প্রজেক্ট ইসিখাথি
লেখক: তন্ময় মুখার্জি (বংপেন)
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
প্রকাণ্ড ঘরটার ভিতর আবছা নীল আলো, এই নীল-কালো আবছায়াটা অভ্রর ভীষণ সুপরিচিত। এই ঘরে হাওয়ার চলাচলও হিসেব মেনে হয়, কিন্তু অভ্রর অবাধ যাতায়াত। আজ একটা নিরেট থমথমে ভাব চারদিকে। ঘরটার উত্তরের দিকে দেওয়াল জোড়া জানালা; কাচের ওপাশে ক্রমশ ফিকে হয়ে আসা রাতের আকাশ। সেই জানালার সামনে একটা বিশাল টেবিল যার ওপর মুখ গুঁজে বসে আছেন এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ। পরনে সামরিক পোশাক। ঝিমোচ্ছেন হয়তো। ভদ্রলোক গোটা রাত এই অফিসেই কাটিয়েছেন; কাজেই ক্লান্তি গ্রাস করাটা আশ্চর্যজনক নয়।
—প্রাইম মিনিস্টার।
—হুম।
—প্রাইম মিনিস্টার!
—হুম? কে?
—আমি অভ্র।
—ওহ্। ক-টা বাজে?
—ভোর পৌনে চারটে।
—দেখেছ কাণ্ড! চেয়ারে বসেই চোখ লেগে গেছিল। সব রেডি?
—রেডি। তবে বুড়োর বড্ড জেদ। বলছে একবার আপনার সঙ্গে দেখা না করলেই নয়।
—আমি তার সঙ্গে দেখা করতে বাধ্য নই। তবে ভাবছি একবার।
—আপনার সিকিউরিটি অ্যাডভাইসর হিসেবে আপনাকে সাবধান করে দেওয়াটা আমার কর্তব্য। ইন্টারগ্যালাক্টিক স্পাইয়ের সঙ্গে আপনার দেখা করাটা সমীচীন হবে না। এর আগেও বহুবার আপনার ওপর হামলা হয়েছে। তা ছাড়া গতকালও ইন্টেলিজেন্স ছিল যে আকাজ্বু গ্যালাক্সির কোনো এক গ্রহ থেকে একদল টেররিস্ট হামলা করতে পারে।
—কিন্তু এ বুড়োর চেহারা তো আমাদেরই মতো। এ পর্যন্ত আমাদের যত ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের দেখেছি, দেখতে-শুনতে তারা কেউই মানুষের মতো নয়। কাজেই এর হাবভাব দেখে মনে তো হয় না।
—ছোটো মুখে বড়ো কথা হবে। তবুও বলি। বিপুলা এ স্পেসের কতটুকুই বা আমরা জানি প্রাইম মিনিস্টার। আমাদেরই মতো কত ছাপোষা মানুষের দল হয়তো বহু গ্রহে ছড়িয়ে আছে। বলাই বাহুল্য যে এ গ্রহের প্রাইম মিনিস্টারকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ চরম হবে। কম্পিটিশন কেউই পছন্দ করে না।
—আমরাও তো তেমন সরল-সিধে নই অভ্র। ক্রমশ রিসোর্স-রিসোর্স করে উন্মাদ হয়ে পড়েছি। বসবাসযোগ্য গ্রহ দেখলেই হামলে পড়ছি, সেখানকার বসতি সাফ করে নিজেদের স্বার্থে সে গ্রহকে শুষে ছিবড়ে করে দিচ্ছি।
—আই বেগ ইওর পারডন প্রাইম মিনিস্টার, কিন্তু আপনার কথার সুরে কোথাও কি অনুতাপ রয়েছে? প্লিজ মনে রাখবেন যে আপনার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠলে কিন্তু এ গ্রহের মানুষদের মধ্যে মারাত্মক আতঙ্কের সঞ্চার হবে।
—না না অভ্র, আমি সেভাবে বলতে চাইনি।
—মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার। একটা গোটা গ্রহের আশাভরসার প্রতীক আপনি। অনুকম্পা ভালো ব্যাপার, কিন্তু তাতে যদি গ্রহের ভবিষ্যতকে অন্ধকারে দিকে ঠেলে দিতে হয়।
—না না। অনুকম্পা নয়। সত্যিই তো। একের পর এক গ্রহ জবরদখল না করলে এ গ্রহের মানুষজনগুলোকে বাঁচানো যেত না।
—জবরদখল নয় প্রাইম মিনিস্টার। অধিগ্রহণ। ফর মিউচুয়ালি বেনিফিশিয়াল প্রগ্রেস।
—তাই তো।
—জল। মিনারেল। শস্য। সবুজ। এসবের অভাব না মেটাতে পারলে শুধু আপনার গদিই টলোমলো হবে না, পৃথিবীর যেটুকু এখনও প্রাণবন্ত আছে, তাও শ্মশানে পরিণত হবে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এথিকাল ডিলেমার খপ্পরে পড়ার কোনো মানে হয় কি?
—আগামী একমাসের মধ্যে আমরা আর ক-টা গ্রহ আক্রমণ করতে চলেছি অভ্র?
—সাতটা। স্ন্বজ, ক্সক্স, উওউ, আক্ক, জসব্ব, ওহাহ আর এক্সভ্যভ। এদের থেকে রিসোর্স এক্সট্র্যাক্ট করতে পারলে আশা করছি আগামী বছরখানেক আর কোনো চিন্তা থাকবে না।
—কিন্তু এতগুলো আক্রমণ… পর পর… দরকার আছে কি? যদি একটু সময় নিয়ে, গুছিয়ে প্ল্যান করে আমরা এগোই।
—সামনেই গ্লোবাল ইলেকশন, এই সময় আমরা দাপুটে কিছু একটা না করতে পারি।
—হুম।
—আমরা আপনার আজ্ঞাবহ দাস প্রাইম মিনিস্টার। আপনার ভালোমন্দ দেখাটা আমাদের কর্তব্য।
—আমার ড্যাশবোর্ডে দেখছিলাম এত ঘনঘন ভিনগ্রহ আক্রমণের প্ল্যানিং শুনে মানুষজন খানিকটা অস্থির হয়ে পড়েছে।
—অপোজিশন ক্রমাগত হল্লা করে চলেছে, তাতে কিছু মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন বটে। তবে সপ্ত-গ্রহ জয় করে দেখুন, মানুষ ধন্য ধন্য করবে। কে না চায় নতুন বাসা? একটু বাড়তি রিসোর্স?
—আমাদের জনসংখ্যাও তো হুহু করে কমছে অভ্র। আজকাল মেরু-অঞ্চলের বাইরে আর লোকজন থিতু হতে পারছে কই?
—রিসোর্স বাড়ুক। লোকজনও বাড়বে। ধৈর্য ধরুন। আমাদের শুধু ইন্টারপ্ল্যানেটরি জঙ্গি-হামলাগুলো সামাল দিতে হবে। আর এই উড়ে এসে জুড়ে বসা বৃদ্ধটি মোটেও সুবিধের ঠেকছে না। ওর হাবভাব অত্যন্ত সন্দেহজনক। আমাদের বৈজ্ঞানিকরা সক্কলে এক কথায় বললে যে বুড়োর স্পেসক্র্যাফটটি অতি বিচিত্র একটা জিনিস। অমন গোলমেলে চেহারার স্পেসক্রাফট আমরা আজ পর্যন্ত দেখিনি।
—কেন? সেবার ক্সক্স থেকে যে বিচিত্র মহাকাশযানটা আমাদের অর্বিটে এসে পড়েছিল? ওই যে, যেটার ভিতর থেকে চারজন প্রকাণ্ড জেলিফিশের মতো এলিয়েন বেরিয়েছিল।
—সেটা বিকট ছিল বটে। কিন্তু সে জিনিসের মেকানিজম বুঝতে আমাদের বেগ পেতে হয়নি। এ বুড়োর ক্র্যাফটটা মিস্টিরিয়াস। যন্ত্রটা কীভাবে চলে সেটাই আমাদের রিসার্চ-টিম ধরতে পারছে না। সবচেয়ে বড়ো কথা মহাকাশযানটার আগমন আমাদের কোনো রেডারেই ধরা পড়েনি। আমরা মোটের ওপর নিশ্চিত যে বুড়োটা কোনো বদ উদ্দেশ্য নিয়েই পৃথিবীতে এসেছে।
—এখনও বুড়ো নিজের পরিচয় দেয়নি?
—নাহ্। কাজেই ওঁর সঙ্গে দেখা করা আপনার উচিৎ হবে না।
—ওর এক্সেকিউশিন কখন?
—আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই। সেটা জানাতেই এসেছিলাম।
—অভ্র। তার আগে আমি বুড়োর স্পেসক্রাফটটা একবার স্বচক্ষে দেখতে চাই।
—কিন্তু প্রাইম মিনিস্টার… সেটাতেও গোলমাল থাকা অসম্ভব নয়। আমার রেকমেন্ডেশন হল।
—এটা তোমার প্রাইম মিনিস্টারের হুকুম।
—আজ্ঞে?
—আমার হুকুম। আমি স্পেসক্রাফটটা না দেখা পর্যন্ত যেন তাকে ইলেকট্রিক শক না দেওয়া হয়।
—কিন্তু প্রাইম মিনিস্টার। আমাদের রিসার্চ-টিম এখনও সে যন্ত্রের কলকব্জা রকমসকম বুঝে উঠতে পারেনি।
—তুমি ভুলে যেও না অভ্র, আমি শুধু প্রাইম মিনিস্টার নই, আমি সবার আগে একজন বৈজ্ঞানিক। তোমার রিসার্চ টিমে এমন কেউ নেই যে এলিয়েন স্পেসক্রাফট সম্বন্ধে আমার চেয়ে বেশি জানে। কাজেই খামোখা আমার সময় নষ্ট কোরো না।
—আচ্ছা। বেশ। এক্সেকিউশন না হয় ঘণ্টাখানেক পিছিয়ে দেওয়া যাবে। চলুন।
***
আর্কটিক স্পেসশিপ হ্যাঙ্গার।
সকালের নরম রোদ পিঠে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্রাইম মিনিস্টার। চুল অবিন্যস্ত, মুখের বরফ-শীতলতা যে নেহাতই মেকি তা চোখের অস্থিরতা থেকেই স্পষ্ট। পরিচিত কণ্ঠের ‘প্রাইম মিনিস্টার’ হাঁকে ঘুরে তাকাতেই নজরে এল ডক্টর নীলের প্রকাণ্ড শরীর। সামান্য ঝুঁকে চলাফেরা করেন নীল, কিন্তু তাতে তাঁর ক্ষিপ্রতা কমে না। দেশের অগ্রগণ্য বৈজ্ঞানিক বলে কথা।
—প্রাইম মিনিস্টার, এই অসময়ে তলব? তাও এই হ্যাঙ্গারে? অভ্র যেভাবে হন্তদন্ত হয়ে আমার কোয়ার্টারে ছুটে গেছিল। আর চারদিক এমন নিস্তব্ধ। হ্যাঙ্গারের কাজকর্ম সব বন্ধ নাকি?
—এসো নীল। আমিই অভ্রকে বলেছি হ্যাঙ্গারটা পুরোপুরি ফাঁকা রাখতে।
—কী ব্যাপার বলুন তো?
—আজ আমি প্রাইম মিনিস্টার হিসেবে তোমায় ডাকিনি নীল। ডেকেছি তোমার এককালের রিসার্চ সিনিয়র এবং বন্ধু হিসেবে। একজন ফিজিসিস্ট হিসেবে।
—বেশ তো। সে অর্থে এ তো গুরুর আহ্বান। বলে ফেলুন, শিষ্য হাজির।
—প্রজেক্ট ইসিখাথি কোন পর্যায় আছে?
—এদ্দিন পর হঠাৎ ইসিখাথির কথা উঠল? আপনি রাজনৈতিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার পর থেকেই তো সেটা কোল্ডস্টোরেজে।
—সে প্রজেক্টের যাবতীয় রেকর্ড কাগজপত্র আর প্রোটোটাইপ আমি তোমায় দিয়ে এসেছি।
—সেগুলো যত্নে রয়েছে, সবচেয়ে বড়ো কথা গোপন রয়েছে। আমি আর আপনি বাদে ইসিখাথি সম্বন্ধে আর কেউই কিছু জানে না। কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না আজ হঠাৎ।
—আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। তোমার কী মনে হয়, প্রজেক্ট ইসিখাথির সফল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল?
—শুরুর দিকে মনে হচ্ছিল যে ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে গেলেও যেতে পারে। কিন্তু কদিন পরেই তো বোঝা গেল হিসেবে বিস্তর গোলমাল। আর আপনিও হাল ছেড়ে দিলেন। নাহ্, আমার মনে হয় না আর কোনো সম্ভাবনা আছে। কিন্তু প্রাইম মিনিস্টার, আপনি এখনও বললেন না এদ্দিন পর আবার সেই প্রজেক্টের প্রসঙ্গ উঠল কেন?
—ইসিখাথি হ্যাস বিন আ সাকসেস, নীল।
—এক্সকিউজ মি?
—ইসিখাথি ব্যর্থ হয়নি।
—আপনি কি রসিকতা করছেন?
—সামনের হ্যাঙ্গারের দিকে এগোলেই বুঝবে যে রসিকতার সময় এটা নয়।
—কী আছে ওদিকে? কোনো ভিনগ্রহের জন্তুজানোয়ার ঝাঁপিয়েটাঁপিয়ে পড়বে না তো? আমি আবার বিটকেল সারপ্রাইজ-টারপ্রাইজ পছন্দ করি না।
—আচ্ছা নীল, অভ্র তোমায় সদ্যাগত ইন্টারগ্যালাকটিক স্পাইটির খবর দিয়েছে?
—বলেছে বইকি। মহা গোলমেলে ব্যাপার নাকি। এলিয়েন অথচ চেহারা পোশাক সমস্তই নাকি মানুষের মতো। যদি সত্যিই তাই হয় তাহলে তো বলতে হয় থ্রিলিং ব্যাপার।
—সে এলিয়েনের স্পেসক্রাফটের ব্যাপারে কিছু শোনোনি?
—অভ্র বলছিল যে ব্যাপারটা নাকি খুবই অদ্ভুত কিছু… ইন ফ্যাক্ট আমাকেও রিকুয়েস্ট করেছিল আমি যদি যন্ত্রটাকে একটু পরীক্ষা করে দেখি।
—সে জন্যই আমি তোমায় ডেকেছি নীল। স্পেসক্রাফটটা দেখে বলো তোমার কী মতামত। এসো আমার সঙ্গে।
প্রাইম মিনিস্টার ডক্টর নীলের ওভারকোটের আস্তিনে টান দিয়ে এগিয়ে গেলেন হ্যাঙ্গারের ‘প্রোটেক্টেড এরিয়া’র দিকে। পার্কিং স্লট নম্বর ২২৩ বাই ৭ বাই সি-র সামনে এসে দাঁড়ালেন দুজনে।
দুজনের সামনেই একটা প্রায় সাড়ে সাত ফুট লম্বা কাচের বাক্স। অনেকটা সেই আদ্যিকালের এলিভেটরের মতো দেখতে। সে বাক্সের গায়ে রকমারি প্যানেল। আর সে প্যানেলে ফুটে উঠছে নানারকমের সাংকেতিক লেখা। সে সাংকেতিক লেখার মর্মোদ্ধার করার লোক পৃথিবীতে বড়ো একটা নেই। যে দুজন সে সংকেত ভেদ করে দিব্যি পড়তে পারে, তাঁরাই দাঁড়িয়েছিলেন সেই কাচের বাক্সের সামনে। বিহ্বল বোধ করছিলেন ডক্টর নীল। গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছিল না তাঁর।
—নীল, চিনতে পারছ?
—অসম্ভব। ইম্পসিবল। আপনি আমার সঙ্গে মস্করা করছেন প্রাইম মিনিস্টার।
—তুমি সমস্তটাই বুঝতে পারছ নীল। গোটা পৃথিবীতে একমাত্র আমরাই পারব বুঝতে।
—কিন্তু এটা সেই ইসিখাথির প্রোটোটাইপ, এই তো! এ চোখের ভুল নয়।
—প্যানেলের লেখাটাও ভুল নয় ভায়া নীল। “প্রজেক্ট ইসিখাথি ইস ফাইনালি আ সাকসেস।”
—অসম্ভব।
—তুমি হাজারবার অসম্ভব বললেও তো ব্যাপারটা মিথ্যে হয়ে যাবে না।
—কে এসেছে? তাঁর সঙ্গে আমাদের দেখা হওয়া খুব প্রয়োজন।
—আমার একটা প্রচ্ছন্ন ধারণা আছে কে এসেছে। এখান থেকে সোজা আমি তাঁর সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছি।
—আমিও যেতে চাই প্রাইম মিনিস্টার।
—নাহ্। প্রথম বোঝাপড়াটা আমার সঙ্গেই হওয়া দরকার।
—কিন্তু…।
—ইট ইজ অ্যান অর্ডার। তুমি এটার কাছে থাকো। এলিয়েন স্টেশনে অভ্র অপেক্ষায় আছে। আমি সেখানে যাচ্ছি।
***
কতক্ষণ যে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কাচের প্রমাণ সাইজ বাক্সটার দিকে তাকিয়েছিলেন তা খেয়াল ছিল না ডক্টর নীলের। সংবিৎ ফিরল ব্রেনওয়েভ কলের ট্রিংট্রিংয়ে। পিএমের সিকিউরিটি অ্যাডভাইসর অভ্র যোগাযোগ করতে চাইছে।
—হ্যালো! ডক্টর নীল!
—বলো অভ্র। কী ব্যাপার, এমন জরুরি কল?
—আপনি কোথায় নীল?
—স্পেস হ্যাঙ্গারেই। প্রাইম মিনিস্টার আমায় এখানেই থাকতে বলে গেলেন।
—ওখানেই থাকুন। নিজে থেকে বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করবেন না। আমাদের সিকিউরিটি ভেহিকল পাঠাচ্ছি। আপনাকে নিরাপদ আস্তানায় পৌঁছে দেবে।
—হঠাৎ কী হল অভ্র?
—আমাদের আশঙ্কা পৃথিবীর ওপর শিগগিরই কোনো বড়ো হামলা হতে চলেছে। কোনো গ্রহ বা কোনো গোপন স্পেস-কলোনি থেকে; সে সম্বন্ধে কোনো ইন্টেলিজেন্স আমাদের কাছে নেই কিন্তু যে কোনো মুহূর্তেই।
—আমি তো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না অভ্র।
—প্রাইম মিনিস্টার নিহত হয়েছেন ডক্টর নীল। দ্য মার্ডারার, সেই অবিকল মানুষের মতো চেহারার এলিয়েন যার সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানতে পারিনি। সে পলাতক! বলাই বাহুল্য খুনি সেই।
—হোয়াট?
—আমি বহুবার বারণ করা সত্ত্বেও প্রাইম মিনিস্টার জেদ করে সেই এলিয়েনের সঙ্গে একা দেখা করতে গেলেন।
—অভ্র, আপনাদের গোটা টিমকে ঘোল খাইয়ে গেল একটা এলিয়েন?
—হাই সিকিউরিটি চেম্বারে তার মুখোমুখি হয়েছিলেন প্রাইম মিনিস্টার। সে চেম্বার ঘিরে হাজারো সিকিউরিটি কর্ডন, শয়ে শয়ে সশস্ত্র রক্ষী মোতায়েন করা। সেই এলিয়েনের কাছে অবশ্যই কোনো অস্ত্রই ছিল না। প্রাইম মিনিস্টারের পিস্তল ছিনিয়ে নিয়ে কুকর্মটা করেছে সে।
—খুনি এখন কোথায়?
—ভেরি সরি ডক্টর নীল। আমরা… আমরা হতভম্ব।
—মানে?
—গুলির শব্দ পেয়ে সমস্ত রক্ষীদের নিয়ে আমি নিজের সেই চেম্বারে ঢুকে পড়ি। প্রাইম মিনিস্টার তৎক্ষণাৎ মারা যান। কিন্তু তাঁর মৃতদেহ ছাড়া সে ঘরে আর কেউ ছিল না। সে এলিয়েন ভোজবাজির মতো গায়েব।
—গায়েব? অত কড়া নজর ফাঁকি দিয়ে উবে গেল?
—আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না নীল… আসলে।
—ওহ্।
—কী?
—ওহ্। ওহ্। আমি বুঝতে পেরেছি অভ্র।
—কী বুঝতে পেরেছেন?
—যা বুঝেছি তা আপনাদের বোঝাতে আমি অক্ষম অভ্র। শুধু এটুকু বলি। পৃথিবী কেউ আক্রমণ করতে আসছে না। সে আততায়ী আদৌ এলিয়েন নয় আর তাঁকে খুঁজে অযথা হন্যে হয়ে লাভ নেই।
—কী বলছেন ডক্টর নীল।
—স্পেসক্রাফটে চেপে কোনো এলিয়েন এসে আমাদের প্রাইম মিনিস্টারকে হত্যা করেনি। খুনি এ পৃথিবীরই মানুষ। আমার সামনের এই যানখানাও ভিনগ্রহ থেকে আসেনি অভ্র।
—আমায় সব খুলে বলুন নীল..আপনাকে বলতেই হবে।
“আপনাকে বলতেই হবে”—অভ্রর কথাগুলো শুনে বুক কেঁপে উঠল নীলের। প্রাইম মিনিস্টারের মৃত্যুকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যায় না। ব্রেনরিসিভারে অভ্রর বলে যাওয়া কথাবার্তা অগ্রাহ্য করে কাচের বাক্সটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন ডক্টর নীল। বাক্সের সামনেই একটা জটিল প্যানেল। স্মিত হাসলেন নীল; এ যন্ত্রপাতি তাঁর অত্যন্ত সুপরিচিত। দ্রুতগতিতে একের পর এক ডিজিটাল বোতাম টিপে গেলেন নীল। আর তার ঠিক তিরিশ সেকেন্ডের মাথায় একটা প্রবল বিস্ফোরণ ঘটল। সে কাচের যন্ত্র আর ডক্টর নীলের কোনো চিহ্নই অবিশিষ্ট রইল না।
***
চল্লিশ মিনিট আগে
—প্রাইম মিনিস্টার! আমি জানতাম আপনি আমার সঙ্গে একটি বারের জন্য অন্তত দেখা করবেন।
—এত কাঠখড় পুড়িয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসা?
—আমায় চিনতে পেরেছেন তো?
—না চেনার কোনো কারণ আছে কী? আমি তাহলে আপনাকে ডক্টর বরুণ বলেই ডাকি। যাক গে, দেখা করার উদ্দেশ্যটা?
—প্রজেক্ট ইসিখাথি ইজ আ সাকসেস। সেটা জানাতেই আমার এদ্দূর আসা।
—এদ্দূর?
—সময়ের দূরত্বটা দূরত্ব নয় প্রাইম মিনিস্টার?
—ইসিখাথি সফল হল ডক্টর বরুণ? এও সম্ভব?
—আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আপনার অসম্ভব মনে হচ্ছে। তবে আজ থেকে বত্রিশ বছর পর আপনিই পারবেন ইসিখাথিকে সফল করতে।
—আই সি! আরও বত্রিশ বছর।
—সেটা জানাতেই এলাম, বত্রিশ বছর পেরিয়ে।
—কেন?
—আপনি বিজ্ঞানের উপাসক। কিন্তু রাজনীতিও বড়ো কাছ থেকে দেখছেন। আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে ইসিখাথির সাফল্য কোনো সুখবর নয়? ভেবে দেখেছেন কী সর্বনাশ হবে পৃথিবীর এবং গোটা ব্রহ্মাণ্ডের যদি রাজনৈতিক ক্ষমতাবাজদের হাতের মুঠোয় টাইম ট্র্যাভেলের ফরমুলা চলে আসে? সমস্তটা ওলটপালট হয়ে যাবে প্রাইম মিনিস্টার! সত্য মিথ্যার তফাৎ ঘুচে যাবে। সমস্তই ধুলোয় মিশে যাবে।
—তাহলে এদ্দূর এগোলেন কেন বরুণ?
—বিজ্ঞানের উপাসনা যে বড়ো বিশ্রী ধরনের জেদ, সেটাও কি আপনাকে বলে দিতে হবে? আমি সময়ের বেড়াজাল পেরিয়ে আপনার কাছে ছুটে এসেছি প্রাইম মিনিস্টার। সময়ের হিসেবে একটা গোলমাল করে যদি আরও বিস্তর গোলমাল রুখতে পারি, সে আশায় বুক বেঁধে আমি এসেছি। আমায় ফিরিয়ে দেবেন না!
—কিন্তু আজ থেকে বহু বছর পর প্রজেক্ট ইসিখাথিকে ঠান্ডাঘর থেকে বের করে এনে সফল করেছেন আপনি। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমি কী-ই বা করতে পারি।
—আমায় যে একমাত্র আপনিই আটকাতে পারেন প্রাইম মিনিস্টার… একমাত্র আপনি।
—ওহ্। ওহ্।
—সবটাই তো স্পষ্ট। তাই না? আপনি তো সমস্তটা জেনেই আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আর বিলম্ব কেন। এইবারে মুক্তি। এই গ্রহটার প্রতি আপনার ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। তাই না?
—সেটা আপনার থেকে ভালো আর কে জানবে বরুণ। বেশ। আপনাকে আটকাতেই হবে।
—প্রাইম মিনিস্টার। আমায় আটকানোর একটাই রাস্তা। সহজ, সরল; আমায় মিথ্যে করে দেওয়া।
—তাই হোক। আপনি যে সম্ভাবনার হদিস দিয়ে গেলেন, সেটা জানতে পেরে বড়ো তৃপ্তি পেলাম। ইয়ে, আমি আমাকে এত আপনি-আজ্ঞে করছি কেন?
—হেহ্।
—তবে কাজটা তুমি সারলেই ভালো হয় ডক্টর বরুণ। তাতে স্টেজ ম্যানেজমেন্টটা ভালোভাবে ঘটবে। এই নিন। আমার পিস্তল।
—থ্যাঙ্ক ইউ প্রাইম মিনিস্টার। তোমার মতো দেশনায়ক সত্যিই বিরল।
—ডক্টর বরুণ, তোমার যাত্রাপথ ভেবে আমার গর্ব হচ্ছে।
কাঁপা হাতে নিজের পিস্তল ডক্টর বরুণের হাতে তুলে দিলেন প্রাইম মিনিস্টার।
ট্রিগার চালানোর সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন আপনদেশে-ভিনদেশী সে অন্য সময়ের দূত। আর তৃপ্ত হাসি আর বুকে রক্ত নিয়ে লুটিয়ে পড়লেন প্রাইম মিনিস্টার বরুণ।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান, তন্ময় মুখার্জি (বংপেন)