জীবন
লেখক: ঋজু গাঙ্গুলী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
“জীবন মানে কী?”
রঞ্জনের দাদু’র এই প্রশ্নটা শুনে আমাদের তর্ক থেমে গেল।
ভ্যাপসা গরম, হঠাৎ বৃষ্টি, আর মাঝেমধ্যেই ‘টু..কি’ করা নীল আকাশ। ঠিক কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়— সেই নিয়ে কোনো সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়নি। অতঃপর রঞ্জনদের বাড়িতে জমায়েত হয়েছিলাম আমরা সবাই। উপলক্ষ্য ছিল তালের বড়া আর তালক্ষীর খাওয়া।
“হাপুশ হুপুশ শব্দ, চারিদিক নিস্তব্ধ।” অবস্থা একসময় শেষ হল। খাদ্যরসিক মনোজদা একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলল, “লোকে বলে বাঁচার জন্যই নাকি খাওয়া। তবে এমন জিনিস খেলে মনে হয়, খাওয়ার জন্যই বাঁচা যায়।”
কথাটা নিয়ে আমাদের কারো দ্বিমত ছিল না। কিন্তু সেটা অপু’র সহ্য হবে কেন? তাই ওকে বলতেই হল, “জীবনকে শুধু খাওয়া দিয়ে মাপলে আমাদের সঙ্গে ডাইনোসরদের কোনো তফাৎ থাকবে না।”
জীবন কেন বৃথা হয় সেই নিয়ে তর্কটা এরপর শুরু হল। “অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে ভালো বোলিং অ্যাটাক না থাকলে”, “আই.লিগ জিততে না পারলে”, “সামনের পুজোয় সম্মিলনীর চেয়ে ভালো প্রতিমা না হলে” ইত্যাদি ঘুরে আলোচনাটা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছিল। তখনই দাদু এই, মানে একেবারে গোড়ার কথাটা তুললেন।
আমরা সবাই একটা জুতসই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ রিনি জানালার দিকে আঙুল তুলে বাইরেটা দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “সরকারজেঠু!”
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার সরকারজেঠুকে আমরা খুব পছন্দ করি দুটো কারণে।
প্রথমত, অন্য অনেক প্রাক্তন যোদ্ধার কথায়-কথায় “আমি যখন ফ্রন্টে ছিলাম তখন…” বলে স্মৃতিচারণ করার বদভ্যাস থাকে। সেটা জেঠু’র একেবারেই নেই।
দ্বিতীয়ত, বলার তুলনায় শোনাই পছন্দ করেন জেঠু। তবে কালেভদ্রে উনি মুখ খুললে আমরা এমন কিছু শুনেছি— যেমনটা গল্পের বইয়েও পাওয়া যায় না।
রিনি’র চিৎকার শুনে আমরা সবাই চনমনে হয়ে উঠলাম। এমনকি দাদুও “সরকার!” বলে একটা পেল্লায় হাঁক পাড়লেন।
রঞ্জনকে দুদ্দাড়িয়ে বাড়ির ভেতরে ছুটতে দেখে ভাবছিলাম, পেট পরিষ্কারের ক্ষেত্রে তালক্ষীরের বিশেষ কোনো ক্ষমতা আছে কি না। তবে একটু পরেই ও হাঁপাতে-হাঁপাতে ফিরে এল।
ঘরে ঢুকে ঠিক কোথায় বসবেন তাই নিয়ে একটু ইতস্তত করছিলেন জেঠু। আমি বলে উঠলাম, “আজকের তর্কের বিষয়— জীবন মানে কী? এবার আপনাকে বলতে হবে।”
দাদুও ফিল্ডে নামলেন, “সরকার, আজ তোমাকে ঝুলি খুলতেই হচ্ছে।”
সৈন্যেরা নাকি কখনোই অপ্রস্তুত হয় না। সরকারজেঠুও এই হঠাৎ অনুরোধ বা উপরোধে খুব একটা অবাক হলেন না। তাঁর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি রঞ্জনের দিকে ঘুরল। উত্তরটা রিনি-ই দিল, কারণ একটু আগে রঞ্জনের দৌড়ের কারণটা ও বুঝে ফেলেছিল, “কফি রেডি হচ্ছে। আপনি শুরু করুন।”
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন জেঠু। আমার নজর ওঁর পরিপাটি পোশাক, চশমার ফ্রেম, এমনকি বাইরের নিম গাছের ডালে বসে বিশ্রী স্বরে ডাকা কাকটার ওপরেও ঘোরাফেরা করে এল।
“বইপত্রে জীবন মানে হল এক ঝাঁক কাজকর্ম— যা হলে একটা জিনিসকে আমরা সজীব বলি।” থেমে-থেমে বললেন জেঠু, “সেগুলো না থাকলে তাকে বলি জড়, বা মৃত। এই কাজগুলোর মধ্যে আছে বড়ো হওয়ার ক্ষমতা, বংশবিস্তার, বিভিন্ন কাজ করতে পারার ক্ষমতা, আর মৃত্যুর আগে অবধি এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থার মধ্য দিয়ে যাওয়া। কিন্তু, শুধু এগুলো দিয়েই কি জীবনের মানে বোঝা যায়?”
আমরা কেউ মুখ খুললাম না। একটা বড়ো শ্বাস নিয়ে জেঠু বলে চললেন।
“সমুদ্রকে রত্নাকর বলা হয়— এ-কথা সবাই জানি। কিন্তু কেন বলা হয়? ডিপ-সি এক্সপ্লোরেশন থেকে এই প্রশ্নের উত্তরটা সবাই বুঝেছে। পেট্রোলিয়াম নয়, সমুদ্রের গভীরে লুকিয়ে থাকা যে-সম্পদটি সবার নজর কেড়েছে তা হল পলিমেটালিক নোডিউলস বা পি.এম.এন। এই পি.এম.এন হল সোনা, রুপো, জিংক, আর বিভিন্ন রেয়ার আর্থ মেটালের আকর। ভারত পৃথিবীর প্রথম দেশ, যাকে রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টারন্যাশনাল সি-বেড অথরিটি এই পি.এম.এন মাইনিং-এর জন্য পায়োনিয়ার ইনভেস্টরের সম্মান দিয়েছিল। ডিফেন্স রিসার্চের কয়েকটা ব্যাপারে পি.এম.এন খুব বড়ো ভূমিকা নেয়। দেশের নিরাপত্তার খাতিরেই, কাজটা ঠিকঠাক হওয়া নিশ্চিত করতে চাইছিল সেনাবাহিনী। তাই, ভারত মহাসাগরের একটা অংশে পি.এম.এন-এর সন্ধানে ম্যাপিং, মাইনিং এবং সিসমিক স্টাডি চালিয়েছিলাম আমরা।
এখন জিওলজিক্যাল সার্ভের হাতে ‘সমুদ্র রত্নাকর’ নামের একটা ভেসেল এসেছে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কেনা ওই বস্তুটি দিয়ে প্রায় ৬০০০ মিটার গভীরতা অবধি পি.এম.এন খোঁজা যায়। কিন্তু তখন আমাদের কাছে ছিল স্রেফ ন্যাশনাল ইন্সটিট্যুট অফ ওশন টেকনোলজি-র একটা পুরোনো জাহাজ ‘সাগর নিধি’। সমুদ্রের নীচে কী আছে— তার কিছুই বোঝা যেত না ওটির সাহায্যে। ফলে বিরাট এলাকায় পি.এম.এন খোঁজার পুরো অধিকার নিয়েও আমরা কিছুই করতে পারছিলাম না।
এই সময়ে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল। সমুদ্র-গবেষণা মন্ত্রক প্রধানমন্ত্রীর অধীন। আমাদের ব্যর্থতার খবর নিশ্চই ওপরমহলে পৌঁছেছিল। তার পরেই আমরা, কয়েকজন ‘বন্ধু’-র মাধ্যমে একটা জিনিস পাই, যেটা ডেপথ্-এক্স নামে বাজারে পরিচিত।”
মনোজদা জিওলজির ছাত্র। দারুণ চমকে, একেবারে সোজা হয়ে বসে সে বলল, “ডেপথ্-এক্স? মানে ডিপ ফ্রিয়াটিক থার্মাল এক্সপ্লোরার? সে জিনিস আমাদের দেশে ব্যবহার করা হয়েছে? কীভাবে?”
আমাদের সবার সপ্রশ্ন চাউনির উত্তরে মনোজদা ঢোঁক গিলে বলল, “ওটা নাসা-র জন্য বানানো হয়েছিল!”
জেঠু অল্প হাসলেন। তারপর মনোজদা’র প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর না দিয়ে বলে চললেন, “ডেপথ্-এক্স আসলে একটা অটোনমাস আন্ডারওয়াটার ভেহিকল, বা এ.ইউ.ভি। জিনিসটা অনেকটা ডিমের মতো চেহারার। লম্বাটে দিকটার দৈর্ঘ্য চোদ্দো ফুট, ছোটো দিকটা দশ ফুট, আর ওজন প্রায় দেড় টন। জলের নীচে হাজার মিটার গভীরতায় স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারত ওটা।
ডেপথ্-এক্সের আসল হাতিয়ার ছিল সোনার অ্যারে। সারিবদ্ধভাবে লাগানো একঝাঁক হাইড্রোফোনের সাহায্যে শব্দতরঙ্গ ছুড়ে দিত সে। তারপর ফিরে আসা প্রতিধ্বনির সাহায্যে আর ক্যামেরা দিয়ে আশপাশের ছবি তুলে ত্রিমাত্রিক ম্যাপ বানাত সে। তারই সঙ্গে পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করার জন্য নমুনাও সে সংগ্রহ করতে পারত।
জিনিসটার নানা বৈশিষ্ট্যের এর চেয়ে বেশি বর্ণনা দেব না। আমরা যে-সব জিনিস ততদিন অবধি দেখেছি তার তুলনায় ওটার প্রযুক্তি অনেক-অনেক এগিয়ে ছিল। সত্যিই মনে হত, আমরা সমুদ্রের নীচে কাদাগোলা জলে নুড়ি খুঁজছি না। বরং একটা সায়েন্স ফিকশন সিনেমায় অন্য কোনো গ্রহে অনুসন্ধান চালাচ্ছি।”
“আচ্ছা জেঠু,” এবার রঞ্জন প্রশ্ন করল, “ওখানে জলের নীচে তিমি বা হাঙর দেখেছেন আপনি?”
“তিমি দেখিনি।” অল্প হেসে বললেন জেঠু, “হাঙর দেখেছি। অবশ্য হাঙর বলতে যে ছবিটা আমাদের চোখে ভাসে, সেই গ্রেট হোয়াইট থাকার পক্ষে ওখানের জলটা বেশি গরম। তাদের না দেখলেও মাকো শার্ক দেখেছি। এছাড়া দেখেছি জেলি ফিশ, স্টিং-রে, ব্যারাকুডা, প্রবাল, নানারকম অ্যানেমোনি। তবে ডেপথ্-এক্স কাজ শুরু করার ক’দিনের মধ্যেই ক্যামেরায় এমন একটা জিনিস ধরা পড়ল, যেটা এর আগে শুধু আমি নয়, জাহাজে থাকা মেরিন জিওলজিস্ট বা অন্য বিশেষজ্ঞরাও দেখেননি।”
“সেটা কী?” আমি আর রিনি একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম।
“ডেপথ্-এক্স যে গভীরতায় অনুসন্ধান তথা পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছিল, সেটাকে মেসোপেলাজিক জোন বলা হয়।” বললেন জেঠু, “দুশো মিটার থেকে শুরু করে হাজার মিটার গভীরতা অবধি ছড়িয়ে থাকা সমুদ্রের এই স্তরে সূর্যের আলো পৌঁছোয়— তবে খুবই ক্ষীণ হয়ে। বায়োলুমিনেসেন্ট, মানে নিজের দেহকোষেই আলো তৈরি করতে পারে এমন অনেক প্রাণীকে এই স্তরে দেখা যায়। জলের নীচে কিন্তু বেনীআসহকলা নয়, স্রেফ নীল-সবুজ আলোই চলে। গভীর জলের মধ্য দিয়ে ওই রঙের আলোই সবচেয়ে দূরে যেতে পারে। ফলে, ওই গভীরতার অধিকাংশ প্রাণীর লাল-হলুদ, বা বেগুনি রং দেখার ক্ষমতাই নেই। কিছু ব্যতিক্রমী প্রাণীও আছে, যেমন ধর… লুজ-জ।”
শেষ কথাটা শুনে আমরা সবাই চমকালাম, কারণ এমন নামের কোনো মাছ বা প্রাণীর কথা আমরা শুনিনি।
“মাছেদের ব্যাপারে আমার জ্ঞান যে খুবই কম এটা বাজার থেকে ফেরার পর তোমাদের জেঠিমা প্রায়ই বলে থাকেন।” মুচকি হেসে বললেন জেঠু, “তবে সেই সময় আমি জলের নীচে যেসব প্রাণী আলো তৈরি করতে পারে, তাদের সম্বন্ধে কিছুটা জেনেছিলাম। অন্য প্রাণীদের সতর্ক করার জন্য নীল-সবুজ আলো তৈরি করতে পারে লুজ-জ নামের মাছেরা। তারই সঙ্গে ওরা এমন একটা লাল আলো তৈরি করে যার তরঙ্গ প্রায় ইনফ্রারেডের মতো লম্বা। এটা দিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করে। কাছে থাকা শিকারকে দেখে নিতে পারে। বেচারি শিকার যেহেতু সেই আলোটা দেখতেই পায় না, তাই সে সতর্ক হওয়ার সুযোগও পায় না।
ডেপথ্-এক্স আলো ব্যবহার করেনি। তবে তার গরম হয়ে ওঠা সারফেস যে সমুদ্রের তলায় ওই প্রজাতির মাছেদের চোখে লাল বা ইনফ্রারেড হয়ে ধরা পড়ছে— সেটা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু একদিন, সমুদ্রের অনেক গভীরে, প্রায় ব্যাথিপেলাজিক বা মিডনাইট জোন থেকে আসা লাল আর ইনফ্রারেড আলোর একটা সংকেত ধরা পড়ল ডেপথ্-এক্স-এর চোখে। তখন আমাদের বিজ্ঞানীরা যে কতটা অবাক হলেন, তা বলে বোঝাতে পারব না।”
“কেন?” এবার দাদু জিজ্ঞেস করলেন, “এই তো তুমি বললে মাছেরা নাকি তোমাদের এ.ইউ.ভি-কে চিনতে পারছিল। তাহলে তাদের মধ্যেই কেউ হয়তো সেটাকে নিজের ভাই-বেরাদর ভেবেছিল। এতে অবাক হওয়ার কী আছে?”
“ঠিক বলেছেন।” জেঠু মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেন, “যদি যন্ত্রটা মাছেদের মতো করেই সংকেত তৈরি করত, তাহলে সেটাই ভেবে নিত সবাই। কিন্তু তা তো হয়নি। বরং ডেপথ্-এক্স-এর তাপ আর আলো-কে ইনফ্রারেডে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাচ্ছিল যে সেটা একটা যন্ত্র— যা রুটিনমাফিক কিছু কাজ করে চলেছে। মাছেরা ওটাকে এড়িয়েই চলছিল। তারপরেও ওইরকম একটা সংকেত পেলে যা হওয়ার তাই হল। আমরা বড়োকর্তাদের কাছে রিপোর্ট পাঠালাম।”
“সরকারের গাড়িটা নীচে রয়েছে দেখছি।” অন্যমনস্কভাবে হাতে ঘড়িটা গলাতে-গলাতে ঘরে ঢুকলেন রণজেঠু, “ও কি তাহলে বেরোয়নি?”
ঘর কাঁপিয়ে আমরা বললাম, “জেঠু এখন কোথাও যাবে না!” রণজেঠু প্রথমে রীতিমতো চমকে উঠলেন। তারপর মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলেন। জেঠুও একটা বড়ো নিশ্বাস নিয়ে আবার কথা শুরু করলেন।
“যে সংকেতটা ডেপথ্-এক্স-এ এসে পৌঁছেছিল— সেটার অর্থ উদ্ধার করার মতো কম্পিউটার আমাদের কাছে ছিল না। তবে সেটা যে প্রাকৃতিক কোনো ঘটনা নয়, বরং একটা নিয়মবদ্ধ কোড, তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। আরও একটা জিনিস বুঝে আমরা চিন্তিত হয়ে উঠেছিলাম।
সংকেতটা ক্ষীণ হয়ে আসছিল।
আমাদের আশঙ্কা ছিল, বড়োকর্তাদের নিয়ে একটা ইউনিট এসে পৌঁছনোর আগেই না সংকেতটা থেমে যায়। দিনদুয়েকের মধ্যেই একটা চপার এসে পৌঁছল ‘সাগর নিধি’-তে। তাতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা আমাদের হাতে থাকা যাবতীয় ফিড দেখে দুটো সিদ্ধান্ত নিলেন।
এক, সংকেতটা যেই পাঠিয়ে থাকুক না কেন, সে ডেপথ্-এক্স-কে একটি প্রাণী ভেবেছে। কারণ যন্ত্রটা চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, সাকার বাড়িয়ে আশপাশের জল থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করছে এবং লাল আলো ও ইনফ্রারেডের মাধ্যমে নিজের উপস্থিতি অন্যদের কাছে বুঝিয়ে চলেছে।
দুই, ডেপথ্-এক্স-এর মতো বড়ো আকারের কোনো ‘প্রাণী’-র কাছে সংকেত যে পাঠাতে পারে, সে নিজেও যথেষ্ট বড়ো হবে। অথচ আমাদের তথ্য অনুযায়ী সমুদ্রের ওই অঞ্চলে অতটা গভীরতায় থাকতে পারে এমন কোনো প্রাণীই নেই।
পর্যবেক্ষণ ছাড়া এক্ষেত্রে আমাদের কাছে কোনো রাস্তা নেই। তাই ঠিক হল, ডেপথ্-এক্সকে নামানো হবে— যতটা নীচে সে যেতে পারে, ততটাই নীচে।
ডেপথ্-এক্স নামতে শুরু করার সঙ্গে-সঙ্গে সংকেতটা আবার ধরা পড়ল। কিন্তু তার তীব্রতা আগের চেয়েও কম ছিল। সংকেতের যে অংশগুলো আমাদের কাছে সাইকল বলে মনে হয়েছিল, তেমন দুটো সাইকলের মধ্যে ফাঁকও আগের চেয়ে বেশি বলে বোঝা যাচ্ছিল। বেশ বুঝতে পারছিলাম, নীচে যে আছে তার শক্তি ফুরিয়ে আসছে।
জলের ওই গভীরতায় লাল আর কালো ছাড়া কোনো রঙের অস্তিত্ব নেই। তাই ঠিক করা হয়েছিল, ডেপথ্-এক্স-এর আলো জ্বালিয়ে অন্য প্রাণীদের উত্তেজিত করা ঠিক হবে না। সেদিন জলে প্রাণীদের উপস্থিতিও ডেপথ্-এক্স-এর ক্যামেরায় খুবই কম ধরা পড়ছিল।
তবু আমাদের টেনশন হচ্ছিল। এমনিতে ওই অঞ্চলটা স্পার্ম হোয়েলের মতো বিশাল প্রাণীদের স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্র থেকে বহু দূরের। কিন্তু দামি ও ‘ধার’-করা মেশিনটাকে খুব বেশি গভীরতায় নামিয়ে তেমন কোনো বড়ো প্রিডেটরের মুখে ঠেলে দিতে কেউই রাজি ছিল না। ঠিক করা হয়েছিল, সোনার অ্যারে-তে আশপাশের ত্রিমাত্রিক ম্যাপে তেমন বড়ো কিছু ধরা পড়লেই আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। গভীরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকা জলের চাপের ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হচ্ছিল। ব্যাথিপেলাজিক জোনে জলের চাপ প্রায় অকল্পনীয়। সব মিলিয়ে, প্যানেলের সামনে বসে আমাদের মতো সৈন্য, পোড়-খাওয়া বিজ্ঞানী, ঝানু আমলা— সবাই নিজের মতো করে উদ্বেগ আর টেনশনে ফুটছিলাম।
ডেপথ্-এক্স নেমে চলছিল সংকেতবাহী আলোর উৎসের দিকে।
মোটামুটি দেড় হাজার মিটার গভীরতায় পৌঁছেছে তখন ডেপথ্-এক্স। সবক’টা ডায়াল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল, বাড়তে-বাড়তে জলের চাপ কোথায় গেছে! আমরা সব জেনেও সেগুলো উপেক্ষা করছিলাম। তখনই বোঝা গেল, সংকেতের উৎসের খুব কাছে চলে এসেছি আমরা। সোনার অ্যারে-তে দেখছিলাম, ডেপথ্-এক্স যেখানে ভেসে রয়েছে, তার আশেপাশেই রয়েছে এক বা একাধিক সি-মাউন্ট— অর্থাৎ ডুবো পাহাড়। ভারত মহাসাগরের ওই এলাকায় বহুযুগ আগে হওয়া অগ্নুৎপাত এবং আরো নানা কারণে গভীর রিজ বা খাতের মতো এই পাহাড়গুলোও তৈরি হয়েছিল। ঝুঁকি না নিয়ে এবার আলো জ্বালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।
আর তখনই আমরা ওটাকে দেখলাম।”
“ওটা?!” ঘরের মধ্যে আমরা সবাই যে প্রায় শ্বাস বন্ধ করে এতক্ষণ কথাগুলো শুনছিলাম, সেটা আমাদের মুখ থেকে সমস্বরে ছিটকে বেরনো প্রশ্নটা শুনে বোঝা গেল।
ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লেন জেঠু, তারপর আবার বলে চললেন।
“ডেপথ্-এক্স-এর আলোয় তখন দেখা যাচ্ছিল, চারপাশে গাছের মতো করে ছড়িয়ে রয়েছে একটা ডুবো পাহাড়ের শাখা-প্রশাখা। সেই শাখাগুলোর মধ্যে একটার ভাঙা পাথরের ফাঁকে আটকে ছিল জিনিসটা। সেটাকে দেখলে প্রথমে একটা প্রকাণ্ড গুবরে পোকা বলেই মনে হয়। কিন্তু একটু পরেই বুঝেছিলাম, আসলে ওটাও দেখতে ডেপথ্-এক্সের মতোই। শুধু গায়ের রংটা উজ্জ্বল লাল বা কমলার বদলে কালচে সবুজ। আর জিনিসটা আকারে আরো বড়ো।
ওটার সামনের অংশেও ছিল ডেপথ্-এক্সের মতোই দুটো চোখ, যা দিয়ে দেখা যায়। তার আশপাশে অসংখ্য গোলাকার ছিদ্র দেখে মনে হল, ওখানেও নিশ্চয় ডেপথ্-এক্স-এর মতো করেই লাগানো আছে বা ছিল অজস্র ল্যাম্প— যাদের তীব্র আলোয় রাতকে দিন করে তোলা যায়। তবে সেই মুহূর্তে ওগুলো স্রেফ গর্ত বলেই মনে হচ্ছিল।
স্তম্ভিত বিস্ময়ে আমরা জিনিসটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ক্রমাগত ফটো তুলে চলছিল ক্যামেরার ঝাঁক। শুধু আমি নয়, সম্ভবত ঘরের সব্বাই একটাই কথা ভাবছিল। এই পাহাড়গুলো তৈরি হয়েছে বহু লক্ষ বছর আগে। তখন জলের নীচে এমন কোনো জিনিস নামানোর ক্ষমতা মানুষের ছিল না। তাহলে, ওই ডুবো-পাহাড়ের মধ্যে আটকে পড়া এই জিনিসটা কোত্থেকে এসেছে? অন্য কোনো গ্রহ থেকে? নাকি অন্য কোনো সময় থেকে?
আমাদের দলনেতা একটা নির্দেশ দিতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তখনই ঘটনাটা ঘটল। আশঙ্কা ছিল, কিন্তু তার জন্য আমাদের কোনো মানসিক প্রস্তুতি ছিল না।
সি-কোয়েক! সমুদ্রের তলায় ভূমিকম্প যে কতটা ভয়ংকর হয়— তা না-দেখলে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। সেই জিনিসই হল তখন। গোটা সমুদ্রতল কেঁপে উঠল সেই কাঁপুনিতে। তখনই, লক্ষ বছর ধরে টিকে-থাকা পাহাড়ের সেই জট— যার ভাঁজে আটকা পড়েছিল জিনিসটা, ভেঙে নেমে যেতে লাগল জলের আরো গভীরে!
মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরাও। ডেপথ্-এক্স আর নামল না। সে উঠতে শুরু করল ওপর দিকে— আশপাশের ভেঙে পড়া বা দুলে ওঠা সব কিছুর থেকে দূরে, নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য।
জিনিসটার আলোর সংকেত আমরা আগেই হারিয়েছিলাম। সোনার অ্যারে থেকেও জিনিসটা কিছুক্ষণের মধ্যেই মুছে গেল।”
জেঠু, আর আমরাও, কতক্ষণ চুপ করে ছিলাম, খেয়াল নেই। চটকা ভাঙল, যখন অপু রুদ্ধকণ্ঠে প্রশ্নটা করল, “ওটা কী ছিল জেঠু?”
“জানি না।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জেঠু, “জানা সম্ভবও নয়। ফটোগুলো অচিরেই হারিয়ে গেছিল সেনাবাহিনীর অজস্র ‘একান্ত গোপনীয়’ ট্যাগ-লাগানো ফাইলের কোনো একটার গভীরে। হয়তো কেউ সেগুলোর বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু কী পেয়েছেন তিনি— তা আর জানতে পারিনি আমরা।
তবে আমার একটা থিয়োরি আছে। মনে হয়, বহু-বহু যুগ আগে আমাদের এই জলে ভরা নীল গ্রহে এসেছিল কেউ। সে পর্যটক ছিল, না শিকারী, না বিজ্ঞানী, না কি আমাদেরই মতো কোনো সৈন্য— তা বলতে পারব না। জলের নীচে একটা দুর্ঘটনার ফলে সে আটকে পড়েছিল সেখানেই। যুগ-যুগান্ত পেরিয়ে গেল তারপর। হয়তো সে আর রইল না। শুধু তার কম্পিউটার আর নিভু-নিভু কিছু যন্ত্র টিকে রইল।
তারপর, কোনো একদিন, সেই কম্পিউটার আর অন্য যন্ত্ররা সন্ধান পেল এক বিচিত্র ‘প্রাণী’-র। সে ওই যানের মতোই দেখতে, তারই মতো করে চলে, তারই মতো করে ‘কথা বলে’! সে ডাক পাঠিয়েছিল ডেপথ্-এক্স-এর উদ্দেশে। আর ডেপথ্-এক্স, বা আমরা, তাতে সাড়াও দিয়েছিলাম। কিন্তু সমুদ্র তার রহস্যকে কাছছাড়া করতে চায়নি। তাই…!”
কথাটা শেষ না করেই উঠে দাঁড়ালেন জেঠু।
“কিন্তু জেঠু,” আকুল হয়ে প্রশ্ন করল মনোজদা, “আপনারা আর ওখানে যাননি কখনও?”
মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন জেঠু। তারপর বললেন, “কোনো সূত্র থেকে আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের খবর নিশ্চই আমাদের ‘বন্ধু’মহলে পৌঁছেছিল। তাই ডেপথ্-এক্স নিজের ঘরে ফেরত চলে গেছিল। তাকে ছাড়া ওখানে গেলেও সমুদ্রের ওই গভীরতায় আমরা একেবারে অন্ধ হয়ে থাকতাম। তাই আর যাওয়ার প্রশ্ন ওঠেনি।
তবে এটুকু বুঝেছিলাম যে জীবন মানে একা বাঁচা নয়, বরং এমন কারো সন্ধান করা যে আমার কথা বুঝবে; যে আমাকে বুঝবে। জীবন মানে এমন কারও অপেক্ষায় থাকা, যার টানে অন্ধকার আর ঠান্ডার দুর্জয় বাধা কাটিয়েও ডাক পাঠানো যাবে শুধু এই আশায়, যে সে আসবে।
একদিন ইউরোপার সমুদ্রে ডেপথ্-এক্স-এর কোনো উত্তরাধিকারী ডাক পাঠাবে। হয়তো তখন সেই অন্ধকার আর ঠান্ডার মধ্য থেকেও কেউ সাড়া দেবে। হয়তো সেদিন নতুন করে খুঁজে পাওয়া যাবে জীবনের মানে।”
লম্বা শরীরটা দাদু’র দিকে ঈষৎ ঝুঁকিয়ে বেরিয়ে গেলেন জেঠু।
-*-
কৃতজ্ঞতা স্বীকার~ দ্য ফগ হর্ন, ‘গোল্ডেন অ্যাপলস্ অফ দ্য সান’, ১৯৫১
[প্রথম প্রকাশ: ইষ্টিকুটুম পূজাবার্ষিকী, ২০১৭; গ্রন্থাকারে প্রকাশ: ‘দশ’, অরণ্যমন প্রকাশনী]
Tags: ঋজু গাঙ্গুলী, গল্প, সপ্তম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা