অপারেশন মধুমিডা
লেখক: সিদ্ধার্থ ঘোষ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
বাঘডোগরা এয়ারপোর্ট পিছনে ফেলে মিনিট কুড়ি বড়ো জোর। দু-চারটে বাঁক। গহন বন দু-পাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল গাড়িটার ওপর। ঝিঁঝির ডাক ডুবিয়ে আলো ছায়ায় আঁকা পাতার জাফরি মাড়িয়ে ছুটে চলেছে কন্টেসা।
পিছনের সিটে সুজন তার বাঁ দিকের জানলার কাচটা তুলে দিয়ে মাফলারটা আরেকটু সামলে নিল। কিন্তু মাঝখানে বসেও প্রায় কাঁপুনি লাগার জোগাড় নিলয়ের। কারণ, ডান ধারে জানলার কাচ তোলা যায়নি। ফুল স্লিভ সোয়েটার, তার ওপরে একটা জ্যাকেট চড়িয়ে বসে আছে ঝন্টুমামা। গরম জামা খুলবে না, কাচও তুলতে দেবে না। গাড়ির জানলা দিয়ে আধখানা মাথা বার করে থেকে থেকে চেঁচিয়ে উঠছে— শাল, সেগুন। একবার একটা তুঁত গাছ চিনে ফেলায় এমন চেঁচিয়েছেন যে ড্রাইভারও আধখানা ঘাড় ফিরিয়েছিল।
সুজন ও নিলয় কেউই লক্ষ করেনি যে ঝন্টুমামা উত্তেজনার বসে কখন জানলা দিয়ে পুরো মাথাটাই প্রায় বার করে ফেলেছেন। শুধু তাই নয়। জ্যাকেটের পকেট থেকে ফাউন্টেন পেনটা টেনে নিয়ে সেটাকে ব্ল্যাকবোর্ড পয়েন্টারের মতো এখন ব্যবহার করছেন।
উত্তরবঙ্গের বুনো পথে গাড়ি ছুটিয়ে চলার আকর্ষণের কথা অস্বীকার করার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু তা বলে এতটা। এই তত প্রথম নয়।
ঝন্টুমামার উত্তেজনায় কন্টেসাও এবার যেন তাল মেলাতে চাইছে। একটা ঝাঁকুনি, পরক্ষণেই তাড়া খাওয়া হরিণের মতো সব শক্তি পায়ের মধ্যে ঢেলে দিয়েছে। নড়েচড়ে বসল সুজন আর নিলয়। সেই মুহূর্তে ঝন্টুমামার ডান হাতটা ড্রাইভারের ঘাড়ের কাছে ছিটকে এল।
বরফের মতো ঠান্ডা অল-মেটালিক ফাউন্টেন পেনটা টিপে ধরে ঝন্টুমামা। চাপা গম্ভীর স্বরে… কিন্তু আদেশ কানে আসার আগেই শিউরে উঠেছে ড্রাইভার। আপনা হতেই তার ডান পা অ্যাকসিলারেটর ছেড়ে উঠে এসেছে ব্রেকের ওপর।
কন্টেসা মাতালের মতো কয়েকটা টাল খেয়ে পথের বাঁ দিক চেপে থমকে গেল। ঝন্টুমামা স্নেহের সুরে বললেন, ‘হাতদুটি মস্তকের উপর তুলে ধরো। না হলে খুলি উড়িয়ে দেব।’ তারপরেই মিলিটারি ভঙ্গিতে কথার চাঁটি। ‘হারি আপ্!’
ঠান্ডা ফাউন্টেন পেনের ডগা রিভলবারের নল হিসেবে কার্যকর হলেও কতক্ষণ তার মেয়াদ সেটা আর জানার সুযোগ পাওয়া গেল না। একটা কালো অ্যাম্বাসডার এসে দাঁড়াল গাড়িটার ডান ধারে। এক সঙ্গে তার চারটে দরজা খুলে গেল। ছিটকে এল চার জন। তাদের মধ্যে দু-জনের হাতে উদ্যত রিভলবার। সত্যিকার রিভলবার।
সশস্ত্র পুলিসের হাতে কন্টেসার ড্রাইভারকে সমর্পণ করে বাকি সকলে উঠে বসল অ্যাম্বাসাডারে। সাদা পোশাকের ইন্সপেক্টরকে কোনো কথা বলার সুযোগ দেয়নি ঝন্টুমামা। ঠিক সময়ে যদি পৌঁছতে না পারা যায় তা হলে আর বাহাদুরির লাভ কি?
গাড়ি মুখ ঘুরিয়ে উলটো পথে ছুট লাগাল। ঝন্টুমামা বলল, ‘মনে হচ্ছিল ঠিক পথে যাচ্ছি না, কিন্তু কনফার্মড হলাম অ্যাম্বাসাডারকে ধাওয়া করতে দেখে।’
‘ব্যাপারটা ঠিক বোঝা গেল না।’ ইন্সপেক্টর হাজরা বলল, ‘এই কালো অ্যাম্বাসাডার গাড়িতে পুলিস আসছে সেটা আন্দাজ করলেন কীভাবে?’
ঝন্টুমামা বললেন, ‘উলটোদিক থেকে চিন্তা করে দেখুন। দুবৃত্তরাই যদি ফলো করবে তা হলে তারা অ্যাম্বাসাডার নিত না নিশ্চয়। আপনারা তো কন্টেসার স্পিডের কাছে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছিলেন, তাই না?’
‘গ্রেট। গ্রেট!’ হাজরা নড়েচড়ে বসল। সমীহ ভরে ঝন্টুমামার জন্য সিটের মধ্যে আরেকটু বেশি জায়গা বরাদ্দ করতে পারলে নিশ্চয় খুশি হত।
‘আমি এবার একটা প্রশ্ন করি।’ ঝন্টুমামা জানতে চায়, ‘আপনারা আমাদের ওপর নজর রাখা সত্ত্বেও এই ভুয়ো ড্রাইভারটা কী করে রিসিভ করল আমাদের?’
‘ওহ! বলবেন না মশাই। দুটো লোক দারুণ জখম হয়েছে। আমরা একটা জিপসী পাঠিয়েছিলাম আপনাদের জন্য এয়ারপোর্টে। মাঝরাস্তায় দারুণ অ্যাকসিডেন্ট… এখন মনে হচ্ছে সেটাও পরিকল্পিত।’
সামনের সিট থেকে ঘাড় কাত করে সুজন প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু আপনারা বুঝলেন কী করে যে এই গাড়িটাতেই রয়েছি আমরা? ফলো করতে হলেও তো…।’
হাজরা হেসে উঠল, ‘এ প্রশ্নটার উত্তর বোধহয় আমার দেওয়া ঠিক হবে না, তাই না স্যার?’
ঝন্টুমামা বলল, ‘গাড়িতে ওঠার আগেই নাম্বারটা একটা চিরকুটে লিখে পোর্টারের হাতে গুঁজে দিয়েছিলাম। অবশ্যই উইথ বখশিশ। তোরা তখন লাগেজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলি।’
নিলয় বলল, ‘ঝন্টুমামা তোমার কিন্তু এবার একটা রিভলবারের জন্য দরখাস্ত করা উচিত। দিন-দিন এমন সব বদমাইশদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছ। সব সময়ে কি আর ফাউন্টেন পেন বাগিয়ে রক্ষা পাবে!’
‘ফাউন্টেন পেন?’ অবাক হয়ে যায় হাজরা।
‘আপনি দেখেননি? কন্টেসাটা না হলে হঠাৎ থামল কী করে?’
‘না, মানে আমি ভেবেছিলাম আপনারা নিশ্চয় ড্রাইভারকে চেপে ধরে…’
‘ওই রকম স্পিডের মাথায়!’
ঝন্টুমামা বলল, ‘শুধু ফাউন্টেন পেন বললে একটু ভুল হয় না কি? না শানালে কি কোনো জিনিস অস্ত্র হয়? কতক্ষণ ধরে পেনটাকে ঠান্ডায় শানিয়ে তবে না রিভলবার হল!’
‘কিন্তু আমরা কি সময়মতো পৌঁছতে পারব শেষ পর্যন্ত?’ জিজ্ঞেস করল সুজন।
‘ঘণ্টা খানেক দেরি হবে। আশা করি ক্ষতি হবে না তেমন কিছু।’
হাজরা বলল, ‘দেখুন স্যার আপনাদের মতো হাই হাই ভি.আই.পি. আসা মানেই নানান ঝঞ্ঝাট। অথচ কেন যে আপনারা আসছেন, কী কাণ্ড হচ্ছে, সেটা জানার কোনো উপায় নেই।’ বোঝা গেল হাজরা একটু ঘুরিয়ে জানতে চাইছে।
ঝন্টুমামা পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে অফার করল। হাজরার লাইটার থেকে নিজেরটা ধরিয়ে নিয়ে ঝন্টুমামা বলল, ‘কারণটা যাইহোক, এটা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন যে কেউ বা কারা চাইছে না যে আমরা কনফারেন্সে যোগ দিই।’
বন-মহলের আলোচনা সভায় পৌঁছতে তিন ঘণ্টা দেরি হয়েছে। এখন অবশ্য মনে হচ্ছে আততায়ীরা তিন দিন আটকে রাখলেও বিশেষ ক্ষতি হত না। দেশের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের আচরণ দেখে তাঁদের অষ্টম শ্রেণীর পড়ুয়া মনে হচ্ছে। মাস্টার মশাই এখনো যেন ক্লাসে ঢোকেননি। তাদের পাশে বরং অনেক সংযত সরকারি অফিসার ও সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিরা।
সুজয় ও নিলয়ের কাছে পুরো ব্যাপারটা এখনও ধোঁয়াটে। ঝন্টুমামা শুধু বলেছেন যে অ্যাডভেঞ্চারের এমন সুযোগ আর হয়তো আসবে না। অতঃপর দু-জনকেই এক মাসের ছুটি নিতে হয়েছে কলেজ থেকে। আর সঙ্গে একটি করে ট্রেকিং এর কিট। হ্যাভার স্যাক। কিন্তু ঝন্টুমামা তাঁর পলিথিনের ব্যাগে ও পোর্টম্যান্টোয় কী যে ভরেছেন কেউই জানে না।
শহর থেকে দূরে নির্জন শালবনের মধ্যে কাঠের বাংলোবাড়িতে অতন্দ্র প্রহরার মধ্যে বৈজ্ঞানিক সম্মোনের ব্যাপারটার মধ্যেই রহস্যের স্বাদ। তার ওপরে পথে অপহরণের চেষ্টা। সুজন আর নিলয় রোমাঞ্চিত।
প্রোফেসর ব্যানার্জি স্লাইড সহযোগে কিছু বলার চেষ্টা করছেন কিন্তু প্রতি কথাতেই বাধা।
ঝন্টুমামা একটু কাত হয়ে বসে বললেন, ‘দিন সাতেক আগে ব্যানার্জি ফিরেছে মধুমিডা থেকে, সেই সব স্লাইডই দেখাচ্ছে।’
ঘরের আলো নিভে গেল। পরবর্তী স্নাইড। পর্দার ওপরে একটা সবুজ সমুদ্রে যেন তুফান উঠেছে। সারা ঘর স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে প্রক্ষিপ্ত ছবির আভায়। কোলাহলে একটু ভাটা পড়ে। গর্বিত কণ্ঠে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় ব্যানার্জি, ‘সবুজের এই সমারোহও যদি প্রমাণ না করে যে মধুমিডা পৃথিবীর চেয়ে ঢের উর্বর…’
দুটো তথ্য আরও জানা গেল।
মধুমিডা তার মানে মহাকাশের কোনো গ্রহ। এবং সেখানে প্রাণের অস্তিত্বও আছে।
ঝগড়াটে গলায় কে একজন বলে উঠল, ‘ছবিটি বড়ো মনোরম। কে এঁকেছে হে? এবার ললিত কলার প্রদর্শনীতে পাঠিয়ে দিতে বলো।’
টুকরো হাসি আর ছেঁড়া কথা ওড়ে সভায়, ‘ঘাস কাটতে রকেট পাঠানোর খরচা পোষাবে কি?’ ‘গ্রহান্তরের ঘাসের স্বাদ নিয়েছেন নিশ্চয়?’
ব্যানার্জি অবিচল, ‘মধুমিডার ঘাসের পুষ্টিগুণ দেখানোর জন্য ছবিটা তোলা হয়নি। বুদ্ধিমানরা নিশ্চয় বুঝতে পারবেন শুধু গোরু ছাগলের হাতে অমন ছাঁটা মসৃণ ঘাসের…
২
আবার সভায় ঝড়-ঝাপটা শুরু হয়ে গেল। বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি। সমর্থকরাও সংখ্যায় কম নয়। টেবিল চাপড়ে একজন হুঙ্কার দিল, ‘আগে শেষ করতে দিন তারপর যতখুশি টিপ্পুনি।’
আরেকজনের বক্তব্য, ‘পাঁচ জন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী মধুমিডায় প্রাণ দিয়েছেন জেনেও অমানুষ ছাড়া এইরকম মন্তব্য…’
অমানুষ শব্দটাকে যেন লুফে নিল বিরোধীরা। ‘প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়ুন, মধুমিডার অমানুষদের দেখি আগে।’
আবার আলো জ্বলে উঠল। ব্যানার্জি এতটুকু বিচলিত নন। দু-পা এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন। বাদামি রঙের বুশ-শার্টটাকে একটু টেনে নিয়ে চশমার পুরু কাচের পিছন থেকে যেন ব্যথিত চোখে চেয়ে বললেন, ‘একটা কথা প্রথমেই স্পষ্ট হয়ে যাওয়া ভালো। আমি এই সভা ডাকিনি। আমি প্রমাণ পেশ করতেও আসিনি যে সত্যিই মধুমিডা নামে মহাকাশের একটি বাসযোগ্য গ্রহ আবিষ্কার করেছি। মধুমিডার অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের ফিরিস্তি তুলে ধরারও কোনো বাসনা আমার নেই। মহাকাশ গবেষণা পর্ষদ বা সামরিক বিভাগেরও এই সব বিষয়ে এই মুহূর্তে বিশেষ কৌতূহল আছে বলে মনে হয় না। একটি বিষয়েই শুধু আপনাদের সমর্থন চাইতে আজ আমরা জড়ো হয়েছি। মধুমিডায় দ্বিতীয় অভিযান চালানোর অনুমতি এবং এবার রীতিমতো প্রস্তুত হয়ে। আগ্নেয়াস্ত্রের অভাব যেন আত্মরক্ষার পক্ষে… শুধু এই একটি কারণেই এবার আমরা পাঁচ জন বিজ্ঞানী মহাযাত্রীকে হারিয়েছি।’
সামরিক বাহিনীর তরফ থেকে জেনারেল শর্মা ব্যানার্জির পাশে উঠে আসতেই শান্তি ফিরে এল। শর্মা বলল, ‘আপনারা নিশ্চয় জানেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাকাশ নিরাপত্তা কেন্দ্রের নির্দেশ অনুসারে ভিন গ্রহে অভিযাত্রীদল পাঠাবার জন্য কয়েকটি শর্ত পালন করতে হয়। সেই অনুসারে প্রোফেসর ব্যানার্জির টিম পাঁচশো রাউন্ড রিভলবারের কাতুর্জ নিয়ে যাত্রা করেন…’
‘প্রথম আক্রমণেই পাঁচশো রাউন্ড ফিনিশ…’ ব্যানার্জিকে থামিয়ে দিয়ে শর্মা বললেন, ‘সেই জন্যই ওঁর দাবি এবারে পুরোপুরি সামরিক প্রস্তুতি দিয়ে এক্সপিডিশনে যেতে হবে…’
‘আর তাই দেশের যত বিজ্ঞানীদের এখানে টেনে এনে তাদের দিয়ে একটা রেকমেন্ডশন লিখিয়ে নেওয়া দরকার, যাতে রাষ্ট্রপুঞ্জকে রাজি করানো যায়।’ ‘আর যে যাই করুক, আমার সই পাচ্ছে না।’ মাথাভরা সোনালি চুল ঝাঁকিয়ে সামনের সারি থেকে যে ভদ্রলোক এই কথা বললেন, পিছনে বসেও তাঁকে চিনতে অসুবিধা হয়নি। পরিবেশ ও জীববিজ্ঞানী সুন্দররাজন।
নিলয় একটু কাত হয়ে সুজনকে ফিসফিস করে বলল, ‘আমার ধারণা সুন্দররাজনের বিশেষ আমন্ত্রণেই আজ আমরা…’
হঠাৎ সভার কোলাহল কমে আসায় কথা শেষ না করেই সোজা হয়ে বসল নিলয়। সুন্দররাজনের সম্মতি সংগ্রহটা যে বিশেষ জরুরি সেটা বিলক্ষণ বোঝা যাচ্ছে। শর্মা বললেন, ‘এভাবে অনর্থক বিতর্কের মধ্যে জড়িয়ে না পড়ে বরং প্রথমেই আমরা ডক্টর সুন্দররাজনকে অনুরোধ করছি তার মূল আপত্তিগুলো জানাবার জন্য। যাতে…’
এবারও চেয়ার ছেড়ে না উঠেই সুন্দররাজন। বললেন, ‘আপত্তি একটি। পৃথিবীর বাইরে বুদ্ধিমান জীব দূরের কথা, একটি কীট বা পতঙ্গেরও প্রাণ নষ্ট করার অধিকার নেই আমাদের। তারা যতই ক্ষতিকর হোক। মনে রাখা দরকার, তারা আমাদের ডেকে পাঠায়নি।’
‘তা বলে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতি আপনি চান না? মহাশূন্যে এমন এক গ্রহের সন্ধান পাওয়ার পরেও—’ বিরোধীরা আবার সরব।
‘চিন পাকিস্তান অবধি মহাশূন্যে রাজ্যবিস্তার করেছে। আর আপনার মতো গুণীজ্ঞানী লোক শুধু বাধা দিতে দিতেই ক্লান্ত।’
অনেকক্ষণ বাদে আবার গলা শোনা গেল ব্যানার্জির, ‘তার চেয়েও বড়ো কথা, আপনি কি করে অনুমান করে নিচ্ছেন যে আমরা ভিনগ্রহীদের আক্রমণ করার জন্যই…’
এইবারে উঠে দাঁড়লেন সুন্দররাজন। ক্রোধে তাঁর গলা চড়ে না, সরু হয়ে আসে, ‘অবিশ্বাস। স্রেফ অবিশ্বাস। পুরোপুরি অবিশ্বাস করি আপনাকে। তাই এই অনুমান।’
বিজ্ঞানীদের মেঘ-গর্জনকে ছাপিয়ে গেল ঝন্টুমামার গলা, ‘পঁচিশ বছর আগে অলক শর্মা নামে এক নৃতত্ত্ববিদ আফ্রিকায় গিয়েছিল অভিযানে। সে কি করেছিল আপনারা জানেন। জানেন না, অলক শর্মা আর অলক ব্যানার্জি একই ব্যক্তি।’
স্বাভাবিকভাবেই এরপর সভার কাজ মুলতবি রাখা ছাড়া উপায় ছিল না। বিকেলের চায়ের পর বিশেষ অধিবেশনে সুন্দররাজন প্রস্তাব দিলেন, ‘মধুমিডায় পুরোপুরি নিরস্ত্র একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠানো হোক। আপনারা শুনলে খুশি হবেন, ঝন্টু সেন ও তার দুই সহকারী স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব…’
‘এরা কারা?’, ‘বিজ্ঞানের ‘ব’ জানে তো?’ —ইত্যাদি গায়ে না মেখেই সুন্দররাজন বললেন, ‘না ঝন্টু সেন প্রচলিত অর্থে বিজ্ঞানী নন। কিন্তু বিজ্ঞানকর্মী এবং অনুসন্ধানী। সবচেয়ে বড়ো কথা বিজ্ঞানীদের মতো তাঁর প্রাণের ভয় নেই। দ্বিতীয়ত, কোনো বৈজ্ঞানিক অভিযানে যাচ্ছেন না তাঁরা। তাঁদের একমাত্র কাজ মধুমিডার বাসিন্দাদের সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করা।’
‘এবং প্রাণ হারানো।’ ব্যানার্জির মন্তব্য, ‘আবার বলছি, অলৌকিক ক্ষমতা ওদের। এবং শক্তের ভক্ত। সাবধান। যাক, সেটা আপনাদের ব্যাপার।’
ব্যানার্জি পোর্টফোলিওর কাগজ গুছিয়ে বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে দেখে জেনারেল শর্মা বলল, ‘আপনি তা হলে আর কোনোভাবেই আমাদের সহযোগিতা করবেন না?’
‘কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অফিসিয়াল কাগজপত্র সব জমা দিয়ে দিয়েছি। স্লাইডও রেখে গেলাম। এর পরে আমি কেন, আমার দলের আর কেউই— মানে, যারা বেঁচে ফিরেছে— এসবের মধ্যে আর নেই।’
‘না, আমি আছি।’ প্রায় সাড়ে ছ-ফুট লম্বা এবং বেতের মতো ছিপছিপে চেহারার এক তরুণ উঠে দাঁড়িয়েছে। হিন্দী ফিল্মের মারকুটে নায়কের রোলে মানাবে।
‘রাহুল! তুমি?’— ব্যানার্জিকে প্রথম অবাক হতে দেখা গেল।
‘হ্যাঁ আমি। আপনি না চাইলেও পূর্ণ সহযোগিতা করব এদের। আপনি দলবল সমেত বিদায় নিলেও মধুমিডার গাইড হিসাবে আমি নেহাত…’
‘বেইমান! বেইমান! এত বছর ধরে হাতে করে কাজ শেখাবার পরেও…’
‘তাঁবেদার তৈরি করতে পারেননি।’
শালের গহন জঙ্গলের মধ্যে একটা জায়গায় যেন টাক পড়েছে। সেইটাই হেলিপ্যাড। সিভোরস্কি কোম্পানির যন্ত্র-ফড়িঙে চেপে ঝন্টুমামার দল রওনা হল। গন্তব্য একটি সামরিক রকেট-বন্দর। কিন্তু স্থানটি কোথায় জানার উপায় নেই। প্রশ্ন করা বারণ।
ঝন্টুমামার দলে শুধু রাহুল বোসই যোগ দেয়নি। এসেছে মহিলা সাংবাদিক বিদিশা মিত্র। অবশ্য বিশেষণ হিসেবে ‘মহিলা’ শব্দটি বিদিশার কাছে ভীষণ আপত্তিকর। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পরিচালিত চারটি দুঃসাহসিক অভিযানে অংশ নিয়েছে বিদিশা। সেই পরিচয়ই তাকে মধুমিডা অভিযাত্রীদের দলে ঠাঁই করে দিয়েছে।
রকেটে চড়ে পৃথিবী ছাড়িয়ে পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি মনে হচ্ছে এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে। হেলিকপ্টারের জানলা দিয়ে প্রকৃতির শোভা তাকিয়ে দেখার সুযোগই দিচ্ছে না কমোডোর তরফদার। প্রায় ছাত্র পড়ানোর মতো করে বক্তৃতা চলেছে। তিন দিনের মধ্যেই যাত্রা শুরু হবে। তার আগে বহু কাজ। সামরিক ঘাঁটিতে পৌঁছনো মাত্র শুরু হবে মেডিক্যাল টেস্ট আর ফিজিক্যাল ট্রেনিং। খাওয়া, শোওয়া ইত্যাদি রকেট যাত্রীদের অবশ্য জেনে রাখা বিষয়ে ক্লাস হবে। জরুরি অবস্থার মোকাবিলার জন্য প্রত্যেককেই শিখে নিতে হবে রকেট পরিচালনার মোটা হিসেবগুলো। স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটারের সাহায্যে সে-কাজ নাকি মোটেই দুঃসাধ্য নয়। তারপর মধুমিডায় নেমে ক্যাম্প স্থাপন…
নিলয় বলল, ‘আগে থেকে শুনে লাভ কি? মনে হচ্ছে তো লোহার খাঁচায় ভরবেন। তখন যা হবার হবে। এখন আমার কিঞ্চিৎ ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে।’
৩
খিদে সুজনেরও পেয়েছি। কিন্তু প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য না করে সে গলা মিলোতে চায় না। কিছু ব্যবস্থা যদি হয় সেও নিশ্চয় বাদ পড়বে না।
তরফদার বলল, ‘ভেরি সরি। আধ ঘণ্টা একটু কষ্ট করতে হবে। অবশ্য সফ্ট ড্রিংক—’
বিদিশা নিচু হয়ে পায়ের কাছ থেকে তার হ্যভারস্যাকটা টেনে নিয়ে বলল, ‘একটা সেমি সফ্ট খাদ্য অবশ্য আমি অফার করতে পারি—’
‘তার মানে?’ নিলয় বলল।
একটা চকোলেট বাড়িয়ে ধরেছে বিদিশা। হাত বাড়াতে গিয়েও থমকে গেল নিলয়। ভুরু কুঁচকে তাকাল। কিন্তু তার আগেই রাহুলের প্রশ্ন সবাইকে বেশ নড়িয়ে দিয়েছে।
‘আপনার ব্যাগটা দেখে মনে হচ্ছে যেন, তৈরি হয়ে এসেছেন। জানতেন কি করে যে আপনিও যাবেন? হাতটাত গুনিয়ে এসেছিলেন নাকি?’
ঝন্টুমামা সারাক্ষণ চোখ বুজে সিটে মাথায় ঠেস রেখে একটা আধ-মরা মানুষের ভঙ্গি অনুকরণ করার চেষ্টা করছিল। চোখ না খুললেও ভুরুতে কিছু খাঁজ দেখা দিল। মাথাটাও যেন এ-পাশে কয়েক মাইক্রন নড়েছে।
চমকটা কাটিয়ে বিদিশা বলল, ‘আপনি তাহলে আমাদের টিমের শার্লক হোমস!’
উপস্থিত বুদ্ধি ও কথার খেলায় বিদিশা হার মানার পাত্রী নয়। রাহুলও জবাব আদায় না করে ছাড়বে না, ‘আমার প্রশ্নটা এখনও কিন্তু কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে।’
‘ক্ষ্যাপা খুঁজে কেরে পরশ পাথর। নিরপেক্ষ সাংবাদিক অশেষ দত্ত যদি এই টিমে ঢুকতে না চাইত আমিও আজ এখানে থাকতাম না। ডক্টর সুন্দররাজন সেই কথাই বলেছিলেন আমাকে। আপনার নিশ্চয় অজানা নয় যে অশেষ দত্ত কয়েকটা বিশেষ কারণে প্রোফেসর ব্যানার্জির কাছে কৃতজ্ঞ। সুন্দররাজন আমায় তৈরি হয়ে আসতে বলেন। এবার আপনি বলুন, বিশেষ কারণগুলো কি আপনার জানা? আর, আপনিও কি ঠিক আমার মতো হাত গুনে নিজেও তৈরি হয়ে এসেছেন?’
রাহুল হেসে ফেলে, ‘না, আপনার সঙ্গে শক্ত কথা বলা চলবে না। আপনিই আসলে মিস মার্পল। আরে, শুধু আমি কেন, আমরা— মানে, প্রোফেসর মুখার্জির আগের টিমের সবাই আজ তৈরি হয়েই এসেছিলাম নেক্সট অভিযানের জন্য।’
‘তা ঠিক। ঝন্টু সেন গায়েব হয়ে গেলে তাই হত!’ দৈববাণীর মতো শোনল ঝন্টুমামার গলা।
সুজন মহা উৎসাহে সবে শুরু করেছিল, ‘ঠিক। ঠিক। যা কাণ্ড আজ— প্রায় ভুলেই গেছলাম—’
অনেকক্ষণ চোখ বুজে রাখার একটা সুফল টের পাওয়া গেল। ঝন্টুমামার দৃষ্টিতে কিছু এক্সট্রা তেজ সঞ্চারিত হয়েছে। সুজন অপ্রস্তুত হয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল। আর নিলয় সেই মুহূতেই আবিষ্কার করল যে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে বিদিশার চকোলেটটা কিন্তু এখন সুজনের হাতে।
শেষ চেষ্টা হিসেবে সুজনের কাছ থেকে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে অবশিষ্ট অংশটা দখল করতে চেষ্টা করল নিলয়। সুজনটা এত মাথামোটা কে জানত। হাতটা শুধু টেনেই নেয়নি, সবাই শুনেছে তার বক্তব্য— ভাগ বসাবার কি দরকার। চাস তো ওকে বল। বিদিশার কাছে নিশ্চয় আরও আছে।’
কে জানে কোথায় হেলিকপ্টার অবতরণ করা মাত্র ঝন্টুমামা চাঙ্গা হয়ে উঠল, ‘কমোডোর তরফদার, অনেক কথাই এখনও জানা হয়নি। মধুমিডা সম্বন্ধে আমরা যা যা জানতে পেয়েছি তার এভরিথিং আমাদের চাই।’
তরফদার ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘অফ কোর্স। একশো বার।’
রাহুল ঝন্টুমামার দিকে তাকাল, ‘মিস্টার সেন, প্রোফেসর ব্যানার্জি যা তথ্য হ্যান্ডওভার করেছেন, সে তো জানতে পারবেনই। আমি সম্ভবত তার চেয়ে বেশি কিছু জানতে পারব।’
‘কি আশ্চর্য?’ এই প্রথম তরফদারকে তার গাম্ভীর্য হারতে দেখা গেল।
‘কি আশ্চর্য! এইটাই কি স্বাভাবিক নয়?’ রাহুল বলল, ‘আপনি যদি ব্যানার্জির জায়গায় থাকতেন তো কী করতেন? তাঁকে নিশ্চয় গর্দভ ভাবার কোনো কারণ নেই। কে না বোঝে যে বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের একটা বড়ো অংশ ব্যানার্জিকে খুব ভালো চোখে দেখেন না। আপনি যদি আন্দাজ করেন বা আপনার নেক্সট প্রজেক্ট সরাকারি বা সামরিক সমর্থন নাও পেতে পারে, তা হলে কি আপনি আপনার পর্যবেক্ষণের গবেষণার সব ফলাফল একেবারে খোলাখুলিভাবে তুলে ধরবেন। কক্ষনো না। তা হয় না। ভাইটাল কিছু কিছু ব্যাপার সবসময়েই গোপন করার চেষ্টা করবেন।’
বিদিশা খপ্ করে বলে উঠল, ‘এই অতি সংগুপ্ত তথ্যের মধ্যে আপনার কাছ থেকে আমরা কী কী পেতে পারি রাহুলবাবু?’
কথার ভঙ্গি কাঠখোট্টা হলেও রাহুল লোকটা সরল চরিত্রের। ব্যঙ্গ গায়ে না মেখেই বলল, ‘সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ হল একটা ম্যাপ— মধুমিডার মানচিত্র। আমরা কোথায় নেমেছিলাম। কোন কোন দিকে কত দূর ঘোরাঘুরি করেছি। কোথায় কি বিচিত্র জীবজন্তুর সাক্ষাৎ পেয়েছি। কিংবা মধু ও মাধুদের কোথায় কোথায় বসতি। কম্পাসের সাহায্যে সেই মানচিত্র একটা তৈরি করা হয়েছিল। তার হদিশ আপনারা জানেন না। ব্যানার্জিও জানেন না যে আমি এক ফাঁকে তার একটা জেরক্স করিয়ে রেখেছি। আমার মতে, রাহুল বোসের এই চুরি করা ম্যাপটাই এবারের অভিযানে আমাদের সবচেয়ে কাজে লাগবে। অবশ্য, মধু আর মাধু, মানে মধুমিডার বা পুরুষ ও নারীদের অলৌকিক ক্ষমতার যেটুকু পরিচয় পেয়েছি— এইসব জ্ঞানকে কতটুকু কাজে লাগানো যাবে সে-বিষয়েও বিলক্ষণ সন্দেহ আছে আমার।’
আকাশে নাক গুঁজে দাঁড়িয়ে রয়েছে রকেটটা।
নাম না জানা জায়গা কিন্তু রকেটটাই চিনিয়ে দিচ্ছে এটা মহাকাশ বন্দর। লোহার পাইপ দিয়ে তৈরি একটা বিশাল মাচার গায়ে আটকানো রয়েছে রকেট। ইলেকট্রিক লিফট দিয়ে কর্মীরা অনবরত ওঠা নামা করছে। সিঁদুরে রং দিয়ে রকেটের গায়ে নাম লেখার কাজ চলেছে। ‘পুষ্পক’ চড়ে রওনা হওয়ার আগে হাতে আছে আর দু-দিন।
একটা অদ্ভুত চাপা উত্তেজনা তরুণ সদস্যদের সকলকেই প্রথমে কাবু করেছিল। বিপদের কথা ভুলে নতুনত্বের আকর্ষণ। অবশ্য প্রথমেই একটা দল ভাগাভাগি হয়ে গেছে। ঝন্টুমামা ও রাহুল এক দিকে। তাদের ভি.আই.পি ট্রিটমেন্ট। সুজন, নিলয় ও বিদিশা যেন সেকেন্ড ক্লাস যাত্রী। শুধু থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাই আলাদা নয়। ট্রেনিঙের ব্যাপারেও তাই।
প্রথম বিদ্রোহ করল নিলয়। ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল বোর্ড ইত্যাদি নিয়ে প্রথম পাঠের পর শুরু হল তাঁবু খাটানোর প্রশিক্ষণ। রীতিমতো গায়ে গতরে খাটার ব্যাপার। তাতেও কিছু হত না, গণ্ডগোল বাধল দুপুরে খাওয়ার টেবিলে। শুধু টিনে ভরা শুকনো খাবার। পাশের টেবিলেই ঝন্টুমামা আর রাহুল বোস কিন্তু কব্জি ডুবিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে।
নিলয় বলল, ‘রাহুল না হয় আগেও মহাকাশে ট্রিপ মেরেছে। তার কথা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু ঝন্টুমামা— ঝন্টুমামা কেন আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে না? খাওয়া নিয়েও শিক্ষা এসব আমার সহ্য হয় না।’
বিদিশা আড় চোখে পাশের টেবিলের দিকে তাকিয়ে একটু সামনে ঝুঁকে পড়ে চাপা গলায় বলল, ‘আস্তে! আমি শুনেছি, কাল পরশু দু-দিন আমাদের নাকি কোনো সলিড ফুড অবধি দেবে না। ট্রেনিং। এই বেলা যত পারো খেয়ে নাও। আমি কয়েকটা টিন অবশ্য ইতিমধ্যেই হাতিয়েছি। ভাগ করে নেবো প্রয়োজন মতো।’
বিদিশা ওদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এরকম খাটতে পারবে, সুজন বা নিলয় কেউই ভাবতে পারেনি। মুখ ফুটে স্বীকার না করলেও, সেই কারণেই নিশ্চয় নিলয় এখনকার মতো প্রতিবাদের পথ দিয়ে আর এগোয়নি।
নিলয়ের আপত্তির কারণ অন্যরকম। খাটাখাটুনির সব দায়িত্ব সে নিতে রাজি। আফটার অল বয়সটাও তো দেখতে হবে। ঝন্টুমামা ও রাহুল অনেক সিনিয়র। কিন্তু স্রেফ তল্পিবাহক হিসেবে তাকে ট্রিট করা হবে, এটা সমর্থন করা যায় না। বাঙাল ভাষা বের হলেই বোঝা যায়, নিলয় রেগে গেছে। শুধু তাই নয়, সে তখন অন্যের সমস্যা নিয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ে।
বিদিশার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে নিলয় বলল, ‘দুই জনে সারাক্ষণ ফুসুর ফুসুর করতাছে। করুক। কিন্তু আমাগো তা জানা দরকার কি কইতাছে ওরা। হ, আপনিরেই কইতাছি— রিপোর্টার তো! কিছু তো জানা দরকার। ভিতরকার কথার্বাতা। সবই যদি সংগুপ্ত রইয়া গেল, আর সংবেদনে থাকবটা কি?’
‘ঠিক। ইউ আর রাইট।’ বিদিশা একমত। ‘তা ছাড়া, দেখুন ছবির ব্যাপারে কিন্ত আমি আপনার ওপরেই নির্ভর করছি। কিন্তু সেদিকেও তো বিশেষ—’
‘ঠিক! ইউ আর রাইট?’— বিদিশার কথার স্টাইল রপ্ত করার চেষ্টা করছে নিলয়, ‘আশা নাই। আশার আলোক দেখতাছি না।’
নিলয় বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে মধুমিডার ফোটোগ্রাফ তোলার টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো নিয়ে। যেমন, সেখানে আলট্রা-ভায়োলোট কীরকম ইত্যাদি। কোনো উত্তর পায়নি। তবে আশ্বস্ত করা হয়েছে, ওগুলো মাইনর ব্যাপার। পৌঁছবার পরেও জেনে নিতে পারবে।
হঠাৎ ডাইনিং রুমে লাউড স্পিকার গমগম করে উঠল, ‘মিস্টার সেন। ঝন্টু সেন। প্লিজ রিপোর্ট টু ইনফরমেশন। দিস ইজ আরজেন্ট!’
ঝন্টুমামা একা নয়, ওরা সকলেই পা চালিয়ে হাজির হয়েছে ইনফরমেশনে। কাউন্টার থেকে একটা টেলিগ্রাম বাড়িয়ে ধরল।
ঝন্টুমামার কাঁধের পাশ দিয়ে সবাই উঁকি মারছে, ‘সরোজ ইন ডেথ বেড, স্টপ। রুমা।’
ঝন্টুমামার সংসারে তাঁর এই দাদা ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণীর কথা কেউ শোনেনি। রুমা মানে বৌদি।
ঝন্টুমামা টেলিগ্রামটা কুচিকুচি করে ফেলে দিল।
‘বোগাস!’ এক শব্দের মন্তব্য। আমাদের মুখের অবস্থা দেখে বোধহয় একটু করুণা হল। বলল, ‘সরোজ বা রুমা জানেই না আমি কোথায়! এখানে টেলিগ্রাম পাঠাবে কী করে?’
অর্ধভুক্ত অবস্থায় নিলয়ের বুদ্ধিটা বেশি চাঙ্গা হয়। তার আরেকটা প্রমাণ পাওয়া গেল, ‘কিন্তু তুমি সরোজবাবুকে বলেছিলে যে সুন্দররাজনের কনফারেন্সে যাচ্ছি? আমি নিজের কানে শুনেছি। রুমা বৌদি যদি ওঁকে জানিয়ে থাকেন…’
রাহুল বোস বলল, ‘ভেরি ফিশি অ্যাফেয়ার। কিন্তু সুন্দররাজনের কাছ থেকে কনফার্ম করে নিলেই তো হয়।’
৪
বলা যত সহজ কাজটা তা নয়। জেনারেল শর্মার লেভেল অবধি পৌঁছবার পর দিল্লীতে সুন্দররাজনকে এস.টি.ডি-তে ধরা গেল।
‘ডক্টর সুন্দররাজন। ঝন্টু সেন অন দিস এন্ড।’
‘সরি সেন! আপনার ট্রিপটা বোধহয় ক্যানসেল করতেই হবে। আপনার বাড়ি থেকে ফোন পেয়েই…
ঝন্টুমামার গলাটা হঠাৎ বেমক্কা ভীষণ সরু আর ভীষণ শোনাল, ‘বাড়ি? আমার বাড়ি থেকে? কোন বাড়ি থেকে? বলেছে কিছু?’
‘না, মানে, তা তো বলেনি—’
ঝন্টুমামার অট্টহাসিটা কেউ আশা করেনি।
‘শুনুন ডক্টর সুন্দররাজন। ওটা একটা ভূতুড়ে ফোন। সরোজদা অলরেডি প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে বেরিয়ে পড়েছে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাজেই সেরকম কিছু ঘটলে, বৌদি প্রথমেই বলত, কোথায় ব্যাপারটা ঘটেছে। ডু ইউ গেট ইট?’
রিসিভারটা নামিয়ে রেখে ঝন্টুমামা বলল, ‘এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তা হলে! যাতে আমার মধুমিডা যাত্রাটা পন্ড করা যায়।’
‘শুধু আপনাকে ঠেকানোর জন্যই বা এত চেষ্টা কেন? আমাদের কি তা হলে কোনো ফ্যাক্টর বলেই মনে করে না নাকি! আপনি না গেলেও নিশ্চয় আমাদের অভিযানে বাতিল হবে না?’ বিদিশার আক্রমণ গায়েই মাখেনি ঝন্টুমামা। কিন্তু ক্ষুদ্ধ হল রাহুল, ‘মিস্টার সেন না গেলে অবশ্যই আমাদের আর যাওয়ার কোনো মানেই হয় না।’
মেঘ জমছে দেখে ঝন্টুমামা বলল, ‘আজ শুধু আমরা ক-জন আলাদাভাবে ডিনার করব একসঙ্গে। অনেক কথা আছে আলোচনার।’
নিলয়ের মুখ শুকিয়ে গেল। এয়ার ফোর্স মেসে আজ স্পেশাল খানাদানার জন্য নিমন্ত্রণ হয়েছিল। সেটাও ফস্কে গেল মনে হচ্ছে। অনেক কষ্টে সামলেছে নিজেকে।
আপশোষ অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ঝন্টুমামার ঘরেই জমা হয়েছিল সকলে। টেবিলের ওপর একটা ম্যাপ পেতে ঝন্টুমামা বোঝাতে শুরু করেছিল কোথায় গিয়ে নামবে ওরা, কীভাবে ক্যাম্প পাতবে… হঠাৎ দরজায় দমাদম ধাক্কা দিয়ে, বিনা অনুমতিতেই ঝড়ের মতো ঢুকে পড়ল একজন। সামরিক বাহিনীর বেশধারী।
মুখ-চোখের উভ্রান্ত চেহারা, ‘সরি স্যার! কমোডোর তরকদার এবং আরও দশ জন সিরিয়াসলি অসুস্থ। ‘পুষ্পক’-এর সব ক্রু মেম্বাররাই। ফুড পয়জন। সবাই হাসপাতালে। ডিনারের মধ্যেই নিশ্চয় এমন কোনো আইটেম ছিল ইন্সট্যান্ট রিঅ্যাকশন…’
তা হলে বিদিশা ঠিকই ধরেছিল। টার্গেট শুধু ঝন্টুমামা একা নয়।
কমোডোর তরকদার ও তাঁর সহকর্মীরা যখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে ‘পুষ্পক’ পাড়ি দিল মধুমিডার উদ্দেশে। ঠিক যে দিন যে সময়ে ছাড়ার কথা তার এক চুলও এদিক ওদিক হয়নি। এও এক ধরনের সফলতা নিশ্চয়। দুষ্কৃতকারীরা নিশ্চয় ভাবতেও পারেনি যে ‘পুষ্পক’ এর পাইলট ও যুবতী পরিচালক অসুস্থ হয়ে পড়ার পরেও যাত্রায় বাধা পড়বে না। (জেনারেল শর্মা হার মানার পাত্র নয়। দু-ঘণ্টার মধ্যে ‘পুষ্পক’ এক নতুন সারথি ও তার টিম নির্বাচন করে ফেলেছিলেন।)
নিলয়ের মনে হল তিন রাত্তিরের খাওয়া এক সঙ্গে খেয়ে ফেলেছে। শরীরটা এমন ভারী। ক্রমেই যেন তলিয়ে যাচ্ছে সিটের মধ্যে।
সুমনের চাপা গলায় উত্তেজনা প্রকাশ পায়, ‘টেক অফ! টেক অফ! মাই গড!’
বিদিশা বলল, ‘ভাগ্যিস বুঝতে পেরেছিস! সত্যি, তোর মতো বুদ্ধিমান সঙ্গে আছে বলেই ভরসা!’
‘ঠাট্টা করবি কর। কিন্তু একটা কথা জানিয়ে দিই। বেজায় তো সাহসী তোরা। আর আমি একাই গর্দভ। কিন্তু এয়ার ফোর্স যদি এতই এফিসিয়েন্ট তা হলে বিষটা মেশানো হল কি করে শুনি ওদের খাবারে। তার মানে সর্ষের মধ্যেই ভূত’ সুজনকে মাঝপথেই থামিয়ে দিল বিদিশা।
বলল, ‘অনেক তো থিয়োরি দিলি। এলি কেন তাহলে সব জেনে বুঝে। সেই যে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করেছিস—’
সুজন ক্ষেপে আগুন, ‘এসেছি শুধু ঝন্টুমামার জন্যে। বুঝেছিস? খবরের কাগজে রিপোর্ট পাঠিয়ে তোর মতো ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার জন্য নয়…’
আরও কিছু বলার ছিল সুজনের। কিন্তু শরীরের ভারটা আবার হালকা হয়ে আসতে একটু থমকে গেল। মাধ্যাকর্ষণের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে ‘পুষ্পক’। আর ত্বরণ নেই এবার স্থির গতিতে ছুটতে শুরু করেছে।
নিলয়ের মনে পড়ে গেল, মধুমিডায় যে ক’দিন থাকবে, খাওয়াদাওয়া যে কী জুটবে তাই নিয়ে এদের কারুরই কোনো মাথাব্যথা নেই। প্রয়োজন মতো খাদ্য সঙ্গে নেওয়া হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে যে রকম স্নাবিং শুনেছে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে, সকলে না খেয়ে শুকিয়ে মরলেও সে আর পাঁচ জনের উপকার করার চেষ্টা করবে না।
‘শুভ যাত্রা! শুভ যাত্রা!’
মহাকাশযান পুষ্পকের সারথির গলা শোনা গেল মাইক্রোফোনে, ‘আমরা হিসাব মতো ঠিক সময়ে রওনা হয়েছি। পৃথিবীর আকর্ষণ ছাড়িয়ে এখন ছুটে চলেছি মধুমিডার দিকে। আপনারা জানেন নিশ্চয় যাত্রাপথ সুদীর্ঘ। তিন মাস সাতাশ দিনের যাত্রার ক্লান্তি কমাবার জন্য আমরা এখন আপনাদের ঘুম পাড়িয়ে দেব। হিম-ঘুম। হাইবারনেশন। শুধু আপনারা নয়, পুষ্পকের পরিচালকরাও তাই করবে। শুধু অতন্দ্র পাহারা দেবে স্বয়ংক্রিয় অটো কম্পিউটার!’
রাহুল গলা ছেড়ে প্রতিবাদ জানাল, ‘না। আমি ঘুমোতে চাই না। জেগে থাকতে চাই। এ-কথা কিন্তু একবারও আগে জানানো হয়নি।’
মাইক্রোফোন রাহুলকে অবহেলা করেনি। বিনীতভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ‘দুঃখিত। জানানোর দায়িত্বটা আমাদের নয়। আপনার কোনো অভিযোগ থাকলে নিশ্চয় করবেন। কিন্তু এখন নয়। ফিরে আসার পরে। হিসেব মতো রসদ নিয়ে পাড়ি দিয়েছি আমরা। আমাদের মধ্যে একজনকেও যদি পুরো যাত্রাপথ জাগিয়ে রাখতে হয় তাহলে রেশনে টান ধরবে। আপনারা জানেন নিশ্চয় যে হিমঘুমে থাকার সময়ে প্রাণীর আহার গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনেক কমে আসে। ইচ্ছার কথা তো ধর্তব্যই নয়।’
সুজন গুনগুন করে একটা সুরে ভাঁজতে শুরু করেছে। বিদিশা তার নিজের সিট থেকে বাঁ দিকে কাত হয়েও, ধরতে পারল না কি গান। জিজ্ঞেস করল, ‘আননোন সামথিং মনে হচ্ছে? নিজের কম্পোজিশন?’
‘আজ্ঞে না। অতি প্রাচীন। ঐতিহ্যেকে বিসর্জন দিলে যা হয়। রামমোহন রায়ের নাম শুনেছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাঁরই লেখা। ক্ল্যাসিক। মনে করো শেষের সে দিন কী ভয়ঙ্কর।’
‘ওহ! রামমোহন না বলে বল চারুলতা। তোর সব সোর্সই সেকেন্ডারি।’
একটা মিষ্টি গন্ধ এরই মধ্যে আবিষ্ট করে ফেলছিল ওদের। একটা কুয়াশা যেন বিছিয়ে পড়ছে ‘পুষ্পক’-এর যাত্ৰীকক্ষে। গান থামিয়ে মুখের কাছে হাত ধরল সুজন। ঘুমের লক্ষণ হিসাবে ঠোঁট দুটো ফাঁক হতে চাইলে সেটাকে গোপন করাই নাকি ভদ্রতা।
বিদিশার আরেক পাশ থেকে নিলয় ঝুঁকে পড়ল, ‘হ্যাঁরে, তোর কাছে চকোলেট টকোলেট আছে নাকি? আমাদের তো কিছু সঙ্গে রাখতে দেয়নি। তোর তো তবু হ্যান্ডব্যাগটা—’
নিলয় হাত বাড়িয়েছিল। বিদিশাও ব্যাগ খুলতে গিয়েছিল। সেই ভঙ্গিতেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। ওদের তিন জনের ঠিক সামনে, ঝন্টুমামা ও রাহুল। দু-জনের মাথা ঠেকে রয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তেও মধুমিডার ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করছিল ওরা।
‘সুপ্রভাত সুপ্রভাত!’ বহু দূর থেকে ভেসে আসছে সম্ভাষণ এতগুলো দিন পেরিয়ে গেছে কিন্তু তার কোনো অনুভবই নেই। মনে হচ্ছে, এই তো গত রাত্তিরেই রওনা হয়েছিল। সেই অসমাপ্ত কথার খেই ধরেই নিলয় বলল, ‘চকোলোটটা এখনো পাইনি কিন্তু।’
সামনের সিট থেকে ঝন্টুমামা একটু পিছন ফিরে বললেন, ‘ঘোষণাটা কিন্তু রীতিমতো অবৈজ্ঞানিক। মহাকাশে আবার সুপ্রভাত কি?’
খবরটা মাইক্রোফোনই দিল। বোঝা যাচ্ছে, যাত্রীদের যাবতীয় কথাবার্তা রুদ্ধ লাউঞ্জের দেওয়াল পেরিয়ে রকেটের পরিচালনা কক্ষে ঢুকতে পারে। সে রকম ব্যবস্থা করা আছে।
‘ঘুম ভাঙার পর পৃথিবীর রেওয়াজ মেনেই সুপ্রভাত জানিয়েছি আমরা। রাত কেটে গেছে, এই অর্থে সুপ্রভাত নয়। ধন্যবাদ।’
এবার দ্বিতীয় ঘোষকের গলা শোনা গেল, ‘আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই আপনারা অবতরণ করবেন মধুমিডায়। তার আগে আমাদের অনুরোধ। আপনারা নতুন ঘড়ি মিলিয়ে নিন।’
মধুমিডায় এগারো ঘণ্টার ব্যবধানে সূর্যোদয় হয়। হিসেবের সুবিধার জন্য ওদের প্রত্যেককে বিশেষভাবে তৈরি রিস্টওয়াচ দেওয়া হয়েছে। সাধারণ ঘড়ির ডায়ালের মতো এখানেও বারোটা ঘর আছে কিন্তু কাঁটা ঘোরে তাড়াতাড়ি। এই ঘড়ির বারো ঘণ্টা পৃথিবীর হিসেবে সাড়ে পাঁচ।
ঝন্টুমামা অদৃশ্য বক্তাকে জিজ্ঞেস করলে, ‘তার মানে, মধুমিডার ঠিক কোন জায়গায় আমরা অবতরণ করব, সেটা আপনারা ঠিক করে নিয়েছেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ— আপনার মানচিত্রে যে স্থান নির্দিষ্ট করেছেন, সেখানেই নামবেন আপনারা। মধুমিডা— সময়ে সকাল আটটায় নতুন ঘড়ির সময় অনুসারে মধুমিডার সূর্যোদয় ছ-টা বারো মিনিটে।’
ঘড়ি মেলাবার পর নিলয় বলল, ‘নামার সময় তো হয়ে এল। সুপ্রভাত বলার পর প্রাতরাশ দেওয়াটাই রীতি নয় কি!’
সুজনের অন্য চিন্তা, ‘স্পেস স্যুট, অক্সিজেন এসব দেবে কখন? আমরা তো একবারও সেসবের মহড়াই দিইনি।’
রাহুল হাসতে শুরু করে, ‘মধুমিডায় প্রায় নেমে পড়লেন এখনও জানেন না যে, ওসব কিস্যু লাগবে না?’
মধুমিডা চাঁদ নয়। পৃথিবীর চেয়েও মনোরম ও স্বাস্থ্যকর এখানকার বায়ুমণ্ডল। যদিও মাধ্যকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর আট ভাগেরও কম।’
মধুমিডাকে ঘিরে দু-বার চক্কর মেরেছে ‘পুষ্পক’, এবার তার কম্যান্ড মডিউল বিচ্ছিন্ন করার সময়। অবশ্য তার জন্য পাঁচ অভিযাত্রীকে নিজের আসন ছেড়ে নড়তে হয়নি। শুধু ফ্লাইং অফিসার সেন এসে যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে।
মূল মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর সেনই গ্রহণ করবে মধুমিডায় অবতরণ পর্বের তদারকি।
‘শুভযাত্রা! পুষ্পক’-এর কম্যান্ডার অরোরা রেডিয়ো অফিসার দয়াল আর নেভিগেটর ঘোষের তরফ থেকে অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আপনাদের অবতরণ ও প্রত্যাবর্তন নির্বিঘ্ন হোক।’
৫
মধুমিডার পিঠে সবুজ ভেলভেটের ওপর আছড়ে পড়ল কম্যান্ড মডিউল। ‘পুষ্পক’-এর যাত্রীবাহী ফেরি। আচমকা কুস্তিগীরদের এক বাহিনী যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে যাত্রীদের ওপর। এলোপাথারি আক্রমণে কে কোথায় ছিটকে গেছে ঠিক নেই। সেকেন্ডের কয়েক ভগ্নাংশ। তারপরেই গোঙাতে শুরু করেছে বিপদসূচক ইলেকট্রনিক স্বর।
ঝন্টুমামা সেন-কে টেনে বার করছে পাইলটের সিটের তলা থেকে। কপালের ডান পাশ থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। কিন্তু সে দিকে তার দৃষ্টি নেই। কোনোরকমে নিজের আসন দখল করেই চোখ গুঁজে দিয়েছে কন্ট্রোল প্যানেলে। একের পর এক নির্দেশ পাঠাচ্ছে আর শুনে নিচ্ছে জবাব। ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করেছে ওরা। এখন ক্ষতির হিসেব নিকেশ।
সুজন নিলয় ও বিদিশা উঠে দাঁড়িয়েছে। তাদের আঘাত সামান্য। শুধু ঝন্টুমামার ডান হাত মচকে গেছে। মুখে কিছু বলছে না কিন্তু বেশ যন্ত্রণা হচ্ছে নিশ্চয়। আঙুল অবধি ভাঁজ করতে পারছে না।
এই মুহূর্তে অবশ্য দু-ফোঁটা রক্ত বা কালশিটের দিকে নজর বা চিন্তা কোনোটাই দেওয়া সম্ভব নয়। সবাই ঘিরে ধরেছে সেন-কে। কারুর মুখে কথা নেই। এই ফেরি রকেটের চোট-জখমের সমাচারই এখন একমাত্র জিজ্ঞাস্য। ফেরি অকর্মণ্য হলে ওরা আর মধুমিডা থেকে ফিরতে পারবে না। অন্তত মাস চারেকের জন্য তো নয়ই। পৃথিবী থেকে উদ্ধারকারী কোনো রকেট না আসা পর্যন্ত। মধুমিডাকে পাক খেয়ে যাবে পুষ্পক। কিন্তু এই ফেরি যান ছাড়া তাদের পক্ষে পুষ্পকের সঙ্গে মিলিত হওয়ার উপায় নেই।
সেন এতক্ষণে রেডিয়ো-কমিউনিকেশন স্থাপন করছে ‘পুষ্পক’-এর সঙ্গে, ‘কোড জিরো এক্স সিক্স! সেন হিয়ার অফ দা হুক! সেন অফ দা হুক!… থ্যাংক ইউ! মাইনর অ্যাকসিডেন্ট। … ইয়েস… চেক করেছি। না, সেরকম কিছু অ্যালার্মিং দুর্ঘটনা নয়। কয়েক দিনের মধ্যেই রিপেয়ার করে নিতে পারব। না, না এখুনি কোনো বিপদবার্তা পৃথিবীতে পাঠিও না। আমাকে চার দিন সময় দাও। তারপর সিদ্ধান্ত জানাব…’
সুজন আর থাকতে পারল না, ‘এরা কি ছেলেখেলা করছে নাকি! জোর জবরদস্তি সব আনাড়িদের হাতে রকেটের ভার ছেড়ে দিলে এই হয়!’
সেন-কে শুনিয়ে শুনিয়ে কথাগুলো বলেনি সুজন। আবার নির্ভেজাল স্বগতোক্তিও নয়। কিন্তু তার ফলে এই প্রতিক্রিয়া কেউই আশা করেনি।
ঝপ করে হাতের মাইক্রোফোন প্যানেলে ঝুলিয়ে দিয়ে পায়ের চাপে চেয়ারটাকে আধ পাক ঘুরিয়ে নিয়ে সেন সুজনের চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা ছুরির মতো কথাগুলো চালিয়ে দিল, ‘আপনি? আপনার অভিমত শুনেছি খুব ভালো। এবার জেনে রাখুন, আর একবার ওই ধরনের ঠেঁকা শব্দ যদি শুনি তা হলে এই আনাড়ি আর কিছুতেই এই ফেরি-যান সারাতে পারবে না। মনে রাখবেন— আপনি এবং আপনারা! সকলেই! আপনাদের সঙ্গে তুলনায় আমার প্রাণের ভয় একটু কম। না, কোনো বীরত্বের কেস নয়। কেউই আমাকে বছর খানেকের বেশি বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। ইন্টেসটাইনের ক্যান্সার। এই প্রথম পাঁচ কান হল কথাটা। যাই হোক, এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে আমার আত্মসম্মান বোধটা কেন একটু বেশি চড়া।’
কথা শেষ করার পর তার হাসি শুনে সত্যিই গা শিরশির করে ওঠে। এর মধ্যে পাগলামির একটা ছোঁয়া রয়েছে। প্রমাণ করা যাবে না কিন্তু অনুভব তাই বলে।
ঝন্টুমামার ডান হাতে চোট না লাগলে কি হত বলা মুস্কিল। কারণ, নেটা না হয়েও তার বাঁ হাতের খোঁচা খেয়ে প্রায় ককিয়ে উঠল সুজন। ঝন্টুমামা বলল, ‘অ্যাপোলোজাইজ। ক্ষমা চেয়ে নাও। না, কোনো কথা নয়।’
ক্ষমা চাওয়া মাত্র সেন অন্য মানুষ। সে নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে সুজনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ফরগিভ অ্যান্ড ফরগেট! বুঝতে পেরেছি— টেনশন।’
‘হেল্প! হেল্প!’ সেনের কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা ক্ষীণ কণ্ঠে ভেসে আসে। সকলেই তটস্থ।
বিদিশা প্রথম লক্ষ করে যে রাহুল তাদের মধ্যে নেই।
‘রাহুল! কোথায় আপনি?’ গলা চড়ায় ঝন্টুমামা।
উত্তরে আবার শুধু ‘হেল্প! হেল্প!’
অনেক কষ্টে রাহুলকে তার নিজের আসনের তলা থেকেই উদ্ধার করা হয়েছে। কোথাও কোনো কাটাকুটির চিহ্ন নেই কিন্তু অর্ধ-অচৈতন্য। বিদিশা ফিসফিস করে বলল, ‘হেড ইনজুরি নয়তো?’
সুজন ও নিলয় পাঁজাকোলা করে রাহুলকে একটা আসনের ওপর বসাবার চেষ্টা করা মাত্র ককিয়ে উঠেছে যন্ত্রণায়। এতক্ষণে জ্ঞান ফিরেছে ‘পা! পা! ডান পা-টা বোধহয় ভেঙে গেছে! সাবধান!’
হাঁটুতে প্লাস্টার থাকলে যেমন হয়, রাহুল ডান পা-টা আড়ষ্টভাবে সিধে করে বসেছে। ‘একটু জল প্লিজ।’
অনেকটা ধাতস্ত হয়েছে রাহুল। এখনও চেয়ারে মাথা ঠেস দিয়ে চোখ বুজেই আধ শোয়া কিন্তু আলোচনায় যোগ দিচ্ছে প্রয়োজন মতো।
পরিকল্পনার কিছু কিছু পরিবর্তন দরকার হয়ে পড়েছে। সেনের পক্ষে ফেরি ছেড়ে নামা সম্ভব নয়। অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত না মেরামতির কাজ শেষ হচ্ছে। অবশ্য এখানে বসেই সে ‘পুষ্পক’-এর মধ্যস্থতায় পৃথিবীর সঙ্গে রেডিয়ো সংযোগ রক্ষা করার দায়িত্বটা নিতে পারে। মধুমিডায় যারা নামবে, তারা ট্রান্সমিটারের সাহায্যে সেনের কাছে খবর পাঠাবে। সেন সেটা রিলে করবে। রাহুল পায়ে চোট পেয়েছে। কাজেই তাকেই নিতে হবে মধুমিডার রেলস্টেশনের দায়িত্ব।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিদিশা বলল, ‘পৌনে ন-টা বাজছে। দিনের আলো থাকতে থাকতেই নিশ্চয় আমাদের ক্যাম্প-খাটানোর পর্বটা শেষ করা দরকার।’
ঘন ঘন মাথা নেড়ে সায় দেয় রাহুল।
ঝন্টুমামা জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু আপনি কি নামতে পারবেন এখুনি?’
রাহুল বলল, ‘কারগো লিফটে চড়ে নেমে পড়ব। মালপত্র নামানোর জন্য সেরকম একটা ব্যবস্থা তো আগের বার দেখেছি।’
সেন ঘাড় না ফিরিয়েই বলল, ‘ইউ আর রাইট। আপনি কার্গো রেলস্টেশনের কাছে চলে আসুন। বাকি সকলে এক্সিট ডোর-এর কাছে গিয়ে দাঁড়ান। দরজা খুলে যাওয়ার পর একে-একে নামবেন। আপনারা নেমে যাওয়ার পর আমি আবার মই গুটিয়ে তুলে নেব।’
সুজন ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তা হলে আপনি আবার মই না নামালে আমরা আর এখানে ফিরতেই পারব না?’
সেন হাসি চেপে বলল, ‘ঠিক তা নয়। হার্ট অ্যাটাকে আমি অকস্মাৎ চন্দ্রবিন্দু হয়ে গেলেও আপনাদের টিম লিডার সংকেত জানেন। ট্রান্সমিটারের সাহায্যে নির্দেশ দিলেই লোহার মই আপনা থেকেই নেমে যাবে।’
‘নিরাপত্তা রক্ষার এমন কড়াকড়ি দেখে এখনই যে বুক শুকিয়ে যাচ্ছে।’ নিলয় বলল।
‘উপায় কি? এই কম্যান্ড মডিউলই সবচেয়ে ভালো নারে বল। এইটি যদি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলেই সব শেষ। মধুমিডা থেকে আর ফেরার…’ কথাগুলো কেটে কেটে বলল রাহুল।
লাল হরফে ‘এক্সিট’ শব্দটা দপ্ দপ্ করতে শুরু করেছে। যেন বলতে চাইছে আর দেরি নয়।
রাহুল তার সামনের সিটের মাথার অংশটা ধরে শরীরটাকে ঠেকিয়ে কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়েছে। সিটের অবলম্বন নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোচ্ছে মালপত্তর রাখার অংশে। বাকি সবাই সারি দিয়েছে বাইরে বেরোবার দরজার সামনে।
বিদিশা বলল, ‘উফ! এ যেন দেশলাইয়ের বাক্সে ভরে আমাদের ছুড়ে দিয়েছে পৃথিবী থেকে! রকেটে ওঠার পর থেকে বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।’
সুজন গুনগুন করে গান ধরেছে, ‘জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না।’ সেই শুনেই নিলয় বলল, ‘সুজন, তোর কিন্তু সবার আগে নামা উচিত। তুই আমাদের অফিসিয়াল ফোটোগ্রাফার। প্রথম পদক্ষেপের ছবি…’
‘সেইটা আমি ওপর থেকে নিতে চাই বলেই তো সবার পিছনে দাঁড়িয়ে।’
দরজার পাল্লাটা স্লাইড করে সরে যেতেই এক ঝলক আলো আর তাজা হাওয়ার ঝাপটা। সারা রাত বন্ধ ঘরে কাটানোর পর দরজা খুলেই চোখেমুখে সূর্যের নবীন আলোর স্পর্শের মতো।
সিঁড়িতে পা রাখার সুযোগ পায়নি ঝন্টুমামা। সবাই মিলে এমন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে দরজার মখে। মধুমিডার সঙ্গে এই প্রথম রক্তমাংসের স্পর্শ— চোখের দেখা।
৬
গোড়ালি অবধি ডুবে যাচ্ছে চটচটে নরম সবুজ উদ্ভিদের মধ্যে। মধুমিডার ঘাস।
বিদিশা ঘড়ির দিকে একবার চোখ দিয়েই নোটবই খুলে লিখে নিল, ‘জিরো নাইন হাওয়ার, এইট মিনিট। মধুমিডা টাইম।’
নিলয় এক খামচা ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে নিল। প্রথম স্যাম্পেল। বলল, ‘ঝন্টুমামা, ঘাস বলছি বটে, কিন্তু এটার সঙ্গে ব্রাহ্মী শাকেরই বেশি মিল।’
‘একটু চিবিয়ে পরীক্ষা করে নিতে পারিস তো। ঠাকুর্দার নামটা যদি মনে পড়ে যায় তাহলেই হবে। স্মৃতিশক্তি সালসা হিসেবে পৃথিবীতে কি রকম ডিমান্ড হবে ভেবে দ্যাখ!’— বিদিশার খোঁচা হজম করে নিল নিলয়। কারণ একটাই— সুজনের চিৎকার, ‘সমুদ্র! বিশাল সমুদ্র!’
মধুমিডায় নেমেই ওরা চার জন বিনা পরিকল্পনাতেই চার দিকে পা বাড়িয়েছিল। রাহুল এখনও নামেনি।
নরম সবুজ ঘাস দিগন্ত বিস্তারী সমুদ্র, সূর্যের মতোই এক নাম না জানা নক্ষত্রের উজ্জ্বল উপস্থিতি— সব সত্ত্বেও অল্প সময়ের মধেই তারা একটা অস্বস্তিকর জিনিস আবিষ্কার করেছে।
প্রকৃতির কারাগারে তারা এখানে বন্দি।
একটা টিলার মাথায় এক ফালি সমতল ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে তারা। পায়ের নীচে, তার দু-দিক ঘিরে সমুদ্র আর বাকি অংশ জুড়েই চড়া পাহাড়ের গা বেয়ে গহন বন।
আসলে বিরাট একটা পাহাড়ের গায়ে একটা চাতালের মতো এই অংশটা।
ঝন্টুমামা বলল, ‘ঘোরাঘুরির অনেক সময় পাওয়া যাবে। আগে তাঁবু খাটানোর কাজ শেষ করো।’
রাহুল এবং প্রয়োজনীয় মালপত্র সবই কার্গো লিফটে করে নেমে এসেছে ইতিমধ্যে। প্রত্যেকের জন্যে আলাদা তাঁবু। অবশ্য রাহুলের তাঁবুটা সুজন আর নিলয়কেই দাঁড় করাতে হয়েছে। নানা রঙের তাঁবুগুলো এখন বৃত্তের মতো ঘিরে ধরেছে কম্যান্ড মডিউলের তেপায়া স্তম্ভকে।
রাহুল তাঁবুতে ঢুকে ক্যাম্প-খাটে লম্বা হয়ে পড়েছে। কোল্ড টি-এর পেপার প্যাক স্যান্ডউইচ হাতে বাকি সবাই মধুমিডার খোলা মাঠে প্রথম বৈঠকে যোগ দিয়েছে।
বিদিশা বলল, ‘ঠিক এই জায়গাটাতেই কি আমাদের নামার কথা ছিল?’
ঝন্টুমামা উত্তর দেয়নি। এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন প্রশ্নটা যে তাকেই করা হয়েছে সেটা বুঝতেই পারেনি।
‘এত পরামর্শ করে শেষে এইরকম বেখাপ্পা একটা জায়গা বাছলেন কেন ঝন্টুমামা?’ সুজন সরাসরি পদ্ধতিতে বিশ্বাসী।
‘যে জায়গাটা আমি আর রাহুল বেছেছিলাম, সেখানেই অবতরণ করেছি কিনা এখুনি বলতে পারব না। তবে জায়গাটা এরকম বেখাপ্পা বলেই মনে হচ্ছে যে আমরা বোধহয় খুব ভুল করিনি।’
‘মধুদের অতর্কিত আক্রমণের সম্ভাবনা কম—’ বিদিশাকে কথা শেষ করার সুযোগ দিল না নিলয়।
‘তার থেকে একটা লোহার খাঁচায় ভরে আমাদের নামিয়ে দিলেই হত। এখানে তো যা বুঝছি শুধু দূরবীণ বা টেলিস্কোপ চোখে লাগিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই।’
কথার পিঠে কথাকে আর এগোতে দিল না আগন্তুক।
তার গুঞ্জন কানে এসেছিল সবারই। শব্দকে অনুসরণ করতেই চোখে পড়ল একটা প্রজাপতি আশ্চর্য রঙিন ডানা নেড়ে তাদের মাথার ওপরে এসে পাক খাচ্ছে।
মধুমিডার প্রথম প্রাণীর সঙ্গে পরিচয়। সুজন সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে তুলে নিয়েছে ক্যামেরা।
প্রথম দর্শনে মনে হয়েছিল প্রজাপতি। সেটার একমাত্র কারণ রংবাহারী ডানা। আকারের দিক থেকে ওটা কিন্তু প্রায় বুলবুলি পাখির মতো।
সাত-আটটা ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছে সুজন। পাখি বা প্রজাপতিটা ওদের মাথার ওপর সমানে ঘুরপাক খাচ্ছে।
ঝন্টুমামা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে হাততলি দিতে শুরু করল।
ফলটা ভালো হল না। এটা ঠিক যে পতঙ্গটা ক্রমেই তার বৃত্তটা ছোটো করে আনছিল এবং নীচের দিকে নেমে আসছিল। কিন্তু হাততালি দিতেই সেটা ডাইভ মারল। বিদিশার ঘাড়ের ওপর এসে বসল।
আর্তনাদ করে উঠল বিদিশা। বুঝতে অসুবিধে নেই যে এটা শুধু ভয় বা ঘেন্না নয়। অনেকে যেমন আরশোলা গায়ে বসলে আঁতকে ওঠে।
যন্ত্রণায় সিঁটিয়ে গেছে বিদিশা। তার হাত থেকে পেপার কাপ খসে পড়েছে। নিলয় সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে এক চড়ে তার ইহলীলা সাঙ্গ করে দিল। ঝন্টুমামা বাধা দিতে লাফিয়ে ওঠার আগেই অনেকটা প্রবৃত্তি বশতই নিলয় পায়ে করে পিষে দিয়েছে তাকে।
ঘাড়ের ওপর হাত রেখেই শিউরে উঠল বিদিশা। গঁদের আঠার মতো চটচটে নীলচে রস লেগে আছে। কিন্তু সে দিকে আর নজর দেওয়ার সুযোগ হয়নি।
দশটা জেট প্লেন যেন পাশের বন থেকে একসঙ্গে পাড়ি দিয়েছে। এমন ভয়ানক গর্জন। স্তম্ভিত হয়ে সবাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। আকাশ ছেয়ে পঙ্গপালের মতো যারা এগিয়ে আসছে তাদের সবাইকার ডানাতেই রামধনু কাঁপছে। মধুমিডার বিষাক্ত প্রজাপতিরা দল বেঁধে আক্রমণ করতে আসছে।
‘পালাও! পালাও! তাঁবু।’ সুজন চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু নিজে নড়েনি। দুর্যোগের মুহূর্তেও শেষ একটা ছবি তোলার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না।
ঝন্টুমামা বিদিশার হাত ধরে ছুট লাগায়। নিলয়ও আর দেরি করেনি। চোখের পলকে পতঙ্গরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নিলয় নিজের ক্যাম্প ছেড়ে বিদিশারটাতেই ঢুকে পড়েছে।
ঝন্টুমামা বিদিশাকে নিয়ে নিজের ক্যাম্প।
সুজন চোখ থেকে ক্যামেরা নামানোর আগেই ঘটে গেল কাণ্ডটা। এক ইঞ্চি নড়ার সুযোগ পায়নি। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো হাজার হাজার নরম পাখার ঝাপটা খেয়ে সে চোখ বুজে ফেলেছে। কিন্তু একটি পতঙ্গও আক্রমণ করেনি সুজনকে।
সুজন ফিরতে পারেনি বুঝে ঝন্টুমামা আর বিদিশা তাঁবু থেকে আবার বাইরে পা ফেলেই চমকে গেল।
হলুদ তাঁবুটা অদৃশ্য হয়ে গেছে বিষাক্ত প্রজাপতির উড়ন্ত ঝাঁকের তলায়। ছেঁকে ধরেছে তাঁবুটাকে।
ঝন্টুমামা বলল, ‘সাংঘাতিক! ওইটাতেই কিন্তু ঢুকেছে নিলয়।’
‘ওকে তো জ্যান্ত খেয়ে ফেলবে। কিছু একটা করুন ঝন্টুমামা!’
ঝন্টুমামা পকেট থেকে একটা রিভলবার টেনে বার করল। যেন খুব চিন্তিতভাবে এখনও মনস্থির করতে না পেরে ধীরে ধীরে লক্ষ্যের দিকে মুখ ফেরাচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্রের।
‘আপনি কি পাগল হলেন? গুলি চালাবেন ওদের ওপর?’
ঝন্টুমামা জবাব দেয়নি। শুধু ট্রিগারটা টিপে মেশিনগানের মতো রিভলবারের মুখটা একটা নির্দিষ্ট বৃত্তপথে নেড়ে চলেছে।
কোনো বিস্ফোরণের শব্দ নেই, আগুনের হলকা নেই, চোখে কোনো বুলেট বর্ষণও ধরা দেয়নি। কিন্তু সেকেন্ড না পেরতেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল পতঙ্গরা। প্রথমে তারা তাঁবু ছেড়ে উঠে গেল আকাশে। কিছুক্ষণ বেশ কিছুটা ওপর থেকে চক্কর মারার পর আচমকা যেন সব জেট প্লেনের ইঞ্জিন এক সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল। নিঃশব্দে ঝাঁক বেঁধে ফিরে গেল তারা বনের দিকে।
তাঁবু ফুটো করে কুড়ি-পঁচিশটা পতঙ্গ আক্রমণ করেছিল নিলয়কে। কিন্তু কামড়ায়নি। নিলয়ের মতে শুধু ভয় দেখিয়েছে।
বিদিশাও স্বীকার করেছে, সে শুধু ভয়েই চেঁচিয়ে উঠেছিল। প্রজাপতি তাকেও দংশন করেনি।
সুজন বলল, ‘সে যাই হোক, এটা স্পষ্ট যে ওরা নিলয়কেই টার্গেট করেছিল। ওকেই ওরা হত্যাকারী হিসেবে…’
৭
ঝন্টুমামার আশ্চর্য অস্ত্রের কথাটা হঠাৎ খেয়াল হয় বিদিশার।
‘আলট্রাসনিক গান।’ ঝন্টুমামা বললেন।
কিন্তু কোনোরকম অস্ত্র আনার তো কথা ছিল না।’ রাহুল কখন খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে এসেছে কেউ লক্ষ করেনি।
‘আরে মশাই, আপনি এতক্ষণ ছিলেন কোথায়?’ সুজন জিজ্ঞেস করে।
‘ওই হিংস্র ইনসেক্টগুলো তোমাদের তাড়া করেছে দেখেই সটান স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়েছিলাম বাপ্রে।’
‘এদের সঙ্গে আগের সফরে তোমার মোলাকাত হয়েছিল নাকি?’ ঝন্টুমামার প্রশ্ন।
‘না, তা হয়নি। তবে এর চেয়েও ঢের ভয়ঙ্কর সব জন্তু দেখেছি। কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না তো!’
‘অস্ত্রের কথা? এটাকে কোনো অর্থেই অস্ত্র বলা যায় না। বধ করার ক্ষমতা দূরের কথা, কাউকে আহত করতেও পারবে না। এর থেকে বিশেষ ধরনের কম্পন সৃষ্টি হয় যা কানে শোনা যায় না। মধুমিডার একটিও প্রাণী— সে কীট হোক কি পতঙ্গ— তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার বেশি ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।’
উহ্ আহ্ করতে করতে রাহুল আবার তার তাঁবুতে ঢুকে গেল। ঝন্টুমামা বললেন, ‘ঘড়ির কাঁটা কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই জোরসে ঘুরছে। অভিযানে বেরতে হলে কিন্তু আর একটুও দেরি করা চলবে না।’
ঝন্টুমামা কী বলতে চাইছে মাথায় ঢোকে না। এখান থেকে কোথাও যাওয়ার উপায় আছে না কি। বিদিশা কামিনী গাছের মতো চেহারার ঝোপঝাড়ের পাশে পা ছড়িয়ে বসে পড়েছিল সমুদ্রের দিকে মুখ করে। ঢেউগুলো পাড়ে আছড়ে পড়ে তুঁতের মতো নীল ফেণার মেঘ ওড়াচ্ছে।
‘এখন প্রশ্নের সময় নয়। হাত লাগাও সকলে।’ ঝন্টুমামার তাঁবু থেকে পলিথিনের ব্যাগটা ওরা ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে এলো।
সুজন হাঁক ছাড়ল, ‘বিদিশা, মধুমিডার প্রথম কবিতাটা এখন অসমাপ্ত রেখে এদিকে এলে ভালো হত না?’
পলিথিনের ব্যাগের মধ্যে কী রহস্য আছে জানার জন্য সবারই কৌতূহল। ঝন্টুমামা হাত চালিয়ে কয়েকটা ফাঁস খুলে দিয়ে বলল, এবার তোমরা এই চারটে খুঁট ধরে চারদিকে টান লাগাও। মশারি টানোর মতো।’
ব্যাগের মধ্যে কিছু ছিল না। ব্যাগটাই স্বয়ং রহস্য। একটা পটলের মতো চেহারা হয়ে গেছে সেটার। তার সঙ্গে নানারকম দড়িদড়ার জটা আর কিছু অদ্ভুত চেহারার যন্ত্রপাতি।
ঝন্টুমামা বলল, ‘আমি যতক্ষণে হাওয়া গরমের ব্যবস্থা করছি, তোমরা চারটে খুঁটি পুঁতে বেলুনটাকে বাঁধার ব্যবস্থা করো।’
বিদিশা রীতিমতো উত্তেজিত, ‘আমরা তা হলে মগলফিঁয়েরের মতো গরম হাওয়ার ভেলায় চেপে মধুমিডা সফরে বেরোব?’
মোটেই খুশি হয়নি সুজন, ‘লক্ষ লক্ষ মাইল নিউক্লিয়ার রকেটে চড়ে মহাশূন্য পাড়ি দিয়ে এখন মধ্যযুগের বাহনে উঠে…’
নিলয় আরও ইন্ধন জোগায়, ‘মগলফিঁয়ে অষ্ঠাদশ শতাব্দীর মানুষ। মধ্যযুগের টাইম বোধহয় গুলিয়ে ফেলেছিল।’
‘আমি ইতিহাসের ডক্টরেট নই। কিন্তু এটা বলতে পারি যে ওটিতে আরোহণ করলে ফেরার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। বাতাসের টানে কোথায় যে নিয়ে যাবে…’ কথা শেষ করার আগেই কেমন হু হু করে তার গলার স্বর।
‘চুপ কর তো। কোথাও যেতে হবে না। এখানেই থাকব। এটা ক্যাপটিভ বেলুন। মানে বুঝিস?’ হাওয়া গরম করা স্টোভটাকে জুড়তে জুড়তেই ধমকে ওঠে ঝন্টুমামা।
মাটির সঙ্গে সংস্পর্শ পুরোপুরি ছিন্ন করবে না তারা। একটা দড়ির সঙ্গে বাঁধা থাকবে বেলুনটা। লাটাইয়ের সুতো ছাড়ার মতো কায়দায় শুধু আকাশে আরোহণ। অবশ্য হাওয়ার টানে দুলতে হতেই পারে। এলোমলো ঝড়ো বাতাসে ক্যাপটিভ বেলুনও বিপজ্জনক। কিন্তু সেরকম কোনো প্রাকৃতিক খামখেয়ালিপনার পরিচয় পায়নি তারা।
নিলয় আর বিদিশা প্রবল উৎসাহে ঝন্টুমামার আদেশ পালন করে চলেছে। সুজনও অমান্য করেনি কিন্তু তার স্বভাবটাই এমনি যে নিজের দুশ্চিন্তাগুলোকে অন্যকে শোনাতে না পারা অবধি স্বস্তি পায় না।
‘খামোখা আকাশে চড়ে লাভটা কী মশাই?’ নিজেকেই সরবে প্রশ্ন করে সুজন।
সুরমিলিয়ে বিদিশাও যেন আপন মনেই তার উত্তর দেয়, সুজনকে শুনিয়ে শুনিয়েই, ‘খামোখা কেন যে লোকে পৃথিবী ছেড়ে ভিন গ্রহে পাড়ি দেয়। খেতে পাচ্ছে, শুতে পাচ্ছে যখন, তার পরেও…’
নিলয় মধ্যপন্থী, ‘ঝন্টুমামা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? ভেবে চিন্তে বেলুন নিয়ে এসেছেন সঙ্গে করে। সেরকম প্রয়োজনের কথা ভেবে। কিন্তু বেলুনের চেয়ে স্পিড বোট বা অন্য কিছু…।’
‘না!’ জলদগম্ভীর স্বর ঝন্টুমামার! যে কারণে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র বহন করিনি আমরা, একই কারণে পরিবেশ দূষণ করতে পারে এমন কোনো জিনিসও এখানে আমদানি করতে চাইনি। কিঞ্চিৎ অক্সিজেন পোড়ানো ছাড়া মধুমিডার আর কোনো ক্ষতি করছি না। এমন কি বাতাস গরম করার এই বার্নারগুলো এমনভাবে তৈরি যে এক বিন্দু কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হবে না।’
‘কিন্তু কী উৎপন্ন হবে জানতে পারি?’ সুজনের নিরাশা দূর হওয়ার নয়।
‘কার্বন ডাই-অক্সাইড। মধুমিডা রীতিমতো সবুজ। কাজেই এর জন্য তার পরিবেশের কোনো বিঘ্ন ঘটার সুযোগ নেই।’
বেলুনের নীচে সংযুক্ত ফাইবার গ্লাসের চুবড়ির মধ্যে সুজন, নিলয় ও ঝন্টুমামা উঠে পড়েছে। সবার শেষে উঠবে বিদিশা। দড়ি দড়ার বাঁধন মুক্ত হওয়ার পর বেলুনে চড়ার জন্য কিছুটা দক্ষতা দরকার। হালকা ছিপছিপে চেহারা না হলে অসুবিধে হওয়ার কথা। একটু বাতাসের ছোঁয়া পেলেই বিদিশাকে কিছু জিমন্যাস্টিকের খেলা দেখাতে হবে। এবং এ-ব্যাপারে সকলেই একমত যে তাদের মধ্যে বিদিশাই শারীরিকভাবে সবচেয়ে পটু।
ঝন্টুমামার গলায় দূরবীণ ঝুলছে। এখনও তিনি হাওয়া গরম করতে ব্যতিব্যস্ত। সুজনের মুখ ঝুলে রয়েছে। আর নিলয় যে তাকে ধমক দিচ্ছে বোঝা যায় না, ‘সুইসাইড ভালো। আত্মঘাতী কাণ্ড করা হচ্ছে। খাদ্যদ্রব্যের কোনো রসদ না নিয়েই এইভাবে কেউ রওনা হয়।’
তিন নম্বর বাঁধন খুলতেই বেলুনটা এক ঝটকায় চার-পাঁচ হাত যেন হড়কে সরে গেল একদিকে। তাও তো এখনও আকাশে ওড়ার স্বাধীনতা পায়নি। বিদিশা তৎপর ও সতর্ক না হলে দড়ির ধাক্কায় ছিটকে পড়ত। মাটির ওপর ডাইভ দিয়ে চোট বাঁধিয়েছে। বেলুনের টানে দড়িটা যেরকম টান-টান হয়ে উঠেছে, ওটা যদি বিদিশার ঘাড়ে চেপে বসে, প্রাণ বাঁচানো কঠিন হবে। ভাগ্যিস হাওয়ার টানে বেলুনটা আরও কাত হয়ে পড়েনি। বুক হেঁটে বিপদ কাটিয়ে উঠে দাঁড়াল বিদিশা।
আরও একটা দড়ির বাঁধন খোলা বাকি, তার পরেই দড়ির সিঁড়ি বেয়ে বিদিশাকে উঠে আসতে হবে। এই দড়ির সিঁড়িটাই মাটির সঙ্গে আটকে থাকবে। নোঙরের শিকলের মতো। ঝন্টুমামা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘বিদিশা, আগে বাঁধন খুলো না। সিঁড়িটায় উঠে দাঁড়িয়ে তারপর ছুরি দিয়ে বাঁধন কাটো। না হলে…’
রাহুল খোঁড়াতে খোঁড়াতে প্রায় ছুটে আসছে দেখে বিদিশা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।
‘দাঁড়াও! দাঁড়াও!’ হাঁপাতে হাঁপাতে চেঁচাচ্ছে রাহুল, ‘আমাকে একা ফেলে, কিছু না জানিয়ে তোমরা কোথায় পালাচ্ছ।’
রাহুলের গলায় রীতিমতো আতঙ্ক। ‘নড়ার ক্ষমতা নেই। একা এই বিপদে…’
‘আমরা তো একেবারে উধাও হয়ে যাচ্ছি না। দরকার হলে চটপট নেমে আসব।’ বিদিশা সিঁড়িতে পা রেখে হাতে মইটাকে পাকড়ে ধরল। তারপর শরীরটা বা ধারে পুরো ঝুলিয়ে দিয়ে বাঁ হাতে এক ঝটকায় ছুরি দিয়ে কেটে গেল বাঁধন। ঝন্টুমামা টান-টান করে রেখেছিল নোঙরের সঙ্গে বাঁধন। তবু বেলুনের আকর্ষণে একটা হেঁচকা লাগে। এক লাফে তিন-চার হাত লাফিয়ে ওঠে বেলুনটা। নিলয় আর সুজন দুজনেই ছিটকে পড়েছে বেলুনের ঝুড়ির মধ্যে। বিদিশা ধাক্কা সামলে এতক্ষণে দু-হাত দিয়ে ধরেছে সিঁড়িটা। তরতর করে উঠে আসছে।
একটা লাফ দিয়ে বেলুনের মধ্যে নেমে বিদিশা বা হাত থেকে ছুরিটা ছুড়ে দিল। ক্যাচ ধরে সুজন নিল, ‘এটাও ফেলিসনি?’
ব্লাউজের স্লিভে কপালের ঘাম মুছে বিদিশা বলল, ‘কই, আমরা উঠছি না কেন?’
সুজন ও ঝন্টুমামা এক সঙ্গে হাত লাগিয়ে লাটাইয়ের চাবি খুলে দিতেই শুরু হয়ে গেল আরোহণ। কোনো ঝাঁকুনি নেই। তরতর করে আকাশে পাড়ি দিচ্ছে। তবে ঠিক সরাসরি নই। হাওয়ার টানে বেলুনটা কাত হয়ে আছে। সমুদ্রের দিকেই তার আকর্ষণ।
ঝন্টুমামার দূরবীণ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিল বিদিশা আর নিলয়। সুজন তার ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ চেঁচয়ে উঠল নিলয়, ‘ওটা কী? ওটা কী?’ তার দূরবীণের দিশা অনুসরণ করতেই বিদিশা খালি চোখেও দেখতে পেল। কালো কুচকুচে ঝালরের মতো চামড়াওলা একটা জন্তু তাদের বেলুন-বাঁধা দড়ির কাছে নাক ঠেকিয়ে কি শুঁকছে? মতলবটা কী?
নিলয়ের হাত থেকে ঝন্টুমামা দূরবীণটা ছিনিয়ে নিল। কিন্তু চোখে লাগাবার সময় পায়নি। তার আগেই কাজ সেরে জন্তুটা ছুট লাগিয়েছে। দাঁতে করে দড়ি কেটে দিয়েছে। দাঁতের কি ধার যে মুহূর্তের মধ্যে… ভাবার সময় হয়নি। তাদের গরম হাওয়ার ভেলা এবার সত্যিই বেপরোয়া গতিতে জুড়ে দিয়েছে দৌড়। অন্যের ইচ্ছে আর তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। তার নির্দেশই মেনে নিতে হবে।
সুজন ক্যামেরা ঘুরিয়ে চেষ্টা করেছিল টেলিফোটোয় একটা স্ন্যাপ নেওয়ার কিন্তু যুৎ করতে পারেনি। হিংস্র প্রজাপতিও মিস করেছে, এটাও গেল। হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে।
নিলয়ের মাথায় অন্য চিন্তা, ‘রাহুলবাবুর কাছে পইড়া রইল অজানা দ্যাশের মানচিত্র খান। পইড়া রইল ওয়্যারলেস সেট। আর আমাগো ক্যাপটিভ বেলুন তরতরাইয়া খুটা ছিঁড়া গোরুর মতো যে দিকে চোখ যায় ছুইটা চলছে।’
৮
মাটির সঙ্গে বাঁধন ছিঁড়ে যেতে সেই আনন্দেই আকাশে যেন লাফ মারল বেলুনটা। তারপর বায়ুস্রোতের ঠেলায় একবার জোর দোল খেয়ে নিয়েই আবার ঠেলা মেরে উঠছে ওপরে। বেলুনের হাওয়া গরমের বার্নারটার আঁচ একেবারে কমিয়ে দিয়েছে ঝন্টুমামা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেটার আকাশে ওঠার তাগাদা কমে এসেছে। ঠান্ডা বাতাসে তাদের গা শিরশির করছে। নিলয় দু-কানে আঙুল পুরে দিল। হঠাৎ বায়ুচাপ পরিবর্তনে কানে তালা।
নিলয় বলল, ‘তোমাকে কি সারাক্ষণ ওই উনুনে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে হবে নাকি?’
‘না, তার দরকার হবে না। অটোমেটিক রেগুলেটর আছে। কোন উচ্চতায় ভাসতে চাই জানিয়ে মিটার সেট করে দিলে আপনা থেকেই আগুন বাড়বে কমবে।’
‘তুমি তো ভাসতে চাও কিন্তু এদিকে যে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার কী হবে? ইতিমধ্যেই তো আমাদের ক্যাম্প আর প্রায় চোখে দেখা যাচ্ছে না। ফিরব কীভাবে সেটা…’
‘ক্যাম্পে ফেরার কথা ভুলে যাও।’ সুজনকে বাধা দিল ঝন্টুমামা। এটা এরোপ্লেন নয় যে মুখ ঘুরিয়ে যে দিকে খুশি যাব।’
রেলিঙের ওপর কনুইয়ের ভর রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল নিলয়। এখান থেকে দিগন্ত বিস্তারী সমুদ্র ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না। কতক্ষণে যে পাড়ের দেখা মিলবে। কথাটা মনে পড়তেই খিদেয় চনচন করে উঠল পেটটা। পিছন ফিরে অভিযোগের সুরে বলল, ‘তখন তো আমার কথা কেউ শুনলা না। কয়দিন খাইদ্য কাছে থাইকলে অখন লড়াই করাটা কত সহজ হইতো, কও তো।’
‘খাইদ্য আর খাইদ্য। স্টপ ইট।’ গর্জে উঠেছে ঝন্টুমামা, ‘নো মোর ঘ্যানঘ্যান। যার মুখ দিয়ে একই হতাশা হাহাকার কি অভিযোগ বা আক্ষেপ বেরবে স্ট্রেট একটি ঘুঁষি মেরে সমুদ্রে বাতিল করে দেবো।’
নিলয় আর সুজন দু-জনেই চমকে গেছে। ঝন্টুমামাকে খুব কমই রাগতে দেখা যায়।
সুজন মুখ ফিরিয়ে ভেলার অন্য প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে বোঝায়, সত্যিই তো, ভয় পেয়ে লাভ কি! গুনগুন করে কবিতা পাঠের মতো একের পর এক অনেকগুলো গানের প্রথম কলি ট্রাই করেছে। ‘ওরে সাবধানী পথ ভোলা’ থেকে ‘তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়’ এবং শেষকালে ‘আমরা চঞ্চল, অদ্ভুত, বিদ্যুৎ’ করে হাল ছেড়ে দেয়। কিছু লাভ হচ্ছে না। ক্যামেরা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করল। না, কোনো ছবি হবে না। বেজার মুখে মাঝভেলার জটলায় যোগ দিয়েছে সুজন। ঝন্টুমামা বলল, ‘নিলয়, জলের দায়িত্ব তোমার। জল যতক্ষণ লড়াইও ততক্ষণ। সেই বুঝে তুমি যা বরাদ্দ করবে আমরা কোনো প্রতিবাদ করবো না। এই দুটি বোতল সম্বল।’
‘এগ্রিড। এগ্রিড।’ বিদিশা হাত তুলে সমর্থন জানাল। সুজন ফিসফিস করে উপদেশ দিল, ‘বেশি চেঁচালে, খিদে তেষ্টা দুই বাড়বে কিন্তু।’
‘সুজন! তোকে একটা দায়িত্ব নিতে হবে। তিনটি যন্ত্রের ভার। একটা থেকে উচ্চতার, দ্বিতীয়টা থেকে হাওয়ার গতি, আর শেষটা থেকে দিক, মানে ডিরেকশনের রিডিং নেবে। তোমার ওপরে নির্ভর করেই আমাদের গতিপথের মানচিত্র এঁকে চলবে বিদিশা। ক্লিয়ার?’
ক্লিপবোর্ডে আঁটা একটা গ্রাফপেপার আর কলম এগিয়ে দিয়ে ঝন্টুমামা বলল, ‘এই এখানে একটা তারা এঁকে দিচ্ছি। এইটা আমাদের ক্যাম্প। আর আমরা এখন এখানে। দশ মাইল উত্তর-পূর্বে। হয়েছে? এইভাবে চালিয়ে যাও।’
‘মধুমিডায় কম্পাস কাজ করবে?’ বিদিশা জানতে চায়। ‘কাজ চলে যাবে। ভাগ্য ভালো মধুমিডার নিজস্ব একটা চৌম্বক ক্ষেত্র আছে। যদিও সেই চৌম্বক ক্ষেত্রের সঙ্গে তার ভৌগলিক অক্ষের সম্পর্কটা এখনও পরিষ্কার নয়। মানে, আমরা যেটাকে উত্তর দক্ষিণ বলছি তারই নব্বই ডিগ্রি কোণে এদেশের সূর্য ওঠে বা অস্ত যায় কিনা বলতে পারব না। সে যাইহোক বনের মধ্যে পথ চিনে ফিরে আসার মতো কাজের পক্ষে ম্যাপটা খুবই হেল্পফুল হতে পারে।’
হঠাৎ নিলয় চেঁচিয়ে উঠল, ‘তীর! ওই তো! ওই দ্যাখো—’
সমুদ্রের এক প্রান্তে সত্যিই সবুজ তটভূমি ইংগিত।
বিদিশা সঙ্গে সঙ্গে তার ম্যাপের ওপর তটভূমির অবস্থানকে দক্ষিণ-পশ্চিম হিসাবে নির্ধারিত করে। ওই দিকেই এগিয়ে চলেছে তাদের বেলুন।
একইভাবে মোটামুটি এই গতিতে এগিয়ে চললে হয়তো দশ-বারো ঘণ্টার মধ্যে পাড়ে গিয়ে পৌঁছবে কিন্তু ক্যাম্প থেকে তার দূরত্বটা যা দাঁড়াবে…
সুজনের মনের কথাটা আন্দাজ করে নিয়েই যেন ঝন্টুমামা বলল, ‘শুধু তো মাটিতে নামা নয়, ফেরার কথাটাও ভাবতে হবে। এবং শুধু দূরত্বটাই হয়তো একমাত্র ফ্যাক্টর হবে না। সবচেয়ে ঝামেলা বাধাবে মাঝপথের নদীনালা বা পাহাড়।’
‘সেগুলোও এই বেলুনে চড়েই তো পেরতে হবে, তাই না?’ নিলয়ের প্রশ্ন।
‘তা তো বটেই। আর সেইখানেই তো আমরা পুরোপুরি বায়ু-দেবতার ওপর নির্ভরশীল।’
‘সে না হয় অপেক্ষা করা যাবে। বনজঙ্গলে কি আর ফলমূল কিছুই—’ জিভ কেটে নিজেকে সামলে নিল নিলয়, ‘সরি। সরি।’ আর একটু হলেই আলোচনাটা আবার খাদ্যদোষে নিষিদ্ধ হত।’
সুজন যন্ত্রের ওপর থেকে মুখ তুলে বলল, ‘আমাদের গতি কিন্তু ক্রমশই কমে আসছে।’
হাওয়া প্রায় বন্ধ। বেলুন প্রায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ওপর নীচে সামান্য দোল খাচ্ছে।
‘আই মাস্ট টেক এ চান্স।’ ঝন্টুমামার স্বরে আশার আলো।
ঝন্টুমামা বলে, ‘মধুমিডার সূর্যাস্তের আর দেরি নেই। এরপর চাঁদ উঠবে কিন্তু কখন তা জানি না। কাজেই এই বেলা, হাওয়া যখন বন্ধ যতটা পারি উঠে যাই ওপরে। যত দূর চোখ যায় একবার দেখে নেওয়া যাক। মধুমিডার ভূগোলের জ্ঞানটা একটু বাড়িয়ে নেওয়া।’
ঝন্টুমামা গ্যাস বার্নারের চাবি তিন পাক খুলে দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ভেলার রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। বিদিশা চোখে দূরবীণ দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে।
সুজন বলল, ‘মধুমিডারও চাঁদ আছে পৃথিবীর মতো?’
‘আমার তো তাই ধারণা। জোয়ার ভাটা হচ্ছে যখন, থাকারই কথা।’
ছেঁড়া মইটা এতক্ষণ লেজের মতো ঝুলছিল। নিলয় সেটাকে গুটিয়ে তুলে ফেলেছে। ঝন্টুমামা তাই দেখে এগিয়ে এসে মইয়ের শেষ প্রান্তটা হাতে টেনে নিয়েই যেন শিউরে উঠল।
‘কি হল ঝন্টুমামা?’
‘দেখতে পাচ্ছিস না? যে জন্তু এই মইটা কেটেছে তার দাঁতের তারিফ করছি। পৃথিবীর কোনো জন্তু পারত না। একবারও কামড়ায়ানি, চেবাতে হয়নি। নিখুঁত ছুরি চালাবার মতো…’
ঝন্টুমামার কথায় বাধা পড়ল। বিদিশা উত্তেজিত, ‘পাহাড়। পাহাড়! তীরের ওধারেই পাহাড়। আর তিনটে নদী। আর কোনো বাধা নেই। তীরে পৌঁছতে পারলে আমরা আবার ক্যাম্পে ফিরতে পারব।’
বিদিশার কথা শেষ হওয়ার আগেই সুজন ক্যামেরা টেনে নিয়েছিল চোখের উচ্চতায়।
কিন্তু বিদিশার কথার উত্তর হিসেবেই কে যেন ভয়ানক রেগে গিয়ে দু-হাতের প্রচণ্ড ধাক্কায় বেলুনটাকে ঝাঁকিয়ে দিল। ক্যামেরাটা সুজনের গলার ফাঁস অমান্য করেই খসে পড়েছে।
সুজন অনেকটা অন্ধের মতোই এবং না বুঝেই হাত বাড়িয়ে ধরে না ফেললে ঝন্টুমামাও নিশ্চয় রেলিং টপকে ছিটকে পড়ত। বাইনোকুলারের ফিতেটা গলায় ঝুলিয়ে না রাখার শাস্তি পেল বিদিশা। হাত ফস্কে সেটাও ছুটে চলেছে সলিল সমাধি নিতে।
ঝন্টুমামা এক ঝটকায় সুজনকে সরিয়ে বার্নারের রেগুলেটারে হাত রেখেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘থার্মাল। থার্মাল! বিদিশা, কুইক। আমাদের ডিরেকশন বলো।’
বিদিশা জানাল, ‘হাওয়া প্রায় ষাট ডিগ্রি দিক পরিবর্তন করেছে।’
‘ওয়ান্ডারফুল! ওয়ান্ডারফুল। একেই বলে ভাগ্য। আমরা হঠাৎ গরম হাওয়ার একটা বিপরীত স্রোত ধরেছি। ঘণ্টাখানেক এটাকে আঁকড়ে থাকতে পারলে আবার মোটামুটি ক্যাম্পের ধারে কাছেই পৌঁছে যাব।’
কিন্তু ঘণ্টা দেড়েক সময় ওরা পায়নি। মধুমিডার সূর্য অস্ত যাওয়ার এবং আকাশে এক জোড়া চাঁদ ওঠার মিনিট দশেকের মধ্যেই হুইসিলের মতো পরপর দুটো শব্দ। দুটো বুলেট গরম হাওয়ার বেলুনকে ফুটো করে দিল। কাদের হাতে কী ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র নিঃশব্দে এই কাণ্ড বাধাল, তার হদিশ পাওয়ার আগেই জমকালো অরণ্যের মধ্যে অবতরণ করতে চলেছে তারা।
৯
দুটো বুলেট। চারটি ছিদ্র। বেলুন এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে বেরিয়ে গেছে। বার্নারের চাবি পুরো ঘুরিয়ে দিয়েছে ঝন্টুমামা। ফলে অবতরণের গতি অনেক কমে এসেছে। তা হলেও ক্র্যাশ ল্যান্ডিং ঠেকানো যেত না। কিন্তু নীচে নামার সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার প্রবল টান কমে গেছে।
বেলুনের নীচে থেকে গাছপালাগুলো এসেই হাত বাড়াচ্ছে। ফাঁকা জায়গার কোনো চিহ্ন নেই। বেঁটে কিন্তু পেল্লাই রকমের ঝাঁকড়া অনেকটা অশ্বত্থের মতো দেখতে একটা গাছের মধ্যে খসে পড়ল বেলুন। এখন তার আবরণ চুপসে গিয়ে ভিজে কাপড়ের মতো। তারই তলায় চাপা পড়েছে যাত্রীরা।
ঝন্টুমামাকে এই প্রথম উপস্থিত বুদ্ধি হারাতে দেখা গেল, সময় মতো বার্নারের আগুনটা নিবিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। বেলুনের সিন্থেটিক আবরণ দপ করে জ্বলে উঠেছিল। দড়ি-দড়া সমেত তাঁবুর তলায় চাপা পড়া ওই অবস্থায় গাছের মাথায়, জতুগৃহের মধ্যে পুড়ে শেষ হয়ে যেত সকলে।
সুজন ঝাঁপিয়ে পড়ল আগুনের ওপরে। দু-হাতে জ্বলন্ত আগুনকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে পিষে দিল। কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার। জীবন মরণের সীমানায় যার মূল্য হিসেব কষে ধরা যাবে না।
গাছ থেকে মাটিতে নেমে এসেছে সকলে। মধুমিডার সূর্য অস্তে গেছে। কিন্তু ঝন্টুমামার কথাই ঠিক। চাঁদের আলোয় চোখ চালাতে অসুবিধে হচ্ছে না। প্রত্যেকের দুটো করে ছায়া পড়ছে লাল কাঁকড় বেছানো বনভূমির ঝরা পাতার ওপরে। মধুমিডায় আকাশে এক জোড়া চাঁদ এখন আলো ছড়াচ্ছে।
নিলয় দু-হাতে দুটো জলের বোতল উঁচু করে ধরে বলল, ‘দায়িত্ব পালন করেছি।’
সুজনের দুটো হাতই বেশ পুড়েছে। ঝন্টুমামা একটা জলের বোতল নিয়ে বিদিশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘কাপর্ণ্য করে লাভ নেই। ভালো করে হাতে জল না দিলে ফোস্কা পড়বে।’
জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার হাত চার-পাঁচের বেশি দৃষ্টি যাচ্ছে না। মামা নিলয়কে নিয়ে আবার গাছে চড়েছে। দু-জনে মিলে বেলুনটার আবরণ ছুরি দিয়ে কেটে ফালি ফালি করে নীচে ফেলে দিয়েছে। দড়ির মইটা ডালপালার সঙ্গে বেয়াড়াভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঝন্টুমামা ওটাকে উদ্ধার না করে নামবে না। সব ছাড়িয়ে নেওয়ার পরেও একটা মোটা ডালের সঙ্গে ফাঁসটা আর কিছুতেই খোলা যাচ্ছিল না। ডালটা ভেঙে ফেললেও অবশ্য কাজ হয়। গায়ের জোরে হ্যাচকা টান মারল নিলয়। ডাল তো নয় যেন রবার। ঝন্টুমামা বলল, ‘ওভাবে হবে না রে?’
‘দাও দেহি ছুরিটা!’ মরিয়া হয়ে গেছে নিলয়। অধৈৰ্য্যও। ছুরিটা দাঁতে চেপে দু-হাতে মাথার ওপরের ডালটা ধরে শরীরটাকে এক মোচড়ে সরিয়ে নিয়েছে। জায়গা করে নিয়ে বাঁ হাতে ডাল ধরে ঝুলে পড়ল। এবার ডান হাতে ছুরি। তিনটে ঘা মারতেই ডাল সমেত মইটা খসে পড়ল নীচে।
ঝন্টুমামা একটা দড়িতে বেঁধে হাওয়া গরমের বার্নারটাকেও মাটিতে নামিয়ে দিয়েছে।
পনেরো মিনিটের বিশ্রাম। বার্নারের আলো জ্বালিয়ে অপরিচিত অরণ্যে ওদের বৈঠক বসেছে। সুজনের হাতে ফোস্কা না পড়লেও চামড়াটা দগদগে হয়ে উঠেছে। সাত-আট দিন মুঠো করে কিছু ধরতে পারবে না। হাত ধোওয়ার পর বোতলে যেটুকু জল ছিল ভাগ করে খেয়েছে। আর এক বোতল রইল। নদী তো আছেই, পুকুরও হয়তো পাবে কিন্তু জীবনের আশা ত্যাগ করার আগে সে জল মুখে দেওয়ার মতো বোকামির কথা কেউ ভাবতেও পারে না।
বিদিশা ম্যাপ খুলে ঝুঁকে পড়েছে। ক্যাম্পে ফেরার পথ এবং কতক্ষণ লাগতে পারে তার হিসেব নেওয়ার চেষ্টা।
নিলয় বলল, ‘ঝন্টুমামা, আপনি কি নিশ্চিত যে আমাদের বেলুনটাকে লক্ষ্য করে রাইফেল ছোড়া হয়েছে? কীরকম অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।’
‘বুলেটের আঘাতেই যে বেলুন ফুটো হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্তত এখন আর নেই। বেলুনটাকে কেটে নামানোর সময়ে ছিদ্রগুলো পরীক্ষা করে আমি এ-ব্যাপারে নিশ্চিত। কিন্তু বুলেটগুলো রাইফেল থেকে ছোঁড়া হয়েছে বলে বিশ্বাস হয় না। আমরা তখন যে জায়গায় ছিলাম এবং যেদিক থেকে বুলেটগুলো ছুটে এসেছিল, সাধারণ রাইফেলের কম নয়।’
‘মধুমিডার বুদ্ধিমানদের তা হলে কারিগরি বিদ্যায় যথেষ্ট উন্নত বলতে হয়!’ সুজন বলল।
‘তার চাইয়াও বড়ো কথা হইল,’ নিলয় বেশ চিন্তিত, ‘ওরা আমাগো ভালো চোখে দ্যাখতাসে না। শত্রু হিসাবেই…’
‘সেটা খুব আশ্চর্য কিছু নয়। ধরো, একদিন মধুমিডার লোকেরা পৃথিবীতে গিয়ে এইভাবে বেলুনে চড়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিচ্ছে। এবং সেখানকার লোকে কোনোদিন বেলুন দেখেনি। তারাও তো ভয় পেত। অতদূর থেকে বুলেট চালিয়ে বেলুন ফুটো করে দেওয়ার ক্ষমতা যদি ওদের থাকে, একেবারে প্রাণে শেষ করে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। তাই না?’ ঝন্টুমামা যেন নিজের সঙ্গেই আলোচনা করছে।
‘কি রে বিদিশা, কী হল? আমরা কি এখানেই রাত কাটাব নাকি?’ সুজন মুখ ফিরিয়ে বলল।
‘ঘণ্টা চার-পাঁচের মধ্যেই মনে হচ্ছে ক্যাম্পে ফেরা যাবে।’ বিদিশা উঠে দাঁড়িয়েছে।
দড়ির ফাঁসের মধ্যে বার্নারটা ঝুলিয়ে নিয়ে তারই আলোয় পথ বেছে এগিয়ে চলেছে ওরা। লিড করছে বিদিশা। অরণ্য গভীর হলেও শুধু বড়ো বড়ো গাছ। গাছের নীচে লতাপাতা ঝোপঝাড় কোনো বাধা সৃষ্টি করছে না। পাতার আকার ও আয়তন দেখেই ওরা সাত-আটটা জাতের গাছের পরিচয় পেয়েছে। মাঝে মাঝেই নাকে আসছে অচেনা ফুলের চড়া গন্ধ। গন্ধ থেকেই এখন বিদিশা চিনে নিতে পারে যে গাছটা পেরচ্ছে তার পাতাগুলো ছ-কোণা কি গোলাকার। হলদে না নীল।
সারি বেধে এগোচ্ছিল ওরা। সবার পিছনে নিলয়। বেলুন খসে পড়ার পর বেশ কিছুক্ষণের জন্য খিদের কথা ভুলে গিয়েছিল। নীল পাতাওলা একটা গাছ বার পাঁচ-ছয় চোখে পড়েছে এর মধ্যে। যতবারই গাছটার তলা দিয়ে গেছে মনমাতানো একটা গন্ধ নাকে এসেছে। মুখ তুলে পর্যবেক্ষণ করেছে। কোনো ফুলের দেখা পায়নি। আবার সেই গন্ধ। নিলয় একটু থমকে দাঁড়াল। হাতের নাগালের মধ্যেই ঝুলছে একটা বাতাবি লেবুর মতো আঁটোসাটো পুরুষ্ট ফল। কিন্তু তার রংটা ঠিক ল্যাংড়া আমের মতো। একট টান দিতেই ফলটা বোঁটা থেকে খসে পড়েছে। নাকের কাছে তুলে শুঁকল। হ্যা, এই ফলটারই গন্ধ পাচ্ছিল এতক্ষণ। হাঁটতে হাঁটতেই বার কয়েক গন্ধ শুকল ফলটার। তারপর কখন যে এক কামড় বসিয়ে দিয়েছে খেয়াল নেই।
বনের মধ্যে পাখি দূরের কথা ঝিঁঝির মতো কোনো কিছুরও ডাক শোনেনি তারা। শুকনো মরা পাতার ওপর তাদের পায়ের শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। আট-দশটা চড়াইপাখির মতো আকারের পতঙ্গ ডানা ঝাপটানোর শব্দ তুলে বার্নারের আলোটা ঘিরে নাচ জুড়ে দিতেই সবাই চমকে গেল। ভয়ঙ্কর প্রজাপতির কথা তারা ভোলেনি। এদের মতিগতির হদিশ পাওয়া ভার। তার ওপর ঠিক জোনাকির মতো দফায় দফায় নিজেরাই আলো ছড়াচ্ছে তারা। তীব্র উজ্জ্বল নিওন লাইটের মতো। শুধু তাই নয়। ওরা যেন বলতে চাইছে, কৃত্রিম আলোর চেয়ে আমরা অনেক বেশি কার্যকর।
ঝন্টুমামা বলল, ‘বিদিশা! বার্নার নিভিয়ে দাও। দেখা যাক কী হয়।’
এর চেয়ে বুদ্ধিমানের মতো সিদ্ধান্ত আর কখনও ঝন্টুমামা নিয়েছে কিনা সন্দেহ। মধুমিডার জোনাকি পাখিরাই এখন পথ চিনিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছে ওদের। বিদিশাই প্রথম টের পেয়েছিল, এরা ওদের ক্যাম্পের দিকেই সটকাট পথে লিড করছে।
আচমকা এসেছিল আবার তেমনই হঠাৎ উধাও হয়ে গেল মধুমিডার বন্ধু-পাখি। ততক্ষণে ওরা বন পেরিয়ে একটা সমতল ভূমিতে এসে পৌঁছেছে। ঝন্টুমামা আবার বার্নার জ্বালাতেই দেখা গেল একটা জঙ্গলের প্রান্তে এসে পৌঁছেছে তারা। মধুমিডার আকাশের দুটো চাঁদের মধ্যে একটা তখন অস্ত গেছে। কিন্তু অবশিষ্ট চাঁদের আলোতেও তাদের বুঝতে অসুবিধে হল না যে এখান থেকে দুশো ফুট নীচের উপত্যকায় নামতে পারলেই তারা পৌঁছে যাবে তাদের ক্যাম্পে।
মধুমির জীবজন্তুরাও কি বুদ্ধিমান? তারাও কি চাইছে ওরা ক্যাম্পে ফিরে যাক এবং পুষ্পক চড়ে আবার পাড়ি দিক পৃথিবীর দিকে?
খুঁটি পুঁতে বেলুনের সিঁড়িটাকে ঝুলিয়ে দিয়ে ওরা এখন ক্যাম্পে নামার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। নিলয় বেঁকে বসল ‘আমি এখানেই থাকব। তোমরা যাও।’
ব্যাপারটা প্রথমে কারোরই বোধগম্য হয়নি। জনে জনে তাকে প্রশ্ন করে। উত্তর সেই একই, ‘আমার ইচ্ছা নেই। এখানে থাকব। কোথাও যাব না।’
নিলয়ের হাতে আমের মতো বাতাবি লেবুটা হঠাৎ আবিষ্কার করল বিদিশা। চোখে পড়ত না, কিন্তু নিলয় মুখের কাছে তুলে কামড় দিয়েছে। ঠোটের দু-পাশ দিয়ে গড়িয়ে এসেছে কয়েক ফোঁটা রস। আধো-অন্ধকারেও দেখা যায় নিলয় শরীরের ভার সামলাতে পারছে না। তার পা টলছে।
ঝন্টুমামা ছোঁ মেরে তার হাত থেকে ফলটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, ‘নে নে, আর ঝঞ্ঝাট বাড়াসনি। আমার পিঠে চড়ে বোস। আমি কাঁধে করে নিয়ে যাব।’
১০
দড়ির মই বেয়ে একে একে সকলেই নেমে এসেছে। নিলয় অবশ্য শেষ অবধি কারুর কাঁধেই ভর করেনি। সুজনও নিজেই নেমেছে পোড়া হাতের ওপর শরীরের ভার রক্ষা করতে গিয়ে চোখ দিয়ে যতই জল বেরোক। নিলয়ের নেশাও অনেকটা কেটে গেছে।
চাঁদের আলোয় সমুদ্রটা ফুটন্ত ফসফরাসের মতো জ্বলছে। তার আভায় তটের ওপর ওদের তাঁবুগুলো কেমন ভূতুড়ে দেখাচ্ছে। রংগুলো গেছে একেবারেই পালটে।
ক্লান্তি খিদে আর বিপদের হাত থেকে যেখানে রেহাই মেলে সেইটাই মানুষের ঘরবাড়ি। ঘরের দরজায় পৌঁছেও কিন্তু ওদের আশ্রয়ের আশ্বাস মিলল না। উত্তরবঙ্গ হলে বলাই যেত, মস্ত হাতির দৌরাত্ম। প্রত্যেকটা তাঁবুর ভেতর তছনছ কাণ্ড। সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ভেঙেচুরে শেষ।
নিজের লাল তাঁবুর মধ্যে সুজন পাগলের মতো হ্যাভারস্যাক, স্লিপিংব্যাগ ইত্যাদি ঘটছে। কোথায় গেল টিন্ড ফুড? জলের বোতলও উধাও।
বাইরে থেকে সুজনের ক্রুদ্ধ গর্জন কানে আসে, ‘আমাদের ওপর সব দিক থেকে আক্রমণ শুরু করেছে। খাদ্যবস্তু পুরো উধাও।’
বিদিশাও বেরিয়ে এসেছে নিজের তাঁবু পর্যবেক্ষণ করার পরে। সবার ঘরেই একই অবস্থা। মিনিট খানেক চোখ বুজে বসে থাকে সুজন। মনের জোর ফিরিয়ে আনে। তারপর বাইরে বেরিয়ে আসে।
সবুজ তাঁবুটার পর্দা সরিয়ে এতক্ষণে ঝন্টুমামা উঁকি মারল। কিন্তু সবুজ তাঁবুটা তো রাহুলের। তা হলে কি… প্রায় একই প্রশ্ন সবার মনে।
ঝন্টুমামার দিকে ছুটে যায় ওরা। কিন্তু কোনো প্রশ্ন করার আগেই কানের পর্দা ফাটানো বিকট গর্জন আর ঝলকে ঝলকে আগুনের শিখা লাফিয়ে ওঠে ওদের ক্যাম্পের প্রান্ত থেকে।
কম্যান্ড মডিউল ওদের না নিয়েই রওনা হয়ে গেল। মধুমিডার আকাশে পরিক্রমারত ‘পুষ্পক’-এ আর তারা কখনই ফিরতে পারবে না। পৃথিবীর কথা তো ভুলে যাওয়াই উচিত।
যতক্ষণ কম্যান্ড মডিউলের রকেটের আগুন চোখে পড়ে চুপ করে তাকিয়েছিল ওরা।
নীরবতা ভাঙল নিলয়, ‘এইটা কিরকম রসিকতা হইল বলো। আমরা এত কষ্টে ফিরা আইলাম না দেখতে পাওয়ার কোনো কারণ নাই। তবু…’
‘রাহুল।’ হঠাৎ কথাটা মনে পড়ে যায় বিদিশার।
‘রাহুল নেই।’ ঝন্টুমামা নিরাস যেন দক্ষিণ কলকাতা থেকে টেলিফোনের তলব পেয়ে উত্তর দিচ্ছে। উদ্বেগের ছিটেফোঁটা নেই।
‘নেই মানেটা কি!’ ঝন্টুমামার নির্লিপ্ত ভঙ্গি বিদিশার পক্ষেও সহ্য করা অসম্ভব হয় না।
‘নেই মানে, তাঁবুতে নেই। এ তল্লাটেও নেই। ওই পাহাড় আর এই সমুদ্রের মধ্যে কোথাও নেই।’
দুটি সম্ভাবনা। হয় মধুমিডার দুশমণরা যখন চড়াও হয়েছিল তারাই ওকে ধরে নিয়ে গেছে। আর নয়তো আক্রমণ হতে পারে আন্দাজ করে আগে থেকেই ‘পুষ্পক’ এর কম্যান্ড মডিউল এ চড়ে বসেছিল। ওরা আর ফিরবে না ধরে নিয়ে প্রাণের ভয়ে চম্পট দিয়েছে।
নিলয়ের প্রবল প্রতিবাদ, ‘এতক্ষণ বইয়া রইল আমাগো জন্য, আর এত কষ্ট কইরা সবে নামলাম, অমনি হুশ কইরা উধাও।’
বিদিশা বলল, ‘কী কেন কবে কোথায় নিয়ে মাথা না-ঘামিয়ে বরং চিন্তা করা দরকার এখন আমাদের কী করা উচিত।’
‘মই। মই সামলানো ওইটাই আমাগো প্রথম কাজ।’ হাত পুড়বার পর থেকে নিলয় বেশ হিরোর মতো ইঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করেছে।
‘একটু খুলেই বল্না বাবা।’ বিদিশা সারেন্ডার করে।
‘এটাও বুঝিয়ে বলতে হবে? আরে বাবা এখানে তো ওই চাইনিজ বক্সট্রি ছাড়া আর জ্যান্ত গাছপালা বলতে কিছু নেই।’
বোঝা যায় নিলয়ের এখনও বাতাবি আম খাওয়ার ঘোর কাটেনি। কামিনী গাছকে চাইনিজ বক্স ট্রি বলছে।
‘কিন্তু, তোরা যতই দোষ ধর, ওই ফলটা সাহস করে খেয়েছিলাম বলেই এখনও কিন্তু তেমন খিদে পায়নি। পা-টা একটু টলছে। তাতে কি? হয়তো ওর চেয়ে বেটার ফুটসও পাওয়া যেতে পারে। একটা আশা অন্তত আছে। এখানে আটকা পড়লে তো নিশ্চিত মৃত্যু। তিলেতিলে। অপয়া সমুদ্রের সামনে বসে তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে…’
কথা বলতে বলতেই ওরা মায়াবী সমুদ্রের তীরে এসে বসেছিল। সুজন হঠাৎ লাফিয়ে উঠল। ছুটে গেল জলের দিকে। হাঁটু গেড়ে বসে সামনে ঝুঁকে হাত দিয়ে কী যেন একটা কুড়োবার চেষ্টা করছে।
সুজন প্রায় হামাগুড়ি দিয়েই জলের মধ্যে নামতে যাচ্ছে দেখে ঝন্টুমামা সাবধান করে দিল, ‘জলে নামিসনি বিপদ হতে পারে।’
‘পেয়েছি। পেয়েছি!’ সুজন ডান হাত উঁচু করে ছুটে আসে। সার্ডিন মাছের টিনটা ছুড়ে দেয়।
মধুমিডার সমুদ্র অন্তত পৃথিবীর একটা রেওয়াজ মেনে চলে। অযাচিত দান গ্রহণ করে না।
ঘণ্টা খানেক তটভূমি ধরে ছোটাছুটি বিফলে যায়নি। খাদ্যভরা আটটি টিন আর চারটি জলের বোতল উদ্ধার করেছে। এখনকার মতো যথেষ্ট। সুজনের ইচ্ছে ছিল কিছু, স্টক বানিয়ে নেওয়ার। ঝন্টুমামা বলল, ‘ভাটার টানে সমুদ্র ক্রমেই পিছচ্ছে। সবুরে ভালোই মেওয়া ফলবে।’
টিন খোলা নিয়ে ছোট্ট সমস্যা একটা ছিল। ঝন্টুমামার পকেট নাইফ দিয়ে কাজ সারা গেছে। মুহূর্তের মধ্যে সব শেষ। জলের বোতল অবধি। কিন্তু এখন আর ভবিষ্যত নিয়ে কোনো চিন্তা কারু মাথায় নেই।
বিদিশা একবার বলেছিল, ‘তাঁবুতে গেলে হত না?’ কিন্তু তার আগেই যে যার মতো পা লম্বা করে, কেউ বা মাথার নীচে হাত ভাঁজ করে উপুড় বা চিত হয়ে পড়েছে মধুমিডার তারা ঝলমলে খোলা আকাশের নীচে। নিলয় আর সুজন ঘুমিয়ে পড়েছে সবার আগে। বিদিশা আচমকা কাত হয়ে কনুইয়ের ওপর ভর রেখে শরীরটাকে আধখানা তুলে ধরে উত্তেজিত স্বরে ঝন্টুমামাকে বলল, ‘ঝন্টুমামা! একটা কথা বলবেন? মধুমিডার এরা যে যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং উন্নত তার তো কম প্রমাণ পাইনি। আমাদের ক্ষতি করাই যদি ওদের ইচ্ছে তা হলে টিনগুলো সমুদ্রে ছুড়ে দিল কেন? ওরা কি জানে না যে ওগুলো আবার ফিরে আসতে পারে?’
ঝন্টুমামা চোখের ওপর থেকে হাত না সরিয়েই বলল, ‘উত্তর নেই। মানে, জানা নেই। গভীর রহস্য। তবে তোর পর্যবেক্ষণশক্তি অ্যাপ্রিসিয়েট করছি। আর সেই সঙ্গে আর একটা প্রবলেম দিচ্ছি। সমাধান করার চেষ্টা কর।’
ঝন্টুমামা একটু পাশ কিরে শরীরের তলা থেকে একটা কালো চাদর টেনে বার করে বলল, ‘দেখছিস? মনে পড়ছে? সেই যে জন্তুটা বেলুনের দড়ি কেটে দিল। জন্তুটা তার গায়ের চাদরটা রাহুলের তাঁবুতে ফেলে গেছে।’
চাদর মুড়ি দিয়ে চলাফেরা করে মধুমিডার জন্তুরা? প্রশ্ন করেও লাভ হয়নি। মধুমিডার চাঁদের সঙ্গে ঝন্টুমামাও অস্তে গেছে। সমুদ্রের ঢেউ ভাঙার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে তার নাসিকা গর্জন।
মধুমিডার ছোট্ট রাত ফুরিয়ে ভোরের আলো ফুটতেই চোখ খুলল সুজন। ঘুমটা ওর এমনিতেই পাতলা। প্রথমেই মনে হল মইটার কথা। আছে তো? কাত হয়ে কনুইয়ে ভর রেখে তাকাল। মইটা শুধু আছে তাই নয়, পাহাড়ের মাথায় চারটি মধু জন্তু সেটিকে পাহারা দিচ্ছে। প্রায় দুশো ফুট উঁচুতে হলেও সুজন বুঝতে পারে আকারে ও চেহারায় ওগুলো পনি ঘোড়ার মতো কিন্তু গায়ে ঠিক সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গলের মতো হলদে সবুজ ডোরা।
ওগুলো কি তা হলে আমাদের ওপরে উঠতেও দেবে না। ভয় দেখাচ্ছে! প্রথমটা মনে হওয়া মাত্র তীক্ষ্ণ স্বরে ডাহুক পাখির মতো জন্তুগুলো সমস্বরে ডেকে উঠল।
চার জনেই উঠে বসেছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মধু-জন্তুদের দেখে ভয় লাগছে বলা যায় না। আবার ডাক শোনা গেল। তবে ডাক না বলে আহ্বান বলাই ভালো। ওরা চার জনেই মন্ত্রচালিতের মতো এগিয়ে যাচ্ছে মইয়ের দিকে।
নিলয় বলল, ‘আশ্চর্য দ্যাশের আশ্চর্য প্রাণী। কোইনো সন্দেহ নাই যে ওগো ভাষা বর্বর ও অজানা ইহলেও বোধগম্য। ভয় লাগতাসে না।’
পাশাপাশি সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে মধু-জন্তুরা পিছনের পা দুটো ভাঁজ করে কোমর নীচু করে দাঁড়াল। এর চেয়ে আর প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় যে ওদের পিঠে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই ওরা হাজির। বিদিশা সবচেয়ে ঢেঙা জন্তুটার পিঠে চড়ে বলল, ‘প্রফেসর ব্যানার্জি কিন্তু ভুল বলেনি ঝন্টুমামা। মধুমিডার জীবজন্তুদেরও দেখছি অলৌকিক ক্ষমতা আছে।’
অলৌকিক ক্ষমতার সত্যিকার পরিচয় পাওয়া গেল ঘণ্টা খানেক পরে। আস্তে আস্তে যাত্রীদের সইয়ে নিয়ে গতি বাড়িয়েছে বাহনেরা। বনভূমির মধ্যে পায়ে হাঁটা বেশ কয়েকটা পথ চোখ পড়ছে। গাছগাছালির আলোছায়া আর পাখির মিষ্টি ডাক পিছনে ফেলে তারা কাঁকুরে মাটির উঁচুনীচু এক উপত্যকা পার হচ্ছে। ডান দিকে পেল্লাই এক নীলচে-সবুজ পাহাড়ের সারি আর তার থেকে নেমে এসেছে ধারা। প্রথম স্রোতস্বিনীটি পেরতে গিয়েই চোখে পড়ল তার জলের অদ্ভুত রং। এমারেন্ড গ্রিন। নদীর বুকের সাদা মার্বেল পাথরের মতো চেহারার জন্য রংটা আরও স্পষ্ট।
সুজনের তেষ্টা পেয়েছিল। খাওয়ার জলের সন্ধান পেলে বেশি খুশি হত। মুখ ফুটে একটাও শব্দ উচ্চারণ করেনি কিন্তু তার বাহন হঠাৎ এমন বেক কষল প্রায় ছিটকে পড়ার উপক্রম। তারপরেই তার মিঠে হুঙ্কার। বাকি তিনটি জন্তু সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সুজনের বাহন এখন লিড করছে। পিছনে বাকি তিন জন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই টলটলে নীল জলের এক ঝরনার পাশে ওদের চার জনকে নামিয়ে দিয়েছে। জল খাওয়া উচিত হবে কিনা তারও মীমাংসা হয়ে গেছে। মধু-জন্তুরাই প্রথম জল পান করেছে।
কতক্ষণ ছুটে চলেছে সময়ের হিসেব রাখেনি কেউ। সকলেই মধু-জন্তুর গলা আঁকড়ে দু-চোখ ভরে শুধু নিসর্গ দৃশ্যের পরিবর্তন লক্ষ করছে। অরণ্য পাথুরে মালভূমি তারপরেই ছোট্ট একটা ঘাসের গালচে বেছানো ছ-কোণা উপত্যকা আর তার ঠিক মাঝখানে ডিমের মতো আকারের দীঘি। সন্দেহ হয় নিছক প্রকৃতির হাতে এমন নিখুঁত জ্যামিতি রক্ষা করা সম্ভব কিনা। উপত্যকার প্রান্তে নীচু এক সারি পাহাড়ের গিরিসংকট পেরোতেই তীব্র আলোর ঝলসানি। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ডান দিকে পুরো চোখ মেলে তাকানো যায় না। তবু চোখ শুধু ওই দিকেই যেতে চায়। ক্রমশ মধুমিডার তারা ঝলমলে খোলা আকাশের নীচে গতি বাড়িয়েছে বাহনেরা।
১১
নিরেট গ্রানাইটের তৈরি খোঁচা খোঁচা অজস্র গম্বুজওলা একটা জমকালো দুর্গের মতো দেখতে পাহাড়টা, তারই একটা বিশাল গুহার মুখ দিয়ে দুরন্ত বেগে হাজার-হাজার কেউটে সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে ছুটে নেমে আসছে একটা জলপ্রপাত। জলপ্রপাত না বলে রামধনু ঝরে পড়ছে বলা ভালো। মধুমিডার সূর্যর তেরছা আলোয় জলের বিন্দুগুলো হিরের মতো ঝলসে উঠছে।
‘হিরের ঝরনা!’ আপন মনে বলে উঠল সুজন। মধুমিডার হাজারও আশ্চর্যের মধ্যে এখন অবধি সেরা। ঝন্টুমামা সুজনের কথা শোনেনি। শুনলে আপত্তি করত না। অন্তত বাগিচার রাস্তায় না পৌঁছানো অবধি। এখন যে-দিকে চোখ যায় শুধু কেয়ারি-করা সবুজের আয়োজন। মধুমিডার বাসিন্দাদের বুদ্ধিমান অস্তিত্বের নির্ভুল পরিচয়। প্রথমে চা বাগানের মতো ঝোপ চোখে পড়ছিল। কিছুদূর অন্তর ছায়া বিছানো বড়ো বড়ো গাছের নীচে তাদের বিস্তার। কিন্তু ফুলের রংই বলে দিচ্ছে যে এক বাগিচা থেকে অন্যটি ভিন্ন জাতের।
যত এগচ্ছে বাগিচার গাছের উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে। আম-জাম-কাঁঠালের মতো গাছের চৌকো চৌকো বাগানে ঢোকার মিনিট পনেরোর মধ্যে তারা এক সারি পাতায় ছাওয়া ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। দো-চালা মন্দিরের মতো দেখতে।
তাদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে তিন জন অপেক্ষা করছিল। কিন্তু এরা যদি মধুমিডার মানুষ হয় তা হলে পৃথিবীর মানুষরাই নিজেদের উৎপত্তি নিয়ে বেজায় ঐতিহাসিক ধাঁধায় পড়ে যাবে। খালি গা এবং কোমরের নীচে বল্কল জাতীয় একটা লজ্জা-নিবারণের বস্ত্র থাকলেও…
অহেতুক চিন্তা করে সময় নষ্ট করতে চায়নি ঝন্টুমামা, ‘নমস্কার। কিন্তু আর দু-জন কোথায়? নিয়োগী, লাহিড়ি, আহমেদ, হক আর শিকদার। অলোক ব্যানার্জির টিমের পাঁচ জনের মধ্যে আপনারা…’
ঝন্টুমামার কথা শেষ হওয়ার আগেই মাথার ওপরের গাছ থেকে ভয়ার্ত হুঙ্কার ছেড়ে একটি কুকুরের মতো চেহারার প্রাণী ঠিক তার কাঁধের ওপর খসে পড়েছে। তার লেজটা অবশ্য হনুমানকেও লজ্জা দেবে।
‘বন্ধু। বন্ধু।’— কথাটা ঝন্টুমামাকে আশ্বস্ত করার জন্যেই উচ্চারণ! না হলে মনের কথাটাই মধু-জন্তুদের নির্দেশ দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
গেছো কুকুরটা এক লাফ মেরে গা ঢাকা দিল। মধুমিডার হোস্টদের মধ্যে লাল দাড়িওলা লোকটা বলল, ‘টুলো পন্ডিতের বংশধর অলক ব্যানার্জির নির্দেশে কাদের প্রাণ সবার আগে কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সেটাও বুঝতে পারেননি? আমি লাহিড়ি। এই নিয়োগী আর শিকদার।’
গাট্টাগোট্টা চেহারার প্রায় ক্লিপ লাগিয়ে চুল ছাঁটা শিকদার বলল, ‘দাঁড় করিয়ে রাখছিস কেন। চলুন ঘরে বসে কথা হবে।’
ঘর মানে তাঁবু, নিকনো মাটির ওপর সাতটি পাতার আসন। মাঝখানে পাল-তোলা রেকাবির মতো সবুজ পাতার থালায় অজস্র ফল আর সবার জন্য একটি করে তরমুজের মতো চেহারার জলভরা পানীয়। নিলয় সবার আগে হাত বাড়িয়েছিল। তার পরিচিত বাতাবি আমটা চোখে পড়া মাত্র। বিদিশা চাপা গলায় বলল, ‘কী হচ্ছে!’
ব্যাপারটা নিয়োগীর চোখ এড়ায়নি। হেসে বলল, ‘ওটার স্বাদ পেয়েছেন তা হলে? একটু ইনটক্সিকেটিং। ওটার আগে একটু কিছু খেয়ে নিন। না হলে হয়তো….’
ঝন্টুমামা ঢক ঢক করে ডাব খাওয়ার মতো মধু-ফল শেষ করে বলল, ‘ইউ মিন, আহমেদ আর হক বেঁচে নেই।’
‘হ্যাঁ। ব্যানার্জি খুন করেছে। সে চেয়েছিল একাই মানে ওরা কয়েকজন শুধু…’
‘চুপ কর লাহিড়ি। কী হচ্ছে।’ নিয়োগী ধমক দেয়।
ঝন্টুমামা বলল, ‘আমাদের ব্যানার্জির লোক বলে ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। সত্যি বলতে, ব্যানার্জির কথা বিশ্বাস করেনি বলেই নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের একটা টিম…’
‘নিরপেক্ষ।’—কথাটা বলল শিকদার। হাসল ওরা তিন জনেই।
লাহিড়ি বলল, ‘মাপ করবেন, আপনাদের ছোটো করছি না। কিন্তু আপনাদের নিরপেক্ষ দলের দু-জন তো কমান্ড মডিউল নিয়ে ভেগেছে। আপনারা ফিরবেন কী করে পৃথিবীতে?’
বিদিশা বলল, ‘পৃথিবীতে ফেরার চেয়ে এখানে থাকতে পারা…’
ঝন্টুমামা ভুরু কুঁচকে বাধা দিল, ‘রাহুল এবং কম্যান্ড পাইলটের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন না।’
শিকদার দাড়ির ফাঁক দিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘গুলিয়ে ফেললে কি আর আপনাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানাতাম। রাহুলকে কি আর চিনতে আমাদের বাকি আছে? যে-ই খবর পেলাম ওরা দু-জনে আপনাদের ফেলে পাড়ি দিয়েছে এবং শুধু তাই নয় যাওয়ার আগে যাবতীয় খাবার-দাবার ছুড়ে দিয়েছে সমুদ্রে— তখনই সন্দেহ হয়েছে…’
ঝন্টুমামা এবার সংক্ষেপে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেন। অলক ব্যানার্জির প্রস্তাব পৃথিবীর বোধবুদ্ধি সম্পন্ন বিজ্ঞানীরা কেন সন্দেহের চোখে দেখেছিল। কীভাবে বনমহলের কনফারেন্সে ঝন্টুমামারা যাতে যোগ দিতে না পারে তার জন্য অপহরণের চেষ্টা। তারপর অবস্থা বেগতিক দেখে রাহুল আর অলক ব্যানার্জির মন-কষাকষির অভিনয় ও সেই সুযোগে রাহুলের টিমে ঢোকা। এবং শেষ পর্যন্ত খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটিয়ে রকেট টিমের সদস্যদের সরিয়ে নিজেদের একজন লোককে ঢুকিয়ে নেওয়া।
সুজন আর চুপ করে থাকতে পারল না, ‘ঝন্টুমামা, তা হলে কি আপনি বলতে চান যে ‘পুষ্পক’ থেকে অবতরণের সময় ওই ক্র্যাশ ল্যান্ডিংটাও ইচ্ছাকৃত? যাতে পায়ে চোট লাগবার অছিলায়…’
‘একশো বার। এবং রাহুলই একটা কালো চাদর গায়ে চড়িয়ে চার হাত-পায়ে হেঁটে ছুরি দিয়ে বেলুনের দড়ি কেটে দিয়েছিল। তার পরেও আমরা ফিরে এসেছি দেখে চটপট চম্পট দিয়েছে।’ ঝন্টুমামার স্বরে নিম বেগুনের স্বাদ।
লাহিড়ি আশ্বস্ত করে, ‘চম্পট দিয়েছে না বলে, বলা ভালো সেই চেষ্টা করেছিল। কোনো ভয় নেই। কম্যান্ড মডিউল আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছে। যখন ইচ্ছে আপনারা চড়ে বসতে পারেন। গা এলিয়ে ফিরে যাবেন পৃথিবীতে।’
বলে কি? মনের কথা ধরে ফেলার ক্ষমতা এরাও কি আয়ত্ত করে ফেলেছে নাকি এরই মধ্যে। শিকদার হেসে বলল, ‘হিরের ঝরনা মশাই। দেখেছেন তো আসার পথে। ওইটাই সব নষ্টের মূলে। ওই ঝরনাটা যে গুহা দিয়ে বেরচ্ছে সেটা এক অবিশ্বাস্য হিরের খনি। আর তারই লোভে আহমেদ আর হক আগের বার প্রাণ দিয়েছে, আপনাদেরও যত বিপত্তি ওই কারণেই। ব্যানার্জি ও তার শাগরেদদের কাছে ওই সামান্য হিরে অনেক বেশি দামি।’
বিদিশার প্রশ্ন, ‘রাহুল তার মানে ওই হিরের খনির মধ্যে …’
‘হ্যাঁ ঢুকেছে কিন্তু পৃথিবীর হিসেবে সাত মাসের আগে বেরতে পারবে না। মধুমিডার দুই চাঁদের অপূর্ব খেলায় ঝরনার জল হঠাৎ গুহার মুখ খুলে দেয়। কিন্তু মাত্র দু-ঘণ্টার জন্যে। তারপরেই সব বন্ধ। রাহুলরা বেঁচে ফিরতে পারবে না।’
ঝন্টুমামা বলল, ‘সব বুঝলাম কিন্তু মধুমিডার মানুষরা কেন দেখা দিচ্ছেন না?’
নিয়োগী বলল, ‘সরি! ওই রিকোয়েস্ট করবেন না। এদের মতো সরল কাউকে পৃথিবীর মানুষ এখনও দেখেননি। ওদের সরলতার জন্যেই অলক ব্যানার্জি, যাইহোক আমাদের আপনারা মধু ও মাধুদের প্রতিনিধি হিসেবেই গণ্য করতে পারেন।’
সুজন বলল, ‘আপনারা পৃথিবীতে ফিরতে চান না?’
‘নেভার। এটাই আমাদের দেশ।’ নিলয় বলল, ‘কিন্তু আমরা যদি পৃথিবীতে ফিরে হিরের ঝরনার কথা বলে দিই। আবার তো…’
‘আপনাদের আমরা বিশ্বাস করি। তবে সেরকম কিছু যদি ঘটেও তার জন্যেই তো আমরা রয়ে গেলাম এখানে। মানুষের মোকাবিলার জন্য এক্স-মানুষ।’ শেষ প্রশ্ন বিদিশার, ‘সব বুঝলাম কিন্তু গুলি ছুড়ে আমাদের বেলুনটাকে ফুটো করে দিলেন কেন?’
‘গুলি? আমরা ছুঁড়েছি?’— মুখ ফুটে ওদের কেউই প্রশ্ন করেনি কিন্তু মুখের ভাবটাই যথেষ্ট।
উত্তর দিল ঝন্টুমামা, ‘উঁহু মধুমিডার লোকদের তার জন্য দায়ী করা যাবে না। এটা এবারের ব্যাপারেই নয়। আগের বার ওরা কিন্তু বেশি বুলেট চালিয়েছিল। মধুমিডার অভিকর্ষ অনেক কম। তাই সেই বুলেটগুলোর মধ্যে এখনও বেশ কয়েকটা কৃত্রিম উপগ্রহ হিসেবে মধুমিডাকে পাক খাচ্ছে। তারই একটা দুর্ঘটনাবশত আমাদের বেলুন ফুটো করে দিয়েছিল। পদার্থবিদ্যায় এমন বেগ ভেলোসিটির ব্যাপরাটার ওপর আরেকবার চোখ বুলিও তা হলেই সব ধাঁধা দূর হয়ে যাবে।’
Tags: উপন্যাস, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সিদ্ধার্থ ঘোষ