উত্তরাধিকার
লেখক: বুমা ব্যানার্জী দাস
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
পৃথিবী, ১০০ অ্যানো এক্সটিঙ্কসনিস
আকাশটা হলদেটে কমলা হয়ে আছে, হালকা পোড়া পোড়া গন্ধে ছেয়ে আছে চারিদিক, যেন দাবানল লেগেছে কোথাও। না, দাবানল আর লাগবে কীভাবে? গাছ থাকলে তবে না দাবানল। এটাই এখন স্বাভাবিক আবহাওয়া। চাপা একটা নিশ্বাস পড়ে দেবদত্ত ৭১৩-র। আড়চোখে পাশে দাঁড়ানো মুস্কো চেহারার বটটার দিকে তাকায় সে। এটা জিওলজি বিভাগের সন্ধানী বট। কপালের, মানে যদি ওখানটা কপাল বলে ভেবে নেওয়া যায়, স্ক্যানার দিয়ে নিবিষ্ট মনে স্ক্যান করে চলেছে মাটির তলা। তার নীচে ত্রিমাত্রিক ডিসপ্লেতে কেবল একরঙা বিজবিজে ফুটি। কাঙ্ক্ষিত বস্তুর সন্ধান পেলে তবেই রঙিন বিন্দুতে ফুটে উঠবে তার অবস্থান সম্বন্ধীয় যাবতীয় তথ্য। এক সময়ে এই জায়গায় মস্ত একটা জলাধার ছিল, না, তাদের কাচের তৈরি ট্যাঙ্কের মতো নয়। প্রাকৃতিক জলাধার। আর তারা, মানে দেবদত্ত ৭১৩-রা যার সামান্য চিহ্নটুকু খুঁজে চলেছে মরিয়া হয়ে, তা নাকি হেলায় ফেলায় সেই জলাধারের পাশে যত্রতত্র গজিয়ে উঠত। হাতের আধ ইঞ্চি ছোট্ট যন্ত্রটায় চাপ দিতেই দেবদত্ত ৭১৩-র হেলমেটের মতো দেখতে তাপনিয়ন্ত্রিত মাথার ঢাকাটার চোখের সামনের স্বচ্ছ অংশে ফুটে ওঠে কতগুলো সংখ্যা। হিসেব করে ঠিক দেড়শো বছর আগের তারিখটা বেছে নেয় সে হাতের রিমোট কন্ট্রোলের মতো দেখতে যন্ত্রটা দিয়ে। সামনের স্বচ্ছ অংশটা চোখ থেকে খানিকটা এগিয়ে, যাতে সেখানে কিছু ফুটে উঠলে দেখতে অসুবিধা না হয়। তারিখটা বাছার সঙ্গে সঙ্গে পর্দায় ফুটে ওঠে এই এলাকার দেড়শো বছর আগেকার দৃশ্য। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দেবদত্ত ৭১৩। প্রথমেই তার মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে ওঠে একরাশ জল দেখে। নীলচে জল, সেটা সামান্য দুলছে। দুলছে দুইপাশের ঘন সবুজ বস্তুগুলোও। এই জিনিসই তো খুঁজছে তারা। আগে বহুবার ঐতিহাসিক ডকুমেন্টরিতে দেখেছে, তাও খুব খুঁটিয়ে দেখতে থাকে সে। সরু সরু লাঠির মতো কিছুর দুইপাশে চ্যাপটা চ্যাপটা গড়নের সবুজ রঙা লম্বাটে গোল আকৃতি। না, সব যে লম্বাটে গোল ধাঁচের তা নয়। কোনোটা সরু লম্বা, কোনোটা হার্ট শেপড। যান্ত্রিক কণ্ঠ কানের কাছে জানান দিল—ওগুলোকে বলে পাতা।
পাতাগুলো দুলছে, এর মানে হাওয়া বইছে। জলের ভিতর থেকে কী একটা প্রাণী হঠাৎ লাফিয়ে উঠে আবার তলিয়ে গেল। দেবদত্ত ৭৩১-র অদ্ভুত একটা ইচ্ছা হল হঠাৎ। মাথার সুরক্ষা আবরণটা খুলে ওই হাওয়াটা মাথায় লাগানোর তীব্র একটা বাসনা যেন সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ল তার। ওই যে জলাধারটা, যান্ত্রিক কণ্ঠ বলছে ওকে নাকি নদী বলে, ওটার পাশে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়তে প্রবল ইচ্ছা করছে।
তার অন্যমনস্ক ভাবটা টের পেতে বেশি সময় নিল না প্রজ্ঞা। কানের কাছে বলে উঠল—মনঃসংযোগ হারাচ্ছ দেবদত্ত ৭১৩। তুমি দেড়শো বছর আগেকার পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে নেই। এটা ২৪৫০ খ্রিস্টাব্দের ছবি, তখন লোকে বলত অ্যানো ডমিনি।
মাথা ঝাঁকিয়ে যেন নিজের চিন্তার জাল থেকে মুক্ত হতে চায় দেবদত্ত ৭১৩। ঠিক কথা, কর্তব্য ভুলে যাওয়ার সময় এটা নয়। ভাগ্যিস প্রজ্ঞা আছে। একসময়ে নাকি প্রত্যেকের নিজের মতো করে চিন্তা করার স্বাধীনতা ছিল, কে কী ভাবছে বোঝার কোনো উপায় ছিল না। স্বভাবিকভাবেই মনুষ্যকৃত অপরাধের সংখ্যা ছিল সীমাহীন। এখন জন্ম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মস্তিষ্কে বসানো হয় ছোট্ট একটি যন্ত্রাংশ। ব্যস, নবজাতক বা জাতিকা যেই হোক, সঙ্গে সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে যায় কেন্দ্রীয় সুপারকম্প্যুটার প্রজ্ঞার সঙ্গে। প্রতিটা চিন্তাস্রোত বা কল্পনা যাই হোক না কেন প্রজ্ঞা তা জানতে পারে, তাকে ফাঁকি দেওয়ার উপায় থাকে না। তবে ওসব বেকার চিন্তাভাবনা করার সমস্যায় কে আর যেতে চায়, নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করলেই ঝামেলা মিটে যায় যখন। এই যেমন এখন ঠিক সময়ে কেমন দেবদত্ত ৭১৩-কে সাবধান করে দিল প্রজ্ঞা। অবশ্য শুধু সাবধান করে দিয়েই ক্ষান্ত হত না সে। তারপরেও যদি দেবদত্ত ৭৩১ নিজের মাথার সুরক্ষা আবরণ খুলে ফেলার চেষ্টা করত, মৃদু বৈদ্যুতিক শক পাঠিয়ে আধঘণ্টার জন্য তাকে অসাড় ধরে ফেলতে গোটা এক সেকেন্ডও লাগত না প্রজ্ঞার।
মিটমিট করে বাইরের পৃথিবীর দিকে তাকায় দেবদত্ত ৭৩১। দেড়শো বছর আগের নয়, বর্তমান পৃথিবীর দিকে। যতদূর চোখ চলে ছোটো ছোটো ফাটলে ঢাকা ধূসর শুষ্ক প্রান্তর। মাথার ঢাকাটা খুলে ফেললে আশি গোনার আগেই সম্ভবত শ্বাসকষ্ট শুরু হত। যাকগে, কাজ এগোনো যাক। হাতে ধরা যন্ত্রটার সাহায্যে এবার ঠিক একশো বছর আগের তারিখ বেছে নেয় সে। চোখের সামনের পর্দায় ভেসে ওঠে পৃথিবীর ইতিহাসে পড়া অতি পরিচিত এক দৃশ্য। সেই জলাধার থেকে বাষ্প উঠছে ঘন হয়ে, দুই পাশের সবুজ বস্তুগুলো নেতিয়ে পড়েছে, হলদে আর খয়েরি মেশানো একটা রং ধরেছে তাদের গায়ে। আধপোড়া দেহ নিয়ে ভেসে উঠেছে প্রাণীর দল। যতদূর মনে পড়ছে ওগুলোকে মাছ বলত। চিন্তাটা মাথায় খেলতেই কানের কাছে প্রজ্ঞার স্থির গম্ভীর গলা জানান দেয়—হ্যাঁ, মাছ।
কী করবে ভেবে পায় না দেবদত্ত ৭১৩। ঠিক একশো বছর আগে লুপ্ত হয়েছে পৃথিবীর সব সবুজ, শেষ হয়ে গেছে প্রাকৃতিক জলের শেষতম বিন্দু। শুরু হয়েছে নতুন অব্দ, অ্যানো এক্সটিঙ্কসনিস। অ্যানো ডমিনির অনুকরণে এও ল্যাটিন ভাষার শব্দ। সে ভাষা যদিও তার অনেক আগে লুপ্ত, কেউ জানে বোঝে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই নাম রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল, কেউ দ্বিমত প্রকাশ করার কথা ভাবেওনি। প্রজ্ঞার অবশ্য অস্তিত্ব ছিল না তখন।
হয়তো মানবসভ্যতাও শেষ হয়ে যেত, কিন্তু ধনীরা নিজেদের ব্যবস্থা ঠিকই করে রাখে। তাই প্ল্যানেট আর্থের যে এক তৃতীয়াংশ মানুষ ঠিক সচেতনতা নয়, অর্থের শক্তিতে নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পেরেছিল, তাদের বংশধররাই এই ধূসর খয়েরি গ্রহের একমাত্র বর্তমান বাসিন্দা।
অবশ্য অ্যানো এক্সটিঙ্কসনিসের বীজ তার বহু আগে বোনা হয়ে গিয়েছিল। এক সময়ে নাকি এই গ্রহের উত্তর আর দক্ষিণ প্রান্ত তুষারের স্তরে ঢাকা ছিল। তুষার বস্তুটা ল্যাবরেটরিতে অল্প পরিমাণে দেখেছে দেবদত্ত ৭১৩, কিন্তু তুষার ঢাকা প্রান্তর কেমন হয় তা বুঝতে পারে না। অপ্রয়োজনীয় তথ্য হিসেবে প্রজ্ঞা সেসব ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করার অনুমতি দেয় না। অনিয়ন্ত্রিত দূষণ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সেই সময়ে প্রান্তদেশের সে তুষার গলে গিয়ে নিয়ে আসে এক অকল্পনীয় প্লাবন। বহু ভূখণ্ড তলিয়ে যায় জলের তলায়। অবশ্য মঙ্গলগ্রহে নতুন কলোনি ততদিনে তৈরি। কিন্তু হলে কী হয়, যে ক-জন মানুষকে পাঠানো হয়েছিল প্রাথমিকভাবে, তাদের মধ্যে দেখা যায় গভীর অবসাদ। ফলে মাঙ্গলিক কলোনিতে বসবাসের সম্ভাবনা বেশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই টানাপোড়েনের মধ্যে পৃথিবীর জলের উপর তখনও জেগে থাকা বাকি ভূখণ্ডগুলোর মধ্যে শুরু হয় তুমুল বিবাদ। দেশের সীমারেখা সবই ওলোট পালোট হয়ে যাওয়ার ফলে পড়ে থাকা সীমিত খাদ্যশস্য, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ, প্রাণিসম্পদের বণ্টন এই বিবাদের মূল কারণ। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও রাসায়নিক আর জৈব অস্ত্রের ব্যবহারে কোনো বাধা ছিল না। এমনকী মঙ্গলের উপনিবেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল সে যুদ্ধের রেশ। ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হতে থাকল প্রাকৃতিক সমস্ত সম্পদ। বোধহয় বণ্টন করার মতো বিশেষ কিছু আর না থাকাতেই একদিন শেষ হল সে বিবাদ। ততদিনে প্লাবন ঘটানো জলরাশিও উধাও। পড়ে থাকা ভূখণ্ড জুড়ে জুড়ে এখন পৃথিবীতে থেকে গেছে চারটি প্রধান দেশ। দেবদত্ত ৭১৩ পুব দেশের বাসিন্দা। প্রজ্ঞা সাত-আটটা নাম বেছে রেখেছে তাদের জন্য, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেগুলো দিয়েই তাদের পরিচয় নির্ণয় করা হয়, সে যেমন দেবদত্ত ৭১৩। অর্থাৎ তার আগে আরো ৭১২ জন দেবদত্ত আছে বা ছিল, তার পরে কেউ এই নাম পেলে সে হবে দেবদত্ত ৭১৪।
জিওলজির বট হঠাৎ তীব্র একটা শব্দ করে ওঠে, মাথার মধ্যে ঝনঝন করে ওঠে দেবদত্ত ৭১৩-র। কিছু পেল নাকি? নাহ্, ডিসপ্লেতে ফুটে উঠেছে কয়েকটি সংকেত যার মানে আপাতত খোঁজা শেষ, এই প্রান্তে অন্তত তাদের অভিযান নিস্ফল। শরীর টানটান করে আকাশের দিকে তাকায় দেবদত্ত ৭১৩। অন্ধকার হয়ে গেছে রীতিমতো। কালচে নীল আকাশে মুহূর্তের জন্য চোখে পড়ে উজ্জ্বল এক বিন্দু। আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন। চাপা একটা নিশ্বাস পড়ে তার। চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুটো উজ্জ্বল খয়েরি চোখ, এলোমেলো নীলচে-কালো চুল। মাথাটা জোরে ঝাঁকিয়ে অন্য একটা চেহারা মনে আনার চেষ্টা করে সে। কেমন যেন, হ্যাঁ লালচে গোলাপি রং, টান টান সুডৌল কপাল, ঈষৎ বাদামি চুল চুড়ো করে বাঁধা। নিখুঁত শরীরের গড়ন। মন্দ কী? তা ছাড়া প্রজ্ঞার সিদ্ধান্তে ভুল হওয়া সম্ভব নয়। একুশ বছর বয়স পূর্ণ হলেই প্রজ্ঞা সঙ্গী নির্বাচন করে দেয়। এই প্রক্রিয়া সহজ নয়, মনোবৃত্তি, শারীরিক চাহিদা, রুচি সব কিছু বিচার করে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে পারিবারিক জীবনে শান্তি বজায় থাকে। তবু মাঝে মাঝে অন্য একটা চেহারা কেন যে উঁকি দেয় দেবদত্ত ৭১৩-র মনে। প্রজ্ঞা অবশ্যই টের পায় সব, তবে যতক্ষণ না কেউ অনভিপ্রেত কোনো কাজ করছে ততক্ষণ তার হস্তক্ষেপ করার প্রশ্ন ওঠে না। আর বছর দুয়েক বাদেই সে আর তার নির্বাচিত সঙ্গী একসঙ্গে থাকতে শুরু করবে, কিন্তু এখুনি তার নামটাও কেন যে মনে পড়ছে না। অন্য একটা নাম মাথাটা জুড়ে বসছে যেন। প্রজ্ঞাকে কি জিজ্ঞেস করে নেবে? নাহ্ থাক।
বটটার পাশাপাশি চুপচাপ গরুঢ়ে গিয়ে ওঠে সে। ক্ষুদ্রাকার কিন্তু অতি দ্রুতগতিসম্পন্ন এই যান মাটি থেকে সামান্য উপরে চলে চৌম্বক উত্তোলনের সাহায্যে। গন্তব্য নির্দিষ্ট করে দিতেই স্বয়ংক্রিয় গরুঢ় পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে শহরের কেন্দ্রের দিকে রওনা দেয়। অপ্রাসঙ্গিকভাবে দেবদত্ত ৭১৩-র মনে পড়ে যায় এই জায়গাটা এক সময়ে ভারতবর্ষ নামে এক দেশের অংশ ছিল।
আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন, ১০০ অ্যানো এক্সটিঙ্কসনিস
জানলার নীচের দিকে ধূসর একটা পিণ্ড। আর উপরের ঘন কালো অংশে ছোট্ট একটা লালচে বুটি। সূর্যের আলোয় নীচের পিণ্ডটা উজ্জ্বল হয় খানিক, তবে ধূসর রং বদলায় না। বহু বছর আগে নাকি নীলচে-সবুজ দেখাত ওটা। হবে হয়তো। সবুজ রং খুব একটা দেখেনি অরুন্ধতী। আসলে তার নাম অবশ্য অরুন্ধতী ৫৫৫, কিন্তু এখানে কে আর আছে। লালচে বুটিটার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সে। লাল গ্রহে উপনিবেশের চেষ্টা সফল হল না বটে, কিন্তু যুদ্ধবন্দি আর তুখোড় অপরাধীদের ওখানে রাখা হয় ইদানীং। পুবের দেশে প্রজ্ঞা বিশেষ অপরাধ ঘটতে না দিলেও পশ্চিম, উত্তর আর দক্ষিণের দেশের বাসিন্দাদের অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে প্রজ্ঞাও যে সবসময় সফল হয় তাও নয়। শয়তানিতে মানুষ চিরকাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে টেক্কা দিয়ে এসেছে।
পৃথিবীর দিকে তাকায় অরুন্ধতী। কবে সে আবার ফিরতে পারবে তা জানে না। প্রায় আট মাস হয়ে গেল সে স্পেস স্টেশনের বাসিন্দা। কিছু দিন আগেও পশ্চিম দেশের এক বৈজ্ঞানিক ছিলেন তার সঙ্গে, মাসখানেক হল তিনিও ফিরে গেছেন। অবশ্য পিছুটান নেই এমন লোকজনকেই বাছা হয় স্পেস স্টেশনে বসে খবরদারি করার জন্য। ছোটো থেকে তাকে এই কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। জন্মের পর থেকে সে অনাথ, তাই রাষ্ট্রই তার অভিভাবক। এমনকি প্রজ্ঞাও তার জন্য কোনো সঙ্গী নির্দিষ্ট করে দেয়নি। তাতে অবশ্য অরুন্ধতীর কোনো অসুবিধা বা আপত্তি নেই। মানুষের সঙ্গ তার বড়ো একটা ভালো লাগেও না। লাল ফুটকিটার দিকে নজর ফেরায় সে। মঙ্গলের চারটে উপগ্রহ থেকে আসা ডেটা ফুটে উঠছে জানালার পাশের নীলাভ স্ক্রিনে। মন দিয়ে চোখ বোলায় অরুন্ধতী। যদিও এটা রুটিন ড্রিল, তবু ভীষণ রকম জরুরি। মঙ্গলের উপনিবেশ আসলে জেল, প্রহরা থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। সেখান থেকে পৃথিবীর দিকে কেউ রওনা দিল কিনা সেটা খেয়াল রাখা দরকার। প্রহরীরা বেশির ভাগ আন্তর্জাগতিক সুরক্ষা বিভাগের বট। তাদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসা মুশকিল হলেও নেহাৎ অসম্ভব নয়। তা ছাড়া মাস ছয়েক ধরে আরও একটা কাজের চেষ্টা চলছে স্পেস স্টেশনে। পৃথিবীতে সমস্ত উদ্ভিদ লুপ্ত হয়েছে একশো বছর আগে। পার্থিব পরিমণ্ডল দূষিত, যথাযথ পোশাক ছাড়া সে বায়ুমণ্ডলে বেরোনো চলে না। বেশির ভাগ প্রজাতির প্রাণী সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে, যদিও কয়েকটি প্রজাতি আশ্চর্য সব অভিযোজনের ফলে টিকে রয়েছে এখনও। তবে তারা মূলত সরীসৃপ শ্রেণীর। মাস আষ্টেক আগে আন্তর্জাতিক সংস্থা এনভোগ্রিনের পক্ষ থেকে জনা দশেক বিজ্ঞানীকে বাছা হয়েছিল কৃত্রিম উপায়ে উদ্ভিদ তৈরি করার বিষয়টা খতিয়ে দেখার জন্য। পাঁচ জন কাজ করছিল পৃথিবীতেই, বাকি পাঁচ জনকে পাঠান হয়েছিল স্পেস স্টেশনে।
বলা বাহুল্য সফলতার কোনো লক্ষণ এখনও দেখা যায়নি কোথাও। স্পেস স্টেশনের বাকি চার বিজ্ঞানী আপাতত এনভোগ্রিনের অনুমতি নিয়ে একে একে ফিরে গেছেন নিজেদের দেশে, থেকে গেছে অরুন্ধতী। হয়তো খানিকটা ইচ্ছা করেই।
লাল ফুটকির উপগ্রহ থেকে পৃথিবীর দিকে দৃষ্টি ফেরায় সে এবার। কোথাও একটা অক্ষত বীজও কি পড়ে নেই? ওইটুকু সাহায্য পেলেই কাজটা অনেকখানি এগোনো যায়। আজকাল উদ্ভিদবিজ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই কেউ পড়ে না, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কাউকে কাউকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় শুধু, যেমন অরুন্ধতীকেও নিতে হয়েছিল। আর সেখানেই তো, নাহ্ থাক—অপ্রয়োজনীয় কথা ভেবে লাভ কী।
অ্যানো এক্সটিঙ্কসনিস শুরু হওয়ার বহু আগে পুরোনো পৃথিবীর স্পেস স্টেশনে কয়েক প্রকার শাক আর ফুল গজাতে নাকি সক্ষম হয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। ওই প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময়েই এসব শুনেছিল তারা। তা সে স্পেস স্টেশন তো বিশাল এক গ্রহাণুর ধাক্কায় কবে চুরচুর হয়ে গেছে। আরও শুনেছিল যে আদ্যিকালের এক পৃথিবীবাসী একটা দশ গ্যালনের বোতলে জল, আর কী যেন একটা গাছের বীজ পুরে সীল করে টেরারিয়াম বানিয়েছিলেন। তখন পৃথিবীতে বহু দেশ, মহাদেশ, সমুদ্র ছিল। অরুন্ধতী চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করে কেমন ছিল সেই পুরোনো পৃথিবী? ইচ্ছামতো সুরক্ষা আবরণ ছাড়াই বাইরে যাওয়া যেত। কত রকম গাছ, ফুল, প্রাণী ছিল সবুজ নীল গ্রহটাতে। ছবিগুলো মনে করার চেষ্টা করে সে। আর সেই ভদ্রলোক, যিনি কাচের বোতলে বীজ পুরে টেরারিয়াম বানিয়েছিলেন, কী যেন বেশ নামটা তাঁর? অন্যমনস্ক অরুন্ধতীর আঙুলগুলো কনট্রোল প্যানেলের কিপ্যাডে ঘুরতে থাকে এলোমেলো। হ্যাঁ মনে পড়েছে, লাটিমার, ডেভিড লাটিমার। আকাশ পাতাল চিন্তা করতে করতে অরুন্ধতী ৫৫৫ কিপ্যাডে টাইপ করে ফেলে শব্দটা। পরমুহূর্তে একটা অপ্রত্যাশিত ঘড়ঘড় শব্দে ভীষণভাবে চমকে ওঠে সে। কেবিনের পিছন দিকের একটা বিশেষ অংশ খানিকটা সরে গিয়ে বেশ বড় একটা চৌকো খোপ তৈরি হয়েছে। জোরালো আলোয় সেই খোপ আলোকিত, আর ভিতরে –
দ্রুত সেফটি বেল্ট খুলে ভেসে ভেসে এগিয়ে যায় অরুন্ধতী। সে যা ভাবছে এটা কী সেই জিনিস? সারা শরীর একবার কেঁপে ওঠে তার। তীব্র আলোর নীচে বিশাল একটা কাচের পাত্র, তার ভিতরে একরাশ অদ্ভুত দেখতে কী যেন। খোপের উপরটা দুই হাতে ধরে ভাসমান এক মানুষ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে একরাশ মরকত মণির মতো সবুজ পাতার দিকে। এই কি তাহলে লাটিমারের টেরারিয়াম! স্বয়ংসম্পূর্ণ এক বাস্তুতন্ত্র। ওই তীব্র আলো সাহায্য করে সালোকসংশ্লেষে, মুক্ত হওয়া অক্সিজেন গাছ নিজেই আবার টেনে নেয়। প্রস্বেদনে ছাড়া পাওয়া বাষ্প কাচের গায়ে লেগে জলকণায় পরিণত হয়ে ঝরে পড়ে নীচের মাটিতে, শিকড় আবার সেটাকেই টেনে নেয়। কিন্তু কে এখানে এটাকে সংরক্ষণ করে রাখল? তার থেকেও বড়ো কথা এখুনি এনভোগ্রিনকে জানানো প্রয়োজন। হঠাৎ পলকের জন্য একজনের কথা মনে পড়ে অরুন্ধতীর। তার কাজ অবশ্য পৃথিবীতে। নাহ্, ব্যাক্তিগতভাবে কাউকে এ খবর দেওয়া নীতিবিরুদ্ধ। হাওয়ায় ভেসে অরুন্ধতী ফিরে আসে কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে।
পৃথিবী, ১০০ অ্যানো এক্সটিঙ্কসনিস
কিন্তু বীজ যেহেতু সংরক্ষিত আছে, অরুন্ধতী ৫৫৫-র বক্তব্য অনুযায়ী পুরো পাত্র জুড়ে গাছ গজিয়েছে, তাহলে এবার আন্তর্জাতিক বৈঠক ডেকে কোন দেশ কোথায়—
এনভোগ্রীনের কর্ণধার স্যামুয়েল ৯৯৬ এর কথা শেষ হওয়ার আগেই পশ্চিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তাঁকে বাধা দেন—স্যাম ওল্ড মেট শোনো, শোনো। তোমার কাজ এখন আপাতত শেষ। এবার আমাদের পালা। ও জিনিস কে নেবে, কেন নেবে সেসব আমরা ঠিক করে নিচ্ছি, তোমার খামোকা চাপ নেওয়ার প্রয়োজন কী? এসব কাজকর্ম মিটে যাক, তারপর আবার তোমার টিম নিয়ে কাজ শুরু করো। একবার যখন পাওয়া গেছে, পশ্চিম দেশকে সবুজে সবুজ করার দায়িত্ব তোমার।
ঠিক বুঝলাম না সুপ্রিমো, ওই টেরারিয়াম তো সারা পৃথিবীর, কোন দিকে বা কোন দেশে আমরা সবচেয়ে সফল হব তাও তো বলা সম্ভব নয়—উদ্বিগ্নভাবে বলেন প্রৌঢ় বিজ্ঞানী স্যামুয়েল ৯৯৬। রাষ্ট্রপ্রধানকে নাম ধরে ডাকার নিয়ম নেই, তাঁদের সুপ্রিমো বলে সম্বোধন করতে হয়। এনভোগ্রিন সারা পৃথিবী জুড়ে কাজ করলেও তাদের প্রধান শাখা পশ্চিম দেশে। স্পেস স্টেশন থেকে জরুরি বার্তা আসার সঙ্গে সঙ্গে সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে খবর পাঠিয়ে দিলেও তিনি নিজে ছুটে এসেছিলেন পশ্চিম দেশের সুপ্রিমোর কাছে। কিন্তু এঁর বক্তব্য ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না, কী যেন একটা গোলমাল ঠেকছে।
হঠাৎ সুপ্রিমোর মুখের রেখা কিঞ্চিৎ কঠিন হয়ে ওঠে। কাটা কাটাভাবে বলেন—কিছু জিনিস আপনি ভালো বোঝেন, কিছু আমি। যথাসময়ে নির্দেশ পাবেন। ততক্ষণ বরং প্রাচীন পৃথিবীর টেরারিয়াম স্পেস স্টেশনে কে সংরক্ষণ করে রেখেছিল সেই নিয়ে গোয়েন্দাগিরি করুন, সময়টা কেটে যাবে।
মুখটা লাল হয়ে ওঠে স্যামুয়েল ৯৯৬ এর। অপমানটা হজম করে উঠে দাঁড়ান তিনি, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যান। লম্বা কাচঢাকা করিডোর পার হতে হতে বাইরে চোখ যায় তাঁর। ধূসর রুক্ষ প্রান্তরে আলপনার মতো ফাটল ধরেছে। একদিন আবার সবুজ হয়ে যাবে তো সব? ডিপ স্পেস নেটওয়ার্কের অপারেটর যখন জানিয়েছিল স্পেস স্টেশন থেকে অরুন্ধতী ৫৫৫ কথা বলতে চায়, স্যামুয়েল ৯৯৬ ভেবেছিলেন ও বোধহয় এবার ফিরতে চায় পৃথিবীতে। মেয়েটার গলা উত্তেজনায় কাঁপছিল কেমন।
আবার ফুল ফুটবে স্যাম, যেমন ছবি দেখিয়েছিলে তুমি হলুদ, গোলাপি, সাদা ফুল—ফুঁপিয়ে উঠেছিল অরুন্ধতী ৫৫৫। রীতি ভুলে স্যাম ৯৯৬ এর বদলে শুধু স্যাম বলে ডেকে ফেলেছিল। পুব দেশের মানুষরা বড়ো অনুভূতিপ্রবণ হয়। এইমাত্র অবশ্য সুপ্রিমোও তাই বলে ডাকলেন। হঠাৎ একটা অকারণ উদ্বেগ বোধ করলেন তিনি, কী যেন একটা বিপদের আঁচ তাঁর অবচেতনে সাঁতরে বেড়াচ্ছে, সচেতন মনে ধরা পড়ছে না।
পরবর্তী সুপারপাওয়ার কে হবে তাহলে? পশ্চিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তাঁর মন্ত্রীমণ্ডলীর হলোগ্রামের দিকে তাকান। দুষ্প্রাপ্য পাথরের মতো তাঁর চোখ দুটো ঝিকমিক করছে।
ওই টেরারিয়াম যে দেশের আয়ত্তে থাকবে, নিঃসন্দেহে তারা—কথা শেষ হওয়ার আগেই মিগুয়েল ৩৭০ এর সপাট জবাব। ছোকরার এলেম আছে, না হলে কী আর এমনি এমনি এত অল্প বয়সে বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব পায়।
কিন্তু ওই বুড়ো স্যামুয়েল তো সব দেশকে জানিয়ে দিয়েছে, তাহলে? সুপ্রিমোর কপালে ভাঁজ।
বুড়োর কাজ বুড়ো করেছে, আমাদের কাজ আমরা করব—মিগুয়েল ৩৭০ এর গলায় উদ্বেগের চিহ্নমাত্র নেই।
প্লিজ এক্সপ্লেন।
সোজা কথায় ওই টেরারিয়াম অন্য কোনো দেশের হাতে পড়া চলবে না। একবার আমাদের হাতে এসে গেলে স্পেস স্টেশনের বৈজ্ঞানিকের হতাশাজনিত ডেলিরিয়ম বলে রটিয়ে দিতে কতক্ষণ।
আর স্যামুয়েল ৯৯৬? সুপ্রিমো টের পান বহুদিন পর তাঁর রক্ত যেন চঞ্চল হয়ে উঠছে।
ওকে কেনা না গেলে সরাতে হবে—একটা ভ্রূ সামান্য উপর দিকে উঠে যায় মিগুয়েল ৩৭০এর।
প্রস্তাব ভালোই, কিন্তু মুশকিল হল ও বস্তু রয়েছে স্পেস স্টেশনে। আনতে গেলে জানাজানি তো হবেই।
পৃথিবী থেকে গিয়ে আনলে জানাজানি হবে, কিন্তু মঙ্গল থেকে যদি কেউ যায়? এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আনাতোলি ৫২-র চাপা গলা ভেসে আসে।
মানে?! চমকে ওঠে সুপ্রিমো।
মিনিটখানেক সব নিস্তব্ধ, তারপরেই অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে সুপ্রিমোর ক্যাবিনেট। স্বয়ং সুপ্রিমোর ঠোঁটেও চিলতে হাসি।
ব্রিলিয়ান্ট, কিন্তু সবাই যদি এটাই ভাবে? মানে আমরা যেটা করতে চাইছি বাকিরাও তো সেটাই—কথা শেষ করে না মিগুয়েল ৩৭০।
গভীর একটা নিশ্বাস ফেলে সুপ্রিমো। তারপর দুই হাত দুইপাশে ছড়িয়ে বলে—তা বেশ তো, প্রাথমিক একটা শক্তি পরীক্ষা হয়েই যাক বরং। মঙ্গলে প্রহরীদের জন্য যা যান আছে, সেগুলোই ব্যবহার করার নির্দেশ দিচ্ছি তাহলে। দক্ষিণ বা উত্তরের দেশ নিয়ে তত ভাবছি না, পুবের দেশকে নিয়েই চিন্তা। তবে তাদের তো আবার অপরাধীই বিশেষ নেই—বোতাম টিপে আলোচনা শেষ করতে যাচ্ছিলেন সুপ্রিমো, মিগুয়েল ৩৭০ বলে ওঠে—স্পেস স্টেশনে এনভোগ্রিনের যে মহিলা বৈজ্ঞানিক আছে, তার ব্যবস্থাও যেন এরা করে দেয়। অবশ্য না বললেও মনে হয় তারা উপযুক্ত ব্যবস্থাই নেবে—বিশ্রী একটা হাসির শব্দের সঙ্গে মিগুয়েল ৩৭০ এর ট্রান্সমিশন বন্ধ হয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন, ১০০ অ্যানো এক্সটিঙ্কসনিস
আটচল্লিশ ঘণ্টা হতে চলল, এখনও কোনোরকম সাড়াশব্দ নেই কারুর। অরুন্ধতীর কপালে ভাঁজ, চোখে অনিদ্রার স্পষ্ট ছাপ। ভেবেছিল খবরটা পাঠানো মাত্রই হইচই শুরু হয়ে যাবে। কোথায় কী। গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় অন্তত সাতাশবার চেষ্টা করেছে স্যামুয়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে, প্রত্যেকবার ডিপ স্পেস নেটওয়ার্কের অপারেটরের নিস্পৃহ গলায়—ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না—শুনে হাল ছাড়তে হয়েছে। অরুন্ধতীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে কোথাও। আধঘণ্টা অন্তর আলোকিত খোপটার কাছে গিয়ে একবার করে দেখে আসছে সে। একবার ভাবল নিজেই জিনিসটা নিয়ে চলে যাবে কিনা। বাঁ দিকের জানলা দিয়ে স্পেস স্টেশনের চ্যাপটা পিঠের উপর ডক করা ছোট্ট ক্যাপসুলটার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে বারবার। স্বয়ংক্রিয় এই যানগুলো একজন মাত্র যাত্রীকে বহন করতে পারে, স্পেস স্টেশন থেকে কেবলমাত্র পৃথিবী পর্যন্ত এর যাতায়াতের পরিধি। সেটুকুই প্রয়োজন আপাতত। কিন্তু অনুমতি ছাড়া সে কাজ করতে পারবে না অরুন্ধতী। এই ব্যাপারে নিয়ম খুব কড়া।
একটানা পিঁইই শব্দে চিন্তার জাল কেটে যায় তার। সামনের স্ক্রিনে দ্রুত ফুটে উঠছে অক্ষরের সারি। দেখতে দেখতে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে ওঠে। এ আবার কী কাণ্ড। লাল গ্রহ থেকে কোনো একটা যান রওয়ানা দিয়েছে। এরকম হলে কী যেন করতে হয়? দ্রুত মনে করার চেষ্টা করে অরুন্ধতী। হ্যাঁ সবার আগে যাত্রাপথ থেকে সম্ভাব্য গন্তব্য বোঝা যায় কিনা দেখতে হবে।
স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে পড়ে অরুন্ধতী, কাঁপা কাঁপা গলায় ভয়েস কম্যান্ড দেয়—সম্ভাব্য গন্তব্য বের করতে পারবে?
পাঁচ সেকেন্ড বাদে নিস্পৃহ যান্ত্রিক কণ্ঠে উত্তর আসে—অবশ্যই, ওদের গন্তব্য স্পেস স্টেশন।
মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে অরুন্ধতী। কে বা কারা লাল গ্রহ থেকে আসছে সেটা জানার একটাই উপায়। অবশ্য খামোকা উদ্বিগ্ন হচ্ছে সে এমনটাও হতে পারে। হয়তো পৃথিবী থেকে উচ্চপদস্থ কেউ গিয়েছিল ওখানে, টেরারিয়ামের খবরটা পেয়ে এখানে আসছে। কিন্তু সেটা হলেও এনভোগ্রিন থেকে তাকে কিচ্ছু জানাবে না!
ডিপ স্পেস নেটওয়ার্কে আপনাকে স্বাগতম, আপনার প্রয়োজনটা বলুন দয়া করে—অপারেটরের গলায় সামান্য বিরক্তি কেন বুঝতে পারে না অরুন্ধতী।
আন্তর্জাগতিক জেলের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিন প্লিজ—শুকনো গলায় বলে সে। নির্ঘাত কোনো বট থাকবে অন্যপ্রান্তে, তাতে বরং সুবিধা। সত্যিটা জানা যাবে, বট তো আর বানিয়ে বলতে পারবে না।
কয়েক মিনিটের অপেক্ষা, অরুন্ধতী বুঝতে পারে তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঘামের স্রোত নামছে।
আন্তর্জাগতিক জেল, আপনার পরিচয়? স্পিকার আচমকা সরব হয় আবার।
স্পেস স্টেশন কম্যান্ডার অরুন্ধতী ৫৫৫, জেল থেকে কেউ পালিয়েছে কি? ওপাশের গলা কিঞ্চিৎ অস্পষ্ট, বট না মানুষ ঠিক বোঝা যায় না। নাম জিজ্ঞেস করবে? নাহ্ সেটা অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন হয়ে যাবে।
কই না, কেন এই প্রশ্ন তা জানতে পারি?
ওখান থেকে একটি যান স্পেস স্টেশনের দিকে আসছে, তারা কে বা কারা এই ব্যাপারে কোনো তথ্য আমার কাছে নেই।
উত্তর আসার আগে সামান্য দ্বিধা। সেটুকুই অরুন্ধতীকে জানিয়ে দেয় ওপাশে বট নয়, জলজ্যান্ত মানুষ। যতদূর সে জানে, অপরাধীরা ছাড়া খুব কম মানুষই আছে ওখানে।
সুপ্রিমোদের আদেশ অনুসারেই সব কিছু হচ্ছে। এর বেশি কিছু বলা আমার এক্তিয়ারের বাইরে—যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার স্পষ্ট শব্দ ভেসে আসে স্পিকারে।
প্রচণ্ড অস্থির লাগে অরুন্ধতীর। সব কিছু তো ঠিকই আছে, তাও কেন মনে হচ্ছে কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে কোথাও? এনভোগ্রিনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে আবার? লাল গ্রহের যান স্পেস স্টেশনে পৌঁছাতে লাগবে আরও দিন দশেক। তার মধ্যে স্যামুয়েলকে যদি পাওয়া যায়—আবার সেই মুখটা ভেসে ওঠে অরুন্ধতীর মনে।
পৃথিবী, ১০০ অ্যানো এক্সটিঙ্কসনিস
এনভোগ্রিনের উৎসাহে হঠাৎ এতটা ভাঁটা পড়ল কেন কে জানে। অন্তত গোটা দুই বছর কাজটা চলবে এমনটাই ভেবেছিল দেবদত্ত ৭১৩। কাল আচমকা তাকে রিপোর্ট জমা দিয়ে কাজ শেষ করতে কেন বলা হল সেটা পরিষ্কার হচ্ছে না। স্যামুয়েলেরও কোনো পাত্তা নেই, তাঁর সঙ্গে নাকি যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। এ তো বড়ো অদ্ভুত কথা। শুধু তাই নয়, এক মাসের সবেতন ছুটি মঞ্জুর হয়েছে তার। সে তো ছুটির জন্য আবেদন পর্যন্ত করেনি। ছুটি পেয়েছে ভালো কথা, কিন্তু ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। তাঁবুর বাইরে অন্ধকারে বসে সাত-পাঁচ নানা কথা ভাবছিল দেবদত্ত ৭১৩। কাল তাঁবু গুটিয়ে ফিরতে হবে। বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে এখন। এই জায়গাটা বড়ো অদ্ভুত, এটা নো ম্যানস ল্যান্ড। একসময় বিরাট একটা নদীর অববাহিকা ছিল, এখন রিক্ত, পরিত্যক্ত। কোনো দেশই ঠিক উৎসাহী নয় জায়গাটা নিয়ে। দেবদত্ত ৭১৩-র অবশ্য এনভোগ্রিন প্রদত্ত বিশেষ অনুমতিপত্র আছে। আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে তারা ফুটে উঠছে, পুরোনো পৃথিবীর মানুষেরাও হয়তো এমনভাবেই তাকাত আকাশের দিকে। নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকে দেবদত্ত ৭১৩। ওই যে আবার স্পেস স্টেশন পেরিয়ে গেল তার দৃষ্টিপথ, তারাদের মাঝে তার আলো চিনে নিতে অসুবিধা হল না মোটেই। সেই খয়েরি চোখ আর, পিং করে একটা আওয়াজে সম্বিত ফেরে দেবদত্ত ৭১৩-র। মেইল এসেছে একটা, চোখের সামনে স্বচ্ছ পর্দায় ভেসে ওঠে প্রেরকের নাম। কানের কাছে যান্ত্রিক কণ্ঠ বলে ওঠে—মেইল ফ্রম অরুন্ধতী ৫৫৫।
আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন, ১০০ অ্যানো এক্সটিঙ্কসনিস
স্পেস স্টেশন থেকে বেরোতে গেলে এয়ারলক পেরোতে হয়। প্রত্যেক এয়ারলকে থাকে দুটো দরজা, একটা মূল কেবিন সংলগ্ন, অন্যটা ছোটো একটা করিডোর পেরিয়ে মহাশূন্যে বেরিয়ে যাওয়ার। দুই দরজার মাঝের অংশের বায়ুচাপ আর কেবিনের ভিতরের বায়ুচাপ সমান থাকলে তবেই ভিতরের, অর্থাৎ কেবিন সংলগ্ন দরজাটা খোলে। কেবিনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে সেটা বন্ধ করার পর বাইরের দরজা আর কেবিনের দরজার মাঝের অংশ বায়ুশূন্য করে দেওয়া হয়। পুরো বায়ুশূন্য করা সম্ভব নয়, ওই যতটা সম্ভব আর কি। তবেই বাইরের দরজাটা খোলে। এই দুই দরজার মাঝেই স্পেস স্যুট পরা আর ছাড়ার কাজটা সারার কথা। বলা বাহুল্য ভিতরে ঢুকতে গেলে ঠিক এর উলটো ধাপগুলো লাগে। বায়ুশূন্য করার সময়ে সে বায়ু মোটেই মহাশূন্যে বিলীন হয় না, এয়ার ফ্লাস্কে ভরে রেখে সেটা দিয়েই আবার প্রয়োজনমতো বায়ুচাপ বাড়ানোর কাজ সারা হয়। তিনটে এরকম এয়ারলক আছে এই স্টেশনে।
পদ্ধতিটা স্বয়ংক্রিয় হলেও কোনো সমস্যা হলে নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেওয়া যায়।
ডকিংয়ের অনুমতি দিয়ে অপেক্ষা করছে অরুন্ধতী। প্রথমে স্পেস স্টেশনের ডকিং পোর্টে এসে যান নিজেকে আটকে নেবে, অনেকটা বোতলের ঢাকা আটকানোর মতো। ডকিং পোর্টগুলো সব এয়ারলকের বাইরের দরজা ঘিরে, এই এলাকার নামও ডকিং চেম্বার। এয়ারলকের দুই দরজার মধ্যেকার বায়ুচাপ আর ডকিং চেম্বারের বায়ুচাপ সমান হলেই বাইরের দরজা খুলে যাবে, ঢুকতে পারবে আগন্তুকরা। কারা আসছে বোঝার উপায় নেই এখনও। তবে গতকাল পশ্চিম দেশের সুপ্রিমোর কাছ থেকে বার্তা এসেছে অবশেষে। এই তিনজনকে ঢুকতে দিতে হবে ভিতরে, টেরারিয়াম হাতবদল হবে। তারপর অরুন্ধতী পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারে। কেবলমাত্র পশ্চিম দেশের সুপ্রিমোর নির্দেশ কেন এল সেটা অবশ্য পরিষ্কার নয় অরুন্ধতীর কাছে। শুধু তাই নয়, এই ক-দিনে আরও দুটো যান রওয়ানা দিয়েছে মঙ্গল থেকে। তারা কারা বা কেন আসছে সে ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি। এনভোগ্রিন বা আন্তর্জাগতিক জেল তো দূর, ডিপ স্পেস নেটওয়ার্কের অপারেটরকেও এর মধ্যে ধরতে পারেনি অরুন্ধতী। পুরো ব্যাপারটাই সন্দেহজনক, কিন্তু কিছু করার তো নেই। আপাতত টেরারিয়ামের খোপটা বন্ধ রেখেছে সে।
ডকিং শেষ। ডকিং চেম্বারের বায়ুচাপ বাড়ছে, এবার খুলে গেল বাইরের দরজা। ঢুকে আসছে তিন জন মানুষ, তাদের পরনে স্পেস স্যুট নেই, থাকার কথাও নয়। ডকিং হয়ে গেলে কেবিনের ভিতর পর্যন্ত বায়ুচাপের তারতম্য ঘটবে না এটাই স্বাভাবিক। স্পেস স্টেশনে পৃথিবীর মতো বায়ুচাপ ও পরিমণ্ডল বজায় রাখা হয়, মঙ্গলের উপনিবেশেও তাই। অবশ্য বলা ভালো, প্রাচীন পৃথিবীর মতো পরিমণ্ডল।
হ্যালো সুইটহার্ট—ভিউস্ক্রিনে যে ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটল প্রথমে, তাকে দেখামাত্র চিনতে পারল অরুন্ধতী। না, ব্যক্তিগতভাবে চেনার সত্যি কোনো কারণ নেই। তবে বছর দুয়েক আগে সমস্ত দেশের মিডিয়া এর ছবিতে ছেয়ে গিয়েছিল। খুন, হিউম্যান ট্র্যাফিকিং, যৌন অপরাধ, কী নেই এর কীর্তির তালিকায়। এই লোক এখানে কী করছে? প্রশ্নটা মাথায় ভালো করে তৈরি হওয়ার আগেই আরও দুজনকে দেখা যায়। কী অদ্ভুত ক্ষুধার্ত এদের চোখগুলো। বিশ্রী ভঙ্গি করে হেসে উঠল তিন জনে। কর্কশ গলায় প্রথম জন বলল—কেবিনের দরজা একবার খুলতে দাও, তারপর ওই গাছপালা আমরাই বয়ে দেব। দ্বিতীয় জন পিছন থেকে মুখ বাড়াল—চাইলে আরও কিছু দিতে পারো, অবশ্য না চাইলেও।
আবার কুচ্ছিত হাসি কেবিনে ছড়িয়ে পড়ে। হিমশীতল একটা স্রোত নামতে থাকে অরুন্ধতীর শিরদাঁড়া বেয়ে। এদের এখানে কে পাঠিয়েছে! পশ্চিম দেশের সুপ্রিমো? কিন্তু কেন?
আর নব্বই সেকেন্ড, তারপরই কেবিনের দরজা আপনা থেকে খুলে যাবে।
পাগলের মতো সাঁতরে কনট্রোল প্যানেলের দিকে এগোয় অরুন্ধতী, আর সত্তর সেকেন্ড। উন্মাদের মতো হাসছে তিনটে শয়তান। অরুন্ধতী মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ম্যানুয়াল কন্ট্রোলের লিভারটার উপর।
দুই দরজার মাঝের বায়ুচাপ কমতে থাকে ধীরে ধীরে। ততক্ষণে কেবিনের দরজার বাইরে পৌঁছে গেছে তিন মূর্তি, অধীর আগ্রহে ছটফট করছে তারা। খুব স্পষ্ট নির্দেশ আছে, কাচের পাত্রে কী সব আছে, সেটা পৌঁছে দিতে হবে পশ্চিম দেশের সুপ্রিমোর কাছে, আর মানুষটাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। বিনিময়ে তারা পাবে মুক্তি, পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার অধিকার। আর তিরিশ সেকেন্ড, কিন্তু কেমন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না হঠাৎ? তীব্র একটানা একটা শব্দ হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ল দুই দরজার মাঝের অংশে। জ্ঞান হারাবার আগে তাদের কানে ভেসে এলো যান্ত্রিক কণ্ঠ—এয়ারলক ফেলিওর।
ঠিক দেড় মিনিট হাতে আছে আর। দশ সেকেন্ডের মাথায় স্বয়ংক্রিয় শাসন চালু হয়ে দুই দরজার মাঝের অংশে আবার পূর্বের বায়ুচাপ ফিরিয়ে আনবে। লোক তিনটে অজ্ঞান হয়েছে বটে, তবে বিশেষ কাবু হওয়ার কথা নয়। বায়ুচাপ স্বাভাবিক হলেই জ্ঞান ফিরবে ওদের। ডকিংয়ের শেষ ধাপ অনুযায়ী যথা নিয়মে কেবিনের দরজা খুলে যাবে। কাঁপা হাতে কিপ্যাডে আঙুল চালায় অরুন্ধতী। লা–টি–মা–র। এক হাতে কাচের পাত্র আঁকড়ে ভাসতে থাকে অরুন্ধতী। দ্বিতীয় এয়ারলক উপরের দিকে, সাঁতরে উপরে উঠতে উঠতে কানে আসে যান্ত্রিক কণ্ঠের ঘোষণা—প্রেসারাইজেশন কমপ্লিট। অর্থাৎ কেবিনের দরজার বাইরের আর ভিতরের বায়ুচাপ এখন আবার সমান।
লোকগুলো ঢুকবে নিশ্চয়ই কেবিনে, ঢুকতে ওদের হবেই। নিজেদের যানে ফিরে গিয়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারবে না, কারণ আনডকিংটাও স্পেস স্টেশনের কনট্রোল প্যানেল থেকেই চালু করতে হবে। সেটা ওরা পারবে কী? সম্ভবত নয়।
ক্যাপসুলে উঠে সযত্নে টেরারিয়ামকে নামিয়ে রাখে অরুন্ধতী। এই ক্যাপসুলগুলো পুরোনো, বড্ড ধীরগতিতে যায়। তা হোক, শয়তানগুলো চট করে স্পেস স্টেশন থেকে বেরোতে পারবে বলে মনে হয় না। মহাশূন্যে ভাসতে ভাসতে অরুন্ধতী মনে মনে বলে—আসছি আমি পৃথিবী, তোমাকে আবার সুস্থ হতে হবে। দেবদত্ত জায়গামতো থাকবে কিনা জানি না, না থাকলে একাই যা করার করতে হবে। তবে আমার বিশ্বাস, সে থাকবে।
আরও দুটো যান যে রওয়ানা দিয়েছিল মঙ্গল থেকে, চূড়ান্ত উত্তেজনায় সে কথা অরুন্ধতী ভুলে যায় একেবারে।
আর আধ ঘণ্টা, তারপরেই পৃথিবীর পরিমণ্ডলে ঢুকবে অরুন্ধতীর ক্যাপসুল। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে রি-এন্ট্রি। নির্ঝঞ্ঝাট যাত্রায় ঝিমুনি এসে গিয়েছিল তার, পৃথিবী খুব কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে এখন। ধূসর অসুস্থ ধরিত্রী। হাওয়ায় তার ধোঁয়ার গন্ধ। যেন দাবানল লেগেছে কোথাও।
তীব্র একটা ঝাঁকুনিতে জেগে ওঠে অরুন্ধতী, চোখ ঝলসানো একটা আলোর ঝলক ঘিরে ধরেছে তার ক্যাপসুলটাকে। ভয়ানক গতিতে তাকে দু-দিক দিয়ে তাড়া করে আসছে দুটো যান। এরা এল কখন! আর কিছু ভাবার আগেই অরুন্ধতী টের পায় এদের গতি তার থেকে অনেক বেশি। এগুলো মঙ্গল গ্রহের প্রহরীদের যান, প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী ক্রিস্টাল লেজার ব্যবহার করতে পারে।
আবার তীব্র আলোর ঝলকানির সঙ্গে ঝাঁকুনি। পার্থিব পরিমণ্ডলে ঢোকার মুহূর্তে অরুন্ধতী বুঝতে পারে তার ক্যাপসুলের তলার তাপ নিরোধক স্তরের বেশ খানিকটা অংশ খুলে বেরিয়ে গেছে। পরিমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে যে তাপ তৈরি হবে তাকে আটকানোর কথা এই স্তরের। কিছু ভাবার আগেই আগুন জ্বলে ওঠে ক্যাপসুলের পিছন দিকে। ওই যে, ওই তো সেই নো ম্যানস ল্যান্ড। জ্বলন্ত ক্যাপসুল ল্যান্ড করানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে অরুন্ধতী। আছড়ে না পড়লেও ঘষটে এগিয়ে যায় বেশ খানিকটা। চালকের আসন থেকে ছিটকে পড়ে যায় সে।
পৃথিবী, ১০০ অ্যানো এক্সটিঙ্কশনিস
আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে ক্যাপসুলের বন্ধ দরজা। প্রায় বুজে আসা চোখ শেষ শক্তি দিয়ে মেলে ধরে অরুন্ধতী, ওই একটা মানুষের অবয়ব নয়? দৌড়ে আসছে এদিকে। দুর্বল একটা হাত তুলে তাকে থামতে বলে আরেক হাত দিয়ে গড়িয়ে দেয় টেরারিয়ামটা। খানিকটা গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে কাচ, জল, সবুজ পাতা। মরুভূমির মতো শুকনো মাটি মুহূর্তে শুষে নেয় জলটা। মানুষের অবয়বটা হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে পাতাগুলোর পাশে, হাতের দস্তানা এক ঝটকায় খুলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে থাকে পাতাগুলোকে। বড়ো নরম সে ছোঁয়া। তারপর দূর থেকে অরুন্ধতীর দিকে তাকিয়ে হাসে, নাকি আসলে ওটা কান্না ঠিক বুঝে উঠতে পারে না অরুন্ধতী। সুরক্ষা আবরণ সযত্নে ঢেকে রাখে সব অনুভূতি।
কথামতো ছোটো একটা ডোমের মতো বস্তু দিয়ে পাতাগুলোকে ঢেকে দেয় সেই মানুষ। অরুন্ধতী জানে কৃত্রিম আবহাওয়ার সুরক্ষা আছে তার ভিতর।
বিস্ফোরণের আওয়াজটা পাওয়ার আগেই অরুন্ধতী টের পায় তার শরীরটা প্রচণ্ড অভিঘাতে অনেক উঁচুতে উঠে গেছে, তারপর পাক খেতে খেতে নেমে আসছে পৃথিবীর দিকে। আছড়ে পড়ার আগের মুহূর্তে প্রাণপণ চেষ্টায় মাথার সুরক্ষা আবরণীটা খুলে ফেলে সে। হোক ধূসর, হোক ধোঁয়ার গন্ধ, তবু শেষবারের মতো এই রুক্ষ মাটির স্পর্শ থাক তার রক্তমাখা দুই গালে। সবুজ হও পৃথিবী, অরুন্ধতী মিশে থাকবে তোমার উর্বর মাটিতে, তোমার ফুলের গন্ধে, পাখির গানে।
কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে স্তব্ধ আরেক মানুষ, অনেক দায়িত্ব তার এখন। এটা নো ম্যানস ল্যান্ড, ট্রিটি অনুযায়ী কারুর অধিকার নেই এই জমির উপর। এই সদ্য পোঁতা গাছের উপর শুধু পৃথিবীর অধিকার। তার সমস্ত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে একে, আপাতত কৃত্রিম পরিমণ্ডলের ছোট্ট একটি বলয় দিয়ে ঘিরে দিয়েছে পাতাগুলোকে, তারপর কী হবে এখনও জানে না সে।
আগামী পৃথিবীর ইতিহাস আজ থেকে লেখা শুরু।
কানের কাছে প্রজ্ঞার কণ্ঠ ভেসে আসে—তোমার চিন্তা ঠিক ধরতে পারছি না দেবদত্ত ৭১৩।
ম্লান হাসে মানুষটা। ধরা গলায় বলে—স্বাভাবিক। তুমি দেবদত্ত ৭১৩ কে চেন। আজ থেকে আমি যে শুধুই দেবদত্ত।
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, বুমা ব্যানার্জী দাস