জানকীমোহনের ডায়েরি
লেখক: শিবব্রত বর্মন
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“১৯২৩ সালে লখনৌ শহরে এক অভিজাত ব্যক্তির বৈঠকখানায় একটা ঘটনা ঘটেছিল। ভারতের সঙ্গীত ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা। তবে সেটার কথা কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। সেই স্মৃতি সবাই ভুলে গেছে। ইচ্ছে করে। ওই ঘটনার যারা সাক্ষী, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাইরে কাকপক্ষীকেও তারা এ ঘটনা জানতে দেবেন না। সবাই এ সিদ্ধান্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। তারা স্মৃতি থেকে মুছে ফেলেছিলেন ওই রাতের ঘটনা।
“একজন ছাড়া। তিনি কলকাতা হাইকোর্টের এক তরুণ বাঙালি ব্যারিস্টার,” বললেন পরিসংখ্যানবিদ। বলে আমাদের দিকে তাকালেন।
আমরা সবাই জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছি তার দিকে, যেন জানতে চাই ওই বাঙালি তরুণ ব্যারিস্টারের নাম ও আনুপূর্বিক বৃত্তান্ত।
রাতের খাবার সেরে আমরা সবাই পরিসংখ্যানবিদকে ঘিরে বসেছি একটা খোলা টেরেসে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত সেই টেরেস। সবচেয়ে উঁচুতে কারণ এর অবস্থান মাউন্ট এভারেস্টের উত্তর ঢালে, জাকার চু উপত্যকার শেষ প্রান্তে, রংবুক মঠে। আমাদেরকে বলা হয়েছে, ভূপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ হাজার মিটার উঁচুতে এই মঠের অবস্থান।
আমরা যখন আড্ডা দিচ্ছি, তখন মাথার উপরে স্লেট পাথরের মতো কালো আকাশে থিকথিক করছে নক্ষত্র।
মাস ছয়েক ধরে আমরা এখানে আশ্রয় নিয়ে আছি। পালিয়ে আছি। লুকিয়ে আছি। পৃথিবীর যে অল্প কয়েকটা জায়গা এখনো নিরাপদ, এটা তার একটা। উচ্চতাই এর নিরাপত্তার কারণ।
দুনিয়া জুড়ে একটা মহাদুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে, আর সে জন্যে সবাই এখন আশ্রয় খুঁজছে।
রাতের খাবার শেষে অলস আড্ডায় সেই দুর্যোগের কারণ ব্যাখ্যা করছেন পরিসংখ্যানবিদ। অন্তত সেরকমই তিনি দাবি করেছেন, শুরুতে। কিন্তু তিনি ঔপনিবেশিক ভারতের এক গুরুত্বহীন শহরের ঘটনা কেন টেনে আনছেন, আমাদের কাছে বোধগম্য হচ্ছে না।
গতকালই মঠে এসে হাজির হয়েছেন তিনি। এসেছেন হোক্কাইদো থেকে, যদিও চেহারা বলছে, তিনি জাপানিজ নন, দক্ষিণ-এশীয় বংশোদ্ভুত, সম্ভবত শ্রীলংকান। আমরা দূর প্রাচ্যের সবশেষ অবস্থা জানতে আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু তিনি দেখি বিপর্যয়ের ব্যাখ্যা হাজির করতে বেশি আগ্রহী।
তার ব্যাখ্যা নিতান্ত মনগড়া। মাত্রাতিরিক্ত অনুমাননির্ভর। তবু আমরা তার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। তার মধ্যে জমিয়ে গল্প বলতে পারার গুণ আছে। তা ছাড়া রাতের খাবার পর ঘুমাতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমাদের খুব বেশি করনীয় ছিল না। মঠে বিনোদনের উপকরণ বলতে কিছুই নেই, গোটাকতক প্রাচীন পুঁথি ছাড়া। আর তা ছাড়া বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন, সংবাদহীন, দমবন্ধ, উৎকণ্ঠাময় এরকম পরিস্থিতিতে যে কোনো ব্যাখ্যাই এখন বিশ্বাসযোগ্য, যৌক্তিক।
“ওই বাঙালি ব্যারিস্টার নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন, তাতে তিনি লিখে রেখেছেন ওই দিনের ঘটনা, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে,” পরিসংখ্যানবিদ বললেন। চেয়ারে তিনি যেভাবে জাঁকিয়ে বসেছেন, মনে হচ্ছিল একটা চরম ভৌগলিক অবস্থানে নয়, তিনি বসে আছেন আলপাইন অঞ্চলের একটা লগ কেবিনে, তার সামনে ফায়ারপ্লেসের উষ্ণ আগুন চিটপিট করে জ্বলছে।
“আইনজীবীর নাম জানকীমোহন দাশগুপ্ত,” পরিসংখ্যানবিদ তামাকের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন। “তিনি সঙ্গীতঙ্গ অতুলপ্রসাদ সেনের চেম্বারে জুনিয়র হিসেবে কাজ করতেন। অতুলপ্রসাদ জাঁদরেল আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও গানবাজনার দিকে ঝোঁক ছিল। তার প্রভাবে জানকীমোহন সঙ্গীতের রাজ্যে ঢুকেছিলেন।
“মনে রাখতে হবে, ঔপনিবেশিক কলকাতায় তখন গানবাজনার খুব রমরমা। শহরের মহল্লায় মহল্লায় নানারকম সঙ্গীতসমাজ বা মিউজিক ক্লাব গড়ে উঠছে। কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে এরকমই একটা ক্লাব গড়ে উঠেছিল, নাম ছিল “সঙ্গীত সংঘ”। খুব সক্রিয় সংঘ। এটির সভ্যদের মধ্যে নাটোরের মহারাজা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন মন্মথ মিত্র, আশুতোষ চৌধুরী।”
পরিসংখ্যানবিদ এমনভাবে বলছিলেন, যেন এইসব নামের তাৎপর্য আমাদের কাছে স্বতঃসিদ্ধ। যেন আমরা ১৯২৩ সালের কলকাতার একটা মহল্লায় বসে শুনছি তার গল্প। কিন্তু কোনো নামই আমাদের কানে কোনো অর্থ তৈরি করছিল না। তবে ঔপনিবেশিক কলকাতার সঙ্গে আমাদের ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক ও কালিক দূরত্ব তার গল্প শোনায় কোনো ব্যাঘাত তৈরি করছিল না।
“এই সংঘে তরুণ ব্যারিস্টারের যাতায়াত ছিল। তবে, আমাদের ঘটনাস্থল কলকাতা বা কর্নওয়ালিস স্ট্রিট নয়। লখনৌ। আর ঘটনাচক্রে ১৯২৩ সালে লখনৌ শহরের ওই আসরে হাজির হয়েছিলেন তরুণ ব্যারিস্টার।
“ওই আসরে শহরের বড়ো বড়ো সঙ্গীতবোদ্ধা ও ওস্তাদেরা হাজির ছিলেন। সেটা একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আসর ছিল। কারণ, সেদিন ওই আসরে হাজির হওয়ার কথা ছিল তিন বিশেষ অতিথির। তাদের একজন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আরেকজন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দিকপাল বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে। মহারাষ্ট্রের এই সঙ্গীতস্রষ্টা ও সংগঠক বয়সে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে এক বছরের বড়ো। আসরের তৃতীয় অতিথির নাম প্রকাশ করা হয়নি। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তিনি সেদিন গরহাজির ছিলেন।
“ওইদিন ওই আসরে নটনারায়ণের ধ্রুপদ গেয়ে আসর মাত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শাস্ত্রীয় গানে রবীন্দ্রনাথের গলা খুব কারুকাজময় ছিল না। কিন্তু তিনি তখন অতিকায় সেলিব্রিটি। তিনি যা করবেন, তাই ঘটনা। অভ্যাগতরা প্রচুর তারিফ করছিলেন তার গায়নভঙ্গির।
“কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেটা ছিল একটা সঙ্গীতের আসর। অভ্যাগতরা সঙ্গীতসুধা পান করতে এসেছিলেন। আর এ কারণে সেদিন সেখানে রবীন্দ্রনাথ আসরের মধ্যমণি ছিলেন না। তার চেয়েও বড়ো আকর্ষণ ছিলেন ভাতখণ্ডে। সেটা রবীন্দ্রনাথ আঁচ করতে পারছিলেন এবং সে কারণে তিনি আসরের মনোযোগ তার দিকে আকৃষ্ট করতে বিশেষ যত্নবান ছিলেন।
“ভাতখণ্ডে সেদিন গান গাইতে রাজি হচ্ছিলেন না। তার শরীর খারাপ ছিল। আগের রাত থেকে একশো দুই ডিগ্রি জ্বর। সামান্য কাশি। আর কী এক অবসাদ যেন ভর করেছিল তার ওপর। কিন্তু অতিথিদের চাপাচাপিতে তিনি ওইদিন গান্ধারের জয়জয়ন্তী, ছায়ানট আর পরজ গেয়েছিলেন। ভাতখণ্ডের ওইদিনের ওই গানের পরিবেশনা ছিল ভারতীয় সঙ্গীত ইতিহাসের ব্যতিক্রমী এক ঘটনা।
“কেন, সেটা বলি। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে আপনাদের কারোরই বুৎপত্তি নেই, সেটা আমি জানি। এগুলোর নুয়ানসেস আপনারা ধরতে পারবেন না। তবু শুধু শুনে যান।
“ওইদিন ওই আসরে ভাতখণ্ডের কণ্ঠ থেকে যে সঙ্গীত বেরিয়েছিল, তার সঙ্গে চেনাজানা কোনো কিছুরই মিল ছিল না। প্রত্যেক সঙ্গীতপ্রতিভার নিজস্ব ভঙ্গিমা থাকে। গায়কি। সুরের মূল কাঠামোয় তারা ইমপ্রোভাইজ করেন, ব্যতয় ঘটান। কিন্তু ভাতখণ্ড ওইদিন যা করেছিলেন, তা কোনো ইমপ্রোভাইজেশন ছিল না। তিনি চিরচেনা জয়জয়ন্তী ও ছায়নটের খোলনলচে পালটে দিয়ে এ দুই বন্দিশকে অচেনা করে তুলেছিলেন, এতই অচেনা যে সকলের মনে হচ্ছিল তারা অন্য কিছুর বন্দিশ শুনছেন। অথচ সেটা জয়জয়ন্তীই ছিল, ছায়ানটই ছিল। অন্য কিছু ছিল না। সঙ্গীতে এ এক অচেনা এবং অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা। এরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি অভ্যাগতদের কেউ কখনো হননি।
“ব্যারিস্টার জানকীর ডায়েরি পড়ে জানা যায়, এই অপরিচিত সুরসঙ্গতী রবীন্দ্রনাথসহ আসরের সকলকেই বিচলিত ও বিব্রত করেছিল। তারা সঙ্গীতগুরুকে আর কোনো গান পরিবেশনের জন্য চাপাচাপি করেননি। আসরে এরপর আর কোনো গানই পরিবেশিত হয়নি। অতুলপ্রসাদ ছিলেন সেই আসরে। তিনি তার নতুন রচিত “একা মোর গানের তরী ভাসিয়েছিলাম নয়ন জলে” গানটি গেয়ে শোনাবেন বলে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। গাওয়া হয়নি।
“অস্বস্তি কাটানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ ধ্রুপদ বনাম খেয়াল বিষয়ক তার প্রিয় ও পুরোনো তর্কের অবতারণা করেছিলেন এবং এ প্রকারে তিনি আসরের মনোযোগের আলো তার ওপর নিবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গানের গলার চেয়ে বাগ্মিতা যে উজ্জ্বল, সেটা অল্পক্ষণেই আসরে পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি খেয়ালের বিপরীতে ধ্রুপদের পক্ষে তার অবস্থান বোঝাচ্ছিলেন।
“ওই আসরের অনুপুঙ্খ বিবরণ তরুণ ব্যারিস্টার জানকী তার ডায়েরিতে টুকে রেখেছেন। তার খটকা লেগেছিল। তিনি একটা অদ্ভুত কথা লিখেছেন তার দিনলিপিতে। আমি সেইটার দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। জানকীর মনে এই সন্দেহ উঁকি দিয়েছিল যে, ওইদিন ভাতখণ্ডের সঙ্গীতে অদ্ভুত ব্যত্যয়ের সঙ্গে তার অসুস্থতার কোনো যোগ থাকতে পারে। সেই যোগটি কী, জানকী কোনো ধারণা দিতে পারেননি।
“পরবর্তীকালে জানকী কিছু খোঁজখবর শুরু করেন, বম্বে শহরে ভাতখণ্ডের ব্যক্তিগত চিকিৎসকের সঙ্গে তার কয়েক দফা চিঠি চালাচালি হয় এবং এগুলোর মারফতে তিনি কিছু অপ্রত্যাশিত তথ্য জানতে পারেন।
“ভাতখণ্ডের ওইদিনের অসুস্থতা বিচ্ছিন্ন কিছু ছিল না। আপনাদের জানা থাকার কোনো কারণ নেই, ১৯২৩ সালে বম্বে শহরে এক অজানা রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। একটা সংক্রামক ব্যাধি। এটির খুব দ্রুত বিস্তার জনস্বাস্থ্যবিদদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। কী প্রক্রিয়ায় এটি ছড়াচ্ছে এবং এটির উৎস প্যাথোজেন বা জীবাণু কী, তা সনাক্ত করা যাচ্ছিল না। সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল এটির উপসর্গ বা সিম্পটম। এ রোগের কোনো ধরাবাঁধা উপসর্গ ছিল না। যারা এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছিলেন, তাদের একেকজনের মধ্যে একেকরকম উপসর্গ দেখা দিচ্ছিল। সেগুলো এত প্যাটার্নহীন যে চিকিৎকেরা একে একটি অভিন্ন রোগ হিসেবে সনাক্তই করতে পারছিলেন না। তারা সন্দেহ করতে বাধ্য হচ্ছিলেন কয়েক ডজন আলাদা জীবাণু একই সঙ্গে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। একই জীবাণুর আলাদা আলাদা স্ট্রেইন নয়, বরং আলাদা আলাদা জীবাণুর একই রকম স্ট্রেইন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর কোনো নজির না থাকলেও অবস্থাদৃষ্টে তারা এমনটা ভাবতে প্রলুব্ধ হচ্ছিলেন।
“মুম্বাইতে এ রোগ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তিন কি সাড়ে তিন মাস। কিন্তু লোকজনের একটা বড়ো অংশই এতে আক্রান্ত হয়েছিল। ভাতখণ্ড এ রোগ বয়ে এনেছিলেন এবং তার মাধ্যমে সেদিন ওই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন লখনৌয়ের ওই সভায় উপস্থিত অভ্যাগতদের সবাই। রবীন্দ্রনাথসহ। শোনা যায়, ফিরে এসে কবিগুরু চার দিন জ্বরে ভুগেছিলেন।
“স্বল্পস্থায়ী হওয়ার কারণে এ মহামারি নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা খুব বেশি মাথা ঘামাননি। তবে ব্যারিস্টার জানকী কৌতুহলী ছিলেন। তিনি কয়েকটা বিষয়ে চোখ রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে তার ডায়েরিতে তিনি এমন কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন, যা বিচলিত হওয়ার মতো। জানকী এক তামিল রবীন্দ্রগবেষকের কথা উল্লেখ করেছেন, যিনি দাবি করেছেন, ১৯২৩ সালের পর থেকে রবীন্দ্রনাথের গানে একটা সূক্ষ্ম অথচ লক্ষণীয় বাঁক পরিবর্তন ঘটেছে। রবীন্দ্র বোদ্ধারা মনে করেন, ওই সময় রবীন্দ্রনাথ রাগ ভুপালি আর রাগ গৌড় মালহার নিয়ে নিরীক্ষা করছিলেন। কিন্তু ওই তামিল গবেষক, যিনি পেশায় ছিলেন ভূতত্ত্ববিদ, এবং সেই সূত্রে কলকাতায় ইন্ডিয়ান জিওলজিক্যাল সার্ভে অফিসে ক্লার্কের চাকরি করতেন, কিছুটা দৃঢ়তার সঙ্গে বলার চেষ্টা করেছেন, রবীন্দ্রনাথ এ সময় সুর নিয়ে খুব বেপরোয়া কিছু অ্যাডভেঞ্চার করেছেন, যা পরবর্তীকালে তার সুর সৃষ্টির মূল খাতটিকেই বদলে দিয়েছে। ওই গবেষক শুধু সঙ্গীতের দিকেই তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিলেন। ফলে একই সময়ে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মেও কোনো বাঁক বদল হয়েছিল কিনা, সনাক্ত করার চেষ্টা বা অভিনিবেশ কোথাও দেখা যায়নি।
“একটি বিশেষ আসরে গিয়ে একটি সংক্রামক ব্যাধিতে রবীন্দ্রনাথের আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে তার সঙ্গীতের বাঁক পরিবর্তনের যোগসূত্র কেউ যদি আবিষ্কারের চেষ্টা করে, তবে তাকে দুঃসাহসী বলা ছাড়া উপায় থাকে না।
“কিন্তু জানকী আরেকটা অদ্ভুত বিষয় উল্লেখ করেছেন তার নোটে। ১৯৬০-এর দশকে বম্বের একদল স্থপতি বলার চেষ্টা করেছেন, ১৯২৩ সালের পর থেকে ওই শহরে ভবন নির্মাণ নকশায় একটা স্পষ্ট পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের পেছনে কোনো বাহ্যিক কারণ তারা কেউই সনাক্ত করতে পারেননি, যেন হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়া লোকে একটা নির্দিষ্ট বছর থেকে ভিন্নভাবে ভবনের ছাদ ও বারান্দার নকশা করতে শুরু করেছিলেন।”
এটুকু বলে পরিসংখ্যানবিদ তার বক্তৃতায় ইতি টানেন। তিনি আকস্মিকভাবে প্রসঙ্গ পালটে রাতে তুষারপাতের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন এবং আমরা শত চাপাচাপি করা সত্ত্বেও লখনৌয়ের সেই গানের আসর ও গোপন মহামারির প্রসঙ্গে আর ফিরে গেলেন না।
পরদিন রাতের খাবারের পর আমরা যখন আবারও আয়েশ করে টেরেসে বসেছি, পরিসংখ্যানবিদ কোনো ভূমিকা ছাড়া শুরু করেন তার আগের দিনের বক্তৃতা। আগের রাতে যেখানে শেষ করেছিলেন, ঠিক সেখান থেকে শুরু করেন তিনি। ফলে আমরা শুরুতে হোঁচট খেয়েছিলাম। বুঝতে পারিনি তিনি কোন প্রসঙ্গে কথা বলছেন।
“রোগ আর তার উপসর্গের মধ্যে যে যোগসূত্র, আমরা সবসময় সেটাকে সরলরৈখিক ভেবে এসেছি,” উঁচু গলায়, প্রক্ষেপণ সহযোগে বলতে শুরু করেন পরিসংখ্যানবিদ, যেন শ্রেণিকক্ষে বক্তৃতা করছেন। “ভেবে এসেছি, এগুলো কার্যকারণ সূত্রে সরাসরি যুক্ত। উপসর্গের কারণ রোগ। এবং নির্দিষ্ট রোগের জন্য উপসর্গের একটি করে নির্দিষ্ট বর্গ, দল বা সেট বিদ্যমান। ডিপথেরিয়া হলে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর হবে, গলা ব্যথা করবে, গ্ল্যান্ড ফুলে যাবে ইত্যাদি। কিন্তু এই একই উপসর্গ অন্য আরো অন্তত সাতটি রোগেও দেখা দেয়। তাহলে ভিন্ন ভিন্ন রোগের জন্যে উপসর্গের যেসব সেট বিদ্যমান, তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সেটগুলো ওভারল্যাপ করে। কোনো রোগের জন্যেই অনন্য কোনো উপসর্গ বরাদ্দ নেই।
“উপসর্গ আর রোগের মধ্যেকার এই সরলরৈখিক সম্পর্কের ধারণা ততদিন পর্যন্ত প্রযোজ্য ছিল, যতদিন কার্য আর কারণের মধ্যে একটা সরলরৈখিক সম্পর্কের ধারণা মানুষ বদ্ধমূলভাবে বিশ্বাস করে এসেছে। এই ধারণা ভেঙে পড়ে আমাদের সময়ে এসে। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, এই ধারণা পালটে যাওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা কোনো তাত্ত্বিক পদার্থবিদ বা গণিতবিদের নয়, মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে একটা রোগ। সেই রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে। তার কোনো নাম নেই। কারণ আমরা সেটাকে রোগ হিসেবে সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছি। কেননা এ রোগের কোনো পরিচিত সনাক্তযোগ্য উপসর্গ ছিল না।
“বম্বে শহরে ভবন নির্মাণ বা স্থাপত্য শৈলির পরিবর্তন বা একজন নোবেলজয়ী কবির সঙ্গীত সৃষ্টির প্রবণতা বদলকে যেমন রোগের উপসর্গ বলে সনাক্ত করা সম্ভব নয়, ঠিক তেমনিভাবে আমরা কার্য আর কারণের সম্পর্ক ভেঙে ফেলা নতুন পদার্থবিদ্যার উদ্ভবকে একটা নতুন রোগ বা মহামারির উপসর্গ বলে সনাক্ত করতে পারিনি। আর আমাদের বর্তমান দুর্যোগের শুরু সেইখান থেকে।
“আমি পেশায় পরিসংখ্যানবিদ। কোনো পদার্থবিদ বা গণিতবিদ নই, যে কারণে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার একটি নতুন শাখার উদ্ভব কীভাবে গত পঞ্চাশ বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় একটি নতুন ও বৈপ্লবিক শাখার জন্ম দিয়েছে, আর কীভাবে সেটা মানবজাতির চূড়ান্ত ধ্বংসের দুয়ার উন্মোচন করেছে, যার পরিণামে আমরা এই মঠে এসে লুকিয়ে আছি, আমি সেটার গাণিতিক ব্যাখ্যায় যেতে পারব না। আমি শুধু দেখানোর চেষ্টা করব, কীভাবে রোগ আর তার উপসর্গের মধ্যে সম্পর্ককে পরিসংখ্যানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে আমরা এই বিপর্যয় উপলব্ধি করতে পারিনি।
“এমন একটি রোগের কথা চিন্তা করুন, যার উপসর্গ সীমাবদ্ধ নয়। একটি রোগের নির্দিষ্ট উপসর্গগুলোকে যদি আপনি একটি সেট হিসেবে কল্পনা করেন, তাহলে এমন এক রোগের কথা ভাবুন, যার উপসর্গ একটি উন্মুক্ত ও সার্বিক সেট। এর উপসর্গ যে কোনো কিছু হতে পারে। সঙ্গীত সৃষ্টি বা স্থাপত্য নকশার প্রবণতায় পরিবর্তন থেকে শুরু করে মানুষের বাজার করার ধরনে পরিবর্তন পর্যন্ত। তখন যেটা ঘটবে, তা হল, আপনি ওটাকে আর রোগ হিসেবে সনাক্ত করতে পারবেন না। তখন রোগ তার উপসর্গের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়।
“২০৩৭ সালে লন্ডনের ট্যাবলয়েডগুলো একটা অদ্ভুত ঘটনার খবর দিয়েছিল। সাত বছর ধরে ফুটবল ক্লাব লিভারপুলের ফ্যানের সংখ্যা কমতে কমতে ওই বছর শূন্যে এসে ঠেকে। এর ঠিক সাত বছর আগে টেমস নদীতে ক্রুশিয়ান কার্প মাছ গণহারে মরে ভেসে উঠতে শুরু করেছিল। এখন কথা হল, টেমসে একটি বিশেষ জাতের মাছের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া রোগের সঙ্গে একটা বিশেষ ফুটবল টিমের সাপোর্টার কমে যাওয়ার কোনো যোগসূত্র কেউ কখনো কল্পনা করেনি, করবে না, যদি না লোকটা পাগল ও পরিসংখ্যানবিদ হয়ে থাকে। রোগের উপসর্গ কীরকম উন্মুক্ত একটা সেট হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে আমি এটা বললাম।
“এবার আমি আপনাদের একটা কথা বলি। খুব সহজ, সোজা কথা। আপনারা এখানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে অনেক কথা বলছিলেন, খাবার টেবিলে শুনেছি। আপনারা আলফা লুপের কথা বলছিলেন, শুনলাম। ২০৪৫ সালের পর থেকে আর্টিফিশায়াল ইন্টেলিজেন্সের বেসিক অ্যালগোরিদমে আলফা লুপ নামে একটা বিশেষ গাণিতিক ঢুকে পড়েছে– সেটা কীভাবে ঢুকল তা নিয়ে আপনারা নানারকম তত্ত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন, দেখলাম। কিন্তু আপনারা কেউ একমত হতে পারছেন না কীভাবে একটা গাণিতিক বাগ হিসেবে ওই লুপ ছড়িয়ে পড়ে দুনিয়াজোড়া আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সকল অ্যালগোরিদমকে করাপ্ট করে ফেলেছে, কীভাবে সেটা স্থায়ী রূপ নিল।
“ড. জানকীমোহনের ডায়েরি এবং লখনৌ শহরের ওই গানের আসরের গল্প আমি এমনি এমনি বলিনি। আমরা কথা হল, আপনারা কি কেউ কষ্ট করে ২০৪৫ সালের পত্রপত্রিকা ও মিউনিসিপালিটির দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখবেন, ওইসময় গণস্বাস্থ্যবিশারদেরা কোনো অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ করেছেন কিনা? কোনো অপরিচিত উপসর্গ? যদি এই কষ্টটা করেন, তাহলে এখন থেকে আর মাস তিনেকের মধ্যে এই উপত্যকা বেয়ে কুচকাওয়াজ করে যে একদল যন্ত্র এগিয়ে আসবে দুনিয়ার এই শেষ মঠের দিকে, যাদের অগ্রযাত্রা আপনারা কোনোভাবে ঠেকাতে পারবেন না, আমি বাজি ধরে বলতে পারি, ওই যন্ত্রগুলোর মগজ বিগড়ে যাওয়ার আদি উৎস আপনারা আবিষ্কার করতে পারবেন। আমি নিশ্চিত।”
এই বলে পরিসংখ্যানবিদ উঠে দাঁড়ালেন। হাত-পা ছড়িয়ে তিনি আড়মোড়া ভাঙ্গলেন। যে আসন্ন বিপদের আভাস তিনি এইমাত্র দিলেন, সে জন্যে তাকে চিন্তিত বা বিমর্ষ মনে হল না। বরং আমাদের সামনে অভিনব একটা আইডিয়া উপস্থাপন করতে পারার বিজয়গর্বে যেন কিছুটা আপ্লুত হয়ে আছেন তিনি।
কালো আকাশে ফুটে থাকা অজস্র রূপালী নক্ষত্রের নীচে তার অন্ধকার অবয়ব একটা বিশাল ভারী ভাস্কর্যের মতো দেখাচ্ছিল।
Tags: গল্প, শিবব্রত বর্মন, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা