তিনটি বাংলা রচনায় এম. আর. জেমসের ‘কাস্টিং দ্য রুনস’
লেখক: প্রদোষ ভট্টাচার্য্য
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
উপক্রমণিকা
১৯১১ সালে রচিত মন্ট্যাগ্যু রোডস জেমসের ভৌতিক কাহিনি ‘কাস্টিং দ্য রুনস’1-এর উপস্থিতি দেখা যায় অন্তত তিনটি বাংলা রচনায়—এর মধ্যে দুটি কিশোরপাঠ্য উপন্যাস এবং একটি নাটক।
রক্তলিপি (১৯৫৫)2
সময়ের হিসেবে সর্বকনিষ্ঠ আশা দেবীর এই উপন্যাসটি, যা আশুতোষ লাইব্রেরী থেকে প্রকাশিত হয়। পরে, সত্তরের দশকে, ক্যালকাটা পাবলিশার্সের পূজাবার্ষিকী আনন্দ-র একটি সংখ্যায় এটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। লেখিকা স্বীকার করেছেন যে মূল ছোটোগল্পটিকে দীর্ঘায়িত করার জন্য তিনি জেমসের আরেকটি গল্প ব্যবহার করেছেন। সেটি হল ১৮৯৫ সালের ‘লস্ট হার্টস’।
আশা দেবী-সৃষ্ট খলনায়ক শঙ্করনাথ রায় একাধারে জেমসের মি. কার্সওয়েল এবং মি. অ্যাবনি। প্রথমজনের মতো শঙ্করনাথ সাঙ্কেতিক লিপির মাধ্যমে তাঁর বিরাগভাজনদের পিছনে প্রাণনাশকারী প্রেতাত্মা লেলিয়ে দেন, আর দ্বিতীয়জনের মতো জীবন্ত মানুষের হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিয়ে তা মন্ত্রপূত করার পর পুড়িয়ে ভক্ষণ করেন। তাঁর প্রথম শিকার পুস্তক-সমালোচক যামিনী দত্ত। তাঁর নিজের বই পিশাচ সাধনা-র বিরূপ সমালোচনা করার অপরাধে যামিনীকে যেভাবে শঙ্করনাথ এবং তাঁর সৃষ্ট দানব অনুসরণ করে, এবং তার মৃত্যু যেভাবে ঘটে, তা আমাদের জেমসের গল্পে যথাক্রমে এডওয়ার্ড ডানিং আর জন হ্যারিংটনের কথা মনে করায়। এরপর আমাদের পিশাচ-সাধক তাঁর নজর ঘোরান প্রায়-নিঃস্ব ভাইপো আনন্দ রায়ের দিকে, যে হল ‘লস্ট হার্টস’ গল্পে মি. অ্যাবনির অনাথ জ্ঞাতিভাই স্টিভেন এলিয়টের বাঙালি সংস্করণ। নিজের প্রভূত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবার লোভ দেখিয়ে শঙ্করনাথ আনন্দকে নৈহাটির উপকণ্ঠে নিজের ‘পুরনো বাগানবাড়ি’-তে আমন্ত্রণ জানান। ভবনটি মি. অ্যাবনির মনোরম আবাসের একেবারে উলটো। হানাবাড়ির মতো এই জায়গায় শঙ্করনাথ ছাড়া থাকে চাকর সনাতন আর একাধারে ঝি ও রাঁধুনি মঙ্গলা, ‘লস্ট হার্টস’-এর পার্ক্স ও মিসেস বাঞ্চের মতো। দেওয়ালে ‘শোভা’ (?) পায় বিভীষিকা-উদ্রেককারী বিচিত্র সব জীব এবং লাঙ্গুল ও খুর-বিশিষ্ট শয়তানের ছবি। এগুলো আমাদের মনে করায় কার্সওয়েল তার এলাকার ছেলেমেয়েদের নিজের বাড়িতে ডেকে যেসব ভয়-দেখানো – অনেক ক্ষেত্রে চলমান – ছবি দেখিয়েছিলেন, সেগুলির কথা।
এবার লেখিকা কাহিনিতে প্রবেশ করান যামিনীর বোন রত্না দত্তকে, ‘কাস্টিং দ্য রুনস’-এ জন হ্যারিংটনের ভাই হেনরির লিঙ্গান্তরিত রূপ। রত্না মানুষ হয়েছে পাটনায় তার মামার বাড়িতে, এবং সে একজন দক্ষ ক্রীড়াকুশলী। নিজের মামাতো ভাই রমেনকে নিয়ে সে যায় কলকাতায় ‘সময়’ পত্রিকার অফিসে যেখান থেকে যামিনীর লেখা শঙ্করনাথের পিশাচ-সাধনা বইয়ের বিরূপ সমালোচনা বেরিয়েছিল। সেখানে সম্পাদক জলদবাবুর কাছ থেকে রত্না পায় শঙ্করনাথের নৈহাটির ঠিকানা। শুরু হয় তার নিজের ভাইয়ের রহস্যময় মৃত্যুর তদন্ত।
এদিকে, আনন্দ বাগানবাড়ির এক আলমারিতে খুঁজে পায় ওই বাড়িতে একসময় আশ্রয় নিয়ে তারপর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এক বৈরাগী-ছেলের একতারা (‘লস্ট হার্টস’-এর জিওভানি পাওলি আর তার বাদ্যযন্ত্র)। উৎস- কাহিনিতে বেদের মেয়ে ফিবি স্ট্যানলি এখানে মঙ্গলার মেয়ে মালতী, যে নিখোঁজ হওয়ার পর মঙ্গলা মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। ড্র্যাকুলা উপন্যাসের লুসির মতো মঙ্গলা নিদ্রা-ভ্রমণের ব্যাধিতে আক্রান্ত, আর ওই একই উপন্যাসের নামহীন মহিলার মতো, যে তার সন্তানের খোঁজে ড্র্যাকুলার প্রাসাদে ছুটে এসেছিল, সে আকুল হয়ে তার মেয়ের কথা জিজ্ঞাসা করে আনন্দকে। এরপর সে আনন্দকে নিয়ে যায় সিঁড়ির তলার একটি ঘরের দরজার সামনে, যে ঘরের মধ্যে মালতীর হৃৎপিণ্ড উপড়ে নেওয়া হয়েছিল। হঠাৎ সেখানে আবির্ভূত হন শঙ্করনাথ। সন্ত্রস্ত আনন্দ এবার চাক্ষুষ করতে বাধ্য হয় শঙ্করনাথের মঙ্গলাকে চাবুক দিয়ে মারার বিভৎস দৃশ্য!
রত্না হাজির হয় পুরোনো বাগানবাড়িতে, ‘রমা দাস’ নামে, পথ হারিয়ে আশ্রয় খোঁজার অছিলায়। শঙ্করনাথ এক কথায়, এই আগন্তুকের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ না করেই, তাকে থাকতে দেন এবং পরের দিন তাকে নিজের পরবর্তী বইয়ের শ্রুতিলেখক হিসেবে সবেতন নিযুক্ত করেন! এর কারণ কার্সওয়েলের সঙ্গে তাঁর একটি ক্ষেত্রে তফাৎ: তিনি যামিনী দত্তের বিরূপ সমালোচনার অন্তত একটা অংশ মেনে নেন, যে তাঁর লেখায় অত্যধিক বানান ভুল থাকে!! যামিনী অবশ্য তাঁর আগের বইয়ের বীভৎস বিষয়বস্তু আর উৎকট লেখনশৈলীরও সমালোচনা করেছিল।
পরের দিন গভীর রাতে সেই বৈরাগী ছেলে আর মালতীর প্রেতাত্মা আনন্দকে দেখা দেয়। ‘দু’জনেরই বুকের পাঁজরার ভেতর কিছু নেই – তাদের হৃৎপিণ্ড তুলে নেওয়া হয়েছে, আর সেই ক্ষতের মুখে ঝর-ঝর করে রক্তধারা ঝরছে।’ (৬৩) এই দৃশ্য উৎস-কাহিনি ‘লস্ট হার্টস’ থেকে তুলে বসানো।
হঠাৎই আমাদের জানানো হয় যে রত্না আর আনন্দের তিন বছর আগে পুরীতে পরিচয় হয়েছিল। তারা এবার যামিনীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ব্যাপারে যুগ্ম-তদন্ত শুরু করে, ঠিক যেভাবে ‘কাস্টিং দ্য রুনস’-এ এডওয়ার্ড আর হেনরি মিলে জন হ্যারিংটনের মৃত্যুর তদন্ত করেছিল।
এবার শঙ্করনাথ ‘রত্না-রমা’-কে দিয়ে তাঁর দ্বিতীয় বই ডাকিনী-মন্ত্র-র শ্রুতিলিখন শুরু করেন। প্রথমেই আসে ফিলিপিন থেকে আহরিত জাদুবিদ্যা, যা অনুযায়ী যে ‘কোন শক্তিমান পুরুষ আট থেকে পঁচিশ বছরের ছেলে বা মেয়ের হৃৎপিণ্ড জ্যান্ত অবস্থায় উপড়ে নিয়ে মন্ত্রপূত করে পুড়িয়ে খেতে’ পারলে অলৌকিক শক্তিলাভ করতে পারে । (৭০) ‘লস্ট হার্টস’-এ মি. অ্যাবনি বিশ্বাস করেন যে ‘happy results may be produced by the absorption of the hearts of not less than three human beings below the age of twenty-one years.’3
এবার শঙ্করনাথ পরের অমাবস্যার মধ্যরাতে আনন্দকে তাঁর ঘরে আসার নির্দেশ দেন। ইতিমধ্যে ছেলে-মেয়ে দুটির প্রেতাত্মা আবার দেখা দেয়, মালতী রত্নাকে আর বৈরাগী ছেলেটি আনন্দকে, আর দুজন মানুষকে নিয়ে যায় সেই ঘরের সামনে যেখানে তাদের হৃৎপিণ্ড ওপড়ানো হয়েছিল। আবার সেখানে শঙ্করনাথের আবির্ভাব ঘটে, কিন্তু এবারেও, আনন্দ আর ‘রত্না-রমা’-কে একসঙ্গে দেখেও, তাঁর কোনো সন্দেহ হয় না! তিনি কি ভূত দুটির এইরকম আচরণে অভ্যস্ত?
শঙ্করনাথের উদ্দেশ্য, মঙ্গলাকে সম্মোহিত করে তাকে দিয়ে আনন্দের (যাকে আগেই মাদক-মেশানো জল খাইয়ে অজ্ঞান করে দেওয়া হবে) হৃৎপিণ্ড কেটে বার করা, যা মঙ্গলাকে দিয়ে আগের দুই জীবন্ত বলির ক্ষেত্রে করানো হয়েছিল। হঠাৎ রত্না ঘরে ঢোকে: সে নাকি তার কলম খুঁজছে! শঙ্করনাথ বিরক্ত হয়ে কলমের সন্ধানে পেছন ফিরতেই রত্না মাদক-মেশানো গেলাসটা পালটে ফেলে। কলম পাওয়া যায় না, কিন্তু এতেও শঙ্করনাথের সন্দেহ হয় না! রত্না চলে যাবার পর আনন্দ ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে। এদিকে মঙ্গলাও সম্মোহিত হয়নি, সে ছুরি নিয়ে তেড়ে যায় শঙ্করনাথের দিকে, তার মেয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে। শঙ্করনাথ খলনায়ক হিসেবে মারাত্মক রকম অপটু। কার্সওয়েল আর অ্যাবনি দস্তুরমতো অপমানিত বোধ করবেন!
বাদানুবাদের মধ্যে রত্না পুলিশে ফোন করে। ‘পাল্প ফিকশন’-এর ‘ভিলেন’দের মহান ট্রেডিশন বজায় রেখে শঙ্করনাথ গ্রেপ্তার হবার আগে সিগার ফোঁকার অনুমতি চেয়ে নেন, আর দেশলাই দিয়ে নিজের ছাইদানে রাখা ডিনামাইট ফাটান। ঘরটি ধ্বসে পড়ার পূর্ব মুহূর্তে রত্না আনন্দকে ধাক্কা মেরে বাইরে করে দেয় আর নিজেও লাফিয়ে বেরিয়ে যায়। হাজার হোক, কলেজে সে লং জাম্প, হাই জাম্প, সবকিছুতেই ফার্স্ট হত! ঘরের ধ্বংসাবশেষে শুধু মঙ্গলারই দেহের পোড়া অংশ পাওয়া যায়। রত্না বলে, শঙ্করনাথও খুব সম্ভব বাঁচেননি।
অবশ্যই শঙ্করনাথ বেঁচে পালিয়েছেন, এবং তিনি এবার আনন্দের পেছনে লাল সাঙ্কেতিক লিপির মাধ্যমে দানব লেলিয়ে দেন। এক ২০ মার্চে আনন্দ জানতে পারে যে ওই মাসের ৩১-এর পর সে আর পৃথিবীতে থাকবে না। হঠাৎ রত্নার মনে পড়ে যে শঙ্করনাথ তাকে বলেছিলেন যে রক্তলিপি যদি প্রেরকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে দানব নির্দিষ্ট শিকারের বদলে স্রষ্টাকেই আক্রমণ করবে। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য এতটা আকস্মিকভাবে লেখিকা উপস্থাপিত করলেন!
কাহিনির শীর্ষবিন্দু ‘কাস্টিং দ্য রুনস’-এর ক্লাইমাক্সের তুলনায় অত্যন্ত অনায়াস। উৎস-কাহিনিতে এই ফিরিয়ে-দেওয়া-দৃশ্যের উদ্বেগ প্রায় দমবন্ধ করা, কারণ জেমস একটি আবশ্যিকতা যোগ করেছেন। জাদুলিপি-সম্বলিত কাগজটি ডানিং-কর্তৃক কার্সওয়েলকে দিতে চাইতে হবে, এবং কার্সওয়েলকে তা গ্রহণ করতে হবে! কৌশলের সঙ্গে সৌভাগ্যের সংযোগ না ঘটলেই সর্বনাশ! রক্তলিপি-তে আনন্দ মনে করে যে অপরাধী তার কুকর্মের জায়গায় ফিরে গেছেই। আর সে আর রত্না পুরোনো বাগানবাড়িতে গিয়ে দেখে যে ঠিক তাই, শঙ্করনাথ নীচের তলার একটি ভাঙাচোরা ঘরে মোমবাতির আলোয় টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে কী যেন লিখছেন। ৩০ মার্চ রাত দশটায় তারা আবার ওই বাড়িতে আসে। এবার সরাসরি উদ্ধৃতি:
হামাগুড়ি দিয়ে আনন্দ শঙ্কর রায়ের চেয়ারের পেছনে এসে বসল … নিশ্বাস বন্ধ করে আছে …
শঙ্কর রায় হঠাৎ চমকে উঠলো।
কিছু নয়, ইঁদুরের পায়ের শব্দ বোধ হয়।
…
মন্ত্রপূত বোতলের জল শেষ হয়েছে। সে তাকের ওপর থেকে আর একটা বোতল আনবার জন্য পেছন ফিরলো।
এই সুযোগে আনন্দ গুঁড়ি মেরে এগিয়ে শঙ্করের লম্বা ঝোলা কোটের পকেটে রক্তলিপিটা রেখে দিলো। তারপর তেমনি হামাগুড়ি দিয়েই সোজা জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। (৯৯)
এরপর শঙ্করনাথের সামনে দানবের আবির্ভাব। অপার্থিব জীবকে মারতে শঙ্করনাথের পকেটে রিভলভার খোঁজা! পরিবর্তে রক্তলিপির টুকরো কাগজে হাত পড়া।
শেষে আনন্দ আর রত্না দেখে ঘরের মধ্য থেকে আগুন আর ধোঁয়া বেরোতে। তারপর এক বিরাট বিস্ফোরণের সঙ্গে সমস্ত বাড়িটা ভেঙে পড়ে।
বিভীষণের জাগরণ (১৯৪২)4
আশা দেবীর অতিশয় অদক্ষ অভিযোজনের প্রায় এক যুগ আগে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে অ্যাডভেঞ্চার ও গোয়েন্দা গল্পের পথিকৃৎ হেমেন্দ্রকুমার রায় ‘কাস্টিং দ্য রুনস’-কে অবলম্বন করে রচনা করেছিলেন এক অসাধারণ মৌলিক আখ্যান। এটি ছিল দেব সাহিত্য কুটীর প্রকাশিত কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজের জন্য রচিত হেমন্ত-রবীন জুটির চতুর্থ ও শেষ উপাখ্যান। এর আগের তিনটিতে রহস্যভেদ করা হয়েছে কঠোরভাবে বস্তুগত জগতে যুক্তিসঙ্গতভাবে। বিভীষণের জাগরণ-এ সঠিক যুক্তিসম্মত চিন্তা-প্রক্রিয়া আরোপিত হল সম্পূর্ণ অতি-প্রাকৃত ঘটনাপ্রবাহের ওপর।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ‘ব্ল্যাক-আউট’ কবলিত নিস্প্রদীপ কলকাতায় এক মধ্যরাত্রে বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরবার পথে হেমন্ত-রবীন শোনে সিংহগর্জন। এরপর হেমন্ত এমন এক জীবের ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে যার জ্বলন্ত চক্ষুদ্বয় মাটি থেকে প্রায় পনেরো-ষোলো ফিট ওপরে এবং যার কণ্ঠ থেকে নির্গত হয় খলখল অট্টহাস্য। তদোপরি, বন্য দুর্গন্ধে চারদিক ভরে যায়। পুলিশ এসে পড়ার পর দশ নম্বর কানাইবাবুর লেনে সবাই প্রত্যক্ষ করে গণহত্যার এক বীভৎস দৃশ্য। কোনোরকম অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। প্রত্যেককেই মারা হয়েছে নখ, থাবা, আর দাঁত দিয়ে!
পরের দিন খবরের কাগজ পড়ে হেমন্ত জানতে পারে যে একই রাতে সেই একই ভয়ংকর – এবং অবাস্তব – জীব হানা দিয়েছিল আরেক বাড়িতে। দু-ক্ষেত্রেই গণহত্যা তো ঘটেইছে, কিন্তু হন্তারক জীবটির বিশেষ আক্রোশ প্রতিফলিত হয়েছে দুই গৃহকর্তার ওপর। অন্যান্যদের দেহ ক্ষতবিক্ষত বা মুণ্ডহীন, কিন্তু দুই গৃহকর্তার ক্ষেত্রে যা পাওয়া গেছে তা দেহাবশেষ মাত্র। বাড়তি তথ্য: দুই বাড়িতেই ঘটনার আগের দিন একদল সন্ন্যাসী এসেছিল। প্রথমজনের – অবনীকান্ত রায়চৌধুরী – সঙ্গে তাদের উচ্চকণ্ঠে বাদানুবাদ প্রতিবেশীরা শুনেছিল।
পুলিশের সতীশবাবু দ্বিতীয় জন, বিধুভূষণ বসুর, বাড়ি থেকে পায় তাঁর ডায়েরি। এর থেকে হেমন্ত জানতে পারে যে তিনি, অবনীবাবু, এবং শক্তিপদ মজুমদার ছিলেন তান্ত্রিক একজটা স্বামীর অসংখ্য শিষ্যদের মধ্যে। একজটা বারোজন শিষ্যকে – যাদের মধ্যে এই তিনজন ছিলেন – আদেশ করেন এক বছর ধরে অমাবস্যায় বলি দেবার উদ্দেশ্যে একটি করে মানুষ সংগ্রহ করতে। অবাঙালি শিষ্যরা রাজি হলেও এই তিন বাঙালি অসম্মত হন এবং একজটা উক্ত পাপ কাজ করলে পুলিশে খবর দেবার কথা বলেন। ক্রুদ্ধ একজটা যোগবলে তাদের সর্বনাশ করার হুমকি দেন। ফলে, বিধু আর অবনীর যা হয়েছে, সবাই জানেন।
হেমন্ত এরপর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শক্তিপদকে নিজের বাড়িতে ডাকে, এবং তাঁকে দিয়ে একজটাকে – গড়িয়াহাটের কাছে এক জঙ্গলে অবস্থিত এক ভাঙা কালীমন্দিরে স্বামী ও তাঁর চ্যালাদের আস্তানা – পুলিশে খবর দেবার শাসানি দিয়ে চিঠি লেখায়। পরের দিন সন্ধ্যায় সপরিবারে শক্তিপদকে নিজের বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে, তাঁর বাড়ির উলটোদিকে এক অসম্পূর্ণ তিনতলা বাড়ির দো-তলায় হাজির হয় হেমন্ত, রবীন, এবং পুলিশের দুই কর্মচারী সতীশবাবু আর ভূপতিবাবু। হেমন্ত সঙ্গে আনে ‘ফ্ল্যাশ-লাইট’-যুক্ত একটি ক্যামেরা। নির্দিষ্ট সময়ে হন্তারক দানব আসে, ‘ফ্ল্যাশ’-এর তীব্র আলোয় প্রতিহত হয়ে, হেমন্তের ভাষায় ‘গগনভেদী আর্তনাদ ক’রে’ (২৩৯) ফিরে যায় আর সংহার করে নিজের স্রষ্টা একজটা আর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের।
উপন্যাসের উৎকর্ষ আছে হেমন্তর দেওয়া ব্যাখ্যার মধ্যে। প্রেতবিদ্যার চর্চা করে সে একটি মূল্যবান তথ্য পায়। বিভিন্ন ভাবের ও চিন্তার বিশেষ-বিশেষ রূপ আছে। গভীর ধ্যান বা প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে এইসব ভাবরূপকে মূর্ত করা যায়। হিন্দু ধর্মের সিদ্ধ সাধকেরা তাঁদের সাধনার্জিত অসাধারণ ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে তাঁদের ইষ্টদেবতার মানসিক মূর্তিকে জীবন্ত শরীরীরূপে স্বচক্ষে দর্শন করতে পারেন।
ঠিক এইভাবে, দুরাচারী তান্ত্রিক একজটা তাঁর সাধনার্জিত ইচ্ছাশক্তি দিয়ে জাগ্রত করেছিলেন এক বিভীষণ-মূর্তিকে, যে তাঁর পাপ-ইচ্ছার দ্বারা চালিত হয়ে বিধু, অবনী ও তাঁদের বাড়ির সকলকে হত্যা করেছিল, এবং আজ এসেছিল শক্তিপদকে সপরিবারে নিধন করতে।
কিন্তু ‘ফ্ল্যাশ’-এর আলো তাকে প্রতিহত করল কেন? হেমন্ত এরও ব্যাখ্যা দিয়েছে। প্রেততত্ববিদেরা ‘চক্রে’ বসার সময় ঘর রাখেন অন্ধকার বা প্রায়ান্ধকার। যে শক্তিকে তাঁরা শরীরীরূপে চাক্ষুষ করতে চান তার উৎপত্তি হয় ইথারের কম্পন (vibration of ether) থেকে। সাধারণ আলোই তার পক্ষে অসহনীয়, ‘ফ্ল্যাশ’-এর মতো তীব্র ঔজ্জ্বল্য তো আরোই তাকে ব্যাহত করবে।
এইবার হেমন্তের মুখে সবাই প্রথম শোনে ‘Casting the Runes’ শব্দবন্ধটি। ‘রুন’ এক মৃত ইউরোপীয় ভাষা যার অক্ষর ব্যবহার করে পাশ্চাত্য জাদুকরেরা কোনো কাল্পনিক দানবকে মূর্ত করে শত্রু-নিধনের কাজে লাগাত, উৎস-কাহিনিতে কার্সওয়েল জন হ্যারিংটন আর এডওয়ার্ড ডানিং-এর ক্ষেত্রে ঠিক যা করেছিলেন, আর রক্তলিপি-র শঙ্করনাথ যামিনী দত্ত আর আনন্দ রায়ের ব্যাপারে যা করেছিলেন। বিভীষণের জাগরণ-এ একজটা আছেন কার্সওয়েলের ভূমিকায়, আর তাঁর শিকার বিধু আর অবনী। তৃতীয় শিকার শক্তিপদের ক্ষেত্রে তাঁর দানবকে ব্যর্থ করে হেমন্ত সেই ভৈরব মূর্তিকে, ‘রুনস’-এর কায়দায় পুনঃপ্রেরিত করেছে তার স্রষ্টার দিকে। জেমসের গল্পে কার্সওয়েলের কাছে কৌশলে তাঁর ‘রুন’-লিপি ফিরিয়ে দিয়ে তাঁরই মৃত্যু ঘটাচ্ছে ডানিং। আনন্দও এই একই ভাবে শঙ্করনাথকে তাঁর দানবের হাতেই শেষ করেছে।
বিভীষণের জাগরণ-এর শেষে উপস্থিত সবাই দর্শন করছে হেমন্তের তোলা ছবি: মানুষের দেহে সিংহের মুণ্ড! বিমূঢ় রবীন বিস্ময়প্রকাশ করে বলে যে ভগবান তো নৃসিংহরূপ ধারণ করেছিলেন পাপীকে শাস্তি দেবার জন্য। উত্তরে হেমন্ত বলে যে একজটার সৃষ্ট দানব শুধু সেই মূর্তির বাইরের খোলসমাত্র। তার মধ্যে না ছিল আত্মা, না ছিলেন পরমাত্মা, ছিল শুধু ‘দুরাত্মার দুরন্ত ইচ্ছাশক্তি’ (২৪২)। স্রষ্টাকে সংহার করে সে মূর্তি আবার বিলীন হয়েছে ভাবের রাজ্যে!
অলৌকিক (১৯৪৫)5
যশোধরা গুপ্ত বিভীষণের জাগরণ নিয়ে লিখতে গিয়ে জানিয়েছেন:6
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এ বই [বিভীষণের জাগরণ] প্রকাশের কাছাকাছি সময়ে ১৯৪৫ সালে শরৎ সাহিত্য ভবন থেকে হেমেন্দ্রকুমারের সম্পাদনায় যে ‘কলরব’ বার্ষিকী প্রকাশিত হয় সেখানে তাঁর লেখা ভয়াবহ একটি নাটক প্রকাশিত হয়, নাম ‘অলৌকিক’, তার বিষয়বস্তুও অনেকটা একইরকম।
বীরাচারী তান্ত্রিক শঙ্কর উপাধ্যায় একটি শবকে জীবন্ত করে দানবিক আয়তন দেয়, সুকোমলের স্ত্রী সুনীতিকে অপহরণ এবং সুকোমলের বাড়ি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। সে সুনীতিকে ভৈরবী-রূপে গ্রহণ করতে চায়! প্রেততত্ত্ববিদ হরিহর চৌধুরী স্পষ্ট বলেন:
বামাচারীরা নিম্নশ্রেণীর সাধক বটে, কিন্তু … একান্তভাবে ধ্যানের দ্বারা আর মন্ত্রগুণে তারা অতিকায় দানব পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে। (২৭৩-৭৪)
মন্ত্রপূত রেখা ব্যবহার করে হরিহর শঙ্করের দানবের আক্রমণ ব্যর্থ করেন। সে অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার আগেই হরিহর তাকে আজ্ঞা দেন, “যে আজ তোর ক্ষুধাকে জাগ্রত করেও তৃপ্ত করতে পারলে না … তোর ক্ষুধাগ্নির ইন্ধন রূপে গ্রহণ কর সেই দুরাত্মাকেই!” (২৭৮) নাটকের শেষে রাস্তায় পড়ে থাকে শঙ্করের মৃতদেহ। তার দেহে কোনো আঘাতের চিহ্ন না থাকলেও, “কে যেন কোন রহস্যময় উপায়ে ওর দেহ থেকে সমস্ত রক্ত একেবারে শোষণ করে নিয়েছে।” (২৭৯) আর শঙ্করের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গেই যে মড়াকে সে জাগিয়ে তুলেছিল, সেই শবের মধ্য থেকে অন্তর্হিত হয় শঙ্করের জীবনী-শক্তি। মড়া রাস্তায় পড়ে থাকে স্বাভাবিক মৃতদেহের মতোই।
আলোচনা
জেমসের ‘কাস্টিং দ্য রুনস’-এর অপার্থিব জীবটি আয়তনে তেমন বড়ো নয়, এবং প্রায় অদৃশ্য। তাকে এক ঝলক দেখতে পায় একমাত্র ডোভারে কার্সওয়েল জলযানে ওঠার সময় যে আধিকারিক তার টিকিট পরীক্ষা করছিল:
’Ad he got a dog with him, or what? Funny thing: I could ‘a’ swore ’e wasn’t alone. Well, whatever it was, they’ll ’ave to see to it aboard.7
এর আগে ডানিং তার নিজের বাড়ির বিছানায় শুয়ে বালিশের তলায় হাত দেয়:
What he touched was, according to his account, a mouth, with teeth, and with hair about it, and, he declares, not the mouth of a human being.8
কিছু পরে হেনরি হ্যারিংটন ডানিংকে বেউইকের করা একটি কাঠে-খোদাই ছবির কথা বলে, যা জন হ্যারিংটনের কাছে ডাকযোগে এসেছিল। তাতে আঁকা ছিল এই দৃশ্যটি:
a moonlit road and a man walking along it, followed by an awful demon creature. Under it were written the lines out of the “Ancient Mariner” (which I suppose the cut illustrates) about one who, having once looked round—
walks on,
And turns no more his head,
Because he knows a frightful fiend
Doth close behind him tread.9
জীবটির আকৃতি বা আয়তন বর্ণনা করা নেই। সে কার্যত খুব একটা দৃষ্টিগোচর নয়।
তিন বাঙালি প্রেতাত্মাই কিন্তু বিরাট আকারের। একজটার নৃসিংহ হাতির মতো উঁচু, শঙ্কর উপাধ্যায়ের জ্যান্ত মড়া দো-তলা বাড়ির সমান লম্বা আর আট থেকে দশ ফিট চওড়া, শঙ্করনাথের দানব গোরিলার মতো কালো আর প্রকাণ্ড। তিনজনেরই চোখ আগুনের গোলার মতো। এছাড়া, তিনটি বাঙালি ভূতই নিজেদের নির্দিষ্ট শিকার ব্যতীতও গণ-বিধ্বংসী ক্ষমতার অধিকারী। একজটার নৃসিংহ বিধু আর অবনীর সঙ্গে-সঙ্গে তাঁদের বাড়ির সবাইকে, এমনকি বিধুর প্রতিবেশী বিনোদলাল আর অবনীর বাড়ির রাস্তার পাহারাওয়ালাকেও হত্যা করেছে, আর শেষে একজটা আর তার শিষ্যদের ছিন্নভিন্ন করেছে। জ্যান্ত মড়াকে শঙ্কর উপাধ্যায় আজ্ঞা দিয়েছে সুকোমলের বাড়িকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে। রক্তলিপি-র শেষে শঙ্করনাথের (হেমেনবাবু আর আশা দেবী দু’জনেই তাঁদের খলনায়কের নাম এক্ষেত্রে এক রেখেছেন!) বাগানবাড়িটি ধ্বসিয়ে দিচ্ছে তাঁরই সৃষ্ট অপদেবতা।
জেমসের সঙ্গে তাঁর বাঙালি রূপান্তরকারীদ্বয়ের আরেকটা তফাৎ এই যে বাংলায় শারীরিক বীভৎসতার পরিমাণ অনেক বেশি। হেমেন্দ্রকুমার অবনীর বাড়িতে অসংখ্য ক্ষতবিক্ষত দেহ আর রক্তগঙ্গার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। তার আগে হেমন্ত রাস্তার ওপর পেয়েছে পাহারাওয়ালার দু-দিকে দু-হাত ছড়িয়ে পড়ে থাকা মুণ্ডহীন দেহ, আর আট-দশ হাত তফাতে হতভাগ্যের ছিন্নমুণ্ড। সে রবীনকে দেখিয়েছে মৃতদেহের কাঁধ আর দেহের ওপর কোনো অস্ত্র নয়, নখ আর দাঁতের চিহ্ন। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনেও উল্লেখিত হয়েছে বিধুর বাড়ির বাইরে বিনোদলালের মুণ্ডহীন দেহ আর বিধুর খণ্ডখণ্ড দেহাবশেষের কথা। অলৌকিক নাটকে অবশ্য মঞ্চে বীভৎসতা প্রদর্শনের সমস্যার কথা মনে রেখে হেমেন্দ্রকুমার শুধু চরিত্রদের মুখে পুনর্জীবিত মড়া থেকে পচা মাংসের গন্ধ আর শঙ্কর উপাধ্যায়ের পুজোর ঘরে চারটি নরকঙ্কাল, মানুষের হাড় দিয়ে তৈরি বেদি, আর ‘এক প্রকাণ্ড অতি-কুৎসিত অনার্য দেবতার ভীষণ মূর্তি’-র (২৬৬) উল্লেখ রেখেই ক্ষান্ত দিয়েছেন। জ্যান্ত মড়াকে দর্শক প্রথমে চোখে দেখতে পাবেন না, চরিত্রদের মুখে তার বিকট ও বিশাল আকৃতির বর্ণনাই শুনবেন। সবশেষে, যখন সে শঙ্করকে নিকেশ করে নিজের অতিপ্রাকৃত শক্তি হারিয়ে স্বাভাবিক আয়তন ফিরে পেয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে থাকবে, তখনই তাকে দেখা যাবে।
আশা দেবি ‘লস্ট হার্টস’ গল্পটি নিয়েছেন শুধু দুই কিশোর-কিশোরীর বুকের উন্মুক্ত ক্ষত দিয়ে রক্তধারা আর তাদের পাঁজরের নীচে যে হৃৎপিণ্ড নেই, এই বর্ণনাটুকু একাধিকবার দেবার জন্য। এর সঙ্গে আছে মঙ্গলার নিদ্রা-ভ্রমণ আর শঙ্করনাথের তাকে চাবুক মারার বেদনাদায়ক দৃশ্য। নইলে, ‘কাস্টিং দ্য রুনস’-এর মূল গল্প ওই হৃৎপিণ্ড-ওপড়ানো বাদ দিয়েও বলা যেত, কাহিনির অগ্রগতির জন্য ‘লস্ট হার্টস’-এর ঘটনা একেবারেই অপরিহার্য নয়।
জেমসের রচনাশৈলীর মূল কৌশল, অন্তত ‘কাস্টিং দ্য রুনস’-এ, হল ন্যূনোক্তি বা under-statement। আগেই বলা হয়েছে, পাঠকদের মানসচক্ষে কার্সওয়েলের সৃষ্ট জীবটি বেশির ভাগ সময়েই স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয় না। একটি ভয়ংকর মুহূর্তে ডানিং অতর্কিতে শুধু স্পর্শ করতে সক্ষম হয় তার মুখ, দাঁত, আর চুলের মতো কিছু। এর সঙ্গে জেমস রেখেছেন প্রচুর অতিলৌকিক ব্যক্তিত্ব ও তাঁদের বক্তব্যসমূহের উল্লেখ: ‘লস্ট হার্টস’-এই বেশি, যেমন উদ্ধৃত অংশে Hermes Trismegistus-এর বলা প্রক্রিয়া: অনূর্ধ একুশ বছর বয়সের তিনজন মানবের হৃৎপিণ্ড ভক্ষণ। ‘কাস্টিং দ্য রুনস’-এ আছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রকাশিত স্যর জেমস ফ্রেজারের নৃতত্বমূলকThe Golden Bough-এর পাশাপাশি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সংকলিত খ্রিস্টান সন্তদের জীবন ও কার্যক্রমের বর্ণনামূলক Golden Legend-এর উল্লেখ। আশা দেবী সাধারণভাবে পিশাচ সাধনা, ডাকিনী মন্ত্র ইত্যাদি, এবং হৃৎপিণ্ড ভক্ষণের ব্যাপারে ফিলিপিন অঞ্চলের উল্লেখ করে দায় সেরেছেন। অন্যদিকে হেমেন্দ্রকুমার করেছেন, অনুবাদ নয়, বরং ভারতীয়—, এবং বিশেষ করে বঙ্গীয়করণ। ‘ভাবের মূর্তি আছে’ এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হেমন্তের মুখ দিয়ে তিনি বলিয়েছেন বাংলায় ভক্তি আন্দোলনের ইতিহাস, যেখানে এসেছেন পঞ্চদশ শতাব্দীর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, অষ্টাদশ শতাব্দীর সাধক-গীতিকার রামপ্রসাদ, আর ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে নাটোরের রাজা রামকৃষ্ণ, এবং অবশ্যই শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, যাঁরা প্রত্যেকেই আপন-আপন ইষ্টদেবতাকে স্বচক্ষে দর্শন করেছিলেন। এর সঙ্গে লেখক একীভূত করেছেন পাশ্চাত্য জাদুবিদ্যা, এবং কু-উদ্দেশ্যে কোনো দানবিক সত্তাকে বাহ্য রূপ দেওয়ার তত্ত্ব। এখানেও হেমেন্দ্রকুমার হিন্দু পুরাণের প্রয়োগ করেছেন। পাপাচারী একজটা মূর্ত করেছেন শুধু তাঁর পাপ-ইচ্ছার শক্তিসম্পন্ন, পরমাত্মা-বিহীন নৃসিংহ মূর্তি। অলৌকিক নাটকটি মঞ্চে না দেখে তার প্রভাব নিয়ে কিছু বলা মুশকিল। বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে বিভীষণের জাগরণ-এর সঙ্গে নাটকটির মিল আছে, সে কথা আরেকজন পাঠিকাও লক্ষ করেছেন।
শেষ বিচারে, বিভীষণের জাগরণ-কেই এই তিনটি রচনার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলব। M. R. James-এর ছোটোগল্পে ছিল জাদুলিপি দিয়ে অলৌকিক হত্যাকারী এক সত্তাকে জাগ্রত করে তাকে দিয়ে বিরাগভাজন মানুষের আপাত-অপঘাতে বিনাশ। এই প্রচ্ছন্ন দ্ব্যর্থতাকে একেবারে প্রকট অলৌকিকতাতে পরিবর্তন করে, হিন্দু পৌরাণিক উৎস ব্যবহার, তার সঙ্গে তৎকালীন প্রেততত্ত্বের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে হেমেন্দ্রকুমার রচনা করেছেন এমন এক ‘ডিটেকটিভ’ গল্প যা একক কাহিনি হিসেবে অসাধারণ তো বটেই, তার ওপর একটি ‘সিরিজে’র শেষ আখ্যান হিসেবে এতে পাঠক দেখছেন একজন ধ্রুপদী, বস্তুবাদী অনুসন্ধানকারী বিবর্তিত হচ্ছে একজন মুক্তমনা অতিলৌকিক রহস্যভেদীতে। সম্ভবত হেমেন্দ্রকুমার অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন উইলিয়াম হোপ হজসন সৃষ্ট টমাস কার্নাকি-দ্বারা। কার্নাকি তার অনুসন্ধানকর্মে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পাশাপাশি প্রচলিত লোককাহিনি থেকেও সাহায্য নিতেন। তাঁর ব্যবহৃত প্রযুক্তির মধ্যে আলোকচিত্র গ্রহণের সঙ্গে ছিল তাঁর নিজের আবিষ্কৃত বৈদ্যুতিক pentacle বা পঞ্চভুজাকার কবচ। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও আলোকচিত্রের উল্লেখ বিভীষণের জাগরণ-এ হেমন্তের কর্মপদ্ধতি মনে করাবে। হেমেন্দ্রকুমারের দুই পূর্বতন সৃষ্টির সঙ্গে হেমন্তের এইখানেই পার্থক্য। অমৃত দ্বীপ উপন্যাসে চৈনিক দার্শনিক লাউ-ৎজুর অনুগামীদের অতিলৌকিক দ্বীপে অদ্ভুত সব ঘটনা দেখে যখন হেমেন্দ্রকুমারের আরেক চরিত্র, রুদ্ধমনা এবং অলৌকিকতাতে কঠোরভাবে অবিশ্বাসী জয়ন্ত, বিরক্তি ও অসহিষ্ণুতা ব্যক্ত করছে, বিমল সেখানে অনেক শান্তভাবে জীবনে যে ‘স্বাভাবিকতা’-র বাইরেও অনেক কিছু আছে, তা মেনে নিচ্ছে। ‘অদৃশ্যের কীর্তি’ নামক ছোটোগল্পের অদৃশ্য জীবের ক্ষেত্রেও বিমল মুক্তমনা। হেমন্ত চৌধুরী হেমেন্দ্রকুমারের সৃষ্ট অনুসন্ধানকারীদের মধ্যে, অপার্থিবতা সম্বন্ধে তার জ্ঞান এবং অনুসন্ধিৎসার নিরিখে, সবার উপরে!
মুখ্য পাঠ্য
- Hodgson, William Hope. Carnacki, the Ghost-Finder (1913) Kindle Edition.
- James, M. R. ‘Casting the Runes’ (1911) in More Ghost Stories of an Antiquary (1911) Kindle Edition.
- ‘Lost Hearts’ (1895) in Ghost Stories of an Antiquary (1904) Kindle Edition.
- আশা দেবী। রক্তলিপি (১৯৫৫) । কলকাতা: বৃন্দাবন ধর।
- হেমেন্দ্রকুমার রায়। বিভীষণের জাগরণ (১৯৪২)। হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১৬ খণ্ড। সম্পাদনা গীতা দত্ত, সুখময় মুখোপাধ্যায়। কলকাতা: এশিয়া পাবলশিং কোম্পানি, ১৯৯৭। পৃ: ১৯৯-২৪২।
- অলৌকিক (নাটক) (১৯৪৫)। হেমেন্দ্রকুমার রায়, কিশোর ভৌতিক সমগ্র ৩। কলকাতাঃ পত্র ভারতী, ২০০৮। পৃ: ২৬১-২৮০।
গৌণ পাঠ্য
- যশোধরা দত্ত। ‘ ‘ছায়াকায়ার মায়াপুরে’ – হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ভূতের গল্প’। বৈশাখী, ‘দুষ্প্রাপ্য হেমেন্দ্রকুমার রায়’ সংখ্যা (কলকাতা: ২০১৮-১৯) পৃ: ৪৬-৭৪।
- R. James. Ghost Stories of an Antiquary Part 2: More Ghost Stories (1911). Kindle Edition.
- আশা দেবী। রক্তলিপি (কলকাতা: বৃন্দাবন ধর, ১৯৫৫)
- James, M. R. Ghost Stories of an Antiquary (1904). Original Classics and Annotated (p. 16). Kindle Edition.
- হেমেন্দ্রকুমার রায়। বিভীষণের জাগরণ। কলকাতা: দেব সাহিত্য কুটীর, ১৯৪২; হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী, ১৬শ খণ্ড। সম্পাদনা গীতা দত্ত, সুখময় মুখোপাধ্যায়। কলকাতা: এশিয়া পাবলশিং কোম্পানি, ১৯৯৭। পৃঃ ১৯৯-২৪২।
- হেমেন্দ্রকুমার রায়, কিশোর ভৌতিক সমগ্র ৩। কলকাতা: পত্র ভারতী, ২০০৮। পৃ: ২৬১-২৮০।
- যশোধরা গুপ্ত, ‘ ‘ছায়াকায়ার মায়াপুরে’ – হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ভূতের গল্প’, বৈশাখী, ‘দুষ্প্রাপ্য হেমেন্দ্রকুমার রায়’ সংখ্যা (কলকাতাঃ ২০১৮-১৯) পৃ: ৪৬-৭৪। ঐ একই সংস্থা থেকে হেমেন্দ্রকুমারের সম্পাদনায় ১৯৫০ সালে সারথি নামে আরেকটি বার্ষিকী বেরোয়। এতে ঐ একই নাম, অলৌকিক, ব্যবহার করে লেখক একটি গোয়েন্দা গল্প লেখেন। এটি এশিয়া-প্রকাশিত রচনাবলী-র ২৬শ খণ্ডে সংকলিত হয়েছে।
- R. James. Ghost Stories of an Antiquary Part 2: More Ghost Stories (Kindle Locations 991-992). Kindle Edition.
- Ibid. Kindle Locations 842-843.
- Ibid. Kindle Locations 939-942. টমাস বেউইক (১৭৫৩-১৮২৮) পেশায় কাঠ-খোদাইকারী এবং জীবতত্ত্বের লেখক ছিলেন।