পর্বততীর্থ জম্ভাজ
লেখক: সোহম গুহ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
রাকার সামনে আজ অনেকখানি খোলা আকাশ। কঙ্কণ বনে বড়ো হয়ে ওঠা মেয়েটি দিশাহারা হয়ে গেল ক্ষণিকের জন্য মেঘ এবং রোদের এই খেলা দেখে। অস্ফুটে বলল, “আমাদের জম্ভা যে এত অপরূপ আমি জানতাম না।”
পাশ থেকে ক্লিষ্ট হাসি হাসল আম্রপালি। দেবী অর্কপ্রভার মন্দিরে বড়ো হয়ে উঠেছে বলেই সে এই আকাশ দেখে অভ্যস্ত। রাতের তারাদের চেনাতে তাদের শিক্ষয়িত্রীরা নিয়ে যেতেন সন্ধ্যার নীচে। যেখানে দিন এবং রাত্রি সর্বদা খেলা করে একে অপরের সঙ্গে, সেখানে একসঙ্গে দেখা যায় জ্যোতিষ্ক এবং জম্ভার দুই সূর্য-যুগলকে। আলোছায়ার সেই শামিয়ানায় দাঁড়িয়ে আম্রপালির নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হত। এখনও হয়। সে বলল, “ওরে জংলী ভূত, আকাশই দেখবি না সামনে এগোবি? পথ যে এখনও অনেক বাকি।”
রাকা মাথা নাড়ল। উচ্চজাতির নারী পুরুষদের কথা মেনে চলতে তাকে তার মা পইপই করে বলে দিয়েছে। কিন্তু মাঝে মাঝে তার বুক ছলাত করে উঠছে। এই যাত্রা সম্পূর্ণ করতে পারলে তাকে বা তার গ্রামের বাকিদের আর শহরের লোকেরা তুইতোকারি করবে না, মনে করবে না আর উচ্ছিষ্টসম। এই তীর্থযাত্রার পরে আর তার গ্রামকে কেউ শবরদের গ্রাম বলবে না, বলবে দেবী অর্কপ্রভার সেবক পুরোহিত রাকার গ্রাম। দিনের সীমা অতিক্রম করার আগে অবধি তার স্থান ছিল দলের একেবারে সামনে। পেছনে আকাশের বুকে ঢলে থাকা দিবসসূর্যের আলো তৈরি করেছে তার সামনে দীর্ঘ ছায়া। সেই ছায়া, তারই মতো, দূষিত। উচ্চবর্ণের মানুষেরা সেই ছায়া এড়িয়ে চলেন। রাকা জানে না বর্ণাশ্রম কার মস্তিষ্কপ্রসূত, শুধু জানে এই বিভাজনের অভিশাপ বর্ষিত হয়েছিল তাদের মতো কিছু মুষ্টিমেয় জনজাতির উপরে, তাদের উপরে, যারা তৃতীয় যুগের শেষে মানুষ এবং দেওতাদের যুদ্ধে দেওতাদের পক্ষ নিয়েছিল। সেই সব জনজাতি যারা রিক্ত জম্ভার বুকে একটুকরো শান্তি খুঁজতে চেয়েছিল।
তার কেবল সঙ্গ দিয়েছে আখেনাতন। নিস্তব্ধ সাগরের পাশে জন্মানো জেলেদের গ্রাম থেকে দ্বাদশবর্ষীয়া মেয়েটিকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল পুরোহিতদের এক দল। রাকার মায়া হয় আখেনাতনের মুখের দিকে তাকালে। এখনও ওর জীবনই শুরু হয়নি, আর তাকে কিনা বসতে বাধ্য করা হয়েছিল বিয়ের পিঁড়িতে, দেনা মেটানোর অন্য রাস্তা জানা ছিল না তার বাবা-মায়ের।
শেষ সহযাত্রী বিভার দিকে সে যাত্রা শুরু অবধি তাকায়নি। মহিলার যৌবন ঢলে পড়েছে, তার পিঠের কাপড় একবার উঠে যেতে রাকা দেখতে পেয়েছিল এক শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতের দাগ। অস্ত্রের দাগ। তিনি এখানে কেন? এই বিপদসঙ্কুল রাস্তায়? আর আম্রপালি? সে কাকে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চায়? তার মাকে?
প্রধান পুরোহিতের সঙ্গে রাকার পরিচয় দিন তিনেক আগে। তখনও তার চোখে ঝিকমিক করছে যাত্রাপথের দৃশ্যাবলী।
তাদের গ্রাম থেকে অর্কপ্রভার মন্দির প্রায় দুই সপ্তাহের রাস্তা। মাঝে পড়ে নিস্তব্ধ রাত্রির সমুদ্র এবং ঝঞ্ঝামাখা সন্ধের তটভূমি। রাকাকে সঙ্গে নিয়ে তিনজন পুরোহিত পাড়ি দিয়েছিল এই দুর্গম রাস্তা দিয়ে। নিস্তব্ধ রাত্রির সমুদ্র পেরনোর সময়ে আকাশের নক্ষত্রেরা ছিল তাদের একমাত্র সম্বল। সেই নক্ষত্রদের মধ্যে একটি নক্ষত্র রাকার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাকিদের মতো সে উজ্জ্বল না, বরং তার গোলাকার আবয়বকে ঘিরে রেখেছে এক ঘন বেগুনি আভা। তার পথপ্রদর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিল রাকা। উত্তর এসেছিল, “মধ্যরাত্রির সূর্যের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থেকো না। অন্ধ করে দেবে তোমায় ওর রাক্ষুসে জ্যোতি।”
মধ্যরাত্রির সূর্য? সূর্যকে তো দেখেছে রাকা। দিবস সূর্য সর্বদা ঝুলে থাকে তার গ্রামের মাথার কাছে। চিরস্থায়ী, অনন্ত। যদিও, গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা বলেন এককালে সূর্য নাকি ঘুরত মাথার উপরে। দিন রাত্রির এখনকার মতো কোনো নির্দিষ্ট সাম্রাজ্য ছিল না। এরকম হয় নাকি? রাকা জিজ্ঞেস করেছিল। উত্তর পায়নি। জম্ভার রাত্রির নীচে বলেই সমুদ্রের বুকে প্রচণ্ড শৈত্য জন্ম দিয়েছে অবিচ্ছেদ্য বরফের এক সমতলভূমির। সেই বরফের উপর দিয়ে তাদের স্লেজ টেনে নিয়ে গেছিল আটটা কুকুর। সেই অন্ধকারে তাদের অতিকায় স্লেজকে দূর থেকে দেখতে লাগছিল এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কদের মতো। রাত্রি সমুদ্রে ভ্রমণকারী বণিকদের মতো পুরোহিতেরা লন্ঠন ব্যবহার করেননি। উজ্জ্বল হয়ে পথ আলোকিত করছিল তাদের পরিধান। রাকার শাড়ির মতো সেই শাড়িগুলো পশম দিয়ে তৈরি না। সেই তন্তুর জন্য যুদ্ধ বেধেছে, রাজা খুন করেছেন রাজমহিষীকে স্বহস্তে, দেওতাদের নিশ্চিহ্ন করেছে ক্ষমতালোভী মানুষের দল। জম্ভার শ্রেষ্ঠ সম্পদ তৈরি করা যায় না, ফলন করা যায় না, খনি থেকে উত্তোলন করা যায় না। কেবল সংগ্রহ করা যায়।
মসলিন। মহাআকন্দ গাছের থেকে প্রাপ্ত এই তন্তু ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম জম্ভার ইতিহাসের প্রবাহ, সম্রাটকে বানিয়ে দিতে পারে ভিক্ষুক, বা ভিক্ষুককে সম্রাট। কিন্তু অর্কপ্রভার পুরোহিতরা বাদে কেউ এই তন্তু সংগ্রহ করতে পারে না। না, সেটা সুমেরু পর্বত জম্ভার দুর্গম এবং উচ্চতম অঞ্চল বলে নয়। কারণ, দেবী অর্কপ্রভার আশীর্বাদধন্য কুমারী কন্যা বাদে আর কারুর ক্ষমতা নেই এই তন্তু সংগ্রহের। বাকিরা মহাআকন্দের ফল উপরে নিলেও সেই ফল থেকে পচা কার্পাস পাবে, মসলিন নয়।
দেবী অর্কপ্রভার মন্দিরে ঢুকে তাই রাকা সন্ধান করেছিল গ্রন্থাগারের। যাত্রাকালে সে পুরোহিতদের অনেক প্রশ্ন করছে, উত্তর পেলেও সেই উত্তর তার মনের মতো হয়নি। দেবীর গ্রন্থাগারের পুথিগুলি তার মন্দিরের মতোই প্রাচীন। ঢুকে কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘুরে সে যখন একেবারে পেছন দিকে গিয়ে পৌঁছল, দেখল দেওয়ালে কিছু একটার উপরে কাপড় চাপান আছে। কাপড় সরাতে তার সামনে ধরা দিল এক তৈলচিত্র। তিনটে খণ্ডে অঙ্কিত সেই ছবির অন্তর্নিহিত কথাগুলি উদ্ধারের চেষ্টা করল রাকা, কিন্তু নিজের সামান্য জ্ঞান সেই কাজের জন্য যথোপযুক্ত ছিল না।
“জম্ভার আগের তিন যুগের কথা বর্ণিত হয়েছে এই ছবিতে।” পেছন থেকে ভারী কিন্তু সুরেলা স্বর শুনে রাকা চমকে উঠল। এই স্বরকে সে কিছুক্ষণ আগেই কথা বলতে শুনেছে তার সঙ্গে থাকা বাকি পুরোহিতদের সঙ্গে। অন্দরমহলে কাপড় পরিবর্তন করছিল বলেই মুখ দেখেনি সে বক্তার, কিন্তু সেই কর্তৃত্বব্যঞ্জক স্বরকে চিনে রেখেছিল। এখন পেছন ফিরে সে দেখল, চিনল। দেখল তাঁর পরিধান, সূক্ষ্ম কারুকার্য করা এক শ্বেত মসলিন শাড়ি। “প্রধান পুরোহিত, আমি দুঃখিত। আমার হয়তো এখানে আসা উচিত হয়নি।”
হাত তুলে অভয় মুদ্রা দেখালেন প্রধান পুরোহিত। “হয়তো তোমাকে কঙ্কণ বনে খুঁজে পাওয়া আমাদের অভীষ্টে লেখা ছিল। মানুষ ভুলে গেছে, কিন্তু এক সময়ে, দ্বিতীয় যুগ পর্যন্ত শবরেরা ছিল মানুষদের পথ প্রদর্শক। তোমাদের পূর্বপুরুষরা মানুষকে শিকার করে খাদ্য সংগ্রহ করতে শিখিয়েছিল, শিখিয়েছিল পাথর ভেঙে অস্ত্র তৈরির কৌশল। আমাদের মতো তোমাদের পূর্বপুরুষরাও ছিল দেওতাদের স্নেহধন্য। কিন্তু আমাদের মতো তোমরা কাপুরুষ ছিলে না, ছিলে না বিশ্বাসঘাতকও।” অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রধান পুরোহিত। “আমরা মেরেছিলাম দেবী অর্কপ্রভাকে, মসলিনের মন্ত্রগুপ্তি জানার জন্য। পেয়েছি, অধিকার করেছি তাঁর স্থান। প্রতিষ্ঠা করেছি তাঁর প্রস্তরমূর্তি, ভুলতে চেয়েছি আমাদের কৃতকর্ম। পেরেছি কি? জানি না। এই তৈলচিত্র তাই বানিয়েছিলাম, নিজেদেরকে মনে করানোর জন্য। কিন্তু ভয় পাই আমরা, নিজেদের অতীতকে, জম্ভার ভবিষ্যৎকে। তাই এই ছবির ঠাঁই গ্রন্থাগারের এক প্রান্তে।” রাকার দিকে ঝুঁকে পড়লেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, “কঙ্কণ বনের বাকি শবরদের থেকে তোমার পার্থক্য কি জানো?”
রাকা জানত, তবুও মাথা ঝাঁকাল। হয়তো তা বুঝতে পারলেন প্রধান পুরোহিত। বললেন, “আমার মেয়েটাকে দেখো। তুমি ছাড়া আর কারুর ক্ষমতা নেই, ইচ্ছাও নেই।”
আম্রপালীকে রক্ষা করার কথা কেন বলেছিলেন পুরোহিত? রাকা জানে না। এখন, কাছ থেকে তাকে দেখে বুঝতে চাইছে সে ভুল করল কিনা প্রধান পুরোহিতকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে। আম্রপালীর গায়ে সম্পূর্ণ মসলিন সুতো দিয়ে তৈরি শাড়ি। সন্ধ্যার অন্ধকারে সেই শাড়ি এক পাতলা স্বর্ণাভা বিকিরণ করছে। আকাশ থেকে পড়ছে বৃষ্টির চেয়েও মিহি বরফগুঁড়ো। সেই বরফকণারা শাড়িতে পড়া মাত্রই বাষ্পীভূত হচ্ছে, ছ্যাঁকা লাগার শব্দ করে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। তাকে দেখে মনে ভক্তির উদ্রেগ হয়, কিন্তু কথা শুনলে মনে জন্মায় বিতৃষ্ণা। আম্রপালীর মধ্যে কি তাহলে দুই সত্ত্বার লড়াই চলে? ওর মা কি তাহলে সেদিন ঠিকই বলেছিলেন? ভয়ে ভয়ে রাকা জিজ্ঞেস করল, “তোমার নিজের বাবাকে মনে আছে?”
সেইদিন গ্রন্থাগারে বসে প্রধান পুরোহিত রাকাকে বলেছিলেন নিজের প্রথম জীবনের কথা, সেই বয়সের কথা যে বয়সে সুকুমার পুরুষ দেখলে বুকে রক্ত ছলাত করে ওঠে। মন্দিরে বড়ো হয়ে ওঠা শকুন্তলা ভেষজবিদ্যা শিখছিল এক ঋষির আশ্রমে। দিনের আলো সেখানে সর্বদা, দিবস-সূর্যের অবস্থান এখানকার মতো পশ্চিমে নয়, পূর্বে। প্রভাতের কাছে থাকা সেই আশ্রম কঙ্কণ বনের নিকটে। কী করে কে জানে সেখানে এক স্বর্ণমৃগ শিকার করতে এসে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিল মেঘমল্লারপুরের যুবরাজ। না, স্বর্ণমৃগ বলে কিছু হয় না। হলে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে দলে দলে আসত শিকারির দল। বনে এক ছত্রাকের রেণু ঢুকে গিয়েছিল যুবরাজের ফুসফুসে। বিভ্রমের শিকার হয়েছিলেন তিনি। শকুন্তলা না বাঁচালে তিনি বাঁচতেন কিনা কে জানে।
তারপর?
যুবরাজ ফিরে গিয়েছিলেন নিজের রাজ্যে, রেখে গেছিলেন অনেক প্রতিশ্রুতি, আর শকুন্তলার গর্ভে এক কন্যাসন্তান। তিনি জানতেন না শকুন্তলা একজন অর্কপ্রভার পুরোহিত, প্রধান পুরোহিতের আসন গ্রহণ করার জন্য নিজেকে তৈরি করছে। জানলে হয়তো নিজের অঙ্গুরীয় দিয়ে বলতেন না তাঁর রাজ্যে আসতে।
রাজ্যাভিষেকের পরে সভায় শকুন্তলাকে দেখে চমকে গিয়েছিলেন রাজন, স্বীকার করতে চাননি নিজের কন্যার অস্তিত্ব। অঙ্গুরীয়কে জাদুবিদ্যা বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছিলেন। এ অপমান যে তাঁর কাছে, জারজ সন্তান থাকা কোন রাজার পক্ষে প্রীতিকর? শকুন্তলা তখন উপায়ন্তর না দেখে সরিয়ে দিয়েছিলেন পরনের আলখাল্লা। তাঁর উজ্জ্বল মসলিন শাড়ির সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিলেন মেঘমল্লারপুরের রাজা।
আম্রপালী জানত না রাকা তার জন্মরহস্য সম্পর্কে অবগত। ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, “আছে, দূর থেকে দেখেছিলাম তাকে। অসুস্থ লোক একটা। তোমার তাতে কি? নিজের বাবা নেই?”
রাকা মাথা নাড়ল। মনে নেই তার। খুব চোখ বুজে ভাবলে একটা ভাসা ভাসা মুখ মনস্পটে ভেসে ওঠে। ব্যাস ওইটুকুই। আম্রপালী ব্যঙ্গপূর্ণভাবে হাসল। “বেঁচে গেছ। কিছু লোকের জীবিত থাকাই উচিত না।”
আম্রপালী বলল বটে, কিন্তু রাকা দেখল প্রধান পুরোহিত ঠিকই বলেছিলেন। তাঁর মেয়ের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে ক্ষত্রিয় চিহ্ন। সেই জন্যই সে জয়ের লিপ্সা নিয়ে এগিয়ে এসেছে এই তীর্থের পথে। পুণ্য লাভ লক্ষ্য নয় তার। নিজেকে প্রমাণ করতে সে বেশি উন্মুখ।
রাকা মাথা তুলে উপর দিকে তাকাল। তারা অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে, কিন্তু মাথার উপরে, বহু উপরে এক সুউচ্চ শিখর সন্ধের লালচে রঙে রঙিন। সুমেরু পর্বতের এই চূড়া থেকে নাকি গোটা জম্ভাকে দেখা যায় পাখির চোখে। সেই জন্যই এই চূড়ার নাম জম্ভাজ। জম্ভাজকে ঘিরে আংটির মতো দাঁড়িয়ে এক মেঘের দল। প্রধান পুরোহিতের কাছে শুনেছে রাকা, সেই মেঘের পেছনে আছে এক হ্রদ, এবং সেই হ্রদকে ঘিরে এক অভয়ারণ্য। প্রাচীন জম্ভার এক নিদর্শন এই অরণ্য। এখানেই একমাত্র জন্মায় আকন্দ গাছ, সেই গাছের ফল থেকেই একমাত্র বানানো যায় মসলিন তৈরির সুতো।
“কিন্তু সেই তন্তু সংগ্রহ করার জন্য কুমারী মেয়েদেরই প্রয়োজন হয় কেন?” প্রশ্নটা রাকা নয়, করল বিভা। বাকিদের থেকে সে বয়সে অনেক বড়ো, অভিজ্ঞতা তাকে সতর্ক এবং সন্দিগ্ধ করে তুলেছে।
“কেন? তুমি কি তাহলে মিথ্যা বলে নিজের জায়গা করেছ তীর্থযাত্রীদের দলে?” আম্রপালীর সপাট প্রতিপ্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল বিভা। উত্তর দিল, আমি এখানে এসেছি নিজের মায়ের কাছে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য নয়, জীবনের নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করার জন্য।”
উত্তরটা আম্রপালীকে বিঁধল তিরের মতো। সে বিড়বিড় করে বলল, “আমি জানি তুমি কে, তুমি কি…” তারপর কী মনে পড়তে মুখে কুলুপ আঁটল।
কথাটা কাছে থাকায় কেবল শুনতে পেল রাকা। সত্যি, যে বয়সে মেয়েরা সুখি হয়ে ঘরসংসারে মন দেয়, সেই যৌবন ঢলে পড়া বছরে বিভা এখানে কেন? পরমুহূর্তেই বুঝতে পেরে জিব কাটল সে। অনধিকার চর্চা করে ফেলেছে সে, শহরের বাবুগুলোর মতো। যার জীবন, তারই কেবল আছে সেই জীবনযাপনের অধিকার।
আর মৃত্যু? মৃত্যুর অধিকার সকলের, রাজা থেকে পুরোহিত, এমনকি দেওতা, কেউ কি পেরেছে এখনও পর্যন্ত সেই অধিকার বিলিয়ে দিতে? তৃতীয় যুগের শেষে সেই যুদ্ধের প্রাক্কালে তারা তো নিঃশব্দ রাত্রির সমুদ্রের তলদেশ থেকে স্বচ্ছ ভেষজ মন্থন করে অমরত্ব লাভের চেষ্টা করেছিল। শেষ প্রচেষ্টা এক যুদ্ধের ফলাফল অনুধাবন করে। যদিও, সেই লতা সিঞ্চন করে অমরত্ব লাভের রস বেরোয়নি, বেরিয়েছিল তরল গরল। এখনও অন্ধকারের মধ্যে তাকালে নাকি দেখা যায়, বরফের সমুদ্রের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে এক অতিকায় স্থাপত্য, সেই ধাতুর তৈরি পর্বত যাকে দেওতারা ব্যবহার করেছিল মন্থন-তুরপুন হিসেবে।
অমর একটি জিনিসই হতে পেরেছে জম্ভায়, মৃত্যু।
রাকা, বিভা, আম্রপালী, এবং আখেনাতন রাত্রির দেশে পা দিয়েছে ঘণ্টা দুয়েক আগে। সন্ধ্যার দেশে থাকা অবধি রাকা সুমেরু থেকে নেমে আসা শীতল বাতাস উপভোগ করছিল, কিন্তু এখন সেই বাতাসই গায়ে দাঁত বসাচ্ছে ধীরে ধীরে। আম্রপালীকে দেখে ঈর্ষা হচ্ছে তার। যেখানে তার দাঁত লেগে যাচ্ছে একে অপরের সঙ্গে, সেখানে… না। রাকা ঠিক করল সে আর এই নিয়ে ভাববে না। জম্ভায় সকলে সমানভাবে জন্মায় না। সে তো জংলী ভূত, এক মৃত অতীতের ধারক এবং বাহক। তার এই পরিস্থিতে মসলিনের ওম কামনা করা পাপ। হয়তো রাকা চোখে মুখে সেই কথা ফুটে উঠেছিল। বিভা কাছে এগিয়ে এল। রাকা লক্ষ করল বিভা তার মাথায় হাত রাখতে গিয়েও রাখল না, প্রাচীন রীতিনীতি তার হাত ধরে নামিয়ে দিল নীচে। সে রাকাকে বলল, “মসলিন তো ধারক এবং বাহক মাত্র, শবরকন্যা। আসল শক্তি, আসল উত্তাপ, সে তো এখানে।” সে নিজের বুকের উপরে হাত রাখল। “আমাদের হৃদয় শুধু রক্তসঞ্চালক যন্ত্র নয়, সে আমাদের আত্মার বসতঘর। নিজের উপরে বিশ্বাস রাখ, নজর স্থির করো অভীষ্টে। লক্ষ্য আপনা থেকেই ধরা দেবে তোমার হাতে।”
লক্ষ্য? তার জীবনের লক্ষ্য কি? রাকা জানে না। বিভার দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে কেন?”
বিভা চকিতে ঘুরে দেখল আম্রপালীর দিকে। মনে মনে কি যেন ভাবল, হয়তো গুছিয়ে নিল নিজের কথাগুলো। “জম্ভায় মেয়ে জন্মানো পাপ, জানো তো… ”
রাকা মাথা নাড়ল। জানে সে, না দেখলেও শুনেছে। কঙ্কণ বনে পাওয়া যায় অনেক দুর্লভ ভেষজগুণে সমৃদ্ধ লতাগুল্ম, এমন কিছু প্রাণী যাদের খুঁজে পাওয়া যায় না জম্ভার আর কোথাও। এককালে নাকি তারা উপলব্ধ ছিল গোটা জম্ভায়, যখন দিন এবং রাত্রি ছিল এক পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি। জম্ভার অক্ষীয় গতি দেওতারা চালনা করতেন। তারা মানুষের হাতে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পরে সেই চালকযন্ত্র খুঁজে পায়নি কেউ, রচিত হয়েছে কেবল উপকথা। জম্ভা থেকে যাওয়ার পরে কঙ্কণ ব্যতিত আর কোনো বন টিকে থাকতে পারেনি। টিকে থাকেনি সেই বনের প্রাণী এবং উদ্ভিদকুলও।
কঙ্কণের গোপন ঐশ্বর্যের সন্ধান পেয়ে দলে দলে এসেছে শহর থেকে মানুষ, রাজা থেকে অর্থলিপ্সু বা শখের শিকারি। শবরদের তারা ব্যবহার করেছে, তারপর ছুড়ে ফেলেছে। শবরদের গ্রাম তারা লুঠ করেছে বারেবারে, কারণ তারা পারে লুঠ করতে, কারণ তাদের লোহার তরোয়ালের সামনে শবরদের ব্রোঞ্জের কুঠার কাজ করে না। শবরদের গ্রাম থেকে এখন শহরে যুবতী মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয়, দেহোপজীবিনী বানানোর জন্য। পুরোহিতদের সামনে রাকার হাতে রাখা মসলিনের সুতো যখন জ্বলে ওঠে, ওর মা দেরি করেননি, মেয়ের শত আপত্তি সত্ত্বেও রাকাকে তুলে দিয়েছিলেন পুরোহিতদের হাতে। তিনি জানতেন রাকা জন্য কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। তিনি নিজে সেই ভবিষ্যৎকে অতীত বানিয়ে এসেছেন। রূপ চলে যাওয়ার আগে অবধি মেঘমল্লারপুরের গণিকালয়ে তিনি ছিলেন প্রাত্যহিক ভোগ্যসামগ্রী। জম্ভায় তাই উচ্চ বংশে না জন্মালে মেয়ে হয়ে জন্মানো উচিত না।
রাকা এই কথাগুলি বিভাকে বলবে কি না ভাবছিল, কিন্তু তার প্রয়োজন পড়ল না। বিভা তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “আসলে আমরা সবাই একই সুত্রে গাঁথা, সেই সুত্রের জন্ম কঙ্কণ বনে। আম্রপালীর জন্ম কঙ্কণ বনে, তোমার শৈশব কেটেছে কঙ্কণে। আমি…”
“আপনি যখন আমার সম্পর্কে এত কিছু জানেন তখন নিজের ব্যাপারে বলতে সঙ্কোচ করা উচিত নয় আপনার।”
বিভা হাসল। “মেঘমল্লারপুরের রাজার বয়স হলেও তিনি বৃদ্ধ হয়ে যাননি। সত্তর বছর বয়সেও তাঁর অদমিত কামেচ্ছা বহু নারীর ঔরসে জন্ম দিয়েছিল বহু ভ্রূণের। বলা বাহুল্য, রাজার নির্দেশে সেই ভ্রূণ এবং তাদের মায়েদের চিরকালের জন্য সরিয়ে দেওয়া হত এই জগৎ থেকে। এই রকমই চলে আসছিল। এবং, হয়তো চলে আসতোও। কিন্তু যুবরাজ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলেন তাঁর বাবার এই কর্মধারায়। তোমাদের গ্রাম একমাত্র নয়, রাকা, বহু প্রান্তিক জনজাতির মানুষ ছিল রাজার এই লালসার ফসল।”
“কিন্তু রাজা তো মারা গেছেন প্রায় চার বছর আগে। তাহলে এখনও কেন?”
“আরশোলার মাথা কাটলেই আরশোলা মারা যায় না, রাকা। আমি কেবল আরশোলার মাথা কেটেছি, তাকে পায়ের তলায় থেঁতলে দিয়ে আসিনি।”
বিভার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো রাকা। “বুঝলাম না… ”
গলার স্বর আরও নীচু করে উত্তর দিল বিভা। “আম্রপালীর বাবা নিজের বাবাকে হত্যা করার জন্য ডেকে এনেছিল আমায়।”
“তুমি…!” চকিতে বিভার কোমরবন্ধনীতে চোখ গেল রাকার। সেখানে ঝুলছে এক ছোরা। সেই ছোরার হাতলে অনেকগুলো দাগ, শিকার সফল হলে নিজের বাড়ির দেওয়ালে ওইভাবে দাগ কেটে হিসাব রাখে… রাখত রাকা। তফাৎ একটাই, সে জন্তু শিকার করত, মানুষ নয়। “তুমি বিষকন্যা?” অস্ফুটে জিজ্ঞেস করল সে।
বিভা মাথা নাড়ল। “রাজার শয্যাসঙ্গিনী হতে তাই আমার কোনো সমস্যা হয়নি, কিন্তু আমার ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়েই রাজা ঢলে পড়েছিলেন মৃত্যুর কোলে। অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর হৃদযন্ত্র।” একটু থেমে দম নিল বিভা। “কিন্তু এই শক্তির দাম দিয়ে চলেছি আমি। আমায় চুরি করে এনেছিল এক তান্ত্রিক, বড়ো হয়ে ওঠার সময়ে আমার একমাত্র কাজ ছিল এক আধারে শুয়ে প্রহর গোনা। সেই সময়ে সেই তান্ত্রিক আমায় বিদ্ধ করত অনেক সূচে, আমার রক্তে ধীরে ধীরে মেশাত বিবিধ ধরনের বিষ। সেই বিষ চকিতে মেরে ফেলে আমার শিকারদের, আর ক্রমশ হরণ করে চলেছে আমার প্রাণশক্তি। কাউকে কামনা করতে পারিনি আমি, কাউকে ভালোবাসতে পারিনি। জানি, আমার স্পর্শে মৃত্যু হবে সেই মানুষটির। একমাত্র অর্কপ্রভার পুরোহিতেরাই পারেন আমার শরীর থেকে সেই বিষদের নিষ্কাশন করতে, আমায় নতুনভাবে বাঁচাতে। তাই স্বার্থপরের মতো এসেছি এখানে, নিজেকে বাঁচাবার শেষ চেষ্টা করতে।”
“আর আখেনাতন? সে কীভাবে এই কাহিনির অঙ্গ?”
“ওর কেন বিয়ে ঠিক হয়েছিল জান?”
রাকা মেয়েটির কাছ থেকে তার অতীত সম্পর্কে কিছু ভাসাভাসা কথা শুনেছে মাত্র। তাই সে মাথা নাড়ল কেবল।
বিভা বলল, “সিংহাসনে বসার পর থেকে রাজা করের হার বহুগুণ বৃদ্ধি করেছেন, রাজকোষে নাকি টান ধরেছিল তাই এই পরিকল্পনা। কিন্তু আমি রাজকোষ দেখেছি, রাকা, সেখানে আমরা ঝাঁপ দিলে স্বর্ণমুদ্রার সমুদ্রে হারিয়ে যেতে পারি।” জোরে জোরে আবার শ্বাস নিল সে। পথশ্রমের কষ্ট নয়, তার মুখে ফুটে উঠেছে জীবনশক্তি শেষ হয়ে আসার পীড়া। “আসলে কিছু মানুষের লালসার কোনো সীমাপরিসীমা নেই। গোটা জগৎটাই ক্ষুদ্র পাত্র হয়ে যায় তাদের লোভের সামনে। সেই কর দিতে পারার সামর্থ্য আর্থ-সামাজিকভাবে রুগ্ন মানুষগুলোর থাকে না। তাই উপায়ন্তর না দেখে মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ধার নিতে বাধ্য হয় তারা। সেই ধার সময়ে না মেটাতে পারলে সবকিছু সেই মহাজনকেই বিক্রি করতে হয় তাদের। চাষি হলে খেত, বড়ো জেলে হলে তার সমুদ্রে যাওয়ার নৌকা, ছোটো জেলে হলে সেই নৌকোর সঙ্গে নিজের মেয়েকেও।”
“অর্কপ্রভার পুরোহিতেরা এত ক্ষমতাবান, তারা জম্ভাব্যাপী এত অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান না কেন?”
“রাকা, কামানের সামনে মসলিন দাঁড়ালে মসলিনই কেবল ছিন্নভিন্ন হয়, সুতোয় লাগে রক্তের ছিটে। কামানের কিছু হয় না। খোজা বাদে কোনো পুরুষ মসলিন পরে প্রকৃতি এবং আত্মার শক্তিকে চালনা করতে পারেন না। আবার মেয়েরা পারে না সেই শক্তিকে ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করতে। মসলিনের প্রয়োজন বহির্ভূত ব্যবহার অনেক পুরোহিতকেই বানিয়ে দেয় এক চলৎশক্তি রহিত জড়বস্তু, তখন তাকে খাইয়ে দেওয়ার জন্যও প্রয়োজন পড়ে আরেকজন মানুষের। জম্ভাকে পরিবর্তনের কথা বলা যতটা সহজ, বাস্তবে রূপান্তরিত করা ততটাই কঠিন।”
রাকার মনে মেঘমল্লারপুরের রাজার বিরুদ্ধে দ্বেষ ছাড়া আর কিছু ছিল না বিভার কথা শোনার পরে। সে আম্রপালীর দিকে তাকাল, সেই সুকুমারী মুখে উজ্জ্বলভাবে প্রস্ফুটিত তার বাবার আদল। কিন্ত তার গায়ের পরিধান তাকে প্রতিমুহূর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছে তার মায়ের কথা। রাকা ভাবল, ‘আসলে মেয়েদের জীবন এই রকমই, নিজের পদবী পর্যন্ত নেই তাদের, নেই উত্তারাধিকারসূত্রে কিছু পাওয়ার আশা, তাদের জম্ভায় জন্ম কেবল শয্যাসঙ্গিনী হয়ে সন্তান প্রসব করার জন্য। কিন্তু কেন? কেন?’ বারদুয়েক মাথা ঝাঁকিয়ে সে এই চিন্তাগুলিকে দূর করল। সে এখন আর প্রশ্ন করে না এইরকম, জোর গলায় জিজ্ঞেস করে না অনাচারের প্রতিনিদান চাওয়ার। সে এখন বুঝছে, শক্তিমান হলেও অর্কপ্রভার পুরোহিতেরা জম্ভার পিতৃতান্ত্রিক সমাজেরই অংশ। আর সমাজের মধ্যে থেকে সমাজের পরিশোধন করা অসম্ভব। একা লড়া যায় না সুপ্রাচীন ব্যবস্থার সঙ্গে। আর তাদের স্থান বর্ণাশ্রমের একেবারে নীচের সিঁড়িতে। একে সে শবর, তার উপরে মেয়েমানুষ।
“এখানে যদি মৃত্যু নেমে আসে আমাদের উপরে, অবাক হব না,” জোর গলাতেই কথাগুলো বলল সে।
থমকে গেল আম্রপালী। জিজ্ঞেস করল, “তুই জানিস এখানে আসার জন্য দলে দলে এককালে কুমারী মেয়েদের ভিড় লাগত দেবীর মন্দিরে, এখানে পা রাখার সুযোগ বা সাহস জম্ভার ইতিহাসে দেওতা এবং আমরা বাদে আর কারুর হয়নি, এবং হবেও না?” জোরে জোরে নিশ্বাস টানল সে। “হয়তো তাই জন্যই, প্রাচীনকালে এই গিরিপথকে বলা হত স্বর্গরোহিণী। সেই আদিকালে নাম তৈরি হত না জায়গার, নাম দেওয়া হত, তখন জম্ভা ছিল নবীন, তার বুকে ছিল অনেক সাগর, নদী, বন। তখন দিন এবং রাত কপোত-কপোতীর মতো জম্ভার বুকে বিহারে বেরত। কিন্তু সেই তিন যুগের মতো সেই ভাষারও বিনাশ ঘটেছে, কালের নদীতে ধুয়ে গেছে সবকিছু। নদীর দুইপাশে চোখ রাখলে একটা দুটো ক্ষয়ে আসা পাথর চোখে পড়ে। চেষ্টা করে যাচ্ছে সেই পাথর তার জন্মবৃত্তান্তকে ধরে রাখার। জনজাতির কথ্য ভাষার মধ্যে যে কয়েকটি প্রাচীন শব্দ এখনও টিকে, তারা ওই পাথরগুলির মত, পরিবর্তনের বিরুদ্ধে একা লড়াই করে চলেছে অবিচল থাকার।”
গর্জনটা কানে গেল সকলেরই। দূর থেকে ভেসে আসছে সেই হুঙ্কার, কিসে যেন মাটির হাঁড়ির মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে গজরাচ্ছে। জন্তুটা যাই হোক, ভারী, কিন্তু লঘুপদ। নাহলে সটান উঠে যাওয়া গিরিবর্ত্মে পা রেখে চলার করত না সেটা। সেই গর্জন আরেকটি কথাও প্রকট করে দেয়। জন্তুটা শ্বাপদ, সম্ভবত বেড়াল প্রজাতির। রাকা দেখল গর্জন শুনে আম্রপালীর মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। সে জানে কীসের ডাক ভেসে সুমেরু পর্বতের বাতাসে।
“তোমাদের যাদের কাছে পর্যাপ্ত মসলিন কাপড় নেই, মানে তোরা দুটো, ফিরে যা এখুনি। তুষারদেঁতোর কবলে পড়লে বেঁচে ফিরতে পারবি না।” আম্রপালী বলল।
তুষারদেঁতো? এই নাম শুনেছে রাকা। তাকে নিয়ে যখন নিঃশব্দ রাত্রির সমুদ্র পেরচ্ছিল পুরোহিতের দল, তখন তাদের নজর ছিল সামনে নয়, দুই পাশে এবং পেছনে। দূরে যখন এক চিলতে রোদের দেখা দিয়েছিল, দেখা গেছিল দিবস-সূর্যের এক দুর্লভ সবুজ রশ্মিচ্ছটা, তখনই কেবল তারা পারিপার্শ্বিকের দিকে লক্ষ রাখা বন্ধ করেছিলেন। বনের নারী বলেই রাকা পুরোহিতদের এই দৃষ্টি চিনতে পেরেছিল, এখন যেমন পেরেছে আম্রপালীর চোখ চিনতে। এই দৃষ্টি হরিণের দৃষ্টি, ভীরু শিকারের দৃষ্টি। জম্ভার অন্ধকার তুন্দ্রার একছত্র রাজা এই দৃষ্টিহীন বাঘ, শিকারকে চিরে ফেলার জন্যই বোধহয় তার শ্বদন্ত ঠেলে নেমেছে থুতনি অবধি। এই শ্বাপদ নাকি শব্দভেদী, সেই জন্যই তার কান দেহের অনুপাতে অনেক বড়ো।
রাকা এগিয়ে এল। তূণীর থেকে বের করল একটা তির। সেই তিরের লেজে লাগানো পালক ছিঁড়ে দুই আঙুলের মধ্যে রাখল। তারপর বলল, “আমার মনে হয় সামনের দিকে এগোনোই এখন সবথেকে নিরাপদ।“ পালকটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে। “বাতাস উপর থেকে নীচের দিকে বইছে। আমরা যদি চিৎকার করে কথা না বলি, বা উলটো দিকে না হাঁটি, ওই বাঘের সামনে আমরা অদৃশ্য।”
“তোর কথা আমি বিশ্বাস করব কেন? কে তুই?” আম্রপালী বলে উঠল। তারপর, রাকার কথা মনে পড়তেই মুখে চেপে ধরল তার দুই হাত।
“কারণ এই পর্বত ওই শ্বাপদের বিচরণক্ষেত্র নয়। যখন সে এখানে এসেছে তখন আমাদের বুঝতে হবে সে ক্ষুধার্ত এবং যুগপৎ রূপে বেপরোয়া। উপরে দেখ, আমরা শীঘ্রই রাত্রি থেকে সন্ধের রাজ্যে আবার পা দেব। তারপর শিখরে আমাদের জন্য সূর্য আবার অপেক্ষা করবে। দিবস-সূর্য দেবীর প্রথম সন্তান। তিনি রক্ষা করবেন আমাদের।”
ঘণ্টা তিনেক পরে একটা মোড় ঘুরতেই ওরা উঠে এল অনেকখানি। পা দিল সন্ধের রাজ্যে। রাকা আরেকবার উপরে চেয়ে দেখল। এখনও অনেক উপরে শিখর। কিন্ত মেঘগুলোকে যেন অনেক বড়ো মনে হচ্ছে আগের থেকে। নিজের গলা থেকে মসলিন উত্তরীয় খুলে চোখ বন্ধ করে মন্ত্র উচ্চারণ করল বিভা। আগুন জ্বলে উঠল কাপড়ের গায়ে। কিন্তু আশ্চর্য, সেই আগুনের তাপ রাকার মেলে ধরা হাতে লাগলেও পুড়ে গেল না কাপড়। খুব ভালো করে লক্ষ করে রাকা দেখল, আগুন কাপড়ের উপরে জ্বলছে, কাপড়ের গায়ে নয়। কাপড়ের একদিক ধরে আছে বিভা, সেই দিকটি সবথেকে উজ্জ্বল। কষ্ট ফুটে উঠেছে বিভার চোখে মুখে। কিন্তু আম্রপালীকে সে আগুন জ্বালিয়ে রাখতে বলল না। উদাসীন হয়ে সে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল পশ্চিম দিগন্তের পানে, যেন সেই তমসার মধ্যে নিজের মুক্তিকে খোঁজার চেষ্টা করছে সে। একটা সময়ে আগুন দপদপ করে উঠল, বিভা কাপড় থেকে হাত সরিয়ে নিতেই রাকা চেপে ধরল তাকে, আরেক হাতে শক্ত মুঠোয় আটকে রাখল বিভার মসলিনের খণ্ডটি। বিভার মুখমণ্ডল মৃত মানুষের মতো বর্ণহীন হয়ে গিয়েছিল। ধীর লয়ে যখন তার ওষ্ঠ রক্তাভ হয়ে উঠল, সে দেখল তার সামনে মসলিনকে কেন্দ্র করে দাউদাউ করে জ্বলছে এক বিরাট ধুনি। এই ধুনি তার আগুনের মতো শীতল বোবা নয়, এই আগুনের শব্দ আছে, লয় আছে। কান পাতলে যেন কাঠ ফাটার আওয়াজও কানে আসে। ক্লিষ্ট হাসল বিভা, আম্রপালীর বিস্ফোরিত চোখমুখের দিকে তাকিয়ে। অর্কপ্রভার পুরোহিতদের তেজ এবং প্রজ্ঞা এখন অস্তমিত, কিন্তু তারা প্রতিভা চিনতে ভুল করেনি। সঠিক শিক্ষয়িত্রীর হাতে পড়লে রাকার সুপ্ত প্রতিভা নিস্তব্ধ রাত্রির সমুদ্রের বরফ ভাঙতে পারবে, অথবা জ্বালিয়ে দেবে গোটা জম্ভাকে তার তেজে।
“তোমাকে নিজের অন্তরাত্মার শক্তি সুতোর মাধ্যমে চালনা করতে কে শিখিয়েছে?” আড়ষ্ট কণ্ঠে আম্রপালী জিজ্ঞেস করল।
সত্যিই তো, কে শিখিয়েছে তাকে? রাকা মনে করার চেষ্টা করল। কোন সে ভুলে যাওয়া শৈশবে সে প্রথমবার বাকি শবরদের পিছু নিয়েছিল কৌতূহলবশত, কঙ্কণ বনে হারিয়ে গেছিল সেই কারণে সেই ছয় বছরের মেয়ে। প্রায় তিনদিন পরে শিকারির এক দল খুঁজে পেয়েছিল রাকাকে। সবাই বলে ওই তিনদিনে রাকা শৈশব থেকে কৈশোরে পা দেয়, দিতে বাধ্য হয়। রাকার মনে পড়ল হঠাৎ সেই বিশাল পাখি-মানুষের কঙ্কাল। দেওতাদের পক্ষ নেওয়ার জন্য যার ডানা কেটে দিয়েছিল মানুষ। সেই পাখি-মানুষের কঙ্কালের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে রাকার অন্তর্নিহিত শক্তি জেগে উঠেছিল। জেগে উঠেছিল তার সমস্ত ইন্দ্রিয়। তার পরিধানের মধ্যে কী করে কে জানে, বোনা সুতোর একটি ছিল মসলিন তন্তু। সেই তন্তু জ্বলে উঠে জ্বালিয়ে দিয়েছিল তার গায়ের কাপড়। রাকা মনস্থির করে আম্রপালীকে সেই ঘটনাটি বলল।
“গরুড়ের দেহ খুঁজে পায়নি কেউ যুদ্ধের পরে। তাকে মারতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল এক গোটা বাহিনী। তুমি বলছ সেই গরুড়ের কঙ্কাল পড়ে কঙ্কণ বনের মধ্যে কোথাও?”
তাকে বাধা দিল বিভা। “গরুড়কে সৃষ্টি করা হয়েছিল ধ্বংসের বাহক হিসেবে। কে জানে সেই কঙ্কালের মধ্যে লুকিয়ে কত অবদমিত শক্তিপুঞ্জ? কিছু জিনিস অগোচরে থাকাই ভালো, নাহলে দলে দলে লোভীর দল পাড়ি দেবে সেখানে।”
“আত্মশক্তি সকলের মধ্যেই থাকে, বিভা। কিন্তু কাজে লাগাতে পারে কয়জন? বুঝতে পারে কজন?” আম্রপালী বলল। “আমাদের তন্তু নিষ্কাশন পদ্ধতি ব্যতীত আকন্দ গাছের ফল থেকে মসলিন তৈরি অসম্ভব। সেই জন্যই এই পথে যাত্রী আমরা চারজন মাত্র।”
ওদের কথা চুপচাপ শুনছিল আখেনাতন। হঠাৎ সে আগুনের পাশ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কাঁপাকাঁপা আঙুল তুলে সামনের পাথরের দেওয়াল দেখিয়ে বলল, “ওটা কী?”
মাঝে মাঝে মধ্যরাতের সূর্য দিবস-সূর্যের সামনে চলে এসে যেমন গ্রহণ করায়, তেমনই সুমেরুর শিখরের মোহময় প্রেক্ষাপট ঢেকে কিসে যেন দাঁড়িয়ে পাথরের দেওয়ালের উপরে। সেই জীবের বিশাল পশমি লেজ অল্পঅল্প দুলছে। অতিকায় দেহ ঢাকা মখমলে লোমে। এত দূর থেকেও জন্তুটার বিশাল শ্বদন্ত, এবং অন্ধ চোখের মণি বুঝতে পারল রাকা। অস্ফুটে বলল, “তুষারদেঁতো।”
বাঘটা ঝাঁপ দিল তখনই। রাকা দেখল সেই অতিকায় শরীর ভেসে আসছে তার দিকে পালকের মতো, সময় যেন হঠাৎ থমকে গেছে তাদের দুইজনের মাঝে। দুইপাশের সবকিছু ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। কেবল একটাই জিনিস সার্বিক সত্য, ওই শ্বাপদের অতিকায় দাঁতজোড়া।
হাতের মুঠোয় তখনও সে চেপে আছে বিভার মসলিনের টুকরোটি। উত্তাপদায়ী আগুন পলকের মধ্যে আকার নিল এক তরোয়ালের, গর্জে উঠল বাঘটার দিকে। শেষ মুহূর্তে দিক পরিবর্তন করল শ্বাপদ, শব্দের উলটো দিকে লাফিয়ে নেমে হারিয়ে গেল পর্বতের কোন খাঁজে। চিৎকার করে উঠল আম্রপালী। “অপদার্থ, শবরের মেয়ে শবরই হয়, তার পুরোহিত হওয়ার যোগ্যতা নেই।”
উত্তর দেওয়ার আগে শুনতে পেল এক গুরুগম্ভীর ক্রমঅগ্রসরমান শব্দ, গোটা জম্ভা যেন কঁকিয়ে গোঙাচ্ছে। উপরে তাকাল রাকা, শব্দের উৎস সন্ধানে। দেখল মেঘের দল ভীমবেগে নেমে আসছে তার দিকে। যখন সে বুঝল তুষারধস দেখতে কীরূপ হয়, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
***
আখেনাতনের ধাক্কায় চোখ মেলে তাকাল রাকা। হাত বাড়িয়ে চারিদিকে কেবল তীব্র ঠান্ডা কিছু ঠেকল। তার চারপাশে ভীষণ অন্ধকার। কেঁদে ফেলল আখেনাতন। “দিদি, ওরা আমাদের এভাবে ছেড়ে পালাল?”
রাকা তখনও বুঝে উঠতে পারেনি তুষারধস তাদের জীবন্ত কবর দিয়েছে। মাথার ধোঁয়াশা কাটতে তার আরও অনেকক্ষণ সময় লাগল। আর সেই সঙ্গে মাথায় চাগাড় দিয়ে উঠল অসহ্য যন্ত্রণা। হাত দিতে কেবল একটা চটচটে অনুভূতি হাতে ঠেকল তার। শীত রক্তপাত ঠেকিয়ে রক্ষা করেছে তাকে। কিন্তু বাতাস যে দ্রুত ফুরিয়ে আসছে! বাইরে কান পাতল সে, কোথাও তাদের ভারী নিশ্বাস ব্যতীত আর কোনো শব্দ নেই, নেই কারুর ত্রস্ত পদশব্দ, অথবা কারুর শঙ্কিত চিৎকার। প্রথমবার ভয় পেল রাকা, অন্ধকারকে ধন্যবাদ দিল সে, আখেনাতনকে তার ভয় না দেখানোর জন্য। “তোমার কবজিতে মাদুলি করে বাঁধা মসলিনের সুতো দিয়ে একটু আলো জ্বালাতে পারবে?”
মনোনিবেশ করার কিছুক্ষণ চেষ্টা করল আখেনাতন। তার কব্জিতে জড়ানো সুতোটি বংশানুক্রমে তাদের মহার্ঘতম সম্পদ। যে জেলেপাড়ায় তার জন্ম, সেই সমুদ্রের ধারের জনপদে মসলিন পরিধান দূরে থাক, দেখাই দিবাস্বপ্ন। কথিত আছে, এক জাহাজডুবি হওয়া সর্দারকে বাঁচিয়ে ছিল তার ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সেই সর্দার দিয়েছিলেন তার মসলিনের রুমাল উপহার। কিন্তু কাপড়ের বয়স হয়, সুতো ছিঁড়ে মিশে যায় বাতাসে। দেড়শো বছর পরে তাই সেই রুমালের এই একটি সুতো ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আখেনাতনের কব্জিতে সেই সুতো জোনাকির মতো কিছুক্ষণ দপদপ করল, তারপর আবার তাদেরকে গ্রাস করল অন্ধকার। রাকা এরই মধ্যে দেখল ভালো করে আখেনাতনের কবজি। সেই সুতো গিঁট দিয়ে লাগানো, রাকার সাধ্য নেই সেই গিঁট খোলার। এই প্রাচীন সুতো ছিঁড়ে গেলে পুরোহিতদের কৌশল ব্যতিত তাকে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যাবে না।
তাহলে? রাকা ভাবল, মনে করার চেষ্টা করল প্রধান পুরোহিতের কথাগুলি। হয়তো সেই স্মৃতিই এখন প্রাণ বাঁচাবে তার।
“মসলিন তো ধারক মাত্র। আসল শক্তি, রাকা, তোমার ভেতরে। সৃষ্টির আদিতে, যখন বন্যার জল নেমে গিয়ে দেখা দিল প্রথম ভূখণ্ড, দেওতারা নতুন করে সৃষ্টি করেছিলেন মানুষদের। আগের বারে সৃষ্টি করে তাঁরা নিজের অক্ষমতা এবং ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, তাই মহাপ্লাবনের পরে আমাদের মুছে দিয়ে আবার যখন গড়লেন তাঁরা, তখন আমাদের আত্মাকে দেহনির্ভর না রেখে গড়ে তুলেছিলেন স্বয়ংসম্পূর্ণ উপস্থিতি হিসেবে। তারপর কালের নদীতে অনেক জল গড়িয়ে গেছে, জম্ভা হারিয়েছে তার অক্ষীয় গতি, কিন্তু আত্মার অন্তর্নিহিত শক্তি কমে গেলেও মুছে যায়নি। আমাদের মধ্যে পাপের ভাঁড়ার যাদের প্রায় খালি, তারাই কেবল শুদ্ধ মনে আত্মার এই শক্তিকে চালনা করতে পারে।” প্রধান পুরোহিত বলে উঠলেন রাকার মনের মাঝে।
“কিন্তু আমি তো পাপ করেছি। পেটের জ্বালা নিবারণের জন্য হত্যা করেছি বনের প্রাণী।” রাকা বিড়বিড় করল।
যেন স্মিত হাসলেন পুরোহিত। “একটু আগে যে শ্বাপদ আক্রমণ করেছিল, সে কি তবে পাপী? তাহলে কি কোনো মাংসাশী জীবের বেঁচে থাকার অধিকার নেই?”
“কিন্তু…”
“রাকা, নিজের জৈবিক প্রয়োজনে হত্যা জম্ভার প্রাকৃতিক শৃঙ্খলের অংশ, সে পাপ নয়, জীবননির্বাহের পথ। কিন্তু মানুষ যখন যুদ্ধ করে, নিঃসঙ্কোচে ছুরি বসিয়ে দেয় কারুর বুকে, তখন সে সমাজবদ্ধ জীব হয়ে যায়, আর মানুষের সমাজ প্রাকৃতিক শৃঙ্খলের অংশ নয়।”
বরফের গায়ে দুরুদুরু বুকে হাত রাখল রাকা। মনে করার চেষ্টা করল তার শৈশব, তার কঙ্কণ বন। মনে করল তার মায়ের মুখ, তার গ্রাম, এবং সেই গহীন বনে চিরশয্যায় শায়িত গরুড়কে। বরফ যেন হাতের তালুতে বিঁধল তাকে, মুহূর্তে অবশ হয়ে গেল তার তালু পশমি দস্তানা না থাকায়।
কিন্তু না, কোনো চমৎকার জন্ম নিল না তার সামনে। তাহলে কি প্রধান পুরোহিত মিথ্যা বলেছিলেন? বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন রাকাকে? নাকি সুযোগ নিয়েছিলেন তার জঙ্গলি মনের?
“নিস্পাপ মনের।” দাঁতে দাঁত পিষে বলল রাকা। কিন্তু হাত সে সরাল না বরফের উপর থেকে। বলা ভালো, সরানোর ক্ষমতা ততক্ষণে হারিয়েছে রাকা। তার হাতের চামড়া আটকে গেছে বরফের গায়ে। কান্না পাচ্ছিল রাকার, কিন্তু আখেনাতনের কথা ভেবে সে কান্নাকে আটকে রাখল। এভাবে মরতে চায়নি সে। এভাবে…
রাকার মনে পড়ল গরুড়ের কঙ্কালের থেকে সে কীভাবে পথ চিনে বেরিয়েছিল কঙ্কণের গোলকধাঁধা থেকে যতক্ষণ না তার দেখা পায় উদ্ধারকারী দল। গরুড়ের বিশাল কঙ্কালের উপরে জন্মেছিল অনেক লতাপাতা, মাটি জমিয়ে ঘর বানিয়েছিল উইয়েরা। তার দেহাবশেষকে রূপান্তরিত করেছিল বিশাল ঢিপিতে। রাকা সেই বয়সে আন্দাজ করতে পারেনি যে বিশাল সময় পেরিয়ে গেছে জম্ভার তৃতীয় যুগ শেষ হওয়ার পরে। শুধু বুঝতে পেরেছিল তার সামনে যে জীবের হাড় পড়ে আছে, তার মৃত্যু হয়েছিল সুপ্রাচীন যুগে। এবং আরেকটা জিনিস সে বুঝতে পেরেছিল বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও। হিংসা যুগে যুগে একই আকার ধারণ করে, একই চিহ্ন ফেলে যায় ভবিষ্যতের জন্য। এখন রাকা বোঝে, সেইটাই কেবল পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে মানুষ উত্তরাধিকার সূত্রে পায়, বিস্মৃতি এবং পুনর্বার ভুল করার স্পৃহা। গরুড়ের হাড় থেকে লতা সরিয়ে সে দেখেছিল অনেক লম্বা লম্বা কালচে দাগ, সেই জায়গাগুলো যেখানে বর্শা বিদ্ধ করেছিল এই প্রাচীন মহাপক্ষীমানবকে। সেই জায়গাগুলো যেখানে মানুষ তার গায়ে চেপে ধরেছিল গনগনে আগুন। এর আগে মানুষের নৃশংসতার পরিচয় সে পায়নি, হতভম্ব হয়ে সে সেই কঙ্কালের সামনে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানে না। সূর্য ঢলে না জম্ভার আকাশে, বালুঘড়ি ব্যতিত সময় জানার অন্য কোনো রাস্তা নেই। রাকার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ভয়ংকর যুদ্ধের ছবি, সেখানে দেওতাদের শূন্যে ভাসমান প্রাসাদে আক্রমণ করেছে মানুষ। জ্বলছে সেই প্রাসাদ, দলে দলে পালাচ্ছেন দেওতারা। যে মানুষেরা সেই প্রজ্বলন্ত প্রাসাদের বুকে দাঁড়িয়ে গর্বোদ্ধত উন্মাদের মতো নৃত্য করছে তাদের সঙ্গে মানুষের থেকে রাক্ষসের মিল বেশি।
বাস্তবে সে ফিরল যখন তার গায়ে মুখ ঘষল এক হরিণ। ওর চারপাশে কিছুক্ষণ লাফালাফি করে বনের ওপর প্রান্তে এগিয়ে গিয়ে আবার পিছন ফিরে চাইল সেটা, আবার কাছে এসে রাকাকে ঠেলে এগোল সেই দিকে। রাকা তখন বুঝতে পারেনি কেন সেই হরিণ তাকে সাহায্য করেছে, কারণ অন্যান্য সময়ে সে শুনেছে শবরদের দেখলেই হরিণের পাল মিলিয়ে যায় জঙ্গলে। রাকা তখন বুঝতে পারেনি যে হরিণটি জঙ্গলের নিয়ম সম্পর্কে অবহিত, অবহিত নয় মানুষের অনর্থক মৃত্যু নিয়ে খেলা সম্পর্কে। কাঁটাঝোপে পেট থেকে রক্ত বেরতে সে চমকে উঠে দেখে সে বিবস্ত্র। কোমরের কাছে শুধু ধিকধিক করে জ্বলছে একটা সুতো।
একটিমাত্র মসলিনের সুতো থাকায় গরুড়ের কঙ্কালে নিমজ্জিত স্মৃতি তাকে গিলে ফেললেও ধরে রাখতে পারেনি। নিজের মনের জোরে রাকা সেই ইতিহাসের বেড়াজাল ভেঙে চলে এসেছে। সুতো তাকে সাহায্য করেছে, পথ দেখিয়ে দেয়নি। মসলিন অনুঘটক মাত্র।
হিসহিস শব্দে রাকার দিকে অপলকে তাকাল রাকা। অন্ধকারের মধ্যেও রাকাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে, দেখতে পাচ্ছে রাকার হাত এবং বরফের সংযোগস্থল থেকে বাষ্প বেরোচ্ছে। শব্দ সেই কারণেই। নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে আখেনাতন। রাকার গোটা শরীর মসলিনের আলোর মতো স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত।
বরফের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে আখেনাতনকে বের করল রাকা। লক্ষ্য তার নীচের দিকে। রাকাকে হাত ধরে টেনে বাধা দিল ছোটো মেয়েটি। “আমি ফিরে যেতে পারি না, দিদি। টাকা দিয়ে আমায় কিনেছে অর্কপ্রভার পুরোহিতেরা। নিজের মূল্য চোকাতে হবে আমায়। আমি শুনেছি, স্বাধীনতা নাকি পাওয়া যায় না, নিতে হয়।”
শৃঙ্গের দিকে এবার তাকাল রাকা। অভীষ্টের এত কাছে দাঁড়িয়ে তার হৃদয় কেন তাকে চলে যেতে বলছে? সে নিজেকে আখেনাতনের সামনে ভীরু প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর কেন? নাকি এই পলায়ন্মুখ আচরণ আসলে তার মায়ের প্রতি রাগের বহিঃপ্রকাশ? মাথা ঝাঁকাল সে। “দেবী অর্কপ্রভার পুরোহিত রাকাশ্বরী দাসি আমার নাম। কঙ্কণ বন আমার বাস। আমি শবরকন্যা। আমি পিছু হটতে জানি না।” বিড়বিড় করে বলল সে।
***
সুদূর অতীতে, সেই প্রথম যুগের শুরুতে এখন এখানে সুমেরু পর্বত, সেখানে নাকি ছিল এক অতিকায় হ্রদ। অর্কপ্রভা তখনও দেবী হননি। স্বর্গের বাগানে খেলে বেড়ানো এক যুবতী তখন তিনি। তখন এক যন্ত্রের উদ্ভাবন করেন তিনি, দিবস-সূর্যের সম্পৃক্ত আলো সেই যন্ত্র সংগ্রহ করে তৈরি করে এক ফল। সেই সৌরশক্তি দিয়ে তৈরি ফল টুপ করে খসে পড়ে এই হ্রদের বুকে, দেখা দেয় মাটিতে এক সুগভীর ফাটল। প্রথমে হ্রদের সমস্ত মাছ মরে গিয়ে ভেসে ওঠে, তারপর তার জল ফুটতে শুরু করে। ক্রমশ সেই হ্রদের জলকে সরিয়ে জায়গা নেয় গলিত পাথর, মাথা ছাড়া দেয় এক আগ্নেয়গিরি। সেই আগ্নেয়গিরির উপরে ওঠার ঈপ্সা কমে না, যতক্ষণ না এক প্রয়লঙ্কর বিস্ফোরণের ফলে তার চুড়োটাই না উড়ে যায়। সেই শৃঙ্গে জল জমে তৈরি হয়েছে এক হ্রদ। আর এখন, তাদের গন্তবস্থল, রাত্রির দেশে থেকেও উচ্চতার জন্য সর্বদা সূর্যের আলোয় আলোকিত, আকন্দের সংরক্ষিত বনাঞ্চল।
সূর্যের ওম পিঠে লাগল তাদের যখন তাদের সামনে গিরিখাত শেষ হয়ে দেখা দিল সবুজের বন্যা। চারিদিকে উঁচু আগ্নেয়পাথরের প্রাকৃতিক প্রাচীর দিকে সুরক্ষিত এই বনে সর্বপ্রথম যা কানে এল রাকার তা হল পাখির ডাক। এতক্ষণ ঊষর পর্বতরোহণের পরে নিজের বাড়ির ডাক শুনতে পেয়ে রাকা স্বভাবতই পুলকিত। ক্ষণিকের জন্য ভুলে গেল সে এখান থেকে পালাতে চেয়েছিল। আকন্দ ফলের তন্তু তোলার পদ্ধতি নিয়ে পুরোহিতদের মন্ত্র সে বলে উঠল গুণগুণ করে।
“না শীত, না উষ্ণ,
না দিন না রাত্রি,
যেখানে প্রাণ অমলিন,
যেখানে মন্থনের বিষ উঠে আসেনি কখনও।
সেখানে আকন্দ ধরা দেয় কুমারীর হাতে,
যদি সেই মেয়ে আসে স্বেচ্ছায়,
যদি সেই মেয়ের ঈপ্সা না থাকে জম্ভা জয়ের।”
রাকা অনুধাবন করল, সম্ভবত এই কারণেই অর্কপ্রভার পুরোহিতেরা জম্ভার দ্বেষমাখা রাজনীতি থেকে দূরে থাকে, হয়তো তাঁরা বিশ্বাস করেন ক্ষমতার লোভ তাদের মধ্যে চাগাড় দিলে মসলিন ক্ষমতা হারাবে তাদের। রাকা ক্লিষ্ট হাসল। আসলে মসলিন ক্ষমতা হারায় না, আর পুরোহিতেদের মন নিস্পাপ থাকে না যখন তাঁরা ক্ষমতা কামনা করেন। আত্মার সঙ্গে দেহের দূরত্ব বৃদ্ধি হতে থাকে সেই সঙ্গে।
অভীষ্টের কাছে এলে মানুষের নেশা লাগে। রাকারও লেগেছিল, তাই পদচিহ্নটা আখেনাতনের চোখে পড়ল, ওর না। দুই জোড়া মানুষের পায়ের ছাপ জঙ্গলের কাদামাটির উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়েছে। গাছ দেখতে পেয়ে সেই মানুষ দুইজন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছে, সম্ভবত নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য। সেইখানে গভীরভাবে পড়েছে তাদের পদচিহ্ন। একজন এর মধ্যে একটু ধীরে হাঁটে, বয়সের জন্য নয়, জীবনশক্তি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ক্লান্তির জন্য। গোড়ালির ছাপ তার স্পষ্ট। আরেক জন উশখুশ করছে আকন্দ গাছ থেকে ফল পেড়ে নেওয়ার জন্য, চঞ্চল বলেই পায়ের ছাপ তার পুরোপুরি পরেনি।
এই পায়ের ছাপদের মৃদুমন্দ গতিতে অনুসরণ করেছে আরেকটি পায়ের ছাপ। পাশের পাথরের দেওয়াল বেয়ে সে নেমেছে, হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড়ের দাগ লেগেছে চলতা উঠে যাওয়া পাথরের গায়ে। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ ঘোরার পরে তার নাকে সম্ভবত এসেছে দুইজন মানুষের ঘ্রাণ। এগিয়ে এসে মানুষদের পদচিহ্ন যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ সে শুঁকেছে। সেইখানে থেবড়ে কাদার উপরে ফুটে উঠেছে তার গভীর পদচিহ্ন। এরপর সে এগিয়েছে পায়ে পায়ে, কিছু জায়গায় গাছে ধাক্কা খেয়েছে জানোয়ারটি, অন্ধ বলে। সেখানে পড়ে আছে দুয়েকটা সবুজ পাতা বা কাঁচা আকন্দ ফল। তুষারদেঁতোটি এক অতিকায় জানোয়ার, তার যৌবন অতিক্রান্ত হয়েছে বহুদিন আগে। রাকা লক্ষ করল সামনের ডান পায়ের ছাপ পুরোপুরি পরেনি কাদায়। সম্ভবত জানোয়ারটি খুঁড়িয়ে হাঁটে। কিন্তু এই শারীরিক অসুবিধা যে তাকে শিকার ধরতে বাধা দেয় না সে রাকা তার লাফ দেওয়া দেখেই বুঝেছিল। আপনা থেকেই তূণীরে হাত চলে গেল তার। থুতনি দিতে গড়িয়ে নামল একফোঁটা ঘাম।
আখেনাতনকে একটা উঁচু ডালে উঠিয়ে পদচিহ্নদের ধাওয়া করল রাকা। বুক তার ভয়ে ধকধক করছে। আম্রপালী যাই হোক না কেন মানুষ হিসেবে, তার মাকে সে কথা দিয়েছে। এখন এইস্থানে এসে সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হবে? ছুটছে রাকা, দুই পাশে তার পিছিয়ে যাচ্ছে গাছের পর গাছ। রাকা খেয়াল করছে না, কিন্তু তার ত্বক থেকে বিচ্ছুরিত হছে এক আলো। আগের থেকে তার জ্যোতি বেশ কিছুটা তীব্র। সেই আলো যে যে ফলের গায়ে লাগছে সেই ফলগুলি মুহূর্তে পেকে গিয়ে ফেটে যাচ্ছে, সেই তুলো ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। রাকা খেয়াল করছে না, কিন্তু সেই তুলোর দল একত্রিত হয়ে মেঘের জন্ম দিচ্ছে। সেই মেঘ, নদী যেমন নামে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে, প্রথমে ধীরে ধীরে, তারপর জলপ্রপাত হয়ে, সেইভাবে পিছু নিচ্ছে রাকার। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে এক শবরকন্যা। তারপর পিছু পিছ চলছে যেন বাতাসে ভাসমান এক অতিকায় সাদা কুকুর।
পথের যেন শেষ হয় না, শেষ হয়না পদচিহ্নর। হ্রদের তীরে পৌঁছে রাকা থমকে গেল। জলে অল্প অল্প করে রক্ত মিশছে। এক ধারে পড়ে আছে বিভা। তাকে আক্রমণ করলেও খাদ্যরূপে বরণ করেনি বাঘটা। হয়তো বিভার রক্তে তীব্র বিষের উপস্থিতি সেটা বুঝতে পেরেছিল। বিভার দেহে তখনও কিছুটা প্রাণ অবশিষ্ট ছিল। রাকাকে দেখে নিজের উত্তরীয় এবং ছোরা কম্পিত হস্তে এগিয়ে দিল সে। “আমায় সামনে ঠেলে দিয়েছে ও। ক্ষমা করো না ওকে।”
বিভা হয়তো অপেক্ষা করছিল রাকার জন্য। কারণ, এরপরই প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল তার। স্থির চক্ষে সে চেয়ে রইল উপরে আকাশের গায়ে লেগে থাকা অসংখ্য নক্ষত্র এবং নিশীথ সূর্যের দিকে। যাত্রা সাঙ্গ হয়েছে বিষকন্যার। এখানে সে সম্ভবত সে বুঝতে পেরেছিল, খাঁটি মসলিন তার কাছে কখনই তার আসল রূপ খুলবে না। যে মসলিনের উত্তরীয় তার প্রভু দিয়েছিল, যে প্রভুকে সে হত্যা করেছিল নিজের হাতে, সেই কেবল জানত মসলিনকে আত্মশক্তির সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্ম করার, যার জন্য কোনো নিস্পাপ হৃদয়ের প্রয়োজন নেই। কিন্তু সে অক্ষম অনুকরণের ক্ষমতা সীমিত, তাই তার নিত্যসহচর এই ছোরা। যাত্রা সাঙ্গ হয়েছে তার। জম্ভার অনেকের মতো সেও এক বিশাল খেলার সামান্য পুতুল।
রাকা আঙুল দিয়ে বন্ধ করে দিল বিভার চোখ, তারপর আবার উঠে দাঁড়িয়ে পদশব্দ অনুসরণ শুরু করল। দেরি হয়ে গেছে তার, অনেকখানি দেরি হয়ে গেছে।
দাঁতের চাপে হাড় ভাঙার শব্দ কানে এল তখনই। হ্রদের তীরে, আরও বেশ কিছুটা দূরে এক অতিকায় আকন্দ গাছের গুঁড়ি পড়ে। সেই গুঁড়ি পেরনোর আগেই আম্রপালীর উপরে লাফিয়ে পড়ে বাঘটা। রাকার কাছে আসার শব্দ শুনে সেটা শিকার থেকে মুখ তুলে কান উঁচু করল। তারপর গন্ধ চিনতে পেরে করল এক রক্তজলকরা গর্জন। পর্বতশৃঙ্গ জম্ভাজের বাতাস যেন দুই টুকরো হয়ে গেল সেই গর্জন শুনে। রাকার প্রচণ্ড ইচ্ছা করল পালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু সে পালাল না। বাঘটার মুখের একদিকে লেগে আছে একটুকরো মসলিন শাড়ির অংশ। কয়েক ঘণ্টা আগেও সেই শাড়ির গায়ে পড়ে বাষ্পীভূত হচ্ছিল বরফকণা। আম্রপালী হেরে গিয়েছিল ধারাল দাঁতনখের কাছে। নিজের বাবার প্রতি যে ঘৃণা, সেই ঘৃণা কলুষিত করে দিয়েছিল তার হৃদয়। পাপ করেনি সে, কিন্তু পাপ করার চিন্তা করেছিল। নিজের মায়ের মতো সে মেঘমল্লারপুরের রাজাকে ক্ষমা করে দিলে হয়তো এখন তার পরিধান জীবন বাঁচাত তার।
রাকা যে সরে যায়নি বাঘটা বুঝতে পারল। উঠে দাঁড়াল সে, ফুলে গেছে তার কাঁধের ধূসর লোম। শ্বদন্ত এবং ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে তার ঝরে পড়ছে রক্তমাখা নাল। অনেকদিন ক্ষুধার্ত ছিল সে, এখন খাওয়ার সময়ে বিঘ্ন ঘটায় সে ক্ষিপ্ত। হাঁটু ভাঁজ করে সে প্রস্তুতি নিল।
রাকা আবার দেখল তার সামনে ধীর গতিতে ভেসে আসছে এক অতিকায় শরীর। সে জানে ওই দাঁত এবং নখ ছিঁড়ে খণ্ডখণ্ড করে দেবে তার শরীর। কেন? কেন সে এল এখানে? বেশ তো ফিরে যাচ্ছিল নীচে। আখেনাতনের কথা না শুনলে ওই পুঁচকে মেয়েটার সাধ্য হত তাকে রোখার? এখন হয়তো তাকে শেষ করার পরে আখেনাতনের সন্ধান করবে বাঘটা। কে জানে, হয়তো এই শ্বাপদ গাছে উঠতেও পারদর্শী।
কাছে এগিয়ে আসছে ওই ধূসর লোমশ শরীর। চোখ বন্ধ করার ইচ্ছা করছে তার ভীষণ। করবে?
না। করবে না সে। আর সে পিছু হটবে না। আর সে পরিস্থিতিকে দেবে না নিজের ভাগ্য নির্ধারণ করতে। আর সে কঙ্কণ বনের এক সামান্য মেয়ে না, সে গরুড়ের দেহ আবিষ্কারক, সে পুরোহিত হওয়ার জন্য এই তীর্থযাত্রায় এসেছে। সে শক্তিধর। সে দেবী অর্কপ্রভার আশীর্বাদধন্য।
আমি…
পলকের মধ্যে রাকা দেখল তার এবং তুষারদেঁতোর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াল তুলোর এক অতিকায় দেওয়াল। কানে এল তার ক্রমাগত বিস্ফোরণের শব্দ। গোটা জম্ভাজের বনাঞ্চল জুড়ে আকন্দ ফল, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে উদ্ভিদতন্তু। মিশে যাচ্ছে সেই তন্তু রাকার সামনের মেঘে। বাঘ সেই মেঘের মধ্যে ভাসমান। থাবা নাড়ানোর শক্তি পর্যন্ত নেই তার। গজরাচ্ছে অতিকায় শ্বাপদ, রাকার সামনে ক্রমাগত শূন্যে খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে তার অতিকায় মুখ। সশব্দে বন্ধ হচ্ছে বাতাসে শক্তিশালী চোয়াল। রাকা জানে না কি হচ্ছে তার সামনে, শুধু বুঝতে পারল, কঙ্কণের মতো এই বনও তার অন্তরাত্মার ডাক শুনেছে। এই বনও তার ঘর।
সে শিকারি, কিন্তু শহরের মানুষগুলোর মতো হত্যাখেলায় মেতে ওঠার জন্য শিকার করে না। এই জন্তুটিও করেনি। অনাহারে প্রায় পাগল হয়ে সে এসেছে এই বনে। রাকা আরেকবার দেখল বাঘটির দিকে। দাঁত নখের জিঘাংসার পেছনে উপস্থিত এক ভয়ার্ত চোখ। মুহূর্তে মনস্থির করে নিল রাকা। তারপর মনের শক্তি প্রয়োগ করল তার চারপাশে পুঞ্জিভূত মেঘের উপরে। বাঘটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল তুলোর মেঘেরা। আধ ঘণ্টা পরে যখন তারা ফিরল তখন তাদের গায়ে লেগে আছে তুষারকণারা। রাকা জানে না বাঘটির আবাস কোথায়। সে শুধু প্রার্থনা করেছিল যাতে বাঘটি নিজের গুহায় ফিরে যেতে পারে। মৃত্যুর দূত সে নয়, অযথা জীবন নেওয়ার অধিকার থাকা উচিত নয় তার।
অর্কপ্রভা মন্দিরের চুড়োয় রাখা আছে এক স্বর্ণকলস, তার আগে গ্রন্থিত জম্ভার দুই সূর্যের একদা উপস্থিত কক্ষপথ। প্রধান পুরোহিতের মন ভালো নেই। বেশ কয়েকঘণ্টা আগে সুমেরু থেকে ভেসে এসছে এক গুরুগম্ভীর গর্জন, তারপর তীর্থপথের উপরে খসে পড়েছে এক অতিকায় চাঙড়। শত দুশ্চিন্তার রেশ কাটাতে তাই অনেক সিঁড়ি বেয়ে এখানে উঠে এসেছেন তিনি। হাঁটু টনটন করছে তার, কিন্তু চোখ তাঁর পর্বততীর্থ জম্ভাজের দিকে। অন্ধকারের মাঝে সে যেন দাঁড়িয়ে এক প্রাচীন বাতিঘরের মতো।
সেই বাতিঘরের আলোর যেন ফুলকি উঠেছে, আকন্দ অরণ্যের চারপাশে মেঘের গায়ে সূর্যের আলো লেগে। সেই আলো থেকে যেন একটা স্ফুলিঙ্গ খসে পড়ল নীচে। না। আরেকটা আলো দেখতে পেয়েছেন তিনি। সেই দ্রুতগতির আলো তাঁদের মন্দিরের দিকেই ধাবমান। না, আর পাঁচটা আলোর মতো এই আলো নয়। মেঘের গায়ে দিবস-সূর্যের আলো লেগে এইরকম উজ্জ্বল বর্ণচ্ছটা তৈরি হতে পারে না। এই আলো সুতোর। এই আলো মসলিনের।
মেঘটা এসে নামল মন্দিরের সুবিশাল দালানে, তারপর যেন গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে পড়ে গেল মেঝের উপরে। প্রধান পুরোহিত ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন তাঁর মেয়েকে। লক্ষ করলেন না মেয়ের পোশাক শতছিন্ন, যেন কেউ ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে চেয়েছিল আম্রপালীকে। পাশে দাঁড়ানো বিভার মুখ আগের থেকে অনেক উজ্জ্বল, তার ওষ্ঠাধরে আবার রক্তের আভা জেগেছে।
আখেনাতন বিভার হাত ধরে টেনে বলল, “দিদি দিদি, রাকাদি যেভাবে… ”
বিভা চকিতে তাকাল অবসন্ন রাকার দিকে, তারপর আখেনাতনকে ইশারা করে চুপ করতে বলল। সে জানে না জম্ভাজে কী ঘটেছিল, শুধু সে জানে তার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পেটের উপরে আপনা থেকেই বারবার হাত চলে যাচ্ছে তার, বিশ্বাস হচ্ছে না অমন গভীর ক্ষত এভাবে মিলিয়ে যেতে পারে। বিভা জানে না তার রক্ত এখন বিষশূন্য। বুঝতে উঠতে এখনও বেশ কয়েকদিন লাগবে তার, যখন দেখবে তার বমি হওয়া বন্ধ হয়েছে, যখন দেখবে তার হাঁপ ধরা কমেছে, যখন সে যে এখনও যুবতী সে বুঝতে পারবে।
আম্রপালীকে রেখে এবার রাকাকে জড়িয়ে ধরলেন প্রধান পুরোহিত। অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, “দেবী তোমার উপরে প্রসন্ন, নাহলে আকন্দ তন্তুরা কথা শুনত না তোমার। আজ থেকে আমি তোমার শিক্ষয়িত্রী। বলো, কী চাও?”
“আমি বাড়ি যেতে চাই, মাকে একবার দেখতে চাই।”
“এখানে ফেরত আসবে তো?”
“এখানে ফেরত না এলে আমি কে জানতে পারব না আমি। আমার জানাটা ভীষণ প্রয়োজনীয়।”
***
উইপোকার ঢিপিটার সামনে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রাকা। অনেক দূরে শবরগ্রাম থেকে ভেসে আসছে মাদল এবং ঢাকের শব্দ। গোটা গ্রামের উচ্ছ্বাস যেন ফেটে পড়েছে। মেয়ে ঘরে ফিরেছে শুধু না, ফিরেছে শিক্ষণবিশ পুরোহিত হয়ে। অনেকে অনেক আশা দেখতে শুরু করেছে, আবার ভবিষ্যতের জন্য ভাবতে লেগেছে। রাকা জানে না সে কতটা এর উপযুক্ত, যেমন সে জানে না কী করে তার সামনে মসলিন আবার আম্রপালী এবং বিভার দেহে প্রাণ সঞ্চার করেছে। সে তো শুধু চেয়েছিল তার সহযাত্রীরা বেঁচে উঠুক। তার চাওয়ার দাম এতটা, যে অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে?
নিজেকে খুব অজ্ঞ মনে হচ্ছিল রাকার। জম্ভা সম্পর্কে কতখানি অজ্ঞ সে, নিজের শক্তি সম্পর্কে কতখানি অন্ধকারে সে। কোথা থেকে উৎপত্তি এই শক্তির? মসলিন যদি বাহক হয়, তাহলে সে মসলিন ছাড়াই এভাবে বরফ গলালো কী করে? প্রশ্ন অনেক, উত্তর নেই। কিছু উত্তর হয়তো পেতে সে পারে অর্কপ্রভার মন্দিরে, সেই ধুলোপড়া পুথিদের মাঝে। কিছু উত্তর হয়তো লুকিয়ে আছে দিবস-সূর্যের নীচে থাকা বালির মহাসাগরের মধ্যে, যেখানে যুদ্ধের পরে আছড়ে পড়েছিল দেওতাদের মহাযান। কে জানে, নিঃশব্দ রাত্রির সমুদ্রের জমাট বরফের নীচে অপেক্ষা করছে কি রহস্য!
যেমন একটি রহস্য এখন তার সামনে, কঙ্কণ বনের মাঝে। উইয়েরা রক্ষা করছে গরুড়ের দেহাবশেষ।
ঢিপির লাল ত্বকে হাত রাখল রাকা। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি জানেন? আপনি বলতে পারবেন জম্ভার গত তিন যুগ সম্পর্কে আমায়?”
ঢিপি উত্তর দিল না, দিতে পারে না। নিজের মনে হেসে গরুড়ের কঙ্কালকে বিদায় জানিয়ে গ্রামের দিকে যাত্রা করল রাকা। মাথার উপরে, পূর্ব দিগন্তের কাছে ফুটে আছে অনেকগুলি তারা। সাঁঝের গন্ধ মেখে তারা অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতের জন্য।
রাকার পেছনে, উইয়ের ঢিপির লাল মাটি আসতে আসতে ফুঁড়ে মাথা তুলে দাঁড়ালো এক চারা। সেই চারার গায়ে রামধনুর রঙ। কারণ, সেটি শিশু উদ্ভিদ নয়, সেটি একটি পালক।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ফ্যান্টাসি, সোহম গুহ