ড্রিম গার্ল
লেখক: মোহর
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“ভগবান তোমার মঙ্গল করুক মা,” সোনালির হাত থেকে পাঁচশো টাকার নোটটা নিয়ে কপালে ঠেকাল প্রাণহরি। তারপর সেটাকে লুঙ্গির গেঁজেতে পুরে পায়ের কাছে পড়ে থাকা বাজারের ব্যাগটা নিয়ে হাঁটা দিল বড়ো রাস্তার দিকে। সাড়ে তিনশোতে রফা হয়েছিল, দেড়শো টাকা বাড়তি দিয়েছে অরুণ বিশ্বাসের কচি বউ। তবে বিশ্বাসদের যা ঠাটবাট, তাতে এমন অনেক পাঁচশোর নোট বিশ্বাস-বউয়ের ওই লুঙ্গি ঝাড়লে পাওয়া যাবে। লং স্কার্ট না কী যেন বলে জিনিসটাকে! একটা ফতুয়া আর এই লুঙ্গি পরেই সারাদিন তার পেছন পেছন ঘুরছিল বিশ্বাস-বউ। বাগানের পাশে বেতের চেয়ার পেতে পায়ের ওপর পা তুলে বসে তার মাটি কোপানো দেখছিল। কী বেহায়া মেয়েছেলে রে বাবা! যাই হোক, তাতে তার কী! “চক্কর মারা” হয়ে গেছে আপাতত, এরপরের কাজটা তো তার বাঁয়ে হাথ কা খেল।
হাওড়া স্টেশন পৌঁছে জেন্টস টয়লেটে ঢুকে চট করে জামাকাপড় পালটে নিল প্রাণহরি। ধুলোমাখা লুঙ্গি আর শতছিদ্র গেঞ্জিকে নাইলনের ব্যাগে পুরে হাফহাতা শার্ট-প্যান্ট পরে পান চিবোতে চিবোতে যখন প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল, তখন সাড়ে চারটার আপ মেদিনীপুর লোকালটা ঢুকছে।
পুজোর আর হপ্তাখানেক বাকি, তাই বোধহয় মফস্বল ঝেঁটিয়ে লোকজন কেনাকাটা করতে যাচ্ছে কলকাতায়। জনাচারেক লোকের গুঁতো খেয়ে, এক বিশালদেহী মহিলার পা মাড়িয়ে এবং গোটাকতক নব্য প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝখান দিয়ে শরীরটা গলিয়ে শেষ পর্যন্ত যখন আন্দুলে নামল তখন ঘামে সপসপ করছে তার ফুল ফুল ছাপ হাফ-শার্ট, বাম পায়ের চপ্পলটার স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। কোনোমতে পা টেনে টেনে স্টেশনের গেটের দিকে এগোতে গিয়েই মনে পড়ল ব্যাগটার কথা। সেটা অবশ্য ততক্ষণে ট্রেনে চড়ে মেদিনীপুর রওনা দিয়েছে। পকেটে হাত বুলোল প্রাণহরি। নাহ্, কপাল ভালো। মানিব্যাগটা যথাস্থানেই আছে। গুনগুন করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে ট্রেকার স্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়াল। ব্যাগটা খোয়া গিয়ে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। পাঁচশো টাকাটার একটা হিল্লে হবে এবার। মনোহর ফ্যাশন স্টোর্স থেকে একখানা লুঙ্গি-গেঞ্জি আর মন্ডল পাদুকালয় থেকে একজোড়া চপ্পল হয়ে যাবে এই টাকায়, সঙ্গে নাড়ুর দশকর্মা ভান্ডার থেকে একটা বাজার ব্যাগও। ফেরার পথেই নিয়ে নেবে। ব্যবসায় মাগনা পাওয়া টাকা ব্যাবসাতেই লাগানো ভালো।
তেঁতুলমুড়িতে নেমে অবশ্য মত পালটালো প্রাণহরি। আজ অনেকদিন পর সূর্য ডোবার পর বেশ একটা ফুরফুরে হাওয়া ছেড়েছে, তাই গুমোট ভাবটাও কম। আরাম করে ঘুমোনোর জন্য একদম আদর্শ পরিবেশ যাকে বলে! আজ রাতে ভালো করে ঘুমোনোটা খুব দরকার। পিন্টুর মা কে বলা আছে, দুপুর বেলায় এসে যেন একমুঠো ভাত করে জল ঢেলে রেখে দিয়ে যায়, এখন বাড়ি ফিরে একটু আলুসেদ্ধ আর ক-টা বড়ি ভেজে নিলেই হবে। ‘অ্যাকশন’এর রাতগুলোতে পান্তাভাত ছাড়া অন্য কোনো কিছুর ওপর ভরসা করে না সে। এতক্ষণ ট্রেনে আসতে আসতে গল্পটা মোটামুটি ভাঁজা হয়েই গেছে, এবার শুধু গুছিয়ে ক্লাইম্যাক্সটা ভাবতে হবে। গত মাসে দেখা একটা তামিল সিনেমার এক রোমহর্ষক দৃশ্যের কথা ভাবতে ভাবতে পা বাড়াল বাড়ির পথে।
***
“একটা চা দে রে শিবু!” বাজারের ব্যাগটা পাশে নামিয়ে রেখে কাঠের বেঞ্চের ওপর ধপাস করে বসে পড়ল প্রাণহরি। সকালে বাজার করে ফেরার পথে শিবুর স্পেশাল আদা চায়ে একটু গলা না ভিজিয়ে নিলে দিনটাই মাটি যায়। চায়ের ডেকচিতে হাতা নাড়তে নাড়তে আড়চোখে তার বাজার ব্যাগের দিকে তাকালো শিবু। “মৌরলা নিলে না যে বড়ো? আজ তো ভালো মৌরলা উটেছেল, বাজারের সাইড দি আসার সময় দেকলুম। ক্কী ভিড় মাইরি! ওই তো… হরেনদাও কেনেচে।”
“পিন্টুর মায়ের চোখে ছানি,” বেজার মুখে বলল প্রাণহরি। “নইলে কি আর নিতুম না? এখন এই মৌরলা নিয়ে গেলে একে তো ঘ্যানঘ্যান করে কানের মাথা খাবে, তারপর কখন কপালে দুপুরের ভাত জুটবে কে জানে! মাছ বেছে-টেছে রেঁধে দিতে দিতে হয়তো দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাবে। থাক বাবা, তার চেয়ে আমার কাটা পোনাই ভালো!”
“কদ্দিন আর পিন্টুর মায়ের হাতে খাবি বলত পানু?” এবার খবরের কাগজটা মুড়ে রেখে তার পাশে এসে বসল হরেনদা। কনুই দিয়ে হালকা গুঁতো মেরে সরস ভঙ্গিতে বলল, “এবার একটা বিয়ে-টিয়ে কর! কিইবা এমন বয়স তোর? আমাদের মতো টাকও পড়েনি, পেটও ঠেলে বেরোয়নি। সময় থাকতে থাকতে একখান ধর্মাঙ্গিনী জুটিয়ে ফেলতে না পারলে বুড়ো বয়সে কে দেখবে শুনি? কম্পিউটার তো চালাতে জানিস… গায়ে হাওয়া না লাগিয়ে একটা চাকরি জোটা এবার। অ্যাই নিলু, তোর কোম্পানিতে কোনো পোস্ট-টোস্ট খালি আছে কিনা দ্যাখ না? একটা হিল্লে হয় তবে ছেলেটার! একবার চাকরি পেয়ে গেলে তারপর আমরাই নাহয় দেখেশুনে একটা বিয়ে দিয়ে দেব।”
“সে খুঁজলে হয়তো চাকরি একটা পাওয়াই যাবে,” চায়ের গেলাস হাতে ভারিক্কি চালে বলল নিলু ওরফে নিলয়।” কিন্তু পানুর বিয়ে? কী যে বলো হরেনদা!”
“কেন রে? ওর বিয়েতে বাধা কোথায়?”
“আরে হাফপেন্টুল থেকে দেখছি পানুকে। সেই যে মিতালীর কাছে হাফসোল খেল, তারপর কোনোদিন আর কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে দেখল না মাইরি! ও করবে বিয়ে?” চোখ টিপে একটা অশ্লীল ইঙ্গিত করল নিলু।
“মিতালী কে গো? পানুদার গালপেন? বলি সিরিদেবীর মতো দেকতে ছেল নাকি যে পানুদার আর মন উটল না?” চা ছাঁকতে ছাঁকতে রগুড়ে গলায় বলে উঠল শিবু। উত্তরে নিলু খ্যা খ্যা করে হাসল নোংরাভাবে। “শ্রীদেবী কী রে! বিশ্রীদেবী বল্! তেল চুপচুপে চুলে গোরুর ল্যাজের মতো এই মোটা বিনুনী, সঙ্গে মোটা কালো ফ্রেমের দাদুমার্কা চশমা। সেই সেভেনটিজের মহিলাদের মতো সবসময় সুতির শাড়ি পরে আসত কলেজে, তাও আবার গায়ে আঁচল চাপা দিয়ে! জাস্ট ভাবো হরেনদা! তখন সবে সবে “কহোনা প্যায়ার হ্যায়” বেরিয়েছে, মেয়েরা হৃতিকের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আমিশা পটেলের মতো স্কার্টের ঝুল কমিয়ে চলেছে, আর সেখানে কিনা ওই মাসিমা টাইপস মেয়ের প্রেমে পড়ল পানু!”
“বাব্বা!” চশমার ওপর দিয়ে জুলজুল করে তাকাল হরেন দা। “তা প্রেম ভাঙল কিসে, অ্যাঁ? মাসিমাও লেঙ্গি দিল?”
“লেঙ্গি দেবে কী গো, তার জন্য তো আগে প্রেমটা জমতে হবে? মাসিমাকে কোনোদিন বলেই উঠতে পারেনি আমাদের দ্য গ্রেট প্রাণহরি মন্ডল!” বেঞ্চ ছেড়ে উঠে নাটুকে ভঙ্গিতে হাত-পা নাড়ল নিলু।
“বলিস কী!” হ্যা হ্যা করে হাসিতে ফেটে পড়ল হরেনদা, তাতে যোগ দিল নিলু। এমনকি ঠোঁট টিপে ফিক ফিক করে হাসতে লাগল শিবুও। প্রাণহরির মাথার মধ্যে একটা ক্ষ্যাপা রাগ একটু একটু করে আঁচড় কাটছিল। খুব বাড় বেড়েছে নিলুটা! ওকে একবার ছোট্ট করে একটা শিক্ষা দিয়ে দেখবে নাকি? সবার অজান্তেই ওর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছিল, মুঠো পাকাচ্ছিল আঙুলগুলো, এমন সময় হঠাৎ কাঠের উঁচু মাচার ওপর রাখা ঢাউস বক্স টিভিটার দিকে নজর যেতেই শিকারী বেড়ালের মতো জ্বলজ্বল করে উঠল প্রাণহরির চোখজোড়া। উঠে গিয়ে বোতাম টিপে ফুল করে দিল ভলিউম।
টিভির স্ক্রিনে তখন প্রায় চিৎকার করে চলেছে চড়া মেকআপ পরিহিত এক সুন্দরী। “এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড়ো খবর! বালি ব্রিজের ওপর মুখোমুখি সংঘর্ষ একটি মালবাহী লরি ও গাড়ির! জানা যাচ্ছে, এই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে দুই গাড়ির চালকেরই। ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছেন আমাদের সংবাদদাতা আশিস বসু, তাঁর কাছ থেকে জেনে নেব সর্বশেষ পরিস্থিতি। আশিস, দর্শকদের জানাও ওখানে ঠিক কী ঘটেছে।” সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনে ফুটে উঠল উশকোখুশকো চুলওলা এক মাঝবয়সি লোক। বুম হাতে এবার তিনি চেঁচাতে লাগলেন, “ধন্যবাদ মৌমিতা! আজ ভোর চারটে নাগাদ বালি ব্রিজের ওপর একটি লাল অডি গাড়িকে ধাক্কা মারে উলটো দিক থেকে আসা একটি দশ চাকার লরি। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে দুই চালকেরই, তবে অডিতে থাকা ব্যক্তির দেহ এতটাই থেঁতলে গিয়ে প্রায় সিটের সঙ্গে মিশে গেছে যে তা সনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না। পরে পুলিশ সূত্রে জানা যায় যে গাড়িটি হাওড়া সদর এলাকার বিখ্যাত ব্যবসায়ী অরুণ বিশ্বাসের নামে রেজিস্টার্ড। একটু আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন অরুণ বিশ্বাসের স্ত্রী সোনালি দেবী এবং অরুণ বাবুর দেহ সনাক্ত করেছেন। আমাদের ক্যামেরাম্যানকে বলব ঘটনাস্থলের দৃশ্য আপনাদের সামনে তুলে ধরতে… ”
হাসি থেমে গেছে বাকিদের। ওদিকে তখনও আশিস বসু নামের লোকটা বর্ণনা করে চলেছে ঠিক কতটা ভয়ংকরভাবে ঘটেছে অ্যাক্সিডেন্টটা। “উফ! কী বীভৎস ব্যাপার!” হাঁ করে টিভির দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে উঠল নিলু। হাত বাড়িয়ে প্লাস্টিকের জগ থেকে এক ঢোক জল খেল হরেনদা। “কখন কার কপালে যে কী লেখা আছে… ” এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকজন খদ্দেরও এসে ধীরে ধীরে ভিড় জমাচ্ছিল টিভির সামনে, একে একে গুঞ্জন উঠছিল নানারকম অ্যাক্সিডেন্টের অভিজ্ঞতা নিয়ে। শুধু সবার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণহরির মুখে পাতলা সরের মতো ভাসছিল এক চিলতে বাঁকা হাসি। ধীরে ধীরে বাজার ব্যাগটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।
লাহাদের ভূষিমাল দোকানটা পেরোলে একটা ছোটো আমবাগান পড়ে। কীসব কোর্টকেস চলছে জায়গাটা নিয়ে, তাই পড়ে থেকে থেকে প্রায় জঙ্গল হয়ে গেছে বাগানটা। এদিকে কেউ আসে না তেমন। বাগানের ভেতরের ডোবাটার পাশে বসে মাছ-সবজি ইত্যাদি সরিয়ে ব্যাগের একদম নীচ থেকে নতুন কেনা স্যান্ডো গেঞ্জিটা বের করল প্রাণহরি। এমনিতেই এতক্ষণে মাছের রক্ত আর শাকপাতার রস লেগে নানারকম ছোপ তৈরি হয়েছে, তবে এর আরেকটু পরিচর্যা দরকার। ডোবার পাশে ধুলোকাদার মধ্যে গেঞ্জিটাকে ফেলে পা দিয়ে ডলতে ডলতে একটা হিংস্র হাসি ফুটে উঠতে থাকল প্রাণহরির মুখে। আচ্ছা, নিলুকে নিয়ে এমন একটা গল্প ফাঁদলে কেমন হয়? এইভাবে দুমড়ে মুচড়ে যাবে ওর শরীরটা! ওই নিলু, হরেনদা, মায় চা দোকানি শিবু… এই যে ওকে নিয়ে ঠাট্টা করার সাহস দেখায়, ওরা কেউ জানে তার ক্ষমতা ঠিক কদ্দূর? আসলে সে কে?
না না, ওরা জানে না। ওরা জানে না যে আসলে সে একজন প্রফেশনাল কিলার। সাদা বাংলায় যাকে বলে পেশাদার খুনী।
গেঞ্জিটাকে ছেড়ে এবার ভাঙা ঘাটে বসে একটা বিড়ি ধরালো প্রাণহরি। একটা ঠান্ডা ভাপ উঠে আসছে ডোবা থেকে, জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীরটা। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে একটা তৃপ্তির হাসি হাসল। নাহ, দুনিয়ার কোনো পুলিশের ক্ষমতা নেই তাকে ধরার। কারণ আর পাঁচটা সাধারণ খুনীর মতো ছুরি-বন্দুক চালিয়ে কিংবা বিষ দিয়ে খুন করে না সে।
সে খুন করে স্বপ্ন দিয়ে।
প্রথম বার ব্যাপারটা অবশ্য একটা বিভীষিকা ছিল তার কাছে। কলেজের ফাইনাল পরীক্ষার আগের রাত ছিল সেটা। প্রায় দুটো অব্দি নোটস মুখস্ত করতে করতে কখন যেন চোখ লেগে এসেছিল। বই-খাতার ওপর মাথা রেখে যখন গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে, তখনই জলের ভিতর দিয়ে আবছা আলো আসার মতো করে তার সামনে ভেসে উঠল দৃশ্যটা। প্রতিদিনের মতো দুপুরবেলা সবার খাওয়া সারা হলে এক কাঁড়ি বাসনপত্র কাঁখে পুকুরঘাটে যাচ্ছে মা। লাল শানবাঁধানো ঘাট, তার গায়ের সরু সরু ফাটলের মধ্যে মাকড়শার রোমশ দাঁড়ার মতো শুয়ে আছে কালচে সবুজ শ্যাওলা। পড়ন্ত দুপুরের নরম আলো যেন তেলসিঁদুরের মতো লেগে আছে ঘাটের ধাপে ধাপে। বাসন ভরতি ভারী গামলাটা নিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে মা, প্রথম ধাপে পা রাখতেই হড়কে গেল শরীরটা! বিশাল এক চিৎকার আর বাসনের ঝনঝনানির মধ্যেও ওই শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিল প্রাণহরি। মাটির খুরি পায়ের চাপে ভেঙে গেলে যেমন মট্ করে শব্দ হয়, ঠিক তেমন। ঘাটের ওপর মায়ের মাথাটা থেঁতলে গিয়ে রক্ত-ঘিলু মাখামাখি হয়ে গেছিল একেবারে। আতঙ্কে ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছিল। স্বপ্ন এত জীবন্ত হয়! ভোরে মা পুকুরে স্নান সারতে যাওয়ার জন্য বেরোতেই পা জড়িয়ে ধরেছিল মায়ের, মাথায় হাত রেখে শপথ করিয়ে নিয়েছিল যেন আজ কোনোভাবেই পুকুরঘাটে না যায়। সেদিন পরীক্ষা হলে গিয়ে এক লাইনও লিখতে পারেনি প্রাণহরি। সাদা খাতা জমা দিয়ে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে বাড়ি ফিরেছিল দুপুরের খাওয়ারের আগেই। মা অবশ্য কথা রেখেছিল, খোকার আব্দারে সেদিন পুকুরঘাট মাড়ায়নি। কিন্তু নিয়তি খন্ডাবে কে! সন্ধে পেরিয়ে রাত নামল। দাওয়ায় বসে ভাতে গরম ডাল মাখতে মাখতে যখন স্বপ্নটার কথা ভেবে মনে মনে হাসছে, ঠিক সেই সময় উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘর থেকে মাছ ভাজা আনতে গিয়ে পা পিছলে ছিটকে পড়ল মা। তারপর সেই একই শব্দ। মট্।
বিড়িতে জোরে জোরে টান দিল প্রাণহরি। সে রাতে সেই স্বপ্নটা না দেখলে কি আজও বেঁচে থাকত মা? নাকি এই সব কিছুই নিয়তির লিখন, শুধুমাত্র যার পূর্বাভাষ পায় সে? মা মারা যাওয়ার পর ঘরবন্দি হয়ে থাকার দিনগুলোতে আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারত না। মনে হত পৃথিবীর সমস্ত আয়নার ভেতর থেকে খলখল করে হাসছে মা। “আমাকে মেরে ফেল্লি খোকা?” ধীরে ধীরে আয়না ছেড়ে ঘরের প্রত্যেকটা দেওয়ালেও হানা দিতে লাগল মা। ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছিল প্রাণহরি, রাতের পর রাত কাটছিল অনিদ্রায়। তারপর যখন একদিন বিছানার চাদর পাকিয়ে পাকিয়ে সিলিং থেকে ঝোলার ব্যবস্থা প্রায় করেই ফেলেছে, সেই রাতেই যেন আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে বন্যা আসার মতো করে ঘুম নেমে এল তার চোখে। আবার একটা স্বপ্ন দেখল, মৃত্যুর স্বপ্ন। কে জানে কে ছিল সেই লোকটা! কিন্তু তার মৃত্যুটাও নিপুণ তুলি দিয়ে আঁকা হয়ে গেল চোখের পাতায়। পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে প্রায় ওই ধরনেরই একটা মৃত্যু নিশ্চয়ই টেনে নিয়েছিল লোকটাকে! তবে প্রাণহরির লাভ হল এই যে, পরের দিন থেকে অপরাধবোধটা যেন ফুড়ুৎ করে গায়েব হয়ে গেল, সেই সঙ্গে মা-ও।
আলতো করে জলে পা ডুবালো প্রাণহরি। এ ডোবায় প্রচুর মাছ আছে। জলে পা ডুবিয়ে রাখলে মাঝে মাঝে এসে ঠোক্কর দিয়ে যায়, অথচ দেখা যায় না ওদের। এই আড়ালে থেকে কাজ করে যাওয়ার একটা আলাদা মজা আছে। এই যেমন গতকাল সে মাটি কোপানোর নাম করে অরুণ বিশ্বাসের ঘরে চক্কর মেরে এল, কিছু বুঝতেও পারল না ওর বউ। আর তারপর আজ সকালেই যা ঘটার ঘটে গেল। “চক্কর মারা” ব্যাপারটা খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ ওর ব্যবসায়। আরে যদি টার্গেটকে কেমন দেখতে, লাইফস্টাইল কেমন, পয়সাওলা মাল নাকি ভিখিরি, মেয়েমানুষের লোভ আছে নাকি একদম সত্যবান… এ সবই না জানল তবে তাকে নিয়ে স্বপ্নটা দেখবে কী করে? তাই সুপারি পেলে প্রথমে টার্গেটের ব্যাপারে যতটা সম্ভব খোঁজখবর নিয়ে, দরকার হলে তার বাড়িতে ঢুকে পড়ে পুরো ব্যাপারটা ভালো করে বুঝে নেয় সে। তারপর ঘরে ফিরে একটা লম্বা ঘুম দেয়। সেই ঘুমের মধ্যেই ইচ্ছেমতো সাজিয়ে নেয় স্বপ্নকে, নিখুঁতভাবে ঘটায় কোনো অ্যাক্সিডেন্ট। পরদিন ঠিক সেই ঘটনাই ঘটে ওই মানুষটার সঙ্গে। অরুণ বিশ্বাসের যে থেঁতলে যাওয়া বডির কথা শুনে চোয়াল ঝুলে গেল হরেনদাদের, সেই সিন তো সে নিজে সেট করেছে স্বপ্নে! হ্যাঁ, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে বটে, কিন্তু কী আর করা যাবে… পার্টির অর্ডার তেমনই ছিল। ডার্কওয়েব চ্যাটে পার্টি পইপই করে বুঝিয়ে দিয়েছিল কতটা নৃশংস হতে হবে অরুণ বিশ্বাসের মৃত্যুটা। সে শুধু সেইমতো স্বপ্ন দেখেছে, ব্যাস! মা মরে যাওয়ার পর নিজেকে অনেক ঘষামাজা করে তবেই না এই জায়গায় পৌঁছতে পেরেছে! তবে তার এই বিশেষ ক্ষমতাটা নিয়ে ঠিক কী করবে সেটা বছর খানেক আগেও জানত না, যদ্দিন না ডার্ক ওয়েবে ঢোকার চাবিকাঠিটা এসেছে তার হাতে।
বাঁ হাতে গেঞ্জিটা টেনে নিয়ে পকেট থেকে একটা ভাঙা কাঁচির ফলা বার করল প্রাণহরি, তারপর এলোপাথাড়ি চালাতে লাগল গেঞ্জীটার ওপর। তাকে চাকরির খোঁটা দেয় হরেনদা! ডার্কওয়েবে ঠিক কতটা চাহিদা এই প্রাণহরি মন্ডলের সেটা জানা আছে তার? এতক্ষণে পার্টির পাঠানো পাঁচ লাখ টাকা ঢুকে গেছে তার অ্যাকাউন্টে, সেই সঙ্গে হয়তো নতুন পার্টির সুপারিও। আজ গেঞ্জিটা রেডি হলেই কাল আবার কোনো একটা ভেক ধরে বেরিয়ে পড়বে চক্কর মারতে, আর তারপর একটা লোকের জীবনমরণ নাচবে তার হাতে। হুঁহ্, তার চেয়ে শক্তিধর, ক্ষমতাশালী মানুষ আর কেউ আছে নাকি পৃথিবীতে?
ঠিক সেই সময়ে ডোবার জলে কাঁপন ধরিয়ে ঘাই মারল একটা মাছ আর হাত চালাতে চালাতে থেমে গেল প্রাণহরি। নিলু, হরেনদা, শিবু সব ছাপিয়ে চোখের সামনে ধীরে ধীরে ভেসে উঠল একটা কান্নাভেজা মুখ। বরের তুবড়ে যাওয়া গাড়ির পাশে আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে কাঁদছিল বিশ্বাসের বউ। বড়ো ভালো মেয়ে। খুব যত্ন করত স্বামীর, গতকাল সে নিজের চোখে দেখেছে। কী পরিপাটি করে জলখাবার বেড়ে দিল! বেরোনোর সময় হাতে হাতে এগিয়ে দিল পার্স, গাড়ির চাবি। দেখে খুব লোভ হচ্ছিল প্রাণহরির। তাকে যদি এমন করে যত্ন করত, ভালোবাসত কেউ! দিনের শেষে অপেক্ষা করত, দেরি হলে দুশ্চিন্তা করত, আর… আর ঠিক এইভাবে কাঁদত তার জন্য। প্রাণহরির বুকের ভেতরের দিঘিটায় যেন টুপ করে একটা ঢিল পড়ল আর সেই ঢেউ খেলে যাওয়া জলের অতল থেকে ডানা মেলল একজোড়া ঘন কালো চোখ। ভাঙা কাঁচিটা খসে পড়ল হাত থেকে। কতদিন! কতদিন দেখেনি তাকে! কোথায় আছে, কী করছে কে জানে! এতদিনে বিয়ে-টিয়ে হয়ে গিয়ে ঘর-সংসার করছে নিশ্চয়? জোরে জোরে শ্বাস টানল প্রাণহরি। এখনও বাতাসে খুঁজলে তার চুলের সেই ফুলেল তেলের গন্ধটা পায়। আজও চোখে ভাসে সেই আটপৌরে ছাপা শাড়ি, মোটা কালো ফ্রেমের চশমার পেছনে কাজলকালো দুই চোখ, গোলগাল মুখে পৃথিবীর সরলতম হাসি। নিলু আওয়াজ দিচ্ছিল না তার ভালোবাসা নিয়ে? সে কি আর বুঝবে কেন আজও ওই সাধাসিদে মেয়েটাকেই পছন্দ তার? কারণ ওর মধ্যে মাকে খুঁজে পেত প্রাণহরি। সেই দেওয়াল জুড়ে হাসতে থাকা ডাইনির মতো মা নয়, লাজুক চাপা স্বভাবের মাথায় ঘোমটা তোলা মা। সারাজীবন এরকম পুরোনোপন্থী হয়েই থেকে যাবে সে, তাতে কোনো আফশোষ নেই। আফশোষ শুধু একটা জায়গাতেই। যদি মিতালীকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো সত্যি করার ক্ষমতা থাকত ওর! শুধুমাত্র একটা রাতেই জীবনটা পালটে যেত। কিন্তু একমাত্র মানুষের মৃত্যু ছাড়া অন্য কোনোকিছুর স্বপ্ন যে সত্যি হয় না তার! প্রাণহরির চোখের কোণদুটো ভিজে উঠল ধীরে ধীরে। অবরুদ্ধ গলায় যেন কোনো এক অজানার উদ্দেশ্যে ডাক দিল, “মিতা?”
বহুদিনের দমচাপা হাহাকারের মতো সেই ডাক ছড়িয়ে যেতে লাগল মাঠ-ঘাট, নদী-পুকুর, খেত-খামার পেরিয়ে দূরদূরান্তে।
***
অমলবাবু যাকে বলে একদম নিরীহ ছাপোষা একজন মানুষ। রিটায়ার্ড স্কুলমাস্টার, স্ত্রী গত হয়েছেন বহু বছর হল। একমাত্র ছেলে বিদেশে সেট্লড। ভদ্রলোক সকাল-বিকেল হাঁটতে বেরোন, দুপুরে ভাতঘুম দেন আর সন্ধে থেকে বাংলা সিরিয়াল দেখেন। এরকম লোকেরও শত্রু থাকতে পারে! তাও যেমন-তেমন শত্রু নয়, কনট্রাক্ট কিলার দিয়ে খুন করানোর মতো শত্রু। চক্কর মারতে গিয়ে একটু খারাপই লেগেছিল প্রাণহরির। কিন্তু কাজের জায়গায় আবেগপ্রবণ হলে চলে না। তাই ভেবেচিন্তে বৃদ্ধের জন্য অপেক্ষাকৃত কম কষ্টদায়ক একটা মৃত্যু ভেবেছিল সে। রাতের খাবার খেয়ে শোবেন ভদ্রলোক, সকালে আর উঠবেন না। ঘুমের মধ্যে হার্টঅ্যাটাক আর কী! কিন্তু এর সঙ্গে একটা বাড়তি কাজও যোগ হয়েছে, যেটা একটু টেনশনে রেখেছে তাকে। মার্ডারটা যে সাকসেসফুল হয়েছে তার প্রমাণও এনে দিতে হবে পার্টিকে। সচরাচর একবার চক্কর মারা জায়গায় দ্বিতীয় বার যায় না প্রাণহরি, ফালতু রিস্ক বেড়ে যায়। কিন্তু কিছু কিছু কনট্র্যাক্টে, বিশেষ করে টার্গেট তেমন বিখ্যাত কেউ না হলে এই কাজটা করতে হয়। পটলার মুদি দোকানে দাঁড়িয়ে মাসকাবারি ভূষিমাল তুলতে তুলতে সেই প্ল্যানটাই ছকছিল প্রাণহরি। গত রাতেই স্বপ্নটা দেখেছে, তার মানে আজকের রাত আর কাটবে না অমলবাবুর। আগামীকাল কুলতলিতে ঠিক কী ভেক ধরে গিয়ে খবরটা নিয়ে আসা যায় সেটা ভাবতে ভাবতেই অন্যমনস্ক পায়ে এগোচ্ছিল, হঠাৎ প্রবল এক ধাক্কা খেয়ে পড়তে পড়তেও টাল সামলে নিল কোনোভাবে।
“উফ!” একটা চাপা মেয়েলি চিৎকারে থতমত খেয়ে সামনের দিকে তাকালো প্রাণহরি, আর সঙ্গে সঙ্গেই যেন জমে গেল পাথরের মতো।
হঠাৎ যেন কমে গেল দুনিয়া শুদ্ধ লোকের তাড়া, বাতাসে ধুলোধোঁয়া, পটলার গজগজানি। তার বদলে ভেসে আসতে লাগল জুঁই ফুলের সুবাস আর “বড়ে আচ্ছে লাগতে হ্যায়” এর মায়াবী সুর, স্লো-মোশানে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে রাগী চোখ তুলে তার দিকে তাকাল… মিতা! না, মিতা তো নয়, কিন্তু… মিতার মতোই… এ কে? তবে কি তার স্বপ্ন…
বিরক্ত মুখে কী যেন বলে আবার মাথা নীচু করে লাল-নীল রংবেরঙের ফুল কুড়োতে শুরু করল মেয়েটা। আহা, কী সুন্দর ভঙ্গিমা! এক মিনিট, এ তো ফুল নয়…
হঠাৎ শোঁওও করে যেন ছেঁড়া ঘুড়ির মতো লাট খেয়ে মাটিতে নেমে এল প্রাণহরি। কোমরে আঁচল গুঁজে মাটি থেকে কিছু সুতোর রিল, উলের গোলা কুড়োচ্ছে একটা মেয়ে। এল খোঁপার পাশ দিয়ে গালের ওপর নেমে এসেছে কয়েক কুচি চুল, মোটা চশমার পেছনে নত হয়ে আছে বড়ো বড়ো পাতাওলা দুই আয়ত চোখ। প্রাণহরির গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছিল। মেয়েটা একটা ছোটো কার্ডবোর্ডের বাক্সে সেগুলোকে ভরে আরেকবার প্রাণহরির দিকে কটমট করে তাকিয়ে হাঁটা দিল রাস্তার দিকে, আর সঙ্গে সঙ্গে খিক খিক করে হেসে উঠল পটলা। “কী বে, ব্যোমকে গেলি নাকি?”
“ইয়ে, না… মানে… ” অপ্রস্তুত হয়ে ঘাড় চুলকোল প্রাণহরি। “আগে পাড়ায় কখনও দেখিনি তো! কে ইনি?”
“বাহিরদিঘির দিকে কোনো একটা ইস্কুলের নতুন সেলাই দিদিমণি। ওখানে ঘরভাড়া পায়নি, তাই গেল হপ্তায় বাগবাবুর ঘরের একতলাটায় ভাড়া এয়েচে। এই তো, ভাইফোঁটার পরেই স্কুল খুলবে। নতুন জায়গা তো, তাই ক-দিন আগেই চলে এয়েচে ঘরদোর গুছাতে। এখানে ভাড়া ঘরেও নাকি একটা সেলাই ইস্কুল খুলবে।”
পাশের দোকান থেকে পান চিবুতে চিবুতে মাথা বাড়াল নাড়ু, “হুঁ, আমার থেকে তো ছুঁচ-সুতো, উল, থান কাপড় সব নিয়ে গেল। ভালোই হয়েছে। মেয়েটাকে দিদিমণির ইস্কুলে ভরতি করে দেব। মেয়েমানুষের একটু সেলাইফোঁড়াই শিখে রাখা ভালো।”
আস্তে আস্তে আবছা হয়ে আসছিস ওদের কথাবার্তা। প্রাণহরি নিজেই বুঝতে পারল না কখন তার পা দুটো রিমোট কন্ট্রোলে চলা খেলনা গাড়ির মতো ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায় উড়তে থাকা হলদে আঁচলের দিকে। তেঁতুলমুড়ির আকাশে-বাতাসে হঠাৎ যেন ছড়িয়ে পড়েছে গুঁড়ো গুঁড়ো অভ্র মাখা আলো, অসময়ের দখিনা বাতাস জুড়িয়ে দিচ্ছে শরীর। আহা, এমন দিন কেন আগে আসেনি! প্রাণহরি দেখতে পাচ্ছিল তার জীবনের আলোমাখা পথটুকু ধরে এগিয়ে চলেছে সেই মেয়ে। কাঁখে কলসি নেওয়ার মতো করে বাম হাতে ধরে আছে কার্ডবোর্ডের বাক্সটা, ডান হাত থেকে ঝুলছে সুদৃশ্য কাজ করা একটা কাপড়ের ব্যাগ। ওই হলদে-কালো ডোরাকাটা সুতির শাড়ি, ছোটো কলার ওঠা পিঠ ঢাকা ব্লাউজ, হাতের দু-গাছা চুড়ি যেন এক ধাক্কায় তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বছর কুড়ি আগের প্রথম যৌবনে। আজ বহুদিন পরে যেন এক অজানা তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে তার।
পোস্টাপিস মোড় পেরিয়ে হঠাৎ থামল মেয়েটা। থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রাণহরিও। হাত থেকে ব্যাগ নামিয়ে আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছল মেয়েটা, আঙুলগুলো মুঠো করল। ইসস, ব্যাগটা বোধহয় খুব ভারী! এগিয়ে দিয়ে আসবে নাকি? কিন্তু যদি আবার হ্যাংলা ভাবে! মুখোমুখি হওয়ার কথা ভেবে হাত-পা কেমন পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল তার। কী করবে না করবে ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ খেয়াল করল সামনে নেই মেয়েটা! বুকের ভেতরের ধুপধুপানিটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল প্রাণহরি। এখানে এসে রাস্তাটা দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। পড়িমরি করে ডান দিকের গলিটায় ঢুকতেই অবশ্য ফের দেখা গেল হলদে শাড়ির আভাস, বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে ততক্ষণে। ধীরে ধীরে একটা গোলাপি রঙের দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সেই মেয়ে। হাত থেকে ব্যাগ নামিয়ে রেখে গ্রিলগেট খুলে ঢুকে গেল ভেতরে। বাড়িটার সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে আড়চোখে তাকাল প্রাণহরি। একতলার গ্রিলে ঢাকা বারান্দায় পেরেক ঠুকে ঠুকে একটা অ্যালুমিনিয়ামের সাইনবোর্ড বসাচ্ছে একটা লোক, আর হাত নেড়ে নেড়ে তাকে নির্দেশ দিচ্ছে মেয়েটা।
সাইনবোর্ডে মোটা মোটা কালো অক্ষরে লেখা আছে, “স্বপ্না স্টিচিং অ্যান্ড নিটিং সেন্টার। এখানে যত্ন সহকারে বিভিন্ন ধরনের সেলাই, উল বোনা, ক্রুশের কাজ ও কাপড় কাটিং শেখানো হয়। প্রযত্নে: স্বপ্না বোস।”
***
“না না, হল না। এই দেখো, এক ঘর সোজা… এক ঘর উলটো… ”
সকালের ঝকঝকে সোনালি রোদে ধুয়ে যাচ্ছে ছোট্ট বারান্দাটা। এ রোদের গায়ে কেমন একটা রোব্বার রোব্বার গন্ধ আছে। এক ঝাঁক কচিকাঁচা দু-হাতে উলকাঁটা আর রংবেরঙের উলের গোলা ছড়িয়ে থেবড়ে বসেছিল মাদুরের ওপর। তাদের মাঝখানে ঘুরে ঘুরে দেখছিল স্বপ্না। আজ একটা আকাশি-নীল তাঁত পরেছে সে। কোমর অব্দি ঢেউখেলানো চুল মখমলি চাদরের মতো ছড়িয়ে আছে পিঠের ওপর, সদ্য ফোটা ফুলের মতো স্নিগ্ধ মুখটায় আলগা লেগে আছে ঘুমের আবেশ। কয়েকঘর উল বুনে সেটা এক ছাত্রীর হাতে দিল, তারপর দু-হাত তুলে আলগোছে একটা হাতখোঁপা বাঁধতে শুরু করল। গেটের কাছে বোগেনভেলিয়ার ঝাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ঘেমে উঠল প্রাণহরি। আকাশি শাড়ির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে গাঢ় নেভি-ব্লু ব্লাউজের আবরণে ঢাকা সুডৌল স্তন আর তার নীচেই মাখন রঙের অনাবৃত পেট ও কোমর। ঠোঁট কামড়ে ধরে প্রাণপনে নিজের শরীরের শিরশিরানিটাকে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগল। আজ দিন দশেক হল এক মারাত্মক অস্থিরতা যেন কোনো পালোয়ানের মতো তাকে মাটিতে পেড়ে ফেলে বুকের ওপর চেপে বসে আছে। সেই প্রবল ফাঁসের নীচে ছটফট করতে করতে প্রায় বিদায় নিতে বসেছে নাওয়া-খাওয়া-ঘুম। এক প্রবল কালবৈশাখীর মতো এসে তার নিশ্চিন্ত নিস্তরঙ্গ জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছে ওই মেয়ে। এই ক-দিনে অনেক খোঁজখবর করেছে প্রাণহরি। এখানে একাই থাকে মেয়েটা। শরীরে শাঁখা-সিঁদুরের চিহ্ন নেই, অতএব ধরে নেওয়া যায় হয় অবিবাহিত, নয় বিধবা। বিধবা হলেও আপত্তি নেই তার, বিদ্যাসাগর তো কবেই বিধবাবিবাহ চালু করে দিয়ে গেছেন! কিন্তু বিয়ে তো পরের কথা, আগে আলাপ জমাবে কীভাবে তাই-ই খুঁজে পাচ্ছে না। স্বপ্না রোজ সকালে সাড়ে আটটা নাগাদ বেরিয়ে ট্রেকারে আন্দুল যায়, ন-টা পনেরোর লোকাল ধরে। সাঁকরাইল থেকে ভেতরদিকে আলমপুর, বাহিরদিঘি, ঘোষপাড়া এই গ্রামগুলো পড়ে, খুবই ছোটো ছোটো কিছু গ্রাম। তার মধ্যেই কোনো একটায় পড়াতে যায়। এই ক-দিন রোজই তার পিছু পিছু আন্দুল অব্দি গেছে প্রাণহরি, তারপর ফিরে এসেছে। একেবারে স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে গেলে যদি বুঝতে পেরে যায়! আবার বিকেলে চারটে পঁচিশের লোকালে ফিরে আসে স্বপ্না। আগেভাগে আন্দুলে পৌঁছে অপেক্ষা করে সে, তারপর ও এলে আবার তেঁতুলমুড়ি ফিরে আসে একই ট্রেকারে চড়েই। এইই এখন তার রোজকার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ছুটির দিনগুলোতেও যেভাবে বাগবাবুর বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি শুরু করেছে, তাতে যে কোনো দিন যে একটা কেলেঙ্কারি ঘটতে পারে সেটা ভালোই জানে প্রাণহরি। কিন্তু কী করবে! ওকে একটা দিন না দেখলে যেন বুকের ভেতরটা ফুটিফাটা হয়ে যায়, তেতো লাগে বেঁচে থাকাটা। তাই সব কিছু ভুলে তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো বারবার ফিরে আসে তার দরজায়। মুশকিল হল, এত ঘোরাঘুরি সত্ত্বেও আজ অব্দি একবারও কথা বলে উঠতে পারেনি! স্বপ্নাও কেমন যেন তাকে দেখেও দেখে না…
“কিছু বলবেন?” একটা মিষ্টি ডাকে চমকে তাকায় প্রাণহরি। কখন যেন ছুটি হয়ে গেছে সেলাই ইস্কুলে, চলে গেছে মেয়েরা। আর গায়ে আঁচল জড়িয়ে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্না, দৃষ্টি সোজা তারই দিকে! প্রাণহরির পেটের মধ্যে হঠাৎ এক ঝাঁক পায়রা ডানা ঝটপটিয়ে উঠল প্রবল শব্দে। গলাটা শুকিয়ে গিয়ে আওয়াজ বেরোনোও যেন কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনোমতে তোতলানো স্বরে বলল, “আ-আমি? ইয়ে… না… মানে… ওই একটু… ”
“ভেতরে এসে বসুন।” কথা শেষ করতে না দিয়ে গেটটা খুলে দিয়েই পেছন ফিরে হাঁটা দিল স্বপ্না। প্রাণহরিও থতমত খেয়ে এগিয়ে গেল তার পিছু পিছু। বারান্দার একপাশে দাঁড় করিয়ে রাখা ফোল্ডিং চেয়ারটা পেতে দিয়ে নিজে বসল ছোটো মোড়াটায়, তারপর প্রাণহরির চোখে চোখ রেখে বলল, “বসুন।”
জড়োসড়ো ভঙ্গিতে বসল প্রাণহরি।
“বলুন, কী বলছিলেন।”
বলবে? কী বলবে প্রাণহরি? কীভাবে বলতে হয় তাইই তো জানে না, অথচ মনে হয় কত কী যে বলার আছে ওকে! আপাতত একটা ঢোক গিলে বাজার ব্যাগটার ভেতর হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল একটা পুরোনো শার্ট। পিন্টুর মা তার পুরোনো জামাকাপড়গুলোকে ডাঁই করে রেখেছিল বিক্রি করবে বলে, সেখান থেকেই বেছেবুছে একটা শার্ট বের করেছে আজ সকালে। কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা স্বপ্নার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা… ”
ভ্রু কুঁচকে শার্টটার দিকে তাকালো স্বপ্না। তারপর হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলে উঠল, “আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন। এটা সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, টেলারিং শপ নয় যে আপনি ছেঁড়া জামা রিফু করাতে নিয়ে আসবেন।”
ফুস করে বুকের ভেতর বেলুনের চুপসে যাওয়ার শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পেল প্রাণহরি। শার্টটার ডান বগলের কাছে অনেকটা সেলাই খুলে গেছে দেখে ভেবেছিল এটা নিয়ে গিয়ে যদি কথাবার্তা শুরু করা যায়, কিন্তু সে আশাতেও জল পড়ল। ইসস, ওকে মাথামোটা ভাবল নাকি! এবার কী করবে! মাথা নীচু করে পায়ের নখগুলো মন দিয়ে দেখতে দেখতে বুঝতে পারল, উঠে পড়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আপাতত। তার ভাবভঙ্গি দেখে স্বপ্না কী ভাবল কে জানে, হঠাৎ নীচু গলায় বলে উঠল, “এ তো খুব সামান্য কাজ, ঘরেই সেলাই করে নেওয়া যায়। শুধু শুধু টেলারিংএ যাওয়ার দরকার কী!”
“ঘরে তেমন কেউ নেই।” এই প্রথমবার সাহস করে একটা পুরো লাইন বলতে পারল প্রাণহরি।
জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকাল স্বপ্না। এবার একটু গলা ঝেড়ে থেমে থেমে প্রাণহরি বলল, “আমি একাই থাকি, পরিবার বলতে তেমন কেউ নেই। আর সেলাইটা আমি ঠিক পারিনা।”
কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকল স্বপ্না। তারপর হঠাৎ ওর হাত থেকে শার্টটা নিয়ে উঠে ভেতরে চলে গেল। শার্টটা নেওয়ার সময় সামান্য আঙুলের ছোঁয়া লেগে গেল তার আঙুলে, আর ওমনি প্রাণহরির পেটের ভেতর আবার ঝটাপটি লাগিয়ে দিল পায়রারা। কিছু খুটখুট শব্দ, মিনিটখানেকের মধ্যে শার্ট হাতে ফিরে এল স্বপ্না। ওর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নিন।”
সেদিন কোনোমতে একটা শুকনো হাসি উপহার দিয়ে একরকম পালিয়েই এসেছিল প্রাণহরি। প্রেস্টিজ বলে আর কিছু থাকল না! ছিঃ ছিঃ! কী ভাবল স্বপ্না? এরপরে কোনোদিন আর ওর সামনে দাঁড়াতে পারবে? আজকের এই ঘটনার ড্যামেজ কন্ট্রোল করবে কীভাবে? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে গোটা দিনটা কেটে গেল। অবশ্য পরের দিন সকালের আলো ফুটতেই তৈরি হয়ে ফের ট্রেকার স্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে দাঁড়াল প্রাণহরি। মুখোমুখি না হতে পারুক, অন্তত আড়াল থেকে তাকে দেখার সুযোগটুকু তো ছাড়া যায় না! ওই আড়ালটুকুই নাহয় তার থাক। স্বপ্নার বারান্দায় কাটানো সেই কয়েকটা মিনিট আর প্রথমবার পাওয়া তার আঙুলের স্পর্শ… এই নিয়েই না হয় কাটিয়ে দেবে বাকি জীবনটা।
তবে সকালবেলার এই হতাশা সন্ধের মধ্যে পালটে গিয়ে যে আরও একবার কাছাকাছি এনে দেবে তাদের, এমনটা বোধহয় তার চিন্তাভাবনার বাইরেই ছিল। সেদিন ফিরতে একটু দেরিই হয়েছিল স্বপ্নার। চারটে পঁচিশের লোকাল চলে গেল, তারপর পাঁচটা দশেরটাও। টিকিট কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে অস্থিরভাবে একের পর এক সিগারেট টানছিল প্রাণহরি। কালীপুজোর পর থেকেই বেলা ছোটো হতে শুরু করেছে, সন্ধের দিকটায় পাতলা সরের মতো কুয়াশা ভাসে মাঠের ওপরে। ছ-টার ট্রেন অফিস ফেরত ভিড়ের শেষ কিস্তিটা নামিয়ে দিয়ে চলে যেতেই হঠাৎ শুনশান হয়ে গেল প্ল্যাটফর্ম। ততক্ষণে ভনভন করতে থাকা মশার পালের মতোই দুশ্চিন্তা ছেঁকে ধরছে তাকে। এতো দেরি তো হয় না! ধীরে ধীরে আলো জ্বলে উঠতে শুরু করল স্টেশন চত্ত্বর জুড়ে। বারবার হাতঘড়ি দেখতে দেখতে যখন নানারকম আশঙ্কা মনে জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে, তখন পৌনে সাতটার ট্রেন ঢুকল স্টেশনে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল প্রাণহরি। ওইতো আসছে! হালকা গোলাপি শাড়ির ওপর একটা পাতলা লাল শাল জড়িয়ে ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে আসছে স্বপ্না। আজ স্কুলে বোধহয় কোনো এক্সট্রা কাজ ছিল। ট্রেকারের মাঝখানের সিটে গিয়ে বসতেই সবার শেষে একদম পেছনের দিকটায় উঠে পড়ল প্রাণহরি। স্বপ্না কি খেয়াল করেছে তাকে? কে জানে! ফোনে টুং করে একটা মেসেজ ঢুকল। পার্টির মেসেজ। মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে উঠল প্রাণহরির। উফফ, একটু শান্তিও কি তার কপালে নেই! ক-দিন ধরে যে ঘুমোতেই পারছে না, সেকথা পার্টিকে বোঝাবে কে? এদিকে গতকাল এমন বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটালো যে স্বপ্নাকে পাওয়ার আশা প্রায় ত্যাগই করতে হয়েছে, তার ওপর এই একের পর এক অর্ডার। এখন যদি বা কখনও দু-চোখের পাতা এক করে, সবসময় বুক থেকে সোজা মাথার ভেতর ভুস করে ঘাই মারে স্বপ্নার মুখ। কালকের পর থেকে আরও বেড়েছে ব্যাপারটা। এরকম চললে তো লাটে উঠবে তার ব্যাবসা! তেঁতুলমুড়ি নেমে অভ্যেস মতো স্বপ্নার থেকে প্রায় হাত তিরিশেক দূরত্ব রেখে হাঁটতে হাঁটতে এলোমেলো চিন্তা করছিল প্রাণহরি। স্ট্যান্ড থেকে পোস্টাপিস মোড়ের দিকে যাওয়ার রাস্তায় পুরোনো বুড়োশিবের মন্দির পড়ে। ক-দিন হল এখানে লাইটপোস্টটা খারাপ হয়েছে, তাই অন্ধকারে ডুবে থাকে রাস্তাটা। মন্দিরের টিমটিমে আলোতে সে অন্ধকার কাটে না। একটা ছোটো টর্চ জ্বেলে হাঁটছিল স্বপ্না, মন্দিরটা পেরোনো মাত্র হঠাৎ চাপ চাপ অন্ধকারের মধ্যে যেন প্রায় মাটি ফুঁড়ে এগিয়ে এল দুই মূর্তি। খানিক দূর থেকে প্রাণহরি দেখল চাপা গলায় স্বপ্নাকে কী যেন বলতে বলতে একজন চেপে ধরল তার মুখ, অন্যজন হাত দুটোকে পেঁচিয়ে ধরল পেছন থেকে! একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল স্বপ্না। হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠে ততক্ষণে দৌড়তে শুরু করেছে প্রাণহরি। নির্মমভাবে টেনেহিঁচড়ে স্বপ্নাকে পাশের বাঁশ বাগানের দিকটায় নিয়ে যাচ্ছিল গুণ্ডাদুটো, এমন সময় একটা আধলা ইট সজোরে আছড়ে পড়ল একজনের কাঁধে! যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল সে। অন্যজন ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড এক রডের বাড়ি পড়ল কোমরে! স্বপ্নাকে ছেড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সেও। “আপনি আমার পেছনে আসুন” বলতে বলতে রডটা মাথার ওপর তুলে প্রবল আক্রোশে তেড়ে গেল প্রাণহরি! তার সেই ভয়ংকর রূপ দেখে খোঁড়াতে খোঁড়াতে উলটোদিকের মাঠে নেমে দৌড় মারল দুই মূর্তিমান, মুহূর্তের মধ্যে আবার মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
রডটা ফেলে দিয়ে এগিয়ে যেতেই অচেতন হয়ে ওর হাতের ওপর ঢলে পড়ল স্বপ্না। দু-হাতে তাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে প্রাণহরির সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছিল। ন্যাপথালিন, পাউডার আর ঘাম মাখা একটা তীব্র মেয়েলি গন্ধ ভেসে আসছে স্বপ্নার নরম লতানে শরীর থেকে। ধরে ধরে শিবমন্দিরের দাওয়ায় এনে থামের গায়ে হেলান দিয়ে বসালো ওকে। লাল শালটা কাঁধ থেকে খসে পড়ায় আলুথালু হয়ে গেছিল আঁচল, তাই মন্দিরের কম পাওয়ারের বাল্বের আলোতেও চকচক করছিল ঈষৎ ঘামে ভেজা বুকের ভাঁজ। নিজেকে ভীষণ এক ধমক দিল প্রাণহরি। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে গায়ে শালটা জড়িয়ে দিল, তারপর পাশের টিউবওয়েল থেকে জল এনে ছিটিয়ে দিল চোখেমুখে। কয়েক সেকেন্ড পরে স্বপ্নার জ্ঞান ফিরল। চোখ মেলে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে প্রচণ্ড আতঙ্কে সিঁটিয়ে গেল মেয়েটা। প্রাণহরি অভয় দিয়ে বলল, “ভয় নেই, ওরা পালিয়ে গেছে। এখন শরীর ঠিক লাগছে আপনার?”
“জল,” আড়ষ্ট গলায় কোনোমতে বলল স্বপ্না।
টিউবওয়েল থেকে স্বপ্নার বোতলে জল ভরে আনতে আনতে চিন্তিত গলায় প্রাণহরি বলল, “তেঁতুলমুড়িতে তো আগে এসব ছিল না! এখানে সন্ধের পরেও মেয়েরা নিশ্চিন্তে চলাফেরা করে। কোথা থেকে আসছে এইসব লোক!”
“ওরা আমার জন্যই এসেছিল,” ঢকঢক করে জল খেয়ে আঁচলে মুখ মুছল স্বপ্না।
“মানে!”
“সে অনেক কথা।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্বপ্না। বাল্বের ক্ষয়াটে আলোয় জল চিকচিক করছিল তার চোখের কোণে। “নিজের জীবনের অন্ধকারকে আর কেই বা বাক্স খুলে বের করতে চায় বলুন? তবে আজ আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন আপনি, আপনার অধিকার আছে জানার।”
নিশ্বাস চেপে অপেক্ষা করছিল প্রাণহরি। একটু থেমে যেন নিজেকে গুছিয়ে নিল স্বপ্না, তারপর বলতে শুরু করল। “আমার বিয়েটা হয়েছিল সম্বন্ধ করেই। বড়ো ব্যবসায়ী ফ্যমিলি, কলকাতায় বিরাট বাড়ি-গাড়ি। স্বভাবতই আমার মধ্যবিত্ত বাবা এতবড়ো সুযোগটা ছাড়ল না। আমার গ্র্যাজুয়েশনের পর চাকরি করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু বাবা বোঝালো চাকরি তো আমি বিয়ের পরেও করতে পারি! খুবই উদার মানসিকতার পরিবার, কোনো অসুবিধে হবে না। রাজি হয়ে গেলাম। সেটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল।”
দূরে কোথায় একটা রাতচরা পাখি কুপ কুপ করে ডেকে উঠল। ঠোঁট কামড়ে ধরল স্বপ্না। “প্রথম প্রথম সব কিছু ঠিকই ছিল, জানেন! মাসখানেক যেতেই বেরিয়ে পড়ল ওর আসল রূপ। শুরু হল প্রতিদিনের অত্যাচার। বিকৃত মানসিকতার লোক একটা! রোজ রোজ নোংরা নোংরা পোশাক পরে আসতে হবে ওর সামনে, আর তারপর… চাবুক, সিগারেটের ছ্যাঁকা… কিছুই বাদ দেয়নি… ” বলতে বলতে দু-হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল হাউ হাউ করে। প্রাণহরির বুকের ভেতরটায় তোলপাড় চলছিল। অবরুদ্ধ গলায় স্বপ্না বলতে থাকল, “দিনের পর দিন মুখ বুজে সহ্য করেছি জানোয়ারটাকে আর তলে তলে একটা চাকরি জোটানোর চেষ্টা করে গেছি। তারপর একদিন স্কুলে প্যারা-টিচারের চাকরি পেলাম, বেরিয়ে এলাম ওই বাড়ি ছেড়ে। থানায় গিয়ে বধূ নির্যাতনের ডায়েরি করেছিলাম। পুলিশ তুলে নিয়ে গেছিল জানোয়ারটাকে। প্রায় বছরখানেক জেলে ছিল বোধহয়। ততদিনে আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। বাপের বাড়ির দিক থেকে কোনোদিনই সাপোর্ট পাইনি, শ্বশুরবাড়ি ছাড়ার পর থেকেই স্কুলের কাছে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতাম। কিন্তু ও জেল থেকে বেরোনোর পরই নতুন করে নরক নেমে এল আমার জীবনে। গুণ্ডা পাঠিয়ে বাড়িতে হামলা, যখন তখন রেপ করার চেষ্টা, এমনকি একবার তো অ্যাসিডও ছুড়েছিল… সেবার বেঁচে গেছিলাম কোনোমতে।”
উন্মত্ত রাগে প্রাণহরির মাথায় যেন আগ্নেয়গিরি ফাটছিল। কে এই লোকটা? নাম ঠিকানা পেলে এক রাতের মধ্যে শেষ করে দিতে পারে কুকুরটাকে! স্বপ্নাকে অত্যাচার করেছে যে হাতে, সেই হাত ভেঙে মুচড়ে দিতে পারে। শুনতে পেল বিড়বিড় করে স্বপ্না বলে চলেছে, “সবই কপাল! কত চেষ্টা করে এই গ্রামের স্কুলে ট্রান্সফার নিলাম। ভাবলাম আমার খোঁজ পাবে না, কোথায় কী! ঠিক পৌঁছে গেছে গন্ধ শুঁকে শুঁকে। একা মেয়েকে কেউ ঘরভাড়া দিতে চায় না, হয়তো এইসব জানাজানি হলে এবার বাগবাবুও বাড়ি ছেড়ে দিতে বলবেন… ” বলতে বলতে প্রাণহরির মুখের দিকে ম্লান চোখে তাকালো। “মাঝে মাঝে মনে হয় নিজেকে শেষ করে দি। অমন কুকুর-শিয়ালের হাতে ছিঁড়েখুঁড়ে মরার চেয়ে সুইসাইড করাটা অনেক সম্মানের হবে। একটা একলা মেয়ে, যার পাশে কেউ নেই, তার বোধহয় বেঁচে থাকার অধিকারও নেই এই দুনিয়ায়।”
হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল প্রাণহরির। আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে বসল স্বপ্নার একদম কাছে। তারপর কাঁপাকাঁপা হাতটা স্বপ্নার হাতের ওপরে রেখে ফিসফিসিয়ে বলল, “একদম ওই কথা মুখেও আনবেন না, কথা দিন। আমি আছি তো! আমি থাকব। সবসময়।”
সজল চোখ মেলে তার দিকে তাকালো স্বপ্না। আধভাঙা চাঁদের আলো পাতলা কুয়াশা মেখে মসলিন চাদরের মতো নেমে আসতে থাকল তাদের ওপর।
***
বিরাট সিমেন্টের খাঁচার মতো ছ-তলা বাড়িটার নীচে স্কুটি পার্ক করল রাকিবুল। চারটে দশ বাজে, অদিতি কি এসে গেছে? এই আন্ডার কনস্ট্রাকশন বিল্ডিংটা তাদের রোজকার দেখা করার জায়গা। পাঁচটা থেকে আবার টিউশন পড়ানো থাকে তার, ওদিকে অদিতির কলেজের লাস্ট পিরিয়ড শেষ হয় চারটেয়। ফলে দুই বাড়ির লোকজন এবং পাড়াপ্রতিবেশীদের নজর এড়িয়ে এই একটা ঘণ্টা শুধুমাত্র তাদের নিজেদের থাকে। বিকেলে মিস্ত্রীরা চলে যাওয়ার পর খাঁ খাঁ করতে থাকে এই বিরাট কঙ্কালসার ফ্ল্যাটবাড়ি, আর এরই আনাচেকানাচে নিজেদের নিভৃত যাপন টুকু কাটায় তারা। কখনও খুনসুটিতে, কখনও চুম্বনের আশ্লেষে, আবার কখনও প্রথম যৌবনের শরীরী খেলায় কেটে যায় সময়টা। সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠে রাকিবুল দেখল একটা স্লিভলেস টাইট টপ আর জিনস পরে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে অদিতি, তাকে দেখেই মুচকি হেসে সরে গেল পাশের অর্ধেক তৈরি হওয়া খোলা চাতালটার দিকে। ইশারা বুঝতে দেরি হল না রাকিবুলের। পরম উৎসাহে সেও দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে জাপটে ধরল অদিতিকে আর তারপর শঙ্খলাগা সাপের মতো মেঝের ওপর গড়িয়ে গেল দুটো শরীর। পাগলের মতো পরস্পরকে চুমু খেতে খেতে তারা খেয়ালও করল না হঠাৎ কীভাবে যেন কাঠের পাটাতন থেকে দড়ি ছিঁড়ে তাদের দিকেই নেমে আসছে লোহার রডের একটা পাঁজা। হঠাৎ পাশের থামটার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল স্বপ্না। মিষ্টি হেসে এগিয়ে আসতে থাকল ওদের কাছে। এদিকে মৃদু ঘড়ঘড় শব্দে নেমে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যু, অন্যদিকে যেন গতি বাড়িয়ে সেই লোহার রডের নীচেই এগিয়ে আসছে স্বপ্না। আর কয়েক সেকেন্ড… রডগুলো প্রায় নেমে এসেছে… স্বপ্না এগিয়ে আসছে হাসতে হাসতে… রাকিবুল অদিতির জামার বোতাম খুলতে ব্যস্ত… মাত্র এক চুলের গ্যাপ…
স্বপ্নার সামনে দিয়ে প্রচণ্ড শব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ল লোহার রডগুলো আর নিমেষে থেঁতলে গেল দুটো শরীর। ঠিক তখনি গোঁ গোঁ করতে করতে বিছানার ওপর উঠে বসল প্রাণহরি। এই ডিসেম্বর মাসেও ঘামে জবজব করছে গোটা শরীর, এখনও খিঁচুনি ধরছে শিরায় শিরায়। এই নিয়ে তিনবার! তার স্বপ্নগুলোর মধ্যে কীভাবে যেন ঢুকে পড়ছে স্বপ্না! এ তো বড়ো ভয়ংকর ব্যাপার!
ঢকঢক করে জল খেয়ে হাঁফাতে লাগল প্রাণহরি। এখনও বুকের ভেতর দমাদ্দম হাতুড়ি পেটার শব্দটা শুনতে পাচ্ছে। জাস্ট সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য রডের বোঝাটা পড়ল না স্বপ্নার ওপর, নাহলে ওই ছেলেমেয়ে দুটোর সঙ্গে পিষে যেত সেও। সারা শরীর শিউরে উঠল! কিন্তু কেন? বারবার কেন তার স্বপ্নে ঢুকে পড়ছে স্বপ্না? খাট থেকে নেমে জানালাটা খুলে দিল প্রাণহরি। কনকনে উত্তুরে বাতাসে হাড়ে অব্দি কাঁপুনি লেগে যায়, সে যাক। বড্ড দমবন্ধ লাগছে। গত সপ্তাহ খানেক ধরে আবার কাজে ফেরার চেষ্টা করছে, কিন্তু মন সাথ দিচ্ছে কই? এরকম চলতে থাকলে তো যে-কোনো দিন এমন একটা অঘটন ঘটবে যে সে আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না!
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল সূর্য উঠে গেছে। শীতের লেবুরঙা রোদ গাছের পাতার ফাঁকে আটকে থাকা শিশির মেখে চুঁইয়ে পড়ছে, বাতাসে হালকা ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ। কত সুন্দর সবকিছু! এমন সুন্দরভাবেই তো চলছে তার জীবনটাও। সেদিনের ঘটনার পর প্রথমে একটু আড়ষ্ট থাকলেও পরে সহজভাবেই মিশতে শুরু করেছে স্বপ্না। না, মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলে উঠতে পারেনি প্রাণহরি, কিন্তু তার হাবেভাবে কি তা বুঝতে পারে না স্বপ্না? বন্ধুর মতো মেলামেশা করে তারা, স্বপ্নার স্কুল ছুটি হলে বিকেল বেলা গল্প করতে করতে ওর বাড়ি অব্দি এগিয়ে দিয়ে আসে প্রাণহরি। ধীরে ধীরে মনের অস্থিরতা কমেছে, তাই আবার অর্ডার নেওয়া শুরু করেছে আগের সপ্তাহ থেকে। ওর পেশার ব্যাপারে এখনও কিছু জানে না স্বপ্না, চক্কর মারতে যাওয়ার দিনগুলোয় কলকাতায় কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে কোচিং দিতে যাচ্ছে বলে বেরোয়। কিন্তু আসল সমস্যা তো হচ্ছে এই স্বপ্ন দেখা নিয়ে! ধীরে ধীরে বাথরুমের বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় প্রাণহরি। আয়নায় নিজের চোখে চোখ রেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করে ঠিক কী ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটছে তার মনের কারখানায়? আচ্ছা, তবে কি এবার বলেই দিতে হবে কথাটা? স্বপ্নাকে নিজের করে পাওয়ার যে প্রবল আকাঙ্খা, তার জন্যই কি অবচেতন মনে বারবার ফুটে উঠছে স্বপ্নার ছবি? চেতনা আর অবচেতনের ঝগড়াঝাঁটির ফলেই কি বারবার তার স্বপ্নে ঢুকে পড়ছে স্বপ্না? জোরে নিশ্বাস টেনে বুকে বাতাস ভরে নেয়। নাহ, এভাবে তো চলতে পারে না! আজ রবিবার, স্বপ্না ঘরেই থাকবে। আজই তার সামনে হাত পেতে দাঁড়াবে প্রাণহরি। কলেজে সাহস করে কোনোদিন মিতালীকে বলে উঠতে পারেনি বলে অনেক আফশোষ করেছে এতদিন, স্বপ্নাকে হারিয়ে ফেলে আর সারাজীবন বুকে পাথর নিয়ে বাঁচতে পারবে না সে। আজ যে করেই হোক বলতেই হবে কথাটা।
বাথরুমের কাজ মিটিয়ে ফিটফাট হয়ে নিল প্রাণহরি, তারপর তার সবচেয়ে ভালো জামা-প্যান্ট আর নতুন কেনা হাফহাতা সোয়েটারটা পরে, চুল আঁচড়ে, সেন্ট লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ল বাগবাবুর বাড়ির উদ্দেশে।
বড়োবাজারের সামনে দেখা হয়ে গেল নিলুর সঙ্গে। দু-হাতে বাজার ব্যাগ নিয়ে প্রায় গলদঘর্ম হয়ে ফিরছিল, প্রাণহরিকে দেখে চোখ কপালে তুলল। “বাওয়া! হেব্বি মাঞ্জা মেরেছিস তো সক্কাল সক্কাল!” তারপর অল্প চোখ মেরে রগুড়ে গলায় বলল, “যাচ্ছিস কোথায়? দিদিমণির কাছে নাকি?”
লাজুক হেসে এগিয়ে গেল প্রাণহরি। শুনতে পেল শিবুর দোকানে ঢুকতে ঢুকতে নিলু রসিয়ে রসিয়ে বলছে, “ও হরেনদা! ভালো দেখে একটা বিয়েবাড়ির মেনু বানাও দেখি? পাড়ায় এই সানাই বাজল বলে!” হরেন দাও সঙ্গত দিল, “সে আর বলতে! আমরা তো কবে থেকেই রেডি আছি, শুধু নেমন্তন্ন পাওয়ার অপেক্ষা!”
লজ্জায় কান লাল হয়ে যাচ্ছিল প্রাণহরির। তেঁতুলমুড়ি ছোটো জায়গা, এখানে হাওয়ার আগে খবর ভাসে। তাকে আর স্বপ্নাকে নিশ্চয়ই একসঙ্গে দেখেছে অনেকে, ব্যাপারটা আর চাপা নেই। তা ছাড়া তার পছন্দের ব্যাপারটাও তো জানে নিলু। কিন্তু এত কিছু যাকে ঘিরে সেই স্বপ্না আজ কী রিঅ্যাকশন দেবে তার প্রস্তাবে? যদি না করে দেয়? পোস্টাপিস মোড় পেরিয়ে যাওয়ার পর নার্ভাস লাগতে শুরু করল প্রাণহরির। পথ যেন আর শেষই হচ্ছে না! আচ্ছা, আজ ওর বাড়িতে গিয়ে বলাটা কি ঠিক হবে? যদি কেউ শুনতে-টুনতে পায়! এইসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করল সে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নার বাড়ির গেটের বাইরে। ব্যাপারটা বুঝতে পারা মাত্র বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গেল, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে যাওয়ার মতো মুখ করে কাঁপা কাঁপা হাতে ঢুকল গেট ঠেলে। বাইরের বারান্দাটা ফাঁকা, বোধহয় বাচ্চাদের ক্লাসের ছুটি হয়ে গেছে। দুরু দুরু পায়ে ভেতরে ঢুকল প্রাণহরি। মাথা নীচু করে একমনে কী যেন সেলাই করছিল স্বপ্না, তাকে দেখে “বসুন” বলে হেসে আবার মাথা নামিয়ে নিল। গলা ঝেড়ে এতক্ষণ ধরে মনে মনে বানিয়ে রাখা লাইনগুলো ঝালিয়ে নিতে গেল, কিন্তু কিছুই ছাই মনে পড়ছে না! মিনিটখানেক পরে সুতোর শেষ প্রান্তটা দাঁত দিয়ে কেটে যখন মুখ তুলল স্বপ্না, তখনও দাঁড়িয়ে বিভ্রান্ত চোখো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে প্রাণহরি। অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে? শরীর ঠিক আছে?”
প্রাণহরি বুঝতে পারছিল এই ভরা শীতেও তার কপালে ঘাম ফুটে উঠছে, গরম ভাপ ছাড়ছে কানের লতি থেকে। স্বপ্না নিজের চোখজোড়া পেতে রেখেছে তার চোখের ওপরেই। ঢোক গিলে শুকনো গলাটা ভেজানোর চেষ্টা করল। যে কথাটা সকাল বিকেল এতবার বলেছে মনে মনে, আজ সেই কথা মুখ ফুটে বলতে গেলে জিবটা যে অসাড় হয়ে যাবে কে জানত! চশমার পেছন থেকে স্বপ্নার স্থির চোখ দুটো যেন সম্মোহিত করে ফেলছে প্রতি মুহূর্তে। হাঁটু দুটো কাঁপছে প্রাণহরির, আজ বলতেই হবে… কিন্তু যদি স্বপ্না রেগে যায়? যদি কথা বলা বন্ধ করে দেয়? কী নিয়ে বাঁচবে সে? আর যদি… সকালের স্বপ্নটার কথা মনে পড়াতে হঠাৎ সব দ্বিধাদ্বন্দ ঝেড়ে মরিয়া হয়ে বলে উঠল প্রাণহরি, “আমাকে বিয়ে করবেন?”
হঠাৎ যেন থমকে গেল সময়, নিস্তব্ধ হয়ে গেল চরাচরের সমস্ত প্রাণী। প্রাণহরির মনে হল এই মুহূর্তে তার চোখের পাতা পড়লেও হয়তো শব্দ হবে। সে স্বপ্নার চোখে চোখ দুটো ডুবিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল ঝড় ওঠার। হ্যাঁ, ঝড় ওঠার আগের নৈঃশব্দ্য ছাড়া এ আর কী? ঝড়ের মতো তার জীবনকে ওলটপালট করে দিতে এসেছিল যে মেয়ে, সে হয়তো আবার ঝড় তুলে সব ভাঙা টুকরোগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে ফিরে যাবে। স্বপ্নার চোখে সে বড়ো সাধারণ একজন মানুষ, কেনই বা তার সঙ্গে ঘর বাঁধতে যাবে সে? হয়তো এই মুহূর্তের পর থেকে তাকে সুবিধেবাদী বলেও ভাবতে শুরু করবে স্বপ্না। কিন্তু এছাড়া যে আর কোনো উপায় ছিল না! যেতে হলে বরং সব উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে চলে যাক, যাতে আর কোনোদিন তার স্বপ্নে ফিরে আসতে না পারে। চোখের কোণটা জ্বালা করছিল প্রাণহরির, তবুও ঠোঁট চেপে নিষ্পলক চোখে সে তাকিয়ে রইল স্বপ্নার দিকে।
শেষ পর্যন্ত প্রথম পাতা ফেলল স্বপ্নাই। ঠিক যেন টুপ করে একফোঁটা শিশির মিশল দিঘির জলে। ধীরে ধীরে টেবিলের ওপর থেকে গোল ফ্রেমে আটকানো রুমালটা বের করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, “নিন। এটা আপনার জন্য বানিয়েছি। খুব ঘামছেন আপনি।”
রুমালটার দিকে তাকিয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল প্রাণহরি। সাদা রুমালের ওপর লাল সুতোয় সেলাই করা একটা হৃদয় চিহ্ন, তার মাঝখানে সুতোর কারুকাজে ফুটে উঠেছে একটি শব্দ। “প্রাণ”।
***
“দেখ পানু, প্রথমেই কিন্তু হুটোপাটি করবিনি। ধীরে ধীরে এগোবি, পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো। আর ফাইনাল ব্যাটিং এর আগে কিন্তু মনে করে এটা রাখবি হাতের কাছে!” এক বাক্স কন্ডোম প্রাণহরির পাঞ্জাবির পকেটে গুঁজে দিতে দিতে চটুল গলায় বলল নিলু। পাশ থেকে চাপা গলায় খিক খিক করে হাসল পটলা। নাড়ু কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, “আমার কিন্তু ভাই আরও একটা খাওয়া পাওনা থাকল। সেদিন দিদিমণি আমার দোকান থেকে উল-সুতো কিনতে না এলে কি আর তোদের প্রেমটা শুরু হত? ঘটক-বিদায়ের একটা খাওয়া তো নেবই নেব।”
প্রাণহরির চোখমুখ লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছিল। আজ তাদের ফুলশয্যা। হরেনদার বউ, পিন্টুর মা মিলে স্বপ্নাকে সাজিয়ে বসিয়েছে ঘরের ভেতর। এমন হঠাৎ করে ঘটে গেল সবকিছু, মনে হচ্ছে যেন জেগে জেগে একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখছে সে। না, কোনো খুনের স্বপ্ন নয়, তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন। আদরে ভালোবাসায় ঘেরা একটা গোটা জীবনের স্বপ্ন। স্বপ্নার ইচ্ছেয় আজ সকালেই মন্দিরে বিয়ে করেছে তারা, তারপর সন্ধেয় কিছু কাছের বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ঘরেই সামান্য খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন। সেই সকাল থেকেই পুরো বিয়েবাড়ির দায়িত্ব সামলেছে হরেন দা, নাড়ু, নিলু, পটলারা। এমনকি হরেনদার তত্ত্বাবধানে তার শোওয়ার ঘরের খাটও সাজানো হয়েছে গোলাপ-রজনীগন্ধায়। শিবু একটা ফিচেল হাসি হেসে কী যেন বলতে যাচ্ছিল তার আগেই হরেনদা রীতিমতো বরকর্তার মতো এসে রাশভারী গলায় তাড়া লাগাল, “অ্যাই, তোরা যা এখন! আজ ছেলেটার ফুলসজ্জে, বউমা অপেক্ষা করে রয়েছে, সারাটা রাত কি এখানে তোদের সঙ্গে গুলতানি করে কাটাবে? অ্যাঁ!”
এতক্ষণ প্রাণহরির বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়েছিল সবাই, হরেনদার কথায় হইহই করে নামতে শুরু করল। যাওয়ার আগেও ইশারা-ইঙ্গিতে ফুলশয্যার ব্যাপারে নানারকম সতর্কতা দিতে দিতে বেরোলো নাড়ুরা। সবাই চলে গেলে সদর বন্ধ করে শোওয়ার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল প্রাণহরি। এই পুরো বাড়িটায় এখন তারা শুধু দুজন। বুকের ভেতর চাপ চাপ উত্তেজনা জমাট বাঁধছে। এই বন্ধ দরজার পেছনে অপেক্ষা করছে স্বপ্না, তার স্ত্রী, তার পরম আকাঙ্খিত নারী! হারানদার বউ স্বপ্নাকে সাজানোর সময় দরজা আটকে দাঁড়িয়েছিল এই বলে, “তোমাদের তো কালরাত্তির-টাত্তির কিছুই হল না বাপু, ফুলসজ্জের আগ পজ্জন্ত সময়টুকুনিই নাহয় কালরাত্তির ধরে নাও। একদম ফুলসজ্জের সময়ই তোমার ফুলের মতো বউকে দেখবেখন!” কেমন দেখতে লাগবে স্বপ্নাকে? ভাবতেই সারা শরীর শিরশির করে উঠল প্রাণহরির। আলতো করে দরজাটা ঠেলল, আর ভেতরে ঢুকেই বিস্ময়ে একটা চাপা শব্দ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে।
ঘরের ভেতরটা ছোটো ছোটো মোমবাতি আর প্রদীপ দিয়ে সাজানো। সেই বিন্দু বিন্দু আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে ফুলের সাজ পরে খাটের ওপর জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে স্বপ্না। এত সুন্দরও কোনো মানুষ হয়! লাল-হলুদ গোলাপের গয়না, লাল চেলী আর বেনারসীতে তাকে ঠিক একটা ফুটন্ত গোলাপের মতো লাগছে। প্রাণহরি ঘরে ঢুকতেই হরিণের মতো কাজলকালো দুই চোখ তুলে তার দিকে তাকালো স্বপ্না, লজ্জা আর প্রশ্রয় মিলেমিশে গিয়ে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে চোখদুটোকে। ধীরে পায়ে কাছে এগিয়ে গেল প্রাণহরি, পাশে বসে তুলে ধরল চিবুকটা। শিশিরভেজা ফুলের নরম পাপড়ির মতো তিরতির করে কেঁপে উঠল স্বপ্নার ঠোঁটজোড়া, নিশ্বাস ঘন হয়ে এল, তারপর মোম আর প্রদীপের মায়াবি আলোকে সাক্ষী রেখে মিশে গেল প্রাণহরির ঠোঁটে।
রাত বাড়ছিল। ধীরে ধীরে খসে পড়ছিল ফুলের সাজ, পাটভাঙা পাঞ্জাবি। একসময় নগ্ন শরীরদুটো ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল পাশাপাশি। প্রাণহরির বুকের ওপর মাথা রেখে ঘুমজড়ানো গলায় স্বপ্না বলল, “এভাবেই সারাজীবন আমাকে বুকে জড়িয়ে রাখবে তো?”
“রাখব,” বলে পরম আদরে স্ত্রীকে আরও কাছে টেনে নিল প্রাণহরি। আস্তে আস্তে ঘুমে তলিয়ে যেতে শুরু করল দুজনেই। ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন ভেসে আসছিল প্রাণহরির চোখের পাতায়। এই প্রথমবার স্বপ্নে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে সে। ফুলশয্যার খাটে তারা দুজনে, ঠিক আজকের মতোই। তবে তফাৎ আছে সামান্য। স্বপ্নার চোখ দুটো নববিবাহিত বধূর মতো লজ্জাবনত নয়, বরং কামনার আগুনে যেন রক্তাভ হয়ে আছে। অপরূপ ভঙ্গিমায় সে একে একে সরিয়ে দিচ্ছে নিজের শরীরের সব আড়াল, ধীরে ধীরে মেলে ধরছে খাজুরাহোর ভাস্কর্যের মতো উন্মুক্ত শরীর। উত্তেজনা আর ভালোলাগার আবেশে কঠিন হয়ে উঠছে প্রাণহরি। দু-হাত বাড়িয়ে তাকে শরীরের সঙ্গে মিশিয়ে নিচ্ছে স্বপ্না, প্রোথিত করছে নিজের ভেতর। তার মাখনের তালের মতো নরম স্তনে মুখ ডুবিয়ে দিতে দিতে একটা দমবন্ধ করা নেশায় যেন মাতাল হয়ে উঠছে প্রাণহরি। হঠাৎ বুকের বামদিকটায় কাঁটার মতো কী যেন চিনচিন করে উঠল। ব্যাপারটাকে আমল না দিয়ে উন্মত্তের মতো স্বপ্নার শরীর বেয়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করল প্রাণহরি। কিন্তু না, ব্যথাটা বেড়েই চলেছে। স্বপ্নার কামাতুর শীৎকারের নীচে চাপা পড়ে গেল প্রাণহরির অস্ফুট গোঙানি। যেন হাজার হাজার পিন গেঁথে যাচ্ছে বুকে! কিছু একটা ভুল হচ্ছে। এই মুহূর্তে পালটে ফেলতে হবে স্বপ্নটা। কিন্তু গভীর ঘুমের মধ্যে দরদর করে ঘামতে ঘামতেও প্রাণহরি বুঝতে পারছিল এই প্রথম বার তার স্বপ্ন তার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই! হাজার চেষ্টা করেও সে নিজেকে ছাড়াতে পারছে না ওই স্বপ্নের কবল থেকে। বুকের মধ্যে বসে একটা বাঘ যেন ক্রমাগত আঁচড়ে চলেছে ভেতরের দেওয়ালটা আর অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে তার শরীর। তাই দেখে হা হা করে হাসছে স্বপ্না! কোথায় গেল তার স্নিগ্ধ, শান্ত রূপ! এ কোন স্বপ্না? তার কামার্ত উলঙ্গ শরীরটা দেখে তো এই মুহূর্তে তাকে নরকের কোনো পিশাচিনী ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না! প্রাণহরি যেন খেলার পুতুল, ঠিক এমন ভঙ্গিতে সে লেহন করে চলেছে তার অসাড় শরীর, কখনও বা মুখটা চেপে ধরছে নিজের দুই জঙ্ঘার মাঝখানে। কিন্তু বিন্দুমাত্র কাম জাগছে না প্রাণহরির, বরং একটা আদিম আতঙ্ক বরফগলা জল হয়ে ঘিরে ফেলছে তাকে। সেই কনকনে ঠান্ডা জলে ডুবে যেতে যেতে ঘোলাটে চোখে আরও একবার হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে প্রাণহরি, কিন্তু না, কিছুতেই হিসেব মেলে না এ স্বপ্নের। ফালা ফালা হতে থাকে হৃৎপিণ্ড, শিরা-ধমনী ফাটিয়ে চলকে পড়তে চায় রক্ত, আর চেতনার কিনারা পেরিয়ে ভেসে যেতে যেতে প্রাণহরি বুঝতে পারে এই ছিল তার দেখা শেষ স্বপ্ন। একটা মৃত্যুর স্বপ্ন।
***
দ্রুত হাতে স্নিকার্সের ফিতে বাঁধছিল সোনিয়া। দিনের আলো ফুটতে খুব বেশি বাকি নেই, তারওপর পাড়াগাঁয়ে লোকজন একটু তাড়াতাড়িই ওঠে। অবশ্য চড়া মেকআপ, গাঢ় লিপস্টিক তার মুখের ধাঁচই পালটে দিয়েছে। গায়ে কালো জ্যাকেটটা চাপিয়ে হুড তুলে দিয়ে নিজেকে দেখে আয়নায়। নাহ, এই জিনস-জ্যাকেটের ভেতর যে আসলে সুতির শাড়ি আর মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা তেঁতুলমুড়ির সেলাই দিদিমণি ঢুকে রয়েছে, এমনটা বোধহয় তার “পতিদেবতা” স্বয়ং প্রাণহরি মন্ডল নিজেও কল্পনা করতে পারত না! প্রাণহরির কথা মনে পড়তেই টুক করে একবার পাশের ঘরে উঁকি মেরে দেখে নিল সোনিয়া। বুকের ওপর বাম হাতটা রেখে চিৎ হয়ে ঘুমোচ্ছে প্রাণহরি। মানে একঝলক দেখে অন্তত তাইই মনে হবে। অবশ্য ডাক্তার এসে বলবে হার্টঅ্যাটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু। মুচকি হেসে বিছানায় পড়ে থাকা শাড়ি-গয়না-মেকআপবক্স ঢোকাতে থাকে ব্যাকপ্যাকে। ফাঁকা ঘরে প্রাণহরির বডি আর তার অনুপস্থিতি দেখে মার্ডারের অ্যাঙ্গেলটা ভাবতেই পারবে না হরেনদা রা। বরং ভাববে গুণ্ডা-ডাকাত এসে জোর করে তুলে নিয়ে গেছে তাদের শান্তশিষ্ট “স্বপ্না দিদিমণি” কে। প্রাণহরির দৌলতে তার বন্ধুবান্ধবরা এতদিনে “একটি ডিভোর্সি, নিপীড়িত, অসহায় মেয়ের দুখভরা কাহিনি” শুনে ফেলেছে কিনা! সেদিন সন্ধেবেলা কীভাবে তাকে দুষ্কৃতিদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল সেকথা বুকফুলিয়ে প্রচার করতে ছাড়েনি প্রাণহরি। অতএব আসল ব্যাপারটা ধরার চান্স কম। আর যদি বা ধরেও ফেলে ততদিনে এ রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে কোথায় চলে যাবে সে!
পাঁচিল ডিঙিয়ে একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে ঘাসের ওপর নামল সোনিয়া। পুরু কুয়াশার স্তর ঢেকে রেখেছে চারপাশ। তার চলাফেরার পক্ষে একদম আদর্শ পরিবেশ। সামনের গেটে মাইক-প্যান্ডেলওলাদের কেউ থাকতে পারে, তাই এক্সিট রুট হিসেবে বাড়ির পেছন দিকটা বরং অনেক সেফ। মুখে কালো কাপড়ের মাস্কটা তুলে দিয়ে সরু গলিপথ ধরল সোনিয়া। এই গলি ধরে গেলে বড়ো রাস্তায় ওঠার একটা শর্টকার্ট রাস্তা পাওয়া যায়।
গলিতে হাঁটতে হাঁটতে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল সোনিয়ার মুখ থেকে। উফফ, কী পরিশ্রমটাই না করতে হয়েছে লাস্ট কয়েকটা মাস! ফাইনালি আজ পরিশ্রম সফল হল। ডার্ক ওয়েবের মোস্ট ডিমান্ডিং কিলার “লাইফ_স্ন্যাচার” এর আসল নামও যে “প্রাণহরি” বেরোবে সেটা কে ভেবেছিল? পাতি ইংলিশ ট্রান্সলেসন মেরেছে লোকটা! ডার্ক ওয়েবের দুনিয়া থেকে কারো আসল নাম ঠিকানা বের করাটা মোটামুটি নেক্সট টু ইমপসিবল ব্যাপার। তবে সেও ডার্ক ওয়েবের খুনে সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী “ড্রিমগার্ল”! হ্যাঁ, ওই নামেই ডার্ক ওয়েবে বিচরণ করে সে। এই বছর খানেক আগে অব্দিও প্রফেশনাল কিলিং এ তার ডিমান্ড ছিল আকাশছোঁয়া। হবে নাই বা কেন! যে কোনো মানুষকে ছুঁয়ে তার স্বপ্নকে কন্ট্রোল করে ইচ্ছেমতো স্বপ্ন দেখানোয় স্পেশালাইজেশান তার। আর দিন কয়েকের মধ্যেই সত্যি হয়ে যায় সেসব স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখিয়ে খুন করার এমন সেফ প্রসেস আর আছে নাকি? বাইরের জগতের কাছে সে একজন হাই সোসাইটির এসকর্ট বটে, কিন্তু এটা কেউ জানে না যে সোনিয়া দত্ত শয্যাসঙ্গীনি হয় শুধুমাত্র তার টার্গেটদেরই! সারা রাত তাদের শরীরে লেপটে থেকে তাদের নিজেদের মৃত্যুর স্বপ্ন দেখিয়েই কাজ হাসিল করত সে। কিন্তু ব্যবসায় টান পড়ল বছর খানেক আগে। মার্কেটে নাকি নতুন কিলার এসেছে যে নাকি নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখলেও সত্যি হয়ে যায় সেটা। যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা হচ্ছে তাকে ফিজিক্যালি টাচ করার কোনো দরকারই পড়ে না। স্বভাবতই মাথায় বাজ পড়েছিল। এমন হলে তো তার বাজার পুরো বসে যাবে! হলও তাই। দলে দলে ক্লায়েন্ট “ড্রিমগার্ল” কে ছেড়ে ভিড় জমাতে শুরু করল “লাইফ_স্ন্যাচার”এর কাছে। তার এই ফিজিক্যাল টাচের ব্যাপারটা কোনো কোনো সময় একটু রিস্কি হয়ে যায় বইকি। মেয়েদের ক্ষেত্রে, এমনকি কিছু কিছু সতীসাধ্বী ধরনের পুরুষ শিকারের ক্ষেত্রেও কাজ করাটা একটু মুশকিল হয়। তখন কিডন্যাপিং ইত্যাদি নানারকম পন্থা নিতে হয় যাতে পুলিশের ট্রেস করার চান্স বেড়ে যায়। কিন্তু এ লোকের কোনো হ্যাপাই নেই! তাই একে একেবারে নিকেষ করতে না পারলে নিজের বাজার ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখতে পাচ্ছিল না সে।
লাহাদের আমবাগানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে একটা চাপা হাসি ভেসে উঠল সোনিয়ার মাস্কের আড়ালে। কেমন “মিতা” মিতা” করে ডাক ছাড়ছিল লোকটা! ঠিক বসন্তের কোকিলটি যেন। তবে তাতে তার উপকারই হয়েছে বটে। আইপি হ্যাক-ট্যাক করে অনেক কষ্টে লোকটাকে ট্রেস করার পর চক্কর মারতে বেরিয়েছিল। তার প্রফেশনে এই চক্কর মারা ব্যাপারটা বেশ ইম্পর্ট্যান্ট। আরে যদি টার্গেটকে কেমন দেখতে, লাইফস্টাইল কেমন, পয়সাওলা মাল নাকি ভিখিরি, মেয়েমানুষের লোভ আছে নাকি একদম সত্যবান… এ সবই যদি না জানল তবে তাকে নিয়ে স্বপ্নটা দেখবে কী করে? তাই চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে মেছুনির ভেক ধরে যেতে যেতে শুনে নিয়েছিল নিলুর কথাগুলো। তার টার্গেটের নাকি একটু আদ্দিকালের মেয়ে পছন্দ! তারপর যখন এখানে এসে লোকটার প্রেমিকার নাম ধরে আকুলিবিকুলি ডাক শুনল, তখনই মোটামুটি বুঝে গেছিল কী করতে হবে তাকে। তারপর হপ্তাখানেক প্ল্যান সাজিয়ে “গাঁয়ের মেয়ে কমলা” টাইপের মেকওভারে আগমন এবং একে একে প্রাণহরির হৃদয় ও প্রাণ হরণ! অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট! আজ থেকে ডার্কওয়েবের ওয়ান অ্যান্ড ওনলি ক্যুইন হবে “ড্রিমগার্ল”। আর কেউ নয়।
পায়ে পায়ে বড়ো রাস্তায় উঠে এল সোনিয়া। দূরে কুয়াশার ঘন আস্তরণ ভেদ করে এগিয়ে আসছে একটা কুচকুচে কালো হন্ডা সিটি। অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করে আছে তার ক্লায়েন্টরা, এবার মাঠে নেমে খেলা দেখানোর পালা। গাড়িটা পোষমানা কুকুরের মতো এসে দাঁড়ালো তার সামনে। পেছনের সীটে উঠে মাস্ক নামিয়ে একটা বড়ো শ্বাস টানল সোনিয়া। তারপর খসখসে নির্লিপ্ত গলায় বলল, “এয়ারপোর্ট”।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, মোহর