ঢেলা
লেখক: সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
[কৈফিয়ত: সঠিক প্যাশটিস কি না ঠিক বলতে পারব না। তবে এটা ঘনাদার গল্প—কারণ ঘনাদা আছেন, বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেনের মেসের বাসিন্দারা আছে, বনোয়ারী, রামভুজও আছে। ঘনাদা তার নিজের কৃতিত্ব জাহির করেছেন মেসের বাসিন্দাদের কাছে আর তাঁর তস্য তস্য পূর্বপুরুষদের কীর্তিকলাপ বর্ণনা করেছেন সান্ধ্যভ্রমণকালে দক্ষিণ কলকাতার কৃত্রিম হ্রদের ধারে প্রবীণ নাগরিক শ্রোতাদের কাছে। এ গল্পটা এই দুইয়ের সংমিশ্রণ, তবে বলেছেন মেসের বাসিন্দাদের কাছে। পূর্বপুরুষের কীর্তি যেহেতু ইতিহাস তাই এখানে ইতিহাসে বর্ণিত স্থান আছে, ঐতিহাসিক ও কাল্পনিক পাত্র আছে, ঘটনা আছে তবে কালের বেলায় গল্পের খাতিরে কিছু কারচুপি করতে হয়েছে। তাতে ক্ষতি নেই। সত্যি বলতে এতো ইতিহাস নয়, গল্প (আড়ালে বলতে গেলে ঘনাদার গুল)।]
(১)
রবিবার দুপুরের খাওয়াটা বেশ ভালোই জমেছিল। নারকেল দেওয়া সোনামুগের ডাল, ঝুরি আলুভাজা, বাঁধাকপির তরকারি, কাঁসার বগী থালার দু-পাশে বেরিয়ে থাকা পাবদা মাছের ঝাল আর আমাদের বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেনের মেসের যে সবচেয়ে বড়ো কাঁসার জামবাটি আছে, তার দু-বাটি রেয়াজি খাসির মাংসের কালিয়া দিয়ে, প্রতি পদের সঙ্গে আলাদা করে ভাতের পাহাড় যখন প্রায় এক নিশ্বাসে শেষ করলেন, ঘনাদা তখন পঁয়তাল্লিশ থেকে নব্বই ডিগ্রীতে অধিষ্ঠান করছেন। এর পরেও চাটনি, মিষ্টি দই আর ডজন খানেক স্পেশাল রাজভোগ দিয়ে ঘনাদা যখন ইনিংসের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন, গৌর সখেদে বলে উঠল, “আজকাল খাওয়াটা কিন্তু বড্ড কমিয়ে দিচ্ছেন ঘনাদা।” বিষম খাবার ভয়ে কোনোমতে হাসি চেপে নিরবে গৌরের টিপ্পনিটা সবাই উপভোগ করলাম।
ছুটির মেজাজ, তাই দুপুর বেলাটা যে যার মতন একটু বিছানায় গড়িয়ে নিয়ে দোতলার আড্ডাঘরে এসে জমায়েত হলাম। কী ব্যাপার ঘনাদার দেখা নেই কেন? বেশ কিছুদিন হল ঘনাদা কেমন যেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। চারবেলা ঘনাদার পছন্দমাফিক ভালোমন্দ খাইয়ে তাঁর তুষ্টিবিধানের কোনো ত্রুটি রাখা হচ্ছে না। ঠান্ডা লড়াই চলার মতন কোনো ঘটনাও ঘটেনি। আমাদের সঙ্গে দিব্যি হেসে কথা বলছেন, শিশিরের সিগারেটের টিন থেকে সিগারেট ধার করাও অব্যাহত আছে, আড্ডাঘরে নিয়মিত আসছেন, আলোচনাতে দু-একটা ছোটোখাটো মন্তব্যও করছেন অথচ আসল বেলাতেই কেমন বার বার পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছেন। দু-একবার আমরা সলতেতে আগুন ধরাবার চেষ্টাও করেছি কিন্তু ওই পর্যন্তই—একটু ফুর ফুর করে জ্বলে আবার নিভে গেল। তবে কি ঘনাদার ঝুলি খালি হয়ে এল? তা হলে আর এই মেসে থেকে লাভ কী?
গতকাল গৌর তার কোন এক বন্ধুর সঙ্গে নিউ এম্পায়ারে ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ দেখে এসেছে। তারই গল্প সবিস্তারে আমাদের কাছে বলছিল। আমরাও খুব উৎসাহ ভরে শুনছিলাম আর তারই উচ্ছাসের ঢেউ যে তিনতলার টঙের ঘর পর্যন্ত যাচ্ছে সে বিষয়ে নিশ্চিত। আচমকা এক কানফাটানো বজ্রনিনাদে চারজনেই আঁতকে উঠলাম। এ তো ঘনাদার গলা। কাকে বকছেন?
“নিশ্চয়ই বনোয়ারীকে,” গৌর বলল, “আবার বোধহয় ব্যাটা ঘনাদার কোনো স্মৃতিবিজরিত অমূল্য দুষ্প্রাপ্য সম্পদ জঞ্জাল ভেবে ফেলে দিয়েছে। মনে নেই, আগেরবার ওই ভাঙা পেপারওয়েটটা ফেলে দিয়েছিল, যেটা নাকি ঘনাদার মতে আমাদের ছায়াপথের বাইরে হাজার হাজার কোটি মাইল দূর থেকে আসা টেকটাইট।”
“ঠিক, ঠিক, চল তো দেখি,” এই বলে আমরা হুড়মুড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখি ঘনাদা তাঁর টঙের ঘরের দরজার বাইরে আর বনোয়ারী দু-এক সিঁড়ি নীচে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। ঘনাদা আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ আমাদের দেখে থেমে গেলেন।
“কী ব্যাপার ঘনাদা? বনোয়ারী কী হয়েছে? কী করেছ?” এমনিতে তো ঘনাদার দয়ার শরীর। নিশ্চয়ই বনোয়ারী অজ্ঞতাবশে কোনো গর্হিত কাজ করে ফেলেছে, না হলে ঘনাদা এ হেন রুদ্রমূর্তি ধারণ করতেন না।
বনোয়ারী কাঁদো কাঁদো স্বরে ইনিয়ে বিনিয়ে যা বলল, তা হল, ঘনাদার ঘরে মশারি টানাবার জন্য দেওয়ালে লাগান একটা হুক একটু আলগা হয়ে গিয়েছিল, তাই সেটা ভালো করে ঠুকে দেবার জন্য উনি বনোয়ারীকে বলেছিলেন। ঘনাদার টেবিলের ওপর কদিন ধরে একটা বেলেপাথরের প্রায় গোলাকৃতির মোটা এবড়োখেবড়ো চাকতি গোছের ঢেলা বিরাজ করছিল। আমরাও দেখেছি। হয়তো রাস্তায় কোথাও অথবা সান্ধ্যভ্রমণের সময়ে লেকের ধারে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। বনোয়ারী হাতের কাছে কিছু না পেয়ে ওই ঢেলাটা দিয়ে হুক ঠুকতে গিয়ে খানিকটা পাথর ভেঙে দিয়েছে। ব্যাস, তাতেই ঘনাদা দূর্বাসা মুনির মতন ক্ষেপে উঠেছেন।
গৌর সব শুনে বলল, “ও এই ব্যাপার! না বনোয়ারী তুমি ঠিক করনি। বড়াবাবুকে না জিজ্ঞাসা করে ওটা দিয়ে হুক ঠোকা তোমার উচিৎ হয়নি। আর ঘনাদা, বনোয়ারী না বুঝে ভুল করে ফেলেছে, ওই সামান্য একটা রাস্তার ঢেলার জন্য…।”
ঘনাদা ঘরের দিকে ফিরছিলেন। গৌরের কথা শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে, শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাওয়ার মতন শান্ত কঠিন দৃষ্টি হেনে জলদ গম্ভীর স্বরে গৌরের কথাগুলো কেটে কেটে পুনরাবৃত্তি করে ঘনাদা বললেন, “ওই সামান্য একটা রাস্তার ঢেলার জন্য…। শিরিকেন কি জান? চিগ্রিকি, মাকিবিশি, কুশারিগামা নাম শুনেছ কখনও? ছশো তিরিশ বছর আগেকার ওই রকম ঢেলাগুলো যদি সাইতামার, হ্যাচিওজির আর ইয়াতসুকির ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া না যেত, তবে নিঞ্জাদের ইতিহাস আজ অন্যরকমভাবে লেখা হত।”
স্টেনগানের মতন পরপর এতগুলো গুলির আঘাতে বলাবাহুল্য আমরা চারজনেই ধরাশায়ী। নাঃ! এর পরে আর ঘনাদাকে কোনোমতেই ঘরে ফিরে যেতে দেওয়া যায় না। আড্ডাঘরে আসার জন্য কাকুতিমিনতি করতে লাগলাম। ঘনাদা একটু দ্বিধাগ্রস্ত। কী চাল দেবেন ভাবছেন। কিন্তু কিস্তিমাতটা শিবুই করল। বনোয়ারীকে বলল, “নীচে যাও। রামভুজকে বলো বিকেলের চা আর স্পেশাল ফিশফ্রাইয়ের চ্যাঙারিটা দোতলার বসার ঘরে নিয়ে আসতে।” ঘনাদা আর দ্বিরুক্তি করলেন না। আমাদের প্রায় আগেই আড্ডাঘরে এসে তার মৌরুসিপাট্টা আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিলেন।
শিশির একটু মাথা চুলকে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা ঘনাদা ওই কী যেন হ্যারিকেন আর কোন এক কুশারি মামার কথা কী সব বললেন ঠিক বুঝলাম না।”
রামভুজ চায়ের ট্রে আর পেছনে বনোয়ারী ফিশফ্রাইএর চ্যাঙারি আর কয়েকটা প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকল। ঘনাদা না দেখার ভান করে শিশিরের দিকে চেয়ে বললেন, “হ্যারিকেন, কুশারিমামা নয়—শিরিকেন আর কুশারিগামা। এগুলো সবই নিঞ্জাদের অস্ত্র।”
“নিঞ্জা মানে?” এবার আমার প্রশ্ন।
ইতিমধ্যে ঘনাদা ফিশফ্রাইয়ে কামড় বসিয়েছেন। পর পর চারখানা ফিশফ্রাই সাবাড় করে চায়ে চুমুক দিয়ে, শিশিরের নতুন সিগারেটের টিন থেকে সিগারেট নিয়ে লাইটার দিয়ে ধরিয়ে দুটো রামটান দিয়ে ঘনাদা বললেন, “নিঞ্জুৎসু জাপানের এক ধরনের মার্শাল আর্ট আর তাতে যারা দক্ষ তাদের বলা হয় নিঞ্জা।”
“কিন্তু কুং ফু আর ক্যারাটেকেই তো শুধু মার্শাল আর্ট বলে জানি, ঘনাদা!” গৌর তার সদ্য দেখা সিনেমার জ্ঞানের ভিত্তিতে বলে উঠল।
ঘনাদা গৌরের দিকে অনুকম্পার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “মার্শাল আর্ট মানে লড়াইয়ের কলাকৌশল। প্রাচীন রোমানদের যুদ্ধের দেবতা ছিল মার্শ। এই মার্শের নাম থেকেই এসেছে যুদ্ধবিষয়ক বিশেষণ মার্শিয়ালিস আর তার থেকেই ইংরেজিতে মার্শাল। শুধু কুং ফু, ক্যারাটে বা নিঞ্জুৎসু কেন, কুস্তি, বক্সিং, লাঠিখেলা, তরোয়াল খেলা, জুডো, জুজুৎসু, টেকোয়ান্ডো, হাপকিডো, সুমো, সাম্বো, বারিৎসু আরও কত কত রকম মার্শাল আর্ট আছে জানো? কালারিপায়াট্টু, সিলাম্বাম, কুট্টু ভারিসাই নাম শুনেছ কখনও? সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশ মিলিয়ে অন্তত প্রায় একশো নব্বই রকমের মার্শাল আর্ট আছে।”
“বারিৎসু কথাটা যেন কোথায় পড়েছি মনে হচ্ছে ঘনাদা,” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
ঘনাদা আমার দিকে তাকিয়ে একটু মৃদু হেসে বললেন, “শার্লক হোমসের ‘দা অ্যাডভেনচার অফ দা এম্পটি হাউস’ গল্পে যেখানে হোমস ওয়াটসনকে বলছেন যে তাঁর বারিৎসু জানা আছে। স্যার আর্থার কোনান ডয়েল এটাকে বারিৎসু লিখলেও আসল কথাটা বারতিৎসু। এটা জাপানি যুযুৎসু, জুডো, কিক-বক্সিং, লাঠিখেলা এ সবের একটা মিশ্র মার্শাল আর্ট যা এডোয়ার্ড বার্টন-রাইট নামের এক ইংরেজ ভদ্রলোক জাপান থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে এসে চালু করেন। তিনি এক অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করে এ বিষয়ে চর্চ্চা শুরু করেন। ইদানিং কালে এই বারতিৎসু ইংল্যান্ডে আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। আর একটা জিনিস জানবে, এখনকার এই ধরনের প্রায় সব মার্শাল আর্টের উদ্দেশ্য প্রধানত শরীর চর্চ্চা, মনঃসংযোগ, প্রতিযোগিতামূলক খেলা, আর আত্মরক্ষা। আসলে মার্শাল আর্ট কথাটা এই হাল আমলে ষাট-সত্তরের দশকে জনপ্রিয় হয়েছে হলিউড আর হংকং থেকে এ সব নিয়ে সিনেমা করার কারণে। তা না হলে এই সব কলাকৌশলতো প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে।”
নাঃ, আজ ঘনাদাকে কোনোমতেই থামতে দেওয়া হবে না। সুযোগ বুঝে কাজের ছুতো ধরে আবার তিনতলায় না চলে যান।
“কী যেন বলছিলেন?” ঘনাদা থামতেই শিবু আবার উসকে দিল। আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, “নিঞ্জাদের অস্ত্রের কথা… ।”
গৌর আমার পিঠে একটা থাবড়া মেরে কথা শেষ করতে না দিয়ে মুরুব্বির মতন বলে উঠল, “এই যে এখন এত ক্যারাটে নিয়ে চর্চা সুরু হয়েছে—এটা তো প্রথম শুরু হয়েছিল চিনের শাওলিন থেকে। তাই না ঘনাদা?”
ঘনাদা গৌরের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, “ক্যারাটে চিনের মার্শাল আর্ট নয় ওটা জাপানের। চিনে এর নাম কুং ফু আর কোরিয়াতে বলে টেকোয়ান্ডো। চিনের হেনান প্রদেশের সুংস্যান পাহাড়ের পাদদেশে এই শাওলিন বৌদ্ধমঠে যে প্রথম এই কুং ফুর প্রবেশ ও পরে প্রভূত উন্নতি সাধন হয়েছিল সে কথা নিশ্চিত। ইতিহাসে বলা হয়েছে বুদ্ধভদ্র নামক জনৈক ভারতীয় বৌদ্ধ সন্ন্যাসী খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে চিনে আসেন উই রাজবংশের সম্রাট শিয়াওয়েনের রাজত্বকালে। সম্রাটের অনুগ্রহে বৌদ্ধধর্ম প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি এই শাওলিন মঠ প্রতিষ্ঠা করেন এবং বা তুও নামে পরিচিতি লাভ করেন।
এর পর সপ্তম শতাব্দীতে অপর এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বোধিধর্ম ভারতবর্ষ থেকে চিনে আসেন মূলত ধ্যানকেন্দ্রিক বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে শিক্ষাদান করতে যা পরবর্তীকালে ছ্যান নামে চিনে আর জেন নামে জাপানে প্রসিদ্ধি লাভ করে। ইতিহাস বলে এই বোধিধর্মই শাওলিন মঠে প্রথম কুং ফুর প্রচলন করেন যা কালক্রমে ধীরে ধীরে সমগ্র পূর্ব এশিয়ায় সামান্য পদ্ধতিগত পরিবর্তন হয়ে বিভিন্ন নাম নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে, যেমন জাপানে ক্যারাটে বা কোরিয়ায় টেকওয়ান্ডো। এক সারা চিন দেশেতেই কুং ফুর অন্তত চারশো ধরনের স্টাইল বা সাবস্টাইল আছে। তিব্বত থেকে পূর্ব চিন সমুদ্র পর্যন্ত এশিয়ার দীর্ঘতম নদী ছাংইয়াং যা সমগ্র চিনের পেট চিরে চলে গেছে তার উত্তরের আর দক্ষিণের আলাদা আলাদা ধরনের স্টাইল আছে যা নর্দার্ন স্টাইল ও সাদার্ন স্টাইল নামে পরিচিত। তার মধ্যে অবশ্য শাওলিন, উইন চান, থাই জি, বাগুয়া ঝাং, জিং ই কুয়ান ও আরও বেশ কিছু স্টাইল আছে যা বিভিন্ন প্রদেশ ভেদে জনপ্রিয়। প্রায় সবগুলোরই নানান প্রতিষ্ঠান আছে প্রশিক্ষণের জন্য।
ঘনাদা একটু দম নেবার জন্য ফুরসুৎ নিতেই গৌর প্রশ্ন করল, “আচ্ছা ঘনাদা বোধিধর্ম তো বৌদ্ধসন্ন্যাসী আর অহিংসা তাঁদের মূলমন্ত্র। তা হলে তিনি কী করে এরকম সহিংস মার্শাল আর্টের প্রবর্তন করলেন যাতে কখনও কখনও মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তা হলে কি বুদ্ধদেবের মৃত্যুর হাজার বছর পর বৌদ্ধধর্মের নীতি পালটে গেল?”
মুখ দেখে বোঝা গেল গৌরের প্রশ্ন শুনে ঘনাদা বেশ প্রসন্ন হয়েছেন। হেসে বললেন, “ভালো প্রশ্ন করেছ।” গৌর আমাদের দিকে একটু গর্বের সঙ্গে তাকাল। ইস্, এই প্রশ্নটা আমার মাথাতেও অনেকক্ষণ ধরে ঘুরঘুর করছিল। জিজ্ঞাসা করব কি করব না ভাবছিলাম। আর গৌর আগেই দুম করে প্রশ্নটা করে আমায় টেক্কা মেরে কৃতিত্বটা নিয়ে নিল।
ঘনাদা সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে বললেন, “দেখ কুং ফু, ক্যারাটে যাই বল, সব মার্শাল আর্টই প্রধানত দ্বন্দযুদ্ধ। লাঠি, ছোরা, তরোয়াল বা কোনো রকম অস্ত্র ছাড়া যে দ্বন্দযুদ্ধ তার প্রধান অস্ত্র হাত আর পা আর সেগুলোর প্রয়োগ ও আটকানোর বিভিন্ন কলাকৌশলই মার্শাল আর্ট। অবশ্য কখনও-সখনও বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রেরও ব্যবহার হয়ে থাকে। এখন কুং ফুর সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের যে একটা যোগ রয়েছে সেটা অস্বীকার করা যাচ্ছে না। ইতিহাস বলে যে প্রায় দু-হাজার বছর আগে প্রথম বা দ্বিতীয় শতাব্দীতে চিনে হান রাজবংশের রাজত্বকালে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এই সিল্ক রুটের পথ ধরে বা তিব্বতের পথে চিনে বৌদ্ধধর্ম নিয়ে এসেছিল এবং ক্রমে ক্রমে বৌদ্ধ ধর্মের ধারণাটি চিনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
মার্শাল আর্ট ইতিহাসের বইগুলিতে বোধিধর্মের নাম বিশেষভাবে বলা হয়েছে যে তিনি শাওলিন মন্দিরে সন্ন্যাসীদের ধ্যান, মনঃসংযোগ, নম্রতা ও সংযমের মতো ধারণাগুলিকে প্রচার করে তাঁদের চিন্তাভাবনার পদ্ধতির পরিবর্তনই করেন। আর এও বলা হয়েছে যে তিনি বাস্তবে সন্ন্যাসীদের মার্শাল আর্টও শিখিয়েছিলেন। যদিও সত্যিই বোধিধর্মই মার্শাল আর্টের প্রবর্তক কি না এ নিয়ে কিছু মতভেদ আছে। কিন্তু এ কথা ঠিক যে তিনি শাওলিনে আসার পর এই সব মার্শাল আর্টের চর্চ্চা শুরু হয় এবং ক্রমে বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এমনকি স্থানীয় তাও মতবাদীদের মঠেও এই কুং ফুর চর্চ্চা শুরু হয়ে যায়। কালক্রমে বোধিধর্মের নামটা কুং ফুর প্রবর্তক রূপে ইতিহাসে স্থান পেলেও প্রকৃত সত্য তা নয়। সেই ইতিহাস বিশদভাবে লেখা ছিল জাপানের আসুকা ডেরা বা হোকো জি বৌদ্ধমঠের এক পরিতক্ত ঘরে তেরোশো বছর ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে অযতনে, অনাদরে ধূলিধূসরিত হয়ে পড়ে থাকা খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে লেখা একটি তালপাতার পুথিতে। দূর্ভাগ্যবশত এই অমূল্য পুথি আবিষ্কারের কিছুদিনের মধ্যে এক অবাঞ্ছিত দুর্ঘটনায় আগুন লেগে এই পুথিটি সম্পূর্ণ ভস্মিভূত হয়ে যায় আর তার ফলে মার্শাল আর্টের ইতিহাসের আসল সত্যটা চিরকালের জন্য অবলুপ্ত হয়।”
আমরা সবাই সমস্বরে ‘ইস্’ করে উঠলাম।
ঘনাদা শিশিরের দিকে একটু অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই শিশির তার ক্যাপস্টেনের টিন থেকে সিগারেট নিয়ে ঘনাদার দুই আঙুলের ফাঁকে ভরে লাইটার জ্বেলে ধরল। ঘনাদা সিগারেট ধরিয়ে পরপর তিনটে টান মেরে কানাডিয়ান ইঞ্জিনের মতন ধোঁয়া ছেড়ে আরম্ভ করলেন, “তোমরা কি সঙ্গম সাহিত্যের নাম শুনেছ?”
আমরা ঘনাদার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে মাথা নাড়লাম।
ঘনাদা বললেন, “মোটামুটিভাবে খ্রিস্টপূর্ব তিনশো থেকে শুরু করে তিনশো খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন তামিল কবি, সন্ত, দার্শনিকদের রচিত যে সকল রচনাবলী তাদের সমন্বয়কে বলে সঙ্গম সাহিত্য। আর এই ছয়শো বছরের কালকে বলা হয় সঙ্গম যুগ। তামিল ব্রাহ্মী হরফে কাব্যে রচিত এই সঙ্গম যুগের রচনাগুলিকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়—অকম আর পুরম। অকম প্রেম-ভক্তি রসাত্মক কাব্য আর পুরম প্রধানত বীরগাথা। সঙ্গম যুগের দুটো এপিক কাব্য শিলাপ্পাতিকারামুম আর মানিমেকালাইয়াম নিয়ে চর্চ্চা করার ইচ্ছায় আমি তখন তামিলনাড়ুর কুড্ডালোর জেলার চিদাম্বরম শহরে আমার বিশেষ বন্ধু আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও সাহিত্যের অধ্যাপক প্রফেসর আলাগাপ্পা সুব্রাহ্মন্যমের আমন্ত্রণে তাঁর অতিথি হয়ে বেশ কিছুদিন ছিলাম। প্রফেসর সুব্রাহ্মন্যম সঙ্গম সাহিত্যের একজন বিশেষজ্ঞ। এর ওপর তাঁর অনেক গবেষণাপত্র রয়েছে। মাদুরাই, কাঞ্চী, তাঞ্জোর, কুম্ভোকোনম প্রভৃতি নানান জায়গার বিভিন্ন শৈব, বৈষ্ণব, জৈন ও বৌদ্ধ মঠ-মন্দির ঘুরে ঘুরে অনেক প্রাচীন তালপাতার পুথি সংগ্রহ করেন ও তার থেকে সঙ্গম যুগের অনেক কবিদের রচনা তিনি উদ্ধার করেন।
প্রফেসর সুব্রাহ্মন্যমের আনুকূল্যে বিভিন্ন লাইব্রেরি ও মঠে সযত্নে রাখা সঙ্গম যুগে লেখা মূল পুথিগুলি দেখার সুযোগ ঘটল। কয়েকদিন নাড়াচাড়া করার পর প্রাচীন তামিল-ব্রাহ্মী হরফগুলি সড়গড় হওয়ায় মূল পুথিগুলো পড়তে আর অসুবিধা হল না। এই সঙ্গম সাহিত্য চর্চ্চা করতে গিয়েই আমি আদিমুরাই, সিলাম্বাম, কুট্টু ভারিসাই, ভার্মা কালাই আর কালারি পায়াট্টুদের সঙ্গে পরিচিত হই…”
আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম—সবারই কীরকম হতভম্ব অবস্থা। শিবু একটু মাথা চুলকে জিজ্ঞাসা করল, “এরা সব কারা ঘনাদা?”
গৌর একটু গম্ভীরভাবে শিবুর দিকে চেয়ে বলল, “এরা সব সঙ্গম সাহিত্যের দিকপাল কবিরা। তাই না ঘনাদা?”
ঘনাদা গৌরের দিকে একটু ক্ষমাসুন্দর চক্ষে চেয়ে বললেন, “না, এগুলো দক্ষিণ ভারতের প্রায় দু হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন প্রচলিত মার্শাল আর্টস…।”
গৌরের ঢোক গেলা মুখটা দেখে আমার খুব আনন্দ হল। বেশ হয়েছে। সবেতেই একটা সবজান্তা ওস্তাদি ভাব।
ঘনাদা সিগারেটে একটা লম্বা টান মেরে বললেন, “… স্থানভেদে ও প্রকৃতিভেদে এদের ভিন্ন ভিন্ন নাম। যেমন ধর, কুট্টু ভারিসাই, সিলাম্বাম, আদি মুরাই তামিল মার্শাল আর্ট আর কালারি পায়াট্টু কেরালা অঞ্চলের। এদের মধ্যে আবার কুট্টু ভারিসাই ছাড়া বাকিগুলোতে বিভিন্ন অস্ত্রের ব্যবহার আছে যেমন বাঁশের লাঠি, তরোয়াল বা ভালো, বর্শা বা কুন্থম, ভালারি যা দেখতে অনেকটা ব্যুমেরাঙ-এর মতন, কাট্টি বা বিশেষ ধরনের ছোড়া, কাস্তের ধরনের আরুভা আর খুব লম্বা চাবুকের মতন পাতলা লোহার পাতের নমনীয় তরোয়াল যাকে বলে উড়ুমি বা সুরুল পাট্টাই। কুট্টু ভারিসাই নিরস্ত্র লড়াই—শুধু হাত আর পায়ের ব্যবহার অর্থাৎ কিল, চড়, লাথি, ঘুসি, রদ্দা, কনুয়ের গুঁতো… ”
“রামগাট্টা,” গৌর টিপ্পনি কাটল।
ঘনাদা না শোনার ভান করে বলে চললেন, “… তবে এলোপাথাড়ি আনতাবড়ি নয়। আঘাত বা পালটা আঘাত—প্রত্যেকটার কিছু নিয়ম আছে, পদ্ধতি আছে, ব্যাকরণ আছে। এর জন্য দরকার নিঁখুত সময়জ্ঞান, সজাগ দৃষ্টি, মনঃসংযোগ, সংযম, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়ানর বিভিন্ন ভঙ্গিমা আর শারীরিক জ্ঞান। শরীরের কোন কোন জায়গায় কী ভাবে কতটা আঘাত করলে প্রতিপক্ষকে সহজে হারানো যায় তার জ্ঞান থাকা খুব দরকার। এ সমস্ত কিছুই জেনেছিলাম তাঞ্জোর শহরের সিলাম্বাম গুরু আয়াস্বামী মুরুগানের কাছে।
প্রফেসর সুব্রাহ্মণ্যমই আমাকে তাঞ্জোরে নিয়ে এসে তাঁর বিশেষ বন্ধু আয়াস্বামীর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বন্ধুর কাছে আমার কথা শুনে, কিছুটা আলাপ পরিচয়ের পর আয়াস্বামী এতটা অভিভূত হলেন যে কিছুতেই আমাকে হোটেলে থাকতে দিলেন না, তাঁর বাড়িতেই আতিথ্য গ্রহণ করতে হল। পুরোনো তাঞ্জোর শহরের ভেন্নার নদীর ধারে কোডি আম্মান মন্দিরের কাছে ওঁর বাড়ি। একতলা মাটির টালির দোচালা পাকা বাড়ি—সামনে টানা চওড়া বারান্দা, সিমেন্টের মেঝে। চারটে মোটা চৌকো কাঠের খুঁটি বারান্দার চাল ধরে রেখেছে। ভেতরে গোটা পাঁচেক ঘর। একটা ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা হল। বাড়ি ঘিরে অনেকটা খালি জমি-বাগান। একদিকে একটা বিশাল চারদিক খোলা আখড়া—মাটির মেঝে, মাথায় টালির চাল, চারদিকে মোটা মোটা চৌকো কাঠের খাম্বা দিয়ে ধরে রাখা। তার পাশে আর একটি মাঝারি ঘর, তাতে আছে নানারকম অস্ত্রশস্ত্র—বিভিন্ন সাইজের বাঁশের লাঠি, ঢাল-তরোয়াল, কাঠের গদা, নানা ধরনের ছোরা, ব্ল্যাকবাক হরিণের প্যাঁচানো শিঙের অস্ত্র মাডাভু, ধাতব চাবুক। কালারি পায়াট্টুতেও এই ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার আছে। আসলে কালারি পায়াট্টু আর সিলাম্বাম অনেকটা একই ধরনের।
আয়াস্বামীর বাবার প্রতিষ্ঠা করা এই সিলাম্বাম-কুট্টু ভারিসাই শিক্ষাকেন্দ্র। আয়াস্বামী নিজে একজন নামকরা শিক্ষাগুরু। বয়স তখন প্রায় ষাটের কাছাকাছি। শান্ত সৌম্য চেহারা। বেশ মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান, ফরসা, মাথার সামনে অনেকটা টাক, কপালে লাল তিলক, পাকা দাড়ি, কালচে-লাল ও সবুজ চওড়া জরিপাড়ের সাদা সিল্কের লুঙ্গির মতন করে পরা ধুতি আর গায়ে শুধু একদিকের কাঁধে ভাজ করা একটা সাদা সিল্কের চাদর। একনিষ্ঠ শিবভক্ত হলেও কোনো গোড়ামো নেই। বিপত্নীক। ঘরের কাজকর্ম ও রান্নাবান্না করার জন্য একটি বয়স্কা মহিলা আর একটি চাকর আছে। আয়াস্বামীর ভাগ্নে পেরুমলও এখানেই থাকে। আয়াস্বামীর নির্দেশ মতন পেরুমল আর একটি ছেলে দুজনেই এখন মার্শাল আর্টের শিক্ষা দিয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের সময় ও গ্রুপ ভাগ করা আছে। প্রায় জনা পঞ্চাশেক ছাত্র-ছাত্রী আছে। তার মধ্যে দু-তিনজন তামিল ফিল্মের অভিনেতাও আছে।
আয়াস্বামীর ঘরের সামনের টানা বারান্দায় দুটো চৌকি—শতরঞ্চি পাতা। তার ওপরে বসেই আমাদের গল্পগুজব হত। প্রাচীন দ্রাবিড়িয় মার্শাল আর্ট সম্বন্ধে বহু কিছুই জেনেছিলাম ওঁর থেকে। মাঝে মাঝে আখড়ায় নিয়ে গিয়ে বিপক্ষকে আঘাত হানা আর প্রতিরোধের বিভিন্ন কলাকৌশল ও দাঁড়ানোর নানারকম ভঙ্গিমা, পা চালানোর কৌশল সব পেরুমলকে সঙ্গে নিয়ে দেখাতেন।”
এই সব মার্শাল আর্টই দু-হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন আর তামিল সভ্যতা ও সংস্কৃতির অঙ্গ। এর মূল কারণ রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা। খ্রিস্টপূর্ব তিনশো শতাব্দী থেকে প্রায় দ্বাদশ শতাব্দী—এই দেড় হাজার বছর ধরে সারা মধ্য ও দক্ষিণ ভারত জুড়ে চোল, চালুক্য, রাষ্ট্রকূট, পল্লব, চেরা, পাণ্ড্য, সাতবাহন, কাকাতিয় সব বিভিন্ন রাজবংশ বিভিন্ন অঞ্চলে রাজত্ব করত। প্রত্যেকেই যে যার সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করত, ফলে এই প্রথম সহস্রাব্দের প্রায় পুরোটাই এই রাজবংশগুলো পরস্পরের সঙ্গে শুধু যুদ্ধ করেই কেটেছিল। যার যত সৈন্যবল সে তত শক্তিশালী এবং তাদের যুদ্ধে পারদর্শী করার ক্ষেত্রে এ সব মার্শাল আর্টের বিশেষ গুরুত্ব ছিল এবং শিক্ষা দেওয়া হত।
অনেক রাজাই যুদ্ধ জয়ের স্মারক হিসাবে বা ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য পাহাড় কেটে পাথরের বিশাল আকারের শিব, বিষ্ণু বা অন্য কোনো দেবদেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করত। দক্ষিণ ভারতে বিশেষ করে তামিলনাড়ু, কর্ণাটকের তাঞ্জোর, কাঞ্চী, মাদুরাই, কুম্ভকোনম, বাদামি, তিরুচিরাপল্লী, চিদাম্বরম অঞ্চলে দেখবে বিশাল বিশাল অজস্র প্রাচীন নামকরা সব পাথরের মন্দির। নিজেরা হিন্দু হলেও জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ সবার ছিল না। তাঁদের মঠ বা বিহারগুলোকেও অনেকে যথেষ্ট আর্থিক সাহায্য করত। শুধু তাই নয় সঙ্গীত, কাব্য-সাহিত্য, স্থাপত্য এ সব কিছুর খুব গুরুত্ব ছিল।
আয়াস্বামীর এই সব প্রাচীন মন্দিরগুলোর স্থাপত্য সম্বন্ধেও খুব জ্ঞান ছিল। ঠিক ছিল ওঁর সঙ্গে এই মন্দিরগুলো ঘুরে দেখব। এমন সময়ে হঠাৎ একদিন প্রফেসর সুব্রাহ্মণ্যম এসে হাজির। জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান প্রফেসর আসাহি কাওয়াবাতার পাঠানো একটি টেলিগ্রাম নিয়ে। আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নাগোয়া আসার জন্য বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছেন। টোকিও ন্যাশনাল মিউসিয়ামের অধিকর্তাও আমার আসার ব্যাপারে খুব উৎসাহী। আমাকে কলকাতার জাপান কনসুলেটের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করতে বলেছেন। প্রফেসর কাওয়াবাতার সঙ্গে আমার বহুদিনের পরিচয়। আনাতোলিয়া অর্থাৎ এশিয়া মাইনর, মঙ্গোলিয়া আর জাপানের সান্নাই মারুয়ামা, কামেগাওকা, ইয়োসিনোগারি অঞ্চলে পুরাতাত্ত্বিক অভিযানে একসঙ্গে কত গেছি। এবারের আমন্ত্রণও যে সেই ব্যাপারে তা তো বুঝতেই পারলাম।
যা হোক দক্ষিণ ভারতের পাট আপাতত চুকিয়ে কলকাতায় এসে জাপান কনসুলেটের অফিসে গিয়ে কনসুলেট জেনারেল আকিরা নাকামুরার সঙ্গে দেখা করলাম। নাকামুরার সঙ্গে অনেক আগে থেকে জাপানে থাকতেই পরিচয় ছিল। তখন ও জাপানের ফরেন মিনিস্ট্রির একজন জুনিয়র অফিসার ছিল। বহুকাল বাদে দেখা। আগের থেকে বেশ মোটা হয়ে গেছে। আমায় দেখে একগাল হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে হাত ঝাঁকিয়ে হ্যান্ডশেক করল। অনেক পুরোনো গল্প হল। আসলে আমার ডোসিয়ার তৈরিই ছিল—শুধু আমার কিছু সই সাবুদ বাদে। ছাড়ল না, নিয়ে গেল পার্ক স্ট্রিটে একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করাতে। ফিরে আসার পর আমার হাতে ভিসা, জাপান এয়ারলাইন্সের কলকাতা থেকে নাগোয়া যাবার টিকিট আর জাপানিস ইয়েনে কিছু রাহাখরচ গছিয়ে দিল।
হাতে দু-দিন সময় ছিল। এই ফাঁকে কয়েকটা দরকারি কাজ সেরে, কিছু প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস কিনে নিলাম। আমার ফ্লাইট ছিল রাত দশটায়। প্রায় পনেরো ঘণ্টার যাত্রা। পরের দিন নাগোয়ার চুবু সেন্ট্রেয়ার বিমানবন্দরে পৌঁছলাম তখন জাপানি সময়ে বিকেল সাড়ে চারটে। বিমানবন্দর থেকে বাইরে বেরিয়েই দেখি প্রফেসর কাওয়াবাতা একতোড়া ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখতে পেয়েই হেসে একটু নড করে এগিয়ে এলেন। টার্মিনালের কাছেই পার্কিং লটে ওঁর গাড়ি রাখা ছিল। একটা বড়ো সাদা ডাইহাতসু গাড়ি। তাতে করেই কাওয়াবাতার বাড়ি এলাম। নাগোয়া ইউনিভার্সিটির সাকুরায়ামা ক্যাম্পাসের কাছে শোয়া ওয়ার্ডে রাস্তার ওপরে ওঁর ছাই ছাই রঙের দোচালা দোতলা বাড়ি। পাশাপাশি আরও কয়েকটা প্রায় একই ধরনের বাড়ি আছে। গ্যারেজ না থাকলেও সামনে একপাশ দিয়ে গাড়ি রাখার জায়গা আছে। দোতলার গেস্ট রুমে আমার থাকার ব্যবস্থা। কাওয়াবাতার স্ত্রী হিনা নাগোয়া সিটি ইউনিভার্সিটি হাসাপাতালে চোখের ডাক্তার। আগে বার দুয়েক আমাদের সঙ্গে পুরাতত্ত্বের অভিযানেও গেছেন। হাসিখুশি ভালোমানুষ আর চমৎকার রান্নার হাত।
সেদিন একটু ক্লান্ত ছিলাম। তাই তাড়াতাড়ি ডিনার হল। চিকেন কারি-রাইস, রাইস বল, বয়েল্ড ভেজিটেবল আর পর্ক দিয়ে তৈরি নিকুজাগা। সেদিন সৌজন্যমূলক সাধারণ কথা ছাড়া আর কোনো কথা হল না। পরদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে মিসো স্যূপ, ভাত, গ্রিলড মাছ আর ডিম দিয়ে তৈরি তামাগোয়াকি খেতে খেতে আমাদের আসল কথা শুরু হল।
আসলে আমাকে জাপানে আমন্ত্রণ জানানোর কারণ ওসাকা শহরের কাছাকাছি নারা অঞ্চলের আসুকা ডেরা গ্রামের এক বুদ্ধ মন্দিরে একটি বহু প্রাচীন হাতে লেখা বই পাওয়া গেছে—কিন্তু কী তার ভাষা বা কী তার হরফ কেউই বুঝতে পারছে না। ফলে কী-ই বা বইয়ের বিষয়বস্তু তাও জানা যাচ্ছে না। সেটা একবার আমাকে দেখাতে চান। তা ছাড়া জাপানের হ্যাচিওজি শহরে একটা প্রাচীন দুর্গের অঞ্চল খনন করে কিছু প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে। প্রফেসর কাওয়াবাতা সেগুলো নিয়ে একটু পরামর্শ করতে চান।
এই আসুকা ডেরা মন্দিরে অনেক দেড় হাজার থেকে হাজার বছর প্রাচীন সংস্কৃত, পালি ও চিনে ভাষায় লেখা বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ আছে। তার মধ্যে বেশ কিছু ভারতবর্ষ থেকে চিনে ও পরে চিন থেকে কোরিয়া হয়ে জাপানে আসে। এই বইটি আসলে একটি তালপাতার পুথি—দুটি চন্দন কাঠের পাটা আর সিল্কের কর্ড দিয়ে বাঁধা। পুথিটি একটি কারুকার্য করা চন্দন কাঠের বাক্সের মধ্যে এমন ভাবে সিল করে রাখা ছিল যাতে কোন বাতাস ঢুকতে না পারে। বাক্সের এক পিঠের কাঠে তান্ত্রিক যন্ত্র, ত্রিশূল, শিবলিঙ্গ জাতীয় প্রতীক ও কিছু সাংকেতিক চিহ্ন খোদাই করা ছিল। কিন্তু বাক্সটি এমন ভাবে তৈরি যে কোনো দিক দিয়ে কোনো খোলার উপায় পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে নাগোয়ার নানযান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক ছাত্র যে ধর্মীয় প্রতীক নিয়ে গবেষণা করছিল, সে সাংকেতিক চিহ্নগুলো বিশ্লেষণ করে বাক্সের দুটো জায়গায় একসঙ্গে আঙুল দিয়ে চাপ দিয়ে ওপরের ঢাকনাটা খুলতে পারল। কিন্তু বাক্স খুললে কী হবে? পুথি তো কেউই পড়তে পারছে না। শেষে আসুকা ডেরা বৌদ্ধ মঠের মোহন্ত বোকুশি দাইশিন প্রফেসর কাওয়াবাতার শরণাপন্ন হলেন।
কাওয়াবাতা পুথি আর কাঠের বাক্সটা দেখে এ টুকু আন্দাজ করলেন যে এটি সম্ভবত ভারতবর্ষ থেকে এসেছে। তিনি নিজে অনেক প্রাচীন হরফের সঙ্গে পরিচিত হলেও এই পুথির হরফ তাঁর অজানা। সিন্ধু সভ্যতার হরফ পাঠোদ্ধার করা না গেলেও হরফের ধরণ তাঁর চেনা। মোহন্ত দাইশিন শুনে হতাশ হয়ে পড়লেন। কাওয়াবাতা তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, “এখনই ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি। আমার বিশ্বাস এই পুথি পড়ার মতন লোক একজনই আছেন যিনি বিশ্বের একজন নামজাদা প্যালিওগ্রাফার, পৃথিবীর যে কোনো প্রাচীন ভাষা, যাদের এ যাবৎ পাঠোদ্ধার করা গেছে, পড়তে তার জুড়ি নেই। আপনি আমাকে কিছুদিন সময় দিন কারণ তিনি এখন আফ্রিকা না দক্ষিণ আমেরিকা না প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো অজানা দ্বীপে আছেন বলা মুশকিল।” যা হোক কাওয়াবাতা জাপান কনস্যুলেটের মাধ্যমে অনেক খোঁজাখুঁজি করে আমাকে তার পাঠায়।
সেদিন ছিল বুধবার। দু-দিন কাওয়াবাতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে, ব্যস্ত থাকবেন। তাই ঠিক হল শুক্রবার আমরা হ্যাচিওজি দুর্গে যাব। সেখানে তখন কাওয়াবাতার নেতৃত্বে জাপানের এজেন্সি অফ কালচারাল অ্যাফেয়ার্সের অর্থসাহায্যে খোঁড়াখুঁড়ি ও গবেষণার কাজ চলছে। দুজন রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট আর জনৈক প্রোজেক্ট অফিসার মি. ফুকুদা দেখাশোনা করছে। আমি এই ফাঁকে দু-দিন নাগোয়া ইউনিভারসিটি লাইব্রেরিতে কিছু বইপত্তর, জার্নাল নাড়াঘাঁটা করলাম আর এক ফাঁকে সিটি মিউসিয়াম ঘুরে এলাম। ওখানকার আর্কেওলজিক্যাল সেক্সনের কিউরেটর মি. তানাকা আমার পুরোনো বন্ধু।
শুক্রবার আমি আর কাওয়াবাতা আমাদের পরিকল্পনামাফিক ব্রেকফাস্টের পর হ্যাচিওজি রওনা হলাম। প্রায় সাড়ে তিনশো কিলোমিটার পথ। নাগোয়া থেকে ট্রেনে এলাম শিন-ইয়াকোহামা স্টেশন। সেখান থেকে লোকাল ট্রেন ধরে হ্যাচিওজি। স্টেশনের বাইরে গাড়ি নিয়ে ফুকুদা দাঁড়িয়েছিল। এখানে দিন তিন-চারেক থাকব। হোটেল বুক করা আছে। তাই সোজা স্টেশন থেকেই চলে এলাম হ্যাচিওজি দুর্গে।
টোকিও থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পশ্চিমে ওকুতামা পর্বতমালার পাদদেশে এই হ্যাচিওজি শহর। তিন দিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই হ্যাচিওজি অববাহিকা যার শুধু পূর্বদিক অর্থাৎ টোকিওর দিক খোলা। দুটো পর্বত শৃঙ্গ মাউন্ট তাকাও আর মাউন্ট জিনবা ট্রেকিঙের জন্য খুব জনপ্রিয়। এর মধ্যে এ দুটোতে উঠতে হবে ঠিক করলাম। সেনগকু সময়ের হ্যাচিওজি দুর্গটি এখন শুধুই ধ্বংসাবশেষ। মোটামুটি ১৪৬৭ থেকে ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় জাপানের সেনগকু জিদাই বা গৃহযুদ্ধের কাল। সামন্ততান্ত্রিক জাপানে এ সময়টা চারজন সম্রাটের রাজত্বকাল হলেও সবারই ক্ষমতা খর্ব হয়েছিল। বরঞ্চ সোগুন আর ডাইমিওরা অনেক বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল।”
“এরা কারা ঘনাদা?” শিবু যেন আমাদের সবার হয়েই জিজ্ঞাসা করল।
ঘনাদা বললেন, “সম্রাট নিয়োজিত জঙ্গী শাসকদের বলা হত সোগুন। দেশের সেনাবাহিনী, শাসন ক্ষমতা, রাজনৈতিক ক্ষমতা সব এদের হাতেই ছিল। আর এদেরই অধীনে যে সমস্ত যুদ্ধবাজ সামন্ত প্রভুরা ছিল তাদের বলতো ডাইমিও। এরা অনেকটা মধ্যযুগে ইংল্যান্ডের ব্যারনদের মতন। ১৩৩৩ সাল থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আশিকাগা গোষ্ঠী ছিল জাপানের মধ্য অঞ্চলের সোগুন বা জঙ্গী শাসনকর্তা। তাদের রাজধানী ছিল বর্তমান কিওটো। সীমানা অঞ্চলে ডাইমিওরা স্বাধীনভাবে শাসন করত। সেনগকু কালে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য এইসব সোগুন ও ডাইমিওরা নিজেদের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই করত। ১৪৬৭ থেকে ১৪৭৭ এই দশ বছরের গৃহযুদ্ধে সেই সময়ের সোগুনের গুপ্তহত্যার পর আশিকাগাদের পতন হয়। তার পরেই সোগুনেট অর্থাৎ বংশানুক্রমিক জঙ্গী একনাকত্বের ক্ষমতা দখলের জন্য বিভিন্ন ডাইমিউদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৬০৩ সাল নাগাদ টোকুগাওয়া নামের এক অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ডাইমিও দেশের শাসনভার হাতে নেয় আর এই টোকুগাওয়া সোগুনেট আড়াইশো বছর ধরে রাজত্ব করে।
এই গৃহযুদ্ধের সময়ে গুপ্তচরবৃত্তি, গুপ্তহত্যা, ষড়যন্ত্র, গেরিলা যুদ্ধ ও নাশকতামূলক কাজের জন্য এক দল লোক বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ লাভ করত যাদের বলা হত নিঞ্জা বা শিনোবি। এরা ছিল পেশাদার গোষ্ঠী। ডাইমিওরা এদের অর্থের বিনিময়ে নিযুক্ত করত। সামুরাইয়ের নাম তো শুনেছ। তারা ছিল সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর বংশানুক্রমিক যোদ্ধা আর তাদের সমাজে যথেষ্ট সম্মান, প্রতিপত্তি ছিল। কিন্তু এই নিঞ্জারা ছিল নিম্নস্তরের। সমাজের চোখে ছিল কিছুটা হেয়। এরা ছিল যেমন সুদক্ষ, তেমনই নিষ্ঠুর প্রকৃতির। গোপনে ছদ্মবেশে নিঃশব্দে এসে দ্রুত কাজ করায় এদের জুড়ি মেলা ভার ছিল। তাদের এই মার্শাল আর্টকে বলা হত নিঞ্জুৎসু। কিন্তু অনেকের মতে নিঞ্জুৎসু মার্শাল আর্ট নয়। কারণ এদের উদ্দেশ্য আত্মরক্ষা নয়। উলটে এরা চোরাগোপ্তা আক্রমণ করে হত্যা করত। এরা গুপ্তচর, গুপ্তঘাতক। এদের মধ্যে ইগা আর কোকা এই দুই গোষ্ঠীর নিঞ্জারা ছিল সবথেকে নামকরা।
ওই সময়কালে হোজো নামে এক খুব ক্ষমতাশালী সামুরাই পরিবার ছিল। তখন যাকে কান্ত অঞ্চল বলত অর্থাৎ এখনকার টোকিও ও আশপাশের বেশ খানিক জায়গায় তাদের রাজত্ব ছিল। এই গোষ্ঠীর হোজো উজিতেরু নামে এক জঙ্গী নেতা ১৫৭০ সালে হ্যাচিওজিয়ামা পাহাড়ের ওপরে এই হ্যাচিওজি পার্বত্য দুর্গটি তৈরি করে, তাদের অধীন পশ্চিমের অঞ্চলগুলো রক্ষা করার জন্য। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চওড়া পাথরের ইট দিয়ে তৈরি সিঁড়ি উঠে গেছে। উঁচু থেকে নীচে শত্রুপক্ষের ওপর নজর রাখা সুবিধে। প্রায় বিরানব্বই একর জায়গা নিয়ে ছিল এই দুর্গ।
১৫৯০ সালের তেইশে জুন আরেক শক্তিশালী যুদ্ধবাজ সামুরাই টয়োটোমি হিদেয়োশি হোজোদের আরেকটি দুর্গ ওডাওয়াড়া আক্রমণ করে। যুদ্ধে হেরে গিয়ে হোজো উজিতেরু হারাকিরি করে অর্থাৎ নিজের পেট কেটে আত্মহত্যা করে। এরপর টয়োটোমি হ্যাচিওজি দুর্গকে আক্রমণ করে তাকে একেবারে গুঁড়িয়ে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়।
এখন এই দুর্গ শুধুই ধ্বংসাবশেষ। চারিদিকেই ঘন জঙ্গল, ঘাস মাটিতে ঢাকা পাথুরে সিঁড়ি, মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো চাঁই, নীচে শুকনো খাদ। এক জায়গায় হোজো উজিতেরুর কবর—পাথরের বেদীর ওপর ছোটো বড়ো স্তম্ভ। আরও দু এক জায়গায় ছোটো ছোটো পাথরের স্তম্ভ—বোঝাই যায় যুদ্ধে মৃত কোনো সম্ভ্রান্ত যোদ্ধাদের কবর। এলাকাটার দুটো ভাগ—একভাগ পাহাড়ের পাদদেশে যাকে বলে গোশুদেন, যেখানে হোজো পরিবারের রাজপ্রাসাদ ছিল। পাথরের সিঁড়ি, মোটা মোটা দেওয়ালের পাঁচিলের ভাঙা অংশ রয়েছে। শুকনো খাদের ওপর দিয়ে গোশুদেন যেতে হলে সেতু পেরতে হয়। নতুন করে সেই সেতু করা হয়েছে। এর নাম হিকিহাসি। আর এক ভাগ পাহাড়ের ওপর হনমারু, দুর্গের প্রধান প্রতিরক্ষামূলক অংশ। পাহাড়ের ধার দিয়ে এখানে ওখানে পাঁচিলের ভাঙা অংশ। এক জায়গায় তেঙ্গুর একটা বিরাট পাথরের স্ট্যাচু রয়েছে। গোশুদেন থেকে হনমারু পায়ে হেঁটে ঘণ্টা দেড়েক লাগে।
“তেঙ্গু কে ঘনাদা?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“তেঙ্গু জাপানের লোককথার এক দুষ্ট ভৌতিক চরিত্র যাকে কোনো উদ্ধত ও গর্বিত ব্যক্তির আত্মা মনে করা হয়। পাহাড়ি এলাকার গাছে থাকে। ছবিতে এর বিশাল নাক আর খুব রাগী মুখ আর লাল পোশাক পরা, হাতে পালকের পাখা দেখা যায়। এই দুর্গ অঞ্চল ভূতুড়ে এলাকা বলে বিশেষভাবে খ্যাত। সাতশো বছর আগে এখানে যে ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল তাতে হাজার হাজার লোক নৃশংসভাবে মারা গিয়েছিল।
অনেকেই বলে রাত্রে বিশেষ করে পূর্ণিমা বা খুব কুয়াশা কিংবা বৃষ্টির রাতে পুরুষদের চিৎকার, মহিলাদের ও শিশুদের কান্না, গুলির শব্দ, ঘোড়ার ডাক, তরোয়ালের ঝনঝনানি শোনা যায়। গোশুদেনে একটা জলপ্রপাত আছে। সে জায়গাটা নাকি বেশি ভূতুড়ে। জনশ্রুতি যুদ্ধের দিন এখানে হোজো পরিবারের মহিলারা শিশুদের নিয়ে গলা কেটে, ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। কেউ কেউ নাকি মহিলাদের আবছা আবছা দেখেওছে। অনেকেই বলত যে এখানে কেউ আসুক মৃত আত্মারা চায় না। তাই এখানে বহুকাল কেউ আসত না। পরে স্থানীয় অধিবাসীরা এখানে মৃতদের উদ্দেশে কিছু স্মারক স্তম্ভ স্থাপন করে ফুলটুল দিত আর এখনও পর্যটকরা দিয়ে থাকে। আমি অবশ্য একা অনেক রাতের দিকে ঘুরেছি, পাহাড়েও উঠেছি। কিন্তু কিছুই দেখিনি বা শুনিওনি। এখন তো এটা একটি অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র।
প্রফেসর কাওয়াবাতা তখন জাপানের গৃহযুদ্ধ ও নিঞ্জাদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এই কালেই নিঞ্জাদের উদ্ভব হয় আর তাদের দক্ষতার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই কালের ইতিহাসের জন্য কাওয়াবাতা হ্যাচিওজি, সাইতামা অঞ্চলের ওডাওয়াড়া, ইয়াতসুকি, হাচিগাতা ও আরও কিছু ওই সময়ের দুর্গগুলোর ধংসাবশেষ থেকে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছিলেন। হ্যাচিওজির এখান থেকে কিছু কয়েন, নানারকম পটারি, বর্ম, কিছু অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেল। এক জায়গায় জঙ্গলের রাস্তায় যেতে যেতে কিছু কিছু অদ্ভুত জিনিস আমার চোখে পড়ল—কয়েকটা পাথরের গোল গোল চাকতি আর কিছু পোরসিলিনের ছোটো বড়ো খেলার মার্বেল কিন্তু তাতে চারদিকে চারটে ছোটো ছোটো গজালের মতন বেরিয়ে আছে—ও রকম গজাল না থাকলে খেলার গুলি ভাবতাম। যা হোক ওগুলো ধুলো পরিষ্কার করে আমাদের ক্যাম্পে পাঠাতে বললাম। গোশুদেনের কাছে খানিকটা সমতল জায়গায় টেন্ট করে আমাদের সাময়িক ক্যাম্প ছিল।
আমি আর কাওয়াবাতা লাঞ্চের পর ওই চাকতি আর স্পাইক দেওয়া গুলিগুলো নিয়ে আলোচনায় বসলাম। কাওয়াবাতা বলল, ‘এরকম গোলাকার সবজে পাথর আমি দু-একটা দেখেছিলাম বটে কিন্তু কোনো সাধারণ স্বাভাবিক পাথর ভেবে গুরুত্ব দিইনি। তবে এই স্পাইক দেওয়া মার্বেল আমার চোখে পড়েনি। আপনি কী সন্দেহ করছেন?”
আমি পোরসিলিনের মার্বেলগুলো হাতে নিয়ে খানিক চিন্তা করে বললাম, ‘স্পাইক না থাকলে আমি এগুলোকে খেলার মার্বেল ভাবতাম। সাইজও একই রকম, এক থেকে দুই সেন্টিমিটার। যদিও মহেঞ্জোদারো, মেসোপটেমিয়া, ইজিপ্টের সভ্যতার কালে মার্বেল খেলার প্রমাণ পাওয়া গেলেও চিন, জাপান, কোরিয়ায় ঠিক এরকম মাটিতে গোল মার্বেলের খেলার ইতিহাস নেই। জাপানে ছোটো মেয়েরা যেটা খেলে সেটা ওহাজিকি—তাও আবার কয়েনের মতন চাকতি দিয়ে। আবার হাতগুলতি ছিয়ে ছুড়ে পাখি মারার জন্যও নয় কারণ স্লিংশট বা হাতগুলতি এসেছে ১৮৬০ সালের পরে—চার্লস গুডিয়ারের ভালকানাইসড রবার আবিষ্কারের পরে। এই স্পাইকগুলো দেখুন শক্ত আর ছুঁচোলো। তাই আমার সন্দেহ এটা মনে হয় ক্যালট্রপ বা মাকিবিশি ধরনের।”
“এগুলো কী ঘনাদা?” শিবু জিজ্ঞাসা করল।
“আড়াই-তিন ইঞ্চি মাপের দুটো লোহার একটু বাঁকানো ডাঁটি যাদের দুটো করে মুখই খুব ছুঁচোলো এমনভাবে আড়াআড়িভাবে জোড়া দেওয়া হয় যে, যেভাবেই হোক মাটিতে পড়লে তিন পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর বাকি পা-টা ছুঁচোলো মুখ নিয়ে খাড়া হয়ে থাকবে। এটাকে বলে ক্যালট্রপ। এরই জাপানি সংস্করণ মাকিবিশি। যুদ্ধের সময়ে শত্রুপক্ষের অগ্রগতিকে কিছুটা বাধা দেবার জন্য রাস্তায় ছড়ান হত। ক্যালট্রপের ছুঁচোলো ফলাটা ঘোড়ার খুরে বা পদাতিক স্যান্ডেলের তলায় গেঁথে যেত। আর সেগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে আবার যেতে কিছুটা সময় লাগত। কখনও কখনও ঘোড়া বা সৈন্য সে রকম আহত হলে খুঁড়িয়ে চলত। তাতে বিপক্ষের আক্রমণ করতে সুবিধা হত। এ হচ্ছে ল্যান্ডমাইনের আদি পুরুষ। হ্যাঁ, যা বলছিলাম।
কাওয়াবাতা একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলল, ‘কিন্তু ক্যালট্রপ বা মাকিবিশির আকার আলাদা আর সেগুলো ধাতুর তৈরি…। আর আপনি যা ভাবছেন সেটা হয়তো সম্ভব। তবে আরও প্রমাণ চাই। অন্য দুর্গেও দেখতে হবে। আর গোল পাথরগুলো কি স্বাভাবিক নয়? আপনার কী মত?’
আমি পাথরগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। তারপর একটা পাথর তুলে নিয়ে ধারগুলো মন দিয়ে দেখে বললাম, ‘হ্যাঁ, পাথরগুলো স্বাভাবিক তো বটেই, কিন্তু এই গোলাকৃতিটার ধরণটা আমার স্বাভাবিক ঠেকছে না।’
এই বলে পাথরটা ওঁর হাতে দিয়ে বললাম, ‘পাথরগুলো কোয়ার্টজাইট স্যান্ডস্টোনের। এই দেখুন পাথরটা ছেনি দিয়ে কেটে গোল করা হয়েছে। ছেনির দাগও বেশ স্পষ্ট। ওপর নীচের তল কতকটা সমান করার চেষ্টা হয়েছে। চল্টা ওঠার দাগ আছে। ধারে দেখুন, এবড়ো-খেবড়ো হলেও বেশ ধারালো। আবার এটা দেখুন ষড়ভূজ ধরনের। সাইজেও ছোটো বড়ো আছে। আমার মনে হচ্ছে এগুলো শত্রুপক্ষকে ছুড়ে আঘাত করার জন্য। আচমকা ভোঁতা জোর আঘাতে তারা হকচকিয়ে যাবে, ব্যথাও পাবে আর ঘোড়ার পায়ে মারলে সে খোঁড়াও হয়ে যেতে পারে। এতে করে শত্রু সৈন্যের অগ্রগতি অত দ্রুত আর হবে না।’
কাওয়াবাতা বলল, ‘সে তো এমনি পাথর ছুড়লেও হত। খামোখা খেটেখুটে এরকম চাকতি করার কী দরকার?”
আমি একটু হেসে বললাম, ‘চাকতির ওপর নীচ অনেকটা সমতল বলে একে ঘুরিয়ে জোরে ছুড়লে বাতাসের বাধা এমনি পাথরের থেকে অনেক কম হয় আর ঘুরতে থাকার জন্য টাল খায় না বলে ডিসকাস বা ফ্রিসবির মতন উড়ে অনেকটা দূর বেশি যেতে পারে। এর আমার তো মনে হচ্ছে এই গোলাকার পাথর আর স্পাইক দেওয়া গুলিগুলো শিরিকেন আর মাকিবিশির আদিরূপ।’
কাওয়াবাতা খানিক চিন্তা করে বলল, “কিন্তু নিঞ্জাদের প্রথম দিকের এ যাবৎ যত অস্ত্র পাওয়া গেছে সবই তো লোহার। আর শিরিকেন তো সোজা বা একটু বাঁকানো যোগ চিহ্নের মতন, ফলাগুলো সোজা ছোড়ার মতন ধারাল। পরে তো অনেক ফলাযুক্ত পাওয়া গেছে। আর মাকিবিশিতো অনেকটাই রোমানদের ক্যালট্রপের ধরনের।”
“কেন জাপানের এডো যুগের প্রথম দিকে পাওয়া শিরিকেনগুলোর মধ্যে কিছু অষ্টভুজ আকারের লোহার চাকতি পাওয়া যায়নি যাদের শীর্ষবিন্দুগুলো চোখা আর ধারাল?” কাওয়াবাতা ইতিবাচক মাথা নাড়ল। আমি বললাম, “আপনি আমাদের মহাকাব্য মহাভারতের ইংরেজি অনুবাদ পড়েছেন। মনে আছে শ্রীকৃষ্ণ চেদীরাজ অত্যাচারী শিশুপালকে হত্যা করেছিলেন সুদর্শন চক্র দিয়ে যেটা দেখতে অনেকটা সাইকেলের চেনের চাকতি গিয়ারের মতন। কিন্তু এর একশো আটটা দাঁত অত্যন্ত ধারালো আর অষ্টধাতুর। আমার মনে হয় চৈনিক অথবা ভারতীয় পরিব্রাজকদের মধ্য দিয়ে আসা এই সুদর্শন চক্রের ধারণা প্রথমে চিন ও পরে জাপানে এসেছে আর তা পরবর্তীকালে শিরিকেনের রূপ নিয়েছে।”
“এডো যুগ কি, ঘনাদা? শিবুর প্রশ্ন।
ঘনাদা চুপ করে শিশিরের দিকে তাকাতে শিশির তাড়াতাড়ি তার সিগারেটের টিন খুলে একটা সিগারেট ঘনাদার দু-আঙুলের ফাঁকে গুঁজে লাইটার দিয়ে ধরিয়ে দিল। চোখ বুজে আয়েশ করে সিগারেট টানতে টানতে বললেন, “১৬০৩ সাল থেকে ১৮৬৭ সালে জাপানে সেংগেকু জিদাই বা গৃহযুধের কাল শেষ হয়। এক শক্তিশালী ডাইমিও টোকুগাওয়া ইয়েসু অন্যদের পরাজিত করে শোগুনেট সামরিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এই পারিবারিক গোষ্ঠির বংশধররা ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত সোগুন নির্বাচিত হয়ে রাজত্ব করে। এই কাল ঐতিহ্যবাহী জাপানের শেষ সময়, অভ্যন্তরীণ শান্তি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সময়। এই কালকে টোকুগাওয়া যুগ, বা এডো যুগও বলে।
হ্যাচিওজিতে দিন তিনেক কাটিয়ে, আমি আর কাওয়াবাতা নাগোয়া ফিরে এলাম। ওর দুই রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট প্রত্নবস্তুগুলো পরিষ্কার করে, নম্বর দিয়ে লিস্ট করে, প্যাকিং করে মি. ফুকুদার তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসবে। আমরা বুলেট ট্রেনে ইয়াকোহামা হয়ে নাগোয়া ফিরে এলাম, তখন বিকেল বেলা। হিনা বাড়িতেই ছিল, তাঁর ডিউটি অফ ছিল সেদিন। এসে হিনার কাছে শুনলাম আসুকা ডেরার মন্দির থেকে মোহন্ত দাইশিন ফোন করেছিলেন। হিনা গ্রীন টি বা জাপানিদের মাত্চা, দুধ আর মধু দিয়ে বানালেন আর তার সঙ্গে স্ন্যাক্স সেন বে বা রাইস ক্র্যাকার আর দানগো বা জাপানিস ডামপ্লিং। গল্প, জোকস, হাসিঠাট্টা করতে করতে চা খাওয়া হল। চায়ের পর কাওয়াবাতা মোহন্তকে ফোন করলেন। কথাবার্তা হল। এটা সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ। দিন দুয়েক পর ছাত্রদের প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষা শেষ হয়ে ছুটি হয়ে যাবে। তাই অক্টোবরের ২-৩ তারিখ নাগাদ আমরা আসুকা ডেরা যাব।
প্রফেসর কাওয়াবাতা এ কদিন ইউনিভার্সিটির কাজে ব্যস্ত রইলেন, হিনাও তাঁর হাসপাতালের ডিউটিতে। আমি বাড়িতেই রইলাম। হিনা আমার খাবার করে রেখে যেতেন। আমি মাইক্রোওভেনে গরম করে নিতাম। তখন জাপানের বাজারে মাইক্রোওভেন নতুন এসেছে। কাওয়াবাতার স্টাডিতে অনেক আর্কেওলজির বই আর জার্নাল ছিল। আমি সারাদিন পড়ার মধ্যেই ডুবে রইলাম। তেসরা অক্টোবর আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে আসুকা ডেরা রওনা হলাম কাওয়াবাতার গাড়িতে। একশো সাতচল্লিশ কিলোমিটার পথ, প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগল বুদ্ধমন্দিরে পৌঁছতে।
নারা প্রশাসনিক এলাকার তাকাইচি জেলার আসুকা গ্রামে জাপানের প্রাচীনতম বৌদ্ধমন্দিরগুলোর অন্যতম এই আসুকা ডেরা। ডেরা কথাটার মানে মন্দির। আসুকা-ডেরা বা হোকো-জি মন্দির খ্রিস্টীয় ৫৮৮ সালে স্থানীয় সোগা গোষ্ঠীর শক্তিশালী নেতা সোগা নো উমাকো তৈরি করেছিলেন। জাপানে একদম প্রথম দিকে বৌদ্ধধর্মের প্রসারে এই সোগা নো উমাকো এক যন্ত্রস্বরূপ ছিল। আদি মন্দিরটি আকারে আর আয়তনে অনেক বড়ো ছিল, যেখানে তিনটি প্রধান হল ছিল। বিভিন্ন সময়ে মন্দিরটি আগুন লেগে, ভূমিকম্পে একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমান মন্দির ও অন্যান্য বাড়িগুলো এডো যুগে তৈরি। ধ্বংস হওয়া মন্দিরের কিছু বাড়িঘর সরিয়ে এনে নারা শহরে এক নতুন মন্দির কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছিল যার নাম গঙ্গো-জি।
গাড়ি মন্দিরের গেটের কাছে পৌঁছে দাঁড়াল। আমাদের গাড়ি থেকে নামতে দেখে মোহন্ত দাইসিন আর কয়েকজন মুন্ডিত মস্তক কালো রোব পরা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, জাপানি ভাষায় সৌর্য, হাত জোড় করে হেসে এগিয়ে এলেন ও জাপানি কায়দায় বাও করলেন। আমরাও হাত জোড় করে বাও করে প্রতি নমস্কার জানালাম। মোহন্ত দাইসিনের বয়স আন্দাজ সত্তর; পরিচ্ছন্ন, পবিত্র, তপঃক্লিষ্ট চেহারা। নিঁখুত কামানো মাথা, দাড়ি-গোঁফ—শান্ত সমাহিত মুখ, রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘শুভ্র ললাটে ইন্দু সমান ভাতিছে স্নিগ্ধ শান্তি।’ পরনে সাদা কিমোনোর ওপর কালো রোব যাকে বলে কোরোমো আর তার সঙ্গে গায়ে জড়ানো লালচে হলুদ চাদর বা কাষায় ডান দিকে বগলের তলা দিয়ে এসে বাঁ কাঁধের ওপর ফেলা। প্রাথমিক আলাপ পরিচয়ের পর দাইসিন আমাদের নিয়ে মন্দিরে এলেন।
মন্দির চত্বর সুন্দর বাগান। মাঝে বৌদ্ধধর্মের ন্যায়-নীতির রক্ষক দেবতা ফিউডো মিওর পাথরের স্ট্যাচু। আমরা হলের ভেতর এলাম। একটা শান্ত, ঠান্ডা, পরিচ্ছন্ন, পবিত্র পরিবেশ। শেষ প্রান্তের মাঝখানে প্রায় পৌনে তিন মিটার উঁচু ব্রোঞ্জের বুদ্ধ বা শাক্যমুনির মূর্তি। শোনা যায় তোরি বিশি নামক জনৈক চৈনিক শিল্পী ৬০৯ শতাব্দী নাগাদ এই মূর্তি তৈরি করেন। একসময়ে আগুন লেগে যখন পুরো মন্দির ধূলিসাৎ হয়ে যায়, এই মূর্তির অর্ধেক মুখ পুড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো ক্ষতি হয়নি। এ ছাড়াও হলে বোধিস্বত্ব রূপে রাজকুমার শোতোকুর একটি কাঠের মূর্তি আছে। মন্দিরের পেছনে একটি ছোটো বাগান—বেরোবার পথে দেখা যায়। তার রাস্তার পাশে কাচের বাক্সে কিছু প্রত্নবস্তু রাখা আছে যা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার হওয়া।
লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে, দাইসিন আমাদের নিয়ে ডাইনিং হলে এলেন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আদর্শ ঐতিহ্যবাহী নিরামিষ খাবার শোজিন রিওরি—ভাত, মিশো স্যুপ, নানারকম সবজি আর দেসার্ট, সয়াবিনের দুধ জমান পনিরের মতন দেখতে তোফু। সুকুবো অর্থাৎ যেখানে সন্ন্যাসীরা থাকেন তার দোতলায় দুটি অতিথি রুমে আমাদের দুজনের জন্য দুটি আলাদা বড়ো ঘর দিলেন। মন্দির থেকে বেরিয়ে লক্ষ করেছিলাম একটি হুডখোলা মিৎসুবিশি উইলি জিপ। খেতে বসে দেখলাম একটি বেশ দশাশই চেহারার সন্ন্যাসী—আপনমনে নিবিষ্ট মনে খাচ্ছে। চোখে আবার গোল রিমলেস চশমা। মুখের ভাব শান্ত কিন্তু ঠিক সৌম্য বলে আমার মনে হল না, কেমন যেন একটা ভিজে বেড়াল ভাব। সকালবেলায় দাইসিন যখন অন্যান্য সন্ন্যাসীদের সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছিলেন, এ সেখানে ছিল না।
দাইসেনের কাছে জানলাম এর নাম তান লুয়ান, দক্ষিণ-পশ্চিম চিনের শিচুয়ান প্রদেশের ফুহু মন্দির থেকে এসেছে। এরা মহাযানপন্থী—জেন বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ জ্ঞানলাভের ইচ্ছায় অনেক খোঁজখবর করে শেষমেশ দিনতিনেক হল এখানেই অধিষ্ঠান হয়েছে। দাইসিন জেন ধর্মের একজন বিদগ্ধ পুরুষ। আলোচনা করার আগে দাইসিন ওকে জেন ধর্ম ও সাহিত্যের কিছু বই দিয়েছেন পড়ার জন্য আর স্থানীয় নারা শহরে জাতীয় জাদুঘরের বৌদ্ধ আর্ট লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়বার জন্য একটা পরিচয়পত্র লিখে দিয়েছেন। সুকুবোর একতলায় একটি ঘরে সে থাকে। তান লুয়ান দু-বেলা খাবার সময় ছাড়া সারাদিন ঘরে দরজা বন্ধ করে পড়াশোনা করে। খেতে এসেও নিঃশব্দে খেয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। সকালবেলা ব্রেকফাস্টের পর জিপ নিয়ে বেরিয়ে যায় সম্ভবত লাইব্রেরিতে আর দুপুরে খাবার আগে ফিরে আসে। তাই আমরা এসে সকালবেলা তাকে দেখিনি। আমাদের দিকে কীরকম ভাবলেশশূন্য দৃষ্টিতে তাকাল। আমার ওর প্রতি কোনো কৌতূহল থাকার কথাই না তবুও কেন যে মনের মাঝে কোথায় যে কাঁটা খচ্খচ্ করছে, বুঝতে পারছি না।
আমরা দুপুরবেলায় খানিক বিশ্রাম নিয়ে দাইসিনের সঙ্গে মন্দিরের পাশে একটা ছোটো হলে এলাম। একটা নীচু পায়ার চারকোনা টেবিলের চারপাশে আমরা মেঝেতে একটা গদির আসনে আসনপিড়ি হয়ে বসলাম। একজন সন্ন্যাসী চা করে নিয়ে এল। চা আর রাইস ক্র্যাকার খেতে খেতে কথা হতে লাগল। চা খাওয়া শেষ হলে দাইসেন উঠে দেয়ালে একটা তালা দেওয়া কাঠের চৌকো ক্যাবিনেট থেকে কাঠের বাক্সে রাখা সেই পুথি নিয়ে এসে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই পুথিটির পাঠোদ্ধার করে দিতে হবে। আমার অন্তরে শাক্যমুনি বলছেন এটা আপনিই পারবেন।’
আমি বাক্সটা হাতে নিলাম। কে কবে কোন শতাব্দীতে এই বাক্স এখানে নিয়ে এসেছে তা জানার কোনো উপায় এখন আর নেই। ঠিকই, চন্দন কাঠের বাক্স, ফুট খানেক লম্বা, ইঞ্চি আটেক চওড়া আর ইঞ্চি ছয়েক উঁচু। ওপরের ডালা আর নীচের ডালা যে কোথায় এসে মিশেছে খুব সূক্ষ্মভাবে না দেখলে বোঝা যাবে না। সারা বাক্স কারুকার্য করা। ওপর তলে মধ্যে শিবলিঙ্গ, মাথার ওপর ফনা ধরা সাপের মাথা, পাশে ত্রিশুলে জড়ানো উর্ধমুখী সাপ—কুণ্ডলিনী। মাথার দিকে অনন্ত শয্যায় শোয়া বিষ্ণু, পায়ের কাছে লক্ষ্মী দেবী। শিবলিঙ্গের নীচে তান্ত্রিক যন্ত্র। বাক্সের লম্বাদিকের দু-পাশে নবগ্রহের মূর্তি আর চওড়া দিকের দু-পাশে ইন্দ্রের চতুর্মুখ বজ্র। বজ্রের মাঝখানে একট করে ছোটো বৃত্ত সংস্কৃতের হরফে ওঁ আঁকা। আমি কিছুক্ষণ মন দিয়ে দেখে বাক্সটা টেবিলের ওপর রেখে দু-দিকের দুটি বৃত্তে আঙুল দিয়ে একসঙ্গে চাপ দিতেই বাক্সের ডালা খুলে গেল। দেখলাম প্রফেসর কাওয়াবাতা আর দাইসিন দুজনেই আমার দিকে বিস্ময় ও প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
ডালা খুলে পুথিটা হাতে নিলাম। ওপরে নীচে চন্দন কাঠের পাটা আর সিল্কের কর্ড দিয়ে বাঁধা, কর্ডটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করেই বলে উঠলাম, ‘এ তো সেই সিল্ক যা দিয়ে কাঞ্জিভরম শাড়ি তৈরি হয়। এটা তালপাতার পুথি যা দক্ষিণ ভারতেই আদিতে শুরু হয়েছিল। যদিও দশম শতাব্দীর আগের কোনো পুথি ভারতবর্ষে পাওয়া যায়নি কিন্তু এই পুথিতে লেখার প্রথা যে আরও অনেক আগের সে কথার উল্লেখ আছে। মনে হয় এই পুথির লেখক কাঞ্চী অঞ্চলের। একসময়ে কাঞ্চী ছিল পল্লব রাজবংশের রাজধানী।’
দাইসিন বললেন, ‘সপ্তম শতাব্দীতে ভারতবর্ষ থেকে বোধিধর্ম চিনের শাওলিনে আসেন বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য। উনি শোনা যায় গার্হস্থ আশ্রমে কাঞ্চীর পল্লব রাজবংশের রাজকুমার ছিলেন।
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। হয়তো এই পুথির সঙ্গে তার সম্বন্ধ থাকলেও থাকতে পারে। যা হোক দেখি পড়া যায় কি না।’ আমি পাটা উলটিয়ে প্রথম দুটো পাতা দেখে চমকে উঠলাম। বললাম, ‘এ কি! এ লেখা তো আমার জানা কোনো প্রাচীন ভাষার সঙ্গে মিলছে না।’ লক্ষ করলাম দাইসিন ও কাওয়াবাতা দুজনের চোখ হতাশায় ভরে উঠেছে। বললাম, ‘এখনি হতাশ হবার কারণ নেই। আমি আর একটু মন দিয়ে দেখি।’
কিছুক্ষণ মন দিয়ে দেখতে দেখতে আমার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমি উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললাম, ‘নাঃ লেখকের মুনশিয়ানার তারিফ করতে হয়। কী করেছে জানেন?’
হতাশা কেটে গিয়ে দুজনেই আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম, ‘হরফটা তামিল ব্রাহ্মী, খুবই প্রাচীন তামিল লিপি, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় থেকে প্রথম শতাব্দীতে প্রচলিত ছিল, ব্রাহ্মী লিপির তামিল সংস্করণ। কিন্তু লেখা হয়েছে বুস্ট্রোফিডন স্টাইলে, অর্থাৎ প্রথম লাইন সোজা, বাঁ দিক থেকে ডান দিক আর দ্বিতীয় লাইন উলটো, ডান দিক থেকে বাঁ দিক বা আয়না-লেখা। পর্যায়ক্রমে এভাবে চলতে থাকে। প্রাচীন গ্রিসে এ পদ্ধতিতে পাথরে লেখা হত। এই পুথি এ পদ্ধতিতে লেখা। শুধু তাই নয়। এ ক্ষেত্রে লেখক প্রত্যেক হরফ আবার উলটিয়ে লিখেছেন, পা ওপরে মাথা নীচে। যে কারণে আমি প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। যাক প্রফেসর, ওশো আপনারা আর চিন্তা করবেন না। এ পুথি আমি পড়ে দেব তবে লেখার জটিলতার জন্য একটু সময় লাগবে।’
দাইসিন চোখ বুজে হাতজোড় করে বলল, ‘ভগবান শাক্যমুনির আশীর্বাদ আপনার ওপর বৃষ্টির মতন ঝড়ে পড়ুক। আপনি এই পুথি আপনার ঘরে নিয়ে যান। যে ক-দিন সময় লাগে আপনি পড়ুন।’ প্রফেসর কাওয়বাতার সহাস্য উজ্জ্বল মুখ বলে দিল যে তিনি আমাকে এখানে এনে সঠিক কাজটি করেছেন। আমরা হল থেকে বেরিয়ে আমাদের ঘরের দিকে চললাম। কাছে আসতে দেখি, তান লুয়ান আমদের দেখে না দেখার ভান করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি একটু ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকালাম।
কাওয়াবাতা সেটা লক্ষ করে আমায় বললেন, ‘কী ভাবছেন?’
‘না কিছু না। তেমন ভাবার সময় বোধ হয় এখনও আসেনি।’
আমি ঘরে এসে নিবিষ্ট মনে পুথি পড়ায় মনোযোগ দিলাম। প্রফেসর কাওয়াবাতা পরদিন সকালে নাগোয়া ফিরে গেলেন। আমার পড়া শেষ হলে ওঁকে খবর দিলেই চলে আসবেন। তিন দিন তিন রাত কোথা দিয়ে যে কেটে গেল, শুধু খাবার সময়টুকু ছাড়া। পঞ্চম দিন সকালে মোহন্ত দাইসিনকে বললাম প্রফেসর কাওয়াবাতাকে ফোন করতে যাতে উনি বিকেলের আগেই এখানে পৌঁছতে পারেন। দাইসিনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললাম যে বিকেল চারটায় হলে আমি পুরো কাহিনি বর্ণনা করব। সকল সন্ন্যাসীদের অনুরোধ করবেন আসার জন্য। দাইসিন খাবার টেবিলে সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেন। তান লুয়ান একটু মাথা তুলে ঘাড় নাড়ল, ভাবটা যেন ‘দেখি যদি পারি তো আসব।’
বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ প্রফেসর কাওয়াবাতা এলেন। এসেই সোজা আমার ঘরে। আমার হাসিমুখ দেখে কাওয়াবাতা সজোড়ে আমার হাতদুটো ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আমি প্রথম থেকেই নিশ্চিত ছিলাম আপনি পারবেন। আপনার ক্ষমতার কথা আমি অনেক আগেই মোহন্ত দাইসিনকে বলেছিলাম আর সে কারণেই আপনাকে জাপানে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম।’
একটু বাদেই দাইসিন এসে আমাদের সেই ছোটো হলে নিয়ে এলেন। পরিচ্ছন্ন হল সুন্দর ধূপের গন্ধে পরিপূর্ণ। মেঝেতে বড়ো কার্পেট পাতা। তার ওপর গোটা দশেক সাদা পুরু আসন। আমি, দাইসিন আর কাওয়াবাতা তিনজনে সন্ন্যাসীদের বসার প্রথম সারি থেকে হাত তিনেক দূরে তাঁদের দিকে মুখ করে বসলাম। আমি মাঝে। সামনে একটা খুব নীচু পায়ার আয়তাকার টেবিল। আমাদের দুপাশে একটু পেছনে দুটো বড়ো সিরামিকের ভাস ফুল দিয়ে সাজানো। ইতিমধ্যে দুটি ছোকরা ব্রহ্মচারী হলের এক কোনায় চা বানিয়ে কাপডিশে করে সবাইকে দিল। সঙ্গে বিস্কিট। সবার চা খাওয়া শেষ হলে ওই দুই ব্রহ্মচারী সবার কাপ ডিশ, চায়ের সরঞ্জাম সব নিয়ে চলে গেল। একটু বাদেই ফিরে এসে নিজেদের আসনে এসে বসল। সবাই কী সুন্দর শান্ত, চুপচাপ, একটা টু শব্দও নেই। দাইসিন প্রথমে একটু উপস্থাপনা করলেন। ঠিক এই সময়ে তান লুয়ানকে দেখি কেমন ভিজে বেড়ালের মতন গুটি গুটি এসে সবার পেছনে বসল। আমার দিকে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে মন দিয়ে কার্পেটের ফুলের নকশা দেখতে লাগল। আমি আরম্ভ করলাম ইতিহাসের এক অজানা, অখ্যাত খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর জগতের এক আশ্চর্য মানুষের রোমাঞ্চকর জীবনের রূপকথা।
(২)
ভরা শ্রাবণ মাসের এক ভয়ংকর প্রলয়ের রাত্রির দ্বিতীয় যাম। দ্রাবিড় ভারতের তামিলাকমের মামাল্লাপুরম বা এখনকার মহাবলীপুরম বন্দর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশের এক পণ্যবাহী পালতোলা জাহাজ প্রায় শতাধিক ক্রোশ দূরে মহাসমুদ্রে প্রবল ঝড়ে উত্তাল ঢেউএর ধাক্কায় দিশাহীন হয়ে মোচার খোলার মতন ভেসে চলেছে। চতুর্দিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। দানবীয় এক একটা ঢেউ জাহাজটাকে কোন চূড়ায় তুলে নিয়ে যাচ্ছে আবার পর মুহূর্তেই কোন অতল তলে নিয়ে ফেলছে। জাহাজের গায়ে আছড়ে পড়া ঢেউভাঙা জলোচ্ছাস প্রায় মাস্তুলের মাথা ছোঁওয়া উঁচু হয়ে জাহাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অপর দিকে কাঠের বেড়া দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। জাহাজের পাটাতনের ওপর যা কিছু ছিল সব ছত্রভঙ্গ হয়ে কিছু কিছু জলের তোড়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। ঝড়ের উন্মাদ গর্জনে যাত্রীদের পরিত্রাহী চিৎকার কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। একবার এক মস্ত ঢেউএর ধাক্কায় ওপারের বেড়ার খানিকটা অংশ ভেঙে সাগরে গিয়ে পড়ল। আর তার সঙ্গে যারা বেড়া আঁকড়ে ধরে টাল সামলাচ্ছিল সাগরে পড়ে পলকের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। ঢেউএর আঘাতে জাহাজের কাঠামোর এক অংশ ভেঙে ভেতরে হু হু করে জল ঢুকতে শুরু করল। আচমকা এক বড়ো ঢেউএর ধাক্কায় জাহাজের মাস্তুল ভেঙে সমুদ্রে পড়তেই জাহাজ একদিকে কাত হয়ে প্রায় আদ্ধেক ডুবে গেল। দেখতে দেখতে জাহাজ মহাসাগরের অতল জলে তলিয়ে গেল। এতকাল যে বাণিজ্যতরী পূর্ব সমুদ্র দাপিয়ে জলের বুকে বিরাজ করত তার কোথাও এতটুকু কোনো চিহ্নটি রইল না।
অথচ দিনটা তো এমন ছিল না। ঝকঝকে রোদ, হাওয়াও ভালোই বইছিল। সব পাল তুলে দিয়ে জাহাজটি তেজপাতা, দারচিনি, গোলমরিচ আর কম্বল নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব মুখে তরতরিয়ে চলছিল। মাল্লারাও খুশিমনে পাটাতনে বসে পচিশি আর কৃদা পত্রম খেলছিল। শেষ অপরাহ্ন বেলায় হঠাৎ হাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। প্রকৃতিতে কেমন একটা থমথমে ভাব। কোথা থেকে আকাশে কৃতান্তসম এক কালো মেঘের উদয় হল। দেখতে দেখতে পুরো আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেল। নেমে এল অন্ধকার। শুরু হল যেমনই উদ্দাম ঝড় তেমনই আকাশভাঙা বিরামহীন বৃষ্টি—এ যেন প্রকৃতির এক যুগলবন্দি খেলা।
রাত্রি তখন তৃতীয় যাম শেষ হয়ে চতুর্থ যাম শুরু হচ্ছে। ঝড়ের প্রকোপ কেটে যাচ্ছে, সমুদ্রও শান্ত হয়ে এসেছে। জাহাজের একটি ভাঙা কাঠের তক্তা আঁকড়ে ধরে একটি মানুষ, সম্ভবত ডুবে যাওয়া জাহাজটির একমাত্র উত্তরজীবী, অকুল সাগরে অজানার উদ্দেশে মৃতপ্রায় হয়ে ভেসে চলেছে। কতক্ষণ ধরে ভাসছে নিজেও জানে না। ধীরে ধীরে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে আর তার সঙ্গে সঙ্গে মেঘও। পুবের আকাশ অরুণোদয়ের আলোর ছটা। লোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে চারিদিক দেখল। শুধুই লবনাম্বুরাশি। কেটে গেল আরও এক দণ্ড। এবারে পরিষ্কার আলোয় লোকটি হঠাৎ দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে দেখল দিকচক্রবালে কালো কালো মেঘের মতন দেখতে কী যেন দেখা যাচ্ছে। আবার মেঘ নয়তো—বুকটা অজানা আশঙ্কায় যেন কেঁপে উঠল। তবুও আশায় বুক বেঁধে কাঠের তক্তা ধরে সাঁতরাতে আরম্ভ করল।
কতক্ষণ যে সাঁতরেছে সময়ের কোনো হিসেব ছিল না। বেলা দ্বিপ্রহর হবে। একবার মাথা তুলে দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠল। নাঃ! এবার আর ভুল নেই। দিকচক্রাবালে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সবুজ বনানী। কাঠের তক্তা ছেড়ে দিয়ে নতুন উদ্যমে দ্বিগুণ বেগে সাঁতরাতে আরম্ভ করল। ক্রমে ক্রমে পায়ের তলায় মাটির স্পর্শ পেল। সাঁতার ছেড়ে জল কেটে হেঁটে আসতে আরম্ভ করল। গলা জল, বুক জল, কোমর জল, হাঁটু জল আর শেষে গোড়ালি জল পেরিয়ে এক ছুটে বেলাভূমিতে এসে সোজা মাটিতে আছড়ে পড়ে গেল। হাঁপ ধরাটা একটু কমে আসতে না আসতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
ঘুম যখন ভাঙল, তখন শেষ অপরাহ্নবেলা। সূর্যদেব পাটে বসতে চলেছেন। পশ্চিমের আকাশ অস্তরবির রশ্মি আভায় রাঙা। লোকটি খিদেয়-তেষ্টায় কাতর। পেটে সাগরের নোনা জল ছাড়া কিছু তো নেই। সামনে কিছুটা হেঁটে এসে দেখল সারি সারি নারকেল গাছ। মাটিতে বেশ কয়েকটা নারকেলও পড়ে আছে। গায়ের ভেজা জামাকাপড় গায়েই শুকিয়েছে। কোমরে শক্ত করে বাঁধা লম্বা লাল কাপড়, কোমর-বন্ধনী, তার ওপর হাত দিয়ে অনুভব করে দেখে নিশ্চিন্ত হল যে খাপশুদ্ধ দু-দিক ধারাল একটু বাঁকান ছোটো কাট্টিটা রয়েছে। পরনের কাপড়টা খুলে নিয়ে কষে বেঁধে পরে নিল—কাছা দিয়ে মালকোঁচা মেরে হাঁটু পর্যন্ত। গায়ে মোটা কাপড়ের গোল গলা হাত কাটা বেনিয়ান। তরতরিয়ে একটা নারকেল গাছে উঠে গোটা কয়েক ডাব কেটে নীচে ফেলে দিল। নেমে এসে গোটা কয়েক ডাবের জল আর নারকেল ছাড়িয়ে খেল। শরীর, পেট কিছুটা শান্ত হল।
সন্ধের অন্ধকার নেমে আসছে। সাগর বলাকারা ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরে আসছে পাহাড়ে জঙ্গলে, তাদের কুলায়। নিজেরও রাতের আস্তানার একটা ব্যবস্থা করতে হয়। নারকেলের গাছগুলো পেরিয়ে ন্যাড়া পাহাড় উঠে গেছে। খানিকটা বেয়ে এসে এক জায়গায় একটু সমতল স্থান আর ঠিক গুহা নয়, পাথরের খাঁজ। তারি মাঝে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ল। রাতের অন্ধকারের স্তব্ধতা, ভেসে আসা সাগরের গর্জ্জন, ঝিঁঝির বিরামহীন ধ্বনি আর মাঝে মাঝে কোনো রাতচরা পাখির ডাকের ঐক্যতান। লোকটি চুপচাপ শুয়ে শুয়ে ভাবছিল তার এই স্বল্প জীবনের ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা।
কতই বা বয়স তার—আঠারো-উনিশ। গত প্রায় দেড় বছর ধরে সুমাত্রা দ্বীপের এক বাণিজ্যতরীতে সারেঙের সহকারী হয়ে সাগরে সাগরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কালো, ঢ্যাঙা লম্বা, খাড়াই নাক শিরিঙ্গের মতন চেহারা অথচ বেশ পেটানো শরীর। যেমন গায়ের জোর, খাটতেও পারে অমানুষিক অথচ সুমধুর ব্যবহার। জাহাজে ওই সর্বকনিষ্ঠ। আর সব দাদা, খুড়ো সম্পর্ক—ভালোবাসে সবাই। তর তর করে দড়ি বেয়ে মাস্তুলের মাথায় উঠে যাওয়া, পাল তোলা, গোটানো সবেতেই যেন ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। আবার সারেঙের সঙ্গে থেকে থেকে অল্পবিস্তর জাহাজ চালানোও শিখছে। ভবিষ্যতে এ ছেলের সারেঙ হওয়া আটকায় কে? জাহাজই ছিল তার ঘর-বাড়ি। অথচ প্রকৃতির নিষ্ঠুর খেলায় এক লহমায় তার এতদিনের ঘর-বাড়ি, সঙ্গী-সাথি কোথায় স্বপ্নের মতন মিলিয়ে গেল। আজ এত বড়ো জগতে সে আশ্রয়হীন, কপর্দকহীন, সঙ্গীহীন একা। পুরোনো চেনা সাথি বলতে শুধু রাতের আকাশের তারাদল।
ওপরে আকাশপানে তাকিয়ে তাদের দেখে যেন একটু আস্বস্ত হল। নিশুতি রাতের আকাশ তারায় তারায় খচিত। ওইতো মাথার ওপর বৃশ্চিক রাশি আদ্ধেক আকাশ জুড়ে যেন শুয়ে আছে। মাথার কাছে জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। নীচে বা দিকে ধনুরাশি। পূর্ব-দক্ষিণ আকাশ থেকে শুরু করে সারা আকাশটা পেরিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম পানে ছায়াপথ চলে গেছে। দক্ষিণের আকাশ বলে প্রায় মাথার ওপরে। আকাশটা সে মোটামুটি চেনে। সারেঙই তাকে চিনিয়েছে। আর তারাদের না চিনলে কি চলে? রাতের সাগরে জাহাজ নিয়ে যেতে হলে তারাই যে পথপ্রদর্শক আর সময় বলে দেয়। তারাদের দেখতে দেখতে কখন যে দু-চোখে ঘুম নেমে এসেছে নিজেই বুঝতে পারেনি।
মুখে রোদ এসে পড়ায় ঘুম তার ভেঙে গেল। প্রথমে ঠিক বুঝতে পারছিল না সে কোথায় এসেছে। পরক্ষণে চট্কা ভাংতেই সে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। সাগর পারে বীজন দ্বীপে নিজেকে একা দেখে মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। মাথার ওপর সাগর বলাকারা উড়ছে। কখনও বেলাভূমির কাছে সাগরের নীল জল থেকে ঠোঁটে মাছ তুলে নিচ্ছে। তাকেও তো নিজের দানাপানির ব্যবস্থা করতে হয়। জলের থেকে মাছ ধরা যায় বটে তা সে কাঁচা খাবে নাকি? পাহাড় থেকে নেমে এসে বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগল। কিছুদূর এসেই দেখতে পেল জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা সরু খাল সাগরে এসে মিশেছে আর তার মোহানা থেকে কিছু আগে একটা বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা মোটা কাছি বালির ওপর দিয়ে সাগরের খাড়ির জলে মিশে গেছে। একটা বুড়ো লোক মাথায় কাঁচা-পাকা ঝাকড়া ঝাকড়া চুল, পাকা লম্বা দাড়ি, হাঁটু পর্যন্ত কাপড় পরা, খালি গা, দড়ি ধরে প্রাণপণ শক্তিতে টানছে।
মানুষ দেখে সে আনন্দে চিৎকার করে ছুটে এল। তাকে দেখে বুড়ো লোকটি কেমন হতভম্ব হয়ে গেল। অবাক বিস্ময়ে বলল, ‘কে তুমি? এখানে কী করে এলে? আগে তো তোমাকে দেখিনি?’
‘আজ্ঞে আমি কৃষ্ণন। সুমাত্রার ব্যাপারী জাহাজে নাবিক ছিলাম। গত পরশু ঝড়ের রাতে আমাদের জাহাজ ডুবে গেছে। বোধ হয় কেউ বেঁচে নেই। আমি একটা তক্তা ধরে ভাসতে ভাসতে কাল এখানে এসে পড়েছি। কী করব, কোথায় যাব, জানি না। আমায় কিছু খেতে দিতে পারো? দড়িতে কী বাঁধা আছে?’ কেমন যেন এক নিশ্বাসে কথাগুলি বলে গেল।
বুড়ো জেলেটির, অল্প বয়সি কৃষ্ণনের সরল মুখের দিকে চেয়ে আর তার কথা শুনে, খুব দয়া হল। কতই বা বয়স ছেলেটার। তার নাতিটা থাকলে এরকমই তো হত। চার বছর আগে সেই যে আড়কাঠির সঙ্গে সৈন্যদলে যোগ দেবে বলে গেল আর তো কোনো খবরই পেল না। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কৃষ্ণনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার মাছ-ধরা নৌকোটা এখানে খুঁটিতে বাঁধা ছিল। ঝড়ে ডুবে গেছে। টেনে তোলার চেষ্টা করছি। আগের মতন জোর তো নেই গায়ে বাবা।’
‘আমি তুলে দিচ্ছি,’ এই বলে কৃষ্ণন কাছি ধরে প্রাণপণ শক্তিতে নৌকোটা বালির চড়ায় টেনে নিয়ে এল। দুজনে মিলে নৌকো উলটে জল ফেলে আবার জলে ভাসাল। বুড়ো বলল, ‘আমি এখানে মাঝে সাঝে সাগরে মাছ ধরতে আসি। তুমি নৌকো বাইতে পার? তা হলে এস আমার সঙ্গে।’
কৃষ্ণন লগি ঠেলে ঠেলে নৌকোটাকে খাড়ি থেকে সমুদ্রের অগভীর জলে নিয়ে এল। বুড়ো লোকটি একখানা লম্বা বাঁশের লাঠির ডগায় তেকাঁটা বর্শা দিয়ে মেরে বেশ কয়েকটা বড়ো বড়ো ভাঞ্জরম, সুরাই আর শীলা মাছ ধরে নৌকাতে তুলল। কৃষ্ণন অবাক হয়ে দেখল বুড়োটা দক্ষতার সঙ্গে কী দ্রুত মাছগুলো ধরে তুলল। দেখতে দেখতে নৌকার পাটাতনের আদ্ধেক মাছে ভরে গেল। বুড়ো বলল, ‘আজ থাক, খাঁড়ি ধরে নৌকো নিয়ে ভেতরে চল, ব্যাপারীর কাছে দিয়ে আসব।’
কৃষ্ণন এবার দাঁড় বেয়ে খাড়ি ধরে চলতে লাগল। ভালোই চওড়া খাঁড়ি। এটা তামিলাকমের কোন জায়গা বুড়োকে জিজ্ঞাসা করল। বুড়ো অবাক হয়ে বলল, এটা তো তামিলাকম নয়—এ তো এলাম—তামিল এলাম, সিনহল দ্বীপের জাফনার থোন্ডাইমানারু। কৃষ্ণন কেমন হতভম্ব হয়ে রইল। এ তো তার স্বপ্নেরও অতীত। এলমের নামই শুনেছে। কোনোদিন তো আসেনি। বেশ খানিকটা খাঁড়ি বেয়ে আসার পর ইটাইকাটু নামে এক জায়গায় বুড়ো নৌকো থামাতে বলল। দুজনে মিলে জলে নেমে নৌকোর গুণ টেনে পারে বালির চড়ায় এনে একটা মোটা কাঠের খুঁটিতে বাঁধল। বুড়ো ওকে রেখে কোথায় চলে গেল। কৃষ্ণন লক্ষ করল বুড়ো সামান্য খুড়িয়ে হাঁটে। ফিরে এল দুটো বেতের ঝুড়ি আর একটা বাঁশের বাঁক নিয়ে। বুড়ো মাছগুলো ঝুড়ি দুটোতে ভরে বাঁকে চাপিয়ে নিয়ে চলল। কৃষ্ণন চট করে বুড়োর কাঁধ থেকে বাঁকটা নিজের কাঁধে নিয়ে নিল।
প্রায় মিনিট দশেক হেঁটে এসে এক জায়গায় একজন বড়ো মাছের ব্যাপারী বড়ো নৌকো নিয়ে এসেছে আর জেলেদের থেকে মাছ কিনে নিচ্ছে। বুড়োও তার মাছ ব্যাপারীর কাছে বিক্রি করে একটা রুপোর মুদ্রা কাহাপনা আর কিছু তামার মুদ্রা গুনে নিল। দুটো বড়ো মাছ আরেক ব্যাপারীর কাছে দিয়ে তার বদলে তার থেকে চাল, ডাল, আলু, মশলা সব কিনে নিল। এর পর কৃষ্ণন কে নিয়ে আরও আধাঘণ্টার পথ হেঁটে নিজের বাড়িতে এল। শনের ছাউনি দেওয়া দুটো মাটির ঘর। পাশে একটা পুকুর। খালি জমিতে কিছু শাকপাতা আর সবজির বাগান। একটা বুড়িমা বেরিয়ে এসে কৃষ্ণনকে অবাক হয়ে দেখল। বুড়ো ওর সম্বন্ধে বললে বুড়িমা একগাল ফোকলা দাঁত নিয়ে হেসে কৃষ্ণনকে বাবা বাছা বলে আদর করে ঘরে তুলে নিলেন। এক অজানা বিদেশির প্রতি বুড়ো-বুড়ির এই সরল আন্তরিক আতিথেয়তায় কৃষ্ণনের চোখে জল চলে এল। যে একাকিত্ব আজ সকাল পর্যন্ত তাকে গ্রাস করছিল তা অনেকটাই ফিকে হয়ে এল। দুপুরবেলা কতকাল বাদে ডাল আর মাছ দিয়ে ভাত খেল।
দিন তিনেক কৃষ্ণন বুড়ো-বুড়ির সঙ্গেই রইল। সকালবেলা বুড়োর সঙ্গে সাগরে মাছ ধরতে চলে যায়। সত্যিই ওর কপালটা খুব ভালো। তৃতীয় দিন… ওরই চোখে প্রথম পড়েছিল। বুড়ো তো মাছ ধরায় ব্যস্ত ছিল। আস্তে আস্তে নৌকো বাইতে বাইতে হঠাৎ দেখে, এক হাতে নৌকো ধরে, হাঁটু জলে নেমে নীচু হয়ে সযত্নে তুলে নিয়েছিল। এতকাল নামটাই শুধু শুনেছে—ভালমপুরিক সাঙ্গু বা দক্ষিণাবর্তী শাঁখ। এ শাঁখ না কি খুব শুভ। বুড়োকে দিতে গিয়েছিল। বুড়ো দেখে খুব খুশি হয়ে বলেছিল, ‘এটা তুমি পেয়েছ, এটা তোমার। এটা তুমি অনুরাধাপুরায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করলে অনেক দাম পাবে। তা দিয়ে তোমার স্বচ্ছন্দে অনেকদিন চলে যাবে—আর ইতিমধ্যে তুমি নিশ্চয়ই কোনো কাজ জোগাড় করে নিতে পারবে। তোমার ওপর ভগবান সোমসুন্দরমের কৃপা আছে।’
কৃষ্ণন কথায় কথায় বুড়োকে বলল তার রাজার সৈন্যদলে ঢোকার ইচ্ছে। সে অল্পবিস্তর লাঠি খেলা জানে। জাহাজে দুজন তরোয়াল ধারী রক্ষী ছিল। তাদের থেকে একটু-আধটু তরোয়াল চালানোও শিখছিল। বুড়ো কিন্তু খুব বাস্তববাদী আর জ্ঞানী ছিল। সে বলল, ‘দেখ তোমার বয়স আছে, স্বাস্থ্য আছে, তুমি অনুরাধাপুরায় সৈন্যদের ছাউনিতে গেলে সুযোগ পেতেই পার। হয় তো বর্ষা চলে গেলে যুদ্ধ হলেও হতে পারে। শোনা যাচ্ছে গুপ্তচররা খবর এনেছে তামিল নাদের কাঞ্চীর পল্লব রাজারা অনুরাধাপুরা আক্রমণ করতে পারে। এখন সৈন্যদলে লোক নেওয়া হচ্ছে। এই তো তুমি আসার ক’দিন আগে আমাদের গ্রামে আড়কাঠি এসেছিল লোক নেবার জন্য। তবে আমি তোমায় একটা কথা বলি। আমার পরামর্শ যদি নাও তো বলতে পারি।’
কৃষ্ণন বলল, ‘বলুন না, আপনার অভিজ্ঞতার তো মূল্য আছে।’
‘আমি বলি তুমি এখনই যোগ দিও না। এখন যোগ দিলে একজন পদাতিক সৈন্য হয়ে ঢুকতে হবে। একটু তরোয়াল চালানো, তির-ধনুক চালানো শিখিয়েই যুদ্ধে পাঠিয়ে দেবে। তাতে তোমার কিছুই আত্মবিশ্বাস থাকবে না। তুমি সহজেই যুদ্ধের শিকার হয়ে যাবে। তার থেকে তুমি দু-বছর গুরু কান্দানের কাছে যুদ্ধবিদ্যার কলাকৌশল শিখে নাও। উনি সিলাম্বাম আর কুট্টু ভারিসাই এই দু-ধরনের যুদ্ধকলার নামকরা শিক্ষক। উনি অনুরাধাপুরা শহরের একপ্রান্তে অশোকাপুরায় থাকেন। আমিও তোমার মতন বয়সে এক গুরুর কাছে সিলাম্বাম শিখতে গিয়েছিলাম। একটা দুর্ঘটনায় আমার পা খুব বাজেভাবে ভেঙে যায়। এক বছরের বেশি লেগেছিল সারতে। তাই আজও আমি খুঁড়িয়ে হাঁটি। একবার তুমি যদি এ বিদ্যায় দক্ষ হতে পার রাজার দেহরক্ষীর কাজ পাবে। আমি দেখেছি দেহরক্ষীদের কী দাপট। তাদের অনুমতি ছাড়া কারোর রাজার কাছে যাবার উপায় নেই—এমন কি প্রধান সেনাপতিরও নয়।
বুড়োর কথা কৃষ্ণনের খুব মনে ধরল। সে পরদিন সকালে বুড়ো-বুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অনুরাধাপুরা রওনা হল। বুড়ো তাকে কিছু তামার মুদ্রা রাহাখরচ হিসেবে দিয়েছিল। তা থেকে সে একটা পরনের কাপড় আর গামছা কিনে নিল। ক’দিন ধরে তার একবস্ত্রেই দিন কাটছে। সারা দিনমান হেঁটে, সন্ধে নাগাদ এলুথুমাট্টুভালো বলে এক স্থানে এল। এখানে একটা মুরুগানের মন্দিরের চাতালে এসে আশ্রয় নিল। সন্ধ্যাবেলার আরতি ও পূজার আয়োজন চলছে। পাশে একটা ছোটো পুকুরে কৃষ্ণন হাত-মুখ ধুয়ে মন্দিরে এসে বসল। সন্ধ্যাবন্দনা শেষ হলে পুরোহিত বাইরে এসে কৃষ্ণনকে দেখে থমকে দাঁড়াল। কৃষ্ণন তাড়াতাড়ি উঠে সংক্ষেপে নিজের পরিচয় ও অবস্থা জানাল। অভুক্ত শুনে পুরোহিত মন্দিরে ঢুকে কেন্দা পাতায় করে অনেকটা ফল, মিষ্টি আর দই-ভাত দিল। পেট ভরে খেয়ে মন্দিরের চাতালেই রাত কাটালো।
পরদিন খুব ভোরবেলা আবার তার হাঁটা শুরু হল। কখনও হেঁটে, কখনও বা ব্যাপারীর মাল নিয়ে যাওয়া গোরুর গাড়িতে চড়ে সে গন্তব্য স্থলের দিকে এগোতে লাগল। সন্ধে হলে কোনো মন্দিরের চাতালে শুয়ে পড়ে। মন্দিরের প্রসাদ বা রাস্তার ধারের গাছের ফল খেয়ে কাটায়। দু-একদিন হয়তো রাস্তায় বা গ্রামের পথে কারোর সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছে, সেই তার বাড়ি নিয়ে গিয়ে যত্ন করে খাইয়ে দিয়েছে। এখানকার লোকজন বেশ সহজ সরল, অতিথি বৎসল। এই দেশটাকে তার খুব ভালো লেগে যাচ্ছে। ভাবে ভবিষ্যতে এখানেই থেকে গেলে কেমন হয়।
দেখতে দেখতে পাঁচ দিন কেটে গেল। ছয় দিনের দিন সে অনুরাধাপুরায় এসে পৌঁছাল। এই প্রথম সে একটা বড়ো শহরে এল। অবশ্য গতকাল যে বৌদ্ধবিহারে সে রাত কাটিয়েছে তারই এক সাধুকে অনুরাধাপুরা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে অনেক কিছু জেনেছিল। হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো এই শহর অনুরাধাপুরা। সিনহল দেশের সভ্যতা, ধর্ম, সংস্কৃতি এই শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, সমগ্র অনুরাধাপুরা রাজ্যের রাজধানী এই শহর। শোনা যায় প্রায় বারোশো বছর আগে ভারতবর্ষের বঙ্গদেশ নামক জায়গা থেকে বিজয়সিংহ নামে এক রাজপুত্র এ দেশে এসে কালক্রমে এক রাজত্ব গড়ে তার রাজা হয়ে বসে। তারই এক মন্ত্রী অনুরাধা কালা ওয়া নদীর ধারে এই শহরের পত্তন করেন। হাজার বছর ধরে কত কত সম্রাট রাজত্ব করল। কত খাল, জলাশয় খনন করে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার পত্তন করা হল। আটশো-সাড়ে আটশো বছর আগে ভারতবর্ষের সম্রাট অশোক পাঁচজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে ভগবান বুদ্ধের বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। ধীরে ধীরে থেরাভেদা বৌদ্ধধর্ম সিনহলে প্রধান ধর্ম হয়ে ওঠে। হাজার হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও শিক্ষার্থীদের জন্য বিশাল বিশাল বৌদ্ধবিহার গড়ে ওঠে।
কৃষ্ণন অনুরাধাপুরা শহরে এসে চারিদিক দেখে কেমন হতভম্ব হয়ে গেল। চওড়া রাস্তা, দু-পাশে ইটের বাড়ি, কত মনোহারি দোকান, খাবারের দোকান, রাস্তায় কত লোকজন পুরুষ, মহিলা, শিশু। কত বিদেশি তীর্থযাত্রী, কত লোকে গোরুর গাড়ি করে, পালকি করে যাচ্ছে, ঘোড়ায় চড়ে সৈন্যদল চলেছে। মন্দিরের কাসর ঘণ্টার শব্দ, লোকেদের কোলাহল।
এত বড়ো শহরে সে কোথায় গুরু কান্দানের বাড়ি খুঁজে পাবে। যতটা আশা নিয়ে এসেছিল তা এখন কী রকম হতাশায় পরিণত হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে সে অনেক বৌদ্ধ সাধু ও তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে অভয়গিরি বিহারে প্রবেশ করল। কত বড়ো জায়গা নিয়ে এই বিহার। সাধুদের থাকবার জায়গা, প্রার্থনা গৃহ, কত পুকুর—ঘাট বাঁধান। বৌদ্ধ স্তূপের কাছে এসে তার ঘোর যেন কাটতে চায় না। কত উঁচু আর বিশাল এলাকা নিয়ে স্তূপ। গায়ে পাথরের ওপর কতশত মূর্তি খোদাই করা। রাস্তার দুধারে, এখানে ওখানে কত যে পাথরের মূর্তি তার লেখাজোখা নেই।
একটি বাগানে বিশাল এক গাছের নীচে ধ্যানরত বুদ্ধদেবের পাথরের মূর্তি তার বিপরিতে অনেক সন্ন্যাসী গেরুয়া কাপড় পরিহিত, মুণ্ডিত মস্তক, বসে ধ্যান করছে। ঘুরতে ঘুরতে দুপুর গড়িয়ে এল। তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে অতিথিশালায় ভাত, সম্বর, সবজি খেয়ে নিয়ে গাছতলায় বসে খানিক বিশ্রাম নিয়ে বিহার থেকে বেরিয়ে এল। এই বিশাল শহরে দেখার অনেক কিছুই হয় তো আছে। কিন্তু তার সময় নষ্ট করলে চলবে না। সঙ্গে মাত্র দুটি তামার মুদ্রা আছে। রাতেই বা থাকবে কোথায়? রাস্তার ধারে বা কোনো বাগানে শুলে নগর-রক্ষীরা চোর বা গুপ্তচর ভেবে ধরে নিয়ে যাবে। এখানে কেউ তাকে চেনে না। তার সত্যি কথাই বা কে বিশ্বাস করবে? যে ভাবেই হোক গুরু কান্দানকে খুঁজে পেতেই হবে।
হঠাৎ তার মনে হল বুড়ো অশোকাপুরা বলে জায়গার নাম বলেছিল। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে বুঝল তা এই অভয়গিরি বিহার থেকে প্রায় দেড় ক্রোশ দূরে শহরের উত্তরদিকে শেষ প্রান্তে। প্রায় তিন দণ্ড পরে সে অশোকাপুরায় এসে ধানখেত, ফাঁকা মাঠ, অনেক গাছপালা, পুকুর দেখে যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। এখানে অবশ্য গুরু কান্দানের বাড়ি খুঁজে পেতে আর বেগ পেতে হল না। প্রথম লোককে জিজ্ঞাসা করাতে সে কিছুটা নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিল। বাড়ির সামনে এসে একটি গাছতলায় এসে বসল। পথশ্রমে খুবই ক্লান্ত। সামনের গাছ-গাছালির মধ্যে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে জনা দশেক শিক্ষার্থী লাঠি নিয়ে, তরোয়াল নিয়ে দ্বন্দযুদ্ধের মহড়া দিচ্ছে। কৃষ্ণন চুপ করে ভাবছে কীভাবে গুরু কান্দানের সঙ্গে দেখা করবে, তাঁকে কী বলবে। একটু ভয় ভয় করছে, তিনি যদি না করে দেন। বেশ কিছুক্ষণ পর উঠে এগিয়ে গিয়ে জনৈক শিক্ষার্থীকে গুরু কান্দানের কথা জিজ্ঞাসা করল। উত্তরে ছেলেটি জানাল যে আসান একটু বাদেই ঘর থেকে আসবেন। অপেক্ষা করতে হবে।
কৃষ্ণন চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল। বুঝল যে এখানে গুরুকে আসান বলে। এক দণ্ড বাদে গুরু কান্দান নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে মাঠে যেখানে মহড়া চলছে সেখানে এসে দাঁড়ালেন। মাঝে মাঝে গুরুগম্ভীর গলায় নির্দেশ দিচ্ছেন। লম্বা স্বাস্থ্যবান চেহারা, কৃষ্ণবর্ণ, মাথায় কাঁচাপাকা লম্বা ঘাড় অব্ধি চুল, পাকা দাড়ি, কপালে রক্তচন্দনের টিকা। পরনে মালকোঁচা মারা সাদা ধুতি, কোমরে লাল কাপড়ের কোমরবন্ধ, হাতে সোনার তাবিজ, গলায় রুদ্রাক্ষ। মুখের ভাব সৌম্য হলেও, বেশ ব্যক্তিত্বপূর্ণ। বুকে অনেক সাহস নিয়ে কৃষ্ণন এগিয়ে এসে গুরু কান্দানকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে হাতজোড় করে দাঁড়াল। গুরুজী একটি অস্নাত, বিধ্বস্ত, ধূলিধুসরিত, নগ্নপদ যুবককে দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে তুমি? এখানে কী চাও?’
‘আমার নাম কৃষ্ণন। আমি আপনার নিকট সিলাম্বমের শিক্ষা পেতে চাই’।
‘কিন্তু তোমার পরিচয় কী? কোথা থেকে আসছ?’
কৃষ্ণন তার জাহাজডুবির ঘটনা, বুড়ো জেলের কাছে আসানের নাম শুনে ও তার উপদেশে সিলাম্বাম শিক্ষার জন্য এসেছে যাতে রাজার সৈন্যদলে যোগদান করে জীবিকা অর্জ্জন করতে পারে।
আসান কান্দান বললেন, ‘ও তুমি বিদেশি। এখানে তোমার পরিচিত কেউই নেই। তুমি সত্য বলছ কি মিথ্যা বলছ তার কী প্রমাণ? তুমি যে কোনো দেশের গুপ্তচর নও তারই বা কী প্রমাণ?’
‘না আসান, সত্যিই আমি কোনো প্রমাণ দিতে পারব না। তবে এই শিক্ষা লাভের জন্যই আমি ইটাইকাটু থেকে প্রায় ষোলো যোজন পথ পদব্রজে এসেছি কপর্দকহীন অবস্থায়। আমি সত্যিই অসহায়। আপনি আমার কথা বিশ্বাস করুন।’
কৃষ্ণনের মুখের দিকে তাকিয়ে গুরু কান্দানের মনে হল ছেলেটি হয়তো সত্যি কথাই বলছে। তবুও আরেকবার বাজিয়ে দেখার জন্য বললেন, ‘বেশ, আমি তোমাকে শিক্ষা দিতে রাজি আছি। তবে তোমাকে উপযুক্ত গুরুদক্ষিণা দিতে হবে। কারণ গুরুদক্ষিণা ভিন্ন শিক্ষা অসমাপ্ত আর তার কোনো ফল হবে না।’
কৃষ্ণন আশান্বিত হয়ে বলল, ‘বলুন আসান কী গুরুদক্ষিণা আমাকে দিতে হবে?’
‘তোমার শিক্ষা গ্রহণের পূর্বে পনেরোটি স্বর্ণমুদ্রা আমাকে গুরুদক্ষিণাস্বরূপ দিতে হবে।’
কৃষ্ণনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সমস্ত মুখে চোখে শরীরের ভাষায় আশাভঙ্গের হতাশার চিহ্ণ স্পষ্ট ফুটে উঠল। সে মাথা নীচু করে বলল, ‘আমি সঙ্গীহীন, নিরাশ্রয়, আত্মীয়স্বজন বিহীন, কপর্দকহীন নিঃস্ব। আমার নিজের একবেলাও খাবার সংস্থান নেই। নিজের দেশে ফিরে যাবার মতন সঙ্গতিও নেই। বুড়ো জেলে দয়াপরবশ হয়ে পাঁচটি তাম্রমুদ্রা দিয়েছিলেন, তার থেকে পরনের কাপড় আর গামছা কিনেছি আর দুটি মাত্র অবশিষ্ট আছে। এ অবস্থায় পনেরোটি স্বর্ণমুদ্রা আমি কোথা থেকে পাব আসান?’
কৃষ্ণনের কথা শুনে গুরু কান্দানের মনে একটু করুণার উদ্রেক হল। একটু ভেবে শান্তভাবে বললেন, ‘কিন্তু যে কোনো গুরুদক্ষিণা তো তোমায় দিতেই হবে। কী দিতে পারবে তুমি?’
কৃষ্ণনের হঠাৎ মনে পড়ল। এর কথা তো প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। সে বলল, ‘আসান আমার কাছে একটি দুর্লভ বস্তু আছে আর এটা একান্তই আমার নিজস্ব। আমি সেটা আপনাকে গুরুদক্ষিণারূপে দিতে ইচ্ছুক।’ এই বলে সে তার কাপড়ের পুঁটলি থেকে শাঁখটা বের করে গুরুজীর হাতে দিল।
গুরু কান্দান শাঁখটা হাতে নিয়ে চমকে উঠে প্রায় চিৎকার করে বললেন, ‘এ তো অত্যন্ত দুর্লভ আর দুর্মূল্য। এ তুমি পেলে কোথায়?’
‘আসান, আমি দিন তিনেক বুড়ো জেলেকে সাগরে নৌকা বেয়ে মাছ ধরতে সাহায্য করছিলাম। একদিন সাগরের অল্প স্বচ্ছ জলে শাঁখটি আমার চোখে পড়ে। দেখে ভালো লাগল বলে জলে নেমে তুলে নিয়ে এলাম। বুড়ো দেখে বলল, “এ দক্ষিণাবর্তী শাঁখ। খুবই দুর্লভ। এটা তুমি যখন পেয়েছ, এটা তোমার। তুমি এটা অনুরাধাপুরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করলে প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা পাবে তাতে তোমার অনেকদিন স্বচ্ছন্দে চলে যাবে। ইতিমধ্যে তুমি কোনো কাজ খুঁজে নিতে পারবে বা ব্যাবসাও করতে পারো।” আমি আজ অনুরাধাপুরে এসেছিলাম কিন্তু শাঁখটা বিক্রি করার কোনো ইচ্ছে হয়নি। শুনেছি এই শাঁখকে শ্রীলক্ষ্মী শঙ্খও বলা হয়। আমার মনে হয়েছে এটা বিক্রি না করে দেবতার চরণে অঞ্জলি দেওয়া উচিৎ। আপনি গুরু। গুরুকে আমরা ছোটো থেকে দেবস্বরূপ, ইষ্টস্বরূপ জেনে এসেছি। তাই আমি এটা আপনাকে দিতে চাই।’
গুরু কান্দানের মুগ্ধ হয়ে কৃষ্ণনের কথা শুনতে শুনতে অন্তর থেকে মনে হল যে এই ছেলেটির মতন সৎ, সত্যবাদী ও নির্লোভ ছেলে এই শাঁখের মতনই দুর্লভ। তার মাথায় হাত রেখে গুরু বললেন, ‘বৎস, আমি তোমাকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করলাম। আজ থেকে তুমি আমার গৃহে আমার পুত্রবৎ থেকে এই যুদ্ধ কলাবিদ্যা শিক্ষা করবে। ভগবান অঞ্জনায়ারের আশীর্বাদে তুমি এই বিদ্যায় চরম উৎকর্ষতা লাভ করবে ও বিশ্বের দরবারে এই কলাকে প্রসারিত করবে। এখন থেকে তুমি আমার গৃহেই থাকবে। আর চারদিন পরে শ্রাবণী পূর্ণিমা। ওই শুভদিন থেকে তোমার শিক্ষা শুরু হবে। এ কদিন তুমি ভালো করে খাওয়াদাওয়া কর আর বিশ্রাম নাও।’
কৃষ্ণন একটি নিশ্চিন্ত নিরাপদ আশ্রয় ও সিলাম্বাম শিক্ষার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে নিজেকে কৃতার্থ ও ভাগ্যবান মনে করে গুরু কান্দানকে প্রণাম করে হাতজোড় করে বলল, ‘আসান আশীর্বাদ করুন আমি যেন আপনার সুযোগ্য শিষ্য হতে পারি।’
গুরু কান্দান তাকে সাদরে ঘরে নিয়ে গেলেন। গৃহে চার-পাঁচটা ঘর ছিল। গুরু তাকে একটি ঘরে থাকতে দিলেন। পরদিন গুরু তাকে একটি পরনের ধুতি ও জামা আর সিলাম্বমের জন্য দুটি করে সাদা মুন্নু ধুতি ও সাদা জামা এবং সবুজ রঙের দুটি মেট্টিস বা কোমরে বাঁধার কাপড় আনিয়ে দিলেন। কৃষ্ণন এ ক’দিন ধরে গুরুসেবা, খাওয়া, বিশ্রাম আর একটা গাছের তলায় বসে নিবিষ্ট মনে সিলাম্বমের মহড়া দেখত।
শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন খুব সকালে কান্নান স্নান করে হাঁটু পর্যন্ত মালকোঁচা মেরে সাদা কাপড়, সাদা জামা আর কোমরে সবুজ মেট্টিস শক্ত করে বেঁধে গুরু কান্দানের সঙ্গে ঠাকুর ঘরে এসে প্রথমে সিলাম্বমের অধিষ্ঠাতা দেবতা ভগবান অঞ্জনায়ার বা মহাবীর বজ্রংবলীকে ও তার পরে গুরু কান্দানকে প্রণাম করে মহড়ার মাঠের এক ধারে একটা মাথায় ছাউনি দেওয়া বিশাল এক ঘরে এল। এখানেই প্রধানত ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়া হয়। বাইরের মাঠে শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্ররা পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দযুদ্ধ অভ্যাস করে।
কৃষ্ণন একটি বাঁশের চাটাইয়ের আসনের ওপর বসল আর গুরু কান্দান একটি কাঠের জলচৌকিতে বসে বললেন, ‘তোমাকে দুটো যুদ্ধ কলা শিখতে হবে—সিলাম্বাম ও কুট্টু ভারিসাই। সিলাম্বাম সশস্ত্র আর এতে লাঠি, ঢাল, তরোয়াল, কাঠের গদা, বর্শা, ভালারি, নানা রকম ছোড়া, ধাতব চাবুক সুরুল পাট্টাই—এই যে একদিকে রাখা আছে দেখতে পাচ্ছ—এ সব অস্ত্রের ব্যবহার শিখতে হবে।
সিলাম অর্থ শারীরিক ক্রিয়া-কৌশল ও নীতি আর বাম অর্থ তিন বা এ ক্ষেত্রে শরীর, মন ও আত্মা। তাই সিলাম্বামের উদ্দেশ্য একটি শক্তিশালী এবং সুস্থ শরীর গড়ে অনুশীলনকারীর মানসিক এবং আধ্যাত্মিক বিকাশ। এই দ্বন্দযুদ্ধ শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্য তবে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে পরাস্থ করার জন্য আহত বা নিধন করা যেতে পারে।
কুট্টু ভারিসাই পুরোপুরি নিরস্ত্র দ্বন্দযুদ্ধ। কুট্টু কথার অর্থ আঘাত হানা আর ভারিসাই অর্থ ক্রম। এতে হাতাহাতি ও আঘাত, প্রতিপক্ষকে কৌশলে জাপ্টে ধরা যেমন কুস্তিতে হয়, মুষ্টি বা পায়ের সজোর আঘাতে প্রতিপক্ষকে ছুড়ে ফেলা আর শরীরের বিভিন্ন অংশে যে গাঁটগুলো আছে যেমন কব্জি, কনুঁই, হাঁটু আর কাঁধ—এগুলোতে এমন কৌশলে আঘাত হানা যাতে ব্যথায় সেগুলো সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। শিক্ষার্থীকে ক্রমান্বয়ে এগুলি শিক্ষালাভ করতে হয়। সিলাম্বাম সহস্রাধিক বছর প্রাচীন, তুলনায় কুট্টু ভারিসাই অনেক নবীন।
উভয় প্রকার যুদ্ধকলায় যা আবশ্যিক তা হল মনঃসংযোগ, প্রখর দৃষ্টি, ক্ষিপ্রতা আর দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতায় পারদর্শিতা। উভয়বিধ দ্বন্দের যেটি প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ তা হল কতকগুলি নির্দিষ্ট কালাদি অর্থাৎপদক্ষেপ ও পদচালনা যা প্রতিপক্ষের চারিদিকে তোমার দেহের দ্রুত অবস্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেহের তৎপরতা, ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করবে।
আমি তোমাকে প্রথমে পদক্ষেপের বিভিন্ন ধাপ ও পদ্ধতিগুলো শিক্ষা দেব। তুমি এগুলো দেখে অভ্যাস করতে থাক। এগুলিতে দক্ষতা অর্জ্জন করলে পর তোমার অস্ত্রশিক্ষা শুরু হবে। সিলাম্বামের শিক্ষা সমাপ্ত হলে কুট্টু ভারিসাই শুরু হবে। এর সঙ্গে সমস্ত বিষয়ে নিয়ম-শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন করবে আর প্রতিদিন মনঃসংযোগের জন্য ধ্যান অভ্যাস করবে।’
সিলাম্বাম সশস্ত্র দ্বন্দ কলা বলে তার পদক্ষেপ অস্ত্রচালনার উপযুক্ত কিন্তু কুট্টু ভারিসাই নিরস্ত্র হওয়ার দরুন তার পদক্ষেপ ও পদচালনা ভিন্ন। প্রথমে আমি তোমাকে সিলাম্বমের পদক্ষেপ শেখাব। এতে এখন আথি, ইডি, কুট্টি, তিরু ইত্যাদি ষোলোটি ভিন্ন ধাপ আছে। তুমি ধীরে ধীরে একে এক করে আয়ত্ত কর।’
এই বলে গুরু কান্দান মাটিতে একটি শক্ত কাঠি দিয়ে গোল গোল বৃত্ত কেটে কীভাবে আগে পিছে করে প্রত্যেক বৃত্তে পা দিতে হবে দেখিয়ে দিতে লাগলেন ও কৃষ্ণন তা অনুসরণ করে অভ্যাস করতে আরম্ভ করল। গুরু তাকে প্রতিদিন একঘণ্টা পদক্ষেপ, একঘণ্টা শরীর চর্চা, একঘণ্টা যোগব্যায়াম ও একঘণ্টা ধ্যান অভ্যাস করতে আদেশ দিলেন। গুরু কান্দান নিজেও একজন যোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি ধাপে ধাপে কৃষ্ণনকে যোগ শেখাতেও আরম্ভ করলেন। গুরুর নির্দেশ কৃষ্ণন অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে লাগল। ক্রমে ক্রমে সে অভ্যাসের সময়ও বাড়াতে লাগল। ধীরে ধীরে পদক্ষেপের বিভিন্ন ধাপে পা কে সামনে পেছনে, বা পাশে সরিয়ে, কখনও বৃত্তাকার ভাবে, তির্যকভাবে, সর্পিল ভাবে, দাঁড়ান অবস্থায় লাফ দিয়ে, শরীর মোচড় দিয়ে এক পাক ঘুরে আবার সাবলীল ভাবে দাঁড়ান সে ভালোভাবেই রপ্ত করল। গুরু কান্দান তার নিষ্ঠা আর দ্রুত শিখবার ক্ষমতা দেখে অবাক ও সন্তুষ্ট হলেন।
প্রায় মাস তিনেক নিষ্ঠার সঙ্গে অভ্যাসের পর গুরু কান্দান তার পরীক্ষা নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে কার্তিকা দীপমের দিন সকালে স্নান সেরে তাঁর ঠাকুরঘরে ভগবান অঞ্জনায়ারের মূর্তির সামনে কৃষ্ণনকে নিয়ে পূজায় বসলেন। ধূপ ধরিয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে, ফুল, কলা, নারকেল, ছোলা, লাড্ডু ও কেশরী ভাত নৈবেদ্য দিয়ে মন্ত্র পড়ে গুরু পূজা সমাপ্ত করলেন। কৃষ্ণন গুরুর সঙ্গে ভক্তিভরে প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করল। এরপর গুরু সিলাম্বামের প্রথা অনুসারে কৃষ্ণনের কপালে রক্তচন্দনের টিকা দিয়ে, মন্ত্র উচ্চারণ করে সিনহলের পবিত্র কেলানি গঙ্গার জল মাথায় ছিটিয়ে তার দেহ মন শুদ্ধ করে নতুন নাম দিলেন কান্নান। এর পর একটি দেড় আঙুল মোটা প্রায় ছয় ফুটের বাঁশের লাঠি মন্ত্র পড়ে ভগবান অঞ্জনায়ারের পাদস্পর্শ করে কান্নানের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এখন থেকে তুমি জগতে কান্নান নামে পরিচিত হবে আর আজ থেকেই তোমার অস্ত্রশিক্ষা শুরু হবে।’
সেদিন অপরাহ্নে গুরু কান্দান কান্নানকে নিয়ে শিক্ষার্থীদের ঘরে নিয়ে এলেন। গুরু নিজে একটি লাঠি নিয়ে উলটোদিকে মুখোমুখি দাঁড়ান কান্নানকে বললেন, ‘তুমি তো ছেলেবেলায় কিছুটা লাঠি খেলা শিখেছ। এখানেও কতকটা একই রকম। দেখ লাঠি চালনার চারটি ধাপ—সঞ্চালন, পক্শিল, প্রয়োগ ও শিল্প। সঞ্চালন প্রথম ধাপ যাতে তুমি বিভিন্ন প্রকারে কী ভাবে লাঠি ধরবে, চালনা করবে আর প্রতিপক্ষকে আঘাত করবে, আর তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উপযুক্ত পদক্ষেপ ও পদচালনা করবে, তার দক্ষতা অর্জ্জন করবে। দ্বিতীয় ধাপ পক্শিলে প্রাথমিক লাঠিচালনা ছাড়াও আরও কিছু জটিল চালনা পদ্ধতি যেমন কী ভাবে প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করবে, তাকে নিরস্ত্র করবে আর তাকে নিক্ষেপ করবে—এ সবেতে পারদর্শী হবে। তৃতীয় ধাপে প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রথম দুই ধাপের বাস্তব প্রয়োগ। আর চতুর্থ ধাপ শিল্প যেখানে শিক্ষার্থীর স্বতন্ত্র সৃজনশীলতা, শৈলীর, নতুন জটিল পদ্ধতি উদ্ভাবনের ক্ষমতা প্রকাশিত হয়।
এই বলে গুরু লাঠি নিয়ে প্রাথমিক স্তর থেকে কান্নানকে দেখাতে লাগলেন ও কান্নানও সেগুলি অনুসরণ করতে লাগল। প্রতিদিন গুরু তাকে আধা ঘণ্টা দেখাতেন আর কান্নান তা দুই-আড়াই ঘণ্টা অভ্যাস করত। আর তার সঙ্গে নিত্য শরীরচর্চা আর ধ্যানাভ্যাস তো ছিলই। ধীরে ধীরে লাঠিচালনার সকল ধাপই সে সাফল্যের সহিত উত্তীর্ণ হল। এর পর গুরু তাকে শেখালেন তরোয়াল চালনা, ঢালের ব্যবহার, নানাবিধ কাট্টি বা ছোড়া, ধাতব চাবুক সুরুল পাট্টাই, ভালো, বর্শা ও অন্যান্য অস্ত্রের প্রয়োগ। এ ছাড়াও শত্রুর প্রাণে ত্রাস সঞ্চারের জন্য কীভাবে হুঙ্কার বা সিংহনাদ করতে হয় তাও শেখালেন। প্রায় দু-বছর কঠোর অনুশীলনের পর কান্নানের সিলাম্বামের শিক্ষা সমাপ্ত হল। গুরুর কঠিন পরীক্ষাতেও সে সফল হল। গুরু সন্তুষ্ট হয়ে তাকে কয়েকদিন বিশ্রাম দিয়ে কুট্টু ভারিসাই শেখাতে আরম্ভ করলেন।
যেহেতু কুট্টু ভারিসাই নিরস্ত্র যুদ্ধকলা তাই আক্রমণ ও আত্মরক্ষার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ ও পদচালনার পরিকল্পনা করা হয় যাতে সর্বাধিক শক্তিকে ব্যবহার করে আঘাত হানা বা আঘাত প্রতিহত করা যায় আর এগুলো উদ্ভব হয়েছে জন্তু-জানোয়ারদের দেখে। প্রধান কয়েকটি হল বাঘ পদক্ষেপ—যা ছোটো অথচ দ্রুত, সাপ পদক্ষেপ—দীর্ঘ ও মসৃণ, ইগল পদক্ষেপ—উঁচু লাফ দিয়ে ওপর থেকে আক্রমণের জন্য, বানর পদক্ষেপ—ছোটো ছোটো লাফ দিয়ে আক্রমণ এড়ানোর জন্য।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা যা হবে অত্যন্ত দৃঢ় ও স্থিতিশীল। একটি ভঙ্গিমা হস্তি পদক্ষেপ বা গজ ভাদিভু। এতে এক পা সামনে হাঁটু সমকোনে ভেঙে থাকবে আর অপর পা খানিক পেছনে সোজাভাবে থাকবে আর শিরদাঁড়া সোজা থাকবে। এতে দেহের ভারসাম্য রক্ষা ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। এ ছাড়া দেহের বিভিন্ন স্পর্শবিন্দুগুলো জানতে হবে যেখানে আঘাত হানলে বিপক্ষ সহজেই ব্যথায় কাবু হয়ে যায়।
এভাবে গুরু কান্নানকে কুট্টু ভারিসাই সম্বন্ধে খানিক আভাষ দিয়ে প্রতিদিন অল্প অল্প করে ধাপে ধাপে তাকে শিক্ষাদান শুরু করলেন আর তার শিষ্যও গুরু অনুসরণ করে তা অভ্যাস করতে লাগল। হাতের আর আঙুলের জোর বাড়ানোর জন্য কাঠের তক্তার ওপর খড়ের দড়ি জড়িয়ে তার ওপর মুষ্ট্যাঘাত, আঙুল দিয়ে আর হাতের ধার দিয়ে কাটারি-আঘাত করে হাতের জোর বাড়াতে লাগল। গুরু কান্দানের শিক্ষায় আর নিজের নিষ্ঠা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেড় বছরের মধ্যে কুট্টু ভারসাইয়ের সকল পদ্ধতিতে কান্নান সুদক্ষ হয়ে উঠল। এমনকি যারা সেখানে বরিষ্ঠ ছাত্র ছিল এবং অন্যান্য ছাত্রদের শিক্ষাদান করত, তারাও কেউ কান্নানকে হারাতে পারত না। অবশেষে গুরু একদিন তার শিক্ষা সমাপ্ত ঘোষণা করে তাকে অন্যতম শিক্ষক নিযুক্ত করলেন ও তাকে একটি সুন্দর বাঁকানো ছোড়া বা কাট্টি উপহার দিলেন।
গুরু কান্দান শিক্ষাদানের জন্য কোনো অর্থ গ্রহণ করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষা কোনো পণ্যবস্তু নয়। অশোকাপুরায় এমন কি অনুরাধাপুরাতেও গুরু কান্দানের যথেষ্ট সুনাম, সম্মান ও প্রভাব ছিল। রাজার সেনাদলেও তাঁর বেশ কিছু উচ্চপদস্থ ছাত্রও ছিল। অনুরাধাপুরার কিছু শ্রেষ্ঠী ছিল গুরু কান্দানের পৃষ্ঠপোষক। তারা তাঁকে নিয়মিত অর্থসাহায্য করত। এতে অবশ্য তাদের কিছুটা স্বার্থও ছিল। গুরু কান্দানের শিক্ষায়তন থেকে উত্তীর্ণ হওয়া কিছু শিক্ষার্থীদের তারা অনেক সময়ে তাদের ধন-সম্পদ, পণ্যসামগ্রী রক্ষার কাজে নিয়োগ করত।
একদিন গুরু কান্দানের বিশেষ পরিচিত অনুরাধাপুরার সুমনাপাল নামক জনৈক ধনী শ্রেষ্ঠী ঘেরাটোপ পাল্কিতে করে এলেন। কুশল বিনিময়ের পর শ্রেষ্ঠী জানালেন, ‘সম্প্রতি অনুরাধাপুরার রাজা মানবম্মা একসময়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছিলেন বটে এখন বৃদ্ধ হয়েছেন। রাজ্য প্রশাসন এখন একটু দুর্বল। সীমান্তবর্ত্তী এলাকাগুলিতে প্রায়ই খুন, রাহাজানি হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় বিশেষত ইয়ালপনম, রুহানা, মগধাপুরা সাম্রাজ্যের ভেতর দিয়ে যে সব পণ্যদ্রব্য পাঠানো হয় তার ওপর আক্রমণ করে লুঠ করা হচ্ছে। আমার পণ্যদ্রব্যের ওপর দু-তিন বার আক্রমণ হয়েছে। রক্ষীরা বাধা দিয়ে কিছু রক্ষা করেছে বটে কিন্তু তাতে হতাহতও হয়েছে। এমত অবস্থায় মশলা বা রেশমের বস্ত্রসম্ভার ছাড়াও বিদেশে যে সব মুল্যবান রপ্তানি পণ্যদ্রব্য পাঠানো হয়ে থাকে অর্থাৎ পান্না, চুনির মতন রত্ন, হাতির দাঁত আমাকে সম্প্রতি আগামী তিন মাসের মধ্যে তালমপারানাই, মহাতিত্থা ও কুড্ডুলিপ্পালাই বন্দরে যে সব শ্রেষ্ঠী রপ্তানি করে তাদের কাছে পাঠাতে হবে তাই আমি বিশেষ চিন্তিত হয়ে আপনার কাছে এসেছি। আমার বিশেষ অনুরোধ আমায় একজন অতি বিশ্বস্ত সুদক্ষ সিলাম্বাম যোদ্ধা দিন যার হাত দিয়ে আমি পণ্যদ্রব্য পাঠাতে পারি। এটা সাময়িক আর এর জন্য আমি উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে প্রস্তুত।’
গুরু কান্দান বললেন, ‘বেশ আমি তিন মাসের জন্য একজন আমার অতি প্রিয় পুত্রবৎ ছাত্রকে দিচ্ছি। বয়স কম হলেও তার মতন দক্ষ এখানে কেউ নেই। তার উপযুক্ত সম্মান আপনি দেবেন। আর তিন মাস পর তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন।’
কান্নানের গুরুকে ছেড়ে যাবার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু গুরুর আদেশ সে কোনো অবস্থাতেই লঙ্ঘন করতে পারে না। তা ছাড়া তাকে তো একদিন বৃহত্তর জগতে একা যেতেই হবে। তাই সে দ্বিরুক্তি না করে সুমনাপাল শ্রেষ্ঠীর সঙ্গে অনুরাধাপুরায় চলে এল। শ্রেষ্ঠী তাকে নিজের আলিসান প্রাসাদে একটি ভালো ঘরে থাকতে দিলেন ও পরদিন তার বস্ত্রাদি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেন। গুরু কান্দান শ্রেষ্ঠীকে অনুরোধ করেছিলেন যে তাঁর অশ্বপালক যেন কান্নানকে একটু অশ্বচালনা শিখিয়ে দেয়। শ্রেষ্ঠী তাঁর অশ্বপালক সাঁইদেবকে নির্দেশ দিলেন কান্নানকে অশ্বচালনা শেখাবার জন্য।
সাঁইদেব কান্নানকে শেখাবার জন্য প্রথমে একটি শান্ত ও অভিজ্ঞ ঘোড়া নিয়ে শ্রেষ্ঠীর অট্টালিকা সংলগ্ন একটি বড়ো মাঠে নিয়ে এল ও কীভাবে ঘোড়ার সঙ্গে ভাব জমাতে হবে, বন্ধুত্ব পাতাতে হবে, ঘোড়ায় চড়া ও নামা, লাগাম চালনা সব ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে যত্ন করে শেখাতে লাগল। কান্নানের মধুর ব্যবহার, তার দ্রুত শিখে নেবার ক্ষমতা তাকে মুগ্ধ করল। নিয়মিত ধ্যানাভ্যাস করে কান্নানের মনঃসংযোগ, স্মৃতিশক্তি ও শ্রুতিশক্তি খুব বেড়ে গিয়েছিল। যেহেতু সাঁইদেব তাকে ঘোড়ায় চড়া শেখাচ্ছে তাই কান্নান তাকে গুরুর মতনই শ্রদ্ধা করত। দিন দশেক প্রতিদিন তিন-চার ঘণ্টা করে অভ্যাস করার জন্য তার ঘোড়ায় চড়া মোটামুটি রপ্ত হল।
একদিন শ্রেষ্ঠী তাকে বললেন যে একটি দুই ঘোড়ায় টানা ছাউনি দেওয়া কাঠের গাড়িতে তাঁর রপ্তানির মূল্যবান পণ্যদ্রব্য কয়েক বস্তা দারুচিনি, লবঙ্গ, গোল মরিচ আর কয়েক গাঠ্ঠি রেশম বস্ত্র নিয়ে কান্নানকে পরদিন খুব ভোরে তালমপারানাই বন্দরে যেতে হবে। সঙ্গে অবশ্য আরও দুজন রক্ষী, দুজন মালবাহক, একজন গাড়িচালক ও একজন সহকারী ব্যবস্থাপক যাবে। সেখানকার শ্রেষ্ঠীর কাছে পণ্যদ্রব্য বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে আসতে হবে। অর্থকড়ির লেনদেন সেখানকার শ্রেষ্ঠীর অনুরাধাপুরার কার্যালয় থেকেই হবে। কান্নান গাড়ির পাশে পাশে ঘোড়ায় যাবে। সে খুব সকালে স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিল। তার হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, গায়ে মোটা কাপড়ের জামার ওপর চামড়ার বর্ম, কোমরবন্ধের ভেতরে বাঁকানো ছোরা, কোমরে বাঁধা তরোয়াল আর হাতে মোটা পাকা বাঁশের লাঠি। কান্নানের কাঁধ অবধি ঘন কালো ঈশৎ কোঁকড়ানো চুল, সাদা পাগড়ি বা পেয়া দিয়ে ঢাকা, কানে কুন্ডল, পায়ে চামড়ার হাঁটু অবধি ফিতে দেওয়া জুতো, ঘোড়ার ওপর বসা, দৃপ্ত ভয়লেশহীন মুখের ভাব দেখে শ্রেষ্ঠী বেশ নিশ্চিন্ত হলেন।
অনুরাধাপুরা থেকে পূর্বদিকে তালমপারানাই বা এখনকার ত্রিনকোমালি প্রায় পঁয়তিরিশ ক্রোশ পথ। খানিক চওড়া হলেও মাটির আর ছোটো পাথর দিয়ে করা রাস্তা। কান্নান ঘোড়ায় চড়ে রাস্তার দু-পাশ দেখতে দেখতে চলেছে। তার ঠিক পেছনে পণ্যবাহী গাড়ি ও অন্যান্য লোকজন। অনুরাধাপুরা থেকে তালমপারানাই যাবার এই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথে কতশত তীর্থযাত্রী, ভ্রমণার্থী, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও ভিক্ষুর দল, গ্রামবাসীরা দলে দলে কখনও হেঁটে, কখনও বা গোরুর গাড়িতে করে স্থানান্তরে চলেছে। কোথাও রাস্তার দুপাশে বনানী। হাতি চলে আসে কখনও-সখনও। গভীর বনে বাঘও আছে। বাঁদরের উৎপাত তো আছেই। কোথাও বা দুপাশে চোখ জুড়ানো বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ধান, বাজরা বা আখের খেত। চাষির দল খেতে কাজ করছে; সন্নিকটেই গ্রাম। নিজের দেশের ছবি যেন ভেসে ওঠে কান্নানের চোখে।
দুপুরের দিকে কান্নানের দল মিহিনতালে পাহাড়ের কাছে তৃতীয় শতাব্দীতে রাজা মহাসেনা নির্মিত মহাকান্তরাভা নামে এক বিশাল জলাধারের কাছে এল। কাছেই তীর্থযাত্রীদের জন্য বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এক সত্রে খাওয়াদাওয়া করে, খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলতে শুরু করল। তাদের সঙ্গে আরও কিছু ব্যবসায়ী দল ও তীর্থযাত্রীর দল জুটে গেল। ডাকাতি, রাহাজানীর ভয়ে তখন অনেকে মিলে একসঙ্গে চলা দস্তুর ছিল।
সে যাত্রা নির্বিঘ্নেই কাটল। পরদিন সন্ধের মুখে কান্নানের দল তালমপারানাইয়ের শ্রেষ্ঠীর প্রাসাদোপম গৃহে এসে পৌঁছাল। সে রাত্রে তারা শ্রেষ্ঠীর অতিথিশালায় কাটিয়ে পরদিন সহকারী ব্যবস্থাপক মালবাহকদের দিয়ে শ্রেষ্ঠির গুদামে রেখে, তাল পাতায় চালান লিখে শ্রেষ্ঠী সই ও সিলের ছাপ নিয়ে নিল। কান্নান ইতিমধ্যে তালমপারানাইয়ের বিখ্যাত কোনেশ্বরম মন্দিরে শিব ও অন্যান্য দেবতাদের দর্শন করে এল। ফিরে এল সবাই সেদিন দুপুরে আহারাদির পর।
এর সপ্তাহ দুয়েক পর কান্নানকে পণ্যসামগ্রী নিয়ে যেতে হল কুড্ডুলিপ্পালাই, যার পরে নাম হয় জাফনা। অনুরাধাপুরা থেকে প্রায় চৌষট্টি ক্রোশ পথ। দিন দশেক লাগল যাতায়াতে। সে যাত্রাতেও কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। কোথাও যাবার না থাকলে কান্নান নিয়মিত ঘোড়ায় চড়া, শারীরিক কসরৎ ও সিলাম্বাম আর কুট্টু ভারিসাইয়ের ছায়া-অনুশীলন করত।
মাস দুয়েক কান্নানের সুমনাপাল শ্রেষ্ঠীর গৃহে কেটে গেল। একদিন শ্রেষ্ঠী তাকে বললেন যে পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য থেকে মহাতিত্থা বন্দরে এক বাণিজ্য জাহাজ এসেছে সিনহলের রত্ন, হাতির দাঁতের সামগ্রী, রেশম বস্ত্র কেনার জন্য। এবার তিনি নিজেই যাবেন হাতিতে চড়ে আর সঙ্গে থাকবে তার জেষ্ঠ্য পুত্র। সহকারি ব্যবস্থাপক, তিনজন রক্ষী, দুজন মালবাহক রেশম বস্ত্রের গাঠ্ঠি আর কাঠের বাক্সে চারিদিকে ঠেসে খড় দিয়ে হাতির দাঁতের বুদ্ধমূর্তি, হাতি, ঘোড়া, পালতোলা নৌকা, বাদ্য যন্ত্র, অলংকার, বাক্সবন্দি করা সব পণ্যদ্রব্য নিয়ে ঘোড়ায় টানা গাড়িতে আসবে আর কান্নান যাবে তার ঘোড়াতে। কান্নান শ্রেষ্ঠীকে তার তরোয়াল, ছোরা ছাড়াও ধাতব চাবুকের মতন তরোয়াল সুরুল পাট্টাই আনিয়ে দিতে বলল।
অনুরাধাপুরা থেকে মহাতিত্থা বন্দর বা এখনকার মান্থাই প্রায় আটতিরিশ ক্রোশ পথ, দু-তিন দিনের মতন সময় লাগবে। এই রাস্তা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ। অনুরাধাপুরা সাম্রাজ্যের অধীনে পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীতে তৈরি। মাটি ও নুড়ি পাথরের রাস্তা। দু-পাশে গাছের সারি। বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রী ও, অনেক সময়ে সৈন্যের দল এ পথে যাতায়াত করে। এমনিতে রাস্তা ভালো, তবে মহাতিত্থা থেকে নয় দশ ক্রোশ আগে প্রায় দশ ক্রোশ রাস্তার দু পাশে হালকা থেকে ঘন জঙ্গল আছে। এ পথে মাঝেমাঝেই ডাকাতি, রাহাজানি, খুনখারাপিও হয়।
অধিকাংশ সময়ে এ পথে যাত্রীরা, ব্যবসায়ীরা অনেকে দল মিলে একসঙ্গে চলে। সুমনাপালের হাতে সময় কম। দেরি হলে বিদেশি জাহাজ ছেড়ে চলে যেতে পারে। তা হলে তার অনেক ক্ষতি হবে। তাই তারা নিজেরাই পথ চলতে লাগল। বনপথের প্রায় মাঝামাঝি চলে এসেছে। কান্নান প্রখর নজরে সুরুল পাট্টাই-এর হাতলে হাত রেখে আগে আগে ঘোড়া নিয়ে চলেছে। কান্নানের ষষ্ঠ অনুভূতিতে মনে হল বনের দু-পাশে যে মানুষ সমান ঘন ঝোপ আছে সেগুলো যেন একটু বেশি আন্দোলিত হল। কান্নান হাত তুলে পেছনের দলকে থামতে ইশারা করে সামনে দু-কদম এগিয়ে গেল। আর ঠিক সেই সময়ে দু-পাশ থেকে প্রায় সাত-আটজন লোক লাঠি নিয়ে রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একজনের হাতে তরোয়ালও ছিল। সে বোধ হয় সর্দার।
কান্নানতো প্রস্তুতই ছিল সুরুল পাট্টাই-এর হাতলে হাত দিয়ে। হুংকার দিয়ে সে ঝটিতে চার ফলাওয়ালা সুরুল পাট্টাই বিদ্যুতগতিতে চালাতে লাগল। স্টিলের নমনীয় চারখানা ধারাল লম্বা পাত ডাকাতদের উন্মুক্ত বুকে পিঠে একসঙ্গে চাবুকের মতন কেটে বসতে লাগল। ডাকাতরা এরকম ঝটিকা আক্রমণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। এরকম অস্ত্রও তারা দেখেনি। তার ওপরে কান্নান ঘোড়ার পিঠের থেকে সুরুল পাট্টাই চালিয়েছে যা ডাকাতদের মাথার ওপর থেকে নেমে এসেছে বলে মারের জোরও ছিল খুব বেশি। হতভম্ব হয়ে মার খেয়ে চারজনের হাতের লাঠি সুরুল পাট্টাই-এর আঘাতে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল। সর্দার গোছের লোকটি তরোয়াল নিয়ে কান্নানের দিকে ছুটে এল। কান্নান বাঁ হাতে কোমরের খাপ থেকে তরোয়াল টেনে সজোরে ডাকাতের তরোয়ালের ওপর আঘাত হানতেই সেটা রাস্তার পাশে মাঠের দিকে ছিটকে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে কান্নান ডান হাতে সুরুল পাট্টাই দিয়ে সর্দারের মুখে গায়ে সপাটে মারল। মারের চোটে সর্দার মাটিতে পড়ে গেল। ইতিমধ্যে ঘোড়ার গাড়ি থেকে তিনজন রক্ষী নেমে এসে কান্নানকে দেখে আরও সাহস পেয়ে ডাকাতদের দিকে তেড়ে এল। তাদের গায়ে পিঠে মাথায় দু-তিন ঘা লাঠি পড়তেই তারা তিরবেগে রাস্তা থেকে উঠে জঙ্গলের দিকে পালাতে লাগল। সর্দার কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে দেখল মাথার ওপর উদ্যত তরোয়াল। সে হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা চাইতে কান্নান থেমে গেল ও সেই সুযোগে সেও পাশের মাঠ ভেঙে প্রাণপণ দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেল।
কান্নান কিছুক্ষণ দেখে মাহুতকে এগোতে ইশারা করল। রক্ষীরাও তাদের গাড়িতে উঠলে ঘোড়ায় টানা গাড়িও চলতে শুরু করল। কান্নানও তার ঘোড়াকে নিয়ে কখনও সামনে কখনও পেছনে গিয়ে পুরো দলটা প্রহড়া দিয়ে চলল।
সমস্ত ঘটনাটা চোখের সামনে এত দ্রুত ঘটে গেল যে শ্রেষ্ঠী কেমন আতঙ্কে স্তম্ভিত হয়ে বসে ছিলেন। সম্বিত ফিরলে পর কান্নানের ভাবলেশহীন মুখ দেখে অবাক হয়ে ভাবলেন যে ছেলেটি মানুষ না মুরুগান স্বয়ং! আজ তাঁর অন্তত তিন শতাধিক স্বর্ণমুদ্রা ক্ষতি হতে পারত। অবশেষে বাকি পথ তাঁর দল নির্বিঘ্নেই পৌঁছাল। মহাতিত্থা পৌঁছে হাতি থেকে নেমে শ্রেষ্ঠী কান্নানকে জড়িয়ে ধরে অনেক কৃতজ্ঞতা জানালেন। সুমনাপাল দিন দুয়েক থেকে বিদেশি জাহাজের ব্যবসায়ীদের কাছে তার রত্নরাজি, রেশম বস্ত্র ও হাতির দাঁতের সৌখিন বস্তুগুলি বেশ চড়া দামেই বিক্রী করলেন। প্রত্যাশার অধিক দামই তিনি পেলেন। মহাতিত্থার পরিচিত এক হুন্ডি ব্যবসায়ীর মাধ্যমে বিক্রয়লব্ধ অর্থ পাঠাবার বন্দোবস্ত করে, কেটিশ্বরম মন্দিরে ভগবান শিবের পূজো দিয়ে শ্রেষ্ঠী সকলকে নিয়ে অনুরাধাপুরম নির্বিঘ্নেই ফিরে এলেন। ফিরে এসে শ্রেষ্ঠী কান্নানকে তার সান্মানিক প্রাপ্য ছাড়াও অতিরিক্ত অর্থ, একটি উচ্চমানের তরোয়াল ও সুরুল পাট্টাই অস্ত্র তাকে উপহার দিলেন।
ইতিমধ্যে তিনমাস কেটে গেছে। কান্নান গুরু কান্দানের কাছে ফিরে যেতে চায়। শ্রেষ্ঠীর মোটেও ইচ্ছে নেই। কিন্তু গুরু কান্দানকে সে রকমই কথা দিয়ে কান্নানকে নিয়ে এসেছিলেন বলে একদিন তাকে নিয়ে গুরুর কাছে এলেন। কান্নানের বীরত্বের কাহিনি বলে গুরুকে শ্রেষ্ঠী অনেক অনুরোধ করলেন যাতে কান্নান তার কাছে থেকে যায়। গুরু তাকে বললেন যে শুধুমাত্র রক্ষী হয়ে জীবন কাটান তার উদ্দেশ্য নয়। বৃহত্তর জগতে তাঁর এই বিদ্যাকে সে যাতে নিজ প্রতিভা বলে ছড়িয়ে দিতে পারে সে উদ্দেশ্যেই তিনি কান্নানকে নিজে হাতে শিক্ষা দিয়ে তৈরি করেছেন। গুরু বললেন, ‘দক্ষিণ ভারতে কানাড়া অঞ্চলে এখন সবথেকে শক্তিশালী চালুক্য সাম্রাজ্য। চালুক্য সম্রাট দ্বিতীয় পুলোকেশী সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছে। তার রাজধানী বাতাপি। আমার ইচ্ছে কান্নান সেখানে গিয়ে নিজের ভাগ্য অন্বেষণ করুক।’
শ্রেষ্ঠী কান্নানকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তাই তিনি বললেন, ‘কান্নানের প্রতি আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তার ভারতে যাবার যাবতীয় ব্যবস্থা আমি করতে প্রস্তুত।’
গুরু কান্দান শুনে খুশি হয়ে বললেন, ‘আর দিন দশেক পরে পোঙ্গাল উৎসব। তার পরেই কান্নান যাবে। আপনি তখন ওর যাবার ব্যবস্থা করে দেবেন।’
শ্রেষ্ঠী গুরুকে সশিষ্য তাঁর গৃহে পোঙ্গাল উৎসবের নিমন্ত্রণ করে গেলেন। গুরু কান্দানও নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। শ্রেষ্ঠী কান্নানের অনেক শুভ কামনা করে ফিরে গেলেন।
শ্রেষ্ঠী সুমনাপালের কাছ থেকে কান্নান যে অর্থ পেয়েছিল গুরুকে তার থেকে অনেকটা অর্থ সে প্রণামী স্বরূপ দিতে চাইল। গুরু শিষ্যের সম্মানার্থে তার থেকে একটি মুদ্রা রেখে বাকিটা তাকে দিয়ে বললেন, ‘তুমি বিদেশে যাচ্ছ। যতদিন না তোমার উপযুক্ত কর্মসংস্থান হচ্ছে এ অর্থ তোমার প্রয়োজন হবে। তাই তোমার কাছেই রাখ।’
তিনদিন ব্যাপী পোঙ্গাল বা এই নবান্ন উৎসব সিনহল ও দক্ষিণ ভারতের সকল তামিলভাষী জনগণের প্রধান বাৎসরিক উৎসব। দ্বিতীয় দিন সূর্য পোঙ্গাল। পোঙ্গাল প্রাচুর্য এবং সমৃদ্ধির প্রতীক এবং এটি ঐতিহ্যগতভাবে সূর্য দেবতাকে নিবেদন করা হয়। সমগ্র অনুরাধাপুরা এই উৎসব আনন্দে মেতে ওঠে। গুরু কান্দান কান্নান সহ তাঁর আরও দুজন শিষ্যকে নিয়ে শ্রেষ্ঠী সুমনাপালের গৃহে উৎসবে যোগদান করলেন।
শ্রেষ্ঠী গুরুকে জানালেন, ‘যে কান্নান যদি জাহাজে মহাতিত্থা বন্দর থেকে ইন্দু সাগরে ভারতের পশ্চিম উপকুলে মঙ্গলাপুরা বন্দরে যায় তা হলে সময় লাগবে দুই থেকে তিন দিন। এখন আবহাওয়াও ভালো। আমার খুব পরিচিত বন্ধুস্থানীয় এক শ্রেষ্ঠীর বাণিজ্য জাহাজ দিনসাতেক বাদে মঙ্গলাপুরা যাচ্ছে। কান্নান সে জাহাজেই যেতে পারবে। আর সেখান থেকে কানাড়ার বাতাপি দেড়শো ক্রোশ পথ। ভালো ঘোড়ায় গেলে দিন আষ্টেক বড়োজোর লাগবে। সেটাই কান্নানের পক্ষে অনেক সুবিধা হবে। আর কুড্ডুলিপ্পালাই থেকে রামেশ্বরম প্রতিদিনই তীর্থযাত্রীদের নৌকা যাওয়া আসা করছে কিন্তু রামেশ্বরম থেকে বাতাপি কম করেও একমাসের পথ। কিন্তু সেই দীর্ঘ পথ অনেক বেশি বিপদ সংকুল। তা ছাড়া চেরা, পাণ্ড্য, চোল এ সব বিভিন্ন সাম্রাজ্যের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। বিদেশি চর ভেবে গেফতার হবার সম্ভাবনাও আছে।’
গুরু বললেন, ‘আপনি যেটা কান্নানের পক্ষে ভালো হবে মনে করেছেন সেটাই করুন।’
কান্নান এ কদিন গুরুগৃহেই রইল। পিতৃসম গুরুকে ছেড়ে যেতে হবে এ জন্য কিছুটা বিষণ্ণ। গুরু তাকে প্রেরণা দিয়ে উদবুদ্ধ করতে লাগলেন। একদিন গুরু তাকে বললেন, ‘তুমি আমাকে গুরুদক্ষিণাস্বরূপ যে দক্ষিণাবর্তী শাঁখটি দিয়েছ, সেটা দেবদুর্লভ বস্তু। এর যথাযোগ্য মর্যাদার প্রয়োজন। আমি বৃদ্ধ হয়েছি। আমার চিন্তা আমার অবর্তমানে এর সেই মর্যাদা থাকবে কি না। তুমি যাবার পথে মহাতিত্থায় কেটিশ্বরম মন্দিরে গুরুক্কাল নামে একজন বরিষ্ঠ পূজারি আছেন, তাঁকে আমার নাম করে দেবে ভগবান শিবের চরণে নিবেদন করতে।’
যাত্রার দিন সকালে কান্নান স্নান সেরে গুরুর সঙ্গে ভগবান অঞ্জনায়ারের পুজো দিয়ে মোটা চাদরের পুঁটুলিতে তার কাপড়-জামা, একটি চাদরে জড়ানো দক্ষিণাবর্তী শাঁখ, একটি ছোটো বাঁকানো তরোয়াল ও সুরুল পাট্টাইটা নিয়ে নিল। লাল কোমরবন্ধে তার সঞ্চিত অর্থ ও গুরুপ্রদত্ত ছোরাটি নিয়ে প্রস্তুত হল। ইতিমধ্যে শ্রেষ্ঠির পাঠানো ঘোড়ার গাড়িটি নিয়ে শ্রেষ্ঠীর এক সহকারী এসেছে কান্নানকে জাহাজে তুলে দেবার জন্য। কান্নান গুরুকে প্রণাম করে বিষণ্ণ মনে ঘোড়ার গাড়িতে উঠল। গুরু তাকে অনেক আশীর্বাদ করে ছলছল চোখে বিদায় জানালেন।
মহাতিত্থায় এসে সহকারী কান্নানকে নিয়ে শ্রেষ্ঠী নাম্বিয়ারের গৃহে এসে তাঁকে শ্রেষ্ঠী সুমনাপালের পত্র দিয়ে সব কিছু জানাল। শ্রেষ্ঠী প্রীত হয়ে কান্নানকে নিজ গৃহেই স্থান দিলেন। সেদিন কান্নান কেটিশ্বরম মন্দিরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে পূজারি গুরুক্কলের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে প্রণাম করে গুরু কান্দানের কথা বলে দক্ষিণাবর্ত্তী শাঁখটা দিল। বৃদ্ধ শাঁখটা পেয়ে খুব অবাক হল। নিজে কান্নানকে নিয়ে মূল মন্দিরে প্রবেশ করে শাঁখটি শিবলিঙ্গের সামনে নিবেদন করলেন। বৃদ্ধ গুরুক্কল একটি রুদ্রাক্ষের মালা শিবকে মন্ত্র পড়ে নিবেদন করে কান্নানকে দিয়ে বললেন, ‘এ মালাটি পরে থেকো, এটি তোমাকে রক্ষা করবে।’ কান্নান মালাটি গলায় পরে নিল।
পরদিন শ্রেষ্ঠী নাম্বিয়ার নিজে তাকে মঙ্গলাপুরা গামী জাহাজে তুলে দিল। শ্রেষ্ঠীর অতিথি বলে জাহাজে সবাই তাকে বেশ খাতির করতে লাগল। ইন্দু সাগর দিয়ে জাহাজ চলেছে। এই সাগর অনেক শান্ত, নদীর মতন—পূর্ব সমুদ্রের মতন এমন তরঙ্গসংকুল নয়। তর তর করে জাহাজ চলেছে। কান্নান অনুভব করল আবার সে একা। এতদিন গুরুর ছত্রছায়ায় পক্ষীশাবকের মতন ছিল। এই সুবৃহৎ জগতে আজ সে একাই চলেছে কোন অজানা ভবিষ্যতের পানে। তবুও আজ তার আগের থেকে আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি। সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থও রয়েছে আর আছে তার নিজস্ব শক্তি, সাহস, যুদ্ধবিদ্যার শিক্ষা আর দক্ষতা। তিনদিন পরে জাহাজ মঙ্গলাপুরা বন্দরে এসে ভিড়ল। নেত্রাবতী নদীর মোহানার মুখেই বন্দর।
সেদিনকার মঙ্গলাপুরা বা বর্তমানের ম্যাঙ্গালুরু ছিল প্রাচীন আলভাখেডা সাম্রাজ্যের রাজধানী। আলুপা রাজবংশের রাজা কুন্দবর্মা তখন সিংহাসনে আসীন। দক্ষিণে মঙ্গলাপুরা থেকে উত্তর কানাড়ার গোকর্ণ পর্যন্ত ইন্দু সাগরের উপকুল অঞ্চল জুড়ে ছিল তার রাজত্ব। পশ্চিমে ইন্দু সাগর আর পূর্বে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা এই সাম্রাজ্যকে দুর্গের মতন রক্ষা করছে। মঙ্গলাপুরার দূর্গাপরমেশ্বরী মন্দিরে বিভিন্ন দেশ থেকে তীর্থযাত্রী আসে। বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বণিক সম্প্রদায় জাহাজে আসে সওদার জন্য। শহরে হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ বিহারের পরিচালনায় ধর্মশালা ও খাবারের ব্যবস্থা আছে। কান্নান সেদিনের মতন একটি ধর্মশালায় আশ্রয় নিল।
শহরে দু-তিনটি আস্তাবল ছিল। তাদেরই মধ্যে যেটি বড়ো তার কাছে কান্নান সন্ধান করল বাতাপি যাবার পথ। আস্তাবলের মালিক জানাল, ‘এখান থেকে ঘোড়া নিয়ে আপনি সোজা বাতাপি অব্ধি যেতে পারেন যদি আপনি প্রতিদিন ঘোড়াকে অন্তত সাত-আট ঘণ্টা বিশ্রাম ও ভালো খাবার দেন। আর যদি শীঘ্র যেতে হয় তা হলে চার-পাঁচ বার ঘোড়া পালটাতে হবে আর অনেক সময়ে নিজেকে পথ চিনে যেতে হবে।
কান্নান বলল, ‘আমার কোনো তাড়া নেই। সন্ধের পর আমি নিজেও কোনো ভালো সরাইখানা বা ধর্মশালায় আশ্রয় নেব। পরদিন আবার ভোরে রওনা হব। ঘোড়াও বিশ্রাম পাবে আর ভালো খাবারের ব্যবস্থাও করব। কান্নানের চেহারা ও কথাবার্তার মধ্যে একটা গম্ভীর ও বীরত্বব্যাঞ্জক ভাব আছে যা আস্তাবলের মালিককে আস্বস্ত করল। সে কান্নানের সঙ্গে কথা বলে জানল যে সে একজন বিদেশি ও যোদ্ধা। চালুক্য সম্রাট পুলোকেশীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার বাসনায় সে বাতাপি যেতে চায়। কান্নানের কথার মধ্যে এতটা স্পষ্টতা ছিল যে আস্তাবলের মালিক সন্তুষ্ট হয়ে একটা ভালো বড়ো সাদা আরবী ঘোড়া নিয়ে এল।
কান্নানেরও ঘোড়াটা দেখে বেশ পছন্দ হল। সে সময় নিয়ে আস্তে আস্তে ঘোড়ার ঘাড়ে, কেশরে, কাঁধে, কানের পেছনে বুঝে বুঝে আদর করে হাত বোলাতে লাগল। তার সঙ্গে শরীরী ভাষা বুঝে নরম সুরে কথা বলতে লাগল। বেশ অল্প সময়ের মধ্যে কান্নান ঘোড়াকে মানিয়ে নিল। মালিক জানাল যে এই ঘোড়াটি বার দু-তিনেক বাতাপি গেছে তাই এই পথ তার চেনা। তাকে তার মতন চলতে দিলে সে ঠিক কান্নানকে বাতাপি নিয়ে যাবে। পথে অবশ্য বারো বার নদী পেরতে হবে। আর তার জন্য সবথেকে ভালো হল বড়ো ভেলা—ঘোড়াশুদ্ধ পার করে দেবে। অবশ্য তিন-চার জায়গায় নদী খুব সরু। এ সময়ে জলও বেশি নেই। ঘোড়া হেঁটেই পার হতে পারবে। কয়েক জায়গায় কাঠের সেতুও আছে। কান্নানতো আর পেশাদার অশ্বারোহী নয় তাই তার নিজস্ব জিন, লাগাম নেই। মালিক তাই নিজেই জিন, রেকাব, লাগাম সব দিয়ে ঘোড়াকে প্রস্তুত করে দিল। কান্নান উপযুক্ত অর্থ দিয়ে মালিককে খুশি করে দিল। মালিক তাকে বলেও দিল বাতাপিতে কোন আস্তাবলে ঘোড়া ফেরত দিতে হবে। কান্নান ঘোড়া নিয়ে যখন ধর্মশালায় ফিরে এল তখন শেষ অপরাহ্ণবেলা।
পরদিন খুব ভোরে কান্নান রওনা হল। উদুপির রাস্তার দিকে ঘোড়াকে চালাতেই ঘোড়া রাস্তা বুঝে নিয়ে নিজের মনে চলতে লাগল। কিছুদূর গিয়ে গুরুপুরা নদীর ওপর কাঠের সেতু পেরিয়ে ইন্দুসাগরের ধার বরাবর ঘোড়া চলতে লাগল। দুপুরবেলা একটা গাছের তলায় ঘণ্টাখানেক জিরিয়ে ধর্মশালা থেকে আনা কিছু শুকনো খাবার চিড়ে, মেঠাই খেয়ে নিল। ঘোড়াকে সামনের ঘাসজমিতে ছেড়ে দিল খাবার জন্য। সন্ধেবেলা উদুপিতে পৌঁছে একটা ধর্মশালায় উঠল।
পরের দিন তার যাত্রাপথে বেশ ধকল গেল। অনেকগুলো নদী পেরতে হল। সুবর্ণ নদীতে কাঠের সেতু থাকলেও সীতা, পঞ্চগঙ্গাবলী, তাকে ভেলায় করে পেরতে হল। সে রাতে হেম্মাদি গ্রামে আশ্রয় নিল। চলতে চলতে তাকে সারাবতী সহ আরও কিছু নদী পেরতে হল। ঘোড়াটা বাতাপির পথ চেনে বলে কান্নান ওকে ছেড়ে দিয়েছে। ঘোড়াটা সত্যিই ভালো। সওয়ারীর সঙ্গে তার একটা যেন সখ্যতা জন্মে গেছে। মঙ্গলাপুরা ছেড়ে আসার প্রায় নবম দিনে বেলা দ্বিপ্রহরে সে এসে বাতাপি পৌঁছাল।
শহরের বাইরে একটি হিন্দু ধর্মশালা পেয়ে সেখানে উঠল। ঘোড়াটাকে ভালো দানাপানি দিয়ে, নিজেও স্নান খাওয়া দাওয়া সেরে ঘোড়াকে নিয়ে যে আস্তাবলে জমা দেবার কথা তার খোঁজে বেরোলো। প্রায় ঘণ্টাখানেক খুঁজে সে আস্তাবলের মালিকের কাছে ঘোড়া বুঝিয়ে দিয়ে ধর্মশালায় ফিরে এল।
দক্ষিণ, পশ্চিম ও মধ্য ভারতের একটা বড়ো অংশ জুড়ে ছিল এই চালুক্য সাম্রাজ্য। তখন সম্রাট—চালুক্য রাজবংশের দ্বিতীয় পুলোকেশীন। তার রাজধানী ছিল এই বাতাপি যার এখনকার নাম বাদামি। উত্তর কানাড়ায় মালপ্রভা নদী থেকে একটু দূরে মালপ্রভা উপত্যকায় অগস্ত্য হ্রদের চারপাশে রুক্ষ, লাল বেলেপাথরের পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। দুটি পাথুরে পাহাড় শহরটিকে ঘিরে রেখে প্রাকৃতিক সুরক্ষা প্রদান করেছে। চালুক্য বংশের প্রথম পুলকেশীন এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। পাহাড় কেটে তিনি তাঁর দুর্গ নির্মান করেন। দুর্গ থেকে সমস্ত শহর আর চারপাশের বিস্তির্ণ এলাকার ওপর নজর রাখা যায়। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীতে তাঁর পুত্র রাজা প্রথম কীর্তিবর্মন ও তাঁর ভ্রাতা মহারাজা মঙ্গলেশা পাহাড় কেটে এখানে গুহা মন্দির, ভূতনাথ মন্দির, শিবালয়, জাম্বুলিঙ্গেশ্বর মন্দির আর কৃত্রিম জলাশয় অগ্যস্ত হ্রদ নির্মাণ করেছিলেন।
প্রথম পুলোকেশীনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম কীর্তিবর্মন রাজা হন। দীর্ঘ বত্রিশ বছর রাজত্বের পর তাঁর যখন মৃত্যু হয় তাঁর তিন পুত্রই তখন খুবই ছোটো। ফলে তাঁর ভ্রাতা বীর যোদ্ধা মঙ্গলেশা সিংহাসনে আরোহণ করেন ও সীমানাবর্তী রাজ্যগুলি দখল করে সাম্রাজ্য বৃদ্ধি করেন। কীর্তিবর্মনের জ্যেষ্ঠপুত্র অবনীবর্মন প্রথম যৌবনে স্বীয় বুদ্ধিবলে আপন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে মঙ্গলেশার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নাদনুরুর যুদ্ধে জয়লাভ করে সিংহাসন দখল করে দ্বিতীয় পুলোকেশীন নাম নিয়ে চালুক্য সাম্রাজ্য বিস্তারে মন দেন।
কান্নান যখন বাতাপিতে আসে তখন সম্রাট দ্বিতীয় পুলোকেশীনের সাত বছরের রাজত্বকাল চলছে। তার এখন একটাই চিন্তা কীভাবে সে সম্রাটের সাক্ষাৎ পেতে পারে। রক্ষীদের চোখ এড়িয়ে দুর্গে প্রবেশ করা একপ্রকার অসম্ভব। তার ওপর সে এখানে অচেনা বিদেশি। সকালবেলা দুর্গের বাইরে থাকা বিভিন্ন কর্মীদের জন্য প্রধান দরজা খুললে তখন তাদের সঙ্গে রক্ষীদের চোখ এড়িয়ে ঢুকে পড়া যায় বটে, কিন্তু ভেতরে গুপ্তচর বলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা প্রচুর। আর গুপ্তচর বলে ধরলে বিচার যাই হোক মৃত্যুদণ্ড শাস্তি অবধারিত। এই সব ভাবতে ভাবতে কান্নান অগ্যস্ত হ্রদের পুব পাড়ে ভূতনাথ মন্দির দর্শন করে রাজপথ দিয়ে আসছিল।
এমন সময়ে পেছনে একটা হট্টগোল শুনে তাকিয়ে দেখে যে একদল অশ্বারোহী সৈন্য প্রবল গতিতে ঘোড়া চালিয়ে আসছে আর তাদের ঠিক সামনে একটি যুবক আপন মনে চলেছে। কান্নন তির বেগে ছুটে গিয়ে যুবককে এক হ্যাঁচকা টানে রাস্তার ধারে নিয়ে এল আর তখনই ঘোড়াগুলো পাশ দিয়ে তাদের গা ঘেঁষে বিদ্যুৎগতিতে বেরিয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় যুবকটি কেমন হতভম্ব হয়ে গেছে। কান্নান তাকে ধরে রাস্তার পাশে একটা বড়ো পাথরের খণ্ডের ওপর বসাল। যুবকটি খানিক ধাতস্থ হয়ে কান্নানের দিকে তাকিয়ে একটু মলিন হাসি হেসে বলল, ‘আজ তুমি না থাকলে বন্ধু আমি ঘোড়াদের পায়ে চাপা পড়েই মরতাম। তোমায় যে কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাব?’
এই প্রথম কেউ বোধ হয় তাকে বন্ধু বলে সম্বোধন করল। কান্নান বলল, ‘নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আমারও আছে।’
শুনে যুবকটি কান্নানের মুখের দিকে জিজ্ঞাসুর দৃষ্টিতে তাকাল। ইতিমধ্যে যুবকটি উঠে দাঁড়াল। পরনে ধুতি, খালি গায়ে শুধু যজ্ঞোপবীত। মাথায় লম্বা চুল, পেছনে গিঁট দিয়ে বাঁধা, কপালে ভস্মের রুদ্র তিলক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। হাতে একট ঝুড়িতে ফুলের মালা আর একটি আস্ত নারকেল। শক্ত করে ধরে রাখার ফলে মাটিতে পড়েনি। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে আলাপ-পরিচয় করতে লাগল। যুবকের নাম অনঘ—দুর্গের ভেতরে যে শিবমন্দির আছে তার পূজারির সহকারী। তার পিতা মন্দিরের পূজারি ছিল। তাঁর দেহান্তের পর সে এই কাজে নিযুক্ত হয়েছে। তার পিতা প্রধান দুর্গরক্ষক বজ্রপাণির গৃহেরও পূজারি ছিল। শুনে কান্নান একটা আশার আলো যেন দেখতে পেল।
কান্নানও তার জীবনকাহিনি আনুপূর্বিক অনঘকে বলল। কথা বলতে বলতে তারা শহরের প্রান্তে অনঘের বাড়ি চলে এল। অনঘ একরকম জোর করেই কান্নানকে ভেতরে নিয়ে গেল। গোটা তিনেক মাটির ঘর, শনের ছাউনি দেওয়া। বিশাল আঙ্গন, ছোটো বড়ো গাছে ভরা। ছায়ায় ঘেরা শান্ত পরিবেশ। বড়ো আমগাছের নীচে দড়ির চারপাই পাতা। অনঘ তার মাকে সব বলে কান্ননের পরিচয় দিল। দুপুরে ভাত, ডাল, সবজি আর দই-ভাত খেয়ে দুই বন্ধু দুটো চারপাইয়ে শুয়ে গল্প করতে লাগল।
কান্নান বলল, ‘বন্ধু আমি সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই। আমার বিদ্যার কলাকৌশল দেখিয়ে তাঁর সেবক হতে চাই। আমি একা কী বলে দুর্গে ঢুকব? তুমি কী আমাকে সাহায্য করতে পার?
‘সম্রাটকে আমি দেখেছি অনেকবার, কিন্তু কোনোদিনই কথা বলার সাহস হয় নি। আর তা ছাড়া দুর্গরক্ষকের অনুমতি ছাড়া সম্রাটের সঙ্গে রাজপরিবার, প্রধানমন্ত্রী আর প্রধান সেনাপতি ছাড়া কেউ দেখা করতে পারে না। আমি তোমাকে বড়োজোর দুর্গরক্ষকের সঙ্গে দেখা করাতে পারি। আমি তার গৃহে পূজার সামগ্রী নিয়ে যাই। তিনি আমাকে চেনেন। এবারে বাকি দায়িত্ব তোমার।
‘ঠিক আছে, দেখি আমি কীভাবে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারি।’
‘তা হলে এক কাজ কর। ধর্মশালা থেকে তোমার জিনিসপত্র নিয়ে আমাদের এখানে চলে এস। আমি তোমাকে খুব সকালে দুর্গের দরজা খুললে ভেতরে নিয়ে যাব। যতদিন তোমার কাজ না মিলছে তুমি নিশ্চিন্ত মনে আমাদের কাছে থাক।’
অনঘের মা তাকে একই কথা বলে আশ্বাস দিলেন। একজন অচেনা অজানা বিদেশিকে এরা কত সহজে আপন করে নিতে পারে—এ কথা ভেবে তার চোখ ছলছল করে উঠল। কান্নান অনঘের কথা মতন ধর্মশালায় গিয়ে তার জিনিসপত্র নিয়ে সন্ধ্যার পূর্বেই ফিরে এল।
পরদিন খুব সকালে দুর্গের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে লোকেদের দলে মিশে অনঘের সঙ্গে কান্নান দুর্গের ভেতরে ঢুকে গেল। একজন রক্ষী কান্নানের অচেনা মুখ দেখে আটকাল। অনঘ তাকে দুর্গরক্ষকের সঙ্গে দেখা করাতে যাচ্ছে বলে ছাড়িয়ে নিয়ে এল। বিশাল দুর্গ—পাহাড় কেটে কেটে তৈরি। বড়ো বড়ো খণ্ড চৌকো পাথর জোড়া দিয়ে প্রাচীর, দেওয়াল। কোথাও পাহাড়ের মূল অংশই দেওয়ালের কাজ করছে। চওড়া পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রধান দরজার পরেই পথ গেছে ভেতরে। আবার উঁচু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হয়। সিঁড়ির পাশে বিশাল গুহার মতন—সেখানে অনেক সৈন্য মোতায়েন করা আছে। উপরে বড়ো চত্বর সেখান থেকে রাস্তা দুর্গের ভেতরে চলে গেছে। ভেতরটা একটা ছোটোখাটো শহর। একস্থানে একটা বড়ো ঘর, দুর্গরক্ষকের কার্যালয়। অনঘ কান্নানকে বাইরে রেখে ভেতরে প্রবেশ করল। খানিক বাদে বেরিয়ে এসে কান্নানকে অপেক্ষা করতে বলে রাস্তা দিয়ে দুর্গের ভেতরে চলে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে দুজন সৈনিক খোলা তরোয়াল নিয়ে কান্নানকে ভেতরে নিয়ে গেল। কান্নান মাথা নত করে হাতজোড় করে প্রণাম করে দাঁড়াল। সামনে পাথরের বেদীর ওপর দুর্গরক্ষক বজ্রপাণি বসে। পঞ্চাশোর্ধ, কৃষ্ণবর্ণ, শালপ্রাংশু চেহারা—রেশমের ধুতি, গায়ে চামড়ার বর্ম, গলায় রত্নখচিত হার, কানে কুন্ডল, দু-হাতে চুনি পান্নার গোটা পাঁচেক আংটি। মাথায় ঝাঁকড়া কাঁচা-পাকা চুল কাঁধ অবধি। গোঁফ-দাড়িতে মুখ ঢাকা, চোখ ছোটো, ক্রুর দৃষ্টি। কোমরবন্ধে খাপে ঢাকা তরোয়াল। তীক্ষ্ণ নজরে কান্নানকে দেখে জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘কোন দেশের গুপ্তচর?’
কান্নানের মুখে, চোখে, শরীরের ভাষায় এতটুকু ভয়ের চিহ্ন নেই দেখে বজ্রপাণি একটু অবাক হলেন। কান্নান শান্ত দৃঢ় স্বরে জবাব দিল, ‘আমি কোনো দেশেরই গুপ্তচর নই।’
‘তুমি কে, কোথা থেকে কী উদ্দেশ্যে এখানে এসেছ?’
কান্নান তার জাহাজডুবির ঘটনা থেকে সিনহলে গুরু কান্দানের কাছে যুদ্ধ কলা শিক্ষা, শ্রেষ্ঠীর কাছে কাজ ও পরিশেষে মঙ্গলাপুরায় এসে শক্তিশালী চালুক্য সাম্রাজ্যের সম্রাটের অধীনে কর্মের উদ্দেশ্যে তার আগমন সংক্ষেপে ব্যক্ত করল।
বজ্রপাণি সব শুনে বললেন, ‘তুমি যে সত্যি বলছ তার প্রমাণ কী? মিথ্যে বলার শাস্তি কিন্তু মৃত্যু।’
‘আমার কথাই আমার প্রমাণ। এর বেশি কোনো প্রমাণ আমার হাতে এখন নেই। আমি নিরস্ত্র, অসহায়—আপনি ক্ষমতায় আসীন। যে কোনো সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা আপনার আছে। তবে আমি যুদ্ধ কলায় পারদর্শী। এর জন্য যে কোনো পরীক্ষা দিতে আমি প্রস্তুত,’ কান্নান এ কথা বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
‘এর জন্য যদি তোমাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়?’
‘আজ্ঞে, আমি তার জন্য চিন্তিত নই।’
অল্পবয়সি একটি যুবকের স্পষ্টবাদীতা ও দৃঢ়তা বজ্রপাণিকে মুগ্ধ করল। তিনি কান্নানকে আর কয়েকজন রক্ষী সৈনিককে নিয়ে ছোটো সিঁড়ি দিয়ে উঠে দুপাশে খাড়া উঁচু পাহাড়ের দেয়ালের মাঝে পাথরে বাঁধান সরু গলি দিয়ে এসে এক উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে এলেন। বজ্রপাণি কান্নানকে মাঠের মাঝে দাঁড়াতে বললেন। এবারে একজন সৈনিককে ইশারা করতে সে তরোয়াল নিয়ে কান্নানকে হঠাৎ আক্রমণ করল। কান্নান অবশ্য প্রস্তুতই ছিল। সে সহজেই তরোয়ালের দু-তিনটে চোট এড়িয়ে আচমকা নিজের ডান পায়ের গোড়ালি দিয়ে সৈনিকের বাঁ পায়ে হাঁটুর পেছনের খাঁজে সজোরে মারল। সৈনিকটি মাটিতে বসে পড়তেই এবারে পা দিয়ে বুকে মারল। সৈনিকটি চিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল আর হাতের তরোয়াল ছিটকে যেতেই কান্নান সেটা কুড়িয়ে নিয়ে সৈনিকের গলায় ডগাটা চেপে ধরল।
এবারে দুর্গরক্ষকের ইশারায় জনা তিনেক সৈনিক কান্নানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কান্নান হাতের তরোয়াল এবার বিদ্যুতবেগে চালাতেই দুজনের তরোয়াল ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল। তৃতীয়জন দু-হাতে তরোয়াল মাথার ওপর তুলে কান্নানের কাঁধ লক্ষ্য করে চালাল। কান্নান তার আগেই তার তরোয়ালের ভোঁতা দিক দিয়ে সৈনিকটার কনুইয়ের হাড়ে সজোরে মারল আর পা দিয়ে প্রতিপক্ষের পায়ের জঙ্ঘার হাড়ে মারতেই সৈনিকটি মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সমস্ত ঘটনাটি এত দ্রুত হয়ে গেল, বজ্রপাণির মতন বহু যুদ্ধের বীর যোদ্ধাও বুঝে উঠতে পারল না যে একজন অনভিজ্ঞ যুবকের পক্ষে এ কাজ কীভাবে সম্ভব। তিনি হাত তুলে থামতে বললেন।
সকলকে নিয়ে তিনি তার কার্যালয়ে এসে কান্নানকে বললেন, ‘দেখে মনে হয় তুমি তোমার যুদ্ধকলা উত্তম রূপেই জানো। আমি তোমার ওপর ভরসা করে আজ থেকে আমার অন্যতম দেহরক্ষীরূপে নিযুক্ত করছি।’
কান্নান শুনে একটু হতাশ হল। সে চেয়েছিল সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর অধীনে সেনাদলে যোগদান করতে। তবে এ মন্দের ভালো। অন্তত সে দুর্গে তো প্রবেশাধিকার পেল! একদিন না একদিন সম্রাটের নজরে সে পড়তেই পারবে এই আশাতেই সে বজ্রপাণির কথায় কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাজি হল।
কিন্তু ভাগ্য যার সুপ্রসন্ন, তাকে আটকায় কে? একটু বাদেই সম্রাটের একজন প্রতিহারী দুর্গরক্ষকের কাছে এসে বলল যে ভট্টারক জানতে চেয়েছেন যে নীচে প্রাঙ্গনে লড়াই হচ্ছিল কেন? আর রক্ষীরা ছাড়া অন্য ব্যক্তিটি কে? তিনি দুর্গরক্ষককে ওই ব্যক্তিটি সহ দেখা করতে বলেছেন।
বজ্রপাণির মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। ভট্টারক তাহলে ওপর থেকে সব লক্ষ্য করেছেন। তিনি প্রতিহারীর সঙ্গে সম্রাটের কাছে কান্নানকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। প্রাঙ্গনের পাশ দিয়ে যে রাস্তা চলে গেছে সেখানে আরেকটা বড়ো প্রবেশ পথ। দরজায় জনা আষ্টেক সশস্ত্র প্রহরী। এখানে সম্রাটের মহল। ক্রমে তারা একটি বিশাল রাজসভায় এসে উপস্থিত হল। প্রশস্ত সভার একধারে কাঠের কারুকার্যমন্ডিত সিংহাসনে সম্রাট দ্বিতীয় পুলোকেশীন মখমলের গদীর ওপর বসে। ঘিয়ে রঙের রেশমের সোনার জরিপার ধুতি, কোমরে সোনার রত্নমন্ডিত কোমরবন্ধ, গলায় রত্নহার, কানে কুন্ডল, বাহুতে অঙ্গদ, মাথায় সোনার মুকুট পরিহিত মহারাজাধিরাজের উন্মুক্ত বক্ষে সবুজ রেশমের অঙ্গবস্ত্র। তৎকালীন দক্ষিণ ভারতীয় রাজা মহারাজাগণের ধারণা ছিল বক্ষ উন্মুক্ত না থাকলে তাঁদের মহান হৃদয়ও উন্মুক্ত থাকে না।
সম্রাট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। সভাসদগণ সকলেই দুপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। কান্নান বজ্রপাণির সঙ্গে একটা থামের গা ঘেঁষে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পরে সম্রাট বজ্রপাণির দিকে তাকাতে, সে দ্রুত সম্রাটের কাছে গিয়ে মাথা নত করে প্রণাম করে দাঁড়াল। সম্রাটের সঙ্গে তাঁর কিছু কথাবার্তার পর বজ্রপাণি ইশারায় কান্নানকে ডাকল। কান্নান সম্রাটের কাছে মাথা নত করে প্রণাম করল। সম্রাট তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে কান্নান তার পরিচয় বিশদভাবেই বলল বিশেষ করে তার সিলাম্বাম শিক্ষার কথা আর কী উদ্দেশ্যে সে বাতাপিতে এসেছে। সম্রাট মন দিয়ে সমস্ত শুনলেন।
সম্রাট, ‘সিলাম্বাম সম্বন্ধে আমি শুনেছি,’ বলে ডানদিকে তাকিয়ে একজনের উদ্দেশ্যে হাত তুলে ইশারা করলেন। জনৈক লম্বা স্বাস্থ্যবান বর্মধারী পুরুষ এগিয়ে এসে সম্রাটকে প্রণাম করে দাঁড়াল। সম্রাট বললেন, ‘পার্থিবন এই ছেলেটি কী রকম শিক্ষা পেয়েছে, পরীক্ষা নাও তো।’
পার্থিবন খাপ থেকে তরোয়াল বের করে নিয়ে দাঁড়াল। সম্রাটের নির্দেশে একজন কয়েকটা তরোয়াল কান্নানের কাছে নিয়ে এলে কান্নান তার থেকে একটা বেছে নিয়ে পার্থিবনের মুখোমুখি নিজস্ব ভঙ্গিমায় দাঁড়াল।
সাম্রাজ্যের সেরা তরোয়ালবাজ পার্থিবন হিসেব মতনই আঘাতগুলো হানছে। কিন্তু কান্নান তার প্রতিটি আঘাতই তার তরোয়াল দিয়ে আটকাচ্ছে অথচ নিজে কোনো আঘাত হানছে না। তার ওপর কান্নানের ঠোঁটের কোনে একটু মিচকি হাসি, পার্থিবনকে আরও উত্তেজিত করে তুলছে। এবারে সে উন্মত্তের মতন কান্নানের সর্ব্বাঙ্গে দ্রুত আঘাত করতে লাগল। কিন্তু সবই কান্নানের বাধায় ব্যর্থ হতে লাগল। ইতিমধ্যে কান্নানের তরোয়ালের ডগার খোঁচায় পার্থিবনের মাথার জড়ির পার দেওয়া গাঢ় বাদামি-লাল রঙের পাগড়ি ছিটকে মাটিতে পড়ল। পার্থিবন এবারে রাগে অন্ধ হয়ে এলোপাথাড়ি তরোয়াল চালাতে লাগল। কান্নান দ্রুত পায়ের অবস্থান পালটে আঘাত এড়াতে লাগল। তারই মধ্যে এবারের খোঁচায় পার্থিবনের গলার সোনার হারটি খসে মাটিতে পড়ে গেল। ইতিমধ্যে পার্থিবন হাঁপিয়ে উঠেছে, ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে, সমস্ত শরীর ঘেমে গেছে। সুযোগ বুঝে কান্নান তার তরোয়ালের ভোঁতা দিক দিয়ে পার্থবনের তরোয়ালের ধরা মুষ্টিবদ্ধ হাতের আঙুলের গাঁটে আঘাত হানতেই হাত থেকে তরোয়াল ছিটকে মাটিতে পড়ল। সভাসুদ্ধ লোক অবাক বিস্ময়ে কান্নানকে দেখছে। পার্থিবনের মতন সেরা তরোয়ালবাজকে একটি অল্পবয়সি যুবকের এভাবে হেলায় হারাতে পারা কী সম্ভব!
এবারে সম্রাট হাতের ইশারায় দুজনকেই থামতে বললেন। কান্নানকে কাছে ডেকে সম্রাট তাঁর হাতের আঙুল থেকে আংটি খুলে দিয়ে বললেন, ‘এই সাম্রাজ্যের যেখানেই যাও এই আংটি দেখালে তোমার অবাধ গতি।’ কান্নান অভিভূত হয়ে সম্রাটকে প্রণাম জানিয়ে পুরস্কার গ্রহণ করল। সম্রাট বজ্রপাণিকে নির্দেশ দিলেন কান্নানকে অতিথি শালায় রাখতে আর অপরাহ্ণে ছোটো সভাগৃহে নিয়ে আসতে। সম্রাট উঠে আপন মহলের দিকে চলে গেলেন। কান্নান পার্থিবনের কাছে গিয়ে হাতজোড় করে বলল, ‘আমার অপরাধ নেবেন না। ভট্টারকের আদেশেই আমাকে আপনার সঙ্গে লড়তে হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করবেন।’ পার্থিবন কিছু বলতে পারল না। শুধু কান্নানের কাঁধে হাত দিয়ে মাথা নাড়ল।
কান্নান অতিথিশালায় আশ্রয় পেল। কিন্তু তার জিনিসপত্র সব তো অনঘের বাড়িতে। অনঘ এখনও শিবমন্দিরেই আছে না চলে গেছে কে জানে? অপরাহ্ণবেলা তো প্রায় হয়েই এল। অনঘের বাড়ি গিয়ে সে সব নিয়ে আসার মতন পর্যাপ্ত সময় নেই। সম্রাট আজ কী বলেন দেখি। আজীবন তো আর সে অতিথিশালায় থাকবে না। কাল বুঝে যা হোক ব্যবস্থা করা যাবে।
চতুর্থ প্রহরের প্রায় শেষ বেলায় কান্নান বজ্রপাণির সঙ্গে দুর্গের অভ্যন্তরে রাজার মহলে একটি বাগান ঘেরা পাথরে বাঁধান আয়তাকার চত্বরে এল। একদিকে পাথরের খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল আর অপরদিকে প্রশস্ত প্রবেশপথ। আরেকদিকের ছোটো প্রবেশপথ রাজার অন্দরমহলের দিকে চলে গেছে। কাঠের বড়ো আসনে সম্রাট, রেশমের গদীর ওপর তাকিয়া নিয়ে অর্ধশায়িত অবস্থায়। দু পাশে পাথরের বেদীর ওপর প্রধানমন্ত্রী সারংদেব ও প্রধান সেনাপতি বীর মহাবাহু আলোচনায় রত।
কান্নান আর বজ্রপাণি সম্রাটকে প্রণাম করে দাঁড়াল। সম্রাট কান্নানকে বললেন, ‘আমি তোমাকে সেনাবাহিনীতেই নিযুক্ত করলাম। তুমি প্রধান সেনাপতি বীর মহাবাহুর অধীনে আপাতত একশো যুবককে সিলাম্বাম শিক্ষা দেবে। তুমি কাল থেকে শহরের প্রবেশপথে যে সেনাছাউনি সেখানেই এখন থাকবে।’ এবারে মহাবাহুকে বললেন, ‘মহাবাহু তুমি ওর সব ব্যবস্থা করে দিও।’ কান্নান আর বজ্রপাণিকে ইশারায় বিদায় নিতে বললেন। তারাও সম্রাটকে প্রণাম জানিয়ে বেরিয়ে এল।
বজ্রপাণি বলল, ‘আজকে অতিথিশালায় থাক, কাল সকালে সেনাছাউনিতে যাবার ব্যবস্থা করে দেব। কান্নানকে অনঘের বাড়ি থেকে তার জিনিসপত্র, অস্ত্র নিতে হবে শুনে বজ্রপাণি তাকে খুব সকালে নিয়ে আসতে বললেন। কান্নান ঘোড়ায় চড়তে পারে জেনে একজন রক্ষীকে নির্দেশ দিলেন যে সকালে তাকে একটা ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দিতে।
পরদিন খুব সকালে কান্নান ঘোড়া নিয়ে অনঘের বাড়ি এল। অনঘ তখন স্নান সেরে পুজোর সামগ্রী নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। হঠাৎ কান্নানকে ঘোড়ায় আসতে দেখে সে আশ্চর্য হয়ে গেল। সে এক নিশ্বাসে বলে উঠল, ‘কী ব্যাপার ঘোড়া কোথায় পেলে? কাল সারাদিন কোথায় ছিলে? রাত্রেই বা কোথায় ছিলে? আমরা কত চিন্তা করেছি।’
কান্নান আনুপূর্বিক সবই বলল। অনঘ আনন্দে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বন্ধু তুমি তা হলে সেনাছাউনিতে চলে যাচ্ছ। তুমি এখন রাজপুরুষ। আমাকে কিন্তু ভুলে যেও না।’
‘আমি গুরু কান্দানের শিষ্য। গুরু শুধু আমাকে যুদ্ধকলা শেখাননি, অনেক নৈতিক শিক্ষাও দিয়েছেন। আজ আমি যা পেলাম সে তো তোমারই জন্য। দুর্গে ঢুকতে না পারলে কী হত? তোমার উপকার আমি ভুলব কী করে?’
কান্নান অনঘের বাড়ি থেকে তার জিনিসপত্র নিয়ে দুর্গে ফিরে এল। তার আঙুলে সম্রাটের দেওয়া আংটি থাকাতে সে যথেচ্ছ দুর্গে ঢুকতে-বেরোতে পারে। বজ্রপাণি একজন সৈনিকের সঙ্গে তাকে সেনাছাউনিতে পাঠিয়ে দিলেন। কান্নান বাতাপি শহরের বাইরে পাঁচিল দিয়ে সুরক্ষিত বিশাল সেনাছাউনিতে এল। প্রবেশপথে সশস্ত্র সৈনিকের দল। প্রধান দ্বাররক্ষক কান্নানের হাতের আংটি দেখে তাকে সসম্মানে প্রবেশ করতে দিল আর তার আসার কারণ শুনে দুজন সৈন্যকে দিয়ে প্রধান সেনাপতির কাছে পাঠিয়ে দিল।
কান্নান যেতে যেতে দেখল এ যেন আর একটা ছোটো শহর। রাস্তার দু-ধারে পাথরের ইটের বাড়ি, কোনো কোনোটা লম্বা টানা দোতলা। বিশাল বিশাল মাঠ, গাছ-গাছালি, ঘোড়ার আস্তাবল, হাতিশাল। আবার একধারে দূরে তাঁবুর পর তাঁবু। সৈন্যের দল কোথাও কুচকাওয়াজ করছে। রাজপথের দুপাশেই সেনাছাউনি। এ ছাড়াও সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে এরকম সেনাছাউনি অনেক আছে। এ ছাড়াও চালুক্য সাম্রাজ্যের অধীনে পশ্চিম গঙ্গা, কদম্ব, লতা, গুর্জর, কোঙ্কানি মৌর্য, আলুপা ও আর যে সব সামন্ত রাজ্য ছিল, তাদেরও অনেক সৈন্যসামন্ত, হাতি, ঘোড়া ছিল আর যুদ্ধ বাঁধলে তারা চালুক্য সম্রাটের অধীনে যোগদান করত।
একসময়ে প্রধান সেনাপতির কার্যালয়ে এসে পৌঁছাল। বীর মহাবাহু কান্নানকে সাদরে আহ্বান করলেন। তিনি কান্নানের ওপর খুব প্রসন্ন। তার প্রধান কারণ সে ভরা রাজসভায় সেনাপতি পার্থিবনকে তরোয়ালবাজীতে হেলায় হারিয়েছে। রাজ্যের সেরা তরোয়ালবাজ বলে পার্থিবনের খুব দেমাক ছিল। সম্রাটের প্রিয়পাত্র বলে সে প্রধান সেনাপতিকেও অনেক সময়ে আমল দিত না। সরাসরি সম্রাটের সঙ্গে কথা বলত। অনেকেরই ধারণা বয়স্ক মহাবাহুকে সরিয়ে সে প্রধান সেনাপতি হতে চায়। কান্নানের কাছে হেরে গিয়ে তার অহংকার এবার ধুলোয় মিশিয়ে গেছে। মহাবাহু তার এক সেনাপতি সম্ভাবীকে ডেকে তার ওপরেই কান্নানের থাকার আর একশো নতুন সেনাদের বেছে নিয়ে কান্নান যে প্রশিক্ষণ দেবে তার সবরকম ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিলেন। মহাবাহু কান্নানের কাছে সিলাম্বাম আর কুট্টু ভারিসাই সম্বন্ধে জানতে চাইলে, কান্নান তাকে অল্প কথায় কিছুটা ধারণা দিল ও তার সুরুল পাট্টাই অস্ত্রটা দেখাল। মহাবাহু এ ধরনের অস্ত্র শুনেছিলেন কিন্তু চাক্ষুষ দেখেননি।
একটি লম্বা টানা বাড়ির দোতলার একটি ঘরে কান্নানের থাকার ব্যবস্থা হল। এখানে মাঝারি স্তরের সেনানায়করা অনেকে একসঙ্গে থাকে। নীচে খাবার ব্যবস্থা। পরদিন সম্ভাবী কান্নানকে নিয়ে একশো নতুন অল্পবয়সি সেনাদের বেছে নিলেন। তাদের প্রশিক্ষণের জায়গাও নির্দিষ্ট করা হল। কান্নান সম্ভাবীকে তার প্রয়োজনীয় অস্ত্রের বন্দোবস্ত করতে অনুরোধ করল। ছাউনির শেষ প্রান্তে বিশাল কামারশালা। জনা বিশেক কামার নানান অস্ত্র তৈরি করছে। সম্ভাবী কান্নানকে বলে দিলেন যে তার যখন প্রশিক্ষণের জন্য যে রকম অস্ত্রের আবশ্যক হবে এখান থেকে বানিয়ে নিতে।
কান্নান পরদিন থেকেই নতুন সেনাদের নিয়ে তার সিলাম্বামের প্রশিক্ষণ শুরু করে দিল। তবে এ ক্ষেত্রে সকল শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণ করার ক্ষমতা এক হয় না বা গুরুত্ব সহকারে নেয় না। কান্নান কড়া শিক্ষক, কোনোরকম শিথিলতা দেখলে শাস্তি দিতে পিছপা হয় না। আর তা ছাড়া সে এটুকু বুঝেছে যে তার হাতে সময় কম। যুদ্ধ যে কোনো সময় লাগতে পারে। আর যুদ্ধ লাগলেই সৈন্যদলে লোক নেওয়া শুরু হয়। অধিকাংশই তেমন একটা শিক্ষা পায় না। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে তারা শুধু মরতেই যায়। তাই কান্নান যতটা পারে চিন্তাভাবনা করে তার শিক্ষার্থীদের যত তাড়াতাড়ি পারে শেখাতে চেষ্টা করে। প্রশিক্ষণ শুরু সূর্যোদয়ের সঙ্গে, চলে প্রায় সারাদিন। দুপুরে দু-ঘণ্টা বিশ্রাম—তারপর আবার সূর্যাস্ত পর্যন্ত। এরই মধ্যে মনঃসংযোগের জন্য ধ্যান ও শারীরিক ব্যায়ামও আছে।
দেখতে দেখতে এক বছর কেটে গেল। একদিন সম্রাট সেনাছাউনিতে এসেছিলেন। কান্নানের প্রচেষ্টায় বেশ সন্তুষ্ট হলেন। সম্রাট আরও একশো জন সেনাকে শেখাতে নির্দেশ দিয়ে গেলেন। কান্নান নিজে বুদ্ধি করে লাঠিখেলা বাদ দিয়ে তরোয়াল, ছোড়া, বর্শা আর সুরুল পাট্টাইয়ের শিক্ষা দিতে লাগল। কারণ লাঠি মূলত আত্মরক্ষামূলক, যুদ্ধক্ষেত্রে চলে না। যারা মোটামুটি দক্ষতা লাভ করেছে তাদের ওপর পুরোনোদের ভার নিয়ে কান্নান নতুনদের শেখান শুরু করল। এভাবে কেটে গেল আরও একবছর।
বর্তমানে যা আরব সাগর তার নাম ছিল সেকালে অনেকের মতে ইন্দু বা সিন্ধু সাগর। গ্রীক ও রোমানরা বলত এরিথ্রিয়ান সাগর। সাগর পারে ভারতের সমগ্র পশ্চিম উপকূল জুড়ে অনেক বন্দর শহর ছিল বিদেশি বাণিজ্যের পীঠস্থান। শতাব্দীর পর শতাব্দী এ সব বন্দরে রোম, মিশর, পারস্য, আরব উপদ্বীপ, মেসোপটেমিয়া প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বণিকরা জাহাজে করে তাদের বিদেশি দ্রব্যের পসরা নিয়ে আসত আর ভারতবর্ষ থেকে নিয়ে যেত রেশম ও কার্পাস বস্ত্র, মশলাপাতি, রত্নপাথর, চন্দন কাঠ ও হাতির দাঁতের সামগ্রী, গন্ধদ্রব্য, গয়না, সিরামিকের পাত্র, উৎকৃষ্ট মানের চাল ও কৃষিজাত দ্রব্য। এই বাণিজ্য শুল্ক থেকে রাজ্যেগুলির আয় হত অনেক। তাই এই বন্দর শহরগুলি যে সাম্রাজ্যের অধীনে থাকবে তারা হবে আর্থিক দিক থেকে প্রচুর লাভবান।
সম্রাট পুলোকেশীন সিংহাসনে আরোহণ করেই কিছু বন্দরগুলির রাজ্যগুলিকে নিজের অধীনে আনেন। তাঁর নজরে আসে কোঙ্কান উপকুলের ছোটো দ্বীপ ঘরাপুরী যা এখনকার এলিফ্যান্টা দ্বীপ। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে পাহাড় কেটে গুহার অভ্যন্তরে তৈরি হয়েছিল এক বিশাল শিবমন্দির। ভারতের পশ্চিম-মধ্য অঞ্চলে কালচুরি সাম্রাজ্যের রাজা কৃষ্ণরাজা এই শিবসৌধ নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। এই দ্বীপে একটি দুর্গও আছে। দ্বীপটিকে পশ্চিম সাগরের লক্ষ্মীও বলা হয়। ব্যাবসা-বাণিজ্য ও সামরিক দিক থেকে এই দ্বীপের গুরুত্ব আছে। পারস্য, আরব, চিন সকলেই এই সাগরে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। সম্রাট পুলোকেশীনের নজর গিয়ে পড়ল এই দ্বীপের ওপর। ইতিমধ্যে কালচুরি সাম্রাজ্য পুলোকেশিনের অধীনে এসে গেছে।
রাতের আঁধারে বাণিজ্য তরীতে সৈন্য পাঠিয়ে অতর্কিত আক্রমণে এই ঘরাপুরী দ্বীপ পুলোকেশীন অধিকার করেন। এরপর তাঁর নজর গিয়ে পড়ল ক্যাম্বে উপসাগরের উপকূলবর্তী অত্যন্ত লাভজনক বাণিজ্যপ্রধান এলাকায়। নর্মদা, তাপ্তি, বিশ্বামিত্রি, মাহি ও সাবরমতী—এই পাঁচটি নদী এসে এই উপসাগরে মিশেছে। উপকূলবর্তী এলাকায় ক্যাম্বে, ভৃগুকচ্ছ ও সূর্যপুরের মতন প্রধান বন্দর রয়েছে যাদের স্থলপথে ও নদীপথে ভারতের অভ্যন্তরের রাজ্যগুলির সঙ্গে সহজ যোগাযোগ রয়েছে। এ হেন অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখলের জন্য পুলোকেশীন মনস্থ করলেন।
সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতের মধ্যভাগে বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে চালুক্য সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি যেমন ছিলেন সম্রাট দ্বিতীয় পুলোকেশীন ঠিক তেমনই বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরে মধ্য ভারতের উজ্জয়িনী, উত্তরে সিন্ধুনদের এলাকা থেকে শুরু করে সমগ্র উত্তর ভারত আর পূর্বদিকে বঙ্গ সহ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল পুষ্যভূতি সাম্রাজ্য যার অধীশ্বর ছিলেন সম্রাট হর্ষবর্ধন। পিতা থানেশ্বরের রাজা প্রভাকরবর্ধনের মৃত্যুর পর তাঁর জেষ্ঠ্যপুত্র রাজ্যবর্ধন রাজা হন কিন্তু তার শ্বশুর গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক তাকে হত্যা করেন আপন কন্যার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। হর্ষবর্ধন মাত্র ষোলো বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করে রাজ্যবিস্তারে মন দেন। কান্বকুব্জ বা কনৌজ ছিল তার রাজধানী। ক্যাম্বে উপসাগরীয় অঞ্চলের ওপর নজর হর্ষবর্ধনেরও ছিল। আর তারই ফলস্বরূপ হর্ষবর্ধন ও পুলোকেশীন এই দুই যুযুধানের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল।
গুপ্তচর মাধ্যম নানা রকম সংবাদ আসছে। কান্বকুব্জ থেকে সম্রাট হর্ষবর্ধন ষাট সহস্র হাতি, এক লক্ষ অশ্বারোহী, অগুনতি পদাতিক আর এই বিপুল বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আরও শতসহস্র কর্মীবৃন্দ, বিপুল অস্ত্রশস্ত্র, রসদ, তাঁবু ও অন্যান্য সামগ্রীর ভান্ডার নিয়ে দাক্ষিণাত্য বিজয় অভিযানে বেরোনোর তোড়জোড় করছেন। পথপ্রদর্শকগণ আগে থেকেই অভিযানের পথ নির্দিষ্ট করে রাখছে। সম্রাট হর্ষবর্ধনের সঙ্গে রয়েছেন কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মন সহ অন্যান্য সামন্ত রাজারা। আগে আগে রাজন্যবর্গ তাঁদের সুসজ্জিত রণহস্তিনীর পিঠের হাওদায় বসে সোনার পাতে জড়ানো ধনুক নিয়ে যাবেন। সঙ্গে থাকবে তাদের অস্ত্রশস্ত্র বহনকারীর দল ও অন্যান্য সেবকবৃন্দ। সর্বাগ্রে থাকছেন সবথেকে উঁচু আর বিশালাকায় রণহস্তী দর্পশতাতে সম্রাট হর্ষবর্ধন স্বয়ং। তখন বর্ষাকাল চলছে। শোনা যাচ্ছে শীতের আগেই পথঘাট শুকিয়ে গেলে হর্ষবর্ধন তার বাহিনী নিয়ে হানা দেবেন।
চরেদের মুখে বিভিন্ন সংবাদ শুনে সম্রাট পুলোকেশীন খুব চিন্তিত। প্রধান মন্ত্রী সারংদেব, প্রধান সেনাপতি বীর মহাবাহু, দুর্গরক্ষক বজ্রপাণি ও অন্যান্য মন্ত্রী ও সেনাপতিদের নিয়ে ঘন ঘন সভা করে যুদ্ধের কৌশল নিয়ে শলা পরমর্শ করতে লাগলেন। সব সামন্ত রাজাদের যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। তাঁরাও তাদের সেনাবাহিনী নিয়ে যোগ দেবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। পার্বত্য ও অরণ্য অঞ্চলে অনেক আদিবাসী যুদ্ধবাজ জাতি রয়েছে। যদিও তারা সম্রাট বা সামন্ত রাজাদের সেনাবাহিনীর অঙ্গ নয়, কিন্তু কোনো যুদ্ধ বাঁধলে তারা সম্রাট বা সামন্ত রাজাদের দলে যোগ দেয় নিজেদের অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যে। যুদ্ধে লুঠের মালেতেও কিছু হিস্যে পায়।
তাই তারাও এসে সম্রাটের বাহিনীতে যোগ দিল। ইতিমধ্যে সম্রাট একদিন সেনাছাউনিতে এসে কান্নানের শিক্ষার্থীদের মহড়া দেখে সন্তুষ্ট হয়ে ঠিক করলেন যে এই দুশো সেনা তাঁর দেহরক্ষীবাহিনীকে ঘিরে থাকবে আর কান্নান এদের নেতৃত্ব দেবে।
কান্বকুব্জ থেকে হর্ষবর্ধনকে তাঁর সুবিশাল বাহিনী নিয়ে নর্মদা পেরিয়ে আসতে গেলে অন্তত আড়াইশো ক্রোশ পথ পেরতে হবে আর তাতে অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশ দিনের বেশিই লাগবার কথা। অবশ্য বাতাপি থেকেও নর্মদা পেরিয়ে যেতে সেরকম সময়ই লাগতে পারে। তা হলেও হাতে মাস তিন চারেক সময় আছে। পুলোকেশীনের ইচ্ছে আগে বেরিয়ে নর্মদা পেরিয়ে গিয়ে হর্ষবর্ধনকে বাধা দেওয়া। কান্নানের মাথায় কিছু চিন্তা ভাবনা ঘুরছিল। কিন্তু সম্রাটকে বলার মতন সুযোগ তার ছিল না। প্রধান সেনাপতি মহাবাহু কান্নানকে খুব স্নেহ করতেন। তাই একদিন মহাবাহুকেই নিজের মনের কথা ব্যক্ত করল।
সেদিন অপরাহ্ণবেলায় কান্নান মহাবাহুকে বলল, ‘মহামন্ডলেশ্বর, আমি যুদ্ধ-সংক্রান্ত একটা বিষয় ভেবেছি যা মহারাজাধীরাজকে বলার এক্তিয়ার বা ধৃষ্টতা আমার নেই। আমি আপনার অধীনে। অনুমতি ও অভয় দিলে আপনাকে বলতে পারি।’
মহাবাহু মাথা নেড়ে অনুমতি দিলে কান্নান বলল, ‘শুনেছি মহারাজাধীরাজ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন যে চালুক্য বাহিনী নর্মদা পেরিয়ে সম্রাট হর্ষবর্ধনের বাহিনীকে আক্রমণ করবে।’
‘মহারাজের সে রকমই প্রস্তাব’, মহাবাহু চিন্তান্বিতভাবে বললেন, ‘কিন্তু এতে এত বড়ো বাহিনী নিয়ে নর্মদা পেরনোর একটা ঝামেলা আছে। আমি সব সেনানীর মত শুনে তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। তোমার যদি কিছু চিন্তাভাবনা থাকে নির্ভয়ে আমার কাছে বলতে পারো।’
কান্নান আশ্বাস পেয়ে বলল, ‘আমি মাঝে মাঝে অবসর পেলে বাতাপিতে মন্দিরগুলোতে যেতাম। সেখানে অনেক সময়ে শৈব সাধু ও তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হত। তাঁরা অনেকেই নর্মদা পেরিয়ে পদব্রজে কাশী, প্রয়াগ, উজ্জয়িনী গেছেন আর তাঁদের যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা শুনতে আমার ভালো লাগত। নর্মদার দক্ষিণে সাতপুরা অঞ্চলের কিছু শিক্ষার্থীদের থেকে তাদের এলাকা সম্বন্ধে শুনেছি। তাতে আমি জেনেছি, উত্তর ভারত জুড়ে পূর্বে বঙ্গ পর্যন্ত সম্রাট হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য। আর দক্ষিণে শুধু উজ্জয়িনী পর্যন্ত। সম্রাট হর্ষবর্ধনকে চালুক্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করতে গেলে উজ্জয়িনীর দিক দিয়ে নর্মদা পেরতে হবে। নর্মদার উত্তর ভাগ সম্রাট হর্ষবর্ধনের নিজস্ব সাম্রাজ্য। এর ভৌগলিক পরিবেশ, পথঘাট, জলবায়ু সবই তার পরিচিত। অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমিতে সহস্র সহস্র হাতি, অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য নিয়ে তাঁর অবস্থান চালুক্য বাহিনীর থেকে অনেক বেশি সুবিধাজনক।
কিন্তু সম্রাট হর্ষবর্ধন যদি নর্মদা পার হয়ে আসেন তা হলে তিনি সাতপুরা পার্বত্য অঞ্চল ও তার সংলগ্ন বনভূমিতে প্রবেশ করতে হবে আর দাক্ষিণাত্যের এই অঞ্চল তাঁর সম্পূর্ণ অজানা। বিশেষ করে হাতি আর অশ্বারোহী নিয়ে চলতে বিশেষ বেগ পেতে হবে। সে ক্ষেত্রে ওই অঞ্চল বকাতকা সাম্রাজ্যের অধীন। কিন্তু ওই সাম্রাজ্যের কোনো প্রভাব এখন আর নেই। ওখানকার আদিবাসী যোদ্ধারা বলতে গেলে স্বাধীন। ওদের সাহায্যে বন ও পার্বত্য এলাকায় চালুক্য বাহিনী যদি আড়াল থেকে যুদ্ধ করে তাহলে সম্রাট হর্ষবর্ধনের বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা অসম্ভব নয়।’
প্রধান সেনাপতি কান্নানের কথা মন দিয়ে শুনলেন। মাথা নেড়ে বললেন, ‘বিষয়টা আমি একটু ভেবে দেখি।’
মহাবাহু দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞ সেনাপতি। বহু যুদ্ধের বিজয়ী নায়ক, দক্ষ যুদ্ধ কৌশলবিদ। কান্নানের চিন্তাভাবনা কিন্তু তাঁর মনে দাগ কেটেছে। তিনি সাম্রাজ্যের উত্তরে সাতপুরা অঞ্চল ও নর্মদার তীরবর্তী অঞ্চলের কাছাকাছি যে সব সেনাছাউনি আছে, তাদের সেনানায়কদের নির্দেশ পাঠালেন যে ওই সব অঞ্চলের পার্বত্য ভৌগলিক পরিবেশ, আদিবাসী যোদ্ধাদের দলপতিদের নিয়ে সে অঞ্চলের কৌশলগত অবস্থান সম্বন্ধে বিশদ বিবরণ যত শীঘ্র সম্ভব পাঠাতে। এমনকি গুপ্তচর পাঠিয়ে নর্মদার উত্তর পারে উজ্জয়িনীর আশপাশের অঞ্চলেরও বিবরণ জোগাড় করতে নির্দেশ দিলেন।
অনেকদিন ধরেই কান্নান সিলাম্বামের নতুন কোনো পদক্ষেপ আর অস্ত্র নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছিল। একদিন সে কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে মাঠ পেরিয়ে আসতে গিয়ে পায়ে গাছের ডালের শক্ত কাঁটা পায়ে গেঁথে গেল। যন্ত্রণায় মাটিতে বসে পড়ে পায়ের কাঁটা তুলতে লাগল। রক্ত তেমন বেরলো না, কিন্তু যন্ত্রণাটা রয়ে গেল। ছাউনির চিকিৎসক মলম দিলেন বটে কিন্তু ক-দিন তাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হল। কিন্তু এতে তার লাভই হল। সে চিন্তা করল যে শত্রুপক্ষের যাত্রা পথে যদি এরকম অজস্র কাঁটা ছড়ানো যায় তা হলে হাতি, ঘোড়া, পদাতিক সেনাদের পায়ে বিঁধে তাদের গতি অনেকটাই রুদ্ধ হবে।
কিন্তু কাঁটা কি সব সময়ে উঁচু হয়ে থাকবে এমন কথা নেই, মাটিতে শুয়ে থাকলে লাভ হবে না। সোজা খাড়া থাকতে হবে। লোহার কাঁটা হলে ভালো হয়। এ কথা ভেবে কান্নান কামারশালায় এক বৃদ্ধ কামারের কাছে গেল যে আগে তার সুরুল পাট্টাই বানিয়ে দিয়েছিল। কামারের সঙ্গে দিন দুয়েক বসে ভেবে ভেবে একটা মনের মতন অস্ত্র দাঁড় করালো। দুটো মধ্যমা আঙুলের সমান লম্বা লোহার কাঁটা দু-দিকে সামান্য বেঁকিয়ে মাঝে জোড়া দিয়ে যেটা বানাল সেটা মাটিতে যে ভাবেই ছোড়া যাক তিনটে কাঁটার পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর একটা কাঁটা ওপর দিকে খাড়া হয়ে থাকে। এ রকম গোটা কয়েক চারকাঁটা বানিয়ে সে প্রধান সেনাপতি মহাবাহুকে একদিন গিয়ে দেখাল। মহাবাহু সমস্ত দেখে শুনে যুদ্ধক্ষেত্রে এর গুরুত্ব সঙ্গে সঙ্গেই উপলব্ধি করলেন ও কান্নানকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, যে বিষয়টি গোপন রাখতে হবে আর কামারকে ডেকে এরকম কয়েক সহস্র আলাদাভাবে বানাতে বললেন।
কান্নানের ছোটোবেলা থেকেই মনে হত মহাভারতে কৃষ্ণ কীভাবে তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে শিশুপালকে হত্যা করল। সে নিজেও খেলার ছলে নানারকম পাথরের বা মাটির চাকতি ছুড়ে লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত হানার চেষ্টা করত। কান্নানের সে কথা মনে পড়ায় সে কামারকে দিয়ে এক বিঘত পরিমাণ লোহার চাকতি বানিয়ে নিল। চাকতির ধারটা চারটে ফলায় ভাগ করে ধারাল করে নিল। কলাগাছের দিকে ছুড়ে দেখল গভীরভাবে কেটে বসে যাচ্ছে। গাছের ছোটো ডাল কেটে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। সে একদিন তার এই চক্র অস্ত্র মহাবাহুকে দেখাল।
মহাবাহু নিজেও এই চক্র কয়েকবার ছুড়ে বুঝলেন যে এই নতুন অদেখা অস্ত্র শত্রুপক্ষকে বিপাকে ফেলবে। তিনি একদিন সম্রাট পুলোকেশীনকে অস্ত্রগুলো দেখালে সম্রাটও কান্নানের প্রশংসা করলেন। কান্নান কামারদের দিয়ে সহস্র সহস্র এইরকম চক্র আর চারকাঁটা বানিয়ে ফেলল। সে তার শিক্ষার্থীদের সকলকে চক্র ছোড়ার শিক্ষা দিল।
ইতিমধ্যে প্রায় একমাস কেটে গেছে। সাতপুরা আর নর্মদার ওপার থেকে চরেদের পাঠানো সমস্ত বিবরণ বিচার বিশ্লেষণ করে প্রধান সেনাপতি নিশ্চিন্ত হলেন যা কান্নানের প্রস্তাবই সঠিক। সম্রাট হর্ষবর্ধনের নর্মদা পেরিয়ে আসাটাই চালুক্যবাহিনীর পক্ষে সুবিধাজনক। সে অনুসারে তিনি তাঁর রণকৌশল স্থির করে প্রধান মন্ত্রী সারংদেব ও দুর্গরক্ষক বজ্রপাণির সঙ্গে আলোচনা করলেন। তারাও প্রধান সেনাপতির সঙ্গে একমত। তিনজন মিলে সম্রাট পুলোকেশীনের সঙ্গে গোপন আলোচনায় বসলেন। সম্রাট প্রথমে গররাজি হলেও পরে প্রধান সেনাপতির প্রস্তাব মেনে নিলেন, কারণ তাঁর রণকৌশলের ওপরেই সম্রাটকে এতকাল ভরসা করতে হয়েছে। সব থেকে বড়ো প্রশ্ন বাতাপি থেকে নর্মদা পর্যন্ত যেতে গেলে কৃষ্ণা, ভীমা, সিন্ধফনা, গোদাবরী ও তাপ্তী নদী পার হতে হবে। নদীগুলো চালুক্য সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। কোথাও নদী সরু, জল কম হেঁটে পার হওয়া যায়, কোথাও বা কাঠের সেতু করা আছে, কোনো কোনো জায়গায় সেনাবাহিনীর নৌকা, বজড়া, বড়ো ভেলা মজুত রাখা আছে। তাই এ সব নদী পার হওয়া মুশকিল নয়। কিন্তু সমস্যা হবে নর্মদা পেরতে যা চালুক্য সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরে। এ সব চিন্তা করে নর্মদা না পেরনোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।
গোপন চরেদের কাছ থেকে খবর আসছে যে সম্রাট হর্ষবর্ধনের বাহিনী রওনা হবার জন্য প্রস্তুত। সম্রাট জ্যোতিষীদের সঙ্গে দিনক্ষণ নিয়ে কথা বলছেন। সম্রাট পুলোকেশীনও শিবমন্দিরে বিশাল যাগযজ্ঞ, পূজা অর্চ্চনা করে সেনাপতিদের নির্দেশ দিলেন খাড়কির উদ্দেশে রওনা হবার জন্য। সামন্ত রাজাদের কাছে আর্জি জানানো হল তাদের সৈন্যসামন্ত নিয়ে খাড়কিতে এসে মিলিত হতে। সাম্রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের সমস্ত সেনাদের বিশেষ করে, নর্মদার পার বরাবর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এবং সাতপুরা পার্বত্য ও অরণ্য অঞ্চলে সমস্ত আদিবাসী যোদ্ধাদের নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। পুলোকেশীনের সেনাবাহিনীর তুলনায় হর্ষবর্ধনের সৈন্য সম্ভার অনেক বিশাল, বিশেষ করে পদাতিক সৈন্য ছাড়াও রণহস্তী ও অশ্বারোহী বাহিনী। পুলোকেশীনকে পদাতিক সৈন্যদের ওপর বেশি নির্ভর করতে হয়।
পুলোকেশীন তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে খাড়কিতে এসে ঘাঁটি গাড়ল। ইতিমধ্যে তাঁর বিভিন্ন জায়গায় যে সব সেনাদল মোতায়েন থাকত আর আলুপা, গঙ্গা, কদম্ব, লতা ও আর যত সামন্ত রাজারা ছিল সব একে একে খাড়কি এসে পৌঁছাল। প্রায়ই গুপ্তচরেরা এসে খবর দিচ্ছে সম্রাট হর্ষবর্ধন কোন পথে কতদূর আসছেন। তিনি তার বাহিনীর বড়ো একটা অংশকে প্রধান সেনাপতির নেতৃত্বে দ্রুত যাভালে গিয়ে ঘাঁটি গাঁড়তে নির্দেশ দিলেন আর নিজে বাকিদের নিয়ে এগোতে লাগলেন।
প্রত্যাশা মতন হর্ষবর্ধন উজ্জয়িনী, শ্রীপুর হয়ে দক্ষিণে নর্মদার তীরে এলেন যেখানে নদীর পাশ কম ও সহজে পার হওয়া যায়। নর্মদা পেরলেই চালুক্য সাম্রাজ্য। কিন্তু নর্মদার দক্ষিণে যে উত্তর দাক্ষিণাত্য, সেখানকার পার্বত্য ও অরণ্য অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যেতে সৈন্যবাহিনীকে বেশ বেগ পেতে হল। পথপ্রদর্শকরাও পর্বত আর অরণ্যের গোলোকধাঁধায় পড়ে মাঝে মাঝেই পথ হারাতে লাগল। বিপুল পরিমাণ হস্তী ও অশ্বারোহী বাহিনীর চলাই দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াল। অরণ্যচারী যে সমস্ত ভীল, গোন্ড, কোরকু, ভারিয়া জাতির আদিবাসী যোদ্ধারা চালুক্যবাহিনীর অধীনে, তাদের সাহায্যও পাওয়া যাবে না। কিন্তু হর্ষবর্ধন কোনো বাধাই মানতে রাজি না। তিনি তাঁর সেনাপতিকে আদেশ করলেন বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যেতে। পথে পড়ল একটু চওড়া গিরিখাত। তার পরেই উপত্যকা।
এই গিরিখাতে এসেই হল বিপত্তি। অনেক পদাতিকের, ঘোড়ার, হাতির চলতে গিয়ে পায়ে তীক্ষ্ণ লোহার কাঁটা বিঁধল। সেই কাঁটা ছাড়াতে গিয়ে তাদের থেমে যেতে হল। শুধু তাই নয়, কাঁটাতে সম্ভবত বিষ মাখান ছিল। অনেকেরই পায়ের যন্ত্রণার জন্য চলতে পারছিল না। দেখতে দেখতে পা ফুলে উঠল। হর্ষবর্ধনের সেনাপতি এ ধরনের কাঁটা আগে দেখেননি। তিনি বুঝতে পারলেন শত্রুর ফাঁদে পড়েছেন। ফলে বাহিনীকে একপ্রকার থেমে যেতে হল।
আর ঠিক সে সময়ে পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে তির এসে পড়তে লাগল। হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল। সে বিশৃঙ্খলার বহু সৈন্য দু-পাশের পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগল। তিরের ঘায়ে হতাহত হয়েও অনেকে পাহাড়ের ওপরে চালুক্য বাহিনীর সৈন্যদের আক্রমণ করল বটে কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারল না। এদিকে সম্রাট হর্ষবর্ধনের বাহিনী আরও দু-তিনটে স্থান দিয়ে চালুক্য সাম্রাজ্যে প্রবেশ করেছে। চালুক্যবাহিনীও চরেদের মুখে খবর পেয়ে শত্রুদের ওপর অতর্কিতে, বিশেষ করে পার্বত্য ও অরণ্য অঞ্চলে আড়াল থেকে আঘাত হানতে লাগল। দেখতে দেখতে প্রায় দশদিন হয়ে গেল যুদ্ধের। চালুক্য বাহিনী যতটা সম্ভব পুষ্যভূতি বাহিনীকে সাতপুরার পার্বত্য ও বনাঞ্চলের মধ্যে আটকে রেখেছে। এখনও পর্যন্ত দুই পক্ষের মুখোমুখি সংঘর্ষ কোথাও খুব একটা হয়নি। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি হর্ষবর্ধনেরই বেশি হল। তার ওপরে চালুক্য সেনারা সরবরাহ ব্যবস্থার একটা অংশ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
সম্রাট হর্ষবর্ধন তাঁর মূল বাহিনী নিয়ে নর্মদা পার হয়ে সাতপুরার যে অঞ্চলে পৌঁছলেন সেখানে পার্বত্য অঞ্চল বা অরণ্য তত দুর্গম নয়। তা সত্বেও তাঁর বিশাল হস্তীবাহিনী নিয়ে পথচলা বেশ দুষ্কর হয়ে উঠল। চালুক্য সেনারা আড়াল থেকে সম্রাট হর্ষের বাহিনী অনুসরণ করছিল। পাথুরে উপত্যকা অঞ্চলে তারা অনেকটা রাস্তা জুড়ে লোহার চারকাঁটা আর বাবলা গাছের অজস্র ডাল কেটে ছড়িয়ে রেখেছিল। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে, ঘন ঝোপের আড়ালে চালুক্য সেনারা লুকিয়েছিল। উপত্যকায় এসে পায়ের মধ্যে অবিরত কাঁটা বিঁধে হর্ষের বাহিনীর নাজেহাল অবস্থা। আর তারই মধ্যে তাদের ওপর বৃষ্টির মতন ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসছে চালুক্য সেনাদের ছোড়া তির। তা সত্ত্বেও হর্ষের বাহিনী মন্থর গতিতেও এগিয়ে চলল। সম্রাট হর্ষ তাঁর বিশালদেহী প্রিয় রণহস্তী দর্পশতায় চলমান দুর্গের মতন সুরক্ষিত হয়ে চলেছেন। তাঁর সঙ্গে কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মণ ও অন্যান্য সামন্ত রাজারা, সেনাপতিরা তাদের নিজস্ব সেনাদল নিয়ে চলেছেন। পদাতিক সেনারা আগে আগে রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে চলেছে। ফলে বাহিনীর গতি খুবই মন্থর। চালুক্য সেনাদের ছোড়া তিরে বহু সৈন্য হতাহত হল।
অবশেষে সম্রাট তাঁর বাহিনী নিয়ে কিছুটা সমতলে এসে পৌঁছালেন যেখানে হাতির পিঠে স্বর্ণখচিত হাওদায়, মাথায় সোনালি রাজছত্র আর সাদা হাতি আঁকা লাল পতাকা সমেত সম্রাট পুলোকেশীন তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে হর্ষের অভ্যর্থনার জন্য এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর পদাতিকবাহিনী সম্রাট হর্ষের মতন না হলেও নেহাৎ কম নয়। তিনিও সহস্রাধিক হাতি নিয়ে এসেছেন। প্রধান সেনাপতি মহাবাহুও এসে তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। সম্রাট পুলোকেশীনকে ঘিরে আছে তাঁর রক্ষীবাহিনী আর তাদের ঘিরে রয়েছে কান্নানের নেতৃত্বে তার অশ্বারোহী দুশো সিলাম্বাম-শিক্ষিত সেনা। মহাবাহুর পরিকল্পনা মতন এ যাবৎ চালুক্যবাহিনীর লাভই হয়েছে। সম্রাট হর্ষের বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই হয়েছে। দীর্ঘ পার্বত্য ও অরণ্য পথে আসতে গিয়ে পদাতিক বাহিনীও বিধ্বস্ত। সে তুলনায় চালুক্যবাহিনীর ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি বললেই হয়।
দুই যুযুধান পক্ষের রণদামামা বেজে উঠল। জয়ঢাক, ভেরী, ঝাঁঝর, শিঙার শব্দের সঙ্গে হস্তীর বৃংহিত, অশ্বের হ্রেষা, মদন্মত্ত সেনানীদের হুঙ্কারে রণক্ষেত্র রণোন্মত্ত হয়ে উঠল। দুই পক্ষই তাদের মতন বুহ্য রচনা করেছে। চালুক্যবাহিনী দাঁড়িয়ে রইল কিন্তু দূর থেকে হর্ষের সেনাবাহিনী বিপুল বেগে ছুটে আসতে লাগল। মাঝে অশ্বারোহীর দল আর দু-পাশে পদাতিক সৈন্যরা ছুটে আসছে। আর তাদের পেছনে হস্তীবাহিনী নিয়ে সম্রাট হর্ষ স্বয়ং। মহাবাহু ইশারা করা মাত্র প্রায় তিরিশটি কাঠের মহাশীলকান্তক যন্ত্র থেকে বড়ো বড়ো পাথর, গরম তেল, সোরা, গন্ধক, পিচ, পশুর চর্বি, পোড়া ছাই ইত্যাদি দিয়ে তৈরি আগুনের গোলা আর চারকাঁটা ছোড়া হতে লাগল।
মহাশীলকান্তক যন্ত্র হতে ছোড়া পাথর, আগুনের গোলা আর চারকাঁটাতে হর্ষবাহিনীর বহু সৈন্য, ঘোড়া আর হাতি আহত হল। দু-পক্ষের হাতিগুলোকে প্রচুর মাদকদ্রব্য খাওয়ানো হয়েছিল। তাদের দাঁতের সঙ্গে এক হাতের থেকেও বড়ো তরোয়াল লাগান ছিল। সেই তরোয়ালের আঘাতে, হাতিদের পায়ের চাপে উভয় পক্ষের সৈন্য হতাহত হল। হাতিগুলোর গা দিয়ে রক্ত ঝড়ছে, উন্মত্তের মতন আচরণ করছে। সৈন্যদের ছোড়া বর্শা পেটে বিঁধে হাতি, ঘোড়াগুলো বেঘোরে মরল। দু-পক্ষের সৈন্যরা পরস্পরের সঙ্গে ঢাল তরোয়াল, বর্শা নিয়ে লড়তে লাগল।
কান্নান দূর থেকে বিশাল হাতির পিঠে হাওদা, মাথায় সোনালি রাজছত্র আর সোনালি সিংহ আঁকা সাদা পতাকা দেখে বুঝল সম্রাট হর্ষবর্ধন আসছেন। তাঁর হাতিকে ঘিরে তাঁর রক্ষীবাহিনী। কান্নান সম্রাট পুলোকেশীনের দিকে তাকাতে তিনি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। কান্নান আর তার একশো জন সৈন্য ঘোড়ায় ছুটে গেল সম্রাট হর্ষের দিকে। হর্ষ হাতে একটা লম্বা হাতি-বর্শা নিয়ে শত্রুসৈন্য নিধন করতে করতে আসছেন। হর্ষ যখন প্রায় হাত পনেরো দূরে কান্নামের ইশারায় তার সেনারা চক্রগুলো বার করে ছুড়তে শুরু করল। এক একবারে একসঙ্গে গোটা পঞ্চাশেক করে চক্র ঘুরতে ঘুরতে উড়ে গিয়ে হর্ষের রক্ষীবাহিনীর ওপর পড়ছে। কয়েকজনের চক্রের ফলাগুলোতে বিষ মাখান ছিল। যাদের গায়ে গিয়ে লাগছে কেটে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে আর আঘাতের স্থানে অসম্ভব জ্বালা করতে শুরু করেছে। মুহুর্মুহু এরকম চক্র উড়ে আসাতে রক্ষীবাহিনী ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে। স্বয়ং হর্ষবর্ধনও কিছুটা বিস্মিত হয়েছেন। এই ফাঁকে কান্নান সম্রাট হর্ষকে আক্রমণ করল। হর্ষ তাঁর লম্বা হাতি-বর্শা দিয়ে কান্নানকে আঘাত হানতে লাগলেন। কিন্তু প্রতিবারই কান্নান দ্রুত সরে যেতে লাগল। হর্ষের কখনও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। উত্তেজনায় হাওদায় দাঁড়িয়ে কান্নানকে বর্শা ছুড়ে মারতে গেলেন।
কান্নান হর্ষের শরীরী ভাষাতে বুঝে নিয়েছে তাঁর উদ্দেশ্য। তাই হর্ষ বর্শা ছোড়ার আগেই সে তার সুরুল পাট্টাই ছুড়ে বর্শায় ধাতব পাতগুলো জড়িয়ে হ্যাঁচকা টান মারতে হর্ষের হাত থেকে বর্শা ছিটকে গেল আর সেই ঘাতে হর্ষ টাল সামলাতে না পেরে হাতি থেকে নীচে পড়তে পড়তে কোনো মতে হাওদার কাঠ ধরে নীচে লাফিয়ে পড়লেন। কান্নান ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে খাপ থেকে তরোয়াল বের করে হর্ষের দিকে ধেয়ে এল। হর্ষও তার তরোয়াল নিয়ে কান্নানকে আক্রমণ করলেন। এবারে শুরু হল দুজনের তুমুল লড়াই। ওদিকে হর্ষের রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে কান্নানের সেনাদেরও ব্যপক যুদ্ধ চলছে।
সম্রাট হর্ষ ও কান্নান দুজনেই দক্ষ তরোয়ালবাজ—আঘাত প্রত্যাঘাত আর তরোয়ালের ঝনঝনানি—কেউই পিছু হটছে না। সম্রাট হর্ষের হাঁটু আর কনুইয়ের অংশ বাদ দিয়ে প্রায় সর্বাঙ্গেই ধাতব বর্ম। কান্নান তারই মধ্যে দুই কনুইয়ে তরোয়ালের ডগা দিয়ে চিরে দিয়েছে। এদিকে হর্ষ অনেকবারই কান্নানের গায়ে বা পায়ে আঘাতের চেষ্টা করলেন কিন্তু সক্ষম হলেন না। কান্নানের মতন হর্ষ অতটা দ্রুত নন বা পদক্ষেপেও ততটা দক্ষ নন। ধীরে ধীরে হর্ষের দম ফুরিয়ে আসছে। বেশ কয়েকবার কান্নানের তরোয়াল তাঁর দেহের বর্মে আঘাত হেনেছে ও সেখানে ধাতু তুবড়ে কেটে বসে গেছে। সুযোগ বুঝে কান্নান মাটি থেকে হাত তিনেক লাফিয়ে তার তরোয়াল দু-হাতে ধরে সজোরে তরোয়ালে কোপ মারতে হর্ষের হাত থেকে তরোয়াল ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল আর তার ঘাতে হর্ষও মাটিতে চিত হয়ে পড়ে গেলেন। কান্নান ইচ্ছে করলেই হর্ষের গলায় তার তরোয়াল চালাতে পারত কিন্তু গুরু কান্দানের আদেশে সে কখনও কোনো নিরস্ত্র ব্যক্তির ওপর আঘাত হানে না।
সম্রাট হর্ষকে পড়ে যেতে দেখে তাঁর বেশ কিছু দেহরক্ষী সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ঘিরে ধরে উঠতে সাহায্য করল কিন্তু হর্ষ এতটাই ক্লান্ত যে দাঁড়াতে পারছেন না। দুজন মিলে প্রায় তাঁকে তুলে ঘোড়ায় বসিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল তাঁর প্রাণ বাঁচানোর জন্য। সম্রাট হর্ষকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চলে যেতে দেখে তাঁর সেনাপতিরা ছুটে এলেন। সম্রাট যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে তাঁর শিবিরে ফিরে গেলেন। হর্ষের হাতি দর্পশতাকে নিয়ে তার মাহুত ফিরে চলল। ইতিমধ্যে হর্ষকে পড়ে যেতে দেখে সম্রাট পুলোকেশীন তাঁর বাহিনী সমেত ছুটে এসেছেন। চালুক্য বাহিনী হর্ষকে ফিরে যেতে দেখে জয় হো জয় হো করে তাড়া করল। পুষ্যভূতির সেনানায়করাও তাদের বাহিনী নিয়ে বাঁধা দেবার মরণপণ চেষ্টা করল। তার ফলে দুই পক্ষের সাতদিন ব্যাপি প্রবল যুদ্ধে রণক্ষেত্রে শুধু হাতি, ঘোড়া আর মানুষের মৃতদেহের স্তূপের পর স্তূপ গড়ে উঠল।
সম্রাট হর্ষ নর্মদার তীরে এসে শুনলেন যে ইতিমধ্যে তার দুটি সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এর পরে তাঁর সৈন্যদের না খেয়ে মরতে হবে। এই যুদ্ধে তাঁর ইতিমধ্যেই বিস্তর ক্ষতি হয়ে গেছে। তিনি প্রধান সেনাপতিকে সম্রাট পুলোকেশীনের কাছে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়ে সমস্ত বাহিনীকে সাম্রাজ্যে ফিরে যাবার নির্দেশ দিলেন। দূতের মুখে খবর পেয়ে সম্রাট পুলোকেশীন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেন। পুষ্যভূতি আর চালুক্য সাম্রাজ্যের মধ্যে সন্ধি হল। এর ফলে চালুক্য সাম্রাজ্য নর্মদার দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত হল আর ক্যাম্বে উপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চল শুধুমাত্র পুলোকেশীন অধিকার করতে পারলেন। চালুক্য বাহিনী বিজয়োল্লাস করতে করতে বাতাপি ফিরে এল।
এদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে যারা কান্নানকে সম্রাট হর্ষের সঙ্গে লড়াই করতে দেখেছিল তাদের মুখে মুখে কান্নানের অসামান্য কৃতিত্ব আর বীরত্বের কথা সাধারণ লোকের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। যে কোনো যুদ্ধ বিজয়ের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব রাজার বা সম্রাটের। লোকে তাদেরই জয়গান গায়। তাই সম্ভবত লোকমুখে কান্নানের এই কৃতিত্ব সম্রাটের ভালো লাগেনি। উলটে তিনি কান্নানকে দোষী সাব্যস্ত করলেন, সুযোগ পেয়েও সে কেন হর্ষবর্ধনকে যুদ্ধে হত্যা করল না। কথায় বলে আগুনের আর শত্রুর শেষ রাখতে নেই। নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা না করা ধর্ম নয়, যুদ্ধে শত্রুকে নিধন করাই ধর্ম। কান্নান সে ধর্ম পালনে ব্যর্থ হয়েছে। বলতে গেলে নর্মদার উত্তরে সমগ্র ভারত জুড়ে সম্রাট হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য। তিনি যে আগামী দিনে সন্ধির চুক্তি ভঙ্গ করে আবার চালুক্য সাম্রাজ্যে হানা দেবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায়? এতে করে কান্নান সাম্রাজ্যের আগামী বিপদের সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখল। তাই এই অপরাধের শাস্তি কান্নানকে পেতে হবে।
আসলে সম্রাট পুলোকেশীনের মনে কী ছিল কে জানে! সে কান্নানের আসামান্য বীরত্ব, দক্ষতা ও জনপ্রিয়তা দেখে শঙ্কিত হয়েছিল। হয়তো বা কোনো দিন পুলোকেশীনকে হটিয়ে সে সিংহাসন দখল করে নিজে সম্রাট হয়ে বসতে পারে। তাই সে সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করাই উচিৎ। সম্রাটের কথা শুনে প্রধান মন্ত্রী, প্রধান সেনাপতি, দুর্গরক্ষক ও আরও কিছু অমাত্য আপত্তি করে জানালেন যে সেটা ঠিক উচিৎ কাজ হবে বলে মনে হয় না। মহাবাহু এও বললেন যে এই যুদ্ধে প্রাথমিক পরিকল্পনা কান্নানই তাঁকে জানিয়েছিল। বরঞ্চ কান্নানকে কোনো উচ্চপদ দিলে সেটা সাম্রাজ্যের পক্ষে ভালোই হবে। কিন্তু সম্রাট পুলোকেশীন সে কথা শুনলেন না। তিনি কান্নানকে অবশ্য মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে একমাসের মধ্যে চালুক্য সাম্রাজ্য ছেড়ে চলে যাবার আদেশ দিলেন। কান্নান শুনে মনে খুব আঘাত পেলেও ভেঙে পড়ল না বা সম্রাটের করুণা ভিক্ষাও করল না। শুধু এই সব রাজন্যবর্গ মহান, উদার ঈশ্বরের সমকক্ষ বলে প্রচার করলেও কত নীচ, ভন্ড ও অকৃতজ্ঞ হতে পারে ভেবে সে স্থির করল যে আর কখনও সে কোনো রাজ্যের সেনাবিভাগে বা অন্য কোনো বিভাগে আর কোনো রকম কর্ম করবে না।
কান্নান এসে দুর্গরক্ষক বজ্রপাণির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সম্রাটের নামাঙ্কিত আংটি ফেরত দিয়ে বলল, ‘আপনি দয়া করে এই গুরুত্বপূর্ণ আংটির ব্যবস্থা করবেন। এতে এখন আমার কোনো অধিকার নেই। আমি কখন কোথায় থাকব তার কোনো ঠিক নেই। চুরি হয়ে গেলে এর অপব্যবহার হতে পারে।’
বজ্রপাণি নিঃশব্দে আংটি গ্রহণ করে কান্নানের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘ভগবান জাম্বুলিঙ্গেশ্বর তোমার মঙ্গল করবেন।’
এদিকে সম্রাট হর্ষবর্ধনকে পরাজিত করার আনন্দে সারা রাজ্য জুড়ে মহোৎসব পালন শুরু হল। পুলোকেশীন নিজে হর্ষকে হারানোর জন্য পরমেশ্বর উপাধি গ্রহণ করলেন। নতুন এক গুহামন্দির করার নির্দেশ দিলেন। একশত আটটি যজ্ঞবেদী স্থাপন করে সাতদিন ধরে যজ্ঞ শুরু হল। মন্দিরে মন্দিরে সারম্বরে পূজা-অর্চ্চনা চলতে লাগল। সহস্রাধিক মৃদঙ্গ, ডমরু, কাহালে, চেন্দে বাজতে লাগল। লক্ষাধিক ঘিয়ের প্রদীপ রাজপ্রাসাদ, মন্দিরে সন্ধে হলেই জ্বালান হত। সকল রাজ্যবাসী এই মহোৎসবে দূর দূরান্তর থেকে এসে যোগ দিল। আর এই আনন্দ উৎসবের মাধ্যে একা কান্নান তার কিছু পরিধেয় বস্ত্র, সঞ্চিত কিছু অর্থ, তার প্রিয় সুরুল পাট্টাই আর, একটি ছোরা নিয়ে, বিদায় কালে প্রধান সেনাপতি মহাবাহু তাকে যে ভালো আরবী ঘোড়াটি উপহার দিয়েছিল, তাতে চড়ে একা নিঃশব্দে বাতাপি ছেড়ে বেরিয়ে গেল আবার এক অজানা ভবিষ্যতের সন্ধানে।
সারা রাস্তা চলতে চলতে তার একটাই চিন্তা কোথায় যাবে। নর্মদা পেরিয়ে উত্তর ভারতে সম্রাট হর্ষের রাজত্ব। যদি কোনো ক্রমে ধরা পড়ে সম্রাট হর্ষ কি তাকে ছেড়ে দেবেন? চালুক্য সাম্রাজ্যের গুপ্তচর বলে মৃত্যুদণ্ডই হয়তো হবে তার একমাত্র শাস্তি। এক চালুক্য সাম্রাজ্যের বাইরে সে পল্লব সাম্রাজ্যে যেতে পারে। বিশেষ করে কাঞ্চী, মামাল্লাপুরম তার কিছুটা পরিচিত জায়গা। সেখানে গিয়ে সে হয়তো স্বাধীনভাবে সিলাম্বাম আর কুট্টু ভারিসাই শিক্ষা দিতে পারে।
দিন চারেক বাদে কান্নান এক সন্ধ্যায় কুক্কানুর নামের একটি শহরে একটা বড়ো বৌদ্ধ বিহারে এসে পৌঁছাল। বিহারের প্রধান আচার্য ভিক্ষু সুদত্তের কাছে সে আশ্রয় প্রার্থনা করল। কান্নান পথশ্রমে ক্লান্ত ছিল। তাই সে রাত্রি সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিল। পরদিন ভিক্ষু সুদত্ত কান্নানের কাছে তার পরিচয় জানতে চাইলেন।
সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ শান্ত সৌম্য ভিক্ষু সুদত্তের স্নেহার্দ স্বরে আশ্বস্ত হয়ে কান্নান তার পরিচয়, শিক্ষা ও বর্তমান দুর্দশার সকল কথাই একে একে ব্যক্ত করল। সব কথা শুনে ভিক্ষু সুদত্তের মন কান্নানের প্রতি করুণায় ভরে উঠল। তিনি বললেন, ‘ভগবান তথাগতের প্রতি আস্থা রাখ, তিনিই তোমাকে পথ দেখাবেন। তবে তাঁর কী ইচ্ছা আমরা জানি না। গত হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে যে মহান বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষ ও বহির্বিশ্বের কিছু দেশকে যে অহিংসার পথ, শান্তি ও মৈত্রীর পথ দেখিয়ে এসেছে, আজকে তার ওপর আঘাত হানা হচ্ছে। একসময়ে সাতবাহন, কদম্ব রাজাদের আমলে কত যে স্তূপ আর সংঘারাম স্থাপিত হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। অতীতে এই চালুক্য রাজবংশের সম্রাটগণের পৃষ্ঠপোষকতাতেই কত শত বৌদ্ধ বিহার আর স্তূপ গড়ে উঠেছিল যা ধর্ম ও জ্ঞান চর্চ্চার কেন্দ্র ছিল। আর আজ তাঁদের ওপর আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। শত শত বৌদ্ধ শ্রমণকে হত্যা করে হচ্ছে, জোর করে ধর্মান্তঃকরণ করা হচ্ছে। বিহারগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, স্তূপগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ইচ্ছাকৃতভাবে শৈব ও জৈন ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। প্রাণের ভয়ে অনেক শ্রমণ বিহার ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
আজ এই সাম্রাজ্য তোমার পক্ষে যেমন নিরাপদ নয়, আমাদের পক্ষেও আর নিরাপদ নয়। তুমি যত শীঘ্র সম্ভব চালুক্য রাজ্য ত্যাগ করে চিত্রদুর্গের পথ ধরে কাঞ্চী চলে যাও। সেখানে খুব প্রাচীন আর নামকরা বিহার আছে। ভিক্ষু ধর্মকীর্তি সেখানে আচার্য। আমি তাঁকে তোমার এক পরিচয়পত্র দিয়ে দেব। সেখানে প্রায় নিত্যই আসেন পল্লব রাজপুত্র বোধিতারা। রাজপুত্র বোধিতারা বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রাজপুত্র শীঘ্রই শ্রমণরূপে বিহারে যোগ দেবেন। আমি স্পষ্ট ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি বোধিতারার মাধ্যমে একদিন বৌদ্ধধর্মের বিশেষ প্রসার লাভ করবে। আমি তোমায় উপদেশ দিচ্ছি, তুমি বোধিতারার সঙ্গলাভ কর। ভগবান বুদ্ধ একদিন তোমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করবেন।
কান্নান ওইদিন বিশ্রাম নিয়ে পরদিন খুব সকালে ভগবান বুদ্ধকে প্রণাম করে তার সঞ্চিত অর্থ থেকে কিছু দান করে আচার্য সুদত্তের থেকে বিদায় নিয়ে কাঞ্চীর পথে রওনা দিল। পথে অধিকাংশ সময়ে বৌদ্ধ বিহারে আশ্রয় নিয়েছে। পথে যেতে বেশ কিছু সদ্য ধ্বংপ্রাপ্ত বিহার চোখে পড়েছে। চালুক্যসম্রাট পুলোকেশীন যে বুদ্ধবিদ্বেষী সেটা কিছুটা সে জানে। প্রায় দু-সপ্তাহের মতন লাগল কান্নানের কাঞ্চী পৌঁছোতে। কাঞ্চী বা কাঞ্চীপুরম তার কিছুটা পরিচিত জায়গা। আগে মামাল্লাপুরমের বন্দরে জাহাজ থাকার সময়ে, জাহাজের সঙ্গীদের সঙ্গে সে কাঞ্চী শহর দেখে গেছে। কত যে মন্দির আছে তার ঠিক নেই। আবার সেই কাঞ্চীতে সে এসেছে কিন্তু তার সেদিনের সঙ্গীরা কেউ আর এ জগতে নেই। পালার নদীর তীরে দীর্ঘ কয়েকশো বছর ধরে পল্লব সাম্রাজের রাজধানী হল কাঞ্চী। অঞ্চল জুড়ে শুধুই শিবমন্দির আর বিষ্ণুমন্দির। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান তীর্থ কাঞ্চী। শুধু তাই নয় গত কয়েক শতাব্দী ধরে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের সাধনা ও জ্ঞানচর্চ্চার কেন্দ্র এই কাঞ্চী যেখানে সে সময়ে প্রায় একশো বৌদ্ধবিহার ছিল।
কান্নান এখানে প্রধান বৌদ্ধবিহারে এসে আচার্য ধর্মকীর্তির কাছে তালপাতায় লেখা আচার্য ভিক্ষু সুদত্তর পত্র পাঠালেন। পত্রবাহক এসে কান্নানকে অতিথিশালায় নিয়ে গিয়ে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে খাওয়াদাওয়া বিশ্রাম করতে বলে জানাল যে আচার্য অপরাহ্ণে কথা বলবেন। কাঞ্চী শহরের এই বৌদ্ধবিহারে কয়েক শত ভিক্ষু ও শ্রমণ বাস করে। অথচ কী শান্ত পরিবেশ। কোথাও এতটুকু বিশৃঙ্খলা নেই। কান্নান ঘরে বসে চুপচাপ চিন্তা করছে। আচার্যের সঙ্গে দেখা হলে সে কী বলবে! নিজের পরিচয় না হয় দিল। তার পর? কী সাহায্য সে প্রার্থনা করবে? কী ভাবে সে কাঞ্চী শহরে সিলাম্বাম আর কুট্টু ভারিসাই শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুলবে? এক এক বার মনে হচ্ছে সে বরঞ্চ সিনহলে গুরু কান্দানের কাছে ফিরে যায়। কিন্তু গুরু তো তা চাননি। তাহলে তো ভারতে আসার প্রয়োজনই হত না। এক রাজপুত্র বোধিতারা যদি সাহায্য করেন। কিন্তু এই সব রাজন্যবর্গের প্রতি সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। এরা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বোঝে না।
অপরাহ্ণে আচার্য ধর্মকীর্তি কান্নানকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন। ছোটো ঘর। একপাশে লম্বা পাথরের বেদির ওপর গেরুয়া মোটা চাদর পাতা। মেঝেতে তিনটি কুশের আসন। একটিতে বৃদ্ধ আচার্য বসে। শীর্ণ চেহারা, হলেও মনে হয় শরীর থেকে জ্ঞান ও তপস্যার জ্যোতি ফুটে বেরোচ্ছে। পাশের আসনে যিনি বসেছেন তিনি লম্বা, স্বাস্থ্যবান, মাথায় বড়ো বড়ো চুল, মুখে কালো দাড়িগোঁফ, চোখ দুটি বেশ বড়ো আর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, ঘন ভুরু, সাধারণ সাদা কাপড় পড়া, গায়ে জামা। দুজনেই হাঁটু গেড়ে বসা। কান্নান প্রবেশ করে দুজনকেই নত হয়ে প্রণাম করল।
আচার্য কান্নানকে বসতে বলে তার পরিচয়, কী উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে জানতে চাইলেন।
কান্নান তার জীবনকাহিনি কিছুটা বিশদভাবেই বলল এবং চালুক্য সম্রাট তাকে কী কারণে নির্বাসিত করেছে তাও বলল। আচার্য কান্নানের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন ও কান্নানের কথার স্পষ্টতা, তার দৃপ্ত অথচ সরল ভঙ্গিমা, তার শরীরী ভাষা লক্ষ্য করে সে যে সর্বৈব সত্য বলছে তা বুঝতে তাঁর অসুবিধা হল না। কান্নানের বলা শেষ হলে তিনি বললেন, “সম্রাট হর্ষবর্ধনের পরাজয়ের খবর আমরা পেয়েছি এবং এটাও জেনেছি তা সম্ভব হয়েছে পুলোকেশীনের জনৈক বীর সেনানায়কের জন্য। তুমিই তা হলে সেই বীর যোদ্ধা। খুবই দুঃখজনক যে সম্রাট তোমাকে পুরস্কৃত না করে যে কারণে তোমাকে তাঁর সাম্রাজ্য থেকে নির্বাসন দিয়েছেন তা অত্যন্ত কাপুরুষজনোচিত ও দুর্ভাগ্যজনক। তবে তুমি শত্রুকে ক্ষমা করে নিরস্ত্র অবস্থায় তাঁকে হত্যা না করে প্রকৃত বীরের ধর্ম পালন করেছ আর এ তোমার সদ্গুরুর কাছে শিক্ষালাভের ফল।’
এই বলে আচার্য কান্নানকে পাশে যে ব্যক্তি বসেছিলেন তাঁর সঙ্গে পরিচয় করালেন, ‘ইনি পল্লব সাম্রাজ্যের অধীশ্বর মহারাজা সিংহবর্মণের তৃতীয় পুত্র রাজকুমার বোধিতারা। রাজকুমার বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ও একজন উপাসক। ওঁর চারিত্রিক গুণাবলী ও বৌদ্ধশাস্ত্রের জ্ঞান কোনো উচ্চপর্যায়ের ভিক্ষুর থেকে বেশি বই কম নয়। আমি রাজকুমারকে অনুরোধ করব তোমার বিদ্যাশিক্ষার উপযুক্ত প্রয়োগের জন্য সাহায্য করতে।’
কান্নান রাজকুমার বোধিতারাকে নত হয়ে প্রণাম জানালে, রাজকুমারও তাঁকে প্রতিনমস্কার করে আচার্যকে বললেন, ‘আচার্যদেব, আপনি জানেন আমি কৈশোরে ও প্রাকযৌবনে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষালাভ করেছিলাম এবং সে সময়ে সিলাম্বামের অল্প কিছু শিক্ষা পেয়েছিলাম তবে কুট্টু ভারিসাই নাম শুনে থাকলেও সে সম্বন্ধে আমার ধারণা নেই। আমি তাই কান্নানের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে এ বিষয়ে জানতে আগ্রহী। আপনি অনুমতি করলে আমি কান্নানকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাই এবং আশা করি ওর হয়তো একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারব কারণ এই বিদ্যা শেখায় এখানে অনেকেরই আগ্রহ আছে যেহেতু এটা তামিল সংস্কৃতির একটা অঙ্গ। গুরু কান্দানের নাম আমি অনেক আগে শুনেছিলাম। বহু বৎসর পূর্বে তিনি তামিলাকমেরই বাসিন্দা ছিলেন।’
আচার্য ধর্মকীর্তি রাজকুমার বোধিতারাকে সানন্দে অনুমতি দিলেন। কান্নান রাজকুমারের সঙ্গে যেতে মনে মনে কুন্ঠিত হচ্ছিল কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাকে নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কী বা উপায় আছে? ভগবান অঞ্জনায়ারের যা ইচ্ছে হয় তাই হবে।
কান্নান তার ঘোড়া আর জিনিসপত্র নিয়ে রাজকুমার বোধিতারার সঙ্গে পল্লব রাজপ্রাসাদে এল। বোধিতারা, প্রাসাদের মূল অংশ যেখানে রাজপরিবার থাকে, সেখানে থাকেন না। তাঁর আলাদা একটি ছোটো বাড়ি ছিল। তারই একটি ঘরে কান্নানের আশ্রয় জুটল। সে অবাক হয়ে দেখল পল্লব রাজকুমারের ঘর—বিছানা বলতে একটি কাঠের মাচার ওপর মোটা চাদর। দড়িতে ঝোলানো কিছু জামাকাপড় আর একটি পাথরের দেয়ালের তাঁকে বেশ কিছু পুথি। যদিও বোধিতারা কান্নানের থেকে বয়সে কিছু বড়ো, তবু দুজনের মধ্যে একটা সহজ প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠল। রাজকুমারের কাছেই কান্নান জেনেছে কাঞ্চীর এই বৌদ্ধবিহার সারা দক্ষিণ ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানচর্চ্চার কেন্দ্র। দুশো বছর আগে থেরাভেদা বৌদ্ধধর্মের মহাজ্ঞানী বুদ্ধঘোষ এই কাঞ্চীতে ছিলেন। পরে তিনি সিনহলে অনুরাধাপুরায় চলে যান। এ ছাড়াও বুদ্ধদত্ত, ধম্মপাল, বুদ্ধপ্রিয়, আনন্দের মতন মহান শিক্ষকগণ এই কাঞ্চীতে বসে পালি ভাষায় অনেক মূল্যবান পুথিতে বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন দিকের ব্যাখ্যা লিখে রেখে গেছেন।
রাজকুমার বোধিতারা কান্নানের কাছে বিশেষ করে নিরস্ত্র কুট্টু ভারিসাই শিখতে চাইলেন। কান্নান তাঁকে শেখাতে রাজি হলেন এই শর্তে যে তিনি তথাকথিত শিক্ষাগুরু হবেন না, একজন সহ-শিক্ষার্থীর মতন রাজকুমারকে শিখতে সাহায্য করবেন। প্রায় বছরখানেক বোধিতারা কান্নানের কাছে কুট্টুভারিসাইয়ের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও আঘাত হানার কৌশলগুলো শিখলেন। বোধিতারা নিজে শাস্ত্রপাঠ, শাস্ত্রব্যাখ্যা ও ধ্যানকেন্দ্রিক সাধনার পক্ষপাতি ছিলেন। তিনি কুট্টুভারিসাই শিখতে গিয়ে অনুভব করলেন যে এতে অত্যন্ত মনঃসংযোগের প্রয়োজন হয় যা পক্ষান্তরে গভীর ধ্যানের সহযোগী হয়।
কান্নান একদিন বোধিতারার কাছে ভারতবর্ষ জুড়ে বিশেষত দক্ষিণ ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের অবক্ষয় ও অস্তিত্ব-সংকটের বিষয় উত্থাপন করল। বোধিতারা এ বিষয়ে নিজে অনেক পর্যালোচনা করেছেন। তিনি বললেন, ‘সম্রাট অশোক, সম্রাট কনিষ্ক, সম্রাট মিলিন্দ থেকে শুরু করে বহু রাজা ও সম্রাট বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারে ও প্রসারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন। সহস্র সহস্র বৌদ্ধ, বিহার, চৈত্য, স্তূপ গড়ে দিয়েছেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ও ভারতের বাইরেও প্রচারক পাঠিয়েছেন। দেশে দেশে শ্রেষ্ঠী ও ধনী ব্যক্তিরাও অর্থ সাহায্য করেছেন, বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন। শত শত জ্ঞানী, মহাতপস্বী, বৌদ্ধ সাধকগণ ভগবান বুদ্ধের বাণী, তার উপদেশ, সন্ন্যাস ও সাধনার নিয়ম, বৌদ্ধ দর্শন ও মতবাদের ব্যাখ্যা ও টীকার ওপর পুথি লিখে ধর্মকে সমৃদ্ধ করে গেছেন।
কিন্তু এখন যে বৌদ্ধ ধর্মের অবক্ষয় দেখছ, তা অল্প অল্প করে অনেকদিন ধরেই শুরু হয়েছে। রাজন্যবর্গ যেমন প্রসারে সাহায্য করেছেন তেমনি অনেকেই বৌদ্ধধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহারও করেছেন। মঠ ও বিহারগুলির প্রাচুর্য হেতু ভিক্ষু ও শ্রমণগণ কঠোর তপস্যা ছেড়ে একটু বিলাসী হয়ে পড়েছেন। অনেক বিহার শ্রেষ্ঠীদের সঙ্গে ব্যাবসাবাণিজ্যেও জড়িয়ে পড়েছেন। অধিক প্রসারের জন্য স্থানীয় অনেক ধর্মীয় আচার-বিচার বৌদ্ধধর্মে ঢুকে পড়েছে। কণিষ্কের আমলে কাশ্মীরে, বসুমিত্রের সভাপতিত্বে চতুর্থ বৌদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে বৌদ্ধ ধর্মের অনুগামীরা বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধের ফলে বৌদ্ধ ধর্ম থেরাভেদা বা হীনযান ও মহাযান দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। নানাবিধ দুর্নীতির ফলে ভিক্ষুরা যে জ্ঞান ও ধ্যানের চর্চ্চা করত তা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এখন শৈব, বৈষ্ণব ও জৈন ধর্মের উত্থান শুরু হয়েছে আর রাজা-মহারাজারা তাদের অনুগামী হচ্ছেন। ফলে সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আর বৌদ্ধ ভিক্ষু ও শ্রমণদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে, বিহারগুলোকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করছে।’
কান্নান মন দিয়ে শুনে বলল, ‘আচ্ছা কুমার বৌদ্ধধর্মের অন্যতম মুখ্য বাণী ‘অহিংসা পরম ধর্ম’। হিংসার বশবর্ত্তী হয়ে অপরকে শারীরিকভাবে আঘাত হানা অন্যায়। কিন্তু আত্মরক্ষা করার জন্য যদি পালটা আঘাত করতে হয়, সেটাও কি অন্যায়? আত্মরক্ষা মানুষের অধিকার। আর এই অহিংসা ধর্ম পালন করার জন্য শত শত ভিক্ষু ও শ্রমণগণ কি মৃত্যু বরণ করছে না?’
বোধিতারা কান্নানের কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে অবশেষে বললেন, ‘তোমার কথার মধ্যে যথেষ্ট যুক্তি আছে এবং বিচার্য বিষয়। তুমি কী বলতে চাও আমি বুঝতে পেরেছি। আমরা সময় সুযোগ মতন আচার্যের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করব। আমি সংসার ত্যাগ করে বিহারে যোগদান করব, স্থির করেছি। আর দিন পনেরো পরে বুদ্ধপূর্ণিমা। আমি ওই পুণ্যদিনে আচার্যের নিকট সন্ন্যাস ভিক্ষা করব। তবে তার আগে আমি তোমার একটা ব্যবস্থা করে যাব।’
কান্নান হাত জোড় করে বলল, ‘কুমার আমার একান্ত অনুরোধ, আপনি আমাকে পরিত্যাগ করবেন না। আমি সন্ন্যাস নেব না বটে তবে সংসারেও থাকব না। বৌদ্ধধর্মের প্রতি আমার যথেষ্ট অনুরাগ আছে। আমি আপনার সঙ্গে বিহারে থাকতে ইচ্ছুক।’
বোধিতারা কান্নানের কথার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলেন। আজ বছরখানেকের বেশি সময় ধরে তিনি কান্নানকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখছেন। তাই শুধু বললেন, ‘ভগবান তথাগতের যা ইচ্ছা তাই হবে। কিন্তু শ্রমণ বা ভিক্ষু না হলে শুধু অতিথি রূপে দীর্ঘদিন বিহারে থাকার অধিকার নেই। তা ছাড়া বিহারে থাকলে তুমি তোমার যুদ্ধকলার অভ্যাস রাখতে পারবে না। তাতে তোমারই ক্ষতি হবে। তুমি আপাতত এখানেই থেকে আমার জেষ্ঠ্যভ্রাতা যুবরাজের দুই পুত্রকে আর প্রধান সেনাপতির দুই পুত্রকে তোমার যুদ্ধকলা শেখাবে। এর জন্য রাজকোষ থেকে তুমি মাসোহারা পাবে। তুমি বিহারে এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে।’
বোধিতারা বিহারে গিয়ে আচার্য ধর্মকীর্তির কাছে তাঁর মনের সংকল্পের কথা ব্যক্ত করে সন্ন্যাস ভিক্ষা করলেন। আচার্য শুনে আনন্দিত হলেন। বোধিতারা আজ পনেরো বছরের ওপর বিহারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। বৌদ্ধধর্মের উপাসক হয়ে বহুকাল ধরে এখানে শাস্ত্রচর্চ্চা ও বিচার করেছেন। বৌদ্ধদর্শনে যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি লাভ করেছেন। বিহারের সন্ন্যাস জীবনের সঙ্গে পরিচিত। দিনের পর দিন এখানে থেকে গেছেন। তাই আচার্য স্থির করলেন আগামী বুদ্ধপূর্ণিমায় রাজকুমার বোধিতারার আনুষ্ঠানিক সন্ন্যাস দীক্ষা হবে।
রাজকুমার বোধিতারা বৌদ্ধসঙ্ঘে ভিক্ষুরূপে যোগদান করলেন। আচার্য ধর্মকীর্তি তাঁর সন্ন্যাস নাম দিলেন বোধিধর্ম। সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর বোধিধর্ম অধিকাংশ সময় ধ্যান ও বৌদ্ধশাস্ত্রচর্চ্চায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। কান্নানও ব্যস্ত রইল দুই রাজকুমারকে সিলাম্বাম ও কুট্টু ভারিসাই শিক্ষা দিতে। মাঝে মাঝে বৌদ্ধবিহারে গিয়ে বোধিধর্মের সঙ্গে দেখা করত। ইতিমধ্যে একদিন বোধিধর্ম কান্নানকে নিয়ে আচার্যের সঙ্গে দেখা করলেন। কান্নান আচার্যকে প্রশ্ন করল, ‘আচার্যদেব আজ দিকে দিকে যে বৌদ্ধ বিহারগুলির ওপর আক্রমণ হচ্ছে তার প্রতিকারের উপায় কী?’
আচার্য ধর্মকীর্তি শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘চালুক্য সাম্রাজ্যে যে সব হিংসাশ্রয়ী ঘটনা ঘটে চলেছে তা খুবই দুঃখজনক। সম্রাটের উদাসীনতা এর অন্যতম কারণ। সম্রাট নিজে শৈব বলে লক্ষ লক্ষ মুদ্রা ব্যয়ে পাহাড় কেটে বিশাল শিবমন্দির তৈরি করাচ্ছেন। কিন্তু বৌদ্ধবিহারগুলি যে অনুদান ও পৃষ্ঠপোষকতা পেত তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিছু উগ্র শৈবসাধক নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য এই হিংসার পথ অবলম্বন করছে। আমাদের পথের অন্যতম মূলমন্ত্র ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ যার মূল উৎস হিন্দুধর্মের মহাগ্রন্থ মহাভারতের অনুশাসন পর্বে। অহিংস বৌদ্ধদের ওপর এই আক্রমণ অত্যন্ত অনুচিত। এর আগেও ইতিহাসে দেখা যায় প্রায় সাতশো বছর আগে শুঙ্গ রাজবংশের সম্রাট পুষ্যমিত্র বৌদ্ধদের নির্বিচারে হত্যা করতেন। এখন আবার দক্ষিণ ভারতে শুরু হচ্ছে। এর প্রতিকারের জন্য সম্রাটের সঙ্গে কথা বলা আশু প্রয়োজন।
কান্নান জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু আচার্যদেব আত্মরক্ষা করা তো অধর্ম নয়। আত্মরক্ষা করার অধিকার সকলেরই আছে।’
‘সে কথা ঠিক। তবে অহিংস পথে এই আত্মরক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। হিংসার দ্বারা হিংসাকে জয় করা যায় না।’
কান্নান বলল, ‘জ্ঞানত ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে শারীরিক বা মানসিক আঘাত করা নিঃসন্দেহে হিংসা। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে আঘাতের প্রত্যাঘাত করাও কি হিংসা?’
আচার্য মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, তবে সে ক্ষেত্রে শত্রুকে করা আঘাত যদি তার মৃত্যুর কারণ হয় তবে সেটা ধর্মবিরুদ্ধ ও মহাপাপ।’
বোধিধর্ম এবারে বললেন, ‘আচার্য আমি পালিভাষায় লেখা প্রাচীন বৌদ্ধশাস্ত্রে পড়েছি যে শত্রু আক্রমণ করলে রাজ্য ও প্রজাদের রক্ষার জন্য যুদ্ধ করা রাজধর্ম এবং রাজার তা পালন করা উচিত। সে ক্ষেত্রে তো রক্তপাত ও বহু শত্রুসৈন্য নিহত হতে পারে। সেটা তো অধর্ম নয়। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তা সত্যি হলে ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে তা সত্যি হবে না কেন?’
আচার্য একটু চিন্তিত হলেন। তারপর বললেন, ‘সে কথা যুক্তিপূর্ণ। কিন্তু কী ভাবেই বা একজন নিরস্ত্র আত্মরক্ষা করতে পারে?’
কান্নান তখন আচার্যকে নিরস্ত্র দ্বন্দযুদ্ধের কলা প্রসঙ্গে বলল আর বোধিধর্মও তাঁকে সমর্থন জানালেন। বোধিধর্ম যে এ বিষয়ে শিক্ষালাভ করেছে তাও উল্লেখ করলেন। আচার্য অনুমতি দিলে কান্নান ও বোধিধর্ম দুজনেই শ্রমণদের নিরস্ত্র কুট্টু ভারিসাই শিক্ষা দিতে প্রস্তুত।
আচার্য নাথা নাড়লেন। বললেন, ‘না এটা বৌদ্ধধর্মের নীতির প্রশ্ন ও বিচার বিতর্কের বিষয়। এই অনুমতি দেবার আমার কোনো অধিকার নেই। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন সঙ্ঘরাজ মহাস্থবির শীলভদ্র। তিনি এখন নালন্দা মহাবিহারের প্রধান অধ্যক্ষ। তিনি মনে করলে অন্যান্য বৌদ্ধ মহাজ্ঞানী, দার্শনিক ও অন্যান্য সঙ্ঘপ্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ভিক্ষু বোধিধর্ম তুমি নালন্দা মহাবিহার যেতে চাইছ, সাংখ্য, বেদান্ত অধ্যয়নের জন্য, তুমি কান্নানকেও তোমার সঙ্গে নাও। সেখানে মহাস্থবির শীলভদ্রের সঙ্গে কথা বলে দেখ ওঁর কী মত।’
তিন মাস পর বোধিধর্ম আর কান্নান কাঞ্চী থেকে নালন্দা মহাবিহারের দিকে রওনা হলেন। কান্নান রাজকোষ থেকে যে মাসোহারা পেত তার সামান্যই তার ব্যক্তিগত খরচে লাগত। ফলে তার সঞ্চিত অর্থ যথেষ্ট ছিল। তার থেকে নিজের আর বোধিধর্মের রাহাখরচের জন্য রেখে বাকিটা সে বৌদ্ধবিহারে দান করে গেল। দুজনেরই সঙ্গে অল্প কিছু জামাকাপড়, দুটো পাকা বাঁশের প্রায় চার হাত লম্বা লাঠি আর কান্নানের কোমর-বন্ধনিতে একটা বাঁকানো ছোরা। বোধিধর্মের গেরুয়া বসন ও চাদর, কান্নানের সাদা কাপড়, জামা ও পাগড়ি। দুজনে ঘোড়া নিয়ে কাঞ্চী থেকে চোলামণ্ডলম হয়ে বঙ্গসাগরের উপকূলবর্তী এলাকা ধরে কলিঙ্গ হয়ে যাবেন স্থির করেছেন। দীর্ঘ পথ, সময় লাগবে অনেক। কখনও সারা দিনে, কখনও রাত্রে চাঁদের আলোয়, তারার আলোয় পথ চলে তাঁরা এগোতে লাগলেন। বেশির ভাগ রাতেই সরাইখানায়, কোনো বৌদ্ধবিহারে, বা যেখানে ঘোড়া ভাড়া পাওয়া যায়, তারই সংলগ্ন সরাইয়ে তাঁরা অনেক সময়ে রাত কাটান। পঁচিশ-তিরিশ ক্রোশ পথ গেলেই তাঁরা অবস্থা বুঝে ঘোড়া পালটে নিতেন। পল্লব সাম্রাজ্যের এলাকা পেরিয়ে তাঁরা বিষ্ণুকুন্ডিনা সাম্রাজ্যে প্রবেশ করলেন। এখানকার রাজধানী অমরাবতী। কিন্তু তাঁরা রাজধানীর দিকে না গিয়ে যতটা সম্ভব উপকূলবর্তী এলাকার পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে কৃষ্ণা নদী পেরিয়ে বাভিকোন্ডা বৌদ্ধবিহারে এসে আশ্রয় নিলেন। বিষ্ণুকুন্ডিনা সাম্রাজ্য অবশ্য সম্প্রতি চালুক্য সম্রাট দ্বিতীয় পুলোকেশীনের কাছে পরাস্থ হয়েছে। বিষ্ণুকুন্ডিনার সম্রাট চতুর্থ মাধব বর্মা পাঁচ বছর যুদ্ধ চলার পর যুদ্ধক্ষেত্রেই প্রাণ বিসর্জ্জন দিয়েছেন।
কান্নান আর বোধিধর্ম কাঞ্চী ছেড়ে এসেছেন প্রায় দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে। পথশ্রমেও কিছুটা ক্লান্ত। বাভিকোন্ডায় তাঁরা দিন তিনেক বিশ্রাম নিলেন। প্রায় নয়শত বছরের পুরোনো এই বিশাল বৌদ্ধবিহার। তেলেগু ভাষায় বাভিকোন্ডা মানে কূপের পাহাড়। এখানে অজস্র কূপ আছে বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য। চৈত্য গৃহ, স্তূপ, সন্ন্যাসীদের বাসস্থান, গুহামন্দির মিলিয়ে ছাব্বিশটা ভবন এখানে আছে।
বাভিকোন্ডা ছেড়ে তাঁরা রওনা দিলেন, কলিঙ্গদেশে উদয়গিরির পথে। ছ’দিনের মতন সময় লাগল। কাছাকাছি অঞ্চলে তিনটি বিহার উদয়গিরি, খন্ডগিরি আর ললিতগিরি। তাঁরা এই তিনটি বিহারই দর্শন করলেন। যাত্রাপথে কান্নান যখনই কোনো বিহারে এসে আশ্রয় নিয়েছেন, বিহারের আচার্যের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপের পর বৌদ্ধদের ওপর সাম্প্রতিক আক্রমণ ও আত্মরক্ষার বিষয় উত্থাপন করেছেন। আক্রমণের বিষয়ে সকলেই চিন্তিত হলেও সবারই এক বক্তব্য, আঘাতের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাত নয়, অহিংসার পথই ধর্ম। কিন্তু আত্মরক্ষা করা যে ব্যক্তিগত অধিকার অযথা আত্মাহুতি না দিয়ে নিজেকে রক্ষা করা যে অন্যায় নয় এ বিষয়ে কেউ অস্বীকার করতেও পারেননি।
এখানেও তারা তিনদিন থেকে এবার আরও এগিয়ে বঙ্গ দেশে প্রবেশ করে তাম্রলিপ্তিতে এলেন। বঙ্গদেশ থেকে প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত হর্ষবর্ধনের পুষ্যভূতি সাম্রাজ্যের অধীনে। বঙ্গদেশে প্রবেশ করে তাঁরা কান্নানের কাছে যে মুদ্রাগুলি ছিল তা বিনিময় করে হর্ষবর্ধনের রুপোর শিলাদিত্য মুদ্রা নিয়ে নিলেন। তাঁরা এবার উত্তর পশ্চিম দিকে নালন্দার দিকে যাত্রা করলেন। দিন সাতেক লাগল তাঁদের নালন্দা মহাবিহারে পৌঁছোতে।
নালন্দা মহাবিহারের শুধু নালন্দা নামেই খ্যাতি আর তা যে এত বিশাল শিক্ষায়তন কান্নানের ধারণা ছিল না। প্রায় পঞ্চাশ হাজার হস্ত পরিমাণ জায়গা বিস্তৃত এই নালন্দায় ছাত্রাবাস, শিক্ষকাবাস, পাঠাগার, শ্রেণীকক্ষ, চৈত্য সব নিয়ে শতখানেক ভবন ছাড়াও অনেক উন্মুক্ত চত্বর, বাগান ও জলাশয় রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, পারস্য, কোরিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, চিন, তিব্বত থেকে আসা প্রায় দশ হাজার ছাত্র এখানে বৌদ্ধ সাহিত্য, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাংখ্য, বেদান্ত, ন্যায়শাস্ত্র, যোগ, ব্যাকরণসহ বিবিধ বিষয়ে শিক্ষালাভ করে। দু-হাজারের মতন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এখানে বাস করেন। মহাস্থবীর শীলভদ্র এখন প্রধান আচার্য। আর্যদেব, দিঙনাগ, শান্তরক্ষিত, অসঙ্গ, বসুবন্ধু, গুণপ্রভর মতন বৌদ্ধ মহাজ্ঞানীগণ এখানে শিক্ষাদান করেন। লক্ষাধিক পুস্তকে সমৃদ্ধ বহুতলবিশিষ্ট পাঠাগার নালন্দার মূল্যবান সম্পদ।
ভিক্ষু বোধিধর্ম ও কান্নান নালন্দায় পৌঁছে প্রধান আচার্যের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলেন। যথাসময়ে তাঁরা আচার্য শীলভদ্রের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেলেন। পল্লব রাজবংশের রাজকুমার বোধিতারার বৌদ্ধধর্মের প্রতি অনুরাগ ও শাস্ত্রচর্চ্চার কথা আচার্য শীলভদ্র কাঞ্চীর বিহারের আচার্য ধর্মকীর্তির কাছে ইতিপূর্বে শুনেছিলেন। তিনিই এখন ভিক্ষু বোধিধর্ম জেনে তাঁর সঙ্গে শাস্ত্রের কিছু অনুশাসনের ব্যাখ্যা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করে বিশেষ প্রীত হয়ে তাঁকে সানন্দে বেদান্ত আর যোগশাস্ত্র নিয়ে শিক্ষালাভ করতে বললেন।
ইতিমধ্যে বোধিধর্মের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করার কালে কান্নানের প্রতি দু-একবারের দৃষ্টিতে তার মুখের শান্ত অথচ দৃপ্ত ভাব ও ধৈর্য্য লক্ষ করেছিলেন। এবারে আচার্য কান্নানের দিকে তাকিয়ে তার পরিচয় জানতে চাইলেন। কান্নান সবিস্তারেই তার পরিচয় দিয়ে বলল, ‘সম্রাট হর্ষবর্ধনের সাম্রাজে আমি যে নিরাপদ নই সে কথা বলা বাহুল্য, তবুও আমি আপনার কাছে এসেছি একট বিষয়ের মিমাংসার জন্য। কারণ এর ওপর নির্ভর করবে আমার ভবিষৎ পরিকল্পনা। ভিক্ষু বোধিধর্ম এ বিষয়ে অবগত আছেন।’
আচার্য শীলভদ্র মন দিয়ে সবটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শান্ত স্বরে বললেন, ‘যুদ্ধে তুমি সম্রাট হর্ষকে পরাজিত করেছ বটে তবে তিনি তার জন্য এখানে তোমার সন্ধান পেলে তার প্রতিশোধ নেবেন—সে কথা আমার মনে হয় না। সম্রাটকে আমি দীর্ঘদিন ধরে জানি। তিনি এখন বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে অহিংসার পথে সুষ্ঠুভাবেই রাজ্যশাসন করছেন। তোমার নিরাপত্তা এখানে যাতে বিঘ্নিত না হয় সেটা আমি দেখব এই আশ্বাস তোমাকে দিতে পারি। এবারে কী বিষয়ে তোমরা মিমাংসা চাইছ, তা আমি জানতে আগ্রহী।’
কান্নান তখন অন্য সকল বিহারের আচার্যদের যে বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেছিল আচার্য শীলভদ্রের কাছে সেই একই বিষয় উত্থাপন করল—দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ বিহার ও সন্ন্যাসীদের প্রতি হিংসা ও আক্রমণ আর বৌদ্ধধর্মের অনুশাসন অনুসরণ করেও আত্মরক্ষা করা যায় কি না।
আচার্য শীলভদ্র বললেন, ‘বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে আমি পরে তোমাদের সঙ্গে আলোচনা করব। কান্নান আপাতত তুমি আমাদের এখানে অতিথিরূপে কিছুদিন থাকো।’
প্রায় পক্ষকাল পরে একদিন আচার্য শীলভদ্র কান্নান ও বোধিধর্মের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। তিনি কান্নানের কাছে বৌদ্ধদের ওপর আক্রমণের বিষয় একটু বিশদভাবে জানতে চাইলেন। কান্নান চালুক্য সাম্রাজ্য ছেড়ে আসার পথে যে সব বিহারে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের কাছে যা জেনেছিলেন, কিছু কিছু ধ্বংস করা, পুড়ে যাওয়া বিহারের অবস্থা আচার্যকে জানাল। আচার্য মনোযোগ দিয়ে শুনে কান্নান ও বোধিধর্মের কাছে বর্তমানে বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়ের কারণ নিয়ে আলোচনা করলেন। কাঞ্চী বৌদ্ধ বিহারের আচার্য ধর্মকীর্তি যে সব কারণ বলেছিলেন আচার্য শীলভদ্রও তাই বললেন। উত্তর ভারতে বৌদ্ধধর্ম নিরাপদ ও প্রসার লাভের কারণ সম্রাট হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতা ও অকাতর অনুদান।
আচার্য শীলভদ্র বললেন, ‘প্রতিহিংসা কখনও হিংসার সমাধান নয়। অহিংসা, শান্তি ও মৈত্রীর পথই সঠিক পথ। তবে যারা ধর্মান্ধ, যারা স্বার্থন্বেষী, যারা রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করে তাদের ক্ষেত্রে অহিংসা, শান্তি ও মৈত্রী এ সব কথার মূল্য নেই। সে সব ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার জন্য প্রত্যাঘাতের কথা চিন্তা করা যেতেই পারে। মহাজান বৌদ্ধ নীতি বলে, ব্যক্তিকে বা বহুজনকে রক্ষা করার জন্য আক্রমণকারী শত্রুকে প্রতিরোধের জন্য প্রত্যাঘাত করা যেতে পারে তবে তাঁকে অযথা রক্তপাত বা হত্যা করে নয়।’
আত্মরক্ষার পদ্ধতি কী রূপ হবে এ বিষয়ে কান্নানের কী মত বা পরিকল্পনা আচার্য জানতে চাইলেন। কান্নান তখন নিরস্ত্র কুট্টু ভারিসাইয়ের উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি সম্বন্ধে বললে পর বোধিধর্ম আচার্যকে বললেন, ‘আমি নিজে কান্নানের কাছে এই দ্বন্দ-কলা শিখেছি, আপনি অনুমতি করলে এর কিছু মহড়া আপনাকে দেখাতে পারি।’
আচার্য শীলভদ্র বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে অবশেষে বললেন, ‘আমাকে এ বিষয়ে অন্যান্য মহাজ্ঞানী আচার্যদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। সম্রাট হর্ষ বৌদ্ধ মহাসন্মেলন আহ্বান করবেন বলেছেন। তখন আলোচনা করে প্রস্তাব নিতে হবে। আমার একা সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ নয়। তবে কান্নান আমার মনে হয় আপাতত তুমি অল্পবয়সি ছাত্রদের যোগব্যায়াম ও সাধারণ শরীর চর্চ্চার প্রশিক্ষণ দিতে পারো।’
আচার্যের নির্দেশ মেনে কান্নান ছাত্রদের যোগব্যায়াম শেখাতে লাগল। বোধিধর্ম ব্যস্ত রইলেন বেদান্ত আর যোগশাস্ত্রের চর্চ্চায়। কান্নানও আচার্য শীলভদ্রের অনুমতি নিয়ে আয়ুর্বেদ শিখতে শুরু করল। দেখতে দেখতে কেটে গেল তিন বছর। ইতিমধ্যে জ্ঞানী ও বৌদ্ধশাস্ত্রে সুপণ্ডিত বলে ভিক্ষু বোধিধর্মের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সময়ের মধ্যে দূর প্রাচ্যের চিন দেশ থেকে বৌদ্ধধর্মে শিক্ষালাভের জন্য নালন্দায় এলেন পন্ডিত পরিব্রাজক ৎসুয়েন সাং। একসময়ে কান্নানের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচয় হয়ে গেল ৎসুয়েন সাংএর সঙ্গে। অবসরকালে কান্নান ৎসুয়েন সাংএর কাছে চিনা ভাষা শিখত। এর আগে কাঞ্চীতে থাকতে সে বোধিধর্মের কাছে পালি ভাষা শিখেছিল। তা ছাড়া নালন্দায় সাধারণের মধ্যে প্রাকৃত ভাষার চলও ছিল বলে কান্নান সেটা শিখে নিয়েছিল। ৎসুয়েন সাংএর কাছে ও চিনদেশের নানান গল্প শুনত। কী ভাবে সে চিনের ছাংয়ান থেকে রওনা হয়ে, কীভাবে সে রেশম পথ ধরে গোবি মরুভূমির মরুদ্যান সহর দুনহুয়াং, তুরপান হয়ে, মধ্য এশিয়া হয়ে তাশখন্দ, সমরখন্দ আবার সেখান থেকে হিন্দুকুশ পর্বত পেরিয়ে ভারতের পেশোয়ারে প্রবেশ করে তক্ষশীলায় আসে। সেখানেও নালন্দার মতন নামকরা শিক্ষায়তন আছে। তারপর প্রয়াগ, বৌদ্ধগয়া হয়ে নালন্দায় এসে পৌঁছোয়। বিভিন্ন দেশের নানান গল্প ৎসুয়েন সাংএর কাছে কান্নান শুনত। সুমাত্রার জাহাজে থাকার সময়ে একবার সে চিনের ক্যান্টন বন্দরে গিয়েছিল। ৎসুয়েন সাংকেও সে নিজের জীবন কাহিনি সব শুনিয়েছিল। চিনা পরিব্রাজক কান্নানের সে কাহিনি শুনে তাকে চিনে যেতে অনুরোধ করেন। তার বিশ্বাস চিনদেশে কান্নানের এই যুদ্ধকলার যথেষ্ট কদর হবে।
উত্তর ভারতে গঙ্গা আর যমুনা নদীর সঙ্গম স্থলে পুণ্যতীর্থ প্রয়াগ। এই স্থানকে লোকে বলে ত্রিবেণী সঙ্গম। প্রচলিত ধারণা গঙ্গা, যমুনা ছাড়া সরস্বতী নদীও এই সঙ্গমে মিশেছে। যদিও সে নদী অদৃশ্য। সম্রাট হর্ষবর্ধন প্রতি পাঁচ বছর অন্তর মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রসারের উদ্দেশ্যে এখানে দান-মেলার আয়োজন করতেন। এই মেলার নাম মহামোক্ষ পরিষদ। বৌদ্ধ ভিক্ষু, শ্রমণ, হিন্দু ও জৈন ধর্মের সাধু-সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণ ও জাতিধর্ম নির্বিশেষে দরিদ্র ভিখারি সকলেই এই মেলাতে যোগ দিত। সেবারের মেলায় সম্রাট হর্ষ আচার্য শীলভদ্রের মাধ্যমে নালন্দার সকল ভিক্ষু ও শ্রমণ বিশেষ করে ৎসুয়েন সাং ও বোধিধর্মকে মেলায় যোগদানের জন্য আহ্বান করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই কান্নান যেতে চায়নি। কিন্তু ৎসুয়েন সাং ও বোধিধর্মের গরজে আচার্য তাঁকে যেতে নির্দেশ দিলেন।
সম্রাটের শিবিরে নালন্দার অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় পর্বে ৎসুয়েন সাং ও বোধিধর্মকে পেয়ে সম্রাট হর্ষ বিশেষ আনন্দিত হলেন কিন্তু কান্নানকে দেখে ততোধিক বিস্মিত হয়ে আচার্য শীলভদ্রের কাছে তার পরিচয় জানতে চাইলেন। আচার্য একটু ইতস্তত হয়ে কান্নানকে নালন্দার যোগব্যায়ামের প্রশিক্ষক ও আয়ুর্বেদের শিক্ষার্থী বলে পরিচয় দিলেন।
সম্রাট হর্ষ প্রখর বুদ্ধিমান। তিনি হেসে আচার্যকে বললেন, ‘আচার্য আপনি ওঁর সম্বন্ধে যা পরিচয় দিলেন তা বোধ হয় যথেষ্ট নয়, আমার মনে হয় উনি একজন অনন্যসাধারণ বীর যোদ্ধা। তবে সম্রাট পুলোকেশীনের সেনাবিভাগ ছেড়ে নালন্দায় কেন এলেন সেটা বুঝতে পারছি না।’
আচার্য শীলভদ্র কান্নানকে হাত দিয়ে ইশারা করে সম্রাটের প্রশ্নের উত্তর দিতে বললেন। কান্নান সম্রাটকে নত হয়ে প্রণাম জানিয়ে তার বিদ্যাশিক্ষা, চালুক্য সাম্রাজে আগমন ও নির্বাসন আর পরিশেষে ভিক্ষু বোধিধর্মের সঙ্গে নালন্দায় আগমন সংক্ষেপে জানাল। সম্রাট নিবিষ্টমনে কান্নানের শান্ত ভাব আর স্পষ্ট কথা শুনে হেসে মাথা নেড়ে শুধু বললেন, ‘আপনি আমার মাননীয় অতিথি আপনাকে এই মেলায় আমি সাদর অভ্যর্থনা করি।’
এরপর ৎসুয়েন সাং বললেন, ‘সম্রাট শিলাদিত্য, আমি ইতিহাস থেকে জেনেছি যে অতীতে ভারতভূমি থেকে কাশ্যপ, মাতঙ্গ, অমোঘবর্ষ, পরমার্থ, কুমারজীব ও বুদ্ধভদ্র চিনে বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের যে প্রচার করেছিলেন তাতে চিনদেশে জনগণের বৌদ্ধধর্মের প্রতি আগ্রহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানের চিনের সম্রাট তাং রাজবংশের মহামান্য তাইজং। তিনি খুবই দক্ষ প্রশাসক। যদিও তিনি চিনের প্রাচীন তাওবাদে বিশ্বাসী কিন্তু অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদের প্রতি বিরূপ নন। ইদানিং চিনে বৌদ্ধধর্মের প্রসারে কিছু ঘাটতি আছে। যদিও সাধারণ বহু মানুষ বৌদ্ধধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই আপনাকে আমি একান্ত অনুরোধ করি যে কোনো জ্ঞানী বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারককে চিনদেশে পাঠাতে যিনি সেখানে এই ধর্মের প্রসার বৃদ্ধি করবেন।’
সম্রাট হর্ষ, ‘আপনার কথা আমাদের অনুপ্রাণিত করল। এ বিষয়ে সঙ্ঘরাজ আচার্য শীলভদ্র যা সিদ্ধান্ত নেবেন তাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে,’ এ কথা বলে আচার্যের দিকে তাকালেন।
আচার্য শীলভদ্র শান্ত স্বরে বললেন, ‘আমি এ বিষয়ে দু-তিন বছর ধরে চিন্তাভাবনা করছিলাম। পরিব্রাজকের কাছে শুনে চিনদেশের মহামান্য সম্রাটের এ বিষয়ে কোনো আপত্তি হবে না মনে করে আরও উৎসাহিত বোধ করছি। আমি অনেকদিন থেকেই আমাদের আচার্যদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করছিলাম। তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই বৃদ্ধ হয়েছেন এবং এতদূরের পথ ভ্রমণের জন্য শারীরিকভাবে অসমর্থ। প্রচারক রূপে ভিক্ষু বোধিধর্মের নাম আমার কাছে অনেকেই উত্থাপন করেছেন। তাঁর বেদান্ত ও যোগশাস্ত্রের শিক্ষাও সম্প্রতি সমাপ্ত হয়েছে। তাই আমি সম্রাট শিলাদিত্যের কাছে ভিক্ষু বোধিধর্মকে চিনে বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্য পাঠাবার প্রস্তাব রাখছি।’
‘এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব। এ বিষয়ে আচার্য যা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তার ওপর কিছু বলা আমার ধৃষ্টতা। আচার্য যখন তাঁকে পাঠাতে মনস্থ করবেন আমি তাঁর যাত্রার সুব্যবস্থা করব। আমি ব্যক্তিগতভাবে সম্রাট তাইজঙের কাছে ভিক্ষু বোধিধর্মের সঙ্গে যথোচিত উপঢৌকনসহ আমার শুভেচ্ছেবার্তা দিয়ে রাজদূত পাঠাব।’
ৎসুয়েন সাং বললেন, ‘ভিক্ষু বোধিধর্মের প্রজ্ঞা আমি সুবিদিত। তিনি প্রচারকরূপে গেলে মহামান্য সম্রাট নিশ্চয়ই খুশি হবেন।’
সম্রাট হর্ষ বোধিধর্মের দিকে ফিরে বললেন, ‘ভিক্ষু বোধিধর্ম, এ বিষয়ে আপনার কী মত?’
বোধিধর্ম বলল, ‘আচার্য আমার শিক্ষাগুরু। তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা আমি গুরুর আদেশ মনে করে শিরোধার্য করলাম। গুরুর আশীর্বাদই আমার পাথেয়। শুধু আমার একটি বিশেষ আর্জ্জি রয়েছে। কান্নান আমার দীর্ঘ দিনের সঙ্গী। এই দূরপ্রাচ্যের যাত্রায় কান্নানকে আমার যাত্রাসঙ্গী হয়ে যাবার বিষয়ে আপনাদের অনুমতি প্রার্থনা করি।’
বোধিধর্ম কি উদ্দেশ্যে কান্নানকে নিয়ে যেতে চাইছেন আচার্য শীলভদ্র সম্যক বুঝতে পেরে বললেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
‘আচার্য যখন অনুমতি দিয়েছেন তখন আমি দুজনেরই যাত্রার বন্দোবস্ত করে দেব,’ সম্রাট হর্ষ বললেন, ‘আচার্য, চিনদেশে নালন্দার খুব সুনাম রয়েছে। তার প্রধান আচার্য রূপে ভিক্ষু বোধিধর্মের একটি পরিচয় পত্র আপনি সম্রাট তাইজংকে দিয়ে দেবেন। আমার ইচ্ছে কান্নান আমার রাজপ্রতিনিধি হয়ে সম্রাটের হাতে আমার উপঢৌকন ও শুভেচ্ছাপত্র দেবে।’ এই বলে সম্রাট হর্ষ নিজের হাত থেকে তাঁর নামাঙ্কিত আংটি খুলে কান্নানের আঙুলে পরিয়ে দিয়ে হেসে বললেন, ‘এটা রাজপ্রতিনিধির চিহ্ন।’
কান্নান বিস্মিত হয়ে সম্রাট হর্ষের দিকে তাকিয়ে মাথা নত করে প্রণাম জানিয়ে বলল, ‘সম্রাট শিলাদিত্য, আপনি সত্যিই মহানুভব।’
সম্রাট হর্ষের বিভিন্ন ধরনের জাহাজসহ একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিল। এই নৌবাহিনীর দক্ষ সামরিক সেনানায়করা কলিঙ্গ সাগর ও ভারত মহাসাগরের বেশির ভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করত। সম্রাট হর্ষ ৎসুয়েন সাংএর কাছে তাঁর চিন থেকে রেশম পথ ধরে মধ্য এশিয়া হয়ে হিন্দুকুশ পেরিয়ে ভারতে আসার কাহিনি শুনেছিলেন। তিনি ভেবেচিন্তে কান্নান আর বোধিধর্মের জলপথে চিনে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করলেন, বিশেষত তাঁদের সঙ্গে যেহেতু চিনের সম্রাটের জন্য উপঢৌকনের সম্ভার পাঠানো হবে।
এ ঘটনার প্রায় ছয় মাস পরে কান্নান আর বোধিধর্ম বঙ্গদেশের তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে দাঁড় টানা, তিরিশ পালের বড়ো জাহাজ বা দোঙ্গা করে চিনদেশের উদ্দেশে রওনা হলেন। তার সঙ্গে আরও দুটি জাহাজে সহস্র স্বর্ণ ও সহস্র রৌপ্যমুদ্রা, এক পেটিকা হিরে, মুক্ত, চুনি, পান্না খচিত স্বর্ণালঙ্কার, তিনশত সংস্কৃত ও পালি ভাষায় লেখা বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের ওপর পুথি, একটি একহস্ত পরিমাণ সোনার বুদ্ধমূর্তি, রেশম ও কার্পাসের বস্ত্রসম্ভার, সুগন্ধদ্রব্য, হাতির দাঁতের নানাবিধ সৌখিন বস্তু, পঞ্চাশটি হাতি, একশো আরবী ঘোড়া, আর ময়ুর সহ হরেক রকম পাখি চিনের সম্রাট তাইজংকে উপঢৌকন পাঠিয়ে দিয়েছেন। মাঝিমাল্লারা ছাড়াও জাহাজগুলির সুরক্ষার জন্য তিনশো সৈন্য ও একশো জনের মতন তল্পিবাহক, মাহুত, অশ্বপালক, আধিকারিক ও অন্যান্য কর্মচারীগণও ছিল। জাহাজের মাস্তুলের মাথায় পুষ্যভূতি সাম্রাজ্যের সোনালি সিংহ আঁকা সাদা পতাকা ছাড়াও শান্তির প্রতীক শ্বেত পতাকাও ছিল।
যাত্রা শুরুর চতুর্থ দিনে জাহাজগুলো ভিড়ল ব্রহ্মদেশের থাটন বন্দরে। এই এলাকা তখন পেয়ু জনগন শাসন করত। তারা সব বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। জাহাজ এখানে একদিন থামল। কান্নান আর বোধিধর্ম এখানে একটি স্থানীয় বৌদ্ধবিহারে এলেন। বিহারের প্রধান তাঁদের স্বাগত জানালেন। বোধিধর্ম নালন্দা থেকে চিনে সম্রাট হর্ষবর্ধন ও আচার্য শীলভদ্র প্রেরিত বৌদ্ধধর্মের প্রচারক রূপে যাচ্ছেন জেনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। কান্নানকে সম্রাটের রাজপ্রতিনিধি জেনে খুব খাতির করলেন। যদিও এখানকার বিহারের সকলে থেরাভেদা বৌদ্ধমতের অনুসরণকারী তবুও প্রধান আচার্য বোধিধর্মকে বিহারের সকল ভিক্ষু ও শ্রমণদের উপদেশ দিতে অনুরোধ করলেন।
জাহাজ থাটন বন্দর থেকে রওনা হয়ে ধীরে ধীরে কলিঙ্গ সাগর পেরিয়ে ক্রমে মালয় সাগরে পড়ল। প্রায় আট দিন একটানা চলে জাহাজগুলো ল্যাংকাশুকা রাজ্যের বন্দর শহরে এসে পৌঁছোল। বর্তমান থাইল্যান্ডের দক্ষিণ অংশে ছিল এই ল্যাংকাশুকা রাজ্য। এখানকার রাজা তখন ভগদত্ত। তাঁর সঙ্গে চিনের সম্রাটের সুসম্পর্ক রয়েছে। এখানেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব রয়েছে। বন্দরের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক সম্রাট হর্ষের জাহাজ দেখে এগিয়ে এল। কান্নান একজন আধিকারিককে তাঁদের আগমনবার্তা আর রাজার সঙ্গে সাক্ষাতের অভিপ্রায়ে দৌতকার্যে পাঠাল। পরের দিন সম্রাটের এক মন্ত্রী এসে সাদর আহ্বান করে কান্নান আর বোধিধর্মকে নিয়ে গেল। সঙ্গে আধিকারিক, তিন সেনানায়কসহ আরও তিনজন তল্পিবাহক রাজদর্শনে গেল। সম্রাট হর্ষ রাজা ভগদত্তের জন্য একটি বহুমূল্য রত্নহার, রেশমী বস্ত্র, কিছু সৌখীন দ্রব্য আর পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। কান্নান রাজপ্রতিনিধিরূপে সেই সব উপঢৌকন রাজার সম্মুখে রাখল। রাজা ভগদত্ত অত্যন্ত প্রীত হয়ে সম্রাট হর্ষের অনেক গুণকীর্ত্তন করলেন। রাজা তাঁদের বিশেষ অনুরোধ করলেন তিন-চার দিন রাজ অতিথি হয়ে থাকার জন্য ও বোধিধর্মের কাছে বৌদ্ধধর্ম ও তার দর্শন নিয়ে শুনতে আগ্রহী হলেন।
ল্যাংকাশুকাতে চার দিন কাটাবার পর জাহাজগুলো এবার সিংহপুর বা বর্তমানের সিঙ্গাপুর ঘুরে উত্তর-পূর্বে দক্ষিণ চিন সমুদ্র ধরে চলল।
টানা দশ দিন চলার পর জিয়াও চাও রাজ্যের লাম আপ বন্দরে এসে জাহাজগুলো নোঙর ফেলল। এখানে দু-দিন বিশ্রাম নিয়ে জাহাজগুলো রওনা হল ক্যান্টনের দিকে। দিন পাঁচেক পরে একদিন সকালের দিকে সম্রাট হর্ষের জাহাজগুলো ক্যান্টন বন্দরে পৌঁছোল। একসঙ্গে তিনখানা শ্বেত পতাকাসহ জাহাজ দেখে বন্দরের প্রধান আধিকারিক ও ভারপ্রাপ্ত নিরাপত্তা অধিকর্তা জনৈক সেনাপ্রধান আরও কয়েকজন রক্ষীবাহিনী নিয়ে জেটিতে হাজির হল। জাহাজের ডেকের ওপর এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে দেখে তারা একটু ভরসা পেয়ে এগিয়ে এল। জাহাজ থেকে দড়ির মই নামিয়ে দিলে তারা জাহাজে উঠে এল। কান্নানকে তাদের চিনা ভাষাতে অভ্যর্থনা করতে দেখে তারা অবাক হয়ে কান্নানের দু-হাত ধরে ঝাঁকিয়ে হেসে জড়িয়ে ধরল। বোধিধর্মকে তারা অনেকটা মাথা নত করে প্রণাম জানাল। কান্নান নিজেদের পরিচয় দিয়ে এখানে আসার কারণ জানিয়ে সম্রাট তাইজঙের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইল।
সেনাপ্রধান জানাল যে সে সম্রাটের কাছে এ বিষয় জানিয়ে দ্রুত সংবাদ পাঠাচ্ছে কিন্তু রাজধানী চাংআন এখান থেকে অনেক দূর প্রায় পাঁচশো ক্রোশ পথ। তাই দ্রুত ডাক ব্যবস্থা থাকলেও সংবাদ পাঠিয়ে উত্তর পেতে বাইশ-তেইশ দিন লাগবেই। এ ক-টা দিন মহাশয়দের অপেক্ষা করতেই হবে। ব্যবস্থা অনুযায়ী কান্নান আর বোধিধর্মকে সেনাছাউনিতে বিশেষ অতিথিশালায় রাখা হল। আর জাহাজগুলো এবং সম্রাটের উপহারের বস্তুগুলো রক্ষার জন্য বাকিরা জাহাজেই থেকে গেল। বন্দরের কর্তৃপক্ষ ও সেনাপ্রধান তাঁদের যাতে কোনোরকম অসুবিধা না হয় তার দিকে নজর রাখল।
সম্রাট তাইজঙের অনুমতি এল প্রায় চব্বিশ দিন পরে। কিন্তু আরও দিন পাঁচেক অপেক্ষা করতে হল সমস্ত ব্যবস্থা করার জন্য। সম্রাটের নির্দেশে একজন শাসনকর্তা গুয়ানচাশি ও স্থানীয় দুই অঞ্চলের শাসক সিশি কান্নানদের অভ্যর্থনা জানাল। সম্রাটের সকল উপহার ও লোকজন সহ মিছিল করে রওনা হল রাজধানী চাংআনের উদ্দেশে। সম্রাট হর্ষের দুশো সৈন্য ও মাঝিমাল্লারা জাহাজেই রয়ে গেল। শুধু একশো সৈন্য মিছিলের সঙ্গে গেল। এ ছাড়া ক্যান্টনের সেনাপ্রধান দুশো চিনা সৈন্য নিয়ে সঙ্গে চললেন। ক্যান্টন থেকে রাস্তা দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রায় সোজাই চলে গেছে রাজধানী চ্যাংআনের দিকে। ইট আর পাথরে বাঁধান প্রশস্ত রাস্তা বড়ো বড়ো শহর আর গ্রামকে জুড়েছে। যাত্রা পথে ৎসিংইউন, তানজো, শিয়াংইয়াং শহরের জনগণ মিছিলের দুপাশে হাত নেড়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের উৎসাহ ছিল দেখার মতন বিশেষ করে অত হাতি, ময়ূর আর পাখি দেখে।
কান্নান আর বোধিধর্মের জন্য আলাদা হাতির ব্যবস্থা ছিল। সম্রাটের জন্য উপহারগুলো ঘোড়ায় টানা গাড়িতে তল্পিবাহকরা নিয়ে আসে। হাতি আর ঘোড়াগুলো সৈন্যদের তত্ত্ববধানে আনা হয়। পথে খাওয়াদাওয়া, বিশ্রামের ব্যবস্থা স্থানীয় প্রশাসনই করছিল। রাজধানী চাংআন পৌঁছতে লেগে গেল প্রায় চল্লিশ দিন। শহরের বাইরে যখন মিছিল এল তখন অপরাহ্ণবেলা। সেদিন রাতে শিবিরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল থাকার জন্য। সে শিবিরে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে কান্নান ও বোধিধর্ম সম্রাট সন্দর্শনে এলেন। বোধিধর্মের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর উজ্জ্বল গৈরিক বেশ। কান্নান রাজপ্রতিনিধি—তাই সম্রাট হর্ষের দেওয়া রেশমের ধুতি, জামা ও উত্তরীয় পরেছিল। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। মাথায় সাদা রেশমের পাগড়ি। রাজধানীর প্রবেশপথে তোরণ করা হয়েছিল। চারিদিকে জনতার ভিড়। হাতির ওপর বোধিধর্মকে দেখে সবাই হাত জোড় করে প্রণাম জানাচ্ছিল।
চিনের প্রধানমন্ত্রী বা ৎসাই শিয়াং রাজপ্রাসাদের প্রধান দরজায় এসে কান্নান আর বোধিধর্মকে অভ্যর্থনা জানাল। রাজপ্রাসাদের বিশাল চত্বরে সম্রাট হর্ষের পাঠানো হাতি আর ঘোড়াগুলোকে সার বেধে দাঁড় করিয়ে রাখা হল। কান্নান, বোধিধর্ম আর প্রধান আধিকারিক দুজন মন্ত্রী বা সাংসুর সঙ্গে রাজসভায় প্রবেশ করে সম্রাটের সম্মুখে এলেন। বিশাল রাজসভা। পাথরের দেওয়াল আর বড়ো বড়ো থাম। দেওয়ালে, দরজায়, মাথার ওপরে বিভিন্ন দিকে শুধুই ফুল-নক্সাকাটা কারুকার্য করা পালিশ করা কাঠের জালির কাজ।
সভার প্রবেশ পথের সোজা বরাবর তিন ধাপ বেদীর ওপর স্বর্ণখচিত সিংহাসনে সম্রাট তাইজং গম্ভীর মুখে বসে আছেন। আশপাশে সভাসদগণ। সম্রাটের মাথায় ঘন কালো লম্বা চুল গুটিয়ে গোল চূড়া করে বাঁধা আর তাতে সোনার আঙটা দেওয়া। তাঁর পরনে মোটা ভারী রেশমের সোনার জরীর ঘন ফুল-লতা-পাতার কাজ করা লম্বা, খুব ঢোলা হাতার পা পর্যন্ত লম্বা পরিধান ছাংপাও, কোমরে কোমরবন্ধ লান। সম্রাট বিশালদেহী, মুখটাও বড়ো, পীত বর্ণ, চোখ ছোটো, সরু পাতলা লম্বা দু দিকে ঝুলে পড়া গোঁফ আর থুতনি থেকে লম্বা সরু দাড়ি।
কান্নান সম্রাটের কাছে এসে মাথা নত করে প্রণাম জানাল আর বোধিধর্ম শুধু হাত জোড় করে নমস্কার করল। সম্রাটও হাত জোড় করে নমস্কার জানাল। কান্নান চিনে ভাষায় নিজেদের পরিচয় দিয়ে সম্রাটের হাতে একটি লম্বাটে চন্দনকাঠের কারুকার্য করা বাক্স দিল। কান্নানের মুখে এত স্পষ্ট শুদ্ধ উচ্চারণে চিনে ভাষা শুনে সম্রাট একটু হেসে মাথা নেড়ে বাক্সটা প্রধান মন্ত্রীর হাতে দিলেন। প্রধান মন্ত্রী বাক্স খুলে সম্রাট হর্ষের শুভেচ্ছা পত্র আর নালন্দার প্রধান আচার্য শীলভদ্র সম্রাটকে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে সহায়তা করার অনুরোধ জানিয়ে যে পত্র দিয়েছেন তা পড়ে শোনালেন। জনৈক দোভাষী পালি থেকে চিনে ভাষায় তর্জ্জমা করে সম্রাটকে শোনাল।
সম্রাট সব শুনে মাথা নাড়লেন আর প্রধান মন্ত্রীর দিকে ফিরে এর জবাব প্রস্তুত করতে বললেন। কান্নান এবার সম্রাট হর্ষের পাঠানো উপঢৌকনগুলো সম্রাটের নিকট উপস্থাপনের অনুমতি প্রার্থনা করল। সম্রাট মাথা নেড়ে অনুমতি দিলে কান্নান আধিকারিককে উপহারগুলো নিয়ে আসতে বলল। প্রথমে রূপোর থালায় করে স্বর্ণ আর রৌপ্য মুদ্রা পেশ করা হল। রাজসভার সম্রাটের নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা জনৈক রাজকর্মচারী থালা গ্রহণ করে সম্রাটের কাছে নিয়ে এলে সম্রাট হাত দিয়ে স্পর্শ করে গ্রহণ করলেন। এর পরে অলংকার সমেত পেটিকা নিয়ে আসা হলে সম্রাট রত্নখচিত অলংকারগুলি হাতে নিয়ে দেখলেন। একে একে সোনার বুদ্ধমূর্তি, বস্ত্রসম্ভার, পুথি, সুগন্ধদ্রব্য ও সৌখিন দ্রব্য পেশ করা হল। হাতির দাঁতের কয়েকটা সৌখিন বস্তু সম্রাট হাতে নিয়ে দেখলেন।
এর পর কান্নান সম্রাটকে হাতি, ঘোড়া আর পাখিগুলো দেখার আবেদন জানাল। সম্রাট তাইজং তাঁর মন্ত্রীবর্গ ও সভাসদগণসহ রাজসভার বাইরে প্রশস্ত পাথরে বাঁধান মসৃণ চত্বরে এলেন যেখানে হাতি, ঘোড়া আর পাখিগুলো সারবদ্ধ ভাবে রাখা ছিল। সম্রাট এতগুলো ভারতীয় হাতি আর ঘোড়া পেয়ে খুশি হলেন। হাতিগুলোর মধ্যে কয়েকটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রণহস্তীও ছিল। রণহস্তী আর আরবি ঘোড়া সম্রাটের অত্যন্ত পছন্দ হল। সম্রাট মন দিয়ে ময়ুর আর পাখিগুলো দেখলেন।
সম্রাট তাইজং কান্নানকে আর বোধিধর্মকে জানালেন যে তিনি শীঘ্রই মহামান্য সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজসভায় চিনের রাজদূত পাঠাবেন। প্রধান মন্ত্রীকে ডেকে নির্দেশ দিলেন কান্নান আর বোধিধর্মকে সম্রাটের অতিথিগৃহে যথোচিত মর্যাদার সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করতে এবং বাকিদেরও যথাবিধি খাতির যত্ন করতে ও পুরস্কার দিতে। সম্রাট বোধিধর্ম আর কান্নানের সঙ্গে অপরাহ্ণে মিলিত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।
অপ্রাহ্ণবেলায় জনৈক রাজকর্মচারী এসে কান্নান আর বোধিধর্মকে সম্রাটের খাস মহলে এক ছোটো উন্মুক্ত অঙ্গনে নিয়ে এল। মসৃন পাথরে বাঁধান। চারিদিকে নানারকম ফুলের গাছ ও পাথরের মূর্তি। মাঝে একটি গোলাকৃতি ছোট্ট জলাশয়ের মাঝে ফোয়ারা। একদিকে কারুকার্য করা কাঠের বড়ো কেদারা আর তাতে গদীর ওপর সম্রাট বসে আছেন। তাঁর ডান পাশে তিনজন বৃদ্ধ সাধু কাঠের বেদীতে বসে আছেন। বাঁ পাশে দুটি খালি কাঠের বেদীতে বোধিধর্ম আর কান্নান এসে আসন গ্রহণ করলেন। বৃদ্ধ তিনজন তাও ধর্মমতের জ্ঞানী সাধু।
সম্রাট ও তাও সাধুগণ বোধিধর্মের কাছে বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। বোধিধর্ম দীর্ঘ সময় ধরে ধর্মের ও দর্শনের বিষয়ে ব্যাখ্যা করে শোনালেন। সাধুগণ তাঁদের তাও মতবাদের আঙ্গিকে নানাবিধ প্রশ্নের উত্থাপন করলেন। বোধিধর্ম তখন বৌদ্ধ ও তাও দর্শনের তুলনামূলক আলোচনায় দুটি দর্শনের মিল ও পার্থক্য বিশদভাবে বর্ণনা করে বোঝালেন। বোধিধর্মের তাও ধর্ম ও দর্শনের ওপর জ্ঞান সাধুদের মুগ্ধ করল। চারদিন ধরে প্রতি অপরাহ্ণবেলায় এই আলোচনা চলল। তাও সাধুগণ বোধিধর্মের পান্ডিত্য, শাস্ত্রজ্ঞান ও বাগ্মীতার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। সম্রাট প্রীত হয়ে বোধিধর্মকে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের অনুমতি দিলেন। বোধিধর্ম শাওলিন মঠে যেতে চাইলে সম্রাট তার ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বাস দিলেন।
আরও তিনদিন পরে বোধিধর্ম আর কান্নান শাওলিন মঠের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। দিন তিনেক পরে তাঁরা শাওলিন বৌদ্ধমঠে এসে পৌঁছলেন। চিনের উত্তরাঞ্চলে হেনান প্রদেশের দেংফেং অঞ্চলের সোংসান পর্বতমালার উরু শৃঙ্গের পাদদেশে এই শাওলিন বৌদ্ধ মঠ। শতাধিক বছর আগে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে চিনে আসেন বুদ্ধভদ্র। তিরিশ বছর তিনি হীনযান বৌদ্ধ মতবাদ প্রচার করার পর, উত্তর ওয়ে অঞ্চলের সম্রাট সিয়াও ওয়েনের নির্দেশে এই শাওলিন মঠের প্রতিষ্ঠা হয় এবং বুদ্ধভদ্র এর প্রথম মোহন্ত। বুদ্ধভদ্র চিনে বা তুও নামে পরিচিত হন।
বোধিধর্ম আর কান্নান যখন শাওলিনে এলেন তখন এখানকার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাজ ছিল বিভিন্ন সংস্কৃত আর পালি ধর্মগ্রন্থগুলি চিনা ভাষায় অনুবাদ করা। দিবারাত্রি সব বসে বসে অনুবাদ করায় রত থাকায় ভিক্ষুরা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল; এবং অনেকেই কুঁজো হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা ধ্যানে কখনই মনঃসংযোগ করতে পারত না। তাঁরা শুধু পুথির অনুবাদ, শাস্ত্রপাঠ ও আলোচনা, মন্ত্রপাঠ, মন্দির ও স্তূপ নির্মাণেই দিনাতিপাত করত ফলে তাঁরা ধ্যানের গভীরে গিয়ে আত্মজ্ঞান লাভ করা থেকে বিরত ছিল। কিন্তু বোধিধর্মের শিক্ষার মূল লক্ষ্য জাগতিক ধর্ম থেকে বেরিয়ে এসে আপন অন্তরে বুদ্ধত্বের অনুসন্ধান করা। আর তার জন্য বৌদ্ধিক চর্চ্চার সঙ্গে শরীর চর্চ্চারও যথেষ্ট প্রয়োজন আছে। দুর্বল শরীরে মনঃসংযোগ হয় না আর মনঃসংযোগ না করতে পারলে ধ্যানও হয় না।
এ ছাড়াও মঠে প্রায়ই ডাকাতের আক্রমণ হত খাদ্যশস্য লুঠের জন্য। দুর্বল সন্ন্যাসীদের আত্মরক্ষা করার বা বাধা দেবার মতন শক্তি সাহস ছিল না। তাই বোধিধর্ম সন্ন্যাসীদের শরীরচর্চ্চার প্রয়োজনীয়তার কথা বোঝালেন।
তিনি কান্নানের পরামর্শে সন্ন্যাসীদের জন্য তিন ধাপের শিক্ষাক্রম তৈরি করলেন যাতে প্রথম ধাপে—কি গং বা শরীর চর্চ্চা বা, দ্বিতীয় ধাপে—শি কাই গং বা শরীরচর্চ্চার সঙ্গে ও মনঃসংযোগ অভ্যাস আর তৃতীয় ধাপে—সেন গং বা ধ্যানের অভ্যাস। প্রথম দুটি ধাপের ভার বোধিধর্ম কান্নানের হাতে দিলেন।
কান্নান এখানে নিরস্ত্র যুদ্ধকলা বা কুট্টু ভারিসাই, যা সে তার গুরু কান্দানের কাছে শিখেছিল, তা শাওলিনের সন্ন্যাসীদের ধাপে ধাপে শেখান শুরু করল। তার সঙ্গে সে যোগব্যায়াম শেখানও শুরু করল। সে কুট্টু ভারিসাইয়ের নতুন নাম দিল—গং ফু। চিনে ভাষায় গং মানে দক্ষতা আর ফু মানে মানুষ। এক কথায় মানুষের দক্ষতা। গং ফু আর কুং ফুএর অর্থ একই। দক্ষিণ চিনে ক্যান্টনীয় উচ্চারণে বলে কুং ফু।
কান্নান বিভিন্ন রকমের শরীরের অবস্থান, হাত ও পায়ের চালনা, আঘাত ও প্রত্যাঘাতের কলাকৌশল যা জানত আর তার সঙ্গে কিছু কিছু নিজে প্রবর্তন করে সন্ন্যাসীদের শিখিয়েছে। সে আরও শিখিয়েছে যে এই যুদ্ধকলা কখনই অযথা আঘাত করার জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়। কান্নানের এই নতুন পদ্ধতি আত্ম-শৃঙ্খলার জন্য যোগব্যায়াম এবং আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধকলাকে একীভূত করেছিল। বোধিধর্ম হত্যা, ডাকাতি, অশ্লীলতা, মিথ্যে কথা বলা এবং সুরা পান করা নিষিদ্ধ করেছিলেন।
কান্নান সন্ন্যাসীদের কঠোর পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিল। সে পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হত বোধিধর্ম তাঁদের তাঁর ধ্যানভিত্তিক বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা দিতেন যা পরে চিন দেশে ছ্যান নামে প্রসিদ্ধ হয়। চিনদেশে বোধিধর্মের নাম হয় দামো আর কান্নানের নাম ছিল কাই নান। বোধিধর্মের মূল উপদেশ ছিল শুধুমাত্র বৌদ্ধিক চর্চ্চা করে বুদ্ধত্ব লাভ হয় না, এর জন্য ধ্যানের মধ্য দিয়ে তাঁকে অন্তরে উপলব্ধি করতে হয়। এর জন্য এবারে তিনি নিজে পর্বতের একটি গুহায় দেওয়ালের দিকে মুখ দিয়ে গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন ও বুদ্ধত্ব লাভ করেন। দীর্ঘ দশ বছর কান্নান চিনে তার প্রবর্তিত যুদ্ধকলা গং ফুর প্রশিক্ষণ দেয়। এর পর শিষ্যপরম্পরায় এই গং ফুর শিক্ষা চিন দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে আর সেই সঙ্গে বোধিধর্মের ছ্যান বৌদ্ধধর্ম।
ভগবান বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় হাজার বছর পরে জাপানে বৌদ্ধধর্ম প্রবেশ করে কোরিয়ার ফেকজে সাম্রাজ্যের রাজা সিওঙের পাঠানো একদল বৌদ্ধ প্রচারকের মাধ্যমে। জাপানের যে সময়কে আসুকা কাল বলা হয়, সে কালে সোগা জাতি ছিল সবচেয়ে বনেদি আর শক্তিশালী। তারাই জাপানে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে খুব উদ্যোগী হয় যেহেতু তাঁদের আদি শিকড় ছিল কোরিয়ায়। ক্রমে এক সময়ে জাপানের সম্রাট ইয়োমেইয়ের সমর্থন পেয়ে বৌদ্ধধর্ম জাপানে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সমর্থ হয়। তার পর থেকেই জাপান থেকে অনেক বৌদ্ধ, আরও গভীর ভাবে বৌদ্ধধর্মকে জানার জন্য, চিনে আসতে শুরু করে আর এভাবেই কান্নানের গং ফুর সুনাম চিন ছাড়িয়ে জাপানেও পৌঁছে যায়। সোগা জাতির অন্যতম সদস্য সোগা নো উমাকোর নির্দেশে ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগে জাপানের নারা অঞ্চলে প্রথম হোকো জি বা আসুকা ডেরা বৌদ্ধমঠের প্রতিষ্ঠা হয়।
সোগা নো উমাকোর পুত্র সোগা নো এমিশি বোধিধর্ম ও কান্নানকে জাপানের নারাতে আসার আমন্ত্রণ জানায়। বোধিধর্ম সেই সময়ে বুদ্ধত্ব লাভের উদ্দেশ্যে পর্বতের গুহায় ধ্যানে বসার উদ্যোগ করছেন। তিনি কান্নানকে নির্দেশ দিলেন জাপানে যেতে। কান্নান যখন জাপানের নারা অঞ্চলে এল, তার কিছুদিন আগে আসুকা ডেরার মঠে একটি অত্যন্ত অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে গেছে। মঠে প্রধান সন্ন্যাসী নিশিরেন শোনিন আর সোগা নো এমিশি কান্নানকে সাদর আমন্ত্রণ জানালেন। নিশিরেন শোনিনের কাছেই কান্নান বিশদ ব্যাপারটা জানল।
ভগবান বুদ্ধের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর দেহ দাহ করা হয় আর তাঁর দেহভস্ম আটভাগ করে মগধের রাজা অজাতশত্রু, বৈশালির লিচ্ছবি, কপিলাবাস্তুর শাক্যজাতি এরকম আট জন বুদ্ধশিষ্যমণ্ডলীর মধ্যে ভাগ হয়েছিল। ভস্মাধারগুলো বিভিন্ন জায়গায় প্রথিত করে তার ওপর স্তূপ নির্মাণ করা হয়েছিল বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের পূজা আরাধনার জন্য। পরবর্তীকালে সম্রাট অশোক সেই দেহভস্মসকল সংগ্রহ করে তাঁর সারা সাম্রাজ্য জুড়ে চুরাশী হাজার বুদ্ধস্তূপ নির্মাণ করেন। ভগবান বুদ্ধের দেহাবশেষ, ভিক্ষাপাত্র, মাথার খুলির হাড়, দাঁত ভারতের বাইরে সিনহল, চিন, জাপান, কোরিয়া সহ বিভিন্ন দেশে আসে। গত শতাব্দীতে ভিক্ষু বুদ্ধদত্ত জাপানে সোনার পাত্রে ভগবান বুদ্ধের একটি কৃন্তক দাঁত নিয়ে এসেছিলেন যা পরে আসুকা ডেরায় নিয়ে আসা হয়। এখানে দীর্ঘকাল ধরে মন্দিরে বুদ্ধমূর্তির পায়ের কাছে সযত্নে রেখে পুজো করা হয়ে আসছে।
এই নারা অঞ্চলে ফুজিয়ারা, তাশিবানা, কিবি, সোগা গোষ্ঠীর কিছু সামন্ত প্রভু ছিল যারা ক্ষমতা, জমি ও অর্থের জন্য প্রায়ই পরস্পরের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হত। এদের মধ্যে সোগা গোষ্ঠী সেই সময়ে সবচেয়ে ক্ষমতাবান ছিল ও জাপানের সম্রাটের দরবারে উচ্চপদে আসীন ছিল। কাগেয়ামা নামের স্থানীয় এক গোষ্ঠীর নেতা ছিল তাকেশি। যেমন বিশাল ছিল তার আকৃতি তেমনি হিংস্র ও নৃশংস ছিল তার প্রকৃতি। তার ওপর নারা অঞ্চলে সে ছিল শ্রেষ্ঠ তরোয়ালবাজ। সে আর তার দলবল ছিল ভাড়াটে যোদ্ধা। অন্যান্য সামন্ত প্রভু বা গোষ্ঠীর নেতাদের হয়ে মোটা অর্থের বিনিময়ে গুপ্তচরবৃত্তি, অতর্কিত আক্রমণ, গুপ্তহত্যা, লুঠ, অগ্নিসংযোগ করা ছিল তাঁদের প্রধান কাজ।
ঘটনাক্রমে তাকেশি শুনেছে আসুকা ডেরায় বুদ্ধমূর্তির পায়ের কাছে যে সোনার পাত্র আছে তাতে ভগবান বুদ্ধের দাঁত রয়েছে আর সেই দাঁত যার কাছে থাকবে সে অমিত শক্তিশালী ও ভাগ্যবান হবে। এটা শোনার পর থেকেই সে সুযোগ খুঁজছে দাঁতশুদ্ধ সোনার পাত্রটা চুরি করার। অবশেষে একদিন গভীর রাতে তাকেশি তার দলদল নিয়ে আসুকা ডেরা মন্দিরে হানা দিল। কয়েকজন সন্ন্যাসী আর রক্ষী যারা ছিল বাধা দিতে এল বটে কিন্তু হানাদারদের হাতে খোলা তরোয়াল, ছোরা দেখে ভয়ে এগোল না। তাকেশি মন্দিরের দরজার তালা ভেঙে বুদ্ধদেবের মূর্তির পায়ের কাছ থেকে দাঁত রাখা সোনার পাত্রটা তুলে নিয়ে দল নিয়ে বিনা বাধায় আসুকা ডেরা থেকে বেরিয়ে গেল।
গোলমাল শুনে মোহন্ত শোনিন ও অন্যান্য সন্ন্যাসীরাও বেরিয়ে এসেছিলেন কিন্তু সশস্ত্র ডাকাতদের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। তাকেশিকে অনেকেই চিনতে পেরেছিলেন। এই ঘটনায় মঠের সবাই খুব ভেঙে পড়লেন। পরদিন সকালেই খবর পেয়ে এমিশি ছুটে এলেন। তাকেশিকে আগে তিনি কয়েকবার ভাড়া নিয়েছেন তাঁর দলের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাকেশির কাছে লোক পাঠালেন দাঁত ফেরত দিয়ে দেবার জন্য। তাকেশি তাদের ভয় দেখিয়ে হাঁকিয়ে দিল। এমিশি সম্রাটের কাছে নালিশ করে সৈন্যদলের সাহায্য চাইলেন। সম্রাট জোমেই নিজে জাপানের প্রাচীন শিন্টো ধর্মের অনুরাগী। তাকেশিরও দলের লোক কিছু কম নয়। সম্রাট অযথা সৈন্যক্ষয় করতে রাজি হলেন না। এমিশি একবার ভাবল যে সে তাঁর সৈন্যদল নিয়ে তাকেশিকে আক্রমণ করবে আর সে ক্ষেত্রে অন্য শত্রুপক্ষীয় গোষ্ঠীদের তাকেশিকে সাহায্য করার সম্ভাবনা খুবই প্রবল; তাই আর সে ও পথে এগোল না।
শেষকালে এমিশি তাকেশিকে অনেক অর্থের লোভ দেখাল। তাকেশি নিমরাজি হল দাঁত ফেরত দিতে কিন্তু সোগা গোষ্ঠির শত্রু অন্য গোষ্ঠির নেতৃস্থানীয় লোকেরা তাকেশিকে ফেরত দিতে নিষেধ করল। তাঁকে বোঝাল যে এই দাঁত কাছে থাকলে তাকেশি ভাগ্যবলে এমিশির থেকেও বেশি অর্থবান ও শক্তিশালী হয়ে যাবে। তাকেশি যদিও নিজে শিন্টো ধর্মাবলম্বী তবুও নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে বুদ্ধদেবের দাঁত যখন তার কাছে আছে তাঁকে কেউ হারাতে পারবে না। সে এমিশিকে জানালো যে সে দাঁত ফেরত দিতে রাজি আছে যদি সে বা তাঁর কোনো লোক তাঁকে দ্বন্দযুদ্ধে হারাতে পারে। এমিশি দেখল এই একমাত্র সুযোগ। সেও রাজি হয়ে গেল। এরপর সে তাঁর তিনজন দক্ষ যোদ্ধাকে পাঠিয়েছিল তাকেশিকে দ্বন্দযুদ্ধে হারিয়ে দাঁত উদ্ধার করে নিয়ে আসতে। কিন্তু ওই তিনজন যোদ্ধাই তাকেশির কাছে হেরে গেল। দুজনের মৃত্যু হল আর একজন গভীরভাবে আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। এমিশি আর নতুন করে কাউকে যুদ্ধে পাঠাতে সাহস করল না।
কান্নান মোহন্ত শোনিনের কাছে সব শুনে তাকেশির সঙ্গে দ্বন্দযুদ্ধ করে ভগবান বুদ্ধের দাঁত উদ্ধার করে আনতে চাইল। শোনিন আর এমিশি দুজনের কেউ রাজি হলেন না। তাঁরা বললেন, ‘আপনি আমাদের সম্মানীয় অতিথি। আপনাকে আমরা জেনেশুনে এই বিপদের মাঝে ছেড়ে দিতে পারি না। আপনার কোনো ক্ষতি হলে আমরা কোনো দিনই নিজেদের ক্ষমা করতে পারব না।’
কান্নান তাঁদের বুঝিয়ে বলল, ‘দেখুন আমি নিজে একজন যোদ্ধা। সম্মুখ যুদ্ধেও হারিনি। আমার নিজের আত্মবিশ্বাস আছে। জেনেশুনেও যদি আমি ভগবান বুদ্ধের পুণ্যশরীরের দাঁত উদ্ধার করতে সচেষ্ট না হই, আমি নিজেও আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারব না। আপনারা আমাকে দয়া করে অনুমতি দিন।’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও মোহন্ত শোনিন আর এমিশিকে রাজি হতে হল। কান্নান এমিশিকে কোনো অস্ত্র কারিগরের কাছে নিয়ে যেতে অনুরোধ করল। এমিশি কান্নানকে তাঁর পরিচিত এক দক্ষ কারিগরের কাছে নিয়ে এলে কান্নান তাকে দুটো দুই আঙুল ব্যাসের আধা হাত লোহার ডান্ডা একটি মোটা শেকল দিয়ে জুড়ে দিতে বলল। এই অস্ত্র কান্নান শাওলিন থাকতে উদ্ভাবন করেছিল প্রশিক্ষনের সময়ে কারণ সে দেখেছিল এর দ্রুত চালনাতে হাত ও চোখের সমন্বয়ে ও প্রতিবর্ত ক্রিয়াতে ইতিবাচক সুবিধা হয়। তা ছাড়া কোনো নিরস্ত্র দ্বন্দে আত্মরক্ষায় তরোয়ালের থেকেও বেশি কাজ দেয়। দরকার হলে এ দিয়ে প্রতিপক্ষকে আঘাত হানাও যায়। এমিশি অবাক হয়ে ভাবলেন এ অস্ত্র দিয়ে কী হবে! চাই তো ভালো তরোয়াল। কিন্তু কান্নানকে মুখে কিছু বলতে পারলেন না।
কান্নান এমিশির সঙ্গে তাকেশির ডেরায় এসে তাঁকে দ্বন্দযুদ্ধে আহ্বান করল। তাকেশি প্রথমে অবাক হয়ে দেখল একজন কৃষ্ণাঙ্গ, লম্বা কৃশ চেহারার লোক হাতে এক শেকল নিয়ে তার সঙ্গে লড়তে এসেছে। সে এমিশিকে হো হো করে হেসে বলল, ‘সামা এমিশি, আপনি এরকম দুর্বল লোককে আমার সঙ্গে লড়তে নিয়ে এসেছেন। তাও আবার শুধু একটা শেকল নিয়ে। এ তো আমার প্রথম কোপেই মরে যাবে। আপনি আর কোনো লোক পেলেন না? নাঃ আমি ভাবছি এমনিই আপনাকে দাঁতটা দিয়ে দেব।’
কান্নান একটাও কথা না বলে শান্ত হয়ে নিজের অবস্থানে দাঁড়িয়ে তাকেশিকে দেখতে দেখতে এক হাতে একটা ডান্ডা ধরে শেকলটাকে দোলাতে লাগল। এমিশি একজন সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর নেতা হয়ে তাকেশির মতন এক ভাড়াটে যোদ্ধার ঔদ্ধত্য দেখে রেগে আগুন হয়ে তাকেশিকে শুধু বলল, ‘তোমার শক্তি আর সাহস থাকে তো বৃথা কথা না বলে লড়ে দেখাও দেখি।’
তাকেশির শক্তি বা সাহস নিয়ে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলে তার মাথা গরম হয়ে যায়। সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘সাম আপনাকে দাঁত আমি আজকে দেবই, তবে ওই বুদ্ধদেবের নয়, আপনার এই ভাড়াটে লোকটির।’
এই বলে এমিশির দিকে তাকিয়েই সজোরে তরোয়াল চালাল কান্নানের গলা লক্ষ্য করে। কান্নান প্রস্তুতই ছিল। চট করে মাথা নীচু করে একটু বসে পড়তে তরোয়াল হাওয়া কেটে শুধু মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। কান্নান আবার শান্তভাবে শেকলটা দুলিয়ে মাথার ডান্ডাটা বৃত্তের মতন ঘোরাতে লাগল। তাকেশি এতটা ভাবেনি। সে এবার পেশাদার তরোয়ালবাজের মতনই তরোয়াল চালাতে শুরু করল। কিন্তু যতবারই সে কান্নানকে আঘাত করে ততবারই কান্নান হয় দ্রুত পাশ কাটিয়ে যায় নয়তো শেকল দুলিয়ে ডান্ডা দিয়ে প্রত্যাঘাত করে। অনেকক্ষণ লড়েও তাকেশি কান্নানের চুলের ডগাও স্পর্শ করতে পারল না। এর আগে তাকেশি যাদের সঙ্গেই লড়েছে তাদের হারাতে সে কখনই বেশি সময় নেয়নি। তাই এবার সে ক্রমে ক্রমে হাঁপিয়ে পড়তে লাগল আর ছন্দও হারাতে শুরু করল।
এবারে সুযোগ বুঝে কান্নান শেকল চালিয়ে ডান্ডা দিয়ে মাঝে মাঝে তাকেশির গায়ে পায়ে আঘাত হানতে লাগল। তাতে তাকেশি ক্ষেপে গিয়ে এলোপাথাড়ি বৃথাই তরোয়াল চালাতে আরম্ভ করল। কান্নান এবার শেকলের ডান্ডা দিয়ে প্রথমে তাকেশির কনুইয়ের হাড়ে আর সঙ্গে সঙ্গে তরোয়াল ধরা মুষ্টিবদ্ধ হাতের আঙুলের গাঁটে সজোরে মারতে তাকেশির মুঠি থেকে তরোয়াল মাটিতে ছিটকে পড়ল। কান্নানও অতি দ্রুত হাত তিনেক লাফিয়ে শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে জোড়া পায়ে তাকেশির বুকে সজোরে আঘাত হানতেই তাকেশি ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে চিত হয়ে পড়ে গেল। কান্নান নিজেও মাটিতে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে তাকেশির তরোয়াল তুলে নিয়ে এক পা তাকেশির বুকে চেপে ধরে তরোয়ালের ডগাটা তাকেশির গলার নলিতে আলতো করে চেপে ধরল। তাকেশি মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে প্রাণভয়ে বিস্ফারিত চোখে কান্নানের দিকে কাতর দৃষ্টিতে চেয়ে হাঁপাতে লাগল।
এমিশি এতক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে কান্নানের লড়াই দেখছিল। এবারে তাকেশিকে বলল, ‘এখন হয় ভগবান বুদ্ধের দাঁত ফেরত দাও নয়তো নিজের প্রাণ দাও।’
তাকেশি দেখল ওই দাঁত নিজের কাছে থাকতেও যদি সে হেরে তাকে প্রাণই দিতে হয় তবে আর ওটা নিজের কাছে রেখে লাভ কি? সে দাঁত ফেরত দিতেই চাইল। এমিশির দেহরক্ষী যারা ছিল তাদের কয়েকজন তাকেশির সঙ্গে গিয়ে ভগবান বুদ্ধের দাঁতসহ সোনার পাত্র নিয়ে এসে এমিশির কাছে দিল। এমিশি আর কান্নান সেই দাঁত নিয়ে আসুকা ডেরায় ফিরে এল।
মোহন্ত শোনিন ভগবান বুদ্ধের দাঁত ফিরে পেয়ে আনন্দে বিহ্বল হয়ে কান্নানকে দু-হাতে ধরে অনেক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, ‘জাপানের সমগ্র বৌদ্ধসমাজ আপনার এই মহৎ কীর্তির জন্য আপনার কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে।’
এরপর এমিশির নির্দেশে ভগবান বুদ্ধের বেদীর অভ্যন্তরে দাঁতসহ সোনার পাত্র প্রোথিত করা হল। মোহন্ত শোনিন এতদিন ইতস্তত করে এবারে বুঝতে পেরেছেন যে অহিংস বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হলেও আত্মরক্ষা করতে পারার কলাকৌশল জানা উচিৎ। তাই এবার তিনি কান্নানকে অনুরোধ করলেন যে মঠের সাধুদের শাওলিন মঠের মতন কুং ফু শেখানোর জন্য। কান্নান মঠের সমর্থ ভিক্ষুদের বেছে নিয়ে কুট্টু ভারিসাইয়ের প্রশিক্ষণ শুরু করল। জাপানি ভাষায় ক্যারাটে কথার মানে খালি হাত। নিরস্ত্র যুদ্ধকলা বলে এখানে কুট্টু ভারিসাইয়ের নতুন নাম হল ক্যারাটে।
এদিকে তাকেশি কান্নানের কাছে হেরে যাওয়ায় ভাড়াটে যোদ্ধা বলে তার আর তার গোষ্ঠীর বাজারদর কমে যায়। একদিন সে এমিশির কাছে এসে ক্ষমা চেয়ে তার আনুগত্য স্বীকার করে নিয়ে তার গোষ্ঠীর দলবল নিয়ে এমিশির সেনাদলে যোগ দেয়। কান্নানের ওই শেকলের অস্ত্র এমিশিকে অবাক করেছিল। সে নিজেও একজন দক্ষ যোদ্ধা। সে কান্নানকে অনুরোধ করল তার দলের কিছু সেনানায়ককে কিছু নতুন অস্ত্রের প্রয়োগ শিখিয়ে দিতে। কান্নান এই শেকলের অস্ত্রের নাম দিয়েছিল কুশারি ফান্ডো অর্থাৎ ওজন বা দণ্ড যুক্ত শেকল। একটা দন্ডের মাথায় ধারাল কাস্তে লাগিয়ে সে আরেকটি অস্ত্র উদ্ভাবন করেছিল যার নাম কুশারি গামা। কান্নান এমিশির অনুরোধ রেখে তার সেনানায়কদের এই শেকলের অস্ত্রের সঙ্গে শিরিকেন আর মাকিবিশির প্রয়োগ শিখিয়ে দিয়েছিল। কান্নান চক্র অস্ত্রের নাম দিয়েছিল শিরিকেন অর্থাৎ হাতে লুকান তরোয়াল।
কান্নান জাপানে দীর্ঘ নয় বছর ক্যারাটের প্রশিক্ষণ দেয়। ক্রমে তা জাপানের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। চিনে বোধিধর্ম তার ধ্যানশেষে বুদ্ধত্ব লাভের পর চিনে বৌদ্ধসমাজের প্রথম পিতৃপুরুষ রূপে স্বীকৃত হন। তার প্রচারিত মতবাদ পরে জাপানে প্রচারিত হয়ে জেন বৌদ্ধধর্ম নামে পরিচিতি লাভ করে।
একদিন কান্নানের কাছে বোধিধর্মের মৃত্যুসংবাদ কানে আসে। সে দ্রুত জাপান ছেড়ে শাওলিনের মঠে ফিরে আসে। সে জানতে পারে বোধিধর্ম তাঁর এক শিষ্যকে উপযুক্ত বিবেচনা করে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। তাতে তাঁর অন্য দু-তিনজন শিষ্য হিংসাবশত বিষপ্রয়োগে তাঁকে হত্যা করে। তাঁর মৃত্যু হলে তাঁকে কবরও দেওয়া হয়। আবার এও শোনা যায় বিষপ্রয়োগ করা হলেও বোধিধর্মের মৃত্যু হয়নি। তাঁকে একজন লাঠি আর একপাটি চটি হাতে গোবি মরুভূমি ছাড়িয়ে হিমালয়ের দিকে যেতে দেখেছে। পরে নাকি বোধিধর্মের কবর খুঁড়ে শুধু একপাটি চটি পাওয়া গিয়েছিল।
কান্নান কোনো কথারই সত্য নিরূপণ করতে পারল না। তাঁর ধারণা হল বোধিধর্ম হিমালয়ের পথে ভারতবর্ষের দিকেই ফিরে গেছেন। কান্নান তাঁর গুরু কান্দানের ইচ্ছে অনুযায়ী বৃহত্তর জগতে তার শেখা যুদ্ধকলার বিদ্যাকে ছড়িয়ে দেবার কাজ ভগবান অঞ্জনায়ারের কৃপায় সে সাধ্যানুযায়ী করেছে। সে বিদেশে থাকার প্রয়োজনীয়তা আর অনুভব করল না। তাই একদিন সে শাওলিন ছেড়ে বোধিধর্মের সন্ধানে ল্যাংজোর পথ ধরে হিমালয়য়ের পানে রওনা হয়ে গেল।
(৩)
কান্নানের কাহিনি এখানেই শেষ। কিন্ত তারপর যে কান্নান কোথায় গেল, বোধিধর্মকে খুঁজে পেল কি না, কোথায় বা সে এই পুথি লিখল আর এই পুথি শেষ পর্যন্ত কীভাবেই বা আসুকা ডেরায় এল তার কোথাও কোনো উল্লেখ পাওয়া গেল না। তবে শেষ পৃষ্ঠায় সে তার নিজের স্বল্প পরিচয় দিয়েছে। তার মাতৃভূমি ছিল বঙ্গদেশ। তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে সে সুমাত্রা দেশের জাহাজে সারেং এর সহকারীরূপে যোগ দেয়। সারেং ও অধিকাংশ নাবিক ছিল দক্ষিণ ভারতের তামিলাকমের অধিবাসি। তার কৃষ্ণন নাম সেই সুমাত্রার জাহাজের সারেং দিয়েছিল। পরে গুরু কান্দান সিলাম্বামের দীক্ষার সময়ে যে কান্নান নাম দিয়েছিলেন সারাজীবন সে সেই নামেই পরিচিত হয়েছে। কিন্তু তার পিতৃদত্ত আসল নাম ছিল ঘনকৃষ্ণদাস।’
আমরা চারজনেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম, “ঘনকৃষ্ণদাস! তার মানে তিনি কি আপনার পূর্বপুরুষ?”
ঘনাদা ঈষৎ হেসে ইতিবাচক মাথা নাড়লেন।
“পঞ্চাশতম নিশ্চয়ই,” গৌর বলে উঠল।
স্মিতহাস্যে ঘনাদা মাথা নেড়ে বললেন, “না, তস্য তস্য। তিনিই প্রকৃতপক্ষে পূর্ব এশিয়ার কুংফু, ক্যারাটে, নিঞ্জুৎসু—এ সব মার্শাল আর্টের আদিগুরু। তিনিই প্রথম এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রচারক। যদিও তা বোধিধর্মের নামে চলে আসছে। আসল ইতিহাস প্রকাশ পেলে এই সব মার্শাল আর্টের ইতিহাস নতুন করে লিখতে হত। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সে পুথি ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ায় তা আর হল না।”
আমরা অবাক হয়ে বললাম, “কেন? কী ভাবে ভস্মীভূত হল? স্যাবোটেজ?”
“না, দুর্ঘটনা,” বলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ঘনাদা শিশিরের দিকে তাকালেন। শিশির তাড়াতাড়ি টিন খুলে ঘনাদাকে সিগারেট দিয়ে ধরিয়ে দিল। সত্যিই তো এতক্ষণ ঘনাদা একটাও সিগারেট খাননি। সম্ভবত তাঁর পূর্ব পুরুষের প্রতি শ্রদ্ধায়।
সিগারেটে পর পর কয়েকটা টান দিয়ে ঘর ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার করে আরম্ভ করলেন, “কাহিনি শেষ করে আমি পুথি মহন্ত দাইসিনের হাতে তুলে দিয়ে বললাম, ‘সবচেয়ে দুঃখের কথা তখনকার ভারতবর্ষে কোনো বৌদ্ধ আচার্য বা জ্ঞানী, পন্ডিত সন্ন্যাসীগণ ধর্মসাধনার সঙ্গে সঙ্গে কুট্টু ভারিসাইয়ের মতন শরীরচর্চ্চা, মনঃসংযোগ ও আত্মরক্ষার কলাকৌশলগুলো অহিংসার দোহাই দিয়ে শেখার কোনো গুরুত্ব উপলব্ধি করলেন না। কিন্তু চিন, জাপান, কোরিয়া তা সাদরে গ্রহণ করেছিল। সেদিন ভারতীয় বৌদ্ধসাধুরা যদি এর গুরুত্ব দিয়ে এই কলা চর্চ্চা জারি রাখতেন তাহলে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মাত্র আঠারোজন অশ্বারোহী নিয়ে ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজী নালন্দার লক্ষ পুস্তকের ওই মহামূল্যবান গ্রন্থাগার কখনই পুড়িয়ে দিতে সাহস পেত না। শত শত লড়াকু সন্ন্যাসীর সামনে খড়কুটোর মতন উড়ে যেত। যা হোক এই পুথির ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। এটা সাবধানে রাখবেন।’
দাইসিন উঠে দাঁড়ালেন। আমরাও সবাই উঠে দাঁড়ালাম। দাইসিন প্রথমে আমাকে হাতজোড় করে নমস্কার জানালেন ও আমার হাতদুটো দু-হাতে ধরে বললেন, ‘পূর্ব এশিয়ার সমগ্র বৌদ্ধসমাজ আপনার মহান পূর্বপুরুষের আর আপনার ঋণ কোনোদিনই শোধ করতে পারবে না। আমি এখনই এটি যথাস্থানে রেখে দিচ্ছি।’
প্রফেসর কাওয়াবাতা আমার দু-কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আপনার পূর্বপুরুষের কীর্তি তো মহান বটেই, আপনিও তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদা রেখেছেন। আপনারও কোনো তুলনা নেই।’
সন্ধে হয়ে গেছে। সকল সন্ন্যাসী মন্দিরে চলে গেল ধ্যান করবে বলে। আমরাও মন্দিরে এলাম। দাইসিন এবার পুথিটা নিয়ে মন্দিরের দেওয়ালের ভেতরে ঢোকান একটা ছোটো স্টিলের সিন্দুকের ভেতর রেখে চাবি দিয়ে, চাবি নিজের কাছে রেখে দিলেন। আমরা ভগবান তথাগতকে প্রণাম করে নিজেদের ঘরের দিকে চললাম। মন্দির থেকে বেরোনোর আগে দেখি তান লুয়ান এক কোনে বসে গভীর ধ্যানে মগ্ন। সে রাতে দাইসিন আমাদের ছাড়লেন না। ডিনারের পর আমি আর প্রফেসর কাওয়াবাতা একটু গল্পগুজব করে যে যার ঘরে চলে এলাম।
পরদিন খুব ভোরে আমার দরজায় টোকার শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখি মোহন্ত দাইসিন। কী রকম উদ্ভ্রান্তের মতন চেহারা, মুখে চোখে উদবেগের স্পষ্ট চিহ্ন। আমি ওঁকে কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করতে, তিনি বিহ্বল হয়ে কোনোমতে আমাকে বললেন, ‘খুব সকালে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনজন সন্ন্যাসী কর্মী ভগবান তথাগতের মন্দির খুলে পরিষ্কার করছিল। মন্দির খোলাই থাকে। আমি খানিক বাদেই মন্দিরে ভগবান তথাগতকে প্রণাম করতে আসি। কাল অনেকক্ষণ পুথির কথা চিন্তা করছিলাম বলেই হয়তো অজান্তেই দেয়াল সিন্দুকের দিকে চোখ গেল। মনে হল সিন্দুকের পাল্লাটা যেন আলগা। তাড়াতাড়ি এসে হাত দিতেই দেখি পাল্লা খোলা। বুকটা ধক করে উঠল। খুলে দেখি পুথিটা নেই। কেউ কৌশলে তালা খুলে চুরি করে নিয়েছে। এখন কী হবে?’
ইতিমধ্যে প্রফেসর কাওয়াবাতাও এসে গেছেন। তিনি শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। আমি দাইসিনকে বললাম, ‘কে নিতে পারে। আপনার কাউকে সন্দেহ হচ্ছে কি?’
‘ঠিক বুঝতে পারছি না। রাত্রে মন্দির বন্ধ থাকে। ভোরবেলায় স্বেচ্ছাসেবক সন্ন্যাসীরা রোজ মন্দির পরিষ্কার করে। তারপর থেকে মন্দির খোলা থাকে। আমি চলে আসি, অন্যান্য সন্ন্যাসীরাও চলে আসে মন্দিরে ধ্যান করার জন্য। হয়তো দু-পাঁচ মিনিট একদম ফাঁকা থাকতে পারে। ওইটুকু সময়ের নিতে পারা কি সম্ভব?’
আমি চুপ করে চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম। বললাম, ‘এ কোনো সাধারণ চোরের কাজ নয়। রীতিমত পেশাদারি কাজ। নিঞ্জাদের মতন নিঃশব্দে কাজ হাসিল করায় দক্ষ। এমন কেউ আপনাদের মধ্যে আছে বলে তো মনে হয় না। আমার মনে হয় পুথি এখনও মঠেই আছে। ভালো করে সবার ঘর তল্লাসি করলে হয়তো পাওয়া যেতে পারে।
শুনে দাইসিন মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘আমার এখানে সব সন্ন্যাসীরা কম করে সাত-আট বছরের বেশি সময় ধরে আছে, এদের অধিকাংশই বলতে গেলে আমার হাতেই তৈরি। আমি কী ভাবে এদের বলব আর কী ভাবেই বা এদের সবার ঘরে তল্লাসী করব? ভগবান তথাগত আমাকে এ কী ফ্যাসাদে ফেললেন! এই অপ্রিয় কাজ আমি করবই বা কী ভাবে?’
আমিও অবশ্য সে কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ আমার একজনের কথা মনে হল। আরে ওই তো একমাত্র বহিরাগত। আর সঙ্গে সঙ্গে ওর আসল রূপ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি বলে উঠলাম, ‘তান লুয়ান’। বলেই আমি ঘরের সামনের বারান্দায় বেরিয়ে দেখি তান লুয়ান নীচে রাখা ওর জিপে বসে কাপরে জড়ানো একটা বড়ো বাক্সের মতন জিপের গ্লোভ কম্পার্টমেন্টে রাখল। আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘তান লুয়ান’। লুয়ানের হাত তখন স্টিয়ারিঙে। আমার ডাক শুনে একবার পেছন ফিরে আমাকে দেখে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফুলস্পিডে মেইন গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি গাড়ির পেছনে দৌড়ে এসে গেটের বাইরে দেখলাম জিপটা বেঁকে বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে চলে গেল। বুঝে গেলাম ও ওসাকা যাবে।
আমি ঘরে ফিরে এলাম। আসার পথে চত্বরে একটা কাওয়াসাকি টি ৫০০ মোটোর বাইক দেখলাম। বারান্দায় দাইসিন আর কাওয়াবাতা বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে। আমি শুধু বললাম, ‘নীচে ওই মোটোর বাইকটা কার?’
দাইসিন বললেন, ‘আমাদের মঠেরই। কাওয়াসাকি কোম্পানির চেয়ারম্যান এটি আমাদের দান করেছিলেন, মঠের কাজের জন্যই।’
বাইকের চাবিটা দিন, তেল পুরো ভরা আছে তো? তান লুয়ান কাশিহারার পথে ওসাকার দিকে গেছে। ওদিকের রাস্তা ভালো না। একে রাস্তা সরু, তাতে অনেক বাঁক আছে ইউ-টার্নও আছে। ঘণ্টা তিনেকের আগে ওসাকা পৌঁছতে পারবে না। তার আগেই আমি ওকে ধরে ফেলব। আমি ওর জিপে সেদিন একটা দোকানের প্যাকেট দেখেছি তা টেম্পোজান হোয়ার্ফ লেখাটা চোখে পড়েছিল। আমার ধারণা তান লুয়ান ওসাকা থেকে জাহাজে হংকং পালাবে। তা ছাড়া ও পৃথিবীর যেখানেই থাকুক না কেন, আমি ওকে ঘাড় ধরে ঠিক নিয়ে আসব।’
এই বলে আমি ঘরে গিয়ে রাতের পোশাক ছেড়ে জিন্সের প্যান্ট-শার্ট আর আমার হাইকিং বুটটা পড়ে নিলাম। মাথায় বিনিস ক্যাপটা কান পর্যন্ত ঢেকে নিলাম। চোখে আমার সানগ্লাস। এদিক ওদিক দেখে আর কিছু না পেয়ে টেবিলের ওপর থেকে গতকাল কাওয়াবাতা যে প্রত্নবস্তুটা দাইসিনকে উপহার দেবে বলে নিয়ে এসেছেন সেটা পকেটে নিয়ে নিলাম।
ইতিমধ্যে জনৈক সন্ন্যাসী বাইকের চাবি নিয়ে এসেছে। আমি চাবি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে এলাম। আমার সঙ্গে দাইসিন কাওয়াবাতাও নেমে এলেন। নীচে এসে দেখি একজন সন্ন্যাসী একটা জ্যারিকেন থেকে বাইকে তেল ভরা শেষ করে ক্যাপ লাগাচ্ছে। আমি বাইকে উঠতে উঠতে বললাম, ‘এখন সময় নেই, মিনিট পনেরো দেরি হয়ে গেছে। পরে সব বলব। প্রফেসর কাওয়বাতা আপনি ওশোকে আর দু-তিনজন সন্ন্যাসীকে নিয়ে আপনার গাড়িতে চলে আসুন। আপনি কাশিহারা কাটসুরাগির রাস্তাটা ধরবেন। আর ওশো আপনি থানায় খবর দিয়ে দিন যদি পুলিশ এ পথে আসতে পারে।’
কাওয়াবাতা বললেন, ‘ও যদি নারা হয়ে ওসাকা যায়?’
‘মনে হয় না। ওকে তা হলে ইয়ামাতো তাকাদা হয়ে পাহাড়ি পথে যেতে হবে। সময় লাগবে অনেক বেশি। ও ভালো গাড়ি চালাতে পারে না তা আমি জানি। ইতিমধ্যে পুলিশে ওর জিপের নম্বর দিয়ে ডায়েরি করলে পুলিশ ওকে নারাতেই ধরে ফেলবে। ও মহা ধুরন্ধর।’
এই বলে আমি বাইকে স্টার্ট দিয়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে কাশিহারার রাস্তা ধরলাম। রাস্তা বেশ সরু। মুখোমুখি গাড়ি এলে প্রায় গা ঘেঁষে যেতে হয়। আনাড়ি ড্রাইভার হলে গায়ে গায়ে ঘষটে যাওয়া অবধারিত। দুর্ঘটনা আকছাড় ঘটে। ফলে সময় লেগে যায় প্রচুর। খুব সকালবেলা বলে রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা। কিনোমোতোচোর কাছে বাঁ দিকে ঘুরতে হল। বলতে গেলে আস্তেই চালাতে হচ্ছে। রাস্তা এত এবড়োখেবড়ো যে স্পিড বাড়ালে উলটে পড়ার সম্ভাবনা। আমার ইচ্ছে ওকে কাটসুরাগিতে ধরা। ও জায়গার রাস্তা খুব খারাপ। তায় আবার পাহাড়ি পথ। বেশ খানিকটা পথ এসে রাস্তার ধারে মাটিতে উইলিস জিপের চাকার দাগ দেখে নিশ্চিন্ত হলাম যে সে এ পথেই গেছে। উইলিস জিপ তখন জাপানে প্রায় নেই বললেই চলে। সুতরাং এটা যে তান লুয়ানের জিপের চাকার দাগ সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
আসুকা ডেরা ছেড়ে মিনিট কুড়ির মাথায় চোখে পড়ল তান লুয়ানের জিপ। হুড খোলা জিপ—মুন্ডিত মাথাটা দেখা যাচ্ছে। জিপের সঙ্গে আমার ব্যাবধান ক্রমশ কমে আসছে। প্রথমটা ও বুঝতে পারেনি। ও আমাকে অনেক কাছে এসে গেছি দেখে জিপের গতি বাড়াতে গেল। কিন্তু একে সরু, তার ওপর পাহাড়ি রাস্তা, একপাশে খাদ—কত আর বাড়াবে। সেদিক থেকে আমার মোটর বাইক সুবিধে জনক পরিস্থিতিতে। এবারে যা চেয়েছিলাম সেই সুযোগ এসে গেল। কাটসুরাগি শহরের কাছে রাস্তাটা ডানদিকে বাঁক নিয়েছে। তান লুয়ান যেই মোড়টা ঘুরেছে আমি তখন তার পেছনে সমকোনে আছি। তার মাথাটা আমার থেকে হাত দশেক দূরে।
আমিও তৈরি ছিলাম। পকেট থেকে পাথরের চাকতিটা যে প্রত্নবস্তু আমরা হ্যাচিওজির দুর্গে পেয়েছি, যাকে আমার মনে হয়েছে শিরিকেনের আদি রূপ—সেটা ফ্রিসবির মতন সজোরে ওর মুখ লক্ষ্য করে জিপের গতি বুঝে ছুড়ে দিলাম। আর সেটা উড়ন্ত চাকির মতন গিয়ে লাগল গিয়ে ঠিক ওর চোখের নীচে। ও চিৎকার করে হাত দিয়ে চোখ ঢাকল। স্টিয়ারিং এক হাতে ধরে সামলাতে পারল না। কেন জানি না জিপের গতি হঠাৎ বেড়ে গিয়ে খানিক বেঁকে রাস্তার ধারে মাটিতে গেড়ে বসা একটা বড়ো পাথরে ধাক্কা লেগে পুরো কাত হতে আরম্ভ করল। তান লুয়ান কীরকম প্রাণভয়ে লাফ দিল রাস্তায় কিন্তু সেখানে খাদের শুরু। কপালগুণে ও একটা পাথরে ধাক্কা খেয়ে আটকে গেল সামনে একটা গাছ আঁকড়ে ধরে। কিন্তু জিপটা কাত হয়ে উলটে গিয়ে কেমন ডিগবাজি খেয়ে নীচে প্রায় বিশ ফুট আছড়ে পড়ল আর জিপটাতে হঠাৎ দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বাইক রাস্তার একপাশে থামিয়ে নেমে ছুটে এলাম। জিপ পড়তে দেখে ভাবলাম খাদে সোজা নেমে গিয়ে জিপের থেকে পুথিটা উদ্ধার করে নিয়ে আসব। আসলে আমি ভেবেছিলাম আঘাত খেয়ে ও হয়তো জিপ থামাবে আর আমি সেই সুযোগে ওকে দু-চার ঘা দিয়ে পুথিটা নিয়ে নেব। কিন্তু যা ঘটে গেল, সেটা কল্পনাতেও ভাবিনি। রাস্তার ধারে এসে নীচে তাকিয়ে জিপটা জ্বলতে দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গেল। তান লুয়ানকে তো লাফিয়ে পড়তে দেখেছি। তা ও গেল কোথায়? এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি। ফুট চারেক নীচে পাথরে খাঁজে আটকে কাতরাচ্ছে।
আমার সব রাগ গিয়ে পড়ল তান লুয়ানের ওপরে। ওরই লোভ আর দুষ্কার্যের জন্য জগতের ইতিহাসের এত বড়ো অমূল্য সম্পদ চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল। আমি খাদে নেমে ওর হাত ধরে টেনে ওপরে এনে রাস্তার ধারে ফেললাম। ওর পায়ের হাড়ে বোধ হয় চিড় ধরেছে। তার ওপর ডান চোখ চোয়াল টেনিস বলের মতন ফুলে উঠেছে। ব্যথায় বাবারে মারে করছে। তারই মধ্যে একহাত দেখি কিমোনোর মধ্যে ঢোকাতে যাচ্ছে। আমি তৎক্ষণাৎ ওর মাথায় দুটো ভালোমত তুড়ুম ঠুকতেই ষাঁড়ের মতন চ্যাঁচাতে লাগল। আমি চট করে ওর কিমোনোর ভেতর থেকে পিস্তলটা বার করে নিলাম। ট্রিগারে আঙুল দিয়ে ওর মাথায় ধরতেই একেবারে মাটিতে শুয়ে পড়ল। আর কথা বলতে পারছে না। হাত দুটো জোড় করে যা বলার চেষ্টা করছে তা ওর কান্নাতেই চাপা পড়ে যাচ্ছে।
আমি বললাম, ‘তুই কী ভেবেছিস? মাথা কামিয়ে সন্ন্যাসী সেজেছিস বলে আমি তোকে চিনতে পারিনি? চেন ওয়াং নাম নিয়ে তুই খারা-খোটোতে আর্কেওলজিস্ট পরিচয় নিয়ে আসিসনি? আর ওখান থেকে প্রত্নবস্তুগুলো চুরি করে নিয়ে পালাসনি? সত্যি বল’।
তান লুয়ান ওরফে চেন ওয়াং আকাশ থেকে পড়ে আমতা আমতা করে বলল, ‘আ… আমি না তো।’
পিস্তলের সেফটি ক্যাচ সরাতেই, হাউ মাউ করে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে।’ এবারে খারা-খোটোতে মূর্তি চুরি, মিউসিয়ামের কর্মীদের যোগসাজসে প্রত্নবস্তু সব চুরি করে অ্যামেরিকার ধনী সংগ্রাহকদের কাছে বিক্রী করা সবই স্বীকার করল।
আমি পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় মিনিট পনেরো পরে দেখি প্রফেসর কাওয়াবাতার গাড়ি আসছে। আমাকে দেখে কাওয়াবাতা একটু এগিয়ে রাস্তার ধারে গাড়িটা রেখে দাইসিনকে নিয়ে এগিয়ে এলেন। সঙ্গে আরও দুজন সন্ন্যাসী।
দাইসিন প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পুথিটা পেয়েছেন তো?’
আমি ওঁদের খাদের ধারে নিয়ে এসে নীচে হাত দিয়ে দেখালাম। তখনও জিপটা জ্বলছে আর কালো ধোঁয়া ওপরে উঠে ছড়িয়ে পড়ছে। সে দৃশ্য দেখে দুজনেই হতভম্ব। দাইসিন মাথায় হাত দিয়ে মাথা নাড়ছেন। প্রফেসর নিশ্চল হয়ে জিপের দিকে তাকিয়ে আছেন মুখে চোখে দুঃখ আর হতাশা ফুটে উঠেছে। দাইসিন তান লুয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হয়ে কী করে এরকম গর্হিত কাজ করলে?’
‘ও আদৌ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী নয়’, আমি বললাম, ‘সন্ন্যাসীর ভেক ধরে এখানে নাম ভাঁড়িয়ে মিথ্যে পরিচয়ে ঢুকেছিল। ওর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সুযোগ বুঝে পুথিটা চুরি করা। ওর নাম তান লুয়ান নয়। আসল নাম চেন ওয়াং। তবে সেটাও ছদ্মনাম কি না কে জানে। ও আসলে একজন প্রত্নবস্তুর আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি। হংকং হল ওর ঘাঁটি। প্রফেসর আপনি নিশ্চয়ই এখন ওকে চিনতে পেরেছেন।
‘আমাদের মঙ্গোলিয়ার গোবি মরুভূমিতে সেই ভৌতিক শহর খারা-খোটো বা ব্ল্যাক সিটিতে পুরাতাত্ত্বিক অভিযানের সময় চিনের চ্যাংচুনের জিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ আর্কেওলজির ডক্টর চেন ওয়াং নামে একজন গবেষক অধ্যাপক আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। ওঁর পুরাতত্ত্ব সম্বন্ধিও কথাবার্তা শুনে ওকে সন্দেহ হয়নি। ছয়-সাত দিন আমাদের সঙ্গে কাজ করল, ক্যাটালগিংএ সাহায্য করল। তার পর হঠাৎ না বলে কোথায় উধাও হয়ে গেল। ও চলে যাবার দু-দিন পর আমরা আবিষ্কার করলাম বেশ কয়েকটা প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি ও আরও গোটা তিন চারেক ফিগারিন খুঁজে পাওয়া গেল না। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সন্দেহ চেন ওয়াংএর ওপর পড়ল। পড়ে আমরা জিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম ওই নামে কোনো গবেষক বা অধ্যাপক এমন কি ছাত্রও নেই। পরেও জাপানের কিছু মিউজিয়াম থেকেও প্রত্নবস্তু চুরি হয়েছিল। একবার একজন কর্মী ধরা পড়ে হংকংএর এক ব্যবসায়ীর কথা বলেছিল। আমার ধারণা ইনিই সেই মহাপুরুষ ছিলেন।’
প্রফেসর কাওয়াবাতা বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে আছে। আরে সে জন্যই চেনা চেনা লাগলেও আমি ঠিক ধরতে পারছিলাম না। আরও মুন্ডিত মাথা, সন্ন্যাসীর বেশ বুঝতে পারিনি। তখন মাথায় কালো চুল। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। এতটা তলিয়ে ভাবিওনি।’
হঠাৎ আমার চোখে খাদের সামনের ঢালু জায়গায় সেই পাথরের চাকতিটা পড়ে আছে দেখতে পেলাম। আমি নেমে সেটা তুলে নিয়ে এসে কাওয়াবাতার হাতে দিয়ে হেসে বললাম, ‘শিরিকেনের কার্যকারিতার ফল দেখলেন।’
কাওয়াবাতা হো হো করে হেসে উঠলেন। দাইসিন ঠিক ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে আমাদের মুখের দিকে জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকালেন। তখন কাওয়াবাতা পাথরের চাকতির ইতিহাস দাইসিনকে বলে সেটা তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা আমাদের তরফ থেকে আপনাকে উপহার দেব বলে এনেছিলাম আর সেটাই এই আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিকে ধরতে সাহায্য করল। এটা আপনি গ্রহণ করুন। আপনার প্রত্নবস্তু সংগ্রহশালায় রাখতে পারবেন।’
দাইসিন চাকতিটা নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে আমাকে বললেন, ‘ভগবান তথাগতের আশীর্বাদ আপনাকে চিরকাল রক্ষা করবেন। আমার একান্ত বাসনা এই প্রত্নবস্তুটি আপনি আমাদের তরফ থেকে গ্রহণ করুন।’
প্রফেসর কাওয়াবাতা সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন করলেন। আমি তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে চাকতিটা পকেটে রেখে দিলাম।
ইতিমধ্যে পুলিশের গাড়িও এসে গেল। দুজন সন্ন্যাসী আর কাশিহারা কোবান বা পুলিশ বক্স থেকে একজন সার্জেন্ট আর দুজন জুনিয়ার পুলিশ অফিসার চলে এলেন। পুলিশ বক্সের অফিসাররা সবাই দাইসিনকে খুবই শ্রদ্ধা করে। তাই সার্জেন্ট নিজেই চলে এসেছেন। আমার কাছে আর দাইসিনের কাছে সমস্তই শুনলেন।
জেরায় চেন ওয়াং সবই স্বীকার করল। জনৈক অ্যামেরিকান ধনকুবের ওকে এই পুথির জন্য এক লক্ষ ডলার দেবে বলেছে। সে কারণেই চাইনিস বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে ও আসুকা ডেরায় ঢুকেছিল। ওকে প্রথম পুলিশ প্রহরায় হাসপাতালে নিয়ে যাবে তারপর পুলিশ ওকে নিজেদের হেপাজতে নিয়ে নেবে। পুলিশকে ওর পিস্তলটা দিয়ে দিলাম। পুলিশ অফিসার দুজন চেনকে তুলে গাড়ির ভেতর নিয়ে গেল। সার্জেন্ট আমাদের সঙ্গে করমর্দন করে গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। দুজন সন্ন্যাসী মোটোর বাইকে রওনা হয়ে গেল। আমরাও বাকিরা প্রফেসরের গাড়িতে করে আসুকা ডেরা ফিরে এলাম। দাইসিন পুথিটার জন্য খুব আফশোশ করতে লাগলেন।
আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘আপনি আর কেন দুঃখ করছেন? হয় তো ভগবান তথাগতের এরকম ইচ্ছেই ছিল। পরাক্রান্ত হর্ষবর্ধনকে পরাজিত করার জন্য সম্রাট দ্বিতীয় পুলোকেশীন যেমন ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে রইলেন তেমনি মহাত্মা বোধিধর্মই ইতিহাসে কুং ফুর স্রষ্টারূপে থেকে যাবেন। আমার তো ধারণা কান্নান নিজেও তাঁর গুরুকে সে মর্যাদা দিতে চাইতেন।’
মোহন্ত দাইসিন আমার কথা শুনে হাসলেন বটে তবে সে হাসিটা বড়োই ম্লান।
আমরা আশুকা ডেরায় সেদিন লাঞ্চ করে নাগোয়া ফিরে এলাম। আরও দিন দু-তিনেক নাগোয়ায় থেকে আমি দেশে ফিরে এলাম। এই পাথরের চাকতিটা আমার তোরঙ্গেই এতকাল ছিল। দিন তিনেক আগে প্রফেসর কাওয়াবাতার চিঠি পেলাম। তিনি জানিয়েছেন যে আর্কেওলজির এক তরুন গবেষক প্রফেসর আকিরা তানাকা সাইতামার ইয়াতসুকির দুর্গের ধ্বংসাবশেষ থেকে হ্যাচিওজির ধরনের অনেক পাথরের চাকতির মতন পেয়েছেন, যেগুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে হাতে কেটে বানানো। আর চিনেমাটির কাঁটা দেওয়া মার্বেলও প্রচুর পেয়েছেন। এগুলো যে শিরিকেন আর মাকিবিশির আদিরূপ সে বিষয়ে তার আর কোনো সন্দেহ নেই। জাপান আর্কেওলজিক্যাল সোসাইটি আমার মতকেই স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই আবার দেখার জন্য দু-দিন আগে তোরঙ্গ থেকে বের করে ওই পাথরটা, তোমাদের ভাষায় ওই ঢেলাটা, টেবিলের ওপর রেখেছিলাম। আজ বনোয়ারী ওই ঐতিহাসিক ঢেলাটা দিয়েই মশারির হুক ঠুকতে গিয়ে ওটা ভেঙে ফেলেছে। ওর কী আর কোনো ঐতিহাসিক মূল্য রইল? ওটা বরং বনোয়ারীকে ফেলে দিতেই বলো।”
শেষ কথাটা ঘনাদা বেশ দুঃখের স্বরে বললেন মনে হল।
গৌর প্রশ্ন করল, “কেন ঘনাদা? সামান্য একটু ভেঙেছে বলে ওর ঐতিহাসিক মূল্য থাকবে না কেন?”
ঘনাদা তাঁর আরামকেদারা ছেড়ে উঠতে উঠতে রাগত স্বরে বললেন, “কি করে থাকবে? ভাঙা প্রত্নবস্তুর কোনো ঐতিহাসিক মূল্য থাকে?”
গৌর সঙ্গে সঙ্গে বলল “সে কী ঘনাদা, কুষাণ সম্রাট কনিষ্কর মূর্তি তো মাথা ছাড়াই পাওয়া গেছে, তা বলে কি তার কোনো ঐতিহাসিক মূল্য নেই? তা হলে মিউজিয়ামে অত যত্ন করে রেখেছে কেন? মিউসিয়ামে তো কত গাদা গাদা সব নাকভাঙা, হাতভাঙা, ঠ্যাংভাঙা মূর্তি দেখি। আমার তো মনে হয় এরকম মূল্যবান প্রত্নবস্তু ফেলে না দিয়ে বরং ঘনাদার নাম দিয়ে কলকাতা জাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়া উচিৎ। ওরা তো লুফে নেবে।”
ঘনাদা গৌরের দিকে ভস্ম করে দেবার মতন চেয়ে রাগে কী করবেন বুঝতে না পেরে টেবিলের ওপর থেকে শিশিরের নতুন সিগেরেটের টিনটা তুলে নিয়ে তাঁর বিদ্যাসাগরী চটি ফটফট করতে করতে সিঁড়ি কাঁপিয়ে তিনতলায় তাঁর টং এর ঘরে চলে গেলেন।
আবার বুঝি ফিরে এল ঠান্ডা লড়াইয়ের দিন। কতদিন চলবে কে জানে!
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী
যথার্থ ঘনাদা-শৈলীতে সত্যিই জব্বর এক ‘ঢেলা’ ছুঁড়েছেন পাঠকদের উদ্দে্শ্যে লেখক সনৎ কুমার ব্যানার্জ্জী তার লেখা এই উপন্যাসের (গল্প বা গুল !!) মাধ্যমে ৷
মার্শাল আর্ট বা লড়াইয়ের কলাকৌশল, বিশেষ করে ভারত থেকে উদ্ভূত হয়ে চীন কোরিয়া ঘুরে জাপানে তাদের প্রচলনের ইতিহাস এই সব দেশে কিভাবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারের সাথে সম্পর্কিত হলো অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথে তা বিবৃত করা হয়েছে ৷ কাহিনীর অনুষঙ্গ হিসেবে প্রাচীন লিপি পাঠোদ্ধার বা প্যালিওগ্রাফি, মধ্য যুগের ভারতবর্ষ ও চীন কোরিয়া, জাপানের শাসন ব্যবস্থার বিস্তারিত বর্ণনাও উপস্থিত আকর্ষণীয়ভাবে ৷ রোমাঞ্চকর ঘাত প্রতিঘাতের বিবরণে রহস্যময়তার এমনই বুনোট – একবার পড়া শুরু করে আর থামতে পারিনি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ৷
মূল বিষয়বস্তুর একটু আভাসই উল্লেখ করলাম এখানে ৷ আরও বেশি জানালে ‘ঘনাদীয়’ কাহিনী পড়ার মজাই নষ্ট হয়ে যাবে ৷