পরিযায়ী
লেখক: শৌভিক সিনহা
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
বড়োবাজারের মাকড়সার জালের মতো লেয়ারের পর লেয়ার, জড়ানো প্যাঁচানো ফ্লাইওভারের প্রত্যেকটা লেয়ারে জ্যাম। ইউসুফ তাই প্রতিবারের মতো এবারেও শিয়ালদা থেকে ট্রামে উঠেছে। তার পেছনে আরও কয়েকটা কারণ আছে বটে। একে তো স্টেট স্পন্সরড বলে সমস্ত নাগরিকদের জন্য এক্কেবারে বিনামূল্যে যাত্রা, তার সঙ্গে নীচ থেকে ওপরের দিকের দু-নম্বর টিউবটায় অন্যান্য গাড়ির হর্নের উপদ্রব নেই। তবে সবথেকে বড়ো কারণটা হল অন্যান্য যানবাহনের চেয়ে ধীর গতি হওয়ার ফলে অনেকটা সময় কাটানো যায় এটুকু দূরত্ব যাওয়ার জন্য। ট্রামগুলো পুরোনোও হয়েছে বটে! একে তো টিউবের এয়ারভেন্টগুলির পরিচর্যার বালাই নেই, উপরি পাওনা হিসেবে ট্রামকোচগুলির বাতানূকুল যন্ত্রের তাপমাত্রাও কখনোই কমের দিকে থাকে না, কাজেই একটা ভ্যাপসা গরম ভাব রয়েই যায়। কিন্তু ওই—অনেকটা সময় পাওয়া যায়! চালকহীন ট্রামের একেবারে সামনের কাচে, দূরে টানেলের শেষ মাথায় বেগুনি-লাল আলোর আভা দেখা দিতেই সঙ্গের যাত্রীরা নামার তোড়জোড় শুরু করল। লোক যদিও বেশি নেই—এক বৃদ্ধ দম্পতি, কিছু অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে আর আমাদের ইউসুফ। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরে ঘোষণা শুরু হল একাধিক ভাষায়, যদিও নতুন কোনো যাত্রী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত এই জড়ানো প্যাঁচানো ভাষার একবিন্দুও বুঝতে পারবে কিনা সন্দেহ। ঘোষণার মূল কথা হল: হাওড়া জংশনে আপনাকে স্বাগত। ইউভি চশমা পরে ফেলুন। আপনার শরীরে কোনো যান্ত্রিক অঙ্গের আইনবহির্ভূত ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। ইত্যাদি ইত্যাদি। মনে মনে হাসে ইউসুফ।।
কোচ থেকে নেমে এক দমকা মুক্ত বাতাস বড়ো আরামের, সঙ্গে অজস্র মানুষের নীচুস্বরে গুঞ্জন অদ্ভুত এক চাপা কোলাহলের সৃষ্টি করে চলেছে (বর্তমান মেয়রের আদেশ অনুযায়ী কোনো প্রকাশ্য স্থানে ৩০ ডেসিবলের বেশি জোরে কথা বলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শুধু নির্বাচন প্রচারের কাজটা ব্যতিক্রম।)। গত মহামারীর থেকে শিক্ষা নিয়ে শেষ অবধি সরকার পক্ষ থেকে সমস্ত ভিড়ের এলাকায় বড়ো বড়ো ইউভি লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে আর তার জোরদার স্ট্রোবিং চলছে মাঝেমাঝেই, কাজেই ইউভি চশমা পরে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এতক্ষণে রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে, কিন্তু চারিদিকে এলইডি লাইটের সুস্পষ্ট নির্দেশিকা থাকায় চলে ফিরে বেড়াতে কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না। যদিও কিছু অত্যন্ত বেপরোয়া লোক বিনা চশমাতেই রয়েছে! তাদের নাকি রং দেখতে ভালো লাগে! ইউসুফ এদের হাস্যকর আর অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে মনে করে। শেষ একবার পিছন ঘুরে পাখির খাঁচার মতো পুরোনো ব্রিজটার দিকে ফিরে তাকায় ইউসুফ, যেন ইচ্ছে করে আবার ফিরে যেতে। কিন্তু আবার দৌড় দৌড় দৌড়। দূরে স্কাই এলিভেটরটা ঝকঝক করছে লক্ষ লক্ষ আলোর মালা শরীরে নিয়ে। যাত্রীবাহী সব পডগুলি সেটার গা বেয়ে ভীষণ দ্রুতবেগে চলে যাচ্ছে আকাশের দিকে, চোখের দৃষ্টির সীমা ছড়িয়ে… ওদের মূল যানগুলি বায়ুমণ্ডলের ওই পারে, মহাকাশে অপেক্ষা করে ভেসে আছে। মনেমনে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইউসুফ ভাবে, আবার বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে চলল সে।
“খ্বাজাজী এই উদ্বাস্তুর মতো দৌড় থেকে নিস্তার দেবে কবে? ইয়া গরীব নওয়াজ, হে খ্বাজাজী আবার বাড়ি আনবে কবে?”
এসব ভাবতে ভাবতে ইউসুফ ততক্ষণে এসে পৌঁছেছে ইকোনমি ক্লাস ক্যাফেটেরিয়ার সামনে। এখনও হাতে সময় রয়েছে, কাজেই পার্সেল না কিনে ভেতরে খেয়ে নেওয়াই স্থির করল সে। কাজেই বাইরের অটোমেটিক ফুড ভেন্ডিং মেশিনের থেকে মুখ ফিরিয়ে ভিতরে ঢুকে সেখানের অটোমেটিক ফুড ভেন্ডিং মেশিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চারিদিকে একবার চোখ চালাতেই মনটা ভালো হয়ে গেল একটু—কোণায় একটা টেবিল ফাঁকা আছে, একদম জানলার পাশে, বাঃ! খাবার নিয়ে টেবিলে হালকা ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে খেতে থাকল সে—নির্নিমেষ তাকিয়ে তাকিয়ে বাইরে নদীর দিকে। নদীর দুই প্রান্তে প্রায় ৩০ কিলোমিটার ব্যবধানে দুটো বাঁধ দিয়ে জলের স্তর বাড়ানো হয়েছে, যাতে করে শহরের সৌন্দর্য্য বাঁচিয়ে রাখা যায়। অপরূপ দেখাচ্ছে বটে! তাতে কত না আলোয় সাজানো বার্জ ভেসে বেড়াচ্ছে, কিছু মাঝারি ক্যাপসুল বোট নিত্যযাত্রীদের নিয়ে পারাপার করে চলেছে। এই ছোটো ছোটো অংশগুলি বাদে নদীর খাতে জল কোথাও আর নেই। শুধু মাঝে মাঝে বন্যার স্রোত বেয়ে আসে সেখানে, সুনামির ঢেউয়ের মতো সেই বন্যা আছড়ে পড়ে উত্তরের বাঁধে। দক্ষিণের বাঁধে প্রতি অমাবস্যা পূর্ণিমায় সমুদ্রের লবণাক্ত ঢেউ হু-হু করে ধেয়ে আসে, সঙ্গে নিয়ে আসে জলে মিশে থাকা কতই না মূল্যবান সব খনিজ—থোরিয়াম, ইরিডিয়াম, সোনা, তামা, ইউরেনিয়াম, লিথিয়াম এসব। কত উটকো ছেলেমেয়ে হাইড্রোস্যুট পরে ঝাঁপ দেয় সেই ঢেউয়ে, ওদের পায়ে লাগানো ছোটো ছোটো অ্যানালাইজারে জল ছেঁকে একটু একটু উপাদান চুরি করে পাড়ে এসে ওঠে, কর্তৃপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে—তবে সবাই যে পাড়ে পৌঁছাতে পারে এমনটা নয়! গত পরশুর পূর্ণিমায় বাঁধের ওপর থেকে ঢেউ দেখতে অনেক বিত্তশালী পরিবার হয়তো ছুটি কাটাতে এসেছিল চাঁদ, মঙ্গল, আর মহাকাশে ভাসমান উপগ্রহ টাউনগুলি থেকে। খাবারের মান যেন দিনে দিনে নীচে নেমেই চলেছে, ইউসুফ বিরক্তিভরা মুখে আরও একটু টেস্ট মেকার সস ঢেলে দিল তার পোলাও-তে। এখনকার খাবার দাবার বেশ সহজ সরল—ময়দা, চাল আর সয়া মিশিয়ে একটা বেস তৈরি থাকে, সেটাকে অর্ডার অনুযায়ী বিভিন্ন আকার দিয়ে সিনথেটিক রং মিশিয়ে যেমন খুশি খাওয়ার বানানো যায়। যেমন ইউসুফের আজকের পোলাও—সঙ্গে খাবারের টেস্ট বাড়াতে সেই আইটেম অনুযায়ী সসও বানিয়ে দেয় একই মেশিন। সস ছাড়া সব খাবারই একই রকম খেতে লাগে—পোলাও হোক বা চাওমিন। একটু একটু ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে ইউসুফের। বেশ নামি হালুইকর ছিলেন ওর আব্বা। নিজের আব্বাকে আর পাঁচজন পুরুষের মতো কখনও শখ করে হলেও বাড়িতে মাংস রান্না করতে দেখেনি সে। ছুটির মধ্যে উৎসবের দিন হলেই আব্বা তার নিজেই সব জোগাড়যন্ত্র সেরে ক্ষীর, চমচম, রাবড়ি কিছু একটা বানাতে লাগতেন—তাঁর সখের গ্যাস চুলায়। সমস্ত প্রতিবেশীরা ততদিনে বিভিন্ন মডেলের ফুড সিন্থেসাইজারে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ইউসুফের বাড়িতেও সিন্থি ফুডেরই চলন বেশি থাকলেও তার আব্বা বিশেষ বিশেষ দিনে বিভিন্ন অমূল্য উপাদান জোগাড় করে আনতেন, গ্যাস চুলা ঝেড়ে মুছে গুছিয়ে বসতেন। রান্না করতে করতে নানারকম হাসি ঠাট্টা করে চলতেন ইউসুফের আম্মির সঙ্গে, ছোট্ট ইউসুফকে টুকটাক অনেক গল্প শোনাতেন। একটা বড়ো লোহার কড়াইতে অনেকটা দুধ ঢালতে ঢালতে বলে চলতেন—“জানিস তোর দাদা আরও অনেকটা করে দুধ আনতেন, তখনও আমাদের ডিস্ট্রিক্টে অনেক খাঁটি দুধ পাওয়া যেত প্লাস্টিকের প্যাকেটে, গুঁড়ো দুধ তো বাড়িতে রাখাই থাকত। সেই গুঁড়ো দুধ যদি একবার খেতি তাহলে আর সারা জীবনেও ভুলতি না। তোর দাদি একটা মশলা থেঁতো করে রাখত—একদম সত্যিকারের এলাচ, যেমনটা তোর বইতে ছবি আছে। আর তখন আসল চিনিও পাওয়া যেত, একদম সত্যিকারের আখের রস দিয়ে বানানো… ” এসব শুনতে শুনতে ছোট্ট ইউসুফ যেন হারিয়েই যেত কোনো আজব দুনিয়ায়, মনে মনে চেখে নিত যেন সেই সত্যিকারের দুধ, চিনি আর এলাচ ফুটানো ক্ষীরের স্বাদ! এসব ভাবতে ভাবতেই কব্জিতে রিমাইন্ডার বাজতে থাকে ইউসুফের—আর ৪৫ মিনিট বাকি গাড়ি ছাড়তে। কাজেই মনের থেকে সব চিন্তাভাবনা দূরে সরিয়ে রেখে, খাবারের প্লেট নির্দিষ্ট বিনে ফেলে দিয়ে পড বে-র দিকে চলতে থাকে ইউসুফ। মাঝে মাঝে কিছু প্রিমিয়াম ক্লাসের যাত্রীদল ভাসমান লাগেজ ক্যারিয়ার নিয়ে সামনে এসে পড়ছে, কোনো কোনো যাত্রীকে আবার রোবট কুকুর দাঁড় করিয়ে স্ক্যান করছে। পড বে পর্যন্ত পৌঁছানোর চলমান প্ল্যাটফর্মে যখন পৌঁছায় ইউসুফ তখনও হাতে ২৫-৩০ মিনিট সময় রয়েছে দেখে আশ্বস্ত হয়। এতদিন যাতায়াতের ফলে ম্যাপটা একরকম মুখস্থই হয়ে গেছে তার। একবার সিকিউরিটি চেকিংয়ের ধাপগুলি মনে মনে আউড়ে নিতে থাকে—প্রথমে ফেসিয়াল স্ক্যান, তারপর বিধিবদ্ধ চুক্তিপত্রের নীচে হাতের দশ আঙুলের ছাপ, রোবট কুকুরের সন্দেহ হলে পুরো শরীর ভিতরে ও বাইরে স্ক্যান করানোর চেম্বারে ঢুকে পড়া… ব্যাস, ঠিক আছে। দেখতে দেখতে পডের ভিতরে এসে ঢোকে ইউসুফ, ১৬ সিটের পড ততক্ষণে মোটামুটি ভরতি হয়ে গেছে। আর মিনিট দশেক পরেই ছেড়ে যাবে এই ইকোনমি ক্লাসের পডটি। তারপর নিজেদের নির্দিষ্ট বে থেকে সেমি ইকোনমি আর প্রিমিয়াম পডগুলির সঙ্গে একে একে এসে জুড়বে মূল যানের সঙ্গে। তারপর শুরু হবে তিন মাসের এক সুদীর্ঘ যাত্রা—যদিও মূল যানে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরেই সমস্ত যাত্রীরা আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে গভীর ঘুমে… যে ঘুমের মধ্যে কোনো স্বপ্ন থাকে না, যে ঘুমের মধ্যে বয়স বাড়ে না, যন্ত্র দ্বারা পরিচালিত যে ঘুম নিতান্তই যান্ত্রিক! ঘুমিয়েই যখন কাটাতে হবে, তখন আর এত রকমের পড বানানোর মানে কি?! বাড়িতে এখন তার আম্মি টিভিতে এই পডের লোকেশন দেখিয়ে দেখিয়ে তিন বছরের নাতিকে খাওয়াচ্ছে আর গল্প বলছে—“ওই দেখ, তোর আব্বার কি সাহস, কীরকম তারাদের দেশে যাচ্ছে! যখন ফিরবে তখন যেন তুই দৌড়ানো শিখে জাস, আব্বা কত খুশি হবে!” ইত্যাদি ইত্যাদি… ইউসুফের আব্বাও যেত এভাবেই, আর ইউসুফের দাদার যুগে তো নাকি এই জংশনে ট্রেনও চলত! তাতে করে তার দাদা যেত দূর দেশে—নামকরা হালুইকর ছিলেন কিনা! ইউসুফকে আরও একটু দূরে যেতে হয় জীবিকার খাতিরে এই যা। তবে পেমেন্টও অনেকটাই বেশি—তার আম্মির চিকিৎসা, পরিবারের দুজনের যান্ত্রিক ফুসফুসের মাসিক কিস্তি, স্বল্প পরিসরে বাড়তে থাকা বাচ্চার জন্য অধিক প্রোটিন, মিনারেল, ভিটামিনে ভরা সিন্থেটিক ডায়েট, ন্যানোবটের টিকা, বাড়ির ইউভি লাইটের ভাড়া, আরও হাজারও খরচ আজকের দিনে। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের যান্ত্রিক ফুসফুস ভরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইউসুফ। যান্ত্রিক অঙ্গের অপব্যবহার কীভাবেই বা করবে সে? অপব্যবহার মানে তো পৃথিবীর বাইরে কোনো বড়োলোকের কলোনিতে গিয়ে বিক্রী করে দেওয়া। সেখানের এসবের আইনানুগ বাজারমূল্য অনেক বেশি—তাই বড়োলোকেরা কম দামে কালোবাজার থেকে অনেকের যান্ত্রিক হাত, পা, চোখ এসব কিনতে চায়। আবার সেখানের কমদাম আমাদের পৃথিবীর মুদ্রার হিসেবে অনেক অনেকটা বেশি। কাজেই ক্রেতা বিক্রেতা দুই পক্ষেরই লাভ সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে এসব কারবার করে। ইউসুফের তো যান্ত্রিক ফুসফুস—কাজেই ওসব কালো ধান্দার কথা ভেবেও লাভ নেই। চার বছর আগে যখন মহামারী সপ্তম বারের জন্য ফিরে এল ১২ বছরের মধ্যে সবথেকে ভয়ংকরভাবে, সাবিনার ডিউ ডেটও ছিল তখনই। ইউসুফ তখন টাইটানে কাজে ব্যস্ত, কিন্তু ফিরতে তো হতই। কাজেই কর্তৃপক্ষ যখন লম্বা ছুটি দিতে সাফ মানা করে দিল কাজের এই ছয় মাসের মধ্যে, ইউসুফের আব্বা তড়িঘড়ি নিজের ছুটি কেটে রওনা দেন, কর্তৃপক্ষ এতে বাধা দেয়নি, কারণ ইউসুফকে হালুইকর যে উনিই নিজের হাতে বানিয়েছিলেন সেটা ওঁরা আগেই জানতেন। ইউসুফ তখন মাঝ আকাশে, তিন মাসের পথের তখনও এক মাসের বেশি সময় বাকি, ওর আব্বার পডে নাকি সংক্রমণ দেখা দেয় টাইটানে পৌঁছানোর দিন পনেরো আগে, ফলে মূল যান থেকে সেই সেমি ইকোনমি আর ইকোনমি পডগুলি মাঝপথে আলাদা করে স্যাটার্ন স্পেস স্টেশনে পাঠানো হয়, প্রিমিয়াম পডগুলিকে টাইটানের বিশেষ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে ইউসুফের পৌঁছানোর দিন সাতেক আগে সাবিনা সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু জেনারেল ওয়ার্ডে সংক্রমণ ছড়ানোয় রোবট ডাক্তাররা সমস্ত নবজাতককে ক্রায়ো চেম্বারে পাঠিয়ে দেয়। আব্বা কিম্বা সাবিনা, কারোর সঙ্গেই আর দেখা হয়নি ইউসুফের। তারপর পৃথিবীতে ফেরা পর শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভরতি হয় ইউসুফ—এই যান্ত্রিক ফুসফুস সেইবারই পাওয়া। একই সমস্যায় তার আম্মিও যান্ত্রিক ফুসফুস পেয়েছিলেন আরও কয়েক বছর আগেই। একটানা এক বছর ক্রায়ো স্লিপে পড়েছিল তার ছেলেটা। কাজেই ২১১৪ সালে জন্মালেও এই ২১১৮ সালে তার বয়স তিন বছরই লেখা আছে সরকারি নথিতে। যাত্রীরা এবার শুনতে পায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঘোষণা, ট্রাম, ক্যাপসুল বোট কিম্বা অন্যান্য সাধারণ যানবাহনের তুলনায় এই কণ্ঠস্বর অনেক অনেক আলাদা—পরিষ্কার, মধুর, সুরেলা। মূল যে সেন্টিয়েন্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি হয়েছিল ২০৭৬ সাল নাগাদ, এখনও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, মহাকাশযাত্রা, দুর্লভ খনিজের বন্টন, রাষ্ট্রনায়কদের মঙ্গলজনক কর্মসূচি, দক্ষতা অনুযায়ী বিভিন্ন কাজে শ্রমিকদের বহাল করা ইত্যাদি সবথেকে জরুরি কাজগুলি এই এ আই নিজেই দেখাশোনা করে। পাশাপাশি নিজের সার্ভারে চাপ কমাতে আর সরকারের খরচ বাঁচাতে, রাষ্ট্রনায়কদের অনুপ্রেরণায় অনেক অনুসারী এ আই বানিয়ে তাদের বিভিন্ন সাধারণ দায়িত্বে বহাল করেছে সে, যেমন জনতার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক অপরাধ দমন, জন পরিবহন, পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি। একসময় যন্ত্রমানবদের বহাল করারও চেষ্টা হয়েছিল রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য। কিন্তু ইউসুফের আব্বার আমলে সমস্ত শ্রমিক ইউনিয়নগুলো মিলে প্রমাণ করে দেখিয়ে দেয় যে যন্ত্রমানবদের থেকে অনেক কম খরচে কাজ করতে পারে মানুষরা।।
একে একে দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নির্দেশ ভেসে আসে যাত্রীদের উদ্দ্যেশ্যে, যেগুলোর সবই কিম্বা অন্তত সারাংশটুকু ইউসুফ আর তার সহযাত্রীদের মুখস্থই হয়ে গেছে এতদিনের যাতায়াতের ফলে। চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে থাকা ইউসুফ শেষবারের মতো বাড়ির কথা ভাবতে থাকে, ছয় মাস যাতায়াত আর ছয় মাস কাজ। আবার এক বছর পর ছয় মাসের জন্য ফিরবে সে। আর ভাবতে থাকে ছোটোবেলার কথা—তার আব্বা দূরদেশে যাচ্ছে কাজের জন্য, দাদা যাচ্ছে ট্রেনে করে… একটু একটু করে যেন দাদার মুখটা ইউসুফের মুখের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। ট্রেনে করে ইউসুফ যাচ্ছে কাজের দেশে।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান, শৌভিক সিনহা