দেখে ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারে না।
—সেন্ট পারসেন্ট বিজ্ঞানী। তা সে কেউ স্বীকৃতি দিক চাই না দিক। রাজারহাটে এক এগারোতলা ফ্ল্যাটের টপ ফ্লোরে প্রায় আড়াই হাজার ফুটের আমার একটা ফ্ল্যাট কাম ল্যাবরেটরি আছে। আসুন-না একদিন।
ঝিমলি ঠিক বুঝতে পারল না এই স্বঘোষিত বিজ্ঞানী ভদ্রলোকের তার প্রতি এত আগ্রহ কেন?
প্রফেসার ম্যাকাও বোধ করি, ততক্ষণে ঝিমলির মনটা পড়ে ফেলেছেন। বললেন, আমি বিজ্ঞানী হলেও আপনার সাবজেক্টেও আমার আগ্রহ কম নেই।
হ্যাঁ। সে প্রমাণ তো ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে ঝিমলি। আর এটা ঠিক এই বয়সেই ঝিমলির ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্বের প্রতি অগাধ অনুরাগ। বেশ নামও করে ফেলেছে। মাঝে মাঝেই তার ডাক পড়ে বিভিন্ন সেমিনারে। আর ব্যক্তিজীবনে ঝিমলি এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাড়ি ভবানীপুর। তবে ছেলেবেলা থেকেই যতসব পুরোনো দিনের ইতিহাসের পাঁজিপুথি খুলে ইতিহাসের অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়ানোই তার নেশা।
প্রথম দিন আলাপেই ঝিমলির স্বঘোষিত বিজ্ঞানী প্রফেসার ম্যাকাওকে দেখে বেশ ইনটারেস্টিং মনে হয়েছিল। তারপর প্রায় বছর ঘুরতে চলল, প্রফেসারের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়নি। নানা কাজ আর গবেষণার চাপে প্রফেসার ম্যাকাওয়ের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল ঝিমলি।
তারপর এদিন দুপুর নাগাদ ঝিমলির কাছে হঠাৎ প্রফেসার ম্যাকাওয়ের ফোন এল, যাকে বলা যায় জরুরি তলব। প্রয়োজনটা কী তা কিছুতেই বললেন না প্রফেসার। শুধু বললেন, তোমার ঠিকানায় গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, এক্ষুনি চলে এসো। এখানে তোমার জন্যে এমন একটা অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে আছে, যা কোনোদিন ভাবতে পারবে না।
এমন কথা শুনলে কার না কৌতূহল হয়। সুতরাং ঝিমলি তৈরি হয়ে নিল।
গাড়ি এসে পৌঁছোল ওর বাড়ির দরজায়।
ঝিমলি পৌঁছে গেল রাজারহাটে প্রফেসার ম্যাকাওয়ের এগারোতলা ফ্ল্যাটের টপ ফ্লোরে তাঁর ফ্ল্যাট-কাম-ল্যাবরেটরিতে।
ডোর বেল বাজাতে এক গ্রাম্য ধরনের যুবক এসে দরজা খুলল। ঝিমলি পরে জেনেছিল ওর নাম মুকুন্দ। প্রফেসার ম্যাকাওয়ের কম্বাইন্ড হ্যান্ড। খুব বিশ্বাসী।
প্রফেসার ম্যাকাও ঝিমলিকে দেখে খুব খুশি হলেন। বললেন, এসো আমার ল্যাবরেটরি হলঘরে।
প্রফেসারের সঙ্গে সেখানে ঢুকল ঝিমলি। দেখে অবাক হল। ভাবা যায় না, কোন বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামটা সেখানে নেই। তবে সেসব দিকে মন দেবার বেশি সময় সে পেল না। দেখল, সে পৌঁছোবার আগেই দুই ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হয়েছে।
তাদের একজনের চেহারা যাকে বলে ঘাড়েগর্দানে। দু-চোখের দৃষ্টির তীব্র, প্রফেসার পরিচয় করিয়ে দিলেন—নান্টু নস্কর। দু-হাতে বাঘ শিকারের অভিজ্ঞতা আছে। আবার যে-কোনো হাতিয়ার চালানোয় পটু। এই সঙ্গে যে-কোনোরকম তালা খুলতে কিংবা ভেঙে ফেলতে পারে।
এমন একজন লোককে প্রফেসারের কেন দরকার পড়ল, তা বোঝার আগেই প্রফেসার দ্বিতীয় ব্যক্তির সঙ্গে ঝিমলির আলাপ করিয়ে দিলেন।
তিনি ড. মেডাক। চেহারাটা ভারী অদ্ভুত। এমন চেহারার মানুষ আগে কোনোদিন দেখেনি ঝিমলি। হাইট চার ফুটের বেশি নয়। হাত-পা সরু সরু কিন্তু আঙুল লম্বা। মাথা শরীর অনুপাতে বড়ো। আর দু-চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক। অনেকটা মাছের মতো। চোখে পাতা নেই। বয়স কত দেখে বোঝার উপায় নেই। ওর দু-কানে খুব সরু তারের মতো ওটা কি হেডফোন? তার একটা প্রান্ত রয়েছে মুখের সামনে। কোন দেশের মানুষ ড. মেডাক! ঝিমলি ভাবে।
কিন্তু প্রফেসার যখন ড. মেডাকের সঙ্গে ঝিমলির পরিচয় করিয়ে দিলেন, তিনি দিব্যি ঝরঝরে বাংলায় ঝিমলির সঙ্গে কথা বললেন। ঝিমলি তো দেখেশুনে তাজ্জব। তারপর জানল, ড. মেডাকের কানে এবং মুখে যে ট্রানস্লেটার যন্ত্রটা ফিট করা আছে, তার সাহায্যে ড. মেডাক যে-কোনো ভাষা বুঝতে এবং বলতে পারে।
দুই
এরপর প্রফেসার ম্যাকাও যখন বললেন, ঝিমলি এই ড. মেডাক কিন্তু আজকের পৃথিবীর মানুষ নন। উনি এসেছেন আগামী পনেরো হাজার চব্বিশ খ্রিস্টাব্দ থেকে। ঝিমলি ভাবল, এই স্বঘোষিত খ্যাপা বিজ্ঞানী প্রফেসার ম্যাকাও তাকে ডেকে এনে রসিকতা করছেন।
কিন্তু প্রফেসার ম্যাকাও ঝিমলির অবিশ্বাসী দৃষ্টির পরোয়া না করেই বলে চললেন, ড. মেডাকও নাকি পেশায় একজন বিজ্ঞানী, যদিও তাঁর অবস্থান আগামী তেরো হাজার বছর ভবিষ্যতে। যে পৃথিবীর সভ্যতা এবং প্রযুক্তিজ্ঞান আজকের থেকে অনেক সহস্রগুণ উন্নত। আর সে কারণে তারা এমন অনেক কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে, যা আজকের দুনিয়ার মানুষ ভাবতে পারবে না। তার মধ্যে একটি হল টাইম মেশিন।
—টাইম মেশিন!
—হ্যাঁ ঝিমলি, যার সাহায্যে ভবিষ্যতের মানুষ ইচ্ছেমতো টাইম ট্রাভেল করতে পারে।
ঝিমলির মনে পড়ল এইচ জি ওয়েল্সের লেখা সেই অসাধারণ ‘টাইম মেশিন’ সায়েন্স ফিকশন উপন্যাসটার কথা, কিন্তু সেটা তো কল্পনা। গল্প। তা কি কখনও সত্যি হতে পারে?
প্রফেসার ম্যাকাও বললেন, বিশ্বাস হচ্ছে না তো? ওই দ্যাখো, জিনিসটা আমার এই গবেষণাঘরের মধ্যেই এখন রয়েছে।
প্রফেসার ম্যাকাওয়ের কথা শুনে ঝিমলি তাকিয়ে দেখল। ঘরের একধারে একটা অদ্ভুত জিনিস রয়েছে।
জিনিসটা দেখতে একটা ফোর-সিটার চৌকো গাড়ির মতো। চারটে চাকাও রয়েছে। আবার দু-পাশে দুটো ডানার মতো কী যেন গুটিয়ে রয়েছে। মাথার উপরে রয়েছে একটা ছোট্ট নব। রংটাও কেমন যেন অদ্ভুত। ঘরের আলোর রঙে যেন মিশে আছে।
ঝিমলি অবাক হয়ে সেই আশ্চর্য বস্তুটার দিকে তাকিয়ে ছিল।
এবার ড. মোডাক বললেন, শোনো ঝিমলি, কেন আমি তেরো হাজার বছর ভবিষ্যৎ থেকে তোমাদের দুনিয়ায় এসেছি।
—কেন? এর বেশি আর কোনো শব্দ বেরুল না ঝিমলির কণ্ঠ থেকে।
ড. মেডাক বলতে শুরু করলেন, বিশেষ দুর্ভাগ্যের কারণে তোমাদের এই সময়ের পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের পনেরো হাজার বছর ভবিষ্যতের পৃথিবীর সম্পর্কটা ছিন্ন হয়ে গেছে। কারণটা অনেকাংশে প্রাকৃতিক এবং দায়ী তোমাদের এই একবিংশ শতাব্দীর মানুষ।
—কী বলতে চাইছেন আপনি? ঝিমলি জিজ্ঞেস না করে পারে না।
—হ্যাঁ, সেটা তো আমায় বলতেই হবে। বললেন ড. মেডাক, আসলে প্রাকৃতিক নিয়মেই এ সময়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের পরিবর্তন ঘটছিল, তার উপর এই একবিংশ শতকে তোমাদের বিজ্ঞান যত এগুচ্ছিল, ততই দ্রুত নষ্ট হচ্ছিল পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য। ক্রমাগত প্রাকৃতিক সম্পদগুলি ধ্বংস করা এবং বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডের মতো ক্ষতিকর গ্যাসগুলির প্রাবল্যে একসময়ে পৃথিবীতে গ্রিন হাউস এফেক্ট শুরু হল। উত্তপ্ত হয়ে উঠল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। এর মধ্যে বিশ্বের দেশে দেশে আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধ—পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিল। বরফ গলতে শুরু করল। পৃথিবীর দুই মেরুতে পৃথিবীর সুউচ্চ পর্বতশ্রেণির শীর্ষ থেকে। পরিণামে বিশ্বময় নেমে এল মহাপ্লাবন। সেই প্লাবনে ডুবে গেল পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চল। ধ্বংস হল মানবসভ্যতার মূলকেন্দ্রগুলি। একই সঙ্গে লুপ্ত হল পৃথিবীর স্থাপত্যকলা। বিভিন্ন মিউজ়িয়ামে সংরক্ষিত মহামূল্যবান নিদর্শনগুলি।
এরপর একটু থেমে ড. মেডাক বললেন, কিন্তু তবু মানুষ এবং মানুষের সভ্যতার অগ্রগতিতে চিরতরে ধ্বংস করতে পারেনি বিশ্বপ্রকৃতি।
প্রফেসার ম্যাকাও এর মধ্যে বললেন, তুমি তো জানো ঝিমলি, বিশ্বপ্রকৃতির কোটি কোটি বছরের ইতিহাসে এমন ভাঙাগড়া বারবার ঘটেছে। সাত কোটি বছর আগে জুরাসিক যুগে একবার ধ্বংস হয়েছিল বিশ্বপ্রকৃতি, লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল দানব ডাইনোসরকুল, কিন্তু বিবর্তনের ধারা বন্ধ হয়নি। সেই বিবর্তনের পথ ধরেই এসেছিল প্রথমে নরবানরের দল, তারপর হোমো স্যাপিয়ান্স বা প্রায়-মানুষের দল।
এসব ইতিহাস জানে ঝিমলি। বিশ্ববিবর্তনের ইতিহাসে এই হোমো স্যাপিয়ান্সদেরই প্রথম মানুষ প্রজাতি ধরা হয়। এরা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ ভূখণ্ডে।
তারপরও বিশ্ববিপর্যয় কখনও থামেনি। কখনও এসেছে আইস এজ, কখনও মহাপ্লাবন। তারপরও অগ্রগতি হয়েছে মানবসভ্যতার।
ঝিমলি মনে মনে এসব কথাই ভাবছিল, কিন্তু বুঝতে পারছিল না, এত হাজার বছর পার হয়ে এই শতাব্দীতে এসে এসব কথা কেন শোনাচ্ছেন ড. মেডাক।
এবার সে কথার উত্তরই শোনা গেল ড. মেডাকের কণ্ঠে, এ অবস্থায় প্রাচীন পৃথিবীর ইতিহাস এবং প্রাচীন সম্পদগুলি ধ্বংস হতে দিতে আমরা পারি না। আর সে কারণেই আমরা আমাদের যন্ত্রগণকের নির্দেশমতো এই শতাব্দীতে এসে প্রফেসার ম্যাকাওয়ের শরণাপন্ন হয়েছি।
—আর আমার ব্রেন এ ব্যাপারে একজনের কথাই বলেছে, সে হল এই ঝিমলি চ্যাটার্জি। বলতে বলতে অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলেন প্রফেসার ম্যাকাও।
ঝিমলির মাথার মধ্যে সব কিছু যেন ঘেঁটে ঘ হয়ে গেল।
প্রফেসার ম্যাকাও বললেন, এ অবস্থায় ড. মেডাক একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
—কী সিদ্ধান্ত? জিজ্ঞেস করল ঝিমলি।
—পৃথিবী প্লাবিত এবং ধ্বংস হবার আগে অতীত শতাব্দী থেকে সংরক্ষণ উপযোগী কিউরিয়ো বা পুরাতাত্ত্বিক দ্রব্যসামগ্রীগুলি নিয়ে যাবেন তাঁর সময়ে। নতুন করে সাজিয়ে তুলবেন তাঁদের সংগ্রহশালা হারানো পৃথিবীর নিদর্শন হিসেবে। কী তা-ই তো, ড. মেডাক?
—হ্যাঁ প্রফেসার। ড. মেডাক বললেন, আর এ ব্যাপারেই আপনার কাছে এসেছি সহযোগিতার জন্য।
ঝিমলির মস্তিষ্কের হ্যাংওভার এখনও কাটেনি। তবু বলল, কিন্তু ড. মেডাক, এ কাজের জন্যে আমাদের সাহায্য আপনার কী দরকার? এ কাজ তো আপনি নিজেই করতে পারেন। এতটা সময় যখন আপনার টাইম মেশিনে আসতে পেরেছেন।
—ঠিকই বলেছেন। ড. মেডাক বললেন, কিন্তু একান্ত এ কাজে আমার সমস্যা দুটি।
—কী সমস্যা?
—প্রথম সমস্যা, এইসব মহামূল্যবান সম্পদ ঠিক কোথায় কীভাবে আছে, আমার জানা নেই। আর দ্বিতীয় সমস্যা, সেগুলি সংগ্রহ করা আমার বা আমার সময়ের মানুষদের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রফেসার ম্যাকাও বললেন, আর ঠিক এই কারণেই আমরা এই টিমটা বানাতে চাই, ঝিমলি। তুমি তোমার ইতিহাসজ্ঞানের পুঁজি থেকে সঠিক কিউরিয়ো বা প্রত্নবস্তুটি চিহ্নিত করে জানাবে। আমরা সেখান থেকে সেটি সংগ্রহ করে এনে ড. মেডাকের হাতে তুলে দেব।
এবার ঝিমলির কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। সে বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে ভাবল। তারপর বলল, এখানে আমার একটা বক্তব্য আছে।
—বক্তব্য! কী বক্তব্য? জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসার ম্যাকাও।
—আমরা বর্তমান পৃথিবীর কোনো সংগ্রহশালা থেকে কোনো প্রত্নসামগ্রী তুলে এনে ড. মেডাকের হাতে তুলে দিতে পারি না। সেটা হবে অনৈতিক। আর অতীত পৃথিবী থেকেও এমন কোনো বস্তু তুলে আনতে পারি না, যা আজকের সংগ্রহশালায় ঠাঁই পেয়েছে। কারণ তাহলে ইতিহাসের পথ পালটে যাবে, যা করা উচিত নয়।
এবার ড. মেডাক এবং প্রফেসার ম্যাকাও মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। ঝিমলির যুক্তি তাঁরা অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু তাহলে উপায় কী?
কয়েক মুহূর্ত এভাবে কাটার পর প্রফেসার ম্যাকাও বললেন, উপায় একটা আছে।
—কী উপায়? প্রশ্ন করল ঝিমলি।
—আমরা বর্তমান পৃথিবীতে সংরক্ষিত কোনো প্রাচীন প্রত্নসামগ্রীতে হাত দেব না। কিন্তু পুরোনো কালে এমন অনেক কিছু ছিল, যা কালস্রোতে হারিয়ে গেছে, যার সন্ধান আজ পাওয়া যায় না। আমরা সেইগুলো খুঁজে তুলে আনব। প্রফেসার ম্যাকাও বললেন।
—কিন্তু তা কী করে সম্ভব? ড. মেডাক সংশয় প্রকাশ করলেন।
—সেটা সম্ভব একমাত্র ঝিমলি চ্যাটার্জির পক্ষেই। তেমন কোনো প্রত্নবস্তুর সন্ধান ঝিমলিকেই দিতে হবে। কী ঝিমলি? এই চ্যালেঞ্জ নিতে তুমি রাজি?
—অবশ্যই। একটুও না চিন্তা করে বলল ঝিমলি। তবে এমন জিনিস খুঁজে বার করার জন্য আমায় কয়েকদিন সময় দিতে হবে।
—তোমায় সাত দিন সময় দেওয়া হল। বললেন প্রফেসার ম্যাকাও।
তিন
ঝিমলি তার গবেষণার পুঁজি থেকে যে সময়টা বার করল, সেটা সপ্তদশ শতাব্দী সঠিকভাবে বলতে গেলে ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে।
এ সময়ে একটা ঘটনা ঘটেছিল। পাটনার নদীতীরবর্তী অঞ্চলে রামদেও পান্ডে নামে এক স্থানীয় ব্রাহ্মণ জমিদার ছিলেন। তাঁর হাবেলিতে ছিল এক মহামূল্যবান প্রাচীন প্রত্নসামগ্রী। সেটা হল এক প্রাচীন পুথি।
এই পুথির সঙ্গে আছে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস।
১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি আক্রমণকারী বখতিয়ার খলজি যখন বিখ্যাত নালন্দা মহাবিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস এবং সম্পূর্ণভাবে দগ্ধ করেন, সেখান থেকে কোনোভাবে রক্ষা পায় এই পুথি।
এই মহামূল্যবান পুথিটি রামদেও পান্ডের সংগ্রহে কীভাবে এল, সেটা ঝিমলি জানতে না পারলেও ওর অনুমান, এই রামদেও পান্ডের সে সময়ের পূর্বপুরুষের সঙ্গে এই নালন্দা মহাবিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সম্পর্ক ছিল এবং সেটি ধ্বংস হবার মুহূর্তে এই একটি পুথি কোনোভাবে সংগ্রহ করে তিনি নিজের কাছে রেখেছিলেন। বংশপরম্পর সেটি পান্ডেদের কাছেই সংরক্ষিত থাকে।
ঝিমলি এরপর ইতিহাসের গলিঘুঁজির মধ্যে থেকে এ তথ্যও খুঁজে পেয়েছে, এই দুষ্প্রাপ্য পুথিটি পান্ডে পরিবারের হেপাজত থেকে খোয়া যায় ১৬৭৫ সালের এক বিশেষ দিনে।
ওইদিনে ঘটেছিল এক বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনা।
ওইদিন পান্ডে পরিবারের এক সদ্যবিধবা গৃহবধূকে জোর করে তার স্বামীর চিতায় তোলা হচ্ছিল। কিন্তু সেদিনের সেই সতীদাহ অনুষ্ঠান থেকে সতী রমণীটিকে তুলে নিয়ে যান জোব চার্নক। তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই প্রতিনিধি পাটনা ইংরেজ কুঠির এক সামান্য কর্মচারী ছিলেন। পরবর্তীকালে এই রমণীকে চার্নক বিবাহ করেছিলেন। এ কথা লেখা আছে ইতিহাসে।
এমন একটি চমৎকার ঐতিহাসিক দুষ্প্রাপ্য সম্পদের খোঁজ পেয়ে প্রফেসার ম্যাকাও উৎসাহে টগবগ করে উঠলেন। বলেছেন, আমরা অনায়াসে সময়যানে সেই সময়ে পাড়ি দিয়ে অন্য কেউ সেই পুথি হস্তগত করার আগে আমরাই নিয়ে আসতে পারি। কী রে নান্টু, পারবি না?
—আলবাত! নান্টু বলল, একবার শুধু আমার খেলটা দেখবেন গুরু। বলে নান্টু দু-হাতের গুলতি ফুলিয়ে দেখাল।
ড. মেডাক মিহি মেয়েলি কণ্ঠে বললেন, লক্ষ্য যখন স্থির হয়েই গেছে, তখন এবার আপনারা প্রস্তুতি শুরু করতেই পারেন। তবে আপনাদের কাজটা সহজ করার জন্য এই বিশেষ যন্ত্রটা আপনাদের তিনজনের হাতে তুলে দিতে চাই। বলতে বলতে যে জিনিসটা উনি প্রফেসার ম্যাকাওকে দিলেন, তার পরিচয় ওরা আগেই পেয়েছে। ড. মেডাক নিজেও তা ধারণ করে আছেন। দেখতে হিয়ারিং এইডের মতো হলেও আসলে তা ট্রানস্লেটার যন্ত্র। ওটা থাকলে ওই শতাব্দীতে পৌঁছেও ওই সময়ের ভাষায় কথা বলতে বা শুনতে অসুবিধা হবে না।
এরপর শুরু হল অভিযানের প্রস্তুতি।
চার
সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করে ওরা চারজন গিয়ে দাঁড়াল সেই টাইম মেশিনের সামনে। এ যাত্রায় অবশ্য ড. মেডাক ওদের সঙ্গী হচ্ছেন না। প্রফেসার ম্যাকাও ইতিমধ্যে ওঁর কাছ থেকে যা কিছু জেনে-বুঝে নিয়েছেন।
ওদের তিনজনকে দেখে অবশ্য এই মুহূর্তে চেনার উপায় নেই। পুরুষ দুজনের পরনে সেই সপ্তদশ শতকের পোশাক—বেনিয়ান, পায়জামা, মাথায় পাগড়ি, দু-কানে মাকড়ি, হাতে মোটা রুপোর বালা। ঝিমলির পরনে সেকেলে বিহার অঞ্চলের নারীদের মতো ঘাগরা। গলায়, হাতে, পায়ে ভারী ভারী রুপোর গহনা। এর মধ্যে অবশ্য ট্রানস্লেটার যন্ত্রটা নিতে ওরা কেউ ভোলেনি।
সময় গাড়িতে ওঠার আগে ড. মেডাক শেষবারের মতো সাবধান করে দিলেন, একটা কথা আপনারা মনে রাখবেন, এই টাইম মেশিন চালিত হয় সম্পূর্ণভাবে সোলার এনার্জি সিস্টেমে। এই সময় গাড়ি নির্দিষ্ট স্থানকালে পৌঁছে নির্দিষ্ট সময়টুকুই অপেক্ষা করবে। এই সময়ের মধ্যে যাত্রীরা না উঠলে, এই সময় গাড়ি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিরে আসবে, যে স্থানকাল থেকে সে যাত্রা করেছিল, সেখানে।
শুনে ঝিমলি চোখ কপালে তুলে বলল, সে কী! এদিক-ওদিক হলে তো আমরা সেই শতাব্দীতেই পড়ে থাকব, ড. মেডাক।
প্রফেসার ম্যাকাওকেও কিছুটা চিন্তিত মনে হল।
ড. মেডাক আশ্বস্ত করে বললেন, আশা করি, তেমন দুরবস্থা তোমাদের হবে না। হলেও উপায় আছে। কিন্তু সেসব কথা নিয়ে আপাতত আলোচনার প্রয়োজন নেই।
নান্টু নস্কর একগাল হেসে বলল, সেখানে থেকে গেলেও আমার কোনো অসুবিধে নেই, কোনো নবাব-বাদশার সেনাদলে ভিড়ে যাব।
প্রফেসার ম্যাকাও তাকে এক ধমকে থামিয়ে দিলেন।
এরপর ওরা সময়-গাড়িতে উঠে বসল।
ভেতরে নানারকম যন্ত্রপাতি। কোনোটা সময়নির্দেশক, কোনোটা দিক্নির্দেশক। নানা ধরনের ঘড়ি, আলো, লিভার।
প্রফেসার ম্যাকাও টাইম মেশিনের ডেট অ্যান্ড ডেস্টিনেশন অর্থাৎ সময় এবং পৃথিবীর অক্ষাংশ, দ্রাঘিমারেখা নির্দেশিত অবস্থান নির্দিষ্ট করে লিভারে চাপ দিতেই টাইম মেশিন সচল হল।
সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। কয়েক মুহূর্তে আশপাশের সব দৃশ্য মুছে গেল। আকাশের সূর্যটা যেন অনবরত জ্বলতে-নিবতে শুরু করল। চন্দ্রোদয়-চন্দ্রাস্ত হতে লাগল ক্ষণেক্ষণে। একসময় টাইম মেশিন দু-পাশের ধাতব ডানা বিস্তার করে উড়ে চলল স্থানান্তরে। তারপর নেমে এল রুক্ষ মাটিতে। প্রাকৃতিক দৃশ্যও বদলে যাচ্ছে বারবার। তারপর একসময়ে পাশে এসে হাজির হল নদীর স্রোতধারা। তারপর হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে টাইম মেশিন থেমে গেল।
ঝিমলি দেখল, তার সামনের সময়নির্দেশক ঘড়ি সময় জানাচ্ছে ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দ। ২ জুন।
পাঁচ
এটা একটা নদীতীরবর্তী এলাকা। চারদিকে ন্যাড়া প্রান্তর। মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়। ছোটো ছোটো পাহাড়ি ঢিপি।
ওরা তিনজন সময়-গাড়ি থেকে নেমে এল। প্রফেসার ম্যাকাও তাঁর হাতের স্থাননির্দেশক যন্ত্রটা দেখে বললেন, এটা পাটনা শহরের প্রান্ত। পাশে ওই নদীটা গঙ্গা।
তার মানে ঠিক জায়গায় পৌঁছোনো গেছে।
কিছু দূরে একটা পাটকিলে রঙের দোতলা হাবেলি চোখে পড়ল।
ঢাকঢোল এবং বহু কণ্ঠের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে দূরে। টাইম মেশিনটা একটা টিলার আড়ালে লুকিয়ে রেখে ওরা তিনজন একটা ঝোপের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। সেখান থেকেই দেখতে পেল, নদীর ধারে এক জায়গায় অনেক লোক জড়ো হয়েছে। সেখানে একটা চিতা সাজানো রয়েছে। চিতায় শোয়ানো আছে এক সুপুরুষ যুবকের মৃত শরীর। চিতাশয্যাটি ঘিরে বাজছে ঢাকঢোল। কিছু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করছে।
হঠাৎ এক মেয়েলি কণ্ঠে বিলাপ শোনা গেল। ওরা তিনজন কান্না লক্ষ করে ফিরে তাকাল। সেখানে এক মর্মস্পর্শী দৃশ্য।
এক সুন্দরী তরুণী। পরনে লালপাড় সাদা শাড়ি, কপালে চওড়া সিঁদুর। তাকে জনাকয়েক বয়স্কা মহিলা ধরে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে আসছে গঙ্গার ধারে। তরুণী ক্রন্দনরতা।
তাকে আসতে দেখে পুরোহিতদের মন্ত্রপাঠ যেন আরও উচ্চগ্রামে শুরু হল।
—সতীদাহ হতে চলেছে, ঝিমলি চ্যাটার্জি বলল, এর মানে আমরা সঠিক স্থানকালেই এসে পৌঁছেছি, প্রফেসার। আমার পাওয়া তথ্য অনুসারে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটবে।
ইতিমধ্যে সেই সদ্যবিধবা তরুণীটিকে চিতার কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়েছে। এবার ওকে শুইয়ে দেওয়া হবে চিতায় তার মৃত স্বামীর পাশে। তারপর চিতায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে। এইভাবেই স্বামীর সঙ্গে জীবন্ত দাহ হয়ে ‘সতী’ হবে সেই বিধবা তরুণী।
উপস্থিত পুরোহিত এবং আত্মীয়স্বজনরা সেই সদ্যবিধবাকে জোর করে চিতায় তোলার চেষ্টা শুরু করল। আর সে কান্না ঢাকার জন্যে আরও জোরে বাজতে লাগল ঢাকঢোল।
আর তখনই শোনা গেল বন্দুকের গুলির ফাঁকা আওয়াজ—গুড়ুম।
ভেসে এল অনেকগুলো ঘোড়ার খুরের শব্দ।
ছুটে আসছে একদল অশ্বারোহী। তারা শ্বেতাঙ্গ ফিরিঙ্গি। তাদের নায়ক এক ফিরিঙ্গি যুবক। মাথায় টুপি, পরনে লাল জ্যাকেট।
—ওই সাহেবই কি জোব চার্নক? প্রফেসার ফিশফিশ করে জিজ্ঞেস করলেন।
—হ্যাঁ প্রফেসার, ঝিমলি চ্যাটার্জি বলল, আমার পুরোনো পুথির তথ্য মিলে যাচ্ছে। সেখানে লেখা আছে, ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে জোব চার্নক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পাটনা কুঠির একজন কর্মচারী মাত্র ছিলেন। এ সময়ে একদিন তিনি এখানকার এক বিধবা হিন্দু তরুণীকে সতীদাহ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যান, পরে তাকে বিবাহ করেন। ইতিহাসের সেই দৃশ্যটাই বোধহয় এখন আমরা নিজের চোখে দেখতে চলেছি।
নান্টু নস্কর বলল, আমার তো মনে হচ্ছে, সাহেবের সঙ্গে আমিই গিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করি। এমন নিষ্ঠুর দৃশ্য চোখে দেখা যায় না, স্যার।
—খবরদার, নান্টু। এ সময়ে এখানে এসে অকারণ মস্তানি দেখাবার চেষ্টা করবে না। ইতিহাসকে বদলাবার ক্ষমতা আমাদের নেই।
—ঠিক বলেছেন প্রফেসার। ঝিমলি বলল।
—গুড়ুম… গুড়ুম… চার্নকের ঘোড়সওয়াররা ইতিমধ্যে চিতাস্থান ঘিরে ফেলেছে। বারকয়েক শূন্যে গুলি ছুড়ে দেশি লোকেদের ভয় দেখাতে শুরু করেছেন চার্নক সাহেব।
ঘটনার আকস্মিকতায় সতীদাহের আয়োজকরা যেন থমকে যায়। জোব চার্নক ততক্ষণে ঘোড়া থেকে নেমে সেই সদ্যবিধবা তরুণীর দিকে এগিয়ে যায়। বোঝা যাচ্ছে তাঁর উদ্দেশ্য সতীদাহ বন্ধ করা।
ঠিক সেই মুহূর্তে ওদিককার হাবেলি থেকে ছুটে আসতে দেখা গেল একদল দেশি পাইক বরকন্দাজকে। ওদের অগ্রবর্তী ব্যক্তিটির চেহারা-পোশাক দেখে বোঝা গেল সেই ব্যক্তি ওই হাবেলির মালিক। তার মানে উনিই সেই ঐতিহাসিক পুরুষ রামদেও পান্ডে। এরই পুত্রবধূ আজ ‘সতী’ হতে চলেছে।
রামদেও চিৎকার করে যা বলল, তা বাংলা করলে দাঁড়ায়—ফিরিঙ্গি সাহেব, তুমি যাও এখান থেকে। আমার পুত্রবধূ ‘সতী’ হতে চলেছে। তুমি বাধা দিতে পারো না।
চার্নক গর্জন করে বলল, আলবাত বাধা দেব। তোমরা একটা জ্যান্ত মেয়েকে জোর করে পুড়িয়ে মারছ। আমি তা কিছুতেই হতে দেব না।
রামদেও চিৎকার করে বলল, অ্যাই, তোরা দেখছিস কী? ওই লালমুখো ফিরিঙ্গিদের মেরে হটিয়ে দে। ওরা আমাদের ধর্ম নষ্ট করতে এসেছে।
এর মধ্যে সেই বিধবা তরুণী কেঁদে উঠল, সাহেব… সাহেব আমায় বাঁচাও।
এরপর দু-পক্ষে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
প্রফেসার ম্যাকাও এবার এবার উত্তেজিতভাবে বললেন, নান্টু, এটাই সুযোগ। ওরা সবাই এখানে ব্যস্ত। চলো, এই সুযোগে আমরা হাবেলির মধ্যে ঢুকে পড়ি। খুঁজে বার করতে হবে নালন্দা মহাবিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দুর্মুল্য পুথি, যা রামদেও পান্ডের হেপাজতে আছে। ঝিমলি, তুমি ওকে সাহায্য করো।
ঝিমলি বলল, প্রফেসার, আপনাকে ওখানে যেতে হবে না। আপনি বরং টাইম মেশিনের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করুন। কেউ হঠাৎ গিয়ে না ক্ষতি করতে পারে।
—ঠিক আছে। তোমরা যাও।
এরপর খেল দেখাল নান্টু নস্কর। ওর শরীরে হাতির বল।
এ সময়ে ফিরিঙ্গিদের হাতে সতীর মর্যাদা রাখতে হাবেলির সবাই বেরিয়ে গেছে। জনাকয়েক মাত্র পাইক আর নারী-শিশু আছে।
নান্টু সহজেই সেই পাইকদের কাবু করে বেঁধে ফেলল আর অন্য যারা ছিল, তাদের একটা ঘরে ঢুকিয়ে বন্দি করল।
এরপর ঝিমলি আর নান্টু গিয়ে ঢুকল রামদেও পান্ডের শয়নকক্ষে। কারণ সে জানে, আগেকার দিনে মানুষ তাদের মূল্যবান সম্পদ শয়নকক্ষে লোহার সিন্দুকে রেখে দিত।
এমন একটা সিন্দুকের সন্ধান এখানেও পাওয়া গেল।
সেই সিন্দুকের সামনে ঝুলছে একটা ভারী লোহার তালা, যা কোনো মানুষের পক্ষে ভাঙা সম্ভব নয়। কিন্তু নান্টু নস্করের শরীরে বোধহয় দশ হাতির বল। সে কোথা থেকে একটা মোটা লোহাদণ্ড এনে সেটার সাহায্যে ভেঙে ফেলল সিন্দুকের তালা।
এরপর সেই সিন্দুকের ডালা তোলা হল। ভেতরে প্রচুর সোনার মোহর আর একধারে একটা সুবর্ণপেটিকা। সেটা তুলে নান্টু ঝিমলির হাতে দিল। ঝিমলি সেই পেটিকা খুলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল দুই কাষ্ঠ আবরণীর মধ্যে একটি তালপাতার পুথি। পরস্পর সোনার সুতোয় বাঁধা।
ঝিমলির দু-চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, হ্যাঁ, এই তো। এটাই সেই নালন্দার অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষা-পাওয়া পুথি। নান্টুদা চলো, এবার এটা নিয়ে চটপট ফিরতে হবে।
—ম্যাডাম, এখানে এত সোনার মোহর, এগুলো ফেলে যাব?
—হ্যাঁ নান্টুদা। আর কোনো জিনিসে হাত দেওয়া যাবে না। চলো।
অগত্যা বিরস মুখে নান্টু ঝিমলিকে অনুসরণ করল।
হাবেলির বাইরে তখনও গঙ্গাতীরে দু-পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ চলছে।
এরই মধ্যে হঠাৎ নজরে পড়ল, চার্নক সাহেব ছুটে গিয়ে হঠাৎ চিতার সামনে থেকে সেই সদ্যবিধবা তরুণীকে নিজের ঘোড়ার পিঠে তুলে নিয়ে তীব্র গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন।
আচমকা এই ঘটনায় সবাই হতচকিত। হাবেলির মালিক রামদেও পান্ডে তার পাইক-বরকন্দাজদের হুকুম করল ওই ফিরিঙ্গি সাহেবকে অনুসরণ করে ‘সতী’-কে ছিনিয়ে নিতে… কিন্তু তার কথা শেষ হল না। তার আগেই এক ফিরিঙ্গি সিপাইয়ের বন্দুকের গুলি এসে বিদ্ধ হল রামদেও পান্ডের বুকে। তীব্র আর্তনাদ করে তার রক্তাক্ত শরীরটা গুটিয়ে পড়ল।
ঝিমলি বলল, নান্টুদা, আর এখানে নিরাপদ নয়। চলো।
ওরা ফিরে গেল টিলার পাশে।
সেখানে প্রফেসার ম্যাকাও অপেক্ষা করে ছিলেন টাইম মেশিনটার ভেতরে। ওরা দুজন পুথিটা দেখিয়ে সব বলল।
প্রফেসার আর দেরি করলেন না। তিনি আবার পৃথিবীর দ্রাঘিমা-অক্ষরেখায় নির্দেশ করে সময় ঘড়িতে একবিংশ শতকের সঠিক তারিখ-সময় লগ-ইন করে লিভারে চাপ দিলেন। সময়-গাড়ি আবার ফিরে চলল তার ভবিষ্যতের ঠিকানায়।
ছয়
একসময়ে টাইম মেশিনের যাত্রা শেষ হল। ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল সময়-গাড়ি।
ওরা তিনজন বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। ওরা সেখানেই এসে পৌঁছেছে, যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। রাজারহাটে এগারোতলা ফ্ল্যাটের টপ ফ্লোরে প্রফেসার ম্যাকাওয়ের গবেষণাগারে।
সময়-গাড়ি থেকে বেরুতেই ওরা ড. মেডাকের মুখোমুখি হল। তিনি শোফায় বসে ছিলেন। উনি সময় দেখে মুচকি হেসে বললেন, আমায় মাত্র এক মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
—আই বাপ! মাত্র এক মিনিট! তার মধ্যে এত কাণ্ড হয়ে গেল। নান্টু নস্কর চোখ কপালে তুলে বলল।
প্রফেসার ম্যাকাও বললেন, অবাক হবার কিছু তো নেই, নান্টু। সময়কে ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করার যন্ত্র আমরা যখন পেয়েছি, আমরা সময়ের আগে-পরেও পৌঁছোতে পারতাম।
—ঠিক বলেছেন প্রফেসার, ড. মেডাক বললেন, টাইম ইজ় দ্য ফোর্থ ডাইমেনশন। তেরো হাজার বছরের ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান একে করায়ত্ত করতে পেরেছে।
—তার মানে আপনারা ত্রিকালদর্শী। ঝিমলি বলে।
—হ্যাঁ বলতে পারো। তোমাদের দেবাদিদেব মহাদেবের মতোই টাইম মেশিনের সাহায্যে ফোর্থ ডাইমেনশনের পথ ধরে যে-কোনো সময়ে পৌঁছে যেতে পারি। তার প্রমাণ তো তোমরা পেয়েছ।
ইতিমধ্যে প্রফেসার ম্যাকাও সপ্তদশ শতক থেকে সংগ্রহ করে আনা সেই নালন্দা মহাবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন পুথিটি ড. মেডাকের হাতে তুলে দিলেন।
ড. মেডাক অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য সেই পুথিটা হাতে নিলেন। একটু নেড়েচেড়ে দেখলেন, তারপর কাঠের আবরণের ভেতর থেকে সোনালি সুতোয় গাঁথা তালপাতার লিপিগুলো বার করলেন। তালপাতায় পুথির লেখা দুর্বোধ্য। ঝিমলিও পাঠোদ্ধার করতে পারেনি। কিন্তু ড. মেডাক কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে সেই পুথির অক্ষরগুলির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, এ লিপির ভাষা এখন থেকে বারোশো বছর আগে মগধ অঞ্চলে প্রচলিত অর্ধ-মাগধী। এই পুথির নাম ভিষক সর্বার্থসিদ্ধি। রচনাকারের নাম দেখছি ভিষকাচার্য। বোধহয় ছদ্মনাম।
উপস্থিত তিনজনই হতবাক। ঝিমলি বলল, ড. মেডাক, যে লেখা আমিও পড়তে পারলাম না, তা আপনি এত তাড়াতাড়ি পড়লেন কী করে?
ড. মেডাক বললেন, আগামী তেরো হাজার বছরের ভবিষ্যৎ মানুষ এই বিদ্যা আয়ত্ত করে ফেলেছে। আমরা আমাদের ট্রানস্লেটার যন্ত্রে শুধু অন্য ভাষার কথা নয়, লেখাও পড়ে ফেলতে পারি।
প্রফেসার ম্যাকাও বললেন, একবার আপনাদের ভবিষ্যৎ দুনিয়া থেকে ঘুরে আসার ইচ্ছে রইল।
—উইথ প্লেজ়ার। ড. মেডাক বললেন, আপাতত আপনারা আমায় অতীতের যে মহামূল্যবার বস্তুটি এনে দিয়েছেন, তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আপনাদের সামান্য উপহার দিতে চাই।
—কী উপহার, স্যার? নান্টু নস্করের উৎসাহ মনে হল, উথলে উঠল।
ড. মেডাক উত্তর না দিয়ে তাঁর সঙ্গের ঝোলা থেকে যা বার করলেন, তা আকারে চার ইঞ্চি দৈর্ঘ্য-প্রস্থের তিনটি নিরেট সোনার বাঁট। তিনি সেগুলো ওদের দিকে এগিয়ে দিলেন।
দেখে তো তিনজনেরই চোখ যাকে বলে ছানাবড়া। ঝিমলি বলল, এ তো অনেক মূল্যবান, ড. মেডাক।
—হ্যাঁ, তোমাদের কাছে মূল্যবান বটে, কিন্তু আমাদের কাছে এটা মূল্যহীন। ড. মেডাক বললেন।
—মূল্যহীন! কী বলছেন মাইরি স্যার! নান্টু নস্কর বলল।
—হ্যাঁ। এ আমরা যে-কোনো সময়ে আমাদের ল্যাবরেটরিতে তৈরি করতে পারি।
—কী করে, স্যার? নান্টু নস্করের বিস্ময় যাচ্ছে না, আপনারা কি ভবিষ্যতে কোনো পরশপাথরের পাহাড় আবিষ্কার করেছেন?
—আরে না, ড. মেডাক বললেন, আসলে আমরা আমাদের গবেষণাগারে একটি পরমাণু কণার মধ্যে নিউটন, প্রোটন এবং ইলেকট্রনের উপস্থিতির প্রয়োজনীয় তারতম্য ঘটিয়ে তৈরি করতে পেরেছি চাহিদামতো মৌল পদার্থের পরমাণু। সেই এক বা একাধিক পরমাণুর সংযোগ ঘটিয়ে ইচ্ছেমতো তৈরি করতে পারি সোনা, রুপা, লোহা, গন্ধক কিংবা হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ইত্যাদির মৌল। তাই প্রয়োজনমতো সোনা তৈরিতে আমাদের অসুবিধে নেই, যা তোমাদের শতাব্দীর মানুষরা এখনও ভাবতে পারে না।
শুনতে শুনতে প্রফেসার ম্যাকাওয়ের ট্যারা চোখ আরও ট্যারা হয়ে গেল। আমতা আমতা করে শুধু বললেন, ব্যাপারটা থিয়োরি হিসেবে ভাবা গেলেও আজকের বিজ্ঞান এখনও সফল হয়নি।
সাত
এবার গল্পের উপসংহার।
ড. মেডাক তাঁর কার্যসিদ্ধি করে টাইম মেশিনে সওয়ার হয়ে নিজের শতাব্দীতে ফিরে গেছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আবার আসবেন।
আপাতত তিনজন হাতে তিনটে সোনার বাঁট নিয়ে ভাবছে, কীভাবে সদ্ব্যবহার করবে। প্রফেসার এবং ঝিমলি এটি বিক্রি করে সেই অর্থ তাদের গবেষণার জন্য ব্যয় করার কথা ভাবলেও নান্টু নস্কর ভেবেছে, এই অর্থে তার টালিগঞ্জের পুরোনো বাসাবাড়ি ছেড়ে গড়িয়ার দিকে একটা ফ্ল্যাট কিনবে। তারপর বিয়েটা সেরে নেবে, এটা তার অনেক দিনের শখ।
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়