ভ্যাম্পায়ারের বিবর্তন: ভক্ষক থেকে রক্ষক
লেখক: প্রিয়াংকা মিত্র
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ভ্যাম্পায়ারের মিথ মানবজাতির ইতিহাসের অংশ। প্রাচীন মিশর, গ্রিস এবং রোম প্রভৃতি বিভিন্ন জায়গায় ভ্যাম্পায়ারের মিথ প্রচলিত। গ্রিসে ভ্যাম্পায়ারদের ‘vrykolakas’, প্রাচীন রোমে তাদের ‘lamiae’, রোমানিয়ায় ‘nosferatu’ বলা হত। মানব ইতিহাস জুড়ে তারা কোনো না কোনো রূপে বিদ্যমান। তারা collective unconsiousness-এর অংশ, যাকে কার্ল জং বর্ণনা করেছেন, “part of the psyche which retains and transmits the common psychological inheritance of mankind”১ (Jung, 1964, 36)। সমষ্টিগত অচেতন মন এমন কিছু চিত্র ধারণ করে যা একটি সাধারণ উৎস থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসে। তবে ভ্যাম্পায়াররা ঐতিহাসিক যুগের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে—লোককাহিনির ভ্যাম্পায়ার থেকে শুরু করে প্রথম দিকের বায়রন, পলিডোরি, এবং লে ফ্যানুর রোমান্টিক ভ্যাম্পায়ার, সেখান থেকে ড্রাকুলা হয়ে ড্যামন সালভাতোর, এডওয়ার্ড কালেন পর্যন্ত। Nina Auerbach বলেছেন, “The rapidity with which our Draculas become dated tells us only that every age embraces the vampire it needs.”২ (Auerbach, 1995, 145)।
‘ভ্যাম্পায়ার’ আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে কারণ, তারা সেইসব জিনিসের প্রতিনিধিত্ব করে যেগুলো মানুষ ভয় পায় আবার নিয়ন্ত্রণও করতে চায়, যথা—মৃত্যু, যৌন আকাঙ্ক্ষা এবং ক্ষমতা। মানুষ একদিকে অজানাকে ভয় পায়, আবার অজানার অমোঘ রহস্য তাকে প্রতিনিয়ত আকর্ষণ করে। আর অজানার প্রতি এই টানই “represents those areas of the world and of consciousness which are, for one reason or another, not available to the normal processes of representation”৩ (Punter, 1980, p. 18)। এই কারণেই কল্পবিজ্ঞান, ফ্যান্টাসি, হরর, তন্ত্র-মন্ত্র ধারাগুলি এত জনপ্রিয়।
আঠারো শতক: কবিতা
ভ্যাম্পায়ারের সংজ্ঞা হিসাবে Encyclopedia Britannica-তে বলা হয়েছে, “Vampire, in popular legend, a creature, often fanged, that preys upon humans, generally by consuming their blood. Vampires have been featured in folklore and fiction of various cultures for hundreds of years, predominantly in Europe, although belief in them has waned in modern times”৪। অনেক সংস্কৃতিতেই এই রহস্যময় জীবের কথা এবং অপ্রাকৃতিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান নথিবদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু দক্ষিণ হাঙ্গেরিতে অসংখ্য রেকর্ড পাওয়া যায়, যে কারণে আঠারো শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপের সঙ্গে ‘ভ্যাম্পায়ার’ শব্দটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল। ‘Living Dead’-দের বিষয়ে অসংখ্য কিংবদন্তি এবং নানা প্রতিবেদন ভ্যাম্পায়ারদের উপস্থাপন করে কবর থেকে উঠে আসা পিশাচ হিসাবে যারা মানুষের রক্ত পান করে বেঁচে থাকে। আঠারো শতককে The Neo-classical Age, The Age of Reason, The Enlightment আখ্যা দেওয়া হয়। মূলত এই সময় থেকেই ইউরোপীয় কবিতার মধ্যে দিয়ে সাহিত্যে ভ্যাম্পায়ারের প্রথম আগমন হয়েছিল। ভ্যাম্পায়ারের ধারণাই সমসাময়িক কবিতার নেতৃস্থানীয় বিষয় ছিল—ভ্যাম্পায়াররা কবর থেকে উঠে প্রিয়জনদের অনুসরণ করে এবং তাদের মৃত্যু নিয়ে আসে।
এই বিষয়ে প্রথম কবিতা লেখেন একজন জার্মান লেখক হেনরিখ অগাস্ট ওসেনফেল্ডার—‘The Vampire’ (১৭৪৮), এরপর গটফ্রিড অগাস্ট বার্গার লিখেছেন ‘Lenore’ (১৭৭৩) এবং সম্ভবত সেই সময়ের ভ্যাম্পায়ার সাহিত্যের বিকাশের জন্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতা গ্যেটের ‘The Bride of Corinth’ (১৭৯৭)। প্রথম কোনো নারী ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে কবি পাঠকের পরিচয় করালেন। সেই বছরই রবার্ট সাউথের ‘Thalaba The Destroyer’ প্রকাশিত হয়, যেটি ভ্যাম্পায়ার সম্বন্ধীয় প্রথম ইংরেজি কবিতারূপে স্বীকৃত। রোম্যান্টিক ইংরেজ কবিরাও ‘undead’ সত্তার কবর থেকে উঠে এসে নিজের ভালোবাসার মানুষের জীবন শুষে নেওয়ার এই ধারণাকে আপন করে নিলেন। ১৮১৩ সালে লর্ড বায়রন ‘The Giaour’ কবিতাটি লেখেন যেখানে ভ্যাম্পায়ারে রূপান্তরিত ব্যক্তিটির নিয়তিই ছিল ‘suck the blood of all(his) race’। ১৮১৬ সালে স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের অসমাপ্ত কবিতা ‘Christabel’ প্রকাশিত হয়, যেটি তিনি সম্ভবত ১৭৯৭ থেকে ১৮০১ সালের মধ্যে লিখেছিলেন। কবিতাটির প্রেক্ষাপট একটি অবাস্তব, ফ্যান্টাসি জগৎ যেখানে প্রথম লেসবিয়ান ভ্যাম্পারিজম দেখা যায়। মূল চরিত্রটিকে কখনই স্পষ্টভাবে ভ্যাম্পায়ার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি, তবুও লেখক তার মধ্যে ভ্যাম্পায়ারের অনেক বৈশিষ্ট্য দেখান। ক্রিস্টাবেল অমানবিকভাবে শক্তিশালী, আমন্ত্রণ ছাড়া বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে না এবং প্রাণীদের উপর অদ্ভুত প্রভাব ফেলে।
আঠারো শতকের ভ্যাম্পায়ারের লোককাহিনির একটি নির্দিষ্ট বর্ণনা করা অসম্ভব। তবুও অধিকাংশ ইউরোপীয় কিংবদন্তির সাধারণ কিছু উপাদান রয়েছে। ভ্যাম্পায়াররা সাধারণত গাঢ় রঙের, তাদের মুখ থেকে রক্ত ঝরছে এবং ছেঁড়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পোশাক পরিহিত, ফ্যাং সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল না। খ্রিস্টান বিশ্বাসের ঐতিহ্যবাহী প্রতীক যেমন পবিত্র জল, ক্রুশের পাশাপাশি রসুন দিয়ে ভ্যাম্পায়ারদের প্রতিরোধ করা যেতে পারে। প্রতিরোধের পদ্ধতি দেশভেদে বিভিন্ন ছিল। স্টেক দিয়ে হত্যা করা দক্ষিণ স্লাভিক সংস্কৃতিতে সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি, রাশিয়ানরা অ্যাশ উড ও হথর্ন পছন্দ করত, আবার সাইলেসিয়াতে ওক ব্যবহৃত হত। এইসব গাছের ডাল দিয়ে হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে ভ্যাম্পায়ারদের হত্যা করার কথা প্রচলিত ছিল।
উনিশ শতক: উপন্যাস
ভ্যাম্পায়ার চরিত্রের বিকাশে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল ১৮১৯ সালে জন উইলিয়াম পলিডোরির উপন্যাস ‘The Vampyre’-এর প্রকাশনা। এটি ইংলিশ সাহিত্যে প্রথম ভ্যাম্পায়ারের কাহিনি হিসাবে স্বীকৃত। ক্রিস্টোফার ফ্রেলিংয়ের বক্তব্য, “the first story successfully to fuse the disparate elements of vampirism into a coherent literary genre.”৫ (Frayling, 1991, 108) পলিডোরি প্রথম রূপক হিসাবে ভ্যাম্পায়ারের সম্ভাবনা, ক্ষমতা ও নমনীয়তা এবং মনস্তাত্ত্বিক সম্ভাবনার কথা উপলব্ধি করেন। গল্পটিতে দেখা যায় লর্ড রুথভেনকে, একজন ইংরেজ দুর্বৃত্ত যিনি গ্রিসে নিহত হয়েও ফিরে আসেন, বন্ধুর বোনকে বিয়ে করেন। তবে বিয়ের রাতে মেয়েটিকে রক্তশূন্য মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। পলিডোরির গল্পটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এটি মিথের ভয়ংকর, ঘৃণ্য জীবটির বিপরীতে সাহিত্যে মনোমুগ্ধকর, পরিশীলিত ভ্যাম্পায়ারের সূচনা করে। পুরোনো পুরুষ ভ্যাম্পায়ার অনৈতিক ও একাকী মানুষের বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল যে বিশ্বের পাশাপাশি মানুষকেও ঘৃণা করে। যদিও পলিডোরির গল্পটি তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা পায়নি, তবে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি একটি লোককাহিনির দানব থেকে ভ্যাম্পায়ারকে একজন অভিজাত হিসাবে রূপান্তরিত করেছিলেন।
এরপর ১৮৪০ সালে ধারাবাহিক প্রকাশনা penny dreadful-এর সঙ্গে প্রকাশিত হয় ‘Varney the Vampire or the Feast of Blood’, যেখানে ভ্যাম্পায়ার ফিকশনের অনেক নতুন উপাদান সংযোজিত হয়। এখানে লোককাহিনির ঐতিহ্যের সঙ্গে অভিজাত সাহিত্যের মিলন হয়। ভার্নি সহানুভূতিশীল ভ্যাম্পায়ারের প্রথম উদাহরণ যে তার শিকারি প্রবৃত্তিকে ঘৃণা করে। তার ফ্যাং আছে, সে মানুষকে হিপনোটাইজ করতে পারে, শোবার ঘরের জানলা দিয়ে শিকারের বাড়িতে ঢোকে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী জুড়ে এই সহানুভূতিশীল ভ্যাম্পায়ার বিক্ষিপ্তভাবে হলেও ধারাবাহিকভাবে সাহিত্যে আসতে থাকে যতক্ষণ না এটি আধুনিক আখ্যানের একটি মূলধারার চরিত্র হয়ে উঠেছে। যেমন ফ্লোরেন্স মারয়াট-এর ‘The Blood of the Vampire’(১৮৯৭), ই. ইভরেট ইভান্স-এর ‘The Undead Die’(১৯৪৮), জেমস এস হার্ট-এর ‘The Traitor’(১৯৫০) ইত্যাদি। অ্যান বিলসন বলেছেন, “perhaps as a result of an erosion in rigid moral standards as once dictated by organised religion, as well as the burgeoning appeal of the rebel outsider, the rise of the conflicted anti-hero and the enshrinement of the individual over the needs of society.”৬ (Billson, 2013, 15)। পুরোনো রক্ষণশীল মতাদর্শ এই নতুন ধরনের কাহিনিগুলিতে ভ্যাম্পায়ারের এই মহিমান্বিত রূপটিকে ব্যর্থ করতে পারেনি।
উনিশ শতকের ভ্যাম্পায়ার সাহিত্যের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ আইরিশ লেখক জোসেফ শেরিডান লে ফানুর ‘Carmilla’। ১৮৭২ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি একটি তরুণীর গল্প বলে যে এক নারী ভ্যাম্পায়ারের মনোযোগের প্রতি সংবেদনশীল। কারমিলা, ভ্যাম্পায়ার এবং শিরোনাম চরিত্রটি পরবর্তীকালের মহিলা এবং লেসবিয়ান ভ্যাম্পায়ারদের মূল প্রোটোটাইপ। যদিও লে ফানু তার ভ্যাম্পায়ারের যৌনতা চিত্রিত করার ক্ষেত্রে সতর্ক ছিলেন, তবুও এটি স্পষ্ট যে কারমিলা এবং লরা-র মধ্যে আকর্ষণই গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। কারমিলা শুধুমাত্র নারী শিকার বেছে নেয়, কারও কারও সঙ্গে আবেগগতভাবে জড়িয়ে পড়ে। তার কিছু নিশাচর অভ্যাস আছে, কিন্তু সেগুলি অন্ধকারে সীমাবদ্ধ নয়। সে অস্বাভাবিক সুন্দর এবং ইচ্ছামত একটি বিশ্রী কালো বিড়ালে রূপান্তরিত হতে পারে, সে দেয়াল ভেদ করে চলতে পারে এবং একটি কফিনে বিশ্রাম করে।
ব্রাম স্টোকারের ‘Dracula’ (১৮৯৭) গথিক হরর উপন্যাসগুলির একটি মাস্টারপিস হিসাবে স্বীকৃত। এই উপন্যাসেই ব্রাম স্টোকার ভ্যাম্পায়ারের অনেক বৈশিষ্ট্যকে জনপ্রিয় যা এখনও ভ্যাম্পায়ারের কাহিনির সঙ্গে যুক্ত। যেমন—ভ্যাম্পায়ারের প্রতিবিম্ব আয়নায় দেখা যায় না—এই বৈশিষ্ট্যটি স্টোকারের তৈরি ছিল, কোনো লোককাহিনির কিংবদন্তি ছিল না। ১৮৯৭ সালে যখন বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তখন অনেকে একে ‘the most blood-curdling novel of the paralyzed century’৭ (Dalby, 1986, 405) বলেছিলেন। এই উপন্যাসটি ১৮৯০-এর দশকে ইংল্যান্ডের জাতিগত মিশ্রণ এবং বিদেশিদের দ্বারা আক্রমণের ভয়কে ফুটিয়ে তুলেছে। ড্রাকুলাকে আয়নায় দেখা না গেলেও সে আমাদের আসক্তি, আমাদের কল্পনা, আমাদের প্রয়োজন, আমাদের সহিংসতা, দুর্নীতি এবং শিকারী প্রকৃতির প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠে, কারণ “Contrary to the old legends that tell us that vampires have no reflection, we do indeed see many diverse reflections – of ourselves – as the vampire stands before us cloaked in metaphor.”৮ (Waller 2010, 3)।
উনিশ শতকের সাহিত্যে ভ্যাম্পায়ারদের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে—তারা অস্বাস্থ্যকর দেখতে, অদ্ভুতভাবে কৌতূহলী, সম্মোহনী দৃষ্টিযুক্ত, নিশাচর, তাদের পাশবিক অল্টার-ইগো আছে এবং ফ্যাং আছে। তাদের কফিনে ফিরতেই হবে, প্রায়শই তারা সেখানে কিছু স্থানীয় মাটি রাখে, বিশেষত যদি তারা স্থানান্তরিত হয়। এইসব গুণাবলী পরবর্তী ভ্যাম্পায়ারদের চিত্রণে প্রাধান্য পেয়েছে এবং ড্রাকুলা হয়ে উঠেছে অসংখ্য ফিল্ম সংস্করণের জন্য অনুপ্রেরণা। প্রথম ভ্যাম্পায়ার মুভিগুলোর মধ্যে একটি ছিল এফ. ডব্লিউ. মুরনাউ পরিচালিত ‘Nosferatu’ (১৯২২)। ফিল্মটি ছিল ব্রাম স্টোকারের বইয়ের একটি অননুমোদিত রূপান্তর। স্টুডিয়ো উপন্যাসটির স্বত্ব পায়নি তাই নাম এবং অন্যান্য বিবরণ পরিবর্তন করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ‘ভ্যাম্পায়ার’ শব্দটি হয়ে উঠেছে ‘নোসফেরাতু’ এবং ‘কাউন্ট ড্রাকুলা’ হয়ে ওঠে ‘কাউন্ট অরলোক’। ব্রিটেনের প্রেক্ষাপটের বদলে উনিশ শতকের জার্মানি দেখানো হয়।
বিশ শতকের ভ্যাম্পায়ার ফিকশন
১৯৭৫ সালে ফ্রেড সাবেরহেগেন, ব্র্যাম স্টোকারের ‘Dracula’-র গল্পটিকেই ড্রাকুলার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখান, তাঁর ‘The Dracula Tape’ উপন্যাসে। সেখানে কাউন্ট ড্রাকুলাকে দেখা যায় পাগল এবং হিংস্র ভ্যান হেলসিংয়ের দ্বারা নির্যাতিত ও সম্পূর্ণ ভুল বোঝা একটি চরিত্র হিসাবে। সহানুভূতিশীল ভ্যাম্পায়ারের প্রচারে টেলিভিশনও একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ষাটের দশকের শেষের দিকে এবং সত্তরের দশকের শুরুতে, ‘Dark Shadows’ সিরিজে বার্নাবাস কলিন্সের চরিত্রটি ব্যাপকভাবে শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং বীর এবং নিঃস্বার্থ ভ্যাম্পায়ার হিসাবে সে শোয়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ১৯৭৪ সালে ব্র্যাম স্টোকারের ‘Dracula’ নিয়ে একটি টেলিভিশন ফিল্ম তৈরি হয়। রিচার্ড ম্যাথেসন-এর চিত্রনাট্য, ড্যান কার্টিস দ্বারা পরিচালিত এবং কাউন্ট হিসাবে জ্যাক প্যালেন্স অভিনীত এই ফিল্মের কেন্দ্রে থাকে লুসির সঙ্গে ড্রাকুলার প্রেম। লুসিকে তার হারিয়ে যাওয়া প্রেমের পুনর্জন্ম হিসাবে পুনরায় কল্পনা করা হয়। এর প্রায় কুড়ি বছর পরে ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা স্টোকারের উপন্যাসের অনুকরণে বিখ্যাত ফিল্মটি তৈরি করবেন, যেখানে তিনিও মিনাকে ড্রাকুলার স্ত্রীয়ের পুনর্জন্ম হিসাবে দেখাবেন।
বিশ শতকের সাহিত্যে অ্যান রাইসের ‘The Vampire Chronicles’ (১৯৭৬-২০১৮) দুর্দান্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৭৬ সালে ‘Interview with the Vampire’, ১৯৮৫ সালে ‘The Vampire Lestat’, ১৯৮৮ সালে ‘The Queen of the Damned’ থেকে ২০১৮ সালের ‘Blood Communication: A Tale of Prince Lestat’ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। বিশ শতকের সাহিত্যে ভ্যাম্পায়ারের চিত্রায়নেও অনেক পরিবর্তন এসেছিল। ভ্যাম্পায়ার কথাসাহিত্য গথিক হরর ছাড়িয়ে কল্পবিজ্ঞানের ধারায় লেখা হয়েছিল। সেসব কাহিনিতে ভ্যাম্পায়াররা অন্যান্য গ্রহে আবির্ভূত হয়, প্রায়শই জেনেটিক মিউট্যান্ট হিসাবে চিত্রিত হয়। এই ধারার একটি প্রাথমিক উদাহরণ হল ১৯০৮ সালে প্রকাশিত গুস্তাভ লে রুজ-এর ‘Le prisonnier de la planète Mars’ (Prisonner of The Vampires of Mars), এই কাহিনিতে বাদুড়-পাখাওয়ালা, রক্ত পান করা হিউম্যানয়েড পাওয়া যায় মঙ্গল গ্রহে। ১৯২০ সালে জে.এইচ. রোসনিয়াইনের উপন্যাস ‘LaJeune Vampire’ (The Young Vampire) এটিকে জেনেটিক মিউটেশন হিসাবে বর্ণনা করে ভ্যাম্পায়ারিজমের জন্য একটি জৈবিক ব্যাখ্যা প্রদান করে।
১৯৫৪ সালে প্রকাশিত রিচার্ড ম্যাথেসনের ‘I am Legend’-এ ভ্যাম্পায়ার মোটিফের একটি বড়ো বদল দেখা যায়। প্রধান চরিত্র রবার্ট নেভিল একটি মহামারী থেকে রক্ষা পায়। রোগটি একটি যুদ্ধের কারণে হয়েছিল, পরে ধূলিকণার ঝড় এবং একটি বিস্ফোরণের সাহায্যে ছড়িয়ে পড়ে। এর উপসর্গ ভ্যাম্পারিজমের মতো। লস অ্যাঞ্জেলেসে নেভিল দৈনন্দিন জীবনযাপন করে এবং রোগটিকে বুঝে তার নিরাময় খুঁজতে চায়। লেখক তার বইতে বিভিন্ন সংস্কৃতির পরিচয় দিয়েছেন, যে জীবনে যেমন ছিল তা তার ভ্যাম্পায়ার ফর্মকে প্রভাবিত করে। যেমন—কেউ যদি খ্রিস্টান হন, তাহলে ক্রুশ; আবার কেউ যদি ইহুদী হয়, একটি তোরা (torah) তাকে বিতাড়িত করবে। বইয়ের শেষে ভ্যাম্পায়ারদের সহানুভূতিশীল এবং সচেতন হিসাবে দেখানো হয়।
বিশ শতকে তথাকথিত অর্ধ-ভ্যাম্পায়ারের ধারণাও এসেছিল। ১৯৮১ সালে হুইটলি স্ট্রাইবার ‘The Hunger’-এ মরিয়ম ব্লেলকের গল্প বলেন, যে একজন রক্তচোষা এলিয়েন জাতির প্রতিনিধি। হাজার হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকার ফলে সে তার মানব প্রেমিকদের আজীবন সঙ্গীতে পরিণত করে। যদিও মরিয়ম মানুষকে ভ্যাম্পায়ারে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে, তবে তাদের অমর করতে পারে না, শুধুমাত্র কয়েক শতাব্দী তাদের আয়ু বৃদ্ধি করতে পারে মাত্র। উপন্যাসটি ভ্যাম্পায়ারের জৈবনিক ক্রিয়াকে পরীক্ষা করে। দেখা যায় তাদের অস্বাভাবিক ক্ষমতার কারণ প্রকৃতপক্ষে তাদের অন্যরকম রক্তের বৈশিষ্ট্য এবং সব ভ্যাম্পায়ারই একসময় মানুষ ছিল এমনটা নয়, বরং এরা একটি পৃথক প্রজাতি যা মানব জাতির সঙ্গেই বিকশিত হয়েছিল। এই ব্যাখ্যাটি বেশ কয়েকটি কল্পবিজ্ঞান কাহিনিতে গৃহীত হয়েছে, যারা অর্ধ-ভ্যাম্পায়ার মোটিফ নিয়ে কাহিনি লিখেছেন।
এই ধারার অন্যতম জনপ্রিয় প্রতিনিধি হল ‘Blade’ (১৯৯৮-২০০৪) মুভি সিরিজ। গর্ভবতী তারা ব্রুকস, ভ্যাম্পায়ারের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যায়। ডাক্তাররা মনে করেন ক্ষতটি কোনো পশুর কামড়ের ফল। তারা তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও প্রসবের পরেই সে মারা যায়। শিশু ব্লেড উত্তরাধিকারসূত্রে ভ্যাম্পিরিক ক্ষমতা লাভ করে, যার মধ্যে অনেক দীর্ঘ জীবনকাল, হিলিং ফ্যাক্টর, রক্তের লালসা, উন্নত ইন্দ্রিয়চেতনা থাকলেও রসুন বা সূর্যালোক থেকে সে হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। সে ভ্যাম্পায়ার-হান্টার হয়ে ভ্যাম্পায়ারদের শিকার করতে শুরু করে।
১৯৬৭ সালে রোমান পোলানস্কি ‘The Fearless Vampire Killers, or Pardon Me, But Your Teeth Are in My Neck’ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন। যদিও এটি কমেডি হরর ঘরানার প্রথম ছবি ছিল না, তবে এই ঘরানাকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য উল্লেখযোগ্য। ছবিটির প্রেক্ষাপট সম্ভবত উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের ট্রানসিলভেনিয়া। প্রফেসর অ্যাব্রোনসিয়াস, তার ছাত্র আলফ্রেডের সঙ্গে ভ্যাম্পায়ারের সন্ধানে বেরিয়েছেন। দুজনে পূর্ব ইউরোপের কোনো ছোটো শহরে এসে একটি স্থানীয় সরাইখানায় ওঠে, যেখানকার আতঙ্কিত বাসিন্দারা অদ্ভুত আচার-অনুষ্ঠান পালন করে শয়তানকে তাড়ানোর জন্য।
১৯৮৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘Near Dark’ ও ‘The Lost Boys’-এর মতো আমেরিকান চলচ্চিত্রগুলি কিশোর-কিশোরীদের ভ্যাম্পায়ারিজমের প্রতি আকর্ষণকে একটি অস্থায়ী সংঘর্ষের সময় উপস্থাপন করে (কারণ এইডস-এর সমস্যা তখন তুঙ্গে), যা অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের সাময়িকভাবে তাদের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিকতা এবং রক্ষণশীল পারিবারিক মূল্যবোধের কাছে ফিরিয়ে আনে। তবুও, সাহিত্যিক ক্ষেত্রে অনেক গল্প ভ্যাম্পায়ারিজমকে পিতামাতার কর্তৃত্ব এবং সামাজিক প্রত্যাশার দমবন্ধ করা প্রভাব থেকে দূরে নিজের পরিচয়কে সুসংহত করার একটি উপায় হিসেবে উপস্থাপন করেছে। “Robert Aickman’s Pages from a Young Girl’s Journal (1973), for example, also employs vampirism as a metaphor for the conflicts and rebelliousness of adolescence, with the difference that the vampire in this story is portrayed as the eponymous Girl’s means of escape and liberation from emotionally distant parents and from asphyxiating social norms.”৯ (Lutz 2006, 33–34)। ভ্যাম্পায়ারিজম ব্যক্তিগত স্বাধীনতার একটি অনুশীলন হয়ে ওঠে এবং মেয়েটির ইচ্ছা ও তার স্বতঃসিদ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি অস্তিত্বের পথ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
মানুষের শত্রু হিসেবে ভ্যাম্পায়ারকে চিত্রিত করার বিপরীতে, অনেক গল্পে তাকে বন্ধুরূপে, দুর্বল ও নিপীড়িতদের রক্ষক হিসেবে, নৈতিক আকাঙ্ক্ষার পোষক, অধিকাংশ মানবজাতির তুলনায় আরও মানবিক, দয়ালু এবং মহৎ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। চেলসি কুইন ইয়ারব্রোর ‘স্যেন্ট-জার্মেইন’, যিনি ‘Hotel Transylvania’ (১৯৭৮) এর নায়ক, একজন বিদ্বান, জ্ঞানী এবং ন্যায়বিচারের রক্ষক, যিনি নারীদের দুর্নীতি, স্বৈরাতন্ত্র এবং এক ধরনের অশ্লীল পিতৃতান্ত্রিকতার বিপরীতে লড়াই করেন। জোডি স্কটের ‘I, Vampire’ (১৯৮৪)-এর স্টার্লিং ও’ব্লিভিয়ন মানব বিশ্বের অসংলগ্ন নিষ্ঠুরতা এবং অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে, যেমন জুয়েল গোমেজের ‘The Gilda Stories’ (১৯৯১)-এর ক্ষেত্রেও হয়। এই ধরনের ভ্যাম্পায়ারদের জন্য রক্তপান অপরাধবোধ এবং নৈতিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে এবং তাদের মধ্যে অনেকেই রক্তের বিকল্প, পশুর রক্ত বা রাইস-এর ভ্যাম্পায়ারদের মতো, শুধুমাত্র অপরাধী এবং দুষ্কৃতিদের থেকে রক্ত পান করার অথবা তাদের শিকারকে না মেরে যতটা সম্ভব কম রক্ত নেওয়ার চেষ্টা করে। এই নতুন ধরনের বিবেকবান ভালো ভ্যাম্পায়ারদের এবং ঐতিহ্যগত দুষ্ট ভ্যাম্পায়ারদের মধ্যে, যারা মানুষকে গবাদি পশুর মতো ব্যবহার করে, সংঘর্ষটি হয়ে ওঠে গল্পের মূল ফোকাস, যেমন জর্জ আর. আর. মার্টিনের ‘Fevre Dream’ (১৯৮২), জাস্টিন সোম্পারের ‘Vampirates’ সিরিজ (২০০৫–২০১১), এবং চার্লেইন হ্যারিসের ‘The Southern Vampire Mysteries’ (২০০১–২০১৪) উপন্যাসগুলো, যা জনপ্রিয় HBO টেলিভিশন সিরিজ ‘True Blood’ (২০০৮–২০১৪)-এর অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
আধুনিক রোমান্টিক প্রবণতা
বিশ শতকের শেষ থেকে আধুনিক রোমান্টিক প্রবণতার সূচনা হয় যা একুশ শতকে সাহিত্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। আমেরিকান লেখকরা ভালো ভ্যাম্পায়ারের ধারণা নিয়ে আসেন, যাদের মধ্যে স্টেফানি মেয়ার-এর সিরিজ ‘Twilight Saga’ (২০০৫-২০০৮) জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছায়। লেখক এখানে একজন ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে একজন মানুষের প্রেমের ধারণাটি চিত্রিত করেছেন।
“Edward: And so the lion fell in love with the lamb.
Bella: What a stupid lamb.
Edward: What a sick, masochistic lion.”১০ (Meyer, 2008, 240)
ভ্যাম্পায়ার এডওয়ার্ডকে তার নিজের অমরত্ব তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় এবং না চাইতেও জীবন ধারণের জন্য তাকে রক্তপান করতে হয়, তাই সে একসময় অপরাধীদের রক্তপান করলেও এখন মনুষ্যেতর প্রাণীর রক্তের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। ভালোমন্দের দোলাচলে আটকে থেকে সে প্রথমে তার সহপাঠী বেলাকে নিজের সংস্পর্শে আসতে দিতে চায় না। তার ইমেজ রোমান্টিক, ভালো ভ্যাম্পায়ারদের চিত্রিত করার আধুনিক প্রবণতাকে প্রমাণ করে। ঐতিহ্যশালী ভ্যাম্পায়াররা আধুনিক ভ্যাম্পায়ারদের থেকে যথেষ্ট আলাদা। যেমন ‘Twilight Saga’-র ভ্যাম্পায়ারদের ধ্বংস করা খুব কঠিন, পবিত্র জল, রসুন, স্টেক, ক্রস বা মানুষের অস্ত্র দ্বারা তাদের বিনাশ করা যায় না। তারা সাহিত্যের অন্য ভ্যাম্পায়ারদের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। সূর্যালোকে তাদের কোনো ক্ষতি হয় না, শুধু তারা সূর্যের আলোতে হীরের মতো ঝকঝকে, তাই তারা সূর্যালোকে মানুষের সামনে আসে না। আয়নায় এবং ফোটোগ্রাফে তাদের দেখা যায়, কফিনের প্রয়োজন নেই কারণ তারা ঘুমায় না, তাদের পূর্বসূরীদের মতো আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে না, তাদের ফ্যাং নেই। মানুষকে কামড়ালে তাদের লালা মানুষের রক্তে মিশে গেলে সেই মানুষও ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়। এছাড়াও ভ্যাম্পায়ার সমাজ গড়ে উঠেছে, তাদের আলাদা মিনিস্ট্রি আছে, মানুষের মতো তাদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধব রয়েছে।
নব্বইয়ের দশক আসতে আসতে সিনেমা অবশেষে প্রায় দু-দশক আগে ঘটে যাওয়া ধারণার পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে এবং সহানুভূতিশীল, যন্ত্রণা-ক্লিষ্ট পুরুষ ভ্যাম্পায়ারকে রোমান্টিকভাবে মহিমান্বিত করতে শুরু করেছিল আর ভ্যাম্পায়ার চরিত্রকে বীর প্রেমিক চরিত্রে রূপান্তরিত করেছিল। ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার ‘Bram Stoker’s Dracula’ (১৯৯২)-তে ড্রাকুলাকে এক অন্ধকার রোমান্টিক নায়ক হিসেবে চিত্রিত করে, যে ভালোবাসার মাধ্যমে পরিত্রাণের সন্ধান করছে। তবে টেলিভিশনই রোমান্টিক ভ্যাম্পায়ারের জনপ্রিয়তার প্রসারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল এবং এই প্রবণতার পিছনে প্রধান চালিকাশক্তিগুলোর একটি ছিল জস ওয়েডনের কাল্ট সিরিজ ‘Buffy the Vampire Slayer’ (১৯৯৬–২০০৩)। বাফি এবং অ্যাঞ্জেলের প্রেম কাহিনি—অন্ধকার, বিষণ্ণ ভ্যাম্পায়ার যে অভিশপ্ত আত্মা নিয়ে বেঁচে আছে—এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে অ্যাঞ্জেল সিরিজ ছেড়ে গেলে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্পাইককে বাফির প্রেমিক হিসেবে দেখানো হয় এবং তাকে আরও পরিণত দর্শকের জন্য একটি স্পিন-অফ সিরিজ দেওয়া হয়।
এরপর আসে ‘The Vampire Diaries’ (২০০৯–২০১৭), যেটি এল. জে. স্মিথের নব্বইয়ের দশকে প্রকাশিত বইয়ের উপর ভিত্তি করে নির্মিত আরেকটি তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক হরর সিরিজ। এলিনা এবং ভ্যাম্পায়ার স্টেফান ও তার ভাই ড্যামন সালভাতোরের মধ্যে ত্রিকোণ প্রেম এই সিরিজের মূল কাহিনি। এই সিরিজটি বিশাল সাফল্য অর্জন করে, কিশোরী মেয়েদের এক ভাই বা অন্যের জন্য, অথবা উভয়ের জন্য সমর্থন করতে অনুপ্রাণিত করে। শুধু তাই নয়, এটি এত জনপ্রিয় হয় যে ২০১৭ সালে সিরিজটি শেষ হওয়ার আগেই ‘The Originals’ নামে এর একটি স্পিন-অফ সিরিজ শুরু হয়, যেটির ৫টি সিজন (২০১৩-২০১৮) হয়েছিল। এই সিরিজের সাফল্যের পর এরও একটি স্পিন-অফ সিরিজ ‘Legacies’ শুরু হয়, যেটির ৪টি সিজন (২০১৯-২০২২) হয়েছিল। এই সিরিজের ভ্যাম্পায়াররা রক্তপান করলে তাদের শরীর স্বাভাবিক মানুষের মতোই কাজ করে। রক্ত ছাড়াও তারা অন্যান্য খাবার ও পানীয়ও গ্রহণ করতে পারে। রক্তপানের সময়েই তাদের মুখ বিকৃত হয়ে ফ্যাং বেরিয়ে আসে। কোনো কোনো ভ্যাম্পায়ার (যেমন ড্যামন) পরিবেশের কিছু উপাদান এবং পশুপাখিদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কোনো জীবিত মানুষের শরীরে নিজেদের রক্ত প্রবেশ করানোর পর সেই মানুষের মৃত্যু হলে তারা ভ্যাম্পায়ার হয়ে ফিরে আসে। তবে তখন তারা রূপান্তরের মধ্যে থাকে, যতক্ষণ না তারা রক্তপান করে ততক্ষণ পুরোপুরি ভ্যাম্পায়ার হয়ে ওঠে না। জীবিত অবস্থায় যে মানুষ যেমন, ভ্যাম্পায়ার হলে চরিত্রের সেই দিকটা আরও বেশি দৃঢ় হয়ে ওঠে। পবিত্র জল, ক্রস, রসুন ইত্যাদি এদের জন্য ক্ষতিকারক নয়, তবে সূর্যালোকে এরা পুড়ে মারা যায় অথবা হৃৎপিণ্ডে স্টেক ঢুকিয়ে এদের হত্যা করা যায়। ভ্যাম্পায়ার নিয়ে তৈরি যে কোনো সিনেমা বা সিরিজের মধ্যে এটি অন্যতম, সিরিজটি শেষ হয়ে যাওয়ার সাত বছর পরেও একে নিয়ে উন্মাদনার শেষ নেই।
লেখক এবং পরিচালকদের হাতে ভ্যাম্পায়ারের ধারণা অনেক বদলে গেছে। ভ্যাম্পায়ার জনসাধারণের চেতনায় প্রথমে ভয়ংকর দানব হিসাবে উপস্থিত হয়ে আজকের রোমান্টিক প্রেমিকে পরিণত হয়েছে দেখে মনে হয়, এর বহুমুখিতা এবং স্থিতিস্থাপকতা ভ্যাম্পায়ারকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে সক্ষম করেছে। প্রতিটি প্রজন্মের অবচেতন ভয় ও আকাঙ্ক্ষাকে নিজের ভয়ংকর রূপের আড়ালে রেখে প্রকাশ করেছে। ভবিষ্যতে ভ্যাম্পায়ার কীভাবে পরিবর্তিত হবে, ভ্যাম্পায়ার গল্পগুলি কোন দিকে যাবে এবং তারা কী প্রশ্ন করবে তা অনুমান করা খুব কঠিন, তবে যা নিশ্চিত তা হল, এই প্রাণীগুলি, যা আমাদের এতটা অস্বস্তিকরভাবে নিকটবর্তী, তারা সত্যিকারের মানব হওয়ার অর্থ নিয়ে বিশ্লেষণমূলক আলোচনাকে চালিয়ে যাবে। কিংবদন্তি ভক্ষক থেকে বর্তমানে যে রক্ষকের ভূমিকা সে নিয়েছে তা থেকে মনে হয়, আমাদের চারিপাশে মানুষের মধ্যে যে এত নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা, সমাজ যেভাবে তার ভয়ংকর নখ-দাঁত বিকশিত করে সর্বদা আমাদের শাসিয়ে চলেছে, তা থেকে ক্ষণিকের স্বস্তি পেতে আমরা আমাদের সঙ্গী হিসাবে এমন একজনকে কল্পনা করছি, যে আমাদের সমস্ত বিপদ থেকে আগলে রাখবে, যার কাঁধে মাথা রেখে আমৃত্যু নিশ্চিন্ত জীবন কাটিয়ে দেওয়া যাবে অর্থাৎ আধুনিক এই রূপকথায় আমরা আমাদের Happily ever after-কে পেয়ে যাব। যদিও মানুষ বেশিদিন বাঁচে না, তবুও ইতিহাসে ও শিল্প-সাহিত্যে, ভ্যাম্পায়াররা অমর হয়ে থাকবে।
তথ্যসূচি:
১) Jung, Carl G., M.-L. von Franz, Joseph L. Henderson, Jolanda Jacobi, and Aniela Jaffe. Man and His Symbols. London: Aldus, 1964. p.36
২) Auerbach, Nina. Our Vampires, Ourselves. University of Chicago Press: Chicago, 1995, p.145.
৩) Punter D., The Literature of Terror, New York: Longman, 1980, p. 81.
৪) https://www.britannica.com/topic/vampire
৫) Frayling, Christopher, Vampyres: Lord Byron to Count Dracula. Lodon: Faber and Faber, 1991, p. 108.
৬) Billson, Anne. edited by James Bell, Monstrous Vampires. In Gothic, London: BFI, 2013, p.15.
৭) Dalby R., Bram Stoker, in Jack Sullivan (ed) The Penguin Encyclopedia of Horror and the Supernatural, Kent, Viking, 1986, p. 405.
৮) Waller, Gregory A. The Living and the Undead: Slaying Vampires, Exterminating Zombies. Chicago: University of Illinois Press, 2010, p.3.
৯) Lutz, Deborah. The Dangerous Lover: Gothic Villains, Byronism, and the Nineteenth–Century Seduction Narrative. Columbus: The Ohio State University Press, 2006, p. 33-34.
১০) Meyer, Stephenie, Twilight, Atom, London: UK, 2008, p.240.
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, প্রিয়াংকা মিত্র