জাল বানাল যুধিষ্ঠির
লেখক: সিদ্ধার্থ ঘোষ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
লেটার বক্সের ফোকর দিয়ে ইলেকট্রিকের নীল বিলটা উঁকি মারছে। বিলটা টেনে নেওয়ার পরে দেখি তার পেছনে দুটো ইনল্যান্ড লেটার রয়েছে। সন্ধেবেলা, তাই স্পষ্টভাবে হাতের লেখা পড়া যাচ্ছে না—কিন্তু তার দরকারই বা কী! একটা ঠিকানা ইংরেজিতে লেখা আর অন্যটা বাংলায়, এটা বোঝা যাচ্ছে। তারপরে আর হস্তাক্ষর বিশারদ হওয়ার প্রয়োজন থাকে না। আমার দুই কাকার চিঠি এসেছে। এই চিঠিগুলো সবসময় জোড়ায় জোড়ায় আসে। অথচ দুই ভাইয়ের মধ্যে এত মধুর সম্পর্ক যে, মুখ-দেখাদেখি বন্ধ। এই ক’দিন আগে যুধিষ্ঠিরকে বলছিলাম, একেই বলে সত্যিকার মনের মিল। বাইরে যতই বিরোধ থাকুক না কেন, আমার এই দুই কাকার মধ্যে একটা যেন টেলিপ্যাথিক যোগ রয়েছে। একজন যদি আমায় চিঠি লেখেন, অন্যজন সঙ্গে সঙ্গে তা জেনে ফেলেন। অ্যাকশন ও রিঅ্যাকশন জাতীয় প্রক্রিয়া।
“চিঠি হাতে অমন বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলে কেন? চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।” যুধিষ্ঠিরের গলা পেয়ে যেন প্রাণ ফিরল। চিঠি দুটো পড়ার পর থেকেই আমি শুধু চারপাশ থেকে রিভলবার ও রাইফেলের মুহুর্মুহু তর্জন গর্জন শুনছি। তার সঙ্গে মিশে রয়েছে কুকুর, বেড়াল ও মানুষের আর্তরব। কল্পনার চোখে সে দৃশ্যটা আমায় হাড়ে হাড়ে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
খাওয়ার টেবিলে মুড়ি বাদামের বাটি আর চায়ের কাপ সাজিয়ে রেখেছে যুধিষ্ঠির। চিঠি দুটো টেবিলে রাখতেই যুধিষ্ঠির হেসে বলল, “আবার! আবার মানিকজোড়ের চিঠি!”
“বড়োদের নিয়ে ঠাট্টা করতে নেই যুধো। আমার কাকাদের মানিকজোড়া বলা অত্যন্ত অন্যায়। এর পর কোন্দিন শুনব ওঁদের নন্টে-ফন্টে বলছিস বা হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন!”
“তুমি আজকাল অকারণে ওভার রিঅ্যাক্ট করো। আমি তো কিছু খারাপ ভেবে বলিনি। এত এক্সাইটেড হচ্ছ কেন। নাও, চায়ের কাপ তোলো। আসলে, আমার ওঁদের বেশ ফানি মনে হয়।”
“ওভার রিঅ্যাক্ট – ফানি- উঁহু! কথায় কথায় একেবারে ইংরেজির ফুলঝুরি ফুটছে। এটা কিন্তু ছোটোকাকা মোটেই ভালো চোখে দেখবে না।”
“ছোটোকাকা মানে তো সেই ধুতি-বাংলা পাবলিক?”
“আবার যুধো! তোর ভাষাটা দিন-দিন গোল্লায় যাচ্ছে। কাদের সঙ্গে মিশিস বল তো? পাবলিক! আমার কাকা পাবলিক? যাচ্ছেতাই। হ্যাঁ, ছোটোকাকা ধুতি পরেন ও বাংলায় লেখেন। তাই বলে ধুতি-বাংলা বলে কোনো বিশেষণ হয় না।”
“বিশেষণটা হয়তো গ্রামার-সিদ্ধ নয় কিন্তু মানে যখন বোঝা যাচ্ছে, নিপাতনে তো সিদ্ধ। যাকগে, আমার ইংরেজি বা ভাষা নিয়ে তোমায় উদ্বিগ্ন না হলেও চলবে। একটু কনশাস হলে, ইংরেজি অ্যাভয়েড করেও তোমার ছোটোকাকার সঙ্গে আমি বাতচিত করতে পারব।”
“হ্যাঁ, তা যে পারবি সে তোর এই নমুনা শুনেই বুঝে গেছি।”
টি-পট থেকে আমার চায়ের কাপে আর একটু ঢেলে দিয়ে যুধিষ্ঠির বলল, “তুমি যাই বলো, আমার ওপর তোমার কিন্তু তেমন আস্থা নেই। হয়তো সেটা তোমার নিজেরই আত্মবিশ্বাসের অভাব। না হলে, আমার বয়স সতেরো পেরিয়ে গেল—কই, তুমি তো একবারও আমাকে তোমার কাকাদের বাড়িতে নিয়ে গেলে না। আজ অবধি দাদুদের একবার চোখে দেখিনি।”
সিগারেট ধরাতে ধরাতেই মনে হল, এবার বোধহয় যুধিষ্ঠিরকেই ওঁদের বাড়ি পাঠাতে হবে। এরকম ঘোরালো পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়িনি।
“কী হল? চুপ করে গেলে কেন?”
“চিন্তা হচ্ছে। দুশ্চিন্তা। রিভলভার ও রাইফেল কিনে কাকাদের হাতে তুলে দিই কী করে! সেটা কি ঠিক হবে?”
যুধিষ্ঠির সামনে ঝুঁকে বসল। তার ভুরু কুঁচকে গেছে, “কী বলছ তুমি?”
“বড়োকাকা রিভলভার কিনে পাঠাতে বলেছেন আর ছোটোকাকা চেয়েছেন রাইফেল। এ. কে. ফরটিসেভেন—না পেলে ভারতে তৈরি ফাইভ পয়েন্ট ফাইভ সিক্স।”
“কিন্তু কেন?”
“রিভলভার চাই বেড়াল মারার জন্যে—শর্ট রেঞ্জে। রাইফেল চাই কুকুর মারার জন্যে।”
“তার মানে আমার বড়োদাদু কুকুর পোষে আর ছোটোদাদু বেড়াল?”
“ঠিক তাই।”
“না বাবি, ব্যাপারটা এখন আর ফানি মনে হচ্ছে না। কে বলতে পারে কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে কিনা! আমার কী মনে হয় জানো? স্ট্রেট জানিয়ে দাও ওসব আগ্নেয়াস্ত্র চালাচালির মধ্যে তুমি নেই। কী করতে গিয়ে কী করে বসবে—শেষে তুমি ভয়ংকর ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে।”
যুধিষ্ঠিরের উপদেশ শুনে হাসি পেল। সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অত সহজ নয়। অবশ্য যুধিষ্ঠিরের দোষ নেই। ওকে আমি আজ অবধি পুরো ব্যাপারটা খুলে বলিনি। তবে এবার জানিয়ে দেওয়াই উচিত। যুধিষ্ঠিরও আর খোকাটি নেই।
“হাসছ যে?”
“তোর কথা শুনে। কাকাদের আদেশ না মানলে আমাদের আর দু’বেলা খাওয়া জুটবে না। বুঝলি? এই ছোটোকাকা আর বড়োকাকার ম্যাচিং গ্রান্টের দৌলতেই আমরা চালিয়ে যেতে পারছি। সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থা আজ অবধি আমায় একটি টাকা দেয়নি। যে গবেষণার ফলে তোকে পেয়েছি—পৃথিবীর প্রথম যন্ত্র সন্তানকে—তার পেছনেও ওঁদের বিরাট অবদান।”
“ঠিক বুঝলাম না। ম্যাচিং গ্রান্ট মানে?”
“মানে, ধর ছোটোকাকা আমার গবেষণার জন্য দশ হাজার টাকা দিল। অমনই বড়োকাকা পাঠিয়ে দেবে পনেরো হাজার। সেই ভাবেই এখনও চলছে। বড়োকাকা ও ছোটোকাকা প্রত্যেক মাসে ম্যাচিং গ্রান্ট পাঠায়। টাকা কম পড়লে শুধু একবার যে কোনো একজনকে জানাতে হয় যে, অন্যজন এক হাজার টাকা বাড়িয়েছে—ব্যাস!”
“চমৎকার। কিন্তু তোমার আর একটা কথা কানে লাগল। আমাকে প্রথম যন্ত্র সন্তান বললে কেন? পৃথিবীতে কি রোবটের অভাব রয়েছে? তাদের মধ্যে অনেকেই আমার চেয়ে অনেক সিনিওর।”
“এইটাই হচ্ছে ইংরেজি ও বাংলার মধ্যে তফাত বুঝতে না পারার ফল। আমি তোকে যন্ত্র সন্তান বলেছি যন্ত্র মানুষ নয়—রোবট বা অ্যান্ড্রয়েড নয়। তোর মতো ওদের কারও বয়েস বাড়ে না। ওরা কেউ তোর মতো মজন্তালি সরকার, হিজিবিজবিজ বা ব্যোমকেশের নাম শোনেনি।”
বাটিটা কাত করে শেষ একমুঠো মুড়ি হাতে নিয়ে যুধিষ্ঠির বলল, “বাবি, আমায় একটা সুযোগ দেবে? হয়তো সমস্যাটা আমি মেটাতে পারব। তুমি তো জানো যে, কুকুর থেকে কুমির—বেড়াল থেকে বোলতা—ওদের আমি থট রিডিং করতে পারি। ওদের মনের কথার বুঝে সেই অনুযায়ী ওদের ম্যানেজ করতে কোনো অসুবিধে—”
যুধিষ্ঠিরকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “ব্যাপারটা শুধু এর কুকুর আর ওর বেড়ালের ঝগড়া নয়। সমস্যাটার শিকড় বেশ গভীর।”
“গভীর মানে?”
“সমস্যাটার উৎপত্তির কারণ না জানলে সেটা বোঝানো যাবে না। এক কথায় এটা একটা গাণিতিক সমস্যা।”
“ওরেবাব্বা! তোমার কাকারা আবার গণিতচর্চা করেন নাকি?”
“ওহ্ হো, ওটা মূর্ধন্য ‘ণ’ নয়—দন্ত্য ‘ন’। গান থেকেও গাণিতিক হয়।”
“গান? মানে আগ্নেয়াস্ত্র?”
“না রে না। গান মানে গান। সংগীত। যেমন, সুমন গায় জীবনমুখী গান। সেই ধরনের গান। দুই কাকারই গলা খুব ভালো। সুরের বোধও অসাধারণ। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ছোটোকাকা নজরুলের অন্ধ ভক্ত আর বড়োকাকা রবীন্দ্রনাথের।”
“তাতে কী হল?”
“কী না হল! রবীন্দ্রনাথের গান শুনলে ছোটোকাকার প্রচণ্ড মাথা ধরে। সাইনাসের সমস্যা বাড়ে। আর নজরুলের গান কানে এলেই বড়োকাকার স্পন্ডেলাসিসের ব্যথা শুরু হয়ে যায়।”
“ওফ! বেজায় সমস্যা তো। অনেক কিছু মুখস্থ করে রাখতে হবে। একদিকে ছোটোদাদু-ধুতি-বাংলা- নজরুল-রাইফেল-বেড়াল আর অন্যদিকে বড়োদাদু-প্যান্টুলুন-ইংরেজি-রবীন্দ্রনাথ-রিভলভার-কুকুর।”
যুধিষ্ঠিরকে এবার আমায় আরও বিশদভাবে বোঝাতে হয়েছে যে, শুধু কয়েকটা নাম মুখস্থ করলেই চলবে না। তার চেয়েও অনেক বেশি বোধবুদ্ধি দরকার। আর সেটা পড়াশোনা না করলে কোনোদিন আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। বড়োদাদু যদি গান ধরেন, মরিলো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে—সেটা রবীন্দ্রনাথের, সে তো সবাই জানে। কিন্তু ছোটোদাদু তখন কী গাইতে চাইবেন—সেটা বোঝা দরকার। অন্তত কাছাকাছি একটা কিছু।”
“একটা উদাহরণ দাও।”
“মরিলো মরি-র পালটা হিসেবে আমার ধারণা ছোটোকাকা খুবই পছন্দ করবেন, তুই যদি গুনগুন করে সুর ভাঁজতে শুরু করিস, রুমু ঝুমু রুমু ঝুম, কে এল নূপুর পায়।”
“ডিফিকাল্ট! বেশ শক্ত! আমাকে অনেক পড়াশোনা করতে হবে। দেখি চেষ্টা করে!”
যুধিষ্ঠিরকে আশ্বস্ত করতে বললাম যে, আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের যাবতীয় গানের টেক্সট ও স্বরলিপি আছে। ওর যন্ত্র মগজে সেগুলোকে তুলে নেওয়া খুব কঠিন কাজ নয়।
“রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ছাড়া আর কোনো বিরোধ সম্বন্ধে কি আমার চেতনা থাকা দরকার?”
“অনেক কিছুই আছে, তবে একটা ব্যাপারে বি কেয়ারফুল! আমিষ ও নিরামিষ আহার! ছোড়দাদু নিরামিষে আছেন আর বড়োদাদু—বলা দরকার? এর সঙ্গে আরও একটা কথা মনে রাখিস। তোর বড়োদাদুর দুটো ফ্রিজ আছে—একটা আমিষের জন্য, আর অন্যটা নিরামিষ। কারণ, দুই কাকিমাই নিরামিষ খান।”
“তাতে কী হল?”
“তোর কি ধারণা যে, ছোটোকাকা ও কাকিমা, দুজনেই নিরামিষ খান বলে তাঁদের শুধু একটা ফ্রিজ থাকবে?”
“কম্পিটিশন এত তীব্র যখন, দুটো ফ্রিজই থাকা উচিত! বুঝছি। কিন্তু তারও তো একটা লজিক দরকার!”
“লজিক! মানে, কেন দুটো ফ্রিজ দরকার ছোটোকাকিমাদের? খুব সরল, একটা নিরামিষ ফ্রিজে খাদ্র্যদ্রব্য থাকে, আর অন্যটায় পলিথিনের প্যাকেটে ভরা ধোবিওয়ালার বাড়িতে কাচা, মাড় দেওয়া ছোটোকাকার ধুতি-পাঞ্জাবি। মাড় দেওয়া ও ইস্ত্রি করা ধুতি-পাঞ্জাবি ঠান্ডা না করে উনি পরতে পারেন না।”
ফ্রিজ বিভেদ শোনানোর পরে এই প্রথম আমি যুধিষ্ঠিরের মুখে একটা মেঘের ছায়া দেখলাম। এক ছিটে আশঙ্কা। তারপরেই প্রত্যাশিত প্রশ্ন, “আমার সম্বন্ধে ওঁরা কতটুকু জানেন? তুমি ওদের কী কী জানিয়েছ?”
“বাড়তি কী জানাব? সবাই যা জানে, ওরাও তাই। তোমার মা নেই। মানে, তুমি জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি চলে গেছেন। এই!”
“কিন্তু তুমি তো বিয়েই করোনি!”
“তাতে কী! আমার সার্টিফিকেট আছে। আর সেটা না থাকলে কি তুমি বাছা এতদিন হেসেখেলে চালিয়ে যেতে পারতে! আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে তোমাকে ওঁরা সুইডেনের ক্রোনোহাক্টেট কারাগারে পুরে ফেলত। লাইসেন্স না থাকলে রোবটদের ওখানেই যাবজ্জীবন কাটাতে হয়।”
বেলগাছিয়ার বাড়ির দরজায় ডোর বেলের দুটো সুইচ। দুটোকেই একসঙ্গে টিপল যুধিষ্ঠির। বুদ্ধিমানের কাজ। তার ছোড়দাদু ও বড়োদাদুর সঙ্গে প্রথম মোলাকাত। যুধিষ্ঠির নিজের পরিচয় দিতেই তাঁদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
বড়োকর্তা বললেন, “এনেছ?”
ছোটোকর্তা অবশ্য এক নজরেই বুঝে ফেলেছেন যে, তাঁর জিনিস—রাইফেল আসেনি। যুধিষ্ঠিরের কাঁধের ওইটুকু ঝোলায় নিশ্চয় এ. কে. ফরটিসেভেন কে পাট করতে ভরা সম্ভব নয়।
যুধিষ্ঠির বিস্ময়ের ভান করে বলল, “কিছু কি আনার কথা ছিল? বাবি তো কিছু বলল না। আমি তো গ্রীষ্মের ছুটি কাটাব বলে অনেক কষ্টে তিনদিনের জন্য পারমিশান পেয়েছি—”
যুধিষ্ঠিরের ছোড়দিদা পেছন থেকে এবার ঝাঁপিয়ে উঠলেন, “ইস, এদের কারবার দেখো। ছেলেটা তেতেপুড়ে এল। দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে—”
বড়োদিদাও পৌঁছে গেছেন, “যে যার নিজের দেনাপাওনা নিয়ে এত ব্যস্ত যে, কচি ছেলেটার কথা—চল বাবা—চল।”
বড়োদিদা যুধিষ্ঠিরের হাত ধরে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। পেছনে পেছনে ছোড়দিদা আসছেন।
ছোটোকর্তা তাঁর দাদার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বড়ো গিন্নিকে বারণ করো দাদা! যুধোর ফুড হ্যাবিট না জেনে তোমরা ওকে হ্যাম, বিফ দিয়ে আপ্যায়ন করতে পারবে না। ওকে আমি ফজলি বা ল্যাংড়া আমি খাওয়াতে চাই।”
“তোমার যা বক্তব্য তোমার বউদিকে নিজে গিয়ে বলে এসো। আমি কি তোমার দোভাষীর চাকরি করি!”
যুধিষ্ঠির পাশের ঘর থেকেই সব শুনছিল। এই বাড়িতে একঘণ্টা নিরাপদে কাটাতে হলেও যে দিদাদের সাপোর্ট দরকার—সেটা বুদ্ধুরামের বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
তিনটে দিনই দিদাদের আঁচলে প্রায় মুখ লুকিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে যুধিষ্ঠির। তবে একেবারেই যে কোনো ঘটনা ঘটেনি তা নয়। প্রচণ্ড ঝগড়া বেধেছিল দ্বিতীয় দিন খাওয়ার টেবিলে। না, আমিষ বা নিরামিষ হেঁশেলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব নয়। সেটা দিদারাই সামলে দিয়েছেন। শুধু ভাই নয়, সতেরো বছর পরে শুধু যুধিষ্ঠিরের সম্মানে ফ্যামিলির সবাই এক টেবিলে বসে খেয়েছেন। খাওয়ার টেবিলে বসে বড়োদাদু সেদিন বললেন, “যুধোর চোখ দুটো ঠিক আমার ভাইপোর ডিটো।” সঙ্গে সঙ্গে ছোড়দাদুর প্রতিবাদ, “চোখের মাথা না খেলে কেউ এমন কথা বলে! চালশের চশমাটা পরলেই দেখতে পেতে, চোখ নয়, নাক। নাকের গড়নটা এক্কেবারে কেটে বসানো। আমাদের ঠাকুরদা ছবিটার সঙ্গে অবধি মিল। আমরা কেউ ওই নাক পাইনি। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের বাপ ঠাকুরদা… ”
যুধিষ্ঠিরের মধ্যে পারিবারিক ঐতিহ্যের কোন ধারাটা বইছে, এই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার জল অনেক দূর গড়িয়েছিল। এবং স্বাভাবিকভাবেই সেই বিপজ্জনক রবীন্দ্র-নজরুল প্রসঙ্গও উঠেছিল। বড়োদাদু ক্লেম করছেন, তাঁর বাবা দিনু ঠাকুরের কাছে তালিম নিয়েছেন। আর ছোটোদাদুর বক্তব্য, তাঁর মা নজরুলের কাছে তিনটি গান শিখেছিলেন। যুধিষ্ঠির ঠিক এই জায়গাটিতে প্রথম নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। সে খাওয়ার টেবিলে বসেই গুনগুন করে ‘খোল খোল মন্দির দ্বার’ ও ‘চাঁদ কহে চামেলি গো’ গেয়ে শোনায়। নজরুল-রবীন্দ্রের বাইরে, অথচ আধুনিক জীবনহীনতার মধ্যেও নয়—তার দুই দাদুই মুগ্ধ। দুজনেরই এখন যুধিষ্ঠিরের ওপর অগাধ আস্থা।
এই আস্থাটাই দরকার ছিল যুধিষ্ঠিরের। তারপরের সমস্যাটা তো অতি সামান্য। কুকুর বেড়াল সামলানো। যুধিষ্ঠির যদি এখানে বাস করত তা হলে কোনো কিছু করারই দরকার হত না। তার একটা চাউনিই যথেষ্ট। সে বড়োদাদুর বাঘা (ছোড়দাদু বলেন নেড়ি কুত্তা) হোক কি ছোড়দাদুর বেড়ালের সংসার (বড়োদাদু বলেন বেজাতের ফৌজ)—যুধিষ্ঠিরকে চারপেয়েরা সবাই সমীহ করে।
যুধিষ্ঠিরের প্রস্তাব দুই দাদুই শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন। কুকুর বেড়ালের খেয়োখেয়ি মেটাতে যুধিষ্ঠির একটা তারের জাল বসিয়ে দিয়ে যাবে। রিভলভার বা বন্দুকের দরকার নেই, যে যার মতো থাকবে। নিজের নিজের জায়গায়।
দাদুদের সামনে কেউ মুখ খোলেননি, কিন্তু পরে যুধিষ্ঠিরকে ডেকে ছোড়দিদা বললেন, “বাবা। যুধো একটা কথা শোন। আমরা নিরেমেষাশী—অবশ্য বেড়ালদের জন্য আলাদা রেঁধে দিই। তাতে বাপু ওদের মন ভরে না। ওরা তো ঠিক কুকুরের মতো নয়। তেমন শাসন মানে না। বড়োদের ঘরে তেমন কিছু রান্না হলে ওরা তাই চলে যায়। তোর বড়োকাকিমারও তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তুই যদি এভাবে বেড়া তুলে দিস—”
টেম্পোয় চড়ে বাড়ি ফিরল যুধিষ্ঠির। এক্সপ্যান্ডেড মেটালের জাল নামিয়ে আনল মোটবাহকেরা। ভাড়া মিটিয়ে যুধিষ্ঠির ঘরে ঢোকা মাত্র দেখি তার হাত থেকে একটা আস্ত ইলিশ মাছ ঝুলছে। তা প্রায় দু’ কেজি মতো হবে। কালই বাজারে দর করেছিলাম। একশো আশি টাকা কেজি!
“কী রে, প্রচুর রোজগার হয়েছে নাকি?”
“তা মন্দ নয়। ওই তারের জাল কেনার জন্য দুই দাদু দশ হাজার দিয়েছেন। আর দিদারা দিয়েছেন তিন হাজার। বেড়া টেড়া তোলার পরেও কিছু তো থাকবেই।”
ইলিশ মাছ নিয়ে যুধিষ্ঠির সেই যে রান্নাঘরে ঢুকল, তারপর আর সাড়াশব্দ নেই। রান্না করতে ও ভালোবাসে, কিন্তু সে ন’মাসে-ছ’মাসে। তা ছাড়া ইলিশ মাছের প্রতি ওর বাড়তি আকর্ষণের কথা জানা ছিল না। দেড়টা বাজল, দুটো, দু’তিনবার ডেকেও সাড়া পাইনি। করছেটা কী!
রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছ তা প্রায় মিনিট পাঁচেক। যুধিষ্ঠির এমনই নিমগ্ন যে, আমার অস্তিত্ব টের পায়নি। একেবারে সব্যসাচীর মতোই তার দু’হাত সমানে চলছে। ডান দিকের বার্নারের ওপরে কড়ায় ইলিশ মাছ ভাজা হচ্ছে। খুন্তি দিয়ে তাদের নাড়াচাড়া চালাচ্ছে। আর পাশের বার্নারের ওপর লোহার চাটুতে অনেকটা নুডুলের মতো চেহারার কী যেন সেঁকছে।
“যুধো, আমার খিদে পেয়েছে। তুমি গবেষণা চালাও কিন্তু দয়া করে আমার খাওয়ার আগে ব্যবস্থা করো।”
“প্লিজ! আর পাঁচ মিনিট! তুমি যাও, আমি তোমায় ডেকে নেব।”
যুধিষ্ঠির কথা রেখেছে। ভাত, ডাল আর ইলিশ মাছ ভাজা। খাওয়ার টেবিলে বসেই কাকাদের বাড়ির সব খবর শুনলাম। টক দইয়ের বাটিতে চামচটা ডুবিয়ে বললাম, “সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু দিদাদের ধাপ্পা দিয়ে টাকাটা নেওয়া তোমার উচিত হয়নি! কীভাবে তুমি বেড়াল ঢোকার ব্যবস্থা করবে?”
“ধাপ্পা মানে! এতক্ষণ তা হলে কী করছিলাম! ইলিশ মাছ কি এমনি এমনি কিনেছি নাকি! যখনই বাড়িতে ইলিশ মাছ রান্না হবে অমনই তারের জালের মধ্যে একটা জায়গায় ছিদ্র আপনা হতে বড়ো হয়ে যাবে। বেড়ালরা ঢুকতে পারবে। চুরি করে পালাতেও পারবে।”
আমার মুখের চেহারা দেখে যুধো হেসে ফেলল। “বিশ্বাস হচ্ছে না? তা হলে দেখিয়েই দিই।”
টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়ে যুধিষ্ঠির একটা তারের চৌখুপ্পি জাল হাতে ফিরে এল। বুঝলাম, নুডুলের মতো চেহারার এই জালের তারগুলোই এতক্ষণ ও সেঁকছিল।
তারের জালটা আমার সামনে উঁচু করে ধরে ও বলল, “দেখছ তো? এই ছিদ্র দিয়ে ইঁদুরও গলতে পারবে না, বেড়াল তো দূরের চিন্তা। এইবার দ্যাখো—”
তারের জালটা ও আমার থালার কাছে নামিয়ে আনল। যেখানে ইলিশ মাছের কাঁটাকুটিগুলো পড়ে ছিল। মুহূর্তের মধ্যে তারের জালটার চেহারা পালটে গেল। তারের বাঁধুনি ঢিলে হয়ে ছিদ্রগুলো অনেক বড়ো হয়ে গেছে!
যুধোকে এরপর অভিনন্দন জানানো ছাড়া উপায় নেই। এতদিন আমরা শেপ মেমরি অ্যালয়ের কথা জানতাম। অর্থাৎ যে শঙ্কর ধাতু বিভিন্ন তাপমাত্রায় বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করে। কিন্তু গন্ধ অনুযায়ী আকর পালটাবে—এটা সত্যিই অভিনব।
যুধো হাসি মুখে বলল, “ওই এক্সপ্যান্ডেড মেটালের জালের নীচে একটা জায়গায় কিছু করে এই ইলশে ফাঁদটা আটকে দেব, যাতে—”
যুধোর কাছে আমার শেষ প্রশ্ন, “কিন্তু বেড়ালদের শুধু ইলিশ মাছ খাওয়ানোর জন্য এত কাণ্ড কেন? অন্য কোনো মাছের গন্ধে কি জালটা ফাঁক হবে না?”
“না—শুধু ইলিশ রাঁধার পরেই জাল ফাঁক হবে। নিত্যদিন যদি জালের ফাঁক দিয়ে বেড়াল ঢুকে মাছ খেয়ে যায়, তা হলে তো ব্যাপারটা ধরা পড়ে যাবে। ইলিশের যা দাম, কোনো বাড়িতেই রেগুলার কেনা হয় না। তা ছাড়া এর পেছনে আমার অন্য একটা শুভ চিন্তাও আছে।”
“সেই শুভ চিন্তাটি কী—জিজ্ঞেস করতে পারি?”
“নিশ্চয়। আমি সত্যিকারের কুকুর প্রেমী। এমনিতেই কুকুরদের পক্ষে মাছের কাঁটা খাওয়া সেফ নয়। আর ইলিশ তো ডেঞ্জারাস। যে কোনো সময়ে ওই সরু কাঁটা ওদের গলায় ফুটে যেতে পারে।”
আর কোনো কথার মারপ্যাঁচে না গিয়ে এইটাই জানাতে চাই যে, কুকুর ও বেড়াল আর সেই সঙ্গে আমার ছোটো ও বড়োকাকার—সবারই মঙ্গল হয় যাতে, সেই ব্যবস্থাই করছে যুধিষ্ঠির।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান, সিদ্ধার্থ ঘোষ
Very nice story