বেহুলা
লেখক: মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
মায়া-পৃথিবী
সিলভার বেইজ প্রকাণ্ড ঘরটির সঙ্গে যেন মিশে গেছে মেয়েটির সুদীর্ঘ সুঠাম চেহারা। খুব ছোটো ঝকঝকে রুপোলি আর সোনালি-মেশানো চুল, পরনে একটা মোছা-মোছা নীল রঙের টি-শার্ট আর ছোটো শর্টসের নীচে ঝমঝম করছে স্বাস্থ্য। দাঁড়িয়ে-থাকা অবস্থাতেও তার মধ্যে চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতা স্থির বিদ্যুতের মতো স্তব্ধ, কিন্তু মুখটা একদম উলটো। বড়ো বড়ো নীল চোখে কেমন বালিকাসুলভ বিস্ময়, হাসি মাখামাখি। চোখ দুটো স্বচ্ছ আয়নার মতো।
ঘরের মধ্যিখানে শূন্যে একটা স্ক্রিন, সে কৌতূহল নিয়ে ওই স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরের একদম শেষ প্রান্তে একটা সোফা, পাশে একটা টেবিল, যার উপর কিছু গ্যাজেটস আর জলের বোতল রাখা, ঘরের সঙ্গে প্রায় মিশে সোফার উপর বসে আছেন দেবেশ—রোগা, ছোটোখাটো চেহারা, পরনে ঢিলেঢালা লিনেনের সাদা জামাকাপড়, চকচকে কামানো মাথা, ধারালো নাক, বসা চোখ আর একটু হাসি-মাখা ঠোঁটে হিসেবি ধূর্ততা।
হাত দুটো জড়ো করা থুতনির নীচে, তাকিয়ে আছেন দিতির দিকে।
‘কী বুঝছ বেব?’
‘দেখছি, ডার্লিং।’
দিতির ঝমঝমে খেলোয়াড়সুলভ শরীরের তুলনায় তার গলাটা অসম্ভব আহ্লাদী, আইসক্রিম যেন গলে পড়ছে গলায়।
‘হুম, আটজন আছে।’
‘লেফ্ট থেকে রাইট দেখো বেব।’
‘হাইট আমার মতো মনে হচ্ছে।’
‘একদম। তোমার ৬ ফুট, এদের ৫-১০ থেকে ৬-২-এর মধ্যেই।’
দিতি মন দিয়ে দেখছে এক-একজনকে: ‘হোয়াইট, ডার্টি ব্লন্ড, ব্রাউন আইজ়।’
‘না না, ব্রাউন নয়, দিতি। অ্যাম্বর, আমার মা-র ছিল। সূর্যের আলো ভেতর দিয়ে চলে যেত।’
‘এদের পারফেক্ট ফিগার বলত ৭০ বছর আগে, রাইট?’
দিতি আঙুল দিয়ে স্ক্রিনটাকে কাছে আনল।
‘ব্রেস্টগুলো একটু ভারী হতে পারত।’
‘ভারী হয়ে যাবে, তোমার মতো। আসলে কী বলো তো, দু-হাজার দশে মেয়েদের ব্রেস্ট, বিশেষ করে মডেলদের ব্রেস্ট প্রায় ছিল না বললেই চলে।’
দিতি-দেবেশের চোখের আরাম। গাঢ় নীল রঙের শর্টসের নীচে ওর পেশিবহুল পাগুলো যেন দৌড়োনোর জন্য প্রায় তৈরি। দিতিকে দেখতে দেখতে দেবেশের চোখ আত্মপ্রসাদে ভরে ওঠে। দ্বিতীয় মেয়েটিকে দেখতে দেখতে দিতি বলে, ‘এর হাইট আমার মতনই মনে হচ্ছে একদম। চুলগুলো খুব সুন্দর।’
তারপর একেবারে পৌঁছে যায় পাঁচ নম্বর মেয়েটির দিকে। চকচকে বেগুনি কালো গায়ের রং। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া একমাথা চুল, পুরু ঠোঁট, বড়ো বড়ো একজোড়া সুন্দর চোখ: ‘গর্জিয়াস!’ মুগ্ধ সে।
‘হুম। কালো, সাদা, হলদে, বাদামি সবই রাখা হচ্ছে।’
‘কিন্তু শুধু বেঁটে না?’ দিতি বলে উঠল।
‘না, বেঁটেখাটো, মোটা এদের দিয়ে চলবে না। তা ছাড়া আপার আর লোয়ার বডির মধ্যে একটা মানানসই সামঞ্জস্য থাকতে হবে।’
এবার দিতি ফিরে তাকাল দেবেশের দিকে, একটা দুষ্টু হাসি ফুটে উঠল তার মুখে।
‘তোমার মাথায় সব একদম পরিষ্কার তা-ই না?’
‘হ্যাঁ সুইটহার্ট। সব কন্টিনেন্ট থেকেই চেহারার প্রতিনিধিত্ব আছে।’
এবার লম্বা লম্বা পা ফেলে দিতি এগিয়ে গেল দেবেশের দিকে, প্রায় তার কোলের উপর উঠে বসল। দেবেশ তার গালে আঙুল বোলাতে থাকল: ‘আর কুড়ি বছর? তারপর সব মেয়ে এরকম দেখতে হবে?’
‘এইরকম, অনেকটা। ইয়েস ডিট্টি ডার্লিং।’
‘আর মেয়েদের বাকি যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য আছে, সেগুলোর কী হবে?’
দেবেশ একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দিতির দিকে।
এর আগে দিতি কখনও এত প্রশ্ন করেনি তো।
‘বৈশিষ্ট্য? আরে, এদের চরিত্রে নানারকম বৈশিষ্ট্য থাকবে, অর্গানাইজ়্ড হবে, স্ট্রাকচার্ড হবে, আর্টিস্ট হবে, মিউজ়িশিয়ান হবে, রিসার্চ করবে… তুমি কি আমাকে এত দেহসর্বস্ব ভাবো নাকি?’ বলতে বলতে দিতিকে আরও কাছে টেনে আনল দেবেশ। তাকে কোলে বসানোর সাধ্য নেই। বয়সের ছাপ না পড়লেও, দেবেশ প্রচুর স্টেইম সেল ইত্যাদি ট্রিটমেন্ট করেছে, সে নিজে কিন্তু জিন থেরাপি করায়নি। এমনিতেই সে মহাশক্তিমান। আজকের পৃথিবী চার-পাঁচটা দ্বীপে ভাগ হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই; তাদের দ্বীপ ‘মায়া পৃথিবী’ তার ইচ্ছায় এবং নির্দেশেই বানানো। হিরণ্য তার প্রধান সাহায্যকারী।
দিতির পা কোলে তুলে নিয়ে পায়ের পাতায় হাত বোলাতে বোলাতে দেবেশ বললে, ‘তুমি তো অ্যাথলিট। অ্যাথলেটিক্স কিন্তু বডিশেপ আর জিনের কম্বিনেশন।’
‘তুমি তো আবার অবসেস্ড, তোমার তো সব চাই।’
দিতির পায়ের দীর্ঘ টানটান পেশি, তার মসৃণ তেল-পিছল ত্বক, তার হাড়গুলো যেন বাইরে থেকে দেখলেও মনে হয় টাইটেনিয়াম দিয়ে বানানো। তার হাতগুলো যেন সাপের শরীরের মতো মসৃণ নমনীয়, তেমনি শক্তিমান হয়ে ওঠে যখন সে টেনিস খ্যালে, সাঁতার কাটে। দেবেশের তর্জনী চলছে তার সমস্ত শরীর দিয়ে…
‘তুমি তো আমার স্বপ্ন দিয়ে গড়া, ডার্লিং।’
তারপর তার শরীরের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান সদ্যকিশোরীর মতো নিষ্পাপ ফুল-কুঁড়ি ঠোঁটে একটা দীর্ঘ চুম্বন দিল দেবেশ।
‘তুমি আমার সার্থক হওয়া স্বপ্ন। তোমার জন্য আমি হিরণ্যর কাছেও কৃতজ্ঞ, ডার্লিং।’
‘আচ্ছা একটা কথা বলো, অ্যান্ড্রয়েড নয় কেন? তোমার তো সিরিজ় অব অ্যান্ড্রয়েডস আছে।’
দেবেশের ধূর্ত মুখেও একটা সত্যিকারের হাসি ফুটে উঠল।
‘এই কারণে, ডার্লিং।’
‘কী কারণ?’
‘অ্যান্ড্রয়েড প্রশ্ন করবে না। তার কৌতূহল নেই।’
দিতির মুখেও হাসি ফুটে উঠল।
আরও চুমু নেমে এল দিতির ঠোঁটে, গলায়। তার গলায় এসে স্থায়ী হল দেবেশের ঠোঁট। তারপর হঠাৎ নিজেকে বিযুক্ত করে নিয়ে হেসে উঠল সে।
একটু অদ্ভুত হাসি। কিছুটা মনে-পড়া, কিছুটা রহস্য-মেশানো।
‘কী? কী হল?’
‘কিছু না।’
‘কী? বলো-না, হাসছ কেন?’
আরও চওড়া হল দেবেশের হাসি।
‘কিছু তো একটা হয়েছে।’
‘তোমার গলা, সুইটহার্ট।’
‘আমার গলায় কী হয়েছে?’
বলে নিজের গলায় অস্বস্তির হাত রাখল দিতি।
‘গলা মানে গলা না—তোমার গলার আওয়াজ।’
‘আমার ভয়েস? মানে?’
‘তোমার গলার আওয়াজটা আমার মনের ইচ্ছে। যখনই তুমি ওই ভীষণ তুলতুলে আধো-আধো গলায় কথা বলো, আমার ভীষণ ভালো লাগে, তোমার এই কচি মুখটার মতোই।’
দিতির প্রায় স্বচ্ছ নীল চোখে ঝিলিক খেলে গেল বিদ্যুৎশিখার মতো। এতক্ষণে যেন সে কথাটা অনুধাবন করছে।
‘তোমার শরীরের এই বাকি স্ট্রাকচারের সঙ্গে তোমার গলাটা ছিল মানানসই, এরকম মিষ্টি ছিল না, তাই তোমার ল্যারিংস, গলা আর ঘাড়ের গঠনকে খানিকটা ম্যানিপুলেট করতে হয়েছে। এখন তো তোমাকে বলতে পারি, সোনা। তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে?’
তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দিতি।
তারপর খুব আস্তে আস্তে বলল, ‘দেবেশ, তুমি আমার গলা বদলানোর জন্য এত কিছু করেছ?’
‘আরে তাতে কী? শরীর তোমার অনেকখানি ন্যাচারাল, ডার্লিং—তোমার মা অনেকটা তোমার মতোই ছিলেন।’
দেবেশ একটু আড়মোড়া ভেঙে উঠব-উঠব করল। দিতির মা ছিলেন একজন নামকরা জার্নালিস্ট। একটা বড়ো পুনর্বাসন মিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি, পুরোনো পৃথিবীর আরও অনেক পেশাদার মানুষের সঙ্গে। মিশনটা সফল করতে দেওয়া যেত না। প্রবলভাবে আক্রান্ত হয়ে পালিয়ে তাদের ভূখণ্ডে এসে পড়েছিল ওই মিশনের কিছু মানুষ, তাদের মধ্যে একজন দিতির মা। সেই সময়ে অনেক মহিলার থেকে ডিম্বাণু সংগ্রহ করে, হিমায়িত করে রেখে দেওয়া হয়। দিতির মা বেশি দিন বাঁচেননি। তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর বাদে দিতির জন্ম।
দিতি উঠে দাঁড়াল। আবার ফিরে গেল ছবিগুলোর কাছে।
‘এরা তো প্রায় ফাইনাল? এদের মতো ব্রিডই থাকবে এরপর আমাদের এই মায়া-পৃথিবীতে?’
‘হ্যাঁ এরাই।’
সে বলল তার ওই আহ্লাদে গলে-পড়া গলায়, ‘তাহলে এখানে বেঁটে, মোটা, ক্লামজি, আনফিট, মিডিওকার, প্রতিভাহীন মেয়ে থাকবে না?’
আজকের দিনটা একটু অন্য। এত প্রশ্ন তো করে না দিতি!
‘এতে অবাক হবার কী আছে? গোরুর কথা ভাবো?’
‘গোরু?’
‘হ্যাঁ। একটা সময়ের পর থেকে গোরুর ভ্যারিয়েশন কত কমে গিয়েছিল, জানো? কত রকমের গোরুর ব্রিডিং করা হবে—এটা মানুষ ঠিক করত। গোরুর দুধ দেবার উপর নির্ভর করে। আর প্রথম মেয়েদের ব্রিড ঠিক করা হচ্ছে, নেক্সট স্টেজে পুরুষদের নিয়েও কাজ শুরু হয়ে গেছে। হিরণ্যর ল্যাবের ওটা নেক্সট স্টেপ প্ল্যান্ড। তবে এমনিতেই পুরুষদের সংখ্যা এত কমে গেছে, সেটাই সমস্যা।’
আগের প্রসঙ্গে ফিরে গেছে দিতি: ‘অনেক দুধ দিতে না পারলে সেই ব্রিডকে তো ধীরে ধীরে অযত্ন করে মেরে ফেলা হত? মানে পুরোনো পৃথিবীতে তো… এখানেও তাহলে তো…’ আইসক্রিমের মতো গলে-পড়া গলায় যে-কোনো কথাই তার ওজন হারিয়ে ফ্যালে…
‘কী আর করা… নতুন করে পৃথিবী বানাচ্ছি আমরা, খুঁত থাকলে তো চলবে না, যখন আমাদের হাতে অপশন আছে।’
সকাল হয়েছে।
ছোটো ছোটো বেগুনি বনফুলে ছাওয়া বিস্তীর্ণ প্রান্তর, একটু উঁচুনীচু। বেশ খানিকটা গিয়ে গড়িয়ে পড়েছে বিস্তীর্ণ জলরাশিতে। পাঁচ দিন রোদ-ঝলমল হবার পর আজ মেঘলা, কাল হয়তো বৃষ্টি হবে। আবহাওয়া এত চমৎকার নিয়ন্ত্রিত এখানে। ওই প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে রাস্তা, তার মধ্যে দিয়ে দৌড়োচ্ছে দিতি। তার জ্ঞান হওয়া অব্দি অ্যান্ড্রয়েড আর মানুষের মধ্যেই আছে সে। তাদের এখানে মানুষ খুব কম, উত্তরের দিকে বেশ কিছু মানুষ আছে, কিন্তু সেখানে সে যায়নি কখনও। সেটা নিয়ে ভাবেওনি। ষোলো বছর বয়স থেকে সে দেবেশের সঙ্গিনী। দেবেশ ছাড়া আর মাত্র কয়েকজন মানুষকেই দেখেছে সে। সবাই তাকে বলে সে আনন্দময়ী। সে অনেক কথা বলে, হাসে, তার মন আনন্দে ভরা। কী সুন্দর পৃথিবী তাদের।
কিন্তু আজ ওই আকাশের মেঘ যেন ঢুকে পড়েছে তার মধ্যে। সে আরও জোরে দৌড়োচ্ছে। তার পা অসম্ভব একটা শক্তিতে মাটিতে পড়ছে।
কিছু ভালো লাগছে না তার।
তার গলাটা এরকম অসহ্য কেন?
উত্তরে কারা থাকে?
***
আবার পৃথিবী
অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশে জায়গাটার অস্তিত্ব নেই। একসময়ে ছিল। এখন শুধু ধু ধু বরফে ঢাকা প্রান্তর। পৃথিবীর প্রায় ফুরিয়ে-যাওয়া হিমবাহের যা অবশিষ্ট আছে, তার মাঝখানে একটা বিশাল ফাটল, যেটা খুব কাছাকাছি না এলে দৃষ্টিগোচর হয় না। কয়েকশো ফুট খাড়া ঢাল বরাবর নেমে গেলে দেখা যায় বিশাল আকৃতি স্বচ্ছ ডোমের মাথাগুলো। মাইলের পর মাইল দিগন্তবিস্তৃত ডোম আর তাদেরকে যুক্ত করে রেখেছে টানেল। উপর থেকে দেখলে স্বচ্ছ সিলিং-এর মধ্যে শুধু সবুজ আর সবুজ। কোনো অজ্ঞাত পথে সূর্যরশ্মি আসছে, সবুজে সোনা-রঙে মাখামাখি চারদিক। এরকম একটি ডোমের মধ্যে একটি ঘর। স্বচ্ছ। চারপাশে শুধু অতি যত্নে বাঁচানো অতীত পৃথিবীর চারাগাছেরা—বাঁচার আশায় ঊর্ধ্বগামী। ঘরের মাঝখানে আরামদায়ক একটি চেয়ার, সামনে একটি টেবিল, চেয়ারে বসে মহামায়া। তার হাতে মাটির টবে একটি ফুলের গাছ, মায়ের মমতায় হাত বোলাচ্ছেন তাতে। তাঁর পায়ের কাছে একটি ছোট্ট ছানা জাগুয়ার। নিজের মনে বসে থাবা চাটছে। উলটোদিকে হলোগ্রামে উপস্থিত একজন মানুষ, আলখাল্লার মতো পোশাক, চুল ঝুঁটি করে বাঁধা, হাতে একটি বাদ্যযন্ত্র মাঝে মাঝেই বাজাচ্ছেন।
‘কেমন বুঝছেন? নতুন হাতে এল। চ্যারাঙ্গ।’
‘বেশ লাগছে তো। আপনার হাতে তো সব সময়ই নতুন নতুন তারযন্ত্র।’
মহামায়ার মুখে, বসার ভঙ্গিতে শান্ত-সমাহিত ভাব, মুখে স্পষ্ট উৎফুল্লতা।
‘আর আপনার হাতে নতুন নতুন ফুল।’
মহামায়ার মুখের উৎফুল্লতা হাসিতে পরিণত হল।
‘সত্যিই তা-ই। কী সুন্দর ফুলটা, কৃষকরা শেখাচ্ছেন, আমাদের অন্তত একটা ফুল ফোটাতে হবে—এটা আমার তৃতীয় ফুল, ফ্র্যানজিপেনি…’ মহামায়ার চারপাশ সাদা রঙের মধ্যে মৃদু হলুদ ছিটের ফুলগুলোর সুগন্ধে ভরে আছে। মহামায়া সুগন্ধ নিলেন ফুলের উপর নাক এনে—’গন্ধটা তো পাচ্ছি না, কিন্তু দেখতে তো ভারী সুন্দর।’
দনার বলে উঠলেন, ‘এটা যে কী আনন্দ দেয়, একটা সৃষ্টিকে আবার বাঁচিয়ে তোলা নিজের হাতে। আমাদের চাষিরা এই অর্ধেক বছরে মিলেট, রাম্বুটান ফল, কাসাভা, রসুন—এই সমস্ত কিছু ফিরিয়ে এনেছে। একটু একটু করে এগোচ্ছি আমরা।’
গাছটাকে ঘরের কোণে অন্যান্য কয়েকটি গাছের সঙ্গে রেখে এসে বসলেন।
দনার বললেন, ‘সত্যি আপনারা যে কী যত্ন করে এই অসাধ্যসাধন করছেন।’
মহামায়া চোখ তুলে তাকালেন—বড়ো বড়ো চোখ, দৃপ্ত মুখ, জলপাইপাতার আলগা লাবণ্য, ভারী শরীর, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, রুপালি-কালো মেশানো, চোখের দু-পাশের কপালের বলিরেখায় জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, পুরু ঈষৎ ছড়ানো ঠোঁটে দৃঢ়তা, পরনে রংচঙে আলখাল্লার মতো পোশাক, গলায় পুরোনো পৃথিবীর মাটিতে বানানো একটি হার, যা তাঁর একমাত্র অলংকার—’আজ মনটা সত্যি খুব ভালো লাগছে। বড়ো তৃপ্তি। আমাদের কাছে সময় আছে, তাই বড়ো যত্ন করে এক-একটা জিনিস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’
তাঁর অন্যমনস্ক মায়াভরা আঙুল চারাগাছটির এক-একটা পাতায়।
‘পুরোনো পৃথিবীতে যত্ন করার সময় তো আর মানুষের কাছে ছিল না। আর তারপর তো এখানে “আবার পৃথিবী”-তে কতগুলো দশক পেরিয়ে গেল, একটা জেনারেশন চলে গেল সারাতে, সারতে। এত আঘাত, কষ্ট-নিয়ে-আসা মানুষ এখানে।’
‘সেটা ঠিক।’ দনার বললেন, ‘তবে ভাগ্যিস আপনাদের “আবার পৃথিবী”-তে পুরোনো পৃথিবীর অনেক জিনিস আগে থেকে সঞ্চিত ছিল। তাই চিকিৎসা আশ্রয় হয়েছিল ওই মানুষগুলোর।’
‘আমিও তো তাদেরই একজন।’
মহামায়ার পূর্বনারী ছিলেন বৈজ্ঞানিক। পুরোনো পৃথিবীর উত্তর মেরুর এই বিশাল গবেষণাগারে যখন বহু প্রাকৃতিক জিনিস সঞ্চয় করে রাখা হচ্ছিল, তিনি তাঁদের মধ্যে একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী ছিলেন আর তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন যোদ্ধা। তাঁদের দুই জেনারেশনের পর মহামায়ার জন্ম। তিনি এখানকার গবেষণা বিভাগের প্রধান।
চামুণ্ডা তাঁদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিভাগ। ‘আবার পৃথিবী’-তে নারীরা সংখ্যা গরিষ্ঠ। তাই গবেষণাতেও মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি।
দনার হঠাৎই বলে উঠলেন, ‘মহামায়া, আপনাকে একটা জিনিস দেখাই।’ বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই মহামায়া আর দনারকে ঘিরে তৃতীয় একটা অদৃশ্য স্ক্রিন উপস্থিত হল।
একটা দিগন্তবিস্তৃত স্বচ্ছ নীলাভ জলরাশির মধ্যে তাঁরা দুজন—মুহূর্তমধ্যে জলে ডুব দিলেন তাঁরা। সবুজ প্ল্যাংকটন গাঢ়, হালকা, পান্না, মাটি—সবুজ গুল্মের রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে রংবেরঙের মাছ, পাশ দিয়ে সাঁতার কেটে গেল এক অতিকায় কচ্ছপ।
মহামায়ার মুখ থেকে অস্ফুট একটা আওয়াজ বেরোল।
‘জলের উষ্ণতা, পিএইচ ব্যালেন্স আর নিখুঁত ইকোসিস্টেম।’ দনার বললেন।
বলতে বলতে তাঁরা এক অপূর্ব সবুজ উপত্যকায়, উঁচুনীচু ঢালু জমি, তার মধ্যে দিয়ে যেন তাঁরা ভেসে চলেছেন। হঠাৎই একটা দিকে হালকা বেগুনি ঘাসফুলে এক প্রায় সমতল প্রান্তর যেন গড়িয়ে গেছে আর-একদিকে।
‘দু-তিন রকমের ভ্যারাইটির ঘাসফুল আছে—একদম নিখুঁত।’
‘মায়া-পৃথিবী’
মহামায়ার চোখে একটু রাগের পূর্ভাবাস, চোয়ালের কাঠিন্যে, ঠোঁটের হাসিটুকুর রেশমাত্র আর নেই।
তিনি একটু নড়ে বসলেন।
‘কেন আমাকে এগুলো দেখান দনার? আমি একদম জানতে চাই না। নিজের পৃথিবীতে দেবেশ, হিরণ্য যা করছে, করুক-না, নিজের মতো থাকুক মায়া-পৃথিবী। আমি বারবার আপনাকে বলেছি, আমি জানতে চাই না। কেন আমাকে দেখান? থাক-না ওরা ওদের নিজেদের মতো?’
‘ওদের নিজেদের মতো থাকাটার সীমা কোথায়, মহামায়া? ওদের পৃথিবীতে ঘাস থেকে মানুষ ওদের মাপে, ওদের পছন্দে নিখুঁত করে ফেলছে… না করতে পারলে ছুড়ে এককোণে ফেলে দিচ্ছে… শেষ হবার জন্য… আরও দেখবেন?’
তাঁদের চারদিক জুড়ে এখন ওই মেয়েগুলি, প্রায় এক উচ্চতা, গঠন, সাদা, বাদামি হলুদ, কালো গায়ের রং, নীল সবুজ, অম্বর, ধূসর, কালো চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। নড়নচড়ন নেই—অতিকায় পুতুলের মতো।
মহামায়া উঠে দাঁড়িয়েছেন, তাকিয়ে আছেন, নিস্পন্দ-নিশ্বাস পড়ছে না আর—
‘এদেরকে নিয়েই?’
‘হ্যাঁ। শুধুমাত্র এদের মতো দেখতে হবে মায়া-পৃথিবীর মেয়েরা।’
মহামায়া যেন নিজের মধ্যে নেই… তারপর কোন সুদূর থেকে যেন বলে উঠলেন, ‘কীভাবে শেষ করে এনেছিল সব কিছু। যুদ্ধ বাধিয়ে বেরোতে দিল না কত মানুষকে। আরেকটা গোটা মহাদেশ তো বৃষ্টিহীনতায় শেষ হয়ে গেল। পরের পর সাইক্লোন, টাইফুন, চার-চারখানা অতিমারি। মনে আছে দনার, পলিউশনের মাত্রা রাতারাতি বেড়ে মারা গিয়েছিল কত কোটি মানুষ?’
‘সত্যি কি তা-ই মহামায়া, কিছু লোকে তো বলে, বাড়ানো হয়েছিল…’
‘সেই। উদ্ধারকার্য কথাটাই উঠে গেল। কে কাকে উদ্ধার করবে?’
মহামায়ার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, চোখের আলোটুকু নিবে এসেছে, অন্যমনস্ক সুরে বলে উঠলেন, যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন, ‘কীভাবে গড়ে উঠেছে আমাদের “আবার পৃথিবী”… কী ছিল আমাদের? আহত, বিধ্বস্ত, পঙ্গু মানুষদের সক্ষম করতেই তো কেটে গেছে একটা পুরো জেনারেশন… আমরা এখন শুধু সৃষ্টিতে আছি দনার, বহু কষ্টে, আজ এই জায়গাতে পৌঁছেছি।’
মহামায়ার বুক ওঠানামা করছে উত্তেজনায়, মুখটা একটু লালচে।
‘আমরা আলাদা পৃথিবী… আমরা…’
তার কথা কেটে দিল দনার, ‘পুরোনো পৃথিবীতে ইউনাইটেড নেশনস যদি শক্তিমান হত… প্রথম থেকে নিরপেক্ষ হত, পরিস্থিতির হাল ধরত…’
কথাটা সঠিক নিশানায় লাগল।
‘খবরদার একদম বলবেন না আপনি ওদের কথা। কিচ্ছু করেনি ওরা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে বিনা কারণে শুরু করা যুদ্ধ, জেনোসাইড, ক্ষমতার আস্ফালন… শেষ হয়ে যাওয়া…’
‘সেটাই তো, কিছু না-করাটাও তো…’
মহামায়া এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়ালেন দনারের দিকে, চোখ দুটি জ্বলছে, মুখ ভ্রূকুটি-কুটিল…
‘এই করে এসেছেন আপনি, আপনার পূর্বপুরুষরা… সেই শুরু থেকে… সব সময়।’
দনার চুপ। মূর্তির মতো স্থির। শুধু চোখে একটু চিকিমিকি।
তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন মহামায়া। আলোকিত চারদিক। টানেলের পর টানেল। ডোমের পর ডোম। স্বচ্ছ আকাশ-ছোঁয়া উচ্চতায় কোনো অদৃশ্য পথে আসা সূর্যের আলোয় ঝলমলে চারদিক। মহামায়া হেঁটে চলেছেন আনারসখেতের মধ্যে দিয়ে, একটু আগে পেরিয়ে এসেছেন মিষ্টি আলুর খেত। হেঁটেই চলেছেন… এত বিস্তৃত এই খেতগুলি, এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে বোঝা সম্ভব নয় এটা পুরোনো পৃথিবী নয়। এরপর একটা খোলা জায়গা, ইতস্তত বেঞ্চ ছড়ানো, অনেক বুনোফুলের ঝোপঝাড়। সামনে খোলা মাঠ। মাথার অনেক উঁচুতে স্বচ্ছ সিলিং, কিন্তু মানুষের দৃষ্টিশক্তি অতদূর পৌঁছোয় না। উলটোদিকে অনেক দূরে নতুন করে শুরু হয়েছে অন্য খেতখামার। মহামায়া কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালেন এক মুহূর্ত। পাশে হঠাৎ করে আবার এসে উপস্থিত দনার।
‘কোথায় চললেন?’
‘এটা চামুণ্ডার মিটিং প্লেস।’
তার দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিলেন মহামায়া, ‘ও। তা চামুণ্ডার বাকি দুই প্রধান কোথায়?’
‘আসছে।’
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ওদের। আদিয়া আর তারা। হেঁটে আসছেন কথা বলতে বলতে।
আদিয়ার ছোটোখাটো মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের মুখ। কচি ফলের মতো সতেজ। তারা বেশ লম্বা, ভারী স্থিতধী চেহারা তার, প্রাচীন নেটিভ ইন্ডিয়ান ধাঁচের। চামুণ্ডার দুই সেকশনের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক, নিজেদের কাজে নিবেদিত প্রাণ, গবেষণার সঙ্গে শিক্ষকতার কাজও করেন।
‘কিন্তু ওঁরা এত তাড়াতাড়ি জানলেন কী করে? ডাকলেন ওঁদের?’
এবার দনারের দিকে মুখ ফেরালেন মহামায়া, ‘আমরা সবাই মানসিকভাবে সংযুক্ত। আমাদের কারও শরীরের প্যারামিটার ওঠানামা করলে অন্যরা বুঝতে পারি—পুরো চামুণ্ডারাই। এর পরের সমস্যাটা কী হবে, বুঝতে পারছেন দনার?’
‘কী, মহামায়া?’
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন মহামায়া, ‘এ অভিনয় করে কী লাভ, দনার? কেন আপনি তারা আর আদিয়ার খোঁজ নিচ্ছিলেন?’
‘সে তো ওরা…’
‘থামুন দনার! এনাগ্রাম করে নিজের নামটা আন্তর্জাতিক মতো করে ফেলেছেন। স্পেস স্টেশনে থেকে সব দিকের খোঁজ রাখেন। যেখানে ইচ্ছে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু কাজটা তো একই করে চলেছেন। সেই আদি-অনন্তকাল। মায়া-পৃথিবীর খবর আমার কাছে নিয়ে এলে তার অভিঘাতে কী হবে, সেই দূরদৃষ্টি আপনাদের আবহমানকাল থেকে আছে।’
সামনের দিকে তাকালেন তিনি, ‘আপনি জানেন, কেন বাকি পৃথিবীগুলোর খবর ওদের, বিশেষ করে আদিয়ার কাছ থেকে দূরে রাখা হয়, ওদের অসম্ভব প্রতিক্রিয়া হয়… বিশেষ করে দেবেশ আর হিরণ্য… ওরা একেবারে ওদেরকে সহ্য করতে পারে না।’
ওদিকে তারা আর আদিয়ার চলার গতিবেগ বেড়ে গেছে… ওঁরা বোধহয় মহামায়ার বাড়তে-থাকা উদ্বেগ অনুভব করতে পারছেন।
দনার শূন্যে ভেসে ভেসে মহামায়ার চারপাশে ঘুরতে থাকেন।
‘কিন্তু মহামায়া, দেবেশ আর হিরণ্যকে আটকাতে গেলে চামুণ্ডার মাথাদের তো চাই।’
‘দনার, কী বলি, বলুন তো… আপনাকে নিয়ে!’
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে। আদিয়া দুই হাতের পাতায় মুখ ঢেকে বসে আছে। একটানা প্রায় চিৎকার করে কথা বলে তার গলার আওয়াজ সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। মুখ সম্পূর্ণ লাল। তার কোমল বালিকা-মুখ দেখে কল্পনা করাও অসম্ভব যে কী তীব্র তার আবেগ, কী আগুনে তার ক্রোধ। সে পারলে এই মুহূর্তে গিয়ে মায়া-পৃথিবী ধ্বংস করে আসে। তার শরীরের প্রত্যেকটা রক্তকণিকা জ্বলছে।
‘এইভাবে শেষ করেছে পুরোনো পৃথিবী… এদের পূর্বপুরুষরা এখন সব নিজেদের ইচ্ছেমতো, মনের মতো যেভাবেই হোক…’
তারা তার পাশটিতে। কোমর-ছাপানো চুল উঁচু করে বাঁধা। কপালে কয়েকটা আঁচড় ছাড়া তাঁর মুখ ভাবলেশহীন। এখন অব্দি একটাও কথা বলেননি।
তাঁর মধ্যে রয়েছে আগ্নেয়গিরি, কিন্তু তিনি যেন পৃথিবীর পূর্বনারীদের স্থৈর্য নিজের মধ্যে ধারণ করে রেখেছেন।
‘দেবেশ বা হিরণ্য কিন্তু নশ্বর।’ তারা বলে উঠলেন।
সবাই তাঁর দিকে তাকালেন।
‘আর মনে রাখতে হবে, দেবেশ মাথা, হিরণ্য চালক। আর দেবেশের বুদ্ধি, পরিকল্পনা—সব নিজের মধ্যেই সীমিত। সে একমেবাদ্বিতীয়ম্। জিনিয়াস। মেগালোম্যানিয়াক। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বহুবার হয়েছে। এদের কোনো উত্তরসূরি হয় না।’
কী যেন এক সম্ভাবনা ঘূর্ণিপাকের মতো তৈরি করছে এক হাওয়া স্তম্ভ তাদের মাঝখানে, কী যেন এক অমোঘ দৈববাণী ঘোষিত হতে চলেছে। দনারের বুকের মধ্যে আনন্দের এক মৃদু বাতাস খেলে গেল।
তারা আবার বলে উঠলেন, ‘নিগ্লোরিয়া ফাইলারি—ব্রেন ইটিং অ্যামিবা, সাউথ আফ্রিকায় ছিল, বহু বহুকাল আগে। কয়েকদিন আগেই পুরোনো পৃথিবী থেকে পুনরুজ্জীবিত করেছি আমরা। অন্যান্য সৃষ্টির সঙ্গে। স্নানের যে-কোনো জলে মিশিয়ে দিলে নাকের মধ্যে দিয়ে শরীরে প্রবেশ—তারপর মস্তিষ্কে। লক্ষণ দেখে চিকিৎসায় এটার সম্ভাবনা চিন্তা করার আগেই…’ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন উনি।
‘মস্তিষ্ক নিয়ে বড়ো অহংকার দেবেশের। তা-ই না?’
দনার হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে জোরে জোরে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শুরু করলেন।
***
ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে বাজাতে বাজাতে থেমে গেলেন তিনি—মহামায়া, আদিয়া, তারা তিনজনই তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে।
‘কী?’
‘যেভাবে এতদিন এখানকার কথা ওখানে নিয়ে গিয়ে সমস্যা সমাধান করেছেন আপনারা, সেটা যে আর হবে না, দনার।’
‘মানে? আপনি এরকম বললে কি হবে? আমি, আমার পূর্বসূরিয়া এ কাজ করেছি, কিন্তু সে তো বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য? আপনি ভেবে দেখুন?’
‘আমরা কোনো সাহায্য করতে পারব না, যতক্ষণ না ওখান থেকে কেউ সাহায্য চাইবে। আর নিজে কাজটা করার জন্য প্রস্তুত হবে।’
‘কী বলছেন? কে চাইবে সাহায্য ওখান থেকে…’
দৃশ্যত ভেঙে পড়েছেন তিনি।
‘মহামায়া, ওখানের মানুষরা দেবেশ, হিরণ্যর হাতে তৈরি। জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড। আর বাকি যারা আছে, তারা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তারা কোনোদিন দেবেশদের কাছে পৌঁছোতে পারবেই না, তাহলে তো কোনো লাভ নেই।’
আদিয়া উঠে এলেন দনারের কাছে।
‘আমাদের প্রয়োজন একজন বেহুলার।’
দনার তাকিয়ে আছেন, তাঁর চোখে কোনো ভাষা নেই।
একটু বাদে সংবিৎ ফিরে পেলেন তিনি…
‘বেহুলা—তার মানে?’
এবার তিনজন একসঙ্গে হেসে উঠলেন। অট্টহাসি। মহামায়া, আদিয়া, তারা। অনন্ত জীবনপ্রবাহের সন্ধিক্ষণে যেন বেজে ওঠে এরকম অট্টহাসি। পৃথিবী আড়মোড়া ভাঙে, ভূগর্ভে প্লেটগুলি নড়েচড়ে ওঠে, সাগরের অতলে শুরু হয় ভূমিকম্প—দনারের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
আদিয়া বললেন, ‘বেহুলা একটা কোড নেম—আমরা ব্যবহার করি। বেহুলা কেমন ছিল, দনার?’
একটু ভাবলেন তিনি।
‘জেদি, সাহসী?’
‘দুটোই। কিন্তু তার চেয়েও বেশি। সমস্ত পৃথিবীর বাধা, অবিশ্বাসের বিরুদ্ধে নিজের নৌকো বেয়ে নিয়ে যাওয়া। নিজের বিশ্বাসটা পৃথিবীর কাছে মৃত হলেও।’
‘ওহ্।’
দিক্চক্রবালের দিকে তাকিয়ে আছেন মহামায়া—’এই বিশেষ ট্রেইটটা ভেতরে থাকলে, যা কিছু হোক, যত তাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হোক, কোনো একটা কারণে জেগে উঠবে আর সেই বিশ্বাস ঠিক পথ খুঁজে নেবে।’
এবারে আদিয়া—এতক্ষণে তার মুখে শরতের মেঘের মতো কোমল ছায়া—‘ওখানে অবশ্যই একজন বা তার বেশি বেহুলা আছে। মানে থাকার সম্ভাবনা খুব বেশি।’
‘অসম্ভব, আদিয়া… কীভাবে?’
‘পঞ্চাশ বছর আগে চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, সমাজকর্মী, সাংবাদিক, ইঞ্জিনিয়ার—এরকম অনেক পেশার মানুষ মিলে প্রায় ধ্বংস-হয়ে-যাওয়া এক দেশে যাবার প্রস্তুতি শুরু করে, নতুন করে শুরু করার পরিকল্পনা নিয়ে, পরিদর্শক হিসাবে। একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মিশন। কিন্তু পৃথিবীর কিছু দেশ চাইছিল না, তারা ছাড়া ওখানে কেউ পৌঁছোয়—’
‘কেন?’ দনার বলে উঠলেন।
‘কেন আবার? একটা বিশেষ মিনারেল পাওয়া যাচ্ছিল ওই দেশে, অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য আর জরুরি। যা-ই হোক, পুরো দলটাকেই আক্রমণ করা হয়, তাদের একটা অংশ গিয়ে পৌঁছোয় “মায়া-পৃথিবী”-তে, গবেষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক… ওখানে বেঁচে-যাওয়া মানুষদের বংশধরদের মধ্যে ওই বেহুলা ট্রেইট থাকার সম্ভাবনা প্রবল, ওই দলটাতে ছিল প্রবল আদর্শবাদী নির্ভীক কিছু মানুষ।’
সবাই চুপ।
দনার প্রায় নেচে উঠলেন, ‘আছে। তাহলে পথ আছে। আমার কাজই তো খোঁজ রাখা। আমি খোঁজ রাখব, কোন মানুষ পথ খুঁজছে, তারপর গিয়ে পৌঁছোব তার কাছে।’ ফ্রেনজিপেনি ফুলের গন্ধ হঠাৎ করে বেড়ে উঠল… চেরাঙ্গর মিষ্টি মূর্ছনায় ভরে উঠল চারদিক।
***
মায়া-পৃথিবী
চুপচাপ কাটতে থাকে কয়েকদিন।
সবাই ব্যস্ত। দিতিও নিজেকে ব্যস্ত রাখে।
খ্যালে, সাঁতার কাটে, দৌড়োয়, রান্না করে।
কথা বলে না।
তার সঙ্গে থাকা অ্যান্ড্রয়েড সিতারা, তার সমবয়সি দেখতে, বছর দুই তার সঙ্গে আছে। সকাল, দুপুর, বিকেল তাকে অভিবাদন জানায়, জিজ্ঞাসা করে, কেমন আছে।
প্রথম দিন সে বলে ভালো।
দ্বিতীয় দিন বিকেলে সে বলে, ভালো না।
সিতারা কাছে আসে। তার পাল্স ধরে। দুজনের মাঝখানে ভেসে ওঠে নৈর্ব্যক্তিক স্ক্রিন, তাতে তার শরীরের সমস্ত প্যারামিটার মাপা হয়ে যায়। হরমোন।
‘দিতি, তোমার মানসিক অবসাদ হচ্ছে?’
সে সিতারার হাত ছাড়িয়ে উঠে যায়। মাঝখানের স্ক্রিন মিলিয়ে যায় শূন্যে।
‘ভিভালডি চালাও সিতারা। পারফেক্ট মিউজ়িক। পারফেক্ট ওয়ার্ল্ড।’
তৃতীয় দিন একই প্রশ্নে তার বালিকা-মুখের নিষ্পাপ চোখে প্রথম ক্রূরতা আসে।
তারপর সে উলটে জিজ্ঞাসা করে, ‘আমি কেমন আছি, সিতারা?’
সিতারা চুপ।
‘আমার গলাটা কেমন, সিতারা?’
সিতারা উত্তর দেয় না।
‘আমার গলাটা কেমন, সিতারা?’ তার আহ্লাদী গলায় তার ভেতরের অবরুদ্ধ জ্বালা বেরোবার পথ খুঁজছে।
‘আমার গলাটা কেমন, সিতারা?’
‘মেয়েদের গলা।’
‘মেয়ে মানে? মহিলা না মেয়ে?’
‘মেয়ে।
‘কী বয়স শোনায়?’
‘দশ-এগারোর সঙ্গে পাঁচের উচ্চারণভঙ্গিমা। কখনো-কখনো একটু বেশি বয়স। তবে তেরোর বেশি মনে হয় না।’
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
‘যখন আমি মজার কথা বলি? হাসি?’
‘একই।’
‘যখন দেবেশকে ভালোবাসি?’’
‘কখনও দশ, কখনও পাঁচ।’
‘আমাকে আগে কেন বলোনি?’
সিতারা তাকিয়ে থাকে।
চিৎকার করে ওঠে দিতি।
‘কেন বলোনি?’ সেই দশ বছরের বালিকা-গলায়।
সিতারা চুপ।
তারপর বলে, ‘ঠিক কী বলতে চাইছ? কী বলিনি?’
‘আমি জানি না।’
রাগে তার প্রত্যেকটা শরীরের কোশ জ্বলতে থাকে। সিতারা ঘরের মধ্যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
দৌড়োবে দিতি। লম্বা দৌড়।
হিরণ্যর ল্যাব।
এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে সে দৌড়েছে পাঁচ মাইল।
হিরণ্যর বয়স তাঁর শরীরে স্পষ্ট। কিন্তু দু-ঘণ্টা ঘুমিয়ে তিনি কাজ করে যেতে পারেন। একের পর এক কাজ। কখনও একসঙ্গে দশরকম। এখন প্রায় তিন দিন হয়ে গেছে, তিনি গবেষণাগার থেকে বেরোবেন না। গবেষণাগারের পাশেই খোলা বারান্দায় বসে ম্যান্ডি। হিরণ্যর অন্যতম সৃষ্টি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রায় যতখানি মানুষ হতে পারে ২০৯০ সালে, তার সব চেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ। হিরণ্যর প্রিয়তমা।
ম্যান্ডি অনেকখানি বোঝে। নিমেষে পড়ে নিতে পারে শরীরের ভাষা। অত্যন্ত সংবেদনার সঙ্গে উত্তর দেয়। যেমন রূপসি, তেমন গাম্ভীর্য তার চেহারায়।
এখন তার সামনে পুরোনো পৃথিবীর দাবার থেকে অনেক জটিল একটি খেলা। বারান্দার বাইরে দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি। তাতে ছোটো ছোটো ঢেউ।
বোর্ডের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী হয়েছে?’
ম্যান্ডির সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে দিতি।
‘আমার মা-র বিষয়ে একটা প্রশ্ন আছে, ম্যান্ডি।’
‘কী?’ তার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকান ম্যান্ডি।
‘আমার মা মায়া-পৃথিবীতে পৌঁছোয় ২০৪০ সালে। তার পরে তার থেকে ডিম্বাণু নেওয়া হয়। মা তারপর মারা যায়। তারপর এত বছর অপেক্ষা করা হল কেন, আমাকে পৃথিবীতে আনতে?’
‘না তো। আগে আরও এসেছে। তিনজন। মানে তোমার আগে তিনবার চেষ্টা করা হয়েছে। দুজন মেয়ে। একটি ছেলে হয় প্রথমে।’
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে দিতি।
‘তারা… তারা কোথায়?’
উত্তরের দিকে অনির্দিষ্ট আঙুল বাড়িয়ে দেয় ম্যান্ডি।
‘ছেলেটিকে প্রথমেই সরিয়ে দেওয়া হয়। একটি মেয়েকেও। তাকে দেবেশের ভালো লাগেনি। দ্বিতীয় মেয়েটিকে দশ বছর পর্যন্ত রাখা হয়েছিল। তারপর বোঝা গেল, তার উচ্চতা খুব মাঝারি হবে, দেখতে তোমার মায়ের মতো নয়। সে-ও বাতিল হয়ে গেল। তুমি ভাগ্যবতী। সব দিক থেকে দেবেশের মনের মতো। গলার আওয়াজটা পালটে নিল, ওর পছন্দমতো।’
‘আমার ভাইবোন ছিল। তারা… তারা…’’
ম্যান্ডি তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়া-পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিছু বোঝার চেষ্টা করছে।
‘কী হয়েছে, দিতি? এত বিচলিত কেন?’
সে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
সাঁতার কাটছে দিতি অনেক অনেকক্ষণ… কী ভালো লাগে জলের ঘিরে-থাকা—পিঠ, পেট, বুকে মাথায় জলস্পর্শ—এটা তার আশ্রয়… সাঁতার কাটতে কাটতে অনেক দূর চলে এসেছে সে, রোজকার সীমানার বাইরে। চিত হয়ে সাঁতার কাটছিল সে, হঠাৎ কী অসম্ভব একটা চাপ বুকে—ঝট করে উলটে গেল সে, দু-হাত-পা ছড়িয়ে শুধু ভেসে আছে।
হঠাৎ করে কী বোঝা! কী ভার!
গত চার দিনে সে গুনে গুনে কথা বলেছে—একটা অদ্ভুত অনুভূতি। নিজের গলাটা কানে গেলে একটা তরল জ্বালা—উত্তাপ গালে, মাথায়—তাই আরও সাঁতার।
কী অসহ্য, কী বইছে সে?
কী অসহ তার গলে-পড়া গলার স্বর।
মাথা তুলে দেখল সে, দূরে উত্তরে তটরেখা দেখা যাচ্ছে, ওইখানে ওই অন্য মানুষেরা থাকে, যারা আর থাকবে না। তার মধ্যে আছে তার ভাইবোনেরা? আছে তারা?
হয়তো নেই আর।
এতদিন ধরে শুনছে সে—যারা নিখুঁত নয়, তারা থাকবে না। সে থাকবে, আর তার মতো যারা।
সামনে আদিগন্ত জল, বুকে-পিঠে ভীষণ চাপ, আর এগোবে সে? যদি চাপ আরও বাড়ে?
বাড়ুক। এই বোঝা নিয়ে এগোবে সে। জানবে। এই অসহনীয় প্রশ্ন।
কেন এতদিন সে নিজে ভাবেনি অন্যদের কথা?
কেন? কেন পালটাবে তার গলা?
চিৎকার করে বলল সে—সে গলা তার নিজের কানে গিয়ে আগুন ছড়াতে লাগল, তাও দেবেশের বানানো। ওই আহ্লাদে গলে-পড়া আধো গলা নিয়েই প্রশ্ন করতে শুরু করল।
কেন? কেন?
প্রথমে ফিশফিশ করে, তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল, চিৎকার ছড়িয়ে পড়তে লাগল হাহাকারে।
কেন? কেন?
বেহুলা জাগছে।
Tags: কল্পবিজ্ঞান, নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়