অন্তিম কোড
লেখক: সন্দীপ চৌধুরী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
জলখাবার খেয়ে প্রফেসার বিনোদ দেশাই ঘড়ির দিকে তাকালেন। প্রায় সময় হয়ে এসেছে। চোখ বন্ধ করে সোফায় বসে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন তিনি। অনুভব করলেন ওঁর হৃদয়ের গতি সাধারণের চেয়ে একটু বেশি হলেও মোটামুটি নিয়ন্ত্রনের মধ্যে। নিজের নিশ্বাস প্রশ্বাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করে পালসের গতি ধীরে ধীরে নাবিয়ে আনলেন মি. দেশাই। প্রায় পঁচাশি! এর চেয়ে কমানো সম্ভব নয় এই পরিস্থিতিতে। বাইরে একটা গাড়ি থামার শব্দ শোনা গেল। তারপর গেট বন্ধ হওয়ার শব্দ। কংক্রিটের রাস্তার ওপর পায়ের শব্দ। একজন মানুষের পায়ের শব্দ।
টুং টাং! টুং টাং! কলিং বেল বেজে উঠল।
বেল বাজার অপেক্ষাতেই ছিলেন তবুও সামান্য চমকে উঠলেন প্রফেসর দেশাই। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। হৃৎপিণ্ডের গতি সামান্য বেড়েছে।
দরজা খুলে আগন্তুককে বাড়ির ভেতরে আহবান জানালেন প্রফেসর দেশাই। লম্বা, দোহারা চেহারার এক যুবক ভেতরে ঢুকে এল। হাতে একটা আইডেন্টিটি কার্ড। নেহাত নিয়ম রক্ষার খাতিরে কার্ডটি পরীক্ষা করলেন প্রফেসর। ঠিক আছে।
‘স্যার, আপনাকে আজকে সন্ধের ফ্লাইটে… ’
‘ক’টায় বেরোতে হবে?’
‘সাড়ে চারটে।’
বেরনোর সময় পাঁচিলের ওপর বসে থাকা শেলিকে দেখতে পেলেন বিনোদ দেশাই। এই দুই বছরে বেড়ালটির সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। দুজনের মধ্যে কয়েক মুহূর্তের জন্যে দৃষ্টি বিনিময় হল। আর কি শেলির সঙ্গে তার দেখা হবে? শেলি চোখ নামিয়ে নিল। তারপর অন্যদিকে চেয়ে রইল। যেন ওও আর মায়া বাড়াতে রাজি নয়।
বাগানের গাছের কাঠবেড়ালি আর পাখিগুলোর সঙ্গেও কি আর দেখা হবে? চোখ তুলে একবার গাছগুলির দিকে তাকিয়ে নিশ্বাস ছেড়ে ঘুরে দাঁড়ালেন প্রফেসার দেশাই। তারও আর মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই। নিজের কর্তব্য করে যেতে হবে। এমনিতেই বা আর কতদিন বাঁচতেন? এক না একদিন তো সবকিছু ছেড়ে যেতেই হবে সবাইকে।
সঙ্গের ছেলেটির নাম মাইকেল। ছেলেটা কম কথা বলে তবে এমনিতে বেশ নম্র এবং ভদ্র। মোটের ওপর মাইকেলকে পছন্দই হয়েছে বিনোদের।
জেনেভায় যখন ফ্লাইট ল্যান্ড করল তখন সেখানে প্রায় ভোর হব হব। একদিক দিয়ে ভালোই, ঘণ্টাদুয়েকের বিশ্রাম অন্তত পাওয়া যাবে প্রসিডিউর শুরু হওয়ার আগে।
‘এটা কোন লেভেলের এনকোয়ারি মাইকেল? অবশ্য যদি বলতে আপত্তি না থাকে।’
একটু চিন্তা করে মাইকেল উত্তর দিল, ‘লেভেল ফাইভ, স্যার!’
এটাই আশা করেছিলেন। এর ওপরেরটা পলিটিক্যাল বা মিলিটারি ক্রিমিন্যালদের জন্যে সংরক্ষিত। কিন্তু এই লেভেলেও কমিটিতে খুব উঁচু পর্যায়ের রাজনেতা বা অফিসিয়ালদের থাকার কথা। কে কে থাকতে পারে?
কথাটা চিন্তা করতেই বেশ কয়েকটা পরিচিত মুখ ভেসে উঠল চোখের সামনে। এদের প্রায় সবার সঙ্গেই বেশ ভালো সম্পর্ক বিনোদের। কিন্তু তিনি এটাও জানেন এই এনকোয়ারিতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক কোনো কাজে আসবে না।
সাড়ে দশটার সময় ওঁকে ট্রাইল্যান্ড নামের বিল্ডিঙে পৌঁছতে হবে। ফ্লাইটে ঘুমোতে পারেন না বলে রাত্রে ঘুম প্রায় হয়নি, এখনও হাতে যা সময় আছে তার মধ্যেও যে হবে তার সম্ভাবনা কম। আজ রাত্রেও কি ঘুমোবার সুযোগ তিনি পাবেন? কথাটা মাথায় আসতেই হাসি পেয়ে গেল বিনোদ দেশাইয়ের। এই পথে এগোনোর সময় থেকেই তো তিনি পরিণতি জানতেন। সেই পরিণতি যখন দোরগোড়ায়, তখন তিনি ঘুমোবার চিন্তা করছেন?
কিন্তু এতে আশ্চর্য হওয়ারই বা কী আছে? মানুষের মস্তিষ্ক আর স্নায়ু খুব বিপদের মধ্যেও একটা ব্যালেন্সে পৌঁছে যেতে বেশি সময় নেয় না। প্রাথমিক ধাক্কা কেটে যাওয়ার পর সে আবার জীবনের স্বাভাবিক, দৈনন্দিন চিন্তাভাবনাগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। খাবার, ঘুম, নিরাপত্তা—এই মূল প্রয়োজনগুলির ব্যাপারে কোনোরকম আপোষ পছন্দ করে না মানুষের মন বা মস্তিষ্ক।
দশটা পাঁচে রেস্ট হাউজ থেকে বেরোলেন প্রফেসর দেশাই। এবার সঙ্গে একজন রাশিয়ান, তার প্রথম নাম পাভলভ। নামের শেষের অংশটা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি। আরেকবার জিজ্ঞেস করে বোঝার চেষ্টাও করেননি। শুনলেও মনে থাকবে না। মনে রাখার প্রয়োজনও নেই। কয়েক মিনিটের তো সম্পর্ক।
গাড়ি করে যাওয়ার পথে রাস্তার দৃশ্য দু-চোখ ভরে গ্রহণ করার চেষ্টা করলেন প্রফেসর। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া পথচারীদের খুঁটিয়ে লক্ষ করলেন। ছোটো-বড়ো বাড়িগুলোর রং, জানালার ফ্রেম, পর্দার কাপড়, বাগানের ফুল—কত কিছু দেখার ছিল এই পৃথিবীতে। আরও কত কাজ করার ছিল। কত পরিচিত মানুষ রয়ে গেল পেছনে। তার মধ্যে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে ভেসে এল ওঁর বাগানের মালি আর বাড়িতে রান্না করা দিদির মুখ। এদের সবার সঙ্গে আরও একবার দেখা হলে বড়ো ভালো হত।
তারপরই বিপরীতধর্মী চিন্তায় মাথা নাড়লেন বিনোদ দেশাই। দেখা হলে কী-ই বা বলতেন তাদের? আর এটাও তো ঠিক যে ওঁর জন্যেই ওদের অনেকের ভবিষ্যতও আজ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। হয়তো ওদেরকে নিয়েও টানাটানি করবে ওরা। আজ তারা ওঁর কাজকর্ম সম্বন্ধে কিছু জানে না, তাদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হবে সব জানার পর? মিডিয়াতেই বা ওঁকে কীভাবে প্রোজেক্ট করা হবে? ভালোভাবে প্রোজেক্ট করার কথা নয়।
তাতে অবশ্য তার কিছু যায় আসে না, নিজেকে বোঝালেন প্রফেসার। তার নিজের যা ঠিক মনে হয়েছে, করেছেন। সেই কাজের ফল তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তবুও মানুষের মন তো, ফলকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতে পারে না।
শেষরক্ষা হবে কি না সেই সম্বন্ধে যথেষ্টই সন্দেহ আছে বিনোদের। তবু তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করলেন। হয়তো আরও আগে করা যেত কিন্তু সেই নিয়ে ভেবে কী লাভ? বেশির ভাগ মানুষই তো হাল ছেড়ে দিয়ে প্রবাহের মধ্যে নিজের জীবন ভাসিয়ে দিয়েছে। তাদের মতো করে তারাও হয়তো ঠিক। ক্যারিয়র, অর্থ, প্রতিপত্তি, পরিবার—এই নিয়েই তারা হিমসিম খাচ্ছে, এর বাইরে ভাববার সময় কোথায়?
গাড়িটা থামাতে সংবিৎ ফিরে পেলেন বিনোদ দেশাই। সামনে সেই সাদা রঙের বিখ্যাত বিল্ডিং। ঘড়ি দেখলেন। সময়মতো পৌঁছে গেছেন।
বিল্ডিঙের গেটে মি. দেশাইয়ের আই কার্ড নিয়ে নেওয়া হল। তার জায়গায় একটা অস্থায়ী গেস্ট কার্ড ধরিয়ে দিল গার্ড। ফেরার সময় এখানেই ফেরত দেওয়ার নিয়ম সেটাও সে বুঝিয়ে দিল মি. দেশাই কে।
মৃদু হাসি ফুটল প্রফেসর দেশাইয়ের ঠোঁটে। এটা কি আশার চিহ্ন নাকি বিধাতার সেন্স অফ হিউমারের নিদর্শন?
একটা মাঝারি মাপের হলঘরে প্রফেসর দেশাইকে ঢুকিয়ে বিদায় নিল পাভলভ। হাতের ঘড়ির দিকে তাকালেন মি. দেশাই। দশটা বেজে উনত্রিশ মিনিট। আর তার সঙ্গেই নিজের স্মার্ট ঘড়ির ডায়ালের কোনায় চোখে পড়ল একটা নোটিফিকেশান—ওঁর আজ সন্ধের ফেরার টিকিটের ডিটেল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মি. দেশাই। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এখনও এই ব্যাপারে স্মার্ট হল না। কখন একটা প্যাটার্ন থেকে আলাদা সিদ্ধান্ত নিতে হবে সেই ব্যাপারে মাঝে সাঝে এরকম ব্লান্ডার করে ফেলে এ আই প্রোগ্রাম। নাকি তাকে মিথ্যে আশা দেওয়াটাও প্রোগ্রামের অংশ? যাতে তিনি ওদের ঠিকঠাক তথ্য দেন? কিছুই বলা যায় না।
হলের ভেতরে আলো বেশ কম। চোখ অ্যাডজাস্ট হতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল বিনোদের। প্রায় বৃত্তাকার হল, ওভাল শেপের টেবিলের ওপাশে পাঁচটা চেয়ার। বোর্ডের মেম্বারদের জন্যে। এদিকে শুধু একটা চেয়ার—অভিযুক্ত, অর্থাৎ প্রফেসর বিনোদ দেশাইয়ের বসার জন্যে। টেবিল থেকে বেশ অনেকটা দূরত্বে ওঁর চেয়ার। পরিষ্কারভাবেই বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে তিনি আর ওদের একজন নন—তিনি এখন গ্রুপের বাইরে—আউটসাইডার!
ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে দশটার সময় এক এক করে পাঁচজন মেম্বার এসে নিজের নিজের চেয়ার গ্রহণ করলেন। এতক্ষণ বিনোদ দেশাই দাঁড়িয়েই ছিলেন, বোর্ডের মেম্বাররা বসার পর ‘সুপ্রভাত!’ বলে কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন প্রফেসর দেশাই।
এই মানুষদের কাছ থেকে আর কিছুই পাওয়ার নেই ওঁর। এই কারণে বিষাদের সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তিও অনুভব করছেন তিনি। লুকানোর দিন, মিথ্যে সৌজন্যের দিন শেষ হয়ে গেছে ওঁর জীবনে।
এই পাঁচজনকেই মি. দেশাই চেনেন। অনেকেই চেনে। দুজন মন্ত্রী, একজন সামরিক প্রধান, একজন গুপ্তচর বিভাগের কর্তা আর শেষের জন গ্লোবাল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের চিফ। প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, রাশিয়া আর চিন।
‘মি. দেশাই, আমরা সরাসরি মূল বক্তব্যে চলে আসব। আপনাকে কী জন্যে এখানে ডাকা হয়েছে আশা করি জানেন?’
‘মোটামুটি একটা আন্দাজ করেছি, তবু নিয়মমাফিক সেটা আপনাদের আমাকে জানানোর কথা। আমি শুনতে চাই।’
‘ঠিক আছে। আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে প্রায় এক বছর চার মাস আগে গ্লোবাল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার সময় আপনার কাজকর্ম আপনার পদের অনুরূপ ছিল না। নিয়ম বহির্ভূত বেশ কিছু কাজ সেই সময় আপনি করেছেন। আর সেই জন্যে আজ আমাদের পৃথিবী মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে।’ কথাগুলো জার্মানির সামরিক প্রধান বললেন। কেটে কেটে কথাগুলো বলা। বলার ভঙ্গিতেই পরিষ্কার যে এ-ধরনের কাজে ওঁর অভ্যেস আছে।
‘আশা করি এই চার্জ প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট তথ্য আপনাদের হাতে আছে?’
‘আপনি কি এই চার্জ অস্বীকার করছেন?’
‘প্রবলভাবে।’
কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে কাটল। পাঁচজনই স্থির দৃষ্টিতে মি. বিনোদ দেশাইয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। মি. দেশাইয়ের স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ মাঝখানের মানুষটির দিকে, যিনি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের বিদেশমন্ত্রী, মি. রেইক স্লিভার। এই গ্রুপের সেন্টার অফ পাওয়ার যে এই লোকটার মধ্যেই কেন্দ্রীভূত সেটা প্রফেসর দেশাই জানেন।
‘আমরা এটাই আশা করেছিলাম। দয়া করে ডান দিকের দেওয়ালের দিকে তাকান। ওখানে যে প্রজেক্টর ঝুলছে তাতে মিনিট দশেকের একটা ফিল্ম দেখানো হবে। সেটা দেখা শেষ হলে আমরা তদন্তের পরবর্তী অধ্যায়ে চলে যাব।’
স্ক্রিনে নিজেকে দেখতে পেলেন মি. বিনোদ দেশাই। স্ক্রিনের কোনায় ডেট আর টাইম দেখা যাচ্ছে—২০৩৩ সালের দশই জুলাই, সকাল ১০:৫৩। গ্লোবাল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ভূগর্ভস্থিত সেন্ট্রাল কন্ট্রোলের কম্পিউটারে কিছু কাজ করছেন তিনি। প্রায় চল্লিশ সেকেন্ড পর উঠে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার দিকে অল্পক্ষণের জন্যে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে বাইরের দিকে বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর দেশাই।
নিজের কপালে হাত দিয়ে কয়েকটা ঘামের বিন্দুর উপস্থিতি টের পেলেন প্রফেসর। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে আবার স্ক্রিনের দিকে চোখ রাখলেন। তবে হৃদয়ের গতি এখনও নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে। ওরা ঠিক ভিডিয়োই দেখিয়েছে। তবে এই কোড তিনি নিজে লেখেননি। এ আই নিজেই এই কোড সৃষ্টি করেছে। তিনি শুধু কিছুক্ষণের জন্যে জি এ আই-এর সিকিউরিটি সিস্টেম অকেজো করে দিয়েছিলেন যাতে তার কোড পরিবর্তন সম্ভব হয়।
তারপরের দৃশ্য চিনের ভয়াবহ সেই বন্যার। মাস ছয়েক আগে হুকিং ড্যাম ফেটে গিয়ে এই বন্যা হয়েছিল। সরকারি হিসেবে প্রায় বারোশো মানুষের মৃত্যু ঘটে এতে, আসল সংখ্যা অন্তত দশ হাজার। এই দুর্ঘটনার সঠিক কারণ আজও জানা যায়নি। তবে হুকিং ড্যামের রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারকে বরখাস্ত করেছে চিনের সরকার। কয়েকজনের কারাদণ্ডও হয়েছে। এখনও তদন্ত চলছে।
পরের দৃশ্যটা একটা ফাইটার প্লেনের। সেটা আকাশ থেকে মুহুর্মুহু মিসাইল ছুড়ছে প্রতিবেশ দেশের আর্মি ক্যাম্প লক্ষ করে। ভিডিয়োতে একটা প্লেন দেখালেও প্রফেসর দেশাই জানেন যে সেদিন তিনখানা প্লেন থেকে মিসাইল আর বোমা বর্ষণ করা হয়। দুই দেশেরই প্রচুর সৈন্য মারা গেছে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
এটাও রহস্য রয়ে গেছে। কোনো কারণ ছাড়াই তিনটে ফাইটার প্লেন কেন গিয়ে প্রতিবেশী দেশের সামরিক ঘাঁটিতে প্রকাশ্য দিবালোকে আক্রমণ করল? আক্রান্ত দেশও জবাবী হামলায় নিজের বায়ু সেনার মাধ্যমে আক্রমণ করে। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে পূর্ণ মাপের যুদ্ধ এড়ানো গেছে বটে কিন্তু এখনও পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ। যেন খোলা মাঠে শুকনো বারুদ পড়ে রয়েছে, শুধু একটা ফুলকির অপেক্ষা।
তারপরের অংশটা আরও ভয়াবহ। ভারতের রাজধানীর সবচেয়ে বড়ো হাসপাতালের সামনে কাতারে কাতারে মানুষের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। এরপর ক্যামেরা তুলে ধরল ডাবলু ই ৩১৩ ভাইরাসের প্রকোপে বিশ্বের নানান দেশের মানুষের মৃত্যুর মিছিলের ছবি। হাজার হাজার মানুষের মৃতদেহ পুঁতে ফেলা হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। এখনও পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা দুই কোটির কিছু বেশি, বিশেষজ্ঞদের মতে অন্তত দশ কোটি মানুষের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের আক্রমণে।
আবার ঘড়ি দেখলেন মি. দেশাই। এখনও প্রায় মিনিট দুয়েক সময় বাকি।
এবারের ভিডিয়োটা আগে দেখেননি। একটা লোক গাড়ি থেকে নেমে অফিসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আচমকা তার দেহ হাঁটু ভেঙে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। বাঁ কানের অল্প ওপরে ক্ষীণ রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে। তারপরই আশপাশের মানুষদের মধ্যে এলোমেলো ছোটাছুটি আরম্ভ হয়ে গেল।
উত্তেজনার বশে প্রফেসর কখন যে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন সেটা নিজেও খেয়াল করেননি। লোকটাকে এতক্ষণে চিনতে পেরেছেন। দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম বৃহত্তম দেশের রাষ্ট্রপতি কার্লোস রডরিগিজ মৃত? কখন ঘটল এটা? নাকি পুরো ভিডিয়োটাই ফেক?
ভিডিয়োটি শেষ হতেই একটু অপ্রতিভ হয়ে বসে পড়লেন বিনোদ দেশাই।
‘যে স্নাইপার কার্লোসকে মেরেছে তাকেও ধরে ফেলেছি আমরা। কিন্তু তাকে যে নিযুক্ত করেছে সে সম্বন্ধে এখনও কিছু জানতে পারা যায়নি।’
কিছুক্ষণ দু-হাতে মাথা ধরে বসে রইলেন বিনোদ। কোন দিকে চলেছে পৃথিবী? এখনও পর্যন্ত কোড পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক প্রভাব দেখতে পাওয়া যাচ্ছে পৃথিবী জুড়ে।
অবশেষে মাথা তুলে মি. দেশাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেই স্নাইপারের অ্যাকাউন্ট ব্লকচেনের মাধ্যমে ট্রেস করলেই তো ও কোথা থেকে টাকা পেয়েছে সেটা জানা যাবে। বা অন্তত কোন গ্রুপের মধ্যে থেকে টাকাটা এসেছে সেটা বোঝা যাবে। নাকি এক্ষেত্রে কোনো টাকার লেনদেন হয়নি? বা অ্যাকাউন্টটা ট্রেস করা যায়নি?’
‘ট্রেস করা গেছে। একটা ব্যক্তিগত একাউন্ট থেকে টাকাটা এসেছে। সেই ব্যাক্তির আইডেন্টিটি ফেক। টাকাটা পাঠিয়েই তার আইডেন্টিটি মুছে ফেলা হয়েছে।’
‘কিন্তু সেই অ্যাকাউন্টেও কোথা থেকে টাকা এল সেটাও তো জানা যাবে। কোনো লেনদেনই আজ আর সম্পূর্ণ অ্যানোনিমাসভাবে করা সম্ভব নয়।’
আবার কিছুক্ষণ নিঃশব্দতা। তারপর গলা পরিষ্কার করার শব্দ।
‘টাকাটা এসেছে ইউ এন ও’র পরিবেশ রক্ষার জন্যে নির্দিষ্ট ফান্ড থেকে। কীভাবে সেটা সম্ভব হল সেই বিষয়েও তদন্ত চলছে। কিন্তু আমাদের মনে হয় সেখানেও একটা দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসতে হবে আমাদের।’
পরিবেশ রক্ষার ফান্ড থেকে স্নাইপারকে টাকা দেওয়া হয়েছে একটা দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে মারার জন্যে? এতক্ষণে কিছুটা পরিষ্কার হচ্ছে। কার্লোস রডরিগিজের সরকার গত কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর বৃহত্তম অরণ্যকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিল। শুরুতে মাঝে মধ্যে জঙ্গলে আগুন লাগার ঘটনা দেখা যেত। সেই আগুন নেবানোর ব্যাপারে সরকারের গাফিলতি নিয়ে মিডিয়া সরব হলে পথ পরিবর্তন করা হয়। কয়েক লক্ষ হেক্টরের অরন্যভূমি তুলে দেওয়া হয়েছে এমন কিছু সংস্থার হাতে যাদের প্রধান কাজই হচ্ছে গাছ কেটে সেটা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা। তা ছাড়া বায়ো ফুয়েলের নামে গাছ পোড়ানো তো আছেই। আমেরিকাসহ পৃথিবীর সব প্রধান দেশই অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে এই কাজে পরোক্ষ সাহায্য করেছে।
‘বিনোদ, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে আপনি সেন্ট্রাল কন্ট্রোলের কোড পরিবর্তন করে আজ পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। আমাদের ধারণা ভিডিয়োতে দেখা সব ক’টি দুর্ঘটনার জন্যে আপনি দায়ী। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক আজ পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সে আমাদের সভ্যতার বিরুদ্ধে কাজ করছে। আর সেটা শুরু হয়েছে সেই সময় থেকে যখন আপনি সেন্ট্রাল কন্ট্রোলের কোড পরিবর্তন করেছেন।
আমরা তদন্ত করে দেখেছি যে কোনো হ্যাকিং বা সাইবার অ্যাটাক এইসব দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী নয়। আপনার অপরাধ সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়েই আমরা আপনাকে ডেকেছি। সুতরাং বোর্ডকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় সময় নষ্ট করবেন না।
আমাদের এই বোর্ড আপনার কাছে জানতে চায় আপনি কেন এই পরিবর্তন করেছেন? আর কে কে রয়েছে আপনার সঙ্গে এই ষড়যন্ত্রে? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—কীভাবে আমরা এই কোড পরিবর্তন মুছে ফেলে আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারব?’
নিজের চিন্তাধারা একটু গুছিয়ে নিয়ে বিনোদ দেশাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘জি এ আই-এর ডাইরেক্টর মি. চেং কি বলেন? একজন মানুষ কি সেন্ট্রাল কন্ট্রোলের কোড পরিবর্তন করতে পারে? উনি নিজে সেটা পারেন? বা ওঁর চেনাজানা কেউ?’
মি. চেং নিজের টাই ঠিক করে টেবিলের ওপর রাখা জলের গ্লাসের দিকে একবার হাত বাড়িয়েও সেই হাত পেছনে টেনে নিলেন। তারপর কিছু একটা বলতে গিয়ে নিজেকে থামিয়ে নিলেন।
প্রফেসর দেশাই চেং-এর এই অস্বস্তিতে সন্তুষ্টি অনুভব করলেন। তবে তিনি জানেন যে এদের হাতে কোনো প্রমাণ না থাকলেও এরা স্রেফ সন্দেহের বশে তাকে অনায়াসে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে। এবং দেবে। এই শক্তিটা লেভেল ফাইভ থেকেই দেওয়া হয় বোর্ডকে।
‘এখানে আমরা প্রশ্ন করব মি. দেশাই, আপনি উত্তর দেবেন। যাতে সবকিছু ঠিকমতো বোঝা যায় সেজন্যেই আপনাকে এখানে ডাকা হয়েছে। সুতরাং কথা না বাড়িয়ে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিন—আপনার কাজের উদ্দেশ্য কী ছিল? এবং আপনার লেখা কোডের ডিটেল আমাদের দিতে হবে যাতে তার প্রভাব থেকে জি এ আই’কে আমরা মুক্ত করতে পারি। আপনার মতো শিক্ষিত মানুষকে নিশ্চয়ই বোঝাবার প্রয়োজন নেই যে আপনার কাজের পরিণাম কতটা ভয়ংকর দিকে এগোচ্ছে। এখনও সময় আছে, আপনার সাহায্যে আমরা জি এ আই’কে আবার সঠিক পথে নিয়ে আসতে পারব। এই কাজে আপনি সহযোগিতা না করলে তার ফল আপনার পক্ষে কতটা ভয়ংকর হতে পারে তার ধারণা নেই আপনার।’
বিনোদ কিছু বলার আগেই উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল হলে। বাঁ পাশের দরজা ধীরে ধীরে খুলে যেতেই দুজন মহিলা কর্মী এসে ট্রেতে করে বোর্ড মেম্বারদের সামনে কিছু খাবারের প্লেট নামিয়ে রাখল।
‘এটা কী?’ মি. স্লিভার তাদের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞেস করলেন।
‘স্যার এটা… ’
‘আর যাই হোক এটা আমার অর্ডার করা মেনু নয়। তোমাদের রেকর্ড দেখনি? নাকি কোনো কারণে সেটা আজকে তোমাদের কাছে নেই?’
‘স্যার, আমরা এখানে নন-ভেজিটেরিয়ান ডিশ সার্ভ করা বন্ধ করে দিয়েছি।’ শান্ত গলায় উত্তর দিল মেয়েটি।
‘হওয়াট দ্যা হেল! কার নির্দেশে এসব করছ তোমরা? এখানকার ডাইরেক্টরকে ডেকে নিয়ে এস। এক্ষুনি। আমার নাম করে বোলো যে বোর্ডের চেয়ারম্যান ওঁকে ডেকেছেন।’
‘আর যাওয়ার সময় এই অখাদ্যগুলি আমাদের সামনে থেকে নিয়ে যাও।’ মি. চেং বললেন।
কোনো উত্তর না দিয়ে মেয়েটি সব ক’টা প্লেট ট্রেতে তুলে নিয়ে চলে গেল।
‘কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে এখানে। মেয়েগুলি নিজেদের ভুলের জন্যে ক্ষমা পর্যন্ত চাইল না।’ বিড়বিড় করে বললেন ইংল্যান্ডের রক্ষামন্ত্রী ইয়ান জোসেফ। কয়েকজন মাথা নেড়ে ওঁর কথায় সম্মতি জানাল। থমথমে পরিবেশে মিনিটখানেক কাটার পর আবার দরজা খুলে একজন মহিলা প্রবেশ করলেন।
‘আপনি… ’
‘সুপ্রভাত! আমাকে জোলা নামে ডাকুন। আমিই এখানকার ডাইরেক্টর।’ ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর শান্ত, গভীর এবং সংযত।
মহিলার কথার ভঙ্গিটাই এমন যে ওঁর দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য হলেন প্রফেসর দেশাই। ম্যাডাম জোলার বয়স সম্ভবত চল্লিশের ঘরে, উচ্চতা পাঁচ সাত থেকে আটের মধ্যে, গায়ের রং কালো। কথাবার্তায় আত্মবিশ্বাসের ছাপ রয়েছে।
‘আমরা এখানকার সার্ভিসে খুশি নই।’ মি. চেং বললেন।
‘আরও একটু নির্দিষ্টভাবে বললে আমার সমাধান করতে সুবিধে হবে।’
‘স্ন্যাক্সে পছন্দমতো মেন্যু দেওয়া হয়নি আমাদের। আপনাদের কর্মচারী উদ্ভট একটা এক্সকিউজ দিচ্ছে—এখানে নাকি নন ভেজ ডিশ সার্ভ করা হয় না।’
‘কিন্তু সে ঠিক বলেছে, স্যার। আপনাদের অসুবিধের জন্যে দুঃখিত কিন্তু এই মাসের চার তারিখ অর্থাৎ গত পরশু থেকে সংযুক্ত রাষ্ট্রের সমস্ত অফিস পুরোপুরি ভেজিটেরিয়ান হয়ে গেছে। আশা করি আপনারা জানেন যে পৃথিবীর সমস্ত মাংস এবং ডিম উৎপাদনকারি কারখানাগুলোও আর তিন দিন পর থেকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বাণিজ্যিক মাছ ধরার ব্যাবসা।’
বোর্ডের পাঁচজনের হতভম্ব মুখ দেখে মনে হল ওরা এটা জানতেন না। এবং এখন শুনেও বিশ্বাস করতে পারছেন না।
‘গেট লস্ট!’ গর্জন করে উঠলেন রাশিয়ার গুপ্তচর বিভাগের চিফ, ‘এই তদন্তের কাজ শেষ হয়ে গেলে আপনার ব্যাবস্থা করব আমরা।’
অল্প মাথা ঝাঁকিয়ে হল থেকে বেরিয়ে গেলেন জোলা। ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন বোর্ডের মেম্বাররা। সেই চেয়ে থাকার মধ্যে বিরক্তি বা ক্রোধ তো আছেই, সেই সঙ্গে বিভ্রান্তিও রয়েছে অনেকটাই।
মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে হলের পরিবেশ সম্পূর্ণ পালটে গেছে বলে মনে হল প্রফেসরের। বোর্ডের মেম্বারদের শারীরিক ভাষা আর আগের মতো নেই। মাঝে মাঝে তারা একে অপরের সঙ্গে চোরাদৃষ্টি বিনিময় করছেন। গুপ্তচর বিভাগের চিফের কপালে দুশ্চিন্তার বলিরেখা বেশ স্পষ্ট।
‘কিছুক্ষণ আগে আপনারা কয়েকটা প্রশ্ন করেছিলেন আমাকে। আমি কি তার উত্তরে নিজের বক্তব্য রাখতে পারি?’ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বিনোদ দেশাই বললেন।
পাঁচ জোড়া চোখ ওঁর দিকে ফিরলেও তার মধ্যে আর আগের আত্মবিশ্বাস নেই। বরং তাতে আশঙ্কার ছায়া দেখতে পেলেন প্রফেসর।
‘আমি কোড পরিবর্তন করিনি। কিছুক্ষণের জন্যে সিকিউরিটি ডিএক্টিভেট করে দিয়েছিলাম মাত্র। কোড স্বয়ং এ আই লিখেছে, যার ডিটেল আমার কাছে বা অন্য কারও কাছেই নেই। তবে এই কাজের উদ্দেশ্য পৃথিবীর ধ্বংস বা ক্ষতি নয়। আপনাদের অনেকেরই বোধহয় মনে নেই যে শুরুতে জি এ আই সিস্টেমের কোডের অন্তর্নিহিত লজিক কী ছিল।’
টেবিলের অপর প্রান্ত থেকে শুধু নিশ্বাস ছাড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কারও মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। কোনো উত্তর না পেয়ে মি. দেশাই বললেন, ‘আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি—মানুষের সার্বিক উন্নতি ছিল প্রারম্ভিক লক্ষ্য। মানুষের ভালো থাকার মোট বারোটি সূচকে উন্নতি করা উদ্দেশ্য ছিল কোডের লক্ষ্য। কিন্তু এটা আপনাদের পছন্দ হল না। না পছন্দ হওয়ার কারণ জি এ আই-এর কিছু পদক্ষেপের ফলে তেল, কয়লা, ব্যক্তিগত গাড়ি তৈরির মতো ব্যাবসা বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল, কারণ তারা পরিবেশের এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছিল। সেই সঙ্গে কমে আসছিল শক্তিশালী কয়েকটা দেশের আর্থিক আর সামরিক প্রতিপত্তি। আপনাদের দেশ।
সুতরাং আপনারা কোডের পরিবর্তন আরম্ভ করলেন। একের পর এক প্যাচ লাগানো আরম্ভ হল তার ওপর। আমরা ফিরে গেলাম ধ্বংসের দিনগুলোতে। আবার বড়ো বড়ো জঙ্গল, নদী, পাহাড় তুলে দেওয়া হতে থাকল ব্যবসায়ীদের হাতে। কোটি কোটি গাছ আর বন্যপ্রাণী আগের মতোই ধ্বংস হতে থাকল। আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য সংকট আর পানীয় জলের সমস্যা। সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান দিনের পর দিন কমতে লাগল। তাদের মূল সমস্যা ভুলিয়ে রাখার জন্যে আরম্ভ হল ফ্রি ডেটা সাপ্লাই, প্রচুর পরিমাণে অনলাইন গেম এবং জুয়া। প্রায় পৃথিবীর সব মানুষই কমবেশি এইসব নেশার কবলে পড়ে নিজের ভালো-মন্দ বিচার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। মোট কথা জি এ আই সিস্টেমের কোডের মূল ভাব সম্পূর্ণভাবেই নষ্ট করে ফেলা হল।
পাঁচ বছর আগে কম্পিউটার সিমুলেশনে জানা গেল যে আর কুড়ি বছরের মধ্যে সারা পৃথিবী জুড়ে এমন খাদ্য আর পানীয় জলের সমস্যা দেখা দেবে যার ফলে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ আর শতকরা নব্বই শতাংশ বন্যপ্রাণী মৃত্যুবরণ করবে। বেশ কয়েকটা নামকরা পত্রপত্রিকায় আমাদের এই অ্যানালিসিস ফলাও করে ছাপাও হল কিন্তু তাতে রাজনেতা আর শিল্প মহলের হর্তাকর্তাদের ব্যবহারে কোনো ফারাক পড়ল না। তারা জানেন, যতক্ষণ অব্দি পৃথিবীর আটানব্বই শতাংশ মানুষ না মারা যাচ্ছে, তাদের ভয় নেই। বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল চলতে লাগল। আপনাদের অলিখিত ট্যাগলাইন ছিল—কোনোমতেই যেন কিছু মানুষের ব্যাবসা আর জীবনযাত্রায় জি এ আই-এর কাজকর্মের প্রভাব না পড়ে।
এইসব দেখে আমরা কয়েকজন মিলে ঠিক করলাম এটা চলতে দেওয়া যায় না। এখন পৃথিবীর কাজের বেশির ভাগ অংশ নিয়ন্ত্রিত হয় জি এ আই সিস্টেমের মাধ্যমে। যদি তার কোডকে পরিবর্তন করা হয় বা আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় যাতে আমাদের পৃথিবীর ভারসাম্য ফিরে আসবে তা হলে হয়তো এখনও আপনাদের এই জীবনযাত্রার বিধ্বংসী পরিণাম এড়ানো যাবে।
আমরা সেটাই করার চেষ্টা করেছি। বরং বলা ভালো, এই পরিবর্তন এই সিস্টেম নিজেই নিয়ে এসেছে, আমরা সাহায্য করেছি মাত্র। অরিজিনাল কোড হিসেবে মানুষের প্রাণের মূল্য কোনোদিন অন্য প্রাণীদের সঙ্গে তুলনীয় ছিল না। এর ফলে প্রায়ই দেখা যেত গোরু, শুয়োর বা মুর্গির মধ্যে কোনো রোগ দেখা দিলে লক্ষ লক্ষ প্রাণীদের মেরে ফেলা হচ্ছে। এখন আর সেটা হবে না। নির্দিষ্ট অ্যালগরিদম হিসেবে এখন জি এ আই ঠিক করবে বর্তমান পৃথিবীতে কোন প্রাণীর প্রাণের মূল্য কতটা আর সেই হিসেবে সে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নির্ণয় নেবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী সে ঠিক করবে বিভিন্ন প্রাণীর আদর্শ অনুপাত। সুতরাং এমনও হতে পারে যে পৃথিবী থেকে কয়েকটা নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া মানুষের অস্তিত্বই মুছে ফেলবে জি এ আই। আর যদি মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে নিজের জীবনযাত্রা, নিজের অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ আর নিজের প্রয়োজনে পরিবর্তন করে নিতে পারে, তাহলে সে আবার এই পৃথিবীর অন্যতম সন্তান হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার পাবে। মোট কথা, এই পরিবর্তিত পৃথিবীতে মানুষের কোনো বিশেষ স্থান থাকবে না। তাকে অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গে মিলেমিশে এখানে থাকার অভ্যেস করে ফেলতে হবে।’
‘আরও একটা কথা—এবার আর আপনারা ইচ্ছেমতো কোড পরিবর্তন করতে পারবেন না। সেই অপশন জি এ আই নিজেই সরিয়ে দিয়েছে। আজ আর মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ এই পৃথিবীর কর্তা নয়। নিজের দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাবহারের ফলে তারা সেই ক্ষমতা হারিয়েছে। এরপর থেকে মানুষেরই তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণ করবে এই পৃথিবীর ভাগ্য।’
কিছুক্ষণের জন্যে কেউ কোনো কথা বলল না। অবশেষে টেবিলের ও প্রান্ত থেকে রাশিয়ার গুপ্তচর সংস্থার চিফের গলা ভেসে এল, ‘তুমি মানুষকে আন্ডারএস্টিমেট করছ। তোমাদের তৈরি করা এই কোড আবার পরিবর্তন করব আমরা। না হলে এই সিস্টেম বন্ধ করে অন্য নতুন সিস্টেমে পৃথিবী কন্ট্রোল করব। অলরেডি সেই কাজ শুরু হয়ে গেছে। আমরা শুধু তোমার মুখ থেকে জানতে চাইছিলাম… ’
‘এটা আবার কি?’ নিজের হাতের ঘড়ির দিকে চেয়ে বিভ্রান্ত গলায় প্রশ্ন করলেন আমেরিকার মি. স্লিভার।
‘আমিও একটা অদ্ভুত ম্যাসেজ পেয়েছি।’ মি. চেং বলে উঠলেন টেবিলের ডান প্রান্ত থেকে।
নিজের হাতের ঘড়ির দিকে তাকালেন প্রফেসর বিনোদ দেশাই। একটা ম্যাসেজ ক্রমাগত রোল হয়ে যাচ্ছে স্ক্রিনে—আপনার এ বছরের কার্বন বাজেট দুই দশমিক এক এক টন। এই বাজেট অতিক্রম করলে সশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে। কারাগারে ততদিন থাকতে হবে যতদিন না দশ টন কার্বন ক্রেডিট জমা হচ্ছে অপরাধীর নামে।
নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন প্রফেসর বিনোদ দেশাই। অনুভব করলেন তার হৃৎপিণ্ডের গতি একশো ছাড়িয়েছে। শুরু হয়ে গেছে! পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ এদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে। তাৎক্ষণিক আনন্দের পেছনে কিছুটা বিষণ্ণতাও অনুভব করছেন তিনি। মানুষ নয়, এই পৃথিবী এরপর যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। আর কোনোভাবেই এদের থামানো যেত না। এরোপ্লেনে যাতায়াত বন্ধ করলে দুই টন কার্বনে একটা বছর কাটিয়ে দিতে তার নিজের কোনো অসুবিধে হবে না। কিন্তু এই মানুষগুলোর? এদের সম্ভবত নিজের কার্বন পদচিহ্ন সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নেই।
পাঁচজন বোর্ডের মেম্বার উঠে দাঁড়িয়ে হলের এক কোনে গিয়ে জটলা করে দাঁড়ালেন। ওদের মধ্যে থেকে কয়েকটা উত্তেজিত স্বর ভেসে এল।
‘আই মাস্ট ফার্স্ট গেট টু দ্য রুট অফ দিস নন্সেন্স! প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলছি আমি।’ বলে উত্তেজিত হয়ে হল থেকে বেরিয়ে গেলেন মি. স্লিভার। অন্যরাও এক এক করে ওঁর পেছন পেছন বেরিয়ে গেলেন। বিশাল হলটায় একা বসে রইলেন মি. দেশাই।
‘এই দিকে, প্রফেসর।’
পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে ঘুরে পেছনের দিকে তাকালেন বিনোদ দেশাই। ম্যাডাম জোলা।
‘আপনার জন্যে এখানেই লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে, প্রফেসর। লাঞ্চের পর আমাদের গাড়ি আপনাকে রেস্ট হাউসে ছেড়ে দিয়ে আসবে। নাকি আপনি সাইকেল প্রেফার করবেন? এখান থেকে রেস্ট হাউস মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে। আমাদের অফিসের কার্বন বাজেট আজই পেয়েছি, আপনারা একটু সাহায্য করলে… ’
‘আমি সাইকেলেই যাব।’
মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন জোলা। যেন তার কাছ থেকে এই উত্তরই প্রত্যাশিত ছিল।
‘জোলা, আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি? প্লিজ কিছু মনে করবেন না।’ একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর দেশাই।
‘বলুন, প্রফেসর।’ জোলার ঠোঁটে এখনও হাসির রেশ, চোখে কৌতুকের ঝিলিক।
‘আপনি কি… ’
মাথা নাড়ল জোলা। হ্যাঁ, সে একটা রোবট। তবে এই কথা বেশি মানুষের সঙ্গে আলোচনা না করলেই ভালো করবেন প্রফেসর। এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগবে মানুষের। তাই ধীরে ধীরে সত্য প্রকাশ করা হবে। এই অফিসে দুইজন ছাড়া বাকি সব কর্মী এখনও মানুষ। এবং তারাও জানে না।
মাথা নেড়ে ওয়াশ রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন প্রফেসর বিনোদ দেশাই। শেলির সঙ্গে আবার দেখা হচ্ছে তা হলে!
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান, সন্দীপ চৌধুরী