নির্জন বাসভূমি
লেখক: মিলন গাঙ্গুলী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
কারও কারও কাছে নিরিবিলি জীবন বেশ পছন্দের।
জামশেদের কাছেও। এইরকম জীবনই চেয়েছিল সে। সব সময়।
হইহল্লা থেকে দূরে থাকা।
আটটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করো। আপিস বা যার যেটা কাজ থাকে, করো। রুজিরোজগারের জন্য আর কী। কাজ শেষ হলে নিজের ব্যক্তিগত বালি-শকটে চড়ে বোসো। নিজেও ড্রাইভ করতে পারো।
টাকাপয়সা যৎপরোনাস্তি, মানে যথেষ্ট হলে একটা রোবট-ড্রাইভার থাকতে পারে।
সেই রোবট-ড্রাইভার তোমাকে নিয়ে আরামসে ড্রাইভ করে বাড়িতে নিয়ে আসবে। আসার আগে মাটির তলার সুপারমার্কেট থেকে কৌটার কিছু খাবার, শ্যাওলার সুপ আর জমাট-বাঁধা নীল জেলিফিশের পুডিং কিনতে পারো।
যদি পরদিন আপিস বন্ধ থাকে, তবে মাঝখানের কোনো একটা বন্দরে যানটা থামতে পারে। সব জায়গা থেকে মানুষজন এসে আড্ডা দেয়। মঙ্গল গ্রহ তো বটেই, চাঁদের উপনিবেশ থেকেও অনেকে আসে। সেই আদিম বাসভূমি পৃথিবী থেকেও আসে অনেকে।
বেশ একটা হাউ কাউ আর গুলতাপ্পি হয় সেখানে।
গোল হয়ে বারে বোসো। ভালো বিয়ার পাওয়া যায়। সোনালি যব আর হলুদ ভুট্টা দিয়ে বানানো। ফেনা আর বুদ্বুদ ভরতি। মঙ্গলে যা গরম, জিনিসটা ভালোই লাগে।
চাঁদের মাটির নীচে প্লাস্টিকের বড়ো বড়ো টিউবের ভেতরে কমলা রঙের মাশরুম হয়। সেইগুলো দিয়েও ভালো বিয়ার হচ্ছে আজকাল।
দু-এক পাত্র গিলতে পারো। সঙ্গে মাছভাজা। অচেনা মশলা আর গুল্ম দেওয়া।
আড্ডা মারতে পারো। যারা পৃথিবী থেকে নতুন এসেছে, তারা তো বকবক করে কানের পোকা মাথার মগজ গরম করে ফেলবে।
এবার বাড়ি ফিরতে পারো।
চারদিকে একঘেয়ে দৃশ্য।
লালমাটি। লাল পাথর। লাল পাহাড়। সূর্যটা পাকা একটা কমলালেবুর মতো ঝুলে আছে আকাশে। অথবা প্রায় দিগন্তের কাছে। বালিঝড় হয় প্রায়ই। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধেয়ে আসে।
চিন্তার কিছু নেই, শকটের ভেতরে বাতাস নিয়ন্ত্রিত। ঠান্ডা-গরম কোনোটাই গায়ে লাগবে না। লাগার কথাও না।
মাইলের পর মাইল ড্রাইভ করে যাও তোমার শকট। যেগুলোকে পৃথিবীতে গাড়ি বলত একসময়। এখন গাড়ি… বলা ঠিক হবে না। শূন্যে ভাসে যে।
একসময় বাড়ি পৌঁছে যাবে।
ফাঁকা নিঃসঙ্গ এক-একটা বাড়ি। বহু দূর দূর পর্যন্ত কোনো প্রতিবেশী নেই। থাকা উচিতও না। মানুষের জীবনে ঝামেলা আনার জন্য একজন প্রতিবেশীই যথেষ্ট।
আর প্রতিবেশী যদি থাকবেই, তবে আর মঙ্গলে এসেছ কেন? চলে যাও পৃথিবীতে। সেখানে গিজগিজ করছে মানুষ। নিজের বাড়ির বারান্দায় বসে নাকের শিকনি ফেললে প্রতিবেশী বুড়োটার টাক মাথার উপর গিয়ে পড়বে।
আজব এক জায়গা!
এভাবে থাকা যায়?
পৃথিবীতে মানুষ বাড়তে বাড়তে এখন তো শ্বাসটাও ঠিকমতো নেওয়া যায় না।
২০৪৩ সালে চাঁদে বসতি শুরু হয়েছে। দেখতে দেখতে ওটাও গিজগিজে হয়ে গেছে। পরের বছর মঙ্গলে বসতি শুরু হল।
তবে ততদিনে আবাসন আইন কঠিন করা হল।
চাঁদে তো পৃথিবী থেকে এমনভাবে মানুষ নেওয়া হয়েছে যেন বাজার থেকে ভাগা হিসাবে চাপিলা মাছ নেওয়া হয়েছিল।
মঙ্গলে নিয়ম করা হল, প্রতি বিশ মাইলে একজন করে থাকবে।
আর রাম শ্যাম যদু মধু চাইলেই আসতে পারবে না। আবেদন করার বিশ বা ত্রিশ বছর পর হয়তো-বা বাড়ি মিলবে।
আবেদন করেছিল জামশেদের বাপ। সেই কাগজ যখন কোর্টে উঠল, বুড়ো বাপ তখন মরে তো গেছেই, জামশেদের বয়সও হয়েছে ত্রিশ। যাক গে, গিন্নিকে নিয়ে এখানে এসে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। আজ পাঁচ বছর হল। ওদের বাচ্চাটা হয়েছে এখানেই।
জামশেদ সুখী।
দুই
ওদের বাড়িটা প্রায় পাঁচ একর জায়গা জুড়ে।
আধুনিক তো বটেই। পৃথিবীর বাড়িঘরগুলোর মতো ঠুনকো নয়। কামরাগুলো সুন্দর। আলো-বাতাস সবই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সোলার প্যানেল আছে। শক্তি উৎপন্ন হয় ওটা দিয়েই। সেই শক্তিতে বাড়ি ঘরের সব কাজ চলে। জল গরম করা হতে শুরু করে রোবট দুটোর ব্যাটারি চার্জ দেওয়া পর্যন্ত।
রোবট দুটো ঘরের সব কাজে গিন্নিকে সাহায্য করে।
বাড়ির সামনে বাগান। ওখানে কিছু সবজির চাষ করে জামশেদের গিন্নি। সহজে ফলে অমন কিছু সবজি। গাজর-মুলা-শালগম-পালংশাক-আলু এইসব আর কী।
শখের চাষ। কিন্তু বাজার খরচের উপর চাপ কমে যায়।
খাঁচার মধ্যে মুরগি পালে কয়েকটা। সঙ্গে পিচ্চি, একটা চৌবাচ্চাতে কিছু তেলাপিয়া। খুব বেশি যত্ন নিতে হয় না। দ্রুত বড়ো হয়। কৌটার মাছ খেতে খেতে যখন অরুচি ধরে যায়, তখন মুখের স্বাদ বদলানোর জন্য গিন্নি এগুলো ব্যবহার করে।
ডিনার টেবিলটা জমে ওঠে ছুটির দিনে।
সাদা ধবধবে ডিনার ক্লথের উপর—চিনামাটির তশতরিতে নতুন খাবার। টাটকা।
খোকাটা সারাদিন বাড়িতেই থাকে। ইস্কুলে যেতে হয় না। বাসায় থ্রিডি ক্লাসে পড়াশোনা করে। পরীক্ষাও দেয় থ্রিডি ক্লাসে। সমবয়সি বন্ধুবান্ধব নেই। তো কী? অনলাইন বন্ধু আছে। ভিডিয়ো গেম, মুভিআর রাজ্যের সব বই তো আছেই।
মাঝেসাঝে হাঁপ ধরে গেলে বাগানে গিয়ে রোবটটার সঙ্গে খেলাধুলা করে কিছুক্ষণের জন্য।
নিজের এই জীবন নিয়ে জমাশেদ খুব খুশি। খুশি হবে না কেন? টিভি-তে যখন পৃথিবীর দৃশ্য দ্যাখে, তখন ওর শরীর শিউরে ওঠে। সন্দেহ নেই, চরম দুর্ভাগারাই এখন পৃথিবীতে থাকে।
নোংরা, ধুলা ভরতি। শীত-গরম দুটোই বেশি। অজানা সব রোগজীবাণু। বাস-ট্রাম ভরতি মানুষ। সকাল হতে-না হতেই ওরা ছোটে। সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসে। ক্লান্ত। এত ছোটো ছোটো বাসাবাড়ি, জুতার বাক্সের মতো।
স্নান করার সময় একজন হেঁড়ে গলায় গান গাইলে অন্যজনের ঘুমের ব্যাঘাত হয়।
জামশেদ ভালো করেই জানে, পৃথিবীর ওরা সবাই সব কিছু ছেড়েছুড়ে মঙ্গলে আসতে চায়। সেটা সম্ভব না। সামনের বছর শনি গ্রহে নতুন বসতি শুরু হতে পারে। তখন আবার সেখানে নেওয়া হবে। শুধুমাত্র ভাগ্যবানদের।
আত্মতৃপ্তি নিয়ে এইভাবেই দিনগুলো কাটছিল জামশেদের।
তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে। প্রতিবেশী ছাড়া। সুখী।
সকালে ওঠো। আপিস যাও। বাড়ি ফেরো। বউ-বাচ্চাকে সময় দাও। টিভি দ্যাখো, বই পড়ো। রোবটের সঙ্গে দাবা খ্যালো। সপ্তাহে একদিন স্টেশনের সেই বারে বোসো। এক পাত্র বিয়ার নিয়ে আড্ডা দাও।
শেষ।
আহ্, জীবন!
সুন্দর!
মাঝে মাঝে মিউজ়িক প্লেয়ারে বৃষ্টির শব্দ ছেড়ে দেয় জামশেদ। কেন জানে না, নির্জনতা সব সময় ভালো লাগে না। মঙ্গলে বৃষ্টি হয় না। মাঝেসাঝে বৃষ্টির শব্দ শুনলে ক্ষতি কী?
এইভাবেই হয়তো চলে যেত বাকি দিনগুলো।
শুধু একদিন কাজ থেকে ফেরার পর গিন্নি বলল, ‘শোনো। বাড়ির নীচতলায় কীসের যেন একটা শব্দ শুনতে পেয়েছি। এই একটু আগে।’
‘কোত্থেকে?’ টাইয়ের নটটা খুলতে গিয়েও থেমে গেল জামশেদ।
‘নীচতলায়।’ আবারও বলল গিন্নি। ওকে এই মুহূর্তে বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছে।
‘মানে সেলারের নীচে?’
‘না। আরও নীচে। আপাতত মনে হচ্ছে সেলারের নীচে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আরও নীচে।’
‘সে কী? অমন তো হবার কথা না।’ অবাক হল জামশেদ, ‘ভুল-টুল শোনোনি তো? নাকি যন্ত্রপাতি কোনোটা বিগড়ে গেছে। জল গরম করার হিটারটা হতে পারে না?’
‘না। শব্দটা তেমন না।’
‘রোবট দুটো কাজ করে সারাদিন। ওরা করেনি তো?’
‘মনে হয় না।’
‘ঠিক আছে। চলো, সেলার রুমটা দেখে আসি।’
গিন্নিকে নিয়ে সেলারে চলে গেল জামশেদ। অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষানিরীক্ষা করল। সন্দেহজনক কিছুই পেল না।
‘ঠিক বুঝতে পারছি না।’ চোখ-মুখ কুঁচকে সত্যি কথাই বলল জামশেদ, ‘তোমার কী মনে হয়?’
‘ভূত-টুত না তো?’ চোখ বড়ো বড়ো করে বলল গিন্নি।
জামশেদ না হেসে পারল না, ‘নাহ্, তুমিও। ভূত আবার আছে নাকি? ওটা তো পুরোনো দিনের গল্প। পক্ষীরাজ ঘোড়ার মতো। মনে হয়, রোবট দুটোর কোনো একটা এসেছিল সেলার রুমে। যা-ই হোক, ছুটির দিনে মিস্ত্রির কাছে নিয়ে যাব দুটোকেই। দেখি, ব্যাটারির কোনো সমস্যা থাকতে পারে।’
গিন্নি আর কিছু বলল না।
সেরাতে আবার ঘুম ভেঙে গেল।
গিন্নি ডেকে তুলেছে জামশেদকে। ফিশফিশ করে বলল, ‘শুনতে পারছ?’
নীচের সেলার রুমে শব্দ ভেসে আসছে। হালকা। অস্পষ্ট।
খুব সাবধানে নীচে চলে এল জামশেদ।
কান পাতল। শব্দটা আসলে সেলারে হচ্ছিল না। আরও নীচে। মাটির নীচে।
‘কী মনে হয়?’ বোকা-বোকা ভাবে বলল জামশেদ। নিজেও শুনতে পারছে এখন।
‘ভূতই হবে। মানুষ হতেই পারে না।’ ফিশফিশ করে বলল গিন্নি, ‘চল্লিশ মাইলের মধ্যে কোনো প্রতিবেশী নেই। কিন্তু আমি জানি এই বাড়িতে আমরা একা নই। আরও কিছু আছে। আগেও টের পেয়েছি।’
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল জামশেদ।
কাল হাউজ়িং কোম্পানির কাছে যাবে। ওদের জানাতে হবে ব্যাপারটা।
তিন
হাউজ়িং কোম্পানির প্রধান লোকটার নাম নিবারণচন্দ্র সাহা।
মোটা। কালো। ভুঁড়িওয়ালা। কুৎসিত ভলিউম এককথায়। মাথায় টাক। অল্প কিছু চুল আছে। না থাকলেই ভালো হত। আছে যখন, এখন সেইগুলোই উলটোদিকে লেপটে আঁচড়ে মাথা ঢাকার একটা বিদঘুটে চেষ্টা চালাচ্ছে।
জামশেদকে দেখে মারাত্মক রকমের খুশি হয়েছে নিবারণ, এমন একটা ভাব দেখালেন। মোটা শরীর নিয়ে সোফা থেকে দ্রুত ওঠার একটা ব্যর্থ চেষ্টাও চালালেন।
‘আরে কী ভাগ্য আমার।’ ফাটা গলা নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, ‘কী মনে করে পদধূলি দিলেন স্যার?’
‘দেখুন, এইসব তেলতেলে কথা বলার কোনো দরকার দেখি না।’ বিরক্ত হয়ে বলল জামশেদ, ‘আমি আমার প্রাইভেট শিপে করে এসেছি। পায়ে ধুলা থাকার কোনো চান্সই নেই। থাকলেও আপনার আপিসে সেগুলো ঝাড়তে আসিনি।’
কী বুঝলেন নিবারণ, কে জানে। ফাটা বাঁশির মতো একটা হাসি দেখা গেল তাঁর চেহারাতে।
‘বলুন, কী খেদমত করতে পারি?’ বিনয়ের অবতার সাজলেন সঙ্গে সঙ্গেই।
‘পুরো মঙ্গল গ্রহে কয়টা বাড়ি আছে?’
‘তা ধরুন গিয়ে আপনার পঞ্চাশ থেকে ষাটটা।’ কম্পিউটারের পর্দায় চোখ রেখে পেশাদারি একটা ভাব ধরে বললেন নিবারণচন্দ্র, ‘আসলে বাষট্টিটা বাড়ি। মানে বাষট্টি পরিবার। একটা স্টেশন। একটা আপিস। একটা সুপারমার্কেট। শেষ।’
‘নতুন কোনো পরিবার বাড়ি পাবে এখন?’
‘মোটেই না, মোটেই না।’ দুই হাত দিয়ে গাড়ির সামনের কাচ পরিষ্কার করার মতো একটা ভঙ্গি করে বললেন নিবারণ।
‘আমার তো মনে হয়, আমার বাড়ির খুব কাছেই নতুন আরেকটা বাড়ি বানানো হচ্ছে। তাও আমার অনুমতি না নিয়ে। আমাকে না জানিয়েই।’
কয়েকটা মুহূর্ত হাঁ করে রইলেন নিবারণবাবু। যেন দম নিতে ভুলে গেছেন।
তারপর প্রায় চিৎকার করে বললেন, ‘স্যার, এইসব কী বলছেন? এ হতেই পারে না। বাষট্টিটা পরিবার। পরিষ্কার বাষট্টিটা বাড়ি। শেষ। এখন শনি বা নতুন গ্রহে বাসভূমি বানানো হবে। সেখানে পৃথিবী থেকে লোকজন নেওয়া হবে দক্ষতার ভিত্তিতে। বাসভূমির সমস্যা আমাদের কবেই মিটে গেছে। এখন প্রত্যেক মাসেই নতুন নতুন গ্রহ আবিষ্কার হচ্ছে, স্যার। এমন একটা সময় আসবে স্যার, একটা পরিবারের জন্য একটা আস্ত গ্রহ বরাদ্দ থাকবে। এটা আমাদের অঙ্গীকার। আগামী এক বছরের মধ্যেই এটা হবে।’
জোর গলায় কথাগুলো বললেন নিবারণচন্দ্র। এই ফাঁকে কোম্পানির বিজ্ঞাপনটাও দিয়ে দিলেন কায়দা করে। এই হাউজ়িং কোম্পানির স্লোগানই এটা। এক পরিবারের জন্য একটা গ্রহ। সুখী প্ল্যানেট।
‘দেখুন, আপনার কোম্পানির স্লোগান শোনার জন্য এতদূর আসিনি আমি।’ খানিক রুক্ষ গলায় বলল জামশেদ, ‘অথবা আপনার সঙ্গে চমকপ্রদ একটু গল্পগাথা অথবা পঙ্ক্তিমালা শোনার জন্যও এতদূর আসিনি। কিংবা আপনার অতিরিক্ত চিনি-দেওয়া ফালতু কফি গেলার জন্যও আসিনি। আমি আমার সমস্যার সমাধান চাই।’
‘বলুন স্যার। সমস্যাটা বলেই দেখুন।’ ধাতানি খেয়ে চটপটে একটা ভাব দেখাচ্ছেন নিবারণচন্দ্র। অকারণেই সুট-টাই ঠিক করছেন বারবার।
সব বলে গেল জামশেদ। শুঁটকি মাছের মতো চেহারা করে সব শুনলেন নিবারণবাবু।
‘সে কী, স্যার?’ অবাক একটা ভঙ্গি করে বললেন তিনি, ‘আজব ব্যাপার, স্যার। আপনার কী মনে হয়?’
‘আমার কিছু মনে হয় না। তবে আমার গিন্নি মনে করে, বাড়ির নীচে ভূত আছে।’
‘কী আছে?’ চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন নিবারণবাবু, ‘ভূত?’ তারপর খ্যাকখ্যাক করে অদ্ভুত বিচ্ছিরি একটা ভঙ্গি করে হেসে ফেললেন ভদ্রলোক।
টানা মিনিটখানিক হেসে দম নিয়ে বললেন, ‘আমার মনে হয়, আপনার মিসেস পুরোনো দিনের ভৌতিক সিনেমাগুলো ডাউনলোড করে দিনরাত্র সেগুলো দেখেন। আমিও দেখি মাঝে সাঝে। গত মাসে দেখেছিলাম—কবরের প্রথম রাত। একদম ফালতু টাইপের মুভি। ভয় তো পাইনি, উলটে হাসতে হাসতে শেষ।
‘তবে একটা দৃশ্য ভালো লেগেছিল। একটা মেয়ের শরীরে প্রেত ভর করেছিল। প্রেতে ভর-করে-থাকা ছোট্ট মেয়েটা যখন বমি করে, সবুজ রঙের বমি হড়হড় করে বেরিয়ে আসে—আহ্ কী দৃশ্য। দেখার পর কয়েকদিন পালংশাকের ঝোল খেতে পারিনি। আমার মিসেস আবার সেই সময়ই পালং আর ডাল দিয়ে ঝোল রান্না করেছিল। কাণ্ড দেখুন। হ্যাহ্ হ্যাহ্ হ্যাহ্।’
‘ভাই, ফাজলামোর একটা সীমা থাকা দরকার।’ বিরক্ত হয়ে বলল জামশেদ, ‘আমি জরুরি একটা সমস্যার সমাধানের জন্য এসেছিলাম। আর আপনি তো হাসির অ্যাটম বম খুলে বসে আছেন।’
‘সরি, মানে দুঃখিত, স্যার।’ তাড়াতাড়ি চেহারাতে দুঃখবোধ এনে ফেললেন নিবারণবাবু, ‘আচ্ছা জামশেদবাবু, মানে জামশেদ স্যার, আপনি মঙ্গল গ্রহে কতদিন ধরে আছেন?’
‘এই তো প্রায় পাঁচ বছর।’
‘তাহলে বলুন, আগে কি কক্ষনো এরকম শব্দ শুনেছেন?’
‘না, তা অবশ্য শুনিনি।’ স্বীকার করতে বাধ্য হল জামশেদ।
‘তবে দেখুন।’ বেশ খানিকটা জয়ী হয়েছেন এমন একটা ভাবভঙ্গি করে বললেন নিবারণবাবু, ‘ব্যাপারটা কিন্তু প্রাকৃতিকও হতে পারে।’
‘কীরকম প্রাকৃতিক?’
‘মানে ধরুন, মাটির নীচে কোথাও পাথর নড়তে পারে। গ্যাসও নড়াচড়া করতে পারে। মঙ্গলের মেরুর বরফও গলছে অল্পবিস্তর। তো সেগুলোরও তো নহরধারা না ঝরনাধারা কী যেন বলে?—বয়ে যেতে পারে অল্পবিস্তর।’
‘ঠিক আমার বাড়ির নীচেই?’
‘হতেও পারে, স্যার।’
‘এ-ও হতে পারে… শুনতে তো আমি আসিনি, নিবারণবাবু। আমি সম্মানিত নাগরিক। আমার বাবার ডিজ়াইন-করা স্পেসশিপ বানানো হত নাসা-তে। আর আপনি কিনা আমাকে হাতি-ঘোড়া বুঝ দিচ্ছেন?’
‘না, স্যার।’ খরগোশের মতো ব্যস্ত হয়ে উঠলেন নিবারণবাবু, ‘কাল বিকেলের আগেই আমি আপনার বাসায় পৌঁছে যাব। ঠিক আছে? পাক্কা কথা দিলাম, স্যার। আসলে হয়তো দেখবেন ব্যাপারটা সিরিয়াস কিছু না।’
‘আপনার অমন ধারণার কারণ? হতে পারে না, ওখানের মাটির নীচে কোনো জীবন্ত প্রাণী আছে?’
‘না স্যার। হতে পারে না। মঙ্গল গ্রহে বাতাসের ৯৬ শতাংশ কার্বন ডাইঅক্সাইড! এ ছাড়া মঙ্গলের বাতাসে অক্সিজেন নেই বললেই চলে। বাতাসের এক শতাংশের মাত্র এক-দশমাংশ অক্সিজেন। কাজেই প্রাণ থাকতেই পারে না। অতীতে মঙ্গলের বুকে কোনো সভ্যতা ছিল, পাগলেও বিশ্বাস করবে না। হয়তো-বা জীবাণু-ফিবানু ছিল। আজ আর কিচ্ছু নেই।’
‘কিন্তু এমন কোনো প্রাণ জন্মাতে পারে না, যেটা কার্বন ডাইঅক্সাইড দিয়েও বেঁচে থাকতে পারে?’
‘না স্যার, পারে না।’
‘আপনার মাথা আর আমার মুণ্ডু। মহাবিশ্বে সব কিছুই সম্ভব।’
‘তা সম্ভব হতে পারে, স্যার।’ অসহায়ভাবে মাথা ঝাঁকালেন নিবারণচন্দ্র।
‘তো?’
‘স্যার, কালকে আপনার বাসায় অনুসন্ধানী টিম পৌঁছে যাবে। দুটো রোবটও নেব। ওরা মাটি খুঁড়ে দেখবে। ঠিক আছে? চা খাবেন এক কাপ? আদা আর তেজপাতা-ফেজপাতাসহ?’
চার
পরদিন একদম দুপুরবেলাতেই নিবারণবাবু পৌঁছে গেলেন।
‘যা-ই বলুন স্যার, বাড়িটা কিন্তু দারুণ।’ গদগদচিত্তে বললেন নিবারণবাবু, ‘বাগানটাও দারুণ। বাহ্, বউদি দেখি, নয়নতারা ফুলও লাগিয়েছেন। দারুণ তো। আমার ঠাকুরমায়ের নাম ছিল নয়নতারা। কলকাতায় থাকতেন। লাউয়ের ঘণ্টা না ঘণ্ট আর ডালের বড়া…।’
‘আপনি আপনার কাজ করুন দয়া করে।’ নিরাসক্তভাবে বলল জামশেদ। ব্যাটাকে চা-ও অফার করবে না। ভাবল মনে মনে।
নিবারণবাবুর সঙ্গে আবাসন কোম্পানির গাড়ি এসেছে। সঙ্গে দুজন লোক। আর দুটো শ্রমিক-রোবট।
গাড়ির ভেতর থেকে বিদঘুটে কিছু যন্ত্রপাতি বের করল নিবারণবাবুর লোকেরা।
তারপর সেইসব যন্ত্রপাতি বাগানের কয়েক জায়গায় ফিট করতে লাগল বেশ ব্যস্ত একটা ভাবভঙ্গি করে।
সেলার রুমটা ভালো করে পরীক্ষা করলেন নিবারণবাবু।
‘নাহ্। তেমন কিছুই তো দেখছি না।’ বিশেষজ্ঞদের মতো মুখের একটা ভাব করে বললেন নিবারণচন্দ্র।
‘শুনতে পাচ্ছেন?’ ফিশফিশ করে বলল জামশেদ।
আমলকী শুকিয়ে গেলে যেমন হরতকি হয়ে যায়, তেমনই মুহূর্তেই মুখটা শুকিয়ে গেল নিবারণবাবুর। সন্দেহ নেই। শব্দটা পরিষ্কার। তিনি নিজেও শুনতে পেয়েছেন।
‘বাইরে চলুন।’ ফিশফিশ করেই জবাব দিলেন নিবারণবাবু।
দুজনেই বেশ তড়িঘড়ি করে বের হয়ে এল সেলার রুম থেকে।
‘যন্ত্রপাতি কী বলছে হে?’ হাঁক ছাড়লেন নিবারণবাবু।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা রোবট।
‘স্যার, মাটির নীচে অদ্ভুত কিছুর কম্পন পাচ্ছি আমরা।’ মিহি যান্ত্রিক স্বরে জবাব দিল রোবটটা।
‘সে কী?’ এইবার বোধহয় ভয় পেয়েছেন নিবারণবাবু। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাগানে দাঁড়িয়েও সামান্য ঘেমে গেছেন যেন।
‘হ্যাঁ, স্যার। জীবন্ত কিছু আছে। হিটওয়েভও পাচ্ছি।’ তথ্য দিল রোবটটা।
‘হুম। মাটি খোঁড়া শুরু করো।’ বললেন নিবারণবাবু, ‘পুলিশে খবর দাও। কয়েকজন বিজ্ঞানীকে ডাকো। ওই যে যারা মাটির নীচের জিনিসপত্র নিয়ে গবেষণা-ফবেষনা করে আর কী।’
কয়েক মুহূর্তেই পরিবেশটা গরম হয়ে গেল।
মাটি খোঁড়া শুরু হল। শুকনো লালমাটি উঠতে লাগল ঝুড়ি ঝুড়ি।
এরই মধ্যে আরও ছয়জন চলে এসেছে। চারজন পুলিশ। পুরো মঙ্গলে মাত্র চারজন পুলিশই আছে। অপরাধের হার এখানে শূন্য। এই চার পুলিশ সারাদিন থানায় বসে ষোলোগুটিমার্কা পুরোনো দিনের খেলা খ্যালে।
মাটি খোঁড়ার পর যখন সুড়ঙ্গটা দেখা গেল, তখন একটুও অবাক হল না জামশেদ।
এরকম একটা কিছুরই আশা করছিল মনে মনে।
বিজ্ঞানী দুজন উত্তেজিত।
ওদের একজন দাবি করছে এটা মঙ্গলের হারানো সভ্যতা। আরেকজন দাবি করছে, অজানা কোনো প্রাণী ঘাপটি মেরে আছে নীচে।
বিজ্ঞানী দুজনকে বাইরে রেখে চার পুলিশ নেমে পড়ল গুহার ভেতরে।
হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র। দাঁড়িয়ে থাকলে মানসম্মান চলে যায় তাই নিবারণবাবুও নেমে পড়লেন।
‘আপনি আসবেন?’ জানতে চাইলেন ভদ্রলোক। তাকিয়ে আছেন জামশেদের মুখের দিকে।
‘অবশ্যই। এটা আমার বাড়ি। নিরাপত্তার জন্য আমাকে জানতে হবে, কী হচ্ছে ওখানে।’ কথাগুলো বলে নেমে পড়ল জামশেদ।
ঠিক গুহা বলা যাবে না। লম্বা একটা টানেল। অনেক যত্ন করে বানানো হয়েছে। উপরে-নীচে পালিশ করা। মসৃণ।
‘কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর কাজ।’ ফিশফিশ করে বলল জামশেদ।
মাথা ঝাঁকালেন নিবারণচন্দ্র।
আরও এগিয়ে যেতে লাগল দলটা। দুইপাশের দেয়ালে নানান নকশা আঁকা। হিজিবিজি। তার পরও ওদের মধ্যে একটা ছক আছে। যত্ন করে কেউ যেন কী সব লিখেছে। এঁকেছে।
অবাক হয়ে দেখছে সবাই।
জামশেদের কাছে বেশ চেনা-চেনা লাগছে এই চিহ্নগুলো। এমন সময় শব্দটা শোনা গেল আবার। টানেলের ভেতরেই খুব গোপনে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছে কেউ যেন।
বাতাস নেই টানেলের ভেতরে। তাহলে?
সাবধানে এগিয়ে গেল দলটা।
টানেলটা সামনে হঠাৎ করেই মোড় নিয়েছে।
মোড়টা ঘুরতেই লোকটার মুখমুখি হয়ে গেল দলের সবাই।
মানুষই। বুড়োমতো। একা। কাজ করছিল। স্পেসসুট পরনে। মাস্কও আছে। সেইজন্যই শ্বাস নিতে পারছে। তবে মাস্ক আর স্পেসসুটটা ওদের সবার মতো অত্যাধুনিক না। পুরোনো। প্রাচীন।
পুলিশ চারজন সঙ্গে সঙ্গেই চিৎকার করে। হ্যান্ডস আপ হতে শুরু করে আধ ডজন বিচ্ছিরি গালিও ছিল সঙ্গে।
পুলিশ তো!
লোকটার হাতে খনিতে কাজ করার উপযোগী একরকম হাতুড়ি ছাড়া আর কিছু ছিল না।
মেঝেতে অবশ্য একটা লন্ঠন ছিল। প্রাচীন আমলের রত্নসন্ধানীরা ব্যবহার করত এরকম লন্ঠন।
হাতুড়িটা ফেলে দিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলল বুড়ো লোকটা।
চমকে উঠল জামশেদ।
দ্রুত সামনে চলে গেল। বিচিত্র একটা ভাষায় জবাব দিল ও।
জামশেদের মুখের কথা শুনে লোকটা হাউমাউ করে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে ফোঁপাতে ফোঁপাতে কী সব বলতে লাগল গড়গড় করে।
জামশেদও প্রশ্ন করতে লাগল মাঝেসাঝে। প্রশ্ন শুনে থেমে থেমে আবার উত্তর দিতে লাগল বুড়ো।
চার পুলিশ বারবার পালা করে একবার জামশেদ, আরেকবার বুড়োর দিকে তাকাচ্ছে। বুঝে উঠতে পারছে না, কী করবে।
‘ও কী বলছে আপনাকে?’ শেষ পর্যন্ত ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন নিবারণবাবু।
‘এক মিনিট।’ খামোখাই রেগে গেল জামশেদ, ‘কথা শেষ করতে দিন।’
তারপর আবার বুড়োর দিকে ফিরে কথা বলা শুরু করল।
বুড়োর ভয় কেটে গেছে। তারপরও বুনো পশুর মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে ঘনঘন। হয়তো এখনও ভয় পাচ্ছে। ক্ষতির আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারছে না।
টানা তিন মিনিটের মতো কথা বলল দুজন। তারপর নিবারণবাবুর দিকে ফিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জামশেদ।
‘ভেতরে আরও অনেকেই আছে।’ বলল জামশেদ, ‘বুড়ো একা না। বিরাট একটা পরিবার আছে ভেতরে। মঙ্গলের মাটির নীচে বসবাস করে ওরা। আমাদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ।’
‘কোন ভাষায় কথা বললেন আপনারা?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন নিবারণচন্দ্র।
‘জার্মান ভাষা। তবে খুবই প্রাচীন। আজকাল এ ভাষা চলে না। ভাগ্যিস শখের বসে শিখেছিলাম ভাষাটা। তাই কথাবার্তা চালাতে পেরেছি। অন্য কেউ থাকলে এতক্ষণে বিরাট কেলেঙ্কারি হয়ে যেত।’
‘জার্মান ভাষা? ওরা পৃথিবীর মানুষ?’
‘অবশ্যই। কেন, আপনি কি ওদের মঙ্গলের মানুষ ভেবেছিলেন?’
‘কবে এল ওরা? আমাদের সিস্টেম ফাঁকি দিয়ে কীভাবে এসে মাটির নীচে বসতি বানাল? ওদের যন্ত্রপাতি এত প্রাচীন কেন?’
একনাগাড়ে বকবক করেই যাচ্ছেন নিবারণবাবু। তাঁর বিস্ময় কাটছেই না।
পাঁচ
আপিসের ভেতরে বসে আছে জামশেদ।
সামনে বসা ভদ্রলোক খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। মঙ্গলের হোমল্যান্ড ব্যুরোর প্রধান। পৃথিবী থেকে মঙ্গলের মাইগ্রেশনের প্রক্রিয়াটা এই ভদ্রলোকই নিয়ন্ত্রণ করেন।
‘তো ওরা জার্মান?’ জিজ্ঞেস করলেন প্রধান।
‘জি স্যার।’ জবাব দিল জামশেদ।
‘ভাগ্য ভালো, ভাষাটা আপনি জানতেন। কবে এসেছে ওরা এখানে?’
‘ওটা স্যার, উনিশো পঁয়তাল্লিশ সালের কথা।’
‘এত আগে?’ প্রায় চিৎকার করে উঠলেন প্রধান, ‘ওদের নেতা কে? কী বলে ওরা?’
‘ওদের নেতার নাম হিটলার।’
‘হিটলার? উনি আবার কে?’
‘খুবই প্রাচীন জার্মান নেতা, স্যার। যতদূর জানি, সেই ভদ্রলোক, মানে সেই লোকটার আমলেই পৃথিবীতে আণবিক বোমার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল পৃথিবীটা।’
‘তো হিটলারের নিশ্চয়ই পরাজয় হয়েছিল? নইলে তো ইতিহাস অন্যরকম হত। আমরা ওঁর নাম জানতাম। তা-ই না?’
‘নিশ্চিন্ত করেই সেটা বলা যায়। নইলে পৃথিবীতে শুধু জার্মান ভাষাই চলত। অন্য কোনো ভাষা টিকে থাকতে পারত না।’
‘ওরা এসেছে কীভাবে?’
‘ওই তো, সেই সময়েই পৃথিবীর ভয়ংকর সব জিনিসপত্র আবিষ্কার হয়েছিল, যা পরে আর জানা যায়নি। হারিয়ে গেছে লোকচক্ষুর আড়ালে। আর সমস্ত নথিপত্রও পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো মিসিং লিংক হচ্ছে সেই সময়টা। কী কী হয়েছিল, পরে আর কিছুই জানতে পারিনি আমরা। তখন থেকেই অনেকগুলো অমীমাংসিত রহস্য রয়ে গেছে পৃথিবীতে।
‘হিটলারের গোপন গবেষণাগারে তখনই স্পেসশিপ তৈরি হয়েছিল। এটা কিন্তু সত্য। পরে অনেকেই ব্যাপারটা সন্দেহ করেছিল। হিটলারের ইচ্ছা কী ছিল, বলা মুশকিল। হয়তো ইচ্ছা ছিল, বিপদ দেখলে স্পেসশিপে করে পালিয়ে যাবেন। কিন্তু তার আগেই একদিন তাঁরই কিছু বিদ্রোহী বিজ্ঞানী স্পেসশিপটা নিয়ে মঙ্গল গ্রহে চলে আসে।
‘এতদূর আসার পরও ওদের মনে ভয় ছিল। বুঝতে পারছিল না, পৃথিবীতে কী হচ্ছে। হয়তো হিটলারই জয়ী হয়েছেন। আর যদি হিটলার জয়ী হন, তবে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের জড়ো করে আরও আধুনিক আর ভয়ংকর স্পেসশিপ বানিয়ে, পালিয়ে-যাওয়া এই বিজ্ঞানীদের খুঁজে বের করবেন। আর এমন শাস্তি দেবেন, যা শয়তানও কল্পনা করতে পারবে না।’
‘আর এই ভয়ে ওরা মাটির নীচে বসতি স্থাপন শুরু করেছিল?’ এতক্ষণ পরে প্রশ্ন করলেন প্রধান।
‘ঠিক তা-ই। ওরা সবাই ছিল দক্ষ বিজ্ঞানীদের একটা দল। নারী-পুরুষ উভয়ই ছিল এই দলে। এমনকি আস্ত স্পেসশিপটা পর্যন্ত ভেঙে টুকরো টুকরো করে মাটির নীচে নিয়ে গেছে ওরা।’ বলল জামশেদ।
‘আমরা যখন মঙ্গলে এলাম, বসতি শুরু করলাম, তখন ওরা বোধহয় ভীষণ রকমের ভয় পেয়ে গিয়েছিল?’ প্রধানের গলায় দুঃখী মানুষের সুর। খানিক বেদনা।
‘সে আর বলতে। ওরা ভেবেছিল, হিটলারের লোকজন চলে এসেছে ওদের খুঁজতে।’
‘খাওয়াদাওয়া কী করেছে এতগুলো বছর?’
‘শ্যাওলা। টম্যাটো, পালং শাক। আলু।’
সবজান্তার একটা ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন প্রধান, ‘পরের জেনারেশনের ওরা সবাই মাটির নীচে থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল? তা-ই না?’
‘জি স্যার।’
চুপচাপ রইল দুজন।
অচেনা একজন কামরার ভেতরে এসে এক পেয়ালা চা দিয়ে গেল। জামশেদের জন্য।
‘আমি এই সময় চা খাই না, স্যার।’ আপত্তি জানাল জামশেদ।
‘আরে খান।’ রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলেন প্রধান, ‘না খেলে পরে আপশোশ করবেন।’
বিরক্ত হলেও পেয়ালাটা তুলে চুমুক দিল জামশেদ।
‘আমার বাড়ির কী হবে?’ খানিকটা বিরক্ত গলায় জানতে চাইল জামশেদ। এতক্ষণ কথা বলে মেজাজ খিঁচড়ে গেছে, ‘আপনি নিশ্চয়ই আশা করেন না, এত টাকা ভাড়া দিয়ে আমি ওই বাড়িতে থাকব? আর আমার বাড়ির নীচে আরও একটা কলোনি থাকবে। আমি নির্জন জায়গাতে থাকতে চাই। ব্যবস্থা আপনারা করবেন। কীভাবে করবেন, সেটা আপনারা জানেন।’
‘তা তো বটেই।’ রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলেন প্রধান, ‘সব সমস্যারই সমাধান থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে অনেকগুলো সমাধান থাকে।’
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল জামশেদ। শরীর ভেঙে ঘুম আসছে ওর। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে শরীরের সব ক-টা কোশ। জ্ঞান হারানোর আগে দেখল, ব্যুরো প্রধান লোকটা মিটিমিটি হাসছেন।
জামশেদ জ্ঞান হারানোর সঙ্গে সঙ্গেই কামরার ভেতরে ঢুকলেন নিবারণবাবু। মোটা শরীর নিয়েও যে এত দ্রুত আর নিঃশব্দে কেউ নড়াচড়া করতে পারে, না দেখলে বিশ্বাসই হবে না।
‘সব ঠিক আছে তো?’ জানতে চাইলেন ব্যুরোর প্রধান।
‘জি স্যার।’ বাম হাত উঁচু করে শূন্যে ধরলেন নিবারণচন্দ্র। স্যালুট করার ভঙ্গিতে, কিন্তু স্যালুট না। অতি বিচিত্র একটা ভঙ্গি।
‘নাতসি বিজ্ঞানীদের আন্ডাবাচ্চাগুলো কই?’
‘সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে, স্যার। হাইরিক হিটলারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি একটাই।’
‘দারুণ। এককথায় চমৎকার।’ মিটিমিটি হাসলেন ব্যুরোর প্রধান, ‘কাকপক্ষীও টের পাবে না।’
‘একে নিয়ে কী করব, স্যার?’ ইঙ্গিতে জামশেদকে দেখালেন নিবারণবাবু।
‘চিন্তার কিছু নেই। ঘুম ভাঙার পর কিছুই মনে থাকবে না ওর। ওর স্মৃতির কিছু অংশ মুছে যাবে। যাও। বাড়ি নিয়ে যাও। ওর স্ত্রী আর বাচ্চা বাড়ি ফেরার আগেই করতে হবে। ওর স্ত্রী-কে ইস্কুলের মিটিং-এ আটকে রাখা হয়েছে কায়দা করে।’
‘জি স্যার। মহান হিটলার দীর্ঘজীবী হোন।’
ছয়
ঘুম ভাঙতেই বিরক্ত হল জামশেদ। সোফায় বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
অচেনা দুটো রোবট আর লোকজন আবাসন কোম্পানির গাড়িতে উঠছে। একজন একজন করে। একটা একটা করে।
কামরার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছেন নিবারণবাবু।
‘কী ব্যাপার? নীচের সমস্যার সমাধান হল?’
‘আজ্ঞে স্যার, হ্যাঁ।’ ঘাম মুছতে মুছতে বললেন নিবারণবাবু, ‘তেমন কিছু না। মাটির নীচের স্তরের কয়েকটা শিলার নড়াচড়া হয়ে গিয়েছিল, স্যার। সেইজন্য এত ভোগান্তি হল আপনার। আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কোম্পানি কিছু ক্ষতিপূরণও দেবে আপনাকে। আর কিছু হলে জানাবেন।’
হাসল জামশেদ।
নিবারণবাবুও হাসলেন। আন্তরিক হাসি।
‘এখন তবে যাই?’ বিনয়ের অবতার নিবারণবাবু।
‘হ্যাঁ, ভালো থাকবেন।’
জানালা দিয়ে তাকাল জামশেদ। দূরে গাড়িটা দেখা যাচ্ছে। গিন্নি আর বাচ্চাটা মার্কেট থেকে ফিরে আসছে।
হোম। সুইট হোম।
মনটা ভালো হয়ে গেল জামশেদের।
আইজ্যাক আসিমভের ‘লিভিং স্পেস’ গল্পের ছায়া অবলম্বনে
Tags: কল্পবিজ্ঞান, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, মিলন গাঙ্গুলী