হলুদ পলাশ
লেখক: দীপেন ভট্টাচার্য
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
এই সময়ে এই শহরে বসন্ত আসার কথা। কিন্তু পৃথিবীর এই অক্ষাংশে, এই দ্রাঘিমায়, বসন্ত কোনো একসময়ে ছিল কি না, নাগরিকেরা মনে করতে চায়। বসন্ত ঠিক কী বা কেমন ভাবতে চায়। তারা শুনেছে, এখানে বসন্তে পলাশ ফুটত, শিমুল ফুলে গাছ হত লাল। কিন্তু পলাশ বা শিমুল গাছ তারা এখন আর চেনে না, শোনা যায়, শহরের দক্ষিণ উপান্তে একটা পলাশ গাছ আছে। তাতে বসন্তে লাল ফুল আসে। অমল এসব শুনে হাসে, তার ছাদে সে যত্ন করে একটা পলাশ গাছ বাঁচিয়ে রেখেছে, তাতে প্রতি বসন্তে ফুল হয়। লাল নয়, হলুদ ফুল। কীভাবে হয়, সে জানে না।
একটা ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে হাঁটে অমল, শাহপুর আলারিজ তাকে বেলা এগারোটায় আসতে বলেছে। নবরূপক রোডে। দূরে কিছু মানুষ জটলা বাঁধে। তাদের থেকে স্লোগান ভেসে আসে, কিছু একটা—‘মানতে হবে’ অথবা ‘মানি না’। এই শেষ সকালেই রাস্তা থেকে গরম ভাপ উঠছে, তার মধ্য দিয়ে দূরের জটলাটা প্রতিসরিত হতে থাকে, দোলে, চকমক করে। অমল নিস্পৃহভাবে তার অলীক বুদ্বুদের মধ্য দিয়ে ওই মানুষগুলো দ্যাখে—তারাও কি অলীক? শূন্য থেকে অলীক কণাদের আবির্ভাব হয়, তার পরমুহূর্তেই আবার শূন্যে মিলিয়ে যায়। চোখ বুজলে কি ওই মিছিল অন্তর্হিত হবে? দাবি মানা বা না-মানার শব্দতরঙ্গ বাতাসে সৃষ্টি করবে না আন্দোলন?
পৃথিবীর মধ্যে তার অস্তিত্বকে সে একটা বুদ্বুদের মধ্যে বসবাসের সঙ্গে তুলনা করে, যদিও সে জানে, সেই বুদ্বুদটা অনায়াসেই ফুটো হয়ে যেতে পারে, শুধুমাত্র একটা অলীক পৃষ্ঠটানে সেই বুদ্বুদ তার আকারটি ধরে রেখেছে। এই পৃষ্ঠটানটি নিতান্ত তার বিশ্বাসের উপর রচিত, বিশ্বাস ভেঙে গেলে বুদ্বুদটি অদৃশ্য হবে, এবং সে পৃথিবীর বাস্তবতাকে মেনে নিতে বাধ্য হবে। ‘সত্য যে কঠিন’—না, সেই কাঠিন্যের মুখোমুখি হতে সে প্রস্তুত নয় এখনও।
দুই
ব্যস্ত রাস্তা নবরূপক রোড। শাহপুরের অফিসটি রাস্তার উপরেই, ‘ভুবন ভিস্তা’ নামে একটা দশতলা বিল্ডিং-এর নীচের তলায়। একটা নিরেট ধাতব দরজা, পাশে কলিং বেল। বেল বাজালে দরজা খুলে দেয় বছর পঞ্চাশের এক নারী, শাহপুরের সহকারী। চুলের সিঁথির দু-পাশে কয়েকটা সাদা চুল, কালোর বিছানায় ছড়ানো। মুখাবয়বে আত্মপ্রত্যয়। ঘরটি খুব বড়ো নয়, শাহপুরের সহকারীর টেবিল একদিকে, সেটার সামনে ও পাশে গোটা পাঁচেক নিতান্ত উপযোগী, আড়ম্বরহীন, ধাতব চেয়ার। দেয়ালে একটা প্রতিষ্ঠানের নাম ও লোগো—‘শাহপুর ডাইনামিক্স’ কথাটা লেখা একটা পদ্ম ফুলের উপর। অমল খেয়াল করে, ফুলটির মধ্যে একটা ‘অসীমের চিহ্ন’ লুকিয়ে আছে। শাহপুরের সহকারীর নাম রত্না সাবেক, টেবিলে তার নামফলক। একটা চেয়ারে বসে শাহপুরের জন্য অপেক্ষা করে অমল। মনে মনে উচ্চারণ করে ‘সাবেক… সাবেক’, কোথাও কি শুনেছে এই পদবিটি? অফিসঘরটির এই সাদামাটা চেহারা অমল আশা করেনি। শাহপুরের কাজ সম্বন্ধে সে যতটুকু আন্দাজ করতে পেরেছে, তাতে মনে হয়েছে, সেখানে বহু মানুষ নিয়োজিত থাকবে, দেওয়াল ঝলকাবে নিয়ন আলোয়, ছাদ থেকে ঝুলবে সর্বাধুনিক এলইডি। এই অফিসটি মনে হল পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে।
শাহপুর ঢোকে মিনিট পাঁচেক পরে। সাদা ল্যাব কোট-পরা, মাথায় ল্যাবের কাপড়ের টুপি, চোখে পুরু লেন্সের চশমা। বলে, ‘সরি, তোমাকে বসিয়ে রাখলাম।’
শাহপুর তাকে পেছনের একটা ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে পাঁচজন পাঁচটা বেঞ্চের উপর কাজ করছে, তাদের সামনে গণকযন্ত্র, পাশে বৈদ্যুতিন বোর্ড। প্রতিজনের দৃষ্টি গণকযন্ত্রের স্ক্রিনে একাগ্র মনোযোগে আবদ্ধ। অমল ওই ঘর থেকে বের হবার আর কোনো দরজা দেখে না। তার বিভ্রান্তিতে শাহপুর হাসে, বলে, ‘ভাবছ এই হল “শাহপুর ডাইনামিক্স”? আসলে এ হল যাকে বলে ফ্রন্ট, সামনের দিকে লোক দেখানো।’
এটা বলতে বলতেই শাহপুর ঘরটির পেছনের দেয়ালে এক জায়গায় হাত রাখে। দেয়ালের একটা অংশ, যেটা ছিল একটা দরজার আকারের মতন, ভেতরে ঢুকে পাশে সরে গেল। দরজার ও পাশে নীচে নামার সিঁড়ি। সেখানে বাতি জ্বলে ওঠে, শাহপুর পথ দেখিয়ে নীচে নামে, অমল অনুসরণ করে। গোটা দশেক ধাপ নামার পরেই সিঁড়িটা শেষ হয়ে যায় আর-একটা দেয়ালের সামনে। শাহপুর দেয়ালের একপাশে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় হাত রাখে, দেয়াল সরে যায়।
সামনে আলোকোজ্জ্বল লম্বা করিডর। তারা দুজন হাঁটে, দু-পাশে কাচের জানালার ওপারে সারি সারি কামরা—গবেষণাগার, সেখানে কোনো ঘরে ল্যাব কোট-পরা কর্মীরা মিটিং করছে, কোনো ঘরে বোর্ডে কী সব লিখে জটলা করে আলোচনা করছে, আবার কোথাও ধাতব অংশকে ঝালাই করে জোড়া লাগাচ্ছে। অমল আশ্চর্য হয়, এত বড়ো কর্মকাণ্ড শাহপুর কেমন করে বাইরের জগৎ থেকে আড়াল করে রেখেছে। শাহপুর আলারিজ—তুমি কেমন করে এই বিশাল সাম্রাজ্য তৈরি করলে?
‘এসব করতে পয়সা লাগে, তুমি জানো।’ করিডরের শেষ প্রান্তে একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে শাহপুর বলে। দরজার উপরে লেখা ‘নির্বাণ চেম্বার’। দরজার একটা অংশে হাত রাখে সে, দরজাটা খুলে যায়। একটা বড়ো ঘর, মাঝখানে কয়েকটি সোফা। ‘আমাদের দেশের কিছু মানুষ বিনিয়োগ করেছে, কিন্তু তারা পুরো ব্যাপারটা জানে না। তাদেরকে সব খুলে বললে তারা পিছিয়ে যাবে, অথবা হইচই করে সব নষ্ট করে দেবে। বাইরে থেকে ফান্ডিং আসে, কিন্তু টাকাটা সরকারিভাবে আনা যায় না।’
ঘরটির একপাশে একটা লম্বা শেল্ফ, তার উপর কফির সরঞ্জাম রাখা, সেদিকে যেতে যেতে শাহপুর বলে, ‘কফি খাবে?’ শাহপুর ডাইনামিক্সের কফি কেমন হবে, সেটা পরখ করতে চায় অমল।
কাপে কফি ঢালে শাহপুর, বলে, ‘বাইরের থেকে কিছু টাকা আসে সরকারি পথে, তাতে রত্না সাবেক আর উপরের ঘরটার পাঁচজনের মাইনা হয়, তুমি তাদের দেখেছ। আর এই নীচে কাজ করে প্রায় পনেরোজন, খুবই মেধাবী উচ্চশ্রেণির বিজ্ঞানী প্রকৌশলী। এদের মধ্যে অর্ধেক আবার নিউরোবিজ্ঞানী। এদের যেরকম ক্ষমতা, তারা পৃথিবীর যে-কোনো জায়গায় কাজ করতে পারত, আর এখানে তারা জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ করে, অর্থাৎ ঘরটাও তাদের ঝাড়ু দিতে হয়। নীচের এই অংশটা সম্পর্কে আমরা কোম্পানির মাত্র বাইশজন জানে, আর আজ তুমি জানলে, আর “নির্বাণ চেম্বারে” কী আছে, তা উপরের লোকগুলোও জানে না।’
কফি নিয়ে তারা সোফায় বসে। অমল কফিতে চুমুক দিয়ে বলে, ‘বাহ্!’ শাহপুর বলল, ‘দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের সেইন্ট হেলেনা দ্বীপের কফি, এখানে পাওয়া যায় না।’ ঘরের আলোটা মৃদু, ঠিক কোথা থেকে আসছে, সেটা অমল ধরতে পারে না। একটা খুব আস্তে হালকা বাজনা ভেসে আসছিল, বাংলা গানই মনে হল, কিন্তু কথাগুলো বোঝা যাচ্ছিল না। চারটে দেয়ালে চারটে বড়ো বড়ো চিত্রকর্ম।
‘এগুলো সবই রিপ্রডাকশন, নকল। এই ঘরটাতে আমার একটা মুড সৃষ্টি করা দরকার ছিল, এমন একটা ব্যাপার—যাতে মনে শান্তি আসে, স্বস্তি পাও।’ শাহপুর বলে।
শাহপুরের কথাগুলোর সত্যতা যেন সঙ্গে সঙ্গে অনুভূত হল, বাইরের আন্দোলন ও বিশৃঙ্খলার পৃথিবীকে মনে হল অনেক দূরে। এরপরে শাহপুর তার ফোনটা বের করে তাতে কিছু বলল। একটা দেয়ালের কিছুটা অংশ সরে যায়, সেখান থেকে ঘরে প্রবেশ করল এক নারী। পঞ্চাশ/পঞ্চান্ন হতে পারে বয়স, প্যান্ট-শার্ট পরা। রত্না সাবেকের মতনই চেহারা, চমকায় অমল। নারী দূর থেকেই সম্ভাষণ করে, ‘হ্যালো।’ এরপরে সে খুব ধীরে সোফাগুলোর কাছে আসে, দ্বিধাগ্রস্ত হাঁটা, যেন সে ব্যালেন্স রাখার ব্যাপারে নিশ্চিত নয়, যদিও তার মুখভঙ্গিমায় কোনো পরিবর্তন হয় না। শাহপুর তাকে হাত দেখিয়ে উলটোদিকের সোফাতে বসতে ইঙ্গিত করে। ঘটনাটির জন্য অমল একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, কিছুটা অশোভনীয়ভাবেই নারীটির দিকে চেয়ে রইল।
‘অমল, তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি হলেন ইকশিতা।’
‘ঈপ্সিতা?’
‘ঈপ্সিতা নয়, ইকশিতা।’ ভুল শুধরে দেয় শাহপুর, ‘একে তুমি অমল সান বলতে পারো, ইকশিতা।’ ইকশিতা হাসে, সেই হাসির মধ্যে আড়ষ্টতা অমলের অলক্ষিত থাকে না। ‘ইকশিতা সবে আমাদের কোম্পানিতে ঢুকল, ও এখনও ট্রেনিং-এ আছে। আর তোমাকে ডাকা এইজন্য যে, তুমি আজ থেকে ওর একজন ট্রেনার হবে।’
অমল ব্যাপারটার মাথামুণ্ডু করতে পারে না, তার বলতে গেলে কোনো বিষয়েই বিশেষ কোনো দক্ষতা নেই। ‘আমি কী করব…’ সে বলতে যায়।
শাহপুর তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘এখানে যারা কাজ করে, তারা বাইরের জগতের আর খবর রাখে না, আমিও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বলা যায়। এখানে দিনে অন্তত চোদ্দো ঘণ্টা থাকি। সূর্যের আলো দেখি না। কিন্তু তুমি তো দ্যাখো। তুমি ওকে পৃথিবী চেনাতে পারবে।’
অমল কী বলবে, বুঝে পায় না। একটি প্রাপ্তবয়স্কাকে পৃথিবী চেনানোর কী আছে?
‘আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না…’ বিড়বিড় করে অমল। অমলকে উদ্ধার করতেই ইকশিতা বলে ওঠে, ‘আসলে আমি আপনাদের মতো মানুষ নই।’ এই বলে ইকশিতা তার দুটো হাত তুলে ধরে, দুটো তালু দেখায় অমলকে। সেখানে কোনো দাগ নেই, আঙুলের করও নেই। অমল চমকায়, ইকশিতা খিলখিল করে হাসে, বলে, ‘ঘাবড়াবেন না, এসব সামান্য জিনিস, হাতের দাগ দিয়ে কি মানুষকে মানুষ প্রমাণ করা যায়? আমাকে বরং আপনি একটা চিমটি কাটুন?’ ইকশিতা উঠে এসে অমলের পাশে বসে। হাতটা বাড়িয়ে দেয়, বাঁ হাত দিয়ে কড়ে আঙুলের নীচের অংশটা দেখায়, ‘এখানে কাটুন।’
অমল বুঝে পায় না, কী করবে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে বিমূঢ়। শাহপুর বলে, ‘চিমটি কাটো, তোমার একটা জিনিস বোঝার আছে।’ অমল কিংকর্তব্যবিমূঢ়! ইকশিতা একটা হাসিমুখ নিয়ে অপেক্ষা করে, শাহপুর আবার তাগাদা দেয়। অমল দ্বিধাভরে তার ডান হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ইকশিতার তালুতে আস্তে করে চাপ দেয়, ইকশিতা চাপা চিৎকার করে ওঠে, ‘উফ, এত জোরে কাটতে বলেছি।’ অমল অপ্রস্তুত হয়, ইকশিতা খিলখিল করে হাসে, বলে, ‘ঠাট্টা বোঝেন না।’
‘দেখলে, অমল, দেখলে,’ বাচ্চা ছেলের মতন লাফিয়ে ওঠে শাহপুর, ‘ওর হিউমার সেন্স দেখলে? আমাদের অক্সিটোসিন আর এন্ডোরফিনের মডেল করতে হয়েছে, এসব হরমোনের ডিজিটাল মডেল ছাড়া তুমি চেতনা আনতে পারবে না, সংজ্ঞা আনতে পারবে না। সেইসব মডেলের তুলনায় চিমটি কাটার ব্যথা তো কিছুই না। ইকশিতার গায়ের চামড়াকে বলা যেতে পারে বৈদ্যুতিন ত্বক, স্বচ্ছ গ্রাফিন দিয়ে তৈরি, এর পেছনে রয়েছে এমন নিউরোমরফিক সেন্সর, যা কিনা নিউরন আর সিনাপ্সকে অনুকরণ করতে পারে। সেখান থেকে সংকেত যায় মস্তিষ্কের থালামাসে, আমিগডালায়, সোমাটোসেন্সরি কর্টেক্সে, ব্যথার উৎপত্তি সেখানে। কিন্তু ব্যথা কী? কে ব্যথা পাচ্ছে?’
শাহপুর পায়চারি করে, দুটো হাত এক করে, খোলে, আবার এক করে। ইকশিতা একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শাহপুরের দিকে, বুঝতে চায়, জানতে চায়, শিখতে চায়। শাহপুর তাকে বলে, ‘তোমার ব্যাটারিগুলো চার্জ করতে হবে, তুমি বরং সেটা করে আধ ঘণ্টা পরে আবার ফিরে এসো।’
ইকশিতা উঠে যেখান দিয়ে এই ঘরে ঢুকেছিল, সেখান দিয়ে বের হয়ে যায়। অমলের খুব কৌতূহল হল জায়গাটা দেখার জন্য।
শাহপুর সোফায় বসে, বলে, ‘আমি ইকশিতার সামনে এই আলোচনাটা করতে চাইছি না। আমি যেটা বলতে চাইছিলাম—তুমি ইলেকট্রনিক সার্কিট দিয়ে নিউরন সৃষ্টি করতে পারো, সিনাপ্স করতে পারো, তাদেরকে হেবিয়ান পদ্ধতিতে ট্রেনিং দিতে পারো, কিন্তু সেটা হবে শুধুই একটা মেশিন, একটা যন্ত্র। তার সঙ্গে একটা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের কোনো পার্থক্য নেই। সংবেদিতা, সেনসিয়েন্স, আমিত্ব, ব্যথা পাওয়া, সে আলাদা একটা ব্যাপার।’
অমল নিজেকে ধাতস্থ করতে চায়, এই মুহূর্তে যেটা ঘটল, সেটা সত্যি কি না ভাবতে চায়। বলে, ‘দাঁড়াও, একটু আস্তে চলো, ইকশিতা সত্যিই মানুষ নয়? আর তুমি তাকে তৈরি করেছ তোমার এই ল্যাবে?’
‘না, সব কিছু যে এই ল্যাবে হয়েছে এমন না। আমি বাইরে বাইশ বছর এর উপর কাজ করেছি, বহু গুণী মানুষের সঙ্গে। তারাও এর সঙ্গে যুক্ত। এটা একটা জটিল প্রক্রিয়া।’
‘হাহা, জটিল প্রক্রিয়া! একটু কম করেই বললে, আর এটা তুমি কর্তৃপক্ষ আর সাধারণ মানুষের থেকে আড়াল করে করতে পারলে?’ অমলের বিস্ময় শেষ হয় না। ত্রিশ বছর আগের স্কুলের বন্ধু শাহপুর আলারিজের সঙ্গে এই শাহপুরকে সে মেলাতে পারে না।
‘শোনো, তোমাকে সব বলা যাবে ধীরে ধীরে, আগে তোমার সঙ্গে কাজের কথাটা বলে নিই।’
‘তার আগে তুমি আমাকে বলো, তুমি কী করে জানো, ইকশিতা ব্যথা পাচ্ছে?’ অমল জিজ্ঞেস করে।
‘যতদূর মনে হয়, সে পাচ্ছে। ইকশিতার মাথায় একগাদা বৈদ্যুতিন সার্কিট আছে বটে, কিন্তু তাদের মধ্যের সংকেত আদানপ্রদান কয়েক হাজার কোটি নিউরনকে অনুসরণ করে, কিন্তু সেখানে কোনো কেন্দ্র নেই। কয়েক কোটি সার্কিটের মধ্যে এমন অরৈখিক যোগাযোগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে “আমিত্ব” সৃষ্টি করবে—এই ছিল আমার আশা।’
‘আশা ছিল, কেন বলছ? ও যখন বলছে, “আমি ব্যথা পাচ্ছি”, ওকে কি তুমি বিশ্বাস করছ না?’
‘না, বিশ্বাস করছি। কিন্তু আমি জানি না, ইকশিতা তার নিউরোমরফিক সেন্সরের সংকেতকে “ব্যথা” বলে তরজমা করছে কি না। ইকশিতার যদি সত্যি ‘‘আমিত্ব’’ থেকে থাকে, তবে সেই সংকেত সে সচেতনভাবে দেখতে পাবে না। সে সেটা অনুভব করবে। একই ব্যাপার রং আর শব্দের ক্ষেত্রে। সে কি লাল রং দেখতে পাচ্ছে? সবুজ? এগুলোকে “কুয়ালিয়া” বলে, কুয়ালিয়াকে তুমি বাইরে থেকে কোনো যন্ত্র দিয়ে ধরতে পারবে না, আমি যে “লাল” দেখি, তুমি কি সেই “লাল” দ্যাখো, এরকম একটা ব্যাপার।’
শাহপুর কথাগুলো বলতে বলতে যেন ক্লান্ত হয়ে যায়। যত বছর ধরে সে একটি সচেতন মস্তিষ্ক সৃষ্টি করতে চাইছে, তত বছর ধরে বাইরের পৃথিবী বদলেছে, সেই বদলানোতে তার কোনো হাত নেই। সে চেষ্টা করেছে ওই বদলে যাবার বাইরে থাকতে। সে বিশ্বাস করেছে তার কর্মযজ্ঞ ক্ষণিক স্থানকালের বাইরে, মানুষের ভবিষ্যতে স্থান পাবে।
অমল বলে, ‘তাহলে তুমি আমাকে কী করতে বলছ?’
‘আমি চাই, অমল, তুমি ইকশিতার সঙ্গে জীবন সম্পর্কে কথাবার্তা বলো। বুঝতেই পারছ অতীত সম্পর্কে ওর কোনো স্মৃতি নেই, তুমি ওকে তোমার জীবনের কাহিনি শোনাও। আর সেই ফাঁকে বুঝতে চেষ্টা করো ওর আমিত্ব।’
‘সেটা ঠিক আছে, কিন্তু তুমি কি বাইরের পৃথিবীর কোনো খবর রাখছ? যেরকম আন্দোলন চলছে, তাতে তোমার এই প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি শঙ্কিত আছি।’
‘শোনো, যে কর্তৃপক্ষই ক্ষমতায় আসুক-না, তারা আমার এই গবেষণা মেনে নেবে না। আর আমার ফান্ডিং বাইরে থেকে আসে, জিনিসপত্র বাইরে অর্ডার দিয়ে গোপনে দেশের ভেতরে নিয়ে আসতে হয়। ইকশিতার ত্বকের ব্যাপারটাই ধরো-না কেন, প্রায় দুই বর্গমিটার গ্রাফিন, যার পেছনে সৌর সেল বসানো, সেটা আমাকে চোরাই পথে নিয়ে আসতে হয়েছে। এসব এই সরকার মানবে না, নতুন যে আসবে, সে-ও মানবে না।’
‘এরকম ঝুঁকি কেন নিচ্ছ তুমি? এই কাজটা কি বাইরে করা যেত না?’
‘এই নিয়ে বাইরে গবেষণা করেছি। সেখানেও রীতিনীতি বেশ কড়া, বিশেষত যখন রোবট-সচেতনতার প্রশ্ন উঠছে, এখানে আমি যে গোপনীয়তাটা রক্ষা করতে পারছি, সেটা ওখানে করতে পারতাম না।’
‘কিন্তু তোমার কোম্পানিতে এতগুলো লোক কাজ করে, তাদের মধ্যে যে দু-একজন তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, তা তুমি কেমন করে জানো?’
‘জানি না, কিন্তু এরা সবাই আমার সঙ্গে একটা চুক্তিতে সই করেছে, সেখানে কী লেখা আছে, তা তোমাকে না-বলাই ভালো, সেই চুক্তিপত্র আমাকে বাঁচাবে। কিন্তু তার থেকেও বড়ো কথা এদের সঙ্গে আমার চুক্তি পাঁচ বছরের, এরপরে এরা সবাই বাইরে চলে যাবে। আমরা প্রতিসপ্তাহে পৃথিবীর সব চেয়ে ল্যাবের সঙ্গে মিটিং করি, তাই বিদেশের নামি প্রতিষ্ঠানগুলো এদের এখন চেনে। শাহপুর ডাইনামিক্সে কাজ করা একটা সম্মানের ব্যাপার।’
মানুষ যখন ঈশ্বরের ভূমিকা পালন করতে চায়, সে অনেক কিছুই করতে পারে, ভাবে অমল। এরকম একটা বিশাল অগ্রবর্তী গবেষণা, তা কি পৃথিবীর দৃষ্টি থেকে আড়াল করা যাবে?
‘তারপর, তারপর কী করবে তুমি? তোমার শেষ গন্তব্য কোথায়?’
‘দ্যাখো, সচেতনতার এই পর্যায়ে আসতে আমাদের সাড়ে চারশো কোটি বছর লেগেছে, অথবা না হয় একশো কোটি বছরই লেগেছে, সেখানে অনেক ভুল পথ ছিল, আবার দক্ষ পথ ছিল, কিন্তু প্রকৃতি অপেক্ষা করেছে, প্রকৃতির হাতে সময় ছিল। আমরা এখন কোটি বছরের বিবর্তনকে একশো বছরের মধ্যে সৃষ্টি করতে চাইছি। আমরা মহাবিশ্বের প্রত্যন্ত প্রান্তে, বহুশত কোটি আগে গ্যালাক্সি কী করে তৈরি হয়েছে, বুঝতে পারি, কিন্তু প্রাণীর চেতনার সৃষ্টি বুঝতে পারি না। আমি মরে যাবার আগে এই রহস্য সম্বন্ধে যতটুকু জানার জানতে চাই।’
‘তাহলে তুমি এটাকে একটা লাভজনক ব্যাবসা হিসেবে দেখতে চাও না?’
‘একেবারেই না। এটা আমার একটা ব্যক্তিগত অভিযান।’
মাটির নীচে ঘরটিতে বসে অমল একটু হাঁপিয়ে উঠেছিল। শাহপুরের তা অলক্ষিত থাকে না। সে বলে, ‘আমি চাই, তুমি সপ্তাহে তিন দিন এসে ইকশিতার সঙ্গে কথা বলো। মাসখানেক পরে আমি তোমার মতামত জানতে চাইব, ইকশিতার মন কি পুরোপুরি সংবেদী, নাকি তাতে যান্ত্রিক প্রভাব রয়েছে। তোমার জন্য আমি আলাদা একটা ফান্ড রেখেছি, একটা কাগজে সই করে যেয়ো।’
অমল উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করে, ‘আর-একটা ব্যাপার। অনেক গবেষণাগারে দেখেছি, রোবট বা অ্যান্ড্রয়েডের মডেল হিসেবে তরুণী বা তরুণ চেহারার কাউকে বেছে নেওয়া হয়। তুমি মধ্যবয়স্কা নারীকে বাছলে কেন?’
হাহা করে হাসে শাহপুর, বলে, ‘খুব ভালো প্রশ্ন, কিন্তু এই সিদ্ধান্তটা আমাদের জন্য খুব সহজ ছিল। এটা পুরোই হরমোনের ব্যাপার বলতে পারো। ইকশিতার জন্য আমাকে এস্ট্রোজেন বা প্রজেস্টরন জাতীয় হরমোনের মডেল করতে হয়নি, কিন্তু অতীতে তার শরীর কেমন ছিল, সেই স্মৃতিটির মডেল করতে হয়েছে। স্মৃতি সৃষ্টি করা তুলনামূলকভাবে সহজ কাজ ছিল হরমোনের তুলনায়।’
তিন
শাহপুর ডাইনামিক্স থেকে বের হয়েই রাস্তার উপরে একটা বিরাট মিছিলের সামনে পড়ে অমল। মূলত অল্পবয়সিরা মিছিলের সামনে, কিছু প্রৌঢ় পেছনে। দূরে রাস্তার মোড়ে, নবরূপক রোড যেখানে শেষ হয়েছে, কিছু পুলিশ দাঁড়ানো, তারা মেগাফোন দিয়ে কী যেন বলছে। মিছিলের লোকেরা কী স্লোগান দিচ্ছে, কিংবা দূরে পুলিশেরা কী বলছে, দুটোর কোনোটাই বুঝে উঠতে পারে না অমল। এর মধ্যে সূর্যটা প্রায় মাথার উপর। শাহপুরের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে ফিরে যেতে চায় অমল, পৃথিবী থেকে দূরে, ডিজিটাল সার্কিটের অনুভবের জগতে।
রাস্তার দু-পাশে উঁচু বাড়ি, পাশে একচিলতে ফুটপাথ। আজ রাস্তায় গাড়ি নেই, কিন্তু মানুষের মিছিলের ঢল আছে। মোড় থেকে শব্দ ভেসে আসে, মানুষগুলো পুলিশ থেকে দূরে দৌড়োয়। অমলের কাছেই একটা টিয়ার গ্যাস এসে পড়ে, ধোঁয়া বের হয় তার থেকে। অমল দৌড়োয়, অসমান ফুটপাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়, কোথাও ছড়ে গেছে, উঠে দাঁড়িয়ে আবার দৌড়োয় সে। তরুণ-তরুণীরা তাকে ফেলে দূরে চলে যেতে থাকে। কিছু প্রৌঢ়কে পার হয়ে যায় অমল।
পকেটের মোবাইল ফোন কাজ করে না, সব নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শহরের পুরোনো অংশে থাকে অমল, সেখানে হেঁটে ফিরতে ঘণ্টা তিনেক লেগে যায়। টেলিভিশনে সন্ধ্যার খবরে হতাহতের কোনো সংবাদ থাকে না।
বাড়ির মানুষগুলো পরদিন তাকে বের হতে নিষেধ করে, কিন্তু নবরূপক রোডের ‘ভুবন ভিস্তা’র হাতছানি তাকে আটকে রাখতে পারে না। বের হবার আগে ছাদে যায় সে, যত্নে বোনা একটু গাছে ফুল এসেছে, একটি ফুলের তোড়া সে ব্যাগে ভরে। হলুদ পলাশ। বাসা থেকে বের হয়ে ঘণ্টাখানেক ধরে সে পোড়া বাস আর গাড়ির ধ্বংসাবশেষের পাশ দিয়ে হাঁটে, তারপর একটা বাস ধরতে পারে। শহরের মনে হয়, একমাত্র চালু বাহন ছিল সেটি। ভাঙা কাচ, ব্যারিকেড, আবর্জনার স্তূপ পেরিয়ে বাসটা তাকে নবরূপক রোডের কাছেই নামিয়ে দেয়। গতকালের মতন আজ সেখানে বিক্ষোভ ছিল না, কিন্তু বহু প্রতিষ্ঠানের সামনের অংশ ক্ষতবিক্ষত হয়ে ছিল। শুধু ‘ভুবন ভিস্তা’ই মনে হয়, রক্ষা পেয়েছিল।
রিনা সাবেক তাকে বহুদিনের পরিচিতের মতো অভ্যর্থনা জানায়, সে কেমন করে আজ অফিসে এল, ভাবে অমল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহপুর এসে তাকে নিয়ে যায়। ক্লান্ত শাহপুর, সারারাত ঘুমায়নি। বাইরের জগতে কী হচ্ছে, সে জানে না, জানতেও চায় না।
নীচে করিডর দিয়ে হাঁটার সময় অমল দ্যাখে গতকালের মতনই ল্যাবগুলোতে সব মানুষজন। এরা কি কেউই বাসায় যায় না? করিডরের শেষে ‘নির্বাণ চেম্বার’ ঘরটি গতকালের মতনই শান্ত স্বস্তিতে ভরা, সেখানে অমলকে বসিয়ে শাহপুর বের হয়ে যায়। গতকালের মতনই একটি গান ভেসে আসছিল, কিন্তু গতকালের মতনই অমল সুরটাকে ঠিক ধরতে পারে না। ইকশিতা ঘরের ঢুকলে তাকে দেখে অমল রিনা সাবেকের সঙ্গে মিল খুঁজে পায়—না মুখাবয়বের মিলে নয়, বরং একটা সামগ্রিক দৈহিক পরিব্যাপ্তিতে।
ইকশিতা সামনে বসলে তাকে অমল জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কী জানতে চান?’
ইকশিতা বলে, ‘আপনি জানেন কি না জানি না, আমার আসলে অনেক তন্ত্রই নেই, যেমন রক্তসংবহনতন্ত্র, লিম্ফ বা লসিকাতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র, প্রজননতন্ত্র। এগুলোর জন্য শাহপুর আলারিজ কিছু প্রক্সি সার্কিট তৈরি করেছেন, যারা এদেরকে কিছুটা প্রতিনিধিত্ব করে। বুঝতেই পারছেন, সামগ্রিকভাবে ওগুলোর শারীরিক বাস্তবতা না থাকলে আমার পক্ষে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সেই অপূর্ণতা থাকা সত্ত্বেও আমার একটা অস্তিত্ব রয়েছে। আর তাই পূর্ণ মানুষ হবার আকাঙ্ক্ষা আর আমার বর্তমান অস্তিত্বকে মেনে নেবার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সেটা আমাকে পীড়িত করে। আমাকে “আকান্ত” করে।’
‘আকান্ত? আকান্ত মানে কী?’
‘আকান্ত, কেন এই কথাটা কি অভিধানে নেই? আকাঙ্ক্ষায় আমি ক্লান্ত। সেটা বোঝাতেই।’
অমলের হঠাৎ মনে হয় তার নামটা নিতান্তই সাধারণ, তার দরকার ছিল একটা মহাকাব্যের নায়কের নাম। তার মনে হল, যার যেরকম নাম, সেই নামকরণই ঠিক করে দেয় একজন মানুষের দেশকালে বিচরণ-ব্যবহার। ‘অমল’ নামের মানুষটি ছাদের টবে ফুল ফোটাবে, সে পুলিশের টিয়ার গ্যাস থেকে দৌড়ে পালাবে, তাকে বন্ধুরা তার ছেলেমেয়েদের দর্শন শেখাতে নিয়োগ করবে (নিতান্ত দয়া করে)। অমল বলে, ‘আমাকে একটা নাম দিন ইকশিতা, অমল নামটি আমার একেবারে পছন্দ নয়। আমাকে এমন একটি নাম দিন, যাতে আমি ভরসা রাখতে পারি, আমার বাড়ির মানুষেরা ভরসা রাখতে পারে।’
হাসে ইকশিতা, একটা টোল পড়ে গালে। শাহপুর আলারিজ কত কী ভেবেছে—গালে টোল, থুতনিতে টোল। ‘নিশ্চয়, অমল সান, আপনার নাম হতে পারে আদ্রিকর, কিংবা অর্কশান, অথবা মিরাথেন। এরকম নাম আপনাকে ইতিহাসের সেনাপতি হিসেবে প্রস্তুত করতে পারে।’
নামগুলো অমলের পছন্দ হয়েছিল, একই সঙ্গে সে ভাবল, ইকশিতা নামগুলো ভাবতে কোনো সময় নিল না। এই কার্যপদ্ধতিটা তার জন্য অনেক শ্লথ হওয়া দরকার, শাহপুরকে ব্যাপারটা বলতে হবে।
ইকশিতা বলে, ‘অমল সান, না না আদ্রিকর সান, আমাকে বাইরের জগৎ সম্পর্কে বলুন। আমি অন্তর্জাল ঘেঁটে অনেক কিছু জেনেছি, কিন্তু আমার বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞান দরকার, মানুষের কাছ থেকে সরাসরি শিক্ষার মাধ্যমে।’
বাইরের জগৎ খুব জটিল, কী বলবে অমল তাকে? পদার্থবিদ্যার চারটি মিথস্ক্রিয়া বর্ণনা করা সহজ, কিন্তু সেসব ইকশিতা নিশ্চয় জানে। সৌরজগৎ, মহাবিশ্বের প্রসারণ, তমোবস্তু, তমোশক্তি, অলীক বস্তুকণা, কোয়ান্টাম বিজড়ন? প্রেম, ভালোবাসা, মায়া, নস্টালজিয়া, আক্ষেপ? রাজনীতি, ক্ষমতা, ইগো, লোভ? তার অস্তিত্বের সংকট—existential angst? চেতনার উৎস কোথায়? জীবনানন্দ—‘আলো অন্ধকারে যাই, মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোনো এক বোধ কাজ করে’?
অমল জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি স্বপ্ন দেখছেন?’
‘দেখছি,’ উত্তর দেয় ইকশিতা, ‘কিন্তু আমি জানি না সেটা শাহপুর ডাইনামিক্সের উদ্ভাবন কি না, অর্থাৎ স্বপ্নকে হতে হবে র্যানডম—নিউরনের যদৃচ্ছ সংকেতকে মস্তিষ্ক একটা যৌক্তিক কাঠামোতে রূপ দিতে চায়। কিন্তু এখানে ডোপামিন হরমোনের একটা ভূমিকা আছে। ওদিকে আমার মস্তিষ্কে তো রাসায়নিক কিছু নেই, তাই ডোপামিন জেনারেটর বলে একটা বৈদ্যুতিন সার্কিট আছে। তবে শেষ পর্যন্ত স্বপ্নগুলো র্যানডম কি না তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।’
‘তাহলে আপনি জানেন না, আপনার ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে কি না?’ অমল প্রশ্ন করে।
‘আপনার কি আছে?’ পালটা প্রশ্ন ইকশিতার।
‘না, আমি তা জানি না, সত্যিই। একসময়ে আমি ভাবতাম, আছে। এখন অত নিঃসন্দেহ নই।’ এই বলতে বলতে অমল তার ব্যাগটা থেকে পলাশের ফুলগুলো বের করে। ‘আপনার জন্য আনলাম, আমি জানি না, শাহপুর আপনার জন্য ফুল নিয়ে আসে কি না।’
ফুলগুলো দেখে ইকশিতার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ‘হলুদ পলাশ। হলুদ পলাশ যে আছে, সেই তথ্য আমি পেয়েছি। শাহপুর সান আমার জন্য লাল পলাশ নিয়ে এসেছিলেন।’
শাহপুর তাহলে গাছটা খুঁজে পেয়েছে।
‘কিন্তু আমার দুঃখ কী জানেন, শাহপুর ডাইনামিক্স এখনও স্বাদ আর গন্ধের মডেল নিখুঁত করতে পারেনি, অন্তত তা-ই আমার মনে হয়। ওরা আমাকে বিভিন্ন গন্ধ এনে ট্রেইন করিয়েছে, কিন্তু আমি যে গন্ধ পাচ্ছি, তা আপনি বা শাহপুর পাচ্ছেন কি না, সেই ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ নই।’
‘কিন্তু ফুল দেখলে আপনি কি সত্যিই উৎফুল্ল বোধ করেন? ফুল যে সুন্দর তা কী বোঝেন?’ অমল প্রশ্ন করে।
‘এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। আমি জানি মানুষ হিসেবে আমার ওই অনুভূতিগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদ্ভূত হবার কথা। মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের সঙ্গে অন্যান্য অংশের বোঝাপড়ার মধ্যেই সৌন্দর্যের ধারণা বের হয়ে আসে। শাহপুর ডাইনামিক্সের নিউরো আর বৈদ্যুতিন বিজ্ঞানীরা মিলে এই সিস্টেমের অন্তর্গত হাইপোথালামাস, আমিগডালা, থালামাস আর হিপোক্যাম্পাসের মডেল করে সার্কিট তৈরি করেছেন। কিন্তু সেগুলোকে নিয়মিত অনুশীলন করাতে হয়। আপনার সৌন্দর্যের বোধ তো আপনার বেড়ে ওঠা, পারিবারিক আর শিক্ষার পরিবেশের উপর নির্ভর করেছে। আমারটাও হয়তো ওরকম। এই মুহূর্তে বলতে পারছি না, সেই বোধটা আমার মধ্যে পুরোপুরি এসেছে কি না।’
শাহপুর ঘরে ঢোকে, কিছুটা উদ্ভ্রান্ত। বলে, ‘অমল, তুমি বরং এখন বাড়ি ফিরে যাও। কোম্পানির সবাইকে আমি চলে যেতে বলেছি, শহরের অবস্থা ভালো নয়। পুলিশের সঙ্গে প্রতিপক্ষের হাতাহাতি লড়াই হচ্ছে, অনেকে নাকি মারাও গেছে। এদিকে টেলিভিশন, অন্তর্জাল সবই বন্ধ, সঠিক কোনো খবরও পাওয়া যাচ্ছে না।’
অমল ভাবে, বাসায় ফিরে যাবার নিরাপদ রাস্তাটা কী হতে পারে।
ইকশিতা শাহপুরকে জিজ্ঞেস করে, ‘এই দুর্যোগে আপনার অবস্থান কী?’
শাহপুর মনে হয়, এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না, সে প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার কথাই ভাবছিল। তবু সে সংযত হয়ে উত্তর দেয়, ‘আমি কোনো সাময়িক উত্থান-পতনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে চাই না, এই সম্বন্ধে ভাবতেও চাই না। আমি মহাবিশ্বের এই রহস্য উদ্ঘাটন করতে চাই, সেখানে আজকের শহরের রাস্তায় কী ঘটছে, তা নিয়ে মাথা ঘামালে আমার সময় নষ্ট হবে।’
‘কিন্তু তোমার গবেষণার অর্থ বা ফান্ডিং তো কারও না কারও কাছ থেকে আসছে। সেখানে কি রাজনীতি-অর্থনীতি যুক্ত নয়?’ অমল যোগ দেয় আলোচনায়।
শাহপুর অধৈর্য হয়ে ওঠে। নিজের কাছে এইসব প্রশ্নের সমাধান অনেক আগেই সে দিয়ে রেখেছে। ইকশিতার সঙ্গে এইসব কথাবার্তা আগেও হয়েছে। সে বলে, ‘থাকতে পারে, কিন্তু সেটা আমার বিবেচ্য নয়। নিউটনের কাছ থেকে আমরা আধুনিক বিজ্ঞান পেয়েছি, কিন্তু নিউটন রাজকীয় টাঁকশালের অধিকর্তা হিসেবে বহু মানুষকে নকল মুদ্রা বানানোর দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে, আমরা কতজন সেটা জানি, আর জানলেও সেটা কি আমাদের নিউটনের অবদানকে খাটো করে দেখায়?’
ইকশিতা ও অমল চুপ করে থাকে। শাহপুর একটু দম নিয়ে বলে, ‘না, আমি নিউটন না, আমি মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়েও কাজ করতে চাই না। আমি আমার জন্যই কাজ করছি। বিত্তের জন্য নয়, একটা রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য। আমাকে কি উন্মাদ বিজ্ঞানী বলা যায়? না, আমি আবার এমন উন্মাদ নই যে আমার গবেষণা মানবজাতির ধ্বংস ডেকে আনবে। সেটা তোমাকে, অমল, ইকশিতাই ভালো করে বলতে পারবে। ওর সঙ্গে আমার এই ব্যাপারে অনেক কথা হয়েছে। যেদিন আমি বুঝব, এটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, সেদিনই এই গবেষণার সমাপ্তি হবে। ইকশিতা এই পরিণতির কথা জানে।
‘আর-একটা ব্যাপার, ইকশিতা, তোমার এটা জানা দরকার। তুমি মনে করো, এই টালমাটাল সময়ে আমাকে একটা পক্ষ বেছে নিতে হবে, অন্তত ন্যায়ের পক্ষে থাকতে হবে। তোমার কাছে ন্যায়-অন্যায়ের বোধটা একেবারে দিন আর রাতের মতো পরিষ্কার। কিন্তু সেই পরিষ্কার তফাত মানবসমাজের জন্য খাটে না, অন্তত আমার জন্য নয়। আমি তোমাকে এটা গ্যারান্টি দিতে পারি যে, আমি যদি আজকে রাজপথ থেকে দূরে থাকি, সেটা শুধু আমার জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে মানুষের জন্যও কল্যাণকর হবে।
‘আমাকে মেগালোম্যানিয়াক ভেবো না অমল। আমি আমার সীমাবদ্ধতা জানি। এই সীমাবদ্ধতাই আমাকে বর্তমান রাজনৈতিক টানাপোড়নের বাইরে রাখছে। কিন্তু তোমার এখন যেতে হবে, আমার সঙ্গে এসো, অন্য একটা পথে তোমাকে “ভুবন ভিস্তা” থেকে বের করব, যাতে তোমাকে নবরূপক রোড দিয়ে না যেতে হয়, ওই রাস্তাটা এখন খুব বিপজ্জনক।’
শাহপুর ঘরটির একদিকের দেয়ালে হাত রাখে, সেখানে দেয়াল সরে যায়, একটা করিডর দেখা যায়। ইকশিতাকে বিদায় জানিয়ে অমল শাহপুরের পেছনে হাঁটে, খুব সরু করিডর, উপরে বাতির সারি পথটাকে দেখতে সাহায্য করে।
শাহপুর বলে, ‘এই দেশে থাকতে হলে অনেক কিছু ভেবে নিতে হয়, জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। আবার এখানে অনেক কিছু করতে পারো, যা বিদেশে বসে করা যায় না। আর এই সুড়ঙ্গটা করা সব দিক বিবেচনা করে, শাহপুর ডাইনামিক্সের নীচের তলার খবর যদি বাইরের বিশ্ব জানে, আর সেটার উপর হামলা হয়, তবে যেন আমাদের কর্মীরা পালাতে পারে।’
মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরে তারা একটা দরজার সামনে পৌঁছায়। এবার শাহপুর পকেট থেকে একটা সাধারণ চাবি বের করে দরজার মধ্যের তালাটা খুলতে খুলতে বলে, ‘এখানে শাহপুর ডাইনামিক্সের কোনো কেরামতি চলবে না। প্রাচীন পদ্ধতিতেই দরজা খুলতে হবে।’ তারা একটা অফিসঘরে ঢোকে। চারদিকে তাক, তাতে দলিল-দস্তাবেজ, মনে হয়, গত পঞ্চাশ বছর তাতে হাত পড়েনি। এরপরে আর-একটা ঘর, সেখান থেকে বের হলেই রাস্তা, তবে সেটা নবরূপক রোড নয়। রাস্তাটা চিনতে একটু সময় লাগল অমলের। শাহপুর ফিরে যায় আবার সুড়ঙ্গ ধরে তার কাজে।
চার
সেইদিন অমল বাড়ি ফিরতে পারে, কিন্তু পরের দু-দিন কোনো কিছুই কাজ করছিল না—ফোন, অন্তর্জাল, টেলিভিশন, রেডিয়ো। তৃতীয় দিন সকালে সব কিছুই আবার চালু হল, সরকার পতন হয়েছে বিরোধী দল ক্ষমতা দখল করেছে। অমল শাহপুরের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু ফোনের ওদিক থেকে কোনো উত্তর এল না। রিনা সাবেকের নম্বর ছিল, কিন্তু সেখানেও রিং হয়ে গেল। চিন্তিত অমল সিদ্ধান্ত নিল নবরূপক রোড যাবার। বাড়ির মানুষেরা তাকে আটকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। শহরে সেদিন যানবাহন সবে চালু হচ্ছে, অমল একটা ট্যাক্সি পেল। চালক বলল, নবরূপক পর্যন্ত যেতে পারবে না, তাকে কাছাকাছি কোথাও নামিয়ে দেবে।
নবরূপক রোডের দু-পাশের অনেক দালানে তখনও আগুন জ্বলছিল। এই রাস্তায় দেশের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অফিস ছিল। কয়েকটি দোকান থেকে মানুষজন জিনিসপত্র নিয়ে বের হচ্ছিল। ‘ভুবন ভিস্তা’র নীচে অন্য দোকানগুলোর সামনের কাচ ভাঙা, আর ‘শাহপুর ডাইনামিক্স’-এর দরজাটা খোলা। খুব খারাপ কিছু হয়েছে এমন একটা চিন্তা নিয়ে অমল ভেতরে ঢোকে। রিনা সাবেকের অফিসের চেয়ারগুলো নেই, তার মানে সেগুলো লুট হয়ে গেছে। টেবিলটা ভাঙা। এর পরের ঘরটারও সেই অবস্থা, গণকযন্ত্রগুলো চুরমার হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। অমল আশা করছিল, এরপরে আক্রমণকারীরা ভেতরের পথ খুঁজে পাবে না। কিন্তু দেয়ালের সেই লুকোনো অংশটা খোলাই ছিল। অমলের হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়, একটা মর্মান্তিক আশঙ্কাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। দেয়াল পার হয়ে নীচে নামতে থাকে অমল, এর পরের দরজাটাও খোলা। দু-দিকের ল্যাবগুলোর জিনিসপত্র চূর্ণবিচূর্ণ, কাচ মাটিতে ছড়ানো। সেখানে কেউ নেই, নিশ্চয় সমস্ত কর্মী পালাতে পেরেছিল, কিংবা ওইদিনের পরে আর ফিরে আসেনি। নির্বাণ চেম্বারের দরজাটা যেখানে ছিল, সেখানে দেয়ালটা পুরো ভাঙা।
নির্বাণ চেম্বারের ভেতরের অবস্থা অন্য সব জায়গার মতোই। অমল ছুটে যায় ঘরের সেই অংশটিতে, যেখানে দেয়ালের পেছনে ইকশিতার থাকার কথা, দেয়ালে কান পাতে, ভেতর থেকে কি কোনো শব্দ পাওয়া যায়? দেয়ালের এই জায়গাটা খোলা নয়, মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়। দেয়ালে টোকা দেয় অমল—‘ইকশিতা, ইকশিতা’। ভেতর থেকে মনে হয়, একটা গোঙানির শব্দ আসে। মিনিটখানেক অপেক্ষা করে অমল, এরপরে দেয়াল সরে যায়, ক্ষীণ আলোয় দ্যাখে, ইকশিতা মেঝেতে শুয়ে আছে। ছুটে গিয়ে ইকশিতার পাশে গিয়ে বসে অমল, ইকশিতার বাঁ হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নেয়। ইকশিতার শরীরে আপাতদৃষ্টিতে কোনো আঘাতের চিহ্ন সে দ্যাখে না। কিন্তু ইকশিতা অসুস্থ, কী কারণে অসুস্থ, সেটা বুঝতে পারে না অমল।
ইকশিতা খুব চাপাস্বরে বলে, ‘অমল সান এসেছেন, কিন্তু সব শেষ হয়ে গেছে, আর এর জন্য আমিই দায়ী।’ কী করে ইকশিতা দায়ী হবে, বুঝতে পারে না অমল।
ইকশিতা বলতে থাকে, ‘আপনি সেদিন চলে গেলে শাহপুর সানের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়। আমার কাছে মনে হয়েছিল, বিরোধী দলের দাবির মধ্যে ন্যায্যতা ছিল। আমি তাকে বলি যে, আমাদের দায়িত্ব এই আন্দোলনে যুক্ত হওয়া।’
অমল বুঝতে পারে না, শাহপুরকে কি এত সহজে এই ব্যাপারে কনভিন্স করা যাবে?
ইকশিতা বুঝতে পারে, অমল কী ভাবছে। বলে, ‘না, আমি তাকে আন্দোলনে সরাসরি যোগ দেবার জন্য কনভিন্স করিনি, আমার বিকাশের জন্য এই আন্দোলন সম্পর্কে জ্ঞান দরকার, ওঁকে সেটাই বোঝাতে পেরেছিলাম।’
অমল তাও বুঝতে পারে না, কেন এই জিনিসটি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। সে বলে, ‘তারপর?’
ইকশিতার কণ্ঠস্বর আরও ক্ষীণ হয়ে যায়, ‘যেহেতু সব ধরনের সংবাদমাধ্যম বন্ধ, আমি শাহপুরকে কনভিন্স করি বাইরে গিয়ে পরিস্থিতিটা দেখে আসতে।’
‘শাহপুর তারপরে বাইরে গেল?’ অমল তাও বিশ্বাস করতে পারে না।
ইকশিতার হাসিটা ম্লান ছিল। বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি, আপনি এটা বিশ্বাস করতে পারছেন না। আসলে আমি তাকে ব্ল্যাকমেল করেছিলাম, সে না গেলে আমি আত্মহত্যা করব বলে হুমকি দিয়েছিলাম।’
‘আপনি আত্মহত্যা করতে পারেন? তাহলে আপনার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে?’ অমলের বিস্ময় বাধ মানে না।
‘হাহা, আমি তা জানি না। সেই হুমকিকে বাস্তবে রূপ দিতে পারতাম কি না জানি না, কিন্তু এখন আমার মৃত্যু হচ্ছে, সেটার উপর আমার কোনো হাত নেই।’
‘কীভাবে?’ ইকশিতার মৃত্যু হতে পারে—এটা অমলের মাথায় আসেনি আগে।
‘শাহপুর ডাইনামিক্সের বিদ্যুৎব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে, আমার রিচার্জ করার আর কোনো উপায় নেই।’
‘কেন, শহরের অন্য জায়গায় তো বিদ্যুৎ আছে?’
‘সেটা থাকলেও তাতে আমার কাজ হবে না, কারণ আমাকে একটা বিশেষ আধারে শুয়ে চার্জ নিতে হয়, আমার সারা শরীরে চামড়ার নীচে সোলার সেল রয়েছে, তাদের উপর চারদিক থেকে আলো আসা প্রয়োজন।’ এই বলে ইকশিতা হাত দিয়ে একটু দূরে একটা বাক্সের মতো জিনিসের দিকে ইঙ্গিত করে। অমল ভালো করে দেখে বুঝতে পারে, সেটা একটা মিশরের মমি রাখার মতন সার্কোফ্যাগাস বা শবাধার।
‘কিন্তু ইকশিতা, উচ্ছৃঙ্খল জনতা এই ভেতর পর্যন্ত কেমন করে ঢুকল? শাহপুর তো বেশ কয়েকটা নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছিল? নির্বাণ চেম্বার পর্যন্ত তো তাদের আসার কথাই ছিল না!’
ম্লান দুঃখের একটা হাসির ছাপ ফুটে ওঠে ইকশিতার মুখাবয়বে। ‘আমাদের মধ্যেই একজন বিশ্বাসঘাতক ছিল, সে যে শাহপুর ডাইনামিক্সের সব কার্যকলাপ সম্পর্কে জানত এমন নয়, যেমন আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে সে নিঃসন্দেহ ছিল না, কিন্তু একশ্রেণির মানুষকে সে খবর দিয়েছিল। তাদের বলেছিল যে, শাহপুর আলারিজ একটা দানব সৃষ্টি করছে, মনস্টার!’
‘এই কোম্পানির মধ্যেই কেউ?’ অমলের কথাটা বিশ্বাস হয় না, শাহপুর সবার ব্যাকগ্রাউন্ড নিঃসন্দেহে ভালোমতো পরীক্ষা করেই তাদের কাজে নিয়োগ দিয়েছে।
‘মানুষের মন একটা অদ্ভুত জিনিস, তাতে কখন পরিবর্তন আসে, মানুষ হয়তো নিজেই বোঝে না। আমার মধ্যেও পরিবর্তন আসছিল। আমি শাহপুর সানের মতন রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে বিযুক্ত ছিলাম, কিন্তু আমি বাইরের জগৎ থেকে যত তথ্য পাচ্ছিলাম, তত সেইসব মতাদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছিলাম, শাহপুর সানের বিরুদ্ধে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলাম।’
‘কিন্তু আপনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, কোম্পানির মধ্যে একজন কেউ আছে, যে কোম্পানির সর্বনাশ করতে প্রস্তুত, সে-ই অর্থ হয়তো আপনি শাহপুরকে কনভিন্স করতে পেরেছিলেন “ভুবন ভিস্তা”র বাইরে যেতে, আপনি ওর প্রাণ বাঁচিয়েছেন বলা যায়।’ অমল একটা ডুবন্ত জাহাজকে ভাসিয়ে তুলতে চায়।
‘আপনার কথাটা সত্যি, কিন্তু পুরোপুরি সত্যি না। পুরো সত্যি হলে খুব ভালো হত, অমল সান। মানুষ কী চায়, সে কি তা জানে? আমি মানুষ হয়ে উঠছিলাম, কিন্তু একই সঙ্গে বুঝতে পারছিলাম, আমি কখনোই একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হব না, আমি আসলে এই জীবন চাই না। কিন্তু যতদিন আমি নির্বাণ চেম্বারে থাকব, ততদিন শাহপুর সান আমাকে ধীরে ধীরে গড়তে থাকবেন, গড়তেই থাকবেন, সেটার শেষ কখনোই হবে না। আমার শরীর একটা কারাগার, সেখান থেকে মুক্তির প্রয়োজন ছিল, সেজন্য শাহপুর আলারিজকে আমি কনভিন্স করাতে চেয়েছিলাম যে আমার বাইরের জগতের প্রত্যক্ষ জ্ঞান প্রয়োজন। একই সঙ্গে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের কোম্পানির কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করবে, বাইরের লোকদের পথ দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে আসবে। কীভাবে বুঝলাম? এই কোম্পানির প্রতিটি মানুষ বাইরের জগতের সঙ্গে যে সমস্ত তথ্য আদানপ্রদান করে, তা আমি দেখতে পাই, শাহপুর সান আমাকে সেই অধিকার দিয়েছিলেন—আমার শিক্ষার জন্যই। সেখানে অনেকেই সংকেতের সাহায্যে তাদের বার্তা লিখত, সেগুলো সবই নিতান্ত নিজেদের প্রাইভেসি রক্ষার্থে, কিন্তু একজনের সংকেত আমার নজর কাড়ে। আমি জানতাম, সেই বিপক্ষের মানুষদের নির্বাণ চেম্বার পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারবে।’
ইকশিতার গলা জড়িয়ে আসতে থাকে, ‘কিন্তু আমি এটা শাহপুর সানকে বলিনি, আমি হয়তো শাহপুর ডাইনামিক্সের ধ্বংসই চেয়েছিলাম। একই সঙ্গে শাহপুর আলারিজের ক্ষতি হোক, তা চাইনি, তাই শেষ মুহূর্তে তাকে বাইরে পাঠাতে পারি। যদিও সেই চয়েসটাও সংশয়ে ভরা ছিল। বাইরে গেলে কি শাহপুর বাঁচবে? সেখানে তার জীবনের নিশ্চয়তা কী? অর্থাৎ আমি যে ক-টা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সব ক-টাই এই কোম্পানির ভবিষ্যৎ জীবনের বিপক্ষে ছিল।’
এরপর ইকশিতা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে, অমল অপেক্ষা করে।
ইকশিতা আবার বলতে শুরু করে, ‘পুরোনো সরকার পড়ে গেলে জনতা নবরূপক রোডের প্রতিষ্ঠানগুলো আক্রমণ করে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোনো সময়ে আইনি বা বেআইনি পথে অনেক প্রশ্রয় পেয়েছিল। শাহপুর ডাইনামিক্সকেও তারা চিহ্নিত করতে পেরেছিল, মূলত প্রতিষ্ঠানটির একজনের বিশ্বাসঘাতকতার ভিত্তিতে। রাস্তার উপরের দুটো ঘরের পেছনের গোপন সিঁড়ি ধরে মূল ল্যাবগুলো পর্যন্ত পৌঁছোতে ওদের অসুবিধা হয় না, কিন্তু নির্বাণ চেম্বারে ঢুকতে ওদের সময় লাগে, কারণ এখানকার প্রবেশ-কোড ওই কর্মচারীর কাছে ছিল না। তবে তারা মনে হয়, পরে দেয়াল ভেঙে ঢোকে, আপনি এটা দেখেছেন, কিন্তু আমার এই ছোটো ঘরটা এমনভাবে লুকোনো যে, তারা এটা খুঁজে পায় না। কোনো দানব বা মনস্টার না পেয়ে তারা খুব হতাশ হয়। তারা মনে করে, তাদের পথপ্রদর্শক তাদের ধোঁকা দিয়েছে, এর ফলাফল ভালো হয়নি… ভাগ্যের পরিহাস কী জানেন, সেই পথপ্রদর্শকের চেহারাকে মডেল করেই আমাকে তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু আমার অস্তিত্বকে তার কাছে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।’
ইকশিতার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। বলে, ‘অমল সান, আপনি আমাকে পলাশ ফুল দিয়েছিলেন। ফুল নাকি সুন্দর একটা জিনিস, আমার এটা পুরোপুরি বুঝে ওঠা হল না। জানেন, আমি আর্কাইভ ঘেঁটে একটা হারিয়ে-যাওয়া গান বের করেছিলাম, গানটার প্রথম লাইনে পলাশের কথা ছিল, আমি সেটা গত দু-দিন শুনেছি…’
এরপরে ইকশিতা আরও কিছু বলে, যা অমল বুঝতে পারে না।
ইকশিতা আর কিছু বলে না। অমল তার হাত ধরে বসে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর তাকে তুলে সেই সার্কোফ্যাগাসের মধ্যে শুইয়ে দেয়, কোনো একদিন আলো ফিরে আসবে হয়তো।
ইকশিতার ঘর থেকে বের হওয়ামাত্র দেয়ালটা বন্ধ হয়ে যায়, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, ভেতরে আর-একটা ঘর আছে। এদিকে নির্বাণ চেম্বারে পুরো ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। এবার অমল খেয়াল করে, একটা ভাঙা সোফার পেছন থেকে একজোড়া পা বেরিয়ে আছে। সেখানে গিয়ে অমল স্তম্ভিত হয়ে যায়, রিনা সাবেকের মৃতদেহ। এবার তার মনে পড়ে, কোনো এক ভাষায় সাবেক মানে হল ন্যায়পরায়ণ। ভাগ্যের পরিহাসই বটে। চোখ ফিরিয়ে নেয় অমল, এই দৃশ্য দেখার মতন নয়। ইকশিতা বলেছিল, ‘এর ফলাফল ভালো হয়নি…’
সেরাতে বাড়ি ফিরে অমল অন্তর্জালে ইকশিতার পলাশ গানটা খুঁজে পায়—
‘পলাশ ফুটেছে শিমুল ফুটেছে
এসেছে দারুণ মাস
আমি জেনে গিয়েছি তুমি
আসবে না ফিরে
মিটবে না পিয়াস…’
একশো বছর হয়ে গেল, তাজুল ইমাম নামে এক শিল্পী গানটি লিখেছিলেন।
পাঁচ
নবরূপক রোডে পুলিশের গুলিতে বা পরবর্তী সহিংসতায় মৃত ব্যক্তিদের তালিকায় শাহপুর আলারিজের নাম খুঁজেছিল অমল, পায়নি। কয়েক মাস পরে নবরূপক রোডের ধ্বংসপ্রাপ্ত সব বিল্ডিংকে বুলডোজ়ার দিয়ে মাটির সঙ্গে সমতল করে দেওয়া হল। সেখানে আন্দোলনের স্মারক পার্ক হবে। অমল অনুমান করে, ইকশিতার সার্কোফ্যাগাসটা সেখানে মাটির নীচে আছে এখনও, সুরক্ষিত। প্রতিদিন তার পুরোনো শহরের বাড়িতে শাহপুরকে প্রত্যাশা করে অমল, অপেক্ষা করে, যখন নির্বাণ চেম্বারের এককোনায় শাহপুরের জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় আবার প্রাণ পাবে ইকশিতা। তার জন্য আবার হলুদ পলাশ নিয়ে যেতে পারবে। আর অমল আবার হয়ে উঠবে আদ্রিকর, অর্কশান, অথবা মিরাথেন।
Tags: দীপেন ভট্টাচার্য, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা