আবার ফোন বাজছে
লেখক: অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
—দেখেছ! আবার মেয়েটা ফোনে কথা বলছে! এতো রাতে কার সঙ্গে কথা বলে রোজ রোজ?
—কোন মেয়েটা?
—আরে বাবা, পাশের ফ্ল্যাটে ভাড়াটে যে মেয়েটা এসেছে, সেই মেয়েটা। শুনতে পাচ্ছো না! বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার কানটাও খারাপ হয়ে গেছে!
—তা কার সঙ্গে কথা বলে, তা দিয়ে তোমার আমার কী? এখনকার মেয়ে। এরা সব ইন্ডিপেন্ডেন্ট টাইপের হয়। অতো সব নিয়মকানুন মানে না এরা।
—তা বলে এতো রাতে? এখন রাত একটা বাজে। ফোনে পুরো এক ঘণ্টা কথা বলে যাচ্ছে। কার না কার সঙ্গে, কে জানে!
—হয়তো হাজব্যান্ডের সঙ্গে কথা বলে।
-ধুর, তোমার কিছু মনে থাকে না। কিছুদিন আগে বললাম না যে মিনু এসে বলল মেয়েটার হাজব্যান্ড নাকি মারা গেছে কয়েক বছর আগে।
—মিনু আবার সে খবর কী করে জানল?
—আহা, ও তো ওর বাড়িতেও কাজ করে।
-ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। বলেছিলে মেয়েটার হাজব্যান্ড কী একটা অ্যাক্সিডেন্টে যেন মারা গেছে। কীভাবে যেন?
—শুনেছিলাম মেয়েটা নাকি প্রেমে পড়ে বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিল। বিয়ে না লিভ টুগেদার তাও অবশ্য ঠিক জানি না । তারপরে হঠাৎ করে একদিন বাড়িতে লাইট না কী একটা লাগাতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে ছেলেটা মাথায় চোট পায়। আর নাকি জ্ঞান ফেরেনি। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে দেখে সব শেষ। সবই মিনুর কাছে শোনা।
—তা মেয়েটা তো একমাস হল ভাড়াটে হিসেবে এসেছে। এখনও তোমার সঙ্গে আলাপ হয়নি!
—না, না, কারো সঙ্গে মেশে না। সারাদিন কোথায় কাজ করে। একা থাকে। ভারী দেমাক। তারপরে ফিরে এসে এরকম সারাক্ষণ ফোনে থাকে।
—উফফ, তবু তো দেখছি সব খবরই পেয়ে গেছ। তুমি সাংবাদিক হলে খুব ভালো করতে। সবার হাঁড়ির খবর রেখে দাও।
—বাহ। রাখব না। পাশের ফ্ল্যাট। মেয়েটাকে দেখতে শুনতেও বেশ ভালো। একেবারে যেন ডানাকাটা পরী। কীরকম পোশাক পরে দেখেছ। জিন্স আর সব কায়দার টিশার্ট পরে অফিসে যায়। একা একা এরকম মেয়ে পাশের ফ্ল্যাটে থাকলে খোঁজখবর রাখব না! খারাপ লোকজন যদি আসে। আজকাল কী হয়, তুমি তো কিছুই খোঁজখবর রাখো না! মিনু ওর বাড়িতে রান্নার কাজ করে। ওর মাধ্যমেই তাই খবর রাখতে হয়।
—তা সেরকম খারাপ টাইপের লোকজন আসে নাকি!
—না, সেরকম খবর এখনও পাইনি। তবে সারাদিন কী করে বেড়ায়, কে জানে! আমার চোখের সামনে তো আর থাকে না!
কথা বলতে বলতে মৌমিতা থামে।
—দাঁড়াও। এবারে আরেকটু জোরে যেন কথা আবার শুরু হয়েছে। মনে হয় পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কী বলে শুনে আসি।—বলে মুখ টিপে হাসে মৌমিতা। একঘেয়ে জীবনে বেশ একটা রহস্যের গন্ধ পেয়েছে।
উৎসাহের সঙ্গে গিয়ে ফ্ল্যাট লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। এখানে দুই ফ্ল্যাটের বারান্দার মধ্যে দূরত্ব খুব কম। পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দায় কেউ কথা বললে, স্পষ্ট সব কথা শোনা যায়। আলো না জ্বালিয়ে চুপ করে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে সব কথা শোনে মৌমিতা।
দূরে কোথাও মাইকে একটা হিন্দী গান জোরে বাজছে। এই সমস্যা। ভালো করে কথা বোঝার উপায় নেই। মাঝরাতেও মাইকে গানের অত্যাচার সহ্য করতে হয়। এ পাড়াটাই ভালো নয়। বিরক্ত হয়ে আরও মন দিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে ভেসে আসা কথা শোনার চেষ্টা করে মৌমিতা।
মেয়েটা বারান্দায় হেঁটে হেঁটে কথা বলছে। ফোনের উলটোদিকের কথা স্পষ্ট শোনা না গেলেও কী বলছে তা আন্দাজ করা যাচ্ছে।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, রোজ ক্যালসিয়ামের ট্যাবলেট খাচ্ছি। তোমার কথা মতো রাত দশটায় অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছি। ভুলি না। তুমি নিজে তো খাচ্ছো না, তাই তো!
একটু থেমে মেয়েটা ফের বলে উঠল—আজ অফিসে খুব প্রেসার ছিল। শেষে আমি আর অরিজিৎ কফি খেতে গিয়েছিলাম একটা ক্যাফেতে।
উলটোদিকের কী একটা কথায় খিলখিলিয়ে উঠল মেয়েটা। বলে উঠল—হ্যাঁ, খুব হ্যান্ডসাম। রিসেন্টলি আগে বউয়ের সঙ্গে ডিভোর্সও হয়ে গেছে। তাই আমার পিছনে পড়েছে। আমারও অসুবিধে নেই। তুমি তো কাছে নেই। যা ইচ্ছে করার অনেক সুযোগ আছে আমার।
আবার উলটোদিকের কী কথা শুনে হেসে উঠল মেয়েটা।
কথা শুনে মনে হচ্ছিল, মেয়েটা যেন ওর স্বামীর সঙ্গেই কথা বলছে। ঠিক সেরকম যেন কোনো গোপনীয়তা নেই। দ্বিধা নেই। যেন খুব পরিচিত কারোর সঙ্গে কথা বলছে।
ফের মেয়েটা বলে উঠল—অনেক দিন তোমাকে দেখিনি জানো। খুব দেখতে ইচ্ছে করে।
মনে হল উলটো দিক থেকে কিছু উত্তর এল না। একটু চুপ থেকে মেয়েটা ফের বলে উঠল—মনে আছে বলেছিলে ইউরোপে যাব একসঙ্গে। এখন অফিস থেকে বারবার যেতে বলে। কিন্তু তোমাকে ছাড়া যেতে ইচ্ছে করে না!
এবারে মনে হল কিছুক্ষণ মেয়েটা চুপ করে থাকল। মেয়েটা কী কাঁদছে? হ্যাঁ, কিছু দূর থেকেই সেটা স্পষ্ট অনুভব করল মৌমিতা। ফের খানিকক্ষণ বাদে কথা বলে উঠল। কান্নার ভেজা স্বরে। এবারে যেন খুব আস্তে আস্তে বলছে।
কয়েক সপ্তাহ এখানে ভাড়া নিয়ে এসেছে মেয়েটা। এখনও কোন আলাপই হয়নি। টু বেড রুম ফ্ল্যাট। এতো সুন্দরী মেয়ে সন্দেহ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আজকের এই একটা কথোপকথন যেন অনেক ধারণা পালটে দিচ্ছে মৌমিতার। তাহলে কী ওর স্বামী মারা যায়নি! ভুল শুনেছে? হয়তো অন্য কোনো দেশে থাকে। সেজন্য এত রাতে ফোন করে। আমেরিকার কিছু জায়গায় এখন তো সবে দুপুর হচ্ছে। এটাই ভালো কথা বলার সময়। অথবা হয়তো এ দেশেই থাকে। কিন্তু হয়তো কিছু একটা করেছে যার জন্যে এখানে আসতে পারে না। জেলে নেই তো? হয়তো সেজন্যই মারা গেছে বলে গল্প রটিয়েছে। জানাজানি হলে কে আর চাইবে যে জেলের কয়েদীর বউ এরকম কমপ্লেক্সে থাকুক।
রাত এখন দেড়টা। দূর থেকে ভেসে আসা গানটা থেমে গেছে। শুধু মাঝে মধ্যে রাস্তা দিয়ে যাওয়া বাস বা গাড়ির শব্দ। তাই মেয়েটার কথার সঙ্গে সঙ্গে উলটো দিকের ফোনের কথাও যেন অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। হ্যা, একটা পুরুষ কণ্ঠ। তার কণ্ঠে আশ্বাস, ভালোবাসার ছোঁয়া, আবেগ। আরও খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে শোনার পরে মৌমিতা ঘরে ফিরে এল।
পরিতোষবাবু যথারীতি উলটোদিক ফিরে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। মৌমিতার মনে হল ধাক্কা দিয়ে খাট থেকে ফেলে দেয়। এতটুকু রোমান্স রসকষ নেই বুড়োটার। শুধু এখন নয়, বিয়ের দু-বছর পর থেকেই সব উধাও। যদি উলটোদিকের ফ্ল্যাটের মেয়েটার হাজব্যান্ডের থেকে কিছু অন্তত শিখত।
বলা যায় সে রাতের পর থেকে মৌমিতার কৌতূহল বহুগুন বেড়ে গেল। মিনুও মেয়েটার বাড়ি কাজ করার সময় মেয়েটাকে ফোনে কথা বলতে শুনেছে। বেশ কয়েকবার। সে কথা নাকি শেষই হতে চায় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে। মাঝে মধ্যে কীসব কথা আবার ইংরেজিতেও বলে। ‘হানি’ মানে কী, ‘নেভার মাইন্ড’ মানে কি, সেটাও একদিন মিনু এসে জিজ্ঞেস করল।
মিনুও তার মহিলাসুলভ কৌতূহলে আজকাল ও বাড়িতে কাজ করার সময় বড়িয়ে দিয়েছে। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে অপর্ণা এমন কারো সঙ্গে কথা বলে যাকে ও খুব ভালোবাসে। কিন্তু সে কী ওর স্বামী? ও হ্যা, মেয়েটার নাম যে অপর্ণা সেটাও মিনুর মুখে শুনেছে।
কিছুদিন বাদে পুজোয় অপর্ণাকে একদম সামনাসামনি পেয়ে গেল মৌমিতা। কীভাবে সেই কথায় আসবে, সেটা মৌমিতা আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল। কিছু একথা-সেকথার পরে বলে উঠল—তোমার হাজব্যান্ড আমেরিকায় থাকে, তাই না! অনেক রাতে তোমাদের কথা হয় শুনি।
অপর্ণা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপরে শুধু বলে উঠল—হ্যাঁ, ও অনেক দূরে থাকে। তাই।
—তা এবারে পুজোয় এল না? নিশ্চয়ই ক্রিস্টমাসে আসবে। ওসব দেশ থেকে ক্রিস্টমাসে আসা সহজ, তাই না? অনেকদিন ছুটি তখন পায়।
এবারে চোখ তুলল অপর্ণা—না, ও আসতে পারবে না। বলতে বলতে চোখটা যেন ছলছলিয়ে উঠল। তারপর যে কী হল, হঠাৎ করে যেন কান্না লুকোতে উলটোদিকে ঘুরে দ্রুতপায়ে ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে গেল।
মৌমিতার একটু খারাপ লাগল। এ বিষয়ে হয়তো ওর কথা বলা উচিত হয়নি। পুজোর দিন। মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। স্বামী কী করে, কে জানে! জেলে থাকার ধারণা যেন আরও বেশি করে মনে পড়ল। কিন্তু কৌতূহল? সেটা সামলাবে কী করে! মনে হল এর জন্য পুজোর অর্ধেক মজাই যেন মাটি হয়ে যাচ্ছে।
সেদিন সন্ধেবেলায় অপর্ণার ফ্ল্যাটের দরজায় গিয়ে হানা দিল। কয়েকবার বেল বাজানোর পরে দরজা খুলল। অপর্ণা একাই আছে।
একটা সবুজ ম্যাক্সি পরে। একদম সাধারণ পোশাক, কিন্তু তাতেই কী সুন্দর লাগছে। তবে মুখে গভীর বিষাদের ছাপ। ঘরের বাইরের পুজোর উত্তাপ, আলো যেন ঘরে প্রবেশ করেনি।
মৌমিতা বলে ওঠে—তোমাকে সকালে প্রশ্নটা করে আমার নিজের খারাপ লাগল। তুমি কিছু মনে করোনি তো? আসলে প্রিয়জনেরা দূরে থাকলে মন খারাপ হওয়া খুব স্বাভাবিক।
—দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলেন কেন! ভেতরে এসে বসুন না। চা করছি।
—না। না। আবার চা নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। আমারও অনেক কাজ পড়ে আছে।
—না হয় দশ মিনিট বসলেন। আমার চা করতে একদম সময় লাগবে না। আমি নিজের জন্যেই করছিলাম এখন।
মৌমিতা মুখে যাই বলুক না কেন চলে যাওয়ার ওর একদম ইচ্ছে ছিল না, এরকম একটা রহস্য। সোফায় বসে চারদিকে তাকাল মৌমিতা।
বেশ সাজানো গোছানো ঘর। বেশ কয়েকটা ইনডোর প্ল্যান্টও আছে। একটা বুককেসও আছে এ ঘরে। ঘরের দেওয়ালে বেশ কয়েকটা ছবিতে অপর্ণার সঙ্গে একটা ছেলে, বেশ সুদর্শন। দেখে মনে হয় অপর্ণার থেকেও কম বয়েস। দেখেই বোঝা যায় বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের। কাছে গিয়ে দেখে বলে উঠল মৌমিতা—কী নাম তোমার হাজব্যান্ডের?
রান্নাঘর থেকেই উত্তর দিল অপর্ণা—অলোক।
—খুব মিষ্টি দেখতে। তোমাদের দুজনকে খুব মানিয়েছে।
এবারে একটু অন্যভাবে কথাটা পাড়ল মৌমিতা।
—আসলে লোকে নানান কথা বলে তো! না জেনে শুনেই যা ইচ্ছে বলে বেড়ায়। তোমাদের নিয়েও কথা হয়। একা একা থাকো। এই বয়সে।
—কী শুনলেন?
রান্না ঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল অপর্ণা।
—না, না, সে কথা থাক।
—বলুন না, দ্বিধা না করে।
—ওই শুনেছিলাম তোমার হাজব্যান্ড নাকি মারা গেছে।
—আপনি ভুল শোনেন নি। ও নেই। দু বছর হল একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।
—মানে?
—তা তুমি তাহলে কার সঙ্গে কথা বলো! দিন-রাত।
মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে গেল মৌমিতার। অবশ্য মৌমিতার মধ্যে লজ্জা চিরকালই একটু কম।
—কেন? ওর সঙ্গে।
—মানে? মজা করছ।
কিন্তু অপর্ণা কিছু বলার আগে ঠিক তখনই অপর্ণার ফোন বেজে উঠল।
—মাসিমা, ও ফোন করেছে। একটু ধরতে হবে।
এবারে রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল মৌমিতা।
বলে অবাক করে ফোনটা ধরে ফের রান্নাঘরে চলে গেল অপর্ণা। না এবারে আর অস্পষ্ট নয়, স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে সেই পুরুষ কণ্ঠ। স্পষ্ট। সেই আবেগ। সেই প্রেম। সেই কথার মধ্যে মধ্যে হারিয়ে যাওয়া। হালকা চালে মজা করা। মাঝে মধ্যে অপর্ণার খিলখিলিয়ে হাসি।
কে তাহলে ফোনের উলটো দিকে। এমন কী পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী মৌমিতা যে এসেছে, সেটা নিয়েও অপর্ণা উল্লেখ করল। উলটো দিক থেকে মনে হল সেই ব্যক্তি বলছে কচুরি রাবড়ি নিয়ে আসতে।
অপর্ণা যেন সেই কথার মধ্যে হারিয়ে গেছে। ঘরে যে অন্য কেউ বসে আছে, তা ভুলে গেছে। ভুলে গেছে যে ডেকচিতে চা ফুটে যাচ্ছে।
মিনিট দশেক বাদে ফোন শেষ হলে অপর্ণা যখন চা নিয়ে এল, মৌমিতার পক্ষে আর প্রশ্নটা না করে থাকা গেল না।
—আচ্ছা, ফোনে কে? কে তোমাকে এভাবে ফোন করে? অন্য কারো সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ভাব ভালোবাসা হলে সেটা তো আর অন্যায় নয়। এটাই তো স্বাভাবিক। সেটা লুকোনোর কী আছে? আমিও এ সব ব্যাপারে বেশ আধুনিক। তোমার বয়েসই বা কী? বেশ করবে, প্রেম করবে। আমরা কেউ কিছু মনে করব না।
হেসে উঠল অপর্ণা। চোখটা যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল। বলে উঠল—না না, অন্য কেউ না। ও। ওরই ফোন। আপনি কথা বলতে চান? ও বলছিল আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
এবারে মৌমিতার ভয় পাওয়ার পালা। যদিও বাইরে এখনও সামান্য আলো আছে, বাইরে পুজো উপলক্ষে নানান ধরনের গান হচ্ছে, হইচই হচ্ছে, তবু এরকম ভূতের সঙ্গে কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই মৌমিতার।
বলে উঠল—না, না, আজ কাজের তাড়া আছে। আরেকদিন আসব।
খিলখিল করে হেসে উঠল অপর্ণা। সে হাসির মধ্যেও যেন পাগলামির চিহ্ন লুকিয়ে আছে। —সে কী আপনার এত কৌতূহল! জেনে যাবেন না কে আমাকে ফোন করে! মিনু কিন্তু আপনার এই আগ্রহ নিয়ে সব কিছু আমাকে বলেছে। আপনি একটু ওর সঙ্গে কথা বলুন। আমি ততক্ষণ চট করে আপনার জন্যে একটু কচুরি নিয়ে আসি। ও তা না হলে পরে বকবে।
মৌমিতা ভয়ে ঘামতে শুরু করেছে। এমনিতেও সোফায় পাখার হাওয়া বিশেষ আসে না। তার মধ্যে এরকম ভৌতিক ঘটনা।
ফোনটা আবার রিং হচ্ছে।
অপর্ণা ফোন ধরে বলে ওঠে—ওই তো মাসিমা বসে আছেন। এখন কথা বলবে?
মৌমিতাকে লক্ষ করে অপর্ণা ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে এবারে বলে ওঠে—মাসিমা ও কথা বলতে চাইছে।
—মানে? সোফায় পিছিয়ে বসে মৌমিতা। কাঁপা গলায় বলে ওঠেন—আমার সঙ্গে?
বাইরে এখন অন্ধকার হয়ে গেছে। ঝুপ করে এত তাড়াতাড়ি যে অন্ধকার হয়ে যাবে সেটা মৌমিতা আগে আশা করতে পারেনি। তার মধ্যে আবার ঘরেও এখনও আলো জ্বালা হয়নি।
ফোনটা কোন রকমে নিয়ে বলে ওঠে—হ্যাঁ, হ্যাল। হ্যালো।
—কেমন আছেন মাসিমা?
উলটো দিক থেকে হালকা মায়াভরা কমবয়েসি গলা। যে গলাটা এতদিন দূর থেকে শুনেছেন। পাশের বারান্দা থেকে। যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে।
—ভা—ভালো। তুমি?
—আমি মৌমিতার হাজব্যান্ড। অলোক। আপনার কথা মৌমিতার কাছে আগেও শুনেছি। আপনি তো পাশেই থাকেন। আসলে আপনারা আছেন বলেই ও একা থাকতে ভরসা পায় এই ফ্ল্যাটে।
একটু যেন গলায় জোর পায় মৌমিতা। গলাটা ঠিক মানুষের মতো। কোনো ভৌতিক কণ্ঠস্বর নয়।
সে কণ্ঠস্বর ফের বলে ওঠে—আপনার তো আগমনীর কচুরি আর শর্মার রাবড়ি খুব পছন্দ। আমি ওকে এমনিতেও বলছিলাম একদিন আপনাদের ডেকে লাঞ্চে বা ডিনারে খাওয়াতে। ও খুব ভালো রান্না করে। বিশেষ করে মাটন কষা। একদিন খেলে আপনার কোলেস্টেরল বেড়ে যাবে না।
—হ্যাঁ, সে ঠিক আছে। একদিন খাবো।—বলতে বলতে গলা শুকিয়ে আসে মৌমিতার। অলোক কী করে জানল যে মৌমিতা এসব খেতে ভালোবাসে। একই সঙ্গে মৌমিতার যে কোলেস্টেরল বেশ বেশি, সেটাও জানে। ভূতেরা কী সব জানে!
—আপনাদের ভরসায় অপর্ণা একা আছে। আমি সেদিক থেকে নিশ্চিন্ত। ভালো থাকবেন। আজ ছাড়ি।
উলটোদিক থেকে ফোন কেটে দেয়।
কোনোরকমে কাঁপা হাতে ফোনটা সামনের টেবিলে নামিয়ে রেখে মৌমিতা সামনের গ্লাস্টা তুলে জল খায়।
অপর্ণা হেসে বলে ওঠে—কী বিশ্বাস হল তো যে ও করে?
—কী কিন্তু এ কী করে সম্ভব! যে নেই, সে কী ভাবে ফোন করে? নাকি ও আসলে মারা যায়নি?
এবারে চুপ করে থাকে অপর্ণা। মিনিট দুয়েক পরে বলে ওঠে।
অপর্ণা বলে উঠল—ও যখন মারা গেল, তার এক বছর বাদে এরকম ফোন আসতে শুরু করল। প্রথমে বুঝতে পারতাম না। ফোনটা পেয়ে মনে হত কেউ যেন আমাকে মজা করে ফোন করছে। ঠিক ওর মতো গলা করে। কিন্তু পরে দেখলাম শুধু ওর মতো গলা নয়, ওই। ঠিক ও যেভাবে যা বলত, যেভাবে আমাকে কথা বলে হাসাত, কাঁদাত, ঠিক সেরকম। শুধু তাই নয়, আমার সব কথা জানে। শুধু আমার নয়, আমাদের সব গোপন কথাও। আমি মেসেজ পেতে শুরু করলাম ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে। ঠিক যেভাবে ও আগে মেসেজ করত। যেন ও আমার সঙ্গেই আছে।
—সে কী করে হয়? কীসব বলছ? তুমি নিশ্চিত যে ও মৃত?
—শুধু আমি না, আমার আত্মীয়েরাও, ওর সব বন্ধুরাও সবাই জানে যে ও নেই। ওকে আমরা শ্মশানে দাহ করে এসেছি।
—তাহলে?
—আমিও অনেক ভেবে কিছু কুল কিনারা করে উঠতে পারছিলাম না। ভূতে ভয় নেই। বিশ্বাসও নেই। একবার ভাবলাম পুলিসে জানাব? কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম পুলিসে জানালে যদি এসব বন্ধ হয়ে যায়। এতো ঠিক ওই। পার্থিব কোনো কারণ হোক, অপার্থিব কোনো কারণ হোক, এই যে ওকে ফোনের উলটোদিকে পাওয়া, এই যে আমার প্রত্যেক মুহূর্ত জুড়ে থাকা, আমাকে দূর থেকেও সঙ্গ দেওয়া, এ তো আমার জন্যে অমূল্য। একে হারানোর কোনো রিস্ক নিতে পারব না।
কয়েকদিনের পরে একটা অন্য ফোন পাই। অচেনা নাম্বার থেকে। তখন রহস্যটা বুঝতে পারি। জানতে পারি একটা বিশেষ সংস্থা এরকম করছে। এটা নাকি এখনও প্রমোশনাল। পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। তারাই নাকি বিশেষ একটা চ্যাটবট তৈরি করেছে, যা ওর হয়ে ফোন করছে। জিজ্ঞেস করলাম এত কিছু জানল কী করে ওরা অলোক সম্বন্ধে? কীভাবে জানল ও ঠিক কীভাবে কথা বলে? কীভাবে জানল আমাদের প্রায় সব গোপন কথা যা আর কারো জানার কথা নয়!
শুনলাম এর পিছনে নাকি ওদের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মেশিন লার্নিং মডেল কাজ করছে যাকে ট্রেন করা হয়েছে ঠিক ওর মতো করে। ওর যত ফোন কল, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব ভিডিয়ো, ব্লগ, হোয়াটস অ্যাপ সব কিছু ওরা স্টাডি করেছে। সেভাবে যে চ্যাটবট তৈরি হয়েছে, সে এখন ঠিক যেন অলোক। আমার অলোক। আমি ভুলে যাই যে আমার আসল অলোক আর নেই।
অপর্ণা চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। ফের বলে উঠল—কিছু মনে করবেন না মাসিমা। এই কথাটা কাউকে বলার দরকার নেই। আমি খুব ভয় পাই যে এমন কিছু হবে না তো যাতে ওকে আমি আবার হারিয়ে ফেলব! এটুকু ছাড়া তো আমার আর কিছুই নেই। এটা নিয়েই আমার বাকি জীবন।
কাঁদতে শুরু করে অপর্ণা। কাছে এসে মৌমিতা জড়িয়ে ধরে অপর্ণাকে।
কিছুক্ষণ বাদে মৌমিতা বেরিয়ে যায়। একা অন্ধকার ঘরে বসে থাকে অপর্ণা। চুপ করে। বাইরে গান চলছে মাইকে। ‘যেতে যেতে কিছু কথা, বলব তোমার কানে কানে।’
সামনের টেবিলে সেই ফুলদানিটা। যেটার কথা চ্যাটবটটা এখনও জানে না। জানতেও পারবে না কোনোদিন। কারণ ওই চ্যাটবট ঠিক সেটাই জানে, যা সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলো জানে ওর সম্বন্ধে। সবকিছু সম্বন্ধে ডেটা থাকলেও ওই রাতটা, ওই ঘটনাটার কথা কেউ জানে না। কোথাও তার কোন চিহ্ন নেই। সবাই জানে অলোকের মৃত্যু স্বাভাবিক।
এই যে অলোকের ভালো স্মৃতিটুকু জড়িয়ে থাকা, এটাই তো অপর্ণা চায়। খারাপ স্মৃতিটুকু হারিয়ে যাবে আস্তে আস্তে। টেবিলের উপরে রাখা পিতলের ফুলদানীটা অন্য কোথাও সরিয়ে রাখতে হবে। ওটাই সেই ভয়ানক রাতের স্মৃতির একমাত্র সাক্ষী।
হঠাৎ যে কী হয়েছিল স্কিৎজোফ্রেনিয়ার পেশেন্ট অপর্ণার। মনে হয়েছিল ছোটোবেলার সেই খারাপ লোকটার মতো কে যেন হঠাৎ করে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। আরও এগিয়ে আসছে। তখনই ধাঁই করে মাথা লক্ষ্য করে মেরেছিল ভারী ফুলদানিটা দিয়ে। ও তো ইচ্ছে করে সেটা করেনি। করার কথা কোনোদিন ভাবতেও পারত না।
যাকে ও নিজের প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসত, তাকেই এভাবে কিনা ও মেরেছে! কী হয়েছিল ব্যাপারটা ও নিজেই ভালো করে জানে না। শুধু জানে ও ছাড়া এটা করার সুযোগ আর কারো ছিল না।
মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করল অপর্ণা।
আবার ফোন বাজছে। চ্যাটবটটাও অলোকের মতো অপর্ণাকে ভালোবাসতে শিখে গেছে। পুজোর দিনে একা থাকতে দেবে না।
Tags: অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, কল্পবিজ্ঞান