বিচ্ছিন্ন
লেখক: মুল রচনা: জোহা কাজেমি অনুবাদ: যশোধরা রায়চৌধুরী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
[ লেখক পরিচিতি: ১৯৮২ সালে তেহরানে জন্ম, ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী জোহা কাজেমি। ইরানে নারীবাদী স্পেকুলেটিভ ফিকশন, কল্পবিজ্ঞান, ফ্যান্টাসি ইত্যাদির রচয়িতা হিসেবে জোহা কাজেমি ইতিমধ্যেই অতি সম্মানিত ও বহুলপঠিত। ১৫টির অধিক প্রকাশিত বই আছে জোহার। Death industry, Rain born ইত্যাদি উপন্যাস ইতিমধ্যেই ইরানের স্পেকু ফিক পুরস্কার ‘নুফে’ জিতেছে। বর্তমান গল্পটা নেওয়া হয়েছে তাঁর সদ্যপ্রকাশিত ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য টাইম রাইডার’ থেকে। ইংরেজিতে গল্পটার নাম ‘স্কিনার’। এই বইটিতে ২০২৩ সালের ইউটোপিয়া অ্যাওয়ার্ড নমিনি একটি গল্প আছে তাঁর। এই গল্পটি অনুবাদের অনুমতি লেখক নিজেই দিয়েছেন। ]
ওর গলায় উঠে-আসা পিত্তি পুরো মুখটাকে টক করে দিয়েছে। কাচের দেওয়ালে নিজের হাতের ভর দিয়ে এগিয়ে দাঁড়াল কোনোমতে। কপাল ঠেকাল ঠান্ডা কাচে। ল্যাবের অন্য পাঁচ কর্মীও তাদের আলাদা আলাদা একক কুঠুরির মোটা কাচের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে। টেস্ট রুমের দিকের দুটো সমান্তরাল করিডরের দিকে বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে আছে। ওই দম্পতিটি, ছেলেটা আর মেয়েটা, ওদের দুটো পৃথক করিডর বেয়ে ক্লান্ত পদক্ষেপে হেঁটে আসছে ঘরটার দিকে। সায়ের মায়া হল। নিজেদের মৃত্যুকূপের দিকে হেঁটে যাওয়া অত সহজ নয়। আজকের পরীক্ষার বিষয় ওরা। জানে ভালো করেই, বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কত কম। কোনো সংখ্যাতত্ত্ব লাগে না এটা জানতে। ন-দিন আগে অব্দি যতগুলো দম্পতিকে টেস্ট রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সকলেই ডেমোলিশন রোবটের দাক্ষিণ্যে এই কাচের শহরের বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এই তরুণ দম্পতিরও সেটা জানার কথাই। তাই সায়ে ভাবল, ওরা মেঝের দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে চলেছে। কাচের এপার থেকে ওপারে পরস্পরের দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। আঠারো বছর বয়স হবার পর থেকেই, টেস্ট রুমে ওরা প্রবেশ করতে দেখেছে ওদের মতোই অন্য তরুণ-তরুণীদের। কাউকেই ফিরতে দেখেনি। গত ন-দিনের ন-টি দম্পতি অবশ্য বেঁচে গেছে। কিন্তু তারা নিজেদের ডরমিটারিতে ফেরেনি। ফিরেছে অন্য কোনো অজানা জায়গায়। একমুখী এই পথ। এ পথে যাওয়া যায়, ফেরা চলে না। তাই প্রতি পদক্ষেপ এত ভারাক্রান্ত, এত দুরূহ।
ওই দম্পতির মতো সায়ে কোনো ভায়েব্ল জিন নিয়ে জন্মায়নি। জন্মের পূর্বে প্রি-নেটাল ইনকিউবেটরে প্রতিটি শিশুর জিন নিয়েই নাড়াঘাঁটা করা হয়, জেনেটিক ছাঁচকে ঢেলে সাজানোর জন্য কিঞ্চিৎ হস্তক্ষেপ। কিন্তু তাতে যেটা সম্ভব হয় না, সেটা হল জানতে পারা, যে মডিফায়েড জিনগুলো জন্মের আগে ঠিকঠাক অ্যাকটিভেট হয়েছে কি না। যারা ঠিকঠাক কার্যক্ষম, ভায়েব্ল জিন নিয়ে জন্মায়, তাদের ল্যাবের ডর্মে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় জিনগত পরীক্ষানিরীক্ষা। বাকিদের পাঠানো হয় আলাদা আলাদা কাচের কুঠুরিতে, এবং তাদের জিনগত ক্ষমতা বা প্রবণতা অনুযায়ী নানা পেশায় ব্যাপৃত করা হয়। কেউ জানে না, জিনের কোন বিশেষ কনফিগারেশনের ফলে কাকে কোথায় কাজ করতে পাঠানো হয়। তাদের ট্রেনিং পর্ব, কৈশোরকাল শেষ হলে তাদের নিয়তি আরও আরও কাচের কুঠুরিতে বন্দি হয়ে যাওয়া। আলাদা আলাদা, বিচ্ছিন্ন, কিন্তু ব্যক্তিগত। সেখানেই তারা কাটাবে তাদের বাকি জীবন।
সঠিক শিশু যারা, বহু বছরের সব জিনগত পরীক্ষায় পাস করেছে, শেষ অব্দি আঠারো বছর অব্দি যদি বাঁচে তারা, তাহলে টেস্ট রুমে প্রেরণ করে দেওয়া হবে তাদের। এই দম্পতিটি যেমন। এখন সায়ে কাচের দেওয়ালে মাথা চেপে ধরে যাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওই টেস্ট রুমে হবে তাদের ‘অন্তিম পরীক্ষা’, তারা সেই নির্বাচিত ক্যান্ডিডেট! ন-দিন আগে অব্দি অবশ্য সায়ে নিজেকে ভাগ্যবতীই ভেবেছে, যে তার জিন অ্যাকটিভেটেড নয়। কিন্তু গত ক-টা দিন থেকে খুব গভীর অনুশোচনার বোধ হচ্ছে তার। যদিও অন্তিম পরীক্ষার ফলটা পুরোপুরি জানে না সায়ে। কিন্তু এতদিন সে সত্যিই ভাবত, পরীক্ষার ফল সদর্থক বেরোলেই ভালো, তাহলে অন্তত পরস্পরবিচ্ছিন্ন কাচের কুঠুরিতে থাকার দুর্ভাগ্য থেকে বেঁচে যাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। স্বাধীন হবে তারা, ও শুধু চেয়েছে এইটুকুই। পরীক্ষা সফল হোক। কাচ নগরীর সব নাগরিক তা-ই ভাবে। ইতিহাসের এই এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। ইতিহাস রচনার এই ধাপটার সাক্ষী হতে পারা কম সৌভাগ্য নয়। বিশাল সাফল্য হবে, যদি অন্তিম পরীক্ষার ফলটা নির্দিষ্ট, স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সায়ে আর তার টিম পুরস্কৃতও হবে। কিন্তু প্রায় হাতের কাছে চলে-আসা অবিশ্বাস্য, বিরাট সাফল্য সায়ের নিজের গলার কাছে কষ্টের দলার মতো আটকে গেছে যেন।
ছেলেটা আর মেয়েটা টেস্ট রুমের দরজার থেকে শুধু কয়েক পা দূরে। তাদের ঢোলা সুতির প্যান্টের তলায় পাগুলো কাঁপছে যেন। সায়ে নিজের ঘড়ির দিকে দেখল। এই পরীক্ষায় অন্যবারের তুলনায় বেশি সময় লেগে যাচ্ছে তো। অথচ সায়ের হাতে এই পরীক্ষার গিনিপিগদের পদক্ষেপ দ্রুততর করানোর কোনো উপায় নেই। অথচ কামরানের সঙ্গে ওর আজ দেখা করার কথা। কামরান রাতের শিফটে কাজ করে, সায়ে দিনের শিফটে। মধ্যে শুধু একটা ঘণ্টা ফাঁকা পাওয়া যাবে। তার মধ্যে দশ মিনিট ইতিমধ্যেই চলে গিয়েছে। মূল্যবান একটা ঘণ্টার থেকে দশটা মিনিট নষ্ট। কাচের দেওয়াল থেকে সরে এসে ওর ভিডিয়ো ডিসপ্লে খুলল সায়ে।
সরি। আজ লেট হবে আমার। কামরানকে ভয়েস মেসেজে জানাল সায়ে।
ঠিক আছে। কোথায় তুমি? কামরান সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল।
যেখানে দেখা হয়, সেখানেই। তবে ১৫ মিনিট পর। আবার কাচের দেওয়ালের দিকে ঝুঁকে পড়ল সায়ে।
টেস্ট রুমের দরজা খুলে যাচ্ছিল। দশম পরীক্ষা যদি সফল হয়, তাহলে আজ রাতেই ওরা পরীক্ষার ফলাফল জ্ঞাপিত করবে। পুরো কাচ নগরী এই সাফল্য শারীরিকভাবে বড়ো জমায়েতে এবং ভার্চুয়াল ঘরে বসে, যে যেভাবে সম্ভব উদ্যাপন করবেই। এটা ওদের কাছে খুব বড়ো ব্যাপার। শেষ অব্দি একটা ব্রেকথ্রু এটা। ইতিহাসের দিক পরিবর্তন করবেই এই সাফল্য। তাহলে হয়তো রাতের শিফট বাতিলও হতে পারে। সবাই যাতে উদ্যাপনে অংশ নিতে পারে সেজন্যে। সায়ে বুঝতে পারছিল না, কোনটা তার বেশি মূল্যবান বলে মনে হবে, কামরানের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটাতে পারা? নাকি সর্বোচ্চ সাফল্যটা হাসিল করে উঠতে পারা! এখুনি ওর আর কিচ্ছু ইচ্ছে করছিল না, শুধু চাইছিল, ছেলেটা আর মেয়েটা জ্যান্ত বেরিয়ে আসুক টেস্ট রুম ছেড়ে। চোখ বন্ধ করে ছিল ও। প্রতিবার পরীক্ষার সময়ে যেটা করে। গত পাঁচ বছর ধরে ‘অন্তিম পরীক্ষা’র দপ্তরের মাথা হিসেবে ওর এই পরীক্ষার হেরে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখতে হত, নিরুপায়ভাবেই। কখনও অভ্যেস হয়ে আসেনি ওর এই শেষ পরীক্ষার ফলাফলে শূন্য পাওয়ার হতাশাটা। অন্তিম পরীক্ষার আগের এতগুলো পূর্ববর্তী টেস্টে ওই ছেলেমেয়ে দুটো উতরে গেছে হয়তো। একে অন্যের ডিএনএ-র কাছে উন্মুক্ত হলেও ওরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, বেঁচে থাকবে, এই আশা জেগেছে বারবার। তবু ওদের মগজগুলো ঠিক অন্যের অপরিচিত ডিএনএ-কে অ্যালার্জেন হিসেবেই চিহ্নিত করেছে, এবং শরীর চলে গিয়েছে অ্যানাফাইল্যাকটিক শক-এ। এক্সপোজ়্ড হয়েছে যেই অন্যের ডিএনএ-র সামনে, ওদের খিঁচ ধরেছে, ফিট হয়েছে, মাটিতে পড়ে ছটফটিয়ে, মুখে গ্যাঁজলা উঠে মারা গেছে ওরা। ক্রমাগত থরথরানি কাঁপুনি, তারপর হৃদ্যন্ত্র আর ফুসফুস বন্ধ হয়ে গিয়েছে, জবাব দিয়েছে। সেই মুহূর্তেই সায়েকে ডাকতে হয়েছে ডেমোলিশন রোবটদের। কিন্তু গত ন-দিনে ঘটনাটা অন্যরকম ঘটেছে। সায়ে দেখেছে, কীভাবে দুজন করে পরীক্ষার বিষয় পরস্পরের হাত ধরেছে, আঙুল ছুঁয়েছে, চার চক্ষু মিলিত হয়েছে এবং তারপর স্পর্শ করতেই থেকেছে তাদের সাথির গলা, মাথা, বাহু… একটা ক্ষেত্রে দম্পতিটি আলিঙ্গনও করেছে। আজ কি সেটাই দেখতে পাবে সায়ে? সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে ঠিক কতটা সম্ভাবনা এটা ঘটার? ৫০-৫০? কম? বেশি?
ওর চোখের পাতা যেন স্থির। ওর আঙুল যেন কাচের দেওয়ালকে আঁকড়ে ধরতে চাইছিল। বড়ো করে একটা নিশ্বাস নিয়ে সায়ে কান দুটো খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করল। না তাকিয়ে। দেখার চেয়ে শোনা ভালো। দুটো কম্পমান শরীরের কাছাকাছি আসার দৃশ্যটা সহ্য করা মুশকিল হয় ওর পক্ষে। টেস্ট রুমের দরজা খুলে গেল, ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট ওদের দুজনকেই টেস্ট রুমে ঢুকতে আদেশ দিল, ও শুনতে পেল। তারপর দুজনকেই বলা হল মুখোমুখি দাঁড়াতে, পরস্পরকে স্পর্শ করতে হাত বাড়িয়ে। উফ, আর সহ্য করা যায় না। চোখ বন্ধ করে সায়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে পিঠটা কাচের দেওয়ালে ঠেকিয়ে দিল। ওদের প্রথম স্পর্শকে শ্রবণের মাধ্যমে অনুভব করতে চেষ্টা করল। মেঝের ওপর শরীরের পতনের কোনো আওয়াজ এল না। বিচ্ছিন্ন কুঠুরিগুলো থেকে সহকর্মীদের স্বস্তির দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দ পেল সায়ে। ঘুরে দাঁড়িয়ে সায়ে ধীরে ধীরে চোখ খুলল। আঙুলের ডগা দিয়ে ছেলেটিকে স্পর্শ করছিল মেয়েটি। ছেলেটি মেয়েটির দীর্ঘ চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। মেয়েটার চোখ থেকে একবিন্দু অশ্রু ঝরে পড়ল। ছেলেটি হাত দিয়ে সেই অশ্রুবিন্দুকে ধরে ফেলল, গলা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যাবার আগেই। দুজনেই হাসল। আর সায়ে, এই নিয়ে দ্বিতীয়বার, দুটি মানুষকে পরস্পরকে আলিঙ্গন করতে দেখল।
সবুজ রঙের আলোটা দপদপ করে জ্বলতে লাগল। ঘরে ঘরে অ্যালার্ম বাতি জ্বলে উঠতেই, হইহই করে কর্মীর দল চ্যাঁচামেচি শুরু করল, আনন্দ, উত্তেজনা আর বিস্ময়ে সবাই আত্মহারা হয়ে পড়েছে। তাহলে অন্তিম পরীক্ষা শেষ পর্যন্ত সম্ভবপর হল, মান্যতা পেল। শেষ দশ পরীক্ষার ভিত্তিতে অবশেষে দশটি দম্পতি মানুষের ডিএনএ-র থেকে ইমিউন বা অনাক্রম্য বিবেচিত হল। দুশো বছর পর, মানুষ আবার বিচ্ছিন্ন কাচের কুঠুরি থেকে মুক্তি পাবে। আবার মানুষ পরস্পরের নিবিড় আলিঙ্গনে আশ্রয় লাভ করতে পারবে। অবশেষে!!
সায়ে নিজের চেপে-রাখা শ্বাস ছাড়ল। আনন্দের অশ্রু মুছল। আর ডেমোলিশন রোবটের প্রয়োজন নেই। সহকর্মীরা এখন ওই দম্পতিটিকে ‘সম্পন্ন’ পরীক্ষাগারে স্থানান্তরিত করবে। তার অ্যাসিস্ট্যান্ট রিপোর্ট লিখছিল। নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সায়ে বুঝল, এখনও কিছুটা সময় আছে। নিজের সহকর্মীদের অভিনন্দন জানিয়ে, সায়ে নিজের কাচ কুঠুরির মুখের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হ্যাচ খুলতেই একটা গোলাকার রুপোলি গাড়ির মতো জিনিস দেখা গেল। সায়ে বসল। তারপর অটোড্রাইভ গাড়িটির হ্যাচডোর বন্ধ হল, এবং আইসোলেশনের সিল ফের আটকে গেল, এবার চলতে শুরু করল গাড়ি। পথ তো পূর্বনির্দিষ্ট। ল্যাব এরিয়া ছেড়ে গাড়িটা এবার আঠারোতলা নীচে যাবে। ওখানে মেইন রুট। তারপর আবার অন্য ডর্ম কুঠুরি পনেরোতলায়। গাড়িটা আরেকটু আস্তে চললে আজ অন্য সব বিচ্ছিন্ন কাচ কুঠুরির বাসিন্দাদের ভালো করে দেখতে দেখতে যাওয়া যেত। প্রত্যেকে তাদের দৈনন্দিন রুটিনে ব্যস্ত। একই কাজ তারা ক্রমাগত করে চলেছে। যদিও কুঠুরিগুলো থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না। কেউ ঘুমোচ্ছে, কেউ খাচ্ছে, কেউ ব্যায়াম করছে। অথবা একটা ছোট্ট ঢাকা-দেওয়া অংশে গিয়ে প্রস্রাব করছে হয়তো। বেশির ভাগ তাদের ভার্চুয়াল রিয়ালিটি খাটে শুয়ে হয় কাজ করছে, না হলে মজা করছে। সবটাই ভার্চুয়াল রিয়ালিটিতে।
তার যন্ত্রের নোটি দেখল সায়ে। কামরানের ভয়েস মেসেজ।
আমি যথাস্থানে। অপেক্ষা করছি। নাইট শিফট বোধহয় আজ বাতিল হবে। আরামসে এসো!
ওর কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার আভাস। সায়ে উত্তর দিল না। গাড়িটা তার কুঠুরিতে এসে পৌঁছে তার হ্যাচডোরের সঙ্গে নম্বর মেলাচ্ছিল। সায়ে অপেক্ষা করল। গাড়ির অপারেটিং সিস্টেম লিকেজ আছে কি না চেক করে শেষ অব্দি ‘নিরাপদ’ বলে বার্তা দিতেই, তার কুঠুরিতে ঢোকার অনুমতি মিলল। পেছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। সে দ্রুত ভিআর (ভার্চুয়াল রিয়ালিটি) বিছানার দিকে ধাবিত হল। মাথায় ভিআর হেডসেট পরেনি তখনও, শুনতে পেল, তার ঘরের বাক্সে খাদ্য বিতরণকারী রোবট এসে খাবারের প্লেট রাখছে। লিকেজ আছে কি না চেক করে আবার রোবটটি ‘নিরাপদ’ বলে ঘোষণা করে কুঠুরির বাসিন্দাকে খাবার খেয়ে নিতে বার্তা দিল। সায়ে উত্তেজনায় আজ খেতেই পারল না। খাবারটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সে ভিআর হেডসেট পরে নিল। একটা কালো মিডি ফ্রক পরল সে তার অবতারের জন্য। ব্যাগে ভরল কিছু ভার্চুয়াল জিনিসপত্র। তারপর প্রাচীন তেহরান কাফেতে যাবার আদেশ দিল। কামরানের সঙ্গে এটাই তার প্রথম ডেট-এর ঠিকানা, এবং তাদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা।
কামরান বসেছিল কাঠের টেবিলে সিঁড়ির নীচে। শান্ত, অনুজ্জ্বল একটা কোনা। গাঢ় নীল শার্ট পরে ছিল সে। প্যান্ট এখান থেকে দেখতে পেল না সায়ে। মুখে একটা হাসি-হাসি ভাব আটকে রেখে সে তার ভিআর ট্যাবলেটে কী যেন দেখছিল। পালিশ-করা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল সে সায়েকে আসতে দেখে। মাথাটা যাতে ওপরের সিঁড়ির বাঁকটায় ধাক্কা না খায়, সেদিকেও নজর রেখেছিল কামরান। সায়ে আর সহ্য করতে পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ে কামরানের বাহুবন্ধনে ধরা দিল।
আরে আরে, কী হল। সব ঠিক হবে, সোনা। এই তো, ভালো খবর এসেই গেছে।
সায়ের মাথা কামরান নিজের বুকের ওপর চেপে ধরে কপালে চুমো দিল।
কামরান তারপর বলল, তোমার সেন্সর সেটিং পালটাতে চাও নাকি? ওর অবতারকে সামনের চেয়ারটাতে বসতে সাহায্য করে কামরান বলল।
কেন? সায়ের ভুরু কুঁচকে গেল। যাতে তোমার সঙ্গে থাকার সময়ে আমার দুঃখ-টুঃখ না হয়? তুমি আমাকে অন্য কেউ হয়ে যেতে বলছ? মানে আমার দীর্ঘ বিচ্ছিন্নবাসের যে কষ্ট, সেগুলো ভুলে গিয়ে তোমার সঙ্গে শুধুই যাতে খুশি-খুশি থাকি? তাই?
কামরান ক্ষমা চাইল, ‘না না, আমি তা বলতে চাইনি… আমি ভাবলাম তোমার এখন খুব আনন্দ হবার কথা। সব জায়গায়, খবরে তোমার নাম। তোমার টিমের বিশাল সাফল্যের খবর। এমনকি আজকের দিনটাকে তোমার টিমের নামে নামকরণ করা হবে। আজকের দিনটা সায়ে দিবস হবে? ভাবো একবার? ক্যালেন্ডারে একটা দিন শুধু তোমার নামে!’ তারপর খানিক থেমে যতি নিয়ে, কাঁপা গলায় বলল, ‘রাতের শিফট বাতিল হয়েছে। সারারাত আমরা একসঙ্গে কাটাতে পারব। তোমার আনন্দ হচ্ছেনা?’
‘হ্যাঁ, আনন্দ হচ্ছে।’ মাথা নামিয়ে বলল সায়ে। থামল। ‘আসলে এই দিনটা তাদের নামেই হওয়া উচিত, যারা এই পরীক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। যে ছেলেমেয়েরা এতদিন ধরে আত্মবলিদান দিল। আর সেইসব বৈজ্ঞানিক, যারা সংক্রমণের জন্য প্রাণ হারিয়েছে। ল্যাব কর্মীরা… যেমন সীমা।’ কেঁদে ফেলল সায়ে, ‘আমরা ইতিমধ্যেই ওদের সবাইকে ভুলেই গেলাম। এই তো এক সপ্তাহ আগে মাত্র, ও মারা গেছে।’ ওর গলা কাঁপছিল।
কামরান ওর হাতটা হাতের মধ্যে নিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল।
‘তা তো তোমার দোষে নয়। কোনোদিন তুমি দায়ী ছিলে না। তা ছাড়া ওরা সবাই বীর সৈনিক। ওদের আত্মাহুতির ফলেই যে এত ঐতিহাসিক একটা জয় এসেছে, সায়ে!’ কামরান ওকে আবার আশ্বাস দিতে চেষ্টা করল, ‘কী ভীষণ কষ্টের ব্যাপার হত, যদি ওদের মৃত্যু ব্যর্থ হয়ে যেত? তা তো হয়নি? এভাবে দ্যাখো ব্যাপারটাকে! তোমরা ওদের আত্মাহুতি থেকে শিক্ষা নিয়ে নিয়ে একটা বড়ো আর ভালো জিনিস হাসিল করলে। ওদের মৃত্যুকে অর্থপূর্ণ করলে! তা-ই না?’
সায়ের আগের চেয়ে হয়তো একটু ভালো লাগছে। কিন্তু তবু পেটের মধ্যে যেন এখনও গিঁট-পাকানো একটা অনুভূতি। খাবার খায়নি ভার্চুয়াল রিয়ালিটিতে আসার আগে। খাওয়া উচিত ছিল। ভিআর সেটিং তো আর ক্ষুধা-তৃষ্ণাকে বিলোপ করে দেবে না! কত লোক দিনের পর দিন ভিআর-এ থাকতে থাকতে অনাহারে মারা গেছে… ভুলে গেছে বাস্তব জীবনের প্রয়োজনটুকু। খাবার আর জল—এই দুই প্রাণদায়ী জিনিসকে উপেক্ষা করার ফল মারাত্মক হতে পারে। তাই ওদের একটা নতুন আইন বানাতে হল। ভিআর-এ পানভোজন সুখ দেবে ঠিকই, কিন্তু ক্ষুধা-তৃষ্ণার বোধ উবে যাবে না। রীতিমতো টনটনে হয়ে উপস্থিতি জানান দেবে।
এআই ওয়েটারকে ডাকল কামরান। জিজ্ঞাসা করল সায়েকে, কী খাবে, বলো?
ওয়েটার এল, সুদর্শন তরুণ, পেছনে দীর্ঘ চুল বাঁধা, কালো ঢলঢলে টি-শার্টের ওপরে নীল অ্যাপ্রন বাঁধা।
সায়ে ওয়েটারকে বলল, কফি প্লিজ়। মনুষ্য অবতার এআই ওয়েটার এই কাফের বৈশিষ্ট্য। অপশনটা সর্বত্র থাকে না। এইটা সায়ের পছন্দ। অন্যত্র ভিআর কাফেতে সব ডিজিটাল মেনু। কামরানও অর্ডার দিল। ওয়েটার তার ট্যাবলেটে লিখে নিল অর্ডারটা। ওয়েটারের বাহুতে অজস্র উলকি আঁকা। সব ক-টার আকার-আকৃতি বুঝতে না পারলেও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল সায়ে। তারপর কাউন্টারের পেছনে উধাও হয়ে গেল ওয়েটার।
কামরান সায়ের দিকে ফিরে বলল, এখন কেমন লাগছে?
সায়ে তখনও ওয়েটারের চলে যাবার পর ওই ফাঁকা জায়গাটার দিকে চেয়ে ছিল। এবার ও কামরানের দিকে ফিরে বলল, তোমার কী মনে হয়, এবার কী হতে চলেছে?
আরও কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করবে নিশ্চয়। আর তারপর, মানুষ আবার মানুষের পাশে দাঁড়াবে!! কামরানের চোখ চকচক করছিল। আবার আগেকার মতো প্রাকৃতিক উপায়ে সন্তানধারণ সম্ভব হবে… সব হবে তোমার কঠোর পরিশ্রমেরই ফলে। তোমারই আসলে আজ সব চেয়ে গর্বের দিন!!!
সায়ে আর কথাটা চালাতে চাইছিল না। ওর গর্ববোধ হচ্ছিল না। ওর মনে হচ্ছিল না, এই সাফল্যের পেছনে ওর কোনো সত্যিকার তাৎপর্যপূর্ণ অবদান আছে… অন্য কারও তুলনায় বেশি কিছু ও করেছে। ওর অনুভূতিদেশে এখন কেবল বেদনা। এক বিপুল গভীর অতৃপ্তি। এই দীর্ঘ, কঠোর কাজের পথ হয়তো সত্যিই শেষদিকে এসে পৌঁছেছে, কিন্তু অনেক বেশি দেরিতে। অনেকের জীবন গেছে। আর ওর নিজের পক্ষেও ঢের ঢের দেরি হয়ে গিয়েছে।
যদিও আমরা তো আর সেটা দেখার জন্য বেঁচে থাকব না! আজকের এই সময়ে, এই পরিস্থিতিতে পৌঁছোতেই তো আমাদের ১৮০ বছর কেটে গিয়েছে।
ওয়েটার ফিরে এল এক কাপ কফি আর একটা লাল ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে। টেবিলের ওপর রাখল পানীয়গুলো। সায়ে আবার ছেলেটার উলকির ডিজ়াইনের গোলকধাঁধার ভেতরে হারিয়ে যাবে না, সচেতন হয়ে গেল। কামরান শার্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করল, তারপর আদ্ধেক খালি প্যাকেটটার দিকে উঁকি দিয়ে দেখল। একটা সিগারেট ধরিয়ে কামরান চেয়ে রইল প্রায়ান্ধকার কাফের আবছা আলোয় উড়ে-যেতে-থাকা ধোঁয়াটার দিকে। ভিআর-এর জগতে সিগারেটের মতো দুর্মূল্য আইটেম আর নেই প্রায়। সায়ের নিজের তো এসব কেনার ক্ষমতাই নেই। কামরান তাকে একটা দিল। খুব কৃতজ্ঞ হয়ে সেটা নিল সায়ে। স্মোকিং একটা সুখ। তার ভেতরে নিজেকে ডুবিয়ে দিল সে। ধূমপান করার সময়ে খানিকক্ষণ নীরবও থাকা চলে। এতেও সুখ আছে। শান্ত বোধ করল সায়ে।
কামরানের মাইনে সায়ের থেকে অনেক বেশি। অথচ ও ল্যাবের মেনটেনেন্স ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। বেশির ভাগ দিন নিজের কাচ কুঠুরির ভেতর বসে বসেই ওর কাজ। ল্যাবগুলোর এয়ারকন্ডিশন চেক করা, তার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা। এটাই কাজ। কখনো-কখনো অবশ্য সশরীরে নেমে এসে পাইপ বা ভাল্ভের ত্রুটি চেক করতে হয় ওকে। ল্যাবে এমনই এক দিনে একটা লিক-করা পাইপ সারানোর জন্য ওকে আসতে দেখেছিল সায়ে। সে এক গুরুতর আর জটিল সমস্যার সময়। গোটা ল্যাবে একটা সংক্রমণ ছড়িয়ে যাচ্ছিল কেন যেন। রোবটদের পক্ষে সামলানো সম্ভব হচ্ছিল না। সেবার দিন আর রাতের শিফটের সব মেন্টেনেন্সের টিমকে ডাকা হয়েছিল। লিকেজ বন্ধ হলে, বাতাস আবার বিশুদ্ধ হয়ে উঠলে, মেন্টেনেন্সের প্রধানকে তা নিজের চোখে দেখতে হবে, শংসাপত্র দিতে হবে। কামরানও তাই এসেছিল। সবাইকে আইসোলেশন সুট পরতে হয়েছিল। যেমন এমার্জেন্সিতে পরতেই হয়। সায়ে আর কামরান পরেছিল। কামরানের উচ্চতা, তার চওড়া কাঁধ, আইসোলেশনের তিন লেয়ার ন্যানো পলিমারের তলা দিয়েও বুঝতে পেরেছিল সায়ে। প্রথম দর্শনেই প্রেম। সে রাতেই ভিআর-এ তেহরান কাফেতে দেখা করেছিল ওরা। ভুল ছিল সেটা। সবাই জানে, বিপরীত শিফটের মানুষের সঙ্গে ডেটিং-এ যাওয়া কোনোদিন সুবিধের হয় না। শেষ ক-মাস তো খুবই কষ্টকর হয়ে গিয়েছে। মাত্র আধ ঘণ্টার জন্য ওদের দেখা হয়েছে। তার ভেতরে শরীরী মিলনের ভিআর-এর পরিস্থিতি তৈরি করাই অসম্ভব প্রায়। তাই শুধু কথা বলেই কাটিয়েছে ওরা সময়টা। সায়ে নিজের কাজের শিফটের পর অল্প সময় ওর সঙ্গে কথা বলত, তারপর দীর্ঘ একটা সন্ধ্যা ওর কাটত নিজের নিঃসঙ্গতায় ডুবে গিয়ে। কামরানও সকালের দিকটা একা থাকত। নিজের সান্ধ্য শিফটের আগে সায়ের সঙ্গে কয়েক মিনিটের দেখা হবার অপেক্ষায় অধীর হয়ে।
কোনো একসময় এমনও হয়েছিল, সায়ে চেয়েছিল ওদের সম্পর্কটা চুকিয়েবুকিয়ে দিতে। তাহলে ওরা চাইলেই নিজের সময়ের সঙ্গে মেলে এমন কারও সঙ্গে শিফটের পরের ফাঁকা সময়ে অনেকটা সময় কাটাতে পারবে। কিন্তু কিছুতেই শেষ পর্যন্ত কামরানকে ছেড়ে দিতে পারল না সায়ে। কামরান কিন্তু উলটোদিকে ভালো করেই জেনে গিয়েছিল, একে অপরকে ছেড়ে ওরা কোনোদিন থাকতে পারবে না। কাজেই নিজের কথা বুকে চেপে ও সায়েকে বলে দিয়েছিল, যদি এ সম্পর্ক ভেঙে দিতে চায় সায়ে, ও তা মেনে নেবে। অবশ্যই কামরান ছাড়া আর কাউকে চায়নি কখনও সায়ে। কিন্তু ওর উপস্থিতি, ওর সঙ্গ, সেটাও তো চাই ওর। অসম্ভবকেই চেয়েছিল ও, চেয়েছিল, শারীরিকভাবে সামনে থাকুক কামরান, পাশে পাশে থাকুক। কিন্তু এসব কিছুই পারেনি, উলটে যা পেরেছিল, তা হল কেবল খেটে চলা আর খেটে চলা। আর ভিআর-এর অ্যাক্সেসের ক্রেডিট পয়েন্ট রোজগার করা। অন্যথায়, ভিআর-এ যেটুকু সময় ওদের দেখা হচ্ছে, এটুকুও জুটবে না তো। কামরান বলল, প্রাইভেট রুমে যাবে?
না, সায়ে জোর দিয়ে বলল, আমি পারব না, আমি চাইও না। কতবার বলতে হবে তোমাকে?
কিন্তু কেন? আমি হয়তো শিফট অফ পাবই না এর মধ্যে বহুদিন।
আমি তো বলেছি আগেই তোমাকে। তোমার যদি কিছু হয়, আমি সহ্য করতে পারব না। দূরে দূরে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এতে আমাদের ক্ষতি হবে, আমাদের কাজের ক্ষতি হবে।
একরাতের জন্য তুমি এমন ভেবে নাও-না কেন, যে এটা যেন আদৌ সত্যিই নয়। এটা একটা ভার্চুয়াল ব্যাপার, যেমন বাকি জীবনটা চলছে, সেইরকম!
সত্যি তো নয়, কিন্তু আমাদের অনুভূতিগুলো তো সত্যি! কফিতে চুমুক দিল সায়ে। আমাদের একবার যদি কাছাকাছি আসার সুযোগ ঘটে, তারপর আলাদা আলাদা থাকা আরও কষ্টকর হয়ে যাবে। আর সহ্যই হবে না তখন। থেমে ও আবার বলল, তোমার সঙ্গে দেখা হবার আগে তো অনেকের সঙ্গে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড হয়েছিল। তাতে কিছু আসত-যেত না। কিন্তু তোমার সঙ্গে তো ব্যাপারটা আলাদা। আমি তোমার সঙ্গে যত সময় কাটাচ্ছি, তত জড়িয়ে পড়ছি। শরীরী ঘনিষ্ঠতা হলে, তারপর তোমাকে ছেড়ে থাকাটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ভীষণ কষ্ট পাব। দুজনকেই খুব কষ্ট দেবে বিষয়টা।
কামরান নিজের ঠোঁটের কোণ কামড়ে বলল, আমার তো এখনই খুব কষ্ট হচ্ছে।
তাহলে আমি চলে যাই। অন্তত এটা জানব, জীবনে একবারের জন্যে প্রেম এসেছিল। একটা সত্যি জিনিস ঘটেছিল আমার এই দুর্ভাগা জীবনে। একটা সত্যিকারের অনুভূতি, যাতে নিজেকে মানুষ বলে মনে হয়। সায়ে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলল।
যেয়ো না। কামরান ওকে হাত ধরে বসাল। আর্তের মতো করুণ প্রার্থনা করল, তোমার কাছাকাছি থাকাও আমার জন্যে যথেষ্ট। এতেই হবে।
সায়ে আবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলো, হাঁটতে যাই বরং।
কোথায়? কামরান উঠে দাঁড়াল।
ভিআর-এর বাইরে কোথাও!
কিন্তু তোমার না পাবলিক হল ভালো লাগে না? কামরান অবাক হয়ে বলল।
না, ওখানে না। সায়ে স্পষ্ট করল। আমার এখনও অসহ্য লাগে।
তাহলে কোথায়? কামরান হতবুদ্ধির মতো বলল।
ল্যাবে চলো। কেউ নেই ওখানে।
হ্যাঁ, কিন্তু ওখানে তো আইসোলেশন সুট পরে যেতে হবে। যদি দুজনে একসঙ্গে যেতে চাই!
তাও, ওটা অনেক বেশি সত্যি… বাস্তব… অনেক কাছাকাছি আসব আমরা। তা-ই না? সায়ে জোর দিয়ে বলল।
বেশ। কামরান বলল, এক ঘণ্টা পরে আসছি।
না, এক্ষুনি চলো। সজোরে ঘোষণা করে সায়ে কাফের দরজার দিকে হাঁটা দিল। ভিআর থেকে এগজ়িট করে গেল দ্রুত।
ভিআর হেডসেট বিছানার ওপর রেখে সায়ে ওর কাচ কুঠুরির কোনায় গিয়ে আইসোলেশন সুট হাতে নিল। খাবারের প্লেটটা ছোঁয়া হয়নি, পড়েই আছে বাক্সের মধ্যে। সুটটা পরে নিল সায়ে, নিজের সাদা সুতির ওভারঅলের ওপর দিয়ে। সুটের কোথাও কোনো লিকেজ আছে কি না একবার দেখে নিল। তারপর হ্যাচডোরে ঢুকে, গাড়িতে চড়ল। ল্যাবের পথে ডিসপ্লে খুলে মেসেজ চেক করল। সবাই সায়েকে অজস্র অভিনন্দন জানাচ্ছে। একটা সংবাদ সম্মেলনের আমন্ত্রণ এসেছে, তারপর শহরের মুখ্য হলঘরে সংবর্ধনাসভার আয়োজন। পাঁচরকম আয়োজন, পাঁচজনের, সবটাই ভিআর দিয়ে। কোনো মেসেজের উত্তর দিল না সায়ে। ল্যাবের সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো চেক করল ও। কেউ নেই। অন্তিম পরীক্ষার রুমের ঠিক সামনে ও গাড়িটা থামাল। কামরানের গাড়ির মগজেও একই আদেশ পাঠাল। দুজনেই ওখানে কাজ করে, তাই দুজনেরই টেস্ট করিডর অব্দি অ্যাক্সেস আছে। সায়ের তা নিয়ে ভয় ছিল না।
গাড়ি থেকে নেমে ও সমান্তরাল দুটি করিডরের একটিতে ঢুকল। রোজ যেখানে অন্তিম পরীক্ষার জন্য তরুণ-তরুণীদের হাজির করা হয় জোড়ায় জোড়ায়—সম্ভাব্য মৃত্যুর জন্য। অটোমেটিক আইসোলেশন সিস্টেম চালু হয়ে গিয়েছে করিডরে। নিজের আইসোলেশন সুট খুলে ফেলে, ও করিডরের দরজার কাছে দাঁড়াল নিজের পাতলা সুতির ওভারঅলটি পরা অবস্থাতেই। কামরানের গাড়ি পৌঁছোল। কামরানকেও ও বলল, সমান্তরাল করিডরে ঢুকে, আইসোলেশন সুট খুলে ফেলতে। কামরান হেলমেটের বোতাম টিপল, ধীরে ধীরে খুলে ফেলল আচ্ছাদন। তারপর সুটের জিপ টেনে খুলে পোশাক থেকে নিজের হাত দুটো বের করে নিল সযত্নে। সুটটা এবার নীচু হয়ে পা থেকে টেনে খুলে ফেলার পালা… খুব ধীরেসুস্থে করল কামরান এ কাজটা। সায়ে কেবল ওর দিকে সতৃষ্ণ চোখে চেয়ে দেখছিল। পা দুটোকে সুট থেকে টেনে তুলে উঠে দাঁড়ানো অব্দি দেখল সায়ে। কামরান ওর বাদামি চুলের ভেতর দিয়ে আঙুলগুলো একবার চালিয়ে নিয়ে, কাচের করিডরের দেওয়ালের দিকে এগিয়ে এল। সায়ের দিকে।
ওর মুখে না-কাটা দাড়ির হালকা আভাস। ওর চোখের তলায় কোঁচকানো চামড়ায়, কপালের বলিরেখার হালকা একটা পরতের জন্য ওকে বয়স্ক দেখাচ্ছিল বেশ। ভিআর অবতারে এইসব ত্রুটি ফিলটার হয়ে আসে। তবু, ওর ওই বানানো অবতারের তুলনায় সায়ের এই বাস্তবের কামরানকে অনেক বেশি হ্যান্ডসাম বলে মনে হল। সায়ে নিজে তার অবতারকে বারবার আপডেট করে, যাতে মুখের নতুন নতুন রেখা আর চুলে পাক ধরার সবটুকু অবতারেও অধিষ্ঠান করতে পারে। সায়ের মনে হয়, তার মুখের প্রতিটি নতুন বলিরেখা আসলে বয়স হবার প্রমাণ নয়, আসলে চোখের সামনে এত এত লোকের মৃত্যু দেখার বেদনা আর চাপের ফসল। ওর মনে হয়, ও যে মানবিক গুণসম্পন্ন, তার প্রমাণ রয়েছে ওর এইসব রেখায়, এইসব পাকা চুলে।
কামরান ওর উলটোদিকে কাচের ওপাশে দাঁড়িয়ে। একেবারে সামনে।
আমাদের যদি ধরে ফ্যালে, বেশ ভালোই শাস্তি হবে। কামরান চিন্তিত স্বরে বলল। সায়ে দেখল কামরান ওর প্রায় দ্বিগুণ লম্বা।
শাস্তি হলেও, পেটে খেলে পিঠে সয়ে যাবে, বলো?
কথাটায় একেবারে সহমত হল কামরান, মাথা নেড়ে বলল, তুমি এত সুন্দর!!! অদ্ভুত সুন্দর।
সায়ে নিজের হাতটা কাচের দেওয়ালের ওপর রাখল। কামরানের বুক স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছিল তার। হাতটা সে এবার ওপরের দিকে সরিয়ে আনল। কামরানের গালের কাছাকাছি নিয়ে গেল। কামরানও নিজের হাত দুটো তুলে সায়ের হাতের বরাবর নিয়ে এল কাচের ওপারে। সায়ের প্রতি ভঙ্গিকে সে যেন অনুকরণ করছিল।
ওরা এই করিডর দিয়ে গিয়ে টেস্ট রুমে ঢোকে। প্রথমে ওরা আঙুলে আঙুল ছোঁয়ায়। সায়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল। হাত ছোঁয়ার যে দৃশ্য দেখেছিল সকালে, সেইটা মনে পড়ল। ও নকল করার চেষ্টা করল। কিন্তু মধ্যে অন্তরাল তো কাচের দেওয়ালটাই।
দুজনেই মাথা নামিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
আমাদের কোনোদিন এই সৌভাগ্য হবে না। স্পর্শ। যদি সব অন্য পরীক্ষাতেও সফল হই। তাও হবে না। আমাদের সাধ্যে নেই। অ্যাকটিভেটেড জিন নেই আমাদের।
হয়তো ওরা আমাদের জিন সারিয়ে তোলার কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার করবে। যদি জানা যায়, এই মনুষ্য ডিএনএ-র প্রতি অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশনের কারণটা ঠিক কী! কামরান ওকে থামাল। আশায় বাঁচে চাষা।
‘এই মিথ্যেটাই ওরা আমাদের বলে আসছে বরাবর।’ সায়ে মাথা ঝাঁকাল, ‘আমাদের বিশ্বাস করাতে চাইছে যে একদিন আমরা আমাদের কাচের কুঠুরি থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। স্বাধীন হব। মুখের স্বর্গে বাস করছি আমরা। আমি জানি। আমার কাজের সূত্রে জানি আমি। অসম্ভব আসলে।’
কামরান চুপ করে গেল। ওর বাদামি চোখ এখন ঢেকে গেছে কান্নায়। তিক্ত এক অশ্রু।
শেষ অব্দি সায়ে সেই কথাটা বলতে পারল। ভিআর কাফেতে কামরানের সঙ্গে ভিআর ডেটে বসে যে কথাটা বলতে চাইছিল।
‘এজন্যেই আমার মন-খারাপ। এতদিন আমরা সবাই এক ছিলাম। আমাদের সবার একটাই অসুখ ছিল। একটাই অসুবিধা। যেজন্যে আমরা বিচ্ছিন্ন থাকাটাকে মেনে নিয়েছিলাম একরকমভাবে। মানুষ হওয়া মানে ওটাই। যে প্রজাতি নিজেই নিজের প্রজাতির শরীরের প্রতি অ্যালার্জেটিক। আমরা ভাবতাম, একে অপরকে স্পর্শ করলেই আমাদের মৃত্যু ঘটবে।’
কাচের দেওয়ালের গায়ে নিজের হাত দুটো কথা বলতে বলতেই সরিয়ে সরিয়ে নিতে লাগল সায়ে। আর ক্রমশ পাশে সরে যেতে যেতে অন্তিম পরীক্ষার ল্যাব রুমের দিকে যেতে লাগল এক-পা এক-পা করে। কামরানও ওকে অন্ধভাবে অনুসরণ করল। যেন আয়নার প্রতিচ্ছবি।
‘কিন্তু এখন তো আমরা জেনেছি যে এটাও সম্ভব। ভিআর-এর বাইরে, বাস্তব জগতে। পরস্পরকে স্পর্শ করা, গন্ধ নেওয়া, চুম্বন করা।…’
আরও এক-পা এগিয়ে গেল ও ঘরটার দিকে। কামরান ওর অনুসারী হল।
‘কেন আমাদের সারাজীবন এর থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে?’ সায়ে বলল।
কামরান কাচের ওপার থেকে আসা সায়ের কণ্ঠের দ্বারা সম্মোহিত যেন। শুধু শুনছে। কিছু বলছে না। ওর দিকে শুধু তাকিয়ে রয়েছে। আর ও যে যে কাজ করছে, তা অনুকরণ করে চলেছে।
এখন ওরা টেস্ট রুমের দরজার সামনে।
এবার আমরা ফিরে যাই তবে? কামরান প্রশ্ন করল।
তাই ওর কথাটা যেন শুনতেই পেল না। ওর প্রশ্নের ভেতরের সন্ত্রাস উপেক্ষা করল।
একবারের জন্য অনুভব করতে চাও না? জানতে চাও না কেমন?
টেস্ট রুমের দরজা ও খুলে দিল।
কামরান ভয় পেয়ে গেল, ‘কী অনুভব করতে বলছ তুমি!’
সায়ে শীতলভাবে বলল, ‘আমাদের?’
‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?’ কামরান চিৎকার করল, ‘আমরা মারা যাব।’
তখনও শীতল, শান্ত কণ্ঠে বলল সায়ে, ‘পেটে খেলে পিঠে সয়।’
‘না, না সায়ে। আমরা মারা যাব। বেঁচে থাকতে চাই আমি। তার মানে যদি কষ্ট পাওয়া হয়। তোমার থেকে দূরে থাকাও হয়।’
ওর কথা যেন শুনতে পেল না সায়ে। টেস্ট রুমে ঢুকল ওর করিডর থেকে। অপেক্ষা করল কামরানের দিকের দরজার সামনে।
কামরান যেন কাঁপছে, যেন এখনই পড়ে যাবে।
‘আমি চাই না! আমি পারব না…’ কামরান জোর করে সায়ের থেকে পিছু ফিরল। করিডরের দিকে দ্রুত পদক্ষেপে সে ফিরতে লাগল। নিজের অপেক্ষারত গাড়িটার দিকে চলল।
ততক্ষণে তার হাঁটা ক্রমশ দৌড়ে পরিণত হয়েছে। সায়ে টেস্ট রুম আর কামরানের করিডরের মধ্যের দরজাটা খুলে দিল। অ্যলার্ম জোরে বাজছে। ডিএনএ সংক্রমণের বিপদঘণ্টী। ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।
কামরান দাঁড়াল। ঘুরে দাঁড়াল। সায়ে আসছে তার কাছে।
কামরানের গলা কাঁপছে, ‘তুমি আমাকে মারলে। আমাদের দুজনকেই মারলে।’
‘এখনও মরিনি! এখনও সময় আছে! কয়েক সেকেন্ড। হয়তো-বা কয়েক মিনিট।’
কামরানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সায়ে বলল। তারপর নিজের বাহু দুটি বাড়িয়ে, কামরানের ঘর্মাক্ত মুখটাকে স্পর্শ করল। ভিআর অবতার কখনও ঘামের বিন্দু দেখায় না। কাউকে এভাবে ঘামতে দেখাও যায় না আইসোলেশন সুট পরা থাকলে। সায়ে আস্তে আস্তে ওর মুখের বলিরেখাগুলোর উপর দিয়ে নিজের আঙুল বোলাতে লাগল। কপালের সমান্তরাল সরলরেখাগুলোর ওপর দিয়েও। কামরানের চোখের তলার কোঁচকানো চামড়াটাতে আঙুলের ডগা দিয়ে স্পর্শ করল ও।
কামরান ওর চোখের দিকে তাকিয়ে এবার আবার অনুকরণে মুখের প্রতিটি রেখা সযত্নে, পরম আদরে ছুঁয়ে দেখতে লাগল। সায়ের মনে হল, এমন এক অনুভূতি জেগে উঠছে ওর ভেতরে, যা জীবনে কোনোদিন পায়নি ও। এই প্রথম যেন ও নিজেকে চিনতে পারছে। অনুভব করতে পারছে। পৃথিবীকে চিনতে পারছে। এই প্রথম ও বেঁচে উঠল যেন-বা। সত্যিকারের বেঁচে থাকা। কামরানের হাতটা ও নিজের হাতে নিল। সায়ের হাতটা কামরান তুলে ধরল। নিজের ঠোঁটের উপর চেপে ধরল।
এই মুহূর্তে বর্তমানকে আঁকড়ে জাপটে ধরতে চাইছে সেও। আলিঙ্গন করতে চাইছে জীবনকেই। আর সামান্য যেটুকু সময় সে পাবে, যে ক-টা মুহূর্ত হাতে আছে, সদ্ব্যবহার করতে হবে। যতটুকু পারা যায়, আনন্দ দিয়ে ভরে নিতে হবে। বেঁচে থাকার স্পষ্ট ও বিশুদ্ধ অনুভব দিয়ে ভরে দিতে হবে সামান্য কয়েকটা মুহূর্তকে।
ও চুম্বন করল সায়ের হাতে। সায়ের শরীরটা তারপরই ফেল করতে শুরু করল। মাটিতে পড়ে গেল সায়ে। তখনও দেখতে এবং শুনতে পাচ্ছিল সায়ে। সারা শরীরে খিঁচুনি লেগে গেছে ততক্ষণেই। সেই কাঁপুনিকে শান্ত করার উপায় নেই সায়ের। ফুসফুসের হাওয়া আর ধরে রাখতে পারছিল না সায়ে। সে দেখতে পাচ্ছিল, তার কাঁপুনি-ধরা শরীরের পাশে কামরান বসে আছে।
কামরান সায়ের মুখ থেকে গেঁজিয়ে-ওঠা ফেনা নিজের ঘর্মাক্ত হাত দিয়ে মুছে দিচ্ছিল। নত হয়ে ওর ঠোঁটের ওপর চেপে ধরছিল নিজের ঠোঁট। ওর শরীরকে নিজের দু-বাহুর মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিল। ওর মুখের ওপর, চুলে ওপর কামরানের অশ্রু ঝরে পড়ছিল সমানে। সংক্রমণের অ্যালার্ম তখনও বেজে চলেছে ক্রমাগত। সায়ে মুখে একটা হাসি জোর করে নিয়ে আসছিল মৃত্যুর আগের মুহূর্তে, যাতে কামরানের সহকর্মীরা দেখতে পায়, ওরা যখন আসবে এই সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে… ও কত খুশি ছিল, কত তৃপ্ত ওর জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও।
ও জেনে গেছে ততক্ষণে, ওর অপরিকল্পিত এবং অনিয়ন্ত্রিত এই শেষ এক্সপেরিমেন্টের ফল পাওয়া গেছে। কামরান এই পরীক্ষাটায় জীবিত অবস্থায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
জোহা কাজেমির মূল ফারসি গল্পের আমির সেফারাম কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন যশোধরা রায়চৌধুরী
Tags: কল্পবিজ্ঞান, জোহা কাজেমি, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, যশোধরা রায়চৌধুরী