সূর্যহরণের পরে
লেখক: সৌম্যসুন্দর মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
এখন (রাত এগারোটা পাঁচ)
নিকষ কালো রাতে পাহাড়ের গা বেয়ে কোনোক্রমে উঠতে উঠতে রাকা ভাবছিল, উপলহ্রদটা আর কত দূর। সে খুব ভালো করেই জানে, দেরি হয়ে গেলে তার বুড়ি দিদিমার শরীরের একটুও উদ্ধার করার মতো থাকবে না। সবাই জানে, পাহাড়ের উপরে এই হ্রদটা ভালো জায়গা নয় – পূর্ণগ্রাসের ছায়ামূর্তিগুলো এখানে ঘুরে বেড়ায়; মানুষ পেলেই তার আত্মার সব শক্তি চুষে নিয়ে ওরা তাদের বন্দি করে রাখে রংবেরঙের অজস্র নুড়িপাথরে।
আজ ঘর থেকে বেরনোর আগে তার ভাই মণি দেখে ফেলেছিল তাকে। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন হল, “দিদি, কোথায় যাচ্ছিস এত রাতে?”
রাকা বলেছিল, “এখানে তো সবসময়ই রাত। যা, তুই ঘুমো, আমি আসছি একটু পরে।”
মণি বলেছিল, “আমার ঘুম আসছে না। খুব ভয় করছে রে। ওরা এই একটু আগে দিদিমাকে নিয়ে গেল, আবার এখন তুইও চলে যাচ্ছিস। এই একলা, ফাঁকা ঘরে আমি ঘুমোব কী করে?”
কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়েছিল রাকা। দিদিমা চলে যাওয়ার পর কঠিন সিদ্ধান্তগুলো কাউকে না কাউকে তো নিতেই হবে।
এগিয়ে এসে ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে দিল রাকা। “দেখ, আমি রেণুকাকিমাকে বলে রেখেছি, সে তোর খেয়াল রাখবে। একটু পরেই হয়তো এসে পড়বে। আমাকে এবার যেতেই হবে রে। যদি কাজটা করতে পারি, দিদিমাকে হয়তো জ্যান্ত ফিরিয়ে আনতে পারব।”
“আর যদি না পারিস?”
ছোট্ট ছেলেটাকে কী উত্তর দেবে, রাকা ভেবে পায় না। একটু বোকা-বোকা হেসে সে বলল, “আমি কথা দিয়ে যাচ্ছি, এইসব ঝামেলা মিটে গেলে তুই আর আমি একদিন পশ্চিমের পাহাড়ে গিয়ে নিজেদের হাতে করে সোনালি ঘোড়াদের ঘাস খাইয়ে আসব।”
মণি একগাল হেসে বলল, “সত্যি?”
“পাক্কা কথা। তুই এবার ঘুমিয়ে পড়। সকালে যখন উঠবি, তখন দেখবি, আমাদের ঘরে আরেকটা মানুষকে আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছি।”
এখন উপলহ্রদের সামনে দাঁড়িয়ে রাকার মনে হচ্ছিল, ভাইকে দিয়ে আসা কথা সে আর রাখতে পারবে না। এই জায়গায় কোথায় খুঁজবে সে দিদিমাকে?
বিরাট হ্রদ—তার সুবিশাল বেলাভূমি জুড়ে ছড়িয়ে আছে হাজার হাজার রঙিন নুড়িপাথর—লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি, হলুদ, গোলাপি। জগতের সব রঙের যেন মেলা বসে গেছে এই নক্ষত্রখচিত প্রায়ান্ধকার হ্রদের তীরে। নুড়িগুলোর নিজস্ব একটা আভা আছে; হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন হ্রদের জলে প্রতিফলিত নক্ষত্রগুলোর মতোই তারা অজস্র জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে আছে।
এত হাজার হাজার পাথরের মধ্যে দিদিমা কোনটা, বুঝব কী করে?
ঠোঁট কামড়াল রাকা। পাথরগুলোর থেকে আসা আভা পড়েছে তার মুখের বাম দিকে; তাকেও যেন একটা পাহাড়ি ভূতের মতোই লাগছে। একটু দূরে মার্বেলের তৈরি বিরাট গোলাকার মূর্তিটা আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে।
সূর্যদেবের এই মূর্তিটা বহুকাল আগে গ্রামের মোড়লরা তৈরি করে দিয়েছিল এখানে—দেব দিবাকরকে শ্রদ্ধা জানাতে। এ মূর্তির গৌরব অনেকদিনই হারিয়ে গেছে। রাকা দেখল, নুড়িগুলোর বিচিত্রবর্ণ আলোর আভাস স্থির হয়ে আছে মূর্তিটার সাদা গায়ে। পাহাড়ের ওদিক থেকে একটা মৃদু হাওয়া বয়ে এল; রাকার চুলগুলো কপালের উপর উড়ে এসে পড়ল; শান্ত হ্রদে হালকা তরঙ্গ উঠল; কালো জলের গায়ে কেঁপে উঠল তারাদের মুখ।
“এই হ্রদটা ভালো জায়গা নয়,” দিদিমা প্রায়শই বলত।
জায়গাটা যে ভালো নয়, সেটা রাকা যেন অনুভব করতে পারছিল। এখানের প্রাকৃতিক দৃশ্য এক কথায় অসাধারণ। কালো জলে তারায় ভরা কালো আকাশ স্থির হয়ে আছে আয়নার মতো, দূরের পাহাড়চূড়াগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে অস্পষ্ট অন্ধকারে, গোলাকার সূর্যমূর্তির গা থেকে বেরিয়ে আসছে মার্বেলের তৈরি অগ্নিশিখা, পায়ের কাছে নানা রঙের ঝকঝকে নুড়িপাথরের সমারোহ—এ দৃশ্য থেকে নজর ফেরানো দায়। কিন্তু চোখে যতটুকু দেখা যাচ্ছে, তার চেয়েও বেশি কিছু যেন আছে এখানে। অদ্ভুত একটা প্রাণহীন নিস্তব্ধতা আচ্ছন্ন করে রেখেছে পুরো জায়গাটাকে—এই নীরবতার যেন নিজস্ব কণ্ঠস্বর আছে। সে কণ্ঠস্বর যেন ওর কানে কানে বলে যাচ্ছে, পূর্ণগ্রাসের অপচ্ছায়াদের এই জগতে কোনো জ্যান্ত মানুষের না এলেই মঙ্গল।
আজ ‘সকালে’ দিদিমাকে যখন গ্রামের লোক এখানে নিয়ে এল, তখন তারও হয়তো এমনটাই মনে হচ্ছিল। বলি দিতে যাদের এখানে আনা হয়, তারা সবাই হয়তো…
রাকার মনে হল ওই পাহাড়ের ওখান থেকে কেউ যেন তাকে দেখছে। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার।
পূর্ণগ্রাসের অপচ্ছায়াদের দেহ অন্ধকার দিয়ে তৈরি; জ্যান্ত মানুষগুলোকে নুড়িপাথরের মধ্যে বন্দি করে ফেলে রেখে তাদের জীবনীশক্তি গ্রাস করতে থাকে ওরা একটু একটু করে। এই উপলহ্রদের তীরে লক্ষ লক্ষ নুড়ি পড়ে আছে; সেগুলোর মধ্যেই ওরা ফেলে রাখে নুড়ি হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে, রাকা এ কথা বহুবার শুনেছে গ্রামের বুড়োবুড়িদের কাছে।
চুপ করে তাকিয়ে রইল সে পাথরগুলোর দিকে। দিদিমাকে যদি ওরা ইতিমধ্যেই কোনো একটা নুড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে থাকে, তাহলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
হঠাৎ একটা গন্ধ পেয়ে চমকে উঠল রাকা। জুঁইফুলের জোরালো গন্ধ আসছে নাকে। সবাই জানে পূর্ণগ্রাসের অপচ্ছায়াদের দেহ থেকে ফুলের গন্ধ ছাড়ে। হ্রদের পাশ থেকে দ্রুত সরে গেল সে দক্ষিণ দিকে বিরাট বড়ো পাথরের চাঁইগুলোর দিকে। অপচ্ছায়াগুলো যদি একবার তাকে দেখতে পায়, সঙ্গে সঙ্গে রঙিন নুড়ি বানিয়ে দেবে।
তার জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে লাল রঙের ছোট্ট পাথরটার অস্তিত্ব অনুভব করে নিল সে। গ্রামের লোক যখন দিদিমাকে নিতে এসেছিল, তার কিছুক্ষণ আগেই দিদিমা জিনিসটা দিয়েছিল তাকে। সত্যিই কি মা বন্দি হয়ে আছে এই লাল নুড়িটার মধ্যে?
সে দেখতে পেল, একটা পূর্ণগ্রাসের ছায়াশরীর ভেসে যাচ্ছে হ্রদের দিকে। জলের উপর এসে দাঁড়াল সে; কিন্তু তার পায়ের পাতা একটুও ভিজল না। তারার আলোয় রাকা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিল, অপচ্ছায়াটার শরীর থেকে একটা মারাত্মক অশুভ শক্তির বিচ্ছুরণ হয়ে চলেছে।
আরও ছায়াশরীর নিঃশব্দে জমা হচ্ছে হ্রদের তীরে; জুঁইয়ের গন্ধে ভরে উঠেছে চারপাশ। গন্ধটা এতটাই তীব্র যে তার মনে হল যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। দু-আঙুলে নাক বন্ধ করে মুখ দিয়ে নিশ্বাস নিল সে কিছুক্ষণ। দীর্ঘ ছায়াশরীরগুলো ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে গোল করে, সবার মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে আছে, যেন নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে ওরা।
এবার সোজা হয়ে দাঁড়াল ছায়ামূর্তিগুলো। নুড়িদের আলোয় কী অদ্ভুত লাগছে ওদের! ওদের মধ্যে একজন ভাসতে ভাসতে এসে দাঁড়াল বিরাট পাথরের চাঁইটার সামনে। কোনোক্রমে পাথরের পেছনে লুকিয়ে রইল রাকা।
সর্বনাশ! বুঝে ফেলল নাকি?
ছায়াটা ফিসফিসিয়ে কথা বলল বটে, কিন্তু পাহাড়ের নিঃস্তব্ধতার মধ্যে প্রত্যেকটি শব্দ পরিষ্কার শোনা গেল।
“শোনো মেয়ে, বহুদিন আগে আমাদের কাছ থেকে যে জিনিস চুরি গেছে, তা যদি ফেরত দিতে পারো, তাহলে আমরা তোমার দিদিমাকে ফেরত দেব, আর তোমাদের দুজনকেই জ্যান্ত বাড়ি ফিরতে দেব। কিন্তু যদি না পারো… ”
***
আজ (পনেরো ঘণ্টা আগে, সকাল আটটা)
দিদিমা বলল, “মণি এখনও ঘুমোচ্ছে। রাকা, তুই বোস এখানে। তোকে কয়েকটা কথা বলার আছে।”
দিদিমার হাতে ছোট্ট লাল পাথরটা জ্বলজ্বল করছে। রাকা অবাক হয়ে বলল, “দিদিমা, এটা কি চুনি?”
“চুনি লাল রঙেরই হয় বটে। কিন্তু এ জিনিস চুনি নয়, তার চেয়েও অনেক দামি। পয়সা দিয়ে এর মূল্য হয় না। রাকা, এটা দিয়ে তোর মাকে হয়তো আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব।”
রাকা তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে। দিদিমা একটু হেসে বলল, “দেখ, আমার হাতে আর বেশি সময় নেই। গাঁয়ের লোক আমাকে নিয়ে যেতে এল বলে। অপচ্ছায়াগুলো গতকাল থেকেই আমার নাম ফিসফিস করে বলছে, শুনেছিস নিশ্চয়ই?”
রাকা মাথা নাড়ল। শুনেছে সে। সে জানে, যখন এইভাবে কারও নাম ধরে ওরা ডেকে পাঠায়, সে ব্যাক্তির এই জগতে আয়ু আর কয়েক ঘণ্টা মাত্র।
তার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল দিদিমা। “উঁহু, যাওয়ার আগে আমি তোর চোখে জল দেখতে চাই না। হাসিমুখের স্মৃতি নিয়েই এখান থেকে যেতে চাই আমি।”
গলার মধ্য থেকে উঠে আসা কষ্টের দলাটাকে জোর করে গিলে নিল সে। গ্রামের লোক আসছে; তারা এসে দিদিমাকে উৎসর্গ করতে নিয়ে যাবে পাহাড়ের পূর্ণগ্রাসের অপচ্ছায়াদের কাছে।
শুকনো মুখে সে বলল, “এখন কি হাসি আসা সম্ভব, দিদিমা?”
দিদিমা দিব্যি হেসে উঠল। “আরে, আরে, কী হল তোর? এত দিন ধরে কী শিখিয়েছি, ভুলে গেলি? জীবনে একটা সময় সবাইকেই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”
অবাধ্য চোখের জল কেবলই গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। হাত দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে রাকা বলল, “আমি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে আমার ভালো লাগে না।”
দিদিমা বলল, “সাহসী হ, রাকা। আমি যখন থাকব না, তখন ছোটো ভাইটার দায়িত্ব তো তোকেই নিতে হবে। কিন্তু হাতে বেশি সময় নেই। ওরা আমাকে নিয়ে যাওয়ার আগেই তোকে একটা কথা বলে নিতে হবে। অনেক দিন ধরেই ‘বলব-বলব’ ভাবছি, কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি।”
দিদিমার মুখ গম্ভীর। রাকা তার দিকে তাকিয়ে রইল। দিদিমা হাত নেড়ে আরও কাছে ডাকল তাকে।
“কী কথা গো দিদিমা?”
“বলছি, কিন্তু তোকে কথা দিতে হবে, এর একটা কথাও তুই তোর ভাইকে বলবি না। এইসব ভয়ংকর গল্প শোনার বয়স হয়নি এখনও ওর। তোকেও এতদিন বলিনি, কারণ যে যন্ত্রণার বোঝা নিয়ে আমি এতদিন কাটালাম, সে বোঝা আমি তোর উপর চাপিয়ে দিতে চাইনি রে। কিন্তু এখন না বলে আমার উপায় নেই।”
রাকা কথা দিল, সে এই ব্যাপারে মুখ বন্ধ রাখবে। তারপর দিদিমা যে গল্পটা শোনাল, তার মতো অদ্ভুত ব্যাপার সে জীবনে শোনেনি।
শেষবার পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়েছিল পনেরো বছর আগে। সেই গ্রহণ থেকে সূর্যদেব আর বেরিয়ে আসেননি।
ঠিকই বলছি। গতবার সূর্য যেই গ্রহণের ছায়ায় ঢাকা পড়লেন, অমনি ওই অশুভ অপচ্ছায়াগুলো তাঁকে বন্দি করে ফেলেছিল ওই পাহাড়ের কোনো এক গোপন বন্দিশালায়।
সেই তখন থেকে আমরা ওই ছায়াগুলোর দাস হয়ে আছি। অন্ধকার দিয়ে তৈরি ওদের শরীর; ওরা মানুষের জীবন চুষে খেয়ে বেঁচে থাকে। ওরা একমাত্র ভয় পায় আলোকে—সূর্যের আলোকে। স্বয়ং সূর্যদেবকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে ওদের সেই ভয়টুকুও আর নেই।
যে মুহূর্তে ওরা সূর্যকে বন্দি করল, সেই মুহূর্তে আমাদের গ্রামের সব আলো নিভে গেল। এই চিরন্তন অন্ধকার এসে গিলে ফেলল আমাদের। ওই অপচ্ছায়াগুলো প্রত্যেক বছরের জন্য আমাদের কৃত্রিম আগুন তৈরি করে দেয় বটে, কিন্তু তার জন্য আমাদের কম মূল্য দিতে হয় কি?
হুঁ, ঠিকই জানিস তুই। একটা মানুষ দিতে হয় ওদের। এক বছরের গোটা গ্রামের আগুনের দাম।
ওরা প্রথম কাকে নিয়েছিল, সেই কথাটা শুধু তুই জানিস না। তোর মা-কে।
যে-কোনো কারণেই হোক, অপচ্ছায়াগুলো তাদের প্রথম বলি হিসাবে চেয়ে নিয়েছিল তোর মা-কে। পুরো গ্রামের বাতাস ভরে উঠেছিল ওদের ফিসফিসানিতে; আমার মেয়েটার নাম ধরে ডেকেই চলেছিল ওরা। কী করে আমার মেয়েকে রক্ষা করব, আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না।
দেয়ালে ছবিটা আরেকবার দেখ, রাকা। তোর মা যে কী সুন্দরী ছিল, তোর মনে নেই, বল? খুব ভালোবাসত ও তোদের দুই ভাইবোনকে। একটা কথা বলে রাখি তোকে। যখনই কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বি, মায়ের মুখটা মনে করিস। সবসময় মনে রাখবি, তোদের জন্য তোদের মা তার সর্বস্ব বিসর্জন দিয়েছিল। তোদের মঙ্গলের জন্য মরতে একটুও ভয় পায়নি সে।
সে বোধহয় আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল, অপচ্ছায়াগুলো বলি হিসাবে তাকেই চাইবে। আমাকে একবার বলেছিল, “মা, তুমি আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমি যাওয়ার পর শুধু বাচ্চাদুটোকে দেখো।”
আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওকে আটকাতে। আমি বলেছিলাম, ওর পরিবর্তে আমিই যাব উপলহ্রদের তীরে পাহাড়ের উপরে অপচ্ছায়াদের কাছে। কিন্তু ও বলেছিল, “মা, তুমি তো জানো, কাউকে না কাউকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হয়।”
তখন আমি বুঝেছিলাম, ও ঠিক কথাই বলছে। ওই অপচ্ছায়াগুলো ওর জীবন চায়—ওর সঙ্গে ওদের ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল। আমি বুঝেছিলাম, আমার ডাক না আসা পর্যন্ত এখানে তোদের মানুষ করে তোলাই এখন থেকে আমার কাজ। আমি আর ওকে আটকানোর চেষ্টা করিনি। গাঁয়ের লোক এসে ওকে পাহাড়ে নিয়ে গেল।
সে কী অদ্ভুত দৃশ্য! ওরা মিছিল করে ওকে নিয়ে যাচ্ছে, আর আমার খালি মনে হচ্ছে, মরা মানুষ যেন নিজেই হেঁটে যাচ্ছে সমাধিস্থ হবে বলে। গাঁয়ের লোক পুরো রাস্তাটা ওর সঙ্গে সঙ্গে গেল। না না, ভালোবাসায় নয়; ওরা বোধহয় ভয় পাচ্ছিল, সঙ্গে না থাকলে যদি ও দৌড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যায়। আমিও ওর পাশে পাশে হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম, আমার মেয়েটা কী ভীষণ সাহসী। আকাশে তো আর সূর্য নেই; চারপাশ ঘোর অন্ধকার। আমরা মশাল নিয়ে মিছিল করে যাচ্ছিলাম। এই মশালের আগুন ওই পূর্ণগ্রাসের অপচ্ছায়ারা আমাদের দিয়েছিল; এক বছর পূর্ণ হলেই সে আগুন নিভে যাবে, যদি না বছরে একটা করে জ্যান্ত মানুষ ওদেরকে আমরা ভেট পাঠাই। গাঁয়ের লোক জানত, এইটুকু আগুন না থাকলে আমরা না খেয়ে কিংবা শীতে জমে মরব।
পাহাড়ের উপরে অন্ধকার হ্রদটার কাছে এসে পৌঁছলাম আমরা। অত উঁচুতে উঠে তখন আমি রীতিমতো হাঁপাচ্ছি। সেই অবস্থাতেই দেখলাম, তোর মা সেই গোলাকার সূর্যের মূর্তিটার কাছে গিয়ে কাঁদছে। এই প্রথমবার ওর চোখে জল দেখলাম আমি; বুঝতে পারলাম, এ কান্না ভয়ের নয়, ভালোবাসার। তোর মায়ের মতো সাহসী মেয়ে আমি কোনোদিন দেখিনি রে। নিজের জীবনের ভয় একবারের জন্যও পায়নি ও—কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস ছিল ওর। ও কাঁদছিল সূর্যের জন্য, ও কাঁদছিল তোদের জন্য—তোদেরকে ও কত ভালোবাসত, তোরা তো জানতেই পারলি না।
জায়গাটা যে ভালো নয়, সে আমরা হ্রদের ধারে দাঁড়িয়ে আমাদের অস্থিমজ্জায় অনুভব করতে পারছিলাম। মনে হচ্ছিল, শরীরের রক্ত যেন জমে যেতে চাইছে, বুকের মধ্যে অকারণেই খুব ধড়ফড় করছে, আর সবার নাকে ফুলের গন্ধ আসছে। গন্ধটা বাড়তে লাগল। আমরা দেখলাম, অন্ধকারের মধ্য থেকে বিরাট বিরাট ছায়ামূর্তি উঠে আসছে; তারা এগিয়ে আসছে গোলাকার সূর্যমূর্তিটার দিকে। ওদের উপস্থিতির মধ্যেই এমন ভয়ংকর একটা কিছু ছিল যে গাঁয়ের যে ক’জন লোক এসেছিল, তারা ভয়ে চিৎকার করে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচের দিকে দৌড় দিল।
প্রথমে আমিও ছুটেছিলাম ওদের সঙ্গে, কিন্তু তারপর ভাবলাম, “থেকে গেলে কেমন হয়?”
থেকেই গেলাম আমি। দেখতে পাচ্ছিলাম, সূর্যমূর্তি থেকে একটু দূরে আমার একলা মেয়েটাকে ঘিরে ধরেছে অশুভ অপচ্ছায়ার দল। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, ও যে আর বাঁচবে না, সে কথা তো আমি জানিই। তাহলে রয়ে গেলাম কেন? নিজের মেয়ের মৃত্যু স্বচক্ষে দেখব বলে? না। আমার মনে তখনও আশা ছিল, যদি মৃতদেহটাও অন্তত পাই, তাহলে আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে সম্মানের সঙ্গে সমাধিস্থ করতে পারব।
গাঁয়ের লোক সব অনেকক্ষণ পালিয়েছে। আমি একটা বিরাট পাথরের আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখছি ওরা কী করে। কিন্তু মেয়ের দেহটা ফিরে পাওয়ার আশা আমার আর রইল না।
ওই পূর্ণগ্রাসের অপচ্ছায়াদের শরীর তোর-আমার মতো রক্তমাংসে তৈরি নয়, বুঝলি? ওরা অন্ধকারের সত্তা—আলোর না-থাকা দিয়ে ওদের শরীর গড়া। ওরা কীভাবে খায়, তুই বোধহয় জানিস না। ওরা বলির মানুষটাকে প্রথমে অজ্ঞান করে, তারপর তাকে বন্দি করে ফেলে ওই নুড়িগুলোর মধ্যে। তারপর ধীরে ধীরে—বছরের পর বছর ধরে—তার জীবনীশক্তি শুষে নিতে থাকে মানুষটার মধ্য থেকে। ‘মুখ’ বলতে আমরা যা বুঝি, সেইরকম কোনো মুখ ওদের নেই; মানুষদের মতো দেহের কলকব্জা নেই ওদের। কিছু না খেয়েও ওরা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে যুগের পর যুগ। কিন্তু ওদের আসলে কীসের খিদে, আমি সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলাম রে।
ওরা আসলে ক্ষমতা চায়।
সূর্যকে বন্দি করে ওরা আমাদেরকে ওদের হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছে। এই ক্ষমতাই ওরা চেয়েছে বরাবর। ওরা পূর্ণগ্রাসের অপচ্ছায়া—ওরা রাহুর উপাসক—সূর্য যা, ওরা তার ঠিক উলটো। সূর্যদেব আমাদের আলো দেন, জীবন দেন; ওরা ঠিক ওই দুটি জিনিসই কেড়ে নিয়েছে আমাদের কাছ থেকে।
পাথরের পেছন থেকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, ওরা ফিসফিস করে তোর মাকে কীসব যেন বলছে। আমার মেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অকুতোভয়ে উত্তর দিচ্ছে। দেখে অবাক হয়ে গেলাম, সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও এতটুকু ভয় পায়নি সে।
সে ভারি অদ্ভুত দৃশ্য, বুঝলি রাকা! একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছ-টা বিরাট ছায়ামূর্তির মাঝখানে এই হ্রদের তীরে। ওদের শরীরের মধ্য দিয়ে আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি। আমি দেখলাম, ও সেই সূর্যমূর্তিটার দিকে আঙুল তুলে কী যেন একটা বলল। বিশাল, কালো থামের মতো অপচ্ছায়াগুলো শরীর দোলাতে লাগল, যেন ওর কথা শুনে ওদের খুব হাসি পাচ্ছে। তারপর ওরা ওকে ইশারা করল ওদের সঙ্গে যেতে।
হ্রদের তীরের উজ্জ্বল নুড়িগুলোর উপর দিয়ে ওদের দেহগুলো ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল। তোর মা হেঁটে চলল ওদের সঙ্গে। তার সামনে রইল তিনজন, পেছনে তিনজন—যাতে সে হঠাৎ দৌড়ে পালাতে না পারে। তোর মাকে দেখে অবশ্য মনে হচ্ছিল না সে পালানোর কথা ভাবছে। আমি জানতাম, সে একবার যখন কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছে, তখন ওসব চিন্তা আর তার মাথায় আসবে না; সে জানে, সে যদি পালায়, তাহলে তোদের উপর আর গাঁয়ের বাকি লোকেদের উপর বিরাট বড়ো আঘাত নেমে আসবে। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, ওর হাতে ধরা কৃত্রিম আগুনের মশালের আলো দেখা যাচ্ছে ওর পেছনের তিনটে অপচ্ছায়ার পাতলা পর্দার মতো শরীর ভেদ করে। একটুও হাওয়া বইছে না; চারপাশটা কী ভীষণ ঠান্ডা!
ওরা এসে দাঁড়াল সূর্যমূর্তিটা থেকে কিছুটা দূরে।
একটা ছায়া তোর মায়ের কানে কানে কী যেন বলল। মনে হল, সে ওকে ওই গোলাকার মূর্তিটার নীচে হাঁটু গেড়ে বসতে বলছে।
তারপর দেখলাম, ও সাবধানে খোঁচা খোঁচা মার্বেলের রশ্মিগুলো এড়িয়ে বিশাল মূর্তিটার তলায় হাত বাড়িয়ে কী যেন একটা খুঁজছে। আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। অপচ্ছায়াগুলো একবার সূর্যমূর্তিটার দিকে তাকিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল।
ওরা ভয় পায় এই মূর্তিটাকে!
এ তো আসল সূর্যই নয়, তবুও ওরা যখন ওই মার্বেলের মূর্তি থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইল, তখন স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ওরা ওটার কাছে যেতে পারে না। আমাদের পূর্বপুরুষরা ওই মূর্তি স্বয়ং দেব দিবাকরের উদ্দেশে উৎসর্গ করেছিলেন। তখন থেকেই তাঁকে আমরা জগতের জীবনদাতা আর আমাদের গ্রামের রক্ষাকর্তা বলে মেনে এসেছি। এই ভেবে মনে মনে একটু খুশি হলাম যে দেব দিবাকরের একটা মূর্তিকেও এই অশুভ অপচ্ছায়ারা এত ভয় পায়।
ওই মূর্তি জীবনের প্রতীক—ওরা তো তাকে ভয় পাবেই!
আমি শুনেছিলাম, আমাদের পূর্বপুরুষরা নাকি ওই হ্রদের তীরে কোনো এক জায়গায় একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিলেন; সে সুড়ঙ্গ চলে গেছে পাহাড়ের গভীর পর্যন্ত। বর্বর উপজাতিদের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য বহুকাল আগে এইসব সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো যে ঠিক কোথায়, আজ আর কেউই জানে না। জানি না কেন, তোর মাকে ওখানে দেখে হঠাৎ বহুদিন আগে শোনা সেই সুড়ঙ্গের গল্পগুলো মনে পড়ে গেল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, আমি যা ভাবছিলাম, ঠিকই ভাবছিলাম।
তোর মা ওই সূর্যমূর্তির নীচে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা করল—বোধহয় কোনো যন্ত্রের হাতল ধরে টান দিল। তারপরেই দেখতে পেলাম, পাহাড়ের পূর্বদিকে একটা বিরাট সুড়ঙ্গের মুখ খুলে গেল। সে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটু থেকে ধুলো ঝাড়ছে, তখন অপচ্ছায়াগুলো তাকে ইশারায় সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকতে বলল।
একে একে ওই অন্ধকার পথে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল ওরা। তোর মায়ের হাতের মশালটা জ্বলতে লাগল সুড়ঙ্গের মুখের সামনে। এইটুকু আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি যে এখানে আছি, ওরা বুঝতে পারেনি। ওরা ঢুকে যাওয়ার পর “যা হয় হোক” ভেবে আমিও ঢুকে পড়লাম ভেতরে।
ভেতরে ঢুকে হাঁটছি তো হাঁটছিই। হাঁপ ধরে গেল হাঁটতে হাঁটতে। তোর মায়ের হাতের মশালটা ছাড়া আর তো কোনো আলো নেই ভেতরে; আর ওরা ততক্ষণে আমার থেকে অনেকটা এগিয়ে গেছে। সুড়ঙ্গের ভেতরটা খুব একটা চওড়া নয়। দেখতেই পাচ্ছিস, আমি লম্বাও নই, তবু ভেতরের এবড়োখেবড়ো পাথুরে ছাদে আমার মাথা ঠেকে যাচ্ছিল। ওই সরু রাস্তার দু’পাশের দেওয়াল থেকে মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে এসেছে খোঁচা খোঁচা পাথর। সুড়ঙ্গপথে অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে ওদের মশালের আলোর আভাটুকু। সেই আলোয় কোনোক্রমে যথাসম্ভব বিনাশব্দে এগোতে লাগলাম আমি। খুব ভালো করেই জানতাম, দুর্ভাগ্যক্রমে একটা শব্দও যদি করে ফেলি, আমাকেও আর জ্যান্ত ফিরে যেতে হবে না। সুড়ঙ্গের ভেতরে আমার তখন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে; তোর আর তোর ভাইয়ের মুখদুটো খালি মনে পড়ছে। তবু সাবধানে পা টিপে টিপে এগিয়ে চললাম আমি সেই অন্ধকারের মধ্য দিয়ে।
হঠাৎ শুনতে পেলাম, তোর মা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। পাথরের উপর আওয়াজ শুনে অনুমান করলাম, সে সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। এত দূর থেকে বুঝতে পারলাম না কী হচ্ছে। খুব সন্তর্পণে এগোতে লাগলাম আমি। আমার সাহসী মেয়েটা হঠাৎ এত ভেঙে পড়ল কেন, দেখতেই হবে আমাকে।
আরও কিছুটা যাওয়ার পর দৃশ্যটা দেখতে পেলাম। একটা লোক অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে গুহার মেঝেতে—মরেও গিয়ে থাকতে পারে। গায়ের রং তামাটে, শক্তপোক্ত চেহারা, চৌকোমতো চোয়াল। তার অসাড় দেহটার পাশে বসে তোর মা ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
আমি মনে মনে যেন বুঝতে পারছিলাম, লোকটা কে।
একটা অপচ্ছায়া বলল, “দেখতেই পাচ্ছ, আমরা মিথ্যে কথা বলিনি। হ্রদের নীচের রাস্তাটা দিয়ে ওকে এখানে নিয়ে এসেছি আমরা। এবার তুমি নিজেকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিতে রাজি তো?”
হতবুদ্ধির মতো তোর মা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”
“তাহলে নিজের হাত কেটে রক্ত বার করো।”
গুহার মেঝেতে অজস্র ধারালো পাথর পড়ে আছে। ও একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে নিজের বাম হাতের উপর বসিয়ে টানতেই হাত কেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল।
ও হাতটা একটু নাড়তেই প্রথম ফোঁটাটা টপ করে গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু ততক্ষণে অপচ্ছায়াগুলো ওদের বাম হাতগুলো উপরে তুলে কী একটা মন্ত্র পড়তে শুরু করেছে। রক্তবিন্দুটা মাটিতে আর পড়ল না, শূন্যে ভেসে রইল একটা চুনির মতো। ওরা যে মন্ত্রটা বলছে, আমি সেটা শুনে শুনে মনে রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম।
ওরা একসঙ্গে বলল, “তোমার জীবন এখন থেকে আমাদের হল। আজ থেকে তুমি তোমার এই প্রভুদের পুষ্টি জোগাবে। রক্তের বন্দি হয়ে থাকবে তুমি, যতদিন না আবার সূর্য উঠছে। এ কথাও নিশ্চয় বুঝতেই পারছ, সূর্য আর কোনোদিন উঠবে না।”
রক্তবিন্দুটা ওদের ইশারায় ভাসতে ভাসতে এসে থামল ওর মাথার উপর। তারপর ওরা একসঙ্গে হাত নামাতেই সেটা এসে পড়ল ওর গায়ে, আর সঙ্গে সঙ্গে ও অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি যে কীভাবে চিৎকার করে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলেছি, সে কেবল আমিই জানি। লাল পুঁতির মতো জমাটবাঁধা রক্তের ফোঁটাটা মাটিতে এসে পড়ল একটা ছোট্ট পাথর হয়ে।
আমার মেয়ে ওই পাথরের মধ্যে বন্দি হয়ে গেল চিরকালের জন্য!
মাটিতে পড়ে থাকা মশালটা তখনও জ্বলছে। সেটাকে ওখানে ফেলে রেখেই অপচ্ছায়াগুলো ফিরে দাঁড়াল। আমি তাড়াতাড়ি একটা বড়ো পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। ওরা আমাকে খেয়াল করেনি; বিরাট বিরাট ছ-টা বাদুড়ের মতো আমার সামনে দিয়ে ভেসে চলে গেল ওরা সুড়ঙ্গমুখের দিকে।
দম বন্ধ করে আমি আরও কিছুক্ষণ ওখানেই অপেক্ষা করলাম। জানতাম, এই সুড়ঙ্গের মুখটা ওরা বন্ধ করতে পারবে না, কারণ তাহলে সেই সূর্যমূর্তিটার কাছে ওদের যেতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ লুকিয়ে থাকার পর যখন মনে হল, ওরা আপাতত আর এদিকে আসছে না, তখন আমার লুকোনোর জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে এগিয়ে গেলাম মেঝের উপর মড়ার মতো পড়ে থাকা লোকটার দিকে।
হঠাৎ দিদিমা থেমে গেল। ওদের কুটীরের বাইরে বহু মানুষের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। গভীর শ্বাস টানল রাকা। “ওরা এসে গেছে!”
দিদিমা তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল, “রাকা, এবার আমাকে যেতে হবে। এই গল্পের শেষের কথা আর তোকে বলার সময় নেই, কিন্তু এই ছোট্ট লাল পাথরটা সবসময় নিজের কাছে রাখিস। এটা ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে তোর মাকে বন্দিদশা থেকে হয়তো একদিন ফিরিয়ে আনতে পারবি। সাবধানে রাখ, হারাস না এটা।”
দিদিমা ওর কপালে চুমু খেল। ছোট্ট মণি এসে তার ছোটো ছোটো হাত দিয়ে একবার জড়িয়ে ধরল দিদিমাকে। গাঁয়ের মোড়ল শুকনো মুখে ঘরে ঢুকে বলল, “কিছু মনে করবেন না, কিন্তু এবার যেতে হবে।”
দিদিমা একটু হেসে বলল, “আমি জানি, সনাতন। আমি তৈরি হয়েই আছি। আর পাঁচ মিনিট সময় দাও, আমি যাচ্ছি।”
মাথা নেড়ে সনাতন মোড়ল বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। দিদিমা বলল, “রাকা, তোকে আর একটা কথাই বলার আছে। জীবনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারবি তো তুই?”
রাকা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে আমার ভালো লাগে না।”
“জানি রে, তবু জীবনে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত আমাদের সবাইকেই নিতে হয়। সে রাতে ওই সুড়ঙ্গের মধ্যে আমিও একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আর তার ফলটি তুই হাতে ধরে আছিস।”
তার হাতের লাল পাথরটার দিকে আঙুল দেখাল দিদিমা; বলল, “রক্ত খুব শক্তিশালী জিনিস, রাকা। রক্তই বদ্ধ করে, রক্তই মুক্ত করে। সেজন্য তোকেও একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
“কী কঠিন সিদ্ধান্ত?”
“দেখ, আমার তো সময় ফুরিয়ে এল। এই বুড়ি আর তোদের বাইরের জগতের সব ঝামেলা থেকে রক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু লম্বা জীবনের এই শেষ পাতায় এসেও আমি একটা কাজের মতো কাজ করে যেতে চাই।”
গলা একদম খাদে নামিয়ে আনল দিদিমা, যাতে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সনাতন মোড়লের কানে কিছু না যায়। “ওই অপচ্ছায়াগুলো আজ রাতে আমাকে নিয়ে এত ব্যস্ত থাকবে যে আজ ওরা অন্য কোনো দিকে মন দেবে না—ঠিক যেমন সেই রাতে ওরা আমার উপস্থিতি বুঝতেই পারেনি।”
রাকা হাঁ করে চেয়ে রইল তার দিকে। দিদিমা হাসল।
“ওই ছোট্ট লাল পাথরটা দিয়ে তোর মাকে ফিরিয়ে আনা যাবে, এইটি মনে রাখিস, রাকা। কিন্তু যাই হোক, ধরা পড়িস না যেন। ওরা যদি তোকে ধরে ফেলতে পারে, তাহলে ওরা সব জেনে যাবে—ওরা অন্যদের মন পড়তে পারে। তুই ধরা পড়লে ওরা পাথরটার কথাও জেনে ফেলবে। ওরা তোর মাকে ভয় পেত; একবার যদি এই পাথর ওরা হাতে পায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এটাকে ওরা ধ্বংস করে ফেলবে।”
“কেন, দিদিমা? তুমি বলেছিলে, মায়ের সঙ্গে নাকি ওদের ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল। কেন?”
“ওরা মনে করে, তোর মা-ই নাকি একমাত্র ব্যক্তি, যে সূর্যকে ফিরিয়ে আনতে পারত; সে-ই একমাত্র ব্যক্তি, যাকে সূর্য ভালোবাসত।”
দেওয়ালে ঝোলানো রাকার মায়ের ছবিটার দিকে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে রইল দিদিমা। তারপর রাকার হাঁ হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে ফিরে সে বলল, “তুই স্বয়ং সূর্যের মেয়ে, রাকা। … চললাম। ভালো থাকিস। কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সাহস রাখিস।”
এই কথা বলে দিদিমা চলে গেল সনাতন মোড়লের সঙ্গে। গ্রামের যত পুরুষ, সবাই তাদের নিয়ে চলল পাহাড়ি পথে উপলহ্রদের দিকে।
***
এখন (রাত্রি এগারোটা দশ)
ওই হতচ্ছাড়া অপচ্ছায়াটা জানল কী করে আমি এখানে আছি?
বেরিয়ে আসা ছাড়া উপায় নেই। ভাসমান ছায়ামূর্তিটা মনে হল তাকে দেখে খুশিই হয়েছে।
“তোমার দিদিমা খুব সাহসী মহিলা, রাকা। আমরা যখন তাকে নুড়ির মধ্যে ভরে দিলাম, একবারও জীবনভিক্ষা চায়নি।”
ছায়াটা একটা গোলাপি রঙের পাথর দেখাল তাকে। রাকার মনে হল, তার বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা একবার জোরে ‘ধক্’ করে উঠল।
অপচ্ছায়াটা বলল, “আমরা তার মন পড়তে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু মহিলার অসীম মানস-প্রতিরোধক্ষমতা। কিছুতেই আমরা তার মাথার ভেতরের চিন্তাগুলো ধরতে পারলাম না। তাই বহুদিন আগে সে আমাদের কাছ থেকে যে জিনিসটা চুরি করে নিয়ে গেছে, সেটার হদিশ পাওয়া গেল না। এই মুহূর্তে আমরা তোমার মাথার মধ্যেকার চিন্তাগুলোও নেড়েচেড়ে দেখছি, কিন্তু মনে হচ্ছে বুড়ি তোমাকে এ ব্যাপারে কিছুই বলে যায়নি। খুবই চালাক মহিলা! সে বোধহয় জানত যে তুমি এসে পড়লে আমরা তোমার মাথার মধ্যে খুঁজে দেখবই।”
রাকা বুঝতে পারল, ওরা তার মায়ের পাথরটার কথা বলছে। ভয় করতে লাগল তার। ওরা কি এখন আমার মন পড়ছে? যদি ওরা বুঝতে পেরে যায় মায়ের পাথরটা এই মুহূর্তে আমার কাছেই আছে, তাহলে কী হবে?
মনটাকে শূন্য রাখার প্রবল চেষ্টা করতে লাগল সে। অপচ্ছায়াগুলোর শরীর থেকে প্রবল জুঁইয়ের গন্ধ আসছে। ওদের দীর্ঘ, অলস, ছায়াময় বাহুগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে যেন গাছের গায়ে মরা সাপ ঝুলছে। হ্রদের ধারের উজ্জ্বল পাথরগুলোর আভায় ওদের আরও অপার্থিব, আরও ভয়ানক লাগছে। ওদের বুঝতে না দিয়ে খুব আস্তে আস্তে গোলাকার সূর্যমূর্তিটার দিকে এগোতে লাগল সে।
“দিদিমাকে ছেড়ে দাও তোমরা।”
তার সামনে দাঁড়ানো অপচ্ছায়াটা হেসে উঠল। “নিশ্চয়। কিন্তু আমাদের জিনিস তাহলে আমাদের ফেরত দিতে হবে তোমাকে। একতরফা কি কোনো কিছু হয়?”
“কী চাও তোমরা?”
পরষ্পরের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ওর কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল ওরা অন্ধকারে। রাকা অপেক্ষা করে রইল। তার হাত পকেটের মধ্যে; তার আঙুলগুলো মুঠো করে ধরে আছে মা-পাথরকে। তার মনে হচ্ছে, পাথরটাকে ছুঁয়ে থাকলে একটু সাহস পাচ্ছে সে।
ওরা বলল, “আমাদের একটা কাজ করে দিতে হবে তোমাকে। তোমার মাকে যখন আমরা প্রথমবার ডেকে পাঠিয়েছিলাম, তখন তোমার দিদিমা এখানে চুপিচুপি এসে হাজির হয়েছিল। আমাদের খুব কাজের একটা জিনিস চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল সে। ওই জিনিস আমাদের ফেরত চাই।”
রাকা বুঝতে পারছে না, তার মায়ের পাথরটা এই অপচ্ছায়াদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ কেন। ও জিনিস সে এদের দিতে চায় না। কিন্তু দিলে যদি ওরা দিদিমাকে সত্যিই ছেড়ে দেয়…!
পকেট থেকে পাথরটা সে বার করতে যাচ্ছে, এমন সময় একটা অপচ্ছায়া বলল, “জিনিসটা তোমার ঠাকুমা ওই সূর্যের মূর্তির কাছে লুকিয়ে রেখে গেছে। কিছু বিশেষ কারণে আমরা ওখানটা খুঁজে দেখতে পারিনি, কিন্তু ওই ধরনের কিছু একটা বস্তুর উপস্থিতি আমরা ওই জায়গাটায় অনুভব করতে পারি। তুমি যদি ওটা আমাদের খুঁজে বার করে এনে দিতে পারো, তাহলে আমরা তোমার দিদিমাকে ছেড়ে দেব।”
পকেটের মধ্যেই মুঠো খুলে দিল রাকা; পাথরটা টুপ করে আবার পড়ে গেল পকেটের তলায়। আচ্ছা, তাহলে ওরা মায়ের পাথরটা খুঁজছে না!
কিন্তু দিদিমা তাহলে কি চুরি করে এনেছিল ওদের কাছ থেকে? আর, সে জিনিস ওদের কাছে এতটা দরকারিই বা কেন?
এই চুরির ব্যাপারে তাকে কিছু না জানানোর জন্য দিদিমার উপর একবার একটু রাগ হল তার। কিন্তু তারপরেই সে বুঝতে পারল, দিদিমা ঠিকই করেছে। সে যদি সত্যিটা জানত, তাহলে তার মনের কথা জেনে ফেলত এতক্ষণে এই অপচ্ছায়াগুলো।
“বুড়ি দিদিমাকে নিয়ে যদি জ্যান্ত ফিরতে চাও রাকা, তাহলে আমাদের কথা শোনো, জিনিসটা ওখান থেকে খুঁজে আনো।”
জুঁইয়ের গন্ধটা যেন মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। রাকা দ্রুত পরিস্থিতি বিচার করছিল মনে মনে। মায়ের পাথরটা দিতে হচ্ছে না, দিদিমা বেঁচে ফিরে আসবে। এত কিছুর বদলে তাকে শুধু একটা ছোটো জিনিস খুঁজে দিতে হবে ওই সূর্যমূর্তির কাছ থেকে। প্রস্তাবটা নিতান্ত খারাপ নয় বলেই মনে হচ্ছে।
সে মুখে বলল, “ঠিক আছে, আমি রাজি,” কিন্তু মনে মনে একটা চিন্তা তার হয়েই চলল।
দিদিমা জিনিসটা ওদের কাছ থেকে চুরি করে নিয়েছিল; তার মানে ওটার মধ্যে এমন কিছু আছে যা এই অপচ্ছায়াগুলোর কাছে খুব মূল্যবান। জিনিসটা ওদের ফেরত দিয়ে দিলে ওরা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে না তো?
কাজটা ঠিক হচ্ছে না—এই চিন্তাটাকে ঝেড়ে ফেলে সে বলল, “কী খুঁজতে হবে বলো?”
ছায়াগুলো ভেসে এল তার দিকে। কালো আকাশের দিকে একবার মুখ তুলে দেখল ওরা, তারপর একসঙ্গে বলে উঠল, “সূর্যমূর্তির কাছে যাও। ওর মধ্যে একটা লাল চুনি লুকানো আছে। তুমি খুঁজে পাবে, আমরা জানি। যে ওটা লুকিয়েছে, তার সঙ্গে তোমার রক্তের সম্পর্ক আছে। এর আগে যাদের বলি দেওয়া হয়েছে, তাদেরকে দিয়েও আমরা খুঁজিয়েছিলাম, কিন্তু তারা ওটা খুঁজে পায়নি।”
বলি দেওয়ার প্রসঙ্গটা রাকার কাছে মোটেই ভালো লাগল না। কিন্তু আর কিছু না বলে সে এগিয়ে গেল সূর্যের বিরাট, গোলাকার মর্মরমূর্তির দিকে। পূর্ণগ্রাসের অপচ্ছায়াগুলো দূরে দাঁড়িয়ে রইল, কাছে আসার চেষ্টাই করল না। তবে দূর থেকে ওরা যে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে, সেটা রাকা বুঝতে পারছিল।
হ্রদের তীর থেকে আসা নুড়িপাথরগুলোর অদ্ভুত আলোটা পড়েছে মূর্তিটার মসৃণ গায়ে। গোলাকার মার্বেলের গা থেকে বেরিয়ে এসেছে সূচালো পাথুরে আলোকরশ্মি। রাকা মূর্তিটার গায়ে হাত রাখল। চুনিটা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। কোথায় থাকতে পারে জিনিসটা?
অপচ্ছায়াগুলো ফিসফিসিয়ে বলল, “মূর্তির নীচে খুঁজে দেখো। তোমার দিদিমা সম্ভবত মূর্তির নীচে কোথাও ওটাকে পুঁতে রেখে গেছে।”
রাকা মূর্তিটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে খুঁজতে লাগল তার তলায়। কই, কিছু তো দেখা যাচ্ছে না।
চারদিক নিঃস্তব্ধ। সে চেঁচিয়ে বলল, “এখানে কিচ্ছু নেই।”
একটা অপচ্ছায়া বলল, “ওখানেই আছে। ভালো করে খোঁজো। খুঁজে পেলে তোমারই লাভ।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাকা আবার খোঁজা শুরু করল। মূর্তির নীচের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে একটু এগিয়ে গেল সে। কী ঠান্ডা মূর্তিটা! হ্যাঁ, ওই যে, ওটা কী?
সে হাত বাড়াতেই মনে হল যেন পাথরটা সূর্যমূর্তির গা থেকে বেরিয়ে এল। একদম তার মায়ের পাথরটার মতোই দেখতে এই চুনিটা। জিনিসটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। বাম হাত দিয়ে হাঁটুর ধুলো ঝেড়ে সে ডান হাতে পাথরটা উঁচু করে তুলে ধরল, যাতে অপচ্ছায়াগুলো ওটা দেখতে পায়।
ওরা একসঙ্গে দুলে উঠল। “এই তো! এই রক্ত-পাথরগুলো ভালোবাসার স্পর্শ বুঝতে পারে।”
আরেকজন বলল, “এতদিন অপেক্ষার পর অবশেষে সেই মুহূর্ত এসে উপস্থিত হয়েছে।”
রাকা একটু অবাক হয়ে ভাবল, “কীসের জন্য অপেক্ষা করছিল এরা?”
ওরা বলল, “কাছে এসো, রাকা। কী পেয়েছ, আমাদের দেখাও।”
রাকা বলল, “উঁহু, ওটি হচ্ছে না। চুক্তি মনে আছে তো? আগে দিদিমাকে ফেরত দাও, তারপর এই চুনি আমি তোমাদের হাতে তুলে দেব।”
সামনে দাঁড়ানো অপচ্ছায়াটা বলল, “কিন্তু তোমার হাতের জিনিসটা আসল কিনা, সেটা আমাদের যাচাই করে দেখতে হবে আগে। তারপর তোমার দিদিমাকে ফিরিয়ে দেব আমরা।”
“এমন কথা তো ছিল না।”
“ছিল না, কিন্তু এখন আছে। আগে আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে পাথরটাকে। তুমি ওটা আমাদের না দিলে তোমারই ক্ষতি। এবার কী করবে, ভেবে দেখো।”
“আমার কাছ থেকে এটা নিয়ে নেওয়ার পর তোমরা যে কথা রাখবে, তার নিশ্চয়তা কই?”
“আমরা কথা রাখব। কিন্তু আমাদের কথায় আপাতত বিশ্বাস করা ছাড়া তোমার আর কোনো উপায় আছে কি?”
রাকা নিজেও বুঝতে পারছে, উপায় তার নেই। ধীর পায়ে সে হেঁটে গেল অপচ্ছায়াদের দিকে। সূর্যমূর্তিটা থেকে যত দূরে সে যাচ্ছে, তার মনে হতে লাগল, যেন একটা সুরক্ষাসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে সে। হঠাৎ শীতবোধ আর জুঁইফুলের গন্ধটা যেন বড়ো বেশি তীব্র হয়ে উঠল।
একটা মরা সাপের মতো ছায়ার হাত এগিয়ে এল তার সামনে। লাল পাথরটা ওই হাতে রেখে দিল সে। এক তাল গোবরের চারপাশে যেন গুবরে পোকারা ভিড় করে আসে, তেমন করেই ছায়ামূর্তিগুলো ঘিরে ধরল পাথরটাকে।
বেশ কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে একজন ঘোষণা করল, “এই রক্তচুনি নকল নয়, আসল জিনিসই বটে। রাকা, আমাদের সঙ্গে এসো তুমি।”
পাহাড়ের পূর্বদিকের সুড়ঙ্গপথে চলতে শুরু করল ওরা। রাকা ওদের পিছুপিছু চলল। সামনের ছায়ামূর্তিটা কৃত্রিম আগুন দিয়ে একটা মশাল জ্বালিয়ে ছুড়ে দিল তার দিকে। “এটা নাও, নয়তো সুড়ঙ্গের ভেতর কিছুই দেখতে পাবে না।”
জ্বলন্ত মশালটা তুলে নিল রাকা। প্রায়ান্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে পায়ের তলায় এবড়োখেবড়ো পাথরের স্পর্শ পাচ্ছে সে। এইবার সে বুঝতে পারছে, দিদিমার বর্ণনা কতখানি নির্ভুল ছিল। মশালের আলোর কিছুটা ওদের শরীর ভেদ করে চলে যাচ্ছে, যেন অদ্ভুত একটা পাতলা পর্দার মতো বস্তু দিয়ে তৈরি ওরা। বুকের মধ্যে প্রচণ্ড জোরে ধুকপুক করছে তার। এই বদ্ধ জায়গায় জুঁইয়ের গন্ধটা অসহনীয় রকমের তীব্র লাগছে।
অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে একটিমাত্র আলো নিয়ে সে চলেছে তো চলেইছে। মশালের আলোটা একটুও কাঁপছে না, কিন্তু আসল আগুনের তেজ এতে নেই—এ যেন এক অদ্ভুত মরা আলো। সুড়ঙ্গের ভেতরটা বেশ ঠান্ডা, তবুও তার কপালে ঘাম জমছে। হাতদুটোও ভয়ে, চিন্তায় কাঁপছে তার, কিন্তু আগুনটা স্থির হয়ে আছে। একটা হাত পকেটে ঢুকিয়ে মায়ের পাথরটাকে স্পর্শ করে নিল সে একবার; সঙ্গে সঙ্গেই একটু চমকে উঠল সে। পাথরটা থেকে অপ্রত্যাশিত একটা আরামদায়ক তাপ বেরিয়ে আসছে!
নিঃশব্দে ছায়াগুলো ভেসে চলেছে অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে। রাকার মনে পড়ল, এখানেই কোথাও তার দিদিমা এক অচেনা, মাঝবয়সি লোককে দেখেছিল।
হঠাৎ ছায়াগুলো থমকে দাঁড়াল। একটা ছোট্ট উঠানের মতো খোলা জায়গায় এসে পড়েছে তারা। এটা একটা গুহার অভ্যন্তর ভাগ; এখানে মাথার উপরে পাথরের ছাদ বেশ কিছুটা উঁচুতে; পায়ের নীচে প্রচুর ভাঙা পাথরের টুকরো। এই পাথরগুলোর মধ্য থেকেও হ্রদের ধারের নুড়িগুলোর মতো আলো বেরোচ্ছে; গুহার ভেতরটা ভরে আছে তাদের বিচিত্র আভায়।
তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াটা বলল, “বন্দিকে মুক্ত করতে তোমার রক্ত লাগবে।”
তাকে ঘিরে ধরল ওরা। রাকার মনে পড়ে গেল দিদিমার বলা কথাটা।—“রক্ত খুব শক্তিশালী জিনিস, রাকা। রক্তই বদ্ধ করে, রক্তই মুক্ত করে।”
একটা ধারালো পাথর তুলে নিয়ে নিজের বাম হাতের তালুর উপর একটা আঁচড় টানল সে। দীর্ঘ রেখার মতো রক্ত ফুটে উঠল হাতে। ছায়াটা বলল, “লাল পাথরটাকে ওই রক্তে ছোঁয়াও। তারপর ওটা ফেলে দাও মাটিতে।”
পাথরটা বাম হাতে নিয়ে মুঠো করে ওটাকে ধরল সে। রক্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে পাথরটাকে, বুঝতে পারছে রাকা। কয়েক মুহূর্ত পর রক্তেভেজা পাথরটাকে ফেলে দিল সে।
টুপ করে জিনিসটা এসে পড়ল মাটিতে, আর সঙ্গে সঙ্গেই চিৎকার করে উঠল রাকা। তার সামনে অজ্ঞান অবস্থায় গুহার পাথুরে মেঝের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন এক মহিলা।
কিন্তু এ তার দিদিমা নয়!
অপচ্ছায়াগুলোও একসঙ্গে ফিসফিসিয়ে উঠল, “এ কী হল? এ কী হল?”
রাকা বুঝতে পারছে, ওরাও ভীষণ অবাক হয়ে গেছে। লাল পাথরের বন্দিত্ব থেকে যে এই মহিলা বেরিয়ে আসবেন, তা ওরাও ভাবতে পারেনি।
রাকা এগিয়ে এসে তাঁর পাশে বসল হাঁটু গেড়ে। মহিলা বেঁচে আছেন; নিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পিঠ ওঠানামা করছে। তাঁর পাশে বসে কাঁধ ধরে তাঁকে সোজা করে দিল রাকা।
এতখানি আশ্চর্য সে জীবনে হয়নি।
মা!
এই মানুষটার ছবিকে সে আজন্ম দেখে এসেছে তাদের কুটীরের দেওয়ালে। দিদিমা মাঝে মাঝেই বলত, তার মেয়ে খুব সুন্দরী ছিল। এই মুখ কি সে ভুলতে পারে?
একটা অপচ্ছায়া গর্জে উঠল, “ও আমাদের ঠকিয়েছে!”
রাকা রেগে গিয়ে বলল, “আমি কিচ্ছু করিনি!”
আরেক ছায়া বলল, “তুমি না, তোমার দিদিমা। নিজের মেয়ের পাথরটা চুরি করে সে লুকিয়ে রেখেছিল সূর্যমূর্তির কাছে। সে জানত, আমরা যেহেতু ওই মূর্তির কাছে যেতে পারি না, তাই ওটা ওখানে নিরাপদ থাকবে। আর তার চালাকির জন্যই আমরা এতদিন ভেবে এসেছি, আমাদের মহামূল্যবান পাথরটা ওখানে লুকানো আছে।”
পূর্ণগ্রাসের অপচ্ছায়াগুলো প্রচণ্ড ক্রুদ্ধভাবে কী যে বলে চলেছে, রাকা এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। সে বলল, “কিন্তু… ”
ওদের কণ্ঠস্বর এবার ভয়ংকর হয়ে উঠল। “আমাদের যা চাই, সে জিনিস নিয়ে এসো, রাকা। এই একবারই সাবধান করে দিচ্ছি তোমাকে, আর দ্বিতীয়বার বলব না। আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না।”
“তোমরা কী চাইছ, আমি জানি না। সে জিনিস কোথায় আছে, তাও আমি জানি না।”
“তাহলে দেখছি তোমাকে একটা শিক্ষা দিতেই হবে।”
ছায়াটা দিদিমার গোলাপি পাথরটা মাটিতে ফেলে তার উপর পা দিয়ে পিষে দিল। পাথরটা নিমেষের মধ্যে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল।
রাকার চোখে জল এসে গেল। দিদিমাকে আর কোনোদিন ফিরিয়ে আনা যাবে না!
“আমাদের কথা মতো কাজ যদি না করো, তাহলে ছোটো ভাইয়ের কাছে আর ফিরে যাওয়া হবে না তোমার।”
জীবনে কখনও এতখানি অসহায় বোধ করেনি রাকা। মণির মুখটা ভাসছে চোখের সামনে। ভাইকে সে কথা দিয়ে এসেছিল যে দুজনে মিলে পশ্চিমের পাহাড়ে গিয়ে সোনালি ঘোড়াদের ঘাস খাইয়ে আসবে।
সেই মুহূর্তেই তার মনে পড়ে গেল তার পকেটের অন্য পাথরটার কথা।
কেন দিদিমা তাকে বলেছিল যে এই পাথরটা দিয়ে তার মাকে ফিরিয়ে আনা যাবে? কে বন্দি আছে এর মধ্যে? যে মানুষটাকে দিদিমা এখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছিল, সে?
এক পলকের মধ্যে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে। ওই লোকটাকে নিজের রক্ত দিয়ে এই পাথরে বন্দি করেছিল দিদিমা নিজে। এই ছিল তার কঠিন সিদ্ধান্ত!
দিদিমা বলেছিল বন্ধনমন্ত্রটা সে শুনে শুনে মুখস্ত করে ফেলেছিল। ওই লোকটাকে সে-ই লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন এই পাথরটার মধ্যে। নির্ঘাত এর কথাই বলছে এই অপচ্ছায়াগুলো।
মনে মনে সে বুঝতে পারছে, লোকটা আসলে কে।
পকেটে হাত ঢুকিয়ে দ্বিতীয় পাথরটাকে বার করে আনল রাকা। আনন্দে হিসহিস করে উঠল পূর্ণগ্রাসের অপচ্ছায়াদল। “ওই তো! ওই তো সেই চুনি!”
রাকা একটু হেসে তার বাম হাতের রক্তাক্ত মুঠোর মধ্যে চেপে ধরল পাথরটাকে।
প্রবল আতংকে চিৎকার করে উঠল পূর্ণগ্রাসের অপচ্ছায়া মূর্তিগুলো। অন্ধকার গুহার ভেতরটা পূর্ণ হয়ে উঠল জবাফুলের মতো লাল আলোতে। সেই আলো দ্রুত সাদা হয়ে উঠতে লাগল আর বাড়তে লাগল তার তেজ। রাকা অনুভব করতে পারছে, তার শরীরের শিরায় শিরায় ওই প্রচণ্ড তাপ ছড়িয়ে পড়ছে, সর্বপ্লাবী আলো ভরিয়ে তুলছে তার সারা শরীর। তার রক্তাক্ত আঙুলের ফাঁক দিয়ে গরম সাদা আলোর রশ্মি বেরিয়ে এল; সেই মহাদ্যুতির প্রথম স্পর্শেই কৃত্রিম আলোর মশাল নিভে গেল আর অন্ধকারের অপচ্ছায়াগুলো ছটফটিয়ে উঠে গলে মিলিয়ে গেল শূন্যে। সদ্যোমুক্ত সূর্যের অপূর্ব উদ্ভাস ঢেকে ফেলল তার সর্বাঙ্গ।
তারপর সে উঠতে লাগল উদীয়মান সূর্যের সঙ্গে। গুহার ছাদ গলে কোথায় মিলিয়ে গেল সেই প্রচণ্ড তাপে। রাকা পুড়তে লাগল, কিন্তু তার কোনো যন্ত্রণা নেই। সেই আলোয় মায়ের জ্ঞান ফিরল; উঠে বসল সে পাথুরে মেঝের উপর। ভালোবাসায় ভরা মায়ের সুন্দর চোখদুটো দেখে অর্ধচেতন রাকা বুঝতে পারল, মা তাকে চিনতে পেরেছে।
সূর্যের সঙ্গে আকাশে আরও উঁচুতে উঠতে লাগল সে। সূর্যের আলো এসে পড়ল হ্রদের ধারের অগুন্তি নুড়িপাথরগুলোর উপর। সঙ্গে সঙ্গে যে অশুভ মায়া তাদের বন্দি করে রেখেছিল ওই পাথরের মধ্যে, সেই মায়ার আবরণ সরে গিয়ে মানুষগুলো বেরিয়ে এল হ্রদের তীরে। অবাক হয়ে তারা তাকাতে লাগল পরস্পরের দিকে। খুব রোগা হয়ে গেছে তারা, শরীর পান্ডুরবর্ণ ধারণ করেছে, কিন্তু তাদের মুখে মুক্তির হাসি। মাটি থেকে তারা চোখ তুলে আকাশে তাকাল। এতদিনে মানুষগুলো প্রায় ভুলেই গিয়েছিল সূর্য কেমন দেখতে। অনভ্যস্ত চোখ কুঁচকে তারা হাঁ করে তাকিয়ে রইল এই অপার্থিব উজ্জ্বলতার দিকে। একমুঠো ছাই হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত রাকা খুশিমনে তাকিয়ে উপভোগ করতে লাগল ওদের এই বিস্ময়।
তার চেতনা দেহ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে সে তার মাথার মধ্যে গম্ভীর কিন্তু স্নেহময় এক পুরুষকণ্ঠ শুনতে পেল, “রাকা, আমি তোর বাবা। তোকে খুব ভালোবাসি আমি।”
রাকা যেন দেখতে পাচ্ছে সূর্যের চোখের জল। সত্যি সত্যি জল—কল্পনা নয়। এত উত্তপ্ত, তবু এমন কোমল প্রাণময় মানুষ হয়?
না, মানুষ তো নয়! সূর্য!
“আমিও তোমাকে ভালোবাসি, বাবা!”
তাকে ঘিরে থাকা আরামদায়ক উত্তাপের মধ্যেই মারা গেল রাকা। এই অদ্ভুত সুন্দর সকালে তার ছাইগুলো ঝরে পড়তে লাগল রঙিন নুড়িপাথরে ভরা উপলহ্রদের তীরে।
***
এখন (সকাল)
রাকার দেহাবশেষ ছাই হয়ে ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে।
মা নীচে দাঁড়িয়ে রইল অঞ্জলি করে। মেয়ের ছাই সে একটুও পড়তে দিল না মাটিতে; আকাশ থেকেই সংগ্রহ করে নিল পুরোটা। তারপর হাতে ধরা ছাইয়ের দিকে সে তাকিয়ে রইল স্নেহভরা চোখে। ফিসফিস করে বলল, “সূর্যই জীবন। সূর্যই মুক্তি।”
তার এক ফোঁটা চোখের জল এসে পড়ল হাতের অঞ্জলিবদ্ধ ছাইয়ের উপর।
তারপর সেই ছাইয়ের স্তূপ থেকে মাথা তুলে তাকাল একটা ছোট্ট সোনালি পাখি। নবজাতক পাখির দিকে চেয়ে রইল মা। সারা পৃথিবীর বিস্ময় কণ্ঠে নিয়ে ডাকতে শুরু করল পাখিটা।
মা তার মাথায় চুমু খেল। পাখিটা খুশি হয়ে ডানা মেলে উড়তে লাগল তার মাথার চারপাশে।
মা পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে চলল তার ঘরের দিকে। এতকাল পরে সূর্যস্পর্শে ঘুমের বন্দিত্ব থেকে জেগে ওঠা আনন্দিত মানুষগুলো ভিড় করে কোলাহল করতে করতে চলেছে নিজেদের ঘরে। একটা ছোট্ট পাখি ডাকতে ডাকতে চলল মায়ের সঙ্গে। তাকে এখন বাড়ি গিয়ে ছোটো ভাইটাকে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিমের পাহাড়ে সোনালি ঘোড়াদের ঘাস খাওয়াতে যেতে হবে।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ফ্যান্টাসি, সৌম্যসুন্দর মুখোপাধ্যায়