অধরা পৃথিবী
লেখক: মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
তাতিমের সামনে মাটি থেকে সিলিং পর্যন্ত আধাস্বচ্ছ দেওয়াল।
সম্পূর্ণ খোলা একটা বিস্তৃত ঘরে তার সামনে দুটো রকিং চেয়ার। ঘরটা সাদা। শুধু এককোণে একটা প্ল্যান্টারে যত্নে রাখা একটা গাছ-রবার প্ল্যান্টের মতো দেখতে। ওই গাছটাই তাদের বাড়ির সবচেয়ে মূল্যবান সদস্য।
মাঝারি উচ্চতার, মোটামুটি সজীব। খুব সন্তর্পনে ওপরের দিকে আধফোটা পাতাতে আলতো করে আঙুল বোলালো তাতিম—কি মসৃণ।
“তাতিম এখন সবে পাতার ঘুম ভাঙছে। এখন ওকে ছুঁয়ো না।” ঘরের ওদিক থেকে বলে উঠল ক্লার্ক। তার দিকে হাসি মুখেই তাকিয়ে। ক্লার্ক তার সারাক্ষণের সঙ্গী। তার শিক্ষক, তার বন্ধু।
তাতিম বেহালা বাজায়। অনেকদিন ধরে একটি পিস সম্পূর্ণ শিখে ফেললে, তার সঙ্গে ক্লার্ক তাতিমের ইচ্ছে মতো ইনস্ট্রুমেন্ট যোগ করে তৈরি করে একটা সুন্দর সিম্ফনি। তাতিম বাজাতে শুরু করল। সে খুব ভালোবেসে বাজায়।
“এর সঙ্গে কী বাজাব?” ক্লার্কের মুখে একইরকম মিষ্টি হাসি।
“ক্লার্ক, ইন্ডিয়ান বাঁশি?”
“ইন্ডিয়ান বাঁশি?” একটু সময় নিল ক্লার্ক। তারপর ঘরে চারপাশে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল বাঁশির মেঠো সুর। কি মিষ্টি, কি দুঃখভরা। এই বাঁশি সে প্রথম শোনে ওই ভিডিয়োটাতে। শুনে এত আনন্দ, মনে হয় যেন ছুটে কোথাও হারিয়ে যেতে আবার একই সঙ্গে তার বুকে কেমন মোচড় পড়ে। এমনটা কখনও হয়নি তার ছোট্ট জীবনে।
বাজনা শেষ। এখন দেওয়াল ঘেঁষা একটা চেয়ারে বসে তাতিম, একটু একটু দুলছে। তার হাতে একটা বড়ো স্ক্রিনের ঘড়ি, তার ছোটো রোগা হাতের তুলনায় বেশ বড়ো। ঘড়ির ডায়াল স্পর্শ করে, দু-বার টিপতেই স্ক্রিনটা বার হয়ে এল তার সামনে—শূণ্যে। স্ক্রিনে ফুটে উঠল ভিডিয়োটা। এই সময়টার জন্য তাতিম সারাদিন অপেক্ষা করে, দিনের মধ্যে তার সবচেয়ে প্রিয় সময়। মেশিনের মতো নিস্তরঙ্গ এই ভোঁতা, পাঁশুটে পৃথিবীতে থেকে, ওই সবুজ, রোদে পোড়া, মেঘে ঢাকা, বৃষ্টিতে ভেজা পৃথিবীর ছবি দেখতে পাবে বলে যেন তাতিমের দিনের চাকা ঘোরে। কিভাবে যে এই ভিডিয়ো ক্লিপটা তার কাছে এল সে নিজেও জানে না। আগের পৃথিবীর ছবি, ভিডিয়ো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেছে এখন। ওই ফেলে আসা পৃথিবীর রূপ, আলো, মায়া দেখতে দেখতে এখনকার মানুষদের মানসিক অবসাদ লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। যা আর কোথাও নেই, তাকে চোখের সামনে রাখলে, যে সামান্য ক’টা মানুষ এখনও পৃথিবীতে আছে, তাদের জীবন অসহ হয়ে যায়। তাই ওগুলো প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে গেছে তাতিমদের পৃথিবীতে। তাই এই ভিডিয়ো চালু করার আগে ক্লার্কের পাওয়ার সুইচ বন্ধ তাকে অচল করে দিল তাতিম। ক্লার্কের মধ্যে তার গতিবিধির রেকর্ড থাকে।
ছোট্ট ক্লিপটা। তার মধ্যে একটা ছেলে একটা সাইকেলে চেপে হু-হু করে চলে। শনশন করে বয়ে চলে হাওয়া—পথের পাশে পেরিয়ে যায় গাছ, গাছের পরে গাছ, আর তার পাশ দিয়ে একটা নদী। মাটিটা কি সুন্দর লালচে। পিছনে দ্রুত ছন্দে বাজতে থাকে বাঁশি। ছেলেটার চোখ হওয়াতে বুজে আসছে।
এলোমেলো চুল উড়ছে হাওয়ায়। মুখে হাসি। ছেলেটির হাসি দেখলে তাতিমের মুখেও ফুটে ওঠে হাসি, ভিডিয়োর উথাল পাথাল হাওয়াতে তার চোখও যেন বন্ধ হয়ে আসে… কীভাবে থেকে গেল ভিডিয়ো ক্লিপটা?
তাকে শ্বাস নিতে দিতে?
কাকার সাইকেলটা হাতে এলে হিরণের কোনো ঠিক থাকে না। তার সামনে এখন অনীকদাদার মোটরসাইকেল, বিদিশাদিদি পিছনে বসে ভিডিয়ো করছে। তার মুখ পেছন দিকে, হিরণকে ক্যামেরা দিয়ে অনুসরণ করছে। আকাশে ছাই-সাদা ঘন নীল মেঘ। নদীতে একটু দূরে দূরে জেলে নৌকো। একটু পরে আসবে একটা ব্রিজ—ডান দিকের রাস্তা দিয়ে তার তলায় নেমে যাবে সে। বেশ এবড়োখেবড়ো রাস্তা। নদী এখানে পাশে পাশে চলে আসে। জায়গায় জায়গায় আবর্জনার স্তূপ। খাবারের উচ্ছিষ্ট, ফেলে দেওয়া কাপ, প্লেটে ছত্রাকার হয়ে আছে। ভ্যাপসা গন্ধ। বিদিশাদিদিরা এখানে ভিডিয়ো করতে আসে না। সে আর অনীকদাদা বেরিয়ে যাবে বড়ো রাস্তার ওপর দিয়ে। এখানে সাইকেল একটু টেনে চালাতে হয়। খানিকটা চালানোর পরেই রাস্তার দু-পাশেই শুরু হয় তাদের গ্রামের ফুলের খেত। বাঁদিকের প্রথম শুধু সাদা, ঝেঁপে এসেছে এবার অ্যাস্টর। শেষ দুপুরের মিঠে-আঁচ রোদে ভেসে যাচ্ছে মাঠ—অ্যাস্টরের পর হলদে, কমলা রঙের গাঁদা খেত। দূর দূর অব্দি। যতদিন অব্দি তার মনে আছে সে দেখে আসছে শীতকালে ফুলে ভরা খেত। তাদের। গ্রামের প্রায় সকলের।
গরমে হয় সবজির চাষ। শীতকালে কাকারা, দাদারা, যারা বাকি সময়ে অন্য জায়গায় কাজ করে, সব বাড়ি চলে আসে, তখন খুব লোক দরকার হয়। বড়ো হবার পর থেকে সেও হাতে হাতে সাহায্য করে। হুড়মুড় করে ডান দিকের রাস্তাটা নিল সে, এদিকে বড়ো যত্নে করা চন্দ্রমল্লিকার খেত। খেতের ঠিক মাঝখানটা গোল করে খানিকটা খালি জায়গা। লম্বালম্বি করে দুটো বেঞ্চে দুটো মেয়ে—কলেজের মেয়ে মনে হয়। শুয়ে পড়েছে আকাশের দিকে মুখ করে, হাত দুটো পাশে ছড়ানো। সবাই জিনস, পুলওভার পরা, একটা ছেলে যথারীতি ফোনে ভিডিয়ো তুলছে। এখন এদের মতো ছেলেমেয়েরা আসে দলে দলে। এদের দেখতে দেখতে হিরণ বুঝে গেছে কী কী কথা বলতে পারে।
সাইকেলটা মাটিতে নামিয়ে ফুল ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে চলে সে।
“চারদিকে ফুল, আর মাথার ওপর খোলা আকাশ। জাস্ট ভাবা যায় না।” একটা মেয়ে বলে উঠল।
“তাকা তাকা তোরা একটু এদিকে তাকা।” ফোন হাতে ছেলেটা বলে।
হিরণ সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
“ফুলের ক্রাউন নেবেন? আমি আর আমার বোন বানাই? গেটের মুখ থেকে নিলে অনেক দাম নেবে।”
শহরের দিদিদের চোখ চিকচিক।
“আনি আগে। পরে দ্যাখো। টিকটক ভিডিয়ো কোরো; খুব সুন্দর লাগবে।” ওরা সবাই হেসে উঠল।
দুড়দাড় করে হিরণ দৌড়োল বাড়ির দিকে। গোটা পাঁচেক ক্রাউন নিয়ে আসলে যদি একটু এক্সট্রা দামে বিক্রি করা যায়। তাদের ফুলের ক্রাউন সামনের দোকানগুলোতে বিক্রি করতে হয়, এদিকে এসে কেউ কেনে না বলে। বোনটা বাড়িতে আছে তো?
হুড়মুড় করে উঠোনে ঢোকার আগে চোখে পড়ল বাড়িয়ে কাছের মোরগঝুঁটি ফুলের খেতের হু-হু করে বয়ে যাওয়া হাওয়ার মধ্যে তার ছ-বছরের বোন মিঠু দু-হাত ছড়িয়ে পাখির মতো ছুটে বেড়াচ্ছে—মাথায় অ্যাস্টর আর গোলাপে গাঁথা ক্রাউন। বিদিশাদিদি, শৌনকদাদা দু-দিকে দুটো ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছে।
“এই হিরণ, বিদিশা খুঁজছিল তো তোকে। কই ছিলি?” কাকিমা বেরিয়ে এল আঁচলে হাত মুছতে মুছতে।
“কেন?”
“ওই তো ভিডিয়ো তুলছে, যা একটা ক্রাউন নিয়ে শিগগিরি যা।”
দাওয়াতে স্তূপ করে রাখা ফুলের ক্রাউন যা তাদের গ্রামে বেড়াতে আসা শহুরে বাবুবিবিদের বিক্রি করে। ওর মধ্যে থেকে একটা তুলেই দৌড় দৌড়। লাল ফুলের খেতে সাদা লাল ফুলের মুকুট পরা দুই শিশু—পাখির ডানার মতো ছড়ানো হাত, সোনালি আলোয় ভাসতে ভাসতে চলেছে।
ভিডিয়ো হয়ে যাবার পর সে আর তার বোন ক্রাউনগুলোকে ব্যাগে ভরে চলল, স্টেশন থেকে তাদের গ্রামের ঢোকার দিকটাতে, ওখানে একটা গেট মতো আছে আর দোকান। ওই ছেলেমেয়েগুলো তাদের খেত থেকে এতক্ষণে চলে গেছে। চন্দ্রমল্লিকা খেতের আর একদিকে একটা চালা মতো আছে। বাবা গত বছর বানিয়ে দিয়েছে। দুপুরে সেখানে বসে থাকে তারা মায়ের সঙ্গে। এই শীতের সময়ে শহর থেকে স্রোতের মতো মানুষ আসছে। তাদের দিকে এলে, হয় চন্দ্রমল্লিকার বা গোলাপ ফুল তুলে তোড়া বেঁধে বিক্রি করে তারা। চালার সামনের দিকে কিছু ঝুড়ি আর ব্যাগ রাখা আছে, গাঁদা ফুল তুলেও বিক্রী করে। ছোটো বলে ফুলের খেতের মধ্যে ঢুকতে তাদের অনেক বেশি সুবিধা হয়। তোড়াগুলো বিক্রি হয় বেশ বেশি দামে। পুরো বিকেল এতেই কেটে যায়। পরশু বিকেলে বেশ রোদ ছিল। খুব ভিড় হয়েছিল সেদিন, বোন আর সে দুজনেই একবার করে খেতের ভেতর যাচ্ছিল ফুল তুলতে, আবার গোলাপের তোড়াও বাঁধছিল। গোলাপ তুলতে, তোড়া বাঁধতে হাতে আর সাড় থাকে না—হাতে কাঁটা ফুটবেই। সেদিকে তারা নজর করে না, খেয়াল করতে হয় যাতে ফুলের ডাঁটা না ভাঙে। সেদিন আবার কয়েকজন দাদা দিদি তাদের ভিডিয়ো তুলছিল। রিল করছিল।
“কী লাভলি দ্যাখ। আলোটা পড়েছে মুখে, এই তোরা হাস।”
এখন একবার বললেই—তারা খুব হাসতে পারে।
“‘কী ইনোসেন্ট দ্যাখ, ফুলের মতোই পিওর।”
বিকেলের তেজি আলো এসে বেঁধে চোখে, ছোটো ছোটো নরম হাতগুলো টনটন করে। কিন্তু তারা সব দাঁত বার করে ক্যামেরার সামনে হাসে। ব্লগ, রিল কত কী তৈরি হয়।
বিদিশাদিদি, অনীকদাদা ডকু না কী বানাচ্ছে। কোনো বিদেশি চ্যানেলের জন্য। বেশ কিছু মাস ধরে ওরা আসে, তাদের পরিবারের সঙ্গে থাকে। গ্রামের রাস্তায় টই টই করে ঘোরে, সবার সঙ্গে গল্প জোড়ে, খবর নেয়।
এখন সন্ধেবেলা। বারান্দায় সবাই বসে; ওখানে উনুনে কাঠের জ্বেলে মা বড়ো গামলায় খিচুড়ি চাপিয়েছে। সবাই একসঙ্গে খাবে। হিরণ ঘরে বড়ো তক্তপোষের একধারে মুড়িসুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। টিমটিম করছে আলো, এখানে ভোল্টেজ খুব কম, কারেন্ট চলেও যায় যখন তখন। হিরণ বিদিশাদিদির একটা মোবাইলে কার্টুন দেখছিল। ওদিকের দেওয়াল ঘেঁষে বোনটা ঘুমিয়ে পড়েছে। হিরণ একটা লম্বা হাই তুলল, তারপর হাত বাড়িয়ে তোষকের একটা কোণ থেকে টেনে বার করল বইটা। বেশ ঠান্ডা লাগছে। হাওয়ায় গরম খিচুড়ির গন্ধ—ওলোট পালট। কিন্তু আজ তার উঠতে ইচ্ছে করছে না।
আজ সন্ধেবেলা সে সিঙ্গাড়া খেয়েছে। খিদে পায়নি। খুব কম দিন তারা বিকেলে কিছু খায়। গত বছর বর্ষায় কাঁসাই নদীর জল উঠে এসেছিল প্রায় ঘরে—কতদিন হয়েছে কোনোরকমে একবেলা খাবার জুটেছে। তখন টিমটিমে আলোয় হিরণ শৌনকদাদার এক বন্ধুর দেওয়া এই বইটা পড়ত। গল্পটা বিদেশের। এই সময়ের নয়। আসছে সময়ের একটা শহরের। শহরটা কোথায় বইতে তা বলা নেই। বাড়িগুলো চকচকে কাচের। একটা বাড়ি, উঁচু অনেক অনেক উঁচু। ওপর থেকে নীচে ওঠানামা করে লিফ্ট। বাইরে থেকে সব দেখা যায়। কোনো ধুলো, নোংরা, কাদা কিচ্ছু নেই। অনেক ওপরে আকাশের কাছাকাছি থাকা ফ্ল্যাটে থাকা একটা ছেলের গল্প। ছেলেটার জীবনে কোনো সমস্যা নেই—ছেলেটার নাকি খিদে পায় না, কি একটা গুঁড়ো জলে মিশিয়ে খেয়ে নেয়। ব্যাস। স্কুলেও যেতে হয় না—কম্পিউটারে পড়ে। বইটা বন্ধ করে সে ভাবে। হাতে ফুলের কাঁটা বেঁধা নেই। তার পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ক্রাউন বানানো নেই। গরমে স্কুল বন্ধ থাকলে মিডডে মিল নেই বলে, সকাল থেকে পেট গুড়গুড় করা নেই। ফুলের তোড়া হাতে দাঁত বার করে যখন তখন হাসা নেই। খিচুড়ির গরম গন্ধ চারপাশে, বাতাসে আরও যেন হিম—ছেলেটার কথা ভাবতে ভাবতে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ছেলেটা সব মেশিন দিয়ে করে। ওর একটা রোবট আছে। সে সব কথা শোনে। ওর আকাশ ছোঁয়া বাড়ি থেকে সব নীচে ছোটো ছোটো দেখা যায়। হিরণ হতে পারে না? ওই ছেলেটা?
তাতিম কাচের স্বচ্ছ দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে কিছু দেখার নেই। বাইরেটা পুরো ধূসর। আকাশ বলে কিছু নেই। কেউ কোথাও নেই। পৃথিবীতে বেশি মানুষ নেই। এখানে হাওয়া এতটাই বিষাক্ত যে অক্সিজেন স্যুট ছাড়া বাইরে যাওয়া যায় না। উত্তাপ ঠেকাতে অধিকাংশ সময়ে পুরো শহরটা একটা বাবলে ঢেকে দেওয়া হয়। তাতিমের বয়স প্রায় দশ হতে চলেছে। এই বয়স অব্দি বাড়িতে অভিভাবকের সঙ্গে থাকা যায়; তারপর তাদের বয়সিদের কাছে বিকল্প আসে বাকি জীবন কীভাবে কাটাতে চায় তারা। সে এই বাবল শহরে তার বাড়িতে থাকতে পারে। এই প্রায় ভার্চুয়াল পৃথিবীতে, তার জন্য নিযুক্ত অভিভাবকের সঙ্গে, বাইরে বিষাক্ত ধূসর পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে—যেমন এখন চলছে তেমনভাবেই। আর একটা বিকল্প আছে। তাতিম অন্যমনস্ক অবস্থায় কানের পাশে একটা সুইচ অন করে। তার ব্রেন চিপের সঙ্গে সংযুক্ত “বিকল্প জীবন”—ফাইলটা। সামনে ভেসে ওঠে ত্রিমাত্রিক এক জগৎ। আকাশটা ধূসর রঙের এর সঙ্গে এক অদ্ভুত গাঢ় বেগুনি। কিন্তু সেটা কোনো কোনো জায়গায় আলগা হয়ে গিয়ে আভাস দিচ্ছে সেই রঙের। আশার রং, বেঁচে থাকার মানের রং—নীল। হালকা নীল। ওই রংটা দেখার জন্য তাতিমের মন কেমন উথাল পাথাল করে। এখনও ওই জায়গায় বছরের কয়েকদিন নীলচে আকাশ দেখা যায়। কিন্তু নীচে অনন্ত ধু-ধু মরুভূমি। তার মধ্যে দেখা সার সার সাদা টিপির মতো বাসস্থান। বাসস্থান যেখানে শেষ—সেখানে বিশাল স্বচ্ছ ডোম। তার মধ্যে গাছপালা, জল প্রয়োজন মতো, আর কাজ করছে কিছু মানুষ। শাকসবজি, ফল ওষধি সব ওখানেই ফলে। ওই তীব্র আলোয়, উষ্ণতায়, খুব কম জলে আর ওই দুঃসহ আবহাওয়ায় কাজ করতে পারে এমন মানুষের যত্নে যে গাছ ফলতে পারে, ওখানে ফলে। কি সবুজ ডোমের ভেতরটা। কত বড়ো। দেখা যায় কিছু মানুষ কাজ করছে তার মধ্যে। দরজা দিয়ে আসা যাওয়া করছে কজন। আঙুল দিয়ে জুম করল বেশ খানিকটা। সে থাকতে পারে এই কয়েক হাজার মাইল দূরে মরুভূমির মধ্যে খোলা জায়গায়, যেখানে আকাশের রং এখনও দেখা যায়, খোলা বাতাসে নিশ্বাস নেওয়া যায়। কিন্তু সমস্যাটা হল সূর্যের উত্তাপ মানুষের শরীরের পক্ষে সহনীয় নয়। কিন্তু তাও খোলা জায়গায় কিছু মানুষ বাঁচছে। বাঁচতে চাইছে। তারা শরীরকে সইয়ে নিয়েছে। এবারে দেখা যাচ্ছে মানুষগুলোকে। এক দৃষ্টিতে, নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে থাকে তাতিম।
তারা আর দেখতে তার মতো নয়। তাদের মুখের চামড়া গায়ের চামড়া খসখসে, ঝুলে ঝুলে পড়েছে। অনেক ভাঁজ। মাথা থেকে শুরু করে সমস্ত শরীর ওইরকমই। বড়ো বড়ো চোখগুলোতে খুব বড়ো বড়ো পাতা। উটের মতো। নিষ্ঠুর প্রকৃতির হাত থেকে বাঁচার জন্য, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে, নিজেদের শরীর পালটে ফেলেছে এই জায়গার মানুষেরা। দরকার হলে আরও পালটাবে। কিন্তু তারা তাতিমদের বুদ্বুদে বাস করবে না। বিকল্প জীবন।
সুইচ টিপে সে বারবার এই ফাইল দেখে, আর জানলার বাইরের গাঢ় অন্ধকার। সময়ের নিয়মে সকাল হবে… ধূসর শূন্যতা। সে জানে। টেবিলের ওদিকে তার অ্যান্ড্রয়েড ক্লার্ক চুপ করে দাঁড়ানো।
“কি করব আমি ক্লার্ক? থাকব না চলে যাব”?
ক্লার্কের পাওয়ার সুইচ এখনও বন্ধ। সে উত্তর দেয় না।
সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হবে তাড়াতাড়ি। জেনেটিকালি অল্টারড হতে গেলে তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে দশ হবার আগেই।
কী করবে তাতিম? তার প্রিয় ক্লিপটা চালিয়ে দেয়। সেখানে লাল সাদা ফুলের মুকুট পরে দুটো ছেলে মেয়ে দু-হাত শূন্যে ছড়িয়ে ছুটে ছুটে বেড়ায় লাল ফুলের খেতে।
তক্তপোশের কোণ ঘেঁষে শুয়ে হিরণের ঘুম পাতলা হয়ে আসে। কম্বলটা পাতলা, খুব ঠান্ডা লাগছে। বাইরে অন্ধকার একটু তরল হয়ে আসছে, হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। তার খুব খিদে পেয়েছে—কাল রাতে বোধহয় তাকে কেউ খেতে ডাকেনি। সকালে খাবার পেতে পেতে কতক্ষণ কে জানে? সে গুটিসুটি মেরে আবার ঘুমোতে চেষ্টা করে। বন্ধ চোখের পাতায় ডেকে আনে উঁচু কাচের বাড়িতে থাকা, সেই অনেক দিন পরের ছেলেটাকে—সে এখন একটা গ্লাস থেকে গোলাপি রঙের শরবত খায়, তারপর তার পাশে বসা একটা রোবটের সঙ্গে ভিডিয়ো গেমস খেলে। সারাদিন।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়