ওঁ অগ্নিমীলে
লেখক: অঙ্কিতা
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ঠিক যেমন শীতকালের শুকনো ত্বকে নখ টানলে খড়ি ফোটে। বর্তমান সময় বুঝি অমনই শীতার্ত এবং রুক্ষ। ছুঁলে শুধুই খড়ি ফোটে, কর্কশতার উদ্যাপ__
বাক্য শেষে হলদে কাগজের উপর কালি ফুরিয়ে যাওয়া নিবের সাদাটে খড়ি ফোটানো আঁকচিরা। আঁকচিরাটা দেখে হারিয়ে যাওয়া বাক্যগুলো ভেসে উঠল অণিমা দেবীর স্মৃতিপটে। তিনি অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন—ককর্শতার উদ্যাপন।
তারপর কী এক গভীর আকাঙ্ক্ষায় তাকিয়ে রইলেন হাতে ধরে থাকা পাতাটার দিকে।
না। অণিমা দেবীর স্বর শুনে কোনো দিব্য-লেখা ফুটে উঠল না হাতের পাতায়। এটা তো কোনো স্রষ্টা-যন্ত্র নয়, যা মানুষের উচ্চারিত এলোমেলো শব্দগুচ্ছকে সমাজ-সহ করে পরিবেশন করবে। এমনকি মা-ঠাকুমার আমলের ডিজিটাল পেজও নয়, যা উচ্চারণ করা বাক্যবন্ধকে হুবহু লিখে দিত। এটা আরও প্রাচীন; পুরোনো মোটা কার্ডবোর্ডে বাঁধানো রুলটানা সাদা পাতার গুচ্ছ। পাতাগুলো কখনও সাদা ছিল, এখন হলদে; ভঙ্গুর প্রায়। মিউজিয়ামে রাখার যোগ্য।
কর্কশতার উদ্যাপন—শব্দবন্ধটা রিয়াধের। এই পাতা ভরা লেখাগুলোও রিয়াধের। এঁকেবেঁকে গেছে লাইন, অক্ষরের আকৃতি বড়ো ছোটো কাঁপা কাঁপা। আজন্ম সুন্দর ছাপানো অক্ষর দেখে দেখে অভ্যস্ত অণিমা দেবীর চোখ, হাতে লেখা অক্ষরসমূহকে বুঝতে পারেন না। তবু… তবু তিনি বহু বছর কাটিয়েছেন রিয়াধের সঙ্গে। তাই অসমাপ্ত হয়ে সত্ত্বেও, এই শব্দবন্ধটা তার পরিচিত ঠেকছিল। কর্কশতার উদ্যাপন।
এইরকম শিশুর হাতের লেখায় ভরতি অসংখ্য পাতা। অণিমা দেবী সাবধানে গুছিয়ে গুছিয়ে রাখেন রিয়াধের স্মৃতি।
যৌবনে রিয়াধ তাকে বলেছিল, যুদ্ধ জয়ের মিছিল আসলে কর্কশতার উদ্যাপন। হয়তো রিয়াধকে হাতে রাইফেল তুলে নিতে হয়েছিল, বলেই রিয়াধ এই কথাগুলো বলেছিল। অণিমাকে রাইফেল তুলতে হয়নি, মানুষের রক্তমাংস ফুঁড়ে গুলি পাঠিয়ে দিতে হয়নি। অণিমাকে কাজ করতে হয়েছিল, বিষাক্ত গ্যাসের কারখানায়। তৈরি করতে হয়েছিল বোমা। ‘একেক ঘায়ে একশো জন’। এইরকমই কিছু একটা স্লোগান বানিয়েছিল ‘স্রষ্টা’। সেটাই মাইকে গলায় ফাটিয়ে বলেছিলেন, তৎকালীন নেতা মন্ত্রীরা।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে, অণিমা দেবী পাড়ার মোড়ের ক্যাফেতে গিয়ে বসেন। এ তাঁর বৈকালিক বিলাস। বসে বসে মানুষ দেখেন। শীতল, নির্লিপ্ত, যন্ত্রসম যূথ-মানুষের দল। কারখানা মুখো, কারখানা ফেরত। যে যার মুঠো যন্ত্রে স্রষ্টার সঙ্গে আলাপে রত। আজ বিশেষ কেউ নেই। ক্যাফেটা একদমই ফাঁকা। ফাঁকা সামনের রাস্তাটাও। আজ তিনি একটু তাড়াতাড়িই চলে এসেছেন। ঘর গোছাতে গোছাতে আর স্মৃতি ঘাঁটতে ঘাঁটতে বড়োই ক্লান্ত লাগছিল। বোতাম টিপে একটা জুঁই ফুলের চা আর হালকা কিছু খাবারের নির্দেশ দিয়ে অণিমা দেবী তাঁর নির্দিষ্ট টেবিলটিতে এসে বসেন।
আজ হয়তো দিনটা অন্যরকম ছিল। আজ গিয়ে বসতেই অণিমা দেবী দেখলেন, উলটোদিকের টেবিলে জনা চারেক তরুণ-তরুণী। বয়স বেশি নয়, হবে সতেরো কিংবা আঠারো। ওদের পরণে ফ্যাকাশে-সবুজরঙ্গা পোশাক বলে দিচ্ছে, ওরা চিত্রকর অথবা লেখক। নিশ্চয়ই সদ্য স্কুল পাশ করে, সামনের ওই নতুন অফিসে শিক্ষণবিশীর কাজে লেগেছে।
একটা মেয়ের মাথায় ঝাঁকড়া চুল। সে খুব কষে পনিটেল বেঁধে ক্লিপ এঁটে চুলগুলোকে পোষ মানাবার চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি। এই মেয়েটির স্বরই প্রথম কানে এল অণিমা দেবীর। মনে মনে অণিমা দেবী মেয়েটাকে ডাকলেন প্রথমজন বলে। দ্বিতীয়জন এবং তৃতীয়জন ছেলে। চতুর্থজন ছেলে না মেয়ে অণিমা দেবী ঠাওর করতে পারলেন না। তার মাথায় ক্রুকাট, পরণের পোশাক ঢিলেঢালা কাটা।
চারজনের গলার স্বর, মুখের ভাব প্রায় আবেগহীন। তবু বোঝা যায়, এখনও এরা সম্পূর্ণ নিরাসক্ত হয়ে পড়েনি জগৎ সম্পর্কে। এখনও এদের রক্তে হরমোন খেলা করছে। এরা শান্ত, কিন্তু শীতল নয়। চারজনেই সামাজিক মাপকাঠিতে ভদ্র, সংযত এবং নীচু মৃদুস্বরে কথা বলছে। অবশ্য এদের মুখনিঃসৃত বাক্যবন্ধগুলো প্রায় অবোধ্য। কিন্তু, এ সমাজে প্রত্যেকের কানেই ছোটো ছোটো ইয়ারফোন। সেই ইয়ারফোনেও স্রষ্টার অনায়াস দখল, তাই দুর্বোধ্য কথাও অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী শুনতে লাগে।
প্রথম – নতুনত্ব কিছু নেই। গত দু-বছর যা শিখেছি তাই।
দ্বিতীয় – নতুনত্ব মানে কী? নতুন কোনো নির্দেশের কোডিং?
তৃতীয় – সে সব তো কোডিং-মাস্টারদের ব্যাপার। ও ব্যাপারে আমাদের কিছু করার আছে নাকি? নতুন কিছু না হলেই বাঁচি। এখনকার নির্দেশ মনে রাখতে রাখতেই আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত।
চতুর্থ – নতুনত্ব বলতে কী তুই ইভল্যুশনের কথা বলছিস?
দ্বিতীয় – ইভলুশ্যন তো হচ্ছে। আগের স্রষ্টার কথা ভাব আর এখন—কম ইভলুশ্যন? আগে নির্দেশ দেওয়াটা কী জটিলই না ছিল! এখন কত্ত সহজ!
তৃতীয় – সহজ নাকি! আমাকে প্রজেক্ট দিয়েছিল গত শতাব্দীর পোস্ট-কনটেম্পোরারি আর্টে বৃহস্পতির উপগ্রহ। স্রষ্টাকে বললাম, গ্যানিমিডের চারটে ‘ক’ মার্কা পোস্ট-কনটেম্পোরারি ছবি দিয়ে প্রজেক্ট বানিয়ে দিতে। আমার সেই প্রজেক্টটা ক্লাসে স্রষ্টার হাতেই ‘চ’ পেয়েছে। এটা ঠকানো ছাড়া আর কী! দেখ—
বলে ছেলেটা নিজের হাতের পাতলা স্ক্রিনটা বাকিদের সঙ্গে শেয়ার করল। অণিমাও দেবী দেখলেন, তৃতীয় ছাড়া প্রত্যেকেরই ঠোঁটগুলো গাল অবধি চওড়া হল। চতুর্থের দাঁত ছরকুটে বেরিয়ে এল। আর, প্রথমের মৃদু হাসির শব্দও তিনি শুনতে পেলেন।
চতুর্থ – শুধু গ্যানিমিডের ছবি বানিয়ে দিতে বললে অমনই হবে। তোর বলা উচিত ছিল টাইমলুপে গ্যানিমিড অথবা সূর্য যখন ব্ল্যাকহোল, তখন গ্যানিমিড। এছাড়াও তোর উচিত ছিল ফিল্টার বসানো, কিংবা অন্য কোনো শ্যাডো মেথড ব্যবহার করা।
তৃতীয় কাঁধ ঝাঁকায়। আক্ষেপ করে, বলে, ‘আমাদের দাদু ঠাম্মাদের আমলে সামান্য নির্দেশেই, স্রষ্টা একদম হাতে গরম নতুন নতুন ছবি বানিয়ে দিত। আজকাল স্রষ্টার সেই তেজ কমে গেছে। বিশেষ নতুনত্ব নেই।’
‘কত নতুন চাই! তুই ঠিকঠাক নির্দেশ দিতে পারিস না, তাই। স্রষ্টার ক্ষমতা অসীম।’ দ্বিতীয় জন বলে। ‘আর তা ছাড়া তোর নির্দেশটাও গণ্ডগোলের। গত শতাব্দী না বলে পোস্ট-কনটেম্পোরারির শাখা-ধারাটা উল্লেখ করে দেওয়া উচিত ছিল। পোস্ট-কনটেম্পোরারিতে কম করে হলেও গোটা পঞ্চাশেক ধারা আছে। স্রষ্টার প্রচলন শুরু হওয়ার সেই প্রথম দশকগুলোতে শিল্পীরা ক্ষেপে উঠে, আমাদের জন্যে একগাদা চ্যাপটার বানিয়ে রেখে গেছে যে।
তৃতীয় – মানে? শিল্পীরা ক্ষেপবে কেন? এ তো সবার মঙ্গলের জন্যে!
দ্বিতীয় আর চতুর্থ কাঁধ ঝাঁকায়। অর্থাৎ তারা জানে না।
প্রথম – শিল্পের ইতিহাসে লেখা আছে, তখন অনেক কোর্ট-কাছারি হয়েছিল। গত শতাব্দীর প্রথম দুটো দশক ছাড়া, টানা এক শতাব্দী ধরে প্রায় শিল্পদ্রোহ চলেছিল। সারা বিশ্ব জুড়ে শিল্পের নতুন ধারার পেটেন্ট আইন তৈরি হল।
দ্বিতীয় – এত কিছু করেও তাদের মন ওঠেনি।
তৃতীয় – কেন?
প্রথম – সে একমাত্র তখনকার শিল্পীরাই বলতে পারবে। মোটামুটি সারা একবিংশ শতক জুড়ে এইসব মামলা, দ্রোহ, আত্মহত্যা, স্রষ্টাকে হনন করার চেষ্টা সবই চলেছিল। ক্রমে তারা একে একে চলে গেছিল দেশ ছেড়ে পাশের দেশে…
দ্বিতীয় – ভাগ্যিস গেছিল। যতসব অসামাজিক, অভদ্র, অনৈতিক সব জিনিসপত্র বানাত ওরা। শিল্পের নামে উৎকট সব বস্তু। আসলে স্রষ্টার মতো সেন্সর না থাকলে যা হয়। ওদের জন্যে সমাজ সংস্কার সব রসাতলে যেতে বসেছিল। ওরা চলে গেছিল বলেই আমাদের শিল্প সংস্কৃতি বেঁচে গেছে।
তৃতীয় – পাশের দেশ ওদের আশ্রয় দিতে গেল কেন?
চতুর্থ (চোখ মটকে) – শেষমেশ বোঝা গেল পাশের দেশের রাষ্ট্রনায়কদের অর্থনৈতিক বুদ্ধি আমাদেরগুলোর থেকে বেশি। ওরা অতি সহজেই শিল্পের পেটেন্ট দিয়ে দিত।
দ্বিতীয় – হাঃ। ওগুলো ওদের গিমিক ছিল শুধু। নয়তো কোথাও কোনো মাথামুণ্ডু নেই, একটা আঁচড় টানা ক্যানভাস অথবা ফাঁকা খাতায় শুধুমাত্র শেষ পাতায় একটা লাইন লেখা—সে-ও নাকি কবিতা—সেও নাকি সৃষ্টি… সেইসব কখনও কোটি টাকায় বিক্রি হয়? আর তাই যদি হয়, তাহলে ওরা কেন আমাদের দেশ আক্রমণ করল? ওইসব হঠকারী শিল্পীগুলো শিল্প দেখে উত্তেজিত হয়ে, নির্ঘাত। যতসব আনসেন্সরড জিনিসপত্র।
প্রথম – মানুষের আবেগ সবসময়ই বল্গাহীন। মানুষের সৃষ্টি নিষেধ মানে না।
তৃতীয় – এটা একদম ঠিক কথা। কোনো মানুষের পক্ষে কী এত ভ্যারিয়েবল মাথায় রেখে কাজ করা সম্ভব! ভাষা ঠিক রাখো, যেন কারোর মনে আঘাত না দেয়। রং ঠিক রাখো, যাতে কারোর চোখ ঝলসে না যায়। সুর ঠিক রাখো, যাতে বর্তমান সামাজিক শান্তি ব্যহত না হয়… বাব্বাঃ! মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় বাপু। স্রষ্টা না এলে, এত কিছু মানুষ মাথায় রেখে শিল্প করতে পারত না। তখনকার মানুষ ব্যাপারটা হয়তো বোঝেনি সঠিক ভাবে। একটু হয়তো বুঝিয়ে বললে…
চতুর্থ (সহাস্যে) – বিজ্ঞানীদের বলি টাইম মেশিনটা আবিষ্কার করে ফেলতে। আমাদের সহপাঠী গিয়ে গত শতাব্দীর শিল্পদ্রোহ মুছে দিয়ে আসতে চাইছে। ইতিহাস সিলেবাস থেকে গোটা একটা চ্যাপটার একেবারে ভ্যানিস।
প্রত্যেকের মুখেই আবার উজ্জ্বল হাসির ছাপ পরে।
দ্বিতীয় – আসলে নতুন কোনো কিছুকে মেনে নিতে মানুষের সবসময়ই অনীহা। গজাল মেরে না পুঁতলে, মানুষের মাথায় কিছু ঢোকে না।
কখন যেন দলটা চলে গেছে। পড়ন্ত বিকেলে চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে অণিমা দেবী ঘাড় কাত করে একবার নতুন বিল্ডিংটার দিকে তাকান। কারখানা ছুটির সময়। দলে দলে নির্দিষ্ট রঙের পোশাক পরে শিল্পীর দল বেরিয়ে আসছে বাড়িটা থেকে। ‘স্রষ্টা’-র এই নতুন ঝাঁ চকচকে কারখানাটা এ পাড়ায় খোলার পর থেকে, মোড়ের মাথার চায়ের দোকানে শিল্পীদের সংখ্যা অনেকগুণে বেড়ে গেছে।
‘শিল্পী! ওরা স্রষ্টার রাঁড় মাত্র।’
সমস্ত সামাজিক ভদ্রতা, সংযম ত্যাগ করে, কে যেন ক্ষোভে চিৎকার করে। অণিমা দেবী চমকে ওঠেন, পা পিছলে পড়ে যান মসৃণ ফুটপাথে। হাঁটুর কাছে চামড়া কেটে রক্তের ধারা দেখা দেয়।
তাঁকে পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে, শিল্প নির্দেশকের দল নির্লিপ্ত শীতল যান্ত্রিক মুখে হেঁটে চলে যায়।
# ২ #
‘শিল্পী! ওরা স্রষ্টার রাঁড় মাত্র!’
রিয়াধ বলেছিল। থুতু ছিটিয়ে। ওইরকমই একটা শিল্পসৃষ্টির শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কারখানা থেকে বেরিয়ে এসে। কারখানা! হ্যাঁ, ওই অতি সুন্দর কাচের জানালামোড়া শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঝাঁ চকচকে বহুতলগুলোকে রিয়াধ কারখানাই বলত। যেখানে মানুষের চিন্তাভাবনা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা পেষাই হয়ে যায় যন্ত্রের আবডালে, তাকে তো কারখানাই বলা চলে।
সেও হয়ে গেছে আজ অর্ধ শতাব্দীর পার। তখন অণিমা দেবীও ওই ছেলেমেয়েগুলোর মতোই তরুণ ছিলেন। আজ তাঁর চুলে বরফ পড়েছে। সে যুগে শিল্পভাবনার সম্পূর্ণ দখল ছিল ‘স্রষ্টা’-র হাতে। স্রষ্টা তখন তার কর্মক্ষেত্রের মধ্যগগনে। তার শিল্পের বিস্তারে মানুষের চোখে ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। মানুষ সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করেছিল সমস্ত ধরনের শিল্পভাবনা অথবা রচনা। স্রষ্টাকে শুধুমাত্র নির্দেশ দিলেই যখন একের পর অনবদ্য লেখা অথবা চিত্র অথবা সুর মায় চলচ্ছবি পর্যন্ত তৈরি হয়ে যাচ্ছে, তখন মানুষের কী দায় পড়েছে কষ্ট করে ব্যাকরণ শেখার, তুলি ধরার, সংগীত সাধনার অথবা অভিনয়ের।
প্রথম কোপটা পড়েছিল চিত্রশিল্পীদের উপর, ধীরে ধীরে লেখক, আর সুরকাররাও কাজ হারাল। অনেকদিন পর্যন্ত অভিনেতা আর স্থাপত্য কলা টিকে ছিল। কিন্তু ডিজিটাইজেশনের সেই যুগে স্থাপত্যকেও থ্রিডি প্রিন্টের আওতায় নিয়ে আসা গেল। একইভাবে মানুষের মুখভঙ্গিমাগুলোকেও নিঁখুতভাবে অনুকরণ করে অনিন্দ্যসুন্দর এ আই-এর মুখে বসিয়ে দেওয়া গেল। মানুষের অভিনয়ও মুছে গেল পর্দা থেকে।
প্রায় এক শতাব্দী ধরে এই টানাপোড়েন চলেছিল। যে জিনিস কম টাকায় পাওয়া সম্ভব, যে জিনিস সাধারণ মানুষ দেখতে ভালোবাসে; সেইসব জিনিসের কদর সবসময়ই। এই জন্যেই দীর্ঘকাল ধরে শিল্পের বাজারে কমার্সিয়াল বলে একটা ধারা প্রচলিত।
একসময় রাষ্ট্রনায়ক আর শিল্পপতিরা বুঝলেন স্রষ্টার সাহায্যে অতি সহজেই এই কমার্শিয়াল ধারাটিকে আরও উন্নত করে তোলা সম্ভব। সর্বোপরি এর মাধ্যমেই সমাজের এক বিশাল অংশকে পরিচালনা করা অতি সহজ। মানুষের তৈরি শিল্প অনেক সময়ই সমাজের ছোটোখাটো বিদ্রোহ বা অশান্তিকে তুলে ধরত। সেক্ষেত্রে স্রষ্টা অনেক মঙ্গলজনক। সে শুধু অর্থনীতির বিশাল বাজারের পদলেহন করে থাকে। শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র এন্টারটেইনমেন্টের জন্যেই শিল্পসৃষ্টি করে।
ক্রমে শিল্পের বাজারটাকে স্রষ্টা গিলে খেতে লাগল। আর্থিকভাবে বেঁচে থাকার জন্যে বহু শিল্পীরাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে নতুন নতুন ধারায় ভাব প্রকাশের চেষ্টা করেছিলেন।
চিত্রশিল্পে পোস্ট-কনটেম্পোরারির ধারাগুলো সেইরকম খড়কুটো আঁকড়ে জীবিত থাকার চেষ্টা।
বিশেষ লাভবান হয়নি তারা। দু-একটা একদম অন্যরকম ধারার সৃষ্টি হলেই। মাত্র পাঁচটা সেই ধারার আঁকা ছবি পেলে স্রষ্টা সেই ধারাকে আত্তিকরণ করতে পারত। নিমেষে তৈরি করে দিত লক্ষাধিক ছবি। ব্যাপারটা বুঝতে শিল্পীদের সময় লেগেছিল, একসময় শিল্পীরা বিদ্রোহ করল।
গত শতাব্দীর প্রথম শিল্পবিপ্লবটা ছিল মূলত কমার্সিয়াল চিত্রকার, লেখক ও সুরকারদের। স্রষ্টা প্রথমে তাদের বাজার দখল করেছিল। প্রায় বছর ত্রিশ পরে দ্বিতীয় বিপ্লবের ঢেউটা উঠল সত্যকারের শিল্পমনস্কদের কাছ থেকে। তারা বলল, তাদের কনসেপ্ট চুরি করে নিচ্ছে স্রষ্টা। শিল্পীরা নিজেদের সৃষ্টি লুকিয়ে ফেলতে শুরু করল। তারা আর কোনো নতুন ধারায় আঁকা ছবি বাজারে ছাড়ল না। কবিরা বন্ধ করে দিল কাব্য রচনা অথবা ছন্দ সৃষ্টি। সাহিত্যিকরা উপন্যাস কিংবা ছোটোগল্পের ফর্ম নিয়ে আর গবেষণা করল না। বা করে থাকলেও, তা লুকিয়ে রাখল গোপনে।
ধীরে ধীরে স্রষ্টার বিশাল মুখব্যাদান করা গহ্বরে তলিয়ে যেতে শুরু করল মানুষের কল্পনাশক্তি।
একটা সুরেলা হইচইতে অণিমা দেবীর ঘোর ভাঙল। ভাঙা পা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিলেন। দেখলেন অনেকগুলো ড্রোন মিছিল করে বেরিয়েছে। মানুষ মুঠোযন্ত্র থেকে মুখ তুলে, আকাশে তাদের শোভা দেখছে। অণিমা দেবী অবাক হলেন। আজ আবার কী? এরকম হইচই তো বহু দিন যাবত দেখেননি তিনি। মাথার উপরে নীল আকাশে অনেক রঙিন বাজির ডিজিট্যাল খেলা দেখিয়ে ড্রোনগুলো একটা বিশাল স্ক্রিন মেল ধরল।
আজকে ‘স্রষ্টা’-র সার্ধশত বৎসর পূর্ণ হল। ওহ্! এই জন্যে এরকম বড়ো বড়ো ডিজিটাল স্ক্রিনের ব্যানার নিয়ে পথশোভা বেরিয়েছে! সামনের ড্রোনের ব্যানারটায় লেখা ফুটে উঠল। আজ রাতের কাউন্ট ডাউনের সঙ্গে সঙ্গে, গত পঞ্চাশ বছরের স্রষ্টার বিভিন্ন ধারার সেরা শিল্প-নির্দেশকদের পুরস্কৃতও করা হবে। আজ সকাল পর্যন্ত কে কত ভোট পেয়েছে সেই সব ইতিবৃত্তও আকাশে ভেসে ভেসে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, রাত বারটা পর্যন্ত ভোটিং অপশন খোলা। শেষ সময় পর্যন্ত চলবে এই খেলা। এর আগে কোনো ‘এ আই’ নিয়ে এরকম হইচই হয়েছে বলে অণিমা দেবী জানে না। অবশ্য স্রষ্টার শত বছরের জন্মদিনটাও কম রঙিন ছিল না। একেবারে রক্তের জয়-তিলকে রাঙ্গানো দিন।
অণিমা দেবী বিনোদনের জন্যে কোনোরকম আধুনিক ডিজিটাল স্ক্রিন ব্যবহার করেন না। এমনকি আন্তর্জালেও কোনো একাউন্ট নেই অণিমা দেবীর। যদি ব্যবহার করতেন তাহলে জানতে পারতেন বহু আগেই। সেইদিন স্রষ্টার কারখানার সামনে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার পর বেশ কয়েক সপ্তাহ বাইরে বেরোন হয়নি। তাই রাস্তাঘাটের ব্যানারের বাড়াবাড়িও অণিমা দেবীকে চোখে আঙুল দিয়ে মনে করিয়ে দিতে পারেনি, আজ রাত পেরোলেই স্রষ্টার সার্ধশত বৎসর পূর্ণ হবে।
আসলে অণিমা দেবী একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন বিগত কয়েক সপ্তাহ। তা না হলে জানালার সামনে দিয়ে অনবরত নিঃশব্দে ভেসে যাওয়া ড্রোনবাহিত ডিজিটাল ব্যানারগুলো তাঁর ঠিকই নজরে পড়ত। জানালার কাছ থেকে সরে আসতে গিয়ে পায়ে খচ করে লাগল অণিমা দেবীর। মুখ বিকৃত করে অণিমা দেবী খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নামতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে। বেসমেন্টে। ‘স্রষ্টা’-র দেড়শো বছরের জন্মদিনের থেকেও, তাঁর বেশি করে মনে পড়ছিল, অর্ধ শতাব্দী আগের সেই রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধ।
গত শতাব্দীর শেষে এসে মানুষ ভুলেই গেল গান বাঁধতে, সুর বানাতে, কবিতা লিখতে, ছবি আঁকতে। স্রষ্টার নেশায় মেতে সকলেই তখন নির্দেশক হতে চায়। স্রষ্টাকে নির্দেশ দিয়ে দিয়ে তৈরি করতে চায় নতুন কোনোও ছবি অথবা গান। এ যেন ড্রাগের নেশার থেকেও ভয়ংকর। বিনোদনের চূড়ান্তে উঠে মানুষ তখন কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তখন, অণিমা দেবীরা স্কুলে পড়তেন। তখন, স্রষ্টার সৃষ্টি ক্ষমতা মধ্য গগনে দাউ দাউ করে জ্বলছে।
সেই যুগে দাঁড়িয়ে স্কুল পড়ুয়া রিয়াধ কবিতা পড়ত। পরিষ্কার উচ্চারণে, শতাধিক বছরের প্রাচীন সব কবিতা। চেষ্টা করত কবিতা লেখার! চেষ্টা করত ছবি আঁকার! কীসব পাগলামি!
হ্যাঁ। রিয়াধের বাবা-মা-ও ব্যাপারটা বোঝেনি। কবিতা, গান, ছবি আঁকা—এইসব কাজ মানুষ কেন করবে? মানুষ কী পারবে ‘স্রষ্টা’-র থেকে ভালোভাবে এইসব কাজ করতে? কখনও পারবে না। ‘স্রষ্টা’-র স্মৃতি ভাণ্ডারে কোটি কোটি মেমোরি সেল। সেখানে আরও লক্ষ কোটি ভাঙাগড়ার খেলা। মানুষের সাধ্য কী তার কাছে পৌঁছানর! ‘স্রষ্টা’-র থেকে ভালো কাজ না করলে, কে কিনবে সেই কাজ? কেনই বা কিনবে? কী প্রয়োজন!
শিল্পের অপ্রয়োজনের গল্পটাই বড়ো বেশি পরিবর্তিত হয়ে গেছিল ততদিনে। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ কাজ করে না। একমাত্র প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে মানুষ মাথা ঘামায়। অপ্রয়োজনে মাথা ঘামালে পকেটে টাকা থাকে না। উন্নত সমাজে পকেটে টাকা না থাকলে, পেটে খিদেয় ডন মারে না বটে; কিন্তু জীবনের নিত্যনতুন হাজার রকমের বিনোদন কেনার কোনো উপায় থাকে না। রিয়াধ অপ্রয়োজনীয় কাজ করতে ভালোবাসত। অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে ভালোবাসত। কথায় কথায় গুঁজে দিত কবিতার লাইন অথবা গান ধরত হেঁড়ে গলায়। সেইসব অপ্রয়োজন ব্যবহার রিয়াধকে একদিন অসামাজিক ঘোষণা করে দিল, যুদ্ধের ঠিক আগে আগেই।
রিয়াধের বাবা-মা দুজনেই সরকারি বিভাগের উচ্চপদস্থ চাকুরে ছিলেন। তাঁরা অনেক চেষ্টা করেছিলেন ছেলেকে বাঁচানোর। প্রথমেই শিল্প-নির্দেশনার চাকরি ছাড়িয়ে রিয়াধকে ঘরবন্দি করা হল। তার কয়েক সপ্তাহ বাদে রিয়াধের কর্নেল বাবা তাকে সেনাবাহিনীর অফিসার বানিয়ে দিলেন। মন্দ নয়। তখন যুদ্ধের মরশুম। রিয়াধের সহপাঠিরা বলত, এবার রিয়াধ দোহাত্তা কামাবে।
যে ছেলে শিল্প-নির্দেশক হিসাবে অভূতপূর্ব হওয়া সত্ত্বেও একটা প্রজেক্ট নিয়ে—ঘণ্টা নয়, দিনের পর দিন কাটিয়ে দিত। সেই ছেলে আদৌ কতটা দোহাত্তা টাকা উপার্জন করবে, তা নিয়ে অণিমা দেবীর মনে সন্দেহ ছিল।
সেনাবাহিনীর শিক্ষণীবিশি শেষ হওয়ার পরের দিন স্রষ্টার অফিসের ক্যাফেটেরিয়ায় রিয়াধকে দেখা যায়। সে দেখা করতে এসেছিল বন্ধুদের সঙ্গে। নিয়ে এসেছিল মা ঠাকুমার আমলের সোলার ডিজিটাল প্যাডে লেখা কয়েকটা কবিতা, কিছু আঁকা ছবি। যা সে লিখেছিল, এঁকেছিল শিক্ষনবিশির দিনগুলোকে নিয়ে।
সেইসব ছবি আর আঁকাকে সমাজবিরোধী, রাষ্ট্রদ্রোহী বলে বসে রিয়াধেরই বাকি বন্ধুরা। যারা নাকি নির্দেশের পর নির্দেশ দিয়ে দিয়ে স্রষ্টার গহ্বর খুঁড়ে তুলে আনে রত্নসম সব শিল্প। সেনাবাহিনীর শিক্ষানবিশি নিয়ে তারাও কম লেখা, আঁকা, গান আর চলচ্ছবি বানায়নি। কিন্তু, রিয়াধের হাতের ঝুরঝুরে ডিজিটাল প্যাডের লেখা আর আঁকাগুলো… কী ভয়ংকর! তারা তো রিয়াধের মতো অসামাজিক নয়, তাই অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, রিয়াধকে।
চলে যাওয়ার সময় স্রষ্টার ঝাঁ চকচকে কারখানার কাচের মতো পরিষ্কার সিঁড়িতে থুতু ফেলে সমাজদ্রোহী রিয়াধ বলেছিল, ‘… ওরা স্রষ্টার রাঁড় মাত্র!’
# ৩ #
সেইদিন ‘স্রষ্টা’-র সার্ধশত বছরের বিজয় মিছিল বেরোবার পরে প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেছে। আজ অণিমা দেবী তাঁর চেনা ছোটো রেস্তোরাঁটায় খাবার খেতে গিয়ে থমকে গেলেন। আজ বুঝি নতুন কোনো একটা সিনেমা রিলিজের ডেট আছে! স্রষ্টা সাধারণত প্রতি সপ্তাহে একটি করে নতুন সিনেমা রিলিজ করে থাকে। এছাড়াও প্রতিদিন প্রতি মিনিটে প্রতি ঘণ্টায় অজস্র ছোটো ছোটো ভিডিয়ো রিল তো আছেই। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে বিগত এক মাস স্রষ্টা কোনো নতুন সিনেমা রিলিজ করেনি।
সবাই কানাঘুষো বলছিল একটা অসাধারণ ঐতিহাসিক সিনেমা আসতে চলেছে। অলটারনেট ইউনিভার্সের উপর। ক্যামেরার কাজ থেকে শুরু করে অভিনেতাদের অভিনয় পর্যন্ত দেখলে তাক লেগে যাবে। স্রষ্টার সার্ধশত বছরে স্রষ্টার তরফ থেকে এটাই মানুষের প্রতি উপহার। সবাই খুবই উৎসুক ছিল এই নতুন প্রোডাকশনটা নিয়ে। সময়ের কোনো একটা ভিন্ন ধরনের চলন দেখাবে হয়তো স্রষ্টা এই সিনেমায়।
সাধারণত এখন মানুষের ঘরে ঘরে বড়ো বড়ো স্ক্রিনের প্রজেক্টর অথবা বিনোদন বাক্স। তবু কিছু মানুষ রেস্তোরাঁর বিশাল পঞ্চেন্দ্রিয় আবহাওয়ায় সিনেমাটা দেখার জন্যে ভিড় জমিয়েছিল। অনান্য দিনের তুলনায় সেদিন রেস্তোরাঁয় অনেক বেশি জনসমাগম হয়েছে। অণিমা দেবী বুঝলেন তিনি ভুল দিনে এসে পড়েছেন, গত কয়েক হপ্তার মতো আজকেও খাবারটা বাড়িতে অর্ডার করে নিলেই হত।
সিনেমাটা শুরু হল। সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে এক বিশাল সমুদ্রের ধার ধরে হেঁটে যাচ্ছে একটা জেনেটিক্যালি মডিফায়েড নারী এবং পুরুষ। দিগন্তে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সেই অস্তমিত সূর্য, ঝিরিঝিরি বাতাস আর নীল সাগরের জলকে সাক্ষী রেখে তারা প্রণয় বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে।
এইটুকু দেখেই অণিমা দেবী বেরিয়ে চলে এলেন রেস্তোরাঁর বদ্ধ ঘর ছেড়ে, খাবারের ট্রেটা হাতে নিয়ে। জেনেটিক্যালি মডিফায়েড নারী পুরুষের অভিনয় তাঁর কেমন যেন জান্তব মনে হল। ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন খুঁতহীন, কিন্তু কোথায় যেন মানুষের সেই চেতনা, সেই প্রাণটাই হারিয়ে গেছে। পর্দার ওই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, নীল সাগরের জল এমনকি সূর্যটাকেও বড়ো বেশি নিঁখুত মনে হচ্ছিল অণিমা দেবীর। যেন অংকের ছকে ফেলে আঁকা। এমনকি ঠিক যতটুকু অব্যবস্থা থাকলে ব্যাপারটা বাস্তবোচিত হবে, ঠিক যেন ততটাই। সব মিলিয়ে আত্মাহীন এক প্রকৃতিদৃশ্য।
রেস্তোরাঁর বাইরে পথপার্শ্বের টেবিল চেয়ারগুলো পুরো ফাঁকা। অণিমা দেবী শান্তিতে মধ্যাহ্নভোজন সারতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরেই তিনি খেয়াল করলেন কিছু কিছু নরনারী রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসছে। সিনেমা তো প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট চলার কথা। আজকাল এক-দু মিনিটের রিলস আর পনেরো মিনিটের সিরিজ দেখে দেখে অভ্যস্ত মানুষ কি সিনেমা দেখার ধৈর্য্যই হারিয়ে ফেলছে নাকি?
—হ্যাহ্, এদ্দিনে এই! সেই পুরোনো বস্তাপচা গপ্প। একই রকম ক্যামেরার কাজ। একই ধরনের অনুভূতি। গতানুগতিক চমক। নির্দেশকদের হলটা কী!
—নির্দেশকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, যা হাতে থাকবে তাই তো বানাবে।
—এবার বুঝি স্রষ্টাও বুড়ো হচ্ছে… গত পাঁচ বছর ধরে নতুন কিছুই তৈরি করছে না।
—হ্যাঁ। পুরোনো জিনিস অথবা ধারাগুলোকেই ভেঙেচুরে অথবা পারমুটেশন কম্বিনেশন করে…
—এবারে আরও খারাপ… পুরোটাই কেমন যেন যান্ত্রিক যান্ত্রিক, খেয়াল করেছিস?
—নাহ্, ব্যাপারটা ঠিক মনোমত হল না।
অণিমা দেবী ভালো করে নিরীক্ষণ করে দেখে তরুণ তরুণীদের মুখ। সেই চারজনের ক্ষুদ্র দলটা। রেস্তোরাঁর বাইরে এসে তারা চেয়ার টেনে বসে পড়ে এদিক ওদিক।
তৃতীয় – সিনেমাটা আমার মন্দ লাগেনি। তবে আগের মতো, একইরকম, সেটা অস্বীকার করা যায় না।
চতুর্থ – আর ভাল্লাগে না। আমরা যখন কাজে ঢুকলাম, তখনই যদি স্রষ্টার চিন্তাভাবনা পড়তির দিকে হয়…
প্রথম – এর থেকে অনেক ভালো ভালো দৃশ্যপট আমার মাথায় ঘোরে। অনেক ভালো তার বক্তব্য।
দ্বিতীয় – আমার মতে সেন্সরশিপ তোলার দিন চলে এসেছে। নয়তো কিছু নতুন সৃষ্টি করা খুব চাপের। মানুষ এবার অন্য কিছু চাইছে।
চতুর্থ – হ্যাঁ। এই ব্যাপারটা আমিও লক্ষ করেছি। শুধু একা আমরা নয় অনেকেই বলছে, সেন্সরশিপ খানিকটা লঘু করলে আরও নতুন নতুন সিনেমা, গান, লেখা, আঁকা বানানো সম্ভব।
তৃতীয় – আসলে মানুষের মন বড়ো জটিল হয়ে গেছে। তাই আর আনন্দ পাচ্ছে না।
প্রথম – শুধু মনোরঞ্জনই কী শিল্পের একমাত্র কর্তব্য? আমাদের কী আর কিছু বলার নেই? অন্যরকম কিছু?
দ্বিতীয় – ক্ষেপে গেলি নাকি? মনোরঞ্জন ছাড়া আবার কীসের দায়? জনগণের মন ভরাতে না পারলে দুদিনে কোম্পানি লাটে উঠবে। আর কোম্পানি তো দূরের কথা। তুই টার্গেট কভার করতে না পারলে প্রথমেই ছাঁটাই খাবি। এখন মার্কেটে নির্দেশকদের কীরকম কম্পিটিশন জানিস?
চতুর্থ – থাম বাপু। চাকরি পাওয়ার আগেই টার্গেট আর কভার নিয়ে কপচাসনি। কাজটাকে ভালো না বাসলে সবই কষ্টের। এই ওর মতো (তৃতীয়ের দিকে আঙুল তুলে দেখায়) অবস্থা হবে। বাপমায়ের চাপে নির্দেশক হতে এসেছে।
তৃতীয় তেড়েমেড়ে কিছু একটা বলতে যায়। তার কথাটা স্রষ্টা সেন্সর করে দেয়। শোনা যায় না।
চতুর্থ হাসে, বলে, ‘গালি দিলি বুঝি? আমি কিন্তু মিথ্যে বলিনি।’
তৃতীয় চুপ করে যায়। তারপর মাথা নীচু করে বসে থাকে। সকলেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। একটু পরে প্রথম মুখ খোলে।
প্রথম – আচ্ছা, আমরা নিজেরা কেন নতুন কিছু বানাই না?
বাকিরা অবাক হয়।
তৃতীয় – নিজেরা মানে?
দ্বিতীয় – আমরা চারজন? কোনো কোম্পানি ছাড়াই? কত খরচা জানিস?
প্রথম – না না, খরচা নয়… মানে শুধু নিজেরাই যদি…
চতুর্থ – নিজেরা বলতে কী তুই স্রষ্টাকে বাদ দেওয়ার কথা বলছিস নাকি?
প্রথম – আমার মাথার মধ্যে অনেক কিছু ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু সেগুলো আমি প্রকাশ করতে পারি না।
দ্বিতীয় – সেন্সরশিপে আটকাচ্ছে নিশ্চয়ই।
প্রথম কাঁধ ঝাঁকায়। অর্থাৎ সে জানে না।
প্রথম অন্যমনস্কভাবে বলে, ‘একদিন মানুষ নিজেই সব বানাত। সিনেমা বানাত, গান লিখত, সুর বসাত… ছবি আঁকত… গল্প কবিতা লিখত… আজকাল মানুষ শুধুমাত্র নির্দেশ দেওয়া ছাড়া কিছুই পারে না। এমনকি নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতেও, সে একটা গোটা বাক্য লিখতে পারে না। কী অদ্ভুতভাবে এই মুহূর্তেও আমরা কথোপকথনের জন্যে স্রষ্টার উপরে নির্ভর করছি। স্রষ্টাকে দিয়ে বাক্যের গঠন, ব্যকরণ শুদ্ধ করিয়ে নিচ্ছি। এমনকি রাগের অনুভূতিতে কী ধরনের বাক্য ব্যবহার করব অথবা বিস্ময়বোধ করলেই বা কী ধরনের ছবি—কোনোটাই মানুষ নিজের থেকে আর লিখতে বা বলতে পারে না। স্রষ্টার দেওয়া অপশন থেকে মানুষকে চুজ করে নিতে হয়। এই যে কথা বলছি, তাও স্রষ্টা ছাড়া দুর্বোধ্য।
স্রষ্টা সার্বিকভাবে মানুষকে পঙ্গু করে দিয়েছে। স্রষ্টার সেন্সরশিপের দরুণ, প্রথমের শেষ বাক্যটা তার বাকি বন্ধুরা শুনতে পায় না। কিন্তু, পাশের টেবিলে বসে থাকা অণিমা দেবী ঠিকই শুনতে পান। তিনি ইয়ারফোন ব্যবহার করেন না।
অণিমা দেবী চমকে ওঠেন। মেয়েটা একটা গোটা বাক্যবন্ধ স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করছে, স্রষ্টার সাহায্য ছাড়াই! আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে রিয়াধ কী এইরকমই কিছু বাক্য বলেনি? তখনও অবশ্য কথার উপরেও এত সেন্সরশিপ চালু হয়নি। ইয়ারফোনেও শুরু হয়নি স্রষ্টার খবরদারী। তখনও স্রষ্টা সীমাবদ্ধ ছিল অনলাইনে। অবশ্য তখনই মানুষ ঠিকঠাক শব্দের ব্যবহার ক্রমে ভুলে যাচ্ছিল। তাও সে গুছিয়ে মনের ভাবটা অন্তত প্রকাশ করে পারত বাক্ দ্বারা।
সেই সময়েই রিয়াধ বারংবার বলত, স্রষ্টা আমার মনে ভাব প্রকাশ করতে দিচ্ছে না। না লেখায়, না আঁকায়।
যুদ্ধ পূর্ববর্তী দেশে তখন গাঢ় রঙের ছড়াছড়ি। আকাশে বাতাসে বিশাল বিশাল রক্ত রাঙ্গা ছবি। ঝনঝনানি আর দামামা যেন স্রষ্টার লেখায় লেখায় বেজে চলছিল। স্রষ্টার সে কী রুদ্ররূপ! সে কি তমসাময়তা! কী অনায়াসে শিল্পের মাধ্যমেই স্রষ্টা সমস্ত দেশবাসীকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল, সময় এসেছে যুদ্ধে যাবার। বহিঃশত্রু আক্রমণ করছে। কেড়ে নিতে এসেছে আমাদের ভূমি, আমাদের বাজার।
তখন কেন যে রিয়াধ কবিতায় ফুল ফোটাতে চাইত, অণিমা তা সত্যিই বোঝেনি। তখন কী ফুল ফোটানোর সময়? তখন তো শুধুই ঘৃণার সময়, বারুদের সময়, হত্যার সময়। অথচ তখন রিয়াধ আঁকছে, অঞ্জলি ভরা কাশগুচ্ছ। যে ফুল … রিয়াধ লিখছে নীল আকাশ আর বহতা নদীর কথা। যে জলে নাকি সমস্ত পাপ ধুয়ে যায়!
যুদ্ধের আগেই পাপ ধোয়ার কথা লেখা কি দ্রোহের সূচক নয়? নিশ্চয়ই তাই। যখন স্রষ্টা আপ্রাণ চেষ্টা করছে দেশবাসীকে জাগ্রত করার, তখন যদি কেউ ঘুমের কথা বলে। যখন দেশবাসীর রক্ত ফুটছে আসন্ন হানাহানির উল্লাসে, তখন যদি কেউ সানাইতে বেহাগ বাজায়… সে দ্রোহী। এই কারণেই বোধহয় যুদ্ধের আগে লেখা রিয়াধের সমস্ত কবিতাগুচ্ছের সেই ডায়েরি, এমনকি সেই অন্তর্জালবিহীন মুঠো যন্ত্রটাকেও রিয়াধের বাবা মা নষ্ট করে ফেলেছিলেন।
আর যখন যুদ্ধ জয়ের পর সকলে ফিরে এল। যখন দিকে দিকে শুধুই ফুলের সম্ভার, শুধুই সুকুমার বৃত্তির চর্চা। সমস্ত পরিশীলতা, সমগ্র ছন্দের ধ্বংস হয় যুদ্ধের মাধ্যমে। যুদ্ধ ফেরত মানুষেরা কিছুতেই যেন আর স্বাভাবিকতায় ফিরতে পারে না। ‘স্রষ্টা’র তৈরি সেই অপূর্ব স্বাভাবিকতা, ছন্দবদ্ধতা যখন দেশের আকাশে বাতাসে।
তখন রিয়াধের ক্যানভাসে শুধুই কালোর আঁচড়। তখন তার কবিতায় অদ্ভুত সব বাক্যবন্ধের মেল।
# ৪ #
যুদ্ধশেষে পা দুটো খুইয়ে ফিরে এসেছিল রিয়াধ। প্রস্থেটিক পায়ে সে দিব্যি হাঁটাচলা করতে পারত। জোরে দৌড়তে আর সিঁড়ি ভাঙতেই সামান্য যা অসুবিধা হত শুধু। সবাই ভেবেছিল এবার রিয়াধ বড়োসড়ো কোনো একটা সরকারি পদে বসবে। কেন্দ্রস্তরের উচ্চপদ না হলেও, রাজ্যস্তরের উচ্চপদ তো পাবেই। আর প্রচুর টাকা কামাবে। রিয়াধের পারিবারিক আভিজাত্য, এবং সম্পদ তো ছিলই; তার সঙ্গে এবার যোগ হল যুদ্ধে তার অঙ্গহানি হওয়ার করুণা। কিন্তু সকলের মুখে ছাই দিয়ে রিয়াধ শহর বদলাল। একদিন সকালে অণিমা দেবী দরজা খুলে দেখলেন, রাতজাগা লাল চোখে বাক্সপ্যাঁটরা হাতে রিয়াধ দাঁড়িয়ে তাঁর দোরগোড়ায়।
যুদ্ধের শুরুতেই অর্থ উপার্জনের জন্যে অণিমা দেবীকে চলে আসতে হয়েছিল এক প্রান্তিক শহরে। সেইখানে বোমা তৈরির কারখানা বসেছিল। যুদ্ধ শেষে শহরটা জৌলুস হারিয়ে ফেলল বটে, কিন্তু অণিমা দেবী ওখানকার গোয়েন্দা বিভাগে একটা চাকরি পেয়ে গেছিলেন। সংসার তার বিশেষ কেউ ছিল না, তাই সেরকম টানের বালাইও ছিল না কিছু। যুদ্ধ চলাকালীন তিনি এই ছোটো শহরটাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন।
অণিমা দেবীর সেই ছোটো শহরে, তাঁর ছোট্ট পাখির বাসায় উঠে এল রিয়াধ। তখনও সবাই ভেবেছিল এ বুঝি রিয়াধের খামখেয়াল। যুদ্ধে আহত মনকে শান্ত করতে গেছে সে। কিন্তু, সপ্তাহ থেকে মাস, মাস গড়িয়ে গেল বছরে। রিয়াধ ওই ছোটো শহরটাতেই থেকে গেল। এক সাধারণ মুদিখানা গুদামে হিসাবনিকাশের কাজ নিয়ে।
তখন সবাই ভাবল, বাবা-মায়ের মস্ত রাজকীয় বাড়ি, অত বিশাল সম্পত্তি, এমনকি ওদের প্রতিপত্তিটুকুর আওতা ছেড়ে বেরোবে বলেই, রিয়াধ বুঝি শহর পালটাল। আসল কারণটা একমাত্র অণিমা দেবীই ধারণা করতে পেরেছিলেন। হ্যাঁ, ধারণা। যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর রিয়াধ বেশি কথাবার্তা বলত না। অন্তত শিল্পসৃষ্টি নিয়ে তো কোনো কথাই বলত না।
অণিমা দেবী তাঁর গোয়েন্দা পুলিশি দৃষ্টিতেই নজর করেছিলেন। সেইসব দিনগুলোতে ‘স্রষ্টা’র কাজ দেখলেই রিয়াধ জ্বলে যেত। জ্বলতে জ্বলতে চলে যেত নিজের ঘরে। গিয়ে পুরোনো দিনের আন্তর্জালহীন ডিজিটাল প্যাড অথবা কখনও আরও প্রাচীন সব কাগজ ক্যানভাসে লিখত আঁকত। যেসব বাক্যবন্ধ রিয়াধ লিখত, সেগুলোর কোনো মাথামুণ্ড ছিল না, কিন্তু কোথায় যেন একটা বিরোধের সুর বাজত ওই বাক্যগুলোর মধ্যে। ভয়ার্ত অণিমা যতটা পারত লুকিয়ে রাখত, রিয়াধের সেই সব সৃষ্টি।
ওই ছোটো প্রান্তিক শহরটায় রাস্তাঘাট তখনও ডিজিটাল ব্যানার-স্ক্রিনে ছেয়ে যায়নি; যেমনটা রিয়াধের নিজের শহর হয়েছিল। খুব সম্ভবত নিজের ব্যর্থ জ্বালাপোড়ার হাত থেকে বাঁচতেই, রিয়াধ এসে উঠেছিল অণিমার পায়রার খোপে। রিয়াধকে নিয়ে অন্যদের মতো অণিমার বিশাল আশাআকাঙ্ক্ষা কিছু তেমন ছিল না। তবু মানুষটা দিনের পর দিন একটা সাধারণ গুদামে হিসাবের কাজ করে যাবে, এতটাও অণিমার সহ্য হয়নি।
প্রায় বছর ঘুরে গেলে, সর্বার্থে শূন্য রিয়াধের সামনে, অণিমা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘তুমি কেন শান্তি পাচ্ছ না? যুদ্ধশেষে সবাই যখন শান্ত হয়ে গেছে। দেশ যখন পূর্ণ গৌরবে ঝলমল করছে। শিল্পে সাহিত্যে লালিত্যের বান ডেকেছে, সুরের মেলা বসেছে। তখন তোমার এ কি ভিখারি মূর্তি!’
কেন তুমি মরা শিশুর ছবি আঁক? কেন তুমি দ্রোহীর মতো লেখো—
জান্নাত ফুঁড়ে নেমে আসে পারিজাত,
একেক ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায় শত শত লাশ…
এসব কীরকম শব্দবন্ধ! এ কেমনতর ভাবপ্রকাশ? সর্বাঙ্গে দগ দগ ক্ষত নিয়ে এরকম উলঙ্গ মূর্তি তুমি কেন প্রকাশ করছ, রিয়াধ!
অথচ যুদ্ধের পরে কত আর্টিস্ট, কত লেখক, কত পরিচালক কী করুণাময়, সহানূভুতিময়, কত অপূর্ব সব রচনা করেছিল। শুধুমাত্র স্রষ্টাকে নির্দেশ দিয়ে। সেইসব পড়লেই চোখে জল আসে। সেইসব সিনেমা দেখলেই গা রিরি করে শত্রু নেতাদের উপর। বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে অনাথ শত্রু-শিশুদের, অবশ্য কিঞ্চিৎ দূরত্ব রেখে; ও কথা তো ভুললেই চলে না ওদের শরীরে বয়ে চলে শত্রু-রক্ত।
মেহাদৃতের সেই ছবির সিরিজ। কয়েক কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছিল। মেহাদৃত পুরো টাকা দান করেছিল যুদ্ধে নিহত সেনাদের পরিবারের কৃষ্টির জন্যে। স্রষ্টার মাধ্যমে বানানো ফিলিক্সের সেই গান। কত জনায় কিনল, শুনলেই চোখে জল নামে। ফিলিক্স সমস্ত টাকা ঢেলে দিল অনাথ-আশ্রমে। এমনকি অনাহিতা নাওরজির বানানো সেই চলচ্চিত্র। অমন বুঝি বিগত কয়েক যুগেও কেউ দেখেনি। দেখলেই, করুণ থেকে করুণতর হয়ে দ্রব হয়ে যায় মন। নাওরজির দলের কত নাম হল। এদের সবার থেকে তুমি বুঝি আলাদা রিয়াধ?
প্রথম প্রথম রিয়াধও অবরুদ্ধ আবেগে কাঁপত। কাঁপা কাঁপা গলায় বলত – ‘আমি যা দেখেছি, তা স্রষ্টা বলছে না, অণিমা। আমি নির্দেশ দিলেও বলছে না। আমার মনের মধ্যে যে সমস্ত রং খেলা করে। আমার মাথার মধ্যে যে সমস্ত দৃশ্য ঘোরে, আমার স্বপ্নে যে চলচ্চিত্র তৈরি হয়, তার একটাও স্রষ্টা বানাতে দিচ্ছে না।
‘স্রষ্টা তো বলছে রিয়াধ। বলছে তো শত্রুবাহিনীর কত সহস্র নিহত। কত লক্ষ আহত। আর কতজনই বা সব খুইয়ে অনাথ, গৃহহীন হয়েছে। সবই তো বলছে স্রষ্টা। আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পেয়েছি। আমরা করুণা প্রকাশ করেছি এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে।
‘না! ওরা শুধু সংখ্যা নয়। ওরা প্রাণ। ওরা মানুষ, ওরা নারী… শিশু… আমি দেখেছি ওদের। আমি ছুঁয়েছি। আমি… আমি নিজের বোতল থেকে জল খাইয়েছি এক নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসা মৃতপ্রায় কিশোরকে। দ্বিতীয় ঢোঁক গিলতে পারেনি সেই কিশোর; শত্রু নাকি সে! কোথায় সেই বিবরণ স্রষ্টার শিল্পে? কোথায় সেই সত্যতা? কোথায় সেই আত্মা?
‘যুদ্ধের আগে স্রষ্টা কেন বলেনি—যুদ্ধ এরকম তীব্র, এরকম কলুষ, এরকম অমানবিক? আজও কেন বলছে না সে? কেন ধরে রাখছে না এই ইতিহাস? শিল্পে, সাহিত্যে, গানে? কেন সেই একই বস্তাপচা মোটা দাগের প্রেম, করুণা, দয়ার ছবিতে ভরিয়ে তুলছে শিল্প জগৎ?’ রিয়াধের স্বর বেসমেন্টের পাথুরে দেওয়াল আর ছাত ভেদ করেও বুঝি আকাশ ছুঁয়ে গেছিল।
হয়তো সেইদিন নয়। হয়তো অন্য কোনোদিন। যেদিন রিয়াধ চৌমাথা মোড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কবিতাপাঠ করেছিল। অথবা তার কয়েক হপ্তা পরে ওই আগুনে আগুনে ছ্যাঁদা করা অদ্ভুত ক্যানভাসটা টাঙ্গিয়ে দিয়ে এসেছিল বাজারের ঠিক মাঝ মধ্যিখানে। গুণে গুণে একশোটা পোড়া গহ্বর সেই ক্যানভাসে। রিয়াধের স্বর আকাশ ছুঁয়েছিল।
সেসব দিনগুলোতে অণিমা কাঁটা হয়ে থাকত। শুধুমাত্র দেশের একপ্রান্তে ছোটো একটা শহর বলেই বোধহয় ওই সমস্ত দ্রোহ সত্ত্বেও রিয়াধ বেঁচে গেছিল। উপরওলাদের চোখ বাঁচিয়ে অণিমাকেই যেতে হত রিয়াধের এই সমস্ত আগুনে কাজ কারবার সামলাতে।
সেসব দ্রোহের দিন।
তারপর একদিন রিয়াধ চুপ করে গেছিল। চুপ করে নিষ্পলক সে দেখছিল তাদের ছোটো শহরের বিশাল ব্যানারটাকে। এক অদ্ভুত স্থাপত্য। এক নতুন শিল্প ধারা। এক অভিনব কলার প্রদর্শন করতে চলেছে স্রষ্টা। এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে স্রষ্টা। সেটা স্রষ্টার শততম জন্মবার্ষিকী। যুদ্ধের ঠিক এক বছর বাদে। চারপাশের মানুষের অবিরল আনন্দ উচ্ছ্বাসের মাঝে, রিয়াধ চুপ করে গেছিল।
অণিমার হাজার ডাকেও সাড়া দেয়নি।
তারপর মধ্যরাতে ঘুমন্ত অণিমাকে ডেকে তুলে অনিবার্যের মতো রিয়াধ উচ্চারণ করেছিল সেই ভয়ংকর শব্দগুচ্ছ—‘তুমি কি জানো অণিমা, এই যুদ্ধ কেন হয়েছিল? তুমি জানো না। আমি জানি। আমি জেনেছি।’
# ৫ #
প্রথম – গতকাল আমি একটা নতুন ধারার শিল্পের কথা ভেবেছি।
দ্বিতীয় – নতুন ধারা আবার কী! নতুন ধারা বলে কিছু হয় না। তুই এই কথা বলতে পারিস যে, স্রষ্টা তোকে একদম একটা নতুন ধারার ছবি বা গল্প বা ভাস্কর্য দিয়েছে।
তৃতীয় – আমায় কেন দেয় না!
চতুর্থ – তুই যেভাবে ঘ্যানাতে শুরু করেছিস। স্রষ্টা না দিলেও, আমাদের বন্ধু নিজের শিল্পটা তোকেই দিয়ে দেবে।
সেই চারজনের এই দলটাকে বহুদিন দেখেননি অণিমা দেবী। প্রায় প্রতিদিনই তিনি রেস্তোরাঁয় খেতে যান। ওরা আসে না।
অণিমা দেবী ভাবতেন, হয়তো ওদের এই রেস্তোরাঁর খাবার পছন্দ নয়। অথবা, ওরা হয়তো স্রষ্টার এই অফিসের কাজ ছেড়ে দিয়েছে। কিছুদিন যাবত অণিমা দেবীর ভীষণ ইচ্ছা করছিল, সেই দলটাকে আরেকবার দেখতে। নবীন সতেজ সেই দলটি। আজ আবার দেখা পেয়েছেন।
মাস দেড়েক আগে সেই সিনেমাটা রিলিজের পর জন-অসন্তোষ বেশ বেড়েছে স্রষ্টার বিরুদ্ধে। বিনোদন বাজার প্রায় ধ্বসে পড়ার জোগাড়। অণিমা দেবী শুনেছেন বিনোদন-মন্ত্রক কোন কোন ক্ষেত্রে সেন্সরশিপ কতটা তোলা যায় সেই নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে।
‘আহ্! কোনো নতুন ছবি নয়। আমি বলছি একদম এক নতুন ধারার কথা।’ প্রথম মেয়েটা বলে। তার হাত মুষ্টিবদ্ধ। চোখ জ্বলজলে। তার ঝাঁকড়া চুল বন্ধনীর বাধা ঠেলে ছিটকে বেরোতে চায়। নিজেকে সামান্য সামলে নিয়ে সে বলে, ‘তবে এটাকে স্থাপত্য বলবি নাকি ভাস্কর্য নাকি চিত্র; সেটা আমি ঠিক বলতে পারব না।’
অস্বাভাবিক একটা নীরবতা নেমে আসে চ্যাট বক্সে। তৃতীয়জন একটু বিতৃষ্ণার চোখে দেখে মেয়েটাকে। হয়তো তার উদ্ধত কথা বলার জন্যেই। দ্বিতীয়জন নড়েচড়ে বসে। চতুর্থজন মেয়েটার পিঠ চাপড়ে দেয়। আপোষের সুরে বলে, ‘বেশ তো। নতুন ছবি আঁকিয়েছিস। ভালো কথা। তুই তো এমনিতেও লোগো হাউজে কাজ চাইছিলি। সেটা এবার পাকা হয়ে যাবে।’
প্রথমা বিরক্তির স্বরে বলে, ‘কতবার বলব আঁকাইনি। আমি নিজে এঁকেছি অথবা বানিয়েছি।’
এবার দ্বিতীয় আর তৃতীয়জন উভয়েই ভ্রূ কুঞ্চিত করে। তারা মেয়েটার কথাই বুঝতে পারছে না। প্রথম এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে, তারপর একটুকরো স্বচ্ছ পলিপ্লাস্টিকের কাপড় বের করে ব্যাগ থেকে। একটা সাদা কাপড়ের উপরের থেকে নীচের দিকে রঙের ধারা নামছে। সেই গাঢ় উজ্জ্বল রং একটু করে কাপড়ের নীচের দিকে নামছে আর ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে… ঠিক যেন মানুষের শিল্পসৃষ্টির বোধের মতো, উদ্ভাবনী ক্ষমতার মতো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চর্চার অভাবে, ক্রমে ফ্যাকশে হতে হতে মিলিয়ে গেছে একদম।
তৃতীয় ভিতু গলায় ফিসফিসিয়ে বলে, আমি শুনেছি আমাদের দেশে, এইভাবে কাপড়ের উপর তুলি না কি যেন দিয়ে, ছবি আঁকা হত প্রায় একশো বছর আগে। দ্বিতীয় শিল্পদ্রোহের আগে। এইভাবে ছবি আঁকাটা স্রষ্টা বিরোধী না?
দ্বিতীয় এবং চতুর্থ জনের মুখে যুগপৎ বিরক্তি আর চিন্তা।
দ্বিতীয় কাঁধ ঝাঁকায়। বলে, শুধু শুধু সময় নষ্ট। তোর ওই আঁকা অথবা ভাস্কর্য স্রষ্টা অনুমোদন করবে না। যে জিনিস থেকে টাকাপয়সা পাওয়া যায় না, সেই জিনিসের চর্চা করে লাভ কি?
মেয়েটা বিদ্রোহী হতে চায়, বলে, ‘কেন করবে না? আমি স্রষ্টার সমস্ত আইন নিয়ম মেনেই এঁকেছি।’
‘নিয়ম মেনে আঁকলে স্রষ্টাকে নির্দেশ দিলি না কেন?’
‘স্রষ্টা আমার নির্দেশ বুঝতে পারছিল না। আমার মনের মধ্যে যে রঙের খেলা চলছিল… ’
তৃতীয়র মুখের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। সে চট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। বলে, ‘আমার ভাই কাজকর্ম আছে। আমি আজ আসি।’
তৃতীয় ছেলেটা প্রায় দৌড়েই রেস্তোরাঁর বাইরে চলে যায়। ছেলেটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে, দ্বিতীয় আর চতুর্থজন দুজনেই মাথা নাড়ে। একে একে বলে,
—‘তুই সময়ের অপচয় করছিস পুরোপুরি। যাই এঁকে থাকিস তা তো স্রষ্টার থেকে ভালো হয়নি। এইসব নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি না করাই ভালো।’
—মানুষ আর যাই হোক, ‘স্রষ্টা’র সমান হতে পারে না। তার থেকে নির্দেশগুলোকে আরও উন্নত করা যায় কীভাবে সেই চিন্তা কর। আমরা যে কিছুদিন আগে সেন্সরশিপ তোলার আন্দোলনটা করলাম। সেখানে আসিসনি কেন?’
কিছুক্ষণ পরে অন্য দুজনও চলে যায়, প্রথমা মেয়েটা একলাই বসে থাকে। আশাহত। মাথা নীচু।
অণিমা দেবী বহুদিন পরে রিয়াধকে দেখতে পান। হত আশা। নীচু মাথা।
অণিমা দেবীর ইচ্ছা করে মেয়েটাকে সঙ্গ দেবার। কিন্তু এরা সঙ্গ চায় না। এরা নিঃসঙ্গ দ্বীপের বাসিন্দা। এদেরকে চিরজীবন একাকী যুদ্ধ করে যেতে হয়। অর্ধ শতাব্দী আগে রিয়াধ যেদিন তাঁকে মধ্যরাতে ডেকে তুলে বলেছিল, ‘যুদ্ধ কেন হয়েছিল, তা আমি জানি।’
সেই মুহূর্তে রিয়াধ যেমন সঙ্গীহীন হয়ে গেছিল, ঠিক তেমনি।
রিয়াধের কথার মাথামুণ্ডু সেইদিন অণিমা কিছুই বুঝতে পারেনি। রিয়াধ তাকে টেনে নিয়ে গেছিল বেসমেন্টে। একটুকরো মোটা প্রিন্টেড কাগজ দেখিয়ে বলেছিল, এটা দেখো অণিমা।
কাগজটা পুরোনো। পুরোনো একটা ফোটোগ্রাফ। ফোটোগ্রাফটার কোণায় কয়েক ফোঁটা রক্ত লেগে। অন্য ধারটা সামান্য পুড়ে গেছে। ফোটোগ্রাফের পিছনে লেখা একটা বিপ্লবী স্লোগান – অগ্নিকে স্তব করি।
একদল বিভিন্ন বয়সি বিভিন্ন দেশের নারীপুরুষের ছবি। প্রায় জনা পঞ্চাশ নারী-পুরুষ। একটা বিশাল দেওয়ালের সামনে কপালে কালো ফেট্টি আর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পিছনের দেওয়ালটায় এক অপূর্ব কারুকীর্তি। পাথরের অন্তরাল থেকেও যেন প্রাণ ফুটে বেরোচ্ছে। ফুটে বেরোচ্ছে তেজ। প্রাচীন সেই আগুনের মতোই। সৃষ্টির কামনায় সে লেলিহান।
অণিমা আঁতকে উঠে বলেছিল, এই… এইটাই আজকে অ্যাড দেখলাম না বাজারে? এই ছবি তুই পেলি কোথায়? আর এরাই বা কারা? এই স্লোগানের অর্থ কী?
—যে গ্রাম, যে অঞ্চল, যে দেশের দখল নিয়ে যুদ্ধ হয়েছিল এটা তারই এক গুহার ছবি। আমি সেই গুহা দেখিনি। যে ছেলেটাকে আমি জল খাইয়েছিলাম এই ফোটোগ্রাফ তার কাছে ছিল। সে এক তরুণ তবলা বাদক। যুদ্ধের খাতিরে সে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। আর ওই স্লোগান! ওর অর্থ ওরা জীবন দিয়ে বুঝিয়ে গেছে।
—কিন্তু ওরা তো বহিঃশত্রু। আমাদের সীমানা আক্রমণ করেছিল। তাই তো আমরা ওদের হত্যা করতে…
—কীসের বহিঃশত্রু? কোথাকার সীমানা? তখন স্রষ্টার অবস্থা মৃতপ্রায়। নতুন কোনো সৃষ্টি সে বানাতে পারে না। শুধুই পুরাতন মৌলিক সৃষ্টিকে চর্বিতচর্বণ। মুদ্রারাক্ষসরা প্রমাদ গুণেছিল। প্রমাদ গুণেছিল রাষ্ট্রনায়করাও। স্রষ্টা ধ্বসে পড়লে সমূহ বিপদ। কীভাবে তাহলে নজরদারী চলবে? কীভাবে চলবে প্রত্যহ বিনোদনের মাধ্যমে মগজধোলাই?
ওরা পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিল নতুন কোনো ধারা। নতুন কোনো সুর। নতুন মাত্রার ছবি, গল্প। হাঃ, ততদিনে আমাদের দেশের মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। শিশুবেলায় আমি প্রমাতামহের কাছে শুনেছিলাম, সংগীতের অনেক ধ্রুপদী রাগ নাকি হারিয়ে গেছে চিরতরে, কারণ সেগুলো তেমন জনপ্রিয় হয়নি। সেগুলো বহু বহু বছরের সাধনার ফসল। জনপ্রিয় হয়নি বলে মানুষ আর সাধনা করতে রাজি হয়নি। এমনভাবেই নাকি পৃথিবীর বুক থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে অনেক সুন্দর সুন্দর ভাষা, কারুকলা, শিল্পবোধ।
তখন আমি ভাবতাম—আহা, সেইসময় স্রষ্টা থাকলে এই সমস্ত কিছু গুছিয়ে রাখত আর্কাইভে। কিচ্ছুটি নষ্ট হত না। যত দিন গেল আমি দেখতে পেলাম, আসলে মানুষের নিষ্ঠা নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে চিন্তন ক্ষমতা। নষ্ট হয়ে গেছে সাধনার ধৈর্য্য। দোষ স্রষ্টার নয়। সে তো হাতিয়ার মাত্র। বল্লম, অথবা আগ্নেয়াস্ত্র, অথবা হয়তো নিউক্লিয়ার বোমার থেকেও ভয়ংকর হাতিয়ার। ড্রাগের থেকেও সে ভয়ংকর নেশা, যা শুষে খায় মানুষের চিন্তাশক্তি। কিন্তু, সে শুধুই জড় অস্ত্র। তার চালক মানুষ। দোষ মানুষেরই। সে নিজেই নিজেকে আবদ্ধ করেছে কুয়োতে। এখন সে চাইলেও আর তৈরি করতে পারবে না নতুন কিছু। তার জন্যে যে ধরনের সাধনা, নিষ্ঠা অথবা পরিবেশ দরকার ছিল তার সবটুকুই বিভিন্ন লোভী মানুষে মিলে নষ্ট করে ফেলেছে।
যে জিনিসের বাজার নেই, তার চর্চাও নেই। আর তা একসময় লুপ্ত হয়ে যায়। যেমন, এখন আমাদের দেশে লুপ্ত হয়ে গেছে মানুষের শিল্পবোধ, উদ্ভাবনী ক্ষমতা।
পঞ্চাশ বছর আগে রাষ্ট্রনায়করা দেখেছিল নিত্যনতুন বিনোদনের অভাব অর্থনীতি ধড়ফরাচ্ছে, শাসন ব্যবস্থা টলোমলো। অথচ পাশেই সেই দেশ, যেখানে তখনও মুক্তচিন্তা বিরাজ করছে। যেখানে তখনও শিল্পের চর্চা হয়। যেখানে শিল্পীরা বাঁচে। অতএব সেই দেশ আক্রমণ করো। তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণ দেখিয়েই আক্রমণ কর। ওই যে আমাদের সীমান্তবর্তী ওই রাজ্যটা। যেখান দিয়ে শিল্পীগুলো কাঁটাতারের বেড়া টপকে অন্যধারে পালাবে ভাবে। ওই মুক্তচিন্তার রাজ্যটাকে বিদ্রোহী ঘোষণা করে দাও। তারপর বল, ওরা যোগ দিয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে। আর প্রতিবেশী রাষ্ট্র আমাদের সীমানা ভেঙে এসেছে ঢুকে।
যেভাবেই হোক স্রষ্টাকে বাঁচাতে হবে, নয়তো বাঁচবে না অর্থনীতি, নয়তো থাকবে না রাজার নীতি।
তারপরের গল্প তো সবাই জানে। বেঁচেছিল স্রষ্টা। আর পেরিয়ে গেছে আরও পঞ্চাশ বছর।
# ৬ #
নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাবার পরে মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়। অণিমা দেবী কী এক ঔৎসুক্যে মেয়েটার পিছু নেন। হাহ্! অণিমা দেবী নিজের মনেই হাসেন, গোয়েন্দাগিরির অভ্যাস এখনও যায়নি আমার।
প্রথমা কোনো যানবাহন ব্যবহার করে না। চলন্ত ফুটপাথের উপর দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে। মাঝে মাঝে মোড় বদল করে। খুব সম্ভবত মেয়েটার হাতে পয়সাকড়ি বিশেষ নেই। সে প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এই রাস্তা ওই রাস্তা আনমনে হেঁটে হেঁটে যায় শহরের প্রান্তের দিকে। অন্য কেউ হলে এতটা রাস্তা ঠিকই বাস অথবা ক্যাব ব্যবহার করত। বৃদ্ধা অণিমা দেবীর পা ব্যথা করে।
আচমকা এক জায়গায় চলন্ত ফুটপাথ শেষ হয়ে যায়। মেয়েটা মোড় ঘুরে সামনের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যায়। অণিমা দেবী দ্রুত পায়ে এগোনর চেষ্টা করেন। বয়স হয়ে তাঁর গতি বড়োই শ্লথ হয়ে গেছে। বাঁকের মুখে পৌঁছাতেই অণিমা দেবী অন্যধারে ভীত সন্ত্রস্ত এক জোড়া পদশব্দ পান। কেউ বুঝি ভয় পেয়ে ছুটে আসছে। এইসব ব্যাপারে অণিমা দেবীর কান বড়ো পাকা। তিনি সরে আসার আগেই অন্য পাশের ছুটে আসা অবয়বটির সঙ্গে তাঁর সজোরে ধাক্কা লাগে আর অণিমা দেবী টাল সামলাতে না পেরে পাশের দেওয়ালে আছড়ে পড়েন।
অবয়বটি কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করেই ছুটে একটা প্রায়ান্ধকার গলিতে ঢুকে পরে। এবার অণিমা দেবী আরও দুটো পদশব্দ আর শোঁ শোঁ ড্রোনের আওয়াজ পেলেন। সিঁটিয়ে দাঁড়ালেন দেওয়াল ধরে। কিছু করার নেই, মাস কয়েক আগে পা পিছলে মালাইচাকিতে যে ব্যথা লেগেছিল; সেইখানেই আবার যন্ত্রণা হচ্ছে।
দ্যাখ না দ্যাখ, ড্রোন দুটো চলে এল। দ্রুত স্ক্যান করল অণিমা দেবীকে, তারপর স্যাট স্যাট করে আবার উড়ে গেল এদিক ওদিক। অণিমা দেবী দেখলেন অবয়বটা যে গলিতে গেছে সেই দিকেই একটা ড্রোন গেল। অন্য পদশব্দের অধিকারীরা ততক্ষণে চলে এসেছে। একটা লোক অণিমা দেবীকে দেখে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করল।
‘কুনো দেখিবি?’
লোকটা যে স্রষ্টা ছাড়া কথা বলতে অভ্যস্ত নয়, তা এই অদ্ভুত বাক্যেই বোঝা গেল। খুব সম্ভবত উত্তেজনায় সে স্রষ্টার ভয়েস ফিল্টার চালু করতে ভুলে গেছে।
অণিমা দেবী হাউমাউ করে অভিনয় করে দেখালেন তাকে ধাক্কা মেরে পালিয়েছে মেয়েটা।
‘কুথা? কুথা?’
অণিমা দেবী উলটো দিকের গলিটা দেখিয়ে দেন। লোকদুটো চলে যায়। ডেকে নেয় ড্রোনগুলোকেও। অণিমা দেবী ধীরে ধীরে অবয়বটা যে গলিতে ঢুকেছিল সেখানে ঢোকেন। তার আগে ভালো করে দেখে নেন ল্যাম্পপোস্টে ক্যামেরা লাগানো আছে কিনা। না, নেই। শহরের এই প্রান্তটা হয়তো তেমন ধনী নয়। মোড়ে মোড়ে প্রতিটা ল্যাম্পপোস্টে ক্যামেরা নেই।
অণিমা দেবীকে বেশি খুঁজতে হয় না। একটু পরে অন্ধকার চিরে মেয়েটাই এগিয়ে আসে। মৃদু খসখসে স্বরে বলে, ‘অলরাইট? আপনি কী লেগে গেছেন?’
অণিমা দেবী ঘাড় নাড়েন, প্রশ্ন করেন। ‘না, তেমন লাগেনি। তুমি জান, ওরা কারা?’
মেয়েটা মাথা নাড়ে। তার হেয়ার ব্যান্ডটা ছিঁড়ে গেছে বা খসে পড়েছে। ঝাঁকড়া চুল দোলে এদিক ওদিক। সে ভয়ার্ত কণ্ঠে দ্রুত বলে, ‘সসটার পুলিশ। জানে যাচ্ছে কে করে? তাড়াতাড়ি জানে যাচ্ছে ওরা! ওরা মেরে দিব আমাকে?’
‘না।’ অণিমা দেবী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলেন। ভয়ে মেয়েটার উচ্চারণ, ব্যকরণ, শব্দবন্ধ, বাক্যবন্ধ সব গোলযোগ পাকিয়ে গেছে। এই প্রজন্ম, শুধুমাত্র নিজের মনের কথাটুকু গুছিয়ে বলার জন্যে, বাক্-এর ব্যবহারও ভুলতে বসেছে। যেমন, একবিংশ শতাব্দীর জেন জি ভুলে গেছিল চিঠি লেখার শিল্প, ভুলে গেছিল রাগপ্রধান সংগীত। এই অদ্ভুত ভাষাতেই ওরা কথা বলে যায় অনর্গল।
প্রয়োজন নেই তো সুন্দর করে গোছান কথা বলার, বা লেখার… মস্তিষ্ককে অতটা পরিশ্রম করানোরও প্রয়োজন নেই। কারণ, স্রষ্টা আছে, স্রষ্টা অর্ধ উচ্চারিত শব্দ আর স্বরের অনুরণন থেকেই সে স্পষ্ট বুঝে নেয় মানুষ কী বলতে চাইছে। সে ঠিক কথাটা পৌঁছে দেয় উলটোদিকের লোকটার কাছে। অবশ্য সময় বিশেষে সামান্য সেন্সর করে। তিন দশক আগের এই আবিষ্কারই ছিল, মানুষের শেষ আবিষ্কার।
অণিমা দেবী বলেন, ‘ওরা তোমাকে কখনই মারবে না। বরং ঠিক উলটোটা। ওরা তোমাকে প্রচুর টাকা দেবে, সুযোগসুবিধা দেবে। নিজস্ব রাজকীয় বাসস্থান, এমনকি তোমার শিল্প সৃষ্টির অপার সুযোগ।’
মেয়েটা অবিশ্বাসে চোখ বড়ো বড়ো করে। ‘ক্… কেনা?’
আধ ঘণ্টা পরে অণিমা দেবী মেয়েটাকে নিজের গাড়িতে করে শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন।
‘কী ভেবে ওই ছবি আঁকলে তুমি?’
অণিমা দেবীর প্রশ্নে প্রথমা বিষণ্ণ হয়, বলে, ‘আমার স্কুলবেলা কেটেছে প্রধান শহরগুলোর একটাতে। আজ খবর পেলাম, আমার স্কুলবেলার পাঁচজন বন্ধু একত্রে আত্মহত্যা করেছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, নতুন এক অসুখ। ওই খবর শোনার পরে, আমার মনে হল ওদের সবটুকু যেন মুছে গেছে। আজকাল আমার মনে হয়, একসময় আমাদের যেন অনেক কিছু ছিল, আজ কিছুই আর নেই… ’
অণিমা দেবী চমকে ওঠেন। তাহলে রিয়াধের ভবিষ্যদ্বাণী ফলেই গেল শেষমেশ! গত কয়েক বছর ধরেই সমাজে এক নতুন সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছিল। যে খবরের কোনো ভিত্তি নেই। যে খবরকে ক্রমাগত চাপা দিয়ে চলেছে সংবাদমাধ্যম। শোনা যাচ্ছে, মানুষ নাকি হতাশ হয়ে যাচ্ছে, ক্রমে পাগলের সংখ্যা বেড়ে চলেছে শহরে শহরে। শোনা যাচ্ছে, কোথায় কোথায় মানুষ নাকি আচমকা আত্মধ্বংসী হয়ে উঠছে। কিন্তু, এই অসুখের কোনো হদিশ খুঁজে পাচ্ছে না মনোবিজ্ঞানীরা। কারণ, বহুদিন হল দেশে নাকি তৈরি হয়নি নতুন কোনো গবেষক। মানুষ নাকি হারিয়ে ফেলেছে তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা।
অবশ্য সমাজের মাথারা বলছে, আমাদের আর নতুন করে কিছু জানার নেই, নতুন করে কিছু বলার নেই; তাই স্থবিরতা গ্রাস করছে সমাজকে। শীতের স্থবিরতা। শীতের রুক্ষতা। কর্কশতার উদ্যাপনে মেতে উঠছে একদল মানুষ। হত্যার উদ্যাপনে। না হয় নিজেকেই; তবু সে তো হত্যাই।
শহরের বাইরে অনেকটা এসে অণিমা দেবী গাড়ী থামান। সামনে বিস্তীর্ণ নির্জন রুক্ষ টাঁড়। একাদশীর ক্ষীণাঙ্গী চাঁদ, ঢাকা পড়েছে ছেঁড়া মেঘের আড়ালে। তাও সারা আকাশ জুড়ে অজস্র নক্ষত্রের আলো প্রতিভাত হয়। অস্পষ্ট বোঝা যায় জনহীন বিস্তারকে। পথের পাশে মাঝে মাঝে দেখা যায় বন্যজন্তুর জ্বলজ্বলে চোখ। রাত্রি বয়ে চলে রুক্ষ টাঁড় জুড়ে।
অণিমা দেবী বিস্তারিত বলেন কী কী ঘটেছিল দেশে বছর পঞ্চাশ আগে। আর কী কী-ই বা ঘটে চলেছে এখন আবার। বিগত পঞ্চাশ বছরে রাষ্ট্রনায়করা বহু চেষ্টা করেছেন যাতে করে স্রষ্টা নিজে নিজেই নতুন কল্পনা খুঁজে নিতে পারে। কিন্তু, এখনও পর্যন্ত তারা ব্যর্থ।
বিগত পঞ্চাশ বছরে তারা এই মেয়েটির মতো বহু সৃজনীশিল্পীকেই প্রচুর টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে। তাদের ভাঙিয়েই মাঝে মাঝে স্রষ্টার নামে বের হয় নতুন ধারার গল্প। কিন্তু, সেই বা কতজন। আর সবাই তো সরস্বতীর বরপুত্র হয়ে জন্মায় না। মানুষের শিল্প তৈরির ক্ষমতা সীমিত। কিন্তু নতুন কল্পনার ক্ষমতা একমাত্র তাদেরই আছে।
এটা বোঝার পরেও রাষ্ট্রনায়করা মানুষকে উদবুদ্ধ করতে পারেনি শিল্পের চর্চায়। আসলে যা হারিয়ে যায়, তা হারিয়েই যায়। তাকে খুঁজে তুলে আনতে শ্রম লাগে বহুগুণ বেশি। এই বিশাল অলস বিনোদনপ্রেমী জনসাধারণকে আবারও কষ্টের কাছে, নিষ্ঠার সামনে দাঁড় করাতে গেলে যে সেই মূল সমস্যা। ধ্বসে পড়বে অর্থনীতি। টলমল করবে গদি, টান পরবে রাজার টিকিতে।
তার থেকে এই ভালো। মাঝে মাঝে এই মেয়েটার মতোই কেউ না কেউ মাথা তুলে দাঁড়াবে। স্রোতের উলটো বাগে হাঁটতে চাইবে। তাদের কিনে নেওয়া হবে। কিনে নেওয়া হবে তাদের বুদ্ধি, তাদের সৃজনীক্ষমতা, তাদের আত্মা…
কথা শেষ হলে, মেয়েটা যেন বহুক্ষণ কী সব ভাবে। মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে, একসময় বলে, ‘আমি তাহলে কী করব? আমি যদি ওদের কাছে নিজেকে বিক্রি করে দিই, তাহলে ইচ্ছামতো সৃজনের ক্ষেত্র পাব, অবকাশ পাব। আর যদি বিদ্রোহী হই তাহলে ওরা নিশ্চয়ই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না?’
‘ওই শহরে থেকে তুমি বিদ্রোহী হতেই পারবে না। ওরা যেন তেন প্রকারেণ গ্রাস করবে তোমাকে। ওরা বারংবার আসবে। বহু প্রলোভন, বিবিধ ভয়ের সম্ভার নিয়ে। এক যদি তুমি মরে যাও। তাহলেই একমাত্র সম্ভব ওদের গ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়া।’
‘আপনি কী আমাকে মরে যেতে বলছেন? আত্মহত্যার কথা বলছেন?’
এটাই শিল্পের অভিশাপ। একজন সত্যকারের শিল্পীর প্রতি। এই হৃদয়বান প্রাণস্বরূপ চিন্তাক্ষমতাই অভিশাপ। অণিমা দেবী বসে থাকেন নিরবে।
অর্ধ শতাব্দী আগের সেই ভয়ংকর যুদ্ধে স্রষ্টানায়করা বেশি সুবিধা করতে পারেনি। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো থেকে কিছু কিছু নতুন শিল্পকলা তারা উদ্ধার করতে পেরেছিল বটে। কিন্তু অগ্নির আরাধক সেই শিল্পীরা বোমা মেরে, আগুন জ্বালিয়ে নষ্ট করে দিয়েছিল অধিকাংশই। ধ্বংস করে ফেলেছিল রেকর্ড লাইব্রেরি। পুড়িয়ে দিয়েছিল ক্যানভাস আর খাতাপত্র।
‘অগ্নিকে স্তব করি।’—জীবন দিয়ে তাঁরা বুঝিয়ে গেছে, তাঁদের স্লোগানের অর্থ। না, শুধু আত্মহনন নয়, এ তার থেকেও বেশি কিছু। নিজের হাতে নিজের সন্তানসম শিল্পসৃষ্টিকে হত্যা করেছিল তারা। যাতে সেই অবোধ সন্তান শত্রুর ঘর না আলো করে।
তারা বুঝেছিল, যত দ্রুত স্রষ্টা তার সমে পৌঁছাবে, তত দ্রুত মানুষের মন আবারও খুঁজে নেবে নিজের আবেগ, নিজের চিন্তার পথ। পাষাণ হয়ে যাওয়া আঙুলেই তারা আবার তুলি ধরবে। চেষ্টা করবে আঁকার। সেই চিত্রেই পাষান ফেটে বেরিয়ে আসবে অহল্যা। ভাষার মূল আবারও শিকড় বিস্তার করবে হৃদয়ের কন্দরে কন্দরে। রুদ্ধ, সুরবিহীন কণ্ঠেই তারা আবার হাঁক পাড়বে। কোনো দুর্বোধ্য জান্তব চিৎকার নয়, আবার মানুষের গলা চিরে বেরিয়ে আসবে আদিম ঋক মন্ত্র। তার প্রাণের ধ্বনি। সেই গানের তালে তালে দুলে উঠবে পঙ্গু শরীর।
সেদিন আহুতি দেওয়া শেষ হবে। সেইদিন অগ্নি আমাদের আশীর্বাদ করবে। সেইদিন আবারও আগুনের থেকে আমরা কেড়ে নেব উত্তাপ। সেদিন শীতের অবসানে, অভিশাপের অবসানে; আবার বসন্ত আসবে…
#পরিশিষ্ট#
ভোরের আলো ফোটার সময় প্রথমা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অণিমা দেবী তাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন শহরে, তার বস্তিতে। তার পর আর কখনও প্রথমার সঙ্গে দেখা হয়নি তার।
পাঁচ বছর পরে এক ভয়ংকর ঘটনায় চমকে উঠল সকলে। এক দ্বীপপুঞ্জে সরকার থেকে কড়া পাহারায় গোপনে লুকান ছিল সমস্ত শিল্পীদের। কোনো অভাব ছিল না তাঁদের। এমনকি তাঁদের কারারুদ্ধও করে রাখা হয়নি। অথচ, তাঁরা সকলে একযোগে আত্মহত্যা করেছেন।
মৃত্যুর আগে তাঁরা বলেছেন, মানুষের আত্মহত্যার ওই নিদারুণ অসুখ যা ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটা ঘরে ঘরে। এর জন্যে তাঁরা সমস্বরে দায়ী করেছেন স্রষ্টাকে। তাঁরা বলেছেন, শেষ যুদ্ধের কথা। তাঁরা বলেছেন, কেন স্রষ্টা-নায়করা দ্বীপের মধ্যে এনে রেখে তাঁদের। তাঁরা বলেছেন, কীভাবে স্রষ্টাকে ব্যবহার করে এক শ্রেণীর মানুষ ধীরে ধীরে নষ্ট করে দিয়েছে সমগ্র জাতিকে। কীভাবে নষ্ট হয়ে গেছে শিল্পবোধ, উদ্ভাবনী ক্ষমতা।
বিশাল সেই বক্তব্যের শেষে এক বিশাল অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে আত্মহুতি দিয়েছেন শিল্পীরা। তাঁরা সমস্বরে উচ্চারণ করেছেন অর্ধ শতাব্দী পুরোনো এক বিপ্লবী স্লোগান – আমরা অগ্নির স্তব করি। অগ্নি আমাদের ফিরিয়ে দেবে রত্নরাজি। হারিয়ে যাওয়া রত্নরাজি…
সেই অদ্ভুত আত্মহত্যার ভিডিয়ো, এবং তার আগে বলা শিল্পীদের বক্তব্যসমূহ, স্রষ্টার সেন্সরশিপকে ভেঙে বন্যার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। আন্তর্জাল বেয়ে চলে গেছে সকলের ঘরে ঘরে। ড্রোনের ডিজিটাল ব্যানারে ফুটে উঠে ভেসে ভেসে বেরিয়েছে সারা আকাশময়। এক নিদারুণ সত্য ফুটে উঠেছে সকলের চোখের সামনে। চলেছে গোটা একটা দিন ধরে। কোনোমতেই বন্ধ করা যায়নি। পুলিশেরা একের পর এক ড্রোন গুলিবিদ্ধ করে মাটিতে নামিয়ে এনেছিল সেইদিন। র্যাফ নির্বিশেষে লাঠি চার্জ করেছিল মারমুখী বিদ্রোহী জনতার উপরে। মিলিটারিরা বোমা ফেলছে সেই দ্বীপে।
শহরে শহরে আগুন জ্বলছে ধিকি ধিকি। বাতাস এখন লেলিহান। আকাশ অঙ্গারবর্ণ।
উন্মত্ত জনস্রোতের মাঝে দাঁড়িয়ে, বৃদ্ধা অণিমা দেবী আকাশের দিকে তাকান। রিয়াধ, তাহলে কি শেষমেশ অভিশাপ ঘুচল? তাহলে কি যজ্ঞ শেষ হল তোমাদের? এবার কি সত্যি সত্যি আকাশ থেকে ঝরে পড়বে তোমার স্বপ্নের পারিজাত? এবার মানুষ ফিরে পাবে হারানো রত্নরাজি? উচ্চারিত হবে প্রথম ঋক মন্ত্র?
ওঁ অগ্নিমীলে…
হোতারং রত্নধাতমম্।।
Tags: অঙ্কিতা, অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান
একটানা গল্পটি পড়লাম। অদূর ভবিষ্যতে যান্ত্রিকতা গ্রাস করবে মানুষের সুকুমার বৃত্তি গুলিকে এই প্রচ্ছন্ন একটা ভয় জাগবেই পাঠকের। বর্তমান যুগের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আমাদের ব্যক্তিগত পরিসরে সর্বক্ষণ নজরদারি করে চলেছে। গল্পটা পড়তে পড়তে তার একটা ছায়া কল্পনা করে শিউরে উঠতে হয় বারে বারে।
ভালো লাগলো 👍