সময় গেরোয়
লেখক: এস. সি. মন্ডল
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
সেবারে গ্রীষ্মের ছুটিতে স্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় মাস খানেকের জন্য এক হিল টাউনে গিয়ে উঠেছিলাম। জায়গাটার নাম সংগত কারণেই উল্লেখ করছি না। সেখানেই ঘটনাচক্রে প্রফেসর সত্যেন সেনের সঙ্গে আমার দেখা হয়।
যারা বিজ্ঞান জগতের টুকটাক খোঁজখবর রাখেন তাদের অনেকের হয়তো নামটা চেনা মনে হবে। পদার্থবিজ্ঞানের নামকরা এই গবেষক এবং শিক্ষক বছর কুড়ি আগে কোনো এক অজানা কারণে অজ্ঞাতবাসে চলে যান। কাজেই তিনি যে এখনও বেঁচে আছেন সেই ব্যাপারটাই অনেককে অবাক করবে।
কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি প্রফেসরের সঙ্গে এই সাক্ষাতের ফলে যে ব্যাখ্যার অতীত রহস্যের মুখোমুখি আমাকে হতে হয়েছে, তার তুলনায় প্রফেসরের নিরুদ্দেশ হওয়াটা নিতান্তই পানসে। এই ঘটনা বিশ্বাস করা না করা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি শুধু সবার জ্ঞাতার্থে আমার ঘটনাটা লিখে যাচ্ছি।
সেদিনটা শুরু হয়েছিল খুব স্বাভাবিকভবে। রোজকার মতো সকাল সাতটার সময় বেরিয়ে এক ঘণ্টা প্রাতঃভ্রমণ শেষে একটা চেনা চায়ের দোকানে ঢুকতে যাচ্ছি, এমন সময় বয়স্ক একজন লোক অনেকটা অন্যমনস্কভাবে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। এক পলকের জন্য লোকটার মুখটা দেখে আমি চমকে উঠলাম। কিন্তু কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক মৃদুকণ্ঠে ‘দুঃখিত’ বলে বাইরে বেরিয়ে পড়লেন।
দোকানের ভিতরে ঢুকতেই দোকানদার একগাল হেসে বলল, ‘উনি একটু ওরকমই। আপনি কিছু মনে করবেন না।’
দোকানদারের কথা শুনে মনে হল ভদ্রলোক তার পরিচিত। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভদ্রলোককে চেনা চেনা লাগল, উনি কে?’
দোকানদার আবারো হেসে বলল, ‘উনি সেনবাবু। আর জানেন, ওঁকে অনেকেরই চেনা চেনা লাগে।’
সেন টাইটেল শুনে আমি সচকিত হয়ে উঠলাম। কারণ ভদ্রলোকের মুখ দেখে আমার যার কথা মনে হয়েছিল, তার টাইটেলও ছিল সেন। আমি তাই কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেনবাবু! ওঁর পুরো নাম কি সত্যেন সেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি চেনেন নাকি ওঁকে?’
এবারে আমাকে সত্যি অবাক হতে হল। লোকটা যদি সত্যিই সত্যেন সেন হন, তবে তাকে না চেনার কোনো কারণ নেই। ইউনিভার্সিটিতে আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম। কিন্তু তার তখনকার চেহারার সঙ্গে এই চেহারার অনেক পার্থক্য। আর তা ছাড়া সভ্য জগতের থেকে প্রফেসর সেন অজ্ঞাতবাসে আছেন তাও প্রায় বছর কুড়ি হতে চলল। এই কুড়ি বছরে বহু চেষ্টা করেও কেউ তার কোনো খবর জানতে পারেনি।
আমি দোকানদার এর কাছে সেই কথাটা চেপে গিয়ে বললাম, ‘উনি কি এখানেই থাকেন?’
‘হ্যাঁ, এই তো এই রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে গিয়ে মোড় ঘুরতেই বড়ো শিমুল গাছটার পাশের ঢালে লাল টালি দেয়া বাড়িটা, ওটাই ওঁর।’
‘কতদিন ধরে আছেন?’
‘তা প্রায় বছর পনেরো-ষোলো তো হবেই।’ দোকানি খানিক ভেবে উত্তর দিল।
আমার চা খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই উঠে পড়লাম। দোকান থেকে বের হবার সময় দোকানি পিছন থেকে ডেকে বলল, ‘ওঁকে এড়িয়ে চলাই ভালো বাবু।’
আমি সন্দিগ্ধ হয়ে জানতে চাইলাম, ‘কাকে? সেন বাবুকে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন? কোনো সমস্যা আছে নাকি?’
দোকানি উত্তর দিল, ‘ওঁর সঙ্গে কথা বললে অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে বাবু।’
‘কীরকম ঘটনা?’
এবারে দোকানি নিশ্চুপ। আমি আবারও জিজ্ঞেস করায় সে মাথা চুলকে খানিক ভেবে বলল, ‘সেটা বলাটা কঠিন বাবু। এখানের সবাই জানে যে মানুষটা স্বাভাবিক নন, ওঁর সঙ্গে কথা বললে অদ্ভুত অনেক কিছু ঘটে, কিন্তু কী ঘটে সেটা কেউ বলতে পারে না।’
দোকানির কথা শুনে আমি অবাক হলাম। এ আবার কেমন ছন্নছাড়া কথা। অদ্ভুত কিছু যদি ঘটেই তবে সেটা কেউ বলতে পারবে না কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে এইমাত্র যে উনি তোমার সঙ্গে কথা বলে গেল, কিছু তো ঘটল না?’
দোকানি বলল, ‘সব সময় ঘটে না বাবু। মাঝে মধ্যে ঘটে।’
আমি আর দোকানির কথায় পাত্তা না দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে রাস্তার মোড়ে শিমুল গাছের পাশে লাল টালি ছাওয়া বাড়িটা চোখে পড়ল। তবে সকালে আমার কিছু ওষুধ কেনার তাড়া থাকায় তখনকার মতো আর সেদিকে গেলাম না। তারপর বিভিন্ন ব্যস্ততায় দিনটা কেটে গেল।
কিন্তু বিকেলেই সময় বের করে বাড়িটায় গেলাম। নির্জন নিরিবিলি জায়গায় বাড়িটা। ঢোকার পথে শিমুল ফুলের ছড়াছড়ি। বাড়ির দরজায় পৌঁছে ঘণ্টা বাজাতে খানিকক্ষণের মধ্যে সকালের দেখা সেই ভদ্রলোক নিজেই এসে দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকে চাই?’
মানুষের পরিচয় লেখা থাকে তার চোখে। আমি তাই এবারে ভদ্রলোকের চোখের দিকে ভালো করে তাকালাম আর সঙ্গে সঙ্গেই সাদা চুল দাঁড়ির আড়ালে চাপা পড়া মানুষটার আসল পরিচয়টা আমার জানা হয়ে গেল। ইনি যে প্রফেসর সত্যেন সেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমি ঝুঁকে পড়ে প্রফেসরের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বললাম, ‘স্যার, আমাকে চিনতে পারছেন? আমি শিমুল, আপনার ছাত্র ছিলাম।’
প্রফেসর সম্ভবত আমাকে চিনতে পারলেন। কারণ, দেখলাম তার চোখে মুখের সন্দেহের ভাবটা কেটে গিয়ে একটা চেনা আন্তরিকতার ভাব ফুটে উঠল। আমাকে ডেকে ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন।
বসার ঘরের টেবিলে ছড়ানো বই দেখে বুঝলাম এখনও উনি পড়াশোনা ছেড়ে দেননি। টুকটাক কথাবার্তার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত বছর লুকিয়ে আছেন কেন?’
আমার প্রশ্ন শুনে প্রফেসরের মুখে একটা হতাশার ভাব প্রবল হল। বললেন, ‘আমি লুকিয়ে নেই তো।’
‘তাহলে?’
‘তুমি বসো আমি একটু চা করে নিয়ে আসি।’
প্রফেসর উঠে কিচেনের দিকে চলে গেলেন। বুঝলাম আমার প্রশ্নের উত্তর তিনি হয়তো দিতে চান না। প্রফেসরের কিছু ব্যাপার এরই মধ্যে আমার কাছে কেমন একটু অদ্ভুত লাগতে শুরু করেছে। বিশেষ করে তার চোখের ওই ভরসা হারানো দৃষ্টি। অথচ আমি যখন ওঁর ছাত্র ছিলাম তখন তাকে দৃঢ় এবং একাগ্রচিত্ত বলেই জানতাম।
বসে বসে প্রফেসরের সঙ্গে নিজের পুরোনো স্মৃতির কথা ভাবছিলাম, এমন সময় উনি চায়ের মগ হাতে ফিরে এলেন। বাইরে তখন সূর্য ঢলে সন্ধ্যা হতে শুরু করেছে। বাতাসে হালকা শীত শীত ভাব। গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রফেসর বললেন, ‘জানো, আমি সম্ভবত এই পৃথিবীর সবথেকে হতভাগ্য বিজ্ঞানী।’
প্রফেসরের কণ্ঠে একটা হতাশার আভাস পেয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এমনটা ভাবার কারণ?’
উনি সরাসরি কোনো উত্তর দিলেন না। বরং জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা তুমি কি এমন কোনো শক্তিতে বিশ্বাস করো যা আমাদের এই বিশ্বজগৎকে অবিরাম নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।’
এমন খাপছাড়া প্রশ্নের মুখে পড়ে আমি খানিক সময়ের জন্য কী উত্তর দেব ভেবে পেলাম না। প্রফেসর তখন নিজে থেকেই বললেন, ‘বিশ্বাস খুব বড়ো একটা শক্তি বুঝলে। বিশ্বাসের কারণে বাস্তবতা বদলে যেতে পারে।’
প্রফেসরের কথা শুনে আমি কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। বললাম, ‘সেটা কীরকম?’
প্রফেসর বললেন, ‘তোমাকে আমার আবিষ্কারটা দেখালে হয়তো তুমি সেটা বুঝতে পারবে। এসো আমার সঙ্গে।’
প্রফেসরের আবিষ্কারের কথা শুনে আমার মধ্যে একটা কৌতূহল জাগল। তাই আপত্তি করলাম না।
প্রফেসর উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি তার পেছনে পেছনে চললাম, কিছুটা উদ্বেগ, কিছুটা কৌতূহল নিয়ে। বসার ঘর থেকে একটা সরু করিডোর পেরিয়ে একসারি সিঁড়ি বেয়ে নেমে যে ঘরটায় আমরা পৌঁছলাম সেটার অবস্থান যে মাটির নীচে সেটা বুঝতে বেগ পেতে হল না। ঘরটার চারদিকে ছড়ানো নানা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, যেগুলোর অধিকাংশই আমার পরিচিত, কিছুটা অপরিচিত। দেখে বুঝলাম এটাই প্রফেসরের ল্যাবরেটরি।
ঘরের একপাশে একটা বড়ো টেবিলের উপর অদ্ভুত এক যন্ত্র রাখা। দেখতে অনেকটা আধুনিক কম্পিউটারের মতো, তবে তার গায়ে লাগানো নানা বাটন, তার আর ডায়াল দেখে মনে হল এটা সাধারণ কিছু নয়। প্রফেসর টেবিলের কাছে গিয়ে যন্ত্রটিকে একবার হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন, যেন সেটার সঙ্গে তার একটা গভীর সম্পর্ক আছে। তারপর বললেন, ‘এই হচ্ছে আমার আবিষ্কার।’
আমি কাছে গিয়ে যন্ত্রটাকে ভালো করে দেখলাম। কেন জানি না, যন্ত্রটা দেখতে দেখতে মনে হল কোন একটা রহস্য যেন একে ঘিরে আছে। সেই সঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্নেরও উদয় হল। সেটা বুঝতে পেরেই প্রফেসর বললেন, ‘কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট কাকে বলে জানো তো?’
‘কিছুটা ধারণা আছে।’
‘তাহলে এটুকু নিশ্চয়ই জানো যে একজোড়া সাব-অ্যাটমিক কণা যদি কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলড অবস্থায় থাকে তবে তাদের একটির ঘূর্ণনের দিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই অন্যটিরও ঘূর্ণনের দিক পরিবর্তন হয়। যদি কণা দুটির মধ্যকার দূরত্ব শত শত আলোকবর্ষও হয় তবুও। এই পরিবর্তন ঘটে তাৎক্ষণিক ভাবে, মানে কোনো সময়ই লাগে না।’
‘পড়েছি। যতদূর মনে পড়ে কেউ একজন এই ব্যাপারটা প্রমাণও করেছিলেন।’
‘হ্যাঁ। জন বেল প্রমাণ করেছেন, ১৯৬৪ সালে। আর তারপর থেকেই চেষ্টা চলছে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট ব্যাবহার করে এমন যন্ত্র তৈরির যাতে করে আলোর চেয়েও দ্রুত তথ্য আদানপ্রদান করা যায়। আমি যখন অজ্ঞাতবাসে যাই, তখন আসলে আমি একটা গোপন গবেষণা সংস্থায় যোগ দিয়েছিলাম যারা এই নিয়ে কাজ করছিল। সেখানে যে পাঁচ বছর আমি গবেষণা করেছি, সেই সময়ে আমি একটা অদ্ভুত ব্যাপার আবিষ্কার করি।’
কথা বলার মাঝে প্রফেসর একটু বিরতি নিলেন। নিজে ল্যাবরেটরির একটা চেয়ারে বসতে বসতে আমাকেও অন্য একটা চেয়ারে বসতে ইশারা করলেন। তারপর বলে চললেন, ‘গবেষণাগারে এনট্যাঙ্গলড কণার বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণের সময় আমি দেখতে পাই কিছু কিছু কণার ঘূর্ণনের পরিবর্তন একটা নির্দিষ্ট ছন্দ মেনে হচ্ছে। আরও দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের পর একদিন বুঝতে পারি যে ছন্দটা আসলে একটা বাইনারি কোড। মানে কেউ একজন এই কণাদের মাধ্যমে কোনো একটা তথ্য পাঠাচ্ছে। তখনও কিন্তু জানতাম না যে এই কণাগুলোর জোড়ার অপরটার অবস্থান কোথায়। তাই আমি একটা থিয়োরি দাঁড় করাই। যে হতে পারে জোড়ার অপর কণাগুলো আছে অতিদূরের কোনো এক উন্নত সভ্যতার কাছে আর তারাই সংকেতটা পাঠাচ্ছে।’
প্রফেসরের কথা শুনতে শুনতে আমি অবাক হয়ে গেলাম। প্রফেসর যা বলছেন তা যদি সত্যি হয় তবে বিজ্ঞান জগতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে যাবার কথা। কিন্তু এমন কিছু এখনও ঘটেছে বলে শুনিনি। প্রফেসর তখন বলে চলেছেন, ‘আমি কিন্তু আমার আবিষ্কারের কথা তখনও কাউকে জানাইনি। আমার ইচ্ছে ছিল আমার এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব যেন আমার দেশ পায়। তাই ওই সংস্থার সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে গেলে দেশে ফিরে এসে এখানে আস্তানা গাড়ি। তারপর ধীরে ধীরে আমার এই যন্ত্রটা তৈরি করি যেটা একই সঙ্গে কোয়ান্টাম কণার কোড রিসিভ এবং ডিকোড করতে পারে। এই যন্ত্রের মাধ্যমে ওই কোড বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারি আমার আগের থিয়োরিটা ভুল ছিল, আর সেই সঙ্গে সত্য যেটা সেটাও জানতে পারি।’
‘সত্যিটা কী?’
‘সেটা তুমি বিশ্বাস করতে চাইবে না।’
‘তবু বলুন।’
‘সত্যিটা হল সংকেতগুলো আসছিল ভবিষ্যতের পৃথিবী থেকে।
‘মানে?’
‘মানে, স্থান আর কাল যে আলাদা কিছু নয় সে তো জানোই। স্থানের অকল্পনীয় দূরত্বে থেকে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট যেভাবে কাজ করে, ঠিক একইভাবে সময়ের দূরত্বে থেকেও কাজ করে। যে সংকেতটা পাওয়া যাচ্ছিল সেটা আসছিল দূরের কোনো সভ্যতা থেকে নয়, আসছিল দূরের একটা সময় থেকে, মানে ভবিষ্যৎ থেকে।’
‘কিন্তু ভবিষ্যৎ জানা যে অসম্ভব প্রফেসর? আপনি নিশ্চিত যে আপনার কোথাও ভুল হয়নি?’
‘আমি নিশ্চিত, শতভাগ নিশ্চিত। থিয়োরিও তাই বলে।’
‘সেটাই যদি হয়, তাহলে আপনার এই আবিষ্কার এখনও বিশ্বের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছেন কেন?’
প্রফেসর মৃদু হাসলেন, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে পূর্বের সেই গভীর হতাশার ভাবটা আবার ফিরে এল। তিনি বললেন, ‘লুকিয়ে আমি রাখিনি। বরং বারবার হাজার বার চেষ্টা করেছি বিশ্বের সামনে প্রকাশ করার। কিন্তু কিছুতেই সেটা পারছি না।’
এবারে প্রফেসরের কথাগুলো কেমন খাপছাড়া মনে হল। প্রফেসর ধীরে ধীরে মাথা ঝুঁকালেন, যেন তিনি ভাবনার এক দুর্বোধ্য গভীর সাগরে ডুব দিচ্ছেন। তিনি বললেন, ‘আবিষ্কারের কথাটা আমি আমার নিজের মধ্যে রাখলে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু যদি বাইরের কাউকে জানানোর চেষ্টা করি তখনই ঘটনাটা ঘটে।’
‘কী ঘটনা?’
‘ঠিক কী ঘটে তা আমি জানি না। তবে কিছু একটা ঘটে।’ প্রফেসর হতাশায় নিজের মাথার চুল খামচে ধরলেন। তারপর আবার বললেন, ‘এই কয়েক বছরে যে আমি কত শতবার এই চেষ্টা করেছি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কিছু একটা হয়! সব কিছু হারিয়ে যায়, মুছে যায়।’
প্রফেসর থামলে আমি একটু ভেবে নিয়ে বললাম, ‘আমি এখান থেকে ফিরে গিয়ে আপনার আবিষ্কারের কথাটা সবাইকে জানানোর ব্যবস্থা করব।’
আমার কথা শেষ হতেই প্রফেসর হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, ‘না, তুমি করবে না। আসলে আমার কোনো কথাই তুমি বিশ্বাস করোনি। যদি করতে, তবে আমার কথার প্রমাণ তুমি পেয়ে যেতে।’
প্রফেসরের কথায় আমি কিছুটা লজ্জায় পড়ে গেলাম। সত্যিই আমি তার কথা কিছুই বিশ্বাস করিনি। করার কথাও নয়। বরং মনে মনে ভাবছিলাম ফিরে গিয়ে প্রফেসরের মানসিক অবস্থার কথা জানিয়ে তার সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
মনের গোপন কথাটা এভাবে প্রকাশিত হয়ে যাওয়ায় আমার অপ্রস্তুত অবস্থা বুঝতে পেরে প্রফেসর বললেন, ‘কোথায় উঠেছ? ঠিকানাটা দিয়ে যাও। আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব।’
আমি তাড়াতাড়ি নিজের ভিজিটিং কার্ডের উলটো দিকে আমার লজের ঠিকানাটা লিখে দিয়ে বিদায় নিয়ে প্রফেসরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। পেছনে শুনতে পেলাম প্রফেসর বিড়বিড় করে বলছেন, ‘আর কতবার? আর কতবার প্রমাণ করতে হবে…’
জানি না কথাটা তিনি কাকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন। তখনকার মতো এসব নিয়ে না ভেবে কোনোরকমে পালিয়ে এলাম। সারাটা রাত বিছানায় শুয়ে প্রফেসরের বলা কথাগুলো চিন্তা করে ছটফট করে কাটল। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।
পরেরদিন সকালটা এল একটা আকস্মিক ধাক্কার মতো হয়ে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখি লজের ম্যানেজার আর সঙ্গে পুলিশ। আমার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে পুলিশ অফিসার বললেন, ‘মিস্টার মন্ডল, আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।’
‘কী ব্যাপারে?’ আমি জানতে চাইলাম।
‘আপনি প্রফেসর সত্যেন সেনকে চেনেন?’
‘হ্যাঁ, চিনি তো। কাল বিকেলেই তার বাড়িতে গিয়েছিলাম।’
‘ওয়েল, তিনি গতকাল রাতে সুইসাইড করেছেন।’
খবরটা শুনে ভয়ানক চমকে উঠলাম। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মাথাটাও সম্ভবত ঘুরে উঠেছিল। ম্যানেজার আর পুলিশ অফিসার দুজনে মিলে আমাকে ধরে ঘরের সোফায় বসিয়ে দিলেন। পুলিশ অফিসার বলে চললেন, ‘ভদ্রলোকের ঘরে আপনার একটা ভিজিটিং কার্ড পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে আপনার উদ্দেশে লেখা একটা চিঠি।’
ভদ্রলোক একটা কাগজ আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি সেটা হাত বাড়িয়ে নিতেই উনি বললেন, ‘চিঠিটা আমরা পড়েছি। তবে পড়ে তেমন কিছু বুঝতে পারিনি, তাই আপনার কাছে আসা।’
আমি সোফায় বসে বসেই চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম। প্রফেসর লিখেছেন—
প্রিয় মন্ডল,
আজ আমার কথা শুনে আমার মানসিক সুস্থতা নিয়ে হয়তো তোমার মনে প্রশ্ন জেগেছে। সত্যি বলতে কি, আজকাল আমি নিজেও মাঝে মাঝে নিজেকে চিনতে পারি না। আমার সঙ্গে কী ঘটছে তার একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা আমি দাঁড় করেছি। সেটা তোমাকে বলছি। তাহলে হয়তো আমার অবস্থাটা তুমি কিছুটা বুঝতে পারবে।
টেম্পোরাল প্যারাডক্সের কথা নিশ্চয়ই শুনেছ। এই প্যারাডক্স বলে ভবিষ্যৎ থেকে তুমি অতীতে এমন কোনো তথ্য পাঠাতে পারবে না যাতে করে ভবিষ্যৎ নিজেই বদলে যেতে পারে। মানে ধরো এখনকার সময়ে দাঁড়িয়ে তুমি ১৯০০ সঙ্গে একটা তথ্য পাঠালে যে হিটলার নামে একজন আসবে যার কারণে একটা বিশ্বযুদ্ধ হবে। এখন তোমার এই তথ্য বিশ্বাস করে কেউ যদি হিটলারকে তার বাল্য অবস্থাতেই হত্যা করে, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও হবে না, আর তুমি কোনোদিন হিটলারের নামটাও জানতেই পারবে না।
আমার ধারণা আমার জীবনটা এই রকমই কোনো একটা প্যারাডক্সের মধ্যে পড়ে গেছে। আমার যন্ত্রের মাধ্যমে আমি যখন ভবিষ্যতের কোনো তথ্য জানতে পারছি আর সেই তথ্য বিশ্বাস করছি তখনই ভবিষ্যৎ পরিবর্তন হয়ে যাবার একটা সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। বিশ্বাস করার ব্যাপারটা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ বিশ্বাস না করলে এমন কোনো কাজ করার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে না যাতে ভবিষ্যৎ বদলে যেতে পারে। তবে যেভাবেই হোক, যখনই ভবিষ্যৎ বদলে যাবার মতো অবস্থা তৈরি হচ্ছে তখনই কোনো এক অদৃশ্য শক্তি এই প্যারাডক্সটা মুছে দিচ্ছে যেন ভবিষ্যৎ ঠিক থাকে।
সেই শক্তিটা যে কী বা কে, সেটা আমি জানি না। এর স্পষ্ট কোনো প্রমাণও আমার কাছে নেই। প্যারাডক্সটা মুছে যাবার পর সব কিছু আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। শুধু মনের মধ্যে কেমন একটা আবছা স্মৃতি থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় এই ঘটনাটা আমার সঙ্গে আগেও ঘটেছে।
এমনটা হয়তো অনেকের সঙ্গেই ঘটে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অহরহ ঘটে চলেছে। এমনকী আমি এই শহর ছেড়ে কোথাও যেতে চাইলেও পারছি না। ব্যাপারটা যে কতটা যন্ত্রণার সেটা আমার অবস্থায় না পড়লে বোঝানো সম্ভব নয়। আমি তাই বিদায় নিচ্ছি। যদিও আমার ধারণা এমন বিদায় আমি আগেও নিয়েছি। ভালো থেকো। হয়তো আবারও দেখা হবে।
ইতি
সত্যেন সেন
পড়া শেষে চিঠিটা নামিয়ে রাখতেই পুলিশ অফিসার আগ্রহী মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিছু বুঝতে পারলেন?’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘উনি গতকাল আমাকে একটা যন্ত্রের কথা বলেছিলেন। সেটার কথাই লিখেছেন। আসলে উনি মনে করছিলেন…’
কথা বলার মাঝে একটু থামলাম। কারণ গতকালের কথা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল, যন্ত্রটা তো এখনও প্রফেসরের বাড়ির বেসমেন্টেই আছে। চাইলেই একবার প্রফেসরের কথা যাচাই করে দেখা যায়।
সম্ভবত এই চিন্তাটাই প্রফেসরের বলা সেই সম্ভাবনার জন্ম দিল যাতে ভবিষ্যৎ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। কারণ সেই মুহূর্তেই লজের ম্যানেজারের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, ‘একি! এটা কী হচ্ছে?’
মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলাম, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক বিস্ফারিত চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঘটনা কী দেখার জন্য পুলিশ অফিসারও দ্রুত উঠে গিয়ে দাঁড়ালেন জানালার পাশে। আর তারপর তার চোখও বিস্ফারিত হয়ে উঠল।
আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। কৌতূহলী হয়ে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর তারপরেই যা দেখলাম, সেই দৃশ্য আমার এত দিনের চেনা জানা জগতের অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিল।
চরম অবিশ্বাসের সঙ্গে দেখলাম দূরে দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা পাহাড়ের সারি, নীল আকাশ সব মুছে গিয়ে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে এক নিকষ কালো ভয়াবহ অজানা শূন্যতায়। আর সেই শূন্যতা ক্রমাগত ধেয়ে আসছে আমারই দিকে।
***
পরিশিষ্ট:
রোজকার মতো সকাল সাতটার সময় বেরিয়ে এক ঘণ্টা প্রাতঃভ্রমণ শেষে একটা চেনা চায়ের দোকানে ঢুকতে যাচ্ছি, এমন সময় বয়স্ক একজন লোক অনেকটা অন্যমনস্কভাবে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। এক পলকের জন্য লোকটার মুখটা দেখে আমি চমকে উঠলাম। কিন্তু কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক মৃদু কণ্ঠে ‘দুঃখিত’ বলে বাইরে বেরিয়ে পড়লেন।
দোকানের ভিতরে ঢুকতেই দোকানদার একগাল হেসে বলল, ‘উনি একটু ওরকমই। আপনি কিছু মনে করবেন না।’
দোকানদারের কথা শুনে মনে হল ভদ্রলোক তার পরিচিত। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভদ্রলোককে চেনা চেনা লাগল, উনি কে?’
কথাটা বলার পরেই মনে হল এই ব্যাপারটা আমার সঙ্গে আগেও ঘটেছে।
Tags: এস. সি. মন্ডল, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা