ক্ষমা
লেখক: অরুণাভ মালো
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
কান খাড়া করে জেগে রয়েছি আমি। শোনার চেষ্টা করছি, যদি কিছু শুনতে পাওয়া যায়। এক নির্মম নিস্তব্ধতার মধ্যে সময় কাটছে আমার। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে অনেক আগেই। এবার বোধহয় উন্মাদনার দিকে এগোচ্ছি আস্তে আস্তে।
প্রথমদিকে চিৎকার করেছি, কেঁদেছি, রেগে গর্জন করেছি… কোনো কিছুতেই কোনো উত্তর পাইনি। পায়ে মোটা একটা শিকল বাঁধা আমার। সেটা ধরে খুঁজতে খুঁজতে দেওয়াল পেয়েছি। কিন্তু সেই দেওয়াল, পায়ে বাঁধা শেকল আর এই মেঝে ছাড়া আর কোনো কিছুরই স্পর্শ পাইনি। কত বড়ো ঘরে ওরা আমায় আটকে রেখেছে, আমি সেটাও জানি না। শুধু অস্পষ্ট মনে আছে এই অন্ধকার ঘরে জ্ঞান ফিরে আসার কথা। মুখের ভেতরটা তেতো লাগছিল। মাথাব্যথা করছিল। টের পেয়েছিলাম পায়ে মোটা শিকল বাঁধা।
অস্পষ্টভাবে এর ঠিক আগের স্মৃতিটুকুও ঝাপসা মনে আছে। নিজের ঘরে ছিলাম। শীতকালের রাত ছিল। দরজায় বারবার আওয়াজ আসছিল। দরজা খোলার পরে কিছু মনে নেই, বোধহয় কতকগুলো ছায়ামূর্তি দেখেছিলাম বাইরের অন্ধকারে। একটা আঘাত লেগেছিল মাথায় খুব জোরে। স্মৃতি বলতে এটুকুই।
তারপর কতদিন কেটে গেছে আমার খেয়াল নেই, চোখ খুলেছিল এই ঘন অন্ধকারে। নিস্তব্ধ এক নিষ্ঠুর পর্দা যেন দু-চোখে টেনে দিয়েছিল কেউ। আলোর সংস্পর্শ পাইনি একফোঁটাও।
খিদে-তৃষ্ণায় মরতে বসেছি আমি। আমার শরীরের প্রত্যেকটা কণা একফোঁটা আলো দেখার জন্য ছটফট করছে আমার শরীরের চামড়ার মধ্যে। কোনো মানুষের কণ্ঠ যদি শুনতে পাই, তাই ইন্দ্রিয়কে হার মানতে দিইনি।
শরীরের শেষ শক্তিটুকুও বোধহয় শেষ, এমন সময় অনতিদূরেই শব্দ করে খুলে গিয়েছিল বিশাল এক সিংহদুয়ার! প্রবেশ করেছিল মায়াবী আলো, আমার ঝাপসা ক্লান্ত চোখ ধাঁধিয়ে উঠেছিল আকস্মিক সেই আলোর উপস্থিতিতে, যন্ত্রণায় শিউরে উঠেছিলাম আমি, চোখ বোধহয় নষ্ট হয়ে গেল সেই আলোতে!
মুখে হাত চেপে বসে ছিলাম কিছুক্ষণ, প্রাণ চাইছিল তাকিয়ে দেখতে, কিন্তু অন্ধকার-সওয়া দু-চোখের স্নায়ু কিছুতেই পারছিল না সাহস করে সেই জ্যোতির দিকে তাকাতে।
তবু শুয়ে শুয়েই এগিয়ে গিয়েছিলাম আমি, আমার থেকে খুব বেশি দূরে নয় সেই বিশালাকৃতি দরজা। তাই শেকলে বাঁধা পড়িনি। ঠিক দরজার মুখে এসে আমি বাইরে তাকালাম।
দু-চোখের যন্ত্রণায় আমি এক সেকেন্ডের বেশি কিছুতেই চোখ খুলতে পারছিলাম না, সেই ক্ষণিকের দর্শনেই আতঙ্কে পরিপূর্ণ হয়েছিল আমার মন! অবিশ্বাসে দু-চোখ চেপে ধরেছিলাম, আবার তাকিয়েছিলাম বাইরে। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল বোধহয় হৃৎস্পন্দনও!
দেখেছিলাম এক আকাশ জুড়ে মায়াবী রঙিন মেঘের মেলা! যেন জলরং দিয়ে দৈত্যাকৃতি এক চার্চের ছাদে আঁকা ছবি! তাতে নেই কোনো মানুষ, নেই কোনো আবেগ, নেই কোনো মর্ম। এক আকাশব্যাপী গুরুগম্ভীর এক নিশ্ছিদ্র মেঘের মেলা! এক ভয়ংকর সৌন্দর্য!
শুধু চাঁদটাই আমার চেনা। বাকি অতল এক মেঘরাশির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি, নিস্তব্ধ সেই পরিবেশে আমি বিহ্বল হয়ে দু-চোখ ভরে দেখতে লাগলাম সেই ভয়ংকর সুন্দর রূপ!
দেখতে পেয়েছিলাম অনেকগুলো সিঁড়ি, ধাপে ধাপে নেমে গেছে আমার পায়ের সামনে থেকে, এঁকেবেঁকে শূন্যে ভেসে রয়েছে সেই সিঁড়িগুলো। অনেক… অনেক দূরে সেই সিঁড়ি যেখানে শেষ, সেখানে কে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে! হ্যাঁ! মানুষই তো!
আমার শরীরটা কেমন যেন হালকা লাগছে, পায়ে শেকলও যেন আর বাঁধা নেই! কী অমোঘ এক আকর্ষণ বোধ করছি সেই মানুষটার কাছে পৌঁছোনোর জন্য! দ্রুতপায়ে আমি সেই অতল রঙিন মহামেঘরাশির মধ্যে দিয়ে ভেসে-থাকা সিঁড়ি ধরে নামতে থাকলাম! নীচে কোনো জমি নেই, দূরে নেই কোনো প্রান্ত, নেই দিগন্ত! কোন মহাশূন্যের মেঘপুঞ্জে সিঁড়ি ধরে নামছি আমি! ওই মানুষটার কাছে আমাকে পৌঁছোতেই হবে! যেতেই হবে আমায়!
কাছে যেতেই চিনতে পেরেছিলাম মানুষটাকে, দু-চোখ ভেঙে অশ্রু নেমেছিল আমার! হৃদয় বোধহয় রক্তাক্ত হয়েছিল ওকে দেখেই। আমার ভালোবাসা। আমার স্ত্রী।
সেই সুন্দর চুল, পাতলা ঠোঁট, সুন্দর শরীর! যার ছোঁয়ায় আমি প্রতিটা রাত কাটিয়েছি, যার আলিঙ্গনে, যার শরীরের ঘ্রাণে আমি শান্তিতে ঘুমিয়েছি প্রতিটা রাত। আমার স্ত্রী।
যে চলে যাওয়ার পরে আমি একরাতও ঘুমোতে পারিনি, আমি বাঁচতেই পারিনি। প্রাণহীন পাথরই হয়ে গিয়েছিলাম। আজ সে আমার সামনে! এতদিন, এত যুগ পরে, এই অসীম অতল স্বপ্নের জগতে…!
আমি দু-হাতে মুখ চেপে বসে পড়লাম। চোখের জলে আমার গাল ভেসে যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখেছিলাম, ভাবলেশহীন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আমার ভালোবাসা, আমার স্ত্রী।
আঁকড়ে ধরতে গিয়েছিলাম তাকে! তার শরীরে মিশে যেতে চেয়েছিলাম, বুক ভরে নিতে চেয়েছিলাম তার শরীরের ঘ্রাণ!
এ কী! ওর সাদা পোশাকটা রক্তে রাঙা হয়ে যাচ্ছে কেন! এ কী হল! আমার স্ত্রী-র শরীর দিয়ে রক্তের স্রোত বইছে! যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম আমি! অত সুন্দর মুখটা কেমন কুঁকড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়! আমি কিছুতেই ওকে ছুঁতে পারছি না! ব্যথায় কাতর হয়ে ডুকরে কাঁদছি আমি! আমি পারলাম না ওকে বাঁচাতে! পারলাম না! এ আমি কী করে ফেললাম!
নিজের হাতের দিকে তাকালাম। আমার হাতে ছুরিটা ধরা, যেটা দিয়ে তুমুল ঝগড়ার দিনে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে খুন করেছিলাম ওকে! ছুরির শানিত ফলা চালিয়ে দিয়েছিলাম এলোপাতাড়ি! ভেতরের জন্তু রূপ পেয়েছিল আমার শরীরে! হিংস্রতার লালা ঝরছিল আমার মুখ দিয়ে, আর বিস্ফারিত চোখে আমার সেই রূপ দেখে নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছিল আমার ভালোবাসা, আমার স্ত্রী-র সুন্দর টানা চোখ দুটো…!
চিৎকার করে ক্ষমা চাইছিলাম আমি স্বপ্নজগতের সেই অতল মেঘরাশির মধ্যে রক্তাক্ত মৃত আমার স্ত্রী-র শরীরের সামনে, “ক্ষমা করো আমায়! আমি শেষ করে ফেললাম তোমায়! মেরে ফেললাম তোমাকে! আমি পারিনি জিততে, হেরে গিয়েছি নিজের ভেতরের পশুর কাছে! ক্ষমা করো আমায়! আমি ক্ষমা চাইছি! আমায় মুক্তি দাও! আমি ভুলতে চাই! আমি মারতে চাইনি!… আমি মারতে চাইনি…!”
নিষ্প্রাণ স্ত্রী-র শরীরটার পিছনের মেঘ থেকে কয়েকটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। তাদের লম্বা হাতে শানিত নখ, সরীসৃপের মতো অবয়ব… এরাই কি তবে দেবে আমায় শাস্তি, এরাই আমার মৃত্যুদূত?
ধারালো শানিত নখ নিয়ে ক্রুদ্ধ আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার উপর ছায়াশরীরগুলো। আসন্নপ্রায় মৃত্যুর আতঙ্কে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম আমি! তখুনি কানে এল অনেক মানুষের কোলাহল, বজ্রগম্ভীর এক বয়স্ক গলার প্রতিধ্বনি, “অর্ডার, অর্ডার!”
ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখতে পেয়েছিলাম হাইকোর্টের উঁচু ছাদ, মোটা কাঠের চেয়ার, টেবিল। বিচারক কে দেখেছিলাম, দেখতে পেয়েছিলাম পুলিশদেরকেও, যাঁরা গত দু-মাস ধরে আমায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে বাড়িতে হানা দিয়েছিলেন, আর নিপুণ দক্ষতায় তাঁদের মনগড়া কাহিনি শুনিয়েছিলাম আমার স্ত্রী-র মৃত্যুর!
দেখতে পেয়েছিলাম অনেক চোখ, চেয়ারে বসে-থাকা মানুষদের। ঘৃণার, আতঙ্কের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল তারা আমার দিকে। কাঠগড়া থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল গোয়েন্দাদের দল, যাদের কয়েকজনকে এর আগে আমার বাড়ির চারপাশে উঁকি দিতে দেখেছি। আমি কাঠগড়ায় একটি চেয়ারে বসা, মাথায় বড়ো ধাতব একটা যন্ত্র চাপানো, তার থেকে বৈদ্যুতিক তার বেরিয়েছে অনেক।
মসৃণ মার্জিত কণ্ঠে দাবি জানিয়েছিলেন সবাই আমার মৃত্যুর, জনতার চোখের ঘৃণায় দেখতে পাচ্ছিলাম আনন্দের উচ্ছ্বাস! মৃত্যু চাই! আমার মৃত্যু।
বজ্রগম্ভীর স্বরে বলে গিয়েছিলেন বিচারক, আমার শাস্তির ঘোষণা।
“আসামির এতদিনের মিথ্যা আজ নতুন এই মেশিনের দৌলতে হার মেনেছে। সাধারণ লাই ডিটেক্টরের জায়গায় রসায়ন ও বৈদুতিন যন্ত্রের সম্মিলনী সাহায্যে গড়া এই অত্যাধুনিক ট্রুথ কনফেসরকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব। এর বৈশিষ্ট্য হল আসামিকে তন্দ্রাচ্ছন্ন রেখে মস্তিষ্কের স্মৃতি-উদ্দীপক কোশগুলিকে আসামির অলক্ষে জাগিয়ে তোলা। যার জন্য একটু আগেই আসামি কোর্ট, জুরি ও আইনকে সাক্ষী রেখে নিজের মুখে উচ্চারণ করে নিজের কৃতকর্ম স্বীকার করেছে। আসামির নিজের মুখে স্বীকার করা অতীব ঘৃণ্য এই খুন ও তদন্তে মিথ্যার আশ্রয় নেবার শাস্তিস্বরূপ আসামির নিজের কৃতকর্মের স্বীকারোক্তিকে নজরে রেখে আসামিকে নিজের স্ত্রী-কে খুনের ঘৃণ্য অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল…!”
উল্লাসে ভরে গেল কানের পর্দা! সবাই খুশি আমার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ শুনে! আমিও ওদের সঙ্গে উল্লাসে গলা মেলালাম! আমিও খুশি! এই মানসিক বিকৃতি নিয়ে, এই উন্মাদনা নিয়ে, নিজের ভুলের এই যন্ত্রণা বুকে নিয়ে আমাকেও আর পালিয়ে বেড়াতে হবে না তার মানে! মুক্তি হবে আমার!
জানি, স্ত্রী-র কাছে আবার ক্ষমা চাইতে পারব, অসীম অতল সেই মেঘের সাম্রাজ্যে, দেখতে পারব দু-চোখ ভরে ওর সুন্দর রূপ! ওর পাতলা ঠোঁট…। নিতে পারব বুক ভরে ওর শরীরের চেনা ঘ্রাণ!
আর সেখানেই আসবে সেই ছায়াশরীরগুলো, মেঘের সাম্রাজ্যের সেই বিচারকরা! এসে শানিত নখে ফালাফালা করে দেবে আমায়! রক্তাক্ত হয়ে জলরঙে আঁকা সেই রঙিন মেঘের মাঝে পড়ে থাকবে আমার শরীরটা। বুঝতে পারব, কতটা যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল আমার স্ত্রী-কে।
সেদিনই বোধহয় পারব নিজেকে ক্ষমা করতে। তবেই পাব মুক্তি। তার আগে নয়…।
Tags: অরুণাভ মালো, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা