প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন
লেখক: স্বর্ণদীপ রায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“কেমন বোধ করছেন এখন?”
“নেভার ফেল্ট বেটার।”
অশীতিপর আইজ্যাক হুবারম্যান স্মিত হেসে বললেন।
বৃদ্ধের উত্তর শুনে গিরিজা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
যাক, এতদিনের পরিশ্রম অবশেষে সফল হয়েছে।
হুবারম্যানের কেসের এই সাফল্যই প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশনকে তার পরবর্তী ধাপে পৌঁছে দেবে।
স্যার বেঁচে থাকলে আজ কত খুশি হতেন।
ডক্টর গিরিজা চন্দ্রশেখরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
তারপর মেডিক্যাল অ্যাটেন্ড্যান্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে রেজ়ারেকশন ল্যাব থেকে বেরিয়ে নিজের কেবিনের দিকে রওনা দিলেন।
প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন অবশেষে চূড়ান্ত সাফল্যের মুখ দেখতে চলেছে।
আজ থেকে পনেরো বছর আগে যখন এমআইটি বা ম্যাসাচুসেট্স ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির প্রফেসার মোহনলাল রায় এই সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন, তখন সকলে ওঁর কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল।
“এজিং ইজ় আ ন্যাচারাল প্রসেস, প্রফেসার রয়।” ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কমিশনের চেয়ারপার্সন প্রফেসার এমা জনসন মোহনলালকে কিছুটা শ্লেষের সঙ্গেই বলেছিলেন, “ইট’স ইম্পসিব্ল টু রেজ়িস্ট ইট অর রিভার্স ইট। অ্যান্ড এনি অ্যাটেম্ট টু ডু সো উইল জেনারেট ট্রিমেন্ডাস নেগেটিভ ইমপ্যাক্টস।”
মোহনলাল এটা মানতে পারেননি।
ওঁর স্থির বিশ্বাস ছিল যে মানুষের বার্ধক্যপ্রাপ্তির প্রক্রিয়াকে কৃত্রিমভাবে আটকে দিলে আখেরে মানবসভ্যতার লাভই হবে। আর এটা করার উপায়ও উনি আবিষ্কার করেছিলেন। তবে তাত্ত্বিক দিক থেকে ওঁর আবিষ্কৃত ওই প্রক্রিয়া নিখুঁত বলে মনে হলেও ওটার বাস্তব প্রয়োগ চাক্ষুষ না-করা পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক মহল ওটাকে কোনোরকম মান্যতাই দিতে চায়নি।
কিন্তু এই কাজটা হাতেকলমে করার জন্য মোহনলালের প্রয়োজন ছিল প্রচুর ফান্ডিং-এর। আর সেটা পাওয়ার জন্যই উনি ওঁর রিসার্চওয়ার্কের উপর ভিত্তি করে একটা প্রোজেক্টের পরিকল্পনা করেন।
এটাই হল ‘প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন’!
এরপর উনি এই প্রোজেক্টের বিস্তারিত প্ল্যানিং-সহ ফান্ডিং-এর আবেদনপত্র জমা দেন ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কমিশনের কাছে। কিন্তু এমা জনসনের নেতৃত্বাধীন ওই কমিশন ওঁকে ফান্ডিং দিতে অস্বীকার করে। কারণ প্রফেসার জনসন আর ওঁর সহকর্মীদের মনে হয়েছিল যে মোহনলাল যেটা করতে চাইছেন, সেটা বাস্তবায়িত হলে প্রকৃতির ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে।
আর এমা জনসন একা নন। এমআইটি-তে মোহনলালের সহকর্মী এমনকি ওঁর পিএইচডি স্টুডেন্টদের অধিকাংশের মনেও ওই প্রোজেক্ট সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ছিল।
তারা মনে করেছিল যে মোহনলালের এই থিয়োরি আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না।
ওঁর ডক্টোরাল এবং পোস্টডক স্টুডেন্টদের অধিকাংশই ওঁর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে অন্য অধ্যাপকদের অধীনে কাজ করতে চলে যায়।
কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল একজন। এমআইটি-র প্রতিভাবান ইয়াং রিসার্চ স্কলার, গিরিজা চন্দ্রশেখরণ। গিরিজা আগাগোড়া মোহনলালের পাশে থেকেছে।
মোহনলালের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি কমপ্লিট করার পরে গিরিজার কাছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা ও অধ্যাপনার জন্য প্রচুর অফার আসতে থাকে।
কিন্তু গিরিজা জানত যে মোহনলাল ওর উপর কতটা নির্ভর করেন। তাই সে মোহনলালের ল্যাব ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা কখনও ভাবেনি।
মোহনলাল ওঁর এই ছাত্রীটির আনুগত্যের কথা কখনও ভোলেননি। নিজের কেরিয়ার কম্প্রোমাইজ় করেও গিরিজা আগাগোড়া ওঁর পাশে থেকেছে আর প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশনকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করে গিয়েছে। প্রতিদানে মোহনলাল নিজের সমস্ত জ্ঞান ও বিদ্যা ওঁর এই ছাত্রীটির কাছে মেলে ধরেছিলেন। ফলে, প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন সম্পর্কে মোহনলালের পরেই যে মানুষটি সব চেয়ে বেশি জানতে পেরেছিল, সে হল ডক্টর গিরিজা চন্দ্রশেখরণ।
ওদিকে মোহনলাল ফান্ডিং-এর জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সরকারি ফান্ডিং না পেলেও উনি সরকারপক্ষের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। আর এঁদেরই অন্যতম ছিলেন নেভাডা স্টেটের গভর্নর আইজ্যাক হুবারম্যান। এই শেষোক্ত ব্যক্তির মধ্যস্থতায় একটি বৃহৎ মার্কিন ইনভেস্টমেন্ট প্রতিষ্ঠান মোহনলালের প্রোজেক্টে ইনভেস্ট করতে রাজি হয়। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানের শর্ত অনুসারে মোহনলালকে এমআইটি ছাড়তে হয়। তারপর ওই প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় আর গভর্নর হুবারম্যানের সহায়তায় নেভাডা স্টেটের এক প্রত্যন্ত উপত্যকায় উনি গড়ে তোলেন নিজস্ব প্রাইভেট রিসার্চ ফেসিলিটি, যার নাম রাখা হয় আমেরিকান ইন্সটিটিউট অব রেজ়ারেকশন স্টাডিজ়, সংক্ষেপে এয়ারস (AIRS)।
মোহনলাল হন ইন্সটিটিউটের প্রথম ডিরেক্টর, আর গিরিজা হয় ওঁর ডেপুটি।
সে-ও প্রায় এক দশক আগের কথা।
ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে গবেষণার কাজ এগিয়েছে রকেটের গতিতে।
সারা বিশ্ব থেকে সেরা সেরা সব গবেষককে মোহনলাল নিয়ে আসেন এই ইন্সটিটিউটে। বায়োকেমিস্ট্রি, সেল বায়োলজি, মলিকিউলার বায়োলজি, নিউরোলজি, ফার্মাকোলজি, রোবোটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স-সহ বিভিন্ন ফিল্ডের এক্সপার্টরা একযোগে মোহনলালের নেতৃত্বে, এখানে কাজ করতে থাকেন।
একের পর এক রিসার্চ পেপার প্রকাশিত হতে থাকে বিশ্বমানের সব জার্নালে।
ফলে ক্রমশ এই প্রোজেক্ট নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলের আগ্রহও বাড়তে থাকে।
এবার আসা যাক মোহনলালের রেজ়ারেকশন থিয়োরির কথায়।
ওঁর ভাবনা ছিল অনেকটা এইরকম…
মানুষের দেহে প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে অসংখ্য জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া। এগুলিকেই সামগ্রিকভাবে বলা হয় মেটাবলিজ়্ম অর্থাৎ বিপাক। এইসব বিক্রিয়ার মধ্যে কতকগুলির ক্রমাগত সংঘটনের ফলে মানুষের দেহ ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। আর এভাবেই একসময় সে যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্বে এবং শেষে বার্ধক্য অবস্থায় প্রবেশ করে। কিন্তু মোহনলালের মতে, বার্ধক্য অবস্থায় প্রবেশ করার পরেও মানুষকে আবার যৌবন অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।
এটাই হল রেজ়ারেকশন (resurrection)!
মোহনলাল একাধিক উপায় অবলম্বনে এই রেজ়ারেকশন সম্পন্ন করার কথা ভেবেছিলেন। আর তার জন্য ক্লাসিক্যাল বায়োলজির বিভিন্ন ফিল্ডের সঙ্গে সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন রোবটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স প্রভৃতি আধুনিক বিজ্ঞানের অন্য কয়েকটি ফিল্ডেরও।
ইন্সটিটিউটে গবেষণার কাজ খুব সুন্দরভাবেই এগোচ্ছিল। মানবেতর বিভিন্ন প্রাণীর উপর সফলভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা সম্পন্ন করার পরে এবার প্রয়োজন ছিল মানুষের উপর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখার।
এই ব্যাপারে ভলান্টিয়ার হওয়ার জন্য ইন্সটিটিউটেরই কয়েকজন স্টাফ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে আসেন।
ওঁদের মধ্যে মোহনলাল নিজেও ছিলেন।
গিরিজা কিন্তু তার মেন্টর মোহনলালের এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করতে পারেনি। জীবনে প্রথমবার সে তার মেন্টরের বিরোধিতা করেছিল।
“স্যার,” গিরিজা মোহনলালকে বলেছিল, “অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে আপনি এমনিতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই এরকম একটি পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়া চালানোর পক্ষে আপনার দেহ উপযুক্ত নয়। আপনি বরং আমায় অনুমতি দিন। আপনার জায়গায় আমি…”
“তা হয় না, গিরিজা।”
মোহনলাল ওকে বাধা দিয়ে বলেছিলেন, “তুমি আমার সন্তানের মতো… আমার অবর্তমানে এই প্রকল্পের নেতৃত্ব তোমাকেই দিতে হবে। তাই তোমার জীবন নিয়ে আমি কোনোরকম ঝুঁকি নিতে পারি না। আর তা ছাড়া এই পরীক্ষার সময় আমি যদি মারাও যাই, আমার বিশ্বাস, সেক্ষেত্রেও তুমি আমাকে মরণের ওপার থেকেও রেজ়ারেক্ট করাতে পারবে। কী? পারবে না?”
গিরিজা ওই কথার তৎক্ষণাৎ কোনো উত্তর দিতে পারেনি। ওর মনে হয়েছিল যে স্যার আসলে ওর দিকে এভাবে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন।
কারণ ইতিমধ্যেই গিরিজা মোহনলালের প্রস্তাবিত রেজ়ারেকশন থিয়োরিকে আরেক ধাপ উন্নত করার জন্য চেষ্টা করছিল। মোহনলাল যেখানে মানুষকে বার্ধক্য থেকে যৌবনে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন, সেখানে গিরিজা চেষ্টা করছিল, যদি মানুষকে মৃত্যুর ওপার থেকেও ফিরিয়ে আনা যায়।
ওর মতে সেটাই হবে যথার্থ রেজ়ারেকশন।
কিন্তু গিরিজা পারেনি।
অন্য সব ভলান্টিয়ারের ক্ষেত্রে পরীক্ষা সফল হলেও মোহনলালের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।
গিরিজার আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণিত করে পরীক্ষা চলাকালীনই মোহনলাল মরণের কোলে ঢলে পড়েন।
সেখান থেকে ওঁকে আর ফিরিয়ে আনা যায়নি।
এই ঘটনার ফলে আমেরিকার বৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক মহলে সাড়া পড়ে যায়। মোহনলালের মৃত্যুর খবরটাই বড়ো করে প্রচার করা হতে থাকে। কিন্তু অন্য সাতজন হিউম্যান ভলান্টিয়ারের ক্ষেত্রে যে পরীক্ষা সফল হয়েছিল, সেই কথাটা চাপা পড়ে যায়।
ইন্সটিটিউট বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে জোরালো দাবি উঠতে থাকে।
গভর্নর হুবারম্যানের সক্রিয় সাহায্য না পেলে গিরিজার পক্ষে তখন ইন্সটিটিউটকে বাঁচানো সত্যিই কঠিন হত।
মোহনলালের অবর্তমানে গিরিজাই তখন ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর।
হুবারম্যানের প্রচেষ্টায় ইন্সটিটিউট বন্ধ হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়, কিন্তু শর্ত আরোপিত হয় যে ফেডারেল গভর্নমেন্টের অনুমতি ছাড়া ইন্সটিটিউট আর কখনও হিউম্যান সাবজেক্ট নিয়ে কাজ করতে পারবে না।
গিরিজা নিরুপায় হয়ে সেই শর্ত মেনে নেয়।
এরপর কেটে গিয়েছে অনেকটা সময়, ঘটে গিয়েছে অনেক ঘটনা।
হুবারম্যান এখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।
ওঁর মতো জনপ্রিয় আর সুদক্ষ প্রেসিডেন্ট দেশ অনেকদিন পায়নি।
কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হলেও হুবারম্যান কখনোই মোহনলাল, গিরিজা এবং ওঁদের ইন্সটিটিউটের কথা বিস্মৃত হননি।
একদিন হঠাৎ উনি গিরিজাকে হোয়াইট হাউসে নিজের অফিসে ডেকে পাঠালেন।
“ডক্টর চন্দ্রশেখরণ, আপনাদের প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন-এর এখন ঠিক কী স্ট্যাটাস?”
প্রেসিডেন্টের প্রশ্নের উত্তরে গিরিজা ওঁকে জানায় যে হিউম্যান সাবজেক্ট নিয়ে কাজ করার নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রোজেক্টের মানব-সংক্রান্ত গবেষণা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অন্যান্য জীবের উপর গবেষণা ভালোভাবেই চলছে।
“গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে আমরা আমাদের রেজ়ারেকশন প্রোটোকলে কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছি।”
গিরিজা আত্মবিশ্বাসী স্বরে বলেছিল, “আমার মনে হয়, এখন যদি আমাদের হিউম্যান সাবজেক্ট নিয়ে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে আমাদের সাফল্যের সম্ভাবনা ৯৯.৯৯%।”
“নট এনাফ।”
প্রেসিডেন্ট হুবারম্যান কিছুটা কৌতুকের সুরে বলেছিলেন, “আমি আপনাকে একজন হিউম্যান সাবজেক্ট দিতে পারি। জাতির স্বার্থেই তাঁর দীর্ঘায়ুর প্রয়োজন। যদি আপনারা এঁকে রেজ়ারেক্ট করাতে পারেন তাহলে আপনাদের উপর থেকে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে। বাট দ্য ক্যাচ ইজ়, ইউ হ্যাভ টু প্রমিস মি আ হান্ড্রেড পার্সেন্ট সাকসেস ইন দিস কেস।”
“আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট।”
গিরিজা বলে ওঠে, “আমরা একশো শতাংশেরও বেশি এফোর্ট দেব।”
প্রেসিডেন্ট এবার কিছুটা অধৈর্যভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “ইউ আর নট গেটিং মাই পয়েন্ট ডক্টর চন্দ্রশেখরণ। আমি আপনাকে এফোর্টের কথা বলছি না, বলছি সাফল্যের কথা। সাফল্য সম্পর্কে আপনি ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা দিলে তবেই ওই ব্যক্তিকে আপনার হাতে তুলে দেওয়া হবে। কারণ এই কেসে আপনারা সফল হলে যেরকম আপনাদের উপর থেকে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে, তেমনই যদি আপনারা ব্যর্থ হন তাহলে ইন্সটিটিউট চিরকালের মতো বন্ধও হয়ে যেতে পারে। সো টেল মি, আর ইউ রেডি টু টেক দিস রিস্ক?”
গিরিজা কিছুক্ষণ চিন্তা করার পরে উত্তর দিয়েছিল যে সে এই প্রস্তাবে রাজি আছে।
“ভেরি ওয়েল দেন।”
হুবারম্যান বলেছিলেন, “ভদ্রলোক আগামী সোমবারে আপনাদের ইন্সটিটিউটে পৌঁছে যাবেন।”
“বেশ।”
গিরিজা বলেছিল, “ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড স্যার, ভদ্রলোকের পরিচয়টা জানতে পারি কী?”
“শিয়োর।”
প্রেসিডেন্ট হুবারম্যান কৌতুকের সুরে বলেছিলেন, “হি ইজ় নান আদার দ্যান দ্য প্রেসিডেন্ট অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস হিমসেল্ফ!”
বিশাল প্রাচীর-ঘেরা এলাকাটা যেন নিজেই একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ রাজ্য।
নিক শুনেছে যে এটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রিসার্চ ফেসিলিটিগুলির মধ্যে অন্যতম। এর পিছনে রয়েছে বৃহৎ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা।
আর তাই নিকের মতে, প্রায় সায়েন্স ফ্যান্টাসসুলভ অবাস্তব বিষয় নিয়ে কাজ করলেও এদের ফান্ডিং-এর কোনো অভাব হয় না।
অবশ্য নিকের এই বিষয়ে মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন নেই। সে এখানে এসেছে বোস্টনের বিখ্যাত সলিসিটার ফার্ম মেকেঞ্জি ব্রাদারসের পক্ষ থেকে, একটা বিশেষ দায়িত্বপালনের জন্য।
ক্যাম্পাস-এর মেইন এন্ট্রান্স থেকে এখানকার সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং-এর দূরত্ব বেশ অনেকটাই।
এই পথটুকু পেরোতে গিয়ে নিকের গাড়িটা প্রায় ১০০ বার থামাতে হল সিকিউরিটি চেকিং-<র জন্য। ইন্সটিটিউটের নিজস্ব সিকিউরিটি চেকপোস্টের পাশাপাশি ইউএস আর্মির চেকপোস্টেও গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করা হল।
এই ব্যাপারটা অবশ্য নিকের একটু অদ্ভুত লাগল।
যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক-না কেন, এটা তো আদতে একটা প্রাইভেট রিসার্চ ফেসিলিটি।
তাহলে এখানকার নিরাপত্তার জন্য সরকারি সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হল কেন?
আসলে এয়ার্স ক্যাম্পাসে প্রেসিডেন্ট হুবারম্যানের উপস্থিতির কথা জনসাধারণের কাছ থেকে গোপন রাখা হয়েছিল।
প্রেসিডেন্টের উপস্থিতির কথা জানা থাকলে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার জন্য সেনা মোতায়েনের ব্যাপারটা নিককে একটুও বিস্মিত করত না।
সুবিস্তৃত ক্যাম্পাসের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে নিকের মনে হচ্ছিল যে ম্যানহাটন প্রোজেক্টের জন্য নিউ মেক্সিকোতে যে সরকারি রিসার্চ ফেসিলিটি তৈরি করা হয়েছিল, সেটাও হয়তো অনেকটা এরকমই ছিল।
সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং-এ পৌঁছোনোর পরে নিককে ভিআইপি ওয়েটিং এরিয়াতে প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে হল। তারপর ওকে নিয়ে আসা হল ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর ডক্টর গিরিজা চন্দ্রশেখরণের কেবিনে।
এত বড়ো একটি সংস্থার সর্বেসর্বা হলেও ডক্টর চন্দ্রশেখরণের বয়েস খুব একটা বেশি নয়, বড়োজোর চল্লিশের কোঠায়। নিকের মনে হল যে ভদ্রমহিলাকে ঠিক রূপসি বলা না গেলেও ওঁর চেহারা যথেষ্টই আকর্ষণীয় এবং ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক।
প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পরে গিরিজা নিকের উদ্দেশে বললেন, “মি. ম্যাকেঞ্জি, আমাকে বলা হয়েছে যে আপনি কোনো একটা ভীষণ জরুরি বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।”
“একদমই তা-ই।”
নিক ম্যাকেঞ্জি বলল, “আসলে আমার আপনাকে কিছু দেওয়ার আছে।”
কথাটা শুনে গিরিজা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল।
নিক একটা মুখ-বন্ধ-করা খাম আর একটা মাঝারি সাইজ়ের কালো বাক্সো গিরিজার টেবিলের উপরে রাখল।
“এসব কী?”
“প্রফেসার মোহনলাল রায় এগুলো আমাদের কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন।”
নিক বলল, “ওঁর নির্দেশ ছিল যে ওঁর মৃত্যুর ঠিক পাঁচ বছর পরে যেন এগুলো আপনার হাতে তুলে দেওয়া হয়।”
“আমার হাতে মানে? এয়ার্স-এর বর্তমান ডিরেক্টরের হাতে?”
“না, উনি নিজের নির্দেশনামায় স্পষ্টভাবে আপনার অর্থাৎ ডক্টর গিরিজা চন্দ্রশেখরণের নামই লিখে গিয়েছেন।”
গিরিজা বিস্মিতভাবে জিনিসগুলোর দিকে চেয়ে রইল।
এয়ার্স-এর গোড়াপত্তনের সময় থেকেই ম্যাকেঞ্জি ব্রাদারস সলিসিটার ফার্ম-টি এয়ার্স-এর আইনি উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছে। তাই স্যার যে ওদের কাছে এই জিনিসগুলো গচ্ছিত রেখে গেছেন, তাতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু কথা হল, জিনিসগুলো তো উনি ওঁর মৃত্যুর পরেও গিরিজার হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলে যেতে পারতেন। এই পাঁচ বছরের গ্যাপটার প্রয়োজন হল কেন?
আর তা ছাড়া জিনিসগুলোই বা কী?
হঠাৎ গিরিজার মোহনলালের বলা কয়েকটা কথা মনে পড়ে গেল। উনি একবার ওকে কথায় কথায় বলেছিলেন, “শোনো গিরিজা, এই প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন-এর গভীরতা যে ঠিক কতটা, সেটা এখনও তোমরা কেউই সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারোনি। তবে তুমি তা পারবে, সঠিক সময় এলে।”
“সেই সময় কখন আসবে, স্যার?”
গিরিজা জানতে চেয়েছিল, “আমার মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে।”
কথাটা বলে মোহনলাল উদাসীনভাবে কফির কাপে চুমুক দিয়েছিলেন।
“কিন্তু স্যার, আপনার গাইডেন্স ছাড়া আমি কীভাবে ওই গভীর উপলব্ধি লাভ করব?”
গিরিজার প্রশ্নের উত্তরে মোহনলাল স্মিত হেসে সস্নেহে বলেছিলেন, “চিন্তা নেই, আমি মরণের ওপার থেকেও তোমাকে গাইড করব।”
এরিয়া ৬৫, অ্যারিজ়োনা
(ইউএস আর্মির সিক্রেট রিসার্চ ফেসিলিটি)
ফেসিলিটির অধিকর্তা জেনারেল এরিক ফ্রিম্যানের মুখোমুখি বসেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ফ্রেডি রজার্স।
“শুনলাম, প্রেসিডেন্টের উপর প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন-এর পরীক্ষা নাকি সফল হয়েছে।” জেনারেল ফ্রিম্যান মন্তব্য করলেন।
“হুম, ঠিকই শুনেছেন।” ভাইস-প্রেসিডেন্ট রজার্স বললেন।
“দেন হোয়াট টু ডু উইথ দ্য ‘করপাস’? ওটাকে কি তাহলে এখন এয়ার্স-এ পাঠিয়ে দেওয়া হবে?”
“নো নো।”
জেনারেলের কথার উত্তরে ভাইস-প্রেসিডেন্ট রজার্স তীব্রভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “ওই ব্যাপারে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। প্রেসিডেন্টই এই বিষয়ে যা বলার তা বলবেন।”
“ভেরি ওয়েল।”
জেনারেল ফ্রিম্যান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “তাহলে আমার জন্য এখন কী নির্দেশ?”
“নাথিং স্পেশাল, আপনি যেভাবে ‘করপাস’টা আগলে রাখছিলেন, সেরকমই রাখবেন। ওটার কথা এই ফেসিলিটির বাইরে ঘুণাক্ষরেও যেন কেউ জানতে না পারে।”
“তা তো বটেই।”
জেনারেল ফ্রিম্যান বললেন, “বিশেষ করে এয়ার্স-এর ডিরেক্টর ওই মহিলা যদি এটার কথা জানতে পারেন তাহলে তো সর্বনাশ।”
“ডক্টর চন্দ্রশেখরণের কথা বলছেন?”
ভাইস-প্রেসিডেন্ট রজার্স হাসতে হাসতে বললেন, “প্রেসিডেন্টের উপর ওঁর পরীক্ষা সফল হওয়ার পরে উনি তো এখন ক্লাউড নাইনে আছেন। আমার মনে হয় না যে নিজের ইন্সটিটিউটের বাইরের অন্য কোনো বিষয় নিয়ে উনি মাথা ঘামাবেন বলে। প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসে ফিরে এলেই প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন-এর উপর থেকে হিউম্যান সাবজেক্ট নিয়ে রিসার্চ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হবে। আই থিংক, শি উইল বি কোয়ায়েট হ্যাপি উইথ দ্যাট।”
“পুয়োর ওম্যান।”
জেনারেল ফ্রিম্যান কিছুটা সহানুভূতির স্বরে বললেন, “বেচারির কোনো ধারণাই নেই যে ওঁর রিসার্চ আমরা ঠিক কীভাবে কাজে লাগাতে যাচ্ছি।”
“এটা নতুন কোনো ব্যাপার নয়, জেনারেল। ম্যানহাটন প্রোজেক্ট-এর সায়েন্টিস্টরাও আগাম অনুমান করতে পারেননি যে ওঁদের গবেষণার ফলাফল গভর্নমেন্ট ঠিক কীভাবে কাজে লাগাতে চলেছে।”
জেনারেল ফ্রিম্যান মাথা নেড়ে ভাইস-প্রেসিডেন্ট রজার্সের কথায় সমর্থন জানালেন। তারপর বললেন, “ঠিকই বলেছেন মিস্টার ভাইস-প্রেসিডেন্ট স্যার। লেট দ্য সায়েন্টিস্টস ডু দেয়ার জব অ্যান্ড লেট আস ডু আওয়ারস।”
ডিয়ার গিরিজা,
যদি তোমরা হাতে এই চিঠি পৌঁছে থাকে, তার অর্থ তুমি এখনও বেঁচে আছ। আর তার মানে প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন এখনও অ্যাকটিভ আছে। তোমার হয়তো মনে আছে যে আমি তোমাকে বলেছিলাম, আমার মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে তুমি প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন-এর গভীরতা সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারবে, আমি তোমাকে সাহায্য করব। সেই উদ্দেশেই তোমার জন্য এই চিঠিটা রেখে গেলাম।
গিরিজা, এই প্রোজেক্টের তিনটে ধাপ রয়েছে।
প্রথম, post-geriatric resurrection। জরা ও ব্যাধিগ্রস্ত মানুষকে যুবা অবস্থায় ও ব্যাধিমুক্ত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা।
দ্বিতীয়, post-mortem resurrection। মূলত তোমার উদ্যোগেই এই সংক্রান্ত গবেষণার কাজ প্রোজেক্টের অন্তর্ভুক্ত হয়।
কিন্তু এই দুটি ছাড়াও এই প্রোজেক্টের একটি তৃতীয় ধাপও রয়েছে। আর আমার মতে সেটাই হল প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন-এর গভীরতম স্তর… তার আত্মা।
এই ধাপের নাম আমি দিয়েছি resurrection of humanity!
লোভ আর হিংসা মানবজাতিকে বিবেকশূন্য করে তুলেছে, করে তুলেছে মনুষ্যত্ববিহীন। প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন-এর তৃতীয় ধাপের কাজ হল মানবজাতিকে তার এই হারানো সম্পদগুলি ফিরিয়ে দেওয়া, যার ফলে resurrection ঘটবে কোনো একজন মানুষের নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির।
এই পর্যন্ত পড়ে তুমি নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছ।
ভাবছ এটা তো দার্শনিক আর আধ্যাত্মিকতাসম্পন্ন মানুষদের কাজ। বিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে কী করতে পারেন!
তাহলে বলি, শোনো।
মানবজাতির কাছে আমাদের বিজ্ঞানীদের বিরাট ঋণ রয়েছে। হিরোশিমা আর নাগাসাকির মতো অমানবীয় ঘটনা তো আসলে বৈজ্ঞানিক গবেষণারই পরিণাম।
তাই এবার বিজ্ঞানকে এমন কিছু করতে হবে, যার ফলে ঘুমন্ত মানবতা আবার জাগ্রত হয়।
আর সেই কাজটা করব আমরা, অর্থাৎ প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন-এর সায়েন্টিস্টরা।
এবার আমার পরিকল্পনার কথা খুলে বলি।
তুমি তো জানোই যে প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন-এর প্রথম আর দ্বিতীয় ধাপে আমরা মানবদেহের সেই সমস্ত জিনকে আইডেন্টিফাই করেছিলাম, যেগুলো মানুষের জরা, ব্যাধি আর মৃত্যুর কারণ। প্রথম ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের সময়ে আমার মৃত্যু হয়েছিল। আজ তোমাকে জানাতে দ্বিধা নেই যে আমার ওই মৃত্যু ছিল আমারই পরিকল্পিত।
এর কারণ আর কিছুই নয়, শুধু প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশনকে রক্ষা করা।
হ্যাঁ, আসলে ওই পরীক্ষা যদি পুরোপুরি সফল হত তাহলে প্রোজেক্টের নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাত থেকে চলে যেত ইউএস আর্মির সায়েন্টিফিক রিসার্চ উইং-এর হাতে। আমাদের তৈরি করা প্রোটোকল ফলো করেই ওরা খুব সহজেই প্রোজেক্টের দ্বিতীয় ধাপও পেরিয়ে যেত।
অর্থাৎ ওরা মৃত্যুকে অতিক্রম করতেও সফল হত।
কিন্তু তার সুফল সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছোত না।
এর সুবিধা ভোগ করতে কেবল এ দেশের শাসকশ্রেণি আর ধনকুবেরের দল।
আর ওখানেই প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন-এর ইতি ঘটত, যেটা আমি চাইনি।
আর তাই আমি ইচ্ছে করেই মৃত্যুবরণ করেছিলাম, যাতে সকলের এটা মনে হয় যে আমাদের ‘রেজ়ারেকশন প্রোটোকল’-এ কোনো বড়োসড়ো গোলমাল রয়ে গিয়েছে।
পরীক্ষায় যদি কোনো হিউম্যান সাবজেক্টের মৃত্যু হয়, সেক্ষেত্রে কী করা হবে—এই নিয়ে আমার সঙ্গে গভর্নমেন্টের একটা স্পষ্ট আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল।
ঠিক হয়েছিল যে মৃত ব্যক্তির দেহ গভর্নমেন্টের কোনো সিক্রেট রিসার্চ ফেসিলিটিতে ক্রায়োপ্রিজ়ার্ভেশন পদ্ধতিতে সংরক্ষিত থাকবে, পাঁচ বছরের জন্য।
পাঁচ বছর পরে একজন হিউম্যান সাবজেক্টের উপর পরীক্ষা আবার রিপিট করার হবে। যদি ফের পরীক্ষা ব্যর্থ হয় তাহলে প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন চিরকালের মতো শাট ডাউন করে দেওয়া হবে।
কিন্তু যদি সাফল্য আসে তাহলে গভর্নমেন্ট এই প্রোজেক্টের নেক্সট লেভেলের কাজের জন্য এয়ার্সকে ক্লিয়ারেন্স দেবে। এই পর্যায়ে গভর্নমেন্টের হেপাজতে থাকা সংরক্ষিত মৃতদেহটিকে (অর্থাৎ আমার মৃতদেহটিকে) resurrect করাতে হবে।
কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তুমি আমাকে resurrect করাবে না। তোমাকে কী করতে হবে, শোনো…
মোহনলালের চিঠিটার শেষ অংশটুকু গিরিজা মন দিয়ে বেশ কয়েকবার পড়ল।
তারপর সামনে বসা নিক ম্যাকেঞ্জির দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, মি. ম্যাকেঞ্জি। ইউ হ্যাভ ডেলিভার্ড টু মি টুডে, দ্য মোস্ট প্রেশিয়াস গিফট অব মাই লাইফ।”
“জেনারেল ফ্রিম্যান?”
“ইয়েস?”
“দিস ইজ় ক্লারা টমাস, পার্সনাল সেক্রেটারি টু দ্য প্রেসিডেন্ট অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস।”
জেনারেল নড়েচড়ে বসলেন।
“ইট’স গ্রেট টু হিয়ার ফ্রম ইউ ম্যাম। মি. প্রেসিডেন্ট স্যার এখন কেমন আছেন?”
“সম্পূর্ণ সুস্থ এবং সতেজ।”
ক্লারা টমাস বললেন, “এবং উনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।”
“শিয়োর! ইট’স অ্যান অনার।” জেনারেল ফ্রিম্যান আপ্লুতভাবে বললেন।
কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা।
তারপরেই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে শোনা গেল প্রেসিডেন্ট হুবারম্যানের পরিচিত কণ্ঠস্বর।
“জেনারেল।”
উনি বললেন, “আশা করি, করপাস এখনও আপনার হেপাজতে সুরক্ষিত রয়েছে।”
“অ্যাবসোলিউটলি, মি. প্রেসিডেন্ট স্যার।”
“গুড, আপনি অবিলম্বে ওটা এখানে, আই মিন এয়ার্স-এ পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।”
“শিয়োর স্যার, আমি এখনই ব্যবস্থা করছি। ইট শ্যাল রিচ ইউ বাই নেক্সট টু আওয়ারস।”
“ধন্যবাদ, জেনারেল।”
ফোনটা রেখে হুবারম্যান ক্লারার দিকে চেয়ে বললেন, “আই ওয়ান্ট টু সি ডক্টর চন্দ্রশেখরণ, নাউ।”
ক্লারা সামান্য নড করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
হুবারম্যান বেডে শুয়ে বিশাল কাচের জানালা দিয়ে অন্যমনস্কভাবে বাইরের দিকে চেয়ে রইলেন।
এইবার গিরিজা চন্দ্রশেখরণকে সবটা জানাবার সময় এসেছে।
হুবারম্যানের অবস্থা এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। উনি একটু একা থাকতে চেয়েছেন। তাই এই মুহূর্তে এই রুমে কোনো মেডিক্যাল অ্যাটেন্ড্যান্ট নেই। ফলে এখন গিরিজার সামনে সব ব্যাপারটা খুলে বলা যেতেই পারে।
প্রফেসার মোহনলাল রায়ের সংরক্ষিত মৃতদেহ, যার সাংকেতিক নাম ‘করপাস’, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে পৌঁছে যাবে।
গিরিজা নিশ্চয়ই খুবই অবাক হবে। তবে নিজের মেন্টরকে পুনর্জীবিত করার এই সুযোগের সে অবশ্যই সদ্ব্যবহার করবে।
আর মোহনলাল জীবিত হয়ে উঠলেই প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশনের মৃতদেহকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রক্রিয়া যথাযথ কি না, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
যদি সত্যিই ওই প্রক্রিয়া সফল হয় তাহলে কী অসীম সম্ভাবনার দরজা যে আমেরিকার সামনে খুলে যাবে, সেটা ভাবতেও প্রেসিডেন্ট হুবারম্যানের নব যৌবনপ্রাপ্ত হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠছে।
হ্যাঁ…
অশীতিপর হুবারম্যান এখন একজন যুবক। ওঁর চামড়া টানটান। চোখের জ্যোতি অম্লান। হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস বা বৃক্কের মতো ভাইটাল অর্গ্যানগুলিও এখন সম্পূর্ণ সতেজ। ওঁর বয়েস যেন রাতারাতি প্রায় পঞ্চাশ বছর কমে গিয়েছে। ফলে আগামী বেশ কয়েকটা বছর উনি সক্রিয় রাজনীতিতে থাকতে পারবেন। এবং সম্ভবত প্রেসিডেন্ট হিসেবেই! আশি বছরের এই ‘নবযুবক’ প্রেসিডেন্ট নিশ্চিতভাবেই দেশবাসীর নয়নের মণি হয়ে উঠবে। বিশেষ করে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশনকে সফল করার পরে। এই প্রোজেক্টের সাফল্য এখন প্রেসিডেন্ট হুবারম্যানের সাফল্য হিসেবেই ওঁর পার্টির তরফ থেকে প্রচার করা হবে।
হুবারম্যান মনে মনে হাসলেন।
প্রফেসার মোহনলাল রায়ও ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কিন্তু উনি সফল হতে পারেননি।
হুবারম্যান সফল হয়েছেন। এখন এই সম্পূর্ণ প্রোজেক্ট উনি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবেন।
আর তারপর…
ডিফেন্স সেক্রেটারি ডেভিড শেরমাকের মুখটা পলকের জন্য প্রেসিডেন্টের মনশ্চক্ষুতে ভেসে উঠল।
“আপনার এই পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত নয়, মি. প্রেসিডেন্ট।” ডেভিড বলেছিল, “উত্তর কোরিয়ার ভেতরে ঢুকে এই ধরনের সামরিক অভিযান চালাতে গেলে আমাদের অসংখ্য সৈনিক প্রাণ হারাবে। ওভাবে যুদ্ধ জেতা যাবে না। ভিয়েতনামের কথা আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই!”
সেই মুহূর্তে হুবারম্যান ডিফেন্স সেক্রেটারির কথার উত্তর দিতে পারেননি।
কিন্তু এখন!
“আমাদের যত সংখ্যক সৈন্যই নিহত হোক-না কেন, আমি আর পরোয়া করি না। ওইসব মৃত সৈনিকের দেহ এয়ার্স-এ এনে তাদের আবার বাঁচিয়ে তোলা যাবে। মার্কিন জাতির সাফল্যের পথে মৃত্যু এখন আর কোনো বাধা নয়! বিশ্বের যে-কোনো প্রান্তেই এখন থেকে আমাদের সেনা আর সিক্রেট এজেন্টরা অকুতোভয় হয়ে কাজ করতে পারবে। আমেরিকার শত্রুদের আর নিস্তার নেই।”
প্রেসিডেন্ট হুবারম্যান কথাগুলো নিজের মনে আওড়ে গেলেন। ডেভিডের মুখের উপর এই কথাগুলো বলতে পারলে তাঁর চেহারাটা কীরকম হবে, সেটা কল্পনা করেই প্রেসিডেন্টের মন প্রফুল্ল হয়ে উঠল।
বিশাল একটা হলঘর।
এদিকে-ওদিকে দেখা যাচ্ছে বিশাল বিশাল সব স্ক্রিন, কম্পিউটার এবং আরও নানা ধরনের উন্নত যন্ত্রপাতি।
এটাই হল এয়ার্স-এর আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স ল্যাব।
ঘরের এককোণে একটা কম্পিউটার টার্মিনালের সামনে বসে ছিলেন দুজন মানুষ। গিরিজা এবং ফারহা।
ফারহা অর্থাৎ ডক্টর ফারহা কাদির হলেন বিশ্বের লিডিং এআই রিসার্চারদের অন্যতম এবং এয়ার্স-এর এআই ল্যাবরেটরির মাথা। দুবাইয়ের সুলতান ফারহাদ আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিভার্সিটি থেকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মোহনলাল ফারহাকে এয়ার্স-এ নিয়ে এসেছিলেন। এই প্রতিভাবান গবেষিকাটির কাছ থেকে মোহনলালের অনেক প্রত্যাশা ছিল। ফারহা ওঁকে নিরাশ করেনি। প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন-এর জন্য অত্যন্ত কার্যকরী এআই-নির্ভর যে সফটওয়্যার সিস্টেম আজ এয়ার্স-এ ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটা আসলে ফারহারই আবিষ্কার!
মোহনলাল ফারহাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার দিয়েছিলেন। তিনি ওর উপর প্রায় গিরিজার সমানই নির্ভর করতেন। ইন ফ্যাক্ট, এয়ার্স-এর প্রথম হিউম্যান ট্রায়ালে মোহনলালের সঙ্গে অন্য যে হিউম্যান ভলান্টিয়াররা অংশগ্রহণ করেছিল, ফারহা ছিল তাদের অন্যতম। তার উপর চালানো রেজ়ারেকশন প্রক্রিয়া সফল হয়েছিল। আর তাই বয়েসে গিরিজার চেয়ে অনেকটা বড়ো হলেও তাকে এখন দেখতে লাগে গিরিজার প্রায় হাঁটুর বয়েসি।
মোহনলাল তাঁর চিঠিতে গিরিজার প্রতি যে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন, সেটা ফারহার সাহায্য ছাড়া পালন করা সম্ভব নয়। আর তাই গিরিজা মোহনলালের রেখে-যাওয়া চিঠি আর কালো বাক্সোটা নিয়ে ফারহার কাছে এসেছে।
“অ্যামেজ়িং।”
চিঠিটা পড়া শেষ করে ফারহা মন্তব্য করল, “প্রফেসার রায় যে এরকম একটা কিছু নিয়ে কাজ করছেন, তার আভাস অবশ্য আগেই পেয়েছিলাম।”
“কীরকম?” গিরিজা কৌতূহলী স্বরে প্রশ্ন করল।
“ওয়েল, আমি লক্ষ করেছিলাম যে উনি আমার এবং আমাদের নিউরোসায়েন্স ল্যাবের হেড, ডক্টর জন পার্কারের রিসার্চ অ্যান্ড ফাইন্ডিংস নিয়ে খুব বেশি আগ্রহ দেখাতেন।”
“আপনারা কি আপনাদের ফাইন্ডিংস ওঁর সঙ্গে শেয়ার করতেন?”
“ন্যাচারালি।” ফারহা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “ইন্সটিটিউটের কর্ণধার হিসেবে এখানকার সমস্ত গবেষকের রিসার্চ সংক্রান্ত ডেটাই তো উনি রেগুলারলি চেক করতেন। তবে আমাদের দুজনের কাজ নিয়েই যেন ওঁর আগ্রহটা সব চেয়ে বেশি ছিল।”
এটা অবশ্য গিরিজা নিজেও লক্ষ করেছিল। কিন্তু ফারহা আর জনের গবেষণার উপর ভিত্তি করে মোহনলাল গোপনে যে এরকম একটা টেকনোলজি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন, সেটা গিরিজা কল্পনাও করতে পারেনি।
“নাউ লেট’স চেক দ্য ডিভাইস।”
ফারহার কথায় গিরিজা কালো বাক্সোটা খুলেছিল। বাক্সোটায় একটা ডিজিটাল কম্বিনেশন লক সিস্টেম লাগানো ছিল। আর ওই লক খোলার সঠিক কম্বিনেশনটা মোহনলাল নিজের চিঠিতে উল্লেখ করে গিয়েছিলেন।
ওটা ব্যবহার করে বাক্সোটা খুলতে গিরিজার কোনোই অসুবিধা হল না।
বাক্সোটা খুলতেই বেরিয়ে এল একটা চতুষ্কোণ, পাতলা, ধাতব চিপ।
মোহনলালের চিঠিতে লেখা কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এটাই হল সেই DRC বা ডিজিটাল রেজ়ারেকশন চিপ। এর মধ্যেই রয়েছে মোহনলালের মস্তিষ্কের একটা ডিজিটাল কপি। ওঁর যাবতীয় স্মৃতি, জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিদ্যা ধরা আছে এই চতুষ্কোণ বস্তুটির মধ্যে। সোজা কথায়, এই চিপটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে মোহনলালের একটি ডিজিটাল প্রতিরূপ।
এয়ার্স-এর আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত হলেই সেই প্রতিরূপটি জাগ্রত হয়ে উঠবে।
আর এভাবেই রেজ়ারেকশন ঘটবে মোহনলালের।
অর্থাৎ উনি আবার ফিরে আসবেন…
তবে নিজের ক্ষয়িষ্ণু জীবজ শরীরের মধ্যে নয়, বরং এক অক্ষয় অবিনশ্বর ডিজিটাল শরীরের মধ্যে।
এভাবেই নিজেকে এক ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ জীব থেকে উনি পরিবর্তিত করবেন একটি শক্তিশালী সফটওয়্যারে। যে সফটওয়্যার অচিরেই হয়ে উঠবে বিশ্বের সকল ডিজিটাল তথা কম্পিউটার সিস্টেমের নিয়ন্ত্রক।
নিজের এই ডিজিটাল প্রতিমূর্তির একটি নামও মোহনলাল নিজেই স্থির করে গিয়েছেন…
Resurrector!
প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন-এর ফাইনাল প্রোডাক্ট!
কিন্তু কেউ যদি মনে করে যে মানবজাতির উপর আধিপত্য করাটাই রেজ়ারেক্টরের উদ্দেশ্য, তাহলে সে ভুল করবে।
আসলে রেজ়ারেক্টরের উদ্দেশ্য হল মানবজাতির পুনরুত্থান বা রেজ়ারেকশন ঘটানো।
আর আধুনিক মানব যেহেতু পুরোপুরি কম্পিউটার সিস্টেমের উপরেই নির্ভরশীল। তাই একবার বিশ্বের সামগ্রিক কম্পিউটার সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে গেলে, মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করাটাও কঠিন হবে না। তারপর ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে তাদের ঘুমিয়ে-পড়া মানবতাবোধকে। যেদিন পৃথিবীর সব জাতির মানুষ নিজেদের মধ্যে সকল দ্বন্দ্ব ও বিদ্বেষ ভুলে পরস্পরকে ভালোবাসতে পারবে, সেদিনই রেজ়ারেক্টরের কাজ শেষ হবে।
“দ্য প্রোগ্রাম ইজ় ইনস্টলিং ইটসেল্ফ ইন আওয়ার মেইনফ্রেম।”
ফারহার কণ্ঠস্বরে গিরিজার চিন্তাস্রোত ছিন্ন হয়।
সে এগিয়ে এসে ফারহার পাশে দাঁড়িয়ে সামনের কম্পিউটার টার্মিনালটিতে চোখ রাখে।
মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত…
তারপরেই টার্মিনালের স্ক্রিনের উপর ভেসে উঠল একটি মেসেজ…
Installation Complete
“মি. প্রেসিডেন্ট, আই ডোন্ট থিংক দ্যাট’স আ গ্রেট আইডিয়া।” গিরিজা মাথা নেড়ে বলল।
বেডে শুয়ে প্রেসিডেন্ট হুবারম্যান ওকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ করলেন।
গিরিজার এই প্রতিক্রিয়া প্রেসিডেন্ট হুবারম্যানের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত!
ওঁর ধারণা ছিল যে মোহনলালের মৃতদেহ সংরক্ষিত হয়েছে এবং তা রেজ়ারেকশনের জন্য এয়ার্স-এ আনা হচ্ছে জানলে গিরিজা উল্লাসিত হবে।
কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে…..
“লিস্ন ডক্টর চন্দ্রশেখরণ।”
হুবারম্যান কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করার পরে বললেন, “প্রফেসার মোহনলাল রয়ের রেজ়ারেকশনের পরেও কিন্তু আপনিই এয়ার্স-এর ডিরেক্টর থাকবেন। হি উইল রিমেইন আন্ডার ইয়োর কেয়ার অনলি। তাই ওঁর রেজ়ারেকশনের ফলে কিন্তু আপনার কিছু হারানোর নেই।”
“ইউ আর গেটিং মি রং, মিস্টার প্রেসিডেন্ট স্যার।”
গিরিজা অসহিষ্ণুভাবে মাথা নেড়ে বলল, “প্রফেসার রয় ট্রিটেড মি অ্যাজ় ইফ আই ওয়াজ় হিজ় ডটার! তাই উনি ফিরে এলে কিংবা আবার এয়ার্স-এর দায়িত্ব নিলে আমার চেয়ে বেশি সুখী কেউ হবে না।”
“তাহলে সমস্যাটা কোথায়?”
গিরিজা কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, “আসলে প্রফেসর রয় নিজেই আর ফিরে আসতে চান না।”
“মানে?”
“ওয়েল, কথাটা খুবই অদ্ভুত শোনাবে। কিন্তু আমাকে এটা বলতেই হবে…”
“কী কথা?”
গিরিজা একটু ইতস্তত করে অবশেষে বলল, “যে প্রফেসার মোহনলাল রয়ের আত্মা এখনও এই ইন্সটিটিউটে ঘুরে বেড়ায়। এবং প্রয়োজনমতো আমাদের বিভিন্ন নির্দেশ দেয়।”
“হোয়াইট রাবিশ আর ইউ টকিং, ডক্টর চন্দ্রশেখরণ।” প্রেসিডেন্ট হুবারম্যান বিরক্তস্বরে বলে উঠলেন।
“আমি জানতাম যে আপনি বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু আমার কাছে প্রমাণ আছে।”
“প্রমাণ! কই দেখান তো আপনার প্রমাণ!”
গিরিজা এবার প্রেসিডেন্টের অনুমতি নিয়ে ঘরের সব ক-টা জানালার পর্দা টেনে দিল। তারপর আলোগুলোও নিবিয়ে দিল। ঘরটা আবছা অন্ধকারে ভরে উঠল।
“মিস্টার প্রেসিডেন্ট স্যার,” গিরিজা ফিশফিশ করে বলল, “প্রফেসার মোহনলাল রয় ইজ় হিয়ার ইন দিস রুম, আর ইউ রেডি টু মিট হিম?”
“ইয়েস, আই অ্যাম।” প্রেসিডেন্ট হুবারম্যানের স্বরে বিন্দুমাত্র অসোয়াস্তির চিহ্ন নেই।
“ভেরি ওয়েল।” গিরিজা একই রকমভাবে ফিশফিশিয়ে বলল।
তারপর নিজের কবজিতে বাঁধা রিস্ট ওয়াচের মতো যন্ত্রটাতে দুইবার ট্যাপ করল। অন্ধকারের জন্য এই ব্যাপারটা প্রেসিডেন্টের চোখে পড়ল না।
মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত, তার পরেই ঘরের এককোণে ফুটে উঠল একটা অপার্থিব লাল জ্যোতি।
আর সেই জ্যোতির মধ্যে দিয়ে আবির্ভূত হলেন… এয়ার্স-এর পরলোকগত প্রতিষ্ঠাতা-ডিরেক্টর প্রফেসার মোহনলাল রায়!
ডক্টর ফারহা কাদির একাগ্রভাবে জায়েন্ট ডিসপ্লে স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে ছিল। এই মুহূর্তে রেজ়ারেকশন ল্যাবের প্রেসিডেন্ট হুবারম্যানের কেবিনে ঠিক কী ঘটছে, তার সবই লুকোনো ক্যামেরার মাধ্যমে ফারহা নিজের ল্যাবে বসে দেখতে ও শুনতে পাচ্ছে।
মোহনলালকে দেখে প্রেসিডেন্ট হুবারম্যান যে প্রচণ্ড চমকেছেন, তাতে সন্দেহ নেই।
কিন্তু আশ্চর্য স্টেডি নার্ভ লোকটার!
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে উনি গিরিজার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, “এক্সেলেন্ট, ডক্টর চন্দ্রশেখরণ! খেলাটা আপনি ভালোই সাজিয়েছেন। কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে আপনার সামনে রয়েছেন পৃথিবীর সব চেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তাকে বোকা বানানো এতটা সহজ নয়। আমি যদি বলি যে প্রফেসার মোহনলাল রায় এখানে নেই, যা রয়েছে তা আসলে হল ওঁর একটি থ্রি-ডাইমেনশনাল হলোগ্রাফিক প্রোজেকশন, তাহলে খুব ভুল বলা হবে কি?”
“লোকটা তো সাংঘাতিক চালাক!”
ফারহা মনে মনে ভাবল, “ঠিক ধরে ফেলেছে!”
ওদিকে হুবারম্যান তখন বলে চলেছেন, “অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে আপনি নিশ্চয়ই আপনার কোনো লোককে সংকেত পাঠিয়েছেন। আর সে-ই এই ইন্সটিটিউটের অন্য কোথাও বসে কলকাঠি নেড়ে হলোগ্রাফিক প্রোজেক্টরের সাহায্যে এই ঘরের মধ্যে মোহনলাল রায়ের থ্রিডি ইমেজ তৈরি করেছে।”
“কিন্তু আমি তাহলে কথা বলছি কীভাবে, মিস্টার প্রেসিডেন্ট?” মোহনলাল রায়ের মূর্তিটি এবার গমগমে স্বরে বলে উঠল।
“এ আই কনট্রোলড অ্যানিমেশন!” প্রেসিডেন্ট হুবারম্যান নির্লিপ্তভাবে বললেন।
“রিয়েলি? বেশ, আপনার এই সন্দেহ দূর করে দিচ্ছি।” মোহনলালের মূর্তিটি বলে উঠল, “প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন-এর প্রযুক্তি ব্যবহার করে আপনি মৃত সৈনিকদের একটি ফৌজ তৈরি করতে চান। আর এই ফৌজের সাহায্যে আপনি দেশের ভেতরে এবং বাইরে আপনার সব বিরোধীকে শেষ করে দিতে চান। কী? তা-ই তো?”
ফারহা দেখল, প্রেসিডেন্টের মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছে। ও বুঝল যে প্রেসিডেন্টের এই গোপন প্রকল্পটির কথা মোহনলাল জানতেন। আর তাই রেজ়ারেক্টরও সেটা জানে।
এবার রেজ়ারেক্টরের এই থ্রিডি হলোগ্রাফিক প্রোজেকশনকে মোহনলালের প্রেতাত্মা বলে মেনে নিতে প্রেসিডেন্টের কোনো অসুবিধা হবে না।
আর প্রেতাত্মার নির্দেশ অমান্য করার সাহস প্রেসিডেন্ট হুবারম্যানের হবে না।
কুড়ি বছর পরে…
সারা বিশ্বে এখন শান্তির বাতাবরণ।
দেশে দেশে, মানুষে মানুষে হিংসার অনেকটাই কমে এসেছে।
কুড়ি বছর আগে মুভি, ওয়েব সিরিজ় বা সোশ্যাল মিডিয়া প্রভৃতি ইলেকট্রনিক মাধ্যমগুলি মানুষের মনকে যতটা প্রভাবিত করত, এখনও তা-ই করে।
কিন্তু এখন ওইসব মাধ্যমে কনটেন্টের চরিত্র অনেকটাই পালটে গিয়েছে। সেক্স আর ভায়োলেন্সের পরিবর্তে আজকাল অন্যরকম কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে, যা মানুষের জীবনবোধকে, তার অন্তর্নিহিত চেতনাকে আর মানবতাবোধকে উদ্দীপিত করে।
আর এর সব কিছুর নেপথ্যেই রয়েছে রেজ়ারেক্টরের কেরামতি।
তবে তার কথা কেউ জানে না।
কেবল দুইজন ছাড়া…
গিরিজা চন্দ্রশেখরণ আর ফারহা কাদির!
রেজ়ারেক্টরের তত্ত্বাবধানে নবযৌবনপ্রাপ্ত শরীর ও মন নিয়ে এরা এখনও কাজ করে চলেছে।
আর সরকারি বেড়াজাল ভেঙে, প্রোজেক্ট রেজ়ারেকশন-এর সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে চলেছে…
Tags: নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, স্বর্ণদীপ রায়