সালোকসংশ্লেষ
লেখক: শরণ্যা মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“কী রে, হল?”
“হচ্ছে হচ্ছে, দাঁড়া।”
“এবারেও যদি না হয়?”
“আরে শুভ কথা বল। সবসময় এরকম নেগেটিভ বলা উচিত নয়।”
“আরে! এই নিয়ে কতবার হল খেয়াল আছে?”
“ধৈর্য হারালে চলবে না। শুনেছি যে এবার যিনি এসেছেন তিনি নাকি আজ অবদি কখনো ফেল করেননি।…”
“সবই তো বুঝলাম। এদিকে কতক্ষণ হয়ে গেল সে খেয়াল আছে?”
“দু-ঘণ্টা কমপ্লিট হয়নি এখনো।…”
“হয়নি? তোর কি সময়ের কোনো জ্ঞানই নেই? আড়াই ঘণ্টা হতে চলল। আর আধ ঘণ্টা পর কিন্তু আমাদের হেড অফিসে রিপোর্ট করতেই হবে।…”
“আরে সে ঠিক আছে। চিন্তা করিস না। এটা বোঝ, যে কেন দেরি হচ্ছে। আগের জনেরা তো এসেও কিছুই করতে পারেনি। দু-ঘণ্টা ধরে হাত-পা ছুড়ে বিদেয় হয়েছে। কেউ কেউ তো এক ঘণ্টাতেই… মাঝখান থেকে মেয়েটা…”
“মেয়েটা? এখন মেয়েটার ওপর তোর দরদ উথলে উঠল? এ যদি সাকসেসফুল না হয়, আমাদের কী হবে সেটা বুঝতে পারছিস?”
“পারছি। পারছি। এত দুশ্চিন্তা করিস না তো। যোগা ক্লাসে কী শেখায়? চিল করতে। ঠান্ডা থাকতে।… না হলেই…”
“এখন আবার নতুন ফতোয়া এসেছে, প্রতি দু-দিনে একবার করে কাঁদতেই হবে, দেখেছিস?”
“দেখিনি আবার। তবে এ রুলটা মাস ছয়েক হল বেরিয়েছে। নতুন নয়। তোদের গুহায় কি নতুন হল নাকি? আগে বলেনি?”
“বলেছে বোধহয়। মাসখানেক হল। আমি তো এই কাজটা নিয়ে আজকাল এখানেই থাকি। গুহায় ফেরত যাই কোথায়? কাল চোদ্দো নাম্বার এসেছিল। ওর মুখেই শুনলাম।”
“আগে কান্নাটা কঠিন লাগত। এখন সহজ হয়ে গেছে। চাপ নেই অত। আজ আমার কান্নার দিন।…”
“আরে আমার কান্নাটা ডিউ থেকে গেছে। যেহেতু আগে জানতাম না। কাল চোদ্দো বলল। আমাকে এবার পরপর চার দিন কেঁদে কোটা ফিল আপ করতে হবে…”
“তুই আজ আমার সঙ্গে কাঁদবি। অসুবিধে নেই। এই কাজটা শেষ হলেই…”
“হ্যাঁ। শোন, কাঁদার কোনো ডিজি ম্যানুয়াল দিয়েছে ওরা?”
“না তো। কাঁদতে জানিস না তুই?”
“না। মানে সেরকমভাবে শিখিনি কখনো।…”
“ছেলেবেলায়? তোদের ট্রেনিং-এ কিছু একস্ট্রা কারিকুলার ছিল না?”
“ছিল তো। হারভেস্টিং-এর নানারকম নতুন নতুন নিয়ম…”
“ধুর। হারভেস্টিং তো সবার মেইন সিলেবাসেই থাকে। তার বাইরে…”
“না রে, আমাদের ট্রেনিং সেন্টারের সিলেবাসে একটু অন্যরকমের জিনিসও শেখাত। এরা যদি আমাকে একবার চান্স দিত না, তাহলে আমি এই মেয়েটাকে এক ঘণ্টায়…”
“ওই… এ সব ভুলেও বলিস না। ফেঁসে যাবি কিন্তু বাজেভাবে। তুই জানিস না, আমরা এ সব পারি না, আমাদের মধ্যে সেই স্পার্ক নেই।”
“আরে, রাখ তো স্পার্ক। আমি খেলা জানি। আমরা যখন সেন্টারে ছিলাম, তখন প্রোভাইডার মেয়ের সংখ্যা একশোর ওপর ছিল। এখন কমতে কমতে…”
“আরে, তার মেইন কারণটাই ভুলভাল লোককে দিয়ে হুল ফোটানো। এই যে, তুই এখন যেমন বলছিস। ওরে এ কাজ সোজা নয়। স্যারকে দেখিননি? স্যার কম চেষ্টা করেছেন নাকি? তিন জন প্রোভাইডার স্যারের জন্যই…”
“এই, চুপ চুপ। এ সব কথা একদম নয়। বিশেষ করে গালা রুমের সামনে। এখানে পাথরের কান থাকে, জানিস না?”
“সরি… আচ্ছা শোন, এবারেও যদি না হয়, তাহলে কী হবে রে আমাদের?”
“কী হবে? আগুন্তিয়াদের যা হয়েছিল।”
“আগুন্তিয়া?”
“আগে যেখানে আফ্রিকার কেনিয়া বলে দেশটা ছিল। সেখানকার একটা জায়গার কথা বলছি।”
“কী হয়েছিল ওখানে?”
“বছর সাতেক আগের কথা। মাস খানেক আগুন্তিয়ার সঙ্গে কারো কোনো যোগাযোগ ছিল না। একদিন রেডারে কোনো রেসপন্স না দেখে ক্যাপটেন জানতে চান কী হয়েছে। ভার্চুয়াল কানেকশন না হওয়ায় একটা টিম পাঠানো হয়।”
“তারপর?”
“আগুন্তিয়ায় পৌঁছবার আগেই, আকাশ থেকেই সেই টিম অনেকগুলো সাদা রঙের চলন্ত ঢিপি দেখতে পায়। ওরা বুঝতে পারে না সেগুলো কী। কাছে যেতে আবিষ্কার করে ওগুলো হাড়ের পাহাড় আর তার তলায় রয়েছে অসংখ্য মাংসাশী বিষপিঁপড়ে।…”
২
কবিতাটা এখনো বসে পড়ে ফল্গু। যদিও এখন কবিতা বলে আর কিছু নেই। কবিতা কী, গান কী, এ সব জিজ্ঞেস করলে এখন আর কেউ উত্তরও দিতে পারবে না। কিন্তু ফল্গুর ভালো লাগে। সে পড়ে। সে শোনে। এই ঘরটায় জায়গায় দিনের আলো পৌঁছোয় না কোনোদিন। তার মাথায় এই মুহূর্তে অসম্ভব বড়ো দায়িত্ব। হাতে সময় আর মাত্র এক ঘণ্টা। তার সামনে খাটের ওপর একজন জলজ্যান্ত যুবতী। সব রকমের মোচ্ছব করার লাইসেন্স তার হাতে। কিন্তু…
“We are the hollow men/ We are the stuffed men/ Leaning together/ Headpiece filled with straw. Alas!/ Our dried voices, when/ We whisper together/ Are quiet and meaningless/ As wind in dry grass/ Or rats“ feet over broken glass/ In our dry cellar…”
আমরা ফাঁপা মানুষ, আমরা খড়পোরা মানুষ! আমাদের গলা শুকনো! আমরা ফিসফিসিয়ে অর্থহীন কথা বলি! যেমন কিনা শুকনো ঘাসের বাতাস বা ভাঙা কাচে ইঁদুরের পায়ের ছাপ!… লাইনগুলো নিজের মনেই নিজের মাতৃভাষায় বিড়বিড় করে ফল্গু। তারপর তামাটে গলায় মেয়েটিকে বলে, “কী অদ্ভুত না! আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে এলিয়ট বলে এক কবি ছিলেন, জানো। ব্রিটিশ, না আমেরিকান বোধহয়! তাঁর লেখা লাইনগুলো আজ বর্ণে বর্ণে এভাবে সত্যি হবে, কেউ ভেবেছিল?”
মেয়েটা কিছু বলে না অবশ্য। কবি শব্দটা ওর পরিচিত নয় বোধহয়। না হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এভাবে “অরসিকেসু রসস্য নিবেদনম্” করতে ফল্গুর ভালো লাগত না আগে। কিন্তু এখন আর ভালো লাগা বা মন্দ লাগাটা সে টের পায় না তেমন। নিজের কথাগুলো কারোর কাছে বলতে চাওয়ার একটা উদগ্র, মর্মন্তুদ বাসনা তাকে ডাকাতের মতো, মাতালের মতো, ধর্ষকের মতো ধাওয়া করে। আজকাল সে তার গুহায় একটা ক্রিস্টাল রেখেছে। স্বচ্ছ। এখন সেই ক্রিস্টালটাকে সে গান শোনায়। ছবি এঁকে দেখায়। কথা বলে। ভালোবাসার কথা, রাগের কথা, অভিমানের কথা।
“আর দেরি করবেন না। ওরা কিন্তু একটু বাদেই ঢুকে আসবে।”
দু-হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে ডাকছে মেয়েটা। ওর হাতদুটো থরথর করে কাঁপছে।
মেয়েটার চোখে অনুনয়। “মেয়েটা” বলা কি ঠিক হচ্ছে? একবার ভালো করে ওকে দেখল ফল্গু। বয়স ত্রিশের ওপর হবে বলেই মনে হয়। যদিও এদের দেখে বয়স বোঝা সম্ভব নয়। সে এখন ফল্গুকে দেখেও…
“স্যার, কী ভাবছেন? সূর্যঘড়ির দিকে দেখুন। আর এক ঘণ্টা পরই অন্ধকার হয়ে যাবে। তখন আর কিছু করা যাবে না। এবারেও না পারলে ওরা আমাকে… স্যার…”
চমকে উঠল ফল্গু। এ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতার সুবর্ণজয়ন্তী হবে এ বছর। মেয়েটির মধ্যে আপাতভাবে কোনো অস্বাভাবিকত্ব চোখে পড়ছে না। টানা চোখ, ছোটো ছোটো ছাঁটা কদমচুল মাথা, মাখন পিছলানো ত্বক। গালে গোলাপি ভিটামিন আভা। এখন একটা লম্বা পাতলা গাউন পরে আছে ও। কিন্তু ও বার বার ফেইল করছে কেন? রোগাপানা শরীরটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ শিউরে উঠল ফল্গু। এই ইন্ডিয়ানা অঞ্চলে প্রায় এক লাখ মানুষ থাকে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। তাদের সকলের খাবার জোগাড়ের ভার একা এই মেয়েটার ওপর?
“স্যার, কেন দেরি করছেন? কাল আমাদের মহোৎসব আছে। বাইরে দেখেছেন কত আনন্দ? সবাই নিজেদের বাড়িঘর সাজাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা গান গাইবে। অনুষ্ঠান করবে। কাল একটা ভালো খবর ওদের দিতেই হবে। এখানে কতদিন লোকে আধপেটা খেয়ে আছে জানেন? সেই গত পূর্ণচাঁদের দিন থেকে। আজ এক মাস হতে চলল। মানুষ এক দানা চালের জন্য খুন করছে স্যার। ক্যাপ্টেন নিজে এবার ইন্ডিয়ানায় আসছেন। কাল মহোৎসব।”
শেষ শব্দদুটো কেটে কেটে টানা গলায় বিসর্জনের বাজনার মতো দ্রিমিদ্রমি স্বরে উচ্চারণ করল মেয়েটা।
“তুমি ক-বার মা হয়েছ এখনো পর্যন্ত?”
“একশোত্রিশ বার…”
“একশোত্রিশ…!”
“হ্যাঁ, কিন্তু শেষ এক বছরে কোনো ভালো হারভেস্টর পাইনি। আমার চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না, বিশ্বাস করুন। কিন্তু কারোর মধ্যেই স্পার্ক ছিল না। আমি সারাদিন রোদে বসে থেকেছি একটা সময়। সারাদিন। একফোঁটা জলও খাইনি, পাছে…”
“কে তোমায় বলল যে আমি একজন হারভেস্টর?”
এ মেয়ে কতদিন বাইরের জগতে বার হয়নি? ও কি জানে না যে এখন হারভেস্টর ব্যাপারটা বেআইনি হয়ে গিয়েছে? ওকেও কি এখানে আটকে রাখা হয়েছে জন্ম থেকেই?
“কেন? যারা আমাদের নিষেক করতে আসে, তাদের হারভেস্টরই বলা হয় তো?” আয়ত চোখ মেলে মেয়েটা পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল ফল্গুর দিকে।
“কতদিন এই ঘরে আছো তুমি?”
“জানি না”, মাথা নাড়ল মেয়েটা। “মানে মনে নেই। শেষ মা হয়েছিলাম, তাও অনেক দিন হয়ে গেল। ছ-মাস অবদি হিসেব রেখেছিলাম। ওই যে, দেখুন, ওইটায়।”
পাথরের স্ল্যাবের বিছানার পাশেই একটা সাদা টুল। তাতে একগ্লাস ঢাকা দেওয়া জল। আর তার পাশে একটা…”
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না ফল্গু। সে কি সত্যিই একটা খাতা দেখছে? কাগজের তৈরি খাতা? শেষ কবে এরকম বাঁধানো খাতা দেখেছে সে? ঠাকুমার কাছে? না। বোধহয় বাবারও ছিল একটা। বাবা ব্যাঙ্কের লকারে রাখত। ভাগ্যিস তখনও ব্যাঙ্ক-লকার চেকিং হত না। খাতা আছে, ধরা পড়লে…
“তুমি এটায় দিনের হিসেব রাখ?”
“হ্যাঁ। পেনও আছে একটা। আমার এখানকার পাহারাদারেরা একেবারেই অশিক্ষিত। এ সব কী, জানে না। তাই বেঁচে গেছি। আমি লিখতেও পারি। অক্ষরজ্ঞান আছে। পড়তেও শিখেছিলাম একসময়। এখন হয়তো আর…”
বহুদূর থেকে ভেসে আসা সুগম সঙ্গীতের মতো কথাটা ধাক্কা মারল ফল্গুর কানে। অক্ষরজ্ঞান পায় এখানকার প্রোভাইডাররা! তাদের গোষ্ঠীতে সবাইকে শুধুমাত্র অঙ্ক আর বিজ্ঞানের কিছু ফর্মুলা শেখানো হয়। এখন ভাষার আর কোনো অস্তিত্ব রাখা হয়নি। শুধু কথ্য ভাষার কিছু ক্লাস দেওয়া হয়। সবাই একটাই ভাষা শেখে। আর সে ভাষার কোনো নিজস্ব ধর্ম নেই। সব দেশের প্রধান ভাষার শব্দভাণ্ডার থেকেই কিছু কিছু শব্দ নিয়ে তৈরি একটা লিঙ্গুয়া ফ্রাঁকা সেটা। কাজের ভাষা। আর যে গোষ্ঠীর যে মাতৃভাষা, সে গোষ্ঠীর ভাষায় একটু বেশি নিজস্ব শব্দ থাকে। এটুকুই। বাইশশো সালের কাছাকাছিই ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল, যতটুকু ফল্গু জানে। সে সময়েই সূর্যে পৌঁছনো এবং সূর্যের থেকে হিলিয়াম, নিয়ন ইত্যাদি গ্যাস নিয়ে আসা শুরু হয়। তারও একশো বছর পরে, মানে তেইশশো সাল নাগাদ ভাষা বা শিল্প মুছে যায়। সৌখিন পৃথিবী ক্রমশ শেষ হয়ে যায়। মানুষ কিন্তু তখনও খুব খারাপ ছিল না। তখনও নাকি সব জায়গাতেই গাছপালা ছিল। নদী ছিল। অরণ্য বলে একটা ব্যাপার হত। সেটাও জানে ফল্গু! কিন্তু সূর্য থেকে তার খনিজগুলি তুলে আনা শেষ হবার পরই মানুষের, মানে এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এই ব্যাপারটা দেখা যায়। সেই সময় থেকেই…
“ছ-মাসের পর আমি হিসেব রাখার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলি। চেষ্টার ইচ্ছেও। জানেন স্যার, আমি জানতামই না যে আমি প্রোভাইডার। আমাকে তুলে আনার হয়েছিল গুন্দেন গোষ্ঠী থেকে। এখানকার নেতা যাঁরা, তাঁরা আমাকে দেখতে পেয়েছিলেন আমাদের ট্রেনিং সেন্টারে। এখন তো প্রোভাইডার পাওয়াই যায় না। আমার মা ছিল না। বাবা খুব খুশি হয়েছিল স্যার। যেদিন আমার নিয়োগ হয় এখানে, সেদিন আমাকে দেখতে সব গোষ্ঠীর লোকেরা নেট অন রেখেছিল সারাদিন। সবাই নিজেদের ট্যাবে আমার ছবি তুলে মিডিয়ায় পোস্ট করেছিল। আমার নিজেকে তখন মনে হচ্ছিল…”
“তুমি “স্টকহোম সিনড্রোম” নামে কোনো অসুখের কথা জানো?”
“না তো?”
মেয়েটির বিধ্বস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত হাসি হাসল ফল্গু। এদের জন্যেই তাদের যুদ্ধ। অথচ এদের কাছে কিছুতেই তাদের কথাগুলো পৌঁছচ্ছে না। কী করে পৌঁছবে? খাদ্যের যোগানের জন্য এখন সবাই মরিয়া। শেষ পঞ্চাশ বছরে দুর্ভিক্ষে, বন্ধ্যাযুগ পরবর্তী পৃথিবীর ত্রিশ শতাংশ মানুষ শেষ হয়ে গিয়েছে। দিকে দিকে নানা ধরনের গবেষণা, আলোড়ন, আন্দোলন, হয়েও লাভ কিছু হয়নি। তার আগে প্রোভাইডার মেয়েদের সংখ্যা তবু একটা বলার মতো জায়গায় ছিল। আর তাদের এভাবে জানোয়ারের মতো বন্দি করে রাখা হত না। তারা অনেকেই স্বেচ্ছায়, তাদের গোষ্ঠীর সম্মানে এই কাজে আসত। একজন প্রোভাইডারকে কখনই দশ বছরের বেশি সার্ভিস দিতে হত না। তারপর গোষ্ঠীতে তার সম্মান থাকত। ভরণপোষণের চিন্তা থাকত না। নিজের জীবন বেছে নিতে পারত সে। কিন্তু কিছু লোকের নিজস্ব স্বার্থপরতার জন্য…
“কাকে বলে “স্টকহোম সিনড্রোম”?”
“আচ্ছা, তোমার নাম কী?”
“নাম?”
মেয়েটা অনির্ণয় চোখ মেলে তাকাল আবার।
“নাম কাকে বলে স্যার?”
“নাম মানে…”
ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিজের খেই হারিয়ে ফেলে ফল্গু…
নাম কাকে বলে? নাম নেই তাদের আর কারোরই।
“নাম হল তোমার পরিচয়। আগের পৃথিবীতে ছিল। যে শব্দ বলে তোমায় ডাকা হবে। যেটা দিয়ে তুমি…”
“ও। নাম্বার। হ্যাঁ, আছে তো। আমার নাম্বার…”
“নাম্বার নয়। বার বাদ। শুধু নাম।”
“শুধু নাম?”
“হ্যাঁ প্রতিমা, শুধু নাম। আমরা বারটা বাদ দেবার চেষ্টা করছি। আবার। বার মানে জানো তো?”
“গরাদ স্যার…”
উজ্জ্বল হয়ে উঠল মেয়েটার মুখ।
“এখন থেকে, এই মুহূর্ত থেকে তোমার নাম হল প্রতিমা। আমি দিলাম তোমায় এই নাম। আপাতত। পরে ইচ্ছে হলে তুমি এই নাম বদলে নিতে পারো। নিজের ইচ্ছেয় নিজের মতো কোনো শব্দ ভাবতে পারো নিজের জন্য। বুঝেছ?”
একটা শূন্যদৃষ্টি ভেসে যায় প্রতিমার চোখে। ফল্গু বুঝতে পারে না প্রতিমা আদৌ বুঝল কিনা ব্যাপারটা। তাই সে প্রতিপ্রশ্ন করল,
“কী শব্দ ভাববে প্রতিমা? যদি তোমায় এখন নিজের জন্য একটা নাম বাছতে বলি?”
প্রতিমার মুখটা সংশয়াকুল হয়ে উঠল বেশ কয়েক সেকেন্ডের জন্য। ঠোঁটটা কাঁপছে তার। কিন্তু কোনো শব্দ বার হচ্ছে না।
“কী হল, বলো।”
“টেস্টোস্টেরন!”
“কী! না! নাম প্রতিমা! নাম। তুমি একটা মানুষ! একটা মেয়ে! তোমার নাম টেস্টোস্টেরন হয় না। তুমি…”
তীব্র বিষাদে মাথা ঝাঁকাল ফল্গু। কাদের জন্য কাজ করছে তারা! ফল্গুর মাথায় হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গনের একটা তীব্র বিস্ফোরণ হয়ে যায়।
“তুমি একটা মানুষ প্রতিমা! মানুষ!” প্রতিমার পাখির মতো শরীর ধরে ঝাঁকায় ফল্গু।
“কী হয়েছে স্যার! কী হয়েছে আপনার? শান্ত হোন।”
প্রতিমা ফল্গুর মাথায় হাত রাখল। কতদিন বাদে কেউ তার মাথায় হাত রাখল। কতদিন? ফল্গুর মনে পড়ে না। ফল্গুর মন শান্ত হয়ে আসে। সে প্রতিমার সামনে মাথা গুঁজে বসে পড়ে। তারপর ফিসফিস করে বলে, “প্রতিমা, তোমরা মানুষ। খাদ্য উৎপাদনের যন্ত্র নও। সূর্যে তোমাদের সেঁকে, তোমাদের ধর্ষণ করে মা বানিয়ে, তোমাদের…”
“আপনি এত ভাববেন না। শান্ত হোন। কাজটা করতে হবে তো স্যার? নাকি?”
প্রতিমার গলাটা পালকের মতো নরম। এরকম সুর শেষবার কবে শুনেছে সে? মায়ের কাছে? মায়ের কাছে। মা-ও… মায়ের কথাটা মনে পড়তেই বিদ্যুৎচমকের মতো সোজা হয়ে বসল ফল্গু।
“প্রতিমা তোমাদের দাস বানিয়ে রাখা হচ্ছে। তুমি বুঝতে পারছ না। তোমাদের গোষ্ঠী, আমাদের গোষ্ঠী, পৃথিবীতে যত গুহা আছে সবাই, সবাই এটাই চায়। যত গোষ্ঠী আছে, সেই বন্ধ্যাযুগের পর যত ক্যাপটেন এসেছেন আমাদের মাথার উপর রাজত্ব করতে; এরা সবাই, সবাই তোমাদের নিজের কুক্ষিগত করে রাখতে চেয়েছে। পায়ের তলায় রাখতে চেয়েছে। কারণ তোমরাই এখন একমাত্র খাদ্যভাণ্ডার তৈরি করতে পার। তোমাদের রক্তেই একমাত্র পাথুরে জমি আবার উর্বর হয়ে ওঠে। বীজের ফলন হয়।…”
“আপনি… আপনি প্রতিরোধ গ্রুপের লোক…!”
স্খলিত স্বর, কিন্তু প্রতিমার গলায় কোনো বিস্ময় নেই। ফল্গু পাথরচোখে প্রতিমার দিকে তাকায়।
“তুমি এই গ্রুপের কথা জানো?”
মৃদুমন্দ হাসি খেলে গেল প্রতিমার মুখে।
“সূর্যকে যখন গোষ্ঠীপতিদের পূর্বপুরুষরা চুরি করে নিচ্ছিল, সব খনিজ তুলে নষ্ট করে দিচ্ছিল, তখন আমার ঠাকুর্দার বাবা এই গ্রুপ বানিয়েছিলেন। আমার বাবা, কাকা, পাড়ার মানুষ, সবাই তাতে যোগ দিয়েছিলেন। আপনি তো জানেনই, এখন মানুষকে বাইরে থেকে দেখলে তার বয়স বোঝা যায় না। দুশো বা তিনশো বছর বাঁচে লোক। এই হিলিয়াম টেকনোলজি, যেটা দিয়ে যৌবন ধরে রাখা হয়, তার কারখানায় আমার ঠাকুর্দা কাজ করতেন। তাঁরা দেখেছেন ওরা কীভাবে সবটা নিজেদের করে নিয়েছে। তার পরপরই গাছ ফুরিয়ে গেল। ক্লোরোফিল তৈরি হত না আর। মাটিতে ফসল ফলা বন্ধ হয়ে গেল। চাষের জমি ফুটিফাটা হয়ে গেল। ক্ষরা এলো, বন্যা এলো। কিন্তু ফসল ফলল না। দুর্ভিক্ষ শুরু হল। লোকে প্রথম দুর্ভিক্ষকালে মরেছে মশা-মাছির মতো।…”
“জানি। একুশশো সালের শেষের দিকে হয়েছিল সেটা।”
“তখনই আমাদের মতো মেয়েরা জন্ম নিতে শুরু করে। আমার দাদাইকে আমি দেখেছি নিজের চোখে প্রোভাইডারদের ঘর বানিয়ে দিতে। গল্পটাও দাদাইয়ের মুখেই প্রথম শোনা। সে বারে অফলা জমিতে চাষীরা হাহাকার করছিল। সেদিন এক চাষীর ঘরে মেয়ে হয়েছিল। তার বাবা রাগে-দুঃখে সদ্য জন্মানো মেয়েটাকে মায়ের কাছ থেকে তুলে এনে নিজের জমির পাথরের মতো শক্ত মাটিতে ছুড়ে ফেলে। মেয়েটার মাথা ফেটে যায়। হাত-পা ফেটে সামান্যই রক্ত ছিটকে বার হয়। সেই রক্ত আর ঘিলুতে মাখামাখি জমিতে সেবারে সবচেয়ে ভালো ধান হয়। এত ফলন হয় যে আশপাশের সব ক-টা গ্রামের লোক খেয়ে আর জমিয়ে ফুরোতে পারে না। সেই গ্রামেই প্রথম বিজ্ঞানীদের দল আসেন। ওই মেয়েটার বাড়িতে। পরীক্ষা করেন। ওর মা-ই প্রথম প্রোভাইডার হয়।…”
“আসলে গোনাডট্রপিন হরমোন একমাত্র অন্তঃসত্ত্বা মানুষের মধ্যেই পাওয়া যায়। আর ওটাই নতুন সূর্যের আলো পেয়ে…”
“মানুষের দুনিয়ার ফসল ফলায়। অনুর্বর জমিকে উর্বর করে। তাই প্রেগন্যান্ট হবার পর থেকেই বাচ্চার জন্ম দেওয়া অবদি, মানে টানা আশি দিনের প্রত্যেক দিন আমাদের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে বিভিন্ন জমিতে দেয় ওরা। তবেই ফসল ফলে। এটাই একমাত্র সার এখন। জানি।”
অম্লান হাসি নিয়ে মাথা নাড়ল প্রতিমা।
“তুমি কি জানো আগে মানুষের সন্তান দশ মাস দশ দিন পর জন্মাত?”
“জানি। শুনেছি এ সব গল্প। কিন্তু সেটা তো অর্ধেক পৃথিবী এমনিতেই মরে যেত স্যার। এত ধীরে যদি মেয়েরা সন্তানের জন্ম দিত…”
“তাই জন্মের সময় কমিয়ে মেয়েদের সন্তান বানানোর যন্ত্র করে ফেলা হল। তাদের বন্দি করে ফেলা হল। তাদের স্বামী, প্রেমিক, কেরিয়ার, সংসার, সন্তান কিছুই আর রইল না। তারা শুধু রক্ত দিয়ে খাবার তৈরি করার মেশিন হয়ে থাকবে, এটাই সত্যি হয়ে গেল।”
“সত্য নয় স্যার। বাস্তব। সবসময় সব বাস্তব সত্য হয় না। প্রায় আশি শতাংশ মেয়েদের অভিযোজন শেষ দুশো বছরে এভাবেই হয়েছে। তাদের রক্তে জমিতে ফসল ফলবে। এটা সত্য। কিন্তু সেটাকে কীভাবে ব্যবহার করবে, সেটা ক্যাপটেনের মতো লোকেরা ঠিক করেছে। এটা বাস্তব। দেশ ভেঙে যাবার পর যখন গোষ্ঠী হল, তখন গোষ্ঠীপতিরা সব মেয়েদের এক জায়গায় করত। দশ বছর বয়স থেকেই বোঝা যেত কারা প্রোভাইডার হতে পারবে। রোদে সারাদিন ফেলে রেখে দেখা হত তাদের রক্তে কিছু পরিবর্তন হল কিনা। যাদের হত, তাদের সবাইকে ধরে নিয়ে যাওয়া হত ফার্টিলিটি ক্যাম্পে।…”
“কিন্তু তুমি যখন এত জান, তাহলে এটাও দেখেছ নিশ্চয়ই যে সব পুরুষ এদের নিষেক করতে পারে না।…”
“পারে না। কিন্তু সেটা সব গোষ্ঠীপতিরা বুঝলে তো। একটা সময় ছিল স্যার। দিনে দশ জন এসে খুঁড়ে যেত আমায়। আমার মতো আরো অনেককে। পাশাপাশি ঘর ছিল তখন। সবই শুনতে পেতাম। তারপর বিজ্ঞান এগোল, কারা পারবে আর কারা পারবে না, তার টেস্ট শুরু হল। তারপর হারভেস্টরদের খোঁজ মিলল।…”
“এখন হারভেস্টর বলে আর কিছু নেই প্রতিমা। মেয়েরা আবার নিজেদের কথা নিজেরা বলতে চাইছে। তাদের খাবার দেবার দায়িত্ব আছে ঠিকই। কিন্তু সেটা তারা স্বেচ্ছায় দেবে, দাস হয়ে থেকে কেন দেবে? কেন কিছু লোক নিজেদের নিজস্ব জমি রাখবে? আর তাতে প্রোভাইডারের হারেম বানিয়ে রাখবে? কেন?”
“আমি এ সব প্রশ্নের উত্তর জানি স্যার। আমি জানি কারণ বাবাও বলত। কিন্তু ওরা কেউই আর বেঁচে নেই। আপনি কি একজন হারভেস্টর? আপনি নিষেক করতে সক্ষম? সত্যি করে বলুন তো আমায়?”
“তুমি সত্যি করে বলো প্রতিমা, একশো ত্রিশ জন সন্তানকে তুমি জন্ম দিলে। একজনেরও মুখ মনে আছে তোমার?”
“কেবলমাত্র যারা প্রোভাইডার আর যারা হারভেস্টর তাদেরই এখন বাঁচানো হয় স্যার। বাকিরা ফসল তৈরির জমিতে মিশে যায়।”
“তোমার কখনো মনে হয়েছে যে এটা ঠিক নয়? প্রতিবার নতুন লোক, প্রতিবার নতুন নিষেক, কোনো টান নেই, মায়া নেই গল্প নেই। গল্প ছাড়া জীবন হয় প্রতিমা? বলো হয়?”
“যে প্রশ্নের উত্তর জানা, সে প্রশ্ন কেন করেন স্যার?”
প্রতিমার গলাটা এত কঠিন শোনাতে পারে, সেটা প্রথমে ভাবতে পারেনি ফল্গু। এখন তার প্রত্যয় হচ্ছে। এ মেয়ে পারবে। পারবেই।
“তুমি আজ আর প্রোভাইডারের ভূমিকায় থাকবে না প্রতিমা।…”
“কীভাবে স্যার? আপনি কি আমাকে এই গালা চেম্বার থেকে বার করে নিয়ে যাবেন? নিয়ে গিয়ে কোথায় রাখবেন? অনেকেই বেরিয়েছে। কেউ বাঁচেনি। আমি কোথাও যাব না স্যার। হয় আপনি নিষেক করুন, আমি পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ছি। আর না হয়…”
“প্রতিমা, তুমি প্রতিরোধ গ্রুপেরই একজন প্রাচীন সদস্যের মেয়ে। তাই তুমি লেখাপড়া কিছু শিখেছ। তাই ধরে নিচ্ছি এখনকার দিনে যে শাস্ত্রগুলো নিষিদ্ধ, যেমন ইতিহাস, নৃতত্ত্ব আর সাহিত্য, সেগুলোও কিছু কিছু জান। কারিগরি বিজ্ঞানের বাইরের দর্শনও বোঝো। তুমি কি জান…”
“আমি কী বুঝি, সেটা এখন আর প্রশ্ন নয় স্যার। আমি যদি আজ প্রেগন্যান্ট হতে না পারি তাহলে আমাদের পুরো গোষ্ঠীটা না খেতে পেয়ে মরবে। আরো একটা জাতি পৃথিবীর বুক থেকে…”
“প্রতিমা তুমি জানো কি আরশোলারা সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে?”
“মানে?”
“একটা আরশোলার মাথা কেটে নিলেও শুধু দেহপুষ্টি নিয়ে সে দশ সপ্তাহ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। তোমাকে কেউ বলেনি প্রতিমা?…”
“আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন স্যার?”
“শহর শেষ হয়ে যাবার পর মানুষ যখন আবার গাছ লাগাবার চেষ্টা করল, নতুন করে গুহায় থাকা যখন আবার শুরু হল, তখনই গোষ্ঠীপতিরা শুধুমাত্র নিজেদের পছন্দের লোকেদের বাঁচিয়ে রাখতে শুরু করেছে প্রতিমা। তারা প্রভু। বাকিরা সবাই দাস। হয় হাল ধরে মাঠে কর্ষণ আর না হলে বিছানায়। গত দুশো বছরের মানবসভ্যতার এটাই ইতিহাস।…”
“আপনি আমাদের মুক্তি দিতে পারবেন না স্যার। প্রতিরোধ গ্রুপ আগে অনেক চেষ্টা করেছে।…”
“তোমাকে মুক্তি দিতে আমি আসিনি প্রতিমা।…”
নিজের পকেট থেকে বড়িটা বার করল ফল্গু।
“হারভেস্টররা ক্রমশ অনুর্বর হয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের শরীরের সুস্থ নিয়মটাকে ভেঙে ফেলার এটাই উপযুক্ত প্রতিফল। এ জাত আর বেশি দিন নয়।…”
“স্যার…”
“আমরা শুধু সেই মৃত্যুটাকে ত্বরান্বিত করতে চাইছি। নতুন পৃথিবী জন্মানোর আগে পুরোনোটাকে…”
“ক্লিন স্লেট প্রোটোকল…”
প্রতিমার গলা ইস্পাত কঠিন।
“দিন স্যার পিলটা…”
হাত বাড়াল সে। এই মুহূর্তে তার হাত একটুও কাঁপছে না।
Tags: গল্প, শরণ্যা মুখোপাধ্যায়, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা